মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-১৭

0
41

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১৭.
“তোমাকে নিয়ে শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।মাকেও বলা হয়ে গেছে।”

আমার পায়ে আলতা পরিয়ে দেওয়া শেষে কথাটা বললেন ধ্রুব।নিজের পায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওনার দিকে তাকালাম আমি।ওনার অপলক দৃষ্টি আমাকেই অবলোকন করতে ব্যস্ত।আমি মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেসা করলাম,

“হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?”

ধ্রুব সরল কন্ঠে বলে উঠলেন,

“ভর্তি পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই।”
ওনার কথা শুনে পলক ফেলে মেঝেতে তাকালাম আমি।ফের দৃষ্টি উঠিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,

“কবে যাচ্ছি আমরা শহরে?”

“পরশু।কালকে একটা কাজ আছে।সেটা সম্পন্ন করেই যাবো।”

আমি কি কাজ বলে জিজ্ঞাসা করলেও সেটা বলতে নাকোচ করলেন উনি।বললেন যখন করবো দেখতে পাবে।আমি ভ্রু কুঁচকে রইলাম।কিন্তু আর জিজ্ঞেস করলাম না কি কাজ।অপেক্ষায় রইলাম তা সচক্ষে দেখার।
.
পরদিন ধ্রুব এক আশ্চর্য কাজ করলেন।শশীকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ দিয়ে এলেন।সপরিবারে!

আমি শুধু ভ্রু কুঁচকে লোকটার কর্মকাণ্ড দেখছিলাম।বিশাল ভোজ আয়োজন হলো সেদিন।রান্নাঘর থেকে সুস্বাদু সব রান্নার ঘ্রাণে ভরে উঠলো বসার ঘর।আমি বাদে সকলের চেহারায় আজ খুশির ঝলক দেখতে পাচ্ছিলাম।কিন্তু হঠাৎ এভাবে শশীকে আমন্ত্রণের হেতু বোধগম্য হলো না আমার।আমি এ ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে উপস্থিত হলাম রাইয়ের কক্ষে।কালকে থেকে এই কক্ষ থেকে বের হয়নি রাই ।পরিচারিকাদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল যেন খাবার এবং যা কিছু প্রয়োজন তা রাইয়ের কক্ষে পৌঁছে দেওয়া হয়।আমি দরজায় ঠক ঠক করে আওয়াজ করতেই ক্ষনকাল পরে রাইয়ের রুগ্ন গলার স্বর ভেসে আসলো,

“এসো।”

ভেতরে প্রবেশ করতে করতে আমি প্রশ্ন করলাম,

“তুমি কি করে জেনে যাও যে এটা আমি?”

শুকনো মুখে মলিন হেসে জবাব দিলো রাই,

“তুমি ব্যতিত আর কার দরকার এ ঘরে?”

বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে থাকা রাইয়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালাম আমি।পরনের হালকা বেগুনি রঙের শাড়িটা কিছুটা মলিন ঠেকছে।কপালে আজ রক্তলাল টিপ নেই।হাতদুটোও শুভ্র।চোখের কোনে কাজলের অস্তিত্বের খোঁজ করলে বিষন্নতার দেখা মিলবে।আমাকে ফের তার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো রাই।হাসি থামিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আমায় তুমি এতটা গাঢ় দৃষ্টিতে কেন দেখ বোধগম্য হয় না আমার।”

আমি কবিদের ভাষার মতোন করে বলে উঠি,

“তুমি সুন্দর তাই চাইয়া থাকি।একি মোর দোষ?”

রাই মুচকি হেসে বললো,

“তোমার কন্ঠে গ্রাম্য ভাষাও বেশ সুন্দর শোনায়।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলাম,

“তুমি কি জানো তুমি কতটা সুন্দর?ভেবো না এটা তোমার বাহ্যিক সৌন্দর্যের তারিফ।বরং তুমি মন থেকে সুন্দর।”

মেয়েটার ঠোঁটে আবার হাসি ফুটে উঠলো।এত সুন্দর দেখায় মেয়েটাকে হাসলে!আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রই। ফের কিছু একটা মনে পরতেই আমার মন বিষন্ন হয়।

“আজকে উনি শশীকে এ বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছেন।জানো?”

আমি রাইয়ের চেহারায় তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না।তবে আমার প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব খুঁজে পেলাম আমি।রাই জানে।আমার আগেও কেউ ওকে ও ব্যাপারে জানিয়েছে।কিন্তু কে?
রাইের চোখেমুখে রহস্য ফুটে উঠলো হঠাৎ।লুকায়িত এক রহস্য!হঠাৎ রাইয়ের মুখের অভিব্যাক্তি পাল্টে যায়।মৃগনয়নে এসে ধরা দেয় একরাশ তাচ্ছিল্যতা।মুহুর্তেই তা পাল্টে রুপ নেয় অসহায়ত্বে।এই দৃশ্য আমার পক্ষে অবলোকন করা কঠিন হয়ে পরে।আমি দৃষ্টি সরিয়ে তাকায় অন্যদিকে।আপনা আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নির্গত হয় ভেতর থেকে।

.

দিবসের দ্বিপ্রহরের প্রারম্ভ শুরু হতেই শশী ও তার মা এসে উপস্থিত হন এ বাড়িতে।শশীর পিতা মাস্টার মশাইয়ের আসা হয়নি।তিনি বিদ্যালয়ে অধ্যয়নে ব্যস্ত।শশী আসতেই আমি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ধ্রুবর সন্ধান করলাম।লোকটা নেই আশেপাশে কোথাও।লোকটার এই কাজে অবশ্য আমি প্রসন্ন ছিলাম না।একে তো উনি কালকে বলেন নি কি কাজ বাকি আছে ওনার।তারপর আজকে আবার শশীকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণের মানে আমার বোধগম্য হচ্ছে না।আমার চিন্তার মাঝেই বসার ঘরে উপস্থিত হন ধ্রুব।আমি একপলক সেদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেই।উনি আসার পরপরই ভোজের আয়োজন শুরু হয়।দুপুরের আহারের পর্ব সমাপ্ত হতেই ধ্রুব সকলের সামনে একটা ঘোঘণা দেন।উনি খুব জরুরি ব্যাপারে আলোচনা করবেন এখন।সকলকে ওনার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার অনুরোধ জানিয়ে উনি বলতে লাগলেন,

“আমি দুটো ঘটনা নিয়ে কথা বলব।একটা বহুআগে ঘটে যাওয়া ঘটনা আর…”

কথাটা বলে উনি আমার দিকে তাকান।আমি তখন সকলের পিছনে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে।ধ্রুব আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলে উঠেন,

“কালকের আগের দিন ঘটে যাওয়া ঘটনা।আপনারা কেউ আন্দাজ করতে পারছেন আমি কোন ব্যাপারে কথা বলতে চলেছি?”

প্রশ্নটা ধ্রুব সকলের দিকে তাকান।বসার ঘরে তখন বাড়ির সকলে উপস্থিত। পরপর সাজানো কাঠের তিনটি চেয়ারে বসে আছেন বাড়ির তিন পুরুষ।ধ্রুব,শুভ আর কাকামশাই।

“কিন্তু এই ঘটনাগুলো আলোচনা করার আগে এখানে একজনের উপস্থিত হওয়াটা প্রয়োজন।”

ধ্রুবের কথা মাথামুন্ডু বোধহয় তখনও কারোর বোধগম্য হচ্ছিল না।যতক্ষণ না বসার ঘরে সেদিনের সেই অচেনা,পালোয়ান দেখতে লোকটা এসে উপস্থিত হয়।তাকে দুজন লোক ধরে নিয়ে এসেছে।লোকটা আমার চোখের সামনে আসতেই আমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালাম।

“এই লোকটাকে এখানে কেন আনা হয়েছে ধ্রুব?

সুবোধ দেবনাথ প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্নটা করেন।যে লোক বাড়ির সম্মানে হাত দিয়েছিল তাকে এভাবে বাড়িতে কেউ আশাই করেনি।কিন্তু শশী হঠাৎ আতংকিত হয়ে পরলো।বারবার চোখের ইশারায় তাকালো শুভর দিকে।তাকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে এমন কিছু একদমই আশা করেনি সে।

“কেন আনা হয়েছে সেটা এখনি বলছি কাকাবাবু।”

কথাটা বলে ধ্রুব অচেনা সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“এখানে উপস্থিত আমরা কেউই লোকটাকে চিনি না তাইতো?”

“এরুম চরিত্রহীন লোকরে কেবল চরিত্রহীনারাই চিইনা থাকে।”

ভীড়ের মাঝে থেকে মেজো কাকিমার কথাটা কানে বাজলো সবার।আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম অসাড় হয়ে এলো আমার দেহ মন।ধ্রুবর কি প্রতিক্রিয়া হলো জানা নেই।তবে একটি প্রতিবাদী নারী কন্ঠ বলে উঠলো,

“চরিত্রদের সাথে একমাত্র চরিত্রহীনদেরই সম্পর্ক থাকে।এ কথা আপনি ঠিকই বলেছেন মামি মা।তবে একটা বিষয় আপনার ভুল হয়ে গেল।উদ্দেশ্য অন্যকেউ হলে আপনার কথার বিপরীতে করতালি দিয়ে উঠতাম আমি।”

গলার স্বর সকলের চেনা।শব্দের উৎসের খোঁজে সকলে সিঁড়ির দিকে তাকালো।মেরুন রঙের শাড়ি পরিহিতা রাই এগিয়ে আসছে।দুহাত আলতায় রাঙা এবার,মুখে সদার ন্যায় একচিলতে হাসি।পায়ের নুপুর তার হাঁটার তালে ছদ্ম তুলছে।রাই সকলের মাঝে এসে দাড়িয়ে খেয়াল করলো সকলের অদ্ভুত দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।স্মিত হেসে সে জানায়,

“আমাকে রোজই দেখেন এত অবাক হওয়ার কিছু নেই।কিন্তু আজ ব্যতিক্রম কিছু হবে,সেটার জন্য নিজেদের অবাক দৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখুন।”

রাইয়ের কথার সুরে উপস্থিত তিনজন কেঁপে উঠলাম।আমি,শশী আর শুভ।একবার ধ্রুব তো একবার শশীর দিকে তাকিয়ে থেকে আমি বুঝতে পারলাম দুই ভাইবোন মিলে কিছু একটা পরিকল্পনা করেছে।কি সেটা?

“কিন্তু এই অচেনা লোকটাকে এখানে আনার কারণ জানা হলো না ধ্রুব।”

শাশুড়ী মার সহজ প্রশ্ন।ধ্রুব মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

“সেদিন আপনার বউমার ঘরে এই অচেনা যুবকের উপস্থিতি একটা পরিকল্পনার অংশ ছিল।জঘন্য, নিখুঁত পরিকল্পনা!কিন্তু পরিকল্পনা কারীদের বুদ্ধি কিছুটা কম।”

ধ্রুবর কথাটা শুনে একপ্রকার অবাক হয়ে তাকালো সকলে।চেয়ারে বসে থাকা শুভ কাচুমাচু করে উঠলো।শশীর দৃষ্টিতে তখন তার প্রতি আগুন ঝরছিলো।এত বড় ভুল কি করে করতে পারে সে?লোকটাকে ঠিক ধ্রুব ধরে সব তথ্য বের করেছে।

“তোমাকে সেদিন কে আমার কক্ষে লুকিয়ে থাকতে বলেছিল?”

দোষী লোকটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে উঠে ধ্রুব।শক্ত,গম্ভীর শোনায় তার গলার স্বর।আমার তখন বুক দুরুদুরু করছে।ধ্রুব এসব কি করছেন?
শুভ এবার উঠে দাড়ায় চেয়ার থেকে।সকলের নজর চলে আসে তার পানে।বলে,

“এসব কি হচ্ছে দাদা?একে তো বৌদির সাথে নো*রা কাজ করতে চাওয়া লোকটাকে তুই বাড়িতে এনেছিস।তার উপর এসব কি জিজ্ঞেসাবাদ?”

শুভর কথা শুনে ধ্রুব তাকে আঙুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলেন।কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যের মনে তখন কৌতুহলের পাথার।এসব কি বলছে ধ্রুব?পরিকল্পনা!
ধ্রুবর মা তীক্ষ্ণ চোখে শুভকে পরখ করলেন।তারপর লোকটার উদ্দেশ্যে আদেশের স্বরে বলে উঠলেন,

“তোমাকে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে।উত্তর দাও।”

লোকটা সময় নিয়ে অকপটে জবাব দেয়,

“সেদিন ধ্রুব বাবুর কক্ষে আমাকে লুকিয়ে থাকতে বলার জন্য আমার ডেরায় দুজন এসেছিল।একজন মেয়ে আরেকজন পুরুষ।”

কথাটা বলে লোকটা শুভর দিকে আঙুল তাক করে।সকলে বড় বড় চোখ করে তাকায়।শুভর চোখেমুখে তখন অন্ধকার!যেন এমন পরিস্থিতিতে পরবে এটা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি।ভাবেনি ভেবেই বোধহয় এমনটা হলো।

লোকটা দ্বিতীয়বার আঙুল তাক করলো শশীর দিকে।শশী তখন মাথা নত করে চোখ বুঁজে আছে।ধ্রুব সবটা জেনে গেছে এটা তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না।কিংবা বুকের ভেতর আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো!

জমিদার বাড়ির সকলে যখন বিস্ময় নিয়ে একে অপরের পানে তাকাচ্ছে তখন শশীর মা তারা দেবী আক্রোশ নিয়ে বলে উঠে,

“এসব কি কইতাছো ধ্রুব?আমার মাইয়ার নামে এতব্র অপবাদ!এই অপবাদ দিবা বইলাই কি ডাইক্কা আইনা ভোজ খাওয়াইলা?”

ধ্রুব ওনার শান্ত দৃষ্টি মেলে ওনার পানে তাকায়।বলে,

“যা সত্য তার নাম অপবাদ হতে পারে না।আপনার মেয়ে এই জঘন্য পরিকল্পনার রচয়িতা ছিল।আর তার সাধ দিয়েছিল আমার কাকাতো ভাই শুভ।”

শশী তখনো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে।মেজো কাকি এবার প্রশ্ন ছুড়ে ওনার পানে।

“এই লোকটা এইডা বললো আর আমরা বিশ্বাস করমু?ধ্রুব তোমার কি ক্ষতি করছে আমার ছেলে?যার জন্য এমন অপবাদ দিতাছো?আমরা তো ভাবতাম ধ্রুব মিথ্যা অবধি কয় না।এখন তো দেখি সরাসরি মিথ্যা অপবাদ দিতাছে!”

“আমি কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছি না কাকি মনি।আর না কাউকে হেনস্তা করছি।আমার উদ্দেশ্য যাদের হেনস্তা করা হয়েছে তাদের ন্যায়বিচার দেওয়া।এই বেচারি রাইদি,ওর নামে পুরো মিথ্যে একটা রটনা রটে আছে গ্রাম জুড়ে!আপনারা সেটার সত্য মিথ্যে যাচাই না করেই ওকে অল্প বয়সে জোর করে বিয়ে দিয়েছেন।কোনদিন জানারও চেষ্টা করেননি আসলে বেচারি সত্য বলছে, না মিথ্যা।বিয়ে হলো,বিধবা হলো!এখনো অবধি সেই কলংক সাথে নিয়ে ঘুরছে ও।”

কথা বলতে বলতে ধ্রুবর গলার স্বর ক্রমশ কঠোর হতে লাগলো।স্তব্ধ ঘরে প্রতিফলিত হলো তার রুদ্র কন্ঠ।

“খুব সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সাজছো তুমি,তাইতো।অথচ পুরো বাড়ির লোকেদের এতদিন একটা মিথ্যে জানিয়ে এসেছো! সেবেলা?তুমি নির্বানীকে ভালোবেসে বিয়ে করছো?করনি।তুমি ওর সম্মান বাঁচানোর জন্য বিয়ে করেছো!নাহলে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যেত যে।”

শুভর কথায় আরেক দফায় চমকে উঠে সকলে।আমি বিস্ময় নিয়ে তাকাই শুভর পানে।এই কথা সে জানলো কি করে?তার তো জানার কথা নয়।একথা তে আমি কেবল রাইকেই বলেছিলাম।তবে কি রাই বলেছে তাকে?এমনটা তো হওয়ার কথা না!
ধ্রুব সরু চোখে তাকায় শুভর পানে।বলে,

“আমার মিথ্যেতে কারো জান,কারো সম্মান যাইনি শুভ!কারো ক্ষতি হয়নি।”

“ক্ষতি হয়নি?শশীদির সুখ কেড়ে নেয়নি এই মেয়ে?”

ধ্রুব কন্ঠে অবাক মিশিয়ে বলে,

“ও কারোর সুখ,কারোর সংসার কেড়ে নেয়নি।আমি ওকে বিয়ে করেছি।আমিই ওর বাড়ির লোকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।নির্বানীর এক ফোঁটা দোষ নেই।যদি দোষ থেকে তাকে তবে সেটা আমার।আমি একজনকে বিয়ের আশা দেখিয়ে,অন্যজনের সম্মান রক্ষায় বিয়ে করেছি।তাহলে তোদের ক্ষোভ কেন ওর উপর এসে পরবে?”

এতটুকু বলে ধ্রুব শশীর পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

“এমনটা কেন করলে শশী?রাইয়ের কলংক,নির্বানীর বদনামের জঘন্য পরিকল্পনা কেন?”

এবার নিজের সমস্ত ধৈর্য থেকে বেরিয়ে শশী একপ্রকার চিৎকার করে উঠে বলে উঠলো,

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসতাম।কারণ আমি তোমার স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম।”

কথাটা বলে শব্দ করে কেঁদে উঠলো শশী।বসার ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে এখন কেবল তার কান্নার আওয়াজ।

“হ্যা আমিই করিয়েছি রাইয়ের বদনাম।ওর নামে মিথ্যে খবর আমিই ছড়িয়েছি।কেননা তুমি ওকে আমার থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে।যেটা সহ্য হতো না আমার।আমি এটা মানতে পারতাম না যে তুমি আমার থেকে কাউকে বেশি গুরুত্ব দিবে।যে তোমার সম্পর্কে যাই লাগুক!”

একটু থামলো শশী।শুভ তখন কপালে হাত চেপে।বাড়ির লোক একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেন অবাক হয়ে।রাই চুপচাপ দাড়িয়ে।কোথাও যেন আটকে আছে তার দৃষ্টি।শশী ফের বললো,

“নির্বানীর ঘরে এই লোকটাকে আমিই পাঠিয়েছিলাম।চেয়েছিলাম এ বাড়ির সকলে ওকে ভুল বুঝে বের করে দিক।ও চলে যাক এখান থেকে।কিন্তু তা হলো না।শেষমুহুর্তে তুমি চলে এলে।ওকে বাঁচিয়ে নিলে।”

“ছিঃ শশী।তোমায় নিজের মেয়ের মতো ভাবতাম আমি।আর সেই তুমি কি না এমন জঘন্য কাজ করছো।ছিঃ”

ধ্রুবর মায়ের মন্তব্যে এবার আরেকবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো শশী।

আমি ক্রন্দনরত শশীর নিকটে এসে দাঁড়ালাম।তার করা সমস্ত জঘন্য কাজকে ছাপিয়ে হঠাৎ তার প্রতি মায়া জন্মে উঠলো আমার।কারো কান্না আমার জন্য সুখকর নয়।হোক সে যতটাই পাপী।
আমি শশীর উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বলে উঠলাম,

“আপনার প্রতি দয়া হওয়াটা বোধহয় অনুচিত!তবে আশ্চর্যভাবে আমার আপনার উপর প্রচন্ড দয়া হচ্ছে।”

শশী তার কান্নারত ভেজা চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো।সেই দৃষ্টিতে আজ রাগ,হিংসা কোনটাই নেই।কেবল অসহায়ত্ব বিরাজমান সেথায়।
আমি বলে উঠলাম,

“আপনার অধিকারপরায়ণ স্বভাব একজন নিষ্পাপ মেয়ের স্বপ্নভঙ্গ করেছে।তার নামে মিথ্যে কলংক ছড়িয়েছেন আপনি।আমার সাথে করা জঘন্য কাজটার কথা নাহয় বাদই দিলাম।আমার তো মনে হয় না আপনি কাউকে ভালোবাসেন!”

শশী আমার কথার প্রতিত্তোরে ভ্রু কুঁচকে চাইলো।বললো,

“কে বলেছে আমি কাউকে ভালোবাসি না?আমি আমার মা-বাবা আর ধ্রুবকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবসেছি”

“মিথ্যে আপনার ভালোবাসা!কিংবা ভালোবাসা কি এটাই আপনার জানা নেই।যদি সত্যিই ধ্রুবকে ভালোবাসতেন তবে এমনটা করতেন না।এমন কোন কিছু করতেন না যার জন্য আপনাকে চিরদিনের জন্য ভালোবাসার মানুষের কাছে নিচু হতে হয়।”

একটু থেমে আমি ফের বললাম,

“কাউকে ভালোবাসার অর্থ সবসময় এটা হতে পারে না যে,তাকে আমার নিজের করে লাগবেই।বরং ভালোবাসার ভালো চাওয়ার মাঝেই ভালোবাসা নিহিত।এই সহজ কিংবা জটিল কথাটা অনেকের বোধগম্য না হওয়ার জন্য কত সুন্দর সম্পর্ক ভেঙে যায়!”

শশীর কান্না ততক্ষণে থেমে গেছে।গাঢ় একটা শ্বাস টেনে সে বলে উঠে,

“মানছি আমি খুব জঘন্য কাজ করেছি।মানছি আমার দ্বারা রাইয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে।কিন্তু ধ্রুবর প্রতি আমার ভালোবাসা সত্য ছিল।”

“সত্যকে পাওয়ার জন্য তবে এত মিথ্যার আয়োজন কেন?”

ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উঠলাম আমি।শশী হেসে উঠলো নিঃশব্দে!চোখের তারায় ভেসে উঠলো বিষাদ ফুল।

“তুমি এই জিনিসটা কখনো উপলব্ধি করতে পারবে না নির্বানী।প্রিয় পুরুষকে অন্য মেয়ের বাহুডোরে দেখার কি মরণ যন্ত্রণা।এই যন্ত্রণা এতই তীব্র যে,মস্তিষ্কের বিবেক নামক জিনিসটাকে ভক্ষণ করে এই মরণ যন্ত্রণা।”

আমি চুপ করে শশীর কথা শুনছি।মাথার ঘোমটাটা কখন যেন বাতাসের তোরে নিচে পরে গেছে।হঠাৎ করে শশী আমার মাথার সিঁদুর স্পর্শ করলো।তার চোখজোড়া পূর্ণ হলো অশ্রুর পাথারে।সেই অশ্রুপূর্ণ চোখেই শুভ্র দাঁত বের করে মৃদু আওয়াজ করে রিনরিনেয়ে হেসে উঠলো শশী।
হাতের আঙুলে লেগে থাকা সিঁদুরে পানে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,

“প্রিয় মানুষের হাতের এক চিলতে সিঁদুরের লোভ বড় লোভ।আমি এই লোভে লোভী ছিলাম।আমি জানতাম ধ্রুবর চোখে আমার জন্য প্রেম কোনদিনই ছিল না।তাতে বন্ধুত্ব আর সেই বন্ধুত্ব রক্ষার দায়িত্ববোধ ছিল প্রখর।তবুও আমি দিনরাত তাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে গেছি।রুপে,গুনে অবশ্য ঈশ্বর আমাকে নিরাশ করেননি।ভাগ্যও প্রসন্ন ছিল আমার উপর।কিন্তু সেই তুমি হুট করে চলে এলে।এতদিন সেই অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করে আমার দিন রাত কেটেছিল,সেই অবস্থানে তোমাকে দেখে কি করে ঠিক থাকতাম আমি বলো?”

আমি আর কিছু না বলে তার থেকে সরে এলাম।শশীর সাথে এমন আলাপ আমাট আগেও হয়েছিল।গোপন,তবে সকলের কাছে দৃশ্যমান।ধ্রুবর দিকে তাকালাম কোমল চোখে।

ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে প্রশ্ন করলো,

“তোমার অপরাধীর কি শাস্তি চাও তুমি?”

আমি দ্বিধান্বিত হৃদয়ে শশীর পানে তাকালাম।নিজের অপরাধ স্বীকার করে কান্নারত সে।আমি কারো কান্না সহ্য করার ক্ষমতা রাখি না।ছোট থেকেই কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার নিজেরও কান্না পায়।আমি দাঁতে দাঁত চেপে শশীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলাম,

“ওনাকে ক্ষ..ক্ষমা করে দিন।”

আমার এই কথা বোধহয় কেউ আশা করেনি।স্বয়ং শশী তার কান্না থামিয়ে বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে।আমি শশীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধ্রুবর পানে তাকালাম।উনিও বোধয় অবাক হয়েছেন সামান্য।তারপর ফের বললেন,

“আর শুভকে কি করবো?”

“উনি আপনার অপরাধী।এই সিদ্ধান্ত আপনি নিন।”

“আমি তাদের ক্ষমা করতে পারছি না।তোমার মত কোমল নই আমি।অপরাধী তার শাস্তি অবশ্যই পাবে।”

একথা বলে রাইয়ের দিকে তাকান তিনি।রাই তখনো কোথায় যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে।ধ্রুব মৃদুস্বরে ডেকে উঠে,

“দিদি?”

রাই চোখ তুলে ধ্রুবর পানে তাকায়।ধ্রুব বলে,

“নিজের অপরাধীর কি শাস্তি চাস তুই?”

রাইয়ের মুখে মলিন হাসি ফুটে উঠে।যার অর্থ হয়ত এই যে,মরা মানুষের আবার কিসের চাওয়া?”

ক্রন্দনরত শশীর দিকে এবার দৃষ্টি ফেরায় রাই।অপরুপ রুপসীকে কাঁদতে দেখতে মায়াই লাগে।হোক না তার হৃদয় বিষে ভরা।কিন্তু রাইয়ের বোধহয় ওর প্রতি মায়া লাগলো না।সে শশীর দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে আছে।বাড়ির সকলের মুখে তখন কঠোর নিরবতা।একদিনে এত ধকল তাদের কুলাচ্ছে না।বয়স্ক তো?
অথচ এই বয়স্কদের করা কটু বাক্যে কত প্রাণ আজও জীবিত!

রাই শশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আমি নির্বানী নই।আমি ওকে ক্ষমা করতে পারবো না।শুধু এতটুকুই চাইবো এই জমিদার বাড়ির ভিটেতে শশী নামক কাল সর্পিণীর ছায়া যেন না পরে।ও যেন গ্রামবাসী সকলের কাছে এই বলে ক্ষমা চায় যে জমিদার বাড়ির মেয়ে রাই কোনদিন কোন বাজে কাজ করেনি।সবটাই ছিল তার প্ররোচনা।ওর অধিকারপরায়ণতার বিষাক্ত ছোবল পরেছে আমার উপর।”

চলবে….