#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৫)
স্বর্ণলতা হাত, মুখ ধুয়ে এসে দেখল, ডাক্তার হাদি উঠোনে নেই। আম্মা রান্নাঘরে উনুনে আগুন ধরাচ্ছেন। উনুনের মুখে কতগুলো শুকনো বাঁশপাতা গুঁজতে গুঁজতে তার উদ্দেশ্যে বললেন,
” ঘরে যা। ডাক্তারসাব ঘরে বইয়া আছেন। ”
সে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। ভেজা মুখ, চোখের পাতা কেমন যেন শক্ত হয়ে এলো! বিরক্ত এসে জড়ো হলো কপালের কুঞ্চনের ফাঁকে, ফুলে ওঠা নাকের পাটায়। ডাক্তার হাদিকে সে শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে। তাই বলে একা ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে গল্পগুজব করবে! স্বর্ণলতা মায়ের দিকে কয়েকপা এগিয়ে গেল। ধীরে, অতি সাবধানে ফিসফিসের মতো বলল,
” তুমি আইবা না? ”
” না। কথা তো তোর লগে কইব। আমি গিয়া কী করমু? ”
সে একবার ঘরের দরজার দিকে তাকাল। হাট হয়ে আছে। একটা লাল রঙের মুরগি তার বাচ্চাসহ ভেতরে ঢুকছে, বের হচ্ছে। ডাক্তার হাদিকে দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চিত হয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল মায়ের দিকে। আগের মতো হালকা স্বরে সুধাল,
” কী এমন কথা কইব যে, তুমি যাইতে পারবা না! তার লগে তো আমার তেমন কোনো গোপন কথা নাই। আসো না, আম্মা। আমার লজ্জা লাগতাছে। ”
উনুনে আগুন ধরে গেছে। দাউদাউ করে শিষ জ্বলছে, উড়ছে। শবনম বেগমের মুখে উত্তাপ ও লাল রঙের ছায়া পড়েছে। মুখটা পিছনে সরিয়ে নিলেন সামান্য। অতঃপর মেয়ের দিকে না ফিরেই বললেন,
” লজ্জার কী আছে? এইডা কি পরথম আলাপ? তোগো আগেও দেখা হয়ছে, কথা হয়ছে। হয় নাই, ক? ”
” হয়ছে, কিন্তু এমন চার দেয়ালের মধ্যে হয় নাই। তুমি আমার লগে না গেলে, তারে ডাকো। আমি বাইরে পিঁড়া দিতাছি। বইসা কথা কইবনে। ”
শবনম বেগম আচমকা রে গে গেলেন। চোখ পাকিয়ে কড়া স্বরে বললেন,
” দেখস না, রান্ধা বসাইছি? এত জ্বালাইতাছস ক্যান? কথা তো ডাক্তারসাব কইব। তুই হুনবি। মন চাইলে কিছু কইবি না হইলে বিদায় দিবি। এত ন্যাকামি বাদ দিয়া জলদি যা। ঘরে তো আমিই পাঠাইতাছি নাকি? ডরের কী আছে? ”
স্বর্ণলতা জায়গা থেকে নড়ল না। অসহায় ভাব ফুটে ওঠল মুখটায়। আরও একবার ঘরের দিকে তাকাতেই আম্মা তাড়া দিলেন,
” যাস নাই এহনও? পোলাডারে বেশিক্ষণ বসাইয়া রাখলে তো খাইতে দিতে হইব। ঘরে চাল ছাড়া কিছু নাই। নুনও না! যা একটু চিনি আছিল, মহাজনের শরবতে ঢাইলা দিছিলাম। এহন ঐডাও নাই। ”
সে ঘরের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে ভাবল, এই দেখা ও কথা বলার খবর যদি মহাজনের কানে যায়? বিয়ের রাতেই মানুষটা তার হাতে সন্না দিয়েছিল। কলিজা কেঁপে উঠে এমন ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, যে তাকে দেখবে, তার চোখ উ পরে ফেলবে! এরপরে কারও নজরে পড়ার সাহস করেনি। বাইরে গেলে বোরকা পরে বেরিয়েছে সবসময়। স্বর্ণলতা ঘরের চৌকাঠ পেরুতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। টের পেল, তার পা কাঁপছে! এই ভ য়টা সে তার জন্য নয়, ডাক্তার হাদির জন্য পাচ্ছে। মানুষটার সাথে খারাপ কিছু ঘটবে না তো! এই সময় ভেতর থেকে কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” দাঁড়িয়ে পড়ো না, স্বর্ণা। ভেতরে এসো। আমার একটু তাড়া আছে, হসপিটালে যেতে হবে। ”
” তাইলে হাসপাতাল থেইকা ঘুইরা আসেন, তারপরে কথা কইয়েন। ”
” না। কথাগুলো এখনই বলতে হবে। নাহলে হয়তো আর কখনও বলা হবে না! ”
” খুব জরুরি? ”
” হ্যাঁ। ”
” মুখোমুখি বইসা কইতে হইব? ”
” হ্যাঁ। ”
স্বর্ণলতা গভীর নিঃশ্বাস নিল। মনকে মানাল এই বলে যে, ডাক্তার হাদি তার স্বামীর মতো ক্ষমতাশালী না হলেও দুর্বল প্রকৃতির লোক নয়। গ্রামের মধ্যে তার সম্মান আছে, আগে-পিছে প্রশংসা পায়। এমন মানুষের চাইলেই চোখ উ পরে ফেলা যায় না। সে ভেতরে পা রাখল। ডাক্তার হাদি চৌকির এক কোণে বসে আছে। স্বর্ণলতাকেও ইশারা করল বসার জন্য। সে বিনাবাক্যে বসে তাগাদা দিল,
” কী কইবেন, কন। ”
ডাক্তার হাদি সাথে সাথে কিছু বলল না। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, স্বর্ণলতার মুখটায়। পানি শুকোয়নি এখনও। ঘামের মতো বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে ঠোঁটের উপর, নাকের দুইপাশে ও ভ্রূর মাঝে। এই মেয়েটির সাথে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঘটেছিল, স্কুলে। শিক্ষকদের অফিস কক্ষের সামনে। ডাক্তার হাদি বোনের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল। স্বর্ণলতা পরীক্ষা ফি দিয়ে বেরুচ্ছিল। সহসা মুখোমুখি হলো দুজন। মেয়েটা চমকে ওঠেছিল শুরুতে। পরক্ষণেই অপ্রতিভ হয়, দৃষ্টিসহ মাথা নামিয়ে ফেলে। কাঁধে পড়ে থাকা সাদা ওড়নাটা মাথায় তুলে পালাবে তখনই সে ডেকে ওঠল। বলল,
” শুনলাম, তুমি নাকি ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়ছ? ”
স্বর্ণলতা ছুটে চলা পা দুটোকে থামিয়ে দেয়। ঘাড় ফিরে এক ঝলক দেখে তাকে। অতঃপর পুনরায় দৃষ্টি নামিয়ে লাজুকভাবে জবাব দেয়,
” হ। ”
” আচ্ছা, বড় স্বপ্নটা কি ব্যাংকের অফিসার হওয়া? ”
” না। ”
” এই গ্রুপ থেকে পড়াশোনা করলে তো এটাই হতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হয়। ”
” আমি ঐসব কিছু হইতে চাই না। ”
” তাহলে কী হবে? ”
” ব্যবসায়ী হমু। আমাদের বইয়ে তো ব্যাংক অফিসার নিয়া তেমন কোনো শিক্ষা নাই, ব্যবসা নিয়া আছে। তাইলে ব্যবসায়ী না হইয়া ব্যাংক অফিসার হইতে যামু ক্যান। ”
” ভালো পয়েন্ট! আসলেই ব্যাংক অফিসার নিয়ে কিছু লেখা নাই? ”
স্বর্ণলতা শ্বাস ছাড়ল। মুখ ও কানজোড়া গরম হয়ে গেছে। সে এর আগে কোনো ছেলের সাথে এতগুলো কথা বলেনি। ডাক্তার হাদিকে তার ছেলের উর্ধ্বে মনে হয়। লম্বা দেহ, সুন্দর মুখ। গায়ের রঙটাও ভারি উজ্জ্বল! তাকানোর ভঙ্গি, কথা বলার ধরণেই বুঝা যায় শিক্ষা-দীক্ষায় উঁচু স্তরে বসে আছেন। বেহালার কাছে শুনেছে বয়সেও তাদের থেকে বেশ বড়। ডাক্তারি পড়া শেষ। এখন হাসপাতালে নিজস্ব কামড়ায় বসে রোগী দেখছে। এত ভালো, নম্র-ভদ্র পুরুষ মানুষটি তাদের গ্রামেই থাকে। স্বর্ণলতাদের প্রতিবেশীও। কথাটা ভাবনার মধ্যেও অবিশ্বাস লাগে।
” স্বর্ণা? উত্তর দিবে না? ”
সে আবারও গভীর নিঃশ্বাস টেনে নিল। কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বেরুল না যেন! কোনোমতে মাথা দুই পাশে নেড়ে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। একবারের জন্যও পিছু ফিরল না। একবারটি যদি চাইত, অত দূর থেকেও ডাক্তার হাদির গভীর চাহনির অর্থ টের পেয়ে যেত!
” আপনি না কইলেন, আপনার তাড়া আছে? তাইলে কথা না কইয়া চুপ কইরা আছেন ক্যান? ”
ডাক্তার হাদির চোখের পলক পড়ল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে। সেদিন দূর হতে চাইলেও যে দৃষ্টির অর্থ পড়া যেত, আজ কাছে বসেও সেই দৃষ্টির অর্থ পড়তে পারছে না। হতাশায় বাহুজোড়া শিথিল হয়েও শক্ত হয়ে গেল। শিরদাঁড়া সোজা করে, বার কয়েক পলক ফেলে বলল,
” তুমি কি আমার সাথে যাবে? ”
” কই যামু? ”
” এই ধরো, তোমার স্বপ্নের কাছে। ”
স্বর্ণলতা একটুক্ষণ চুপ থেকে আচমকা বলল,
” আমার স্বপ্নের কাছে আপনি যাইবেন ক্যামনে? আপনি তো আমার লগে ঘুমান না। ঘুমাইলেও যাইতে পারতেন না। স্বপ্ন তো ঘুমের মধ্যে থাকে। আর ঘুম থাকে চোখে। আপনার চোখ আর আমার চোখ এক না। ”
” আমি এই স্বপ্নের কথা বলছি না, স্বর্ণা। ”
” তাইলে? ”
ডাক্তার হাদি আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর বলল,
” আচ্ছা, বাদ দাও। তোমাকে অন্যকিছু বলি। ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। তার গল্পে মন বসছে না। মাথাটা ভার লাগছে। মনটাও অস্থির হয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত হুট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কোথায় গেল কে জানে!
” আমার বাবা একজন জনপ্রিয় মিউজিক ডিরেক্টর। সিনেমা, নাটকে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। নাম বললে হয়তো চিনবে। এই মুহূর্তে তাকে চেনা জরুরী নয়, তাই নাম বলছি না। ”
” তাহলে জরুরী কথাটায় কন না! ”
ডাক্তার হাদি থেমে গেল। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,
” তোমার কি আমাকে বিরক্ত লাগছে? আমি চলে যাব? ”
” আরে, না। বিরক্ত লাগবো ক্যান? আমার তো ভ য় লাগতাছে। দুশ্চিন্তাও হইতাছে। ”
” কার জন্য? ”
” আপনার জন্য। মহাজন শেষ রাইতে হঠাৎ কইরা চইলা গেছিল। এহন যদি হঠাৎ কইরা চইলা আসে? আর আমাদের ঘরের মধ্যে এমনে কথা কইতে দেখে? ”
সে প্রশ্নের জবাবটা সরাসরি না দিয়ে বলল,
” তুমি কি কিছু সময়ের জন্য মহাজনকে ভুলে থাকবে? ”
স্বর্ণলতা উত্তরটা দিতে পারল না। পূর্বেই ডাক্তার হাদি পুনরায় বলল,
” হঠাৎ করে চলে আসলেও সমস্যা নেই। সে আমার গায়ে হাত দিতে পারবে না। ”
” সত্যি? ”
ডাক্তার হাদি মাথা নাড়ল। স্বর্ণলতার মুখটা ঝলমল করে ওঠল। একটু আগে তাহলে মনকে মিথ্যা বলে মানায়নি! সে চৌকির উপর পা উঠিয়ে নিল। ডাক্তার হাদির দিকে পুরোপুরি ঘুরে বসে বলল,
” কী যেন কইতে চাইলেন? কন। আমি মহাজনরে ভুইলা থাকতাছি। ”
অনুমতিসুচক বাক্যটিতে প্রশ্রয়েরও ছোঁয়া আছে। স্বর্ণলতা চৌকিতে পড়ে থাকা হাত পাখা উঠিয়ে নিল। ডাক্তার হাদি গরমে ঘামছে! বাতাস করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
” পানি নিয়া আসমু? খাইবেন একটু? ”
” দরকার নেই। বসো। কথাগুলো শেষ করি আগে। ”
” আচ্ছা। ”
ডাক্তার হাদি কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকল। ভেতরে ভেতরে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল,
” আমার মায়ের গানের গলা ভীষণ ভালো ছিল। বাবার এত পছন্দ হলো যে, ঠিক করলেন মাকে সঙ্গীতের শিল্পী বানাবেন। সেরকম আয়োজনও শুরু হলো। একটা, দুইটা গানও রেকর্ড হলো। এরপরে ঝামেলাটা সৃষ্টি হলো। বাবা খেয়াল করলেন, মা গানের সুর মনে রাখতে পারে না। কথাগুলোও ভুলে যায়! এরকম হলে অ্যালবামটা বানাবেন কীভাবেন? আরও গান রেকর্ড করতে হবে। বাবার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও অনেক বড়। শুধু একটা নয়, শ’খানেক অ্যালবাম বানাতে চান। সিনেমার গানে গলা দিতে চান। দেশের সেরা সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে দেখতে চান। তার এই সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে মা। শুধু কণ্ঠ হলেই তো হয় না! সুর ও কথাও মনে রাখতে হবে। বাবা ভাবলেন, সাংসারিক কাজকর্মে থাকায় এই সমস্যা হচ্ছে। তাই মাকে সাংসারিক কাজ থেকে সরিয়ে দিলেন। সেইসাথে গানের শিক্ষক রাখলেন। নিয়মিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ চলতে থাকে। এমন করে একটি অ্যালবাম বের হলো। প্রচুর বিক্রিও হলো। মায়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। বাবা খুব খুশি হলেন। গর্বও বোধ করলেন এই ভেবে যে, তিনি ভুল কণ্ঠকে পছন্দ করেন নি। তাই পরের অ্যালবাম প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মায়ের খাওয়া, পরা, চলাফেরা সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে দিলেন। গানের শিক্ষক বাড়ল, রেওয়াজ বাড়ল। এ সবকিছু বাবা খুব আনন্দের সাথে করলেও মা আনন্দ পাচ্ছিল না। সে সঙ্গীত শিল্পী না, সংসারী হতে চায়। ছেলে ও স্বামীর মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চায়। এই চাওয়া কখনই বাবাকে বলতে পারেনি। শুধু অভিমান করেছে, কষ্ট পেয়েছে। রাতে আলো নিভিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে নীঃশব্দে কেঁদেছে! আমি সব দেখতাম, বুঝতাম। মায়ের কান্না বেশিদিন সহ্য করতে পারলাম না। একদিন বাবার মুখোমুখি হলাম। মায়ের পক্ষে কথা বললাম। তিনি সেসব আমলেই নিলেন না। উল্টো আমাকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আমার এত রা গ হলো যে, ছুটিতেও বাড়ি যেতাম না। আমি বোর্ডিংয়ে থাকা অবস্থায় বেহালার জন্ম হলো। পৃথিবীতে এলো। আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। বোনকে দেখার জন্য ছুটে গেলাম। তাকে দেখলাম, কোলে নিয়ে আদর করার সময় খবর পেলাম, মা নেই! ”
সে থেমে গেল। অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে আসা চোখদুটি অন্যদিকে সরিয়ে নিল। স্বর্ণলতা পাখা ঘুরানো বন্ধ করে বলল,
” যে গল্প শুনাইলে কষ্ট বাড়ে, সেই গল্প শুনাইতাছেন ক্যান? ”
” বলছি। আরেকটু অপেক্ষা করো। ”
” আচ্ছা। ”
” গলাটা শুকিয়ে গেছে। একটু পানি খাওয়াবে? ”
স্বর্ণলতা উঠল কিন্তু বের হতে পারল না৷ পূর্বেই বাঁধা দিয়ে বলল,
” থাক। সময় নষ্ট হচ্ছে। কথা শেষ করি আগে। স্বর্ণা, বসো। ”
সে বসে পড়ল। পাখাটা হাতে নিয়ে বলল,
” দুঃখ পাইয়েন না। বাচ্চা জন্ম দেওয়া অনেক কষ্ট! সুবর্ণ যখন হইল? তখন তো আমি আম্মার লগেই। কী যে য ন্ত্রণা হয়! আমি তো কাইন্দা দিছিলাম! অমন য ন্ত্রণা সবাই সহ্য করতে পারে না। আপনার মাও হয়তো পারে নাই..”
” আমার সময় সহ্য করতে পারলে বেহালার সময় পারবে না কেন? আমার মা ইচ্ছে করেই সহ্য করেনি, স্বর্ণা। তার বেঁচে থাকার ইচ্ছা মরে গিয়েছিল। আমি বোর্ডিংয়ে যাওয়ার পর আম্মা আরও একা হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে যে কাঁদবে সেরকমও কেউ ছিল না তো! ”
স্বর্ণলতা জবাবে কী বলবে খুঁজে পেল না। দৃষ্টিনত করে পাখা ঘুরাতে থাকে। ডাক্তার হাদি আবারও বলতে লাগল,
” মাকে কবরে রেখে ঐবাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাবাকে সহ্য হচ্ছিল না। চোখের সামনে পড়লেই বুকের মধ্যে আ গুন জ্বলে ওঠত! যদি হাত উঠিয়ে ফেলি? এই ভ য়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম। সেই যে বের হলাম আর ঢুকিনি। দূরে থেকেই বেহালার খোঁজ-খবর রাখতাম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর, সেখানে গিয়ে দেখা করতাম। তারপর পড়াশুনা শেষ হলো। বাড়িতে না উঠে তোমাদের এই সুয়াপুরে আসলাম। আমার নানাবাড়িতে। খবরটা বাবার কাছে পৌঁছাতে ছুটে এলেন। আমাকে নিয়ে যেতে চান। ছেলে এমবিবিএস ডাক্তার হয়েছে অথচ বাবার সাথে থাকছে না! সংবাদটা মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে, উনার সম্মানে লাগবে খুব। ”
এখানে এসে সে জোর করে থামল। স্বর্ণলতার মুখটায় চেয়ে বলল,
” আমি বুঝতে পারছি, আমার কথার অনেক কিছুই বুঝছ না। কতগুলো শব্দ আজই প্রথম শুনছ। ”
” হ। ওগুলোও কি গল্প শেষ হইলে বুঝাবেন? ”
ডাক্তার হাদি মৃদু হাসল। মাথা নেড়ে পরবর্তী অংশে চলে গেল,
” বাবা জোরাজুরি করেও আমাকে নিয়ে যেতে পারলেন না। শেষে বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ এখানে থাকতে চাও? থাকো। আমি বাঁধা দিব না। শুধু কথা দাও, আমার অমতে বিয়ে করবে না। তুমি আমার একমাত্র ছেলে, বংশের রক্ষাটা তোমাকেই করতে হবে। তাই যাকে-তাকে বিয়ে করে বসলে চলবে না। আমার বাড়ির বউ হবে, তোমার মায়ের মতো। শিক্ষিত, সুন্দরী, প্রতিভাসম্পন্না। ‘ ঐ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আমি কোনোদিন বিয়েই করব না। তাই বাবাকে কথা দিয়ে বিদায় করেছিলাম। এর প্রায় চার বছর পরে হঠাৎ করেই বেহালা আসে। একা, খালি হাতে। অথচ থাকবে কিছুদিন। আমি ভাবলাম বেড়াতে এসেছে। পরে শুনি, বাবার সাথে ঝগড়া করে পালিয়ে এসেছে। মায়ের মতো ওর ও গান-টানে আগ্রহ নেই। অথচ বাবা শিশুকাল থেকেই নাকি গান শেখাচ্ছেন। মাকে দিয়ে যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি, সেই স্বপ্ন বেহালাকে দিয়ে পূরণ করতে চান। সেই একই অত্যাচার, বাড়াবাড়ি! আমার মাথায় র ক্ত চড়ে গেল। মেয়ের পেছন পেছন বাবাও ছুটে এলেন সুয়াপুরে। বেহালাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। সে যেতে চায় না। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। অনুরোধ করল, তাকে যেন রেখে দিই। বেহালা এখানে থেকে পড়াশুনা করবে, জীবন গড়বে। সেই অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। ভ য় হলো, মায়ের মতো বোনটাও যদি কিছু করে বসে! তাই বাবার সাথে যুদ্ধটা করতেই হলো। স্বর্ণা, সেই যুদ্ধটা শেষ হয়নি। এখনও চলছে। এরমধ্যে যদি আমি আরেকটা যুদ্ধ শুরু করি, তাহলে কি আমি টিকতে পারব? ”
” আরও একটা যুদ্ধ? ঐটা কার লগে হইব? ”
” মহাজনের সাথে। তোমাকে যদি আমার বাসায় নিয়ে যাই, তাহলে কি সে চুপ থাকবে? অন্য কোথাও পালিয়েও যেতে পারব না। বাবাকে দেওয়া কথাটা নাহয় ভেঙে দিলাম। কিন্তু বেহালা? তার ভবিষ্যৎ কী হবে? সে বাবার কাছে যাবে না। আমি জোর করে পাঠালে যদি খারাপ কিছু হয়? সাথে করে নিয়ে গেলেও কি শান্তিতে থাকতে পারবে? আমি এখানে নতুন করে শুরু করেছিলাম। আরেক জায়গায়ও করতে পারব। আমার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তোমার আর বেহালার ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি জেনে-বুঝে দুটো জীবন ধ্বংস করে দিই কী করে? আর কোনোভাবে যদি যুদ্ধে হেরে যাই, মহাজনের হাতে আমার মৃ ত্যু হয়, তখন? বেহালা বাবার কাছে যেতে বাধ্য হবে কিন্তু তোমার কী হবে? এখন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছ, তখন সেটাও পারবে না। মহাজনের বউ হিসেবে যে পরিচয় পেয়েছ সেটাও হারাবে। তোমার পরিবার আদৌ টিকে থাকবে নাকি জানি না। মহাজনকে আমার থেকেও তুমি ভালো জানো। ”
স্বর্ণলতা নিমগ্নে কথাগুলো শুনছিল, আচমকায় চমকে ওঠল। হকচকিয়ে গেল। হাত থেকে পাখাটা পড়ে গেল। ডাক্তার হাদি খেয়াল করে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটার চোখদুটিতে চেয়ে থাকতে পারছে না! পাশে বসে থাকতেও ভীষণ বিব্রত লাগছিল। দরজার দিকে ফিরে বলল,
” তোমার হয়তো মনে হচ্ছে, এতকিছু কেন বললাম? যার অর্ধেকটায় তুমি বুঝতে পারছ না। কিন্তু স্বর্ণা, আজ বুঝতে পারছ না। কাল ঠিকই বুঝবে। তখন যদি মনে হয়, আমার আজকের নেওয়া সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়নি তাহলে আমার দিকে ফিরেও তাকিয়ো না। আমি কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিব। ”
ডাক্তার হাদি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শবনম বেগম উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়লেও কিছু বলল না। নীঃশব্দে হাঁটা ধরতেই শুনতে পেল,
” ডাক্তারসাব, আপনে স্বর্ণলতা রে পছন্দ করছেন ঠিকই কিন্তু ভালোবাসেন নাই। ভালোবাসা না পাইলে কষ্ট হয় আর পছন্দের জিনিস না পাইলে আফসোস হয়। স্বর্ণা আপনার চিরকালের আফসোস হইয়া থাকব। ”
সে থামল কিন্তু পিছনে ফিরল না। জবাবও দিল না। শবনম বেগম আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন,
” ভালোবাসায় অন্ধ হইলে মাইনষে নিন্দা করলেও আমি প্রশংসা করি। মনে হয়, সত্যিকারের ভালোবাসায় অন্ধ হইতে হয় নইলে দুনিয়ার লগে লড়াই করা যায় না। ”
_________
বাড়ি ফিরে মুনছুর সাখাওয়াতের দেখা হলো আসমানের সাথে। সে দৌড়ে এসে পায়ে পড়ে বলল,
” এত কঠোর হবেন না, মহাজন। একটু ভিতরে ঢুকতে দেন। আমার বউ অসুস্থ, একটু দেখা না পেয়ে যে মরে যাচ্ছি! ”
দারোয়ান ছুটে এসে জানাল, মুনছুর সাখাওয়াত বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই আসমান আসে। ভেতরে ঢুকতে চায়। সে ঢুকতে দেয়নি। এই বাড়িতে পুরুষদের ঢোকা নিষেধ। যারা ঢুকে তাদের পূর্ব থেকেই অনুমতি দেওয়া থাকে। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়িতে নেই, আসমানের ব্যাপারে কিছু জানিয়েও যায়নি। তাই বাইরে আটকে রেখেছে এত সময় ধরে।
আসমান মাথা তুলে পুনরায় কাতর স্বরে বলল,
” আমাকে ঢুকতে না দিলে, চাঁদনিকে বের করে আনুন। ও কে নিয়ে আমি শহরে ফিরে যাব। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আচমকা সজোরে লা থি মারল। আসমানের দেহটা দূরে ছিটকে পড়তেই সে হুং কার ছাড়ল,
” ছয় বছর হলো বিয়ে হয়েছে৷ একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারল না এখনও! মাইগ্যাটাকে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধ। আমি শরীরটা ধুয়ে আসছি। ওর সাথে আমার বুঝাপড়া আছে। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৬)
খাইরুন নিসা ফজরের সালাত আদায় করছিলেন। সুন্নত শেষ করে ফরজের নিয়ত বাঁধতেই মনোযোগ সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় চলে গেল বাইরে, বসার রুমটার দিকে। ধপধপ শব্দ হচ্ছে, ভূমি কাঁপছে। তীক্ষ্ণ একটা শব্দ তুলে ধাতুর কী যেন একটা মেঝেতে ঘর্ষণ করে সরে গেল! তিনি চমকে ওঠলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সূরা পাঠ বন্ধ রাখলেন। এই হাঁটা তার একমাত্র নাতির। কী ভ য়ানক রে গে আছে! সামনে যা পাচ্ছে, লা থি মারছে। ছেলেটা রে গে গেলে পা দুটো পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে যায় বোধ হয়! নাহলে মাটি অমন করে কাঁপবে কেন? খাইরুন নিসা পুনরায় নামাজের নিয়ত ধরলেন। অন্য সময়ের মতো দীর্ঘ সিজদাহ দিলেন না। যতটা সম্ভব দ্রুত নামাজ শেষ করলেন। নামাজের পর নিয়মিত কুরআন পাঠ করেন। আজ সেই নিয়মটা ভাঙতে হলো জোর করে। মনোযোগ বসছে না। বুকের ভিতরে অস্থিরতার ঝড় বয়ছে। দুশ্চিন্তায় নিঃশ্বাস ঘন ও উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত বউকে আনতে গিয়েছিল, সে কি এলো? তার শরীরটা এখন কেমন? নাতির কাছে অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়েছিল, এরপরে কী ঘটেছিল? অসুস্থ মেয়েটাকে জোর করে তুলে আনেনি তো? একের পর এক প্রশ্ন হামলা করছে মস্তিষ্ক ও মনে। খাইরুন নিসা জায়নামাজটাও ভাঁজ করলেন না। কোনোমতে তুলে বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রথমে উঁকি দিলেন পাশের রুমটায়। চাঁদনি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, অন্য কেউ নেই। তাহলে কি স্বর্ণলতাকে নিজের ঘরে তুলল! তিনি মাথায় পরে থাকা দীর্ঘ হিজাবটা টেনে ঠিক করতে করতে ছুটলেন নাতির ঘরের দিকে। ভ য়াবহ রা গের আঁচ পেয়েছেন নামাজে থেকেই। এই অবস্থায় মাথা, মন কিছুই কাজ করবে না। মেয়েটার গায়ে হাত না তুললেই হয়! মুনছুরের তো কথার চেয়েও হাত বেশি চলে!
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। তিনি দুই হাতে জোরে জোরে থাপ্পড় মেরে ডাকলেন,
” মুনছুর? আমার দাদাভাই! কখন এলি? ”
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এলো,
” মাত্রই। ”
” দরজাটা খোল। ”
” আগে গোসল করি। ”
” দরজাটা খুলে দিয়ে যা। ”
” দাদিজান, জ্বালিও না তো! ”
কণ্ঠটায় রাগের আভাস নেই। মৃদু অনুরোধ ও বিরক্ত মিশে আছে। খাইরুন নিসা সামান্য বিরতি দিলেন। নীরবে কান পাতলেন দরজায়। ওপাশে একজোড়া পায়ের ছুটাছুটির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। স্বর্ণলতার কি জ্ঞান ফিরেনি? কেউ, কারও সাথে কথা বলছে না কেন? নাকি আরও ভ য়ঙ্কর কিছু ঘটেছে? তার উদ্বিগ্নতা কমার বদলে বাড়ে। নীরবতা ভেঙে সরাসরি প্রশ্নটা করলেন,
” স্বর্ণলতা কোথায়? ”
” কোথায় আবার? ওর বাড়িতেই। ”
” আসেনি? ”
জবাব এলো না। দরজার ওপাশটাও নীরব। কোনোরূপ সাড়াশব্দ নেই। খাইরুন নিসা প্রশ্নটা আরও একবার করলেন
আগের চেয়েও উঁচু স্বরে। এবারও জবাব এলো না। ভাবতে বাধ্য হলেন, ছেলেটা স্নাগারে ঢুকে পড়েছে। পানি পড়ার শব্দটাও মৃদু হয়ে ভেসে আসছে। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাবধানে মৃদুস্বরে ডাকলেন,
” স্বর্ণলতা? ”
সাথে সাথে জবাব এলো,
” বললাম তো এখানে নেই, তারপরও বিরক্ত করছ কেন? শান্তিতে গোসলটাও করতে দিবে না? ”
খাইরুন নিসা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। দ্রুত বুঝে গেলেন, বউকে নিয়ে আসতে পারেনি বলেই এত রা গ, অশান্ত। কিছু আনার উদ্দেশ্যে বের হলে সচরাচর খালি হাতে ফিরে না! তিনি প্রত্যুত্তর করলেন না। নীঃশব্দে সরে এলেন তার দোরগোড়া থেকে। মূল দরজাটা হাট হয়ে আছে। এগিয়ে চাপাবেন, তখনই চাপা কণ্ঠগুলো কানে প্রবেশ করল। আপনমনে বিড়বিড় করলেন, ‘ পান্না আর কাশেমের গলা না? বাড়ির ভেতরে কী করছে? ‘ তিনি কৌতূহলী হলেন। একসময় এদের এই বাড়িতে অবাধ যাওয়া-আসা ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত বিয়ে করার পর কমে এসেছে। রোজ সকালে বাজার করে দেয় যে ছেলেটা, তারও চলনপথ ঐ উঠোন পর্যন্ত।
খাইরুন নিসা কৌতূহলীবদনে বাইরে উঁকি দিলেন, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে চাপা গুঞ্জন ভেসে আসছে, কাঁঠাল গাছটার ঐদিক থেকে। ওখানে বেশ কিছু চেয়ার সাজানো থাকে। মুনছুর সাখাওয়াত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় মিটিং করে এখানে বসে। এখন কি মিটিং চলছে? কার সাথে? প্রশ্নটা মনে উদয় হওয়া মাত্র তৃতীয় কণ্ঠটা ভেসে এলো। প্রায় চিৎকার করে বলছে,
” আমাকে ছেড়ে দিন। দয়া করে, ছেড়ে দিন। আমি চাঁদনির কাছে যাব। ও যে খুব অসুস্থ! ”
আকুল আবেদনময় কণ্ঠটা আসমানের। খাইরুন নিসার ধরতে সময় লাগল না। তখনই বেরিয়ে এলেন বাইরে। বারান্দার সিঁড়ি পেরিয়ে উঠোনে নামলেন। কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত ধৈর্য হলো না। দূর থেকেই চেঁচালেন,
” এই, ছাড় বলছি। ও কে বাঁধছিস কেন? ”
মোটা দড়ি দিয়ে আসমানের পুরো দেহটায় বাঁধা হয়েছে। শেষ গিট্টুটা পড়েছে পায়ের কাছে। পান্না ও কাশেম সেটাই শক্ত করতে করতে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। সহসা দাদিজানের কণ্ঠ পেয়ে উঠে দাঁড়ায়। একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। কয়েকপা এগিয়েও যায় সামনে। ততক্ষণে খাইরুন নিসা পৌঁছে গেছেন। আসমানের দিকে চাইতে সে কেঁদে ফেলল। দু’চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে! ভীষণ অসহায় ও করুণ কণ্ঠে বলল,
” বিশ্বাস করেন, দাদিজান। আমি কিছু করিনি৷ আপনার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলাম, দারোয়ান ঢুকতে দেয়…”
পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। পান্না ধ মকে ওঠল,
” চুপ, শালা! তোর কাছে কিছু জানতে চায়ছে? ”
খাইরুন নিসা পাল্টা ধ মকে ওঠলেন,
” ভদ্র ভাষায় কথা বল, পান্না। আসমান এই বাড়ির জামাই। ”
সে থেমে গেল। দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই পুনরায় বললেন,
” ও কে বেঁধেছিস কেন? ছাড় বলছি। এখনই ছাড়বি। ”
পাশ থেকে কাশেম বিনয়ের সাথে বলল,
” মহাজনের আদেশে বানছি, দাদিজান। তার আদেশ ছাড়া তো ছাড়া যাইব না! ”
” মুনছুর বাঁধতে বলবে কেন? কী করেছে ও? ”
” কিছু না করেই দোষ করেছে। ”
” মানে? ”
কাশেম বিস্তারিত কাহিনি বলল। অপরাধের কারণ শুনে খাইরুন নিসা হতভম্ব হয়ে গেলেন! এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই, এটাও ঠাওর করে মুখ ফেরালেন। আগের মতো দ্রুত পদধ্বনি তুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। আরও একবার গিয়ে দাঁড়ালেন নাতির দরজার সামনে। এবার ডাকতে হলো না। দরজায় এক আঘাত পড়তে খুলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত ভেজা উন্মোক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের কাছে সাবানের ফ্যানা জমে আছে। মাথা থেকে টপটপে পানি পড়ছে কাঁধে। সেই পানি গড়িয়ে গিয়ে পড়ছে ফ্যানার কাছেই! চোখদুটি কী ভীষণ লাল! উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গড়িয়ে পড়ছে নাসা থেকে। তিনি একই সাথে ভীত ও স্নেহপূর্ণ হলেন। ছেলেটা রা গী, বদমেজাজি, নিষ্ঠুর হলেও এলোমেলো নয়। ভীষণ পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন। সর্বদায় নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করে।
মুনছুর সাখাওয়াত দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে বলল,
” দরজা খোলায় আছে। ভেতরে যাও, নিজ চোখে দেখে বিশ্বাস করো যে, স্বর্ণলতা আসেনি। ”
খাইরুন নিসা খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে সরে এলেন। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক পলকের জন্য তাকালেন বুকটায়। মাথার পানিতে ফ্যানা ধুয়ে গেছে অনেকটা।
” এবার বিশ্বাস হলো? ”
” আমার আগেই বিশ্বাস হয়েছিল। ”
” তাহলে আবারও ডাকছিলে কেন? ”
” অন্য কথা বলতে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত হাঁটা ধরল। সামনে পা ফেলতে ফেলতে বলল,
” পরে শুনব। ”
” এখনই শুনতে হবে। মুনছুর, দাঁড়া। ”
সে দাঁড়াল না। খাইরুন নিসা পিছু ধরলেন। বড় বড় কদম ফেলেও তাকে ধরতে পারছে না। বাধ্য হয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
” আসমানের গায়ে হাত দিবি না। আমি কিন্তু খুব রা গ করব। ”
দীর্ঘকায় দেহটা থেমে গেল। ঘাড়টা ঘুরিয়ে দাদিজানের দিকে তাকাল কিন্তু কোনো কথা বলল না। খাইরুন নিসা এই সুযোগে আরও কয়েক কদম এগিয়ে এসে বললেন,
” তুই বাড়াবাড়ি করছিস। এসব ঠিক হচ্ছে না। অভিশাপ লাগবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল। বিদ্রুপের মতো বলল,
” কার? ঐ মাইগ্যাটার? অভিশাপ তো ওর উপরেই পড়েছে। ছয় বছর পেরিয়ে গেল এখনও সন্তানের মুখ দেখতে পেল না! ”
” এটা অভিশাপ না, ভালোবাসা। আসমান ওর বউকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাই চাঁদনির ইচ্ছেটাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। ”
” ছাই ভালোবাসা! দোষ কাটানোর ভালো বুদ্ধি মাত্র! আমার তো মনে হয়, ওর মধ্যে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার শক্তি নেই। পুরুষত্বের অভাব। এজন্যই বউয়ের পা ধরে থাকে, যা বলে তাই শুনে। ”
” তাহলে তো তোরও পুরুষত্বের অভাব। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখজোড়া জ্বলে ওঠল। মুহূ্র্তেই কঠোর হয়ে ওঠল চোয়ালদ্বয়। কটমটে হয়ে ওঠল বদনখানা। খাইরুন নিসা মৃদু হেসে বললেন,
” ভুল বলেছি? ”
” অবশ্যই ভুল বলেছ। আমাকে দেখলে শুধু নারী না পুরুষও ভ য়ে কাঁপে! ”
” স্বর্ণলতা কাঁপে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত দাঁত চর্বন করা থামিয়ে দিল। দৃষ্টি শীতল ও উদাস হচ্ছে। গতকালের প্রতিটি মুহূর্তকেই স্মৃতির পাতায় সাজাল, একটা পাতাতেও স্বর্ণলতার ভীত মুখটা বসল না। মেয়েটা কি ভ য় পাওয়া ভুলে গেল? অথচ একদিন পূর্বেও ভ য়ে কেমন থরথর করে কেঁপেছে! জোর করেও চোখ মেলে থাকতে পারেনি। সে মাথা ঝাকাল। ঠাট বজায় রেখে বলল,
” অবশ্যই কাঁপে। এর সাক্ষী তো তুমি নিজেই। ”
” ছিলাম। এখন নেই। স্বর্ণলতা ওর বাড়িতে, আমি এবাড়িতে। গতকাল রাতে ওখানেই ছিলি, কী হয়েছে তোদের মাঝে? ”
” কী হবে? সবসময়ের মতো ভ য়ে অজ্ঞান হয়ে গেল! তোমাকে না ফোনে বললাম? ”
” হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু শোনা কথা সবসময় সত্যও হয় না। ”
” তুমি কিন্তু আবারও আমাকে অবিশ্বাস করছ, দাদিজান। ”
” করার কারণ আছে, তাই করছি। ও যদি তোকে ভ য়ই পাবে, তাহলে সঙ্গে এলো না কেন? তুই তো স্বর্ণলতাকে আনতে গিয়েছিলি। না আসলেও জোর করে উঠিয়ে আনার কথা। তোর স্বভাবের সাথে ওটাই মানায়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একটু চমকাল। দাদিজান কি তাকে উস্কাচ্ছে? খাইরুন নিসা পুনরায় বললেন,
” আনলি না কেন? ”
” এমনি। ”
সে ঘুরে গেল। চৌকাঠে পা রাখতে তিনি বললেন,
” সত্যিটা না বলেই পালাচ্ছিস, মুনছুর। জোর করলে ও কষ্ট পাবে, তাই আনিসনি। এখানে পুরুষত্ব না, ভালোবাসা আগে আসে। ঠিক যেমন আসমানেরও এসেছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চৌকাঠে একপা উঠিয়ে থামল। পেছন না ফিরে বলল,
” আমি কাউকে ভালোবাসি না, দাদিজান। কেউ একজন প্রমাণ করেছে, আমার মধ্যে হৃদয় নেই। ভালোবাসা তো হৃদয় থেকেই আসে, তাই না? ”
সে বারান্দায় নেমে এলো। কিন্তু উঠোনের দিকে অগ্রসর হলো না। মনে হলো, বুঝাপড়াটা আসমান না, চাঁদনির সাথে করা উচিত। সবকিছুর মূলে এই অভদ্র, বেহায়া মেয়েটাই তো আছে। মুনছুর সাখাওয়াত তখনই বাড়ির ভেতরে ফিরে এলো। দাদিজানকে উপেক্ষা করে তার রুমের দিকে পা বাড়ানোর সময়, স্বর্ণলতার মুখটা মনে পড়ল। তার সাথে কাটানো সময়গুলোও। দাদিজানের কথা একেবারেই ফেলে দেওয়া যায় না। সত্যিই তো বউটা আসতে চায়নি তো কী হয়েছে? সে চাইলে জোর করে আনতে পারত। স্বর্ণলতা বার বার বলেছে, সে বাঁধা দিবে না। প্রশ্রয় পেয়েও জোরটা দেখাতে পারল না কেন! তাহলে কি সেও আসমানের মতো পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলছে? দুইদিন পর বউয়ের পা ধরে থাকবে? যা বলবে, তাই শুনবে! চাঁদনির রুমের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মনস্থির করল, সে শুধু বোঝাপড়া করবে। মাফ-টাফ চাইবে না। মহিলা মানুষের কাছে মাফ চাওয়া মানেই মাথা নত হওয়া, পুরুষত্ব কমে যাওয়া। সে জেনে-বুঝে এই কাজটা কখনই করবে না। এখন স্বর্ণলতা নিজ ইচ্ছায় আসলে ভালো, নাহলে সত্যি তুলে আনবে। তার কষ্ট পাওয়ায় মুনছুর সাখাওয়াতের কিছু যায় আসে না।
” থেমে গেলে যে? ভেতরে আসো। অনেক দিন হয়, তোমাকে দেখি না। খুব মনে পড়ছিল! ”
চাঁদনির কণ্ঠ দুর্বল ও ক্লান্ত। মুনছুর সাখাওয়াত নির্দ্বিধায় ভেতরে প্রবেশ করল। বুক উঁচা করে শানিত দৃষ্টি রাখল মুখটায়। তারপরে প্রশ্ন করল,
” তোর বাচ্চা-কাচ্চা নেই কেন? ”
সে ঘুম থেকে মাত্রই ওঠেছে। শরীর পুরো সুস্থ নয়। চোখ হলদে, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। সিধা হয়ে বসে থাকতে পারছে না। খাটের পেছনে হেলান দিয়ে রয়ে-সয়ে স্পষ্টভাবে বলল,
” তোমার সাথে শুইনি বলে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মাথায় র ক্ত উঠে গেল বুঝি! একটুও সময় ব্যয় করল না, ভাবনা-চিন্তায় গেল না। সোজা গলা টিপে ধরে বলল,
” যদি খু ন হতে না চাস, সত্যি কথা বল। তোর জামাইকেও বেঁধে রাখছি। ওটাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করব না। শরীরে ক্যারাসিন ঢেলে, আগুন লাগিয়ে দিব। ”
গলায় চাপ পড়ায় তার মুখ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। এবার ভ য়ে ছটফট করতে লাগল। দুইহাতে মুনছুর সাখাওয়াতকে খামচে ধরতে চাচ্ছে, পারছে না। সে গলাসহ মাথাটা পেছনে সরিয়ে ফেলেছে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে অস্পষ্টভাবে টেনে টেনে বলল,
” বলছি। ছাড়ো। ”
সে ছাড়ার বদলে আঙুলের চাপ আরও বাড়াল। অতঃপর হু মকি ছাড়ল,
” সত্যি বলবি তো? ”
সে জবাব দিতে পারল না। চোখের পলক ফেলে বুঝাল, বলবে।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৭)
মুনছুর সাখাওয়াত গলা থেকে হাত সরিয়ে নিল। চাঁদনি ম রণপণ লড়াইয়ে জিতে গেলেও সুস্থ থাকতে পারল না। সাথে সাথেই কাশি উঠল। বিরমাহীন, কিছুতেই থামছে না। পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম! ঠিকমতো শ্বাসকার্যটাও চলছে না। চোখ, মুখের অবস্থা বেদনাপূর্ণ। মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূদ্বয় কুঁচকে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বার দুয়েক গোঁফে হাত চালিয়ে ধৈর্য ধরল। শুকনো চোখ ও রুক্ষ মুখটায় সামান্যতম মায়া কিংবা দরদ নেই। চাঁদনির শিয়রের কাছেই কাঠের ছোট্ট টেবিলটা। পানিভর্তি জগ ও গ্লাসও আছে। মুনছুর সাখাওয়াতের প্রতীক্ষিত চোখদুটি খেয়াল করল। বুঝতে পারল, মেয়েটার গলায় পানি পড়া প্রয়োজন। তবুও পানি ঢেলে গ্লাস তুলে দিল না। পরোপকারী তার স্বভাবে নেই। সে কাজ করে শুধুমাত্র নিজের জন্য, আপন স্বার্থে। চাঁদনি কাশির তোড়ে ভীষণ কাঁপছে! শ্বাসকষ্টটাও বাড়ছে। কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারছে না। মুনছুর সাখাওয়াত পানির জগটার দিকে ইশারা করে নীরস গলায় বলল,
” ম রণ কাশি উঠল নাকি? একটু পানি খেতে পারছিস না? ”
সে মাথা নাড়ল। কাঁপা হাতে পানির জগের হাতলটা চেপে ধরল। উঁচু করতে পারছে না। এত ভারী ঠেকছে! বহুকষ্টে সামান্য উঁচু করল। এতেই দেহের সকল শক্তি ফুরিয়ে গেল বুঝি। পানি ঢালবে তো দূর গ্লাসের কাছেও নিতে পারল না। এর পূর্বেই হাত ফসকে জগটা পড়ে গেল। পানি ছিটকে পড়ল টেবিল, বিছানা ও মেঝেতে। মুনছুর সাখাওয়াত বিরক্তসূচক শব্দ করে বাইরে বেরিয়ে এলো। দূর হতে দেখল, দাদিজান বসার রুমে। সোফার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত কদমে কয়েকপা এগিয়ে আদেশের সুরে বলল,
” চাঁদনির রুমে পানি পাঠাও। ”
রান্নাঘরে ময়না কাজ করছিল। দাদিজান তাকে পানিসহ পাঠালেন। চাঁদনির রুমে ঢুকে যেতেই নাতির কাছে এলেন ক্ষিপ্রপায়ে। চাপা শা সানোর স্বরে বললেন,
” তুই কিন্তু কথা দিয়েছিলি, বাড়ির মধ্যে কাউকে মা রধোর করবি না। ”
” মা রধোর নয়, র ক্ত ঝরাব না বলেছিলাম। ”
” সেটাও তো করছিস। ”
” কার র ক্ত ঝরালাম? ”
মুনছুর সাখাওয়াতেরও গলা শুকিয়ে এসেছে। সে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল খাবার টেবিলটায়। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে শুনল,
” রুমকির। তোর নিজেরও তো ঝরেছিল! ভুলে গেলি? ”
” ওটা ইচ্ছাকৃত ছিল না, দাদিজান। ”
সে পানি খাচ্ছে। এটুকু সময় চুপ থাকলেন খাইরুন নিসা। খাওয়া শেষ হতে বললেন,
” রুমকিরটা তো ইচ্ছাকৃত? চাঁদনির কপালেও র ক্ত জমেছিল। আরেকটু আঘাত পেলেই হয়তো…”
” হয়তো ঝরত। কিন্তু ঝরেনি তো! তার আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ”
” এখন কী করে এসেছিস? মেয়েটাকে না মে রে শান্তি হচ্ছে না? ”
” অশান্তিটা ওই বাড়াচ্ছে! আমি শুধু কমানোর চেষ্টা করছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানকে উপেক্ষা করে হাঁটা ধরল। চাঁদনির রুমের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ালে, ময়না নত মাথায় বেরিয়ে এলো। সে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। চাঁদনির কাশি থামলেও, শরীরের কাঁপুনি থামেনি এখনও। বসার ভঙ্গিতে ভীষণ দুর্বলতা। চোখ-মুখের অবস্থা করুণ। এসব কিছুকে অগ্রাহ্য করে বলল,
” অনেক সময় নষ্ট করেছিস। এবার মুখটা খোল। ”
সে মুখ তুলে তাকাল। নিষ্প্রাণ চাহনি। চোখজোড়া বুঁজে আসতে চাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত ধ মকে ওঠল,
” মুখ খুলবি নাকি সারা জীবনের জন্য বন্ধ করে দিব? ”
চাঁদনি ফুঁপিয়ে ওঠল। অনুযোগ তুলে বলল,
” তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? ”
” প্রশ্ন নয়, আমার উত্তর চাই। ”
সে গভীর নিঃশ্বাস টানল। দুটো শুকনো ঢোক গিলে ধীরে ধীরে বলতে লাগল,
” সেদিন আমাকে অনেক ভালোবেসেছিলে, মুনছুর। আমাদের দুটো শরীর প্রথমবারের মতো এক হয়েছিল। আমরা পাগলের মতো একে-অপরকে..”
কথার মাঝেই ঠাঁই করে চ ড় পড়ল। এত ভারি ও আকস্মিক আ ঘাতে চাঁদনির মাথা ঝিম ধরে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল যেন! কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা আসছে না। এরমাঝেই মুনছুর সাখাওয়াত গর্জে ওঠল,
” যা শুনতে চেয়েছি, তাই বল। একটা শব্দও বাড়তি বললে, লা থি খাবি। ঠিক তোর এই বুক বরাবর লা থি দিব। ”
চাঁদনির দুই চোখে অশ্রুর উপচে পড়া ভিড়! অভিমান ও অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আছে। গালে একটা হাত রেখে ভার গলায় বলল,
” সেদিনের পর তো আমাকে জোর করে বিয়ে দিলে! আমার অনেক কষ্ট হয়, অভিমান হয়। ঠিক করি তোমার সাথে আর কখনও যোগাযোগ করব না। আসমানের বাড়িতে গেলেও, ও কে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। তাই দূরে দূরেই থাকছিলাম। এরমধ্যে টের পাই, আমি সন্তান সম্ভবা। শুরুতে ভয় পেয়ে যাই। আসমানকে কী জবাব দিব! তাই দিন-রাত ভাবতে থাকি কী করা যায়। হঠাৎই মনে পড়ে, আমি আসমানকে এখনও গ্রহণ করিনি। তোমার বাচ্চাও আমার পেটে। এই খবর পেলে তুমি খুশি হবে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। মিলন যেভাবেই হোক, বাচ্চা তো তোমারই। তাই খবর পাঠাই। কিন্তু তুমি আসোনি। ডাক্তার হাদিকে পাঠালে, বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। আমি যে প্রতিবাদ করব সেই সাহসও পাই না। যদি হেরে যাই? তখন তো আমার একুল-ওকুল দুই-ই যাবে! তাই চুপচাপ বাচ্চা নষ্ট করি। শুরুতে বাচ্চাটার জন্য মনখারাপ হয়নি। কিন্তু দিন যত এগুতে লাগল, বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূণ্য হতে লাগল! রাতে ঘুম আসে না। আস্তে আস্তে শূণ্য বুকে নতুন কষ্ট জড়ো হতে লাগে। টের পাই, তোমাকে হারিয়েও আমি এতটা কষ্ট পাইনি, যতটা বাচ্চার জন্য পাচ্ছি। খাওয়া-পরা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। অসুস্থ হয়ে বিছানায়ও পড়ে থাকলাম সপ্তাহের মতো। ঐ সময় কেমন করে যেন আসমান আমার কাছে চলে আসে। তোমার মতো করে…”
চাঁদনি থেমে যায়। ধীরে ধীরে তাকায় মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। চোখে অ গ্নির মতো উত্তাপ ছড়াচ্ছে। দুই হাত মুঠো পাকা। এই হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
” স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্কটা হয়ে গেলেও সন্তানের প্রতি টান আসল না। আসমান বেশ কয়েকবার বলেছে। আমিও মনে মনে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঔষধ খাওয়া বন্ধ করতে পারছিলাম না। ”
” কেন? ঔষধে কি মধু ছিল নাকি যে লোভ সামলাতে পারছিলি না? ”
” লোভ না, মুনছুর। আমার আসলে রা গ হচ্ছিল তোমার উপর। মনে হচ্ছিল, তুমি অনেকগুলো দোষ করেছ অথচ একবারও ক্ষমা চাওনি। সবসময় আমাকে অবহেলা করেছ নাহয় রা গ দেখিয়েছ। শেষবার তো স্বার্থোদ্বারও করলে! আমার প্রথম বাচ্চাটাও নষ্ট করালে। তাই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, যতদিন না তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছ ততদিন আমি বাচ্চা নিব না। মাও হব না। ”
” এসব কিছু তোর পাওনা ছিল। আমি কখনও তোর কাছে গেছি? সবসময় তুই আমার কাছে এসেছিস। অন্যায় করার সুযোগ তো তুই দিয়েছিস। যদিও এসবকে আমার অন্যায় মনে হচ্ছে না। যা আমার জন্য ক্ষতি তা উপরে ফেলা উচিত। আমি সেই উচিত কাজটাই করেছি। ”
” ঠিক আছে। সব ভুল, অন্যায় আমার। কিন্তু তুমি তো বড় ছিলে, একবার কি পারতে না আমাকে বুঝিয়ে বলতে? ”
” না, পারতাম না। এসব আজাইরা দায় মুনছুর কাঁধে নেয় না। ”
চাঁদনি চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে নিল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলাচ্ছে। কথা বলার সময়ও গালটা টনটন করছে। নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে হাঁ করে।
” তুমি কি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে না? ”
” এত কিছু ঘটানোর পরও এই আশা হয় কী করে? ”
” দেখ, এসব ঘটানোর কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। তোমাকে আমি মন থেকে সরিয়েই ফেলেছিলাম। দাদিজান ডাকল বলে এলাম। ভেবেছিলাম, তোমার থেকে ক্ষমাটা উশুল করে নিব। কিন্তু তোমাকে দেখার পর কেমন যেন ঘেটে গেলাম! তোমার বউটাকে দেখলেই আমার হিংসা হতো। ওর জায়গাটা পাওয়ার জন্য কত পাগলামিই না করলাম, তারপরও পেলাম না। অথচ স্বর্ণলতা কত সহজেই পেয়ে গেল! ”
‘ স্বর্ণলতা ‘ নামটা কানে প্রবেশ করা মাত্রই শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়ায়। হাতের মুঠো খুলে গেল। চোখের চাহনি, মুখের ভঙ্গি, দাঁড়ানোর ধরণ সবকিছুতে কেমন যেন ব্যর্থতার ছাপ চলে এলো। মেয়েটা মুনছুর সাখাওয়াতকে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সে তো তাকে পায়নি!
” মুনছুর, এত পাষাণ হয়ো না। একটু সদয় হও। আমি মা হতে চাই। শুধু একবারের জন্য স্বীকার করো যে, তুমি অন্যায় করেছ। মন থেকে করতে হবে না। মুখে মুখে করো, তাহলেই হবে। কথা দিচ্ছি, আমি এখান থেকে চলে যাব। তোমার আর স্বর্ণলতার মাঝে কখনও আসব না। ”
” আসবি না কেন? আমার প্রতি ভালোবাসা শেষ? ”
” না। সত্যিকারের ভালোবাসার শেষ হয় না কখনও, সময়ের বিবর্তনে শুধু বেড়ে যায়। ”
” সত্যিকারের ভালোবাসা তো একজনের জন্যই আসে, তাই না? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে আসমানকে কি মিথ্যা ভালোবাসিস? ”
” ও কে আমি ভালোবাসি না। সত্য না, মিথ্যাও না৷ ”
” আসলেই? কিন্তু মুখ খোলার কারণ তো আসমানই। যদি ভালোবাসা না থাকে, তাহলে ভয় পেলি কেন? ”
” ওটা ভালোবাসা না, সম্পর্কের মায়া। মানুষটা না থাকলে আমার কী হবে? মা নেই, বাবা নিরুদ্দেশ। তুমিও তো আমাকে দেখবে না! ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুগ্ধ হলো। ভালোবাসা ছাড়াও এরকম মায়া, দরদ হয়? তাহলে স্বর্ণলতার হচ্ছে না কেন? চাঁদনি আর আসমানের মতো তারাও তো স্বামী-স্ত্রী! মুনছুর সাখাওয়াতের মনে হলো, স্বর্ণলতার ভালোবাসা না হলেও চলবে, শুধু এই সম্পর্কের মায়াটুকু থাকলেই হবে। সে চাঁদনির পাশে বসল। খোশমেজাজে বলল,
” বুকের মধ্যে একটা বিরাট পাথর বসেছিল। সেটার ওজন কমিয়ে দিলি। এই খুশিতে তোর প্রতিজ্ঞাটা রক্ষা করতে ইচ্ছে করছে। ”
” তুমি কি ক্ষমা চাচ্ছ? ”
” হ্যাঁ, এবার ফিরে গিয়ে বাচ্চা নিবি। ”
” তোমার অন্যায় স্বীকার করে নিচ্ছ? ”
” ঐদিন মদ খাওয়া ঠিক হয়নি। ”
চাঁদনি চট করে বিছানা থেকে নামল। মুনছুর সাখাওয়াতের পা ধরে বলল,
” আমারও অন্যায় হয়েছে, ঐদিন তোমাকে উস্কানো উচিত হয়নি। ক্ষমা করো। ”
সে পা ছাড়াল না। বিছানায় দুই হাত রেখে পেছনে হালকা হেলে বলল,
” অবশ্যই ক্ষমা করব কিন্তু একটা শর্তে। ”
” কী শর্ত? ”
” আমি যে তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছি, এই কথাটা যেন স্বর্ণলতা না জানে। ”
চাঁদনি অবাক হয়ে বলল,
” ও জানবে কেন? ও তো এতকিছু জানে না। যা জানে, তাও বিশ্বাস করেনি। মুখ দেখলেই বুঝা যায়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। মনে মনে বলল, ‘ স্বর্ণা, সব জানে। তুই, আমি যা জানি না তাও জানে। আমি মাফ চাইলে যে, তুইও মাফ চাইবি এটাও জানত। ‘ সে উঠে দাঁড়াল। দরজা মেলে বের হবে তখনই চাঁদনি শুধাল,
” আসমানকে ছেড়ে দিবে তো? ”
” মূল্য পেলে অবশ্যই দিব। ”
” কিসের মূল্য? ”
সে ঘাড় ফেরাল, কুটিল হেসে বলল,
” জানিস না, মুনছুর বিনা মূল্যে কিছু করে না? এত কষ্ট করে সময় নিয়ে বাঁধলাম, এমনি ছেড়ে দিব? ”
” কী চাও? ”
” স্বর্ণলতাকে এই বাড়িতে দেখতে চাই। ”
” মানে কী? ও এখনও আসেনি? আমি যে শুনলাম, তুমি আনতে গেছ? ”
” গেছিলাম, কিন্তু আনিনি। এখন তুই আনবি। ”
” আমার সাথে আসবে? ”
” না আসলে আসমান গাছের সাথে বাঁধা থাকবে। ও কে এক ফোঁটা পানিও দেওয়া হবে না। এখন দেখি, তোর সম্পর্কের মায়া কতটা গভীর! ”
সে বেরিয়ে এলো। চাঁদনিও দুর্বল শরীরটাকে নিয়ে পেছন পেছন ছুটে এসে ডাকল,
” মুনছুর, শোন না। ”
সে থমকে গিয়ে বলল,
” আমাকে ভাই আর স্বর্ণলতাকে ভাবি ডাকা অভ্যাস কর। এটাই শেষ, আর মনে করাব না। ”
চাঁদনিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পুনরায় বলল,
” তোর ভাবির দুটো ভাইবোন আছে না? এবার গিয়ে দেখলাম না কেন? খোঁজ নিয়ে জানাস তো। ”
_______
স্বর্ণলতা তাক থেকে বইগুলো নামাল। একটা দড়ি দিয়ে বাঁধতে চাইলে, কলি সাহায্য করে। শবনম বেগম লবণ দিয়ে ভাত মাখছেন। মেয়েকে মুখে তুলে খাওয়াবেন। সকালের নাস্তায় এছাড়া আর কিছু নেই! স্বর্ণলতা বইগুলো বেঁধে চৌকির নিচে রাখল। অতঃপর মায়ের কাছে খেতে বসল। একবার খেয়ে আরেকবার হাঁ করতে চেয়েও থেমে গেল। আচমকা বলল,
” ডাক্তার হাদির মতো উনিও শুদ্ধ ভাষায় কথা কয়, আমগো মতো নাকে বাজে না, টান-টুনও দেয় না। উনিও কি ঢাকার মানুষ? ”
” কার কথা কছ? ”
” তোমগো মহাজনের কথা কই। দাদিজানের কথা বলাও সুন্দর। চাঁদনিবুও শুদ্ধ কইরা কথা কয়, কিন্তু আঞ্চলিক টান থাকে। বুঝা যায়, এই গ্রামেরই মাইয়া। ”
শবনম বেগম মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন,
” ঢাহার মানুষ নাকি কইতে পারমু না। কিন্তু আমার যহন নতুন বিয়া হইল তহন হুনছিলাম বাইরে থেইকা একডা পরিবার আইছে, বিদ্যানগরে থাকার লাইগ্যা। নতুন বউ, জামাই ছাড়া বাইরে যাউন নিষেধ। তোর বাপে আমারে কোনোদিন নিয়া যায় নাই, তাই দেখতেও পারি নাই। তুই যহন আমার পেডে আইলি, তহন আমগো বাড়ির পেছনে একডা মাঠ আছিল। পোলােপান বল খেলত। মাঝেমধ্যেই বল উইড়া আইসা পড়ত আমগো চালে। আমি বকতাম। কইতাম, বল দিমু না। কিন্তু পরতিবারই একডা পোলাই আইত বল নিতে। চোখ লাল কইরা পেটের দিকে এমনভাবে চাইত! মনে হইত, বল না দিলে ব্যাট দিয়া পেটের মইধ্যেই বাড়ি মা রবো। আমি ভ য়ে দিয়া দিতাম। ”
” ঐ পোলাডাই কি তোমাগো মহাজন? ”
” হ। চেহারা তেমন মিলে না, কিন্তু তাকানোর ভঙ্গিডা অমনই লাগে। আরেক গেরামের তো? তাই সামনে না আইলে দেখার উপায় নাই। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৮)
স্বর্ণলতা মুখে ভাত নিয়ে উদাস হলো। ভাতের দানা চিবুচ্ছে ধীরে ধীরে। একস্থির দৃষ্টি ঘরের দরজা পেরিয়ে গিয়েছে। অন্যমনস্কভাবেই বলল,
” মানুষটা ছোটকাল থেইকাই এমন? ”
” কেমন? ”
” ভ য়ঙ্কর, বেপরোয়া, জন্তুজানোয়ারের মতো হিং স্র! ”
তার দৃষ্টি ফিরে এলো ঘরের মধ্যে, মায়ের কাছে। মুখের ভাতটা গিলে নিয়ে অস্থিরভাবে বলল,
” আরও খারাপ। আমি আসলে বুঝাইতে পারতাছি না, আম্মা। ”
শবনম বেগম শিউরে ওঠলেন! প্লেটসহ হাতটা কেঁপে ওঠল। দ্রুত প্লেটটা নামিয়ে রেখে মেয়ের গাল স্পর্শ করলেন। ব্যাকুল স্বরে সুধালেন,
” তোরে কি মা রে? ”
এই পর্যায়ে স্বর্ণলতা চমকে ওঠল। দৃষ্টি আটকে গেল মায়ের মুখটায়। উত্তরটা তৎক্ষনাৎ মুখে এলো না। মুনছুর সাখাওয়াত তাকে মে রেছে, এরকম কোনো ঘটনা মনে ভাসছে না। সে আরেকটু ভাবল, মস্তিষ্কে চাপ বাড়াল। প্রায় মিনিট খানেক সময় নীরবে ভাবার পর উপলব্ধি করল, মানুষটা তাকে আজ অবধি একটা ধ মকও দেয়নি। সে ভেতরে ভেতরে আশ্চর্য হলো। বাইরে প্রকাশ করল না। শুধু বলল,
” না, এখনও মা রে নাই। ”
শবনম বেগম প্রশ্নটা করে দম আটকে রেখেছিলেন। এবার ছাড়লেন! গাল থেকে হাতটা সরিয়ে প্লেটটা তুলে নিতে নিতে বললেন,
” হাতের সরম ভাঙ্গে নাই এহনও। ”
” হাতের সরম? ”
” হ, জামাইয়ের হাতের সরম একবার ভাইঙ্গা গেলে, বউরা সারা জীবনই মা র খায়। ”
” সারা জীবন থাকতাছে ক্যা? ”
স্বর্ণলতা পেছনে তাকাল। দড়ি দিয়ে বাঁধা বইগুলো চৌকির নিচে রাখা আছে। সেদিকে চেয়ে বলল,
” মেট্রিকটা পাশ হইতে দাও শুধু, তারপরেই ভাগমু। ”
শবনম বেগম প্লেটটা আবারও বিছানায় রাখলেন। এঁটো হাতটাসহ দুইহাতের সাহায়্যে স্বর্ণলতার মুখটা সামনে ঘুরালেন। বিপন্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কী কছ এগুলা? কার লগে ভাগবি? ”
” ঐ চিন্তা পরে। আগে মেট্রিক পাশের ব্যবস্থা করি। ”
তিনি মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরলেন। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালেন এক ঝলক। বাড়িতে ঢোকার মুখে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মোটা লাঠি! দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে ফিসফিসের মতো বললেন,
” দায়ে পইড়া তোরে গাঙ্গে ভাসাইছিলাম। আল্লাহ ডুবতে দেয় নাই, সুস্থদেহে ডাঙ্গায় তুইলা দিছে। এহানেই সুখ খুঁইজা নে, মা। আর লোভ করিস না। ”
” এইডা লোভ না, আম্মা। নিজের জন্য লড়াই। ”
শবনম বেগম মেয়েকে ছেড়ে দিলেন। ছুটে এলেন বইয়ের কাছে। কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই বইয়ের গাঁটরি তুলে জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন। স্বর্ণলতা দৌড়ে এলো। জানালার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করতে করতে বলল,
” এডা কী করলা, আম্মা? ”
” ভালা করছি। এই বই যদি ঘরে ফেরত আহে, তাইলে উনুনে ঢুকাইয়া থুমু। ”
স্বর্ণলতা এই হু কমিকে পরোয়া করল না। ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। শবনম বেগম হাত বাড়িয়েও আটকাতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে কলির উদ্দেশ্যে বললেন,
” খাড়াইয়া আছ ক্যা? স্বর্ণা রে আটকাও। নইলে মহাজন রে কইয়া দিমু, ওরে ভাগতে তুমি সাহায্য করছ। ”
কলি দৌড়ে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা উঠোনে নেমে ডানে ঘুরল। বাড়ির এইপাশটা ঘুরে যেতে হবে। বেশিদূর এগোতে পারল না। দূর হতে ভিন্ন স্বরে ডাকটা উড়ে এলো,
” মুনছুরের বউ না? এই দাঁড়াও। এভাবে ছুটছ কেন? ”
সে থমকে যেতে বাধ্য হলো। কণ্ঠটা চেনা। শুনে অভ্যস্ত। সে ঘাড় ফেরাল। সাথে সাথে বিস্ময়ের ছটা ছড়িয়ে পড়ল কিশোরী চোখ দুটিতে। কয়েকপা এগিয়ে এসে জবাব দিল,
” চাঁদনিবু? আপনে এখানে যে? ”
চাঁদনি একগাল হাসল। পায়ের গতি বাড়িয়ে আরও কাছে এগিয়ে এলো। স্বর্ণলতার একটা হাত ধরে সৌহার্দপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” তোমাকে দেখতে আসলাম। সেই যে আমাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে এলে আর তো দেখতে গেলে না! তাই আমিই চলে এলাম। ”
সে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। ঐবাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় চাঁদনি ঘুমিয়ে ছিল, তাই বলেও আসেনি। তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে নিশ্চয়?
” বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে? ভেতরে বসতে দিবে না, মুনছুরের বউ? ”
” বসতে দিমু না ক্যা? আসেন না! আপনার যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ বইসা থাকবেন। ”
স্বর্ণলতা তাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে এলো। চৌকিতে বসিয়ে হাত পাখাটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
” উনি আমার আম্মা। ”
শবনম বেগম ঘরের একপাশে চেপে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথায় কাপড় তুলতে তুলতে অস্পষ্টভাবে সালাম দিল। চাঁদনিও উত্তর দিল মাথা নেড়ে। তারপরে স্বর্ণলতার হাত থেকে পাখাটা কেড়ে নিয়ে বলল,
” বাতাস করতে হবে না, আমার পাশে বসো। তোমাকে একটু দেখি। খুব শুকিয়ে গেছ। ”
” একটুও না। আমি শুকামু ক্যা? আপনি শুকাইছেন, অসুখ তো আপনার হইছিল। ”
” তাই নাকি? আসার সময় তো আয়না দেখিনি। দেখলে বুঝা যেত কে সত্যি বলছে। ”
এই পর্যায়ে শবনম বেগম এগিয়ে এলেন। আড়ষ্টভাবে বললেন,
” আমগো বাড়িত আয়না নাই, ম্যাডাম। একটু বহেন, আমি নিলুগো বাড়ি থেইকা আইনা দিতাছি। ”
সে চটপটে বেরিয়ে গেল। এই সুযোগে স্বর্ণলতা সুধাল,
” আপনে কি আমারে নিতে আসছেন? ”
চাঁদনি শুরুতে অবাক হলো। পরক্ষণে হেসে ফেলল। প্রশংসাপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” তোমার তো খুব বুদ্ধি হচ্ছে। কী সুন্দর বুঝে গেলে! ”
” আপনারে ক্যা পাঠাইছে? দাদিজান নাকি উনি? ”
” দুজনেই। ”
” চাঁদনিবু মিথ্যা কইবেন না। আমার সত্যিটা জানা দরকার। ”
সে একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” মুনছুর পাঠাইছে। ”
” আমারে কিছু কইতে কইছে? ”
” না ”
” কোনো কাগজপত্র দিছে? ”
” না। ”
” তাইলে আমি যাইতে পারমু না। ”
” ওমা! যেতে পারবে না কেন? আমি গাড়ি নিয়ে আসছি তো। তোমাকে ধরে থাকব। একটুও ঝাকি খাবে না। ”
স্বর্ণলতা তার পাশ থেকে উঠে গেল। পাখাটা পুনরায় হাতে নিয়ে বলল,
” আপনের কাছে মিথ্যা কইতে ইচ্ছা করতাছে না। আবার সত্যিটাও কইতে পারমু না। তাই অনুরোধ করতাছি, এই প্রশ্নটা আর করবেন না। ”
চাঁদনিও উঠে দাঁড়াল। তার মুখের হাসির উজ্জ্বল রঙটা নেই, মুখ ভার করে বলল,
” সত্যি যাবে না, মুনছুরের বউ? ”
” না। ”
” আমি যে কথা দিয়ে আসছি! ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদনি সেই মুখটা উঁচু করে বলল,
” তোমাকে যেতেই হবে নাহলে আসমানকে ও ছাড়বে না। ”
” আসমান ভাই উনার কাছে? ”
তার কণ্ঠে শঙ্কা, ভ য়। মনের ভেতর অস্থিরতার ঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। চাঁদনির চোখজোড়া ছলছল করছে। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,
” হ্যাঁ। গাছের সাথে বেঁ ধে রাখছে। খাবার, পানিও দিবে না বলেছে। ”
স্বর্ণলতার হাত থেকে তালপাখাটা পড়ে গেল। ধপাস করে বসল চৌকিতে। চোখের পাতা ও শ্বাস উভয় বন্ধ করে রাখল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। অতঃপর বলল,
” উনারে ছাড়ানোর আর কোনো উপায় নাই, চাঁদনিবু? ”
সে পাশে বসল ধীরেসুস্থে। স্বর্ণলতার চোখে চোখ রেখে মৃদু মাথা নেড়ে বলল,
” না। ”
স্বর্ণলতা ভেঙে পড়তে গিয়েও সামলে ওঠল। গভীর দৃষ্টি রাখল চাঁদনির মুখপানে। এই গভীর বিষাদ, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখভঙ্গির অন্তরালে কী যেন একটা ভাসছে! সে সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। প্রশ্ন করল,
” চাঁদনিবু, তুমি কি কিছু কইতে চাও? ”
সে নড়েচড়ে ওঠল। দৃষ্টি এদিক-ওদিক ফেলতে ফেলতে বলল,
” না তো। ”
স্বর্ণলতা জোরের সাথে বলল,
” কওয়ার থাকলে কও। এখনই সঠিক সময়। ”
চাঁদনি ঝটিতে উঠে দাঁড়াল। এক-দুই কদম আগে-পিছে হাঁটল। পরিশেষে খানিক শক্ত স্বরে বলল,
” তোমার তো ভালো সাহস হয়েছে। একটু ভালো করে কথা বলেছি অমনি আমার উপর হুকুম চালাচ্ছ! ”
সে ঘুরে দাঁড়াল স্বর্ণলতার দিকে। গলাটা এগিয়ে আগের চেয়েও অধিক শক্ত স্বরে বলল,
” তোমরা কি মেহমানের খাতির-যত্নও করতে পার না? একজন আয়না আনার নাম করে পালিয়েছে আরেকজন সময়-জ্ঞান শেখাচ্ছে। মুনছুর কোথায় বিয়ে করল! ”
স্বর্ণলতা কোনো জবাব দিল না। মুখের দিকে চেয়ে আছে শুধু। চাঁদনি ঘৃণায় নাক, মুখ কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণে রা গে ফুঁসে ওঠছে। ঘরময় পায়চারি করে পুনরায় বলল,
” এই মেয়ে, যাও ব্যাগ গুছাও। তুমি এখনই আমার সাথে যাবে। ”
স্বর্ণলতা এবারও জবাব দিল না। জায়গা থেকেও নড়ল না। আগের ভঙ্গিতে একস্থির চেয়ে আছে চাঁদনির মুখপানে। সে হঠাৎই তার একহাত চেপে ধরে বলল,
” এখানে নেওয়ার মতো আছে কী যে, ব্যাগ গুছাবে! কিছু নেওয়া লাগবে না। শুধু তুমি চললেই হবে। ”
চাঁদনি তাকে টেনেধরে হাঁটতে লাগল। স্বর্ণলতা এত বিরক্ত হলো! মুখের সম্পূর্ণ অংশটায় কুঁচকে এলো। হাত-পা সব শক্ত হয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আচমকা থমকে গেল। অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে ভাবল, এদের সম্পর্কের মাঝে কিছু হোক বা না হোক তার কিছুই যায়-আসে না। তারপরেও এদের এত গুরুত্ব দিয়ে কী লাভ? এই মুহূর্তে তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত পড়াশুনায়।
” দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? হাঁটো। ”
” না। আমি কোথাও যামু না, চাঁদনিবু। হাত ছাড়েন। ”
” যাবে না মানে? জোর করে তুলে নিয়ে যাব। ”
” এই সাহস বা অধিকার কোনোটায় আপনার নাই। যদি জোর কইরা নিতেই হয় তাইলে উনারে ডাকেন। ”
সে ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল। চাঁদনিকে ঘরে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো। সোজা হেঁটে চলে গেল জানালার কাছে। বইগুলো এখানে পড়ে আছে। মাটি ও ধুলোবালি পড়েছে। দড়ির গিঁট ঢিলা হয়ে দুটো বই অর্ধেকটা বের হয়ে আছে। স্বর্ণলতা উবু হয়ে বইগুলো ঠেসে ভরল। গিঁটটা ঠিক করে কোলে তুলে নিল পুরো গাঁটরিটা। সাবধানে উঠোনের দিকে হাঁটছিল। সহসা ঝড়ের গতিতে কেউ তার কাছে এলো। কোনো কিছু আঁচ করার পূর্বেই বইয়ের গাঁটরিসহ তাকে পাঁজা কোলা করে হাঁটা ধরল রাস্তার দিকে। মুনছুর সাখাওয়াতের জীপগাড়িটা ঐদিকে দাঁড় করা আছে।
চলবে