#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৩)
খাইরুন নিসা ওযু করে এসে দেখলেন, স্বর্ণলতা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টিজোড়া জমিনে স্থির। নিমিষে ওযুর পানিতে ভেজা ভ্রূযুগল বিরক্তে কুঞ্চিত হলো। ধ মকে ওঠলেন,
” মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? নামাজ পড়তে হবে না? ওযু করে আসো, যাও। নামাজের কথা প্রতি ওয়াক্তেই মনে করিয়ে দিতে হবে নাকি? ”
স্বর্ণলতার কিশোরী দেহটা মৃদু কেঁপে ওঠল। ভ য়ে তটস্থ হয়ে আছে তনু ও মন। ভীষণ অসহায় ও নিরুপায় বোধ হচ্ছে। গোসল করেছে, কাপড় বদলেছে। তবুও সে নাপাক। হায়েজ অবস্থায় আল্লাহর হরফ ছুঁতে পারবে না। জায়নামাজে বসতে পারবে না, সিজদাহতে লুটিয়ে পড়তে পারবে না। সৃষ্টিকর্তার এই বিধান অবগত হয়েও কি পাপে লিপ্ত হওয়া যায়? স্বর্ণলতা ভীষণ দোটানায় পড়ে গেল। এই মুহূর্তে সত্য প্রকাশ করা ঠিক হবে নাকি ভুল, বুঝতে পারছে না। এই ব্যাপারে সুনিশ্চিত, দাদিজান সত্যি জানতে পারলে বেজায় রা গ করবেন। সেই সাথে স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য পালনেও তাগিদ দিবেন।
” এখনও দাঁড়িয়ে আছ যে? তুমি তো দিনে দিনে চরম অবাধ্য হচ্ছ! মুনছুরের মতো নামাজ, কালাম সব বাদ দিয়ে পাপী হতে চাও? আল্লাহ এসব সহ্য করবে না, বুঝছ? তাছাড়া মুনছুরও তো চায়, তুমি নামাজি হও। শোনো মেয়ে, স্বামী যেমনই হোক না কেন, তার সকল আদেশ নীরবে পালন করতে হয়। নাহলে আল্লাহ নারাজ হবে। তিনি নারাজ হলে, তোমরা সুখী হবে না। কেউই শান্তি পাবে না। ”
স্বর্ণলতা চোখ তুলে তাকাতেই তিনি পুনরায় তাগাদা দিলেন,
” যাও, ওযু করে আসো। একসাথে নামাজ পড়ব। ”
” আমি তো নামাজ পইড়া ফালাইছি, দাদিজান। ”
খাইরুন নিসা জায়নামাজের ভাঁজ খুলছিলেন। সহসা থমকে গেলেন। বিস্মিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল নাতবউয়ের মুখে। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে সুধালেন,
” নামাজ পড়ে ফেলেছ? ”
সে মুখে উত্তর দিতে পারল না। গলায় শব্দগুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে আটকে পড়ল। বুকের ভেতরটা ক্রমশ কাঁপছে! মিথ্যা কথাটা বলার কোনোরূপ প্রস্তুতি ছিল না। ভ য়ে, বেফাঁসে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন সেটাকে ফিরিয়ে নিতেও সাহস পাচ্ছে না। শুকনো ঢোক গিলে মৃদু মাথা নাড়ল দুপাশে। দাদিজানের চমক ভাবটা আরও একটু বাড়ল। সুধাল,
” কখন পড়েছ? আমি তো দেখিনি। ”
এই প্রশ্নের উত্তর মাথা নেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। শব্দের ব্যবহার করতে হবে। স্বর্ণলতা সেকেন্ড কয়েক সময় নিল। বুকের কাঁপন নিয়ন্ত্রণে আনল। সাবধানে গভীর নিঃশ্বাস টেনে ক্ষীণ গলায় প্রত্যুত্তর করল,
” কতক্ষণ আগে। আমার ঘরে পড়ছি তো, তাই দেখতে পান নাই। ”
” আমাকে বলোনি কেন? ”
” আপনি তো খাবার খাইয়া জিরাইতেছিলেন। চোখ বুঁইজা ছিলেন। আমি ভাবলাম, ঘুমাই গেছেন। নামাজ পড়বেন না। তাই চুপচাপ পইড়া নিছি। কাযা হইলে যদি রা গ করেন? ”
কথাটুকু বলে সে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। স্থির চেয়ে আছে দাদিজানের দিকে। তার প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা করছে। সেই সাথে গোপনে সমানে ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছে আল্লাহর কাছে। মায়ের কাছে শুনেছিল, যারা নিয়মিত নামাজ পড়ে তারা কখনও মিথ্যা বলে না। সেও এখন নিয়মিত নামাজ পড়ে। তাই মিথ্যাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আজ পারল না৷ অনেকগুলো মিথ্যা বলে ফেলল!
” ঠিক আছে। কিন্তু আর কখনও একা একা পড়বে না। তুমি শিখছ মাত্র, একা পড়লে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আসরের নামাজ আমার সাথে পড়বে। ”
তিনি নামাজ আদায়ে মনোযোগী হয়ে পড়লেন। স্বর্ণলতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল! হেঁটে এসে বসল দাদিজানের বিছানায়। বসতেই মনে পড়ল, এবার মিথ্যা বলে বেঁচেছে। কিন্তু পরেরবার? দাদিজান তো বলেই দিয়েছেন, তার সাথেই পড়তে হবে! মুহূর্তেই অসহায়ত্ব ফুটে ওঠল মুখজুড়ে। সেই সাথে রা গ হলোও খুব। দানবটা তাকে এভাবে ফাঁসিয়ে দিতে পারল? জবরদস্তিতে বিয়ে করেও ক্ষান্ত হয়নি সে। পদে পদে অ ত্যাচার করা চাই। ঘরে দরজা আটকে পারছে না তো কী হয়েছে? দরজার বাইরেও শান্তি দিবে না। বেলা বেলায় অপদস্ত ও হেয় করে যাবে।
খাইরুন নিসা নামাজ শেষ করে বললেন,
” চাঁদনিকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় সে? ”
” পাশের ঘরে। ”
” ডাক দাও। ”
স্বর্ণলতা উঠে গেল। পাশের রুমের দরজা ও জানালা উভয় খোলা। সূর্যের আলো নির্বিঘ্নে ঢুকছে৷ জায়গা করে নিয়েছে সমস্ত রুমটা। এরপরও রুমের বাল্বটা জ্বলছে। সাদা, ফকফকে আলো। ঘরের আসবাবপত্র, দেয়াল ও মেঝে এত পরিষ্কার ও ঝকঝকে লাগছে যে, তার চোখ ধাঁধিয়ে ওঠছে৷ পাপড়ি জোড়া মেলে ঠিক করে তাকানো যাচ্ছে না। সে আধো চোখ বুঁজে আছে। সেই অবস্থায় দেখল, চাঁদনি খাটের উপর বসা। মুখটা বাল্বের দিকে। হাতে একটি চারকোণা আয়না। আয়নাটি উর্ধ্বে তুলে ঠোঁটে লিপস্টিক মাখছে। সে পেছন থেকে ডাকল। চাঁদনি সাজগোজে এতই মত্ত যে, তার ডাক কানে পৌঁছাচ্ছে না৷ দরুন কোনোরূপ সাড়াশব্দও করছে না। স্বর্ণলতা খাটে উঠতে বাধ্য হলো। পিঠে হাত রেখে জোরাল গলায় বলল,
” চাঁদনিবু? দাদিজান তোমারে ডাকে। ”
সে এবারও সাড়া দিল না। সামান্য নড়লও না। আগের মতোই গভীর মনোযোগে লিপস্টিক দিচ্ছে। স্বর্ণলতা আরও একবার ডাক দিবে তখনই মুখটা ঘুরে গেল। চোখজোড়ায় দারুন উৎসাহ ফুটিয়ে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সুধাল,
” রঙটা দেখ, সুন্দর না? আমার ঠোঁটের সাথে এত ভালো মানিয়েছে! মনে হচ্ছে, শুধুমাত্র আমার জন্যই বানানো হয়েছে। ”
স্বর্ণলতা ঠিকমতো দেখল না। দাদিজান সেই কখন ডাক পাঠিয়েছে! তাই তাড়াহুড়ায় বলল,
” হ। খুব সুন্দর। এবার চলেন, দাদিজান আপনারে ডাকে। ”
চাঁদনি তখনই ছুটল না। লিপস্টিকটাসহ আরও যে সাজসরঞ্জাম ছড়িয়েছিল, সময় নিয়ে সেগুলো গুছাল। আয়নাটাও বালিশের কাছে উল্টে রাখল। চুলে আরও একবার চিরুনি চালানোর পর খাট থেকে নামল। কুঁচির বিন্যাসগুলো মসৃণ ও সিধা করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
” মুনছুর আসছে? ”
” না। ”
” কখন আসবে? ”
” জানি না তো। ”
সে মাথা তুলল। মুখের ভাবটা শক্ত করে কপট রা গ দেখিয়ে বলল,
” জানো না কেন? তোমার স্বামী না? স্বামী কখন, কোথায় গেল, কতক্ষণ বাইরে থাকল, কখন ফিরল সব জানতে হবে। বুঝছ? ”
” হ, বুঝছি। এবার চলেন।
স্বর্ণলতা তার হাত টেনে ধরল। একপ্রকার জোর করেই রুম থেকে বের করল। দাদিজানের রুমে ঢুকতে ঢুকতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ এতসব জেনে আমার কী লাভ? আমি তো চাই, দানবটা সারাজীবনের লাইগা বাইরে থাকুন। সে বাইরে থাকলেই আমার শান্তি। নিশ্চিন্ত মনে একটু ঘুইরা বেড়াতে পারি। ‘
_____
খাইরুন নিসা বিছানায় আধশোয়া। হাতে তসবিহ। চোখ বুঁজে একমনে জিকির করছেন। স্বর্ণলতা ডাকবে কী ডাকবে না, বুঝতে পারছিল না। তখনই চাঁদনি বলে ওঠল,
” ডাকছিলে কেন, দাদিজান? জলদি বলো। আমার সাজ শেষ হয়নি। ”
তিনি চোখ মেললেন। চাঁদনির মুখটায় চাইতেই, দৃষ্টি আটকে গেল। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল, বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ চোখজোড়ায়। ঠিক যেন সুরসুন্দরী! চাঁদনির মতো একাধারে নিখুঁত রূপ, পরিপূর্ণ যৌবনের মেয়ে দ্বিতীয়টি দেখেননি। সাজগোজেও কী দারুন পটু! পরিপাটি থাকে সবসময়। খাইরুন নিসা তার আপাদমস্তক পরখ করলেন। গাঢ় নীল রঙের সুতি শাড়ি পরেছে মেয়েটা। সাথে মিলিয়ে গয়নাগাটিও পরেছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাতে ও পায়ের নখে নেইলপালিশ সবই পরেছে। কোনোকিছুতেই বাড়তি কিংবা ত্রুটি নেই। এরপরও মেয়ে বলে, সাজ এখনও বাকি! খাইরুন নিসার মনে কৌতূহল উদ্রেক হলো। জিজ্ঞেস করলেন,
” আর কী বাকি আছে? ”
” ফুল বাকি। আবুলকে দিয়ে নীলঘণ্টা ফুল আনিয়ে ছিলাম তো। পরব না? ”
খাইরুন নিসা ঈষৎ হাসলেন। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বললেন,
” পরিস। এখন আমার কাছে বস। তোর সাথে দুটো কথা বলি। ”
” ফুলটা পরে আসি? তারপরে দুটো কেন দুই হাজার কথা বলো। যতক্ষণ না মুনছুর আসছে ততক্ষণ তো আমি ফ্রি আছি। ”
সে অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষাও করল না। চড়ুই পাখির মতো চঞল পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা অবাক হলো। হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে আছে খোলা দরজায়। চাঁদনিবুর সাহসে সে মুগ্ধ!
খাইরুন নিসা এই সময়টাতে মনোযোগ দিলেন কিশোরী, হতভম্ব মুখটার দিকে। তার পরনেও নীল রঙের শাড়ি। নতুন ও দামী হওয়া সত্ত্বেও রঙটা ঠিকমতো ফুটছে না। কারণটা খুঁজতেই পেয়ে গেলেন। বোকা মেয়েটা নীল রঙের শাড়ির সাথে লাল রঙের ব্লাউজ পরেছে। কুঁচি ঠিক নেই, আঁচলের কাজটাও উল্টো। গলা ও কান খালি। রুক্ষ ঠোঁট, কাজলহীন চোখ। এলোমেলো চুলের হাত খোঁপা। সেটাও খুলি খুলি ভাব। তার মেজাজ গরম হয়ে গেল। ধ মকে ওঠলেন,
” এই মেয়ে, তুমি কি শাড়ির উল্টো সোজাও চিনো না? ”
সে চমকে কেঁপে ওঠল। দৃষ্টি ফিরে এলো ঘরের ভেতর, সোজা দাদিজানের মুখের ওপর। তিনি রু ষ্ট স্বরে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
” তোমার কান, গলা খালি কেন? গয়না পাঠিয়েছিলাম না? কী করেছ? ”
স্বর্ণলতা চটজলদি উত্তর দিতে পারল না। খানিক ভাবতেই স্মরণ হলো, রুমকি যেদিন শাড়ি নিয়ে গিয়েছিল সেদিন একটি গয়নার বাক্সও নিয়েছিল। সে তো মেলেই দেখেনি! তারপরে কত কী ঘটল! সেই বাক্স কোথায় আছে জানেও না৷ দাদিজান যদি না নিয়ে থাকে তাহলে তো মুনছুর সাখাওয়াতের ঘরেই পড়ে থাকার কথা। আজ সকালে সেই ঘরে স্বর্ণলতা ছিল। চোখে পড়েনি তো!
” কী হলো? আবারও বোবায় ধরেছে নাকি? ”
” না, দাদিজান। গয়নার বাক্সটা তো আপনার নাতির ঘরে। সেদিন অসুস্থ হইয়া গেলাম না? পরে আনতে মনে নাই। ”
খাইরুন নিসার রা গ বাড়ল। রক্তিম চোখে চেয়ে থাকলেও মুখে কিছু বললেন না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লেন কয়েকটা। অতঃপর পালংক থেকে নামতে নামতে বললেন,
” দরজা বন্ধ করে এদিকে আসো। শাড়িটা ঠিক করে পরিয়ে দিই। তোমাকে দিয়ে তো কোনো কাজই হচ্ছে না! ”
তিনি শাড়িটা সোজা করে পরাতে চাইলেও, পরালেন না। নিজের আলমারি থেকে একটি লাল রঙের শাড়ি বের করলেন। তালাবদ্ধ একটি ড্রয়ার থেকে আরও একটি গয়নার বাক্স বের করলেন। সেখান থেকে স্বর্ণের একজোড়া কানের দুল, চুড়ি ও একটি মোটা চেইন বের করলেন। স্বর্ণলতাকে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” এগুলো আমার। তোমাকে ধার হিসেবে দিলাম। খেয়াল রেখ, হারিয়ে যায় না যেন! তাহলে কিন্তু খুব রা গ করব। মুনছুর আসুক। গয়নার বাক্স বের করে আনার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আমাকে ফেরত দিবে। ওটার মধ্যে অনেক গয়না আছে, সেগুলো পরবে। ওগুলো তোমার। ”
এরমধ্যে দরজায় আঘাত পড়ল। সেই সাথে চাঁদনির গলাও ভেসে আসছে। স্বর্ণলতা দাদির অনুমতি নিয়ে দরজা খুলে দিল। চাঁদনি ভেতরে ঢুকে অভিযোগের মতো বলল,
” ফুলগুলো খুঁজে পাচ্ছি না, দাদিজান। কেউ চুরি করেছে। ”
” এই বাড়িতে চুরি হয় না, চাঁদনি। এই কথা ভালো করেই জানিস। ”
” চুরি না হলে যাবে কোথায়? ”
” বাতাসে উড়ে গেছে হয়তো। নিশ্চয় খোলা রেখে এসেছিস? ”
চাঁদনি একটু থেমে নীরবে ভাবল। দাদিজানের অনুমান ঠিক। সে পরবে বলে পাশেই নিয়েছিল। কাজল আর লিপস্টিক পরতে এত সময় নিল যে, ফুল উড়ে গেছে কখন খেয়ালই করেনি। সে আদেশের মতো বলল,
” মুনছুরের বউ? দেখ তো, ফুলগুলো উড়ে কোথায় গেল। খুঁজে এনে দাও, এখনই। ”
স্বর্ণলতা আদেশ শুনে, বেরিয়ে যাচ্ছিল। দাদিজান থামালেন। চাঁদনির দিকে চেয়ে বললেন,
” স্বর্ণলতা ফুল খুঁজতে যাবে না। ও এই বাড়ির ঝি না, বউ। তোর ফুল, তুই খুঁজে নে। ”
” ফুল খুঁজলে যদি ঝি হয়ে যায়, তাহলে আমিও ফুল খুঁজতে যাব না। ”
চাঁদনি পালংকের উপর উঠে বসল। মনখারাপ করে, অভিমানে মুখ ফুলিয়ে বলল,
” কী কথা বলবে, বলো। ”
খাইরুন নিসা বিছানায় উঠে বসলেন। স্বর্ণলতাকেও ডেকে আনলেন। নিজের পাশে বসিয়ে তাকালেন চাঁদনির দিকে। পরক্ষণে নাত বউয়ের দিকে। কান ও গলা স্বর্ণের ছোঁয়া পেতেই মুখের আদলটা অন্য রকম দেখাচ্ছে, জ্যোতিও ছড়াচ্ছে। তবুও চাঁদনিকে টেক্কা দিতে পারেনি, কাছাকাছিও যেতে পারেনি। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চাঁদনি উচ্চ বংশের মেয়ে, দেখতেও সুন্দর। মুনছুরকে পাগলের মতো ভালোবাসে। যদি মুনছুরও বাসত! তাহলে এই মেয়েটি আজ এই বাড়ির বউ হতো। খাইরুন নিসা একদমই আপত্তি করতেন না। মনে মনে রাজিও ছিলেন। কিন্তু চাঁদনির প্রতি মুনছুরের বড্ড অবহেলা ছিল। বয়সটাও কম। জোর করতে পারেননি। সেই সাথে মনে হয়েছিল, চাঁদনি যদি অসুখী হয়? কোনোকালেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ না করে? তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। তারচেয়ে ভালো মেয়েটি অন্য জায়গায় সুখী হোক। এই উদ্দেশ্যেই চাঁদনির অন্যত্র বিয়েতে আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন। পাত্র খোঁজায় নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। চার গ্রামে খোঁজ লাগিয়ে, আসমানকে পেয়েছিলেন। একদম মনের মতো। ঠিক যেন, মুনছুরের বিপরীত। বিয়ের রাতে চাঁদনির সে কী কান্না! একবার তার পায়ে ধরে কাঁদছে তো, আরেকবার মুনছুরের। শেষমেষ নিজের বাবা, মায়ের পা ধরেও রক্ষা হলো না। আইন ও ধর্মমতে, আসমানকেই স্বামী হিসেবে পেল!
” তুই কি বন্ধ্যা? ”
চাঁদনি চকিতে তাকাল। বিস্ফারিত আঁখিদ্বয়। বিশ্বাসই করতে পারছে না, দাদিজান এই প্রশ্নটা করেছে। ক্ষণকাল বিস্ময়ে বিমূঢ় থাকল। সহসা ফোঁস করে ওঠল,
” বন্ধ্যা হব কেন? ”
” তাহলে তোর বাচ্চা হয় না কেন? বিয়ের অনেক বছর হলো তো। ”
” বাচ্চা নিই না, তাই হয় না। ”
” নিচ্ছিস না কেন? আসমান মানা করেছে? ”
” ওর কি এত সাহস আছে? ”
” তাহলে? ”
চাঁদনি সাথে সাথে উত্তর দিল না। তার চোখে, মুখে দুষ্টুমির ছটা। খাইরুন নিসা শুরুতে ধরতে পারলেন না। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। সহসা হাত উঁচিয়ে শা সালেন,
” উল্টাপাল্টা কিছু বললেই চ ড় খাবি। ”
সে গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” তাহলে আগে চ ড়টায়ই দাও। জবাবটা তারপরে দিই। ”
তিনি চ ড় দিলেন না। রা গটাকে নিয়ন্ত্রণে আনলেন। নরম স্বরে বললেন,
” মুনছুরকে ভুলে যা। ও তোকে কখনই ভালোবাসবে না। এখন বিয়ে করেছে, বউ আছে। বউ রেখে কি তোকে ভালোবাসবে? এরকম আশা রাখা বোকামি। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছিস। মিথ্যা স্বপ্নের পেছনে ছুটছিস। নিজেকে ঠকাচ্ছিস, আসমানকেও ঠকাচ্ছিস। আল্লাহ কি এসব মেনে নিবে? ”
চাঁদনি জবাব দিল না। চোখ, মুখ শক্ত করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। খাইরুন নিসা পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। একটু সময় নিয়ে পুনরায় বললেন,
” আসমান তোকে কত ভালোবাসে! ওরকম করে মুনছুর কখনই ভালোবাসতে পারত না। ”
” মুনছুরের ভালোবাসা লাগবে না, দাদিজান। শুধু বলো, বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। তাহলেই হবে। আর কিছু চাই না আমার। স্বর্ণলতা থাকলেও আপত্তি নেই। আদর, সোহাগ, বাড়ি, গাড়ি, গয়নাগাটি সবকিছু ও কে দিয়ে দিলেও রা গ করব না৷ সত্যি বলছি। আল্লাহর কসম। ”
তার কাতর কণ্ঠস্বর, অশ্রুতে টলমল চোখ দুটি স্বর্ণলতার বুকের ভেতরে গিয়ে আটকা পড়ল। মায়ায় পূর্ণ হয়ে ওঠল অন্তরের সকল প্রকোষ্ঠ। সহানুভূতি দৃষ্টি রাখতেই ছিটকে ওঠল। দাদিজান আরও একটি চ ড় মা রলেন চাঁদনির হলদে রঙা কোমল গালটায়৷ তারপরে শুনতে পেল,
” তোকে এই বাড়ি ডেকে আনায় ভুল হয়েছে। ভাবছিলাম, বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী, সংসার আছে। মাও তো মা রা গেল গত বছর! এতদিনে সব ভুলে গেছিস, সুধরে গেছিস। তাই ডেকে এনেছিলাম। একটু গ্রামে বেড়িয়ে গেলি, সেই সাথে আমার কাজেও লাগলি। এখন তো দেখছি, আমার ভাবনায় পুরোপুরি ভুল। তুই ব্যাগপত্র গুছা। আমি আসমানকে ডেকে পাঠাচ্ছি। আজই শহরে ফেরত যাবি। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৪)
মহাজনের বাড়ির লম্বা বারান্দাটি পাকা ও মসৃণ। ধার লাল রঙে ল্যাপা। মাঝে পাঁচ পাপড়ির বড় ফুল আঁকা। উঠোনে নামতে হয় তিন ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে। প্রতিটি ধাপ বেশ মোটা ও চওড়া। চাঁদনি দ্বিতীয় ধাপে বসে আছে আলস্যভাবে। তার হাতে গোটা কয়েক গোলাপ ফুল। মাত্রই পেরেছে। উঠোনে নামার পথের ডান পাশে ছোট্ট একটি বাগান। সেখানে একটি গোলাপ ফুলের গাছ আছে। গাছটির কাণ্ড বৃক্ষের মতো শক্ত, মোটা ও দীর্ঘ। ইতিমধ্যে এর শাখা ও প্রশাখা বারান্দার চাল ছাড়িয়েছে। ফুলের পাপড়ির রঙ হালকা গোলাপি ও পুংকেশর হলদেটে। গোলাপ গাছের সাথে তিন, চারটে গাঁদা গাছও আছে। চাঁদনি মৃদু সুরে গান ধরল। দুটো ফুল কানে গুঁজল। বাকিগুলো থেকে পাপড়ি ছাড়াচ্ছিল, সহসা ঝাড়ি শুনল,
” ঐ মেয়ে থাম। আযানের সময় গান গাচ্ছিস, মনে কী ডরভয় নেই? মাথায় কাপড়টা পর্যন্ত দেওয়ার নাম নেই। জ্বীনরা তোকে ঠে সে ধরে না কেন? ”
চাঁদনি গান থামাল। আঁচলটা আলগোছে মাথায় রাখা মাত্র পড়েও গেল। দ্বিতীয়বার টেনে আনল না। দাদিজানের রুমের একটা জানালা এই বাগানের কাছেই। সেই দিকে চেয়ে চাঁদনি উচ্চ স্বরে হেসে ওঠল। দুষ্টুমি সুরে জবাব দিল,
” জ্বীনরা ঠে সে ধরবে কেন? ওরা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে, দাদিজান। তোমার নাতির মতো গর্দভ নাকি যে, বিনামূল্যে মানিক পেয়ে বুকে না লুকিয়ে লা থি মা রবে! ”
” তুই মানিক? ”
” না, মানিকের চেয়েও দামী। ”
খাইরুন নিসা কথা বাড়ালেন না। জানালার পর্দা ছেড়ে দিলেন। নারী যদি বুঝে যায়, সে সুন্দরী তাহলে ভয়ঙ্কর রকমের অহংকারী হয়ে ওঠে। দুনিয়ার অন্য সব সৌন্দর্য, লাবণ্যকে দাসত্ব হিসেবে পেতে চায়। এই সময় মুনছুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে ঢুকল। চাঁদনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে, জীপটির দিকে। খুব করে চাইছে, কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির চোখ দুটি তার দিকে পড়ুক। পড়ল না। এদিকে এগিয়ে এলো না পর্যন্ত। জীপ থেকে নেমে কাঁঠাল গাছের তলায় গিয়ে বসল। ওখানে পূর্ব থেকেই চেয়ার ও টেবিল পাতা। চাঁদনি খেয়াল করল, মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে আরও একটি লোক আছে। কাছাকাছি বয়স হবে। বেশভূষা সভ্য ও পরিপাটি। মুখোমুখি বসেছে দুজনে। মুখ দুটি ভীষণ গম্ভীর ও শান্ত।
” আসসালামু আলাইকুম, ম্যাডাম। ভালো আছেন? ”
চাঁদনির ধ্যান ভাঙল। তার সামনে পান্না দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটিকে সে চিনে, মুনছুর সাখাওয়াতের ভীষণ বিশ্বস্ত ও পুরোনো শাগরেদ।
” ঐ লোকটা কে? মুনছুর কার সাথে কথা বলে? ”
পান্না এক ঝলক পেছনে ফিরল। দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলল,
” চিনতে পারলেন না? উনি তো আমাগো হাদি ডাক্তার। ”
” হাদি ডাক্তার! ”
চাঁদনির কণ্ঠ থেকে নামটা এমনভাবে উচ্চারণ হলো যে, পান্না ভাবল সে চিনতে পারছে না। তাই আগ বাড়িয়ে বলল,
” ভুইলা গেছেন? আমাগো রাণীসাহেবার গাঁয়ের ছেরাই তো। বছর কয়েক আগে আপনার লগে শহরে দেখা করতে গেছিল তো! ”
চাঁদনির মুখের রঙটা খানিক অনুজ্জ্বল হলো। বিচলিতও দেখাল। মনি জড়ো বার দুয়েক এদিক ওদিক ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,
” ডাক্তার যে আমার সাথে দেখা করেছে, এ কথা তুমি জানলে কীভাবে? ”
পান্না আরম্ভে অবাক হলো। পরক্ষণে অটল আত্মবিশ্বাস ও মৃদু গর্বের সাথে বলল,
” আমি জানমু না তো কে জানবো? মহাজনের সব গোপন আর গুরুত্বপূর্ণ কাজ তো আমিই হ্যান্ডেল করি। ”
চাঁদনি চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল। এই ছেলেটাকে শুরু থেকেই তার পছন্দ নয়। প্রতিটা কথার শেষে সে শব্দ করে হাসে। দু’পাটি দাঁতও বের হয়। উপরের পাটির দাঁতের মাঝে বিশাল ফাঁকা! দেখলেই চাঁদনির ঘৃণা হয়, মুখে থুথু জমে। সে পান্নার পায়ের কাছে একদলা থুথু ফেলে বলল,
” রানিসাহেবা কে? ”
প্রশ্নটা শোনামাত্র পান্না উচ্চস্বরে হেসে ওঠল। সেই হাসি থামছেই না। হাসির সাথে শরীরটাও এমনভাবে দুলছে, চাঁদনির মনে হলো ছেলেটা এখনই মাটিতে গড়াগড়ি খাবে! সে রে গে গেল। অধৈর্যও হয়ে পড়ল। হাসি থামার অপেক্ষা করতে পারল না। ধ মকে ওঠল,
” সমস্যা কী? আমি একটা প্রশ্ন করেছি। উত্তর তো দিচ্ছই না, উল্টো হেসে যাচ্ছ! আমার সাথে বেয়াদবি করো? এত সাহস! মুনছুরকে ডাকব? ”
পান্না হাসি থামাল মুখে হাত চেপে। অতঃপর বলল,
” আমি আপনারে ডরাই না। কিন্তু মহাজন জরুরি আলাপে বসছে। এখন ডাকলে বিরক্ত হইব, মেজাজ খারাপ হইব। এজন্য জোর কইরা হাসি থামাইলাম। ”
এই কথাটা শেষ করেও সে হাসছে। এবার শরীর দুলছে না। চাঁদনি কড়া চোখে তাকাল। রা গে তার অস্থিমজ্জায় জ্বালা ধরেছে। ইচ্ছে করছে, দাদিজানের মতো সটান চ ড় মেরে বসতে!
” যে কাজে আসলাম, সেটাই তো কওয়া হইল না। ভেতরে খবর দেন, মহাজন চা-নাশতা পাঠাইতে কইছে। ”
” পারব না। নিজের খবর নিজে দিয়ে নে। আমি এই বাড়ির মেহমান, তোর মতো কাজের লোক না। ”
সে রা গ দেখিয়ে, মুখ ফিরিয়ে নিল। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এলো। মূল দরজার কাছে পৌঁছাতে দেখল, স্বর্ণলতা এদিকে উঁকি মারছে। চোখে চোখ পড়তে মুখটা সরিয়ে নিল। দৌড়ে পালাবে, পূর্বেই চাঁদনি হাত ধরে ফেলল। বলল,
” উঁকি মেরে ব্যাটা মানুষ দেখিস? তোকে তো ভালো মনে করেছিলাম। ছি, মুনছুরের বউ! ”
সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
” আমি তো আপনার জামাইরে দেখার লাইগা উঁকি মারছিলাম। ঐটা আপনার জামাই না? ”
চাঁদনি নাক, মুখ কুঁচকে ফেলল। আরও একদলা থুথু ফেলে বলল,
” ওই আমার জামাই হতে যাবে কেন? শেয়ালের মতো বিচ্ছিরি দেখতে! আমার জামাই তো সালমান শাহ’র মতো সুদর্শন। মুখটা দেখলেই বুকটা শান্তি হয়ে যায়। ”
” আপনার জামাইয়ের নাম সালমান? দাদিজান যে, আসমান কইল? ”
চাঁদনি হতাশার নিশ্বাস ফেলল। সালমান ও আসমান যে দুটো আলাদা মানুষ, এটা বুঝানোর ধৈর্যও হলো না। সে অন্য কথায় চলে গেল,
” আমার জামাই ছাড়ো, তোমার জামাই চা-নাশতা নিয়ে যেতে বলেছে। ”
” আমারে নিতে কইছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” আমি তো ফ্রি নাই। দাদিজানের লাইগা গরম পানি করতে আইছি। ”
স্বর্ণলতা রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরল। অবসর থাকলেও তো চা-নাশতা নিয়ে যাবে না। যে তাকে ইচ্ছে করে বিপদে ফেলে, তার হয়ে সে কোনো কাজ করবে না। মা রলে, কা টলেও করবে না। চাঁদনি তার পিছু পিছু হাঁটছিল। রান্নাঘরের কাছে পৌঁছে, ডিঙিয়ে সামনে গেল। কলি ও ময়না দুজনেই উপস্থিত ছিল। একজন চা-নাশতা বানানোতে ব্যস্ত হলো। আরেকজন গরম পানিতে। স্বর্ণলতা পানি নিয়ে চলে আসবে, তখনই চাঁদনি বলল,
” মুনছুরের বউ, দেখ তো আমার সাজ ঘেটে গেছে নাকি। ”
গরম পানির ভাপ উপরে ওঠছে৷ তাপ লাগছে তার মুখে। সে মাথাটা কিঞ্চিৎ পেছনে সরিয়ে দাঁড়াল। পর্যবেক্ষকের ন্যায় তাকাল সামনের উচ্ছ্বসিতার দিকে। লিপস্টিকের রঙটা সামান্য হালকা হওয়া ছাড়া আর কিছুই পরিবর্তন হয়নি। কানে গুঁজে থাকা গোলাপ থেকে মিষ্টি সুবাসও ছড়াচ্ছে। স্বর্ণলতার এত ভালো লাগল, ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। গাঢ় করে নিঃশ্বাস টেনে বলল,
” না, সব ঠিকঠাকই আছে। নাশতা দেওনের সময় আপনার মুনছুরের কাছাকাছি দাঁড়াইয়েন। এবার রা গ করবো না। ”
চাঁদনি একই সাথে বিস্মিত ও সন্দেহে পতিত হলো। সুধাল,
” কী করে বুঝলে, রা গ করবে না? ইচ্ছে করে বদ বুদ্ধি দিচ্ছ না তো? বাইরের মানুষের সামনে চ ড় খাওয়ানোর পরিকল্পনা করছ? ”
” বদ বুদ্ধি না, চাঁদনিবু। আপনার কানে গুঁজা ফুল থেকে সুন্দর গন্ধ ছড়াইতাছে। আপনার মুনছুরের তো, ফুলের গন্ধ অনেক পছন্দ। ”
” তাই নাকি! কে বলল, এ কথা? মুনছুর বলেছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
স্বর্ণলতা উত্তর দিল না। গরম পানি নিয়ে ছুটল দাদিজানের রুমের দিকে। এখন হাতেও তাপ লাগছে তার! সহ্য করা যাচ্ছে না। ভাপে মুখটা ঘেমে গেছে। চোখেও জ্বালা হচ্ছে। কোল দুটি লাল হয়ে ওঠেছে। ঝাপসা দেখছে। দরজার কাছেও পৌঁছাতে পারল না। অসহণীয় যন্ত্রণায় চোখ বুঁজে এলো, হাতের জোর হারিয়ে গেল। গরম পানির পাতিলটা ফসকে গেল হাত থেকে। ঠিক তখনই জাদুকরের মতো উদয় ঘটল মুনছুর সাখাওয়াতের। ভূমিতে পতিত হওয়া পাতিলটি দুহাতে চেপে ধরল। নিজের কাছে সামলে নিয়ে বলল,
” গরম পানি টানতে মানা করেছিলাম না? এখনই তো পা দুটো পুড়ে যেত! ”
তার কণ্ঠে একাধারে শাসন, যত্ন। উদ্বেগ জড়ানো দৃষ্টি জোড়া স্থির হয়ে আছে, স্বর্ণলতার পায়ে। সেখান থেকে দৃষ্টি ছুটল চাঁদনির কণ্ঠস্বরে। সে ছুটে এসে বলল,
” কী করলে এটা? পানি ধরতে গেলে কেন? তোমার তো পাঞ্জাবি ভিজে গেল! ”
হঠাৎ জোরের সাথে পাতিল ধরতে গিয়ে পানি নড়ে ওঠেছিল। কয়েক ফোঁটা গিয়ে পড়েছে, তার পাঞ্জাবিতে ও পায়ের কাছে। মুনছুর সাখাওয়াত সেদিকে নজর দিল না। কঠিন চোখে তাকাল চাঁদনির দিকে। ক্রো ধে ফেটে পড়ে বলল,
” এই পানি তোর কাছে থাকার কথা না? স্বর্ণলতার কাছে গেল কীভাবে? বল, কীভাবে গেল? ”
সে কেঁপে ওঠল। কাঁপতে কাঁপতে উপলব্ধি করল, স্বর্ণলতার সামনে মানুষটা আরও বেশি হিং স্র হয়ে যায়। চোখদুটিতে জোর করেও তাকিয়ে থাকা যায় না। রা গ মিশ্রিত কণ্ঠস্বরটা এড়ানো যায় না। চাঁদনির বুকের ভেতরটা নড়ে ওঠে। সমস্ত সত্তাটা কেঁপে ওঠে। অথচ ছোট থেকেই সে এই রা গের সাথে পরিচিত, অভ্যস্ত।
মুনছুর সাখাওয়াত গরম পানির সবটা ঢেলে দিন চাঁদনির পায়ে। তার আ র্তনাদ, ম রণ কান্না কিছুই কানে পৌঁছাল না। সামান্যতম মায়া, দরদ দেখা গেল না মুখটায়। আহত ও যন্ত্রণায় কাবু হওয়া মেয়েটাকে রেখে নাশতা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
__________
” ডাক্তার, এত ভেবে কাজ নেই। চা, বিস্কুট খা। তারপর বল, আমাকে কী কী করতে হবে। ”
ডক্টর হাদি ভাবনা বাদ দিতে পারল না। চুপ করে আছে। চা, বিস্কুট কিছুতেই হাত দিচ্ছে না। নিষ্পলকে চেয়ে আছে সামনের চেয়ারে বসা মানুষটার দিকে। চেয়ে থেকেই প্রশ্নটা করল,
” আপনার কি বুকে সার্জারি হয়েছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন পেয়ে থমকে গেল। ঠোঁট সরিয়ে নিল চায়ের কাঁপ থেকে। ভ্রূযুগল বাঁকিয়ে দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল,
” না তো। কেন? ”
” সত্যি সার্জারি হয়নি? ”
” মুখের কথা বিশ্বাস হয় না? বুক আলগা করে দেখাতে হবে? ”
ডক্টর হাদি ব্যস্ততার সাথে বলল,
” না, না। আপনার মুখের কথাই বিশ্বাস করেছি। ”
” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? ফার্মেসি বসাতে হলে কি আমার বুকে সার্জারি করতে হবে? ”
” একদমই না। আমি প্রশ্নটা করেছি, অন্য কারণে। ”
” কী কারণ? ”
এবার সে চায়ের কাপে হাত দিল। বিস্কুটের পিরিচটাও কাছে টেনে নিল। একটা বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে বলল,
” আমি এমবিবিএস শেষ করে আপনার সাথে দেখা করেছিলাম। আমার হাসপাতালে চাকরি করার ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিলাম, বাসার কাছেই ব্যক্তিগত চেম্বার খুলে বসব। আপনি জানেন, সুয়াপুর ও কিতাবগড়সহ আরও দুটি গ্রামে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত ডাক্তার নেই। একজন হাতুড়ি ডাক্তার আছে। সে বসে বাজারের শেষ সীমানায়। তার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ নেই। এসব দেখার পর সিদ্ধান্ত নিই, আমার চেম্বারটা এমন জায়গায় বসাব যেখান থেকে চারটা গ্রামেই আমার যাওয়া-আসা সহজ হয়। সেই জায়গাটি ছিল, আপনার বাড়ির সামনে। খোলা জায়গাটা। আপনার সাথে আলাপে বসতেও চেয়েছিলাম। আপনি বসেননি, আমার প্রস্তাবটাকে গুরুত্ব দেননি। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনো ভাড়া হবে না। চাইলে কিনতে পারি। আমি কিনতে চেয়েও পারিনি। আপনি জমির দাম ধরেছিলেন দশগুণ বেশি! ঐ সময় আমার কাছে এত টাকা ছিল না। তাই পিছিয়ে গিয়েছি। অথচ আজ, আমাকে বাড়িতে ডেকে বিনামূল্যে সেই জমি দিতে চাচ্ছেন। অদ্ভুত না? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চায়ের কাপটা রাখল শব্দ করে। চোখ, মুখ কঠোর করে বলল,
” এসব বলে কী বুঝাতে চাচ্ছিস? তুই আমার প্রস্তাবে রাজি না? ”
” রাজি হব না কেন? ভালো কাজে হাদি সবসময়ই এগিয়েই থাকে। আমি তো কৌতূহলে আটকে গেছি, মহাজন। এই পরিবর্তনটা কীভাবে ঘটল সেটাই জানতে ইচ্ছে করছে। বুকে সার্জারি না হলে হৃদয়টা আসল কোথা থেকে? বীজটা কি এমনি একনি রোপন হয়ে গেল? ”
সে জবাব দিল না। মুখের কাঠিন্যভাবটা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি ফার্মেসি থাকলে যে, কতটা উপকার হয় এই উপলব্ধিটা আজ সকালেই হয়েছে। স্বর্ণলতার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে তাকে অনেক দূর যেতে হয়েছে, অনেকটা সময়ও লেগেছে। মেয়েটা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই পড়েছিল। না জানি, কতটা কষ্ট আর অস্বস্তিতে কাহিল হয়ে পড়েছিল! প্রথম রাতের ঘটনাটাও মনে পড়ে গেল। র ক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো, জ্ঞান ফিরে এসেছিল, অন্য কোনো সমস্যা হয়নি। যদি বড় কিছু হতো? এত রাতে সে ভালো ডাক্তার কোথায় পেত? জরুরি ঔষধের দরকার পড়লে কী করত? মুনছুর সাখাওয়াতের বুকের ভেতর অস্থিরতার উদ্রেক হলো। দুশ্চিন্তা বাড়ল। সে আনমনে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে আবারও রেখে দিল। আচমকা বলল,
” তোর জমি, টাকা-পয়সা কোনো কিছু নিয়েই চিন্তা করতে হবে না। সব আমি দেব। তুই শুধু সবসময় আমার বাড়ির কাছে থাক। তাহলেই হবে। ”
” সবসময় কী করে থাকব? আমি তো জেলা হাসপাতালেও রোগী দেখছি। ”
” বাদ দে। ওখানের থেকেও দ্বিগুণ বেতন দিব। ”
ডক্টর হাদি মতামত জানানোর সময় পেল না। এর পূর্বেই দাদিজান ছুটে এলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
” তোর বউ তো আবারও জ্ঞান হারিয়েছে! ”
মুনছুর সাখাওয়াত তড়িঘড়িতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেও, বাড়ির ভেতর গেল না। নিজ জায়গায় স্থির থেকে দাদিজানের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” জানি না। আমি ওযু শেষ করে, তোর বউকেও পাঠালাম ওযু করতে। গোসলখানার দরজার কাছে গিয়েই পড়ে গেল! ”
সে চেয়ারটায় বসল। পেছনে হেলান দিয়ে ভীষণ শান্তভাবে বলল,
” এত ভ য় পাওয়ার কিছু নেই, দাদিজান। ডাক্তার তো বাড়িতেই আছে। তুমি ওর কাছে যাও, ডাক্তার আসছে। ”
তিনি কিছুদূর এগুতে মুনছুর সাখাওয়াত ডাক্তারের দিকে তাকাল। নিচু স্বরে বলল,
” রোগীকে ছোঁয়ার দরকার নেই। দরজার কাছ থেকে দেখে বলে দিবি, শরীর খুব দুর্বল। বিশ্রাম নিতে হবে। টানা সাতদিন বিছানায় শুয়ে, বসে থাকলেই সুস্থ হয়ে যাবে। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৫)
ড. হাদি দাদিজানের রুমে ঢুকে দেখল, চাঁদনি বিছানায় বসে কাঁদছে। অবিরত অশ্রুতে তার কাজল ল্যাপ্টে গিয়েছে। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, চুল এলোমেলো। কানের ফুল দুটির মধ্যে একটিতে পাপড়ি নেই।
” ঐদিকে কী দেখ? আমার নাতবউ নিচে। গোসলখানার দরজার কাছে পড়ে আছে। ”
দাদিজানের নির্দেশনায় সে গোসলখানার কাছে পৌঁছাল। কিশোরী দেহ, মুখটার সিংহভাগ ঢাকা আঁচল দিয়ে। ড. হাদি পেছন ফিরল। শক্ত গলায় প্রশ্ন করল,
” কখন জ্ঞান হারিয়েছে? এখনও নিচে পড়ে আছে কেন? উপরে তোলার ব্যবস্থা করুন। ”
” কে তুলবে? নিজের শরীর নিজেই তো বয়তে পারি না। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে পড়ি! ”
খাইরুন নিসা বিছানায় বসে পড়লেন। ড. হাদি বিস্মিত নেত্রে চেয়ে দেখল, তিনি ধপাস করে শুয়ে পড়লেন। জোরে জোরে শ্বাস টানছেন ও ফেলছেন। সেই অবস্থায় দুর্বল ও ক্ষীণ স্বরে বললেন,
” রোগী দেখা শেষ হলে আমাকে একটু পানি দিও, ডাক্তার। বুকটা শুকিয়ে গেছে! ”
বিছানার কাছেই একটি ত্রিকোণাকৃতির উঁচু টেবিল। তার উপরে পানি ভর্তি একটি জগ ও খালি গ্লাস। ড. হাদি দ্রুত হস্তে পানি ঢালল। দাদিজানের কাছে গ্লাস পৌঁছে দিয়ে বলল,
” বাড়িতে আর কেউ নেই? এভাবে নিচে পড়ে থাকলে তো…”
কথা শেষ হলো না। দাদিজান পানি খাওয়া বন্ধ করে প্রত্যুত্তর করলেন,
” যার বউ সে মুখ ফিরে দেখল না, আর কে ধরবে? এই বাড়িতে পুরুষ মানুষ ঢোকা নিষেধ। তুমি ডাক্তার, মুনছুরের অনুমতিতে ঢুকতে পেরেছ। ”
ড. হাদি বিভ্রান্তে পড়ে গেল। ধীরগতিতে হেঁটে এলো স্বর্ণলতার কাছে। নিথর দেহটা শ্বাস-প্রশ্বাসও টানছে না! এভাবে ফেলে চলে যাওয়া যায়? নিজের পেশা, বিবেক উভয়ের কাছে নিচু হয়ে যাবে যে! সে মুনছুর সাখাওয়াতের আদেশ অমান্য করল। প্রথমে স্পর্শ করল, স্বর্ণলতার হাতের কব্জি অংশ। অতঃপর মুখ থেকে আঁচল সরাল। বন্ধ চোখের পাতা টেনে ধরে বলল,
” স্বর্ণা, তোমার চোখে স্বপ্ন ভাঙার দুঃখ নেই কেন? ”
স্বর্ণলতা উভয় চোখ মেলল। সচকিত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে ডাক্তারের মুখপানে। সহসা উঠে বসল। পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিচু সুরে বলল,
” স্বপ্ন ভাংগে নাই, তাই দুঃখও নাই। ”
” ভাঙেনি বলছ? ”
” হ। বিশ্বাস হইতাছে না?
” আগে বলো, তুমি কি মহাজনের স্ত্রী? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। মুখের মধ্যে মেঘের ছায়া পড়ছে। ড. হাদি হতাশ স্বরে বলল,
” বিশ্বাসের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার পা এমন শেকলে বাঁধা পড়েছে, যেটা ভাঙা অসম্ভব। ”
সে দুই হাত সামনে আনল। পাশাপাশি রেখে ভীষণ উৎসাহের সাথে বলল,
” হাত দুইটা তো খোলা আছে। শেকল ভাঙার দরকার নাই, চাবি দিয়া তালা খুইলা দৌড় দিমু। ”
ড. হাদি মৃদু হাসল। স্বর্ণলতার মুখটায় চেয়ে থেকে বলল,
” তোমার এই বলতে পারার সাহসটা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে! ”
সে চট করে উঠে দাঁড়াল। মুনছুর সাখাওয়াতের বলে দেওয়া কথাটা দাদিজানকে শুনিয়ে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ শুনতে পেল,
” হাদিভাই? চাঁদনিবু রে দেখবেন না? উনার পা দুইটা পুইড়া গেছে! ”
ড. হাদি ফেরত যেতে পারল না। চাঁদনির কাছে এগিয়ে গেল। পা দুটো লাল হয়ে গিয়েছে, ফোসকা পড়াও শুরু হয়েছে। সে দ্রুত ঠাণ্ডা পানি, পরিষ্কার কাপড় ও কাঁচা মধু এনে দিতে বলল। দাদিজান ক্লান্ত ও দুর্বল। স্বর্ণলতাকেই ডাক্তারের চাওয়া পূরণ করতে হলো। কলিকে দিয়ে পানি ও মধু আনাল। ড. হাদি পোড়া পায়ে বিশ মিনিটের মতো ঠাণ্ডা পানি ঢালল। তারপরে নরম ও পরিষ্কার কাপড়টি দিয়ে ড্রেসিং করল। সবশেষে কাঁচা মধু লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় দেখা হলো, মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে। তার শুকনো, মায়া শূণ্য চোখজোড়ায় চেয়ে বলল,
” আপনার ইচ্ছেটা আমি রাখব। কিন্তু আমার দুটো শর্ত আছে। ”
” আমাকে শর্ত শুনাতে চাস? আমাকে? ডাক্তার, তোর বুকে তো ভালোই সাহস জমেছে। বাড়িতে ডেকে আনতে না আনতেই মাথায় উঠতে শুরু করেছিস! ”
” আপনার মাথায় উঠার ইচ্ছে বা রুচি কোনোটায় নেই। দুটো শর্ত শুনলে যদি আপনার মান চলে যায়, তাহলে শুনবেন না। আমি জোর করছি না। হাতে, পায়েও ধরছি না। ”
ড. হাদি তাকে পাশ কাটিয়ে উঠোনে নামল। মূল ফটকের দিকে হাঁটা ধরতে মহাজন ডেকে ওঠল,
” ঐ দাঁড়া। আমার ডাকে এসেছিস। কথা শেষ হবে, তারপরে যাবি। এত তাড়া কিসের? পায়ে খুব জোর? ভে ঙে দিলে, এই উঠোনে পড়ে থাকবি! ”
সে দাঁড়াল ভীষণ অনিচ্ছায়। মুখটা কঠোর, দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো। মুনছুর সাখাওয়াত তার কাছে এগিয়ে বলল,
” তোর শর্ত দুটো শুনা। ”
ড. হাদি শুনানোর জন্য ঠোঁট দুটি কেঁপে ওঠতে সে সতর্ক করল,
” তোকে খুশি করতে শর্ত শুনছি। আবার ভাবিস না, আমি শর্ত পূরণও করব। ”
” আপনাকে পূরণ করতেই হবে, মহাজন। নাহলে আমি বাড়ির কাছে চেম্বার খোলা তো দূর, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে ভুল করে চেয়েও দেখব না। ”
” তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস! ”
ড. হাদি তার হু মকি পাত্তা দিল না। র ক্তবর্ণ চোখদুটিতে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
” সম্মান দিয়ে কথা বলুন। বয়সে আপনার চেয়ে ছোট হলেও, পেশায় অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আমার প্রথম শর্ত, আজকে এই মূহুর্ত থেকে আমাকে আপনি সম্বোধন করে কথা বলবেন। দ্বিতীয় শর্ত, আপনার থেকে কোনো টাকা-পয়সা লাগবে না। জমিটার যতটুকু অংশ ব্যবহার করব, ততটুকুর ন্যায্য ভাড়া দিব। তাহলে পরবর্তীতে আমার কাছে আসলে, আমাকে গোলাম নয় ডাক্তার মনে হবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কিছু একটা বলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেছিল, পারল না। ড. হাদি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” যদি শর্ত দুটো রাখতে পারেন, তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। অন্যথায় বিরক্ত করবেন না। হালাল উপায়ে টাকা রোজগার করা অনেক কঠিন। সেই কঠিন কাজটা আমি করি। দয়া করে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। ”
________
চাঁদনি ও স্বর্ণলতা নিজেদের রুমে, পাশাপাশি শুয়ে আছে। সহসা চাঁদনি প্রশ্ন করল,
” ঐ ডাক্তারটা কি তোমার প্রেমিক? ”
স্বর্ণলতা আকাশ থেকে পড়ল যেন! দুইগালে দ্রুত হাত ছুঁয়ে বলল,
” তওবা, তওবা, কী কন এসব! উনি আমার প্রেমিক হইতে যাইব ক্যান? ”
” তাহলে কী হয়? ”
” কিছুই না। দেখা হলে, ভাই বলে ডাকি। ”
” আমার সাথে মিথ্যা বলবে না। তোমরা ফিসফিস করে যে, ভালোবাসার কথা বলেছ, আমি সব শুনেছি। ”
” মিথ্যা তো আপনি কইতাছেন, চাঁদনিবু। আমরা কোনো ভালোবাসার কথা কই নাই। ”
” তাহলে কীসের কথা বলেছ? আদর, সোহাগের কথা? বাপ রে, তুমি তো আমার থেকেও এগিয়ে! আমি প্রেমিক হওয়ার পর, আদর সোহাগে গেছিলাম। তুমি তো প্রেমিক হওয়ার আগেই আদর, সোহাগে চলে গেছ! মুনছুরের বউ, সত্যি করে বলো। তুমি কি ডাক্তারের সাথে শুয়েছ? ”
স্বর্ণলতা উঠে বসল। প্রচণ্ড বিরক্তের সাথে বলল,
” আপনি সবসময় বেশি বেশি ভাবেন। হাদিভাই, আমার বান্ধুবীর ভাই। ওরা অনেক বড়লোক। ঐ বাড়ি যাইতে আমার শরম লাগে। বান্ধবী একবার জোর কইরা নিয়া গেছিল। হাদিভাইয়ের লগে পরিচয়ও করাইয়া দিছিল। পরিচয়ের সময়, আমার স্বপ্নের কথা জিগাইছিল। সেই স্বপ্নের কথা হইতাছিল তখন। বুঝছেন? ”
সে খাট থেকে নেমে পড়ল। ধুপধাপ শব্দে দরজার কাছে পৌঁছাতে শুনল,
” কোথায় যাও? ডাক্তার না বলল, সাতদিন বিছানায় শুয়ে, বসে বিশ্রাম নিতে? ফেরত আসো। নাহলে কিন্তু দাদিজানকে ডাক দিব। ”
নিতান্ত বাধ্য হয়ে স্বর্ণলতা খাটে উঠে বসল। চেপে গেল জানালার কাছে। চাঁদনিকে অসহ্য লাগছে, বাইরের এই ঝাপসা অন্ধকারটাকেও অসহ্য লাগছে। কথা বলবে না সে। কারও সাথে কথা বলবে না। এই বাড়িতে এমন একটা মানুষও নেই, যার কাছে শান্তিতে দুই দণ্ড বসা যায়, একটু কথা বলা যায়। সে কোথায় এসে পড়ল! এখান থেকে বেরুনোর রাস্তাটা কোনদিকে?
________
ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে দাদিজান স্বর্ণলতাকে দেখতে এলেন। তার হাতে একটি কাঠের বাক্স। ঢাকনা খুলে নাতবউয়ের দিকে বাড়িয়ে বললেন,
” এই যে, তোমার সম্পদ। লুকিয়ে রাখ। ”
স্বর্ণলতা বাক্সটা নিল ভীষণ অনাগ্রহে। এই বাক্স, বাক্সের ভেতরের দামি গয়না কোনো কিছুতেই তার লোভ নেই। সামান্যতম আসক্তিও সৃষ্টি হয়নি। সে জিজ্ঞেস করল,
” লুকিয়ে রাখতে হবে? ”
খাইরুন নিসা তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না৷ এক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন চাঁদনির পানে। আচমকা বসে পড়লেন প্রশ্নকর্ত্রীর কাছে। খানিকটা গা ঘেষে, কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,
” মেয়েদের মূল্যবান দুটি সম্পদ হলো গয়না ও স্বামীর ভালোবাসা। এই সম্পদ দুটো সবসময় লুকিয়ে রাখবে। ভুল করেও অন্য কোনো মেয়ের সামনে খুলে রাখবে না৷ তাহলেই চুরি হয়ে যাবে। ”
স্বর্ণলতা হতভম্ব হয়ে গেল। গয়না চুরি হওয়ার ঘটনা সে শুনেছে। কিন্তু স্বামীর ভালোবাসা! এটা চুরি হবে কী করে? ভালোবাসা কি ছোঁয়া যায় নাকি বিক্রি করা যায়? তার ইচ্ছে হলো, দাদিজানকে জিজ্ঞেস করে। পরক্ষণে কৌতূহলটা দমিয়ে ফেলল। ততক্ষণে তিনি উঠে সরে গিয়েছেন। স্বর্ণলতা হাতের চুড়ি খুলল। কানের দুলে হাত দিতেই দাদিজান বললেন,
” এখনই ফেরত দেওয়া লাগবে না৷ পরেই ফেলেছ যখন, কিছুদিন থাকুক। ”
চাঁদনির দিকে চেয়ে পুনরায় বললেন,
” দুজনেই তো অসুস্থ! কে, কাকে দেখবে? আমি কলিকে বলেছি, এই ঘরে ঘুমাতে। কিছু লাগলে, ও দিবে। ”
খাইরুন নিসা চলে গেলেন। স্বর্ণলতা খুলে ফেলা চুড়িগুলো পরল না। গয়নার বাক্সে রেখে দিল। ঢাকনা বন্ধ করবে, তখনই নজর পড়ল চাবির গোছাটায়। সাথে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজও আছে। সে চাবিটা হাতে নিল, পরিচিত লাগছে। কোথাও দেখেছে! কোথায় দেখেছে, মনে পড়ছে না এখন। সে কাগজটাও হাতে নিল। ভাঁজ খুলতেই এক লাইনের লেখাটি চোখে পড়ল,
‘ তুমি কি আমার আদুরী হবে? ‘
তার ভ্রূযুগল আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। মনে হলো, এই নামটার সাথেও সে পরিচিত অথচ মনে পড়ছে না। হঠাৎ করে স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল হয়ে গেল কী করে?
” কী ওটা? দেখি? ”
চাঁদনি হাত বাড়িয়ে নিতে চাইল, পারল না। স্বর্ণলতা চট করে দূরে সরিয়ে নিল। পরক্ষণে সুযোগ বুঝে বাক্সে ফেলে দিল। বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে শিয়রের কাছে রাখতে খেয়াল হলো। মনে পড়ল দাদিজানের মাত্রই বলে যাওয়া কথাটি। যা সে চেতন অবস্থায় উপেক্ষা করলেও, অবচেতনে মনের ভেতর গেঁথে ফেলেছে। এই সময় কলি ভেতরে ঢুকল। তার কাঁখে শীতল পাটি ও একটি বালিশ। পাটি বিছিয়ে বালিশ রেখে জিজ্ঞেস করল,
” দরজা কি আটকাইয়া দিমু? ”
চাঁদনি উত্তর দিল,
” না। ”
” আপনাগো কিছু লাগব? ”
” না। তুই চুপচাপ ঘুমাত। বিরক্ত করছিস কেন? দেখছিস না আমার পা পু ড়ে গেছে? ”
কলি নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিপরীত পাশে কাঁত হয়ে বিড়বিড় করল, ‘ আহা রে, কী আহ্লাদ! পায়ে গরম পানি পড়ছে তাতেই জবান বন্ধ হইয়া যায়। আগুন পড়লে তো শ্বাসই বন্ধ হইয়া যাইব! ‘
স্বর্ণলতাও শুয়ে পড়েছিল। হঠাৎ উঠে বসল। চাঁদনিকে ডিঙিয়ে উঁকি মারল নিচে। হালকা গলায় সুধাল,
” কলিবু, তোমাগো মহাজন কি ঘরে? ”
” হ, ঘরেই তো। ”
সে একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমার একটা কাম কইরা দিবা? ”
” কী কাম? ”
কলি উঠে বসল। স্বর্ণলতা ঘাড় ফেরাতে দেখল, চাঁদনি তার দিকে চেয়ে আছে। কৌতূহল দৃষ্টি! তাকে উপেক্ষা করে কথা এগিয়ে নিল,
” একটা কাগজ আর কলম আইনা দিবা? ”
” এহন কাগজ, কলম কই পামু? ”
” তোমার কাছে নাই? ”
” না। ”
স্বর্ণলতা ও কলি একই সাথে চাঁদনির দিকে তাকাল। মুখ ফুটে কিছু বলতে হলো না। পূর্বেই সে জানাল,
” আমি কি স্কুলে পড়ি যে, কাগজ-কলম নিয়ে ঘুরব। ”
দুজনে আশাহত হলো। যে যার বালিশে ফেরত যেতেই শুনল,
” দাদিজানের কাছে থাকতে পারে। ”
কলি বলল,
” উনি ঘুমাইছে। এহন ডাকলে রা গ করব। চ ড়ও মা রতে পারে! ”
স্বর্ণলতা তার সাথে সহমত পোষণ করল। চাঁদনির এই বিষয়ে আগ্রহ না থাকলেও উঠে বসল। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
” মুনছুর জেগে আছে। ওর কাছে কাগজ, কলমও থাকবে। তোমরা অপেক্ষা করো, আমি নিয়ে আসছি। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৬)
চাঁদনি বেরিয়ে যেতেই স্বর্ণলতা উপুড় হলো। খাটের কিনারে থুতনি গেড়ে মনোযোগী হলো কলির দিকে। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কলিবু, এই বাড়িতে কত দিন ধইরা আছ? ”
” পাঁচ, ছয় বছর তো হইবই। ”
স্বর্ণলতা একটুক্ষণ চুপ হলো। গভীর চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছে, সহসা প্রশ্ন করল,
” তোমার ছারের আরেকটা বউ আছে না? উনার নাম কইতে পারবা? ”
কলি চমকে ওঠল। বিস্ময়ের আভা ছড়িয়ে পড়ল সম্পূর্ণ মুখটায়। চোখের আকার অস্বাভাবিক, মনিজোড়া কালো মারবেলের মতো চকচকে, পলকহীন দৃষ্টি। যেন ভারি আশ্চর্যের গোপন খবর শুনে ফেলেছে! খানিকক্ষণ স্তম্ভিত থেকে সুধাল,
” ছারের আরও একডা বউ আছে? ”
প্রশ্নের উপরে প্রশ্ন পড়ায় স্বর্ণলতা সামান্য বিরক্ত হলো। ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। থুতনিটা তুলে সোজা হয়ে বসল। এই বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছে ও আগ্রহ উভয়ে মরে গেছে। সে নিজের বালিশে ফিরে যাচ্ছিল, যাওয়া হলো না। কিসে যেন আটকাল! কৌতূহলটা নতুন উদ্যমে জাগ্রত হলো। কলির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,
” জানো না? ”
সে দ্রুত মাথা নেড়ে উচ্চারণ করল,
” না। ”
” তাইলে যা জানো, তাই কও। ”
কলির মুখের আভা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে চট করে একবার দরজা ও জানালার দিকে চোখ বুলিয়ে এনে বলল,
” সত্যি কমু? ছার যদি জানতে পারে? আমার গ লা চিপ্পা ধ রবো। ”
সে কথার মাঝে নিজ হাতে গলা চিপে ধরল আলগাভাবে। ভয়ার্ত দেখাচ্ছে চোখদুটি। স্বর্ণলতা আস্বস্তের সুরে বলল,
” ধরবো না। তুমি তো অন্য কাউরে কইতাছ না। তার বউরেই কইতাছ। ”
শেষ বাক্যটা সোনামুখি সুঁইয়ের মতো ফুঁড়ল মস্তিষ্কে। বিদ্যুৎ প্রভার মতো আলোকিত হলো বক্ষের অন্দর মহল। শিলাবৃষ্টির মতো প্রশ্নটা গড়িয়ে পড়ল সেই আলোকিত অন্দরমহলের আচ্ছাদনে, ‘ আমি কি অবচেতনে তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিলাম! ‘
” আমি যহন এই বাড়ি আহি, তহন ছারের বাপ বাইচা ছিল। নিয়ম কইরা রাইতের খাবার খাইত একলগে। খাইতে বইয়া ছারের বিয়ার কথা তুলত। এই নিয়া পরতিদিনই রা গারাগি হইত। ”
” কে রা গ করত? ”
” ছার, ছারের বাপ দুইজনেই। ছারের বাপ কইত, এহন বিয়া কর। ছার কইত, পরে করবো। এই নিয়াই কথা কাটাকাটি হইত। দাদিজান কাউরেই থামাইতে পারত না। মাঝখান থেইকা ধ মক খাইত। একদিন রা গারাগি বন্ধ হইল। ছার বিয়ার জন্য রাজি হইল। সক্কাল বেলা বাপের লগে বাইরও হইল। কিন্তু ফেরত আইল না। পরের দিন হকালে, দাদিজানও বাইর হইয়া গেল। কাহিনি কী তহনও বুঝতে পারি নাই। বৈকালে, আবুল কাকারে ধরার পর জানতে পারছি, ছারের বাপ নাই। ম ইরা গেছে। ছারেও হাসপাতালে ভর্তি। ”
” এই ঘটনা কত বছর আগে? ”
” তিন, সাড়ে তিন বছর হইব। ঠিক হিসাব কইতে পারমু না, রানিসাহেবা। আমি হিসাবে মেলা কাঁচা! ”
স্বর্ণলতা তার দিকে এগিয়ে এলো। সাগ্রহে সুধাল,
” সেই বিয়ার কী হইল? বউ নিয়া আসে নাই? ”
” বউরে তো আনতে দেহি নাই। বিয়ার ব্যাপারেও কিছু হুনি নাই। তয় বাতাসে একটা খবর উইড়া বেড়াইছিল। ”
” কী খবর? ”
কলি তাৎক্ষণিক উত্তরটা দিল না। সতর্ক দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনল, খোলা দরজা ও জানালার কাছ থেকে। অতঃপর মুখটা জিরাফের মতো লম্বা করে স্বর্ণলতার দিকে এগিয়ে নিল। ফিসফিসের মতো বলল,
” এই বিয়ার খবরটা ভুয়া। ছার নাটক সাজাইয়া বাপে রে নিয়া গিয়া খু ন করছে। কেউ যাতে টের না পায়, সেই জন্য নিজের শরীর জখম কইরা হাসপাতালে ভর্তি হইছে। ”
স্বর্ণলতা ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠল। স্পষ্ট টের পেল, তার শিরদাঁড়া বেয়ে বরফের মতো শীতল কিছু বেয়ে নামছে। সে ভীত ঢোক গিলে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল,
” নিজের বাবা রে খু ন করছে? ”
” হ। নিজের স্বার্থের লাইগা ছার সব করতে পারে। ”
” বাবারে মাইরা কোন স্বার্থ উদ্ধার করছে? ”
কলি মুখটা সরিয়ে নিল। গম্ভীর কিন্তু অনাস্থার সাথে বলল,
” ঠিক কারণটা তো কইতে পারুম না। একেকজন একেকটা কয়। তয় আমার মনে হয়, বাপের উপর ছারের মেলা রা গ ছিল। তার মইধ্যে, ছারের ব্যপসা বন্ধ করার লাইগা উইটাপইড়া লাগছিল। ”
স্বর্ণলতা এখানে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারল না। চাঁদনির পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। দুজনেই চট করে দূরত্ব বাড়িয়ে চুপ হয়ে যেতে শুনল,
” মুনছুর তো ঘরে নেই। দরজায় তালাও নেই। কোথায় যে গেছে, আল্লাহই জানে! আমি পুরা বাড়ি খুঁজে এলাম। ”
সে খাটের উপর বসল। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে বলল,
” তোমার কি কাগজ-কলম খুব দরকার? ”
এই উত্তরটাও দেওয়ার সময় পেল না। চাঁদনি অতি দ্রুত বলল,
” মুনছুরকে একটা কল দিই। বাইরে থাকলে বলব, তোমার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে আসতে। ”
সে ভ্যানিটি ব্যাগের চেইন খুলল। স্বর্ণলতা অবাক হয়ে দেখল, চাঁদনি ছোট্ট একটা শক্ত যন্ত্র বের করছে। সেটা আবার ভাঁজ করা ছিল। ভাঁজ খুলতেই দুই সেকেন্ডের একটা সুরেলা ধ্বনি বাজছে। সে চুপ থাকতে পারল না। প্রশ্ন করল,
” আপনার কাছে মোবাইলও আছে? ”
চাঁদনি মোবাইল টিপছিল। প্রশ্ন শুনে তার দিকে তাকাল। দারুন ভঙ্গিতে হেসে বলল,
” হ্যাঁ, মুনছুর দিয়েছে। ”
সে চট করে স্বর্ণলতার দিকে ঘুরে গেল। রসিয়ে রসিয়ে বলল,
” আমার যেদিন বিয়ে হলো? সেদিনই দিয়েছিল। অনেক ভালোবাসে তো! কথা না বলে থাকতে পারবে? তাই এই মোবাইলটা উপহার দিয়েছিল। আমাদের তো রোজ কথা হয়। প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা, আদরের কথা। তুমি শুনবে? ”
স্বর্ণলতা উত্তর দেওয়ার পূর্বেই আবারও বলল,
” একদিন সময় করে শুনাব। আমি সব রেকর্ড করে রেখেছি। ”
কথার ফাঁকে মুনছুর সাখাওয়াতের নাম্বারে ডায়াল করেছিল। রিং হয়নি, কলটা ঢুকছে না পর্যন্ত। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে বলল,
” নেটওয়ার্ক নেই। দাঁড়াও, এখনই কল ঢুকবে। ”
সে বিছানা থেকে নামল। জানালা খুলে দিল। মোবাইলটা খোলা জানালায় গলিয়ে দেওয়া মাত্র একটি শক্ত হাত তার কনুইর কাছাকাছি অংশটা চেপে ধরল প্রথমে। তারপরে অন্যহাতটা জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে চাঁদনির চুলের মুঠি চে পে ধরল। ব্যথা ও যন্ত্রণায় আ র্তনাদ বেরিয়ে আসতে শুনল,
” এই মোবাইলটা কে দিয়েছে? বল, কে দিয়েছে? ”
তার হিং স্র আ ক্রমণ ও কণ্ঠস্বরে স্বর্ণলতা ও কলি উভয়ে কেঁপে ওঠল। চাঁদনি ছুটার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কলি পাটি থেকে নেমে সিঁটিয়ে আছে দেয়ালের কাছে। স্বর্ণলতা বিছানার চাদর খামচে ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, মুনছুর সাখাওয়াতের হাতে। যেটা চাঁদনির চুলের মু ঠি ধরে আছে শক্ত করে!
” জবাব দে। নাহলে আজকে প্রাণটা বের করেই ছাড়ব। শা-লীর বেটি! মুখ খুললেই মিথ্যা বের হয়, না? জান কবজ করে ফেলব একদম। অনেক জ্বালাচ্ছিস! ”
হু মকির সাথে আঘাতও চলছে পালা করে। মাথাটা দুম করে বাড়ি খাওয়াতে জবাব এলো,
” দাদিজান দিয়েছে। এবার ছাড়ো, লাগছে। ”
তার আকুতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর, অশ্রুতে ভেসে যাওয়া চোখ দুখানায় মুনছুর সাখাওয়াত সামান্যতম গলল না। তেজি, ক্রো ধে ফেটে যাওয়া কণ্ঠস্বরটা আবারও বাজল,
” দাদিজান মোবাইলটা কাকে দিয়েছে? ”
চাঁদনি এবার সময় নিল না। ব্যথাতুর কণ্ঠে দ্রুত প্রত্যুত্তর করল,
” আসমানকে দিয়েছে। ”
” এই মোবাইল দিয়ে আমার সাথে কখনও কথা হয়েছে? ”
” না। একবারও হয়নি। ”
” রেকর্ড আছে কিছু? ”
” নেই। কিছু নেই। আমি মিথ্যা বলেছি, ছাড় এবার। সব স্বীকার করেছি তো! ”
মুনছুর সাখাওয়াতের হাতের মুঠো আরও শক্ত ও দৃঢ় হলো। মাথাটা আরেকবার বা ড়ি খায়িয়ে বলল,
” ভাই বল। মুনছুর ভাই বল, এখনই। ”
চাঁদনির জবাব এলো না। ছুটতে চাওয়ার চেষ্টায় সকল বল ক্ষয় করে ফেলেছে এমনভাব। কণ্ঠ ও শরীর উভয় নিস্তেজ হয়ে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াতের এসবে খেয়াল নেই। ভীষণ অধৈর্য ও নিষ্ঠুরের মতো আরও একবার মাথাটা বা ড়ি খাওয়ানোর জন্য উদ্যত হলো। ঠিক তখনই স্বর্ণলতার হাতের ছোঁয়া পেল। নরম ও কোমল স্পর্শ! সে হাতের মুঠো ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ও বলছে,
” ছাড়েন। উনি মইরা যাইব তো! ছাড়েন কইতাছি। ”
সে ছেড়ে দিল। চাঁদনির শরীরটা মাটিতে পড়ে গেল। স্বর্ণলতা তার উপর ঝুঁকে ডাকতে লাগল। কলির উদ্দেশ্যে ব্যস্তভাবে বলল,
” পানি আনো। জ্ঞান আছে এখনও। ”
তারপরে গরম চোখে তাকাল জানালার দিকে। কাঠখোট্টা বদনের র ক্তলাল চোখজোড়া তার দিকেই চেয়ে আছে। পলকহীন দৃষ্টি! র ক্ত থাকলেও তেজ নেই। স্বর্ণলতা ধ মকের মতো বলল,
” চাঁদনিবুর যদি কিছু হইছে, আপনার খবর আছে। আযরাইল একটা! এভাবে কেউ কাউকে মা রে? আপনার মধ্যে কি আল্লাহ একটুও দয়া-মায়া দেয় নাই? ”
কলি পানি নিয়ে এসেছে। স্বর্ণলতা জোর করে একটু পানি খাওয়াল। গ্লাস থেকে পানি নিয়ে চাঁদনির মুখটা ধুয়ে দিল, চুলটা ভেজাল। এই সেবাশুশ্রূষার মধ্যে এক ঝলক তাকাল জানালার দিকে। নির্দয় মানুষটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে আবারও আদেশের সুরে বলল,
” কলিবু, জানলাটা লাগাও তো। ”
সে দূরে ছিটকে গেল। কাঁপা কাঁপা স্বরে জানাল,
” আমার ডর করে। ”
স্বর্ণলতা নিজেই উঠে গেল। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে না তাকিয়ে জানালা আটকে দিল।
__________
চাঁদনির জ্বর এসেছে, মুখ পুরো ফুলে গেছে। স্বর্ণলতা সারারাত সজাগ ছিল, ভোরে দাদিজান ঘরে আসতে সে কেঁদে ফেলল। খাইরুন নিসা কিছু বুঝে উঠার আগেই, সে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরল। কান্নারত অবস্থায় বলল,
” আমার ভয় করতাছে, দাদিজান। আযরাইলটা একদিন, আমারেও মাইরা ফেলাবো। আমারে বাঁচান। ”
কলি দরজা খুলে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। দাদিজান তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? আমাকে সব খুলে বল। ”
সে ধীরে ধীরে সবটা খুলে বলল। খাইরুন নিসা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না। স্বর্ণলতাকে নিজের থেকে ছাড়ালেন না। অনেকটা সময় নীরব দাঁড়িয়ে থেকে হাত রাখলেন, স্বর্ণলতার চুলে। স্নেহার্দ গলায় বললেন,
” মায়ের কাছে যাবি? ”
সে মাথা তুলল। অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া মেলে মাথা উপর-নীচ করল। দাদিজান চোখ মুছে বললেন,
” এখনই যেতে চাস? ”
” হ। ”
” ঠিক আছে। চল, আমি যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ”
স্বর্ণলতা দাদিজানের সাথে হাঁটা ধরলেও, ঘর থেকে বেরুতে পারল না। দরজার কাছে পৌঁছে, আচমকা পেছন ফিরল। জ্বরে কাতর চাঁদনির দিকে চেয়ে বলল,
” উনারে ডাক্তার দেখানো লাগবো। শরীর আগুনের মতো গরম। চোখ, মুখ ফুইলা গেছে। চাইয়া থাকতে পারতাছে না। ”
খাইরুন নিসা অসহায় মুখে বললেন,
” ডাক্তার ডেকে আনার ক্ষমতা আমার নেই। তাছাড়া চাঁদনিকে হাজার নিষেধ করার পরও, মুনছুরের পেছনে লাগছে। মনে হয় না, মুনছুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে দিবে। ”
” আপনি কইলেও দিবে না? ”
” না। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত চুপ থাকল। সহসা বলল,
” আমি কইলেও, দিবো না? ”
” সঠিক বলতে পারছি না। তুমি বলে দেখতে পারো। ”
” উনি কি ঘরে? ”
” না। আযানের সাথে সাথে বেরিয়েছে। তোমার জন্য একটা খাতা আর কলম দিয়ে গেছে। ও বাড়িতে নেই, এই সুযোগে তোমাকে বাড়ি পাঠাতে পারব। ”
” কখন ফিরবেন, কইয়া গেছে? ”
” দুপুরের দিকে ফিরবে। মুনছুর চলে এলে কিন্তু তুমি মায়ের কাছে যেতে পারবে না। এখন ভাবো, কী করবে। মুনছুরের জন্য অপেক্ষা করবে নাকি মায়ের কাছে যাবে। ”
তিনি ঘর থেকে বেরুলেন। খাবার টেবিলের কাছে একটি দেয়ালঘড়ি আছে। সেখানে চেয়ে বললেন,
” আমি নামাজ পড়তে গেলাম। তুমি এই সময়টা ভাবো। তারপর আমাকে জানাও, কী করতে চাও। ”
চলবে