মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
732

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৭)

” স্বর্ণলতা, আমার ঘরে যেতে বলেছি। আজ থেকে তুমি আমার ঘরে থাকবে, আমার সাথে ঘুমাবে। ”

সে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দাদিজানের রুমের দিকে দৌড় দিল। দরজার পাল্লা ভেজানো ছিল। একহাতে ধা ক্কা দিয়ে বিপন্ন গলায় বলল,
” দাদিজান, আমারে উনার ঘরে যাইতে কইতাছে! ”

খাইরুন নিসা এশার নামাজ শেষ করে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। নাতবউয়ের কণ্ঠস্বরে থামতে হলো। কোরআন বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন,
” কার ঘরে? ”

স্বর্ণলতা হাঁপাচ্ছে। ঘাম ছুটছে কপাল থেকে। নিশ্বাস ফেলছে ঘনঘন। এইটুকু পথ দৌড়ে কাহিল হয়ে পড়েছে। ছোট থেকে সে খেলাধুলায় পারদর্শী ছিল। সবকিছুতে এগিয়ে থাকত, প্রথম হতো। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পর আসতে আসতে দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। শরীর জুড়ে লজ্জা ও আড়ষ্টতা বাসা বাঁধে। অনেকদিন পর এরকম চোখ বন্ধ করে দৌড় দেওয়ায় এই অবস্থা! সে দাদিজানের বিছানায় বসতে বসতে বলল,
” আপনার নাতির ঘরে। কইতাছে, আজ থেইকা উনার ঘরে থাকতে হইবো, একলগে ঘুমাইতেও হইবো। ”

দাদিজানের মুখখানা জ্বলে ওঠল। বিস্ফারিত হলো বার্ধক্য চোখজোড়া। দ্রুত হাতে কোরআন নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। যথাস্থানে রাখতে রাখতে সুধালেন,
” গাধাটা আবার চেতছে কেন? ”
” জানি না, দাদিজান। আমি কিন্তু যামু না। ”

সে দৃঢ়স্বরে নিজ মতামত জানিয়ে দিয়ে এগুল পানির গ্লাসের দিকে। দাদিজানের রুমে থাকলেও তার সব জিনিসপত্র ব্যবহার করতে পারে না। ভুল করেও স্পর্শ করা মানা। বিশেষ করে পানির গ্লাস, কাপড়চোপড়, কাঁথা-বালিশ। প্রবল দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তায় সেই মানা স্বর্ণলতা ভুলে গেল। দাদিজানের গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খাওয়া শুরু করে দিল। খাইরুন নিসাও খেয়াল করলেন না। আপন খেয়ালে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ আশ্বাসের সুরে বললেন,
” যেতে হবে না। তুমি চুপচাপ বসে থাকো। আমি মুনছুরের সাথে কথা বলব। ”

এই সময় দরজার কাছ থেকে মুনছুর সাখাওয়াতের কণ্ঠ পাওয়া গেল,
” কথা বলে লাভ নেই, দাদিজান। স্বর্ণলতাকে আমার ঘরে যেতেই হবে। ”

দুজনে একইসাথে চমকে ওঠল। সচকিত দৃষ্টি গিয়ে আটকাল দরজার পানে। দীর্ঘকায় শরীর ও রুক্ষ বদনের অধিকারী যুবাটি ভেতরে প্রবেশ করল। বুক টানটান, শিরদাঁড়া সোজা, দুইহাত পেছনে। দাঁড়ানোর ভঙ্গি ও অবিচলিত দৃষ্টিতে দাদিজানের গলা শুকিয়ে এলো। স্বর্ণলতা কণ্ঠ পেয়ে পালংকের উপরে ওঠে। একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে চাদর খামচে বসে পড়ে। মুখ গুঁজে রাখে দুই হাঁটুর মাঝে। খাইরুন নিসা এক পলক নাতবউয়ের দিকে চেয়ে নাতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
” জোর করে নিয়ে যাবি? ”
” প্রয়োজন পড়লে করব। ”
” তুই তো চেয়েছিলি, স্বর্ণলতা তোর ঘরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করুক। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাত সামনে আনল। দাঁড়ানোভঙ্গিতে সামান্য শিথিলতা এসেছে। মুখ লুকিয়ে রাখা স্ত্রীটির দিকে চেয়ে বলল,
” এখন মত বদলাচ্ছি। ”
” হঠাৎ কী এমন হলো যে, মত বদলাতে হলো? ”

সে বিরক্ত হলো। রু ষ্ট হয়ে বলল,
” কথা বাড়িও না, দাদিজান। যা বলেছি, তাই হবে। স্বর্ণলতা কোনো পরনারী নয়, আমার স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকবে, এটাই নিয়ম। তুমি কি চাও, সেই নিয়ম ভঙ্গ হোক? ”
” এতদিন তো হয়েছে! আর কিছুদিন হলে সমস্যা কী? মেয়েটা আরেকটু বড় হোক, সম্পর্কের দায়-দায়িত্ব বুঝে নিক। ”
” অনেক বুঝেছে। যেটুকু বাকি আছে, আমি শিখিয়ে দিব। ”

সে স্বর্ণলতার দিকে ফিরল। বলল,
” নিচে নেমে আসো, স্বর্ণলতা। ”

স্বর্ণলতা নিচে নামল না। আরও গুটিয়ে গেল, চাদরটা সর্বশক্তিতে ধরে রাখল। দাদিজান এগিয়ে এলেন। মুনছুর সাখাওয়াতকে আটকানোর আরও একটু চেষ্টা করলেন,
” তুই তো বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকিস না। প্রায় সময় রাতে বাইরে থাকিস। সেইসময় স্বর্ণলতা কী করবে? একা একা ভ য় পাবে না? ”
” এখন থেকে রাতে বাইরে থাকব না। যদি থাকতেই হয়, তাহলে ও তোমার ঘরে থাকবে। সমস্যা নেই তো! কিন্তু আমি যতক্ষণ বাসায় থাকত ততক্ষণ স্বর্ণলতাকে আমার ঘরে, আমার সামনে থাকতে হবে। ”

খাইরুন নিসাকে কথা বাড়ানোর সুযোগ দিল না। পূর্বে সে বলল,
” দাদিজান, তোমার নাতবউকে নিচে নামতে বলো। নাহলে আমি উপরে উঠে যাব। তুমি নিশ্চয় চাও না, আমি এই নোংরা, অপবিত্র অবস্থায় তোমার বিছানা স্পর্শ করি? ”

তিনি তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। বুঝে গেলেন, নাতির সাথে পেরে ওঠবেন না। সে ভীষণ বেপরোয়া ও একরোখা হয়ে আছে। অযথা তর্ক করলে, বাঁধা দিতে গেলে হিং স্র ও ভয়া নক হয়ে ওঠবে। যা তার ও স্বর্ণলতা কারও জন্য ভালো হবেন না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে বললেন,
” জোরাজুরি করার দরকার নেই। তুই যা, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত অমত করল না। মেনে নিল। দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,
” পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। এরমধ্যে না এলে, আমি তুলে নিয়ে যাব। ”

সে বেরিয়ে যেতে স্বর্ণলতা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
” আমি যামু না, দাদিজান। ”

খাইরুন নিসা কাছে এগিয়ে এলেন। বিছানায় উঠে নাতবউয়ের পাশে বসলেন। জলে টলমল অসহায় চোখদুটিতে নীরবে চেয়ে রইলেন। মেয়েটার মুখে ভারি মায়া! স্বভাব-চরিত্র যতটা খারাপ ভেবেছিলেন ততটাও নয়। তার খুব খেয়াল রাখে, চোখে চোখে রাখতে চায়। বুকটার মধ্যে মায়া-মমতাও আছে। মুখটায় তাকালেই মনখারাপ হয়, করুণা হয়। কেন যে, মুনছুরের চোখে পড়ল, বিয়ের বাঁধনে জড়িয়ে পড়ল! প্রবল ইচ্ছে হয়, এই বিয়ের বাঁধন থেকে মুক্তি করে দিতে। ভাগ্য বদলে দিতে। এমন কারও কাছে রেখে আসতে, যার কাছে সে সুখী হবে। শান্তি পাবে। যে সুখ, শান্তি মুনছুর দিতে পারবে না কখনও। সে ভালোবাসে, তীব্র ভালোবাসা টের পায় কিন্তু জোর করেও মনকে বুঝাতে পারে না, স্বর্ণলতাকে সুখী করতে পারবে, সম্মান দিতে পারবে, দু-দণ্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে দিবে!

দাদিজান মাথায় হাত রাখলেন পরম স্নেহে। জিজ্ঞেস করলেন,
” যাবি না কেন? ও তোর স্বামী। স্ত্রীর কাজই হলো স্বামীর কাছাকাছি থাকা। ”
” উনার কাছে থাকলে আমার ভ য় করে, দাদিজান। নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া যায়। মনে হয়, আমি খাঁচায় বন্দি। পাখা থাকলেও উড়তে পারমু না কোনোদিন। ”

খাইরুন নিসার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠল। তার ভাবনাটা কী দারুনভাবে মিলে গেল। এত অল্প সময়েই মেয়েটা তার পরাধীনতা টের পেয়ে গিয়েছে! তিনি সান্ত্বনা দিতে বললেন,
” পারবি। তোর পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল না? ওটা তো পূরণ হচ্ছে। তাছাড়া মুনছুর তোকে কত ভালোবাসে! যদি দেখে খাঁচায় থাকতে কষ্ট হচ্ছে তাহলে ঠিকই মুক্ত করে দিবে। ”
” আপনে আমারে সত্যি ঐ রুমে পাঠাইবেন? ”

দাদিজান সরাসরি উত্তর দিতে পারলেন না। না পাঠিয়ে যে উপায় নেই! ছেলেটা যেমনই হোক, তার একমাত্র নাতি। বংশের শেষ প্রদীপ। তন্মধ্যে খুব ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। মনেপ্রাণে চান, সে সুখী হোক। এতদিন মনে হতো, টাকায় মুনছুরের সুখ। এখন মনে হয় টাকা না, স্বর্ণলতায় সুখ। তার মুখের দিকে তাকালেও দরদে পূর্ণ হয়ে আসে বুকটা। স্বার্থপর হতে বাধ্য করে। ভুলে যেতে ইচ্ছে হয়, স্বর্ণলতার স্বাধীনতাকে। দুজনকে পাশাপাশি দেখলেও যে, খুব আনন্দ হয় তেমনও না। ভীষণ দুশ্চিন্তা হয়। আবার দূরত্ব তৈরি হলেও খারাপ লাগে। নাতি ও নাতবউকে নিয়ে যে মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে, এটা কি কখনও শেষ হবে?

স্বর্ণলতার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল গালে। এত অভিমান হলো! নীরবে পালংক থেকে নেমে এলো। পায়ে পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল সহসা শুনতে পেল,
” শোন, মুনছুরকে বেশি কাছ ঘেষতে দিস না। বাহানা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখিস। তোদের কাছাকাছি আসার সময় হয়নি এখনও। ”

সে নিরুত্তর থাকল। চৌকাঠ পেরিয়ে যাবে তখনই বলল,
” আপনে যদি রা গ না করেন, একটা সত্য কথা কমু। ”
” করব না। বল। ”

স্বর্ণলতা ইতস্তত করে বলল,
” আমার মাসিক হয়ছে। ”

দাদিজান অবাক কণ্ঠে সুধালেন,
” এখন? ”
” না। যেদিন চাঁদনিবু আইছিল তার পরেরদিন। ”
” সর্বনাশ! মুনছুর জানে? ”

স্বর্ণলতা চুপ হয়ে গেল। আঁখি যুগল নামিয়ে নিতে তিনি বললেন,
” ঝামেলা তো বাড়িয়ে দিলি! ”

তিনি উদ্বিগ্ন চিত্তে নিচে নেমে এলেন। নাতবউয়ের কাছে এসে বললেন,
” এখন তো বাহানাও কাজ করবে না! ”

সে চোখ তুলে কৌতূহলী গলায় বলল,
” ক্যা? ”
” ওটা তো এমনি পাগল! ”

স্বর্ণলতার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে সুধাল,
” পাগল মানে? উনার মাথায় গণ্ডগোল আছে? ”
” ধুর মেয়ে! ঐরকম পাগল না। ”
” তাইলে? ”

খাইরুন নিসা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এই বিষয়ে কথা বলার জন্য চাঁদনিকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি শহুরে মানুষ, শিক্ষা-দীক্ষাও পূর্ণ। অল্প বয়সে বাচ্চা নিলে কী কী স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে, সবটায় জানেন। মুনছুর সাখাওয়াত সেদিন বড় গলায় নির্লজ্জের মতো বলেছিল, এই ব্যাপারটা সে দেখবে। আদৌ মনে আছে নাকি কে জানে! বাচ্চা জন্মনিরোধকের বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। ছেলেটা কি জানে? গ্রহণ করেছে কিছু? বাড়ির কাছাকাছি কোনো ঔষধেরও দোকান নেই যে, তিনি আনিয়ে দিবেন স্বর্ণলতাকে! তিনি মহাবিপদে পড়েছেন, এমন মুখ করে আছেন। এই সময় দূর হতে ডাকটা শুনলেন,
” দাদিজান, ও কে আসতে দাও। সময় নষ্ট করছ কেন? ”

তিনি অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়লেন। মুনছুর সাখাওয়াত সেই দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করল না। এগিয়ে এলো। স্বর্ণলতার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
” চলো। ”

সে দাদিজানের দিকে তাকাল। ভীষণ অসহায় ও কাতর দৃষ্টি! কোনোরূপ আশা, ভরসার প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল, মুনছুর সাখাওয়াতের রুমের দিকে।

_______
স্বামীর ঘরে এসে স্বর্ণলতা কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে গেল। হাত-পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন! শ্বাসকার্যও বন্ধ থাকল কতক্ষণ। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে একটা হাত ধরল। বিছানার কাছে টেনে নিয়ে বলল,
” বসো। ”

সে বসল। মুনছুর সাখাওয়াতও পাশে বসল। সাথে সাথে বেলি ফুলের কড়া গন্ধটা স্বর্ণলতার নাকে লাগল। মুহূর্তে তার স্থগিত দেহ প্রতিক্রিয়া চলমান হয়ে ওঠল। তেজো গলায় বলল,
” কী মাখেন শরীরে? বিশ্রী গন্ধ! দূরে বহেন, আমার বমি আইতাছে। বিয়ার দিনও এইটা মাইখা গেছিলেন, তাই না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত খেল যেন! অপমানে জড়োসড়ো হয়ে এলো দেহ ও মন। এভাবে মুখের ওপর কেউ বলেনি। লজ্জিত গলায় বুঝাতে চাইল,
” আতর মাখি। এটাতে বেলি ফুলের সুবাস থাকে। সৌদি থেকে আনাই। কত দামী জানো? ”
” দাম দিয়া কী হইবো, যদি গন্ধতে বমি আসে? ”

স্বর্ণলতা মুখে হাত দিল, গাল দুটো ফুলিয়ে এমন একটা ভাব করল যে, মুনছুর সাখাওয়াতের মনে হলো সে বমি করে দিবে। চট করে উঠে আসল। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আসলেই বিশ্রী গন্ধ? ”

স্বর্ণলতা মুখে হাত রেখে মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝাল, আসলেই বিশ্রী গন্ধ। মুনছুর সাখাওয়াত চিন্তিত বদনে বলল,
” বউ গন্ধ সয়তে না পারলে তো বিরাট সমস্যা! আচ্ছা, এই বিষয়টা পরে দেখছি। আগে বাইরের ঝামেলাটা মিটিয়ে আসি। ততক্ষণে তুমি বিশ্রাম করো। ”

সে বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায়। স্বর্ণলতা ত্বরিত ডেকে ওঠল,
” শুনেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত থামল। পেছনে ফিরতে স্বর্ণলতা বলল,
” কই যাইবেন? ”
” কাছেই। ”
” না গেলে হয় না? আপনার ঘরে আমার ভ য় করে। ”
” ভ য় করবে কেন? পাশেই তো দাদিজানের রুম। রান্নাঘরে লোক আছে। কান খাড়া করলেই শব্দ পাবে। ”

সে হাল ছাড়ল না। বুকের ভেতরটা কেমন জানি লাগছে! হাঁসফাঁস আর অস্থিরতায় ছেয়ে যাচ্ছে তনু ও মন। মনে হচ্ছে, কাউকে মা রতে যাচ্ছে। লোকটা কী ভ য়ানকভাবে মা রে! নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, বন্য জন্তুদের মতো হিংস্র হয়ে যায়। স্বর্ণলতা দেখেছে, আর্তনাদও শুনেছে কয়েকবার।

” পাই না তো। আমার মনে হইতাছে, এই ঘরে জ্বিন-ভূত আছে। একা পাইলেই খাবলাইয়া ধরবো। আপনি যায়েন না। আপনে কান খাড়া করে দেখেন, গা ছমছম করা একটা শব্দ হইতাছে। এটা জ্বিন-ভূতেরই কাজ। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের এসবে বিশ্বাস নেই। তবুও শ্বাস ধরে রেখে অখণ্ড মনোযোগ রাখল ঘরটায়। সেকেন্ড কয়েক নীরব থেকে বলল,
” বাতাসের শব্দ আসছে। ”

সে এগিয়ে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল। অতঃপর বলল,
” এখন আর শব্দটা নেই। অযথা ভ য় না পেয়ে বিশ্রাম করো। আমি আসছি। ”

স্বর্ণলতা হেরে যেতে পারল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” কারে মা রতে যাইতাছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আবারও থেমে গেল। স্ত্রীর দিকে তাকাতে সে অনুরোধের সুরে বলল,
” মাফ কইরা দেন। মাফ করলে, মাফ পাইবেন। ”

এবার বুঝি চমকে ওঠল। চোখ, মুখ বিস্ময়ের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। সেই সাথে সন্দেহের পানি পড়ল মনের ঘরে। মেয়েটা জানল কীভাবে মা রতে যাচ্ছে? মাফ চাওয়ার কথা বলছে কেন? তাহলে কি সে জেনে গিয়েছে, ডাক্তার আল হাদি তার কাছে বন্দী! মুনছুর সাখাওয়াত মাথা ঝাড়া দিল। স্বর্ণলতার এসব জানার কথা না। ডাক্তারকে তো সে বাড়ির ভেতরে আনেনি, এই বিষয়ে কারও সাথে কথাও বলেনি। সেরকম হলে, দাদিজানও টের পেতেন। তাকে প্রশ্ন করতেন৷ মুনছুর সাখাওয়াত ঠাঁট বজায় রেখে বলল,
” আমার মাফ পাওয়ার দরকার নেই। ”
” আছে। ”
” স্বর্ণলতা, তুমি কিন্তু দেরি করাচ্ছ! ”
” আপনে মাফ করবেন না? ”
” অসম্ভব! ”

স্বর্ণলতা কিছু বলল না। সামনে থেকে সরে এলো। বিছানার এক কোণে বসে অভিমানি সুরে বলল,
” দাদিজান কইছিল, আপনে নাকি ট্যাকার থেইকাও আমারে বেশি ভালোবাসেন। সেইটা যে মিথ্যা, তার প্রমাণ পাইলাম। দেখা হইলে কইয়া দিমু। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলল না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দাদিজানের সাথে দেখা হলো খাবার টেবিলে। বললেন,
” তোরা কি রাতে খাবি না? ”

এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। বড় দরজার দিকে হেঁটে চলে গেল। বারান্দায় পা নামতে গিয়েও নামল না। ফিরে এলো। হেঁটে চলে গেল খাবার টেবিলে। প্লেটে ভাত ও তরকারি বাড়তে বাড়তে বলল,
” স্বর্ণলতা এখন থেকে রুমের মধ্যে খাবে। ”
” কেন? তুই কি ও কে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখতে চাচ্ছিস? ”
” মনে করো তাই। ”
” কী বলছিস! তোর কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে, মুনছুর? ”
” এই মুহূর্তের জন্য তাই। যতক্ষণ না ঠিক হচ্ছে ততক্ষণ আমার সামনে এসো না। ”

সে ভাতের প্লেট নিয়ে চলে গেল নিজের রুমে। স্বর্ণলতা বিছানায় বসে ছিল। চমকে তাকাতে বলল,
” তুমি না বলেছিলে, আমার মধ্যে হৃদয় নেই? হৃদয় ছাড়া ভালোবাসা হয়? দাদিজানের কথাটা সত্যি নাকি মিথ্যা তখনই বুঝে ফেলা উচিত ছিল। ”

স্বর্ণলতার এই সত্য-মিথ্যা বের করায় কোনো আগ্রহ নেই। সে কথাটা বলেছিল, মুনছুর সাখাওয়াতের মনোযোগ পেতে। তার সিদ্ধান্তটা বদলানোর জন্য। জিজ্ঞেস করল,
” আপনের কাজ শেষ? ”
” না। ”
” তাইলে ফিরা আইলেন যে? ”
” ঘুম ধরছে। ঘুম ধরলে আমার কোনো কাজ করতে মন চায় না। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো তো, শুয়ে পড়ি। ”

মানুষটা ফিরে এসেছে দেখে, স্বর্ণলতার ভারি আনন্দ হলো। অন্তত কাউকে তো এই লোকের হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্য রেহাই দিতে পারল! সে দ্বিমত করল না। চুপচাপ খেতে বসে গেল। ভাত মুখে দেওয়া মাত্র মুনছুর সাখাওয়াতের শেষ কথাটা মনে পড়ল,
‘ তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো তো, শুয়ে পড়ি। ‘

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৮)

মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করতে গিয়েছিল। বেরিয়ে দেখল, স্বর্ণলতা খাচ্ছে তখনও। খানিক অবাক হলো। গোসলে যাওয়ার সময় তার খাওয়া প্রায় শেষের পথে ছিল। শেষ অংশটুকু এত সময় ধরে খাচ্ছে? সে দূর হতে তাগাদা দিল,
” তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। ”

স্বর্ণলতা চকিতে তাকাল। তার মুখে ভ য় ও অস্বস্থি। এই মানুষটার সাথে একখাটে, পাশাপাশি সারারাত ঘুমাবে! ভাবলেই লজ্জার পাতলা প্রলেপ পড়ছে মুখজুড়ে। মুখে ভাত নেই, খাওয়ার ইচ্ছে হারিয়েছে অনেক্ষণ আগেই। হাত দিয়ে শুধু নাড়ছিল। এই অযুহাতে যতটা সময় ব্যয় করা সম্ভব ততটাই করবে। সে চমকিত দৃষ্টিজোড়া সরিয়ে নিতে পুনরায় শুনল,
” শুধু নেড়ে যাবে? ভাত খাচ্ছ নাকি গুনছ? ”

স্বর্ণলতার ইচ্ছে হলো কড়া একটা জবাব দিতে। দিল না। মনে বল পাচ্ছে না। যা কিছুই বলুক না কেন শেষমেষ এই দানবটার সাথেই ঘুমাতে হবে! মানুষটা এত আত্মনিমগ্ন, একরোখা! খেয়ালই করছে না সে অল্পবয়সী কিশোরী। বয়স, শরীর সবদিক দিয়েই বড্ড ছোট! এরপরও অন্যকিছু ভাবে কী করে? সে এক পলক তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। বুড়ো লাগছে না। চুল, গোঁফ সবই ঘনকালো, সুঠামদেহের তাগড়া যুবক। চেহারা-সুরতও মন্দ নয়। তবুও চোখে লাগে না, মনে বসে না। একবার তাকিয়ে ফেললে দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে করে না।

স্বর্ণলতা মুখে ভাত নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনে খাইবেন না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় অবধি লম্বা চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। স্ত্রীর প্রশ্ন শুনে মাথাটা ঘুরাল। প্লেট একটা হলেও ভাত ও তরকারি বেশি করে এনেছিল। ভেবেছিল, দুজনে ভাগ করে খাবে। স্বর্ণলতা প্লেট টেনে নিয়ে এমনভাবে খেতে বসল যে, সে লজ্জায় কথাটা বলতে পারল না। নতুন করে নিজের জন্য ভাতও আনতে ইচ্ছে হলো না। একরাত না খেয়ে থাকলে কী হবে? বউটাকে তো পেয়েছে! বিয়ের পর এই প্রথম একসাথে ঘুমাবে। তার হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠল। আনমনে জবাব দিল,
” না। ”
” ক্যা? ”
” আমার ক্ষুধা নেই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করে উদাম শরীরে আতর মেখে অভ্যস্ত। অভ্যাসবশত কাজটা সেরে ফেলার পর স্বর্ণলতার কথাটা মনে পড়ল। গন্ধটা তার পছন্দ নয়। প্রথমবারে পাশাপাশি ঘুমাবে অপছন্দনীয় কিছু থাকলে সময়টা ভালো যাবে না। সে চট করে গোসলখানায় ঢুকে পড়ল। আরও একবার শরীরে সাবান মেখে সেই গন্ধ দূর করল। বেরিয়ে এসে দেখল, স্বর্ণলতার প্লেটে এখনও এক মুঠো ভাত পড়ে আছে। সে এগিয়ে এসে প্লেটটা নিয়ে বলল,
” খেতে না পারলে রেখে দাও। কেউ তো ফাঁসির আদেশ দিয়ে রাখেনি! ”

স্বর্ণলতার বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ দিতে কতক্ষণ? যে মিনিটের মধ্যে একঘর থেকে আরেকঘরের বাসিন্দা বানিয়ে দেয় সে ফাঁ সিও দিতে পারে। আমার তো মনে হয়, আপনি ফাঁ সি পর্যন্তও অপেক্ষা করবেন না গলা টি পে দম বন্ধ করে দিবেন! ‘ বলা হলো না। স্বামীর শান্ত কণ্ঠের আদেশ পেল,
” যাও, হাত ধুয়ে এসো। ”

সে চুপচাপ হাত ধুয়ে এলো। ততক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা ঝেড়ে টানটান করে ফেলল। স্বর্ণলতাকে ইশারা করল শুয়ে পড়ার জন্য। সে ভীরুপায়ে এসে বসল বিছানায়। বালিশ, কাঁথা কিছু নেই৷ জিজ্ঞেস করল,
” বালিশ ছাড়া ঘুমামু? ”
” তোমার তো অভ্যাস আছে। ”
” এখন অভ্যাস বদলায়ছে। ”

অভ্যাস যে বদলেছে, মুনছুর সাখাওয়াতও জানে। স্বচক্ষে দেখেছে। মেয়েটা বালিশ মাথার নিচে দেয় না। বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। সে সুধাল,
” জড়িয়ে ধরার জন্য লাগবে তো? ”

স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিতে পারল না। তার দেহ-মন অবশ হয়ে আসছে যেন! জড়তা নিয়ে মাথা উপর-নিচ করল। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে বলল,
” এরজন্য বালিশের দরকার কী? জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলে পাশে কাউকে পেয়ে যাবে। দাদিজানের মতো তার শুচিবায়ু বাতিক নেই। ”

সে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” শুচিবায়ু কী? ”
” এক ধরনের রোগ। যারা এই রোগে আক্রান্ত থাকে তারা অন্যের স্পর্শকে সহজে নিতে পারে না। বিরক্ত হয়, রে গে যায়। ”
” দাদিজান কোনো রোগী না। উনি পরিষ্কার থাকতে বেশি পছন্দ করেন, তাই অন্য কেউ উনার জিনিসপত্র ধরলে রা গ করেন। ”
” আমি করব না। তোমার ইচ্ছে হলে ধরো। ”
” কী ধরমু? ”
” জড়িয়ে ধরার মতো পাশে কিছু পেলে। ”
” কিছুই তো নাই! ”

স্বর্ণলতা পুনরায় পুরো বিছানায় চোখ বুলাল। মুনছুর সাখাওয়াত তার অন্য পাশে বসল। আস্তে-ধীরে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,
” আছে। ভালো করে খুঁজো। ”

সে আরও একবার চোখ বুলানোর জন্য উদ্যত হতে শুনল,
” বসে থাকলে পাবে না। শুয়ে পড়ো, স্বর্ণলতা। ”

স্বর্ণলতার চেতন ফিরল। সাথে সাথে বুকের ভেতরটায় ধকধক শব্দ হতে লাগল। দানবটা শরীরের উপরের অংশে কিছু পরেনি, শুধু পায়জামা পরে আছে। বুক, পেট সব উন্মুক্ত। মাথাটা হাতের উপর রেখে একপাশে কাত হয়ে আছে। একস্থিরভাবে চেয়েও আছে তার দিকেই। নির্লজ্জ ও নিষ্পলক চাহনি! সেই চোখের দিকে এক পলক চেয়ে স্বর্ণলতা দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। এই এক ঝলকেই মুনছুর সাখাওয়াতের গোপন ষ ড়যন্ত্র ধরে ফেলল। মুহূর্তেই চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল। বিস্বাদ ঠেকছে গলার ভেতরটায়! লজ্জা পাচ্ছে না, ঘৃণা হচ্ছে। লোকটার মূল চাওয়া, লক্ষ্য তো এটাই ছিল। বাস্তবায়ন হতে দেরি এলো একটু এই যা! ভদ্র হওয়ার অভিনয় করছিল। দেখছিল, পাখি নিজে থেকে ধরা দেয় নাকি। দিচ্ছে না তাই জোরজবরদস্তি চলবে এখন। সে গভীর নিঃশ্বাস টেনে ছাড়ল ধীরে ধীরে। অতঃপর বিছানায় বসল। শুয়ে পড়লও আসতে আসতে। একপাশে কাত হয়ে, মুনছুর সাখাওয়াতকে পিঠ দেখিয়ে। চোখদুটি বুঁজারও সময় পেল না। শুনতে পেল,
” শুচিবায়ু বাতিকটা কি তোমাকেও ধরল? ”

দুজন দুইপ্রান্তে শুয়ে আছে। মাঝে বিস্তর ফারাক! তারপরেও কণ্ঠটা এত কাছ থেকে শুনাল! স্বর্ণলতার মনে হলো, লোকটা তার নিকটে। ঘাড়ের কাছে। কান ছুঁয়ে কথা বলছে। সে ভেতরে ভেতরে ছিটকে ওঠল। ভ’য়টা ক্রমশ বাড়ছে, অশান্তির ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এত অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ নিয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকা যায়? ঘুমের দেখা এই জীবনে পাবে বলে মনে হচ্ছে না! সে প্রশ্নটা শুনতে পেলেও সাড়াশব্দ করল না। এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। ঘুমের ভাব ধরে থাকলে কি রক্ষা পাবে?

” এত কিনারে শুয়েছ কেন? পড়ে যাবে তো! আমি দেখেছি, তুমি ঘুমের মধ্যে একজায়গায় স্থির থাকতে পার না। ”

স্বর্ণলতার মিথ্যা ঘুমের ভাবটাও ছুটে গেল। চোখদুটি এমনভাবে খুলল যেন, ভ’য়ানক কিছু শুনে ফেলেছে! এই লোকটার সামনে ঘুমায়নি কখনও, পরিস্থিতি সামাল দিতে শুয়ে ছিল, সেটাও কিছু সময়ের জন্য। তাহলে তার ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া দেখল কীভাবে? প্রশ্নটা মনে উদয় হলেও সে প্রকাশ করল না। চুপচাপ নিথর হয়ে থাকল। এই মুহূর্তে তার সাথে কথা বলা, আদেশ শোনা মনেই তাকে প্রশ্রয় দেওয়া। পরবর্তী ধাপে এগোনোর জন্য উৎসাহি করা।

” স্বর্ণলতা, এদিকে চেপে এসো। নাহলে আমি টেনে আনব। সবকিছুতে জোর করতে বাধ্য করো না। তাহলে তোমার মতামতের গুরুত্ব থাকবে না। মানুষ একই কাজ লাগাতার করতে থাকলে সেটাকে সত্য ও যৌক্তিক হিসেবে ধারণ করে ফেলে। তখন হাজারবার বুঝালেও ধারণার পরিবর্তন আসে না। ”

ঠান্ডা গলার হু মকি! ভ য় দেখানোর তীব্র চেষ্টা। স্বর্ণলতা ভ য় পেল না। যুক্তি খুঁজে নিল। লোকটা যে উদ্দেশ্যে কথাটা বলুক না কেন, খারাপ বলেনি। এত দ্রুত মুনছুর সাখাওয়াতের স্পর্শেও আসতে চায় না। সে সামান্য ভেতরের দিকে চেপে গেল। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব কতটুকু কমেছে জানে না। দেখতেও চায় না। মুখ ফেরালে দানবটাকে দেখতে পাবে। নিশ্চয় কামুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পেছন থেকে যতটুকু পারছে দেখছে, উত্তেজনা তৈরি করছে দেহাভ্যন্তরে!

স্বর্ণলতা হাত-পা কিছুটা গুটিয়ে শুয়েছিল, এখন আরও গুটিয়ে নিল। এতেও ক্ষান্ত হলো না। ওড়নাটা মাথায় প্যাঁচানো ছিল। সাবধানে খুলে যতটা মেলা যায়, মেলল। অতঃপর ধীরে ধীরে শরীরটাও ঢাকতে লাগল। তার এই কর্মকাণ্ড বেশিক্ষণ সহ্য হলো না পাশের মানুষটির। খানিক বিরক্ত সুরে বলল,
” কোমরটা ঢাকেনি তো! পাগুলোও খোলা থেকে যাচ্ছে। এত ছোট্ট ওড়না দিয়ে কি পুরো শরীর ঢাকে? যাও, বোরকা পরে এসো। হিজাব পরতেও ভুলে যেও না। ”

স্বর্ণলতা তার বিরক্তি, কৌতূকটা ধরতে পারল না। সে নিজেকে ঢাকা নিয়ে নিমগ্ন ছিল। ভিন্ন ও উপযোগী সমাধানটাকে পরামর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ফেলল। চট করে উঠেও বসল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, এই ঘরে তার বোরকা নেই। অন্য কোনো কাপড়ও না। সবকিছু দাদিজানের রুমে আছে। মুনছুর সাখাওয়াতের কাছে নির্দ্বিধায় সমস্যাটা প্রকাশও করল,
” বোরকা, হিজাব তো দাদিজানের ঘরে! এই ঘরে আনতে মনে নাই। ”
” তাহলে আমার পাঞ্জাবি পরো। বোরকার চেয়েও বড় হবে। আলাদা করে হিজাব পরতে হবে না, এক পাঞ্জাবিতেই মাথা থেকে পা অবধি ঢেকে যাবে। আমি কিছু দেখতে পারব না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতও উঠে বসল প্রথমে। পর মুহূর্তে বিছানা থেকে নেমে গেল। মেয়েটাকে ঘরে এনেও শান্তি নেই। পাশাপাশি ঘুমাবে ভেবে যে সুখ পাচ্ছিল, সেটাও হারিয়ে যাচ্ছে। একটু হাঁটাচলা করতে স্বর্ণলতার ধীরে খেয়ে সময় নষ্ট করার কারণটাও বুঝে চলে এলো। তার হাঁটার গতি বেড়ে গেল। জানালার কাছে পৌঁছে পাল্লাটা মেলে দিল আচমকা। বাইরে অন্ধকারে চেয়ে আপনমনে চেঁচিয়ে ওঠল, ‘ আমি তোমাকে কোনোভাবে পাচ্ছি না, স্বর্ণা। নরম হয়ে না, গরম হয়েও না। এর বাইরেও কি কোনো পথ আছে? আমি দেখতে পাই না কেন? ‘

” আমার সাথে মজা করছিলেন? ”

স্বর্ণলতার উত্তাপ ছড়ানো কণ্ঠস্বর। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আঁটো ভঙ্গিতে। জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুঁড়ছে। মুনছুর সাখাওয়াত পেছন ফিরল না। এই কণ্ঠস্বর, চাহনি তার পছন্দ হলেও আজ ভালো লাগছে না। আজকের চাওয়াটা ছিল ভিন্ন, নরম-সরম কিছু। সে বাইরে চেয়ে থেকে বলল,
” যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। ”
” আপনি ঘুমাবেন না? ”
” না। ”
” কেন? ”

সে নিঃসংকোচে পরিষ্কার গলায় উত্তর দিল,
” তুমি চাও না আমি ঘুমাই। ”

ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছিল। মুনছুর সাখাওয়াত ইচ্ছে করে নিভায়নি। নতুন ঘর, বিছানা। তাকেও পছন্দ করে না। স্বর্ণলতা যদি ভয় পায়? এই ভাবনা থেকে আলোটা রেখেছিল। এবার সুইচবোর্ডের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বলল,
” দাঁড়িয়ে থেকো না। শুয়ে পড়ো, আমি আলো নিভিয়ে দিচ্ছি। ”

স্বর্ণলতা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত উত্তর দিল না। আলো নিভিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে থেকে দরজায় তালা মারতে ভুলল না।

_______
ডাক্তার আল হাদিকে মাফ করার প্রশ্নই ওঠে না। স্ত্রীর মন রাখতে মুনছুর সাখাওয়াত রুমে থেকে গিয়েছিল। স্বর্ণলতার সাথে তার প্রথম রাতযাপন। ভেবেছিল, খুশি হবে। নিজে থেকে দূরত্ব না কমালেও বাঁধা হবে না। মেয়েটা বাঁধা হলো। মন ও শরীর উভয়কেই রাগিয়ে তুলল। এতটুকু মেয়ের কাছে সে বার বার পরাস্ত হচ্ছে। কোনোভাবেই সামনে আগাতে পারছে না। এই ব্যর্থতা তাকে বেলা বেলায় পুড়াচ্ছে!

মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। উঠোনে নামতে দেখল, গেইটটা খোলা। আশেপাশে মানুষজন নেই। আবুল কোথায়? তার তো দিন-রাত বাঁধা সময়। গেইট ছেড়ে কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই। খাওয়া, ঘুম সব সেখানেই। বিস্তীর্ণ উঠোন। দূর থেকে পরিষ্কার বুঝাও যায় না। সে হাঁটার গতি বাড়াল। বড় বড় কদম ফেলে মিনিটের মধ্যে পৌঁছে ফটকের নিকটে। বাইরে দৃষ্টি পড়তে বিস্ময়ে হতবাক! আলামিন ও পান্না মাটিতে লুটিয়ে আছে। পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। শার্ট দিয়ে হাত ও প্যান্ট দিয়ে পা বাঁধা। একটু দূরে, রাস্তার কিনারে আবুলকে পাওয়া গেল। সে কান ধরে ওঠবস করছে। তার শার্ট খুলেও হাত বাঁ ধা হয়েছে কিন্তু প্যান্ট খোলা হয়নি। তাই পা দুটো আলগা, উঠবস করতে সুবিধা হচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে হুং কার ছাড়ল,
” শু য়োরের বাচ্চা! গেইট ফেলে ওখানে কী? কার কথাতে তুই কান ধরে উঠবস করছিস? এদিকে আয়, তোর কানদুটো আমি হাত দিয়ে ছিঁড়ব। ”

তার রা গের মাত্রা বাড়ল। মুহূর্তে চোখ, মুখ ও বস্ত্রহীন বুকটা রক্তিম হয়ে ওঠল। কিছুতেই সামাল দিতে পারছে না যেন! ঘামছে ও কাঁপছে। এই সময়ে এই পরিস্থিতি তার প্রত্যাশিত ছিল না। মাটিতে পড়ে থাকা আলামিন ও পান্নার পিঠ বরাবর লা থি মারতে মারতে বলল,
” এদের এই অবস্থা করল কে? আমার বাড়িতে এসে আমার লোকদের বেঁধে ফেলে দিয়ে যায়! এত বড় বুকের পাটা কার হয়েছে? ”

তৎক্ষনাৎ উত্তর এলো,
” আমার। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি ছুটে গেল রাস্তার কিনারে। যেখানটায় আবুল কানধরে ওঠবস করছিল। একটা মানব ছায়া বেরিয়ে এলো আঁধার থেকে। গেইটের কাছে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলো মুখে পড়া মাত্র সে চমকে ওঠল। অবিশ্বাস্য ঠেকছে। আলোতে ধরা পড়া মুখটা ডাক্তার হাদির। তার শরীরেও কাপড় নেই। হাতে একটা লাঠি। সেটা নিয়ে আরও কয়েক কদম এগিয়ে এসে থামল। তার চলনবলনে ভ য় নেই, দুর্বলতাও নেই। চোখের তারা দুটিও দারুন উজ্জ্বল! মুনছুর সাখাওয়াত হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ওঠে বলল,
” তোর মৃ ত্যু আমার হাতেই আছে। এজন্যেই একের পর এক দোষ করে যাচ্ছিস! দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আয়। প্রথমে তোর বুকের মধ্যে হাত ঢুকাব! ”

তার এই ভারী হু মকিধামকিকে ডাক্তার হাদি পাত্তা দিল না। সামনে এক কদমও আগাল না। হাত থেকে লাঠি ফেলে দিয়ে বসে পড়ল। এখানে দুটো মোটা কাগজের বাক্স আছে। ভেতরে অসংখ্য কাগজপত্র। এগুলো তার বাড়ি থেকে আনা হয়েছে। সে দুইহাতে ভেতরে হাতড়াতে লাগল। হন্ন হয়ে খুঁজছে কিছু। মুনছুর সাখাওয়াত তার এই আচরণেও চমকাল। বিভ্রান্তে পড়ে গেল বোধ হয়! কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। অবাক চোখে চেয়ে দেখছে, ডাক্তারের কার্যকলাপ।

প্রায় মিনিটখানেক সময়ের মধ্যে ডাক্তার হাদি কতগুলো কাগজ গুছিয়ে ফেলল। সেগুলো নিয়ে মুনছুর সাখাওয়াতের কাছে দৌড়ে এলো। তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” এই নিন। এগুলোই চেয়েছিলেন তো? নিয়ে নিন। তারপরেও আমাকে যেতে দিন। আমার বোনটা অসুস্থ! হসপিটালে ভর্তি হয়ে পড়ে আছে। পাশে থাকার মতো কেউ নেই। এই গ্রামে ওর আপন বলতে একমাত্র আমি। দয়া করুন, মহাজন। আপনার যদি আমার কাছে আরও কিছু চাওয়ার থাকে। বলবেন, আমি বিনা বাক্যে দিয়ে দিব। ”

তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠল। চোখ জোড়া অশ্রুতে টলমল। স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। শ্বাস ছাড়ছে শব্দ করে। মুনছুর সাখাওয়াত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব লক্ষ্য করার পরেও মন গলল না। বলল,
” এত সহজে ছেড়ে দিই কী করে, ডাক্তার? তুই তো একটা অপরাধ করিসনি! ”
” তাহলে সময় দিন। আমার বোনটা সুস্থ হলে আমি নিজে থেকেই আপনার কাছে ধরা দিব। যত ইচ্ছে হয় মা রবেন। ”

আলামিন ও পান্না শুয়ে থেকে তাদের দেখছিল, কথা শুনছিল। এই পর্যায়ে পান্না চেঁচিয়ে ওঠল,
” ছাইড়েন না, মহাজন। পালাইবো। ওরে চিনেন না, এক নাম্বারের হারামি! সাহস দেখছেন? আমগো বাইন্ধা রাখছে! ”

ডাক্তার হাদি তার দিকে উবু হলো। হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে মিনতিপূর্ণ গলায় বলল,
” ভুল হয়েছে, পান্না ভাই। মাফ করেন। মহাজনের আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে ভ য় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আপনারা আমাকে মে রে ফেলবেন! ”

প্রথমে পান্না, তারপরে আলামিনের বাঁধন খুলে দিল। দুজনে উঠে দাঁড়িয়েই আ ক্রমণ করল ডাক্তার হাদির ওপরে। দুইপাশ থেকে চেপে ধরে মহাজনের উদ্দেশ্যে বলল,
” ধইরা ফেলাইছি, মহাজন। কী করতে হইব, কন। গলাটা ফালাইয়া দিমু? ”
” না, ছাড় ও কে। ”

দুইজনেই হতভম্ব হয়ে গেল। একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করল। অতঃপর সন্দেহি গলায় সুধাল,
” সত্যি ছাইড়া দিমু, মহাজন। ”
” হ্যাঁ, ছাড়। ”

তারা ছেড়ে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এলো ডাক্তারের দিকে। হাতের মুঠোয় দুমড়েমুচড়ে থাকা কাগজগুলো নিতে নিতে বলল,
” তোকে নিয়ে কী করব, ঠিকঠাকমতো ভাবি। যতক্ষণ না ভেবে পাচ্ছি ততক্ষণ তুই মুক্ত। ”

সে কৃতজ্ঞ চোখে এক ঝলক চেয়ে রাস্তার দিকে দৌড় দিল। মুনছুর সাখাওয়াতও দাঁড়িয়ে থাকেনি। বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। নিজের রুমের দরজার তালা খুলতে খুলতে ভাবছে, স্বর্ণলতা ভ য় পায়নি তো! প্রথমবার বের হওয়ার সময় ভ য়ের কথা জানিয়েছিল, পাশে থাকতে অনুরোধ করেছিল। পরেরবার জানানোর সুযোগ পায়নি। আলোটাও নিভিয়ে দিয়েছিল। এতক্ষণে মনে হলো, এটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। একা, অন্ধকার রুমে রেখে বাইরে থেকে আটকানো উচিত হয়নি। যদি সত্যি ভ য় পেয়ে থাকে, পালানোর সুযোগটাও পায়নি। এখন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেই হয়। মেয়েটার তো জ্ঞান হারানোর অভ্যাসও আছে!

মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদি তালা খুলে দরজায় ধাক্কা দিল, খুলল না। জোর বাড়িয়ে পুনরায় ধাক্কা দিল, এবারও না খুলতে বুঝে গেল দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। সে ডাক দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েও থেমে গেল। ডাকল না, কোনো রকম শব্দও করল না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেসে ফেলল। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ বোরকা না পরেও নিজেকে গোপন রাখার ব্যবস্থাটা করেই ফেললে! স্বর্ণা, তুমি জানো না। তোমার এই কাজগুলো আমাকে কতটা মুগ্ধ করে! ‘

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪৯)

মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদি তালা খুলে দরজায় ধাক্কা দিল, খুলল না। জোর বাড়িয়ে পুনরায় ধাক্কা দিল, এবারও না খুলতে বুঝে গেল দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। সে ডাক দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েও থেমে গেল। ডাকল না, কোনো রকম শব্দও করল না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেসে ফেলল। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ বোরকা না পরেও নিজেকে গোপন রাখার ব্যবস্থাটা করেই ফেললে! স্বর্ণা, তুমি জানো না। তোমার এই কাজগুলো আমাকে কতটা মুগ্ধ করে! ‘

____
খাইরুন নিসার রুমে পানি নেই। স্বর্ণলতাও রুমে নেই। একা ঘুমিয়েছিলেন, সহসা ঘুম ভেঙে গেল। পানির পিপাসা পেল। গ্লাস ও জগ দুটোই খালি! পানি এনে রাখার দায়িত্বটা নাতবউ পালন করে এসেছে। কখনও বলতে হয়নি, অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে নেই, কাউকে দিয়ে যে পানি আনিয়ে রাখবে এটাও মনে ছিল না। বাধ্য হয়ে জগটা নিয়ে বের হতে হলো পানির উদ্দেশ্যে। বসার রুমের আলোটা সবসময় জ্বালিয়ে রাখা হয়। সেই আলোতে নাতিকে দেখতে পেলেন, রুমের বাইরে। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হলেন! দ্রুত কদমে কাছে পৌঁছে বললেন,
” একা একা হাসছিস কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চমকাল না। লজ্জাও পেল না। দাদিজানের দিকে তাকাল স্বাভভিকভাবেই। দরজা থেকে মাথাটা আলগা করতে করতে বলল,
” হাসছি না তো। ”
” হাসতে হাসতে বলছিস, হাসছি না। তোর হয়েছেটা কী? সত্যি করে বলতো, মুনছুর। ”

সে জবাব দিল না। দাদিজানের দিকে চেয়ে থাকল শুধু। আচমকা জড়িয়ে ধরল। কাঁধে মাথা ফেলে গভীর নিঃশ্বাস টানল। অতঃপর ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
” জানি না, দাদিজান। কিন্তু মাঝেমধ্যে টের পাই, আমি আমার মধ্যে নেই। হারিয়ে গেছি কোথাও। তখন এই শরীরটা এত হালকা লাগে! মনে হয়, হালকা বাতাস লাগলে উড়ে যাব। ”

খাইরুন নিসা নাতির পিঠে হাত রাখলেন। সস্নেহে মর্দন করতে করতে সুধালেন,
” আজকেও এমন মনে হয়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদিতে কিছু বলল না। ভাবল কিছুক্ষণ। সঠিক সময়টা খুঁজছে, পাচ্ছে না। কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে! ডাক্তার হাদি ও স্বর্ণলতা উভয়ের মুখটায় ঘনঘন মনে পড়ছে। কার সাথে থাকা অবস্থায় এরকম অনুভূতিটা হয়েছিল? সে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারল না। বিরক্ত হয়ে ওঠল। দাদিজানকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
” সব কথা তোমাকে বলতে হবে? যে কাজে এসেছ সেটাই করো না! ”

সে সামনে হেঁটে এলো। যে রুমটায় স্বর্ণলতা ও চাঁদনি কিছুদিন থেকেছিল, সেই রুমের তালা খুলল। ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। আজ এই রুমে ঘুমাবে। মনের বদল না হলেও রুমের বদল হয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত এতেই খুশি হলো। হৃদয় নতুনভাবে পুলকিত হলো। বিছানায় উঠতে উঠতে কল্পনা করছে, এখানে তার কিশোরী বউটা ঘুমিয়েছে! বিছানার যে পাশে স্বর্ণলতা শুয়ে থাকত, সেই পাশটাতে সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখদুটি বন্ধ করতে মনে পড়ল, স্বর্ণলতাকে প্রথম দেখার ঘটনাটি। শীত শীত রাত। সারাদিন খুব বৃষ্টি হলো, একটানা! ঝড়-ঝাপটায় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়েছে। কারও বাড়ির চাল উড়ে গেছে। মুনছুর সাখাওয়াত সেদিন বাড়িতে, নিজের রুমে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ খবর এলো, ইকবাল হাসান বাড়ি ঢুকেছে। চুপিচুপি, গামছায় মুখ ঢেকে। মুনছুর সাখাওয়াত সটান উঠে বসল। ঘুম, শীত, বৃষ্টির তান্ডব সবকিছুকে ভুলে বাড়ি থেকে বের হলো। ইকবাল হাসানকে ধরতেই হবে। কথা দিয়ে কথা রাখেনি! একলাখের মতো নগদ টাকা ধার নিয়েছে। দুইবারে। একমাসের চুক্তিতে। সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল, শোধ করতে পারেনি। ধরতেই জমির কাগজ জমা রেখে আরও টাকা চাইল। এবার চুক্তিতে নতুন শর্ত যোগ হলো। দুই মাসের মধ্যে পুরো টাকা শোধ না হলে তার ভিটে মহাজনের অধিকারে চলে আসবে। সেই টাকা তিন মাসেও পেল না। একবার দেখা পর্যন্ত করেনি! মুনছুর সাখাওয়াত লোক পাঠিয়েছিল, ধরে আনার জন্য। পায়নি, গ্রাম ছেড়ে ভেগেছে। চুক্তি অনুযায়ী ইকবাল হাসানের বসতবাড়ি ও জমিটুকু তার। চাইলে দখল করতে পারে কিন্তু করছে না। সে চাচ্ছিল ঋণগ্রহীতাকে উপস্থিত রাখতে। অপদস্ত করা যাবে। পলায়ন করারও শাস্তি দিবে। এসব কিছু করবে তার বাড়ির লোক ও প্রতিবেশির সামনে। এই পৈ শাচিক পরিকল্পনা সফল করতে ছুটল ইকবাল হাসানের বাড়িতে। তিনি ঘরে ছিলেন, দরজা আটকে ঘুমাচ্ছিলেন। মুনছুর সাখাওয়াত উঠোনে দাঁড়িয়ে পান্নাকে আদেশ করল,
” ডাকতে হবে না। দরজায় লা থি মার। এক লা থিতেই যেন দরজাটা ভেঙে পড়ে। ”

পান্না আদেশ মোতাবেক দরজায় লা থি মারল। এক লা থিতে দরজা ভাঙল না। সে আরও একটা লা থি মারার জন্য পা তুলতেই দরজা খুলে গেল। দরজা খুলেছে শবনম বেগম, ইকবাল হাসানের স্ত্রী। তাকে দেখে ভ য়ে পেছনে সরে গেল। ধা ক্কা খেল স্বামীর সঙ্গে। মুনছুর সাখাওয়াত পেছন থেকে হুং কার ছাড়ল,
” পুরুষ মানুষ হয়ে বউয়ের পেছনে লুকায়! ছাগলটাকে ধরে নিয়ে আয়। কুরবানি দিব। তারপরে গাছের সাথে উল্টা লটকিয়ে চামড়া ছাড়াব! ”

পান্নার সাথে আরও দুটো ছেলে ছিল। তিনজনে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। ইকবাল হাসানকে টেনে বের করে নিয়ে আসল বাইরে। শবনম বেগম চুপচাপ দেখতে পারছিলেন না। কেঁদে ফেললেন। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মহাজনের সামনে হাত জোড় করে অনুরোধ করতে লাগলেন,
” মাফ করেন, মহাজন। উনারে ছাইড়া দ্যান। তিনটা পোলা মাইয়া আছে। ওগোরে নিয়া পথে বইতে হইব! ”

মহাজন পাষণ্ডের মতো বলল,
” এই বেটিরে আগে বাঁধ। ”

শবনম বেগমকেই প্রথমে বাঁধা হলো। তারপরে ইকবাল হাসানকে। মুনছুর সাখাওয়াত পরবর্তী আদেশ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তখনই ঘর থেকে দুটো ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এলো। দুজনের চোখেই ঘুম। ঠিক করে হাঁটতে পারছে না। এলোমেলো পা ফেলছে। মেয়েটি বড় হওয়া সত্ত্বেও ছোট ভাইকে জড়িয়ে আছে, কাঁপছে। মুখ থেকে সমানে লালা ঝরছে! সে ভারি বিরক্ত হলো, ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” আরেকটা কোথায়? পান্না, ভেতরে যা। ওটাকে বের কর প্রথমে। তারপরে জিনিসপত্র বাইরে বের কর। ঘরটা আজকেই দখলে নিব। ”

সে আদেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার করল,
” এটাও তো মাইয়া, মহাজন। ঘুমাইতাছে। ডাকি, হুনে না। টাইন্যা তুলমু? ”

মুনছুর সাখাওয়াত খানিক এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। এত ভ য়ঙ্কর পরিস্থিতেও কেউ ঘুমায় কীভাবে? মরে-টরে যায়নি তো! তাহলে আরেক ঝামেলা হবে। সবাই ভাববে সে মে রেছে। অথচ হাত লাগায়নি। মুখটাও দেখেনি! খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” না। আমাকে দেখতে দে। তোরা জিনিসপত্র বাইরে ফেল। ”

পান্না চৌকি থেকে নামল লাফিয়ে। অন্যান্য জিনিসে হাত লাগাল। মুনছুর সাখাওয়াত ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। চৌকিতে নজর রাখতে তার দৃষ্টি আটকে গেল। চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী। কী সুন্দর মুখ! কুপির আলোতে ঝলমল করছে। ঠোঁটদুটি অনবরত কাঁপছে। হাত, পা গুটিয়ে এনেছে পেটের কাছে। এমন করে কেউ ঘুমায়? মেয়েটির শরীরে হাড় নেই নাকি! সন্দেহটা উদয় হওয়া মাত্র মেয়েটি কেঁপে ওঠল! মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে চেঁচাল,
” পান্না, এত শব্দ করছিস কেন? বাইরে যা। এখনই। ”

সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সহসা আদেশ দিল,
” দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যা। ”

শবনম বেগম বাঁধা অবস্থায়ও ঘরের দিকে চেয়েছিলেন। দরজা খোলা থাকায় সবই দেখছিলেন কিন্তু শুনতে পারছিলেন না। আচমকা পান্নার বেরিয়ে আসা, দরজা লাগানো দেখে তার পিল চমকে ওঠল। অমঙ্গলের ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন বোধ হয়। দূর হতেই চিৎকার করলেন,
” স্বর্ণা! স্বর্ণারে ছাইড়া দ্যান। ওই ছুডু মানুষ, জ্ঞান নাই। জ্বরে পড়ছে। মহাজন, ওই তো কিছু করে নাই। ছাইড়া দ্যান, মাইয়াডা মইরা যাইব। ”

পান্না দৌড়ে এসে শবনমের মুখ চেপে ধরে বলল,
” চুপ, ব্যাডি! গলা ফাটানো বন্ধ কর। মহাজন মাইয়া মানুষ ছোঁয় না। ”

ইকবাল হাসানের মুখ ফুটল এতক্ষণে। প্রশ্ন করল,
” তাইলে দরজা লাগাইয়া কি পূজা করতাছে? ”

পান্না তার নাকে ঘু ষি মারল। এসবের কিছুই দেখল না মুনছুর সাখাওয়াত। ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে স্বর্ণলতার মুখটায়। বাইরে লালা ফেলা মেয়েটির সাথে চেহারায় বেশ মিল। কিন্তু গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল, মুখটাও পরিচ্ছন্ন। খুব কোমল। পবিত্র দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেন! ঠোঁটের কাঁপন থামেনি তখনও। শরীরটাও মৃদু কাঁপছে! শীত করছে কি? সে চট করে দরজা মেলে দাঁড়াল। বাইরে উঁকি দিয়ে ডাকল,
” পান্না? ”

সে ডাক পেয়ে ছুটে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত দেখতে পেয়ে বলল,
” দাদিজানের চাদরটা গাড়িতে ফেলে এসেছি। নিয়ে আয়। ”

পান্না চাদর এনে দিয়ে সতর্ক করল,
” মহাজন, মাইয়াডা জ্বরে পড়ছে কিন্তু। ”

মুনছুর সাখাওয়াত উত্তরে কিছু বলল না। নীরবে চাদরটা নিয়ে দরজা আটকাল নিজ হাতে। সিটকানি তুলে দিয়ে স্বর্ণলতার কাছে বসল। চাদরের ভাঁজ খুলে পুরো শরীরে মেলে দিল। সাথে সাথে কাঁপুনি থেমে গেল। সে কপাল স্পর্শ করে তাপমাত্রা মাপল। ভীষণ গরম! এই সময়ে স্বর্ণলতা নড়ে ওঠল। গড়িয়ে দূরে সরে গেল। ঘুমের মধ্যেই, অচেতনে। মুনছুর সাখাওয়াতের মনে হলো, মেয়েটা বিছানার মাঝে ছিল। এটুকু সময়ে কিনারে এসে পড়েছে। ঘুমিয়ে শান্তি পাচ্ছে না নাকি? সে আবারও নড়ে ওঠল। গড়িয়ে চলে গেল একেবারে কিনারে। নিচে পড়েই যাচ্ছিল, তখনই মুনছুর সাখাওয়াত হাত বাড়াল। স্বর্ণলতার কোমর চেপে ধরে আটকে ফেলল গুটিশুটি মেরে থাকা শরীরটা। একটা রাম ধ মক দিতে চেয়েও পারল না। কেমন করে যেন নিজেকে সামলে ফেলল! এত সহজে জবান নিয়ন্ত্রণে চলে এলো? নিজের আচরণে নিজেই আশ্চর্য হচ্ছে।

মুনছুর সাখাওয়াত অনেকটা সময় এভাবে বসে আছে। স্বর্ণলতার কোমর থেকে হাত সরায়নি। দরুন চাদরের উপর দিয়েও তার শরীরের উষ্ণতা, কমনীয়তা অনুভব করতে পারছিল। এই অবস্থায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। স্বর্ণলতাকে বিছানার মাঝে এনে শুয়িয়ে দিল। অতঃপর দরজা খুলে বেরিয়ে এসে শবনম বেগমের বাঁধন খুলে দিল। চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়ে ইকবাল হাসানকে নিয়ে দলবলসহ এই বাড়ি ত্যাগ করল। রাস্তার মধ্যে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
” তোর মেয়েকে আমি বিয়ে করব। কালকেই। বিনিময়ে তোর কী লাগবে বল। আজই পেয়ে যাবি। ”

_______

স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙল দাদিজানের ডাকে। দরজায় ক্রমাগত ঠকঠক শব্দ করছে। ঘুম চোখে উঠে বসল। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াতেই তিনি মোবাইল বাড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
” তোমার ভাই কথা বলবে। ”

বর্ণ কল করেছে! স্বর্ণলতার কান বিশ্বাসই করতে পারল না। মনে হলো ভুল শুনেছে। তার ঘুম ছুটে গেল। সন্দেহি গলায় জিজ্ঞেস করল,
” কে কথা কইব? ”
” তোমার ভাই। নাম বলল, সুবর্ণ। ”

সে চমকে ওঠল। চোখ বড় বড় করে তাকাল প্রথমে। পরক্ষণেই হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কানে ধরল। উত্তেজিত হয়ে সুধাল,
” বর্ণ নাকি রে? কেমন আছিস, ভাই? ”
” ভালা না। ”
” ক্যান? কী হয়ছে? ”
” জানি না, আফা। তোমার বান্ধুবীর খোঁজ-খবর পাইতাছি না। অশান্তি লাগতাছে! ”
” কে? বেহালা? খোঁজ-খবর পাবি না ক্যান? বাড়িত ঢুকতে দেয় না? ”
” উনি তো বাড়িত নাই! ”
” তাইলে? ”
” হাসপাতালে। হুনছি, খুব অসুখে ধরছে। ঐখানেই থাকতে হইতাছে। আফা, তুমি আমারে নিয়া যাবা? ”
” আমি? ক্যামনে? আমার তো গেইটের বাইরে যাওয়াও মানা। ”
” তাইলে ঠিকানা কইয়া দেও। আমি একাই যামু। আমার কাছে ট্যাকা আছে। ”
” কই পাইলি? ”
” এতকিছু জাইনা কি হইবো? ঠিকানা কও। ”
” তুই একা যাবি? ”
” হ। ”
” অনেক দূরের রাস্তা! হারাইয়া যাবি। আমি নিয়া যামুনে। বাড়িত বইয়া থাক, একটু পরে কল দিতাছি। ”

মোবাইল দিয়ে খাইরুন নিসা নিজের রুমে ফিরে গিয়েছিল। দরজা খোলা পেয়ে স্বর্ণলতাও বেরিয়ে এলো। দাদিজানকে পেল তার রুমে। মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,
” আপনার নাতি রে দেখতাছি না! কই গেছে, দাদিজান? ”
” জানি না। আমাকে বলে যায়? ভোর বেলায় বেরিয়েছে। নামাজ পড়ার সময় গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ”

_______
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়িতে এলো দুপুরের দিকে। স্বর্ণলতা দাদিজানের রুমে ছিল। জীপ ঢোকার শব্দ পেয়েছে। সে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে নিশ্চিত হলো। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে। স্বর্ণলতার ইচ্ছে হলো এখনই দৌড় দেয়, দিল না। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করল। বাইরে থেকে এসেছে মন-মেজাজ কেমন আছে জানে না। সুযোগ বুঝে কথাটা পাড়তে হবে। রাজিও করাতে হবে। বেহালার জন্য তার মনেও অশান্তি হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় সকালে ভালো করে খেতে পারেনি। মেয়েটার সাথে শেষবার দেখা হয়েছিল, এই বাড়িতেই।

স্বর্ণলতার ধৈর্য বেশিক্ষণ টিকল না। চঞ্চল পা জোড়া ছুটিয়ে নিয়ে গেল স্বামীর রুমে। দরজা ভেজানো আছে। সে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসা। সামনে একটি বাক্স। সেখান থেকে সাদা রঙের কিছু নিয়ে হাতে প্যাঁচাচ্ছে। একটু ভালো করে নজর দিতে চিনে ফেলল, ব্যান্ডেজ! সামনে এগুতে এগুতে আচমকা বলল,
” হাতে কী হয়ছে? দেখি! ”

মুনছুর সাখাওয়াত চট করে হাত পেছনে লুকিয়ে ফেলে বলল,
” ওখানেই দাঁড়াও। তুমি না র ক্ত দেখতে পার না? ”
” র ক্ত! আপনার হাত থেইকা র ক্তও পড়তাছে? ডাক্তার দেখাইতে হইবো তো। চলেন জেলা হাসপাতালে যাই। ”

সে কী একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। ভ্রূ জড়ো বাঁকিয়ে চেয়ে আছে স্ত্রীর পানে। মাথার মধ্যে কী চলছে, বুঝার চেষ্টা করছে। মুনছুর সাখাওয়াত জানে, তাকে পছন্দ করে না। তার উপস্থিতিতেও বিরক্ত হয়। সেই মেয়ে হঠাৎ করে তার হাত নিয়ে পড়েছে। দরদ দেখাচ্ছে! হজম হচ্ছে না বিষয়টা। সহসা মনে পড়ল, স্বর্ণলতা জেলা হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে। কেন? ডাক্তার হাদি ঐ হাসপাতালেই আছে। রোগি দেখে। তার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে না তো? সে চায় না স্ত্রীকে সন্দেহ করতে, আবার না করেও পারছে না। আপনাআপনি জন্মে যাচ্ছে যেন!

মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” জেলা হাসপাতালেই যেতে হবে কেন? ”
” ওইখানে বেহালাও ভর্তি আছে। আপনার হাত দেখানোর পরে ওর লগেও একটু দেখা কইরা আসতাম। শুনছি, কঠিন রোগ ধরছে। ”

সে গোপনে শ্বাস ছাড়ল। সেই শ্বাস সন্দেহের পুরোটায় নির্গত হয়ে গেল বোধ হয়। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কীভাবে জানলে? ”
” আমার ভাই কইছে। দাদিজানের নাম্বারে কল করছিল। আমগো লগে ওরেও নিয়া যাই? ”
” না। কারণ, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। ”
” ক্যান? ”
” তুমি এই রুম থেকে বের হয়েছ কেন? আমার থেকে অনুমতি নিয়েছিলে? এটা তোমার শাস্তি। আমার কথা না শুনলে, আমিও তোমার কথা শুনব না। ”

স্বর্ণলতার ভারি মনখারাপ হলো। মুখ ফুলিয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে রইল। মুনছুর সাখাওয়াত এই সুযোগে হাতের ব্যান্ডেজটা শেষ করল। ফার্স্ট এইডের বাক্সটা গুছাতে গুছাতে মনে মনে বলল, ‘ তোমার মুখ দেখাটা জরুরি না, পাশে থাকলেও আমি শান্তি অনুভব করি। ‘

_______
বেহালা প্রায় সুস্থ। হাসপাতাল থেকে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। পালানোর চেষ্টা করেও পারছে না, ভাইয়া সর্বক্ষণের জন্য একজন নার্স রেখে দিয়েছে। একটা রুমে, একটা মানুষের সাথে কতক্ষণ থাকা যায়? মানুষটাও অপরিচিত। মাঝেমধ্যে দরজার কাছে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে। পাশের রুমেও একজন ভর্তি আছে। তার সাথে সারাক্ষণই কেউ না কেউ থাকছে। পরিবারের কেউ। আপন মানুষ। অথচ তার সাথে থাকছে একজন নার্স! ভাইয়া মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসলেও বেশিক্ষণ থাকছে না। বেহালার বাবার কথা মনে পড়ল, মায়ের কথাও। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে একজন কল করেছিল। জানাল, বাবা আবার বিয়ে করেছে। সত্য নাকি মিথ্যা জানে না। ভাইয়ার সাথেও এটা নিয়ে কথা হয়নি। আগ্রহই পেল না!

আজও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সহসা নজরে পড়ল সুবর্ণকে। করিডোর পেরিয়ে এদিকেই আসছে। সাথে আরও একটি ছেলে। বয়সে অনেক বড়। দুই হাতে বিশাল দুটো ঝুড়ি! দুটোতেই নানা রকমে ফল। তাকে অবাক করে দিয়ে সুবর্ণ বলল,
” এইডা আপনার। ”

সে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। কথা হারিয়েও ফেলল বোধহয়। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে সুবর্ণের মুখটায়। হাসিখুশি, মায়ায় পূর্ণ মুখটা মলিন হয়ে গেল নিমেষেই। ম্লান গলায় বলল,
” পছন্দ হয় নাই? হইবো ক্যামনে? মইরা গেছে তো! সেই ভোরবেলা তুলছিলাম। ”

বেহালা হতভম্বের ভাব কাটিয়ে ওঠল। গলায় জোর এনে বলল,
” মরেনি। তাজা আছে এখনও। তুমি পদ্ম ফুল পাও কোথায় বলো তো! সেদিন টিয়ামনিরেও দিয়েছিলে। ”
” টিয়ারে দেই নাই তো। আপনেরে দিছিলাম। দেয় নাই? ”
” হ্যাঁ, আমাকেই দিয়েছে। বললে না তো, কোথা থেকে আনো। ”
” আমগো গ্রাম থেইকাই। মন্দিরের কাছে যে পুহুরডা? ওইখানে চাষ হয়। ”
” ওগুলো তো পূজার জন্য। তোমাকে দেয়? ”
” না। চুরি কইরা আনি। ”

সুবর্ণের সাথে সাথে যে ছেলেটা এসেছিল। সে বলল,
” এগুলা কই রাখমু, ম্যাডাম? ”

বেহালা অবাক কণ্ঠে সুধাল,
” আমাকে বলছেন? ”
” জি। এগুলা আপনের জন্যই আনা হয়ছে। ”

নার্সটা ভেতরে বসা ছিল। শুনতে পেয়ে সে এগিয়ে এলো। ফল ভর্তি ঝুড়ি দুটো নিয়ে চলে গেল। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর বেহালা জিজ্ঞেস করল,
” এগুলো তুমি এনেছ? ”

সুবর্ণ মাথা নেড়ে জবাব দিল,
” না। দুলাভাই পাঠাইছে। আমারেও তো উনি নিয়া আইলেন। কাউরে কিন্তু কইয়েন না। উনি মানা করছে। ”

কথাটা বলতে বলতে একটা কাগজ এগিয়ে দিল বেহালাকে। সে ভাঁজ খুলে দেখল, কিছু লেখা। সাথে সাথে পড়ে নিল,

‘ তোমার বান্ধুবি বলেছে, মাফ করলে মাফ পাওয়া যায়। কাল রাতে মনে হয়, একজনকে মাফ করেছি। এখন মাফ পাওয়া বাকি। করবে তো? আমি জানি, তোমার অসুস্থ হওয়ার কারণটা আমি। আমার থেকে পাওয়া আঘাতটা তুমি সহ্য করতে পারোনি। ‘

বেহালা হেসে ফেলল। ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” উনি কি চলে গেছেন? ”
” না। হাসপাতালের বাইরে খাড়াইয়া আছে। আমারে লইয়া যাইবো। ”

সে এক মুহূর্তও দেরি করল না। রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। নার্সের ডাক অগ্রাহ্য করে সোজা হাঁটা ধরল। সুবর্ণও তাকে অনুসরণ করছে। দুজনে একসাথে হাসপাতালের মূল ফটকে এসে দাঁড়াল। মুনছুর সাখাওয়াতকে খুঁজতে হলো না। জীপটা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। সে জীপে নেই, একটু দূরে। একটা মাঝবয়সী লোককে সমানে থাপড়াচ্ছে।

চলবে