মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৩১+৩২+৩৩+৩৪

0
841

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩১)

উঠোনে ভারী কিছু পতনের শব্দ হলো। স্বর্ণলতা ভীষণ চমকে ওঠল। সম্পূর্ণ দেহ কেঁপে ওঠে স্থির হতে পারল না। তন্মধ্যে কলি ছুটে এসে বলল,
” পান্নাভাই কারে যেন ধইরা আনছে। ছারেরে খবর দিতে কইছে। ”

তার কণ্ঠ অতিশয় ভীত ও শঙ্কিত। স্বর্ণলতা চোখ বুঁজেই কথাগুলো শুনল। তার বুকের ভেতরের ঢিপঢিপে ধ্বনি কমার বদলে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। নিজেকে সামলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিমগ্ন, ঠিক তখনই রূক্ষ ও উগ্র কণ্ঠটা ঘণ্টার ধ্বনির মতো তীব্র হয়ে বাজল,
” শবনম? সুকুমারের পাওনা কত? ”

শবনম বেগম মেয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাথায় অভ্যাসগত আঁচল টানা, থুতনি নুয়ে আছে বুকের কাছে। মেয়ের জামাইয়ের ডাক পেয়ে সতর্ক হলেন। লজ্জিতার ন্যায় মৃদু স্বরে জবাব দিলেন,
” জানি না৷ স্বর্ণার বাপ আমারে কয় নাই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা থেকে ওঠল। চৌকির দুর্বল নড়বড়ে পায়ার ক্যাচক্যাচে শব্দটা চাপা পড়ে গেল স্বর্ণলতার কণ্ঠে। সে প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বলল,
” আম্মা, তুমি কি সত্যিই চাও, আমি তোমারে নাম ধইরা ডাকি? ”

শবনম বেগম আরম্ভে চমকে ওঠেছিলেন পরক্ষণে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠল চাহনিতে। স্বর্ণলতার মধ্যে সহানুভূতি প্রদর্শনের লক্ষণ নেই। কড়া দৃষ্টিতে একস্থির চেয়ে আছে মায়ের দিকে। উত্তর চাই তার। কোনো ছাড় নেই। এরমাঝেই মুনছুর সাখাওয়াত দরজায় পা রাখল। স্বর্ণলতাকে পাশ কাটা মাত্র দৃষ্টি কেঁপে ওঠল। ভিন্ন কিছুর আঁচ পেয়ে ত্বরিত বলল,
” কোথাও যাবেন না, ঐখানে দাঁড়ান। ”

সুদীর্ঘ পুরুষ দেহটা সত্যি থেমে গেল। ঘাড় ফেরাতে স্বর্ণলতা কলির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
” কলিবু, উনারে কইয়া দেও এটা গরীবের ঘর হইতে পারে। কিন্তু এর ভেতরে বাস করা প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা কইরা হৃদয় আছে৷ সেই হৃদয় দয়া-মায়া দিয়া পূর্ণ থাকে সবসময়। এমন হৃদয়ের মানুষরা অন্যের আঘাত, ব্যথা সহ্য করতে পারে না। গাছ বুইঝা পাইলে যেন সুকুমার কাকারে ছাইড়া দেয়। ”

বাড়ির পাশেই একটি ছোট্ট নিমগাছ। শাখা-প্রশাখা ছড়াচ্ছে। কঁচি পাতা উঁকি মারছে। মুনছুর সাখাওয়াত একহাত বাড়িয়ে সেই গাছটা উপড়ে ফেলল। অতঃপর নীরস স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” কেউ একজন বলেছে, আমি হৃদয়শূন্য মানুষ। এমন মানুষেরা অন্যের আঘাত, ব্যথা, কান্না সব সহ্য করতে পারে। আমিও পারি। সব থেকে বড় কথা, আমি এই ঘরে বাস করি না। এই ঘরে বাস করা কোনো মানুষের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই। আত্মীয়তার সম্পর্ক হতে পারে, যদি তুমি আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করো। যতদিন না করছ ততদিন ঐ সম্পর্কটাও নেই। ”

সে উপড়ে ফেলা নিমগাছটা নিয়ে উঠোনের দিকে পা বাড়াল। স্বর্ণলতা তার পেছনে ছুটল। হাত বাড়িয়ে একটা হাত ধরতে চাইল, পারল না। অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। সে ডাকতে চেয়েও ডাকল না। ঘৃণায় চোখ, মুখ কুঁচকে এলো। মিনিটের মতো সময়টাও পেরুতে পারল না। পূর্বেই লাগাতার বা ড়ি পড়ার শব্দ হতে লাগল। বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল উৎপীড়িত সুকুমারের তীব্র আ র্তনাদ। স্বর্ণলতা দুইহাতে কান চেপে ধরল। চোখদুটিও বুঁজে নেওমামাত্র উপলব্ধি হলো মুনছুর সাখাওয়াতের এই প্রহারের ইচ্ছা, দুর্দমনীয় রা গ ও উগ্র মেজাজ তার প্রতি। কোনো এক যাদুবলে সে বরাবরই রক্ষা পেয়ে আসছে। আজও পেয়েছে। কিন্তু সুকুমারের ভাগ্য খারাপ। ভুল সময়ে তার হাতের কাছে পড়ে গিয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্বর্ণলতার ভাগের নৃ শংসতা তাকে ভোগ করতে হচ্ছে।

” একা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঘরে চলো। ”

স্বর্ণলতা চোখ মেলেও বন্ধ করে ফেলল। তীব্র আলোর রশ্মিটা সহ্য করতে পারল না। টর্চের আলোটা সরাসরি তার চোখে পড়ছে। কান থেকে হাত সরাতে সরাতে বলল,
” মুখ থেইকা আলো সরান। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের আলো সরাতে ইচ্ছে করল না। কী সুন্দর মুখ! নিখুঁত ছাচ। টর্চের আলোর মতোই লাবণ্য বেরুচ্ছে যেন! পুষ্ট গালযুগল আয়নার মতো চকচকে। তুলতুলে, নরম অধরজোড়া এত আকর্ষণীয় ঠেকল যে, হাত দিয়ে ছোঁয়ার অদম্য বাসনাকে সামলাতে পারল না। ডান হাতটা ঠোঁটের কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই স্বর্ণলতা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ঘরের দিকে হাঁটা ধরতেই শুনল,
” তোমার আম্মাকে যদি তুইতোকারি না করি, নাম ধরে না ডাকি। সম্মান দিয়ে কথা বলি তাহলে বাড়ি যাবে? ”

দা নবের মতো মানুষটা তার পাশে হাঁটছে। রাস্তার দিকে নজর নেই, উৎসুক দৃষ্টিযুগল তার পানে বিঁধে আছে। স্বর্ণলতা টের পেয়ে থামল। এক সেকেন্ডের মতো বিরতি দিয়ে বলল,
” না। কিন্তু আমি খুশি হমু ”

সে হাঁটা ধরল। দা নবটার উপস্থিতি পাচ্ছে না৷ পেছনে রয়ে গেল কি? প্রশ্নটা মনে উদয় হতে চিৎকারটা ভেসে এলো,
” তুমি যদি না যাও, আমি এখানে থেকে যাব। আমাকে রাখার মতো যোগ্যতা এই বাড়ির আছে তো? ”
” নাই। আপনি ফেরত যান। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ফেরত গেল না। চোখ, মুখে রা গের তেজ নিয়ে ঘরে ঢুকল। স্বর্ণলতা আগের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মা ও কলি পাশাপাশি দরজার একটু আড়ালে। শবনম বেগম এক ঝলক ভেতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলেন। দেখতে পেলেন না কিছুই। মুনছুর সাখাওয়াত এবার একটু ভেতরের দিকে বসেছে। দরজার মাঝে না আসলে দেখা যাবে না। তিনি ব্যর্থ দৃষ্টি এনে রাখলেন মেয়ের দিকে। সে গাল ফুলিয়ে মুখ আঁধার করে আছে। শবনম বেগম মুখটা সামান্য সামনে এগিয়ে বললেন,
” উদাম গায়ে আইছে দেখলাম! এহনও কিছু পরে না দেহি। জামা-কাপড় লগে কইরা আনে নাই নাকি? আমি তো ভাবলাম গরমে রাস্তার মইধ্যেই খুইলা ফালাইছে। ”

স্বর্ণলতা ভ্রূদ্বয় কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। সেভাবেই ভেতরে তাকাল। মানুষটা যে খালি শরীরে আছে, এতক্ষণ নজরেই পড়েনি। এমন তো নয়, সারাক্ষণ খালি শরীরে দেখে অভ্যস্ত! তাহলে নজরে পড়ল না কেন?

” ঘাইমা তো গোসল দিয়া লাইছে। এমনেই থাকলে তো বুকের মইধ্যে ঠাণ্ডা বয়ব। ”

সে নানাবিধ চিন্তা-ভাবনায় ডুবে ছিল। মায়ের বারংবার কণ্ঠে কিঞ্চিৎ বিঘ্ন ঘটল। যথারীতি রা গেও পেয়ে বসল কণ্ঠস্বর। চেঁচিয়ে বলল,
” তো আমি কী করমু? আমারে এতকিছু জিগাও ক্যান? তারে গিয়া প্রশ্ন করো। ”

শবনম বেগম একটু যেন মিঁইয়ে গেলেন। সামান্য বিরতি দিলেন কথা-বার্তায়। কিন্তু একেবারে থেমে যেতে পারলেন না। একে তো নারী, তন্মধ্যে মা। হৃদয় যতকিছুতেই পূর্ণ হোক না কেন, তলানিতে মায়া-মমতার খোঁজ থাকবেই। একটুক্ষণ পর পুনরায় বললেন,
” রা গ করিস না। মাইয়া মানুষের রা গ থাকা ভালা না। ”

স্বর্ণলতা কড়া চোখে তাকাল, তিনি পাত্তা দিলেন না। মৃদু সুরে বললেন,
” বিয়ার দিন, তোর জামাইয়ের লাইগা একটা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর গামছা কিনছিলাম। দেওয়া হয় নাই। এহন দিমু? ”

সে আগের মতোই চেঁচিয়ে বলল,
” যা খুশি করো। আমারে কইতাছ ক্যান? ”
” তোরে না কইয়া উপায় আছে? ঐগুলা তো প্যাকেট কইরা তোর বই-খাতা রাখার তাকেই রাখছি। এহন ভিতরে যাই ক্যামনে? তুই গিয়া দিয়া আই। গামছাডা দিয়া শরীর মুছতে পারব। মোটা প্যান্ট খুইলা লুঙ্গি পরলে আরাম পাইব। ”

স্বর্ণলতা বিস্ময়ের একটা ভাব ধরে বলল,
” তোমার কি মাথা নষ্ট হইছে? আবোলতাবোল কইতাছ ক্যান? যে তোমার বানানো শরবত খাইল না, সে তোমার দেওয়া কাপড় পরব? ”
” নিজের মতো ভাইবা বইসা থাকলে হইব রে, মা? আগে তো দিয়া দেখ। বাজারের সব চেইয়া বড় দোকান থেইকা আনছি। আমরাও তো জানি, উনি আমগো মতো যা-তা পরব না! ”

স্বর্ণলতা এটারও একটা জবাব দিতে চেয়েও থেমে গেল। মায়া জন্মাল বুকটার ভেতর। চাহনি নরম ও শীতল হয়ে গেল মুহূর্তে। জামাইকে কিছু দেওয়ার কী দারুন আগ্রহ, উচ্ছ্বাস! শখ করে বাজার ঘুরে টাকা খরচ করে কিনেছেও অথচ দিতে পারছে না। ভ য়ে হাত, পা কেমন কাঁপছে! সাহসটা একেবারে শূণ্য কুঠুরিতে। মহাজনের জায়গায় অন্যকেউ হলে বিষয়টা নিশ্চয় অন্যরকম হতো? স্বর্ণলতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল! সে আনমনে ভেতরে ঢুকল। আম্মার নির্দেশনানুযায়ী কাপড়ের ব্যাগটা পাড়ল। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে ফিরতে দেখল, সে তার দিকেই চেয়ে আছে। কী আশ্চর্য! লোকটার দিকে তাকালে সবসময় এই দৃশ্যটায় নজরে পড়ে কেন? সে চোখ নামিয়ে নিল। ব্যাগটা সামনে বাড়িয়ে বলল,
” এটা আপনার। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মা ও মেয়ের কথোপকথন শুনেছিল। দরুন ব্যাগের ভেতরে কী আছে দেখতে হলো না, এমনিতে বুঝে গেল। সেই সাথে এটাও বুঝে গেল, স্বর্ণলতা সেধে এসে কথা বলছে, কিছু দিচ্ছে মানে এটা তার নিতেই হবে। তবুও স্বভাব থেকে সরতে পারল না। বলল,
” আমি অন্যের হাতে কিছু খাই না, কিছু পরিও না। স্ত্রী হিসেবে এটুকু জানা তোমার কর্তব্য। ”

সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। দরজার দিকে তাকাল। মাকে সরাসরি দেখতে না পারলেও ছায়া দেখা যাচ্ছে। সেখানে চেয়ে ফোঁসফোঁস শব্দে নিশ্বাস ছাড়ল কতক্ষণ। তারপরেই বলল,
” অন্য কেউ হইব ক্যান? আপনার স্ত্রীর মায়ে দিছে এটা। ধরেন, পইরা লন। বাড়ির মধ্যে তিনটা মহিলা মানুষ। তাদের সামনে উদাম গায়ে ঘুইড়া বেড়াইতেছেন। আপনার শরম না থাকলেও আমগো আছে। ”
” তিনজনের মধ্যে একজন আমার বউ, আরেকজন বউয়ের মা। এদের সামনে লজ্জা কী? শেষ একজন কলি। ও আমাদের ঝি। এখন কি কাজের ঝিকেও গণনায় নিতে হবে? লজ্জা দেখাতে হবে? ”

স্বর্ণলতার কেন জানি, এই লোকটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, শুনতেও ইচ্ছে করে না। চোখের সামনে পড়লে আগে ভয় হতো, এখন রা গ হয়। বিরক্তি আসে। এমন একটা মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটাতে হবে? ভাবতেই তার দেহ-মন অবশ হয়ে এলো। মাথা চাড়া দিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ অসম্ভব! আমার মুক্তি চাই। হয় পালিয়ে না হয় ম রে গিয়ে। ‘

” এখানেই যদি থাকতে হয় তাহলে জেগে বসে থেকে কী লাভ? আসো, ঘুমাই। ”

তার এই আহ্বানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বর্ণলতা বলল,
” আপনি এইগুলা পরবেন না? ”
” না। ”
” তাইলে আপনার দেওয়া কোনোকিছুই আমি পরমু না। যা দিছেন সেগুলাও পুইড়া ফালামু। ”

স্বর্ণলতা আসার সময় কোনো কাপড় নিয়ে আসেনি। পরনে যে শাড়ি ছিল, সেটা পরেই চলে এসেছিল। বাসায় এসে শাড়ি বদলে সালোয়ার-কামিজ পরে। খুলে রাখা সেই শাড়িটা বের করে সে কুপির আগুনে ধরল। মুহূর্তেই এককোনায় আগুন ধরে গেল। ঘটনা এত দ্রুত ও অপ্রত্যাশিত ছিল যে, মুনছুর সাখাওয়াতের বুঝে উঠতে দেরি হলো। যতক্ষণে শাড়িটা কেড়ে নিল, আগুন নেভাল ততক্ষণে অনেকখানি পুড়ে গেছে। স্ত্রীর প্রতি মুনছুর সাখাওয়াতের রা গ আছে শুরু থেকেই। সেই রা গ কখনও প্রকাশ করতে পারে না। আবার একেবারে নিভিয়েও ফেলতে পারে না। তাই রা গটা বুকের মধ্যেই চরকির ন্যায় ঘুরাঘুরি করে। আজ সেই রা গটা আচমকায় হাওয়া হয়ে গেল। কত বড় দুর্ঘটনা ঘরিয়ে ফেলল অথচ সে শান্ত, নির্বাক। বিস্ময়ের একটা ভাব ফুটে আছে পুরো মুখটায়। সেভাবেই বলল,
” ঠিক আছে, তুমি কাপড় বদলে আসো। আমিও ওগুলো পরছি। ”

স্বর্ণলতা অন্যদিকে চেয়ে কাঠ গলায় বলল,
” আমার কাছে যা আছে সব এরকমই। ”
” আমাদের বাড়ি থেকে কিছু আনোনি? ”
” না। ”
” আমি এনে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বাইরে বের হলো। পান্নাকে ডেকে এনে বলল, ঐ বাড়ি যেতে। সাথে কলিকেও পাঠাল। পান্না ও কলি রওনা দিবে তখনই পেছন ডাকল। এটকুক্ষণ নীরব থেকে কী যেন ভাবল! সহসা গলার স্বর উঁচু করে বলল,
” এতরাতে কলিকে একা পাঠানো ঠিক হবে না। তোদের রানিসাহেবার মাকেও সাথে করে নিয়ে যা। ”

স্বর্ণলতা শুনতে পেয়ে ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠল। দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। মা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে নেই। উঠোনের দিকে চেয়ে চিৎকার করল,
” আম্মা? তুমি যাইবা না। ঐ বাড়ি থেইকা কিছু আনতে হইব না। যা আছে আমি তাই পরমু। ”

শবনম বেগম উত্তর দিলেন না। পেছনেও ফিরলেন না। স্বর্ণলতা দূর হতে দেখল, কলির পেছন পেছন একটা আবছা হেঁটে উঠোন পার হচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত তাদের বিদায় করে এসে বলল,
” তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে! এক গ্লাস পানি দাও, গলাটা জুড়াই। ”

সে কোনো সাড়া দিল না। মূর্তির মতো শক্ত হয়ে চেয়ে আছে উঠোনের ওপারে। যেখান দিয়ে মা দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে ফেলল। মুনছুর সাখাওয়াত তার একটা হাত চেপে ধরল। ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” থাক পানি লাগবে না। শরবতটা দাও, ওটাতেই তৃষ্ণা মিটে যাবে। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩২)

স্বর্ণলতাকে চৌকিতে বসাল। অতঃপর দরজায় খিল টানল মুনছুর সাখাওয়াত। ফিরে এসে বসল স্ত্রীর পাশে। সে আড়ষ্টভাবে বসে আছে, মাথায় ঘোমটা নেই। কুপির ম্লান আলোয় মুখটা আগুনরঙা দেখাচ্ছে। ঘামে ডুবে আছে কপাল ও নাক। উভয় কানের পাশে এক গোছা চুল ভিজে ল্যাপ্টে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত উদ্বিগ্ন গলায় সুধাল,
” হঠাৎ করে ঘেমে নেয়ে ওঠলে যে! খুব গরম লাগছে? ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিব? ”

সে অনুমতি চাইল ঠিকই কিন্তু পাওয়ার অপেক্ষা করল না। চট করে উঠে দাঁড়াল। টর্চের আলোয় সুইচবোর্ড খুঁজছে। আচমকা থেমে গিয়ে বলল,
” ধ্যাত! এখানে তো ফ্যানই নেই, সুইচ আসবে কীভাবে? ”

চৌকির উপরে শিয়রের কাছে একটি তালপাতার পাখা আছে। স্বর্ণলতা হাত বাড়িয়ে আনল। বিরক্ত ছিটকে ফেলা মানুষটার দিকে বাড়িয়ে ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত হাতপাখাটা নিল। উল্টেপাল্টে নাড়ল কতক্ষণ তারপরে স্ত্রীর পাশে বসে বলল,
” আমি হাত পাখা ঘুরাতে পারি না। অভ্যাস নেই৷ ”

স্বর্ণলতা পাখা ফিরিয়ে নিতে চাইল, মুনছুর সাখাওয়াত দিল না। ঠাঁট বজায় রেখে মৃদু সুরে বলল,
” চেষ্টা করে দেখি ঘুরাতে পারি নাকি! ”

সে সবল হাতে রয়েসয়ে পাখা ঘুরাতে লাগল। আধা মিনিটের মতো সময়ও পার হলো না। অধৈর্য হয়ে বলল,
” এটা কোনো পাখা হলো? শুধু ঘুরেই যায়, বাতাস কোথায়? ”

বিরক্ত ও রা গ উভয় গিয়ে পড়ল পাখাতে। সাথে সাথে ঢিল মা রল। পাখাটি উড়ে গিয়ে পড়ল দরজার কাছে। লম্বা ডাঁটটি বাঁকা হয়ে গেল। ছড়ানো অংশটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে রইল। স্বর্ণলতা শুরুতে চমকে চেয়েছিল। পরক্ষণেই সেই চাহনি হতাশায় রূপান্তর হলো। চৌকি থেকে নামার জন্য উদ্যত হতে মুনছুর সাখাওয়াত হাত ধরে ফেলল। জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় যাও? ”

সে নিতান্ত বাধ্য হয়ে ক্ষীণতর গলায় জবাব দিল,
” জানালা খুইলা দিই। বাতাস আইব। ”
” ভালো বুদ্ধি। তুমি বসো, আমি জানালা খুলে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের কণ্ঠে বিরক্ত ও রা গের ভাবটা নেই। স্বর্ণলতাকে আগের মতো বসিয়ে দিল। জানালা খুলে ফিরে এসেই বলল,
” তোমার হাতটা ঠাণ্ডা লাগল মনে হয়! দেখি। ”

সে নিজ উদ্যোগেই হাতটা ধরল। সন্দেহ পুরোপুরি মিলে গিয়েছে। হাতটা বরফের মতো ঠাণ্ডা! মুনছুর সাখাওয়াত চট করে অন্য হাতটাও ধরল। দুটো হাতের অবস্থা একই। সে হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে তাকাল কিশোরী মুখটায়। এখনও ঘামের ধারা বেয়ে পড়ছে কর্ণপাশ ধরে। ভীষণ চিন্তিতসুরে সুধাল,
” ঠাণ্ডার মধ্যে মানুষ কাঁপে, তুমি ঘামছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ করছে? ”

সে জবাব দিল না। চোখদুটি বুঁজে যাচ্ছে আপনাআপনি। মুনছুর সাখাওয়াত হাত ছেড়ে গাল স্পর্শ করল। মুখটা শক্ত করে ধরে পুনরায় সুধাল,
” আরে কী হলো! চোখ খুলো। স্বর্ণলতা? ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে এলো। স্বর্ণলতার ঠোঁটের কাছে ধরা মাত্র মুখটা একপাশে হেলে পড়ল! বারংবার ঘাড়টা সোজা রাখার চেষ্টা করে ডাকাডাকি চলল। কিন্তু সাড়া এলো না। চোখের পাতা দুটিও মেলল না। মুনছুর সাখাওয়াত এত ভ য় পেল! আতঙ্গে চোখ, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। হঠাৎ করেই বোবায় পেল যেন! স্বর্ণলতার মুখটা ছেড়ে দিতেই দেহটা লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। প্রায় মিনিটখানেক সময় সে পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকল। চোখের পলক পড়ল না, মুখ দিয়ে শব্দ বেরুল না, সামান্যতম নড়াচড়াও করল না। এই শ্বাসরু দ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে দরজার দিকে ছুটল। বন্ধ দরজা মেলে বাইরে বেরিয়ে এলো দৌড়ভঙ্গিতে। পান্নার নাম ধরে ডাকতে চেয়েও থেমে গেল। স্মরণে এলো, তাকে ঐবাড়িতে পাঠানো হয়েছে। আলামিনও ওখানেই। তাহলে এখানে কে আছে? কাশেম! নামটা মনে পড়তেই চিৎকার করল। সে বাড়ির পেছনে পাহারারত অবস্থায় ছিল। ডাক শুনে দৌড়ে এলেও দেরি হয়ে গেল খানিকটা। এসে সাফাই দেওয়ারও সুযোগ পেল না। মহাজন ছুটে এসে না ক বরাবর ঘু ষি মা রল। কাশেম ব্য থায় ক কিয়ে ওঠল। নাকে হাত রেখে ছি টকে দূরে সরে গেল। রক্ষা হলো না। পাহারায় থাকা বাকি লোকগুলোও এসে পড়েছে। দুজন এগিয়ে এসে তাকে ঝা পটে ধরল। মহাজনের কাছে ঠেলে পাঠিয়ে দিল বিনা আদেশেই। কাছে পেয়ে তার হাতের মুঠো পে কে যায়। হাত উঁচিয়েও থেমে গেল মাঝপথে। র গরগে চোখেমুখে আদেশ করল,
” হাদি ডাক্তারের বাড়ি এই গ্রামেই না? ও কে নিয়ে আয়। এখনই। ”

কাশেম মাথা নাড়ল। আ হত অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে গেল রাস্তার দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত তার গমনপথের দিকে চেয়ে আছে। প্রতীক্ষিত চাহনি! ভুলেও অন্যদিকে তাকাচ্ছে না। ভাবটা এমন, কাশেম ডাক্তারকে নিয়ে এখনই ফিরে আসবে। অথচ একই গ্রামে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও পথের দূরত্ব আছে বেশ। যাওয়া-আসা মিলিয়ে আধঘণ্টার মতো সময় লাগবে। ঠিক এই সময় মুনছুর সাখাওয়াতের মোবাইলটা বেজে ওঠল। রিংটোনের শব্দে সে একইসাথে বিরক্ত ও রা গান্বিত হলো। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকানোর ভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে, বের করেই আ ছাড় দিবে। আ ছাড় দিল না। দৃষ্টি আটকে গেল স্ক্রিনে। দাদিজানের কল! এই প্রথম দাদিজানের নাম্বারটা ভেসে ওঠেছে মোবাইলের স্ক্রিনে! মুনছুর সাখাওয়াত জানে, দাদিজান তাকে ভীষণ ভালোবাসে, স্নেহ করে। আচার-আচরণে টেরও পায়। তবুও কখনও কলে কথা হয়নি তাদের। কাজের সূত্রে সে প্রায়শই বাইরে থাকে, দুই-তিন রাত বাড়ি ফিরে না। দাদিজান দুশ্চিন্তা করেন, বাড়ি ফেরার পর ব কা-ঝ কাও করেন কিন্তু কল করে একবারও খোঁজ নেননি। হঠাৎ কল পেয়ে মুনছুর সাখাওয়াতের শ্বাস আটকে গেল। কোনো বিপদ হলো না তো! সে কল রিসিভ করল। মোবাইল কানে ধরতে দাদিজানের গলার স্বর ভেসে এলো,
” মুনছুর, কোথায় তুই? ”
” জানো না? ”
” জানি। ”
” তাহলে জিজ্ঞেস করছ কেন? ”

দাদিজান একটু নিভে গেলেন বোধ হয়। খানিকটা সময় নীরব থেকে আচমকা বললেন,
” তোর বউকে দে। কথা বলব। ”
” ওর সাথে কী কথা? ”
” আছে। অনেক কথা। তোকে বলা যাবে না। স্বর্ণলতাকে দে। ”
” এখন দেওয়া যাবে না। পরে আমি কথা বলিয়ে দিব। ”
” পরে কেন? এখন বললে কী সমস্যা? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চুপ হয়ে গেল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কণ্ঠের এই তে জ, বেপরোয়া ভাবটা ধরে রাখতে পারছে না। বুকের ভেতরের ভ য়টা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। তার মনে হচ্ছে, ভ য়টা তাড়াতে না পারলে যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। চোখে অন্ধকার দেখবে। সে ঢোক গিলল। গভীর নিশ্বাস টেনে বলল,
” ঐবাড়িতে শান্তি দেওনি, এই বাড়িতেও দিবে না? ”
” না, দিব না। আমি নেই, এই সুযোগে মেয়েটার সর্ব নাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি? ”
” কার সর্ব নাশ করব? কী বলছ এসব! পাগল হলে নাকি? ”
” কার আবার? স্বর্ণলতার। ওর আম্মা-আব্বাকে বাড়িতে ডেকে আনার কথা বলায় খুব তো রা গ দেখালি। এই বাড়িতে ওদের আসা নিষেধ করে দিলি। তাহলে এখন নিজেই পাঠিয়েছিস কেন? ”
” দরকারেই তো পাঠালাম। ”
” চুপ। মিথ্যা বলবি না আমার সাথে। তোর কি ধারণা, আমি কিছু বুঝি না? মুনছুর, তুই এত স্বার্থপর হলি কেন? আমাকে বাদ দিলাম, নিজের বউয়ের ভালো-মন্দ দিকটাও ভাববি না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আবারও চুপ হয়ে গেল। দাদিজানের ধারণা পুরোপুরি সত্য না আবার মিথ্যাও না। সে সুযোগ নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সর্ব নাশ করা অবধি ভাবেনি। তার ভীষণ ইচ্ছে করছিল, স্বর্ণলতা তার কাছে বসুক। দুনিয়ার সকল দিক থেকে ধ্যান সরিয়ে শুধুমাত্র তাকে খেয়াল করুক।

” মুনছুর? কথা বলিস না কেন? কল কেটে গেল নাকি? ”
” না কাটেনি। ”
” তাহলে স্বর্ণলতাকে দে। ”
” এখনই দিতে হবে? ”
” হ্যাঁ, এখন দিতে সমস্যা কী? মুনছুর, ও সুস্থ আছে তো। নাকি এরমধ্যে সর্ব নাশ ঘটিয়ে ফেলেছিস? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চাচ্ছিল, দাদিজানকে কিছু না বলতে। তাই যথেষ্ট মনোযোগ ও সতর্কতা সহকারে কথা বলছিল। সবকিছু ভুলে বেফাঁস হলো। বির ক্ত ঝরে পড়ল কণ্ঠস্বরে,
” সর্ব নাশ ঘটিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় আছে নাকি? ”
” মানে কী? কী হয়েছে ওর? ”

প্রশ্নটা শোনামাত্র নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। ধরা পড়ে গিয়েছে টের পেয়েই চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে নিল। দাদিজানের অধৈর্য কণ্ঠস্বরটা পুনরায় বাজল,
” মুনছুর? উত্তর দে। মেয়েটা বেঁচে আছে তো নাকি…”

তাকে বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে দিল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত ধ মকে ওঠল,
” দাদিজান! কথাবার্তা সাবধানে বলবে। তোমার নাতবউয়ের সাথে আমি কিছুই করিনি। তার আগেই তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলল! ”
” আবার জ্ঞান হারিয়েছে? ”

সে জবাব দিল না। তার নীরবতাতেই দাদিজান উত্তর খুঁজে নিলেন। উদ্বিগ্ন গলায় সুধালেন,
” কিছু না করলে জ্ঞান হারাবে কেন? আবার হাত কে টেছিস? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এখানে আসার পর কী কী ঘটেছে সবটায় খুলে বলল। সবশেষে খাইরুন নিসা বললেন,
” এই রা গ তোর দাম্পত্য জীবনে কাল হবে। মুনছুর, এখনও সময় আছে। সামলে নে। ”
” কেন? আমি কি স্বর্ণলতাকে মে রেছি নাকি ব কেছি। চোখ রা ঙিয়ে তাকাইনি পর্যন্ত! ”
” তাতে কী? ওর সামনেই তোর ভ য়ঙ্কর রূপটা বার বার প্রকাশ পাচ্ছে। দুই চোখে যা দেখছে, তা নিজের সাথে ঘটবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে? ডাক্তার ডেকেছিস? ”
” হ্যাঁ, কাশেমকে পাঠিয়েছি। ”
” এতকিছু ঘটিয়ে মেয়েটাকে একা রাখা উচিত হয়নি। তুই তো জানিস, ও তোকে কত ভ য় পায়! দরজা, জানালা খুলেছিস? ঘরে হাওয়া ঢোকা দরকার। ”
” খুলেছি। ”
” এককাজ কর, ও কে ঘরের বাইরে আনার ব্যবস্থা কর। জ্ঞান ফিরে নিজেকে মুক্ত দেখলে মনে জোর পাবে। ততক্ষণে ডাক্তারও চলে আসবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কল কেটে দিল। এক ঝলক বাইরে চেয়ে ঘরের দিকে ছুটে গেল। স্বর্ণলতা তখনও অচেতন। এই বাড়ির মেঝে কাঁচা। বাইরে বারান্দা নেই। স্বর্ণলতাকে উঠোনে শোয়াতে হবে। উঠোনে শুকনো মাটি ও পাতা ছড়িয়ে আছে। এভাবে শোয়ানো যাবে না। মুনছুর সাখাওয়াত টর্চ জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে খোঁজ চালাল। শোয়া যায় এমন কিছুর অনুসন্ধানে আছে। সহসা একটি পাটি পেল। সে দৌড়ে গিয়ে উঠোনে পাটি বিছালো প্রথমে। তারপরে স্বর্ণলতাকে কোলে করে নিয়ে গেল। আলাদা করে বালিশ নিল না। নিজের কোলে মাথাটা তুলে নিয়ে মৃদু সুরে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”

উত্তর এলো না। এরমধ্যে কাশেম চলে এলো। বাইরে থেকে জানাল,
” ডাক্তার হাদি আসে নাই। ”
” কেন? ”
” কইছে, আপনার ডাকে সে আইব না। ”
” এত বড় সা হস! আমাকে মানা করে। ওর ঘা ড় ধরে টে নেহিঁচ ড়ে আনলি না কেন? ”
” বাড়ির ভিতরেই তো ঢুকতে পারি নাই, মহাজন। ঘা ড় ধরমু ক্যামনে? ”
” ঢুকতে পারিসনি মানে কী? গেইট খুঁজে পাসনি নাকি? ”
” পাইছি। কিন্তু গেইটে দুইটা দারোয়ান খাড়াইয়া আছে। আমি এক লা পারুম না। লগে যদি আরও কারোরে দিতেন তাইলে সাহ স পাইতাম! ”
” যতজন ইচ্ছে নিয়ে যা। আমি ডাক্তারকে এখানে দেখতে চাই। ”

কাশেম চলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত রা গে ফুঁসল কতক্ষণ। বার কয়েক উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত হলো। স্বর্ণলতার মুখটায় চেয়ে কাতর স্বরে বলল,
” এত ভ য় পেলে চলবে? আরেকটু মনে সাহস রাখলেই বুঝতে পারতে আমি দরজা আটকেছিলাম, একটা কথা বলতে। কথাটা শুনলেই তোমার ভুল ভাঙত, জে দটাও শেষ হতো। ”
” কথাটা কি চাঁদনিবুরে নিয়া ”

প্রশ্নটা করে স্বর্ণলতা উঠে বসল। আশপাশে তাকিয়ে বলল,
” তাড়াতাড়ি কন। আমি পানি খাইতে যামু। ”
” তোমার যেতে হবে না। আমি এনে দিচ্ছি। ”

সে তখনই ছুটে গেল ঘরের ভিতরে। গ্লাসে পানি ঢেলে আসার সময় মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘ কাশেম, ফিরে আয়। ফিরে আয়। ঝা মেলা করার দরকার নেই। ‘

স্বর্ণলতা পানি খেয়ে বলল,
” এবার কন, কী কইবেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটুক্ষণ থেমে থেকে ধীরে ধীরে বলল,
” চাঁদনির সাথে দু র্ঘটনা ঘটার সময় আমি সজ্ঞানে ছিলাম না। বন্ধুরদের সাথে ম দ খাচ্ছিলাম। চাঁদনি নিজে থেকেই এসে আমাকে উস কেছিল। ”
” উনি উস কাইলেই আপনি উস কাইয়া যাইবেন? ”
” বললাম না, জ্ঞানে ছিলাম না?
” জ্ঞানে না থাকলে ঘটনা ঘটে ক্যামনে? আমিও তো একটু আগে জ্ঞানে ছিলাম না। আপনি এত ডাকাডাকি করলেন! চোখ মেলছি? আমি সামান্য চোখ মেলতে পারি নাই, আর আপনি এতকিছু কইরা ফেলছেন? ”
” স্বর্ণলতা, আমার কথা কি ঠিকভাবে বুঝছ না? আমি ম দ খেয়ে মা তাল ছিলাম। ”
” তো? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হলো। পর মুহূর্তে হতাশায় দৃষ্টি নুয়ে পড়ল। এই মেয়ে দুনিয়ার সব বুঝে-জানে অথচ ম দ খেলে যে মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না এটা জানে না!

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৩)

” স্বর্ণলতা, আমার কথা কি ঠিকভাবে বুঝছ না? আমি ম দ খেয়ে মা তাল ছিলাম। ”
” তো? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হলো। পর মুহূর্তে হতাশায় দৃষ্টি নুয়ে পড়ল। এই মেয়ে দুনিয়ার সব বুঝে-জানে অথচ ম দ খেলে যে মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না এটা জানে না!

” মদ কি ভালা জিনিস? ”

মুনছুর সাখাওয়াত দৃষ্টি তুলল। হঠাৎ করে আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠল! কিঞ্চিৎ আলো ছড়াচ্ছে হৃদয় ঘরে। মাথাটা দুপাশে নেড়ে দ্রুত জবাব দিল,
” না। খারাপ। ”

স্বর্ণলতা ঠোঁট বাঁকাল। বিদ্রুপের মতো করে বলল,
” তাইলে খারাপের উপর দোষ চাপাইয়া কী লাভ? সে তো নিজেই দোষী। ”

মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিতীয় দফায় আশ্চর্য হলো। দৃষ্টিজোড়া চমকে ওঠল যেন! মেয়েটার ভাবনা এত গভীর, এত নিখুঁত কেন? এই কিশোরী মুখ, নরম কণ্ঠস্বরের আড়ালে অন্যকিছু আছে। যাকে বয়স দিয়ে গণনা করা যায় না। বুদ্ধি, গুণ তুলনাহীন। মাপকাঠির উর্ধ্বে। সে নিজেকে দোষমুক্ত করার আরও একবার চেষ্টা করল। বলল,
” এই খারাপ জিনিসটা আমি ইচ্ছে করে খাইনি। বিশ্বাস করো। ”
” কেউ জোর করছিল? ”
” হ্যাঁ। আমার বন্ধুরা। ”
” ওরা ভালা? ”
” একটুও ভালো না। খুব খারাপ। নাহলে জোর করে মদ খাওয়াত? ”
” ওগো ডাইকা আনছিল কে? ”
” আমি। ”
” সাথে কইরা মদ নিয়া আইছিল? ”
” না। আমার বাসায় ছিল। ”

স্বর্ণলতা আবারও ঠোঁট বাঁকাল। আগের চেয়েও অধিকতর ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
” তাইলে ওগোর উপর দোষ চাপাইয়া কী লাভ? খারাপের ডালা নিয়া খারাপকে আপনি সজ্ঞানে বরণ করছেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে নিল। আশার প্রদীপ এমনভাবে নিভল যে, ধোঁয়াটুকুও বের হচ্ছে না। মেয়েটা তাকে জেরায় বসিয়েছিল, একটু সতর্ক থাকলেই মামলা ডিসমিস হয়ে যেত। হলো না। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই সে সত্যের সাথে ঠিকঠাক দিয়েছে। এত সততা কোথা থেকে আসল? সামান্য মিথ্যার আশ্রয়টুকুও নিতে পারেনি। ভাবখানা এমন যে, সারাজীবনে একটিও মিথ্যা বলেনি! জীবনে প্রথমবার সত্যের পথ ধরে ফেঁসে গেল! দোষমুক্ত হওয়ার আর কোনো উপায় আছে কি? সে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠল। উত্তেজনায় নিশ্বাস কাঁপছে। ব্যাকুল চিত্তে দুই হাতে মস্তিষ্ক হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কিছু একটা চাই। এই ছোট্ট, অল্পবয়সী মেয়েটার কাছে হেরে গেলে বিপদ। পুরো দুনিয়ার কাছে মাথা নত করতে হবে। মুনছুর সাখাওয়াত ভাবনার মধ্যে চমকে ওঠল। স্বর্ণলতার কাছে হারলে পুরো পৃথিয়ার কাছে মাথা নত হবে কেন? এই চিন্তাটা মাথায় আসল কীভাবে? তাহলে কি সে অজান্তে, অবচেতনায় স্বর্ণলতাকে এই পৃথিবীর চেয়েও অধিক বড়, অধিক ক্ষমতাশালী ভেবে বসে আছে? মুনছুর সাখাওয়াত ঝটিতে চোখ মেলল। খানিক উদ্ধত স্বরে বলল,
” আমি বন্ধুদের ডেকেছি। মদও খেয়েছি। কিন্তু চাঁদনিকে তো ডাকিনি। সে নিজে এসেছে। আমাকে মাতাল অবস্থায় পেয়ে সুযোগ নিয়েছে। তুমি যে দোষে আমাকে দোষী করছ, তার সম্পূর্ণ দায় চাঁদনির। যদি মাফ চাইতে হয়, তাহলে ওর আমার কাছে চাওয়া উচিত। ”
” চাইবো তো। কিন্তু আগে আপনি চাইবেন। আপনি যদি মদ না খাইতেন চাঁদনিবু সুযোগ নিতে পারত না। ”
” ওর জন্য আমার মদ খাওয়া বন্ধ থাকবে? ”
” উনার জন্য না, আল্লাহর জন্য বন্ধ থাকব। মদ খাওয়া পাপ। এই এক পাপ দুনিয়ার সকল পাপের বাপ। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের ভাব আরও শ ক্ত, রুক্ষ হলো। ক্রু দ্ধ হয়ে একরোখা ভঙ্গিতে বলল
” আমি আল্লাহ মানি না। ”
” তাইলে মাফ চাওয়ার দরকার নাই। ”
” বেশ, তোমার কথা সই। এবার বাড়ি চলো। ”

স্বর্ণলতা হাতের গ্লাসটা পাটির উপর রাখল। দুইহাত এক করে সামনে বাড়িয়ে ধরে বলল,
” বাইন্ধা নিয়া চলেন। বাঁধা দিমু না। ”
” বাঁধতে হবে কেন? তুমি সেচ্ছায় যাবে। ওটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। ”
” আমি তো আপনারে স্বামী মানি না, শ্বশুরবাড়ি হইল ক্যামনে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত কী যেন একটা বলতে চাইল। পূর্বেই স্বর্নলতা দৃঢ় ও দীপ্ত গলায় জানাল,
” কিন্তু আমি আল্লাহ রে মানি, বিশ্বাস করি। লগে এইডাও বিশ্বাস করি, আপনি পাপ করছেন। পাপমুক্ত হওয়ার দুইটা উপায়। মাফ চাওয়া অথবা শা স্তি পাওয়া। আমি আপনারে মাফ চাইতে কইতে পারমু, শা স্তি দিতে পারমু না। ঐটা তো আল্লাহ দিব। এখন আপনি ভাবেন, মাফ চাইবেন নাকি শা স্তি নিবেন। ”

সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। মনে মনে বিড়বিড় করল, ‘ শা স্তির মধ্যে রেখে বলছে, শা স্তি দিতে পারমু না! ‘ মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তের জন্য চোখটা সরাল। উঠোনটা অন্ধকারে ডুবে আছে। আকাশে চাঁদ, তারা কিছু নেই। মেঘের বর্ণ ধরে আছে অথচ বৃষ্টির ভাব নেই। থেমে থেমে মৃদু বাতাস উড়ে আসছে কিন্তু গায়ে লাগছে না। সে সমানে ঘেমেই যাচ্ছে! ঘর্মাক্ত শরীরটা মুছে শুকনো করা কিংবা আবরণ দিয়ে ঢাকার প্রতিও আগ্রহ নেই। কিছু সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টি উদাস হলো। চিন্তা-চেতনা পৌছে গেল নিজ বাড়িতে। বাড়ির বারান্দা, প্রশস্ত সিঁড়ি, তার উপরে বসে আছে মুনছুর সাখাওয়াত। পাশেই তার অল্পবয়সী স্ত্রী। খালি পা, হাতে ভাতের প্লেট। মাখানো ভাত দলা করে তার মুখে ধরে আছে। এবার সে হাঁ করল না। নিষ্পলকে চেয়ে আছে শুধু। কী তৃষ্ণা সেই চাহনিতে! যা পানির মতো গড়িয়ে যাচ্ছে গলা, বুক ও পেটে। এই মুহূর্তে তার পেট মোচড় দিয়ে ওঠল। হারিয়ে গেল সবকিছু। চিন্তা-চেতনা ফিরে এলো অন্ধকার উঠোনে। উদাস দৃষ্টি ঘুরে এলো স্বর্ণলতার দিকে। মেয়েটা এখনও হাত দুটো বাড়িয়েই আছে! মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল। পাটি থেকে নেমে পুরো উঠোনে একবার পাক দিল। এই সময়ের পুরোটায় স্বর্ণলতাকে নিয়ে ভাবল। ওটা স্বপ্ন নয়, কল্পনা। কল্পনা মানুষের তৈরি৷ স্বর্ণলতা তাকে খায়িয়ে দিচ্ছে এমন কল্পনা সে তৈরি করল কেন? অন্যের হাতে খাওয়া তার পছন্দ নয়। মুনছুর সাখাওয়াতের স্পষ্ট মনে আছে, ছোটবেলা থেকে সে নিজ হাতে খায়। দাদিজান খায়িয়ে দিতে চাইলে চিৎকার-চেঁচামেচি করেছে। জোর করলে ভাতের প্লেট ফেলে দিয়েছে। শুধু খাওয়া নয়, ব্যক্তিগত সকল কাজই সে নিজে করতে পছন্দ করে। ঘর গুছানো, পরিষ্কার রাখা, কাপড় ধোঁয়া, স্ত্রী করা সবটায় সে নিজে করে। শুধু রান্নাটা করতে পারে না। ইচ্ছাকৃত কিংবা আলসেমিতে নয়। সময় পায় না। কখন, কোথায় খাচ্ছে তারও তো ঠিক নেই! মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিতীয়বারের মতো পাক দেওয়ার সময় জীপ আসার শব্দ পেল। দ্রুত কদমে ফিরে এসে দেখল, শবনম বেগম ও কলি গেইট দিয়ে ঢুকছে। তাদের হাতে অনেকগুলো ব্যাগ। স্বর্ণলতা বসা থেকে উঠেনি। চোখ তুলে এক নজর চেয়েও দেখছে না। মুনছুর সাখাওয়াত আরেকটু এগিয়ে কলির উদ্দেশ্যে বলল,
” এখানে কী? ভেতরে যা৷ দেখছিস না, আমরা কথা বলছি? ”

কলি দৌড় দিল। তার পেছন পেছন শবনম বেগমও ঘরের দিকে যাচ্ছেন। মুনছুর সাখাওয়াত তাদের থেকে মনোযোগ সরাল। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে বলল,
” যে সাজে এসেছিলে সেই সাজে শ্বশুরবাড়ি ফিরবে। ওরা যা এনেছে তা এখানেই থাক। আমি নতুন কিনে দিব। ”

সে জবাবের অপেক্ষা করল না। হাঁটা ধরল। জীপটা বাড়ির বাইরে, রাস্তাতে দাঁড় করানো আছে৷ সেদিকে যাচ্ছিল সহসা থামল। ঘাড় ফিরিয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”

সে কেঁপে ওঠল। সচকিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল গেইটের কাছে দাঁড়ানো দীর্ঘকায় শরীরটায়। টর্চ নেয়নি সাথে। অন্ধকারে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। চোখদুটি কুপির আলোর মতো টিমটিমে জ্বলছে। মুনছুর সাখাওয়াত চমকিতার দিকে চেয়ে তরল গলায় বলল,
” যেদিন আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে সেদিন একপ্লেট ভাত মাখিয়ে খায়িয়ে দিবে। শুধু এক প্লেট। ওটাই যেন প্রথম ও শেষবার হয়। ”

কথাটা বলে সে বাড়ি থেকে এমনভাবে বেরিয়ে এলো যেন, কোনো মূল্যবান বস্তু চু রি করেছে। ধরা পড়লে বে দম প্রহার মিলবে তারপরে মাথা ন্যাড়া করে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে বেড়াবে।

__________
মুনছুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে বেশিদূর এগুতে পারল না। পথিমধ্যে আচমকা থামতে হলো। কাশেম ও আরও দুটো ছোকরা এদিকে আসছে। ডাক্তার হাদি তাদের সাথেই আছে। তিনজন মিলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসছে। মহাজনকে থামতে দেখে তাদের গতি বেড়ে গেল। কাছে আসতে মুনছুর সাখাওয়াত ধ মকে বলল,
” ডাক্তারকে নামা। ”

আদেশ পেয়ে ডাক্তার হাদিকে ছেড়ে দিল। তিনজন একসাথে ছেড়ে দেওয়ায় সে ধপ করে মাটিতে পড়ল। দীর্ঘদিন বৃষ্টি নেই, মাটি ভীষণ শক্ত! পিঠে ও মাথার পেছনে লাগল লোহার মতো। ধূলোবালিতে মিলেমিশে গেল হাফ হাতার টি-শার্ট ও লুঙ্গি। মুনছুর সাখাওয়াত আগের চেয়ে কড়া স্বরে ধ মকে ওঠল,
” আহম্মকের দল! নামাতে বলেছিলাম, ফেলে দিতে না। ডাক্তারকে ওঠা। ”

ওরা দ্বিতীয় আদেশ পালনে তৎপর হয়ে ওঠলেও সফল হতে পারল না। ডাক্তার হাদি হাত উঁচিয়ে মানা করল। তারপরে নিজেই আস্তেধীরে উঠে দাঁড়াল। কাপড় থেকে ধূলোবালি পরিষ্কার করছে হাত দিয়ে। কাশেম টর্চের আলো ধরে আছে তার দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থেকে বলল,
” রোগী তো সুস্থ। তোরে আর লাগবে না। বাড়ি ফেরত যা। ”

কাশেমের দিকে চেয়ে তৃতীয়বারের মতো আদেশ দিল,
” বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়। আবার ফেলে দিস না। ”
” জি, আচ্ছা। এহনই দিয়া আইতাছি, মহাজন। ”

সে ডাক্তারের দিকে পুনরায় বলল,
” চলেন, ডাক্তার। ”

ডাক্তার হাদি কাশেমের আহ্বানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল। পা বাড়িয়ে এগিয়ে এলো মুনছুর সাখাওয়াতের জীপের কাছে। ক্রো ধে রাঙানো দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। চোয়ালদ্বয় শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
” এসবের মানে কী? ”
” এখন মানে বুঝানোর সময় নেই। কাল বাড়িতে আসিস। আলোচনা করতে হবে। ”
” কিসের আলোচনা? ”
” আমি যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেই ব্যাপারে। ”
” আমিও তো শর্ত দিয়েছিলাম। ”
” সমস্যা নেই। পূরণ করে দিব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ইঞ্জিন চালু করল। সামনে এগিয়ে যাবে তখনি ডাক্তার হাদি চেঁচানো সুরে বলল,
” যার দরকার সে আসবে। আমি কারও বাড়ি যেতে পারব না। ”

জীপটা খানিক এগিয়ে গিয়ে আচমকা ব্রেক কষল। ইঞ্জিন চালু রেখে মুনছুর সাখাওয়াত মাথা বের করল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখতে ডাক্তার হাদি পূর্বের কথাটায় পুনরায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলল,
” দরকার তো আপনার, তাই না? তাহলে আমি কেন আপনার বাড়িতে যাব? ”
” তাহলে কি আমি তোর বাড়ি যাব? ”
” জি, আপনারই আসা উচিত। এভাবে টে নেহিঁচড়ে এনে আদেশ করবেন আর আমি মেনে নিব? এত সহজ নাকি? আমি কিন্তু আপনার কেনা গোলাম নই। ”
” মে জাজ গরম করিস না। আমি কারও বাসায় গেলে ভাঙচুর করি, কথা বলি না। ”
” আমার বাসায় নাহয় কথা বললেন। ”
” পাগল নাকি! মানুষ শুনলে আমার সম্মান থাকবে? ”

ডাক্তার হাদি একপেশে হাসল। কৌতুকের মতো বলল,
” যেটাকে আপনি সম্মান বলছেন ওটা সম্মান নয় ভ য়। মানুষ আপনার টাকার সামনে মাথা নত করে, ক্ষমতাকে সালাম করে। এই দুটো নিজের থেকে আলাদা করে দেখুন, কেউ ফিরেও তাকাবে না। আপনার এই গোলামগুলোও আপনাকে চিনতে অস্বীকার করবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কাশেমের দিকে তাকাল। সে দ্রুত মাথা নেড়ে বুঝাচ্ছে, এসব মিথ্যা। সে এমনটা কখনই করবে না। ডাক্তার হাদি পুনরায় বলল,
” সম্মান কিনে বা জোর করে পাওয়া যায় না। সম্মানকে অর্জন করতে হয়। এজন্যে টাকা বা ক্ষমতা নয় সুন্দর মন আর ব্যবহার প্রয়োজন। যার একটিও আপনার মধ্যে নেই। ”

কথাটা বলে সে হাঁটা ধরল। বিপরীত মানুষটার জবাব বা প্রতিক্রিয়া কোনোটার প্রতি আগ্রহ নেই। এতদূর এসেছে যখন রোগীর সাথে দেখা করা যাক। তার মন বলছে, মুনছুর সাখাওয়াতের রোগী স্বর্ণলতা। সাথে নেই মানে বাড়িতেই আছে। সে হাঁটার গতি বাড়াল। উঠোনে পা রাখা মাত্র ফজরের আযান ভেসে এলো দূরের মসজিদ থেকে। চারপাশে ভোরের আলো ফুটছে। শীতল বাতাস বয়ছে। খাঁচায় আটকে থাকা মুরগিগুলো গলা ফাটিয়ে ডাকছে। ডাক্তার হাদির ডাকতে হলো না। মুরগির ডাকে শবনম বেগম বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তাকে দেখেই চমকে ওঠেও সামলে নিল। ডাক্তার হাদি দেখতে পেয়ে বিনয়ীর সাথে সালাম দিল। শবনম বেগম মাথা নেড়ে সালাম গ্রহণ করলেন। খাঁচা তুলে মুরগিগুলোকে মুক্ত করতে করতে প্রশ্ন করলেন,
” ডাক্তারসাব, ভালানি? ”

সে জবাব দিল না। আরেকটু এগিয়ে ফিসফিসের মতো বলল,
” আপনার সাথে কথা আছে। ঐদিকে চলুন। ”

শবনম বেগম ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। পরক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
” আমার মেলা কাজ। ঐদিকে যাইতে পারমু না। কী কইবেন, এহানেই কন। ”

সে তাৎক্ষনিক কিছু বলল না। এক ঝলক তাকাল ঘরটার দিকে। দরজা ভেজানো, ভেতরে কে আছে বা কী হচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে চেয়ে থেকেই আগের মতো নিচু স্বরে সুধাল,
” স্বর্ণা কোথায়? ”
” ঘুমাইতাছে। ”

দৃষ্টিজোড়া ফিরিয়ে এনে সরাসরি বলল,
” আপনি এমনটা কেন করলেন? স্বর্ণাকে তো আমার বিয়ে করার কথা ছিল। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৪)

স্বর্ণলতার সাথে ডাক্তার হাদির প্রথম দেখা হয় তার বাড়িতে। প্রায় ছয় মাস আগে। এক বিকেলে। বোন বেহালা ভীষণ জ্বরে পড়েছিল, স্কুলে যাচ্ছিল না। সেও বাড়িতে থেকে গিয়েছিল। বোনের দেখভাল করছিল। সহসা আগমন ঘটে স্বর্ণলতার। কিশোরী উদ্বিগ্ন মুখ, দুই বেনি ঝুলছে কাঁধের দুইপাশে। সুতি শাড়ি প্যাচানো কচি দেহ। দুই হাত ভর্তি পাকা তেঁতুল। ডাক্তার হাদি পত্রিকা পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করেছিল,
” তুমি বেহালার বন্ধু? ”

সে জবাব দিল না। মাথা নুয়ে ফেলল। এক কদম পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। ডাক্তার হাদি পত্রিকা ভাঁজ করে রাখল। পায়ের উপর পা তুলে গম্ভীরমুখে পুনরায় সুধাল,
” হাতে কী ওগুলো? ”

স্বর্ণলতা এবারও নিরুত্তর। আরও এক কদম পিছিয়ে যেতেই সে উঠে দাঁড়াল। কাছে এগিয়ে বলল,
” প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এভাবে পেছাচ্ছ কেন? তুমি কি বোবা? ”

এবারে সে পেছাল না, জবাবও দিল না। চিবুক আরও নেমে গেল। বুকটা ছুঁইছুঁই করছে। ডাক্তার হাদি খেয়াল করল মেয়েটার হাত কাঁপছে। তেতুলগুলো পড়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। সে উপর থেকে গোটা কয়েক তেঁতুল আলগোছে তুলে নিতে নিতে বলল,
” বেহালার কাছে শুনেছি, তুমি খুব বুদ্ধিমতি। পড়ালেখায় দারুন করছ। ভবিষ্যতে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখ। নতুন মানুষ দেখলে এরকম কাঁপা-কাঁপি করলে, কথা হারিয়ে ফেললে তো স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। ”

স্বর্ণলতার ঠোঁটদুটি কেঁপে ওঠল। মাথা নিচু অবস্থায় বলল,
” ডাক্তার দেখলে আমার ভ য় লাগে। ”
” কেন? ওরা কি দেখতে ভ য়ঙ্কর? ”

সে মুখে জবাব দিল না। মাথা দু’পাশে নাড়ল। ডাক্তার হাদি দ্রুত প্রশ্ন করল,
” তাহলে ভ য় লাগার কারণ কী? ”
” আপনারে কওয়া যাইব না। ”

জবাব দিয়ে সে পেছনে ঘুরে গেল। ডাক্তার হাদিকে অবাক করে সে দৌড় লাগাল দরজার দিকে। চৌকাঠ পেরুবে তখনই সে চেঁচিয়ে বলল,
” আরে, পালাচ্ছ নাকি? বেহালার সাথে দেখা করবে না? ”

স্বর্ণলতা দৌড়ে থেকেই জবাব দিল,
” তেঁতুলগুলা ওরে দিয়েন। জ্বরের মুখে টক ভালা লাগব, জিহ্বায় স্বাদ আইব। ”

সেদিন সে সত্যি চলে গিয়েছিল। পরবর্তীতে বোনের কাছে শুনেছিল, স্বর্ণলতা ছোটবেলায় ভীষণ অসুখে পড়েছিল। মরি মরি অবস্থা! কবিরাজি চিকিৎসায় ভালো হচ্ছিল না। দরুন মা-বাবার সাথে শহরে যায়, সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার সময় তাকে দুইবার ইনজেকশন পুঁশ করে। পরবর্তীতে অসুখ সেরে গেলেও সেই পুঁশ করা স্থানটি ফুলে যায় ও ব্যথা থেকে যায় অনেকদিন। এরপর থেকে ডাক্তার দেখলেই নাকি তার ইনজেকশন পুঁশ করা স্থানটিতে ব্যথা হয়, জ্বরও আসে। গল্পটি ডাক্তার হাদিকে ভীষণ অবাক করে, কৌতূহল সৃষ্টি করে। পরদিন সকালেই সে স্বর্ণলতাদের বাসায় পৌঁছায়। বোনের থেকে শোনা গল্পটি যদি সত্যি হয়, আজও স্বর্ণলতার শরীরে ব্যথা হবে, জ্বর আসবে।

বাসায় স্বর্ণলতাকে পাওয়া গেল না। তার মায়ের সাথে পরিচয় হলো। এক ফাঁকে স্বর্ণলতার কথা জিজ্ঞেস করতেই শুনল,
” ও তো স্কুলে। আজ নাকি পরীক্ষার রেজাল্ট দিব, তাই আগে আগেই চইলা গেছে। মাইয়াডা জ্বরে কাঁপতাছিল! কত কইরা কইলাম তোর যাওয়া লাগবো না। আমি রেজাল্ট আইনা দিমুনে। কে হুনে কার কথা! জ্বর নিয়াই দৌড় দিল। ”

ডাক্তার হাদি হতবাক! নির্বোধের মতো কয়েক পল তাকিয়ে থাকে শবনম বেগমের মুখের দিকে। তিনি যে সত্যি বলছেন, বিশ্বাস করতে পারছে না। এরকম ঘটনার সম্মুখীন হলো এই প্রথম। অনেকটা সময় নীরব থেকে বলল,
” স্বর্ণলতা আসবে কখন? ”
” বৈকালে। ”
” বাসায় থাকতে বলবেন। আমি একবার এসে দেখে যাব। ”

ডাক্তার হাদি সেদিন হাসপাতালে গেল না। বাসায় ফিরে গেল। বেহালাও স্কুলে। খালি বাড়িতে একা বসে থেকে কী হলো কে জানে! দারোয়ানকে দিয়ে দুই কেজি মিষ্টি আনাল। বিকালে বেহালার হাতে ঔষধ পাঠিয়ে দিল। সেই সাথে বলে দিল, শবনম বেগমকে যেন এই বাসায় পাঠায়। জরুরি কথা আছে।

________
শবনম বেগম জরুরি তলবে এসে জানাল, স্বর্ণলতা পাশ করেছে। মেধাস্থানে দ্বিতীয় হয়ে দশম শ্রেণিতে ওঠেছে। খবর শুনে ডাক্তার হাদিও খুশি হলো। আগে থেকে আনা মিষ্টির প্যাকেট দুটো তাকে দিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা মিষ্টি পছন্দ করে তো? ”
” হ, ও তো মিষ্টির লাইগা পাগল! বাপের কাছে ঐ একটা জিনিস খাওয়ারই আবদার করে। ”
” তাহলে তো মিষ্টি কম হয়ে গেল। বসেন, আরও আনিয়ে দিচ্ছি। ”

শবনম বেগম মানা করলেন। সে শুনল না। দারোয়ানকে টাকা দিয়ে আবারও বাজারে পাঠাল। অতঃপর সোফায় বসল। শবনম বেগমকে পাশের সোফাতে বসার জন্য ইশারা করল৷ তিনি বসলেন আড়ষ্টভাবে। মাথায় টেনে রাখা আঁচলটা আরেকটু টেনে দিলেন। ডাক্তার হাদি প্রশ্ন করল,
” স্বর্ণলতা তো দারুন মেধাবী ছাত্রী। ওর পড়ালেখা নিয়ে কী ভেবেছেন? শুনেছি, ওর নাকি ঢাকায় গিয়ে পড়ার শখ? ওখানে আপনাদের আত্মীয় আছে? ”
” না। কিন্তু ওর আব্বা ডাকাতেই কাম করে। ”
” উনার কাছে থেকে পড়বে? ”

শবনম বেগম উত্তর দিতে পারেন না। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেন। স্বর্ণলতার পড়ালেখার ব্যাপারে বাবার কোনো আগ্রহ নেই। খোঁজ-খবরও নেয় না তেমন। খাতা-কলম কেনার টাকাটাও মাকেই যোগাড় করতে হয়। সরকারি স্কুল, খরচ লাগে না বিধায় মেয়েটা এখনও পড়তে পারছে। এরপর কী হবে তিনি নিজেও জানেন না! সহসা ডাক্তার হাদি বলল,
” ওর পড়ালেখার খরচ যদি আমি চালাই, আপনারা আপত্তি করবেন? ”
” আপনে চালাইবেন ক্যান? স্বর্ণা কি আপনার থেইকা সাহায্য চাইছে? ”

সে দ্রুত জবাব দিল,
” আরে না, না। স্বর্ণার সাথে আমার সেভাবে কথাই হয়নি। মেধাবী স্টুডেন্ট, পড়ার প্রতিও আগ্রহ আছে। তাই ভাবলাম…”

কথাটা শেষ করল না৷ নিজে থেকেই থেমে গেল। দৃষ্টি উদাস হলো। আপন চিন্তায় ডুবে যাওয়া মাত্র প্রশ্নটা শুনতে পেল,
” এমনি এমনি কেউ ট্যাকা দিয়া সাহায্য করে নাকি? আপনে তো আমাগো কিছু লাগেনও না। হাচা কইরা কন, আপনার মতলব কী? ”

শবনম বেগম উঠে দাঁড়ালেন। পুরো বাড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন,
” এত বড় বাড়ি! কিন্তু মানুষজন তো দেহি না। আর কেউ থাকে না? আপনার বাপ-মা কই? ”
” আমার মা নেই। বাবা ঢাকা থাকেন। ”
” পুরা বাড়িত আপনে একাই থাকেন? ”
” বেহালাও থাকে। ”

তার হঠাৎ করে কিছু মনে পড়েছে এমনভাবে বললেন,
” স্বর্ণা কাল এইখানে আইছিল না? ”
” জি। ”
” বেহালা তো অসুস্থ ছিল! আমার স্বর্ণার লগে কিছু করেন নাই তো। সত্যি কইরা কন, দোষ কাটাইতে ট্যাকা দিতে চাইতাছেন? ”

ডাক্তার হাদি যেন আকাশ থেকে পড়ল! অবস্থার বেগতিক দেখে সরাসরি বলল,
” আমি স্বর্ণাকে বিয়ে করতে চাই। ”

শবনম বেগম বিস্ময়ের অতিকে ওঠলেন বুঝি! কয়েক মুহূর্তের জন্য বাকহারা হয়ে গেলেন। স্বর্ণলতার বয়স কম, বিয়ের উপযুক্ত হয়নি এখনও। কৈশোরে পা দিয়েছে মাত্র। শরীর বদলাচ্ছে একটু একটু করে। স্বামী, সংসার কী বুঝে না। আশপাশের মানুষের সাথেও মিশে না তেমন৷ স্কুলের একমাত্র বন্ধু বেহালা। ঘরের কাজকর্মেও হাত দেয় না, বইপত্র নিয়েই থাকে সারাক্ষণ। তিনিও ডাকেন না। একা হাতেই সবকাজ করেন।

ডাক্তার হাদি পুনরায় বলল,
” আমি জানি, ওর বিয়ের বয়স হয়নি। আমি চাইলেও এখন বিয়ে করতে পারব না। আমার বাবা মানবেন না। ”
” মানার মতো হইলে তো মানবো। আপনে ডাক্তার, বড় ঘরের সন্তান। ”
” সমস্যাটা বড় ঘর, ছোট ঘরের নয়। ”
” তাইলে? ”
” ওটা পরে একসময় বলব। আপনি শুধু বলেন, পাত্র হিসেবে আমাকে পছন্দ নাকি। বাকিটা আমি সামলে নিব। ”

শবনম বেগম তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিতে পারলেন না। ডাক্তার হাদির সাথে দেখা-সাক্ষাৎ আজকেই প্রথম হয়েছে। এর আগে নাম শুনেছে। প্রশংসা শুনেছে। চরিত্র কিংবা আচার আচরণে খারাপ কিছু শুনেনি এখন পর্যন্ত। দেখতেও মাশাআল্লাহ! শুধু বয়সটা একটু বেশি। কত হবে অনুমান করতে পারছেন না।

” এখনই কিছু বলতে হবে না। বাড়িতে যান, স্বর্ণার বাবার সাথেও আলাপ করুন। ”

ডাক্তার হাদি মিষ্টির প্যাকেট দুটো তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” বাকি মিষ্টিগুলো আমি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিব। ”

শবনম বেগমকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। তিনি বাড়ির রাস্তা ধরতে সে পিছু ডাকল। সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতাকে এখনই কিছু বলার দরকার নেই। পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটবে। আমি সময় হলে জানাব। বুদ্ধিমতি মেয়ে, বুঝিয়ে বললে ঠিক বুঝবে। ”
” যদি না বুঝে? অমত করে? ”
” ওটা আমার উপর ছেড়ে দিন। ”

শবনম বেগম সারারাত এই বিষয়টি নিয়েই ভাবলেন। স্বর্ণলতার বাবার সাথে আলাপ না করেই পরেরদিন জানিয়ে দিলেন, তিনি ডাক্তার হাদির প্রস্তাবে রাজি। এরপর থেকে স্বর্ণলতার যাবতীয় খরচ সেই চালাচ্ছিল। এরমধ্যে মুনছুর সাখাওয়াতের আকস্মিক আগমন ঘটে। চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায় স্বর্ণলতাকে। সে জানতেও পারল না!

শবনম বেগম সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ডাক্তার হাদির দিকে সরাসরি দৃষ্টি রেখে বললেন,
” কথা ছিল, আমি রাখতে পারি নাই। এহন কী করবেন? ফাঁ সিতে ঝুলাইবেন? ”

তার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত ও ঝাঁঝ। সে বুঝতে পেরে বলল,
” এই রা গটা তো আমার দেখানোর কথা, আন্টি! ”
” তাইলে দেখান। আমি কি মানা করছি? ”

শবনম বেগম রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ডাক্তার হাদি তার পিছ ধরল। পেছন থেকে বলল,
” পালাচ্ছেন কেন? কথা শেষ করুন। ”

তিনি থেমে গেলেন। পেছন ফিরে প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বললেন,
” যেদিন স্বর্ণার বিয়া হইছে ঐদিনই আপনের লগে আমার কথা শেষ হইয়া গেছে। বুঝছেন? ”
” বিয়েটা হলো কীভাবে? আমি তো সেটাই বুঝছি না। স্বর্ণা আমার নামে ছিল। আপনাদের সম্মতিতেই তো…”
” আপনের কি মনে হয়, আমি সাইধা ওরে বিয়া দিছি? মহাজন কেমন মানুষ জানেন না? আমিও জানি। জাইনা বুইঝা মাইয়াডারে গাঙ্গে ভাসামু না বইলাই আপনের কাছে খবর পাঠাইছিলাম। ”
” খবর পেয়েই আমি ছুটে এসেছিলাম। ”
” তাতে লাভডা কী হইছে? আপনেরর চোখের সামনে দিয়াই তো ওরে নিয়া গেল! বাঁধা দিতে পারছেন? ”

ডাক্তার হাদির মাথানত হলো। শবনম বেগম নতমুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,
” যার লগে আপনে পারেন নাই, তার লগে আমি ক্যামনে পারমু? এটা বুঝতাছেন না? উল্টা আমার কাছে জবাব চাইতাছেন! ”
” খবরটা দেরি করে দিয়েছেন। আরও আগে যদি দিতেন তাহলে….”

তাকে কথা শেষ করতে দিল না। শবনম বেগম পূর্বেই বললেন,
” তাইলে কী করতেন? স্বর্ণারে নিয়া ভাগতেন? তাইলে ভাগেন! ”

ডাক্তার হাদি চকিতে তাকাল। সামনের মানুষটা কী বলছে! এখনও কি ভাগার মতো অবস্থায় আছে? স্বর্ণলতার যে বিয়ে হয়ে গেছে! শবনম বেগম তার চমকানো দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
” আমার মাইয়া সুখে নাই। সুখ দেওয়ার মতো মানুষ মহাজন না। আমি এহনও চাই, আপনে ওরে বিয়া করেন। ওর স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেন। সেই সুযোগ আল্লাহ কইরা দিছে। স্বর্ণা একা আছে। যান, ওরে নিয়া যান। ”

শবনম বেগম উঠোনের ঐদিকে তাকালেন। বাড়ির ঢোকার মুখটায়। দুটো ছেলে এখনও পাহারায় আছে। বাড়ির পেছনেও দুজন আছে হয়তো। সাড়া পেয়েছেন। ডাক্তার হাদির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বললেন,
” ওদের চোখে ফাঁকি দেওয়ার দায়িত্ব আমার৷ আপনে শুধু কন, স্বর্ণা রে নিবেন নাকি। ”
” কী বলছেন! মহাজন জানতে পারলে আপনাকে খু ন করে ফেলবে। ”
” করুক। আমার জানের বিনিময়ে যদি আমার মাইয়ার ভবিষ্যৎ হয়, হইল। মা হিসাবে এইটুকু কুরবানি দিতে পারুম না? ”

ডাক্তার হাদি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এই মানুষটার কি মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে? নাকি সে ভুল শুনছে? শবনম বেগম মাথাটা খানিক এগিয়ে এনে বললেন,
” কী ভাবতাছেন? স্বর্ণা এহনও কুমারি আছে। জামাইয়ের লগে ঘুমাই নাই। ওর মুখে হুনছি, মহাজনের দাদি নাকি আলাদা ঘরে রাখছে। বিশ্বাস না হইলে খোঁজ-খবর নিয়া লও। ততক্ষণে দেরি হইয়া গেলে আমারে কিছু কইতে আসবেন না। মহাজন বাড়ি গেছে, ফিরা আইতে কতক্ষণ! ”

এই সময় স্বর্ণলতার গলা পাওয়া গেল। দুয়ারে দাঁড়িয়ে ঢুলুঢুলু অবস্থায় বলছে,
” আম্মা, কার লগে কথা কও? আব্বায় আইছে? ”

উভয়ে চমকে তাকাল তার দিকে। শবনম বেগম এক ঝলক ডাক্তার হাদির দিকে চেয়ে প্রত্যুত্তর করলেন,
” না, ডাক্তারসাব আইছে। তোর লগে কথা কইব। যা হাত-মুখ ধুইয়া আয়। ”
” পরে কইলে হইব না? আরেকটু ঘুমাইতাম! ”
” এহনই কইব। কথা শেষ হইলে আবার ঘুমাইস। ”

মেয়েকে হাত-মুখ ধুতে পাঠিয়ে তিনি মনোযোগী হলেন ডাক্তার হাদির দিকে। বললেন,
” আপনের হাতে সময় বেশি নাই। জলদি সিদ্ধান্ত নেন। আমার তো স্বর্ণারেও তৈরি করতে হইব। ”

চলবে