#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৩)
চৈত্রের উত্তাপিত দুপুর। যোহরের ওয়াক্ত চলছে। খাইরুন নিসা নামাম শেষ করে দেখলেন, স্বর্ণলতা গোসল করে বেরুচ্ছে। শাড়ির অর্ধেক ভিজিয়ে ফেলেছে পরার সময়ে। বাকি অর্ধেক ভেজাচ্ছে কাঁধে রাখা ধোয়া ভেজা কাপড় থেকে ও খুলে রাখা চুল থেকে। বিরক্তে কপাল দলা হলো। কপট রা গ নিয়ে বললেন,
” শাড়ি পরেছ কেন? মুনছুর তোমার জন্য থ্রি-পিস পাঠিয়েছে না? ”
সে তৎক্ষনাৎ শাড়িতে মনোযোগ দিল, আঁচলটা সরে যায়নি তো! পেটটা উন্মুক্ত দেখাচ্ছে না তো! আজ বেশ সময় নিয়ে পরেছে, কুঁচি দেওয়ার সময় হাত ফসকে দুই বার শাড়ি পড়ে গিয়েছিল। এত যত্ন করে, সময় ব্যয় করে পড়ার পরও কি ত্রুটি থেকে গেল?
” আম-কাঁঠালের মৌসুম আসছে। গরমে দুনিয়া সিদ্ধ করে ফেলবে। এই অবস্থায় ভেজা কাপড় পড়লে সমস্যা। জ্বর-সর্দিতে পড়বে। যাও, থ্রি-পিস পরে আসো। ”
স্বর্ণলতা এতক্ষণে খেয়াল করল, তার শাড়ির কুঁচির অংশটা ভেজা। বুকের দিকের অংশটাও ভিজে যাচ্ছে। সে চট করে ভেজা কাপড়গুলো হাতে নিয়ে বলল,
” আমি ঐ কাপড় পরতে পারি না, দাদিজান। ”
” থ্রি-পিস পরতে না পারার কী আছে? বিয়ের আগে তুমি কি শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে? ”
” জি, হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আম্মা মালা-ফ্রক বানাই দিছিল।
”
খাইরুন নিসা কী একটা বলতে চেয়েও থেমে গেলেন। স্মরণে এলো, এই গ্রামের মেয়েরাও আগে সুতি শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াত। চাঁদনিকে খুব একটা শাড়ি পরতে দেখেননি, কিন্তু ফ্রক পরতে দেখেছেন। থ্রি-পিসের ফ্যাশন চালু হয়নি এখনও। শহরে বাস করছে কিংবা ঘন ঘন যাতায়াত করছে এমন কিছু পরিবারের মেয়েরা থ্রি-পিস পরতে শুরু করেছে। অথচ ঢাকার দিকে মেয়েদের প্রধান পোশাক থ্রি-পিস। বিবাহের পূর্বে তিনিও পরেছিলেন! এই গ্রামগুলো প্রায় দুই যুগের মতো পিছিয়ে আছে। তিনি হিসাবটা শেষ করে বললেন,
” এগুলো ফ্রকের মতোই। শুধু দুই পাশে কাটা আছে। পরতে কোনো সমস্যা নেই। যেভাবে ফ্রক পরো, সেভাবেই পরবে। ”
স্বর্ণলতার মুখে মেঘ জমল। চোখের দৃষ্টিতে রাজ্যের অনিচ্ছা ও অনিহা। দাদিজানকে কী করে বুঝাবে, এই কাপড়গুলো না পরার সংকল্প করেছে। তার নাতি যে, উপহারের লোভে ফেলে ভালো সাজার চেষ্টা করছে, সেই পরিকল্পনা বানচাল করতে হলে সংকল্পটা রক্ষা করতেই হবে।
খাইরুন নিসা একভাবে চেয়ে আছেন নাতবউয়ের দিকে। আচমকা মুখের রং ও প্রতিক্রিয়া বদলে যেতে ভাবলেন, নতুন ধরনের কাপড় পরতে ভয় পাচ্ছে। লজ্জা পাচ্ছে। তিনি মৃদু হাসলেন। আন্তরিক দৃষ্টি রেখে স্নেহমাখা গলায় বললেন,
” আচ্ছা, আমি পরিয়ে দিচ্ছি। তোমার পছন্দমতো একটা জামা নিয়ে এসো। ”
স্বর্ণলতা বুঝল, পুরোদমে ফেঁসে যাচ্ছে। সংকল্প ভেঙে গুড়াগুড়া হবে এখনই। সে চটজলদি বলল,
” নামাজটা পইরা লই, দাদিজান? জামা বদলাইতে গিয়া কাযা হইয়া যাইবো। ”
সে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। বড় বড় কদম ফেলে রুমের বাইরে এলো। ময়না বসার রুম পরিষ্কার করছিল। স্বর্ণলতাকে দেখে দৌড়ে এলো। হাতদুটি নিজের শাড়িতে মুছতে মুছতে সভয়ে বলল,
” আপনে কাপড় ধুইতে গেছেন ক্যা? এই কাজ তো আমার। ছার হুনলে আমারে মাইরা ফালাইবো। জলদি দেন, নাইড়া দিতাছি। ”
সে বাঁধা সৃষ্টি করল না। ধোয়া কাপড় হস্তান্তর করে রুমে ফিরল। ওযু করাই আছে। অন্য একটি জায়নামাজ বিছিয়ে নামজে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাদিজান বৃদ্ধ মানুষ, স্মৃতিশক্তি কমে এসেছে। দিন-রাত আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত থাকেন। একটু সময় পেরিয়ে গেলেই জামা বদলানের বিষয়টি ভুলে যাবেন। স্বর্ণলতা ঠিক করল, নামাজ শেষ করে তসবিহ পাঠ করবে, দীর্ঘ মোনাজাত ধরবে।
_______
দাদিজান সত্যি সত্যি স্বর্ণলতার কাপড়ের বিষয়টা ভুলে গেলেন। দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একটা বই, খাতা ও কলম নিয়ে সতর্ক পায়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। পড়াশোনাটা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে করবে। তিনি যতক্ষণ ঘুমাবেন, ততক্ষণ সে নিশ্চিন্ত। মন ও মাথা দুটোই ঠাণ্ডা, সতেজ। এমন অবস্থায় পড়াশোনা ভালো হয়। স্মৃতিশক্তি সচল থাকে বেশি। স্বর্ণলতা খুশিমনে পড়া শুরু করলেও বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারল না। কলির আগমন ঘটল। জানাল,
” আবুল ভাই আম্মাজান রে ডাকে। উনি তো ঘুমাইতাছে। কী করমু, আফামনি? ”
সে বই থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল,
” ডাকে ক্যা? ”
” জানি না, জিগাই নাই তো। ”
” তাইলে জাইনা আসো। গুরুত্বপূর্ণ কাজ হইলে উনারে ঘুম থেইকা তুলমু। ”
কলি ব্যস্ত পায়ে চলে গেল। স্বর্ণলতা পুনরায় পড়ায় মন দিল। এবার মন বসছে না। বার বার চোখ চলে যাচ্ছে বড় দরজাটায়। একটা পাট মেলা। বারান্দার এক ফোটা দেখা যায় শুধু, আর কিছু না। তারপরেও কী যেন দেখার জন্য মনটা হাপিত্যেশ করছে। এই সময়ে আচমকা, আলোর রশ্নির মতো মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটা ফুটে ওঠল মস্তিষ্কে। সে চমকে ওঠল, পড়ার জন্য অনর্গল নড়তে থাকা ঠোঁটদুটি থেমে গেল। স্মরণে এলো, এই মানুষটা কাউকে খুঁজছে। যাকে সে চেনে। অবশ্যই চেনে, নাহলে তিন বছর ধরে কাউকে খুঁজছে সেই তথ্যটা তার কাছে প্রকাশ করবে কেন? এতদিন ধরে এই বাড়ি আছে, মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। কখনও এরকম কিছু বলেনি। অন্য কোনো মানুষকে নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। এবারই বলেছে! স্বর্ণলতা নিশ্চিত এই লোকের কাছে টাকা-পয়সা পায় না। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে খুঁজছে।
” কারা যেন দেহা করতে আইছে, আপামনি। দাদিজান রে ডাকতেই হইবো। নইলে জোর কইরা ঢুকার হু মকি দিতাছে। ”
স্বর্ণলতা নিজের ভাবনায় এতটায় ডুবে ছিল যে, কলির দ্বিতীয় আগমনকে টের পেল না। চমকে উঠল তার কণ্ঠস্বরে। সচকিত দৃষ্টিজোড়া আটকে গেল কলির মুখপানে। অবোধের মতো চেয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করল। অতঃপর বই-খাতা সোফায় রেখে উঠে দাঁড়াল। দাদিজানের রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
” বাড়িতে ঢুকতে চায়? মেলা সাহস তো! ”
কলি তাকে অনুসরণ করতে করতে প্রত্যুত্তর করল,
” হ। মনে অয়,ছার যে বাড়ি নাই এই খবর নিয়া আইছে। ”
” কারা আইছে? চিনো নাকি? ”
” না। ঐদিন কইলাম না? এই গেরামের না। চিনমু ক্যামনে? দিন-রাত তো এই বাড়িই পইড়া থাকি। ”
স্বর্ণলতা রুমের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, সহসা পা’জোড়া থমকে গেল। শক্তহাতে দরজার পাল্লা চেপে ধরে ফিরল পেছনে। সুধাল,
” ঐ মাইয়া আর পোলাডা? ”
” হ। ”
” ওদের দাদিজানের কাছে কী কাজ? ”
” ক্যামনে কমু? আবুল ভাই এই বিষয়ে কিছু কয় না। শুধু কইছে, দাদিজান রে পাঠাইতে। ”
তাদের কষ্ট করে ডাকতে হলো না। দরজার কাছে কথা-বার্তা হচ্ছিল বিধায় দাদিজানের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। আধোঘুমে ধ মকে ওঠলেন,
” দরজার সামনে এত কথা কিসের? কে ওখানে? ”
কলি চেঁচিয়ে জবাব দিল,
” আমি, আম্মাজান। আপনে রে ডাকতে আইলাম। ”
” কেন? ”
” আবুল ভাই পাঠাইছে। আপনের লগে দেহা করার লাইগা দুইডা লোক আইছে। ”
” আমার সাথে! ”
তিনি রয়ে-সয়ে উঠে বসলেন। আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকছেন। স্বর্ণলতা ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
” জি, দাদিজান। সেদিন যে দেখা করতে আইছিল? ওরাই। খুব দরকার নাকি বার বার আইতাছে! ”
খাইরুন নিসা ভ্রূযুগল ও কপালের মাঝের অংশ কুঁচকে ফেললেন। মনে পড়ছে না বোধ হয়। সেকেন্ড কয়েক পেরুতেই মুখের রঙ বদলাল। বিচলিত দেখাচ্ছে। কলির উদ্দেশ্যে দ্রুত বললেন,
” আমার সাথে দেখা করে লাভ নেই। মুনছুরের সাথে দেখা করতে হবে। ওদেরকে বলে দে, মুনছুর এখনও ফিরেনি। ফিরলে আমি খবর পাঠাব। আবুলের কাছে ঠিকানা নাহয় মোবাইল নাম্বার দিয়ে যেতে বল। ”
কলি চলে যেতেই স্বর্ণলতার উদ্দেশ্যে বললেন,
” চারদিন হয়ে গেল, ছেলেটা এখনও ফিরছে না! তোমাকে কিছু বলেছে? ফিরবে কবে? ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। মুনছুর সাখাওয়াত যাওয়ার দিন সময়টা বলেছিল। সে মনে করার চেষ্টা চালিয়ে নিশ্চিত হলো। অতঃপর বলল,
” দুই-তিন দিন কইছিল। ”
” আজ পাঁচদিন চলে। ছেলেটা ঠিক আছেতো! কেন যে, এসব মা রামারি ঝামেলায় যায়! টাকা-পয়সায় কি সব? দুই-একজনের থেকে ফেরত না পেলে কী হবে? ও তো কম জমায়নি! ”
তিনি গভীর দুশ্চিন্তায় পতিত হলেন। তীব্র আশঙ্কায় ভুগছেন। স্বর্ণলতা খেয়াল করল, দাদিজানের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ছে। ঘাম ঝরছে কানের দুইপাশ দিয়ে। মাথার উপরে পাখা চলছে। গরম কমাতে পারছে না বোধ হয়। সে চার্জার ফ্যানটাও চালিয়ে দিল। খাইরুন নিসা ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে আচমকা বললেন,
” আমার মোবাইলটা দাও। একটা কল দিই। ”
মোবাইলটা বালিশের নিচে ছিল। সে এনে দিল। দাদিজান সময় নষ্ট করলেন না। তক্ষুনি কল লাগালেন নাতির নাম্বারে। প্রথম কলেই নাম্বারটা বন্ধ দেখাল। তার বুকের ধুকপুকানি বাড়ল। নাতবউয়ের দিকে ফিরে অসহায় কণ্ঠে বললেন,
” বন্ধ বলছে তো! ”
কণ্ঠটা এত ভার ও কাতর শোনাল যে, স্বর্ণলতার হৃদস্পন্দনও বেড়ে গেল। মনে পড়ল, জামা পরে মাপ দেখে রাখতে বলেছিল। একটু পরে, কল দিয়ে জানবে। সেই কল আসেনি। স্বর্ণলতাও সেধে জানায়নি। উল্টো খুশি হয়েছিল। এরপরে যে, আরও তিনদিন কীভাবে কেটে গেল, বুঝতেই পারেনি! দিন-তারিখটা তার মস্তিষ্কে ঢুকামাত্র আঁতকে ওঠল। দুইদিন পরে তার পরীক্ষা! পরীক্ষার ফি দেওয়া হয়নি, রুটিন আনা হয়নি। প্রথমে কোন বিষয়ের পরীক্ষা জানে না। পড়বে কীভাবে? সব থেকে বড় সমস্যা মানুষটা না আসলে বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না, বিদ্যালয়ে যেতে পারবে না, পরীক্ষাও দিতে পারবে না। চারদিন ধরে যে নিদ্রাহীন অক্লান্ত পড়াশোনা করেছে, সব ভেস্তে যাবে। সে এত সহজে হারতে চায় না।
স্বর্ণলতা দাদিজানের মোবাইলটা ছিনিয়ে নিল প্রায়। কল দেওয়া শেখা হয়েছে। অনেকদিন পূর্বে ডাক্তার হাদির সাথে কথা হয়েছিল এই মোবাইল দিয়েই। তখনই কল দেওয়া ও ধরা দুটোই শিখেছে। সেই জ্ঞান থেকে, মুনছুর সাখাওয়াতের নাম্বারটায় কল দিল। আশ্চর্য হলেও সত্যি, কল ঢুকল ও সাথে সাথে রিসিভ হলো। স্বর্ণলতা টের পেয়ে সুধাল,
” আপনের নাম্বার বন্ধ ক্যা? ”
” স্বর্ণলতা! তুমি কল করেছ? ”
ওপাশের কণ্ঠটায় অকৃত্রিম আনন্দ, অভিভূত। বিশ্বাস করতে পারছে না, স্বর্ণলতা কল করেছে। সে ত্যাড়া গলায় জবাব দিল,
” স্বর্ণলতা না, আমি কল দিছি। ”
” তুমি আর স্বর্ণলতা ভিন্ন? ”
” হ। ”
” আমার কথা মনে পড়ল কার? তোমার নাকি স্বর্ণলতার? ”
” দাদিজানের। নেন, কথা কন। ”
সে মোবাইল হস্তান্তর করল দাদিজানের কাছে। মাঝে যে, মুনছুর সাখাওয়াত বার দুয়েক ‘ স্বর্ণা ‘ নামে ডাকল, গ্রাহ্য করল না। দাদিজান মোবাইল কানে ধরতেই ধ মক খেল,
” আরে, মোবাইলটা তুমি নিলে কেন? তোমার নাতবউয়ের কাছে দাও। আমার কথা আছে। ”
খাইরুন নিসা মোবাইল ফেরত দিতে চেয়েও দিলেন না। শক্ত হলেন। বললেন,
” আমারও কথা আছে। শেষ করি, তারপরে দিব। ”
” আমারটা আগে শেষ করতে দাও। ”
” না। আগে আমার সাথে কথা বল। ”
ওপাশটা ক্ষনিকের জন্য নীরব হয়ে ওঠল। সহসা মুনছুর সাখাওয়াতের গলা ভেসে এলো,
” আবার শুরু করলে? আমাদের মাঝে না আসলে তোমার দিন-রাত ফুরায় না, দাদিজান? ”
” সেধে যাচ্ছে কে? তোরাই তো টানছিস! ”
” দাদিজান! দাও না৷ একটু কথা বলি, তারপরে নাহয় ফাঁ সিতে ঝুলিয়ে দিও৷ ”
এই নরম গলা, আবদারে পরিপূর্ণ বাক্যটা শুনলে খাইরুন নিসার রা গ পড়ে যায়। স্মৃতিবিজড়িত হয়ে উঠে মন ও মস্তিষ্ক। চোখের সামনে ভেসে উঠে একমাত্র বড্ড আদরের নাতির ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠার প্রতিটি মূহুর্ত।
স্বর্ণলতা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। উঁশখুশ করছে। মুনছুর সাখাওয়াত কবে ফিরবে সেই তথ্যটা শোনার অপেক্ষায় আছে। দাদিজান চুপ হয়ে যেতে সে অধৈর্য হয়ে ওঠল। কাঁধে স্পর্শ করে ফিসফিসে বলল,
” কবে আইবো কইছে? ”
তিনি মোবাইলটা বাড়িয়ে ধরে বললেন,
” না। তুমি জিজ্ঞেস করো। ”
” আবার আমি ক্যা? আপনে জিগান না, দাদিজান। ”
” আমাকে বলছে না। তুমি জিজ্ঞেস করো, হয়তো বলবে। ”
খাইরুন নিসা হাতে জোর করে মোবাইলটা ধরিয়ে দিলেন। সে গড়িমসি করছে। মোবাইল কানে নিতে চাচ্ছে না। সেধে প্রশ্নটা করতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। আবার প্রশ্ন না করেও উপায় নেই। উত্তরটা তার জানা দরকার। শুধু জানলে হবে না, কালকের মধ্যে লোকটাকে বাড়িতেও আনতে হবে৷ আজ আসলে আরও ভালো হয়। সে কি আবারও দরজা আটকে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটাবে?
দাদিজান তাগাদা দিলেন,
” মোবাইল বুকে না ধরে কানে ধরো, তাহলে কথা শুনতে পারবে। মুনছুর কী বলে শুনো, তারপর তোমার কথাটাও বলো। তাড়াতাড়ি করো, টাকা কাটছে তো! ”
সে নিতান্ত বাধ্য হয়ে মোবাইল কানে ধরল। সাথে সাথে প্রশ্নটা করল,
” আপনি আইতাছেন না ক্যা? ”
” আমাকে খুব দরকার নাকি? ”
” হ। ”
” দরকারটা কার? তোমার নাকি স্বর্ণলতার? ”
” দুজনেরই। ”
” বাহ! এতদিন একজনের দরকার পড়েনি, আজ দুইজনেরই দরকার পড়ছে। ”
” এত কথা না কইয়া উত্তরটা দেন। ”
” খুব তাড়া দেখছি! ”
” কইবেন নাকি কাইটা দিমু। ”
” দেও। আমার সমস্যা নেই। দরকারটা তো আমার না, তোমার। ”
স্বর্ণলতা কল কেটে দিল। দাদিজানের হাতে মোবাইলটা দিয়ে গোসলখানার দিকে ছুটল। সশব্দে দরজাটা আটকে দিল। খাইরুন নিসা ভ য় পেয়ে গেলেন। পেছন পেছন আসতে চেয়েও পারলেন না, ফোনটা বেজে ওঠল। ধরে বললেন,
” স্বর্ণলতাকে কী বলেছিস? আবারও দরজা আটকে দিয়েছে। ”
” কোন দরজা? ঐ রুমের তালা খুলল কীভাবে? ”
” রুমের না, গোসলখানার। ”
” তাই বলো! তুমি তো আমাকে ভ য় পায়িয়ে দিয়েছিলে। দাদজান, তুমি কিন্তু আজকাল ছোট ছোট বিষয়েও খুব ভ য় পাচ্ছ। এরকম চললে, নিশ্চিত হার্ট ফেইল করবে। ”
” ভ য় পাওয়ার ঘটনা ঘটলে, ভ য় পাব না? তুই এত হালকাভাবে নিচ্ছিস কেন? ও কিন্তু এখনও বের হয়নি। ”
” হবে। তুমি গিয়ে বলো, আমি আসছি। ”
খাইরুন নিসা গোসলখানার দিকে এগুতে এগুতে বললেন,
” তুই আসলেই কী? ও তোকে আগের মতো ভ য় পায় না। ”
” পাবে। বলেই দেখ। ”
তিনি দরজায় কড়া নাড়ার পূর্বে ফিসফিসে সুধালেন,
” সত্যি আসছিস? ”
” আহা, এত প্রশ্ন কেন? যা বলছি, তাই করো। ”
খাইরুন নিসা ত্বরিত দরজায় আঘাত করলেন। বাক্যটা উচ্চারণ করতেই স্বর্ণলতা দরজা খুলে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” সত্যি আইতাছে? ”
তিনি আশ্চর্য হলেন। মুখে কোনে শব্দ এলো না। মাথা নেড়ে বুঝালেন, সত্যি আসছে।
________
সেই রাতে স্বর্ণলতার একটুও পড়ায় মন বসল না। বই-খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকল শিয়রের কাছে। খাবারটাও পেট পুরে খেতে পারল না। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর ঘড়ি দেখল। জানালা দিয়ে চেয়ে থাকল, অদূরে গেইট পানে। কোনো ছায়া দেখলে, ঝটিতে বসে। কোথাও সামান্য শব্দ হলেও ঝটিতে উঠে বসে। তারপরে অনেক্ষণ চেয়ে থাকে জনমানবহীন, নিস্তব্ধ খোলা উঠোনটায়। প্রত্যাশিত মানুষটা আসে না। অপেক্ষাও ফুরায় না। খাইরুন নিসা অবাক হয়ে নাতবউয়ের এই অস্থিরতা, অবুঝপনা দেখেন। হঠাৎ করে মেয়েটা মুনছুর সাখাওয়াতের জন্য পাগল হলো কীভাবে তাই ভাবেন। একসময় ঘুমিয়েও পড়েন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন, স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা জানালার ধারে ঠেকে আছে। শাড়ি ঠিক নেই, চুল অবিন্যস্ত। তিনি মৃদু সুরে ডাকলেন,
” স্বর্ণলতা? ওঠো, নামাজ পড়বে। ”
সে নড়ল। অস্পষ্টভাবে কী যেন বললও। তিনি বুঝতে পারলেন না। আবারও ডাকলেন, এবার সাড়াশব্দ এলো না। একভাবে হেলে পড়ে আছে জানালার কাছে। গভীর ঘুমে অচেতন। গাঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ছে। খাইরুন নিসার মনে হলো, মেয়েটা সারারাত জেগেছে। এখন জোর করে জাগালে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তিনি কাঁধটা চেপে ধরে মৃদু গলায় বললেন,
” স্বর্ণলতা ঠিক করে ঘুমাও। এভাবে ঘুমালে, শরীর ব্যথা করবে। পড়েও যেতে পার। নাতবউ? ”
সে হালকা নড়ল। ঢুলুঢুলু চোখে তাকালে তিনি আশ্বাস দিলেন,
” আমি সাহায্য করছি। বালিশে মাথা রাখো। ”
তাকে কিছুই করতে হলো না। সে নিজেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। বালিশটা মাথার নিচে না দিয়ে কোল বালিশের মতো চেপে ধরল।
_________
মুনছুর সাখাওয়াত বাসায় ফিরল, বেশ বেলা করে। খাইরুন নিসা তখন নাস্তা সারছেন। সে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বলল,
” তুমি একা নাস্তা করছ! স্বর্ণলতা কোথায়? ”
তিনি এক ঝলক তাকালেন। এতেই পুরো শরীরটা পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। পরনের পাঞ্জাবিটা নতুন, স্ত্রী করা। মাথার চুল পরিপাটি। আতরের সুবাস পাচ্ছেন দূর থেকেই। তিনি গোপনে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
” ঘরে। ”
” খেয়েছে? ”
” না। ঘুমাচ্ছে। ”
” এখনও? শরীর খারাপ নাকি? ”
” না। সুস্থই আছে। ”
” তাহলে খেতে ডাকোনি কেন? একা একাই খাচ্ছ! লজ্জা করছে না? ”
খাইরুন নিসা উঠে দাঁড়ালেন। খাবার রেখে চলে যাবেন এরকম একটা ভাব ফুটে উঠেও, হারিয়ে গেল। পুনরায় বসে পড়লেন। ধৈর্য ধরে শান্ত গলায় বললেন,
” তোর অপেক্ষায় সারারাত জেগে ভোরবেলায় ঘুমিয়েছে। ঘুমটা কাঁচা। এখন ডাকলে, শরীর খারাপ হতে পারে তাই ডাকিনি। ”
” তাহলে অপেক্ষা করতে। ”
দাদিজানের উত্তরটা নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। সোজা হাঁটা ধরল তার রুমের দিকে। খাইরুন নিসা খাবার টেবিলে বসে থেকে সাবধান করলেন,
” এখন উঠাস না, মুনছুর। মেয়েটা সত্যি ভোরবেলা ঘুমিয়েছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত থামল না। দাদিজানের রুমের ভেতর ঢুকল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ফিরতেই ঘুমন্ত স্বর্ণলতাকে দেখতে পেল। ভারি নিশ্চিন্তে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে! সে বিছানার দিকে এগুনোর সময় সাবধান হলো। এত আস্তে আস্তে পা ফেলল যে, স্বর্ণলতা তো দূর মাটিও বোধহয় টের পেল না!
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৪)
স্বর্ণলতা ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে আছ। বুকের মাঝে বালিশ, হাত-পা গুটানো। মাথায় টেনে দেওয়া আঁচলের অংশটুকু বাতাসে উড়ে এসে পড়েছে মুখটায়। গলা ও বুকের আংশিকও ঢেকে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত ধীরে, অতি সাবধানে আঁচলটা সরিয়ে দিল। নিদ্রালু, নিষ্পাপ মুখটা অনাবৃত হতে তার হৃদয় সিক্ত হলো। শান্তি পেল তৃষ্ণাপীড়িত নেত্রজোড়া। বুকের খাঁখাঁ জমিটুকুতে অঝোরে বৃষ্টি নামল বুঝি! সে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইল। আপনমনে ফিসফিস করল, ‘ আমার আদুরী ফিরে এসেছে! ‘
মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিশোরী বউটিকে। সহসা সে নড়ে ওঠল! বালিশটা সরিয়ে দিল বুকের মাঝ থেকে। গুটিয়ে রাখা পা’দুটি লম্বা করল। অপরপাশে ফিরতে দেখা গেল, শাড়িটা সামনে ঠিক থাকলেও পেছনে পুরোই অগোছাল। পিঠের মাঝের সম্পূর্ণ অংশ আলগা হয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত ঢেকে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হলো। হাতে একটি বই ধরা ছিল। সেটি রাখল, স্বর্ণলতার শিয়রের কাছে। অতঃপর শাড়ি আলগোছে টেনে এনে রাখল, খোলা পিঠে। ঠিক এই সময়ে স্মরণে এলো, স্বর্ণলতার জন্য অনেকগুলো থ্রি-পিস পাঠিয়েছিল। মেয়েটা সেখান থেকে একটা পরতে পারত, তা না করে শাড়ি পরে শুয়ে আছে কেন? তার একবারের জন্যও মনে হয়নি, স্বর্ণলতা ইচ্ছে করে পরেনি। সে নিজ মুখে বলেছিল, শাড়ি পরে শান্তি পায় না। শান্তির বস্তু পাওয়ার পরও না পরার কারণ কী হতে পারে? মুনছুর সাখাওয়াতের মস্তিষ্কে দাদিজানের মুখটা উজ্জীবিত হলো। সাথে সাথে রা গ উঠে গেল মাথার তালুতে। ক্রো ধেপূর্ণ বদনখানা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসবে তখনই চোখ পড়ল, স্বর্ণলতার পায়ের কাছে। শাড়ির পাড় উঠে আছে হাঁটুর কাছে। কোমল ও কমনীয় পা’জোড়া থেকে স্বর্গীয় আভা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন! সে মোহঘোরে পড়ে গেল। স্পর্শের লিপ্সায় ডুবে গেল। কিছুতেই দমন করতে পারছে না পৌরুষের উত্তেজনাকে। মনের অজান্তে পা’দুটি ছুটে এসে থামল স্বর্ণলতার পায়ের কাছে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করবে সেই মুহূর্তে দাদিজান ডেকে ওঠলেন,
” মুনছুর! ”
সে ত্বরিত হাত সরিয়ে নিল। চকিতে তাকাল দরজার দিকে। দাদিজান অপ্রস্তুত হলেন। লজ্জায় আড়ষ্ট হলেন। নাতির দিকে চেয়ে থাকতে পারছেন না। মুখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। দ্বিতীয় কোনো শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না। মুনছুর সাখাওয়াত চটপটে এগিয়ে এলো। খ্যা পা কণ্ঠে শা সাল,
” কোনো শব্দ করবে না। যাও, এখান থেকে। ”
তার দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষাও করল না। মুখের উপর দরজা আটকে দিল। সিটকানি তুলে হেঁটে এলো স্ত্রীর কাছে। সে তখনও গভীর ঘুমের নিঃশ্বাস ফেলছে। মুনছুর সাখাওয়াত আগের স্থানে দাঁড়ালেও হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল না। পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকাল। এখানে একজোড়া সোনার নুপুর আছে। সপ্তাহখানেক হলো সোনার কারিগর দিয়ে গড়িয়েছে। স্বর্ণলতাকে দেওয়া হয়নি, ইচ্ছে করে দিচ্ছিল না। মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করছিল। নুপুর জোড়া পকেটে রাখার পর অদ্ভূত উপলব্ধি হয়েছে। যতবার নুপুরগুলো হাতে নিয়েছে ততবারই মনে হয়েছে, স্বর্ণলতা তার আশপাশে আছে। শুধু দেখা দিচ্ছে না, লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছে। অথচ এই নুপুর জোড়ার কথা সে ঘুণাক্ষরে জানে না, ভুল করে দেখেনি পর্যন্ত! মুনছুর সাখাওয়াত স্পর্শ বাঁচিয়ে আলগোছে নুপুর দুটি স্ত্রীর সুন্দর পা জোড়ায় পরিয়ে দিল।
_______
দাদিজান বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। ভীষণ অস্থির ও উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আল্লাহ ভীরু মানুষ। ধর্মীয় সকল নিয়ম-নীতি সর্বদা মেনে চলার চেষ্টা করেন। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে, স্বর্ণলতার বয়স কম হলেও মুনছুর সাখাওয়াতের স্ত্রী। তাকে কাছে পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তাই মন সায় না দিলেও সরে আসতে হয়েছে। তাছাড়া প্রতিবাদ করেও জিততে পারতেন না। নাতির পায়ের গতি এত ক্ষিপ্ত ছিল! কণ্ঠটাও কেমন পাগলাটে লেগেছিল! একবারের জন্য মনে হয়েছিল, দরজায় হাত রাখলেই খু ন হবে। সম্পর্কে কী হয় ভাববে না।
খাইরুন নিসা বসার রুমে পায়চারি করছিলেন। সহসা মাটি কাঁপানো পদধ্বনি টের পেলেন। রুমের দিকে উঁকি দিতে দেখলেন, মুনছুর সাখাওয়াত এদিকে আসছে। চোখাচোখি হতে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। তাকে পাশ কাটিয়ে নীঃশব্দে ঢুকল তার রুমে। তিনি হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকলেন নাতির চলে যাওয়ার পানে।
” আম্মাজান, ছার তো খাইতে বইল না। খাবারগুলা কী করমু? ”
কলির কণ্ঠে চেতন ফিরল। বললেন,
” তুমি খেয়ে নেও। ”
” আমার তো খাওয়া শ্যাষ! ”
” তাহলে যা খুশি করো। বিরক্ত করো না। ”
খাইরুন নিসা নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। দু’কদমও আগাতে পারলেন না। পেছন থেকে বজ্রকণ্ঠটা বাজল,
” দাদিজান, ঐ রুমে যেও না। তোমার নাতবউ এখনও ঘুমাচ্ছে। ”
তিনি ঝটিতে পেছন ফিরলেন। মুনছুর সাখাওয়াত নিজের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পোশাক বদলেছে। বন্ধ দরজার ভেতরে কী হয়েছে, কতটুকু হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছেন ন। কেমন যেন ধোঁয়াশা ঠেকছে সবকিছু। তিনি বিরক্ত মুখে প্রশ্ন করলেন,
” তাহলে কী করব? নিজের রুম থাকতেও বাইরে বাইরে ঘুরব? ”
” আমার রুমে এসো। ”
কথাটা এমনভাবে বলল যে, খাইরুন নিসার মনে হলো এটা কোনো সমাধান নয়, আদেশ। ঐ রুমে ডেকে নেওয়ার পেছনে কোনো কারণ আছে। হয়তো কিছু বলতে চায়! তিনি বিনা বাক্যে সেই আদেশ মানতে বাধ্য হলেন। মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বে রুমে ফিরে গিয়েছিল। দাদিজান ঢুকলেন সংশয় চিত্তে।
” দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো। এটা নতুন চাদর। মাত্রই বিছালাম। ”
খাইরুন নিসা যারপরনাই বিস্মিত হলেন। এত অল্প সময়ে, নিজের কাপড় ও বিছানার চাদর বদলে ফেলেছে! মিথ্যাও মনে হচ্ছে না। মুনছুর সাখাওয়াত একটা চেয়ার টেনে এনে বলল,
” বিশ্বাস না হলে এই চেয়ারটায় বসো। ”
তিনি বিছানায় বসলেন। নাতির দিকে চেয়ে বললেন,
” কিছু বলবি? ”
” হ্যাঁ, তোমাদের ধর্মে মেয়েরা কি শুধু পরপুরুষের সামনেই পর্দা করে? নিজের পুরুষের সামনে করে না? ”
” নিজের পুরুষ কী? ”
” স্বামী। স্ত্রীরা কি স্বামীর সামনে পর্দা করে না? ”
” স্বামীর সামনে আবার পর্দা কিসের? স্ত্রীলোকের সকল সৌন্দর্য দেখার একমাত্র অধিকার স্বামীর। সেই অধিকার রক্ষা করতেই স্ত্রীরা পর্দা করে। ”
” স্বামী যদি দেখতে না চায়? ”
” দেখতে চায়বে না কেন? এটা কি উপেক্ষা করার মতো কিছু? ”
” ধরো, উপেক্ষা করল। সে জানিয়ে দিল, আজ থেকে তার স্ত্রীর কোনো সৌন্দর্য দেখতে চায় না। তাহলে কি স্ত্রীটি পর্দা করতে পারবে? ”
খাইরুন নিসা মহা মসিবতে পড়লেন! এরকম কোনো ঘটনায় সাক্ষী হন নি, শুনেননি, পড়েননিও। এই ক্ষেত্রে কোন হাদিসটির প্রয়োগ হবে? তিনি গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিলেন সহসা টনক নড়ল। সন্দেহি সুরে সুধালেন,
” ঐ স্বামীটি কি তুই? ”
” হ্যাঁ, স্ত্রীটি তোমার নাতবউ। ”
” তুই চাস, স্বর্ণলতা তোর সামনে পর্দা করুক? ”
” শুধু পর্দা না, খাস পর্দা করবে। হাত-পায়ের নখও ঢাকা থাকবে। ”
” তাহলে গলা টি পে মে রে ফেল। তারপরে কাফনের কাপড় পরিয়ে দিবি। হাত-পায়ের নখ তো দূর চোখদুটিও দেখা যাবে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখ শক্ত হয়ে ওঠল। চোয়ালদ্বয় কঠোর করে বলল,
” আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও। ”
তিনি এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। সঙ্গে সঙ্গে গটগটিয়ে বেরিয়ে এলেন।
_______
স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙল, গনগনে দুপুরে। আড়মোড়া ভাঙার সময় সুন্দর ঝংকার শুনতে পেল। সে আশ্চর্য হলো। ঝংকারের উৎস খুঁজতে গিয়ে দৃষ্টি আটকাল শিয়রের কাছে, বইটির ওপর। বইয়ের উপরে একটি সুশীলা নারীর ছবি। তার উপরে বড় করে লেখা, স্বামী। নিচে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সে বিস্ময়ে অভিভূত! এরকম ছবি লাগানো বই এর আগে দেখেনি। স্বর্ণলতা কৌতূহলী হলো। প্রবল আগ্রহে বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ভেতরের পড়াগুলো পড়তে শুরু করা মাত্র যোহরের আযান পড়ল। সে ছিটকে ওঠল। ঝটিতে তাকাল দেয়ালঘড়িটার দিকে। সময়ের ধারণা হতে বুকের ভেতর কেঁপে ওঠল। বই ফেলে পুরো রুমে চোখ বুলাল। দাদিজান কোথাও নেই। গোসলখানার দরজাটাও মেলা। স্বর্ণলতা পালংক থেকে নামল লাফ দিয়ে। তখনই সেই শ্রুতিমধুর ঝংকারটা পুনরায় শুনল। এবার অন্যদিকে নয়, সরাসরি তাকাল নিজের পায়ের দিকে। প্রথমে চমকে ওঠল। পরক্ষণে সন্দেহে পতিত হলো। ক্রমান্বয়ে তাকাল বই ও নুপুরের দিকে। এতেই সন্দেহটা গাঢ় হলো। হৃদয়ের মাঝে আনন্দের ধারা বয়তে শুরু করল। প্রফুল্লচিত্তে ছুটে গেল দরজার দিকে। বাইরে পা রাখতে দাদিজানকে অদূরে দেখতে পেল। চেঁচিয়ে ডাকল,
” দাদিজান, উনি কি আইছে? ”
খাইরুন নিসা মাথা নাড়ল। সে দৌড়ে পৌঁছাল তার কাছে। পরবর্তী কথাটা বলতে পারল না। দেখল, তার কাছের সোফাটাতে মুনছুর সাখাওয়াত বসে আছে, পরের সোফায় তার বান্ধুবী বেহালা। বেহালার পাশে আড়ষ্ট ও ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে সুবর্ণ।
প্রথমে মুনছুর সাখাওয়াত ও পরে বেহালাও দাঁড়িয়ে পড়ল। স্বর্ণলতার আনন্দ ও উল্লাস দ্বিগুণে পৌঁছাল। সকলকে ডিঙিয়ে জড়িয়ে ধরল বেহালাকে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সুধাল,
” কখন আইছ? কতদিন পর দেখা হইল। ভালা আছ? ”
বেহালা হেসে ফেলল। স্বর্ণলতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” ভালো আছি। তুই ভালো আছিস তো, স্বর্ণা? ”
সে বান্ধুবীকে ছাড়ল। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকল বেহালার মুখপানে। বিশ্বাসই হচ্ছে না, তার এই ভীষণ প্রিয় বান্ধুবীটি এখানে এসেছে। অতি আনন্দ ও উত্তেজনায় আরও একবার জড়িয়ে ধরে বলল,
” আসো, আমার রুমে আসো। ”
স্বর্ণলতা নিজেই টেনে নিয়ে গেল বান্ধুবীকে। সুবর্ণ মাথা নুয়ে অনুসরণ করছে। বেহালাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। কাছে টেনে এনে বলল,
” কেমন আছস, ভাই? ”
প্রশ্নটা করে কপালে চুমু খেল। সুবর্ণ এত লজ্জা পেল! আপুর কাছ থেকে সরে গিয়ে বলল,
” ভালা, তুমি? ”
সে জোরের সাথে বলল,
” খুব ভালা। ”
এই সময় মাথায় হালকা চ ড় খেল। সে চকিতে ফিরতে বেহালা বলল,
” আবার শুরু হয়ে গেছে? তোকে না বলেছি, পড়ার সাথে সাথে ভাষা ব্যবহারটাও উন্নতি করতে? ঢাকায় পড়তে হলে, শুদ্ধ ভাষাটাও জানতে হবে। নাহলে দাম পাবি না। ”
স্বর্ণলতা হাসল। এই মেয়েটির সাথে প্রথম আলাপ স্কুলে। দশম শ্রেণির ক্লাসে। এক সপ্তাহের মধ্যে সহপাঠী থেকে বান্ধুবী হয়ে গেছিল। তারপরে যত গল্প, আড্ডা, ঘুরাঘুরি সব এই বেহালার সাথে। স্বর্ণলতার সম্পর্কে সবকিছু জানে। স্বপ্নের ব্যাপারেও।
” তুমি ছাড়া আর তো কেউ শেখায় না। তাই ভুলে যাই। ”
” এই তো আছি। ”
স্বর্ণলতা আবারও হাসল। ভাইয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আম্মা, আব্বা, বড় আফা ওরা সবাই ভালো? ”
” হ। ”
সে ভাইকে আবারও কাছে টেনে নিল। হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আব্বার লগে কই গেছিলি? আমি গিয়া পাইলাম না ক্যা? আম্মাও তো ঠিক কইরা…”
সে বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। পূর্বে বেহালা মাথার চুল টেনে ধরল। স্বর্ণলতা যে আবারও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে, মনে করিয়ে দিতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত ঝড়ের মতো উড়ে এলো। বেহালার গালে ঠাস করে চ ড় মেরে বসল। সে আচমকা চ ড় সামলে উঠতে পারল না। পড়ে গেল। স্বর্ণলতা আঁতকে ওঠল। বিস্ফারিত নেত্রে বলল,
” কী করলেন এটা! ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে ফিরতে দুই হাতে বুক বরাবর ধা ক্কা মা রল। বিশাল দেহটা সামান্য টলল। স্বর্ণলতা এতে ক্ষান্ত হলো না। একের পর এক ধা ক্কা দিতে দিতে বলল,
” আযরাইল একটা! বাইর হোন এই ঘর থেইকা। আপনে রে দেখলেই আমার গা জ্বলতাছে। আমার চোখে সামনে আইবেন না কোনোদিন। বাইর হোন। ”
একাধিক ধা ক্কাতেও যে দেহটা চুল পরিমাণ নড়ছিল না। সেই দেহটায় আচমকা নড়ে ওঠল। বিনাবাক্যে, বিনা প্রতিবাদে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
স্বর্ণলতা তার দিকে ফিরেও তাকাল না। ছুটে এলো বান্ধুবীর কাছে। তাকে টেনে তুলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” মেলা বেদনা হইতাছে? ইশ, গালডা তো লাল হইয়া গেছে! ”
বেহালা চোখে অন্ধকার দেখছে। মাথাটা কেমন ঝিম মেরে আছে! বিশ্বাসই করতে পারছে না সে বাস্তবে আছে। কেউ তাকে মে রেছে! স্বর্ণলতা ব্যস্ত হয়ে ওঠল। পানি দিয়ে আঁচল ভেজাল। বেহালার গালে চেপে ধরে সুধাল,
” বেদনা কি কমছে? ”
সে জবাব দিল না। দুই চোখ মেলে পুরো রুমটা দেখছে। চেতনা ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। স্বর্ণলতা পুনরায় বলল,
” তুমি এখানে আইতে গেলা ক্যা? ”
” তোর খোঁজ নিতে। কাল থেকে তো পরীক্ষা! আমি রুটিন নিয়ে আসছি। ”
এটুকু বলে সুবর্ণের দিকে তাকাল। সে খাটের এককোণে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটি ছলছল করছে। বেহালা বলল,
” রুটিনটা দাও। ”
সে রুটিন দিল। স্বর্ণলতা বিছানায় ফেলে দিয়ে বলল,
” পরে দেখমু নে। আগে কও, ব্যথা কমছে নাকি। ”
” কমেছে। কিন্তু উনি আমাকে মা রলেন কেন, এটাই বুঝতে পারছি না। ”
” উনার মা রতে কোনো কারণ লাগে না। মন চাইলে মাইর শুরু কইরা দেয়। ”
” তোকেও মা রে? ”
” না। আমারে এখনও মা রে নাই। কিন্তু এবার মনে হয়, মা রবো। ”
” কেন? ”
” তোমারে মা রছে দেইখা তো রাইগা গেছিলাম। কী সব কইছিও। এরপরও কি চুপ থাকবো? ”
বেহালাকে আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। তাহলে কি ভাইয়া এই লোকের সম্পর্কে যা যা বলেছে, সব সত্যি? স্বর্ণলতার বাবাকে মা রার পেছনে তার গোপন স্বার্থ আছে? সে শঙ্কিত গলায় বলল,
” এরকম ছেলেরা বউদের পড়াশুনা করায় না। তোকে করাবে? ”
” জানি না। এই ব্যাপারে কথা বলার জন্যই উনারে ডাইকা আনছিলাম। ”
” হায় আল্লাহ! তার আগে এসব ঘটে গেছে? এখন তো রাজি করানো অসম্ভব প্রায়। ”
স্বর্ণলতা কিছু বলল না। কী থেকে কী হয়ে গেল! বেহালা জিজ্ঞেস করল,
” আমি কথা বলব? ”
” একদম না। আবার মা রবো। তুমি বুঝতে পারতাছ না, উনি কতটা ভয়ঙ্কর। যা কওয়ার আমি কমু। ”
” তাহলে এখনই বল। সময় নেই। কাল থেকেই পরীক্ষা। আমরা যাই, আরেকদিন আসব। ”
বেহালা বিছানা থেকে নামল। সুবর্ণ নীরবে তার পিছ ধরল। স্বর্ণলতাও বাঁধা দিল না। সে চায় না বিপদ আরও বাড়ুক! বান্ধবী ও ভাইকে বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। দুজনে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল সহসা সুবর্ণ থামল। দৌড়ে এলো আপুর কাছে। ইতস্তত করে বলল,
” একটা কথা জিগামু, আফা? ”
” কী? ”
” তোমার বান্ধুবী রে দেখলে আমার পদ্মফুলের কথা মনে পড়ে ক্যা? আবার পদ্মফুল দেখলেও তোমার বান্ধুবীর কথা মনে পড়ে। ”
স্বর্ণলতা ঈষৎ হেসে বলল,
” কারণ, আমার বান্ধুবীর চোখ দুইটা পদ্মফুলের মতো সুন্দর। ”
_______
স্বর্ণলতা দাদিজানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
” উনি কই? কোনোহানে তো দেখি না। ”
” চলে গেছে। ”
” চইলা গেছে! কই গেছে? ”
” জানি না। আমাকে বলে যায়নি। ”
” আমারেও তো কইল না, দাদিজান। ”
খাইরুন নিসা কপট রা গ নিয়ে বললেন,
” তুমি তো বের করে দিলে! ”
” আমি শুধু এই ঘর থেইকা বাইর হইতে কইছিলাম। ”
” মুনছুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ”
স্বর্ণলতা কান্নায় ভেঙে পড়ল। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল বই-খাতার দিকে। খাইরুন নিসা পুনরায় বললেন,
” তোমার সাহস দেখে, আমি তাজ্জব বনে গেছি। বাড়ির কর্তাকে অপমান করে বের করে দাও! কলি, ময়না সবাই দেখছে। মুনছুরের সম্মান মাটিতে মিশে গেছে। এরপরও যে, তোমাকে কিছু বলেনি! শুকরিয়া আদায় করো। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করো। ”
দাদিজানের বালিশের নিচে মোবাইলটা। স্বর্ণলতা দৌড়ে এসে মোবাইল বের করল। কল দিল মুনছুর সাখাওয়াতের নাম্বারে। বন্ধ দেখাচ্ছে! আরও একবার কল দিল। এবারও বন্ধ পেয়ে সে মাটিতে বসে পড়ল। খাইরুন নিসা ধ মকালেন,
” আরে, ওখানে বসলে কেন? উপরে ওঠো। উঠো বলছি। ”
সে ওঠল না। হাঁটুতে মুখ গুঁজে অবিরত কেঁদে চলল।
_________
মুনছুর সাখাওয়াত বাসায় ফিরল এক সপ্তাহ পর। রাতের বেলা। দাদিজান ও স্বর্ণলতা একসাথে খাবার খাচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়ে উভয়ে উঠে দাঁড়ালেও সে ফিরল না। এক ঝলক চেয়েও দেখল না কারও পানে। সোজা চলে গেল নিজের রুমে। দরজা আটকে দিতে দাদিজান বললেন,
” কর্তা ফিরছে। যাও, রা গ ভাঙাও। ”
স্বর্ণলতা বিনা বাক্যে চলে গেল স্বামীর দোরগোড়ায়। মৃদু আঘাত করল বন্ধ দরজায়। ভেতর থেকে প্রশ্ন এলো,
” কে? ”
অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” আমি। ”
” পরে এসো। আমি গোসল করব। ”
স্বর্ণলতা কিছু বলল না। জায়গা থেকেও নড়ল না। জমিনের দিকে চেয়ে ঢিলেভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এক মিনিটও পেরুল না। দরজা খুলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় ফিরে গিয়ে বসল। গম্ভীর স্বরে বলল,
” কী চাও? ”
সে ভেতরে ঢোকার জন্য উদ্যত হতে, মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদি বলল,
” ওখান থেকে বলো। ভেতরে আসার প্রয়োজন নেই। ”
” এখান থেইকা পা ধরমু ক্যামনে? ”
” কার পা ধরবে? ”
” আপনের। দাদিজান কইছে, পা ধরলে মাফ কইরা দিবেন। ”
” এই কথা দাদিজানকে কে বলেছে? ”
” জানি না। ”
” না জেনে পা ধরতে এসেছ? ”
স্বর্ণলতা নিরুত্তর। মাথাটা ঝুঁকে আছে বুকের দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করল, সে থ্রি-পিস পরেছে। বয়সটা কি এজন্যই আরও কমে গেল? এই কমে যাওয়া বয়সের সাথে অবোধ আচরণটাও মানানসই লাগছে। সে উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি সত্যি মাফ চাও নাকি দাদিজান বলেছে তাই চাচ্ছ। ”
” উনি কইছে, আমিও চাই। আপনে আমার থেইকা অনেক বড়। বড় মানুষের গায়ে হাত তোলা পাপ। মুখেও অনেক কিছু কইছি! ”
মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” মাফ করব। কিন্তু আমি যেভাবে বলব, সেভাবে চাইতে হবে। ”
” আচ্ছা। ”
” ভেতরে এসো। ”
স্বর্ণলতা গুটি গুটি পায়ে ভেতরে এলো। তার থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়ালে বলল,
” আরও সামনে এসো। ”
স্বর্ণলতা এই কথাটাও মানল। মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” আমাকে জড়িয়ে ধরো। ”
আদেশ পাওয়া মাত্র সে জড়িয়ে ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত কপাল কুঁচকে ফেলল। তার ধারণা ছিল, স্বর্ণলতা এই কথাটা মানবে না। প্রতিবাদ করবে। সন্দেহের জল পড়ল মন ও মস্তিষ্কে। পুনরায় বলল,
” এবার মাফ চাও। ”
” আমারে মাফ কইরা দেন। এরকম ভুল আর কখনও হবে না। যদি…”
” চুপ। ”
সে থেমে গেল। মুনছুর সাখাওয়াতের সন্দেহ বাড়ল। আবারও বলল,
” এখন থেকে আমি যতবার বাইরে থেকে আসব তুমি ততবারই আমাকে জড়িয়ে ধরবে। ”
” আচ্ছা। ”
” স্বর্ণলতা ছাড়ো। ”
সে সাথে সাথে ছেড়ে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত মুখটায় চেয়ে আছে। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। মুখটা একবারের জন্যও উঁচুতে ওঠছে না। সমানে পা দিয়ে মেঝেতে খুঁটছে। মাটি হলে এতক্ষণে ছোটখাটো গর্ত হয়ে যেত। সে অধোবদনে চেয়ে বলল,
” আমার সাথে এসো। ”
স্বর্ণলতা পেছন পেছন খাবার টেবিলের সামনে গেল। মুনছুর সাখাওয়াতের ইশারাতে পাশে বসল। দাদিজানও খাবার নিয়ে বসে ছিলেন। নাতিকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোদের ভাব হলো? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তাকাল কিন্তু জবাব দিল না। দাদিজানের দিকে চেয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, প্লেটে ভাত নাও। ”
সে ভাত নিতে নিতে আদেশ পেল,
” বোলের সবগুলো ভাত নেও। ”
স্বর্ণলতা তাই করল। প্লেটে জায়গা হলো না। অধিকাংশ ভাতই পড়ে গেল চারপাশে। মুনছুর সাখাওয়াত তখনও দাদিজানের দিকে চেয়ে আছে। সেভাবে বলল,
” তরকারিও পুরোটা নাও। ”
সে তরকারি ঢেলে নিল। দাদিজান ভ য় পেয়ে গেলেন। বিপদ আঁচ করে স্বর্ণলতাকে কি যেন বলতে চাইলেন, পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত চোখের ইশারায় থামিয়ে দিল। অতঃপর স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
” এবার খাও। ”
সে খাওয়ার জন্য মুখে ভাত নিবে, তখনই মুনছুর সাখাওয়াত আটকে ফেলল। একহাতে তার হাত ধরে রেখে অন্য হাতে ভাত-তরকারিসুদ্ধ প্লেটটা ঢিল মেরে ফেলে দিল। তারপরে দাদিজানের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ওর কী হয়েছে? ”
দাদিজান কাঁপা কাঁকা কণ্ঠে বললেন,
” কিছু হয়নি তো! ”
সে পানির জগটা ঢিল মা রল। আগের চেয়েও উঁচু স্বরে বলল,
” সত্যি করে বলো, স্বর্ণলতার কী হয়েছে। ”
তিনি জবাব দেওয়ার পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত টেবিলের সবকিছু ফেলে দিল। বসার চেয়ারটা লা থি মারতে স্বর্ণলতা দাদিজানকে জড়িয়ে ধরল। খাইরুন নিসাও তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
” ওর অভিমান হয়েছে। বউয়ের অভিমান ভাঙতে হয় আদর করে, ভাঙচুর করে নয়। গাধা একটা! ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৫)
মাঝরাত। ঘরের আলো নিভানো। শোঁ শোঁ শব্দে বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। খাইরুন নিসা ও স্বর্ণলতা উভয়েই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সহসা দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। স্বর্ণলতা সামান্য নড়ল কিন্তু ওঠল না। ঘুমিয়ে পড়লে মেয়েটা হালকা শব্দে কিংবা একডাকে ওঠতে পারে না! আরও একবার কড়া নাড়ার শব্দ হতে দাদিজানের ঘুম ছুটে গেল। অন্ধকারে বিছানা হাতড়ালেন। স্বর্ণলতার শরীরের স্পর্শ পেয়ে নিশ্চিত হলেন, সে ঘরে আছে। দরজায় শব্দটা করছে অন্যকেউ। বাহির থেকে। তিনি ধীরেসুস্থে উঠে বসলেন। এই সময় দরজায় ঘনঘন হাতের আ ঘাত পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন,
” কে? ”
” দাদিজান, আমি। ”
” এতরাতে কী চাস? শান্তিতে ঘুমাতেও দিবি না? ”
” দরজা খোলো। কথা আছে৷ ”
খাইরুন নিসা প্রত্যুত্তর করতে চেয়েও থেমে গেলেন। স্বর্ণলতা নড়ছে। উঠে না পড়লে হয়! মেয়েটার মধ্যে পূর্বের ভ য়টা ফিরে আসছে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শরীরটা ক্রমাগত কেঁপেছে। মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোয়নি। কতবার খাওয়ার জন্য সাধলেন! কিছুই খেল না। হাত-পা এখনও বেজায় ঠাণ্ডা! জ্বর না আসলে হয়। অজ্ঞান হওয়ার গুণটাও তো আছে। নীরবতা ভাঙল মুনছুর সাখাওয়াতের গলায়,
” কী হলো? দরজাটা খোলো। ”
অন্যরকম কণ্ঠস্বর। রা গ ও বিরাগের মাঝামাঝি। উগ্রত্ব নয় আবার ধৈর্য্যশীলও নেই। খাইরুন নিসা পালংক থেকে নেমে এলেন। দরজার কাছে পৌঁছে নিচু স্বরে বললেন,
” সকালে আয়। এখন তোর বউ ঘুমাচ্ছে। বিরক্ত হবে। ”
” তাহলে আমার রুমে এসো। ”
” কাল বললে হয় না? তোর সাথে কথা বলা মানেই অশান্তি, ভাঙচুর। এই মাঝরাতে হা ঙ্গামা নিতে পারব না। ”
” কোনো হা ঙ্গামা হবে না। শান্তভাবে কথা বলব। কথা দিচ্ছি তো! দাদিজান, দরজাটা খোলো আগে। ”
খাইরুন নিসা দরজা খুলে দিলেন। এই ছেলেকে বুঝিয়ে লাভ নেই। উল্টো ঝামেলা বাড়বে। এরচেয়ে ভালো হবে, দ্রুত কথা শেষ করে ফেলা। তিনি দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন,
” বল। ”
” এখানে না, আমার রুমে এসো। ”
” পারব না। আমি দরজা চাপিয়ে দিচ্ছি, আস্তে বলবি। ভেতরে আওয়াজ যাবে না। ”
” তোমাকে আমার রুমেই যেতে হবে। এখন ঠিক করো, হেঁটে যাবে নাকি আমার কাঁধে চড়ে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের ভাব বদলে গিয়েছে। কণ্ঠটাও ভীষণ কঠোর শুনাল। দাদিজান হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। নাতিকে তিনি আজও চিনতে পারেননি। ভবিষ্যতেও চিনতে পারবেন না এই ব্যাপারে সুনিশ্চিত হলেন। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়টাও পার হবে ফাঁদে পড়ে ও ধোঁকা খেয়ে।
খাইরুন নিসা নাতির রুমে প্রবেশ করলেন। আলো জ্বালানো ছিল। সে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে বলল,
” বসো। ”
তিনি অধৈর্য গলায় বললেন,
” কী বলতে চাস, বল না! স্বর্ণলতাকে একা রেখে এসেছি। ঘুম ভেঙে গেলে ভ য় পাবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। উত্তাপ দৃষ্টি ছুঁড়ল শুধু। তাতেই কাজ হলো। দাদিজান বিনা প্রতিবাদে বিছানার কিনার ঘেষে বসলেন। নাতির দিকে তাকাতে শুনল,
” এবার বলো। ”
” কী বলব? তোর বলার কথা না? ”
” স্বর্ণলতার সমস্যার কথা বলো। হঠাৎ করে অভিমান এলো কীভাবে? আমি ওর বান্ধুবীকে আ ঘাত করেছি। ও রে গে গিয়ে আমাকে আ ঘাত করেছে। কাটাকাটি হলো না? এখন এই অভিমান কেন? ”
” এই প্রশ্নের জবাব স্বর্ণলতার কাছে থাকার কথা, আমার কাছে না। অভিমান ও করেছে। ”
” তুমিও জানো। দাদিজান, প্যাঁচিও না। তাহলে রাত ফুরাবে ঠিকই কিন্তু তুমি রুমে যেতে পারবে না। ”
” শা সাচ্ছিস? ”
” যা খুশি ভাবতে পার। কিন্তু আমার কথার নড়চড় হবে না। এই মুনছুর যতটা বলে, তার চেয়েও বেশি করে দেখায়। ”
খাইরুন নিসা তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। আদলটা মায়ের মতো হওয়া সত্ত্বেও বাবার মুখটায় মনে পড়ে বেশি। চোখের চাহনি, কথা বলার ধরণ, জেদ, রা গ সবকিছু বাবার থেকে পেয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে, বাবাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে! তিনি দৃষ্টি সরিয়ে বললেন,
” তুই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলি, এই ঘটনাটা স্বর্ণলতা মানতে পারেনি। খুব কষ্ট পেয়েছে। ”
” আমি বাড়ি থাকলে কি ও খুব আনন্দে থাকে? খুশি হয়? আমার তো মনে হয় না। ”
” এবার হয়েছিল। যেদিন চলে গেলি, তারপরের দিন মেয়েটার পরীক্ষা ছিল। স্বর্ণলতা জানত, তোর অনুমতি ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না, পরীক্ষাও দিতে পারবে না। এজন্য তোর অপেক্ষায় ছিল। তুই আসলে বলেকয়ে অনুমতি নিবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের হৃদয়টা ভার হয়ে ওঠছে। স্বর্ণলতা দরকারে তাকে মনে করেছিল, মোবাইল করে আসতে বলেছিল। অন্য কোনো কারণ নেই। তার হৃদয়ের ঘরে প্রবেশ করবে তো দূর আঙিনারও দেখা পাচ্ছে না! সে গোপনে শ্বাস ছেড়ে বলল,
” বুঝলাম, পরীক্ষা দিতে পারেনি বলে অভিমান করেছে। কিন্তু মাফ চাইতে এলো কেন? ”
” আমি বলেছিলাম, তুই চায়লে ও আবারও পরীক্ষা দিতে পারবে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা ছিল। এই পরীক্ষা স্কুল থেকে নেওয়া হয়, বোর্ডে খাতা জমা দিতে হয় না। উপস্থিত ও ফলাফলের কাগজ শিক্ষকদের কাছেই থাকে। তাই বেশি ঝামেলা হওয়ার কথা না। সাথে কাউকে নিয়ে গিয়ে অনুরোধ করলে মিটে যাবে। হয়তো জরিমানা চায়বে, নাহয় পুনরায় আলাদাভাবে পরীক্ষা দিতে বলবে। কিন্তু সবার আগে তোকে রাজি করাতে হবে। তোদের মাঝের রা গারাগির পর্বটা শেষ করতে হবে। এজন্যই স্বর্ণলতাকে মাফ চায়তে বলেছি। ”
” তুমি বলেছ? ও নিজে থেকে চায়তে আসেনি? ”
” না। কিন্তু অনুতপ্ত হয়েছে। শুরুতে বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমি বুঝানোর পর, বুঝতে পেরেছে। ”
” কীভাবে বুঝিয়েছ, দাদিজান? ”
খাইরুন নিসা উষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়লেন। অসন্তুষ্টে ডুবে আছে পরিপক্ক বদনখানা। চোখের ভেতরটায় ক্লান্তি ও ঘুমের ছায়া। বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” এটাও জানতে হবে? ”
” অবশ্যই। ভালো কথা দিয়ে বুঝিয়েছ নাকি মন্দ কথা দিয়ে? ”
” সত্যি দিয়ে বুঝিয়েছি। তুই স্বর্ণলতার স্বামী, প্রায় চৌদ্দ বছরের বড়। এরকম একটা মানুষের গায়ে হাত দেওয়া, খারাপ কথা বলা বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে। ”
” এতটুকুতে বুঝে গেল? ”
” বুঝেছে। কারণ, ওর মধ্যে সামান্য হলেও আদব আছে। যেটা তোর মধ্যে নেই। স্বর্ণলতা একবার তোর দোষটাও তুলে ধরেছিল। আমি সেটাকে জোর করে সরিয়েছি। দোষীকে শা য়েস্তা করার জন্য তো নিজেও দোষী হওয়া যাবে না! ”
খাইরুন নিসা উঠে দাঁড়ালেন। এই ঘর, বিছানা কোনোকিছুতেই শান্তি নেই। স্বস্তিতে দু দণ্ডও বসা যায় না। মনে হয়, মুনছুর সাখাওয়াতের সকল পাপ এখানে এসে জমা পড়ে। ঘরের প্রতিটি জিনিস এত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন হওয়া সত্ত্বেও স্পর্শ করতে ভ য় পান। মনে হয়, পাপ ছুঁয়ে ফেলছেন! তিনি সম্পূর্ণ রুমটায় চোখ বুলিয়ে বললেন,
” সব উত্তর পেয়েছিস? এবার যেতে পারি? ”
সে সাথে সাথে জবাব দিল,
” না। আগে বলো, পরীক্ষার ব্যাপারে কি স্বর্ণলতা নিজে থেকে বলেছে? ”
” হ্যাঁ। শুরুতে বলতে চায়নি। অসুস্থ হওয়ার পর নিজেই…”
খাইরুন নিসা জিভ কামড়ে ধরলেন। তিনি চাচ্ছিলেন না, স্বর্ণলতার অসুস্থের ঘটনাটা সামনে আনতে। তাই খুব সাবধানে ও সতর্কতার সাথে নাতির প্রশ্নগুলোর সংক্ষেপে উত্তর করছিলেন। রুমে চোখ বুলানোর সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন ও বেফাঁসে তথ্যটা বেরিয়ে আসল। মাঝপথে থেমে গেলেও রক্ষা হলো ন। মুনছুর সাখাওয়াত ধরে বসল। ব্যাকুল স্বরে সুধাল,
” স্বর্ণলতা অসুস্থ ছিল? কী হয়েছিল ওর? ”
ধরা পড়ে যাওয়ার পর অস্বীকার করা বোকামি। কথা বাড়ে, দ্বন্দ দীর্ঘ হয়। দাদিজান দুটো থেকেই মুক্ত থাকতে চান। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন,
” খুব জ্বর হয়েছিল। তাপমাত্রা একশ তিন ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাচ্ছিল! একটু পরপর জ্ঞান হারাচ্ছিল। শরীরটাও খুব দুর্বল! দুইদিন ধরে কিছু খায়নি যে! জ্বরে পড়লে মুখের স্বাদ থাকে? জোর করে খাওয়ালেও পেটে থাকছিল না। বমি হচ্ছিল। ”
” এ তো ভয়ঙ্কর অবস্থা! দুইদিন ধরে খায়নি কেন? ”
” তোর দুঃখে। ঐ যে চলে গেলি? তারপর থেকে টানা দুইদিন কিছু খায়নি। পানিও না। শুধু কেঁদেছে! কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছিল, তারপরও থামেনি৷ শেষে জ্বরে পড়ে থামল। ”
” এতকিছু ঘটে গেল, আমাকে খবর দাওনি কেন? ”
” উপায় ছিল কি? তুই তো মোবাইল বন্ধ করেছিলি। বাধ্য হয়ে ডাক্তার ডাকলাম। ”
” ডাক্তার! আমাকে না বলে বাড়িতে ডাক্তার ঢুকিয়েছ? ”
খাইরুন নিসা ক্ষ্যা পে গিয়ে বললেন,
” তাহলে কী করতাম? তোর বউকে ম রতে দিতাম? ”
ক্রো ধে মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখের ভাব কঠোর হয়ে এসেছিল। এখন একটু ঢিলা হলেও কণ্ঠ বদলাল না। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
” কোন ডাক্তার? ”
” হাদি। ”
সে যারপরনাই বিস্মিত হলো। ভ্রদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ল। অবিশ্বাসী ভাব ফুটে ওঠল চোখের চাহনিতে। নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করল,
” ডাক্তার আল হাদি? ”
” হ্যাঁ। ”
” ও এই বাড়িতে এসেছিল? ”
” অবাক হচ্ছিস যে! ও ডাক্তার মানুষ, ডাকলে তো আসবেই। ”
” কাকে দিয়ে ডাক পাঠিয়েছিলে? ”
” কাউকে না। আমি কল করে বলেছিলাম। ”
” কল করে ডাকতেই চলে এলো? ”
” আসল তো। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একস্থির চেয়ে রইল দাদিজানের দিকে। এই কথাটা কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না! ডাক্তার হাদি এই বাড়িতে বসে দৃঢ় গলায় জানিয়েছিল, আর কখনও আসবে না। কিছুদিন আগেও একই কথা বলেছিল। সে নিমন্ত্রণ পাঠালে প্রত্যাখ্যান করে দেয়। সাফ জানিয়ে দেয়, যার দরকার সে যেন ডাক্তার হাদির বাসায় যায়। সেই ডাক্তার কি না দাদিজানের এক কলে চলে এলো! মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় সুধাল,
” নাম্বার পেলে কোথায়? ”
” মোবাইলে ছিল। স্বর্ণলতা একদিন কল দিয়েছিল। ”
” স্বর্ণলতা! ওর কাছে নাম্বার এলো কীভাবে? ”
” জানি না। ও কেই জিজ্ঞেস কর না। আমাকে এত জ্বালাস কেন, মুনছুর? ”
সে থেমে গেল। গভীর ভাবনায় ডুবল। দৃষ্টি উদাস হতে খাইরুন নিসা বললেন,
” আমি গেলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত অন্যমনস্ক অবস্থায় মাথা নাড়ল। তিনি রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন। দীর্ঘ বসার রুমটার মাঝামাঝি আসতে নাতির কণ্ঠ পেলেন। পিছনে ফিরতে সে জিজ্ঞেস করল,
” আসল প্রশ্নটায় করা হয়নি। ”
” কোনটা? ”
” স্বর্ণলতা মাফ চায়তে এসে পুতুলের মতো আচরণ করছিল কেন? অভিমান হলে কি মানুষ এমন আচরণ করে, দাদিজান? ”
তিনি মৃদু হাসলেন। সহাস্যে বললেন,
” না। ও কে বলেছিলাম, মাফ চাওয়ার সময় তুই যদি কিছু করতে বলিস তাই যেন করে। নাহলে সহজে মাফ পাবে না। মাফ না পেলে তো, পরীক্ষাটাও দিতে পারবে না। মেয়েটা পড়াশোনা বড্ড ভালোবাসে! ”
” পুতুলের মতো আচরণ করতে মানা করে দিও। আমি সহ্য করতে পারি না! ”
_________
সকালবেলা। নাস্তার সময় হয়নি তখনও। রান্নাঘরে তোরজোর চলছে মাত্র। মুনছুর সাখাওয়াতের অপেক্ষা করার সময় নেই। ভীষণ জরুরি কাজ আছে। এখনই বের হতে হবে। সে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরুল। দরজায় তালা ঝুলাবে তখনই শুনল,
” আপামনি, আপনে কিছু ধইরেন না তো! ছার দেখতে পাইলে রা গ করবো। হেই তো চায় না, আপনে কাম করেন। ”
” কাম করতাছি না তো, কলিবু। রুটিটা ছুঁইয়া ছুঁইয়া দেখতাছি। এত সুন্দর গোল বানাও ক্যামনে? আমারে শিখাইবা? ”
” আপনে শিইখা কী করবেন? ”
” দাদিজান রে বানাইয়া দিমু। উনি তো অন্য কারও ধরা খাবার খাইতে চায় না! নিজে বানাইতে পারে না, বানাইয়া দেওয়ার মতো পরিবারেও কেউ নাই। তাই ভাবতাছি, তোমার থেইকা শিখতে পারলে আমি বানাইয়া দিতে পারমু। ”
মুনছুর সাখাওয়াত অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে ডাকল,
” কলি? ”
সে তটস্থ পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মালিকের দেখা পেতে দাঁড়িয়ে পড়ল মাথা হেঁট করে। মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” আমি কি তোর দুলাভাই লাগি? ”
সে হতভম্ব হয়ে গেল। চোখের পাতা উঠতে চেয়েও ওঠল না। দ্রুত দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
” না। ”
” তাহলে আমার বউকে আপামনি ডাকিস কোন সাহসে? ”
” তাইলে কী ডাকমু? ”
” ম্যাডাম। ”
উত্তরটা সে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে দিল। বাইরে থেকে রান্নাঘরের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যমান অংশে স্বর্ণলতা নেই। আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয়! সে কখনই চায় না, স্বামীর দৃষ্টিতে পড়ুক। মেয়েটা এত কেন স্বামী বিমুখী হয়েছে! মুনছুর সাখাওয়াত এই বিমুখীতা চায় না। যেকোনো মূল্যে কাটাতে চায়। সে কলির উদ্দেশ্যে বলল,
” তোমার ম্যাডামকে বলো, রান্নাঘর থেকে বের হতে। ওখানে তার কোনো কাজ নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না। দাদিজানের অন্যদের বানানো খাবার খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। বদলানোর দায়ভার তাকে নিতে হবে না। ”
স্বর্ণলতা ভেতর থেকে সবই শুনেছে। ইচ্ছে হলো না, রান্নাঘর থেকে বের হতে। কিন্তু কলি ও ময়নার হাত জোর করে মিনতি দেখে বাধ্য হলো। বাইরে পা রাখতে টের পেল, মুনছুর সাখাওয়াত সামনে আছে। একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। সে লজ্জাবোধ করল। অস্বস্থিও ঠেকল। আড়ষ্টতায় দেহ ও হাত-পা সংকুচিত হয়ে আসছে। মাথার ওড়নাটা টেনে কপালটাও ঢেকে ফেলল। এভাবে পায়ে পায়ে স্বামীকে পাশ কাটছিল সহসা বজ্রকণ্ঠটা শুনতে গেল,
” তোমার পায়ের নুপুর কোথায়? ”
সে হকচকিয়ে গেল। চলন থেমে গেল। মেঝের সাথে পায়ের তালু জোড়া আটকে গেল আঠার মতো। মুনছুর সাখাওয়াত কাছে এগিয়ে এলো। পায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পুনরায় প্রশ্নটি করল,
” স্বর্ণলতা, তোমার পায়ের নুপুর কোথায়? ”
সে স্থির দাঁড়িয়ে থেকেও কেঁপে ওঠল। ভীত দেখাল মুখ ও চোখের চাহনি। এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত অসহিষ্ণু গলায় বলল,
” কী সমস্যা? উত্তর দিচ্ছ না কেন? ”
স্বর্ণলতা পূর্বের মতো নিশ্চুপ। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। মুনছুর সাখাওয়াতের স্থির ও প্রতীক্ষিত নেত্রদ্বয় ভীষণ চঞ্চল হলো। দাদিজানের রুমের দিকে চেয়ে হাঁক ছাড়ল,
” দাদিজান? ”
তিনি দরজার কাছে এলেন। নাতি ও নাতবউদের দিকে পরপর দৃষ্টি রেখে বললেন,
” আমাকে আবারও তোদের মাঝে টানছিস? একটা বেলা কি শান্তি দিবি না, মুনছুর? আমার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে! ”
সে এই কথাগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল,
” ওর পায়ে নুপুর নেই কেন? ”
” খুলে রেখেছি। ”
” তুমি খুলেছ? এত সাহস! ”
খাইরুন নিসা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
” একে তো সোনার নুপুর। তারমধ্যে হাজারটা ঘণ্টি দেওয়া। আমাদের ধর্মে এই ধরনের নুপুর পরা হারাম। চাইলে নিজ ঘরে, স্বামীর সামনে পরতে পারে। কিন্তু স্বর্ণলতা তো…”
” তোমার ধর্মের নিয়ম তুমি মানো। আমার বউকে মানতে হবে না। এখনই ও কে নুপুর ফেরত দেবে। ”
” মুনছুর, সাবধান। এতটা বাড়াবাড়ি ভালো না। ধ্বংস হয়ে যাবি। ”
” ভালোই হবে, তোমার চাওয়া পূরণ হবে। এখন যাও, নুপুর নিয়ে এসো। ”
দাদিজানের প্রবল ইচ্ছে হলো, নাতির গালে কষে দুটো চ ড় মা রতে। কিন্তু সাহস পেল না। যদি হাতটা ধরে ফেলে! মোচড় দিয়ে বসে! ছেলেটা আগে থেকেই শক্ত ধাঁচের। মায়া-মমতা নেই বললেই চলে। বিয়ের পরে অত্যধিক উগ্র ও হিংস্র হয়েছে। তার সাথে যে র ক্তের সম্পর্ক আছে, স্নেহের বাঁধন আছে ভুলেই গিয়েছে বোধ হয়। আগে হঠাৎ হঠাৎ খোঁজখবর নিত এখন সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে! খাইরুন নিসা রা গে চর্বণ করতে করতে নুপুর জোড়া এনে দিলেন। মুনছুর সাখাওয়াত হাত বাড়িয়ে নিবে পূর্বে স্বর্ণলতা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। দাদি শাশুড়ির রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” দাদিজান, উনারে কইয়া দেন। আমার নুপুর মন চাইলে পরমু, মন না চাইলে পরমু না। ”
সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। দাদি ও নাতি উভয়ে চেয়ে ছিল তার চলে যাওয়ার পানে। সহসা মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যাও। তোমার নাতবউকে বোরকা পরিয়ে পাঠাও। আমরা বের হব। ”
” কোথায় যাবি? ”
” সেটা তোমাকে না জানলেও হবে। যে যাবে, সে তো চোখ মেলে দেখবেই। চোখ বেঁধে তো নিচ্ছি না। ”
________
স্বর্ণলতা জীপে ওঠল আলস্যভঙ্গিতে। মুনছুর সাখাওয়াতের পাশে বসল ভীষণ অনিচ্ছায়। পান্না ও আলামিন পূর্ব থেকেই মোটরসাইকেল নিয়ে তৈরি ছিল। মহাজন এলে দৌড় দিবে। দৌড় দেওয়া হলো না। একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে পান্না নেমে এলো। মুনছুর সাখাওয়াতের পাশের দরজায় দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলল,
” মহাজন, আমরা হিন্দু বাড়ি যাইতাছি। ঐ চাড়ালে কিন্তু মুসলমানের দিকে ফিরাও তাকায় না। দুনিয়ার কিপ্টা! এক গেলাস পানিও খাওয়াইবো না। পাওনা ট্যাকাও তুলতে হইবো মাইরাধইরা! এমন জায়গায় ম্যাডাম রে নিয়া যাওয়া ঠিক অইবো? ”
” আমরা হিন্দু বাড়ি যাচ্ছি না৷ ”
” কী কন! আমার কাছে খবর আছে, জুয়া খেইলা লাখ দেড়েকের মতো টাকা জিতছে। এই ট্যাকা তুইল্যা না নিলে তো আবারও জুয়াই খেলবো। এবার নিশ্চিত হারবো। পরে কিন্তু জবাই করলেও ট্যাকা তুলতে পারবেন না! ”
কথাটা শেষ হওয়ামাত্র মুনছুর সাখাওয়াত সজোরে দরজা মেলল। পান্না বাড়ি খেয়ে একহাত দূরে ছিটকে পড়ল। আহত চোখে তাকালে বলল,
” মায়ের চেয়েও মাসির দরদ বেশি! আলামিন, ওর মুখে গামছা বাঁধ। আজকে সারাদিন গামছা মুখে থাকবে। খাওয়া-পরা সব বন্ধ। ”
জীপ ছুটে চলল। সরু মেঠোপথ পার হলে, চওড়া ইটের রাস্তা। তারপরে পাকা রাস্তা। স্বর্ণলতা জানে না কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। শুধু চেয়ে দেখল, এই পথটা তার চেনা। বর্ষার সময় এই পথ ধরে স্কুলে যাওয়া হতো। অনেক দূরের পথ, হেঁটে কুলানো যায় না। ভ্যানে করে যেতে হয়। ভ্যানে গেলে ভাড়া লাগে, তাই বর্ষার আগে ও পরে বিল পার হয়ে স্কুলে যায়। ঐ রাস্তা ছোট, হেঁটে যাওয়া যায়। সে দু-চোখ মেলে রাস্তার দুই ধার দেখতে দেখতে ভাবছে, এই গ্রামে তার বিয়ে হবে, শ্বশুরবাড়ি হবে কল্পনাও করেনি কোনোদিন!
” বইটা কী করেছ? ওটাও কি দাদিজানের কাছে জিম্মি রেখেছ? ”
স্বর্ণলতার ধ্যান ভাঙল। ঘন ঘন চোখের পলক পড়ল। সতর্ক হয়ে বসল ঠিকই কিন্তু প্রশ্নের জবাব দিল না। মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় বলল,
” আমি পুতুলের মতো আচরণ করতে মানা করেছি, কথা বলা থামিয়ে দিতে বলিনি। ”
সে এবারও নিশ্চুপ। জানালায় মাথাটা হেলিয়ে দিল। দৃষ্টিজোড়া বাইরে স্থির হতে শুনল,
” স্বর্ণলতা, তোমার কি আমার থেকে কিছু চাওয়ার আছে? ”
স্বর্ণলতা এক ঝলক তাকাল। মুখে জবাব না দিলেও মাথাটা কিঞ্চিৎ নাড়ল। এতে মন ভরল না মুনছুর সাখাওয়াতের, আরও বেশি তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠল। তার সেই দীপ্ত কণ্ঠস্বর, উত্তপ্ত চাহনি, প্রতিবাদী চেতনা দেখার লোভ হচ্ছে। মেয়েটাকে ওরকমই মানায়।
” চাওয়ার থাকলে বলো। ভয় বা সংকোচ করো না। আমি তোমার সব চাওয়া মিটাতে চাই। যদি বলো আকাশের চাঁদ চাই, তাও এনে দিতে রাজি। শুধু একটাই শর্ত, জোসনা উপভোগ করার সময়ে আমাকে সঙ্গে নিতে হবে। ”
জীপ এসে থামল, স্বর্ণলতার স্কুলের গেইটে। সে ঝটিতে ফিরল স্বামীর পানে। বিস্মিত ও অবিশ্বাস্য চাহনি! মুনছুর সাখাওয়াত এখনও তার দিকে চেয়ে আছে। কুটিল হেসে বলল,
” তোমার স্বামীর ক্ষমতা দেখতে চাও? ”
সে জবাব দিতে পারল না। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থাকল শুধু। মুনছুর সাখাওয়াত নিজেই বলল,
” না চাইলেও দেখতে হবে। দাদিজান সচরাচর আমার কাজ-কারবার নিয়ে মাথা ঘামায় না। ক্ষমতা সম্পর্কেও তেমন ধারণা নেই। তবুও তোমার সামনে বলেছে, আমি চাইলে পরীক্ষা দিতে পারবে। সেই কথাটা কতটুকু সত্য তাই প্রমাণ করব। আশা করছি, দাদিজানের মাথা নিচু হবে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্কুলের ভেতরে ঢুকতেও পারল না। গাড়ি থেকে নামছে মাত্র। এরমধ্যে প্রধান শিক্ষক শশব্যস্তে ছুটে এলেন। হাত কচলে লাজুক ভঙ্গিতে একাধারে বলে চললেন,
” আসসালামু আলাইকুম, স্যার। ভালো আছেন? আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন, আমাকে ডেকে পাঠাতেন! ”
সে মৃদু হাসল। স্বর্ণলতা তখনও গাড়ি থেকে নামেনি। এই স্যারটাকে সে যমের মতো ভ য় পায়। খাটো মানুষ অথচ বিশাল বুড়ি৷ ক্লাসে ঢুকে সে বার বার প্যান্ট উপরে তুলে। কণ্ঠটা এত চিকন! কানে বাজে খুব। নিয়ম-কানুনে একটু হেরফের হলে ক্লাসে এসে অন্যান্য শিক্ষকদের বকাঝকা করেন। সময়-জ্ঞান, পরিবেশ কিছুই দেখেন না! প্রধান শিক্ষক তার দিকে তাকাতে সালাম দিল। তিনি উত্তর নেওয়ার সময় পেলেন না। আগেই মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
” তুমি সালাম দিচ্ছ কেন? যে আমাকে সালাম দেয়, সে তোমাকেও সালাম দিবে। ”
সাথে সাথে প্রধান শিক্ষক তাকেও সালাম দিল। স্বর্ণলতা হতভম্ব হয়ে গেল। উত্তর নেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে বসল!
________
মুনছুর সাখাওয়াত ও স্বর্ণলতা বসে আছে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। সামনে চা-বিস্কুট ও ঠাণ্ডা পানীয় দেওয়া। দুজনের কেউই কিছু নিল না। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর পরিচয় ও পরীক্ষার ব্যাপারে কথা তুলল। প্রধান শিক্ষক ভীষণ আন্তরিক হাসলেন। ভাবখানা এমন, কোনো মজার প্রসঙ্গ নিয়ে গল্প চলছে। হাসতে হাসতে বললেন,
” কোনো ব্যাপার না, স্যার৷ পরীক্ষা হয়ে যাবে, ম্যাডামের আসতে হবে না। দরকার হলে আমি লিখে দিব। ”
স্বর্ণলতা যারপরনাই বিস্মিত হলো। দাদিজানের ধারণার বাইরে চলে যাচ্ছে সব। জরিমানা বা পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার কথাটা ভুলেও আসছে না। তারা কথাবার্তা শেষ করে বাইরে আসছিল, সহসা শিক্ষকমশাই বললেন,
” ম্যাডামের ভাই, সুবর্ণও পরীক্ষা দিচ্ছে না। ওর পরীক্ষাটাও কি দিয়ে দিতে হবে, স্যার? ”
স্বর্ণলতা চকিতে ফিরল। প্রধান শিক্ষকের দিকে চেয়ে সুধাল,
” আমার ভাই পরীক্ষা দিতাছে না? ”
” না। ”
” ক্যান? ”
” শুনেছি, পরীক্ষার ফি দেয়নি। পরীক্ষার হলেও আসেনি। এটা সরকারি স্কুল, ফি’য়ের জন্য পরীক্ষা আটকে থাকবে না। কোনো না কোনো ব্যবস্থা হতো, কিন্তু ও তো স্কুলেই আসছে না! ”
মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” দিয়ে দে। বাকিটা পরে দেখছি। ”
দুজনে জীপে ওঠল। স্বর্ণলতা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। সুবর্ণ পরীক্ষা দিচ্ছে না কেন, বুঝতে পারছে না। ফি’ও আটকে থাকার কথা না। আগে ভাই ও তার পড়াশোনার খরচ চালাতে হতো। এখন শুধু সুবর্ণের খরচ চালাবে। বাবা কি এটুকুও পারছে না? হঠাৎ করে এতটা অভাবে পড়ে গেল?
” স্বর্ণলতা? ”
এই ডাকটাকে সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। অজান্তেই মুখটা ঘুরে গেল স্বামীর দিকে। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখতে শুনল,
” তোমার এতবড় একটা চাওয়া পূরণ করে দিলাম, বিনিময়ে আমাকে কিছু দিবে না? ”
সে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিল। মুনছুর সাখাওয়াতের এত খারাপ লাগল! ইচ্ছে হলো, এই মুখটা চেয়ে নিতে। তারপরে আয়নার মতো সারাক্ষণ নিজের মুখের সামনে ধরে থাকবে। কখনও অন্যদিকে ফিরতে দিবে না। স্বর্ণলতা অনেক্ষণ পর হালকা স্বরে বলল,
” আপনার ঘরে থাকতে পারমু না। এইডা ছাড়া অন্য কিছু চাওয়ার থাকলে, কন। ”
” আপাতত, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিলেই হবে। ”
” কী প্রশ্ন? ”
” ডাক্তারের সাথে কি তোমার পূর্ব পরিচয় আছে? ”
স্বর্ণলতা চমকে ওঠল। আচমকা এই প্রসঙ্গ চলে এলো কেন, বুঝে উঠতে পারল না। ভেতরে ভেতরে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষটা টের পাচ্ছে না তো? সে মুখে জবাব দিতে সাহস পেল না। মাথা নেড়ে বুঝাল, আছে। মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থামিয়ে দিল। কালো বোরকায় আবৃত বালিকা বধূর চোখজোড়ায় চেয়ে বলল,
” কোন ডাক্তারের কথা বলছি, বুঝেছ তো? ”
সে পুনরায় মাথা নাড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে ফেলল। পুরোপুরি তার দিকে ফিরে বলল,
” তোমাদের গ্রামের একমাত্র ডাক্তার। অবশ্যই নাম শুনে থাকবে, দেখেও থাকবে। সেরকম চেনাজানার কথা বলছি না। এর বাইরে অন্য কোনোভাবে কি পরিচয় হয়েছে? ”
এই পর্যায়ে স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিতে বাধ্য হলো। বলল,
” উনি বেহালার ভাই। ”
” ব্যস, এই পর্যন্তই নাকি আরও কোনো পরিচয় আছে? ”
সে উত্তর দিবে পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” মিথ্যা বলো না, স্বর্ণলতা। আমার কাছে তুমি মানে চিরন্তন সত্য। তোমাকে ঘিরে থাকা প্রতিটা তথ্য, বস্তুও ধ্রুব সত্য। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৬)
” মিথ্যা বলো না, স্বর্ণলতা। আমার কাছে তুমি মানে চিরন্তন সত্য। তোমাকে ঘিরে থাকা প্রতিটা তথ্য, বস্তুও ধ্রুব সত্য। ”
সে চট করে কিছু বলল না। পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মুনছুরের মুখপানে। স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষ, কঠোর ছাপটা নেই। চোখদুটিতে কী নিদারুণ আকুতি, মিনতি! মণি জোড়া স্থিরতা হারাচ্ছে বার বার। একভাবে বসে থাকার চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। ভীষণ বিক্ষিপ্ত ও অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে যেন! স্বর্ণলতা মনে মনে আশ্চর্য হলো। মানুষটাকে এরকমভাবে দেখেনি কখনও।
মুনছুর সাখাওয়াত আরও একবার নড়ে ওঠল। মুখের ভাবটা এমন যে, সিটে বসে আরাম পাচ্ছে না। ভীষণ অস্বস্থি ও অসুবিধায় পড়ে গেছে! সে সিটের পেছনে কনুই দিয়ে গুঁতা মারল। সিটসহ পুরো জীপটায় মৃদু কেঁপে ওঠল। স্বর্ণলতা ছিটকে ওঠল। ভাবল, ভূমিকম্প হচ্ছে। ভ য় ও শঙ্কা চিত্ত চেপে ধরল। চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া চারপাশে ঘুরতেই শুনল,
” স্বর্ণলতা, সত্যিটা বলো। ডাক্তারের সাথে অন্য কোনো পরিচয় আছে? ”
সে অন্যদিকে চেয়ে থেকে উদাসভাবে জবাব দিল,
” না। ”
” বিশ্বাস করলাম। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। সবসময় করব। ”
স্বর্ণলতা চকিতে ফিরল। পর্যবেক্ষকের ন্যায় তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের ঠোঁটে। হাসি নেই, গাম্ভীর্যে পূর্ণ হয়ে আছে ঠোঁটের রেখা ও কোণজোড়া। তাহলে কি সে ভুল শুনল? এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, মানুষটা হাসছে। আনন্দে ভাসছিল কণ্ঠস্বরটা। জীপটা পুনরায় চলতে শুরু করেছে। স্বর্ণলতা চোখ সরিয়ে নিল। একমনে চেয়ে রইল রাস্তার দিকে। সহসা শুনল,
” আমার বুকে হাত রাখ। ”
আদেশপূর্ণ কণ্ঠস্বর। স্বর্ণলতা চমকে ওঠল। সচকিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। সে সামনে চেয়ে আছে। সতর্ক দৃষ্টি! গাড়ি চালাচ্ছে একমনে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে না, একটু আগের কথাটা বলেছে। স্বর্ণলতা নিজের উপরে বিরক্ত হলো। মনের মধ্যে কী চলছে তার? উল্টাপাল্টা কথা শুনছে কেন? মুখটা ফিরিয়েও নিতে পারল না পুরোপুরি। আচমকা জীপ থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পড়ল,
” আমার বুকে হাত রাখ। ”
স্বর্ণলতা অবাক হলো। কথাটা সত্যি বলেছিল, সে ভুল শুনেনি তাহলে! মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে চেয়ে ছিল। নিজের বুকের বা’পাশে একটা হাত রেখে বলল,
” ঠিক এখানে রাখবে। ”
সে প্রথমে ভ্রূদ্বয় কুঁচকাল। পরক্ষণে মুখ ফিরিয়ে নিল। দুই হাত গুটিয়ে নিয়ে বুঝাল, কোথাও হাত রাখতে পারবে না। মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” হাত তো রাখতেই হবে। নিজে থেকে রাখবে নাকি আমি জোর করে রাখাব? ”
স্বর্ণলতা বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট স্বরে উত্তর করল,
” যা ইচ্ছা হয়, করেন। আমি তো বাঁধা দিতাছি না। ঐ শক্তিটুকু আমার নাই। যেদিন হইবো সেদিন ঠিকই বাঁধা দিমু। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কথা বাড়াল না। ত্বরিত স্ত্রীর হাতটা বুকে ঠেকিয়ে রাখল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” কিছু অনুভব করছ? ”
সে বিরস গলায় প্রত্যুত্তর করল,
” না। ”
” মনোযোগ দাও। চোখ বন্ধ করো। ”
স্বর্ণলতার চোখ বন্ধ করতে হলো না। তার আগেই হৃদযন্ত্রের তীব্র কম্পন টের পেল। চোখদুটি বন্ধ করল তারপরে। মুহূর্তে হৃদস্পন্দনের ধকধক শব্দটাও কানে পৌঁছে গেল। সে বেশিক্ষণ শুনতে চাইল না। চোখ মেলে হাতটা সরিয়ে নিতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত বাঁধা দিল না, হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
” তুমি ডাক্তারকে চিনো, কথাটা শোনার পর থেকেই বুকের ভেতরে এই শব্দটা টের পাচ্ছি। ভেবেছিলাম, তোমার সাথে কথা বললে থেমে যাবে। যায়নি, আরও বাড়ছে মনে হয়। স্বর্ণলতা, এই বিষয়ে আমার আরও প্রশ্ন আছে। ঝটপট উত্তর দাও, নাহলে গাড়ি চালাতে পারব না। দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ”
স্বর্ণলতা অসহায়বোধ করল। মনে পড়ে গেল, সেই ভোরবেলা, ডাক্তার হাদির বলা প্রতিটি কথা। মানুষটির সাথে আর কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু সে চেয়েছিল, আরও একটি পরিচয় বানাতে। মহাজনের ভ য়ে আগাতে পারেনি! এই কথাটি সে কী করে বলবে?
” দাদিজান বলছিল, তোমার কাছে নাকি ডাক্তারের নাম্বার আছে? ”
” আছে। ”
” কোথায় পেয়েছ? ”
” উনি দিছিলেন। ”
” কেন? ”
” কইছিল, দরকার হইলে কল দিতে। ”
” কী রকম দরকার? ”
স্বর্ণলতা পূর্ণ চোখে তাকাল। রা গের ভাব ফুটে উঠেও ফুটছে না যেন! মুনছুর সাখাওয়াত টের পেয়েও ভীত হলো না। সামান্যতমও ঘাবড়াল না। অটলভাবে বলল,
” মুখে জবাব দেও। আমার জানাটা জরুরি। ”
” মাইনষে ডাক্তারের নাম্বার রাখে ক্যা, জানেন না? ”
” আমি শুধু তোমারটা জানতে চেয়েছি, অন্যদেরটা ঢুকাবে না। ”
” আমি এতকিছু ভাবি নাই। নাম্বার দিছে, রাইখা দিছি। ”
” দাদিজানের মোবাইল থেকে একদিন কল করেছিলে। কী দরকার পড়েছিল? ”
” এই উত্তরটা আপনে জানেন। আমার দেওয়া লাগবো না। ”
সে আরও কিছু বলতে চাইল, সুযোগ পেল না। পূর্বেই স্বর্ণলতা বলল,
” আর একটা প্রশ্ন করলে, আমি গাড়ি থেইকা নাইমা যামু। সহজে তুলতে পারবেন না কিন্তু। অযথায় জ্বালাইতাছেন! ”
হু মকিটা কাজে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত থেমে গেল। গাড়ি চলতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর বলল,
” বাড়ি যেতে যেতে আমার নাম্বারটা মুখস্থ করে ফেল। ”
সে নিজের নাম্বারটা বার বার শুনাতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে নিজের বুকে হাত রেখে হৃদস্পন্দনের গতিটাও পরীক্ষা করে নিল। কমছে! এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, স্বর্ণলতা ডাক্তারকে পছন্দ করে। স্বামী হিসেবে পেতে চায়। এজন্যই বিয়ে করতে চায়নি। তার প্রতি আগ্রহবোধও করে না। সারাক্ষণই মুখ ফিরিয়ে রাখে। কথা-বার্তা যেটুকু হয়, সেটাও দায়ে পড়ে।
________
বউকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে ছুটল সুয়াপুরের উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়বারের মতো উপস্থিত হলো শ্বশুরবাড়িতে। শবনম বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। সুবর্ণ সাজনা গাছে উঠেছিল। সাজনা পারতে পারতে দুলাভাইকে দেখল। গাছ থেকেই চেঁচিয়ে বলল,
” দুলাভাই আইছে! আম্মা, দেখ। আমগো বাড়ি দুলাভাই আইছে। ”
সে সাজনা পাড়া বন্ধ করে দিল। তরতর করে গাছ থেকে নেমে পড়লেও, দুলাভাইয়ের কাছে যেতে পারল না। রান্নাঘরের কোণে দাঁড়িয়ে রইল। শবনম বেগম ছেলের ডাক পেয়ে চুলার আগুন নিভিয়ে দিলেন। মাথায় আঁচলটা প্যাঁচিয়ে নিতে নিতে ছুটলেন ঘরের ভেতর। বিছানায় ইকবাল হাসান শুয়ে আছেন। হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেও, পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। একটা পায়ের হাড় ভেঙে অচল হয়ে গেছে, ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। হাতের অবস্থাও ভালো না! মুঠো করে কিছু ধরতে পারেন না। তিনি স্বামীকে ঠেলে চাপিয়ে দিলেন একপাশে। খালি পাশটা দ্রুত হস্তে ঝেড়ে বললেন,
” মহাজন, বহেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকল না। বাইরে থেকে বলল,
” কলি বলল, আমি যাওয়ার পর এই বাড়িতে ডাক্তার আসছিল। কথাটা কি সত্যি? ”
শবনম বেগম প্রথমে চমকে ওঠলেন। পরক্ষণে ভ য়ে কুঁকড়ে গেলেন। মেয়েটাকে কতবার করে বলেছিল, এই কথাটা যেন মহাজনকে না বলে। তারপরেও বলে দিল? এতদিন পর!
” মিথ্যা হলে তো আমি এখানে আসতাম না। অবশ্যই সত্যি বলেছে। আমি আসার কারণটা জানতে চাই। শবনম, কিছু আড়াল করবি না। যা জানিস, সব বল। নাহলে…”
মুনছুর সাখাওয়াত নিজে থেকেই থেমে গেল। জানে, বাকিটা না বললেও চলবে। এই মহিলাটা তাকে দেখলেই ভ য় পায়। ভ য়ের শুরুটা হয়েছিল, অনেক বছর আগে। তখন সে পোয়াতি ছিল।
শবনম বেগম ভ য়ে ভ য়ে বললেন,
” উনি চাইত, স্বর্ণা যেন পড়ালেহাডা ঠিকমতো করতে পারে। ”
” আর কিছু চাইত না? ”
তিনি মাথা নাড়লেন। মুনছুর সাখাওয়াত দেখল, তার ঠোঁট কাঁপছে। যে কথাটা বলতে চাচ্ছে, সেটা বের হচ্ছে না। সে আশ্বাসের গলায় বলল,
” নির্ভয়ে বল। তোর মেয়ের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি জানি, ও কোনো দোষ করেনি। আমি শুধু জানতে চাই, ডাক্তারে কতদূর এগিয়েছিল। ”
শবনম বেগম এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি চান না ডাক্তার হাদিরও কোনো ক্ষতি হোক। ভালো ছেলে, নানানভাবে তাদের সাহায্যও করেছে। স্বর্ণাকে বিয়ে করলে যে, খুব সুখে রাখত এই ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিল। তিনি তো মনে মনে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনেও নিয়েছিলেন। তারপরে ঝড়টা এলো। লণ্ডভণ্ড করে দিল, তার ও ডাক্তার হাদি উভয়ের স্বপ্নকেই!
” বলবি নাকি তোর জামাইয়ের নিঃশ্বাস আ টকে দিব? ”
মুনছুর সাখাওয়াত ঘরের দিকে পা বাড়াল। শবনম বেগম আঁতকে উঠে বলল,
” কইতাছি, মহাজন। উনারে আর কষ্ট দিয়েন না। ”
সে থেমে গেল। ঘাড় ফিরে চাইতে তিনি দ্রুত জানালেন,
” ডাক্তারসাব স্বর্ণা রে খুব পছন্দ করত। বিয়া করতে চাইছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ফিরে আসতে আসতে বলল,
” তারপর? ”
শবনম বেগম অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে সবকিছু খুলে বললেন। কিছুই গোপন করলেন না। মুনছুর সাখাওয়াত চুপচাপ শুনছিল। শাশুড়ির কথা শেষ হতে তাকাল সুবর্ণের দিকে। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। সে ভীরু পায়ে এগিয়ে এলো। মাথা নত করে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করল,
” পরীক্ষা দিসনি কেন? ”
” মন চায় নাই। ”
” মন কী চায়? ”
” আপনা রে কইতে ইচ্ছা করতাছে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূজোড়া কপালে উঠে গেল। মাথা নিচু করে রেখেছে অথচ কণ্ঠস্বর দীপ্ত, নিঃশঙ্ক! সে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করল। সাধতেই বলল,
” আফায় কইছে, কারও থেইকা এমনে এমনে ট্যাকা নেওয়া ভালা না। ”
” এমনিই দিইনি। দুলাভাই ডাকলি যে? সেজন্য দিয়েছি। ”
” দুলাভাই ডাকা কি কোনো কাজ? ”
” আমার জন্যে তো তাই। ”
সে জোর করে শ্যালকের হাতে টাকাগুলো দিয়ে বেরিয়ে এলো। পান্না ও আলামিন জীপের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত জীপে উঠতে উঠতে বলল,
” ডাক্তারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ধরে নিয়ে আয় তো। ”
পান্নার মুখে গামছা বাঁধা, কথা বলতে পারছে না। আলাদিন বাধ্য হয়ে সভয়ে জানাল,
” ওরে তো এহন বাড়ি পামু না, মহাজন। হাসপাতালে চইলা গেছে। ”
” যখন আসবে তখনই ধরে আনবি। বিশ্রাম করার সুযোগও যেন না পায়। ”
__________
স্কুলে কী কী ঘটেছে, স্বর্ণলতা সবটায় জানাল দাদিজানকে। তিনি প্রথমে বিস্মিত হলেন পরমুহূর্তেই হেসে ফেললেন। বললেন,
” হেডমাস্টার এমনি এমনি সালাম দেয়নি। কারণ আছে। ”
” কী কারণ, দাদিজান? ”
” উনি চাঁদনির বাবার কাছে দেনাগ্রস্থ ছিলেন। মুনছুর যখন সবকিছু নিজের নামে নিয়ে নিল তখন তাকে দেনামুক্ত করে দিছিল। তারপর থেকে ও কে দেখলে সমীহ করে চলে। আমার সাথেও কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ”
স্বর্ণলতা বুঝতে পেরেছে এমনভাবে মাথা দুলাল। তারপরে চটপটে বলল,
” আপনের নাতিরে কইবেন, আমি পরীক্ষা দিমু। যে কইটা দিতে পারি নাই, ওগুলাও আমি দিমু। দুই নাম্বারি কইরা পাশ কইরা কী লাভ? শিখনের কী আছে ওতে? ”
সে গোসলখানার দিকে যাচ্ছে। দরজার কাছে পৌঁছে পুনরায় বলল,
” আপনের নাতি কইল, আমি চাইলে চাঁদও আইনা দিবো। চাঁদ কি কেউ আনতে পারে? ”
” ধুর! চাঁদ আনবে কেন? ওটা কথার কথা। ”
” মিথ্যা কইছে? ”
” মিথ্যাও না। বুঝিয়েছে, চাঁদের মতো অমূল্য, দুষ্প্রাপ্য জিনিস চাইলেও এনে দিবে। ”
স্বর্ণলতা কাছে এগিয়ে এলো। দাদিজানের পাশে বসে বলল,
” কথাটা আবার কইবেন? বুঝতে পারি নাই। ”
খাইরুন নিসা মৃদু হাসলেন। আরও সহজ করে চলার চেষ্টা করলেন,
” মনে কর, এমন একটা জিনিস চাইলি যেটার দাম অনেক। মুনছুরের পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই। সেটাও এনে দিবে। ”
” সামর্থ্য না থাকলে ক্যামনে দিবো? ”
” ওটা তো মুনছুর জানে। আমি কীভাবে বলবো? ”
” আমি এত দামি জিনিসের নাম জানি না। ”
” তাহলে চাওয়ার দরকার নেই। যাও, গোসল করো। নামাজের ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। ”
স্বর্ণলতা হতাশ চিত্তে গোসলে ঢুকল। এত বড় একটা সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারবে না? সে ঠিক করল, বেহালার থেকে একটা দামি জিনিসের নাম শিখে আসবে। দানবটা টাকার যে অহংকার করে সেটা ভেঙে ছাড়বে!
_________
মুনছুর সাখাওয়াত সেবেলা বাড়ি ফিরল না। হিন্দু বাড়ি গেল। নিজের পাওনা টাকা আদায় করে বাড়ির দিকে রওনা দিল সন্ধ্যা নাগাদ। ফটকের কাছে পৌঁছাতে দেখা হলো হাদির সাথে। তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে মাটিতে। হাত দুটো পেছনে বাঁ ধা সত্ত্বেও শান্ত থাকছে না। ছুটার চেষ্টা করছে। যদি পালিয়ে যায়, এই ভ য়ে আবুল ও পান্না দুইপাশ চেপে ধরে আছে। আলামিন দূরে দাঁড়িয়ে আছে লাঠি হাতে। ভাবখানা এমন, দৌড়াতে ধরলে পায়ে বাড়ি মা রবে। জীপ থেমে গেল ফটকের কাছে। মহাজনকে নামতে দেখে আলামিন এগিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কখন ধরেছিস? ”
” দুই ঘণ্টা তো হইবোই। আমি আর পান্না ভাই বিলের কাছে ওত পাইতা ছিলাম। নৌকা থেইকা নামতেই ঝা পাইয়া পড়ছি। গেরামে ঢুকতে দেই নাই। ডাইরেক এইখানে নিয়া আইছি। ”
সে জবাবে কিছু বলল না। দূর থেকে তাকিয়ে আছে ডাক্তার আল হাদির দিকে। সেও তাকাল। চোখ থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে যেন! মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে হলো, আঙুল দিয়েই চোখ দুটি উপ ড়ে ফেলতে। এই চোখ দুটি দিয়েই তো স্বর্ণলতাকে দেখেছে, কামনা করেছে। মাটিতে ফেলে বুকের উপরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে শান্তি হতো। ঐ বুকের মধ্যেই তো স্বর্ণলতার জন্য ভালোবাসা জমেছিল!
” ওর বাড়িতে এখন কে কে আছে? ”
” কেউ না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হলো। জিজ্ঞেস করল,
” ওর একটা বোন আছে না? ও কোথায় থাকে? ”
” ঐ বাড়িতেই। ”
” তাহলে বললি কেন, কেউ নেই? ”
” কয়দিন ধইরা নাই। শুনছি, ওর বুইন মেলা অসুস্থ! হাসপাতালে ভর্তি আছে। বাড়ি ফিরে নাই এখনও। ”
সে একটু নীরব থাকল। গোঁফে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবল কতক্ষণ। সহসা বলল,
” ডাক্তারের পকেটে দেখ, কী কী আছে। সব ছিনিয়ে নে। ওর বাড়িতেও কাউকে পাঠা। প্রতিটা রুমে তালাশি নিবি। যত রকমের কাগজ পাবি সব গুছিয়ে নিয়ে আসবি। ততক্ষণে আমি ভেতর থেকে আসছি। ”
” ডাক্তার রে কী করমু, মহাজন? ”
” যা খুশি কর, শুধু যেন পালাতে না পারে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। ডাক্তার আল হাদির দিকে এক পলকও চেয়ে দেখল না।
_________
স্বর্ণলতা টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছিল। সহসা আগমন ঘটল মুনছুর সাখাওয়াতের। সে ভেবেছিল, সরাসরি রুমে ঢুকবে। কাপড় বদলাতে হবে, গোসলটাও সারতে হবে। পরনের জামায় দুই ফোঁটা র ক্তের ছাপ পড়েছে। এই অবস্থায় দাদিজান কিংবা স্বর্ণলতা কারও নজরেই পড়তে চাচ্ছিল না। সেই ভাবনাটাও ভুলে গেল, স্বর্ণলতাকে দেখে। সে নিজের মধ্যে নেই। আনমনে হাতের কাজ সারছে। নাহলে তার আগমন টের পেত। পালিয়ে যাওয়ারও ওযুহাত খুঁজত। এই সুযোগটাকে সে হেলায় ফেলতে পারল না। কয়েকপা এগিয়ে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিশোরী বধূর মুখটায়। মাথায় ওড়না নেই, চুলগুলো বেনি করা। গলা, কানে কোনো গয়নাও নেই। অনাড়ম্বর সাজেও কী মায়াবী লাগছে! অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে আচমকা হাদির কথা মনে পড়ল। সেও নিশ্চয় এভাবে চেয়ে থাকত, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত স্বর্ণলতার দেহের প্রতিটি নারী সৌন্দর্যকে! মুহূর্তে মাথায় র ক্ত উঠে গেল। স্বর্ণলতার উদ্দেশ্যে বলল,
” এখানে কী? তোমাকে না কাজ করতে মানা করেছি? ”
তার সম্বিৎ ফিরল। মাথায় ওড়নাটা দিতে দিতে বলল,
” কাজ করলাম কই? আমি তো ভাত বাড়তাছি। ”
” ভাতও বাড়তে হবে না। ঘরে যাও। ”
আশেপাশে কেউ নেই। সে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। দ্রুতপদে দাদিজানের রুমের দিকে অগ্রসর হতেই শুনল,
” ঐ ঘরে না। আমার ঘরে যাও। ”
স্বর্ণলতার পা দুটো থমকে গেল। বুকের জমিনটা প্রচণ্ড বেগে নড়ে ওঠল। পিছু ফিরল না। জবাবও দিল না। পুনরায় সামনে হাঁটা ধরলে মুনছুর সাখাওয়াত ডাকল,
” স্বর্ণলতা, আমার ঘরে যেতে বলেছি। আজ থেকে তুমি আমার ঘরে থাকবে, আমার সাথে ঘুমাবে। ”
চলবে