মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৫০+৫১+৫২+৫৩

0
815

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫০)

লাগাতার থা প্পড় খেয়েও লোকটি চিৎকার করতে পারছে না। নিজেকে বাঁচাতে পারছে না। দুই হাতে লুঙ্গির গিঁট ধরে আছে। হয়তো জীবনের চেয়েও সম্মান বাঁচানো জরুরি! মুনছুর সাখাওয়াত আরও দুটো থা প্পড় মারতে সে তাল হারিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পান্না দৌড়ে এলো। কাঁধ খামচে ধরে সোজা করল। তারপরে জোশ নিয়ে বলল,
” আমি ধরছি, মহাজন। আপনে মা রেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মা রার জন্য হাত উত্তোলিত করেও থেমে গেল। আচমকা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বেহালা। দৃঢ়বদ্ধ দেহভঙ্গি! নির্ভয়া মুখশ্রী। চোখে চোখ রেখে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল,
” উনাকে মা রছেন কেন? ”

সে হাত নামায়নি এখনও। হঠাৎ বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় খানিক চমকেছিল, থমকে গিয়েছিল। পরক্ষণে ক্রোধন ফুটে ওঠল চোখজোড়ায়। চোয়াল কাঁপছে! দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
” তোকে বলে মা রতে হবে? বাপ হয় তোর? সামনে থেকে সর। ”

বেহালা থতমত খেল যেন! মুখটা অপ্রতিভ হয়ে ওঠল। দাঁড়ানোর ভঙ্গি শিথিল হয়ে আসছে। একটু আগে যে কাগজটা পেয়েছিল, সেখানে ভদ্র ভাষা ছিল। মাফ-টাফও তো চাইল। সেই মানুষটা পাল্টে গেল মুহূর্তে? মুখের ভাষাটাও বিশ্রী! তার ইচ্ছে হলো, এখান থেকে দৌড়ে পালায়। কত মানুষ দেখছে! কেউ কেউ হয়তো জানে, সে ডাক্তার আল হাদির বোন। অপমানের ফোঁটা তার গায়েও পড়বে।

” সরছিস না কেন? এই পান্না, সরা ও কে। নাহলে আবার থা প্পড় মেরে বসব। ”

পান্না আদেশ পেয়ে ছুটে আসছিল। স্পর্শ করবে তখনই মুনছুর সাখাওয়াত বলে ওঠল,
” তুই না। সর। দূরে যা বলছি। ”

সে দ্বিধান্বিত দৃষ্টি রেখে পিছিয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল চারপাশে। সহসা নজরে পড়ল সুবর্ণকে। ভিড়ের মধ্যে থেকেও কাঁপছে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে। তার উদ্দেশ্যেই বলল,
” শালা মিয়া? ওখানে কী করছিস? তোর রোগিকে নিয়ে যা, জলদি। ”

সে একপাও এগুতে পারল না। পূর্বে বেহালা সাবধান করল,
” সুবর্ণ ওখানেই থাকো। তোমার দুলাভাইয়ের সাথে আমি কথা বলব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিল,
” তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই। ”
” ঠিক আছে। এটা তো বলুন, উনাকে মা রছিলেন কেন? বয়সে আপনার থেকে বড় হবে না? বড় ভাইয়ের মতো। এরকম একটা মানুষকে জনসম্মুখে মা রছেন, অপমান করছেন। কেন? আমি জানি, আপনি অযথায় মার ধোর করেন না। নিশ্চয় কোনো দোষ করেছে। সেই দোষটা আমরা শুনতে চাই। ”
” আমরা বলছিস কেন? বল, আমি শুনতে চাই। এখানে এমন কেউ নেই, যে আমার থেকে কৈফিয়ত চাইবে। ”
” বেশ তো। আমাকেই বলুন। মা রছিলেন কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে হলো, একটা কষে চ ড় মেরে বসতে। স্পর্ধা কী! তার থেকে কৈফিয়ত চায়! স্বর্ণলতার বান্ধুবী বলে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। নাহলে এতক্ষণে চ ড়ে আটকে থাকত না! আরও ভয়ঙ্কর কিছু করে বসত। সে চোখ বুঁজে দম আটকে নিল। এতেও রাগ সংবরণ হচ্ছে না। শেষে বাধ্য হয়ে নিজের হাত কা মড়ে ধরল। প্রায় সেকেন্ড কয়েক পরে বলল,
” ও আমার থেকে ঋণ নিয়ে পালিয়েছে। শোধ করেনি। ”
” করবে কী করে? আপনি তো আসলের চেয়েও সুদ বেশি নেন! শোধ করার জন্য সময় দেন, এক কী দুই মাস। কখনও ভেবে দেখেছেন, এত অল্প সময়ে অতগুলো টাকা কীভাবে শোধ করবে? আপনার কাছে বিপদে পড়েই তো আসে! সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে আরও বিপদে ফেলে দেন। এজন্যই ভয়ে পালায়। নাহলে তো প্রাণ নিয়ে নিবেন! কেউ কেউ নিজের বসতবাড়ি, চাষের খেতের বিনিময়ে নিজের প্রাণ বাঁচায়। মুনছুর ভাই, আপনি সাহায্যের নামে স্বার্থ হাসিল করেন। এটা অন্যায়। অসৎ…”

মুনছুর সাখাওয়াতের ধৈর্যের সীমা ভেঙে গেল। অসহ্য ঠেকল বেহালাকে। মনে হচ্ছে, কথা বলছে না। বিষ ছাড়ছে! সে তীব্র ক্রো ধে আকস্মিত চিৎকার করে ওঠল,
” আমি কারও ভাই না। খবরদার আমার নাম মুখে আনবি না। জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব! আমি মহাজন। সুদের ব্যবসা করি। আমার পরিচয় এটাই। সকলেই জানে, তুইও জেনে রাখ। ফের এই ভুলটা করবি না। ”

সে গাড়িতে উঠে বসল। পান্না লোকটিকে নিয়ে পেছনে বসল। সুবর্ণ বসল সামনে, দুলাভাইয়ের পাশে। আসার সময়ও এখানে বসে ছিল। তাই সাহসটা করতে পারল! বেহালা এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকল না। দ্রুত কদমে এগিয়ে আসল জীপের সামনে। মহাজনের পাশের জানালাটির সামনে একটা কাগজ দেখিয়ে বলল,
” এই মানুষটার সাথে আপনার কোনো মিল পাচ্ছি না। ”

তার কণ্ঠে হতাশা, আফসোস। একটু আগের তেজ, উঁচু স্বরটা নিভে এসেছে যেন! মুনছুর সাখাওয়াত কাগজটায় এক ঝলক চেয়ে বলল,
” ওটা আমি না। ”
” আমারও তাই মনে হচ্ছে। লেখাটা সুবর্ণের। আমি ভেবেছিলাম, আপনি লিখিয়েছেন! ”

বেহালার মুখটা ম্লান দেখাল। অনুরোধের সুরে বলল,
” একটু দাঁড়াবেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। ভ্রূ উঁচিয়ে তাকাতেই সে জীপের কাছ থেকে সরে এলো। ব্যক্তিগত নার্সটাকে দিয়ে ফলের ঝুড়ি দুটো আনাল। জীপে রেখে বলল,
” দুঃখিত, আপনার সুদের টাকায় কেনা উপহারটা রাখতে পারলাম না। ”

সে এ নিয়ে কিছু বলল না। জীপ নিয়ে বেরিয়ে এলো বড়, ব্যস্ত পথে। কিছুদিন এগিয়ে বলল,
” মেয়েটা বেশি কথা বলে। অভদ্র, উগ্র স্বভাবের। ভাইয়ের মতো হয়নি একদমই। তাই না, শালা মিয়া? ”
” হ, কিন্তু সুন্দর কইরা কথা কয়। শুনতে ভালা লাগে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সামনে চেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। এবার দৃষ্টি ঘুরাতে হলো। সুবর্ণের মুখটায় চেয়ে থেকে আকস্মিক বলে ওঠল,
” প্রেমে পড়ছিস নাকি? ”
” প্রেম! ”

শব্দটা দারুন বিস্ময়ের সাথে মোলায়েমভাবে উচ্চারণ করল। অতঃপর সুধাল,
” প্রেম কী দুলাভাই? ”
” লোভ। ভালো লাগা মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য কাছে পাওয়ার প্রবল লোভই হলো প্রেম। ”
” কত কাছে? ”
” সর্বনাশ! তোর তো দেখি এসবে কৌতূহল বেশি। ”

সুবর্ণের চোখে, মুখে কৌতূহলের ঢেউ নামছে যেন! দ্বিধা, ভয় কিছুই কাজ করছে না। বরঞ্চ মুখটা খানিক এগিয়ে এনে আবদারের গলায় বলল,
” কইবেন না, দুলাভাই? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ সরিয়ে নিল। সামনে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ভাবছে, কীভাবে বুঝানো যায়। অল্প বয়স, কিশোরকালে পড়েছে। এই বয়সে কৌতূহল, উৎসাহ একটু বেশিই থাকে। ভালোর চেয়েও মন্দের দিকে ঝুঁকে পড়ে অনায়াসে। সে আরেকটু ভেবে বলল,
” বিয়ের দিন তোর আপু আর আমি যত কাছাকাছি বসেছিলাম, তত কাছে। ”
” তাইলে তো আমারও বিয়া করতে হইবো। ”
” এই তো বুঝে গেছিস! ”

তার প্রশংসিত কণ্ঠস্বরে সুবর্ণ একটুও খুশি হতে পারল না। আপুর ক্রন্দনরত মুখটা মনে পড়ল। সে বিয়েতে রাজি ছিল না। সারাটা বেলাই কেঁদেছে। ভাঙার জন্য কত কষ্ট করেছে! এত কষ্ট বেহালাকে দিতে পারবে না। কাঁদাতেও পারবে না। সুবর্ণ চায়, মেয়েটা হাসুক। সবসময় আনন্দে থাকুক। সে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আমি আপনার প্রেমে পড়ব না। কখনও না! ‘

সুবর্ণকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত খাতা-কলম কিনে দিয়ে বলল,
” বাসায় গিয়ে পড়তে বসবি। কালকে তোর আর তোর আপুর পরীক্ষা। ফেইল করলে দুটোকেই গাছে ঝুলিয়ে রাখব। ”

______
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার দিকে। রুমের কাছে এসে দেখল, দরজা খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে কিশোরী বধূর মুখ দর্শনও পেল। সে পালংকের মাঝে বসে আছে। সামনে বই, খাতা, কলম। একমনে পড়াশোনা করছে। স্বামীর পদধ্বনি শুনতে পেল না বোধ হয়। একবারের জন্য চেয়েও দেখছে না! মুনছুর সাখাওয়াত ধীরে, নীঃশব্দে পাশে বসল। স্বর্ণলতা নিচে ঝুঁকে কিছু লিখছে। সে মুখ বাড়িয়ে নিল তার কানের কাছে। ফিসফিসে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করল,
” কবুল, কবুল, কবুল। ”

স্বর্ণলতা ছিটকে ওঠল। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে পড়ল সটান। বিছানা থেকে নামতে চেয়েও পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত একহাত চেপে ধরে আটকে ফেলে বলল,
” বিয়ে না করেই পালাচ্ছ! কবুল বলো। ”

সে ভয়ে ভয়ে হালকা গলায় সুধাল,
” কিসের বিয়া? একবার না হইলো? ”
” আবার হলে সমস্যা কী? আমি আর তুমিই তো! বলো। ”

স্বর্ণলতা বলতে ইচ্ছুক নয়। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার খুব জোর চলছে। মুনছুর সাখাওয়াত হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল,
” কবুল বললেই ছেড়ে দিব। ”

সে অসহায় চোখে তাকালে, মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” তোমার কিন্তু পড়ার সময় নষ্ট হচ্ছে, স্বর্ণলতা। বিয়ে করা স্বামীকেই আবার বিয়ে করছ, সমস্যা কী? অন্য কেউ দেখছেও না। শুধু তুমি, আমি। ”

স্বর্ণলতার অসহায়বোধ কেটে গেল। বিরক্ত ধরা দিল চোখে, মুখে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
” কবুল। ”

সাথে সাথে হাতটা মুক্ত হয়ে গেল। বই-খাতা তুলে নিয়ে পালাতে চাইলে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এতক্ষণ যেভাবে পড়ছিলে সেভাবেই পড়ো। আমি বিরক্ত করব না। গোসলে যাব। ”

_______
মুনছুর সাখাওয়াত গোসল থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, স্বর্ণলতা ঝুঁকে বসে পড়ছে তখনও। পিঠটা ব্যথা করছে না? লিখতেও অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়! তার ভারি মায়া হলো। চেয়ার-টেবিল থাকলে এই কষ্টটা হতো না। মনস্থির করল, সকালের মধ্যে মেয়েটাকে নতুন চেয়ার-টেবিল এনে দিবে। কিন্তু টেবিলটা বসাবে কোথায়? সঠিক স্থানটা খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার এই পড়ালেখার শখটা কতদিন থাকবে? ”

স্বর্ণলতা লিখতে লিখতে জবাব দিল,
” সারাজীবন। ”
” অসম্ভব! ”
” কী? ”

মুনছুর সাখাওয়াত তার কাছে আসতে আসতে বলল,
” সারাজীবন ধরে তুমি ঐ কোণায় টেবিলে বসে পড়বে, আমি এই কোণায় বসে দেখব? চলবে না। ”

কথাটা বলতে বলতে একটা বই তুলে নিল। নিচে ছুঁড়ে মারল। আরও একটা বই তুলবে তখনই স্বর্ণলতা বই, খাতা সব দুই হাতে আগলে নিয়ে বলল,
” কী হয়েছে? আমার বই ফেলতাছেন ক্যা? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। তার নজর গিয়ে পড়ল বউয়ের মুখটায়। নাক, কান, গলা সব খালি। কোথাও গয়না নেই। চুলগুলোও টেনে ঝুঁটি করে আছে। পরনের থ্রি-পিসের সাথে এই সাজটা এত সুন্দর মিলে গেছে যে মনে হচ্ছে না, এই মেয়ের কোনোকালে বিয়ে হয়েছিল! পুরো স্কুলের বাচ্চা লাগছে। তার মনের অশান্তি বেড়ে গেল কয়েকগুণ। বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো, মেয়েটা শাড়িতেই বেশ ছিল। অল্প বয়স বুঝা গেলেও বাড়ির বউ মনে হতো। নতুন বউয়ের মতো মাথায় সর্বদা ঘোমটা টেনে থাকত। সে তখনই বুকসেলফের নিচের ড্রয়ার খুলল। এখানে স্বর্ণলতার শাড়িটা ও গয়নার বাক্স যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। এগুলো বের করে বলল,
” যাও, শাড়িটা পরে এসো। এখনই। দ্বিতীয় কোনো কথা বললে বই-খাতা সব জ্বালিয়ে দিব। ”

শান্ত কণ্ঠের দৃঢ় আদেশটা সে অমান্য করতে পারল না। চট করে গোসলখানার ভেতরে চলে গেল। মিনিট দুইয়ের মধ্যে মাথা বের করে বলল,
” এখানে তো ব্লাউজ, পেটিকোট নাই। শাড়ি পরমু ক্যামনে? ”
” আমি এনে দিচ্ছি। কোথায় রেখেছ? ”
” দাদিজানের রুমে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তখনই দ্রুত কদমে বেরিয়ে গেল। এই সুযোগে স্বর্ণলতা গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এলো। ত্বরিত বই-খাতাগুলো গুছিয়ে লুকিয়ে ফেলল বুকসেলফের ড্রয়ারেই। যেখানে তার শাড়ি ও গয়নার বাক্স ছিল। স্বামীর পদধ্বনি শুনতে পেয়ে সে দৌড়ে পুনরায় গোসলখানায় ঢুকে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত শুধু ব্লাউজ, পেটিকোট না। সব কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে রঙ মিলিয়ে একটি ব্লাউজ ও পেটিকোট দিল। স্বর্ণলতা শাড়ি পরে বেরিয়ে আসার পর বলল,
” গয়না পরো। ”

সে চুপচাপ গয়না পরতে পরতে ভাবছে, যাই হয়ে যাক না কেন, পড়ালেখা বন্ধ করা যাবে না। তার জীবনের এই একটাই তো চাওয়া! এত সহজে পেয়েও হারিয়ে ফেলবে?

” নুপুরগুলোও পরো। এখন থেকে সবসময় শাড়ি পরবে। ”
” থ্রি-পিস পরমু না? ”
” না। ফেলে দাও। ”

স্বর্ণলতা আঁতকে উঠে বলল,
” ফালাইয়া দিমু? সবগুলাই তো নতুন। আমি মাত্র দুইটা পরছি। ”
” হ্যাঁ, সব ফেলে দিবে। আমি নতুন শাড়ি এনে দিব। ”
” আপনি হুদায় ট্যাকা নষ্ট করেন! ”
” কী বললে? ”

স্বর্ণলতা পুনরায় বাক্যটা উচ্চারণ করল না। তার ভালো লাগছে না। আবারও এই বারো হাতের কাপড়টা জড়িয়ে রাখতে হবে সবসময়! গয়নাগাটিও পরতে হবে। সাথে নুপুর জোড়াও যুক্ত হয়েছে। এক সময়ে তার নুপুরের খুব শখ ছিল। সেটা পূরণ হলো শাস্তির মতো। কোনো আনন্দ নেই, উল্টো যন্ত্রণা হচ্ছে। নুপুরের শব্দে মাথা ধরে যাচ্ছে।

মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে স্বর্ণলতার মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,
” সারাজীবন পড়ার কী দরকার? এসএসসি পাশ করলে চলবে না? ”
” না। আমি কলেজেও পড়মু। ”
” বিয়ের দিন এই কথাটা বলোনি কেন? তাহলেই তো বিয়েটা ভেঙে দিতাম। ”
” সত্যি? ”

তার চোখে বিস্ময়ের দ্যুতি পড়ল যেন! মনিদুটো চকচক করছে। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। গাল, নাক, ঠোঁট সবকিছুতেই ভিন্ন রঙ এসেছে। সম্পূর্ণ মুখের ছাঁচটায় বদলে গেছে। চুলের ঝুঁটির জন্য ঘোমটা থাকছে না। বার বার পড়ে যাচ্ছে। স্বর্ণলতা চটজলদি উঠাতে চাইল, পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত চুলে হাত দিল। একটানে ঝুঁটি খুলে দিয়ে বলল,
” আর কখনও ঝুঁটি করবে না। ”

সে মাথা নেড়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কইলেন না তো। সত্যি বিয়া ভাইঙ্গা দিতেন? ”
” না। ”
” তাইলে কইলেন ক্যান? খালি মিছা কথা কয়! ”

স্বর্ণলতা ঠোঁট বাঁকাল। মুখটা ভার করে অন্যদিকে চেয়ে আছে। ভাবটা এমন যে, তাদের এখন বিয়ে হচ্ছে। কথাটা মিথ্যা হওয়ায় বিয়েটা ভাঙছে না! মুনছুর সাখাওয়াত একটু কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আলতোভাবে হাতটা ধরতে চাইল। নাগাল পেল না। স্বর্ণলতা না দেখেও কীভাবে যেন টের পেয়ে গেল। মুহূর্তেই স্প্রিংয়ের মতো দূরে সরে গিয়ে বলল,
” দাদিজানের কাছে যাই? দুপুর থেইকা একলা আছে। একটু পরে তো ঘুমাইয়া যামু। দেইখা আসি কিছু লাগবো নাকি। ”
” না। তুমি পড়া শেষ করো। আমি দাদিজানের কাছে যাচ্ছি। ”

সে বেরিয়ে যেতেই স্বর্ণলতা দরজায় সিটকানি তুলে দিল।

______
আজকেও ঘুম ভাঙল দাদিজানের ডাকে। স্বর্ণলতা দরজা খুলে দাঁড়াতেই বললেন,
” তোমাকে মুনছুরের থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম, নামাজ থেকে না। এই ঘরে ঢুকতেই আল্লাহকে ভুলে গেছ! এটা কি শয়তানের আস্তানা হয়েছে নাকি? যে থাকছে সেই বিপথে চলে যাচ্ছে! ”

সে মাথা নত করে ফেলল। সত্যি তো! দুইদিন ধরে নামাজ পড়ছে না। ফজরের সময় সজাগও হতে পারছে না। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে গেল নাকি?

” আমার সামনে মাথা নামিয়ে কী হবে? আল্লাহর কাছে নামাও। যদি ক্ষমা করেন! ”

তিনি অসন্তুষ্ট মুখে চলে গেলেন। স্বর্ণলতা নিজেকে সামলে উঠারও সময় পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকে পড়ল। দরজা আটকে দিতে দিতে সুধাল,
” ঘুম কেমন হলো? ”

সে একটুও ঘাবড়াল না। স্বামীর মুখটায় চেয়ে থাকল। সেকেন্ডের মধ্যে চোখদুটি ছলছল হয়ে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত হকচকিয়ে গেল। দ্রুত সিটকানি নামিয়ে দরজা খুলে দিল। স্বর্ণলতা এতেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ধীরপায়ে গিয়ে বসল বিছানার এককোণে। চুপচাপ, ভীষণ শান্ত। মুখটায় তাকানো যাচ্ছে না। গভীর ব্যথায় থমকে গেছে যেন! মুনছুর সাখাওয়াত সামনে এগোনোরও সাহস করল না। দূর থেকে বলল,
” আমি সত্যি কিছু করতাম না, স্বর্ণলতা। দরজাটা…”

সে কথা শেষ করার আগেই স্বর্ণলতা বলল,
” আপনার রুমে জায়নামাজ নাই ক্যান? কুরআন শরীফও নাই। আপনে আল্লাহরে না ডরাইলেও, আমি ডরাই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” তুমি এজন্যে কাঁদছিলে? ”

সে জবাব দিল না। উঠে দাঁড়াল। ঘন ঘন পা ফেলে তার সামনে এসে দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে বলল,
” যেই রুমে জায়নামাজ নাই, কুরআন শরীফ নাই ঐ রুমে আমি থাকমু না। ”

স্বর্ণলতা সত্যি সত্যি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল। মুখে কিছু বলল না, হাত বাড়িয়ে আটকালও না।

______
সুবর্ণ এলো দুপুরের দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে করে নিয়ে এসেছে। বসিয়েছে নিজের রুমেই। স্বর্ণলতা দাদিজানের রুমে। ভাইয়ের আসার খবর পেল কলির মুখে। সাথে সাথে দেখা করার জন্য ছুটে এলো। রুমে ঢোকার জন্য পা বাড়াতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” সকালে কী বলে বেরিয়েছিলে, মনে আছে তো? ”

সে থেমে গেল। বাইরে থেকে ভাইকে ডাকল। সুবর্ণ ডাক পেয়েও যেতে পারছে না। দুলাভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে। অনুমতির প্রত্যাশায় আছে। মুনছুর সাখাওয়াতের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। পকেট থেকে দুটো কাগজ বের করল। সুবর্ণের হাতে দিয়ে বলল,
” এগুলো প্রশ্নপত্র। একটা তোর, আরেকটা আপুর। যদি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে চায়, তাহলে তোর পাশে বসে যেন পরীক্ষা দেয়। বাইরে তোদের শিক্ষক বসে আছে। পরীক্ষার সময় শেষ হলে, খাতা নিয়ে যাবে। ”

সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সোজা হেঁটে এলো বাইরে। উঠোন পেরিয়ে গেল কাঁঠাল গাছটার নিচে। সেখানে চেয়ার পাতা আছে। স্কুলের হেডমাস্টার একটা চেয়ারে বসে আছেন। মুনছুর সাখাওয়াত আরেকটা চেয়ারে বসল। মুখোমুখি। পায়ের উপর পা তুলে। মিনিট দুইয়ের মধ্যে নাস্তাও চলে এলো। হেডমাস্টার জানে, এগুলো তার জন্যই আয়োজন করা হয়েছে। তারপরেও ছোঁয়ার সাহস হচ্ছে না। হাসি মুখে চেয়ে আছে সামনের মানুষটির দিকে।

মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ নীরব থেকে আচমকা বলল,
” শুনলাম, ডাক্তারের সাথে তোর মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছিস? ”
” জি। ”

উত্তরটা দিয়ে তিনি হাসলেন। মুনছুর সাখাওয়াত আবারও চুপ হয়ে গেল। হাতের ইশারায় চা নিতে বলল। হেডমাস্টার চায়ের কাপ তুলে নিলেন। এক চুমুক দিতেই শুনলেন,
” ওর সাথেই কেন? গ্রামে তো আরও ছেলে আছে। ”
” জি, আছে। কিন্তু ওর সাথে তুলনা হয় না। আমি হলফ করে বলতে পারি, মহাজন। শুধু এই গ্রামে না, আশপাশের গ্রামেও ডাক্তারের মতো সুশীল, সুশিক্ষিত ছেলে নেই। আমরা গর্বিত, এমন একটা ছেলে আমাদের গ্রামে আছে। সকলকে চিকিৎসা দিচ্ছে। শুনেছি, গরীবদের থেকে টাকাও নেয় না। বড় দিলদার ছেলে! ”

তিনি চায়ের কাপে আরেকবার চুমুক দিতে চাইলেন, পারলেন না। মুনছুর সাখাওয়াত চায়ের কাপ কেড়ে নিল। তারপরে বলল,
” উঠ। ”

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ঘাবড়ে গিয়েছেন খুব! ঘেমে উঠছেন। মুনছুর সাখাওয়াত তাকে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে বলল,
” এখন তুই ছাত্র, আমি শিক্ষক। যা যা জিজ্ঞেস করল, ওখান থেকে উত্তর দিবি। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫১)

মুনছুর সাখাওয়াত হেডমাস্টারকে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখল প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো। এই পুরো সময়টা সে শুধু ডাক্তারকে নিয়ে ভেবে গেল। ছেলেটা শুধু দুঃসাহসী নয়, দুর্দম্য শক্তিশালীও। পান্নাকে দিয়ে তথ্য যোগাড় করিয়েছে, ডাক্তার হাদির বাবা ধনাঢ্য ব্যক্তি। ঢাকায় খুব নামা-ঢাক আছে। সব থেকে বড় কথা তাকে গ্রামবাসীরা পছন্দ করে, প্রশংসায় রাখে সবসময়। এরকম একটা মানুষকে দুর্বল ভাবা বোকামি, মুর্খামি। মুনছুর সাখাওয়াত বোকা না, মুর্খও না। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে ডাক্তারকে বেশিদিন আয়ত্বে রাখা যাবে না। এখনই ফোঁস করে ওঠছে, কয়েকদিন পর কামড়ে ধরবে। তখন হার নয়, পতন দেখতে হবে। এত বছরে গ্রামবাসীদের মনের মধ্যে যে ভয়, আতঙ্ক তৈরি করেছে এক নিমিষেই শুষে নিবে ডাক্তার হাদি। সে আরও কিছুক্ষণ ভাবনায় বিভোর থাকল। আচমকা বিজয়ের রশ্নি খুঁজে পেল যেন! সে আপনমনে হেসে ওঠল। সেই হাসি হেডমাস্টার দেখতে পেল না৷ ঘর্মাক্ত বদনে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে মহাজনের সামনে।

মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল। ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল,
” স্কুল ছুটি হওয়ার সময় হয়েছে। আরেকটু কষ্ট কর। খাতাগুলো নিয়ে আসি। ”

সে তখনই ঘন ঘন পদ ধাপে এগিয়ে এলো বাড়ি মুখি। মূল দরজা খোলা ছিল, ভেতরে ঢুকে সরাসরি পৌঁছে গেল নিজের রুমের সামনে। এই দরজাটাও মেলা। ভেতরে সুবর্ণ ও স্বর্ণলতা। পাশাপাশি বসে আছে। কী নিয়ে যেন ফুসুরফাসুর করছে! মুনছুর সাখাওয়াত দরজার পাল্লায় খটখট শব্দ করতে দুজনে থেমে গেল। তটস্থ হয়ে সামান্য দূরত্ব তৈরি করে বসল। দেহ ও মুখের ভাব শক্ত ও নীরব। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। মুনছুর সাখাওয়াত তাদের কাছে এগিয়ে এলো। প্রথমে তাকাল নিজের স্ত্রীর দিকে। সে জানত, মেয়েটা রুমে ঢুকবে। পরীক্ষাটাও দিবে। ধারণাটা মিলে যাওয়ায় খুশি হলো। একটু একটু করে তাকে বুঝতে শিখছে! সে সুবর্ণের দিকে চেয়ে বলল,
” শালা মিয়া, লেখা শেষ? ”

সুবর্ণ মাথা নেড়ে প্রত্যুত্তর করল,
” হ, দুলাভাই। আমার তো মেলা আগে শেষ। আফা লিখতাছিল এতক্ষণ ধইরা। ”
” আচ্ছা। খাতা নিয়ে বাইরে যা। হেডমাস্টার দাঁড়িয়ে আছে, ওর কাছে জমা দে। আমি একটু পরে আসছি। ”

সে তখনই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আপুর দিকে ফিরে তাকাল না। মুখে কিছু বললও না। ভাইয়ের এই পরিবর্তিত আচরণে আশ্চর্য হলো স্বর্ণলতা। এই ছেলেটা মায়ের থেকেও বেশি পছন্দ করত তাকে। সারাক্ষণ গা ঘেষে থাকত। যা বলত তাই করত। কখনও অমত করেনি, নিজের ইচ্ছাও রাখেনি। সেই ছেলে আপুর সান্নিধ্যে থেকেও মুখ খুলছিল না। কত কী জিজ্ঞেস করল! কিছুই বলল না। শুধু এড়িয়ে যাচ্ছিল। এখন এই বিদায় বেলা এক পলকের জন্যও তাকাল না।

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর পাশে বসল। দূরত্ব সামান্য। স্বর্ণলতা খেয়ালই করল না। সে ভাইয়ের কথা ভেবে যাচ্ছিল একাগ্রহে। সহসা শুনতে পেল,
” নিজের ইচ্ছায় স্বামীর রুমে ঢুকেছ। জোর করতে হয়নি। তাই একটা সুবিধা পাবে। ”

সে চমকে ওঠল। সচকিত দৃষ্টি রাখল স্বামীর পানে। সরতে চেয়েও সরল না। যদি হাতটা ধরে ফেলে? দানবটার হাত এত শক্ত! লোহার মতো। ব্যথা করে। ধরে রাখা স্থানটা প্রথমে লাল হয়, তারপরে ফুলে ওঠে ধীরে ধীরে। মুনছুর সাখাওয়াত তার চকিত নজরে চেয়ে বলল,
” আমার অনুপস্থিতে যদি এই ঘর থেকে তোমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে তাহলে যেতে পারবে। আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু কাজ শেষ হতেই ফিরে আসতে হবে। আমাকে যেন ডেকে আনতে না হয়। ”

স্বর্ণলতা সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল,
” নামাজ পড়তেও যাইতে পারমু? ”

মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” নামাজ যদি জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে তাহলে যাবে। ”

সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। উঠোনে নেমে দেখল, রোদ নেই। সূ্র্য ডুবতে শুরু করেছে। হেডমাস্টার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটু বাঁকা হয়ে আসছে, মৃদু কাঁপছেও। বেচারা! এত লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকেনি কখনও। না জানি কত কষ্ট হচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াতের একটুও মায়া হলো না। চোখে, মুখে কাঠিন্যের ছাপ ফেলে বলল,
” বাড়ি যা। বিয়ের আয়োজন কর। মেয়েকে তৈরি রাখবি। আমি বর নিয়ে আসছি। ডাক্তার আজই তোর মেয়েকে বিয়ে করবে। ”

সুবর্ণকে নিয়ে বসাল নিজের গাড়িতে। সামনে, পাশের সিটে। ইঞ্জিন চালু করে ছুটে যেতে যেতে বলল,
” তোর প্রেমিকার খবর কী? ”

সে অবোধের মতো চেয়ে বলল,
” প্রেমিকা ক্যাডা, দুলাভাই? এই নামে তো কাউরে চিনি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মাথায় হালকা থাপ্পড় মেরে বলল,
” রোগিকে চিনিস তো? সুন্দর করে কথা বলে যে? ”
” আফার বান্ধুবী? উনার নাম তো প্রেমিকা না, বেহালা। ”
” জানি। দেখা হয়েছে আর? ”

সুবর্ণ বিষণ্ণ গলায় জানাল,
” না। আম্মা যাইতে দেয় নাই। ”
” কেন? ”
” হিন্দু পাড়া থেইকা নালিশ আইছে। আমি যে, পদ্মফুল চুরি করছিলাম? একজনে দেইখা ফেলাইছিল! ”

সে কৌতূক করে বলে ওঠল,
” প্রেমিকা বুঝিস না, প্রেম বুঝিস না, অথচ চুরি করা শিখে গেছিস। বাহ! ”

সুবর্ণ কৌতূকটা ধরতে পারল না। চট করে জবাব দিল,
” প্রেম বুঝি তো, দুলাভাই। ঐদিন না আপনে বুঝাইলেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। বেহালার কথা উঠতে তার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সাথে সাথে নিজের স্ত্রীর কথাও মনে পড়ল। তারও বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। সুবর্ণের মতো সেও ডাক্তারের প্রেমে পড়েনি তো? হয়তো অনুভূতিটাকে চিনতে পারেনি, প্রকাশ করারও সুযোগ পায়নি। গোপনে হৃদয় দখল করে আছে, এজন্যই সে জায়গা পাচ্ছে না! বিয়ে হয়েছে অনেকদিন হলো তো! আর কত নরম হবে? ধৈর্য ধরে থাকতে পারছে না।

শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। সুবর্ণকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
” তোকে পদ্মফুল চুরি করতে হবে না। আমার নাম বললে সেধেই দিবে। কিন্তু এর বিনিময়ে একটা কাজ করতে হবে। ”
” কী কাজ? ”
” তোর রোগিকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম না? সেটা আমাকে ফেরত এনে দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন জানতে না পারে, কাজটা আমার কথায় করেছিস। পারবি? ”

সুবর্ণ এক মুহূর্তও সময় নিল না। তাৎক্ষণিক প্রবল বিশ্বাসের সাথে বলল,
” পারব। ”

বেহালা যে ফলের ঝুড়ি দুটি ফেরত দিয়েছিল, সেগুলো জীপেই পড়ে ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত সেগুলো নামিয়ে দিয়ে বলল,
” এগুলো বাড়িতে নিয়ে যা। ”

_______
হেডমাস্টারের বাড়িতে দারুন আয়োজন হয়েছে। বাড়ির ভেতরে, বাইরে সবখানেই আলো ঝলমল করছে। বড় করে মঞ্চ সাজিয়েছে। আত্মীয়স্বজন ডেকে এনেছে। অতিথিও আসতে শুরু করেছে। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়িতে পা বাড়িয়েই বুঝে ফেলল, এই লোক ভয়ে না খুশিতে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেছে। মনে মনে সব পরিকল্পনাও করে ফেলেছিল, শুধু পাত্রকেই রাজি করাতে পারছিল না। আজ সেটাও সম্ভব হয়ে গেল!

ডাক্তার আল হাদি মহাজনকে অনুসরণ করছিল। আচমকা থেমে গিয়ে বলল,
” আমাকে এখানে এনেছেন কেন? ”

তার কণ্ঠ কাঁপছে! সন্দেহের তীরটা ভালো করেই বুকে বিঁধছে। যা ভাবছে, তা যদি সত্যি হয়? কী করবে? মহাজনের থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো পথ কি খোলা আছে? মুনছুর সাখাওয়াত থামল না। হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল,
” পরীক্ষা দেওয়াতে। সেদিন কথা দিয়েছিলি না, যা বলব তাই করবি? আজ করে দেখা। ”

পান্না ও আলামিন পেছন পেছন আসছিল। মহাজনকে এগিয়ে যেতে দেখে পান্না ধাক্কা দিল ডাক্তারকে। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল,
” জামাই মিয়া, জলদি চলেন। আপনে দেরি করলে বিয়া হইতে দেরি হইবো। পরে আমগো বাড়ি ফিরতেও দেরি হইবো। কয়ডা বাজছে দেখছেন? ”

ডাক্তার হাদি অনিচ্ছায় হাঁটতে লাগল। এক ফাঁকে হাতঘড়িটায়ও তাকাল। রাত দশটা বাজছে। বেহালাকে আজকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে। দুপুরের দিকে বাড়িতে রেখে এসেছে। সাথে টিয়ামনি আছে শুধু। দেখভাল কেমন করছে কে জানে! সে ঘন ঘন পা ফেলে মহাজনের কাছে চলে এলো। পাশাপাশি হাঁটছে। পায়ে পা মিলিয়ে। সহসা বলল,
” আপনি যে ভয়ে এত তাড়াহুড়ো করছেন, সেটা মিথ্যা। স্বর্ণলতাকে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি, বিয়ে করতে চেয়েছি। ও কিছু করেনি, জানতও না পর্যন্ত। পুরোটা এক তরফা ছিল, মহাজন। যেটা বিয়ের আগে হয়নি, সেটা বিয়ের পরে হবে কীভাবে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত থামল। নীরবে ধৈর্য নিয়ে পুরো কথাটা শুনল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপচাপ একস্থির চেয়ে দেখছিল ডাক্তার হাদির মুখটা। আচমকা কলার চেপে ধরে চাপা উত্তেজনায় শাসাল,
” ফের যদি আমার বউয়ের নাম উচ্চারণ করেছিস, এখানে হাত না ছুরি বসে থাকবে। ছুরির চারপাশ দিয়ে গলগলে র ক্ত বের হবে। বোন, বাবা কারও থেকে বিদায় নেওয়ার সময়টাও পাবি না। ”

সে আরও কিছুক্ষণ ফোঁসফোঁস করল। ক্রোধযুক্ত দৃষ্টিটা ধরে রাখল। অতঃপর হাতটা সরাল। শার্টটা টেনে ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
” অতি প্রয়োজনে রানিসাহেবা ডাকতে পারিস। আমি প্রয়োজন বুঝে মাফ করে দিব। ”

হেডমাস্টারের সাথে দেখা হলো মঞ্চের সামনে। তাদের দেখতে পেয়ে মুখভর্তি হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো। আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল অন্যরা। ডাক্তার হাদি অবাক হয়ে দেখল, তার বাবাও এখানে। চোখাচোখি হতে এগিয়ে এলেন। ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
” তোর বন্ধু না বললে তো জানতামই তুই বিয়ে করছিস! একমাত্র ছেলের বিয়ে করছে অথচ বাবা উপস্থিত নেই, খবরটাও পায়নি। মিডিয়া জানলে কী হতো ভাবতে পারছিস? আর কত ডুবাবি আমায়, বাবু? ”

তিনি একটু থেমে পুনরায় বললেন,
” বউমা পছন্দ হয়েছে। তাই ক্ষমা করে দিলাম। যা, তৈরি হয়ে নে। আমার ছেলে হয়ে তো শার্ট পরে বিয়ে করতে পারিস না! সম্মান থাকবে? মেয়ের বাবার কাছে ছোট হয়ে যাব না? ”

ডাক্তার হাদির বয়সী একটা ছেলে এগিয়ে এলো। পরনের বেশভূষা ও মুখ দেখলেই বুঝা যাচ্ছে, সে মেকাপম্যান। গায়ে হাত দিতে চাইলে, সে হাত তুলে সাবধান করল। তখনই মুনছুর সাখাওয়াত পাশ থেকে বলল,
” কথা দিয়েছিলি কিন্তু? ঝামেলা করিস না। এই গ্রামে এখন শুধু তোর বোন না, বাবাও আছে। আমি না চাইলে কেউ বের হতে পারবে না। ”

সে ক্রোধন দৃষ্টি রাখল। ক্ষোভ ও আক্রোশে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। হাতদ্বয় মুষ্ঠ পাকালেও আক্রমণ করে উঠতে পারল না। বাবার জন্য পরোয়া না করলেও বোনের জন্য করে।

________
ডাক্তার হাদি তৈরি হয়ে বের হতে পারল না৷ পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকল। তার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
” রাজপুত্রের মতো চেহারা পেয়েছিস। তাতে কী? সুয়াপুরের রাজকন্যাকে তো আমিই জয় করেছি। ”
” ওটা জয় না। অন্যায়ভাবে দখল করা। স্বর্ণলতা রাজি ছিল না। জোর করে বিয়ে করেছেন। ”

আবারও নাম নিয়েছে! মুনছুর সাখাওয়াতের মাথায় র ক্ত উঠে গেল। দুই হাত গলা দাবানোর জন্য এগিয়ে এসেও থেমে গেল। সে নিজেই জোর করে থামাল। রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে বলল,
” শুভ কাজে যাচ্ছিস, তাই বেঁচে গেলি। কিন্তু এটায় শেষ। ”

ডাক্তার হাদি একপেশে হাসল। ইচ্ছে হলো নামটা শ’বার উচ্চারণ করতে। মহাজনের রাগটা সে দারুন উপভোগ করছে। কখনও ভাবতে পারেনি, এই মানুষটা তাকে নিয়ে ভীত থাকবে, হিংসাত্মক আচরণ করবে। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে আরেটু চেপে এলো। চোখে চোখ রেখে বলল,
” স্বর্ণলতাকে জয় করা এত সহজ নয়। আমি ওর গন্তব্য ছিলাম না। তাই পথ আটকে দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তারচেয়ে ভালো হয়, পথটা ঘুরিয়ে দিন। নিজে গন্তব্য হয়ে যান। তাহলে জয়ের দেখা পেতে পারেন। জানেন তো, পোষা পাখিও সুযোগ পেলে পালিয়ে যায়। স্বর্ণলতা তো পাখিও না, মানুষ। আপনার সাথে থাকছে। উঠছে, বসছে। দেখবেন, আপনার মতো ঠকিয়ে দেওয়ার অভ্যাসটা যেন আয়ত্ব করে না নেয়। তাহলে প্রথমে আপনাকেই ঠকাবে। তখন বুঝবেন ঠকে গেলে কেমন লাগে! ”

মুনছুর সাখাওয়াত কিছু বলারও সুযোগ পেল না। সে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। মঞ্চে উঠে বলল,
” বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। দশ মিনিট সময় দিলাম। এরমধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হলে ভালো, বউ সাথে যাবে। নাহলে আমি একাই যাব। ”

কাজী আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। হেডমাস্টার দৌড়ে গিয়ে ধরে আনল। সাথে সাথে বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে গেল।

________
মুনছুর সাখাওয়াত বাসায় ফিরল রাত বারোটার দিকে। মুল দরজা লাগানো ছিল, কলি খুলে দিয়ে পালাল। বাকি সব ঘুমে। দাদিজানের রুমের দরজাটা আটকানো। স্বর্ণলতাও নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে? সে আর ঐদিকে গেল না। ক্লান্ত লাগছে খুব। দেহ, মন সবই অবশ হয়ে আসছে। নড়াচড়া করতে ইচ্ছে করছে না একটুও। মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানের পাশের রুমটায় ঢুকল। বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ামাত্র মোবাইলটা বেজে ওঠল। এত রাতে কল করল কে! সে ঘুম ঘুম চোখে আলস্য ভঙ্গিতে মোবাইলটা সামনে আনল। দাদিজানের নাম্বার। জেগে আছে নাকি? তাহলে তো বুঝার কথা সে বাসায় এসেছে। কল করার কী প্রয়োজন? প্রথমে বিরক্ত হলো, পরক্ষণে দুশ্চিন্তায় পতিত হলো। অসুস্থ হয়ে যায়নি তো? তার ইচ্ছে হলো দাদিজানের রুমে দৌড় দেয়, ডাকে। কী হয়েছে পর্যবেক্ষণ করতে। কিন্তু শরীরটা সাড়া দিচ্ছে না। সে বাধ্য হয়ে চেঁচাল,
” দাদিজান? কল করছ কেন? আমি বাসাতেই। ”

সাথে সাথে জবাব এলো,
” আমি কল করতে যাব কেন? মোবাইল তোর বউয়ের কাছে। ”

স্বর্ণলতা! কলটা কেটে গিয়েছিল। মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদি ফিরতি কল দিল। ওপাশ থেকে ধরে বলল,
” আপনে কি খাইতে বইছেন? ”
” না। কেন? ”
” তাইলে আমিও খাইতে বইতাম। দাদিজান কইছে, এখন থেইকা আপনের আগে খাউন যাইবো না। ”
” তুমি এখনও খাওনি? ”
” না। আপনের লাইগা বইসা আছি। ”

সে ঘড়ি দেখল, বারোটা পেরিয়ে গিয়েছে। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” কয়টা বাজে দেখেছ? এতক্ষণ ক্ষুধা নিয়ে বসে থাকে কেউ? খেতে আসো। জলদি। ”
” আমারও যাইতে হইবো? আপনের ঘরে ভাত রাইখা আসছি। আমার ঘরেও ভাত আছে। আপনে খাইয়া নিলেই তো আমিও খাইতে পারি। একলগে পাশাপাশি বইসা খাইতে হইবো, এরকম তো দাদিজান কয় নাই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত উঠে বসল। আলো জ্বেলে দেখল, বেডসাইড টেবিলের উপরে ভাত, তরকারি রাখা। পানি, লবণ সবই আছে। গুছানো, ঢাকা। সে ঢাকনা খুলে দেখতে দেখতে বলল,
” দাদিজান বলেনি, আমি বলছি। খাবার টেবিলে আসো। আমরা একসাথে খাব। তারপরে যার যার ঘরে ফিরে যাব। আমার ঘরে তোমার ঘুম কেমন হচ্ছে জানি না। কিন্তু তোমার ঘরে আমার খুব ভালো ঘুম হচ্ছে। আমি তো ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখছি। সবগুলো ভালো স্বপ্ন। স্বপ্নগুলো কাউকে বলা হয়নি! আজ তোমাকে বলব। ”

স্বর্ণলতা এলো। দুই রুম থেকে ভাত নিয়ে সাজাল টেবিলে। মুনছুর সাখাওয়াত নিজের চেয়ারে বসে ছিল। স্বর্ণলতা একটা ফাঁকা রেখে পরেরটায় বসতে যাচ্ছিল, তখনই শুনল,
” ওটাতে না। আমার সামনে বসো। তাকালেই যেন, তোমার পুরো মুখটা দেখতে পারি। তাহলে গল্প জমবে ভালো। ”

সে মাথার ঘোমটা খানিক টেনে আনল। উভয় ভ্রূ ঢেকে গেল। সেভাবেই আড়ষ্টভঙ্গিতে বসল উল্টোপাশের চেয়ারটায়। একদম মুখোমুখি। ভাতে তরকারি মিশিয়ে নিতে নিতে শুনল,
” একটা সুখবর আছে। ”

স্বর্ণলতা জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চাইতে বলল,
” ডাক্তার বিয়ে করেছে। ”
” কোন ডাক্তার? ”
” তুমি যাকে হাদিভাই বলে ডাক, সেই ডাক্তার। ”
” এটা স্বপ্নে দেখলেন? ”
” না। বাস্তবে দেখেছি। আমি বিয়ে বাড়ি থেকে এসেছি। তোমার হাদিভাই দাওয়াত করেছিল। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫২)

” ডাক্তার বিয়ে করেছে। ”
” কোন ডাক্তার? ”
” তুমি যাকে হাদিভাই বলে ডাক, সেই ডাক্তার। ”
” এটা স্বপ্নে দেখলেন? ”
” না। বাস্তবে দেখেছি। আমি বিয়ে বাড়ি থেকে এসেছি। তোমার হাদিভাই দাওয়াত করেছিল। ”

স্বর্ণলতার মুখে বিস্ময়ের ছটা উজ্জ্বল হয়েও হারিয়ে গেল। চমকে উঠা দৃষ্টি জোড়া স্বাভাবিক হতে হতে উদাসে রূপান্তর হলো। মনের মধ্যে আলোর ফুলকির মতো জ্বলে ওঠল, একটি ভোরবেলা। সেই ভোরবেলায় তো ডাক্তার হাদির সাথে মুখোমুখি বসে ছিল! ঘরের ভেতরে। প্রথমবারের মতো। তারা একা, আর কেউ ছিল না সাথে। কত কথা হলো! তিনিই বেশি বলেছিলেন। স্বর্ণলতা কিছু বুঝছিল, কিছু বুঝছিল না। যে কথাগুলো বুঝছিল, সেগুলোর প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। বাকি সময় চুপচাপ ধৈর্যের সাথে শুনেছে। একটুও বাঁধা সৃষ্টি করেনি। প্রশ্ন করে বিরক্ত করেনি। একভাবে নিষ্পলকে চেয়ে ছিল ডাক্তার হাদির মুখটায়। এত কাছ থেকে, সরাসরি এই মুখটা দেখা হয়নি কখনও। যত দেখছিল, তত মুগ্ধ হচ্ছিল। কী সুন্দর মুখটা! ছবির নায়কদের মতো নিখুঁত, পরিপাটি। কথা বললে চোখদুটি আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। বুদ্ধি ও জ্ঞানপ্রভা প্রকট হয়ে থাকে। গ্রামের সকলে তাকে নিয়ে গর্ব করে। মায়ের মুখেও অনেক প্রশংসা শুনেছে। কিন্তু সেই ভোরবেলায় মা একটুও প্রশংসা করল না, নিন্দাও করল না। তারপরেও কথাগুলো তার ভালো লাগেনি। ডাক্তার হাদিরও না। স্বর্ণলতা দূর থেকে মুখটা দেখেছিল, আচমকা ম্লান হয়ে ওঠেছিল। দৃষ্টিজোড়া নেমে গিয়েছিল আপনাআপনি। তাহলে কি মা তাকে অপমান করেছিল? স্বর্ণলতা মায়ের বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। তিনি বলেছিলেন, ‘ ডাক্তারসাব, আপনে স্বর্ণলতা রে পছন্দ করছেন ঠিকই কিন্তু ভালোবাসেন নাই। ভালোবাসা না পাইলে কষ্ট হয় আর পছন্দের জিনিস না পাইলে আফসোস হয়। স্বর্ণা আপনের চিরকালের আফসোস হইয়া থাকবো। ‘ কথাগুলো মনে পড়তে ভাবনার মধ্যেও চমকে ওঠল! হাদি ভাই তাকে পছন্দ করে, এটুকুতে মা খুশি না। সে চাচ্ছিল, স্বর্ণলতাকে ভালোবাসুক। পছন্দ আর ভালোবাসা কি আলাদা? যাকে ভালোবাসে না, তাকে কি পছন্দ করা যায়?

মুনছুর সাখাওয়াতের খাওয়ায় মন নেই। তার অভঙ্গুর মনোযোগ স্বর্ণলতার মুখটায়। হঠাৎ চমকে ওঠা, আবার মিইয়ে পড়া সবই লক্ষ্য করছে। উদাস দৃষ্টি, আনমনা চিত্তটাকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”

সে ছিটকে ওঠল। অপ্রস্তুতভাবে আওয়াজ দিল,
” হুম? ”
” খাওয়া থামিয়ে কী ভাবছ? ”
” হাদিভাইকে নিয়েই ভাবছিলাম। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের উত্তরটা জানা ছিল। তারপরেও স্ত্রীর মুখে শুনতে ভালো লাগল না। চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে ওঠল নিমিষেই। ক্রো ধে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠল চোখজোড়া। হাতের তলায় থাকা ভাত কয়টা পিষে নিতে নিতে সুধাল,
” ওর কথা কী ভাবছিলে? ”

শান্ত ও সুধীর কণ্ঠস্বর। রা গের ছিঁটেফোঁটাও বেরিয়ে এলো না গলা দিয়ে। উল্টো ভীষণ আগ্রহী ও কৌতূহলী দেখাল। স্বর্ণলতা পূর্বের মতো নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায় জবাব দিল,
” ভাবতাছিলাম, বিয়া করবো এই কথাটা তো জানাইল না! ”
” তোমাকে জানানোর কথা ছিল? ”
” না। কিন্তু আমগো গ্রামের পোলা তো! বেহালার একমাত্র বড় ভাই। সেদিন দেখাও হইল। কত কী কইল, এটা তো কইল না। বেহালাও তো কইল না! ”
” ও জানত না। বিয়েটা হঠাৎ করে হয়েছে। ”

একটু থেমে পুনরায় বলল,
” সেদিন কী বলেছিল, স্বর্ণলতা? ”
” কোনদিন? ”
” এটা তোমার জানার কথা। মাত্রই বলেছ, সেদিন কত কী বলেছে। কী বলেছে? ”

স্বর্ণলতা এবার একটু বিরাম দিল। তটস্থ হলো। সতর্কতা দেখাল কথাবার্তায়। নিজের ভাতের প্লেটটায় মনোযোগী হতে হতে বলল,
” তেমন কিছু না। আমার পড়ালেখার বিষয়ে খবর নিতাছিল। পড়ালেখা শেষ কইরা কী করমু, তাই জানতে চাইছিল। ”
” আর কিছু জানতে চায়নি? ”
” হ। কইতাছিল, তার লগে আমার স্বপ্নের কাছে যামু নাকি। ”
” তুমি কী বলেছিলে? ”

সে এবার বিরক্ত হলো। চোখ দুটো ঝটিতে উঠে গেল। ভ্রূদ্বয় ও কপালের মাঝে ভাঁজ ফেলে বলল,
” খাইতে ডাইকা এত প্রশ্ন করতাছেন ক্যান? আমি উত্তর দিমু নাকি খামু? ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত খেল যেন! হতভম্ব হয়ে গেল। মেয়েটার কণ্ঠ একটু বেশি উঁচুতে উঠে গেল কি? গলাটাতে কি শুধুই বিরক্ত নাকি রা গ, কষ্টও আছে? ডাক্তার হাদির বিয়ের সংবাদ মেয়েটাকে নিশ্চয় ব্যথা দিয়েছে, হৃদয় ভেঙেছে। তাহলে কি স্বর্ণলতা অবচেতনে ডাক্তারকে ভালোবেসেছে?

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর মুখটায় আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে হালকা স্বরে বলল,
” খাও। ”

সে সত্যি খেতে শুরু করে দিল। একবারের জন্যও দৃষ্টি তুলল না। নতুন করে কিছু বলছেও না। মুনছুর সাখাওয়াত চুপচাপ তার খাওয়া দেখছে। মুখটায় অনেক্ষণ চেয়ে থেকেও মনের মধ্যে কী চলছে বুঝতে পারছে না। অব্যর্থ থাকতে ভালোও লাগছে না। নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল,
” কাকে বিয়ে করেছে শুনবে না? ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। দেহভঙ্গিতেও কোনো পরিবর্তন নেই। একমনে খেয়ে চলছে। এক ফাঁকে শুধু গ্লাসে পানি ঢেলে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” তোমাদের হেডমাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করেছে। শুনলাম, তোমার সাথেই নাকি পড়ে? ডাক্তার তো দেখেই পাগল হয়ে গেল। আমার কাছে ছুটে এসে হাত-পা ধরে বলল, বিয়ে করিয়ে দিতে। ”

তার খাওয়া প্রায় শেষ। এক গ্রাসের মতো ভাত পড়ে আছে প্লেটে। সেগুলো জড়ো করছিল মুখে পড়বে, হলো না। খাওয়া বন্ধ করতে হলো। সামনের মানুষটার দিকে তাকাতে বাধ্য হলো। নীরব চেয়ে থেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল,
” বিয়াটা কি আপনে করাইছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাসার চেষ্টা করেও পারল না। ঠোঁটদুটো অবশ হয়ে আছে যেন! বুক উঁচু করে দাম্ভিক সুরে বলল,
” হ্যাঁ। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে পরিয়েছি। ডাক্তারকে তো আমিই বিয়ে বাড়ি নিয়ে গেলাম। ”

স্বর্ণলতা তাৎক্ষণিক কিছু বলল না। স্বামীর রুক্ষ বদনটায় চেয়ে আছে শুধু। চোখের তারায়, কণ্ঠে বিজয়ের উল্লাসটা বেমানান লাগছে। মুহূর্তেই চেহারাটা ভীষণ অসহণীয় ঠেকল। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” খাওয়া শেষ করেন। আমার ঘুম ধরছে। ”

মহাজন এই কথাটা ফেলতে পারল না। ভাতের দিকে মনোনিবেশ করে দেখল, সেগুলো আস্ত নেই। দানার চিহ্নও মুছে গেছে প্রায়। হাতের চাপে পড়ে গলে-মিশে একাকার অবস্থা! খাওয়ার রুচিটায় চলে গেল। অন্য সময় হলে হয়তো পানি ঢেলে উঠে যেত নাহয় নতুন করে ভাত নিত। আজকে দুটোর একটাও করল না। চোখ বুঁজে শক্ত হয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। চিবুনোর ঝামেলায় গেল না। মুখে নিয়েই গিলতে লাগল। প্রতি গ্রাসের পরপরে এক ঢোক করে পানি খেল। এই বেহাল, বিস্বাদ গ্রহণের মধ্যে শুনতে পেল,
” আপনে কইছিলেন না, আমি যেন সবসময় সত্যি কথা কই? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখে জবাব দিল না। চোখ খুলে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণলতা বলল,
” তাইলে আপনেও আমার কাছে সবসমসয় সত্যি কথা কইবেন। ”

সে পানি খেয়ে নিল চট করে। তারপরে প্রত্যুত্তর করল,
” আমি সত্যিই বলি, স্বর্ণলতা। ”
” মিথ্যা কথাও কন। একটু আগেই কইছেন। ”
” কোন কথাটা মিথ্যা বলেছি? ”

স্বর্ণলতা হাত ধুয়ে নিল। হাতটা শাড়ির আঁচলে মুছে তাকাল স্বামীর দিকে সরাসরি চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে দৃঢ় গলায় বলল,
” হেড স্যারের মাইয়া রে দেইখ্যা হাদিভাই পাগল হয় নাই। হইতেই পারে না। উনার পছন্দের সাথে ঐ মাইয়ার কোনো মিল নাই। ওর মাথা ভর্তি গোবর। স্বভাবচরিত্রও ভালো না। আমার সাথে পড়লেও বয়সে তিন বছরের বড়। আমগো ক্লাসে ভর্তি হইছে এই বছরে। এর আগে অন্য স্কুলে পড়ছে। শুনছি, ঢাকায় মামাবাড়ি থাকত। ওখানকার স্কুলে দুইবার মেট্রিক পরীক্ষা দিছে। পাশ করতে পারে নাই, তাই হেডস্যার এই স্কুলে ট্রান্সফার কইরা আনছে। এখানে আসার সাথে সাথে দুই পোলার সাথে সম্পর্কে জড়াইছে। খারাপ সম্পর্ক! সবাই জানে। হাদিভাইয়েরও জানার কথা। এরপরেও এই মাইয়া রে বিয়া করার জন্য পাগল হইবো কোন দুঃখে? গ্রামে কি মেয়ের অভাব পড়ছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত নিজেও এই ঘটনা জানত। কিন্তু মনে ছিল না। এসব মনে রেখে তার কী লাভ? স্বর্ণলতা এখানে থামল না। আরও বলল,
” তারপরে যে কইলেন, হাদিভাই আপনের কাছে ছুইটা আইসা হাত-পা ধইরা কইছে, বিয়া করাইয়া দিতে? এইটাও মিথ্যা কথা। উনি আপনে রে পছন্দ করে না। আপনের বাড়ির ধার দিয়াও হাঁটতে চায় না। তারপরেও এখানে ছুইটা আইবো ক্যান? আপনে কি উনার আব্বা লাগেন নাকি মাইয়ার আব্বা লাগেন? উনার বিয়ার সাথে আপনের কী সম্পর্ক? হাদিভাই এমনিতেই ভালা মানুষ। দেখতে সুন্দর। তার উপরে ডাক্তার। কত বড় বাড়িতে থাকেন! যে কোনো বাড়িতে বিয়ার প্রস্তাব দিলে রাজি হইয়া যাইবো। আপনের ডর দেখাইতে হইবো না। ”
” তুমিও রাজি হয়ে যেতে, তাই না? ”

স্বর্ণলতা দমে গেল। চোখের দৃষ্টি কেঁপে ওঠল। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বিচলিত দেখাল মুখের ভাবে, দেহভঙ্গিতে। মুনছুর সাখাওয়াত এবার প্লেটে পানি ঢালল। হাত ধুয়ে নিল সেও। পরিষ্কার ভেজা হাতদ্বয় টেবিলের উপরে রেখে মুখটা সামনে এগিয়ে বলল,
” উত্তর দেও, স্বর্ণলতা। ডাক্তার যদি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিত, তুমি রাজি হতে? ”

তার মাথা নুয়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না একদম। জড়োসড়ো হয়ে আছে। চোখের সামনে ডাক্তার আল হাদির মুখটা ভেসে আছে। কী ভালো দেখতে! অমায়িক ব্যবহার। একবার যে ফোনে হেসেছিল, সেটাও মনে পড়ে গেল এই মুহূর্তে। কী আশ্চর্য! তখন খেয়াল না করলেও আজ, এখন মনে হচ্ছে এত সুন্দর করে আর কেউ হাসতে পারবে না।

মুনছুর সাখাওয়াত উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নীরব, ভীত স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে গেল অনেকটা। তারপরে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” রাজি হতে না? স্বর্ণলতা, বলো। ”

সে ফট করে উত্তর দিল,
” না। ”
” মিথ্যা কথা। স্বর্ণলতা, তোমাকে মিথ্যা বলতে মানা করেছি। ”
” আমি সত্যি কইতাছি। ”
” বিশ্বাস করি না। একটু আগে তুমি নিজেই বলেছ, যেকোনো পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারা রাজি হবে। ”
” হয়তো আমিও হইতাম। কিন্তু এখন না, আরও পরে। যদি তখনও তিনি এমন থাকতেন, তাইলে। এখন তো আমি বিয়া নিয়া ভাবি নাই। আমি শুধু পড়ালেখা নিয়া ভাবছি। ”
” পরে বিয়ে, এখন ভালোবাসা? ”

স্বর্ণলতা এই কথাগুলো বলার সময় চোখ বুঁজে ফেলেছিল। এবার খুলল। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে আছে ঝুঁকে থাকা দীর্ঘকায় শরীরের মালিকটার দিকে। চোখে, মুখে কী যেন একটা সমানে ছুটে চলেছে। এক মুহূর্তের জন্য থামলে সে ধরে ফেলত। কিন্তু থামছেই না!

” চুপ করে থেকো না, স্বর্ণলতা। উত্তর দেও। তুমি যে ডাক্তারকে ভালোবাসো, টের পাচ্ছ? ”

ভালোবাসা! কেমন ভালোবাসার কথা বলছে? স্বর্ণলতার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, তার আম্মাও এই ভালোবাসাটায় ডাক্তার হাদির মধ্যে খুঁজেছে, পায়নি। মহাজন কি পেয়েছে? কীভাবে পেল? এই ভালোবাসা বুঝার কি কোনো লক্ষণ আছে? স্বর্ণলতার সেরকম কোনো লক্ষণ জানা নেই। বইয়ের মধ্যে সে অনেক রোগের লক্ষণ পেয়েছে, কিন্তু ভালোবাসার লক্ষণ পায়নি। এটা কি কোনো বিশেষ রোগ? সে সংশয় চিত্তে হালকা গলায় জানাল,
” না। ”
” অবশ্যই ভালোবাসো। নাহলে একটা মানুষের সম্পর্কে এতকিছু জানলে কী করে? ওর হয়ে তুমি প্রতিবাদও করছ। ”

স্বর্ণলতাও উঠে দাঁড়াল। এঁটো প্লেট, বাটি একসাথে করতে করতে বলল,
” আমি কারও পক্ষে প্রতিবাদ করি নাই। সত্য কইছি। আপনে যে আমার সাথে মিথ্যা কইছেন, সেটা বুঝাইছি। ”

সে টেবিল ঘুরে এলো মুনছুর সাখাওয়াতের কাছে। তার প্লেটটাও তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরতেই আঁচলে টান খেল। চমকে পেছনে তাকাতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত আঁচল ধরে আছে। তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল! হাত কাঁপতে লাগল। জড়ো করে তুলে আনা প্লেটগুলো ফসকে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। স্বর্ণলতা রুদ্ধশ্বাসে ভয়ে ভয়ে চোখ বুলাচ্ছে চারপাশে। কেউ নেই! মধ্যরাতে কারও থাকার কথাও না। মানুষটা ডেকে এনে ফাঁসিয়ে দিল না তো!

মুনছুর সাখাওয়াত তার এই ভয়ার্ত মুখ, বুকের ধুকপুকানি, হাত-পায়ের কাঁপুনি কিছুই দেখল না। সে আঁচলে হাত মুছল প্রথমে, তারপরে ঠোঁট মুছে ছেড়ে দিয়ে বলল,
” তোমাকে বিশ্বাস করলাম। ভবিষ্যতেও করতে চাই। এজন্যেই ডাক্তারকে বিয়ে করাতে হয়েছে। তোমাকে পাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছি। ”

স্বর্ণলতা আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়ল ধীরে ধীরে। হাতের কাঁপুনি থামেনি তখনও। হৃদস্পন্দনের গতিটা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এত জোরে ছুটছে! কতদূর ভেবেছিল! দানবটা কাছে আসার চেষ্টা করছে বিয়ের দিন থেকেই। কিন্তু এভাবে কাপড় টেনে ধরেনি তো কোনোদিন। এজন্যেই হয়তো ভয়, আতঙ্ক সর্বোচ্চ কোটায় পৌঁছে গিয়েছিল।

মুনছুর সাখাওয়াত ধীর পদক্ষেপে তার সামনে এসে দাঁড়াল। হাত থেকে এঁটো বাসনপত্র নিতে নিতে পুনরায় বলল,
” তুমি সত্য বলেছ, তাই আমিও সত্য বলছি। ডাক্তার বিয়ে করতে চায়নি। আমি বাধ্য করেছি। তুমি ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জানো। যেটা জানো না, সেটা আমি বলি। ডাক্তার তোমাকে ভালোবাসে, বিয়ে করতেও চেয়েছিল। তুমি যেমন এখনই বিয়ে করতে চাও না, পড়ালেখা করতে চাও? ডাক্তারও তোমাকে এখনই বিয়ে করতে চায়নি, তোমাকে পড়ালেখা করাতে চেয়েছিল। দুজনের চিন্তা-ভাবনা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা একই। মেলামেশা না করেও একে-অপরকে চেনো, জানো, বুঝো। তারপরেও তোমরা এক হতে পারনি, পারবেও না। কারণ, আমার ভাগ্যে তুমি ছিলে, পেয়েও গেছি। ”
” হাদিভাই আমারে ভালোবাসে? আপনারে কইছে এই কথা? ”
” না। আমি বুঝেছি। ”
” কীভাবে বুঝলেন? আমি তো বুঝি নাই! ”
” এখন বুঝেও লাভ নেই, স্বর্ণলতা। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, ডাক্তারও বিয়ে করেছে। সব থেকে বড় কথা তুমি ও কে ভালোবাসনি। ব্যস! এই চ্যাপ্টার এখানেই ক্লোজড। ”

তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না। মুনছুর সাখাওয়াত বাসনপত্রগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে দ্রুত বলল,
” এগুলো আর কখনও ধরবে না। এই কাজ তোমার না। বাড়িতে ঝি আছে, ওরা করবে। ঠিক আছে? ”

স্বর্ণলতা উত্তর দিল না। সে ঘোরে পড়েছে। ভীষণ আনমনে দেখাচ্ছে। হাদিভাই তাকে ভালোবাসে, কথাটা শোনার পর থেকেই বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। তার বারবার মনে হচ্ছে, এই ভালোবাসার অর্থ আলাদা, অনুভবতা আলাদা। এখানে চাওয়া-পাওয়া হয় অন্যরকম। কিন্তু সঠিকভাবে ও নিশ্চিত হয়ে উপলব্ধি করতে পারছে না। সে আপন ভাবনায় এতটায় বিভোর যে, টেরও পাচ্ছে না মুনছুর সাখাওয়াত তার হাত ধরে আছে। দুইহাত একসাথে মিলিয়ে নিজের হাতে নিয়ে বলল,
” তুমি শুধু আমাকে ভাত বেড়ে দিবে, একসাথে খাবে। তাহলেই হবে। বুঝেছ? ”

সে এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঠিকই কিন্তু দেখছে অন্যকিছু। ভাবনার সম্পূর্ণটায় দখল করে আছে ডাক্তার আল হাদি। তার ভালোবাসার অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এতেও কী দারুন সুখ পাচ্ছে!

হাত ধরার পরেও মেয়েটা চমকায়নি, হাত ছাড়িয়ে নেয়নি। মুনছুর সাখাওয়াত ভারি আশ্চর্য হয় প্রথমে। পরমুহূর্তে ভেবে নেয়, স্বর্ণলতা হয়তো তাকে মেনে নিচ্ছে। তাই সায় দিচ্ছে। কিন্তু এতক্ষণেও কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সন্দেহ উদ্রেক হয়। ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণা? ”

সে চমকে কেঁপে ওঠল। সম্বিৎ ফিরে পেল সঙ্গে সঙ্গেই। হাত টেনে নিল এত দ্রুত যে, খেয়ালও করল না লোহার মতো শক্ত হাতের স্পর্শ কতটা কোমল ছিল! স্বর্ণলতা এক ঝলক স্বামীর দিকে চেয়েই সরে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াতের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল।

________
ঘুমে চোখ বুঁজে এলেও মুনছুর সাখাওয়াত ঘুমাতে পারছে না। পাতা দুটি এক করলে তার মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। আয়নার প্রতিবিম্বের মতো স্পষ্ট ও জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে। নড়ছে, কথা বলছে কিন্তু ছোঁয়া যাচ্ছে না! এভাবে তাকে কখনও মনে পড়েনি। মায়ের মতো কেউ যে তার জীবনে ছিল, এই বিষয়টা সে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা হয়ে প্রকট হলো। মুনছুর সাখাওয়াতের এত অস্থির লাগছে! ঘুমানোর প্রাণপণ চেষ্টা বাদ দিয়ে উঠে বসল। এতেও শান্তি পাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে পড়ল, ঘরময় হাঁটতেও লাগল। এই মানুষটার আকস্মিক আগমনের কারণ কী হতে পারে তাই ভাবছে। বেঁচে থাকতেও তো এমন জ্বালায়নি! এভাবে চিন্তা-চেতনায় জড়াতে পারেনি! সে অন্ধকার রুমে অনেক্ষণ হাঁটল। হাঁটতে হাঁটতেও সহসা মনে হলো, সে একা হাঁটছে না। পাশে একটি নারী ছায়া। গা থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে। ভালো না আবার খারাপও না। কিন্তু পরিচিত, চাইলে সহ্য করা যায়। মুনছুর সাখাওয়াত সহ্য করতে চায় না। সে তখনই ছুটে গিয়ে রুমে আলো জ্বালাল। পুরো রুমে চোখ বুলাল। কেউ নেই। কিন্তু গন্ধটা আছে। আগের চেয়েও তীব্র হয়ে ছড়াচ্ছে যেন! তার এত রা গ হলো! বেফাঁসে মায়ের নামটা নিয়ে খারাপ একটা গালি দিয়ে ফেলল। নিজ কানে পৌঁছানো মাত্র মুখটা দুই হাতে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ এভাবেই মুখ চেপে থাকল। তারপরে হাত সরিয়ে নিতে নিতে দেখল, গন্ধটা নেই। শান্তি পেল। বুক ভরে শ্বাস টেনে রুমের আলো নেভাল। পুনরায় বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজতেই মায়ের মুখটা আবারও দেখা দিল। তারপরে স্বর্ণলতা, তার আঁচলখানিও। সে চোখ খুলল না। স্বর্ণলতা খাওয়া শেষ করে আঁচলে হাত মুছামাত্রই মুখটা মায়ের মুখের সাথে বদলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত ঝটিতে চোখ মেলল। সটান উঠে বসতেই মাকে মনে পড়ার কারণ উদ্ঘাটন করে ফেলল।

শীতকালে মুনছুর সাখাওয়াতের মায়ের হাত ও পায়ের আঙুলের ফাঁকে এক ধরনের ঘা হতো। পানি হাতালে বা বেশিক্ষণ ভিজে থাকলে সেই ঘা ভয়ঙ্কর রূপ ধরত। এত বিচ্ছিরি দেখাত! গন্ধও ছড়াত। ঘৃণায় মুখের মধ্যে থুতু জমত। তার ছোঁয়া কিছু খেতে ইচ্ছে করত না। এই কারণে তার মা শীতকালে ঘর সংসারের কাজ করতেন না। করলেও পানি ব্যবহারে খুব সতর্ক থাকতেন। সারাক্ষণই আঁচলে হাত মুছতেন। খাওয়ার পরে স্বর্ণলতা আঁচলে হাত মোছার সময়ে সে খেয়াল করেছিল। সেখান থেকেই কিছু একটা হয়। স্ত্রী হাতের কাছে আসতেই মুনছুর সাখাওয়াত বেখেয়ালে তার আঁচল ধরে ফেলে, হাত-মুখ মুছে। এই ধরনের অভ্যাস তার মধ্যে ছিল না। এখন না, বাচ্চাকালেও না। ছোট থেকেই সে নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করে। নিজস্ব জিনিসগুলো পৃথক রাখতে শুরু করে।

মায়ের সাথে স্ত্রীর এই মিলের কারণেই কি তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল? মুনছুর সাখাওয়াত ভাবতে বসল। বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না। হঠাৎ করেই মস্তিষ্কে কিছু একটার বিস্ফোরণ ঘটল। গা ছমছমে অনুভূতি হতে লাগল। অন্ধকার রুমে চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবল, এই রুমে সে ছাড়া আর কেউ নেই। তারপরে মনে হলো, শুধু এই ঘরে না, এই বিশাল বাড়ি, গ্রাম, জেলাতেও কেউ নেই। গোটা দেশটায় ফাঁকা! পুরো পৃথিবীতে একটি মাত্র প্রাণ বেঁচে আছে। সেই প্রাণটি সে। ভীষণ একলা, অসহায়। মুনছুর সাখাওয়াত আবারও উঠে গিয়ে রুমে আলো জ্বালাল। তারপরে দ্রুত হস্তে কল লাগাল দাদিজানের মোবাইলে। মোবাইলটা এখনও স্বর্ণলতার কাছেই আছে। প্রথমবারে ধরল না। সে আবারও কল করল। এবার ধরল। ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল,
” কে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ব্যাকুল হয়ে ওঠল। অতিশয় আকুল গলায় বলল,
” আমি। স্বর্ণা, আমি। তোমার স্বামী। ”

ওপাশটা নীরব হয়ে গেল। সে একবার মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে দেখল, কল কেটে গেছে নাকি। কাটেনি। আবারও ডাকল,
” স্বর্ণা? চিনতে পারছ না? আমি মুনছুর সাখাওয়াত। ”

সাথে জবাব এলো,
” খালি নাম কইলে হইবো? চেহারার বর্ণনা দেন। বাড়ির ঠিকানা, স্বভাবচরিত্রও কইতে হইবো। তাইলে না চিনমু! ”

কণ্ঠটায় ঘুমের ভাব নেই। পরিষ্কার ও শ্লেষাত্মক শোনাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত তবুও ধরতে পারল না বোধ হয়। অসহায় গলায় সুধাল,
” তুমি কি সত্যি আমাকে চিনতে পারছ না? ”
” আপনের কথা শুইনা তাই তো মনে হইতাছে! ”

সে একটু থামল। গভীর নিঃশ্বাস টেনে ভাবল, মাঝরাতে বউয়ের কাছে মজার পাত্র হয়ে গিয়েছে! এই দিনটাও দেখার বাকি ছিল? মেয়েটার কাছে সে অপদস্ত হওয়া ছাড়া কিছুই পাচ্ছে না! স্বর্ণলতা ঐপাশ থেকে তাগাদা দিল,
” আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া চুপ কইরা আছেন ক্যান? কিছু কওয়ার থাকলে কন নাইলে কাইটা দিই। ”
” আমার ঘুম আসছে না। ”
” তাইলে জাইগা থাকেন। ”
” জেগে থাকতেও পারছি না। ”
” ক্যান? ”
” ঘুমে চোখ বুঁজে আসছে। ”
” তাইলে ঘুমাইয়া যান। ”
” পারছি না। মা খুব যন্ত্রণা করছে। ”

ঐপাশ থেকে বিস্ফারিত কণ্ঠে আওয়াজ এলো,
” মা! আপনের মা বাঁইচা আছে? ”
” না। মারা গেছে। তারপরেও খুব যন্ত্রণা করছে। চোখ বন্ধ করলেই মাকে দেখতে পারছি। ”
” ওহ। খুব ভালোবাসতেন মনে হয়। তাই..”
” না। আমি মাকে ভালোবাসি না। মা মারা যাওয়াতে আমার কোনো দুঃখও হয়নি। ”
” কী কন! মাকে তো সবাই ভালোবাসে। ”
” আমি ভালোবাসি না। ”
” তাহলে দেখা দিতাছে ক্যান? ”
” জানি না। তুমি এ ঘরে একটু আসবে? ”
” আমি গিয়া কী করমু? আপনের মারে তাড়াইয়া দিমু? ”
” হ্যাঁ, আসো না! ”
” কী কন! পাগল হইছেন? আপনের মা কি ভূত যে, আমি দোয়া-দরুদ পড়ে তাড়িয়ে দিব? ”
” কিছু পড়তে হবে না। তুমি এলেই চলে যাবে। ”
” পারমু না। আমার ঘুম ধরছে। ”

স্বর্ণলতা কল কেটে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত মোবাইলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপরে আবারও কল দিল। সে হয়তো ইচ্ছে করেই ধরছিল না। কিন্তু লাগাতার কল যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে আবারও ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” দরজা খোলো, আমি আসছি। ”
” না। আপনে রে ঠিক লাগতাছে না। মায়ের কাহিনিও বিশ্বাস হইতাছে না। আপনে আইবেন না, আমিও যামু না। ”
” আমি মিথ্যা বলছি না, স্বর্ণলতা। ”
” আমার তো সত্যিও মনে হইতাছে না। আপনে কি ছোট বাচ্চা যে, খারাপ স্বপ্ন দেইখা ভয় পাইতাছেন? উল্টা আপনে রে দেইখা জাগনা মানুষরাও ভয় পায়। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫৩)

স্বর্ণলতা নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে কল কেটে দিল। ফোনটাও বন্ধ করে রাখল। মুনছুর সাখাওয়াত কলে পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে ফোনটা বন্ধ তারপরেও লাগাতার কল করে যাচ্ছে। থামছে না। কোনোদিকে তাকাচ্ছেও না। কল ঢুকছে না, কাটছে আবার দিচ্ছে। এই একই কাজ করে গেল প্রায় আধঘণ্টার মতো। এরপরেই ধৈর্য্যের তার কেটে গেল। মেজাজ ও শ্বাস-প্রশ্বাস উভয় উত্তপ্ত ও উগ্র হয়ে ওঠল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাতের ফোনটা আছাড় মা রল! মেঝেতে বাড়ি খেয়ে কোথায় যে ছিটকে পড়ল খেয়ালও করল না। সে হম্বিতম্বিতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সোজা এসে দাঁড়াল নিজের রুমটার সামনে। দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে আটকানো। মেয়েটা সত্যি দরজা খোলেনি! এতবার করে বুঝানোর পরেও বুঝল না? তার বেলায় এই অবুঝপনা কেন? দূরে দূরে থাকা, এড়িয়ে যাওয়া স্বভাবটা কতকাল বয়ে বেড়াবে? অনেকদিন তো হলো বিয়ে হয়েছে, তার বউ হয়েছে!

মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে হলো দরজাটা ভেঙে ফেলতে, এরপরে আর ঠিক করবে না। আজীবন ভাঙা দরজা নিয়েই সংসার করবে। তবুও এই দরজা আটকে দেওয়ার সুযোগটা স্বর্ণলতাকে দিবে না। এত বিরক্তিকর! সে লা থি মারার জন্য পা উঁচিয়েও থেমে গেল। আস্তেধীরে নরম গলায় ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”

ঐপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। তারপরেও তার মনে হলো, মেয়েটা জেগে আছে। দরজার দিকে চেয়ে আছে। তাকে শুনছেও কিন্তু উত্তর দিচ্ছে না। মিটিমিটি হাসছে কি? হয়তো! সে কষ্ট পেলেই তো স্বর্ণলতা খুশি। তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত করাতেই তার যত সুখ, আনন্দ। পরাজিত করতে চায় সবক্ষেত্রে, সকলের কাছে। মুনছুর সাখাওয়াত দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে বলল,
” দরজা খোলো। স্বর্ণলতা, দরজাটা খোলো। ”

এবারও কোনো উত্তর এলো না। দরজাটাও খুলল না। সে বাধ্য হয়ে বলল,
” দরজা ভাঙতে কিন্তু আমার দুই মিনিটও লাগবে না। এসব কাজে আমি ওস্তাদ! জানোই তো? ”

সাথে সাথে স্বর্ণলতার কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” ভাঙ্গেন। মানা করছে কে? আপনের ঘর, আপনের দরজা। আমার কী? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হলো। ব্যথিতও হলো। মেয়েটার ডর-ভয় কি একেবারেই চলে গেল? নাকি উস্কাচ্ছে? এরপরে এটাকেও অযুহাত বানিয়ে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিবে না তো? সে দরজার কাছে আরও এগিয়ে এসে বলল,
” এভাবে বলছ কেন? এই ঘরটা তোমারও। ঘরের সবকিছুতেই তোমার ভাগ আছে। আমি দিয়েছি তো! ”
” তাইলে তো শান্তিতে ঘুমাইতে পারতাম। কেউ জ্বালাইতে পারত না। ”
” দরজাটা খুলে ঘুমাও। আমি একটুও জ্বালাব না। বিশ্বাস করো। তোমার পায়ের কাছে শুয়ে থাকব। ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। একেবারে চুপ হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত দরজার কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার কানটা ঠেকিয়ে নিল। ভেতরে কী চলছে, বুঝার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। সহসা শুনতে পেল,
” আপনে কি মদ খাইছেন? ”
” এই না, একদমই না। আমি তো মদের আশপাশেও থাকি না। ”
” তাইলে পাগলের মতো কথা কইতাছেন ক্যান? আপনের মাথাটা তো সত্যি ঠিক নাই। এখান থেইকা যান, আমি দরজা খুলমু না। ”

সে অবাক হয়ে জানতে চাইল,
” পাগলের মতো কী বললাম? আমার মাথা ঠিক আছে। শুধু ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। সেই কারণটাও তো তোমাকে বললামই। ”
” যে ভুল কইরাও কারও কাছে মাফ চায় না, মাথা নামায় না। সে আমার পায়ের কাছে মাথা রাইখ্যা শুইতে চায়! মাথা নষ্ট না হইলে এরকম কেউ কয়? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূদ্বয় কুঁচকে এলো। তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারল না। মেয়েটা কি তার চাওয়া বুঝতে পারছে না? তার পায়ের কাছে শোয়ার সাথে মাফের কী সম্পর্ক? দুটো কি এক বিষয়? তার স্পষ্ট মনে আছে, স্বর্ণলতার পায়ে মাথা রেখে ঘুমাবে এই কথাটা আরও একদিন বলেছিল। আজকে নতুন বলছে না। তাহলে কি সে ভুলে গেল? ভুলে যাওয়ার সমস্যাটাও তার সময়েই দেখা দেয়? মুনছুর সাখাওয়াত পায়ের কাছে মাথা রেখে নয়, পা দুটো জড়িয়ে ঘুমাতে চায়। এটা বললে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যেত! সে মানানোর চেষ্টা ছাড়ল না। বলল,
” তুমি ভুল বুঝছ। দরজাটা খোলো। আমি ভেতরে এসে বুঝাচ্ছি। ”
” পারমু না। দরজা ভাঙতে চাইছেন না? ভাঙ্গেন। ”

এই জেদের সাথে কিছুতেই পেরে ওঠল না। মুনছুর সাখাওয়াত হেরে গেল। আরও একটিবার পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলো।

_______
স্বর্ণলতা দরজা খুলে রুম থেকে বেরুল, ভোরবেলা। ফজরের নামাজের সময়। এই রুমে জায়নামাজ নেই, নামাজ পড়ার মতো পবিত্রতা আছে নাকি জানেও না। সন্দেহ নিয়ে নামাজ পড়া ঠিক হবে না। তাই দাদিজানের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। দরজাটা খোলাই আছে। সে দূর হতে দেখল, দাদিজান নামাজ পড়ছেন। আজও সে পরে ওঠেছে! জানতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তখনই নজরে আটকাল মুনছুর সাখাওয়াতের দীর্ঘকায় শরীরটা। দাদিজানের বিছানায় উপুড় হয়ে আছে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে! এই রুমে এই মানুষটা সচরাচর ঢুকে না। প্রয়োজনে কিংবা ডাক পেলেও দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ প্রয়োজনে সামান্য ভেতরে ঢুকে। কিন্তু বিছানায় বসতে দেখেনি কখনও। দাদিজানও সাবধান থাকেন সবসময়। চোখে, মুখে এরকম একটা ভাব থাকে যে, নাতি রুমে ঢুকলে সব নোংরা, অপবিত্র হয়ে যাবে। সেই মানুষটা তার রুমে, বিছানায় ঘুমাচ্ছে। তাকে রুমে রেখে দাদিজান নামাজও পড়ছেন! সে আশ্চর্য না হয়ে পারল না। বিস্ময়ের দ্যুতিটা ধরে রেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ঘুমন্ত স্বামীর দিকে দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। উপুড় হয়ে থাকায় মুখটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু চুল, পোশাক, হাত-পায়ের অবস্থান সবই এলোমেলো দেখাচ্ছে।

খাইরুন নিসা সালাম না ফেরানো পর্যন্ত সে নীরবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টিজোড়া প্রথম থেকেই মুনছুর সাখাওয়াতের দিকেই স্থির ও অপলক আছে। অবিশ্বাস্য ও বিস্ময় ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। ধ্যান ভাঙল দাদিজানের কণ্ঠস্বরে,
” ঘুমিয়ে আছে, ভয় নেই। এখন উঠবে না। নামাজটা শেষ করো। যাও। ”

স্বর্ণলতা তখনই ওযু করে নিল। নামাজ শেষ করে জায়নামাজ ভাঁজ করছে। ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখছে। মানুষটা এখনও উপুড় হয়ে আছে। দুই হাতটাও বুকের নিচেই পিষে আছে। ঘাড়টা পর্যন্ত নাড়ায়নি! একভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। শ্বাস নিচ্ছে নাকি কে জানে! দূর হতে বুঝা যাচ্ছে না। সে অজান্তেই বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। পর্যবেক্ষণটা ঠিকমতো করতে পারল না। দাদিজান মাথায় হাত রাখলেন। স্নেহপূর্ণ স্পর্শ! মৃদু হেসে বললেন,
” তোমরা সুখী হও। ”

সে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখতে তিনি পুনরায় বললেন,
” মুনছুর তোমাকে আদুরীর মতোই আগলে রাখতে চাচ্ছে, ভালোবাসতে চাচ্ছে। দেখ, আবার ওর মতোই হারিয়ে যেও না। তাহলে নাতিটা খুব কষ্ট পাবে। কাল রাতেই যে পাগলামিটা করল! শুধু কান্নাটায় বাকি ছিল। ”

আদুরী! আবারও এই নামটা সামনে এলো। এবার মুনছুর সাখাওয়াত না, দাদিজান এনেছেন। তাহলে কি তিনি আদুরীর বিষয়ে জানেন? সে কৌতূহলটা দমাতে পারল না। চট করে প্রশ্নটা করে ফেলল,
” আদুরী কে, দাদিজান? ”
” মুনছুরের পোষা আদরের বিড়াল। ”
” বিলাই! উনি আমারে বিলাই বানাতে চায়? ”

সে নাম, মুখ কুঁচকে ফেলল। এমনিতেই তার বিড়াল পছন্দ নয়। গা ভর্তি লোম, যেখানে সেখানে মুখ দেয়! কালো রঙের বিড়াল দেখলে তার আত্মা কেঁপে ওঠে। লোকটা আর কিছু পেল না? তাকে কি না ঐ ছোঁচা, ভয়ঙ্কর দেখতে বিড়াল বানাতে চাইল! স্বর্ণলতা মনস্থির করল, কোনোদিনও আদুরী হবে না। পায়ে পড়লেও না। খাইরুন নিসা তার থুতনিতে হাত রাখল। মুখটা উঁচু করে বলল,
” এত ছোট করে দেখ না। মুনছুর জন্মের পরে মন থেকে যদি কাউকে ভালোবেসে থাকে তাহলে ঐ আদুরীকেই বেসেছে। ”
” ক্যান? জন্মানোর লগে লগেই কি উনার আব্বা, আম্মা মইরা গেছিল? ”
” না তো। ওর চৌদ্দ বছর বয়সে ওর আম্মু মারা যায়। আমার ছেলে মানে মুনছুরের আব্বু তো মারা গেল সেদিন! ”

স্বর্ণলতা জিভ কামড়ে ধরল। লজ্জায় চোখ বুঁজে এলো। মায়ের মৃত্যুর সময়টা সঠিকভাবে না জানলেও বাবারটা জানত। কলিবুর মুখে শুনেছিল। তারপরেও বোকার মতো কথাটা বলে ফেলল! সে দ্রুত লজ্জা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল,
” দাদিজান, সন্তানরা তো সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজের আব্বা, আম্মা রে। ”
” হয়তো। কিন্তু মুনছুর এই দল থেকে ছুটে গেছে। ও ছোটকাল থেকেই একটু অন্যরকম ছিল। সহজে কাউকে পছন্দ করত না। যাকে পছন্দ না, তার সাথে জোর করেও মেশানো যেত না। আবার যাকে পছন্দ, সে মিশতে না চাইলেও মুনছুর তার কাছে গিয়ে পড়ে থাকত। ”
” তাইলে কি উনার আব্বা, আম্মারেও পছন্দ ছিল না? ”
” জোর দিয়ে বলতে পারছি না। বলা উচিতও না। মুনছুরের মা চাকরি করত। তাই ছেলেকে বেশি সময় দিতে পারত না। এজন্যে হয়তো ভাব-ভালোবাসাটা ঠিকমতো হয়নি। ”

স্বর্ণলতা অবাক হলো। সেই সাথে সন্দিহানও। সে গ্রামের মেয়ে। এখানের মেয়েরা চাকরি করে না। আয়-রোজগারের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব বর্তায় ছেলেদের উপরেই। যদি কোনো কারণে এটা সম্ভব না হয় বা সংসারের অবস্থা করুণ হয়, আর্থিক অভাব অনটনে পড়ে তাহলে বাধ্য হয়ে মেয়েরা কিছু একটা করতে চায়। অধিকাংশরাই বড় বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। মুনছুর সাখাওয়াতের মাও কি তেমন কিছু করত? স্বর্ণলতা প্রশ্নটা মনের মধ্যে আটকে রাখল। অন্য কিছু জিজ্ঞেস করল,
” তখন কি আপনেরা অনেক গরীব ছিলেন, দাদিজান? ”
” তুমি যতটা ভাবছ ততটা গরিব ছিলাম না। তোমার দাদা শ্বশুরের পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকায়। ইট-পাথরের বানানো দো’তলা বাড়ি। আমরা উপরে থাকতাম। নিচের অংশটা ভাড়া দিতাম। ওতেই আমাদের সংসার চলে যেত। কিন্তু সমস্যা হলো মুনছুরের আব্বুকে নিয়ে। সে চাকরি করবে না, ব্যবসাও না। কিন্তু দুইহাতে টাকা খরচ করবে। এই টাকা তাকে কে দিবে? বাড়ি ভাড়ার টাকা তো সংসারেই শেষ! তাই বউকে মা রধোর করত। বলত, বাপেরবাড়ি থেকে এনে দিতে। তার পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না। তাই চাকরি করতে বাধ্য হয়। বেতনের পুরো টাকাটায় মুনছুরের আব্বুকে দিয়ে দিত। এত কিছু করেও বেচারি সুখী হতে পারল না! স্বামী ভালোবাসল না, ছেলেটাও না। ছুটির দিনে ছেলেটাকে ডেকেও কাছে নিতে পারত না! ”

খাইরুন নিসা কথা বলতে বলতে রুমের বাইরে আসেন। বসার রুমটা পেরিয়ে খাবার টেবিলে যান। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে ভারি আক্ষেপের সাথে বললেন,
” মনের মানুষটাকে পেলেই মনের মতো সংসার হয় না, জীবন হয় না। বুঝলি, নাতবউ? মুনছুরের আম্মু ওটায় প্রমাণ করে গেল। ”

দাদিজানকে অনুসরণ করতে করতে স্বর্ণলতাও টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। নাস্তা তৈরি হয়নি এখনও। তারপরেও এখানে এসে বসলেন কেন সে জানে না। সহসা কথাটা শুনল। সহজ কথা অথচ কী গভীর অর্থ! তার বুকে গিয়ে বিঁধল তীক্ষ্ণ ফলার মতো। মুহূর্তেই বিষিয়ে ওঠল সর্বাঙ্গ! একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল অথচ কারণটা ধরতে পারল না। সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আগ্রহ ভঙ্গিতে চেয়ে আছে দাদিজানের দিকে। খাইরুন নিসা পানি খাচ্ছেন। কতগুলো কথা বললেন! গলাটা শুকিয়ে এসেছে। গলাটাও ধরে এলো বোধহয়। ছেলের বউটাকে ভীষণ ভালোবাসতেন কি না! আচমকা তার মৃত মুখটা মনে পড়ে গেল।

পানি খাওয়া শেষ করে নাত বউয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” ওদের প্রেমের বিয়ে ছিল। প্রেম বুঝিস তো? ”

স্বর্ণলতা উত্তর দিল না। তিনি প্রত্যাশাও করেননি। নিজের মতো বলে চললেন,
” বউমা শিক্ষিত ও মার্জিত পরিবারের মেয়ে ছিল। প্রেমের সম্পর্কটা মানতে চায়নি। মানার মতো পাত্রও ছিল না। মুনছুরের আব্বুকেও পড়ালেখা করিয়েছিলাম, কিন্তু বেকার। চাকরি নেই, পাওয়ার চেষ্টাও নেই। এরকম একটা ছেলের কাছে কেউ মেয়ে দিতে চায়? বিয়ের পরে খাওয়াবে কী? বউমা ভাবল, বিয়ে হলে দায়িত্ব কাঁধে পড়বে তখন ঠিকই চাকরি করবে। এই আশায় পরিবারের অবাধ্য হয়ে বিয়েটা করল। কিন্তু কিছু বদলাল না! উল্টো বাপেরবাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে বলছে। কোন মুখে চাইবে বলো? সংসারেও নিত্য অশান্তি! তাই চাকরিটা করে। তুমিও ও কে খারাপ মনে করো না। খুব ভালো মেয়ে ছিল। বেঁচে থাকলে দেখতে পেতে। ওর মতো মানুষই হয় না! ”

তার কণ্ঠটা আবারও ধরে এলো। কাঁপছে। চোখদুটিও অশ্রুতে চিকচিক করছে। স্বর্ণলতার সামনে না থাকলে হয়তো কেঁদেই দিতেন! সে বুঝতে পারছিল, এখানেই থেমে যাওয়া উচিত। তবুও থামতে পারল না। জিজ্ঞেস করে বসল,
” উনি মরছে ক্যামনে, দাদজান? ”
” বিষ খেয়েছিল। ”

স্বর্ণলতা চমকে ওঠল। হতভম্ব হয়ে গেল। এই সময়ে কলির আগমন ঘটল। জিজ্ঞেস করল,
” আম্মাজান, আপনের নাস্তা বানানো হইয়া গেছে। নিয়া আইমু? ”
” না, পরে খাব। ”

কলি মাথা নেড়ে চলে গেল। স্বর্ণলতাও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। মনে হলো, নাস্তাটা পরে নয় এখনই খাওয়ানো উচিত।

_______
সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে অথচ মুনছুর সাখাওয়াতের ঘুম ভাঙছে না। এদিকে স্বর্ণলতার ক্ষুধায় পেট, পিঠের সাথে লেগে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। তারপরেও কিছু মুখে তুলছে না। দাদিজানের আদেশ, স্বামী বাড়িতে আছে তাকে রেখে খাওয়া যাবে না। ঘুম ভাঙলে একসাথে খাবে।

খাইরুন নিসা উঠোনে হাঁটতে গিয়ে দেখেন, গাছের আমগুলো বেশ বড় হয়েছে। পাকতে শুরু করেছে। তাই আলামিন ও চঞ্চলকে দিয়ে আম পাড়ালেন। সেগুলো জড়ো করে বাড়ির ভেতরে ঢুকেন। এসে দেখেন স্বর্ণলতা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। সামনে দুই প্লেটে খাবার সাজানো। আলগা, মাছি বসছে। তিনি প্রথমে খাবারগুলো ঢাকলেন। তারপরে স্বর্ণলতাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” মুনছুর কোথায়? ”
” ঘুম থেইকা উঠে নাই। ”
” এখনও ঘুমাচ্ছে? কয়টা বাজে দেখেছ? যাও, ডাক দাও। না খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমানো ভালো লক্ষণ না। ”
” আমি ডাকতে যামু? ”
” আর কে যাবে? স্বামীটা তো তোমারই। ”

স্বর্ণলতা প্রচণ্ড অনিচ্ছায় চোখ, মুখ বিরস বানিয়ে চেয়ার ছাড়ল। দাদিজানের রুমে এসে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত তখনও উপুড় হয়ে একভাবেই ঘুমাচ্ছে। গরমে শরীর ঘেমে গিয়েছে তারপরেও ঘুম ভাঙছে না। নড়চড়েও না। অদ্ভুত! সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল,
” এই যে, শুনছেন? ”

এই ডাকে সে উঠবে তো দূর সামান্য নড়লও না! স্বর্ণলতা একটু এগিয়ে এসে আবারও ডাকল। এখনও কোনো হেলদোল নেই। স্বর্ণলতা বিরক্তের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। একে তো পেট খালি তন্মধ্যে এই দানবের মতো লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ডাকতে এসেও সাড়া পাচ্ছে না! সে এগুতে এগুতে শিয়রের কাছে চলে এলো। উচ্চস্বরে ডাকল,
” শুনছেন? এই যে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এখনও উত্তর দিচ্ছে না। ঘুমটাও ভাঙছে না! মরার মতো ঘুমাচ্ছে। এমন করে ডাকলে তো মরা লাশও উঠে পড়ত এতক্ষণে। ভাবনাটা মস্তিষ্কে বাজতেই থমকে গেল। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল মন, চেতনা। অস্থিরতার হাওয়া স্পর্শ করতে লাগল মাথা থেকে পা অবধি। সে বেফাঁসেই বলে ফেলল,
” সত্যি সত্যি মইরা গেছেন নাকি? ”

এই প্রশ্নেরও উত্তর নেই। স্বর্নলতার শ্বাস ঘন ও তপ্ত হয়ে ওঠছে। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। লোকটা এত নীঃশব্দ কেন? মরা লাশের মতোই নিথর হয়ে পড়ে আছে যেন! সত্যি প্রাণ হারিয়েছে নাকি? বুঝবে কীভাবে যে, সুস্থ নাকি অসুস্থ? সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল মুখটায়। অন্যদিকে ফিরে আছে। এপাশ থেকে শুধু মাথা ও চুলই দেখতে পাচ্ছে সে। সোজা হয়ে ঘুমালে এতক্ষণ ঠিক টের পেয়ে যেত কী হয়েছে!

স্বর্ণলতা ভয়ে ভয়ে বিছানায় ওঠল। যেপাশে মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটা ফেরানো সেদিকে গিয়ে বসল। নাকের কাছে হাতটা নিবে তখনই চোখটা খুলে গেল। স্বর্ণলতা ভয়ে চমকে ওঠল। পেছনে সরে যেতে যেতে বলল,
” দাদিজান খাইতে ডাকে। ”

সে চোখ মেলেই থাকল। দেহ নড়ল না, মুখটাও না। পলক ফেলছে না। চাহনি আরও বড় করে তাকাতে স্বর্ণলতার বুকটা ধক করে ওঠল। এত লাল! যেন র ক্ত দিয়ে মাত্রই ল্যাপা হয়েছে। সে দূরে বসেও কাঁপছিল। নেমে গিয়ে যে পালাবে সেই শক্তিটাও পাচ্ছে না। লোকটা এমন আচরণ করছে কেন? ভূতেটুতে ধরেনি তো?

প্রায় মিনিট দুই পরে মুনছুর সাখাওয়াত উঠে বসল। স্বর্ণলতার দিকে তাকাল না। সোজা নেমে গেল বিছানা থেকে। হেঁটে খাবার টেবিলের কাছে পৌঁছাতে দাদিজানের সাথে দেখা হলো। কিন্তু থামল না। চোখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগল। নিজের রুমটার কাছাকাছি যেতে শুনতে পেল,
” আবার ঐ ঘরে ঢুকছিস যে, খাবি না? ”

সে উত্তর দিল,
” গোসল করে আসছি। ”

________
স্বর্ণলতা খাবার নিয়ে আবারও অপেক্ষা করছে। এবার একা নয়, সাথে দাদিজানও আছেন। তার নাতির সাথে কথা আছে। ভেবেছিলেন, খাওয়ার সময় সেরে নিবেন। সেটাও হচ্ছে না। ছেলেটা গোসল করতে এত সময় নিচ্ছে! না পেরে নাতবউকে বললেন,
” এখনও আসছে না কেন? দেখে আসো তো, কী হলো। ”

রাজ্যের অলসতা পেয়েছে যেন! দুর্বলও লাগছে দেহটায়। সকাল থেকে খালি পেটে ঘুরছে। একবার এই রুম আরেকবার ঐ রুম। সব তো এই লোকটার জন্যেই। স্বর্ণলতার মনে হলো, স্বামীরা বাড়ি থাকলেই বেশি জ্বালা। শান্তিমতো খাওয়াও যায় না! সে রুমে ঢুকেই ফেরত এলো। বিস্ফারিত গলায় জানাল,
” উনি তো গোসল করতে ঢুকে নাই। ঘুমাইতাছে। ”

খাইরুন নিসা অবাক কণ্ঠে সুধালেন,
” আবার? ”
” হ। ”
” মুনছুর তো এত সময় ধরে ঘুমায় না! ”

তার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পুনরায় বললেন,
” শরীর খারাপ করল নাকি? ”
” জানি না। ”
” তাহলে জেনে আসো। যাও ”

স্বর্ণলতা আবারও ঘরে ছুটল। মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বের মতোই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। গরমে ঘেমে নেয়ে ফেলেছে। পরনের পাঞ্জাবি পিঠের সাথে ল্যাপ্টে গেছে! ঘুমের এত তাড়া যে পাখাটাও ছাড়েনি! সে প্রথমে পাখা ছেড়ে দিল। তারপরে কাছে এগুতে এগুতে সুধাল,
” আপনের কি শরীর খারাপ? ”

সে নিরুত্তর। ঘুমে ডুবে আছে। ভারি নিঃশ্বাসও ছাড়ছে। স্বর্ণলতা দূর হতেও সেই শ্বাস টানার শব্দ পাচ্ছে। আরও একটু এগিয়ে আসতেই দেখল, ঘুমন্ত শরীরটা নড়ছে। মুহূর্তেই হাত, পা গুটিয়ে নিয়ে কাঁপতে লাগল। সে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনের কি শীত করতাছে? ”

বলতে বলতে ফিরে গিয়ে পাখাটা বন্ধ করে দিল। তারপর ছুটে এলো স্বামীর মাথার কাছে। সে চাপা স্বরে গোঙাচ্ছে। থরথরে ঠোঁট কাঁপছে। বন্ধ চোখটাও স্থির নেই! তার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে হলো না। এতটুকুতেই বুঝে গেল, দানবের মতো দেহটাকে জ্বর কাবু করে ফেলেছে। স্বর্ণলতা ছুটে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। দাদিজানকে খবরটা দিতে চেয়েও পারল না। তিনি খাবার টেবিলে নেই, রুমেও না। কলিবুকে জিজ্ঞেস করতে জানাল, তিনি বাড়ির বাইরে গেছেন। স্বর্ণলতা কিছুক্ষণ বসল। অপেক্ষা করল। কিন্তু তিনি ফিরছেন না! তার ভেতরটা অস্থিরতায় ফেটে যাচ্ছে যেন! মুনছুর সাখাওয়াতের কাঁপতে থাকা শরীরটা মাথা থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও সরছে না। লোকটাকে তার পছন্দ নয়, তাই বলে তো মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না! সে কী করবে ভাবতে ভাবতে স্মরণে এলো, দাদিজানের মোবাইলটা ঐ ঘরেই। ফেরত দেওয়া হয়নি। স্বর্ণলতা তখনই উঠে দাঁড়াল। রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিল। কল লাগাল ডাক্তার হাদির নাম্বারে। রিং হতে হতে কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” স্বর্ণলতা, বলো। ”

সে কেঁপে ওঠল যেন! কণ্ঠটা এত ভরাট, গম্ভীর। কিছু বলার আগেই চিনে ফেলল তাকে। স্বর্ণলতা একটুক্ষণ নীরব থেকে সুধাল,
” আপনে বিয়া করছেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” প্রীতুলরেই? ”
” হ্যাঁ। ”
” ও তো ভালা মাইয়া না। সবাই জানে। আপনে…”

তাকে কথা শেষ করতে দিল না। পূর্বেই ডাক্তার আল হাদি ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণা? ”
” হুম? ”
” প্রীতুল এখন আমার ওয়াইফ। বউ। ও কে নিয়ে কেউ নিন্দে করলে আমার ভালো লাগবে না। তাছাড়া বিয়ের আগে কী করেছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। বিয়ের পরে কী করছে সেটায় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আগে আমি ছিলাম না। এখন আছি। আশা করি, বুঝতে পেরেছ। ”

স্বর্ণলতা চুপ করে শুনছিল। এই নিশ্চুপতা আর ভাঙল না। কী যে বলবে ভেবেই পাচ্ছিল না! সহসা ডাক্তার হাদিই প্রশ্ন করল,
” তুমি কি এটা জানতেই কল করেছ? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

তার যেন হুট করেই কারণটা মনে পড়ল! বলল,
” উনার অবস্থা ভালা না। জ্বরে কাঁপতাছে। উঁ..উঁ.. করে শব্দ করতাছে। ”
” মহাজন? ”
” হ্যাঁ। ”
” আমাকে বলছ কেন? আমি কী করব? ”
” আপনেরেই তো জানামু। আপনে না আমগো গ্রামের ডাক্তার? আমি তো আর কাউরে চিনি না! ”
” স্বর্ণলতা, তোমাকে আগেও বলেছিলাম ঐবাড়িতে আমি যাই না। এখন তো আরও যাব না। ”
” তাইলে আমি এখন কী করমু? এমনেই ফালাইয়া রাখমু? চাইয়া চাইয়া মরতে দেখমু? ”
” জ্বর হলেই মানুষ মরে যায়? আজব তো! ”

কণ্ঠটায় প্রচণ্ড বিরক্তের ছোঁয়া পেল। এভাবে সে কখনও কথা বলেনি! স্বর্ণলতার ভারি খারাপ লাগল। বিয়ে হতে না হতেই কেমন বদলে গেল! কল কেটে দিতে চাইল, পারল না। ডাক্তার হাদির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” চাঁদনির জন্য জ্বরের ঔষধ পাঠিয়েছিলাম না? দেখ আছে নাকি। আমি বেশি করেই পাঠিয়ে ছিলাম। থাকার কথা। পেলে খায়িয়ে দাও। ”

কলটা ডাক্তারই কাটল। স্বর্ণলতা মোবাইল রেখে ছুটল পাশের ঘরটায়। দাদিজান এখনও ফিরেনি! সে ঘরের ভেতরে গিয়ে তাজ্জব বনে গেল! পুরো রুম এলোমেলো। বিছানায় চাদর নেই, বালিশ নেই। জগ পড়ে আছে, গ্লাস ভাঙা। মেঝেতে ধূলোবালি গড়াগড়ি খাচ্ছে। এসব ঠিক করতে অনেক সময় লাগবে, তাই ঔষধ খোঁজায় মন দিল। ত্রিকোণাকৃতির টেবিলটায় ড্রয়ারে পেয়েও গেল।

________
স্বর্ণলতা পানি ও ঔষধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াতকে বেশ কয়েকবার ডেকেছে, ওঠেনি। এমতাবস্থায় ঔষধ খাওয়াবে কীভাবে? এদিকে দাদিজানকে না বলেই তার কাঁথা নিয়ে এসে অসুস্থ মানুষটাকে দিয়েছে। জানার পরে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ভাবলেই শিউরে ওঠছে!

স্বর্ণলতার হঠাৎই মনে হলো, তার ডাক দেওয়া হচ্ছে না। হয়তো এভাবে কেউ ডাকে না, তাই বুঝতে পারছে না মুনছুর সাখাওয়াতকেই ডাকছে। অন্যভাবে ডাকতে হবে। দাদিজানের মতো নাম ধরে ডাকবে? না, অভদ্রতা হবে। গ্রামের লোকেদের মতো মহাজন ডাকবে নাকি চাকরদের মতো স্যার ডাকবে? ভাবতে ভাবতে এত ঘেটে গেল যে, ডাকতে লাগল, মহাজন স্যার বলে। একবার, দুইবার, তিনবার ডাকতেই চোখটা খুলে গেল আচমকা। সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে স্বর্ণলতার দুই হাত চেপে ধরল। তার একহাতে পানির গ্লাস ও অন্যহাতে ঔষধ ছিল। গ্লাসটা প্রথমেই পড়ে ভেঙে গেল। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। মুনছুর সাখাওয়াত রক্তলাল চোখে চেয়ে বলল,
” হাত মেল। মেল, বলছি। ”

সে ভয়ে কাঁপছে। প্রাণপাখিটা এই বুঝি উড়ে চলে গেল! সেই অবস্থায় কান্না প্রায় গলায় বলল,
” হাতের মধ্যে ওষুধ, মেললে পইড়া যাইবো। আপনের কিছু নিই নাই। সত্যি কইতাছি। ”

তার কথাগুলো মুনছুর সাখাওয়াতের কানেই ঢুকল না বোধ হয়। পূর্বের মতোই একই কথা পুনরাবৃত্তি করল,
” হাত মেল। মেল, বলছি। ”

হাতের চাপ এত শক্ত হয়ে বসছিল যে, সে বাধ্য হলো মেলতে। সাথে সাথে ঔষধের টুকরোটা নিচে গড়িয়ে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত দুই হাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে বলল,
” তোমার কি হাতে কোনো রোগ আছে? যেটা শীতকালে দেখা দেয়? ”

স্বর্ণলতা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
” না। ”

সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিল। একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। দাদিজানের কাঁথাটা জড়িয়ে নিল। এবার জড়োসড়ো হয়ে একপাশে কাত হয়ে শুয়েছে। চোখের নিমিষে ঘুমিয়েও গেল। স্বর্ণলতা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। রুম থেকে পালিয়ে এলো।

________
বিকালবেলা। দাদিজান বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। কলি ও ময়না কাঁচা আম কাটছে। এগুলো দিয়ে আচার হবে৷ স্বর্ণলতা দাদিজানের পাশে দাঁড়িয়ে আম কাটা দেখছে। মুনছুর সাখাওয়াত যে অসুস্থ, এই কথাটি দাদিজানকে বলেনি। যদি ঐ রুমে পাঠিয়ে দেয় এই ভয়ে। সে ঠিক করেছে আজকে আর ঐ রুমে যাবে না। লোকটা দেখতে কী ভয়ঙ্কর হয়েছে! চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, রক্তচোষা। হাতগুলোও কত শক্ত করে ধরেছিল! লাল হয়ে ফুলে গিয়েছে। ব্যথা আছে এখনও। স্বর্ণলতার আম কাটার দৃশ্যটা বেশিক্ষণ দেখা হলো না। আচমকা বাড়ি কাঁপিয়ে ডাক ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”

বারান্দায় উপস্থিত প্রতিটি মানুষ ছিটকে ওঠল। ময়নার তো হাতটাও কেটে গেল! কোনো রকম সহানুভূতি প্রদর্শনেরও সুযোগ পেল না কেউ। আরও একবার নামটা মুখরিত হলো পুরো বাড়িতে। খাইরুন নিসা দ্রুত বললেন,
” পাগলটার ঘুম ভাঙছে মনে হয়। জলদি যাও। তোমাকেই ডাকছে তো। ”

সে যেতে যেতে আরও দুইবার নাম ধরে ডেকে ফেলল। রুমের কাছে পৌঁছেও ভেতরে ঢুকল না। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল। মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসে আছে। পরনের কাপড়টা বদলে ফেলেছে। চুল ভেজা, মুখটা সতেজ। চোখের রঙ স্বাভাবিক। গোসল করেছে বোধহয়। স্বর্ণলতা বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করল,
” আপনের জ্বর কি চইলা গেছে? ”

সে ঠমক ধরে রেখে ভাব নিয়ে বলল,
” কিসের জ্বর? আমার কাছে কোনো জ্বর-টর আসে না। ”

স্বর্ণলতার ভ্রূজোড়া কপালে উঠে গেল। সাথে সাথে আবার শুনল,
” বাইরে কেন? ভেতরে এসো। আমি তো দরজা খুলেই রেখেছি। ”

সে ভেতরে এলেও বেশি আগাল না। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখান থেকেই নজর বুলাল মেঝেতে। ঔষধের টুকরাটা কোথাও নেই। ভাঙা গ্লাসটাও নেই। মেঝে শুকনো, চকচকে। স্বর্ণলতা বিছানায় তাকাল। চাদর বদলেছে কিন্তু দাদিজানের কাঁথাটা নেই। সে আঁতকে ওঠে সুধাল,
” খ্যাতাটা কী করছেন? ”
” আমি তো কিছু করিনি! ”

তার মাথা পাক দিয়ে ওঠল। লোকটা কিছুই স্বীকার করছে না। রুমের মধ্যেও কিছু পাচ্ছে না৷ তাহলে কি ঐ ঘটনাটা বাস্তব নয়? কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল? তার ভাবনার মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকতে পার। স্বামী মেনে নিলে অন্যরাও মেনে নিতে বাধ্য। ”

_______
রাতে খাওয়ার সময় মুনছুর সাখাওয়াতকে পাওয়া গেল না। সেই যে বিকেলে বেরিয়েছে, ফিরেনি। স্বর্ণলতা দাদিজানকে খায়িয়ে রুমে পাঠিয়ে দিল। নিজে খেল না, খাবেও না। গতরাতে খাওয়ার জন্য সুন্দর করে ডেকে এনেই তো কত কী ঘটাল! সে তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে গেল। লোকটা ফিরে আসার আগেই সে শুয়ে পড়বে। মোবাইলটা দাদিজানকে ফেরত দিয়েছে। চাইলেও কল দিয়ে জ্বালাতন করতে পারবে না। স্বর্ণলতা রুমে ঢুকেই দরজা আটকাতে চাইল, পারল না। ভূতের মতো আগমন ঘটল মুনছুর সাখাওয়াতের। দরজায় হাত রেখে বলল,
” আজকে একটু দেরি করে ফেলেছ, বউ! ”

সে হকচকিয়ে গেল। পেছনে সরে গেল অজান্তেই। এই সুযোগে মুনছুর সাখাওয়াত দরজা মেলে ভেতরে এলো। সাথে সাথে সিটকানিও টেনে দিল। স্বর্ণলতার দিকে ফিরতেই সে হঠাৎ বলে ওঠল,
” আমার একটা কথা আছে। ”
” একটাই? এক সেকেন্ডেই তো শেষ হয়ে যাবে। আমাদের হাতে সারারাত সময় আছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সময় নিয়ে বলো। ”
” আমি এখনই কইতে চাই। ”
” আচ্ছা, বলো। ”

অনুমতি দিয়ে সে কয়েক কদম এগিয়ে এলো। স্ত্রীর কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারল না। সে ত্বরিত সুধাল,
” আপনে কি এখনই আমার থেইকা বাচ্চা চাইতাছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত থেমে গেল। দূর হতেই ভ্রূ উঁচিয়ে তাকাল স্ত্রীর মুখটায়। হঠাৎ করে বাচ্চার প্রসঙ্গটা এলো কেন? স্বর্ণলতা অধৈর্য হয়ে বলল,
” উত্তর দেন না ক্যান? এখনই বাচ্চা চাইতাছেন? ”
” না। ”
” তাইলে সারাক্ষণ আমার কাছ ঘেষার মতলবে থাকেন ক্যান? ”

মুনছুর অবাক হয়ে সুধাল,
” তোমার কি মনে হয়, স্বামীরা শুধু বাচ্চা নেওয়ার জন্য বউয়ের কাছ ঘেষতে চায়? ”
” হ, আর কী কারণ হইবো? বিয়াই তো করে বাচ্চার লাইগ্যা। ”

চলবে