#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৩৯)
আচমকা কোলে তুলে নেওয়ায় স্বর্ণলতা আরম্ভে চমকে ওঠেছিল। ভ য়ে বুক কেঁপে ওঠেছিল। কণ্ঠনালী থেকে চিক্কুর বের হবে তখনই মেঘনাদের মতো কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” বইগুলো পড়ে যাচ্ছে তো, ঠিক করে ধরো। ”
স্বর্ণলতার কণ্ঠপথে জ্যাম বেঁধে গেল বোধ হয়! শব্দের অভাবে পড়ল। ঝটিতে তাকাল ওপরে। মোটা গোঁফের উগ্রমূর্তিটা! ধারাল থুতনিতে অল্পস্বল্প দাড়ি উঁকি মারছে। উত্তাপ ছড়ানো চোখদুটি তার মুখের দিকে বিঁধে আছে তীরের মতো। অপলকে চেয়ে থেকে স্বর্ণলতার দেহটা আরেকটু উঁচু করল। বুকের দিকে টেনে নিয়ে আরও গভীরভাবে চেপে ধরে বলল,
” তুমি বলেছিলে, জোর করে নিয়ে যেতে। একটুও বাঁধা দিবে না। আশা করছি, কথা রাখবে। ”
স্বর্ণলতা চোখ সরিয়ে নিল। গাল ফুলিয়ে, মুখ গোমড়া করে আছে। মানুষটা সত্যি মাফ চায়নি! চাঁদনিবুর মনের মধ্যে অন্য কোনো কথা ছিল না। সে ভুল ভেবেছে। অযথায় বিরক্ত হয়েছে, জেদ ধরেছে। স্বর্ণলতা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। হাত-পায়ের বেঁচে থাকা শক্তিটাও ইচ্ছে করেই হারিয়ে ফেলল। মুনছুর সাখাওয়াত তাকে বুকের মাঝে এমনভাবে গুঁজে রাখল যে, বইয়ের গাঁটরিটাও হাত দিয়ে ধরে রাখতে হলো না। নিজে থেকেই নির্জীবভাবে পড়ে আছে। তারা উঠোনের মাঝে পৌঁছাতে চাঁদনির গলা পেল,
” তুমিও চলে এসেছ? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জীপের দিকে এগুতে এগুতে জবাব দিল,
” এলাম। ”
” আমাকে পাঠিয়েছিলে তো? একটু ভরসা করতে পারলে না? ”
” আমার নিজের ওপরেই ভরসা নেই। ”
স্বর্ণলতাকে এবার সামনে বসাল; প্রথমবারের মতো। ওড়না দিয়ে মাথা ও মুখ ঢেকে দিয়ে বসল ড্রাইভারের সীটে। গাড়ি চালু করতেই শুনল,
” চাঁদনিবু গাড়িতে উঠে নাই। ”
” মুনছুরের গাড়িতে যে-সে উঠতে পারে না। ”
” উনি আপনাগো অতিথি। ”
” আমার কোনো অতিথি নেই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত নিজ হস্তে বউয়ের মাথায় ওড়না পরিয়ে দিল। মুখের প্রায় সম্পূর্ণ অংশটায় ঢেকে ফেলল। বইয়ের গাঁটরিতে হাত বাড়ালে স্বর্ণলতা বলল,
” ধরবেন না। এগুলা আমার। আমার কাছেই থাকবো। ”
” তোমার বসতে কষ্ট হবে। ”
” তাইলে নাইমা যাই? ”
সে হাত সরিয়ে নিল। গাড়ি ছুটাল গ্রামের সরু পথে। আঁকাবাঁকা ও অমসৃণ পথ। জায়গায় জায়গায় ছোট-বড় গর্ত। মাঝেমধ্যে পাড় ভাঙা। দুইপাশের গাছের ঢালপালা নেমে এসেছে। বাঁশঝাড় থেকে শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ছে। মুনছুর সাখাওয়াতের সর্বোচ্চ গতিতে জীপ চালানোর অভ্যাস। এসব ভাঙাচোরাকে গুরুত্ব দেয় না কখনও। আজ দিল, গাড়ির গতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনল। সদা সতর্ক থেকে ধীরেসুস্থে সামনে এগুচ্ছে। এতেও স্বর্ণলতা একবার ডানে, আরেকবার বামে হেলে পড়ছে। সে খেয়াল করল, যতবারই হেলে পড়ছে ততবারই বইয়ের গাঁটরিটাকে দুইহাতে আগলে ধরছে। ভাবখানা এমন তার চেয়েও বইয়ের মূল্য বেশি। পড়ে গেলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। মুনছুর সাখাওয়াত এই দৃশ্যটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। সুয়াপুর থেকে বের হয়ে কিতাবগড়ের রাস্তা ধরামাত্র আচমকা বইয়ের গাঁটরি তুলে নিল। পেছনে ঢিল মেরে সুধীর গলায় বলল,
” ঠিক করে বসো। আরেকবার হেলে পড়লে বইগুলো রাস্তায় ফেলে যাব। ”
স্বর্ণলতা মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলল। চট করে পেছনে ফিরে দেখল, বইগুলো দড়ি থেকে আলগা হয়ে গেলেও নিচে পড়েনি। সে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। সীটে ঠিকঠাকভাবে বসে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকল।
_________
খাইরুন নিসা সকালের নাস্তা নিয়ে বসে আছেন। খাবারে রুচি আসছে না। আজকাল ক্ষুধাও টের পান না। নিয়ম করে ঔষধ খেতে হয় বিধায় খাবারের কথা মনে রাখতে হয়। বিস্বাদ ঠেকলেও খেতে হয়।
” আম্মাজান, রুডি কি বদলাইয়া দিমু? এগুলা ঠাণ্ডা হইয়া যাইতাছে। ”
রুমকি নেই, স্বর্ণলতাও নেই। তাই ময়নার পরিবেশন করা খাবারই খেতে হচ্ছে। খাইরুন নিসা ভীষণ বিরক্ত ও অসন্তোষের সাথে বললেন,
” তোর কোনো কাজ নেই? মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”
” আছে তো। আপনের খাওয়া না হইলে ক্যামনে যাই? কিছু লাগলে ক্যা দিবো? ”
” কাউকে দিতে হবে না। তোর কাজে যা। ”
” সত্যি যামু? ”
তিনি চোখ পা কালেন। সে মাথা নত করে দ্রুত কদমে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। খাইরুন নিসা ভীষণ অবহেলায় রুটিতে হাত দিলেন। এক টুকরো ছিঁড়ে আলাদা করে মুখে পুড়বেন তখনই কানে শব্দটা পৌঁছাল। জীপগাড়ির ছুটে আসার শব্দ। তিনি রুটির টুকরোটা প্লেটে ফেরত রাখলেন। তারপরে ঘনঘন পা ফেলে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এলো। তার পেছন পেছন স্বর্ণলতা। আধহাত ঘোমটা টানা, হাত কচলাচ্ছে।
সে সংশয় নিয়ে সুধাল,
” এলো? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না, মৃদু হাসল। স্ত্রীর দিকে এক ঝলক চেয়ে বলল,
” আগেরবার নাতবউ এনেছিলাম, এবার সম্পদ আনলাম। তোমার কাছে আমানত রেখে যাচ্ছি। ঠিকমতো রক্ষা করো। প্রথমবার মাফ করেছি, দ্বিতীয়বার মাফ করব না। ”
খাইরুন নিসা চমকে তাকালেন। ভ য়ে বৃদ্ধ শরীরখানা কেঁপে ওঠল। স্বর্ণলতাকে বাড়িতে যাওয়ার সবরকম ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন যে, মুনছুর কি জেনে গিয়েছে?
” শেষ বয়সে গৃহহারা হতে চাও না নিশ্চয়? যদি বের হতেই হয় এক কাপড়ে, খালি হাতে বের হবে। অন্যকিছু নিতে দিব না। দাদাজানের রেখে যাওয়া একটা সুতোও না। ”
” আমাকে বের করে দিবি? তোর দাদিজানকে? কষ্ট হবে না? ”
” তোমার কষ্ট হয়েছিল? ”
” আমি তোকে বের করে দিইনি। ”
” আমার বউকে দিয়েছ। ”
” বের করে দিইনি। ও যেতে চেয়েছিল, আমি শুধু…”
” ঐটাও করা যাবে না, দাদিজান। ”
মুনছুর সাখাওয়াত পেছনে তাকাল। স্বর্ণলতার তার ঠিক এক কদম পেছনে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সমানে পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছে! সে পা থেকে জুতো খুলে বলল,
” এগুলো পরো। এখন থেকে সবসময় জুতা পরে থাকবে। ”
স্বর্ণলতা জুতা পড়ল না। জুতো জোড়া ডিঙিয়ে বারান্দায় ওঠল। দাদিজানের কাছে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে দীপ্তস্বরে বলল,
” দাদিজান, গাড়িতে আমার কিছু সম্পদ পইড়া আছে। ঐগুলা যেন সসম্মানে আমার ঘরে পৌঁছাইয়া দেয়। ”
বড় দরজা খোলা ছিল। সে ভেতরে ঢুকে গেল। একবারের জন্যও পেছনে ফিরল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বলল,
” এই মেয়েকে তুমি বাচ্চা বলেছিলে না? ”
খাইরুন নিসার হাসি পেল। ঠোঁট টিপে হাসি আটকে বললেন,
” বাচ্চাই তো। এরকম অকারণ জেদ বাচ্চারাই করে। ”
” অকারণ জেদ না। ”
” তাহলে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থাকল খোলা দরজাটির দিকে। অতঃপর আদেশের মতো বলল,
” চাঁদনি নেই। তোমরা একসাথে, এক ঘরে থাকবে। ”
সে পা ঘুরিয়ে হাঁটা ধরল। খাইরুন নিসা উঁচু স্বরে সুধালেন,
” আবার কোথায় যাচ্ছিস? ”
” কুজনপুর। ”
” কুজনপুর! ওখানে কেন? ”
খাইরুন নিসার কণ্ঠে একইসাথে চমক ও ভ য়। মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। হেঁটে চলেছে। তিনি বারান্দা থেকে নেমে এলেন। কয়েকপা এগিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” ফিরবি কখন? ”
” তোমাকে যে কাজ দিয়েছি সেটাই মন দাও, দাদিজান। ”
” ঠিক আছে। আমাকে না বললি, বউকে বলে যা। তোর জন্যে অপেক্ষা করবে তো। ”
” যেদিন সত্যি অপেক্ষা করবে সেদিন বলে যাব। ”
সে উঠোনে ধূলো উড়িয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
_________
স্বর্ণলতা নিজের রুমে বসে ছিল। দাদিজান ঢুকে বললেন,
” আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি ফিরবে না। ”
সে এই কথার প্রত্যুত্তর না করে বলল,
” আমার বই দিয়া গেল না? ”
” কিসের বই? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। বারান্দায় এসে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত নেই। তার জীপগাড়িটাও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আবারও দৌড়ে পৌঁছাল নিজের রুমে। দাদিজানকে সুধাল,
” উনি কই গেছেন? ”
” জানি না। ”
” ফিরবে কখন? ”
” এই প্রশ্নগুলো আমাকে না, তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। শ্বশুরবাড়ি থাকতে পারলে, বউয়ের দায়িত্বও পালন করতে পারবে। বইয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে, সংসারে মনোযোগী হও। ”
খাইরুন নিসা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। সহসা থমকে গিয়ে বললেন,
” আজ থেকে আমার ঘরে শুবে। ঐ ঘরে তোমার যে জিনিসপত্র আছে, আমার ঘরে নিয়ে এসো। আমি দরজায় তালা দিব। ”
স্বর্ণলতা নিজের রুমের দরজা আটকে ধরে বলল,
” আমি এই ঘরে থাকমু। ”
” তোমার স্বামীর আদেশ না মানলে কী হবে জানো? আমার ঘরে ভাঙচুর করবে। আমি জেনে-বুঝে এমনটা হতে দিব না। ঐ ঘরে যা আছে সব তোমার দাদা শ্বশুরের। সৎ পথে রোজগারের টাকা থেকে বানিয়েছে। মানুষটা নেই, তার এই স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। ”
” ভাঙচুর করবো না। আমি মানা করমু। ”
” তুমি মানা করলেই মুনছুর শুনবে? তাহলে চাঁদনির কাছে মাফ চাইল না কেন? জোর করেই তো তোমাকে নিয়ে আসল। ”
” এইটা শুনবো। বিশ্বাস করেন। ”
” মুনছুরকে বাদ দেও, আমি তোমাকে থাকতে দিব না। একা এত বড় ঘরে থেকে ভ য় পাবে। ”
স্বর্ণলতা রুমের ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল।
_______
ফাল্গুনের শেষ বিকাল। সূর্যের তেজ কমেনি তখনও। চারপাশে ভ্যাঁপসা গরম ধরে রেখেছে এখনও। এই গরমে সুবর্ণ ফাঁকা উঠোনে কাগজ কেটে ঘুড়ি বানাচ্ছে। খালি গা, শুকনো ধূলো এসে পড়ে ভিজে যাচ্ছে গড়িয়ে পড়া ঘামে। এসবে তার মন নেই। সে ধ্যানমগ্ন হয়ে ঘুড়ি বানাচ্ছে। সহসা কানের কাছে একটা মিষ্টি কণ্ঠ বাজল,
” স্বর্ণলতা বাড়িতে নেই? ”
সে চমকে তাকাল। ঘামে তার সম্পূর্ণ মুখটায় ভেজা। চোখের পলক পর্যন্ত ভিজে আঠা লেগে আছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। সুবর্ণ ঘন ঘন পলক ফেলে সম্পূর্ণ দৃষ্টি মেলল। মুহূর্তেই পলকজোড়া স্থির হয়ে গেল। চুম্বকের মতো আকর্ষণ বোধ করল মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারিনীর মুখটায়। সূর্যের শেষ আলোর সম্পূর্ণটায় এসে পড়েছে যেন মুখটায়! কী দারুন ঝলমলে নিটোল কিশোরী মুখ! সে অজান্তেই উঠে দাঁড়াল। এই সময়ে কণ্ঠটা আবার বাজল,
” আমি বেহালা। স্বর্ণলতার বান্ধুবী। ”
সুবর্ণের চুম্বকার্ষণ ছুটে গেল। কাছা দেওয়া লুঙ্গি ছাড়িয়ে দ্রুত বলল,
” আফা তো বাড়িত নাই। ”
উত্তরটা দিতে দিতে বেহালার আপাদমস্তক দেখে নিল। গাঢ় সবুজ রঙের শাড়িটা কী সুন্দর কুঁচি দিয়ে পরেছে! শরীরের সাথে এত ভালো মিশে আছে যে সে মুগ্ধ হলো। স্বর্ণলতাকেও মাঝেমধ্যে শাড়ি পরতে দেখেছে কিন্তু এভাবে কখনও পরেনি। আঁচলখানি সবসময় কোমরে প্যাঁচিয়ে রাখত। তারপরেও কত সুন্দর লাগত! মনে হতো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তার আফা। সেই মনে হওয়া ভুল করতেই কি এই মেয়ে সম্মুখে হাজির হয়েছে?
” কোথায় গিয়েছে? ”
সুবর্ণ তার মুখের দিকে চেয়ে জবাব দিল,
” শউরবাড়ি। ”
” শ্বশুরবাড়ি! ভাইয়া তাহলে সত্যি বলেছে? ”
” কী কইছে? ”
” কিছু না। তুমি সুবর্ণ তো? স্বর্ণার ভাই? ”
সে হেসে ফেলল। লাজুক হাসি! মাথা নেড়ে জবাব দিল,
” হ। ”
” ঐ লেখাগুলা তোমার? ”
সুবর্ণ একটু থতমত খেল। সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করল,
” কোন লেখা? ”
বেহালা তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। আশপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
” টিয়ামনি, দেখ বসার মতো কিছু পাস নাকি। এতদূর হেঁটে এসেছি। আমার তো পা ব্যথা করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ”
” আচ্ছা, আফা। আমি খুঁজতাছি। ”
সুবর্ণ এতক্ষণে খেয়াল করল, তার সামনে একটি নয় দুটি মেয়ে। টিয়ামনি নামের মেয়েটি ছোট, বয়স আট কী নয় হবে। পরনে গোল ফ্রক। চড়ুই পাখির মতো পুরো উঠোন ছুটে বেড়াচ্ছে। সে তার ছুটে চলা দেখতে দেখতে বলল,
” টিয়ামনি নামটা তো আপনার হওয়া দরকার ছিল। ”
বেহালা প্রশ্ন করল,
” কেন? ”
” আপনার ঠোঁটগুলা টিয়াপাখির মতো লাল টুকটুকে। ”
সে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
” আমি লিপস্টিক পরেছি। ”
সুবর্ণ মাথা চুলকাল। স্বর্ণলতাকে তেমন একটা সাজগোছ করতে দেখেনি। দূরে কোথাও গেলে চুল আঁচড়াত, পাতিলের তলা থেকে একটু কালি সর্ষে তেল দিয়ে মেখে চোখের তলে লাগাত। ওটা তো লাল রঙ নয়! সে কৌতূহলী চিত্তে সুধাল,
” লিপিস্টিক কী? ”
বেহালা হাসি থামিয়ে বলল,
” বড় হলে বুঝবে। এখন বলো, এত সুন্দর করে লেখা কোথায় শিখেছ? ”
” কোন লেখার কথা কন? ঐটাই তো বুঝতাছি না। ”
এরমধ্যে টিয়ামনি দৌড়ে এলো। সে একটি পিঁড়া যোগাড় করেছে। বেহালার কাছে রাখতে সে এটাতে বসল। সুবর্ণ বসল মাটিতে, পা ভাঁজ করে। বেহালা বলল,
” স্বর্ণা পরীক্ষার আগে আমাকে খাতায় নোট করে দিত। কিন্তু নোটের লেখাগুলো ওর ছিল না। আমি জিজ্ঞেস করলে বলত, এগুলো তার ভাই লিখে দেয়। ওর ভাই তো তুমি, তাই না? ”
সুবর্ণর পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ নেই। নিজের বই-খাতা বছরের শুরুতেই হারিয়ে ফেললেও পড়া থেকে মুক্তি পেত না। স্বর্ণলতার সাথে নিয়ম করে পড়তে হতো। তার বই কম, পড়া কম। আপুর আগেই পড়া শেষ হয়ে যেত, তখন তাকে দুটো খাতা দিয়ে বলত, একটা থেকে দেখে আরেকটাতে তুলতে। তার লেখাগুলো কি এই মেয়েটির কাছে নোটের নামে পৌঁছানো হতো?
” হ, আমিই। আফার তো আর কোনো ভাই নাই। ”
” তুমি কোন ক্লাসে পড়ো? ”
” ফাইভে। ”
” মাত্র? তোমার লেখা দেখে মনে হয়, কলেজে পড়ো। এত সুন্দর করে কীভাবে লেখ? ”
সে আবারও হাসল। লাজুক হাসি! মাথা নুয়িয়ে বলল,
” জানি না৷ কিন্তু আফা আমারে কোন কাজ দিলে, আমি মন দিয়া করি। ”
” আচ্ছা, এবার বলো তোমার কী চাই। ”
সুবর্ণ মাথা তুলল। অবাক হওয়া কণ্ঠে সুধাল,
” কী চাই মানে? ”
বেহালা উত্তরে বলল,
” স্বর্ণা এত কষ্ট করে আমার জন্য নোট তৈরি করত। তার বিনিময়ে আমি উপহার দিতে চাইলে, নিত না। বলত, যদি কিছু দিতে ইচ্ছে হয় তাহলে যেন তোমাকে দিই। আমি এর আগেও একবার এসেছিলাম, তোমাকে পাইনি। আজ পেয়েছি। বলো, কী চাও। ”
” কাজের বিনিময়ে দিতাছেন? ”
” অবশ্যই। নোট তো তুমিই লিখে দিতে। ”
” তাইলে চাওয়া যায়। ”
” হ্যাঁ, চাও। ”
” যা চামু তাই দিবেন? ”
বেহালা মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল। সুবর্ণ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” চার পেলেট ভাত খামু। তরকারি যা মন চায় দিবেন কিন্তু ভাত চার পেলেটই লাগবো। ”
” ব্যস, আর কিছু না? ”
সুবর্ণ সবেগে দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
” না। ”
” ঠিক আছে। চলো। ”
সে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুবর্ণও দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
” কোথায়? ”
” আমার বাড়ি। আমি তো ভাত নিয়ে আসিনি। ”
” এহনই যাইতে হইব? কাল গেলে হইব না? ”
” কাল কেন? ”
সুবর্ণ ঘাড় ফিরে তাকাল নিজেদের ঘরের দিকে। তারপরে বলল,
” আম্মা, বাড়িত নাই। বড় আফা রে ক্যা দেখব? ”
” তোমার আম্মা কোথায় গেছে? ”
” জেলা হাসপাতালে। ”
বেহালা উদ্বিগ্ন হলো। জিজ্ঞেস করল,
” হাসপাতালে কেন? উনি কি অসুস্থ? ”
” না, আব্বারে ভর্তি করছে। ”
” বড় সমস্যা নাকি! কী হয়েছে? ”
” হাত-পা ভাই ঙ্গা দিছে। ”
বেহালার উদ্বিগ্ন বাড়ল। চোখ, মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। টিয়ামনিকে দূরে পাঠিয়ে ফিসফিসের মতো বলল,
” ভেঙে দিয়েছে বলছ কেন? কেউ কি উনাকে মে রেছে? ”
” হ। ”
” কে? ”
সুবর্ণ চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপরে একটা হাত সামনে এগিয়ে বলল,
” আগে হাত ছুঁইয়া কথা দেন, কাউরে কইবেন না। ”
সে হাত স্পর্শ করে বলল,
” বলব না। বলো। ”
সুবর্ণ অনুমতি না নিয়েই কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” আমার দুলাভাই। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪০)
বেহালা চমকে ওঠল! বিস্ফারিত দেখাল নেত্রদ্বয়। ত্রাসিত বদনে সুধাল,
” দুলাভাই কে? স্বর্ণার স্বামী? ”
সুবর্ণ মুখে জবাব দিল না। মন্থরগতিতে মাথা উপর-নিচ করল। বেহালার চমকের মাত্রা বাড়ল, আতঙ্কে বুকের ভেতরটা কাঁপছে। ভাইয়ার মুখে শুনেছে, লোকটা ভালো নয়। অসৎ ব্যবসা চালায়। আদব-কায়দা জানে না। অন্তরে নূন্যতম মায়া নেই। স্বার্থ হাসিলে আপন ব্যক্তিদ্বয়েরও প্রাণনাশ করতে পারে। স্বর্ণলতার বাবা তো সম্পর্কে শ্বশুর হয়। সম্মান ও শ্রদ্ধায় ঘিরে থাকা সম্পর্ক। এটাও রক্ষা করেনি? এতটায় নি ষ্ঠুর, নির্দয়! বেহালার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সংশয় ফুটে ওঠছে মন ও মস্তিষ্কে। পুনরায় প্রশ্ন করল,
” উনি তোমার বাবাকে মা রবে কেন? বয়সে কত বড়! বাবার মতো না? তুমি ভুল শুনেছ হয়তো। ”
” আমি শুনি নাই, চোখ দিয়া দেখছি। দুলাভাই যখন আব্বা রে মা রতাছিল, তখন আমি সামনেই। ”
” কী বলছ! তোমার সামনেই মে রেছে? ”
সুবর্ণ এই জবাবটা দিল মাথা নেড়ে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রেখে। তার চোখে, মুখে ভ য় বা আতঙ্ক নেই। চাপা উত্তেজনা, আনন্দের মৃদু রঙ ঝিলিক দিচ্ছে। বেহালা দৃষ্টি সরিয়ে নিল। টিয়ামনির অবস্থান দেখে নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
” মজা করছ না তো? ”
” একদম না, এই কসম। ”
সুবর্ণ কথার মধ্যে নিজের গলায় হাত রাখল। চিমটার মতো চেপে ধরল শ্বাসনালি। বেহালা দুই হাত বুকে বেঁধে দৃঢ়ভঙ্গিতে দাঁড়াল। অতঃপর পরিক্ষকের মতো গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
” তাহলে বলো মা রল কেন? ”
” বড় আফা রে দিয়া ভিক্ষা করাইতাছিল তাই। ”
তার কপাল কুঁচকে এলো আপনাআপনি! ঠোঁটের মাঝে হালকা ফাঁক সৃষ্টি হলো। হাতের বাঁধন ছুটে গেল। অবাক কণ্ঠে বলল,
” তোমাদের বড় বোন? উনি না অসুস্থ? ”
” হ। ”
অসুস্থ সন্তানকে দিয়ে বাবা ভিক্ষা করাচ্ছে। নির্লজ্জ ব্যক্তিসত্তা! নিচু মনের অধিকারি! দৃশ্যটা কল্পনা করেই বেহালার ঘৃণায় সম্পূর্ণ মুখটায় কুঁচকে এলো। বুকের জমিন শক্ত হয়ে ওঠল। হাতজোড়া নিশপিশ করছে। ভাবখানা এমন এই নির্লজ্জ, নিচু মনের লোকটাকে সামনে পেলে কয়েক ঘা বে তের বাড়ি বসাবে। চ ড়-থা প্পড়ও মা রতে পারে। ভাবনাটা নিজের মস্তিষ্কে পরিষ্কার হতে সে ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠল। স্বর্ণলতার স্বামীর মতো সেও কি আদব-কায়দা ভুলে বসল? খারাপ মানুষের গল্প শুনলেও মন-মস্তিষ্কে খারাপ প্রভাব পড়ে, এই বিষয়ে নিশ্চিত হলো। এজন্য গল্প করতে হয় ভালো মানুষকে নিয়ে।
” এটা তো ভালো কাজ না, সুবর্ণ। তোমার আব্বাকে আটকাওনি? ”
” ক্যামনে আটকামু? আমি তো দেখি নাই। ”
” এই তো বললে, নিজের চোখে দেখেছ। ”
” হ, আব্বারে মারতে দেখছি। বড় আফা রে ভিক্ষা করতে দেখি নাই। দুলাভাই মা রার সময় চিৎকার কইরা কইতাছিল, তখন শুনছি। ”
” তুমি কোথায় ছিলে? ”
” কাঠের দুকানে। আব্বার লগে কাজ করতাছিলাম। আচমকা দুলাভাই আইল, আমারে দূরে সরাইয়া ইয়া বড় কাঠটা তুইলা আব্বারে বাইড়াতে শুরু কইরা দিল! ”
সুবর্ণ হাত দিয়ে কাঠের মাপটাও বুঝানোর চেষ্টা করল। বেহালার সেদিকে মনোযোগ নেই। সে ভাবছে, সুবর্ণ পড়ালেখা করে। তার বড় বোন অসুস্থ। ঠিক অসুস্থ বলা যায় না। স্বর্ণলতার মুখে তার সম্পর্কে শুনে বুঝেছিল, তার মস্তিষ্ক ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। কথা-বার্তা স্পষ্ট না। নিজের কাজগুলোও করতে পারে না। নতুন মানুষ দেখলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। ঘর থেকে বেরোতে চায় না। এগুলো বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর লক্ষণ। সে স্পষ্ট করে ‘ প্রতিবন্ধী ‘ শব্দটা উচ্চারণ করেনি। গ্রামের মানুষদের কাছে এই শব্দটা এখনও অপরিচিত, অচেনা। তবে একবার দেখা করে মনে মনে নিশ্চিত হয়েছিল, মাধবীলতা আপু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।
সুবর্ণ নিজের মতো বলে যাচ্ছিল,
” মেলা মা রছে! আব্বার তো জ্ঞান চইলা গেছিল। সবাই ভাবছিল, মই রা গেছে। কিন্তু ম রে নাই। দুলাভাইয়ের লোকেরা কান্ধে কইরা হাসপাতালে নিয়া শুয়াই দিছে। আমারে আর বড় আফা রে দুলাভাই গাড়িতে কইরা বাড়ি দিয়া গেছে। যাউনের সময় আমারে কইয়া গেছিল, এই কথা যেন কাউরে না কই। ”
” তোমার আম্মা জেনেছে কীভাবে? ”
” জানি না। ”
” তুমি কি শুধু আমাকেই বললে? ”
সুবর্ণ এই জায়গায় মাথা দুলাল। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। বেহালার এই হাসিটা দারুন লাগল। কথা-বার্তায় লজ্জা নেই। নিঃসংকোচ, পরিষ্কার কণ্ঠস্বর। বাবার সম্পর্কে ভ য়ঙ্কর গল্পটাও বলল নির্ভয়ে অথচ হাসার সময় কোথাও থেকে এক চিমটি লজ্জা এসে পড়ে চিকন কচি ঠোঁটজোড়ায়। তার হঠাৎই মনে হলো, এই ছেলের ঠোঁটজোড়া টিয়াপাখির মতো লাল টকটকে। ঠিক যেমনটা সুবর্ণ তাকে বলেছিল। বেহালা নতুন করে কিছু বলল না। দ্রুত চোখ বুলিয়ে ফেলল পুরো উঠোনটায়। টিয়ামনি কোথাও নেই। একটু আগেই কলপাড়ের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। সে কয়েকপা এদিক-ওদিক সরে আচমকা ডাকল,
” টিয়ামনি? ”
প্রথম ডাকেই উত্তর এলো,
” জে, আফামনি। ”
কণ্ঠটা কাছে কোথাও থেকে ভেসে এলেও মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না। সে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
” কোথায় তুই? দেখতে পাচ্ছি না কেন? ”
” এই যে, আফামনি। উপরে তাকান। পাকঘরের দিকে। ”
সুবর্ণের চোখে ধরা পড়ল প্রথমে। হাসতে হাসতে বলল,
” ঐ যে! বান্দর মাইয়া, গাছে উঠতাছে। পাখির নামে নাম রাখলেই কি পাখি হউন যায়? পাখি হইতে দুইডা পাখা লাগে। তাইলে গাছে উঠতে এত কষ্ট করতে হইত না। ”
বেহালা ভীষণ বিরক্ত হয়ে চেঁচাল,
” গাছে উঠছিস কেন? নেমে আয় জলদি। ”
সে গাছের মূল শাখাতে পা রেখে বলল,
” দুইডা সাজনা পাইড়া নামি, আফামনি? আপনের তো মেলা পছন্দ! ”
বেহালা শাক-সবজি খাওয়ায় অভ্যস্ত নয়। বাবার কাছে থাকতে সে দুইবেলায় মাছ-মাংস দিয়ে খেয়েছে। এখানে আসার পর সেই অভ্যাস বদলাতে হয়েছে। ভাইয়া, মাছ-মাংসের চেয়ে শাক-সবজি রান্না করে বেশি। নানা রকম গুণাগুণ জানিয়ে খাওয়ার প্রতি উৎসাহ বাড়ায়। উৎসাহে কাজ না হলে জোর করে প্লেট টেনে খাবার মুখে তুলে দেয়। এই একটা বিষয়ে সে ভাইয়ার সাথে পেরে উঠে না। সবজির মধ্যে সাজনাটা তার মনে ধরেছে। একদিন কথায় কথায় বলেছিলও। টিয়ামনি শুনেছে, মনেও রেখেছে। সাজনা গাছ সামনে পেয়ে পাড়তেও শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটা বয়সের তুলনায় একটু বেশি বুদ্ধিমতি, বুঝ শক্তিও বেশি।
সুবর্ণ গাছের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলল,
” আরে, করো কী! এই গাছের ডালা নরম হয়। ভাইঙ্গা পড়বা। নিচে নামো, আমি পাইড়া দিতাছি। ”
টিয়ামনি তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পা বাড়াল একটি ডালে। ডালটা পাতাসহ নড়ে উঠতে বেহালা শিউরে ওঠল। আসন্ন বিপদ টের পেয়ে বিপন্ন স্বরে বলল,
” সাজনা লাগবে না। নেমে আয়। নাহলে কিন্তু যাওয়ার পথে তোকে তোর বাড়িতে রেখে যাব। ”
টিয়াপাখি ওখানে থেমে গেল। পা পিছিয়ে আনল। আপামনির দিকে করুণ দৃষ্টি রাখতে সে পুনরায় বলল,
” আমার কথার কিন্তু নড়চড় হবে না। বাড়িতে মালিক নেই। অনুমতি ছাড়া কারও কিছু নিতে হয় না। নেমে আয়। ”
সে এক মুহূর্তও দেরি করল না। ঝটপট নেমে এসে দাঁড়াল বেহালার কাছে। গাছে উঠা-নামার মধ্যে পরনের জামা ছিঁড়ে গেছে!
” আমার অনুমতি ছাড়া গাছে উঠে অন্যায় করেছিস। এখন শা স্তি নিতে হবে। ”
টিয়ামনি মাথা নত করে ফেলল। বেহালা দমল না। বলল,
” সুবর্ণকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। যতক্ষণ না ফিরছে ততক্ষণ ওর বড় আপুর দেখাশোনা করবি। এরমধ্যে যদি আন্টি চলে আসে, জানিয়ে দিবি সুবর্ণ আমার সাথে আছে। পারবি না? ”
সে পুনরায় মাথা তুলল। আগ্রহের সাথে সুধাল,
” তাইলে কি আমারে আপনের লগে নিয়া যাইবেন? ”
” হ্যাঁ, যাব। ”
_________
বেহালাদের বাড়িতে পৌঁছে সুবর্ণ মুগ্ধ হলো। বিস্মিতনেত্র জোড়া মেলে দেখল, মস্ত বড় বাড়িটা। গেইটের ভেতর ঢুকতেই দেখল, একপাশে একটি সাদা রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে গাড়িটির নাম জানে না। কিন্তু গতকাল রাস্তায় দেখেছে কয়েকটা। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, এগুলোতে বড়লোকরা চলাফেরা করে। তাহলে কি বেহালাও বড়লোক? অল্পবয়সী ও অনভিজ্ঞ মস্তিষ্কে উত্তরটা খুঁজে পায় না। বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” আপনে গো গাড়ি আছে? তাইলে আমগো বাড়ি হাঁইটা গেলেন ক্যা? এত দূরের রাস্তা! পা তো বেদনা করবোই। ”
এই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ নেই। ভাইয়া হাসপাতালে রোগী দেখছে। সে দরজার তালা খুলতে খুলতে বলল,
” ভাইয়া বলছে, এই গ্রামে গাড়ি চালানো নিষেধ। গ্রামে নাকি একটা পাগল ঘোরাফেরা করে, গাড়ি দেখলেই ভাঙতে আসে। ”
” গাড়ি ভাঙ্গা পাগল! এই রকম পাগল তো আমি দেখি নাই। ”
” তুমি ছোট যে, তাই দেখনি। এই পাগল শুধু বড়রা দেখতে পায়। ”
সুবর্ণকে খাবার টেবিলে বসিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগুল। ভেতরে ঢুকে মাথায় হাত পড়ল! ভাত-তরকারি কিছু রান্না করে নেই। সে রান্নাও পারে না। টিয়ামনি কিছু কিছু পারে। তাকে তো রেখে এসেছে সুবর্ণদের বাসায়। ছেলেটাকে কী খাওয়াবে? কত সাধ দেখিয়ে নিয়ে এলো বাড়িতে অথচ খাবারের একটা দানাও নেই! বেহালা নিরুপায় হয়ে ভাইয়ার মোবাইলে কল লাগাল। প্রথমে জানতে চাইল কতক্ষণ লাগবে। দেরি হবে শুনে বলল,
” ভাইয়া, ভাত রান্না করে কীভাবে? ”
” কেন? ”
” আমি একটু রান্না করতে চাচ্ছিলাম! ”
” হঠাৎ রান্নার শখ জাগল কেন? ”
বেহালা মিথ্যা বলল,
” ক্ষুধা লাগছে। ”
” আমি তো রান্না করে রেখে এসেছিলাম। ”
” নেই। নতুন করে রান্না করতে হবে। বলো না, ভাইয়া। ”
” তোর রাঁধতে হবে না। টিয়াকে দে। ও পারবে। কাজে-কর্মে পটু আছে। ”
সে আবারও মিথ্যা বলল,
” টিয়ামনি ছোট্ট মেয়ে, শরীরটাও একটু খারাপ। আমাকে বলো, ঠিক পারব। ”
ওপাশ থেকে উত্তর আসার পূর্বেই সুবর্ণের গলা পাওয়া গেল। রান্নাঘরের বাইরে থেকে বলল,
” ভাত রানবেন? আমারে কইলেই তো পারেন। আমি রানতে পারি। খালি চালডা বাইর কইরা দেন। ”
বেহালা চট করে কলটা কেটে দিল। এরমধ্যে সুবর্ণ ভেতরে ঢুকে পড়ল। রান্নাঘরটা দেখতে দেখতে বলল,
” কত্ত বড় রান্নাঘর! আমগো ঘর থেইকাও বড়। ”
বেহালার মোবাইল বেজে ওঠল। ভাইয়া কল করেছে। সে কি সুবর্ণের গলাটা শুনতে পেয়েছে? তাকে এই বাড়ি নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল না, তাই ভাইয়াকে জানানোও হয়নি। শুধু বলেছিল, স্বর্ণলতাদের বাড়ি যাবে। এই অনুমতিটাও শুরুতে দিতে চায়নি। জোরজবরদস্তিতে নিয়েছে। এখন যদি শুনে, তার ছোটভাই এসেছে ভাত খেতে, তাহলে প্রতিক্রিয়া কী হবে?
সুবর্ণ নিজেই চাল, ভাতের পাতিল খুঁজে বের করল। চাল ধুতে ধুতে বলল,
” উনুন দেখতাছি না! বাড়ির বাইরে রাখছেন? ”
বেহালা সিলিন্ডার গ্যাসের চুলাটা জ্বালিয়ে দিল।
_________
স্বর্ণলতা সেই যে সকালবেলা রুমের দরজা আটকেছে আর খুলেনি। দাদিজান কয়েকবার ডাকাডাকি করলেন, চেঁচামেচি করলেন, হু মকি-ধ মকিও দিলেন। কিছুতেই কাজ হলো না। মেয়েটা দরজা খুলবে কী সাড়াশব্দও করল না! চাঁদনি তার স্বামীকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ও ডাকতে এসেছিল। স্বর্ণলতা তখনও দরজা খুলল না। সে বন্ধ দরজার এপাশ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলো।
স্বর্ণলতা সারাদিন না খাওয়া, গোসলও হয়নি। খাইরুন নিসা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটা নিজের সাথে কিছু করে বসেনি তো! তার আচরণে বুঝা যাচ্ছে, সেচ্ছায় আসেনি। মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে নিয়ে এসেছে। এতে রা গ হওয়া স্বাভাবিক, তাই বলে দরজা আটকে বসে থাকবে? কথা বলা বন্ধ করে দিবে? অন্যায় করেছে তার নাতি অথচ দুশ্চিন্তায় ভোগতে হচ্ছে তাকে। র ক্তের সম্পর্কে এই এক জ্বালা! ভালো কাজের ভাগীদার না হতে পারলেও খারাপ কাজের ভাগীদার না চাইলেও হতে হয়। এ যেন এক অলিখিত নিয়ম!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নাতি ফিরবে নাকি খাইরুন নিসা জানেন না। তাই সবরকম চেষ্টা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ঘরে এসে মোবাইলটা বের করে কল লাগালেন নাতির নাম্বারে। প্রথম কলে ধরল,
” ব্যস্ত আছি, দাদিজান। পরে কল দিচ্ছি। ”
” আচ্ছা, বউ বেঁচে থাকতে থাকতে দিস। নাহলে তো বলবি, আমি মে রে ফেলেছি। ”
” মানে কী? ”
” এখন তো ব্যস্ত আছিস। ফ্রি হয়ে কল দে, বলছি। ”
” খোঁচানো বন্ধ করে বলবে, কী হয়েছে? ”
কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত ও তাগাদা। খাইরুন নিসাও সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিলেন না। দুশ্চিন্তা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেছেন। এবার মুক্তি চান, বললেন,
” তোর বউ দরজা আটকে দিয়েছে। ”
” দরজা আটকে কী করছে? ”
খাইরুন নিসা উত্তরটা দেওয়ার পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এক সেকেন্ড, লাইনে থাকো। ”
সে বোধহয় দ্রুত কদমে হেঁটে এলো কোথাও। তারপরে বলল,
” এবার বলো। ”
তিনি শুরু থেকে সবটা খুলে বললেন। মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে কিছু বলল না। পরক্ষণে রা গ বেরিয়ে এলো কণ্ঠস্বর থেকে,
” একটাই তো কাজ দিয়ে এসেছি, সেটাতে ঝামেলা লাগিয়ে দিলে! আমি কত দূরে আছি জানো? ফিরতে ফিরতে ভোর হবে। ফেরাও তো সম্ভব না। গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছি। ”
” তাহলে আবুলকে বল, দরজাটা ভেঙে দিতে। ”
” দরকার নেই। স্বর্ণলতা কোন অবস্থায় আছে, ওটাও তো জানো না! ”
মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ নীরব থেকে আচমকা ক্রো ধে ফেটে পড়ল,
” এভাবে জ্বালাতে থাকলে ও একদিন সত্যি ম রবে। আমার হাতে ম রবে। সাবধান করো, দাদিজান। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে বন্ধ করো। ”
কলটা গেল। দাদিজান মোবাইল হাতে ছুটে এলেন স্বর্ণলতার রুমের সামনে। দরজায় সমানে আ ঘাত করতে করতে বললেন,
” দরজা খোলো। মুনছুর কিন্তু খুব রে গে গেছে। ফিরে এসে কী করবে, আমি জানি না। তোমাকে এখনও কিছু বলেনি দেখে ভেবো না, কখনও বলবে না। স্বর্ণলতা? দরজা খোলো। ”
সে দরজা খুলল না। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে খাইরুন নিসার মোবাইলটা বেজে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত কল করেছে। ধরতে জিজ্ঞেস করল,
” দরজা খুলেছে? ”
” না। ”
সাথে সাথে কল কেটে গেল। কলে থাকা অবস্থায় গাড়ির হর্ন শুনতে পেয়েছিলেন। বুঝে গেলেন মুনছুর সাখাওয়াত ফিরছে। তার সর্বশরীরে কাঁপুনি উঠে গেল। ছেলেটা যত খারাপই হোক, বউয়ের বিষয়ে ধৈর্য ধরেছে। ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। আজকে বোধহয় সেই রূপটা খসে পড়বে! তিনি কি কল দিয়ে ভুল করেছেন? অন্য কোনো উপায়ও তো নেই। মেয়েটা যদি সত্যি খারাপ কিছু করে বসে? সেই দায়টা তো তার উপরে এসেই পড়বে! খাইরুন নিসার মোবাইলে আবারও কল এলো। ধরতেই আগের প্রশ্নটা শুনলেন,
” দরজা খুলেছে? ”
এবার তিনি চট করে জবাবটা দিতে পারলেন না। মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় প্রশ্নটা করতেই বললেন,
” এখনও খুলেনি। কিন্তু…”
কল কেটে গেল। দশ মিনিট অন্তর অন্তর এই কল আসতে লাগল। ধরলে সেই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪১)
ডাক্তার আল হাদি বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার পর। কাপড় বদলে, হাত-মুখ ধুয়ে হাঁটা ধরল বোনের রুমের দিকে। দরজা খোলা, বেহালা মুখ গুঁজে আছে বইয়ের মধ্যে। সে এক ঝলকে পুরো রুমটা দেখে বলল,
” টিয়াকে কোথাও দেখছি না যে? ”
বেহালা ঝটিতে তাকাল। বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকলেও মাথায় অন্যকিছু চলছিল। সুবর্ণ খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যায়। তাকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, টিয়ামনিকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে। দেয়নি! সন্ধ্যা কাটিয়ে রাত হয়েছে। গ্রামের দিকে এই সময় সকলে ঘুমিয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট থাকে ফাঁকা, নির্জন। রিকশা নেই, ভ্যানও চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখন মেয়েটা আসবে কীভাবে? কতদূরের পথ! কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে। শেয়ালের ডাকও শোনা যায়। মেয়েটা সুস্থ অবস্থায় ফিরবে তো? দুশ্চিন্তায় হাত-পা হিম হয়ে আসছে। পড়ায় মন বসছিল না। ভাইয়া আসলে কী জবাব দিবে সেটাও গুছাচ্ছিল৷
” থম মেরে গেলি কেন? দোকানে পাঠিয়েছিস? ”
বেহেলা চমকে ওঠল। পড়ার টেবিল থেকে সরে আসতে আসতে বলল,
” না। ”
” তাহলে? বাসায় গেছে? আমার থেকে ছুটি নেয়নি তো! ”
” বাসায় যায়নি। ”
উত্তরটা দিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। মনে সাহস সঞ্চয় করে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল,
” স্বর্ণাদের বাসায় রেখে এসেছি। ওর বড়বোন অসুস্থ। ”
আল হাদির কপাল কুঁচকে এলো। সন্দেহ দৃষ্টি রেখে বলল,
” ওর বোন তো প্রতিবন্ধী। ছোট থেকেই। এছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে? ”
বেহেলা আবারও চুপ হয়ে গেল। সত্য বলবে নাকি মিথ্যা? তার মন বলছে, সুবর্ণের বাড়িতে আসা ঘটনাকে ভালোভাবে নিবে না। রা গ করবে। হয়তো বকাঝকা করবে না কিন্তু মুখটা কঠোর বানিয়ে রাখবে। কথা-বার্তা কমিয়ে দিবে, খাওয়ার টেবিলে সবজি খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করবে না। এই ব্যবহারটা সে সহ্য করতে পারে না। বাড়িতে তারা দুটি মাত্র সদস্য। একজন চুপ হয়ে গেলে আরেকজনকেও চুপ থাকতে হয়। কারও কাছে যে অভিযোগ করবে সেই উপায়টাও নেই! বেহালা মিথ্যা বলল,
” হ্যাঁ, জ্বর এসেছে। আন্টিও বাসায় ছিলেন না। ”
” উনি তো সবসময় বাসায় থাকে। ”
” আজ নেই। হাসপাতালে গেছেন। তোমার হাসপাতালেই তো গেছে, দেখা হয়নি? ”
” না। ”
এত বড় হাসপাতাল! রোজ হাজার খানেক রোগী আসে। একেকজনের একেক সমস্যা। সে শুধু নিজের বিভাগের রোগী দেখে। বাকিদের খোঁজ-খবর নেওয়ার সময় কোথায়? আল হাদি জিজ্ঞেস করল,
” অসুস্থ মাধবীলতা না? সে বাসায় থাকলে, আন্টি হাসপাতালে গেল কাকে নিয়ে? ”
” আঙ্কেলকে নিয়ে। ”
” উনার আবার কী হয়েছে? ”
বেহালা চুপ হয়ে গেল। স্মরণ হলো, সুবর্ণের প্রতিজ্ঞাবাক্য। সে বলেছিল, কাউকে না বলতে। এখন প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে হলে ভাইয়াকে মিথ্যা বলতে হবে। ছেলেটার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সে ভাইয়ার সাথে মিথ্যা বলছে। এরকম ঘন ঘন মিথ্যা কথা কখনও বলেনি! বেহালা দৃষ্টি নত করে হালকা স্বরে বলল,
” শুনেছি, রোড এক্সি ডেন্ট হয়েছে। রাস্তার মানুষরা হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে। আন্টি খবর পেয়ে ছুটে গেছেন। ”
” তাই বলে, টিয়াকে রেখে চলে আসবি? ঐ ছোট্ট মেয়েটা ওখানে কী করবে? বড় কোনো মানুষ নেই। সুবর্ণও কিন্তু বাচ্চা নয়, বেহালা। কৈশোরে পা দিয়েছে। এই সময় ছেলে-মেয়েদের মাথা ঠিক থাকে না। ”
যে মুখটা দেখতে চায় না বলে, বেহালা মিথ্যা বলল সেই মুখটায় দেখতে হলো। আল হাদি মুখাবয়ব কঠোর করে ফিরে যেতে যেতে বলল,
” কাজটা ঠিক করিসনি, বেহালা। আমাকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। ”
বেহালার মনখারাপ হয়ে গেল। সুবর্ণ তো বাচ্চাই! দাড়ি-গোঁফ জন্মায়নি ঠিকমতো। মুখটা কী মসৃণ! চোখে-মুখে রাজ্যের কৌতূহল। চালচলনে সংকোচ বা দ্বিধাবোধ আসেনি। স্বতস্ফুর্তভাবে মিশে। দুনিয়া সম্পর্কে জানে কতটুকু? মাত্র তো পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে! ভাইয়া তাকে উদ্দেশ্য করে যে কথাটা বুঝাতে চাইল, সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বেহালা ভাইয়ার পিছু নিতে নিতে বলল,
” তুমি কি টিয়ামনিকে আনতে যাচ্ছ? ”
আল হাদি জবাব দিল না। খুলে রাখা শার্টটায় পুনরায় পরতে শুরু করে দিল। বেহালা কাছে এগিয়ে বলল,
” তোমার যেতে হবে না, ভাইয়া। ও এখনই চলে আসবে। সুবর্ণকে বলেছিলাম, সন্ধ্যার পর দিয়ে যেতে। ”
” সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। ”
” আরেকটু অপেক্ষা করো। আমার মন বলছে, ওরা পথে আছে। এখনই…”
” পড়তে যা। আমি দারোয়ানকে বলছি, এগিয়ে যেতে। ”
বেহালা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ঐ বাড়ি গেলে সে সত্যিটা জেনে যাবে। তারপর সুবর্ণকে পে টাবে। এই মনে হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ আছে কি?
_______
রাতের রান্নাটা আল হাদিই করল। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে বোনকে ডাকল। বেহালা দৌড়ে এসে বসতে সে বলল,
” টিয়ামনি আসেনি এখনও। ”
” আসবে। স্বর্ণাদের বাসা তো অনেক দূর! এখন ভ্যান চলে না। হেঁটে আসতে সময় লাগবে না, বলো? ”
সে জবাব দিল না। চুপচাপ বোনের প্লেটে ভাত ও তরকারি দিল। বেহালার ভেতরটা অস্থিরতায় ফেটে যাচ্ছে, দুশ্চিন্তায় মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। সত্যি মেয়েটা বিপদে পড়েনি তো! এখনও আসছে না কেন? তার এই হাঁসফাঁস ও অসুস্থের ভাবটা অপ্রকাশ রেখে বলল,
” ভাইয়া, তুমি বিয়ে করছ না কেন? ভাবি এলেই খাবারে লবণটা ঠিকমতো হবে। তিনবেলা ভাত খেতে হবে না। সে নিশ্চয় রুটি বানাতে পারবে। ”
আল হাদি নিজের পাতের ভাত মাখছিল। বিয়ের প্রসঙ্গ আসায় থমকে গেল। মনের আকাশে বিজলির মতো স্বর্ণলতার মুখটা জ্বলে ওঠে নিভে গেল। মেয়েটা কি রুটি বানাতে পারে? তরকারিতে কতটুকু লবণ দিতে হয় জানে? এই বিষয়ে কখনও প্রশ্ন করা হয়নি। সে শুধু চেয়েছিল, মেয়েটা পড়াশুনা করে শিক্ষিত হোক, বেশভূষায় পরিপাটি হোক, মার্জিত আচরণ শিখুক। যেন অন্যসব গ্রাম্য মেয়েদের থেকে আলাদা করা যায়। এসব চাওয়া এখন অপূরণীয় স্বপ্নের তালিকায় পড়ে গেছে! সে পুনরায় ভাত মাখতে মাখতে বলল,
” লবণ কম খাওয়া ভালো। রুটি বানানোর চেষ্টা করলে পারা যাবে। কিন্তু সেই সময়টা তো নেই। দেখি, টিয়ামনিকে দিয়ে এই কাজ করানো যায় নাকি! ”
যে প্রসঙ্গ বদলাতে চাচ্ছে, সেটাই ঘুরেফিরে আসছে! বেহালা আবারও চেষ্টা করল। বলল,
” তুমি স্বর্ণার স্বামীকে যতটা খারাপ বলেছ, ততটাও খারাপ নয়। একটু একটু ভালো আছে। ”
” তাই নাকি! আলাপ হয়েছে নাকি? ঐবাড়িতে ছিল? ”
” না। আমি গিয়ে কাউকে পাইনি। ”
” তাহলে জানলি কীভাবে? ”
সে থতমত খেল। টিয়ামনিকে ভোলাতে চেয়ে সে অন্যকিছু প্রকাশ করে দিচ্ছে! বেখেয়ালে প্রতিজ্ঞাটা ভেঙেই যাচ্ছিল। বেহালা তৎক্ষনাৎ সাবধান হলো। বলল,
” এমনি মনে হলো। ”
আল হাদি বিপরীতে একপেশে হাসল। মনে হওয়া আর বাস্তবে দেখা এক বিষয় নয়। মানুষটাকে সে চিনে। পছন্দসই তরকারি দিয়ে আয়েশ করে মাখানো ভাতটা খেতে পারেনি, মুখের সামনে থেকে কেমন ছিনিয়ে নিল!
” তুমি যে বলেছিলে, এই গ্রামে গাড়ি ভাঙা একটা পাগল থাকে? দেখলাম না তো! সুবর্ণও চিনে না। পাগলটার নাম কী? ”
সে দ্বিধাহীন গলায় বলল,
” মুনছুর সাখাওয়াত। ”
এই সময় কলিংবেল বেজে ওঠল। বেহালা খাবার ফেলে দৌড়ে গেল মূল দরজাটার কাছে। দ্রুততার সাথে সিটকানি টেনে ধরে পাল্লা মেলল। সাথে সাথে মুখটা ঝলমলিয়ে ওঠল! টিয়ামনি এসেছে। জিজ্ঞেস করল,
” এত দেরি করলি কেন? ”
” আমি দেরি করতে চাই নাই। সুবর্ণ ভাই, এক ঝলক দেখা দিয়া বাইর হইয়া গেল। আর তো আহে না! তার আফা রে একা ফালাইয়া থুইয়া আইলে তো রা গ করবেন, তাই বইয়া ছিলাম। ”
” কোথায় গেছিল? ”
” ফুল আনতে। এই লন। ”
বেহালা এতক্ষণে খেয়াল করল, টিয়ামনির হাতে পদ্মফুল। হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
” আমার জন্য? ”
” হ, একডা কাগজও দিছে। ”
টিয়ামনি প্যান্টের ভাঁজ থেকে কাগজটা বের করে দিল। কুঁচকে গিয়েছে। বেহালা সিধা করে দেখল, তাতে সুন্দর হাতের লেখা। প্রথম দর্শনে মনে হবে, বই থেকে ছাপানো লেখা। তারপরে চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝা যায়, বইয়ের নয় হাতের লেখা। সুবর্ণ এত সুন্দর করে কীভাবে লিখে! সে তৎক্ষনাৎ লেখাগুলো পড়ল,
‘ আম্মায় কয়, দাওয়াতে গেলে কিছু নিয়া যাইতে হয়। আমি তো খালি হাতে খাইয়া আইলাম! মাফ কইরা দিয়েন। ‘
একটু নিচে আবার লিখেছে,
‘ ফুলটা দেইখাই আপনার কথা মনে পড়ল, তাই তুইলা দিলাম। নামটা যে কী, মনে করতে পারতাছি না! আফার লগে দেখা হইলে জিগামু নে। আমার আফা সব ফুলের নাম জানে। ‘
_________
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি পৌঁছাল শেষ রাতের দিকে। খাইরুন নিসা জেগে ছিলেন। জীপের শব্দ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। বড় দরজাটা খুলে দাঁড়াতে দেখলেন, সে বারান্দায় ওঠছে। ক্রো ধযুক্ত চেহারা, হাতে লোহা কাটার মেশিন। তিনি শিউরে ওঠলেন। বিপন্ন গলায় সুধালেন,
” এটা দিয়ে কী করবি? ”
তার মেজাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। চোখের কোটর র ক্তলাল! প্রশ্নটা শুনে আরও বিগড়ে গেল। ব্যঙ্গ করে উগ্রভাবে বলল,
” আমার গলা কা টব। দেখবে? ”
খাইরুন নিসা ভ য় পেয়ে গেলেন। হাত থেকে মেশিনটা ছিনিয়ে নিতে চাইলে, সে উপরে তুলে ফেলল। কড়া গলায় শা সাল,
” ভেজাল করো না তো! সামনে থেকে সরো। নাহলে সত্যি গলা কে টে ফেলব। মাথা পুরা আউলে আছে। ”
তিনি বাঁধা দেওয়ার সাহস পেলেন না। সরে দাঁড়ালেন। সে মেশিনসহ বড় বড় কদম ফেলে এসে দাঁড়াল স্বর্ণলতার রুমের সামনে। বন্ধ দরজায় কান পেতে থাকল কতক্ষণ। তারপরেই আচমকা মেশিন চালু করল। দরজার হাতলের অবস্থান কেন্দ্র করে কাটতে লাগল। মিনিট দুইয়ের মধ্যে চারকোণা আকারে একটা অংশ আলাদা করে ফেলল। সেটা সরিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। সিটকানি একটানে খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখল, স্বর্ণলতা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দেহটা একবারের জন্যও টলছে না! এত আওয়াজ, তার উপস্থিতি সবকিছুকেই কী দারুনভাবে উপেক্ষা করছে! মুনছুর সাখাওয়াতের রা গটা কমল না। হাতের পেশিদ্বয় শক্ত হয়ে আছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কিছুতেই। ইচ্ছে করছে, মেয়েটাকে হেঁচকা টানে নিচে ফেলে দিতে। তারপর! আর ভাবতে পারল না। চিন্তা-ভাবনা সব থমকে গেল স্বর্ণলতা মুখ ঘুরিয়ে চাইতে। চোখদুটি অশ্রুতে পূর্ণ! নাক, গাল, ঠোঁট সব ভেজা ও ফোলা। দরজা বন্ধ করে কি সে কাঁদছিল? এতটা সময় ধরে দুনিয়া ভুলে শুধুই কাঁদছিল? মুনছুর সাখাওয়াতের বুকের ভেততটা কেমন জানি করে ওঠল। এক অচেনা অনুভূতির সাক্ষাৎ পেল। এই অনুভূতিতে শুধু হৃদয় ভার হয়, ব্যথা হয়, দুঃখ হয়। রা গ বা আনন্দের কোনো চিহ্ন নেই!
স্বর্ণলতা পুনরায় মুখ ফিরিয়ে নিতেই সে নতুন অনুভূতিটাকে সয়ে ফেলল। কাছে এসে বলল,
” এই পাগলামির মানে কী? আমি কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছি, জানো? ”
সে কোনো জবাব দিল না। চেয়ে দেখলও না পর্যন্ত। মুনছুর সাখাওয়াত স্থির থাকতে পারছে না। হাত দুটো আপনাআপনি মুঠো হয়ে আসছে বার বার। কোথাও আ ঘাত না করলে এই অস্থিরতা কমবে না। সে উল্টো ঘুরে গেল। ডান হাতটায় সজোরে কামড় বসাতে একটু শান্তি অনুভব করল। পুনরায় স্বর্ণলতার দিকে ফিরে বলল,
” তিন বছর ধরে একটা জা নোয়ারকে খুঁজছিলাম। আজ পেয়েছি। হাত বাড়ালেই গলাটা…”
সে চোখ বুঁজে ফেলল। মাথাটা ঝাড়া দিয়ে বলল,
” ধরে ফেলেছিলাম প্রায়। আচমকা বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে! এখন যদি পালিয়ে যায়? পান্নাকে রেখে এসেছি। কিন্তু ওর সাধ্য ঐ রাজহাঁস মা রা…”
সে জিভ কা মড়ে ধরল। বার বার মা রামারি মধ্যে চলে যাচ্ছে কেন? স্বর্ণলতার সামনে এসব কথা বলতে চায় না, আবার না বলেও পারছে না। তার জীবনে মা রামারি ছাড়া কোনো গল্প নেই!
এই সময় স্বর্ণলতা হুড়মুড়িয়ে ওঠল। রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াতের হাতে ধরা পড়ল। সে কব্জি বরাবর চেপে ধরে জিজ্ঞেস বলল,
” আমার প্রশ্নের উত্তর চাই। দরজা আটকে কী করছিলে? ”
সে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আমার বইগুলা কী করছেন? ”
” জীপেই আছে বোধহয়। ”
উত্তরটা দিয়ে সতর্ক হলো। স্বর্ণলতার দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে বলল,
” বইয়ের জন্য কাঁদছিলে? ঐ কটা বইয়ের জন্য এতকিছু? আমি চাইলে তোমাকে হাজারখানেক বই কিনে দিতে পারি! একদিন বলেছি না, তোমার স্বামীর আর কিছু থাক বা না থাক, টাকার অভাব নেই? ”
” সবকিছু থাইকা যদি ঐ একটার অভাব থাকত, তাইলে বইগুলার জন্য চিন্তা করতাম না৷ ”
” মানে? ”
স্বর্ণলতা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
” আপনে চাইলে হাজারখানেক বই কিইনা দিতে পারবেন, কিন্তু কোনোদিনই চাইবেন না। ”
” না চাওয়ার কী আছে? এটা কি মানুষ পে টানোর চেয়েও কঠিন কাজ? আশ্চর্য! ”
মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের হাত ছেড়ে দিল। দুই মিনিটের মধ্যে স্বর্ণলতার বইগুলো নিয়ে আসল। বিছানায় ঢিল মেরে বলল,
” তোমার জিনিস পেয়ে গেছ? এবার দাদিজানের কথা শুনে চলো। আমাকে এখনই বের হতে হবে। দুই-তিনদিন পর ফিরব। ”
সে তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বের হতে চাইল। দরজা পার হবে তখনই শুনল,
” দাদিজান রে কইয়া যান, আমি এই ঘরে থাকমু। ”
” না। তুমি দাদিজানের রুমে থাকবে। ”
” তাইলে আমারে হাত-পা বাইন্ধা ঐ ঘরে ফালাইয়া থুইয়া যান। নইলে আমি এই ঘরে ফেরত আসমু। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুখে কিছু বলল না। তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। সহসা বইগুলা একহাতে গুটিয়ে নিয়ে, অন্যহাতে স্বর্ণলতাকে ধরে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দাদিজান বাইরে ছিলেন। তার উদ্দেশ্যে বলল,
” এই রুমে তালা দাও এখনই। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪২)
খাইরুন নিসা কাঁপা হস্তে দ্রুত তালা ঝুলালেন দরজায়। মুনছুর সাখাওয়াত হাত পেতে তালার চাবি নিল। স্বর্ণলতাকে নিয়ে গেল দাদিজানের রুমে। ভেতরে রেখে সে বেরিয়ে এলো। দাদিজান তখনও বাইরে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে। মুনছুর সাখাওয়াত তার পাশে এসে বলল,
” ও যা করতে চাই, করুক। তুমি বাঁধা দিও না। শুধু বাড়ির বাইরে যাওয়া বা বাইরে কারও সাথে যোগাযোগ করতে না পারে, এই বিষয়টায় কড়া নজর রাখবে। ”
” কতদিন? এভাবে বেঁধেধরে সংসার হয় না, মুনছুর। তোর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ও যা করতে চায়, করতে দে। ”
সে ক্রু দ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। চেয়েই রইল। সহসা গোঁফে হাত বুলিয়ে বলল,
” সংসার করতে চাচ্ছে কে? আমি শুধু চাই, স্বর্ণলতা আমার সাথে জুড়ে থাকুক। ”
খাইরুন নিসা হতাশ হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই জুড়ে থাকাকে কেন্দ্র করেই তো সংসারের জন্ম! ছেলেটাকে এসব বুঝাবে কে? সে এক কদম এগিয়েও ফিরে এলো। পুনরায় বলল,
” তোমার মোবাইলটা সাথে রেখ। প্রয়োজন হলে কল দিও। আমি কল দিলে অবশ্যই ধরবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কোথাও একদণ্ড বসল না, এক গ্লাস পানিও খেল না। এত তাড়া কিসের কে জানে!
স্বর্ণলতা কয়েক মুহূর্ত নীরব দাঁড়িয়ে থাকে। ভূমি কাঁপা পদধ্বনি টের পাওয়া মাত্র দাদিজানের বিছানার কাছে হেঁটে যায়। বইপত্রগুলো এখানে ফেলেছে! সে আস্তেধীরে সযতনে গুছাতে লাগল। স্বর্ণলতা চাইলে, সারারাত উঠোনে কাটিয়ে দিতে পারে, রান্নাঘরে পিঁড়ায় মাথায় রেখে শুয়ে পড়তে পারে। বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। দাদিজানকে বলে যাওয়া কথাটা সে শুনেছে। তিনি বাঁধা না দিলে আর কে আসবে! তবুও সে এসব কিছু করবে না। চুপচাপ বাধ্য মেয়ে হয়ে এই বিছানায় ঘুমাবে, দাদিজানের পাশে। বৃদ্ধ মানুষটার পাশে থাকলে স্বর্ণলতার ভালো লাগে। ভয়-ভীতি টের পায় না। স্নেহ-মমতার সুবাস পায়।
বইগুলো শিয়রের কাছে গুছিয়ে রাখল। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে শুনতে পেল,
” এই রুমেই আসতে হলো। তাহলে এত নাটক করলে কেন, মেয়ে? মাঝখান থেকে আমাকে হয়রানি করালে। বুড়ো মানুষটাকে কেউ ছাড় দিচ্ছ না! ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। চোখ বুঁজে মনে মনে বলল, ‘ কিছু চাওয়া সাথে সাথে পূরণ করে নিতে হয়। নাহলে পরে পূরণ করা হয় না। বইগুলোও আমার তেমন চাওয়া ছিল, দাদিজান। মুখ ফুটে বলার পরও যেগুলো আমার কাছে আসেনি, সেগুলো হয়তো কোনোদিনই আসত না। ‘ কপাট লাগানোর শব্দ হলো। আলোও নিভে গেল। দাদিজান খাটে উঠে এলেন। দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ার পরও স্বর্ণলতা সেই সুবাসটা পেল।
_______
খাইরুন নিসা ভোরের আলো ফুটার পূর্বে ওঠেন। পাক-পবিত্র হতে হতে ফজরের আযান শোনায় অভ্যস্ত। আজ একটু গোলমেলে বাঁধল। ঘুম ভাঙল, ভিন্ন কোনো আওয়াজে। তিনি পিটপিটে চেয়ে দেখলেন, স্বর্ণলতা গলা ছেড়ে পড়ছে। মাথায় ঘোমটা নেই, ভেজা চুল থেকে টপটপে পানি পড়ছে। জামার বদলে শাড়ি জড়িয়ে আছে কিশোরী শরীরটায়। তিনি সন্দেহি সুরে সুধালেন,
” গোসল করেছ নাকি? ”
সে ঠোঁটে পড়া ধরে রেখে তাকাল। মাথাটা নাড়ল উপরে ও নিচে। তিনি উঠে বসতে বসতে পুনরায় সুধালেন,
” নামাজ পড়েছ? ”
তার পড়া থেমে গেল। দৃষ্টি নিচে নেমে গেল ধীরে ধীরে। মলিন বদনে দুপাশে মাথা নাড়ল। খাইরুন নিসার কণ্ঠ থেকে বিরক্ত ঝরে পড়ল,
” নামাজ রেখে বই নিয়ে বসেছে! এই বই দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করবে তো? ”
স্বর্ণলতার মাথাটা আরও নুয়ে গেল। থুতনিটা বুক ছুঁই ছুঁই করছে। নামাজ পড়ার সময় হয়নি। সে এখনও নাপাক! অন্য রুমে থাকতে চাওয়ার জেদ ছিল, এই কারণেই। নামাজের বিষয়টা সহজেই এড়িয়ে যেতে পারবে। দাদিজান এখনও জানতে পারেনি, তার ঋতুচক্র চলছে। আলাদা রুমে একা থাকলে পড়াশুনাটাও নির্বিঘ্নে চালাতে পারত। এবার বাড়ি গিয়ে শুনেছে, এক সপ্তাহ পরে তার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা।
” যা খুশি করো। আমার কী? আমি তো জোর করে পড়াতে পারি না! নামাজ পড়তে হয়, আল্লাহর ভয়ে। মুনছুরও বলে গেছে, তোমাকে কিছু না বলতে। ভালোই হয়েছে, অন্তত এই একদিক দিয়ে দুজনে একদলে আছ। ”
তিনি বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। স্বর্ণলতার চোখ ছলছল করছে। অপরাধ না করেও ব কা শুনতে হচ্ছে! বদ লোকটার দলে চলে যাচ্ছে। সে কখনও ঐ লোকের দলে থাকতে চায় না। ভালো কাজে না, খারাপ কাজেও না। স্বর্ণলতা বই রেখে দিল। বিছানা থেকে নামল লাফ দিয়ে। রুম থেকে বের হতে হতে বলল,
” আমি গরম পানি নিয়ে আসছি। ”
” লাগবে না। আমি বেনামাজির হাতের ছোঁয়া জিনিস ব্যবহার করি না। ”
তিনি স্বর্ণলতাকে পাশ কাটালেন। দরজার অভিমুখে পৌঁছে ডাকলেন,
” ময়না? গরম পানির পাতিলটা নিয়ে আয়। ”
স্বর্ণলতা নীঃশব্দে একটি বই, খাতা ও কলম নিয়ে বেরিয়ে এলো। বারান্দার সিঁড়িতে বসে একাধারে পড়া ও লেখা চালিয়ে গেল। কেউ তাকে দেখতে আসেনি, বিরক্তও করেনি। পড়ায় মজে থাকায় খেয়ালও করেনি, শ্বশুবাড়িতে আসার পর এই প্রথম দীর্ঘ সময় ধরে বাড়ির বাইরে বসেছে, সময় কাটিয়েছে। কোনো হাঁকডাক নেই, শোরগোল নেই। মানুষ জনের আনাগোনাও সীমিত।
_______
স্বর্ণলতা পড়ালেখায় বিরতি দিল, সকালের নাস্তার সময়ে। দাদিজান ময়নাকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন। সে চটপটে পৌঁছাল নাস্তার টেবিলে। দাদিজানের পাশে বসল। খাবার পরিবেশনের প্রয়োজন পড়ল না। দুজনের থালাতেই খাবার সাজানো। স্বর্ণলতা অবাক হলো। দাদিজানের দিকে তাকাল। তিনি দৃষ্টি বিনিময় করলেন না। চুপচাপ খাচ্ছেন। স্বর্ণলতা বুঝতে পারল, বৃদ্ধ মানুষটার রা গ ভাঙেনি। রে গে গেলে তিনি ভয়ঙ্কর রকমের জেদি হয়ে পড়েন যে, স্বর্ণলতা জানে। রুমকিবুকে দেখতে যাওয়ার সময় প্রমাণ পেয়েছিল। নাতির সাথে জেদ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন, তবুও জেদ ছাড়েননি!
খাইরুন নিসার প্রথম খাওয়া শেষ হলো। টেবিল ছেড়ে যাওয়ার সময় বললেন,
” এখন বারান্দায় রোদ পড়বে, বই-খাতা নিয়ে ঘরে বসো। আমি বুড়ো মানুষ! নামাজ-কালাম নিয়ে ব্যস্ত। অন্যকে বিরক্ত করব কখন? ”
অভিমানি কণ্ঠস্বর। মুখ ফিরিয়ে নিলেও মন ফিরিয়ে নিতে পারছে না। মানুষটার মধ্যে কি স্বর্ণলতার জন্য মায়া সৃষ্টি হয়েছে? তার মনটা আবারও খারাপ হলো। ইচ্ছে হলো, জানিয়ে দিতে সে ইচ্ছে করে নামাজ বাদ দিচ্ছে না।
স্বর্ণলতা দাদিজানের আদেশ অমান্য করতে পারল না। বই-খাতা গুছিয়ে আবারও ফিরে এলো তার রুমে। খাটের এক কিনারে বসে পড়ালেখা চালিয়ে গেল। এবার যতটা পারল নিচু স্বরে পড়ল। দাদিজানের মতো সেও তাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছে না। পড়ার মাঝে শুনতে পেল, দাদিজানের মোবাইল বাজছে। সে বই থেকে মুখ তুলল। তিনি রুমে নেই। কখন বেরিয়েছেন খেয়াল করে নি। কোথায় গিয়েছে জানেও না। একবার ভাবল, বাইরে গিয়ে খোঁজ নেয়। পরক্ষণে মন বদলাল। এসব কাজের সময় নেই। কার না কার কল! সে মোবাইলের থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনল বইয়ে। পরীক্ষা নিকটে, সব পড়াই বাকি! সিলেবাস নেই, সাজেশন্স নেই, নোটও করা হয়নি কিছু। দশম শ্রেণিতে ঠিকমতো ক্লাস করা হয়নি। অনেক পিছিয়ে আছে।
পড়ায় বেশিক্ষণ মনোযোগ দিতে পারল না, মোবাইলটা আবারও বেজে ওঠল। স্বর্ণলতা জায়গায় বসে মোবাইলের খোঁজ করল। দাদিজানের বালিশের নিচে আছে বোধ হয়। ওখান থেকেই আওয়াজটা ভেসে আসছে। সে কি একবার দেখবে, কে কল করেছে? হাতটা বাড়িয়েও ফিরিয়ে আনল। যেই কল করুক না কেন, তার কিছু হয় না। তাই গুরুত্ব দেওয়ারও কিছু নেই। স্বর্ণলতা বই হাতে বিছানা থেকে নেমে এলো। এতবার কল করছে! জরুরি কলও হতে পারে। সে রুমের বাইরে এসে এদিক-সেদিক তাকাল। দাদিজানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রান্নাঘরে কলি, ময়না দুজনেই উপস্থিত আছে। নিজ নিজ কর্মে ভীষণ ব্যস্ত। এদের মধ্যে কলির সাথে সম্পর্ক ভালো হয়েছে। তার উদ্দেশ্যে বলল,
” দাদিজান রে দেখছ? ”
” না। ঘরে নাই? ”
স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে না বুঝাল। কলি রান্না চড়িয়েছে। চুলার আঁচ কমিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
” আম্মাজান তো ঘর থুইয়া কোনোহানে যায় না। আপনে দাঁড়ান, আমি উঠানডায় চোখ বুলাই আহি। ”
কলি তৎক্ষনাৎ দ্রুতপায়ে ড্রয়িংরুমটা পার হয়ে গেল। স্বর্ণলতা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। চিন্তা হচ্ছে, শঙ্কা বাড়ছে। সেও জানে, বৃদ্ধ মহিলা নিজের ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না। স্বর্ণলতা উদ্বিগ্ন চিত্তে সদর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়িতে নামতে দেখল, কলি ফিরছে। চিন্তামুক্ত বদন। পা’জোড়ায় চঞ্চলতা। কাছাকাছি এসে মৃদু হাসল। বলল,
” ডরায়েন না। আম্মাজান হারাইয়া যায় নাই। গেইটের কাছে দাঁড়াইয়া আছে। কারা যেন, দেহা করতে আইছিল, তাগো লগে কথা কইতাছে৷ শেষ হইলে ফেরত আইবো। ”
” কারা আসছে, কলিবু? ”
তার কণ্ঠে সীমাহীন কৌতূহল, আগ্রহ। চোখ দু’খানার চাহনি দূরের গেইটটা দিকে ছুটে চলে গেল। দাদিজানের দেহটা আংশিক দেখা যাচ্ছে। দুপুরের তপ্ত রোদ্রে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছে এত সময় ধরে!
” চিনি না। আগে দেহি নাই। একটা মাইয়া আর পোলা। মাইয়াডা আপনের বয়োসী, পোলাডা ছোড। মনে হয়, ভাইবোন। ”
” এই গ্রামের না? ”
” না। তাইলে তো চিনতামই। ”
কলি কথা বাড়াল না। রান্নার দোহায় দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। স্বর্ণলতা আরও কিছুক্ষণ গেইটের দিকে চেয়ে থাকল। বুকের ভেতরটা আচমকায় উচাটন শুরু হয়েছে। চোখদুটোর মতো মনটাও সরছে না। এই সময় দেখল, দাদিজান ধীর পদক্ষেপে ফিরছেন। স্বর্ণলতা চট করে নিচে নেমে এলো। দ্রুত কদমে হেঁটে গেল খাইরুন নিসার কাছে। তিনি হাঁপিয়ে ওঠেছেন, ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছেন। ঘেমেও ওঠেছেন। মাথা ঢেকে রাখা কাপড়টা দিয়েই মুখ মুচছেন। স্বর্ণলতা এগিয়ে গিয়ে একপাশ থেকে বাহু চেপে ধরে বলল,
” এত রোদে একা বাইর হইছেন! মাথা ঘুইরা যাইব তো, আমারে ডাক দিতেন। ”
তিনি চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন। বিরক্ত ফুটে ওঠল মুখটায়। কিন্তু হাতটা সরিয়ে দিলেন না। দুর্বলতায় কাবু হয়ে গেছেন। একা একা হাঁটার সাহস পাচ্ছেন না। স্বর্ণলতা তার চাহনিকে অগ্রাহ্য করে সুধাল,
” ক্যা আইছিল, দাদিজান? ”
” তোমার জানার দরকার নেই। পড়াশোনা করছ না? মুনছুর ফেরার আগ পর্যন্ত ওটাই করো। আর ঝামেলা বাঁধিও না। ”
স্বর্ণলতার মুখ ভার হলো। পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথায় আসল। হঠাৎ ঝামেলা করতে মানা করল কেন? গেইটের বাইরে কি তার চেনা কেউ ছিল? তারা পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। দাদিজানের রুমে প্রবেশ করামাত্রই মোবাইলটা বেজে ওঠল। স্বর্ণলতা টের পেয়ে জানাল,
” অনেক্ষণ ধইরা মোবাইলটা বাজতাছে। ”
” মুনছুর ছাড়া আর কে কল করবে? ধরলেই পারতে। এখন তো হাজারটা কথা শুনাবে! ”
” অন্যকেউও তো হইতে পারে। ”
খাইরুন নিসা খাটে বসলেন। গ্লাস টেনে নিয়ে একটু পানি খেলেন। তারপরে বললেন,
” আমার নাম্বার আর কে জানে? ”
এই সময়ে স্বর্ণলতার স্মরণে এলো, নাম্বারটা তার মা জানে। ঐবাড়ি যাওয়ার পরে দাদিজানের নাম্বার দিয়েছিল। বলেছিল, খুব দরকার পড়লে এই নাম্বারে কল দিতে। সে দেয়নি তো! মায়ের থেকে শুনেছিল, আব্বা বড় আপা আর সুবর্ণকে নিয়ে শহরে গিয়েছে। বলেছিল, আপার চিকিৎসা করাবে। সাথে সুবর্ণ থাকলে ভালো হবে তাই তাকেও নিয়ে গিয়েছিল। তারা ফেরত এসেছে কি? আপা সুস্থ হয়েছে নাকি জানার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠল। স্বর্ণলতা নিজ উদ্যোগেই মোবাইলটা বালিশ থেকে বের করল। দাদিজানের দিকে বাড়িয়ে বলল,
” ধরলেই তো বুঝবেন, দাদিজান। ”
তিনি মোবাইল হাতে নিলেও কলটা ধরতে পারলেন না। কেটে গেল। নাম্বারটা দেখার জন্য বাটনে চাপ দিতেই মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বললেন,
” আরে, বন্ধ হয়ে গেল নাকি! এখন আবার চার্জে দিতে হবে। মুনছুর তো ভালোই ঝামেলায় ফাঁসাল। ”
খাইরুন নিসা বিছানা থেকে উঠলেন চার্জারের সন্ধানে। স্বর্ণলতা হতাশ চিত্তে পড়ায় বসল।
________
সন্ধ্যার দিকে কলি একগাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে আসল। দাদিজান জিজ্ঞেস করতে বলল,
” পান্না ভাই দিয়া গেল। কইল, ছার পাঠাইছে। ”
খাইরুন নিসা আধ শোয়া ছিলেন। আপনমনে তসবিহ পাঠ করছিলেন। বিরতি দিতে হলো। তহবিহটা গলায় পরতে পরতে বললেন,
” দেখি, কী পাঠিয়েছে। ”
কলি একটা ব্যাগ এগিয়ে ধরল। দাদিজান মেলে দেখলেন, থ্রি-পিস। ভ্রূজোড়া কুঁচকে গেল আপনাআপনি। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
” ব্যাগগুলা রাখ এখানে। ”
সে দুইহাত ভর্তি শপিং ব্যাগগুলো বিছানায় রাখল। চপলপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে খাইরুন নিসা বললেন,
” বই রেখে এদিকে আসো। দেখ তো, কী কী পাঠিয়েছে। ”
স্বর্ণলতা এক কোণে বসে লিখছিল। তন্মধ্যে টের পেল, তাকেই ডাকছে। সে খাতা-কলম ফেলে শপিং ব্যাগগুলো খুলল। সবগুলোতেই থ্রি-পিস। শুধু রঙ ও কারুকাজ আলাদা। খাইরুন নিসা একে একে সবগুলো দেখে আচমকা বললেন,
” মুনছুর এই কাজটা ভালো করেছে। তুমি শাড়ি পরতে পারো না, সামলাতেও পারো না। বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই দেখে রক্ষা! যাও, কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখ। এখন থেকে তুমি এসবই পরবে। ”
সে কাপড়গুলো গুছিয়ে শেষ করতে পারল না। তন্মধ্যে মোবাইলটা বেজে ওঠল। দাদিজান ও নাতবউ উভয়ে চমকে ওঠল! খেয়াল হলো মোবাইলটা এখনও চার্জে। চার্জার থেকে খোলার কথা কারই মনে নেই। স্বর্ণলতা দৌড়ে গেল মোবাইলের কাছে। যদি মা কল করে থাকে!
খাইরুন নিসা কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে কণ্ঠটা ভেসে আসতে চিনে ফেললেন। বললেন,
” হ্যাঁ, পান্না মাত্রই দিয়ে গেল। ”
স্বর্ণলতা উৎসাহী চোখে চেয়ে ছিল। পান্না নামের সাথে মায়ের কোনো যোগসূত্র নেই। নামটা প্রকাশ না হলেও বুঝে গেল, মুনছুর সাখাওয়াত কল করেছে। সে আশাহত হলো। দাদিজানের কাছ থেকে সরে পড়বে, তখনই হাতটা ধরে ফেললেন। বললেন,
” মুনছুর কথা বলবে। নেও। ”
এই লোকের সাথে তার কোনো কথা নেই। ইচ্ছে হলো, হাতটা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়তে। তেমন কিছুই করল না স্বর্ণলতা। দাদিজান রাত থেকেই রে গে আছেন। সকালের দিকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রায়। দুপুরের পর রা গ কমেছে, কথা বলছে। এখন কথা না শুনলে সেটাও বন্ধ করে দিতে পারেন। সে ভীষণ অনিচ্ছা ও অবহেলায় মোবাইলটা হাতে নিল। সাথে সাথে ওপাশ থেকে কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” স্বর্ণলতা? ”
সে দাদিজানের দিকে তাকাল। মুখটা শক্ত হয়ে আছে। ঠোঁটদুটো সামান্যতমও নড়াল না। শুধু আওয়াজ করল,
” হুম। ”
” থ্রি-পিসগুলো পছন্দ হয়েছে? ”
” হুম। ”
” পরেছ? মাপ ঠিকঠাক আছে? ”
” হুম। ”
” সত্যি? দাদিজান যে বলল, মাত্রই দিয়ে গেছে। এরমধ্যে পরেও ফেলেছ? ”
” হুম। ”
” কী আশ্চর্য! শুধু হুম হুম করছ কেন? ঠিক করে বলো। পছন্দ না হলে আরও পাঠাচ্ছি। ”
স্বর্ণলতা এবার ঠোঁট নেড়ে চটজলদি বলল,
” লাগবে না। এত দিয়ে কী করব? আমি তো মাত্র একটা মানুষ। ”
” তাহলে জামাগুলো পরো। তারপরে বলো, মাপে ঠিক আছে নাকি, পরে শান্তি লাগছে নাকি এটাও জানাবে। আমি একটু পরে আবার কল করব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কল কেটে দিল। স্বর্ণলতা বুঝতে পেরেও মোবাইলটা কান থেকে নামাল না। অন্য ভাবনায় ডুবে গেল। মনে পড়ল, একদিন বলেছিল শাড়ি পরলে অশান্তি লাগে। লোকটা কি থ্রি-পিস দিয়ে সেই অশান্তি দূর করে ভালো সাজতে চাচ্ছে? স্বর্ণলতা মনস্থির করল, এই জামাগুলো পরবে না। সে চায় না লোকটাকে ভালো ভাবতে। সে খারাপ, চূড়ান্ত পর্যায়ে খারাপ। কথাগুলো মনে মনে জপতে জপতে বই হাতে নিল। তখনই দাদিজান বললেন,
” আমি জানতাম, মুনছুর সব থেকে বেশি টাকা ভালোবাসে। এখন মনে হচ্ছে টাকার চেয়েও বেশি তোমাকে ভালোবাসে। নাহলে দেনাদারের থেকে টাকা আদায় না করে তোমার কাছে আসত না। এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। ”
সে বইয়ের পাতা মেলতে মেলতে বলল,
” ঐ লোক দেনাদার না, অন্যকিছু। ”
চলবে