#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫৪)
মুনছুর সাখাওয়াত দৃঢ় স্বরে জানাল,
” বাচ্চা নেওয়ার জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি। ”
” তাইলে? ”
স্বর্ণলতা জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার মুখটায়। মুনছুর সাখাওয়াতও স্ত্রীর দিকে চেয়েই কথা বলছিল। এবার দৃষ্টি সরল। আনমনে দেখাল মুখটা। সেই অবস্থায় বসল বিছানার এক কিনারে। আলগোছে, মন্থরগতিতে। জবাব দিচ্ছে না, নীরব সময় বাড়ছে। উন্মনা, বিষণ্ণ চাহনি আটকে গেল মেঝেতে।
স্বর্ণলতা সামনে এগিয়ে এলো। প্রবল আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেছে। জিজ্ঞেস করল,
” কন না ক্যান? বাচ্চা নেওয়া ছাড়া আর কী কারণ হইতে পারে? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের একস্থির দৃষ্টি কাঁপল কিন্তু ছুটল না। স্মরণে এলো, সেই বৃষ্টি ভেজা রাত যেই রাতে স্বর্ণলতাকে প্রথম দেখেছিল। কেমন গুটিসুটি হয়ে শুয়ে ছিল! প্রথমে ভেবেছিল, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পরে বুঝল, তীব্র জ্বরে হুঁশ হারিয়েছে। ঠাণ্ডায় খুব কাঁপছিলও! শরীরে হাত রাখতেই এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এটা কোনো মানুষ না, মেয়েও না। এটা তার আদুরী। এত কোমল, নরম, উষ্ণ শরীর তো তার আদুরীরই ছিল। মুখখানিও কী সুন্দর আদুরে! নির্মল। ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। যতক্ষণে বুঝে এলো, এটা তার আদুরী নয়। ছোট্ট, কিশোরী মেয়ে। ততক্ষণে ছুঁয়ে থাকার ইচ্ছেটা এতটায় তীব্র হয়ে ওঠল যে, সে নিজেকে সামলাতে পারল না। দেহ, মন, মস্তিষ্ক সবকিছুই তার বিরুদ্ধে চলে গেল। ঘোষনা দিয়ে দিল, এই মেয়েকে বিয়ে করবে। নিজের করে নিবে আজীবনের জন্য। এজন্যে সে যেকোনো মূল্য পরিশোধ করতে প্রস্তুত। সেই মূল্য এত ভারী হয়ে পড়ল যে, আজও শোধ দিতে পারছে না! মুনছুর সাখাওয়াতের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অতঃপর মুখ তুলে বউয়ের উৎসূক চোখজোড়ায় চেয়ে বলল,
” তোমাকে দেখে আমার আদুরীর কথা মনে হয়েছিল। ”
” আপনের ঐ পোষা বিলাইটা? দাদিজান তাইলে ঠিকই কইছিল। ”
স্বর্ণলতার প্রশ্নের উত্তর এলো না। সে অপেক্ষাও করল না। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” আমি দেখতে কি বিলাইয়ের মতো? ”
সে দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে আবারও বলল,
” ওর মতো কি আমার গা ভর্তি লোম? সারাক্ষণ ম্যাঁও ম্যাঁও করি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত হাতের দিকে তাকাল। মসৃণ ত্বক, চকচকে। কোমল আভা ছড়াচ্ছে যেন! তার মনে হলো, স্পর্শ করলে সেই রাতের মতো উষ্ণ অনুভূতিটা টের পাবে। কিন্তু স্পর্শ করল না। মুখটা আরও বিষণ্ণ, গম্ভীর দেখাল। আপনমনে ভাবল, এই মেয়ে তার অনুভূতিটা বুঝবে না। বয়স কম, জ্ঞানের স্বল্পতা আছে। তন্মধ্যে গ্রামের মেয়ে, শহরের ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত নেই। এদিকে পশুপাখির প্রতি এক ধরনের মায়া-মমতা আছে। কিন্তু পশুপাখি হিসেবেই। এদেরকেও যে মানুষের মতো আদর, ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে বুকের কাছে রাখা যায়, নিজের জীবনের অংশ বানানো যায়, এটা জানে না, দেখেনি, শুনলেও বিশ্বাস করতে পারে না। স্বর্ণলতাও বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই গভীরতাও অনুভব করতে পারছে না। মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করল। বলল,
” যদি বাচ্চার জন্যই কাছ ঘেষতে চাইতাম, তাহলে চাঁদনি আমার বউ হতো। হলো না তো। ”
” পেটে বাচ্চা তো আইছিল। ”
” পেটেই মারা গেছে। ”
” আপনেই মারছেন। হয়তো পছন্দ হয় নাই। ”
” আমি বাচ্চাটাকে দেখিনি, অপছন্দ হবে কীভাবে? ”
উত্তর দেওয়ার জন্য স্বর্ণলতার ঠোঁট যুগল কেঁপে উঠেও থেমে গেল। উপলব্ধি হলো, তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই! এই সময় মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল। তার কাছাকাছি এগিয়ে এসে বলল,
” প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের কাছাকাছি আসার মূল কারণ, বাচ্চা নয়। ওটা পরবর্তী পরিকল্পনা। যেখানে বংশরক্ষার উদ্দেশ্য থাকে, পরিবার বড় করতে চায়, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চায়। ”
” তাইলে মূল কারণটা কী? ”
” ওটা তুমি জানো। জানো বলেই তুমি বুঝে গিয়েছিলে, আমি কেন চাঁদনির কাছ ঘেষে ছিলাম। এই নিয়ে তো কড়া চিঠিও লিখেছিলে, আমার দোষ বের করে মাফ চাইতেও বলেছিলে। কী কী লিখেছ, মনে আছ তো? নাকি চিঠিটা এনে দিব? ”
স্বর্ণলতা হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শুকনো ঢোক গিলল। ঘাম জমতে লাগল কপালে, নাকে ও গলায়। মুনছুর সাখাওয়াত হাত বাড়িয়ে ভিজে উঠা নাকের আগাটা মুছে দিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, তুমি ধরা পড়ে গেছ। এই বাচ্চা বাচ্চা ভাবের মিথ্যে খোলসটা থেকে বের হয়ে আসো। তোমার মতো আমারও একটা কথা আছে। ”
সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সুধাল,
” কী কথা? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” আগে গলাটা ভিজিয়ে নেও, শান্ত হও। তারপরে বলছি। তোমার মতো আমার এত তাড়া নেই। সকালের আগে তো দরজা খুলছি না। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। অতর্কিতে পানির গ্লাসটা টেনে নিল। এক দমে পুরো পানিটা খেয়ে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত খালি গ্লাস ফিরিয়ে নিল। পাখার গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” শরীর খারাপ লাগলে বিছানায় বসো, বিশ্রাম করো। যতক্ষণ না স্বাভাবিক হচ্ছ ততক্ষণ অপেক্ষা করব। সমস্যা নেই। কিন্তু খবরদার জ্ঞান হারানোর অভিনয়টা করবে না। আমাদের মধ্যকার ঝামেলাটা আজকেই মিটাব। অনেক সময় দিয়েছি, আর না। ”
সে বসল ঠিকই কিন্তু দুর্বল ভাবটা কাটিয়ে ওঠল সাথে সাথেই। স্বাভাবিক ও পরিষ্কার গলায় বলল,
” আমি ঠিক আছি। কী কইবেন, কন। আমি শুনতাছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথেই বলল,
” শুধু শুনলে হবে না। বলতেও হবে। ”
” কী কমু? ”
” আমাকে ভালোবাসার সুযোগ দিচ্ছ না কেন? মানছি, তোমার আমাকে পছন্দ নয়। পছন্দ না হওয়ার অনেক কারণও আছে। সেজন্য হয়তো আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা আসে না। এই নিয়ে আমার কোনো অভিযোগও নেই, কিন্তু আমার তো তুমি পছন্দ। তোমাকে বিয়ে করেছি, বউ বানিয়েছি। এরপরে ভালোবাসতে চাচ্ছি, তাতেও বাঁধা সৃষ্টি করছ। কেন? আমি সঠিক কারণটা জানতে চাই। বলো। ”
স্বর্ণলতা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মুখ খুলছে না। মুনছুর সাখাওয়াত অনেক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,
” আমি বলেছিলাম, শুধু শুনলে হবে না, বলতেও হবে। স্বর্ণলতা, বলো। আমি শুধু এই একটা উত্তরই জানতে চাই। এতদিন মনে হয়েছে, ডাক্তার কারণ হতে পারে। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত, ও আমাদের মাঝে আসেনি। অন্য কোনো কারণ হবে। সেটা কী? বলো। ”
সে এবারও কিছু বলল না। চোখটাও সরিয়ে নিল। হাতদুটো গুটিয়ে এনে রাখল কোলের ওপর। এখানে দৃষ্টি স্থির করে সমানে একপাশের ঠোঁট কামড়াতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বেও একবার মেয়েটিকে এমন ঠোঁট কামড়াতে দেখেছিল। এটি কি কোনো কিছুর লক্ষণ? সে ঠিক করে ধরতে পারল না। মনোযোগ সরিয়ে বলল,
” তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, তোমারও উচিত আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। চুপ করে থাকবে না। আমার কিন্তু ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। ”
” যাক, তারপরেও কমু না। ”
সে আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” কেন? ”
” আমি নিজেই বুঝতে পারি নাই এখনও৷ আমার কারও সাথে কথা কওয়া দরকার। ”
” বলো, আমি আছি তো। সব শুনব। ”
” আপনেরে কইলে হইবো না। কথাগুলা তো আপনেরে নিয়াই। ”
” তাহলে দাদিজানকে ডাকছি। ”
দরজার দিকে ব্যস্তচালে হেঁটে যাচ্ছিল। স্বর্ণলতা দ্রুত জানাল,
” উনিও আপনের পক্ষেই কথা কইবো। ”
সে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বিপক্ষের কাউকে লাগবে? ”
স্বর্ণলতা মাথা উপর-নীচ করতেই সে বলল,
” তোমার আম্মাকে নিয়ে আসব? উনি নিশ্চয় তোমার পক্ষে কথা বলবে। ”
” না। আপনের, আমার কারও পক্ষ নিবে না এমন কাউকে লাগবে। ”
” তোমার বান্ধবী রে নিয়া আসি? ”
” ওর তো বিয়াই হই নাই, ওই কী বুঝবো? ”
” বিবাহিত কেউ লাগবে? ”
” হুম, ভালা জ্ঞানবুদ্ধি আছে এমন কেউ। আপনেরে চেনা-জানা থাকলে আরও ভালা হইবো। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মহা মসিবতে পড়ল যেন! এতরাতে এরকম নিরপেক্ষ, বিবাহিত, জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষটাকে কোথায় খুঁজবে? বাড়ির বাইরে তার সম্পর্কেও কেউ তেমন কিছু জানে না। সবাই জানে, সে মহাজন। মানুষকে সুদের উপরে টাকা ধার দেয়। ব্যস, এতটুকুই। সে ভাবনার মধ্যেও মাথা চুলকাচ্ছিল। সহসায় মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল,
” যেমন চাচ্ছ তেমনই দিব। কিন্তু মনে রেখ, আজকেই আমার উত্তরটা চাই। তারপরে কী হবে, কী হবে না সেটা আমি ঠিক করব। ”
কথাটা বলতে বলতে সে স্বর্ণলতার বোরকা নিয়ে এসে দিল। দরজার সিটকানি খুলে বলল,
” আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। তৈরি হয়ে এসো। আমাদের কূজনপুর যেতে হবে। ”
_______
মাঝরাত, গ্রামের রাস্তা পুরো ফাঁকা। আলোর ব্যবস্থা তেমন নেই। চাঁদের জোসনায় আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। দূরের গাছপালা, বাড়িঘর, খেতখামার দেখাচ্ছে ছায়ার মতো। ঘন কালো কিন্তু স্থির। তবুও মুনছুর সাখাওয়াতের গাড়ি চালনায় ব্যাঘাত ঘটছে না। সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে যাচ্ছে যেন! স্বর্ণলতা এই দিকে আসেনি কখনও৷ সব অচেনা, জানাশোনাও নেই। কিন্তু নামটা আগেও শুনেছে। শ্বশুরবাড়িতে আসার পরেই শুনেছে। দাদিজান নাহয় মুনছুর সাখাওয়াত কেউ একজন নামটা উচ্চারণ করেছিল। সে একমনে রাস্তা ও পাশের দৃশ্য দেখছিল। সহসা প্রশ্ন করল,
” কূজনপুরে কি আপনার আত্মীয় থাকে? ”
” না। আমার আব্বুর দিকে কোনো আত্মীয় নেই, আম্মুর দিকে আছে। ওরা ঢাকায় থাকে। আমাদের সাথে যোগাযোগ নেই। ”
” তাইলে ওই গ্রামে কে থাকে? ”
” দেখা হলেই জানতে পারবে। মেয়েটি নিজেই বলবে। আমি যতদূর বুঝেছি, ও মিথ্যা কথা বলে না। ”
” উনি তাইলে মাইয়া মানুষ! ”
স্বর্ণলতার কণ্ঠটা কেমন যেন শোনাল! মুনছুর সাখাওয়াত আচমকা ব্রেক কষল। সংশয় চিত্তে সুধাল,
” মেয়ে হলে হবে না? ”
” হবে। ”
গাড়ি পুনরায় চালু করতে করতে বলল,
” ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলে, কতদূর চলে এসেছি! ফিরতে ফিরতেই রাত শেষ হয়ে যেত। ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। সে মুখ ফিরিয়ে রাখল জানালার দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবল, কণ্ঠটা অন্যরকম শোনাল কেন? এক ঝামেলা মেটাতে গিয়ে আরেক ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে না তো? তার কি উচিত, নিজে থেকেই মেয়েটার পরিচয় তুলে ধরা? সিদ্ধান্তে আসতে আসতে রাস্তা ফুরিয়ে গেল। স্বর্ণলতাকে নিয়ে একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকল। দুচালা টিনের ঘর। সামনে মস্তবড় উঠান। চারপাশে উঁচু করে টিনের বেড়া দেওয়া। জোসনার আলোয় ভালোয় ফকফকা দেখাচ্ছে। কেউ জেগে নেই, আলোও নেভানো। মুনছুর সাখাওয়াত উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল,
” তুমি যাও। আমি এখানে আছি। ”
সে অবাক কণ্ঠে সুধাল,
” আমি একা যামু? ”
” হ্যাঁ। আমি সাথে গেলে দরজা খুলবে না। ”
” ক্যান? ”
” এই মেয়ে কঠোর পর্দা করে, পুরুষ মানুষের সামনে আসে না। কথাও বলে না। ”
স্বর্ণলতা আরও বেশি অবাক হলো। এরকম একটা মেয়ের সাথে এই লোকের পরিচয় হলো কীভাবে? সে ভেবেছিল, বন্ধু। এখন তো ছেলেদের মেয়ে বন্ধু, মেয়েদের ছেলে বন্ধুও হয়। সেই ধারণাও ভুল মনে হচ্ছে। যদি দেখা না হয়, কথা না হয় তাহলে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা তৈরি হবে কীভাবে? সে জিজ্ঞেস করল,
” উনি আপনের বন্ধু লাগে না? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” বলেছি তো, ও নিজেই বলবে। ”
স্বর্ণলতা দরজার দিকে এগুতে চেয়েও এগুল না। পেছন ফিরে বলল,
” উনি তো ঘুমাইতাছে। বিরক্ত করা ঠিক হইবো? কাল সকালে আসি? ”
সে আশ্বস্ত করে জানাল,
” বিরক্ত হবে না। তুমি যাও। ”
স্বর্ণলতা নিতান্ত বাধ্য হয়েই সামনে অগ্রসর হলো। দুই কদম এগুতেই শুনল,
” শোনো? ”
সে থামতেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এই মেয়েটির একটি আশ্চর্য গুণ আছে। সহজেই প্রভাবিত করে ফেলে। তুমি বলতে চাও না, এই কথাগুলোও পেট থেকে বের করে ফেলবে। যাই বলো না কেন, একটু ভেবে নিও। কিছু খেতে দিলে ভুল করেও মুখে নিবে না। বেশি জোর করলে বলবে, আমি মানা করেছি। ”
স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে হাঁটতে লাগল। দরজার সামনে দাঁড়িয়েও সাথে সাথে দরজায় টোকা দিল না। এত অস্বস্থি লাগছে! দাদিজান ঠিকই বলে, এই লোকটা আসলেই পাগল। পাগলটাকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে সে নিজেই। কী দরকার ছিল, ঐ কথাটা বলার? আর কিছু খুঁজে পেল না? বানিয়ে মিথ্যা কিছু বলে দিতে পারত। চেষ্টা যে করেনি, এমনও না। যতবারই কিছু ভাবছিল ততবারই কানের কাছে একটা কথায় বাজছিল, ‘ মিথ্যা বলো না, স্বর্ণলতা। আমার কাছে তুমি মানেই চিরন্তন সত্য। তোমাকে ঘিরে থাকা প্রতিটা তথ্য, বস্তুও ধ্রুব সত্য। ‘
স্বর্ণলতা আরও কিছুক্ষণ নীরবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল। অতঃপর দরজায় মৃদু টোকা দিল। একবার, দুইবার, তিনবারে নারীর মিহি কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” কে? ”
” আমি। ”
সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। মোটা পর্দার আড়াল থেকে একটা মুখ উঁকি দিয়ে প্রথমে সালাম দিল। তারপরে অপরাধী সুরে জানাল,
” মাফ করবেন, বোন। আপনাকে চিনতে পারছি না। পুরো পরিচয় না জানালে ভেতরে ঢোকার আহ্বান জানাতে পারছি না। মাঝরাত, ঘরে আমি একা। নিজের সুরক্ষার জন্য এটুকু তথ্য জানা আবশ্যক। ”
অপরিচিত নারীটি একাধারে এতগুলো কথা বলল যে, সে গুলিয়ে গেল। দিশাহারা বোধ করছে। এত অসহায় ঠেকছিল! নিজের পরিচয়, এখানে আসার কারণ কিছুই মনে পড়ছে না যেন! সে চট করে পেছনে ফিরে বলল,
” আমারে উনি পাঠাইছেন। ”
মেয়েটি যৎসামান্য মুখ বের করেছিল। এবার আরও একটু বের করল। মুখে হাত দিয়ে ওড়না চাপা। সেই অবস্থায় দূরে উঠোনের পুরুষ অবয়বটা দেখে নিয়ে বলে ওঠল,
” আপনি স্বর্ণলতা? ”
” জি। ”
সাথে সাথে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। দরজা আটকে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” এত দ্রুত আপনার সাথে সাক্ষাৎ হবে বুঝতে পারিনি। ”
কণ্ঠস্বরে উচ্ছাস, কৃতজ্ঞতা। স্বর্ণলতার মুখটা দুই হাতের আঁজলে নিয়ে পুনরায় বলল,
” মাশাআল্লাহ। উনার পছন্দের প্রশংসা করতেই হয়। ”
এই কথাগুলো তার কানে প্রবেশই করল না। চাহনি আটকে গেল সামনের অপরিচিত মুখটায়। মুখে চেপে রাখা ওড়নাটা নেই। পুরো মুখটায় দেখতে পাচ্ছে। সেই মুখটা থেকে দৃষ্টি সরছেই না। অজান্তেই বেফাঁসে বলে ওঠল,
” আপনে কি পরি? উনি আমারে পরি দেখাইতে আনছে? ”
মেয়েটি মুচকি হাসল। দু’গালের খাঁজগুলো এত সুন্দরভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠল যে, রূপের আলো আরও বেশি করে ছড়াতে লাগল। স্বর্ণলতার মনে হলো, সে সত্যিই পরি দেখছে। এত সুন্দর মানুষ হয়? সে এতদিন ভেবেছে, তার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী হলো চাঁদনিবু। আজ সেটায় ভুল প্রমাণিত হলো। এই মেয়ে তারচেয়েও কয়েকশো গুণ বেশি সুন্দর। অতুলনীয়া।
” আমি কোনো পরি না, বোন। সাধারণ মানুষ। আমার নাম মানছুরা। ”
এটুকু বলতে বলতে স্বর্ণলতাকে বিছানায় বসাল। তারপরে ছুটে গেল কোথাও। ফিরে এলো পানি আর মিষ্টি নিয়ে। তার কাছে রাখতে রাখতে বলল,
” একটু মুখে দিন, বোন। আমার ভালো লাগবে। ”
সে হাত বাড়িয়ে নিতে চেয়েও থেমে গেল। চোখ বন্ধ করে সমানে মাথা ঝাকাল কতক্ষণ। তারপরে হাত সরিয়ে নিতে নিতে বলল,
” উনি কিছু খাইতে মানা করছে। ”
মানছুরার মুখের হাসির উজ্জ্বল রঙটা হারিয়ে যেতে যেতেও আবার ফিরে এলো যেন! খাবারগুলো সামনে থেকে সরাতে সরাতে বলল,
” স্বামীর আনুগত্যে থাকা স্ত্রীর জন্য ওয়াজিব কাজ। আর ওয়াজিব অবশ্যই পালনীয়। দোয়া করি, আপনারা সুখী হোন। ”
এটুকু বলে সে স্বর্ণলতার হাত ধরে দাঁড় করাল। পুরো ঘরটা দেখাতে দেখাতে নানান কথা বলল। নিজ থেকেই। সে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে শুনছে। সবশেষে জিজ্ঞেস করল,
” আপনে কি উনারে চিনেন? ”
মানছুরা হাসিমুখেই জবাব দিল,
” হ্যাঁ। ”
” কতটুকু? ”
” যতটুকু উনি বলেছেন। ”
” আপনেরে কইল কীভাবে? আপনে না পুরুষ মানুষের লগে কথা কন না? ”
সে আবারও মুচকি হাসল। হাসির রঙ ছড়িয়ে পড়ল সম্পূর্ণ মুখটায়। সহাস্যেই বলল,
” মনে হচ্ছে, উনি আমার পরিচয় দেয়নি। তাই তো? ”
” কইছে, আপনে নিজ থেইকা কইবেন, কন নাই তো। ”
” আমি তো ভাব জমাচ্ছিলাম, বোন। আপনার এতটুকু সময়ও ধৈর্য হলো না। আমি এতক্ষণ ধরে কী বলেছি, দেখিয়েছি কিছুই হয়তো খেয়াল করেননি। মনে মনে শুধু এই প্রশ্নটায় ঘুরঘুর করছে। ঠিক বলেছি না, বোন? ”
স্বর্ণলতা বিস্মিত হলো। সত্যিই তো! সে এতক্ষণে হুঁশে এলো যেন! নিজের আশপাশে তাকাল। যে রুমে বসেছিল, সেখানে নেই। অন্য একটা রুমে আছে। এটা বেশ চাপা, সরু ও দীর্ঘ। কোনো চৌকি নেই। একটা সেলাই মেশিন ও আলমিরা। শেষ মাথায় একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গোসলখানা। সে চোখ ফিরিয়ে আনল মানছুরার দিকে। বলল,
” কমু না। উনি কইছে, আপনে নাকি যাদু কইরা পেট থেইকা কথা বের কইরা ফেলেন। ”
সে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে সুধাল,
” যাদু করে কথা বের করি? এটা বলেছেন? ”
স্বর্ণলতা একটু ভেবে সংশোধন করল,
” না। ওই রকমই একটা শব্দ ব্যবহার করছিলেন। কঠিন শব্দ, মনে করতে পারতাছি না। ”
” কোনো সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করিনি। আসুন, ভেতরের ঘরে যাই। ওখানে পাখা আছে৷ আপনি ঘেমে যাচ্ছেন। ”
মানছুরা এবারও হাত ধরেই তাকে ভেতরের ঘরে আনল। বিছানায় বসিয়ে পাখা চালিয়ে দিল। তারপরে পাশে বসে বলল,
” আজকের রাতটা এখানে থাকবেন তো, বোন? ”
সে দ্রুততার সাথে বলল,
” না, না। আমি তো থাকার লাইগ্যা আসি নাই। ”
” তাহলে? ”
স্বর্ণলতার এতক্ষণে এখানে আসার কারণটা মনে পড়ল। কিন্তু বলতে ইচ্ছে হলো না। মেয়েটা সুন্দরী, মিশুক। এটুকু সময়ের মধ্যে আপনবোধ জাগিয়ে ফেলেছে। কথা-বার্তায়ও ভদ্রতা আছে। মুখে মুচকি হাসিটা লেগেই থাকে, সহজে সরে না। তারপরেও সংকোচভাবটা রয়ে গেল। পরিচয়টাও দেয়নি এখনও। এমনভাবে অধৈর্য বলল যে, দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পাচ্ছে। জবাবে কী বলবে তাই ভাবছিল। সহসাই পেয়ে গেল কিছু। জিজ্ঞেস করল,
” উনি আমারে আপনের হাতে কিছু খাইতে মানা করল ক্যান? ”
মানছুরা একটুও সময় নিল না। সঙ্গে সঙ্গে নির্দ্বিধায় স্বীকারোক্তি দিল,
” ভয়ে। যদি আপনাকে মেরে ফেলি? একবার আমার হাতের দুধ খেয়ে উনি মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। ”
স্বর্ণলতা বিস্ফারিত চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” বিষ মিশাইয়া দিছিলেন? ”
” না। ঘুমের ঔষধ ছিল। আমি মিশাইনি, শুধু খেতে দিছিলাম। আমি তো জানতামও না, ওটাতে ঔষধ মেশানো ছিল! ”
” তারপরে? ”
” জানি না গো। আমিও তো ঐ গ্লাসের দুধ খেয়ে ছিলাম। উনার মতো আমিও ঘুমে পড়ে ছিলাম। পরেরদিন জানতে পারি, উনি নাকি হাসপাতালে ভর্তি। সেখানে গিয়ে শুনি, কেউ নাকি খুব মেরেছে। ঐরকম মার আর কখনও খাননি তো, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আক্রমণকারীরা ভেবেছে, মরে গেছে। তাই বিলের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে একটা মেয়ের সাহায্যে হাসপাতালে এসে প্রাণ বাঁচিয়েছে। ”
” কত বছর আগের ঘটনা? ”
” তিন বছর তো হবেই৷ ”
” ওই মেয়েটা তো আমি! ”
মানছুরার চোখে, মুখে বিস্ময় ভাব ফুটে ওঠল। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে এলো মাথাটা। স্বর্ণলতার হাত টেনে নিয়ে চুমু খেল। তারপরে জিজ্ঞেস করল,
” এজন্যই বুঝি আপনাকে বিয়ে করেছে? ”
” আমারও তাই মনে হইছিল। কিন্তু উনি কইল, ওই ঘটনা নাকি ভুইলা গেছেন। ওই কারণে বিয়া করে নাই। ”
” আপনি দেখতে অনেক সুন্দর তো! দেখেই হয়তো পছন্দ হয়ে গেছে। ”
স্বর্ণলতা মুখ ভার করে বলল,
” এই কারণেও বিয়া করে নাই। ”
” তাহলে? ”
” উনার নাকি আমারে দেইখ্যা বিলাই মনে হইছে, তাই বিয়া করছে। ”
” বিড়াল! আদুরী নাকি? ”
” হ, আপনে আদুরীর কথাও জানেন? ”
মানছুরা হাসতে হাসতে বলল,
” জানি তো। আরও অনেক কিছু জানি। বিশ্বাস না হলে প্রশ্ন করেন। উত্তর শুনলেই তো বুঝবেন, সত্যি নাকি মিথ্যা বলছি। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫৫)
স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” কন তো, উনার পরিবারে কে কে আছে? ”
তার চোখে, মুখে, কণ্ঠস্বরে প্রবল উৎসাহ, কৌতূহল। আমোদের ঝিলিক উঁকি দিয়েও হারিয়ে যাচ্ছে। লুকোচুরি খেলছে যেন! সংকোচভাব, দ্বিধা মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মানছুরা মুচকি হাসল। হাসতে হাসতে ঠোঁটের উপরে ডানহাতটা এমনভাবে রাখল যেন, কৌতুক শুনছে! বলল,
” এত সহজ প্রশ্ন? একটু কঠিন প্রশ্ন করেন না, বোন। ”
” করমু, আগে সহজটার উত্তর দিয়া লন। প্রথমেই কঠিন প্রশ্ন করলে যদি না পারেন? খেলাটা তো বন্ধ হইয়া যাইবো। ”
মানছুরা মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে বলল,
” উনি, দাদিজান আর আপনি। ”
” আর কেউ নাই? ”
” না। উনার মা, বাবা মৃত। ”
” মরছে ক্যামনে? ”
” মা বিষ খেয়ে আ ত্মহত্যা করেছিলেন। ”
স্বর্ণলতা আশ্চর্য হলো। বিস্ফারিত দেখাল চোখদুটি। এই তথ্যটা সে গতকালই পেয়েছে। দাদিজান জানিয়েছিলেন। অথচ এই মেয়ে, সুন্দরী নারী আরও আগে থেকেই জানে! তার আগ্রহ বাড়ল। মেয়েটিকে আরও পরখ করতে ইচ্ছে হলো। এতক্ষণ সে যতটুকু জানত, সেখান থেকে প্রশ্ন করেছে। এবার বাইরে থেকে করল,
” বিষ খাইলো ক্যান? ”
মানছুরার মুখের উজ্জ্বল হাসির ছটা মুছে গেল। বিষণ্ণ হয়ে ওঠল বদনখানা। চোখদুটিতেও অশ্রুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে কি কেঁদে দিবে? স্বর্ণলতা অস্থির হয়ে ওঠল। সে তো কাউকে কাঁদাতে আসেনি! ব্যস্ত হয়ে কিছু বলবে, পূর্বেই মানছুরা বলে ওঠল,
” ভয়ে। উনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন, বোন। সংসারে সর্বস্ব দিয়েও কিছু পাচ্ছিলেন না। আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। জীবন্ত লাশ হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। তখনই ঘটনাটা ঘটে গেল! ”
” কোন ঘটনা? ”
মানছুরাকে ভীষণ আনমনে দেখাচ্ছে। চোখের চাহনি, বসার ভঙ্গি ও কথা বলার ধরন সবকিছুই অন্যরকম। কখনও চঞ্চল, কখনও ঝিলের মতো স্থির, শান্ত। দূরে দূরে মনে হচ্ছে। হয়তো শরীরটায় এখানে কিন্তু মন ও চেতনা অন্য কোথাও ঘাঁটি বসিয়েছে। যেখানে স্বর্ণলতা যেতে পারছে না। তাই দূর হতেই গভীর মনোযোগে শোনার চেষ্টা করছে। মানছুরা উদাস গলায় বলল,
” উনি একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন। উনার বাবার রেফারেন্সে পেয়েছিলেন। সেই ব্যাংক থেকেই টাকা চুরি করছিলেন, কখনও সরাসরি। কখনও সই নকল করে। আবার বড় অংকের লোনও নিয়েছিলেন। শোধ করতে পারছিলেন না! সবকিছু মিলেমিশে বিশাল পাহাড়ে পরিণত হলো। সেই পাহাড় আচমকায় ভেঙে পড়ল মাথার উপর। তিনি ধরা পড়ে গেলেন! অন্যকেউ হলে হয়তো সাথে সাথেই পুলিশে ডেকে ধরিয়ে দিত। উনাকে দেয়নি। উনার বাবার জন্যই এই অপমান থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু শর্ত একটায়। টাকা ফেরত দিতে হবে। উনার পক্ষে এটাও সম্ভব ছিল না। তাই বাড়িতে এসে বিষ খেয়ে নিলেন। ভেবেছিলেন, সম্মান বাঁচবে টাকাও পরিশোধ করতে হবে না। নিজের পরিবারকে ভালো রাখার শেষ চেষ্টা ছিল। সফল হোননি। কাউকে জেলে যেতে হয়নি কিন্তু বাড়ি, জমিজমা সব হারাতে হলো। শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিলেন। ”
স্বর্ণলতার মুখটাও বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। অশ্রুতে টলমল হয়ে ওঠল চোখদুটি। তার জিজ্ঞেস করতে হলো না। নিজে থেকেই বুঝে গেল, মুনছুর সাখাওয়াতের মা এই অন্যায় কাজগুলো করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার স্বামীর জন্য। মানুষটা কী ভ য়ঙ্কর লোভী ছিল ভাবতেই মনটা বিষিয়ে ওঠল! মানছুরার মতো সেও কাঁদল না। চোখের কোলে অশ্রুকে ঠেকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করল,
” এবার কন তো, উনার আব্বা মরছে ক্যামনে? ”
” আপনার স্বামীর মতো আপনার শ্বশুরও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কিন্তু সয়তে পারেননি। হায়াতও ফুরিয়ে এসেছিল হয়তো। তাই এই অসিলায় চিকিৎসায় থাকা কালে হাসপাতালেই মারা যান। ”
স্বর্ণলতা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। স্মরণে এলো, কলিবুর কথা। সে বলেছিল, মুনছুর সাখাওয়াত নিজেই তার বাবাকে মে রেছে। কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা আজকেই যাচাই হয়ে যাক। এই মেয়ে এতকিছু জানে, এটাও জানতে পারে। সে চট করে জিজ্ঞেস করল,
” উনার আব্বা রে মা রছে কারা? ”
” জানি না, বোন। উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেননি। ”
স্বর্ণলতার উত্তরটা পছন্দ হলো না। সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” আম্মারটা কইলে, আব্বারটা কইবো না ক্যান? ”
” আম্মারটা উনি বলেননি, দাদিজান বলেছেন। ”
” দাদিজানও আপনেরে চিনে? ”
তার কণ্ঠে একই সাথে সন্দেহ ও বিস্ময়ের ভাব। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না যেন! দাদিজানের সাথে এখন তার ভালোই ভাব হয়েছে। অবসরে, নামাজের পরে বেশ গল্পগুজব হয়। কতকিছুই বলেন, কিন্তু এই মানছুরা নামের কাউকে নিয়ে কখনওই কিছু বলেননি।
মানছুরা নির্ভয়ে মাথা নেড়ে জানাল,
” হ্যাঁ। ”
স্বর্ণলতা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছিল না। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। সহসা সুধাল,
” আপনাগো নামে তো খুব মিল! আপনেরা কি ভাই-বোন? ”
মানছুরার স্বভাবসুলভ মুচকি হাসিটা ফিরে এলো। সহাস্যে প্রত্যুত্তর করল,
” না। নামে মিল হইলেই কি ভাই-বোন হয়ে যায়? সেরকম হলে তো আপনার স্বামী আমার জন্য পরপুরুষ হতো না, মাহরামের তালিকায় থাকত। এই ঘরেও ঢুকতে পারত। ”
” মাহরাম কী? ”
” ইসলামে মাহরাম হলো পরিবারের এমন সদস্য, যার সাথে বিবাহ হারাম। কোনো অবস্থাতেই বিবাহ সম্ভব না। ”
স্বর্ণলতা এই কথাটা এই প্রথম শুনল। ঠিকমতো বুঝে এলো না, মাথার মধ্যে ঢুকাতে কষ্ট হলো। সময়ও লাগল। কতক্ষণ থম মেরে থেকে আচমকা সুধাল,
” তাইলে আপনাদের সম্পর্ক কী? ”
” এখনই জানতে হবে? ”
প্রশ্নটা এত হেঁয়ালি লাগল! তার মনে হলো গুরুত্ব পাচ্ছে না। মুহূর্তেই বিরক্ত উড়ে পড়ল কপালের মধ্যিখানে। ভ্রূজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসতে শুনল,
” আপনি চাইলে এখনই বলে দিতে পারি। আমার লুকানোর ইচ্ছে নেই। কিন্তু আপনার মনখারাপ হবে। কষ্টও পেতে পারেন। রাগ করে হয়তো এখান থেকে বেরিয়েও যেতে পারেন। ”
স্বর্ণলতার বিরক্ত বাড়ল। কপালের মসৃণ চামড়া ও লতার মতো মোটা ভ্রূ দুখানা আরও কুঁচকে এলো। নাকের পা’টা ফুলছে, নিভছে। সন্দেহ ভরা দৃষ্টি স্থির রেখে প্রশ্নটা করল,
” আপনারা কি প্রেমিক, প্রেমিকা? ভালোবাসার সম্পর্ক? ”
মানছুরা চমকে ওঠল। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল। বিস্ময়ের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল অনিন্দ্য মুখখানা। কয়েক সেকেন্ড পরে সব হারিয়ে গেল। পূর্বের মতো হেসে উঠে বলল,
” না। আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নেই। উনি আমাকে ভালোবাসেননি কখনও। ”
” তাইলে কী? ”
” বড্ড অধৈর্য আপনি! ”
স্বর্ণলতা আবারও লজ্জা পেল। দৃষ্টিসহ মুখটা নামিয়ে নিল। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, চাঁদনিবুর মতো এই মানুষটার সাথেও অবৈধ সম্পর্ক আছে। সাথে সাথে বুকের ভেতরটায় বন্দি পাখির মতো কিছু একটা ছটফট করছিল। কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিল না। এত যন্ত্রণা দিচ্ছিল যে, প্রশ্নটা না করে থাকতে পারল না। এখন ছটফটে যন্ত্রণাটা নেই। থেমেছে বোধ হয়। শান্তি লাগছে।
মানছুরা জিজ্ঞেস করল,
” আপনি প্রেমিক, প্রেমিকা বুঝেন? ”
স্বর্ণলতা মাথা তুলল। এক ঝলক চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। লজ্জায় রাঙা হলো কিশোরী মুখটা। মানছুরা খেয়াল করে পুনরায় সুধাল,
” ভালোবাসার সম্পর্কও বুঝেন? তাহলে তো আপনি অতটাও বাচ্চা নন, যতটা আপনাকে দেখে মনে হয়। ”
সে নিরুত্তরই থেকে গেল। এত অস্বস্থি হচ্ছে! লজ্জায় দেহমন এক হয়ে যাচ্ছে যেন। এভাবে মুনছুর সাখাওয়াতও বলেছিল। কিন্তু সময় নিয়েছে অনেক। মানছুরা এক পলকেই বুঝে গেল। স্বর্ণলতার মধ্যেও গোপন করার অভিপ্রায় নেই।
” কে বুঝাল? উনি নাকি অন্য কেউ? ”
সে চকিতে চাইতে মানছুরা আশ্বস্ত করল,
” ভয় নেই। আপনাকে আমি ছাড়া আর কেউ শুনছে না, দেখছেও না। সত্যিটা বলতে পারেন। কথা দিচ্ছি, আজীবন গোপন থাকবে। ”
সে কথাটা শেষ করে স্বর্ণলতার হাতের উপরে হাত রাখল। সামান্য বলপ্রয়োগ করে চাপ দিয়ে পুনরায় বলল,
” কৈশোরে পড়েছেন, স্কুলেও পড়ছেন। ছেলে-মেয়ে একসাথে তো? প্রেমে পড়তেই পারেন। অস্বাভাবিক কিছু না। এই সময় প্রেমটা চট করেই হয়ে যায়। মেয়েদের তো একটু বয়স বেশি এই ধরনের ছেলেগুলো বেশি পছন্দ হয়। ”
শেষ কথাটা হুল হয়ে বিঁধল বোধ হয়। সে হাতটা সরিয়ে দিল। বেসামাল হয়ে উত্তেজিত গলায় বলল,
” আমি উনাকে ভালোবাসি না। ”
” উনিটা কে? ”
” হাদিভাই। ”
নামটা উচ্চারণ করামাত্র তার হুঁশ এলো। সে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। ঠিক তখনই মুনছুর সাখাওয়াতের সাবধান বাণীটা মনে পড়ল। এই মেয়ে সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। পেট থেকে কথা বের করতে পারে। এই সময়ে মানছুরা বলল,
” এটা তো ভালো কথা। আপনি শুধু আপনার স্বামীকে ভালোবাসবেন। হৃদয় উজার করে ভালোবাসবেন। কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। তাই না, বোন? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিতে পারল না। মুখ থেকে হাতটা নেমে এলো ধীরে ধীরে। আপন ভাবনায় বিভোর হলো অজান্তেই। মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে ঘটা প্রতিটি ঘটনায় এক এক করে মনে করতে করতে আচমকায় বলল,
” বাঁধা হইয়া দাঁড়াইছে। ”
” কে? হাদিভাই? ”
” না। চাঁদনিবু। ”
” চাঁদনি! ওর কথা জানলেন কীভাবে? আপনার স্বামী বলেছে? ”
স্বর্ণলতা জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আপনে চাঁদনিবুরেও চিনেন? ”
” হ্যাঁ। আমাকে তো দাদিজান বলেছিলেন। আচ্ছা, ও বাঁধা হলো কীভাবে, বলুন না। আমি যতদূর জানি, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ উত্তর করল না। ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে লাগল। সে এই বিষয়ে কথা বলার জন্যই কাউকে খুঁজছিল। পেয়েছে, প্রসঙ্গটাও সামনে এসেছে আপনাআপনি। তাহলে এড়িয়ে যাবে কেন? বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখে তো শান্তি পাচ্ছে না। তার অশান্তির আগুনে অন্যরাও পুড়ছে। বিশেষ করে ঐ মানুষটা, যে নিশিরাতে বাইরে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার কি মায়া লাগছে? স্বর্ণলতা মাথা ঝাড়া দিয়ে বলল,
” চাঁদনিবুর সাথে যে, উনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হইছিল। জানেন তো? ”
” জানি। কিন্তু ওটা তো ইচ্ছাকৃত ছিল না। আপনার স্বামী মাতাল ছিল, যা হয়েছে বেহুঁশ অবস্থায়। তাও বিয়ের আগে। অনেক বছর আগের ঘটনা। তখন আপনি ছিলেন না। ”
” হ, এজন্যই তো আমি এটা নিয়া মনখারাপ করি নাই। বেশি গুরুত্ব দিই নাই। তখন তো উনারে আমি দু’চোখে দেখতে পারতাম না। খালি পলানোর চিন্তায় থাকতাম। ”
” তাই নাকি? বিয়েতে বুঝি আপনার মত ছিল না? ”
” না। জোর কইরা করছে। আমি তো বিয়া নিয়া কোনোদিন ভাবিও নাই। শুধু পড়ালেখা নিয়া ভাবছি। মনে হইছিল, উনি আমারে পড়ালেখা করতে দিবো না। তারমধ্যে ব্যবহারও জন্তুজানোয়ারের মতো! আমার আম্মা, আব্বারে নাম ধইরা ডাকে, তুইতোকারি করে। যারে সামনে পায়, তারেই পিটাইতে থাকে। কোনো দয়ামায়া নাই। দাদিজানরে পর্যন্ত ধমকায়। আমি তো পারলে ভয়ে মইরা যাই! ভালোবাসার কথা ভাবমু কখন? উনিও যে আমারে কোনোদিন ভালোবাসব এটা কল্পনাতেও আনতে পারি নাই। খালি মনে হয়ছে, আমারে একলা পাইলেই গলা টিইপ্যা ধরবো। ”
” ধরছে? ”
” না। বকাঝকাও করে নাই। কয়দিন যাইতে বুঝলাম, উনি সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও আমার সাথে করে না। তখন ভয়টা ভাঙল। তারপরে জানতে পারলাম চাঁদনিবুর সাথে কেলেঙ্কারির কথা। দুইজনে দুইরকম কাহিনি শুনাইল, আমি আসল কাহিনি বাইর করলাম। বুঝলাম, দুইজনেরই দোষ আছে। আমি মাফ চাওয়ানোর জন্য কত কী করলাম, তাও চাইল না! ”
” কার কাছে মাফ চাইতে বলেছিলেন? ”
” চাঁদনিবুর কাছে। অন্যায় তো উনার সাথেই হয়ছে। ”
” আপনার কাছে চাইতে বলেননি? ”
” না। আমার তো এটা নিয়া মনখারাপ হয় নাই। উনারে আমি স্বামী মানি নাই। চরিত্র ভালা হইলে কী খারাপ হইলে কী? সারাজীবন তো থাকমু না। সুযোগ পাইলেই পালামু। তাই চাঁদনিবুর কাছে চাইতে কইছিলাম। উনার এটা নিয়া অনেক দুঃখ হইতাছিল। আমার মায়া লাগল, তাই ভাবলাম দুঃখ দূর কইরা দিই। ঐটাও হইলো না! ”
মানছুরা একমনে দেখছে তাকে। চোখ, নাক, ঠোঁট এমনকি নিঃশ্বাসের গতিবিধিও পরীক্ষা করছিল। সহসা হেসে উঠে বলল,
” থামলেন কেন? তারপরে বলুন না। চাঁদনি বাঁধা হলো কীভাবে, এটা কিন্তু পরিষ্কার হয়নি এখনও। ”
স্বর্ণলতা আবারও বলতে লাগল,
” তারপরে দেখলাম, আমার পড়াশোনা নিয়া উনার কোনো আপত্তি নাই। উল্টা যে কয়টা পরীক্ষা দিতে পারি নাই, ওগুলাও আমার ইচ্ছেমতো দেওয়ার ব্যবস্থা করাইল। সাথে আমার ভাইয়ের পড়াশোনাটাও টিকাইয়া দিল। তখন মনে হইল, উনারে যত খারাপ মনে করছিলাম তত খারাপ না। একটু একটু ভালা আছে। পালাইয়া গিয়া পড়াশুনা করতে কষ্ট হইতো, টাকাপয়সা লাগত, অনেক ঝামেলাও হইতো। উনার কাছে থাকলে এসব কিছু হইবো না। তাই পালানোর চিন্তা বাদ দিলাম। সমস্যাটা হলো এখানেই। যেই ভাবলাম, উনার কাছেই থাকমু তখনই চাঁদনিবু বাঁধা হইয়া দাঁড়াইল। মহাজন স্যার রে দেখলেই আমার ঘিন লাগে। ”
” মহাজন স্যার! আপনার স্বামীকে এ নামে ডাকেন? ”
স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে বলল,
” হুম। ”
মানছুরা পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” ঘিন লাগে কেন? ঐ সম্পর্কটার জন্য? কিন্তু ঐ সময়তো উনি…”
সে কথা শেষ করতে দিল না। চট করে বলল,
” এটা তো আমি মাইনা নিছিই। সমস্যাটা হইছে অন্য জায়গায়। আমার বার বার মনে হইতাছে, উনি যদি চাঁদনিবুরে ভালোবাসত, তারপরে এসব করত তাইলেও আমার এমন খারাপ লাগত না। কিন্তু উনি ভালোবাসত না। পছন্দও করত না। খুব খারাপ ব্যবহারও নাকি করত। এত অপছন্দের একটা মানুষের কাছ ঘেষল ক্যামনে? মদ খাইলে মানুষ বেহুঁশ হয়, তাই বইলা এতটা! পুরা মানুষটায় বদলাইয়া গেল? তাইলে তো উনি চাইলে হুঁশ থাকতেও অনেক কিছু করতে পারে। হয়তো করছেও। আমরা কেউ জানি না। ”
” না, করেনি। ”
” আপনে এত নিশ্চিত হইয়া কইতাছেন ক্যামনে? আপনে কি দিন-রাত সারাক্ষণ উনার লগে ছিলেন? ”
” ছিলাম। সাতদিনের মতো। তারপরেও উনি কিছু করেনি। শেষ দুইদিন আমার শরীরে কোনো কাপড় ছিল না, তারপরেও উনাকে আকৃষ্ট করতে পারি নাই। উনি হুঁশেই ছিল, বোন। ”
স্বর্ণলতা হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময়ের ভাব এতটায় তীব্র ছিল যে, তার মাথা পাক দিয়ে ওঠল। চোখের পাতা মিলে যাচ্ছিল, সহসা মানছুরা তার বাহুদ্বয় চেপে ধরল। কাতর স্বরে বলল,
” আমাকে খারাপ ভাববেন না। তখন আমি তার স্ত্রী ছিলাম। ”
স্বর্ণলতা আরও একবার কেঁপে ওঠল। পূর্ণ দৃষ্টিতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেয়ে রইল মুখটায়। মুনছুর সাখাওয়াত যেদিন চিঠিতে প্রথম বারের মতো আদুরী নামটা নিয়েছিল। সেদিনই তার সন্দেহ হয়েছিল, হয়তো সে বিবাহিত। পূর্বে বিয়ে করেছে। সেই স্ত্রীর সন্ধানও করেছিল, পায়নি। শুধু জানতে পেরেছিল, মহাজনের বাবা বিয়ের জন্য খুব চাপ দিত। একদিন পাত্রী দেখতেও বেরিয়েছিল। ইনিই কি সেই পাত্রী?
মানছুরা নিজ থেকেই বলতে লাগল,
” আপনার মতো উনিও এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। পরিবারের চাপে পড়ে বিয়েটা করেছিলেন। বিয়ের দিনই উনার উপরে আক্রমণ হয়। তারপরে আপনার সাহায্যে হাসপাতালে যায়। সুস্থ হওয়ার পরেও আমার কাছে আসেনি। আমিও ঐ বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পাইনি। আমি চিঠি পাঠিয়েছি, উত্তর দেয়নি। কল করেছি, ধরেনি। আব্বাকে পাঠিয়েছি, ভাইকেও। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। সবাই বলছিল, আর কখনও আসবে না। কিন্তু উনি এলেন। পুরো একমাস পর। এক সপ্তাহের মতো থাকলেন এখানে, এই ঘরে, এই বিছানায়৷ ”
সে চোখের ইশারায় বিছানাটা দেখাল। স্বর্ণলতা যেটাতে বসে আছে, সেটায়। সে সটান উঠে দাঁড়াল। একটু দূরে সরে দেখল, মানছুরা বিছানাটায় হাত বুলাচ্ছে। সেভাবেই বলতে লাগল,
” আমরা একসাথে শুয়েও ছিলাম। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এরচেয়ে বেশি কিছু হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয়দিন কিছুই বলেনি। শান্ত ও স্বাভাবিকই ছিল। তৃতীয় দিন আমার গলা টিপে ধরে বলল, ‘ এত সুন্দর হয়ে কী লাভ, যদি ছুঁতেই ইচ্ছে না করে! যা সেজেগুজে আয়। ‘ আমি খুব সাজলাম। উনি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখলেন ঠিকই কিন্তু আমাকে কাছে টেনে নিলেন না। আরও রেগে গেলেন। আমার জামা-কাপড় খুলে দাঁড় করিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরেরদিনও একই কাজ করে দুইদিন সময় দিলেন। এই দুইদিনেও যদি উনাকে দিয়ে স্পর্শ করাতে না পারি তাহলে তালাক দিবেন। ”
মানছুরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্বর্ণলতার দিকে ফিরে চোখে চোখ মিলিয়ে বলল,
” আমি পারিনি, বোন। উনি কথা রাখলেন, আমাকে তালাক দিয়ে চলে গেলেন। ”
শেষদিকে কি গলাটা ধরে এলো। খুব কাঁপছিল বোধ হয়! স্বর্ণলতা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সে একস্থির চেয়ে ছিল, মানছুরার চোখজোড়ায়। টলটলে পানিতে ঢেউ ওঠছে ঠিকই কিন্তু তীর ভাঙতে পারছে না। মেয়েটির মনোবল এত পোক্ত! কী দারুনভাবে কান্না শুষে নিল! মাথানত অবস্থায় অপরাধির মতো বলল,
” স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা কারও কাছে প্রকাশ করতে নেই, কথাটা জানার পরেও করেছি। মাফ করবেন, বোন। আমি একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলান। সেই সাথে মনে হচ্ছিল, আপনাকে বলা উচিত। ”
সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল মানছুরাকে। ফিসফিসের মতো বলল,
” আমারে তুমি কইরা কন। আমি তো আপনের ছোট বোইনের মতো! ”
সেও জড়িয়ে ধরল প্রথমে। তারপরে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
” তাহলে বড় আপুর হাত থেকে একটু পানি হলেও মুখে দেও। প্রথমবার এলে, খালি মুখে যেতে দিই কী করে, বলো? আর তো কখনও আসবে না। ”
” আসব। ”
” উনি নিয়ে আসবে না। ”
মানছুরা ফেরত নেওয়া মিষ্টি ও পানির গ্লাস আবারও নিয়ে এলো। স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত দ্বিধা করল পরক্ষণেই খেতে লাগল। খেতে খেতে শুনল,
” তোমার সমস্যার সমাধান পেয়েছি। ”
” কী? ”
” তুমি মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে চাচ্ছ, উনি তোমার কাছে মাফ চাক। তুমি অবশ্য এমনি এমনি মাফ করতে চাও না, শাস্তি দিতে চাও। ”
” আমি শাস্তি দিতে চাই? ”
” হ্যাঁ। দিবেও। নাহলে মনের মধ্যে যে রাগটা লুকিয়ে আছে ওটা যাবে না। ”
” আমার কোনো রাগ নাই। ”
” আছে স্বর্ণলতা। পছন্দ হোক বা না হোক, উনি তোমার স্বামী। সে এমন একটা কাজ করবে আর তোমার খারাপ লাগবে না? আমার তো বিয়ের আগেই খারাপ লেগেছিল। দাদিজান উনার সম্পর্কে সবকিছুই বলেছেন। আমি সব মেনে নিলেও এটা মেনে নিতে পারছিলাম না, তাই বিয়েতে মত দিচ্ছিলাম না। আব্বু, আম্মু তো কিছুতেই উনার কাছে আমাকে বিয়ে দিবে না। কিন্তু দাদিজান হাল ছাড়ছিলেন না, বার বার আমার কাছে আসছিলেন। মানানোর চেষ্টা করছিলেন। বুঝিয়ে বলছিলেন, উনার তখন বয়স কম, তার উপরে মাতাল অবস্থায় ছিল। সামলানোর মতোও কেউ ছিল না, তাই বেসামাল হয়েছে। আমি যেন মাফ করে দিই। এরকম ভুল আর করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। আমি অনেক ভাবলাম। দাদিজানের জন্যও মায়া হচ্ছিল। বুড়ো মানুষ, কতদূর থেকে আসছে! তাই ভাবতে বসি। আব্বুকেও বলি খোঁজ লাগাতে, এরকম আরও ঘটনা আছে নাকি। এসব করে বিয়েটা হতে সময় নেয় অনেক। কিন্তু সঠিক খোঁজ পাই, এরকম ঘটনা নেই। কিন্তু মেয়ে মানুষের উপরে হাত তুলেছে অনেক বার। ঐটাও টাকার জন্য। দাদিজানকে এই কথা জানাই। উনি অসহায় মুখে আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে জানান, এই কারণেই উনি আমাকেই নাতবউ হিসেবে চায়। উনার ধারণা, একমাত্র আমিই পারব উনার নাতির এই পাপের ব্যবসা বন্ধ করতে। আল্লাহর পথে আনতে। ”
স্বর্ণলতা অবাক হয়ে সুধাল,
” উনি পাপের ব্যবসা করে? ”
” উনি সুদের ব্যবসা করেন। আমাদের ধর্মে সুদ নেওয়া ও দেওয়া হারাম। ঐ হিসেবে এটা পাপের ব্যবসায়। ”
মানছুরাও তার হাত ধরে বলল,
” আমি দাদিজানের ইচ্ছেটা রাখতে পারিনি, তুমি রেখ। ”
” দাদিজান তো এরকম কিছু কই নাই আমারে। ”
” তোমার বয়স কম তো, তাই হয়তো ভরসা করে উঠতে পারেনি এখনও। কিন্তু আমি করছি। তোমার স্বামী তোমাকে অনেক ভালোবাসে। এই সুযোগটা নিও। চেষ্টা করো, হয়তো বদলে যেতে পারে। ”
স্বর্ণলতা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” উনি তো উনার আম্মা-আব্বারেই ভালোবাসতে পারে নাই, আমারে কী ভালোবাসবো! যেটা আপনের কাছে পাই নাই, ঐটা আমার কাছে চায়। পাইলেই এসব ভালামানুষি বাইর হইয়া যাইবো। আপনে এত সুন্দর তারপরেও গলা টিইপ্যা ধরছে। আমি তো আপনের ধারেকাছেও নাই। বিলাইয়ের মতো দেখতে! চাওয়া পূরণ হইয়া গেলে গলা পর্যন্ত হাতও নিব না। বুকে পাড়া দিয়া জান বাইর কইরা নিবো! ”
মানছুরা আঁতকে ওঠল। স্বর্ণলতার মুখটা হাত দিয়ে আটকে বলল,
” আসতাগফিরুল্লাহ, কী বলো এসব! উনি তোমাকে সত্যি ভালোবাসে। আদুরীর মতো না, ওর চেয়েও বেশি। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। ”
মানছুরা কী যেন একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গি করে ভেতরের ঘরটায় চলে গেল। মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো একটা কাগজ নিয়ে। স্বর্ণলতাকে দিয়ে বলল,
” পড়ো। ”
সে কাগজের ভাঁজটা খুলে পড়তে লাগল। তাতে লেখা,
‘ আমাদের আশপাশে এমন কিছু আশ্চর্য রকমের সৌন্দর্য আছে। যা দেখলে, শুধু চেয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। মুগ্ধতায় দেহ, মন অবশ হয়ে আসে কিন্তু যতক্ষণ চেয়ে থাকে ততক্ষণই। চোখ ফিরিয়ে নিলে দ্বিতীয় বার তাকানোর মতো আকর্ষণ বোধ করে না। আমার কাছে তুমি সেই আশ্চর্য সৌন্দর্যের অধিকারিনী। যখন চেয়েছি, তখন মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। ক্লান্ত হয়ে পলক ফেলে দিলে আর দেখতে ইচ্ছে হয়নি।
কিন্তু স্বর্ণলতা!
আমার বউ!
তোমার মতো চোখ ধাঁধানো রূপ নেই ওর। কিন্তু অপার্থিক কিছু একটা আছে, যা প্রবল আকর্ষণ তৈরি করে। তাকালে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় না, ছুঁয়ে দেওয়ারও লোভ হয়। সেই লোভ আমি সামলে উঠতে পারি না। কিছুতেই পারি না! আমার এই দুর্বলতা মেয়েটা টের পেয়ে গেছে বোধ হয়। তাই আমার কাছে আসে না৷ দূরে থেকে মজা নেয় শুধু। আমার এত রাগ হয়! ইচ্ছে হয় চড়িয়ে গাল ফাটিয়ে দিই। কামড়ে শরীর জখম করে দিই। অথচ উঁচু স্বরে একটা ধমকও দিতে পারি না। কী অবাক কাণ্ড! নিজের ব্যবহারে নিজেই আশ্চর্য হই।
বউটা এত পাজি, জোর করে কাছে টেনে এনেও শান্তি নেই। মুখ ফিরিয়ে রাখবে অন্যদিকে। বিয়ের পরে সম্পূর্ণ মুখটা ঠিকমতো দেখতেই পারলাম না এখনও! কখনও চোখ দেখার সুযোগ পেয়েছি, কখনও ঠোঁট। নাকটা দেখার আগেই মুখ সরিয়ে নেয়। কীভাবে যে বুঝে যায় একমাত্র ওই জানে। তখন ওর এলোমেলো শাড়ির প্যাঁচ, আধ খসা কুঁচি, পায়ের নখ দিয়ে জমিন খুঁচানো দেখি। জোর করেও যখন কাছে আনতে পারি না তখন এগুলো দেখার জন্যও ছটফট করি। মনে হয় মুখ দেখতে হবে না, কাছে আসতে হবে না। শুধু নজরের মধ্যে থাকুক আমি মাথার ঘোমটা পড়ে যাওয়া, খোঁপা খুলে যাওয়া দেখেও মন জুড়িয়ে নিব।
মানছুরা, আমার বিশ্বাস তোমাকে আল্লাহ অনেক পছন্দ করে। তাই তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি, তার শাস্তি পাচ্ছি। হয়তো মাফ চাইলে আমার শাস্তি ফুরিয়ে আসতে পারে কিন্তু চাইব না। আমি আজ অবধি আল্লাহর কাছেই মাফ চাইনি, তোমার কাছে চাই কী করে বলো? তাই কষ্টের কথাগুলো লিখলাম। পড়ে যদি তুমি একটু শান্তি পাও।
মুনছুর সাখাওয়াত ‘
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫৬)
স্বর্ণলতা চিঠি পড়া শেষ করে বলল,
” কত খারাপ দেখছেন! বড় বউয়ের কাছে ছোট বউয়ের নামে নালিশ করতাছে। আপনেরেও তো ছোট করল! এরপরেও এই লোকটার দোষ ঢাকবেন? ”
মানছুরা হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
” আমি এখন উনার বউ না। তালাক হয়ে গেছে আমাদের। তাই নিজেকে ছোট বউ না ভেবে শুধু বউ ভাব। উনার জীবনে তুমি একমাত্র বউ। ভীষণ আদরের ও ভালোবাসার বউ। ”
” ধুর! আপনে খালি উনার পক্ষ নিতাছেন ক্যান? ”
” আমি কারও পক্ষ নিচ্ছি না, স্বর্ণলতা। আমার জ্ঞান যা বুঝছে তাই বলছি। এই চিঠিতে উনি নালিশ করেননি। তোমাকে কতটা ভালোবাসে সেটায় বুঝিয়েছেন। ”
স্বর্ণলতা আরও একবার চোখ বুলাল। বিড়বিড় করে দ্রুত পুরোটা পড়ে নিয়ে বলল,
” কই? ভালোবাসার কথা তো দেখতে পাইতাছি না, বুবু! ”
মানছুরার হৃদয় কেঁপে ওঠল। সম্পূর্ণ দেহটায় আনন্দের দোলনায় পড়ল যেন! উচ্ছ্বসিত চিত্তে সমানে দোল খেয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা আচমকা এক ধাক্কাতে এত কাছে টেনে নিবে ভাবতেও পারেনি। আবেগে আপ্লুত হলো। চোখের তারা ঝিকঝিক করছে। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল,
” উনার মধ্যে যদি সবসময় খারাপ দিকটায় খুঁজে বেড়াও তাহলে ভালো দিকটা সামনে পড়ে থাকলেও দেখতে পারবে না। ”
সে স্ব হস্তে চিঠিটা পুনরায় ভাঁজ করল। স্বর্ণলতার মুঠোয় পুড়ে দিয়ে বলল,
” চিঠিটা যত্ন করে রেখে দিও। তোমার স্বামীর মধ্যে যেদিন ভালো কিছু দেখতে পাবে সেদিন এই চিঠিটা আবার পড়বে। দেখবে, এখানে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। আমার নামটাও না। ”
এই সময়ে একটি কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ ভেসে এলো। মানছুরা চকিতে তাকাল বন্ধ দরজার দিকে। মুহূর্তেই ব্যস্ততা চলে এলো চালচলনে। বিছানা থেকে পানির গ্লাস ও মিষ্টির পিরিচটা সরিয়ে নিতে নিতে বলল,
” তুমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকবে? ”
” ক্যান? ”
” আমার ভাই এসেছে। খেতে দিব। যদি থাকো তাহলে আমরা আরও গল্প করতে পারতাম। ”
স্বর্ণলতা দরজার দিকে তাকাল। কেউ কি কড়া নেড়েছে? সে শুনতে পায়নি তো! সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ভাই আইছে বুঝলেন ক্যামনে? উনি কি ডাকছে? আমি শুনলাম না ক্যান? ”
” না, ডাকেনি। ওর বন্ধুর গলা পেয়েছি। একটু কান খাড়া করো, তুমিও শুনতে পাবে। ”
স্বর্ণলতা চুপ হয়ে গেল। শ্বাস বন্ধ করে মনোযোগ রাখতে কুকুরটা আবারও ঘেউঘেউ করে ওঠল। সে অবাক হয়ে উচ্চারণ করল,
” কুত্তা! ”
মানছুরা হেসে মাথা নাড়ল। তারপরে বলল,
” সারাদিন পরে ফিরেছে! পড়ালেখা ভালো লাগে না। বইপত্র বেচে দিয়ে গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে বেড়ায়। সঙ্গী হয়েছে ঐ কুকুরের বাচ্চাটা! ”
স্বর্ণলতার মনে হলো, সুবর্ণের কথা বলছে। এই ছেলেটাও পড়তে চায় না। সে জোর করে পড়াত। এখন কী করছে কে জানে! তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কতদিন ভাইটাকে দেখে না! আম্মা-আব্বার কথাও খুব মনে পড়ে গেল।
” থাকবে তো? ”
স্বর্ণলতার সম্বিৎ ফিরল। বলল,
” না, চইলা যাই। আরেকদিন আমু নে। উনিও কখন থেইকা দাঁড়াইয়া আছে। পরে রাগ করবো। ”
মানছুরা জবাবে কিছু বলল না। শুধু হাসল। স্বর্ণলতা নিকাবটা পরে নিল। যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে বলল,
” বুবু, একটা প্রশ্ন করি? ”
” করো। ”
” উনি যে আপনেরে এত কষ্ট দিল, আপনের রাগ হই নাই? ”
” হয়েছে তো। ”
” তাইলে উনার খারাপ না চাইয়া ভালা চাইতাছেন ক্যান? আপনে তো চাইলে আমারে দিয়াও উনার ক্ষতি করতে পারতেন। ”
” জানি। আমি চাইলে তোমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারতাম। তোমাকে চিরতরে সরিয়েও দিতে পারতাম। এই আশঙ্কটা উনার মধ্যেও আছে। তাই তোমাকে আমার হাতে কিছু খেতে মানা করেছে। কিন্তু স্বর্ণলতা, এতে আমার লাভ কী হতো? হয়তো হৃদয় শীতল হতো। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য। তারপরে? তোমার স্বামী কি আমাকে বাঁচতে দিত? সবচেয়ে বড় কথা, আমার আল্লাহকে কী জবাব দিতাম? তারচেয়ে ভালো না, তোমার বৈবাহিক সম্পর্কটা মজবুত করে দেওয়া? তোমরা সুখী হলে আল্লাহও খুশি হবেন। এই অসিলায় তিনি আমার দোয়া কবুল করে নিতে পারেন। ”
” কী দোয়া, বুবু? কন না, আমিও আপনের হইয়া দোয়া করতে চাই। ”
” আমার ভাইটার বুদ্ধিনাশ হয়েছে। ওর মাথা খুব ভালো। পড়ালেখা করলে বড় কিছু হতে পারত। কিন্তু ছেলেটাকে কিছুতেই পড়াতে পারছি না! দোয়া করো, ওর যেন সুমতি হয়। ”
স্বর্ণলতা তখনই বের হতে পারল না। মানছুরা আটকাল। তাকে বসিয়ে রেখে কলম ও কাগজ আনল। তাতে ঝটপটে গোটা কয়েক লাইন লিখে কাগজটা ভাঁজ করে ফেলল। অপেক্ষারত মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল,
” উনাকে দিও। ”
________
স্বর্ণলতা বাইরে এসে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠ ঘুরানো। মুখটা বাড়ির গেইটটার দিকে ফেরানো। ভাবখানা এমন, কতকাল ধরে বন্দি হয়ে আছে। বের হওয়ার পথ দেখতে পাচ্ছে কিন্তু যেতে পারছে না! সে ধীরে ধীরে হেঁটে এসে দাঁড়াল পেছনে। হালকা স্বরে বলল,
” বাড়ি চলেন। ”
সে হকচকিয়ে গেল। আবছা চওড়া দেহটা কেঁপে ওঠে খানিক সরে গেল। স্বর্ণলতা তাজ্জব বনে গেল। লোকটা কি ভয় পেল? তার মনেও ডরভয় আছে? নাকি একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল?
মুনছুর সাখাওয়াত অতি দ্রুত সামলে উঠে জিজ্ঞেস করল,
” কথা শেষ? ”
” হ। ”
” কারণটা পেয়েছ? ”
” হ। ”
” তাহলে বলছ না কেন এখনও? ”
” এখানেই কইতে হইবো? বাড়ি যামু না আমরা? নাকি এখানেই আরেকটা সংসার পাততে চান! ”
সে একটু চুপ থেকে বলল,
” মেয়েটির পরিচয় পেয়ে গেছ তাহলে! ”
” মেয়েটি আবার কী? নাম নাই উনার? ভাব দেইখ্যা মনে হইতাছে জীবনে দেখা-সাক্ষাতও হই নাই। ”
স্বর্ণলতা মুখ বাঁকাল। নাক, চোখ কুঁচকে ফেলল। মুনছুর সাখাওয়াত জোসনার আলোয় সবই লক্ষ্য করছিল। সহসা কুকুরটি দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। গলা ফাটিয়ে সমানে ঘেউঘেউ করতে লাগল। স্বর্ণলতা ভয়ে প্রথমে লাফিয়ে একপাশে সরে এলো। পরক্ষণে স্বামীর একটা হাত চেপে ধরল শক্ত করে। কুকুরটি থামেনি তখনও। উগ্র হলো আরও। আক্রমণাত্মকভাব! যেকোনো মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ে কা মড়ে দিতে পারে। স্বর্ণলতা ছিটকে ছিটকে ওঠছিল। তীব্র ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে সরে যাওয়ার কথাটা বলতে চাইল, পারল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত সজোরে লা থি মারল কুকুরের বাচ্চাটিকে। সে আঁতকে উঠে উত্তেজিত গলায় বলল,
” কী করলেন এটা? ছোট বাচ্চা ছিল। যদি মইরা যায়? ”
” যাক। ”
স্বর্ণলতা হতবাক হয়ে গেল। হাতটা ছেড়ে দিল। দূরত্ব বাড়িয়ে নিল। আদুরীর কথাটা শোনার পরে অবচেতনেই ধরে নিয়েছিল, এই লোকটির মানুষের প্রতি দয়ামায়া না থাকলেও পশুপাখির প্রতি আছে। এখন মনে হচ্ছে, সেটাও ভুল। নাহলে এমন নির্মমভাবে কুকুরটির মৃত্যু চাইতে পারত না! তারা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ঘটনায় আগমন ঘটল মানছুরার ভাইয়ের। সে দৌড়ে এলো উঠোনে। থামল ঠিক তাদরে সামনে। এক পলকেই দুজনকে দেখে নিয়ে বলল,
” আপনাকে যতবার দেখেছি ততবারই কবর খুঁড়েছি, দুলাভাই। আপনি কি মৃত্যু সাথে নিয়ে ঘুরেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। বুকের কাছটা থাবা দিয়ে ধরে বলল,
” আমি মহাজন। আরেকবার দুলাভাই ডাকলে কবর খুঁড়ার জন্য হাত দুটো থাকবে না। ”
স্বর্ণলতা চুপচাপ থাকতে পারল না। অসহ্য হয়ে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াতের হাতটা টেনে সরিয়ে বলল,
” আপনেরে বদলানোর চেয়েও সহজ বিষ খাইয়া মইরা যাওয়া। ”
কথাটা বলেই সে হাঁটা ধরল। একবারের জন্যও থামল না, পেছনেও ফিরল না। উঠোন পেরিয়ে জীপে গিয়ে বসতেই শুনল,
” তুমি বি ষ খাবে? ”
” হ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার পেছন পেছন এসেছিল। গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিতে সে ঘুরে গিয়ে বসল অন্য সিটটাতে। গাড়ি চালু করল না। স্বর্ণলতার দিকে ঘুরে বলল,
” কেন? আমি কি তোমাকে মারছি নাকি গালি দিচ্ছি? যৌতুকের টাকাও তো চাইনি! ”
” চান। মানা করছে কে? ”
” দরকার নেই তো। টাকা-পয়সার অভাব নাকি আমার? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। তার মাথা ধরেছে। গা গুলাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে, কুকুরটি মারা গিয়েছে। যে জোরে লাথি মে রেছে! উড়ে গিয়ে কোথায় পড়েছে দেখতেও পারেনি। নিশ্চয় পেট ফেটে নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে এসেছে। সে চোখ বুঁজলেই একদলা নাড়িভুঁড়ি দেখতে পাচ্ছে। সাথে সাথে পেটের ভেতরে মোচড়ামুচড়ি হচ্ছে।
মুনছুর সাখাওয়াত নরম গলায় অনুরোধের মতো বলল,
” স্বর্ণলতা, তুমি বিষ খাবে না। আমি এসব কিছুই করব না। ”
সে জানালায় মাথা এলিয়ে দিল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বলল,
” গাড়ি ছাড়েন না ক্যান? বাড়ি যামু। ”
সাথে সাথেই ইঞ্চিন সক্রিয় হয়ে ওঠল। জীপ ছুটতে লাগল রাস্তা ধরে। মানছুরাদের বাড়ির রাস্তাটা অতিক্রম হওয়ার পরে স্বর্ণলতা গভীর নিঃশ্বাস টানল। অতঃপরে একটি কাগজ এগিয়ে ধরে বলল,
” বুবু এটা আপনেরে দিতে কইছে। ”
সে কাগজ নিতে নিতে বলল,
” তুমি যাকে তাকে বুবু বানিয়ে ফেল কেন? আমার পছন্দ না এটা। ”
” তাইলে কি আপনের মতো নাম ধইরা ডাকমু? ”
” ডাকতেই পার। তুমি আমার স্ত্রী। আমি যাকে নাম ধরে ডাকব, তুমিও তাকে নাম ধরে ডাকবে। ”
” ডাকতে পারি না। কারণ, আমি আপনের মতো বেয়াদব না। ছোট থাকতেই আমার আম্মা ভদ্রতা শিখাইছে। ”
” আমি বেয়াদব? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। মুখ ফিরিয়ে নিল। সাথে সাথে শুনতে পেল,
” এটাতে কিছু লেখা আছে নাকি? এখনই পড়ব? ”
” আপনের ইচ্ছা। ”
মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থামিয়ে রাখল রাস্তার একপাশে। এখানে ঘন অন্ধকার। চাঁদের আলো আসছে না পর্যন্ত! সে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। টর্চ জ্বালিয়ে পড়তে লাগল,
‘ সালাম নিবেন। প্রথমেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আপনার বউটার মুখ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। যেদিন শুনলাম, আপনি বিয়ে করেছেন। সেদিন থেকেই মুখটা দেখার খুব ইচ্ছে করছিল, বলতে পারিনি কাউকে। কিন্তু আমার আল্লাহ! তিনি তার বান্দার মনটাও পড়তে পারেন। আপনি বলেছিলেন না? তিনি আমাকে পছন্দ করেন। সেজন্য হয়তো ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলেন।
আমি জানি, আপনার বউয়ের মুখ দেখানোর জন্য আমার কাছে আসেননি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। সেটা পরিষ্কারভাবে ধরতে পারিনি। আপনার স্বর্ণলতাও নির্দিষ্ট করে বলেনি। তবে ওর সাথে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি, সেটায় তুলে ধরছি।
মেয়েটা এখনও আপনাকে ভালোবাসতে পারেনি ঠিকই কিন্তু আপনার প্রতি নির্ভর হয়ে পড়েছে। মায়ায় আটকা পড়ছে। সেটাও নিজে থেকে। আপনার কোনো কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে না। যে মেয়ে নিজে থেকে কারও উপর নির্ভয় হয়, মায়ায় পড়ে সেই মেয়ে ভালোবাসতে বাধ্য। আজ নাহয় কাল আপনাকে ভালোবাসবেই। এই ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। শুধু অনুরোধ করব, ওর উপরে জোর করবেন না। কোনো রকম দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিবেন না। তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। যদি পারেন, স্বর্ণলতার পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিন। তাহলে আপনার সাথে সহজ হবে, কথা বলতে আগ্রহ পাবে। মনের মধ্যে কিছু জমিয়ে রাখবে না। মনে কথার ভার না থাকলে ভালোবাসা দ্রুত জন্মায়। দোয়া করি, আল্লাহ যেন আপনার ধৈর্যশক্তি বাড়িয়ে দেয়। ‘
সে চিঠি শেষ করে তাকাল পাশে। স্ত্রীর দিকে। মুহূর্তেই চমকে ওঠল! স্বর্ণলতা তার দিকেই চেয়ে আছে পূর্ণ দৃষ্টিতে। এই দৃশ্যটা কি এই প্রথম দেখল? চোখাচোখি হতে স্বর্ণলতা বলল,
” খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাছেন তো! কী লেখা আছে এইটাতে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
” নিজেই পড়ে নেও। ”
” আমি অন্য কারও চিঠি পড়ি না। ”
সে মুখ বাঁকিয়ে নিতে চেয়েও নিল না। আচমকা বলল,
” বুবু কি বাড়িতে একা থাকে? কাউরে তো দেখলাম না। ”
” ওর ভাই থাকে হয়তো। মা তো মারা গেছে। ”
স্বর্ণলতার বুকটা ধক করে ওঠল। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য ভাব। সুধাল,
” কবে? আপনেগো বিয়ার মধ্যেও না ছিল? ”
” ঐদিনই, বিয়ের পরপরেই মারা গেছে৷ ”
” কী কন! ক্যামনে? বুবু তো কিছু কইল না! ”
” খু ন হয়েছে। মানছুরা হয়তো এখনও আসল ঘটনা জানে না। তাই বলেনি। ”
” খু ন! আপনে মারছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সামনে চেয়ে কথা বলছিল। নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর। দায়সারা অভিব্যক্তি প্রকাশ। এবার যেন একটু বিরক্ত হলো। ভ্রূদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকাল বিষণ্ণ, আগ্রহপূর্ণ চোখদুটিতে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না। বলল,
” না। যারা আমাকে মারার পরিকল্পনা করেছিল, তাদের হাতে খুন হয়েছে। উনি এই পরিকল্পনার অংশ ছিল না, কিন্তু ভুল করে জেনে গেলেও অংশ হতে চায়নি তাই মেরে দিয়েছে। ”
” আপনি জানলেন ক্যামনে? ”
” মানছুরার বাবা বলেছে। ”
” উনি জানল ক্যামনে? ”
” সে এই পরিকল্পনার অংশ ছিল। ”
স্বর্ণলতা বিশ্বাস করল না। বিরক্ত দেখিয়ে বলল,
” উল্টাপাল্টা বুঝাইতাছেন ক্যান? উনি বুবুর আব্বা না? মাইয়ার বিয়ার দিন মাইয়ারে বিধবা করতে চাইবো ক্যান? ”
” টাকার জন্য করেছে। এই পৃথিবীতে একমাত্র টাকায় পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। তোমার বাবাও তো টাকার জন্যই তোমাকে বিয়ে দিয়েছে। ”
স্বর্ণলতা মনখারাপ করতে চেয়েও করল না। জিজ্ঞেস করল,
” নিজেরে মারার জন্য বুবুর আব্বা রে ট্যাকা দিছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত হতাশ হলো। এই মেয়ে সবকিছুতে তাকেই আনছে কেন? তার কি ধারণা পৃথিবীতে একমাত্র সেই খারাপ? টাকা দিয়ে স্বার্থোদ্ধার করে? সে অল্পক্ষণ চুপ থেকে জানাল,
” না। চাঁদনির বাবা দিতে চেয়েছিল। ”
” এখানেও চাঁদনিবু! ”
স্বর্ণলতা ধপ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এবার মুখটা ফিরিয়ে নিল। এরপরে প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করল না। যা বুঝার আপনজ্ঞানেই বুঝে যাচ্ছে। সে চুপ হয়ে গেলেও মুনছুর সাখাওয়াত হলো না। সে বলতে লাগল,
” মানছুরার খোঁজ এনেছিল চাঁদনির বাবাই। তখন দাদিজান ও আব্বু আমাকে বিয়ে করানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে দাদিজান। তার মনে হচ্ছিল, বিয়ে করলেই আমি সুধরে যাব। তাই এমন মেয়ে খুঁজছিল যে সুন্দরী, শিক্ষিত, উচ্চবংশীয় হবে। সাথে আল্লাহ ভীরুও হতে হবে। মানছুরার মধ্যে এই সবকিছুই ছিল। দাদিজান একদেখায় পছন্দ করে ফেলল। তারপরে মা, ছেলে মিলে আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগল। আমি মানছিলাম না দেখে বুঝাল, পছন্দ না হলে বিয়ে হবে না। শুধু একবার যেন দেখতে যাই। আমি যাওয়ার আগেই ঠিক করেছিলাম, ওখানে বসেই মানা করব কিন্তু মেয়েটা…”
এখানে এসে থেমে গেল। স্বর্ণলতা তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। সরাসরি চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী কইলেন? শুনি নাই। আবার কন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দ্রুত সংশোধন করে নিল,
” কিন্তু মানছুরা যে এত সুন্দর হবে কল্পনাও করতে পারিনি। ”
” তাই বিয়া কইরা নিলেন? ”
” হুম। আমার যে পছন্দ হয়েছে এই কথা আমি স্বীকার করতে চাইনি, মানছুরাই করিয়েছে। তোমাকে বললাম না? ও মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে? আমাকেও করে ফেলেছিল। যদি দাদিজান জিজ্ঞেস করত, তাহলে ঠিকই বলতাম মেয়ে পছন্দ হয়নি। কিন্তু…”
সে থেমে গেল। স্বর্ণলতা তখনও তার দিকে চেয়েই আছে। এটা বুঝার পরেও মুনছুর সাখাওয়াত ঐ চোখদুটিতে চোখ মেলাতে পারল না। না চেয়েই বলল,
” তারপরে কী হয়েছে জানোই তো। ”
” জানি না। আপনে কন। ”
সে অবাক হয়ে বলল,
” মানছুরা বলেনি? ”
” কইছে। যেটা কই নাই ওইটা কন। ”
” কী বলেনি? ”
” রূপে মুগ্ধ হইয়া একদেখায় যারে বিয়া করলেন তারে তালাক দিলেন ক্যান? ”
” ওর প্রতি ভালোবাসা আসেনি তাই। ”
” ভালোবাসা কি এত সহজ যে, চাইলেন আর হইয়া যাইবো? এরজন্যে সময় লাগে। আপনে তো ঐটাই দেন নাই। ”
” অন্যকিছুও তো আসে নি! ”
” কী? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জীপের গতি কমাল। তারপরে তাকাল কিশোরী বউয়ের দিকে। মেয়েটা জেরা করতে করতে তার দিকে চেপে এসেছে। মুখটা বেশি এগুনো। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করতে পারবে, করল না। নিজের মুখটাও খানিক এগিয়ে চোখদুটিতে চেয়ে বলল,
” নিকাবটা খুলো তারপরে বলছি। ”
স্বর্ণলতা ঝটিতে সরে গেল। নিকাব খোলার বদলে আরও ঠিকঠাক করল। তারপরে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
” এটা তো বুবু কইছেই। আর কোনো কারণ নাই? ”
” আছে। আমি হাসপাতালে থাকতেই জানতে পেরেছিলাম, ওর দেওয়া দুধের গ্লাসেই ঘুমের ঔষধ মেশানো ছিল। তখনই মাথায় রক্ত উঠে যায়। ভাগ্যিস, কাছে ছিল না। তাই বেঁচে গেছে। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, মানছুরাও এই পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাস আসেনি। মনে হয়েছিল, ওর সাথে থাকলে আমি মৃত্যু ভ য়ে থাকব। হয়তো এই কারণেই ওর প্রতি কোনো অনুভূতি কাজ করেনি। ভবিষ্যতেও করত না। তাই তালাক দিয়েছি। ”
” তালাকটা তো ভালোভাবেও দিতে পারতেন, অপমান করলেন ক্যান? ”
” অপমান করেছি? ”
” করছেনই তো। একটা মাইয়া রে আপনে রাতভর উলঙ্গ কইরা দাঁড় করাইয়া রাখছেন! ”
মুনছুর সাখাওয়াতের জীপ থেমে গেল আচমকা। স্ত্রীর দিকে ফিরে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সুধাল,
” মানছুরা তোমাকে এটাও বলেছে? ”
” হ। ”
সে জানত মানছুরা মিথ্যা কিছু বলবে না। কিন্তু সত্য বলতে গিয়ে যে ব্যক্তিগত মূহুর্তের প্রতিটা ঘটনায় বিস্তারিতভাবে বলবে, এটা বুঝতে পারেনি। বিশ্বাস করতে বেশ সময় লাগল। কথাই বলতে পারল না কতক্ষণ। নীরবে আবারও জীপ চালিয়ে যেতে যেতে সহসা বলল,
” মানছুরার কাছে আমি আবারও গিয়েছিলাম দাদিজানের জন্য। অনেক অনুরোধ করছিল, ও কে বাড়িতে আনতে। তার নাতবউ হিসেবে একেই লাগবে। কিন্তু আমি কোনো আগ্রহ পাচ্ছিলাম না, তাই আগ্রহ আনার চেষ্টা করছিলাম শুধু। ”
” এমনে চেষ্টা করে কেউ? উনার কেমন লাগতাছিল বুঝার চেষ্টাও করেন নাই একবারও? বুবুর জায়গায় যদি আপনে হইতেন? তাইলে ক্যামন লাগত ভাবেন তো। ”
” আমিও তো ছিলাম। তুমি যেদিন প্রথম আমাকে দেখলে সেদিন আমার শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। তুমি কিছু একটা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলে। ”
” আপনে তাইলে প্রতিশোধ নিছেন? ”
” কী জানি, মনে নেই। কিন্তু স্বর্ণলতা, মানছুরা তখন আমার স্ত্রী ছিল, আমার যেভাবে খুশি সেভাবে দেখতেই পারি। এখানে অপমানের কী আছে? আমাকে খুশি করা তো ওর কর্তব্য, তাই না? ”
” তাইলে আমারেও কন৷ ”
” কী বলব? ”
” জামাকাপড় খুইলা আপনের সামনে দাঁড়াইয়া থাকতে। আমিও তো আপনের স্ত্রী। আপনে রে খুশি করা আমারও কর্তব্য। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কী যেন একটা বলতে চাইল। সুযোগই দিল না। স্বর্ণলতা ঘোষণা দিয়ে দিল,
” যতদিন না এমনে কইবেন ততদিন আমি নিজ থেইকা আপনের কাছে যামু না। ভালোবাসতেও দিমু না। আপনে মানলে ভালো, না মানলে জোর কইরা করবেন৷ আপনে তো এই কাজেও ওস্তাদ! ”
” আরে, কীসের সাথে কী মিলালে! স্বর্ণলতা…”
” বাড়ি পৌঁছাইতে আর কতক্ষণ লাগবো? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চট করে আশপাশটা দেখে বলল,
” আধঘণ্টা। ”
” তাইলে আমি ঘুমাই। ”
স্বর্ণলতা সিটে হেলান দিল। চোখ বুঁজে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। তার এত খুশি লাগছে! বিয়ের পরে এরকম খুশি লাগেনি কখনও। এই লোকটাকে শাস্তি দিয়ে এত আনন্দ হবে ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ মনে পড়ল মানছুরা বুবু বলেছিল, চাঁদনিবুর বিষয়টার জন্যও শাস্তি দিতে। কিন্তু কী শাস্তি দেওয়া যায়? সে চোখ বুঁজে এসবই ভাবছিল। সহসা পেয়ে গেল। চোখ খুলে বলল,
” আরেকটা কথা। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চট করে বলল,
” মানছুরাকে নিয়ে আর একটা কথাও না। ঘুমাতে চেয়েছ না? ঘুমাও। ”
” কথাটা কইয়া তারপরে ঘুমামু। ”
” না। আগে ঘুমাও। মানছুরার প্রভাব থেকে বের হও আগে তারপরে কথা বলব। নাহলে একটু পরে বলবে, বুবুরে তালাক দিয়া ভুল করছেন, আপনের জন্য তার বিয়া হইতাছে না। এখন তারে আবার বিয়া করেন। ”
সে হুবহু স্বর্ণলতার মতোই আঞ্চলিক ভাষায় কথাটা বলল। স্বর্ণলতা প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণে হেসে ফেলল। নিকাব থাকায় মুনছুর সাখাওয়াত হাসিটা দেখতে পেল না। কিন্তু শুনল বোধহয়। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি হাসছ? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের উত্তরটা দিল না। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়ে বলল,
” নিজ থেইকা বিয়ার কথা কইতাছেন। করবেন নাকি? ”
” অসম্ভব। এই চিন্তা মাথা থেকে বের করে দাও এখনই। অবশ্য তুমি বললেও সম্ভব না। যে স্ত্রীকে তালাক দেয় সেই স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করা যায় না। যদি একান্ত প্রয়োজন পড়ে তাহলে আরেক জায়গায় বিয়ে দিতে হয়। সেই স্বামী যদি সেচ্ছায় আবারও তালাক দেয় তাহলে বিয়ে করা জায়েজ আছে। তোমার কি মনে হয়, আরেক জায়গায় বিয়ে হওয়া মেয়েকে আমি আবারও বিয়ে করব? ”
” তালাক দিলে তো করবেন! বুবু দেখতে যেমন সুন্দর, মনটাও তত সুন্দর। এমন বউ পাইয়া কেউ তালাক দিবো? আপনের মতো কি সবার মাথায় সমস্যা আছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ কপালে তুলে সুধাল,
” আমার মাথায় সমস্যা আছে? ”
স্বর্ণলতার কেন জানি এই প্রশ্নটা শুনেও হাসি পেল। হাসলও কিন্তু শব্দ করল না। সাবধান থাকল। তারপরে অধৈর্য গলায় বলল,
” আমি অন্য কথা কইতে চাইছিলাম। কমু? ”
” বলো। ”
” আজকে থেইকা আপনে সব মাইয়ারে মায়ের চোখে দেখবেন। শুধু আমি আর দাদিজান বাদে। ”
” কী বললে এটা? বুঝলাম না তো! ”
” বুঝবেন ক্যামনে? নিজের আম্মা রে ভালোবাসেন নাই। তাই বুঝেন ও না আম্মা কী জিনিস। তারে কেমন সম্মান দিতে হয়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রত্যুত্তরে বলল,
” কথাটা তো এটা না, কথা হলো আমি সব মেয়েকে মায়ের নজরে দেখতে যাব কেন? আমার আব্বু কি ধরে ধরে সব মেয়েকেই বিয়ে করেছে? ”
” বিয়া করতে হইবো ক্যান? আমি কি আপনেরে সবার পেট থেইকা বাইর হইয়া দুধ খাইতে কইছি? ”
জীপটা আবারও থেমে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপরে ব্যস্তভাবে স্বর্ণলতার হাত ধরল। এপিঠ, ওপিঠ পরখ করে তার নিকাবটাও খুলে ফেলল। কপাল, গাল, গলা বেশ কয়েকবার স্পর্শ করল। অতঃপর উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
” জ্বরে তো ধরে নাই, তোমাকে কি তাহলে জ্বীন-ভূতে ধরল? ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫৭)
জীপে পানির বোতল সংরক্ষিত ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত তড়িঘড়িতে পানির বোতল বের করল। মুখ খুলে বউয়ের চোখ, মুখে পানি ছেটাতে লাগল। অপরিকল্পিত কাজ! তাড়াহুড়ায় যত্ন ও সতর্কতা হারাল। পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল গলা ও বুকে। স্বর্ণলতা ভারি বিরক্ত হয়ে বলল,
” কী করতাছেন! থামেন। গোসল করাবেন নাকি? ”
” তুমি হুঁশে নেই। হুঁশ ফেরাচ্ছি। ”
” আমি তো হুঁশেই আছি। ”
” না, নেই। জ্বীনে আঁচড় করছে মনে হয়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আবারও তার মুখ ধুয়ে দিল পানিতে। হাতের তালুতে পানি নিয়ে স্বর্ণলতার মাথা ভেজাতে ভেজাতে বলল,
” মানছুরার মতো দ্বীনদার নারীদের আশপাশে জ্বীন-ভূতের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু ধরার সাহস পায় না। তাই অন্য কাউকে ধরে, বিরক্ত করে। তোমাকেও ধরেছে মনে হয়। কিন্তু বিরক্ত করছে আমাকে। ”
” আপনে জ্বীন বিশ্বাস করেন? ”
” অবিশ্বাসের কী আছে? জ্বীন তো আল্লাহর সৃষ্টি। কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। ”
” আপনে এটাও জানেন? ”
” হ্যাঁ। ”
সে বউয়ের হুঁশ ফেরানোতে খুব তৎপর! সমানে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কী বলছে খেয়ালই করছে না। শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। স্বর্ণলতা তার পানির ছেটানো কাজে ব্যাঘাত ঘটাল না। জিজ্ঞেস করল,
” আপনে কোরআন পড়তে পারেন? ”
” পারি। ”
” অর্থ বুঝেন? ”
” বুঝি। ”
” তাইলে তো মুখস্থও থাকার কথা। দুইটা আয়াত পইড়া শুনান তো। যেটার অর্থও কইতে পারবেন। ”
সে একটা সুশীতল শ্রুতিমধুর সুর আরম্ভ করে থেমে গেল আচমকা। ভ্রূ কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেই স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” থামলেন ক্যান? ”
” তোমার তো হুঁশ ফিরে আসছে! এতক্ষণ বলোনি কেন? অযথায় পানি ঢালছিলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বোতলের মুখ আটকাল না। আধ খালি বোতল ও মুখটা বাইরে অন্ধকারে ঢিল মারল। তারপরে জীপ চালু করে গম্ভীরমুখে বলল,
” নিকাব পরে নাও। ”
” আপনে তো আল্লাহরে বিশ্বাস করেন। তাইলে মিথ্যা কইয়া বেড়ান ক্যান? ”
সে এই প্রশ্নের জবাব দিল না। বিনাবাক্য ব্যয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। এক পলকের জন্য পাশে ফিরলও না। দৃষ্টি সর্বদা রাস্তায়, সম্পূর্ণ মনোযোগ গাড়ি চালনায়। স্বর্ণলতা বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করল। পেল না। পুনরায় জিজ্ঞাসাও করল না। নিকাব পরে নিল চুপচাপ। এই নীরবতা বেশি দীর্ঘ হলো না। মুনছুর সাখাওয়াতই ভাঙল,
” স্বর্ণলতা? ”
সে খোলা জানালায় মাথা এলিয়ে রেখেছিল। নির্জন রাস্তা, মৃদু বাতাস, নিশী রাতের অন্ধকার ও জোসনার আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা বেশ উপভোগীয় লাগছিল। কখন যে ঘুমে ঝিমিয়ে পড়ল, টেরই পেল না। স্বামীর ডাকে সশরীরে ছিটকে ওঠল। চকিতে মুখ ফেরাতে শুনল,
” এখন যদি আমি মারা যাই, তুমি কী করবে? ”
তার চেতন সম্পূর্ণভাবে ফিরেনি। ঘুমের ভাব, স্বপ্নের ঘোর লেগেই ছিল। শুধু চোখের পাতা দুটো মেলা। প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না। অবুঝের মতো চেয়ে থেকে বলল,
” বুঝি নাই, কী কইলেন? কে মইরা গেছে? ”
” কেউ মারা যায়নি। ”
” তাইলে? ”
” বলছিলাম, এখন যদি আমি মরে যাই, তুমি কী করবে? আমাদের বাড়িতে থাকবে নাকি চলে যাবে। ”
স্বর্ণলতার মাথায় এবার প্রশ্নটা ঢুকল, ভাবার্থটাও বুঝে আসতে শিউরে ওঠল। বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল। আতঙ্ক ফুটে ওঠল চোখজোড়ায়। পরক্ষণে মিইয়ে গেল সকল অনুভূতি। বিদ্রুপের মতো বলল,
” আপনে কি আযরাইল দেখতে পাইতাছেন? ”
” না তো! ”
” আমি তো শুনছি, মানুষ মরণের সময় আযরাইল দেখতে পাই। তাইলে আপনে দেখতে পাইতাছেন না ক্যান? ”
মুনছুর সাখাওয়াত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ পেল না। সে নিজেই উত্তর পেয়ে গেল যেন! চটপটে জানাল,
” আপনে নিজেই তো একটা আযরাইল! আরেকটা দেখবেন ক্যামনে? ”
” আমি মজা করছি না, স্বর্ণলতা। ”
” আমিও না। ”
” উত্তরটা দাও। ”
” জানি না। আমি কি আপনের মৃত্যুর দিন,তারিখ জাইনা বইয়া রইছি যে, তারপরে কী কী করমু সব এখনই ঠিক কইরা রাখমু? ”
” আমি বলে দিচ্ছি, কী কী করবা। ”
স্বর্ণলতার মধ্যে কোনো কৌতূহল দেখা গেল না। সে ভীষণ অনাগ্রহ ও অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে নিল। রাস্তা ফুরাচ্ছে না, অন্ধকারও দূর হচ্ছে না। হঠাৎ করেই পথটা এত দীর্ঘ লাগল যে, সে বিরক্ত হলো। বাড়ি পৌঁছানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। এই অবস্থায় স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। সে বলছে,
” তুমি কোথাও যাবে না। আমার বাাড়িতেই থাকবে। দাদিজানের সব কথা শুনবে। একটাও ফেলবে না। খবরদার একটাও তর্ক করবে না। ”
সে ফুঁসে ওঠে বলল,
” আমি দাদিজানের লগে তর্ক করি? ”
” এখন করো না। তখন করতেও পার। ঐ সময় তো আমি নেই, ভয়ও নেই। ”
” আপনে কই যাবেন? ”
” কবরে। ”
স্বর্ণলতার রাগটা নিভে গেল। মানুষটা কি সত্যি মরে যাবে? তারও মৃত্যু হবে? এরকম ভাবনা তো মাথায় কখনও আসেনি। জীবনে কিছু মানুষের প্রভাব এতটায় বিস্তীর্ণ থাকে যে মনে হয়, তারা চিরন্তন, চিরজীবী। অমরত্বের অলৌকিক শক্তি পেয়েছে। এদের কাছে মৃত্যু ছায়া আসে না, আসতেই পারে না!
মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” তোমার গয়নার বাক্সে একটা চাবি রেখেছিলাম। পেয়েছিলে? ”
স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিল না। মন ভার হয়ে আসছে তার। অবশতা ঘিরে ধরছে চিন্তা-চেতনাকে। সে কোনোমতে মাথা নেড়ে বুঝাল, পেয়েছে। উত্তর পাওয়া মাত্র কণ্ঠটা আবার বেজে ওঠল,
” আমার ঘরে যে একটা বুকশেলফ আছে? ওটার চাবি। তালা খুললে কতগুলো দলিল পাবে ও কিছু টাকা পাবে। আমি না থাকলে এসবই তোমার হবে। তাই প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করবে। তবুও চাকরি বা অন্যকিছু করতে যাবে না। আমি জানি, তোমার বা দাদিজানের অর্থের লোভ নেই। উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। এতেই তোমাদের জীবন পার হয়ে যাবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের কণ্ঠটা গম্ভীর কিন্তু পরিষ্কার। কোথাও দুঃখ বা আফসোসের রেশ নেই। নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় বলে চলল,
” একটা ব্যাংকের এ্যাকাউন্টও খুলে ছিলাম। টাকা-পয়সা বেশি রাখিনি। সরকারকে হিসেব দিতে হবে। এত ঝামেলায় যায় কে! আমার উপার্জনের বেশির ভাগটায় বাড়িতে রাখতাম। তুমি আসার পরে সরিয়ে ফেলেছি। যেখানে রেখেছি, সেখানে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। গেলেও পাবে না। কড়া পাহারায় আছে। আমি মরে গেলে, যারা পাহারা দিচ্ছে তারায় ভাগবাটোয়ারা করে খাবে। তুমি গেলে উল্টো বিপদে পড়বে। যদি একান্তই অর্থের প্রয়োজন পড়ে তাহলে ব্যাংকে যোগাযোগ করবে। বুকশেলফের ড্রয়ারে এ্যাকাউন্টের কাগজপত্রও রাখা আছে। সরকারি ব্যাংক, চাইলে পাবে। ঠকবে না। ”
স্বর্ণলতা অবশতা কাটিয়ে ওঠল। ঠোঁট নেড়ে বহুকষ্টে কণ্ঠ থেকে শব্দগুলো আওড়াল,
” আপনে কি এখনই মইরা যাবেন? ”
” মনে হচ্ছে। ”
” হঠাৎ এমন মনে হইল ক্যান? ”
” আমি হাতে-পায়ে জোর পাচ্ছি না, স্বর্ণলতা। চোখদুটিও বুঁজে আসছে বার বার। হাজার চেষ্টায়ও খুলে রাখতে পারছি না! ”
সে মুখ বাড়িয়ে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বুঁজে আছে। সেভাবেই গাড়ি চালাচ্ছে। সে সাথে সাথে চেঁচাল,
” আরে, আপনে তো ঘুমাইয়া পড়তাছেন! চোখ মেলেন। এজন্যই কইছিলাম, সকালে আসি! ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ মেলল। জোর করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। স্বর্ণলতার পিল চমকে ওঠল যেন! চোখদুটি এত লাল! শরীরের সবটুকু রক্ত এসে এখানেই জমেছে হয়তো। মুখটা মৃদু কাঁপছে। স্বর্ণলতা চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝল, শুধু মুখ না তার পুরো শরীরটায় কাঁপছে। দেহের প্রতিটি লোমকূপ কাঁটার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ল, তার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে তাপমাত্রা খুঁজছিল সেটা এই মানুষটার হাতের মধ্যে ছিল। জ্বর তার নয়, মুনছুর সাখাওয়াতকে ধরেছে। সেটাও সকাল থেকে। স্বর্ণলতা ঔষধ খাওয়াতে চেয়েছিল, পারেনি। কী ভয়ঙ্কর আচরণই না করেছিল! এরপরে কী হয়েছে জানে না। কিন্তু বিকালবেলায় সুস্থ মানুষের মতো বেরিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া, ঘুম কিছুই হয়নি। তন্মধ্যে রাতের আঁধারে তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। টানা গাড়ি চালিয়েছে, উঠোনে একা দাঁড়িয়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপরে আবারও একাধারে গাড়ি চালাচ্ছে। এত পরিশ্রম তো সুস্থ মানুষের পক্ষেও সামলে উঠা কঠিন। স্বর্ণলতা শঙ্কায় পড়ে গেল। ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। সুধাল,
” আপনের জ্বরটা কি ফেরত আইছে? ”
” কোন জ্বর? ”
তার কণ্ঠটা দুর্বল, কাঁপা কাঁপা। স্বর্ণলতা বুঝতে পেরে বলল,
” গাড়ি থামান। আপনের বিশ্রামের প্রয়োজন। ”
” এখানে? কোথায় আছি জানো? শেয়াল, কুকুর এসে ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। ”
” নিবো না। আমি পাহারা দিমু আপনে একটু ঘুমাইয়া লন। ”
” তুমি আমাকে পাহারা দিবে? একটু আগেও কুকুরের বাচ্চা দেখে ভয়ে কাঁপছিলে। শেয়াল দেখেছ কখনও? ”
স্বর্ণলতা শেয়াল দেখেনি। ডাক শুনেছে। তাতেই গা ছমছম করে ওঠত। সুবর্ণ এই শেয়ালের ভয়ে রাতের বেলায় টয়লেটে যেতে চাইত না। তাকে উঠোনে দাঁড় করিয়ে রেখে রান্নাঘরের পেছনে প্রস্রাব করে আসত।
মুনছুর সাখাওয়াত একটি পানির বোতল বের করল। স্বর্ণলতার কোলে রেখে বলল,
” এমন ঘুম বাপের জন্মেও ধরেনি! আমার চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে দেও তো। এখন আর জীপ থামিয়ে সময় নষ্ট করব না। ”
সে পানির বোতল নিল ঠিকই। কিন্তু মুখটা আলগা করল না। বলল,
” এদিকে আপনের পরিচিত কেউ নাই? ”
” না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বোতলটা ছোঁ মেরে নিল। গাড়ির গতি কমিয়ে ঝটপটে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বলল,
” ঠিক করে বসো। দশ মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব। দোয়া করো যেন সামনে কিছু না আসে। তাহলে কিন্তু উড়িয়ে দিব। ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ে হতবাক গেল। সন্দেহ গলায় সুধাল,
” যদি আমগো উড়াইয়া দেয়? ”
” তাহলে কবরে পৌঁছে যাব। ”
সে গাড়ির গতি সর্বোচ্চ করল।
________
স্বর্ণলতারা যখন বাড়ি ফিরল তখন ভোরের আলো একটু একটু করে উন্মোচন হচ্ছে। একটু পরেই ফজরের আযান পড়বে। দুজনেই সুস্থ ও অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ির উঠোতে উপস্থিত হলো। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সোজা গিয়ে দাঁড়াল দাদিজানের রুমের সামনে। দরজায় ঠকঠক করতে স্বর্ণলতা চাপা স্বরে সাবধান করল,
” উনি ঘুমাইতাছেন তো। একটু পরে এমনেই ওঠব। যা কওয়ার তখন কইয়েন। এখনই কি আপনের ট্যাকা-পয়সার হিসেব বুঝাইতে হইবো? ”
” এক হিসাব দুজনকে বুঝিয়ে সময় নষ্ট করব কেন? দাদিজানকে তোমার হিসেব বুঝাব। ”
দুজনের কথাবার্তার মধ্যে খাইরুন নিসা দরজা মেলে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” দোয়া-দরুদ পড়ে তোমার নাতবউকে ফুঁ দিয়ে দাও তো। ও কে জ্বীনে ধরেছে! ”
তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে উচ্চারণ করলেন,
” জ্বীন! কীভাবে বুঝলি? ”
” মানছুরাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই আমার মতো করে কথা বলছে। জ্বীনটা মনে হয়, আমার মধ্যে আসতে চেয়েছিল। সাহস পায়নি, তাই ওর মধ্যে ঢুকে আমার মতো আচরণ করছে। ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। এই শেষ রাতে দাদিজানকে ডেকে তুলেছে এসব বলার জন্য? সে কি আসলেই মহাজনের মতো কথা বলছিল? একদমই না৷ ঐ কথাগুলো তার মন থেকে এসেছে। নিজের চিন্তা, নিজের বুদ্ধি, নিজের সৃষ্টি। সে কারও অনুকরণ করেনি! সে তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে ওঠল,
” আমারে কিছু ধরে নাই, দাদিজান। উনারে জ্বরে ধরছে। দেখেন সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারতাছে না। ”
খাইরুন নিসা নাতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। চোখ, মুখের অবস্থা ভয়ানক। বেশভূষায়ও আলুথালু অবস্থা! তার প্রিয় ও দীর্ঘ বছরের লালিত গোঁফটাও কেমন খরখরে। দাঁড়িয়ে আছে একপাশে হেলে, দেয়ালে একবাহু ঠেকিয়ে। তিনি এগিয়ে এসে কপালটা ছুঁয়ে আঁতকে ওঠে বললেন,
” শরীর তো পুড়ে যাচ্ছে! ”
তারপরে স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে ধমকে ওঠলেন,
” এই অবস্থায় ঐবাড়ি গেছিলি কেন? পথটা কি কম দূরের? ”
মুনছুর সাখাওয়াতকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না। নাতবউয়ের দিকে চেয়ে বললেন,
” ও কে ধরো। পড়ে যাবে তো! দেখ, হাঁটু কাঁপছে কীভাবে! ”
তিনি রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। পাশের রুমটায় ঢুকতে ঢুকতে আদেশের মতো বললেন,
” মুনছুরকে রুমে নিয়ে যাও। আমি দেখি, জ্বরের ঔষধটা পাই নাকি। ”
স্বর্ণলতা সেই আদেশ পালন করল না। অবাক হয়ে দেখছে, এত বড় শরীরটা দুর্বল হচ্ছে, থেমে থেমে কাঁপছে। তারপরেও মুখের রুক্ষ, চটা ভাবটা পুরোপুরি যায়নি। রক্তচক্ষু জোড়া পূর্বের মতোই শুষ্ক, হিংস্র।
” দাদিজান ধরতে বলল তো! কথা শুনছ না কেন? ”
সে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” শুনমু না। আপনে কইছেন, আপনে না থাকা অবস্থায় সব কথা শুনতে। এখন তো আছেন, তাই দুই একটা কথা শুনমু না। ফালাইয়া দিমু। ”
স্বর্ণলতা তাকে রেখে হাঁটতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত অনুসরণ করতে করতে বলল,
” বাহ! আমার কথা ভালোই মানছ তো। তাহলে আরেকটা শোনো। ”
সে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,
” কী? ”
” তুমি কোনোদিন বিয়ে করবে না। ”
” ক্যান? ”
” আমি মরে গিয়েও তোমার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত নিজের হাতেই দরজার তালা খুলল। পাল্লা মেলে দিয়ে দাঁড়াল সোজা হয়ে। স্বর্ণলতাকে প্রথমে ঢোকার জন্য সুযোগ দিচ্ছিল। সে খেয়াল করল না। জিজ্ঞেস করল,
” একবার মইরা গেলে আবার বাঁচে ক্যামনে? ”
” সময় হলে ঠিক বুঝতে পারবে। এখন ভেতরে যাও। দাদিজান আসছে। দেখে ফেলবে কিন্তু তুমি আমাকে ধরে নিয়ে আসোনি! ”
সে চট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াতও পেছন পেছন ঢুকল। স্বর্ণলতার মতো দাঁড়াল না। বিছানায় গিয়ে বসল ধপাস করে। শুয়ে পড়বে তখনই চিৎকারটা ভেসে এলো,
” শুবি না। মুনছুর, বসে থাক। ”
সে শুয়েই পড়েছিল প্রায়। দাদিজানের চেঁচানো শুনে অজান্তেই সোজা হয়ে বসে পড়েছে। বিরক্ত চোখে তাকাতেই শুনল,
” ঔষধ খেয়ে তারপরে শুবি। তার আগে ভাতটুকু খেয়ে নে। ”
স্বর্ণলতা দেখল, দাদিজানের হাতে ভাতের প্লেট। তরকারি উপরেই ঢালা। তাড়াহুড়ায় ভিন্ন বাটিতে সাজিয়ে আনতে পারেনি হয়তো। খাইরুন নিসা তার দিকে চেয়ে বললেন,
” নেও, ঝটপট খায়িয়ে দাও তো। বসে থাকতে থাকতেই শেষ করো। একবার শুয়ে পড়লে আর তুলতে পারবে না! ”
সে অসহায় গলায় সুধাল,
” আমি খাওয়াই দিমু? উনার হাতে তো কিছু হয় নাই, দাদিজান! ”
” জানি। তারপরেও তুমি খায়িয়ে দিবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখের পলক ভারী হয়ে আসছে। সেই বিস্ময়কর ঘুমটা ফেরত এসেছে। বিছানার স্পর্শ পেয়েও জেগে থাকা যায়? বসেও থাকতে পারছে না! সে প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বলল,
” কী ভাত নিয়ে পড়লে, দাদিজান! আমার কিছু হয়নি। ঘুম ধরছে শুধু। যাও তো এখান থেকে। ”
খাইরুন নিসা নড়লেন না। নাতিকে ঘুমানোর অনুমতিও দিলেন না। চোখের ইশারায় পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন নাতবউয়ের সাথে। এক ফাঁকে ফিসফিসে বললেন,
” সময় নষ্ট করো না। ও ভাতের প্লেট ফেলে দিবে। জ্বরে পড়লে এই ছেলের মাথা ঠিক থাকে না! ”
স্বর্ণলতা এই শেষ কথাটার সাথে সম্মতি প্রকাশ করল। ঘুমিয়ে পড়লে যে উঠবে না এটাও মানতে বাধ্য হলো। আজ সকালেই তো কত করে ডাকল! উঠেনি। উল্টো ভয়ঙ্কর ক্ষ্যাপে গিয়েছিল। হাত ধরে কীসব বলছিল! সে ভাতের প্লেটটা নিল ভীষণ অনিচ্ছায় ও অবহেলায়। নিতান্ত বাধ্য হয়ে ছোট হাতটা দিয়ে ভাত ও তরকারির মিশ্রণ বানাল। অতঃপর মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের সামনে গ্রাস তুলে ধরল। সে সাথে সাথে খেল না। ঠোঁট দুটি ফাঁক করে সামান্য হাঁও করল না। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকল শুধু।
খাইরুন নিসা পাশ থেকে ধমকালেন,
” কী হলো? হাঁ কর। ”
সে এবারও হাঁ করল না। স্বর্ণলতার মুখে চেয়ে থেকে ভাতের প্লেটটা টেনে নিল। দাদিজানের হাত থেকে ট্যাবলেটের পাতাটাও ছিনিয়ে নিল। দুটো ঔষধের টুকরো বের করে ভাতের সাথে মিশিয়ে নিল। তারপরে মুঠোয় মুঠোয় ভাত মুখে দিয়ে গিলতে গিলতে বলল,
” শান্তি পেয়েছ? এবার যাও, আমাকে ঘুমাতে দাও। ”
কথা বলতে বলতে গলায় ভাত ঠেকল। স্বর্ণলতা পানির গ্লাস এগিয়ে ধরল। সে এক ঢোকে পানি খেয়ে কড়া দৃষ্টি রাখল দাদিজানের ওপরে। তিনি এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। দরজার বাইরে পৌঁছাতে মুনছুর সাখাওয়াত ভাতের প্লেট রেখে শুয়ে পড়ল। চোখ বুঁজে নিতে নিতে বলল,
” কারও কথা শুনে নয়, স্বর্ণলতা। যেদিন আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে সেদিনই আমাকে এক প্লেট ভাত মেখে খাওয়াবে। শর্ত তো এটায় ছিল! ”
স্বর্ণলতা তার কাছে এগিয়ে এলো, ফিসফিসে সুধাল,
” দাদিজানের খেতা কই রাখছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত উত্তর দিল না। ভারী ও তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। গভীর ঘুমে অচেতন হচ্ছে। স্বর্ণলতা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল না। দাদিজানের থেকে চেয়ে অন্য একটি কাঁথা এনে ঢেকে দিল অসুস্থ শরীরটা!
_________
স্বর্ণলতা ফজরের নামাজটা দাদিজানের সাথেই পড়ল। নামাজ শেষেও ওঠল না। দাদিজানের কোরআন তেলাওয়াত শুনছিল। চোখ বুঁজে, একাগ্রতার সহিত। সহসা শুনতে পেল,
” পাগলটা তোমাকেও তো জাগিয়ে রেখেছে। সারারাত বাইরে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছে। যাও, তুমিও একটু ঘুমিয়ে নেও। নাহলে মুনছুরের মতো অসুস্থ হয়ে পড়বে। ”
” এখন তো সকাল হইয়া গেছে! ”
” তাতে কী? নাস্তা খাওয়ার সময় হয়নি। দুই-তিন ঘণ্টা ঘুমালেও শরীর আরাম পাবে। যাও, কথা বাড়িও না। ”
স্বর্ণলতা উঠে দাঁড়াতে তিনি পুনরায় বললেন,
” মুনছুরের হাতটা ধরে ঘুমিও। ছেলেটা জ্বরে পড়লে ওর আম্মুকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে। তখন খুব ভয় পায়! হাতটা ধরে থাকলে ভয় পাবে না। ”
সে বিস্মিত হলো যেন! অবাক চোখে চেয়ে রইল দাদিজানের মুখটায়। গতকাল কি তাহলে দুঃস্বপ্ন দেখেই জেগে ওঠেছিল? আম্মুকে নিয়ে কিছু বলেছিল কি? স্বর্ণলতার মনে পড়ছে না। কিন্তু তার আগের দিন রাতে কলে বলেছিল। সে পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল, মিথ্যা নাটক করছে। তাহলে কি মানুষটা সত্যি ভয় পাচ্ছিল? আম্মুকে নিয়ে কারও যে ভয় হতে পারে সে জানতই না!
স্বর্ণলতা ভাবনার মধ্যে স্বামীর রুমে ঢুকল। ঘরে আলো জ্বালানো নেই। ফ্যান, জানালা সব বন্ধ। অসুস্থ অসুস্থ গন্ধটা খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দিল। তারপরে রুদ্ধ করে রাখা শ্বাসটা ছাড়ল। ফ্যানটা ছাড়ল কিন্তু গতি কমিয়ে দিল। অতঃপর আস্তে ধীরে অতি সাবধানে শুয়ে পড়ল মুনছুর সাখাওয়াতের পাশে। সে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। আপাদমস্তক কাঁথা দিয়ে ঢাকা। হাত, পাসহ পুরো শরীরটা যতটা পেরেছে কেঁচোর মতো গুটিয়ে নিয়েছে। এই অবস্থায় হাত ধরবে কীভাবে? সে আলগোছে কাঁধে একটা আঙুল ছুঁয়ে চোখ বুঁজল।
_______
মুনছুর সাখাওয়াতের ঘুম ভাঙল দুপুরের পরে। এবার গোসল করল না, পরিষ্কার হওয়ার কোনো প্রচেষ্টাও দেখা গেল না। ঘুম ঘুম কণ্ঠেই হুঁংকার ছাড়ল,
” স্বর্ণলতা। ”
মিনিটের মধ্যে সে ছুটে এলো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি রাখতে সুধাল,
” তুমি কি আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিলে? ”
স্বর্ণলতা অপ্রতিভ হলো। বেজায় অপ্রস্তুত দেখাল। চোখের চাহনি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। তার ঘুম ভেঙেছে এই আধঘণ্টা আগেই। চোখ মেলে দেখে সে মুনছুর সাখাওয়াতের গলা প্যাঁচিয়ে ধরে আছে। এটা তার পুরোনো অভ্যাস। পাশে কেউ শুয়ে আছে বুঝতে পারলেই হলো, সোজা গলা প্যাঁচিয়ে ধরবে। অন্যকিছু না, শুধু হাতটা বাড়িয়ে গলাটা ধরবে। এই নিয়ে মায়ের থেকে কম বকা খায়নি! তার নাকি নিঃশ্বাস আটকে যায়। ধরেই নিয়েছিলেন, একূ্দিন ঘুমের ঘরে মেয়ের হাতে দম আটকে মরবেন। দাদিজানের পাশে শোয়ার সময় সে খুব সতর্ক থাকত। যতটা পারত দূরত্ব বাড়িয়ে ঘুমাত। তারপরেও এই কাণ্ড ঘটিয়েছে নাকি জানে না। তিনি তো এই নিয়ে কিছু বলেননি।
উত্তর না পেয়ে মুনছুর সাখাওয়াত নিজেই বলল,
” মনে হয় স্বপ্নে দেখেছি। কিন্তু এতবেলা ঘুমালাম কেন? ডাকবে না? ”
সে মুখ তুলে ধীর গলায় বলল,
” ঘুমালেনই তো ভোরবেলা! তাই ডাকিনি। ”
” ভোরবেলা ঘুমিয়েছি? রাতে কী করেছি তাহলে? ”
স্বর্ণলতা চোখটা ঝলকে ওঠল যেন! এই লোকের রাতের কথা মনে নেই? তাহলে তো তার দেওয়া শাস্তিগুলোও ভুলে গেছে। আবার নতুন করে বলতে হবে? সে একপা এগিয়ে এসে সুধাল,
” স্বপ্নে আর কী কী দেখছেন? ”
” তোমাকে নিয়ে কূজনপুরে গেছি। ”
” কার কাছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত ইতস্তত বোধ করছে। স্বর্ণলতা টের পেয়ে বলল,
” কন, চুপ কইরা আছেন ক্যান? কিছু কি লুকাইতে চাইতাছেন? ঐ গ্রামে আপনের বউ থাকে না তো? ”
সে চকিতে চাইল। পরক্ষণে দ্রুততার সাথে বলল,
” থাকত কিন্তু তালাক দিয়েছি তো। ”
” স্বপ্নে? ”
” স্বপ্নে তোমাকে বলেছি কিন্তু তালাক দিয়েছি বাস্তবেই। ”
” আর কী কী দেখলেন? ”
সে ধীরে ধীরে সবই বলল। ঠিকঠাক, সত্যি ঘটনাগুলোই। কিন্তু স্বর্ণলতার দেওয়া দুটো শাস্তির কথা এড়িয়ে গেল। সে চটে গেল মুহূর্তেই! আরও একপা এগিয়ে এসে বলল,
” এগুলা স্বপ্নে না, বাস্তবেই ঘটছে বুঝছেন? আর যেগুলা ইচ্ছা কইরা লুকাইলেন ওগুলাও আমি বাস্তবে, সজ্ঞানে কইছি। আপনে যদি শুনেন ভালো, না শুনলে আরও ভালো। কইতে পারবেন না যে, আপনেরে মাইনা নেওয়ার চেষ্টা করি নাই। ”
স্বর্ণলতা কথাটা শেষ করে ফিরে যেতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত একহাত চেপে ধরে আটকাল। উঠে দাঁড়িয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল,
” তাহলে তো জড়িয়ে ধরাটাও বাস্তবেই ছিল! ”
স্বর্ণলতা সাথে সাথেই বলল,
” হাত ধরলেন ক্যান? আপনে কি চাইতাছেন দরজা মেইলা রাইখাই কাপড় খুইল্যা দাঁড়াইয়া থাকতাম? ”
সে হাত ছেড়ে দিল। ছিটকে দূরে সরে গিয়ে সাবধান করল,
” এই কথাটা আর কখনও বলবে না। ”
” তাইলে আপনে কইয়েব। একজনের তো কওয়া লাগবোই। ”
________
মুনছুর সাখাওয়াত আধশোয়া অবস্থায় দেখল, স্বর্ণলতা রুমে এলো। নিজে থেকে দরজা আটকে চুপচাপ তার পাশে শুয়ে পড়ল। প্রথমে মনে হলো, সজ্ঞানে নেই, ভ্রম হচ্ছে। পরক্ষণে বুঝে গেল, বাস্তব। তার অল্পবয়সী বউটা সত্যি তার পাশে শুয়েছে। সংকোচ বা দ্বিধা কিছুই নেই। সেইরাতের মতো বার বার জামা টেনে ঠিক করছে না। এপাশ-ওপাশও করছে না। শান্ত ও সহজভঙ্গিতে শুয়ে আছে। যেন এই রুমে, এই বিছানায় তার পাশে শুয়ে অভ্যস্ত।
মুনছুর সাখাওয়াত ধীরে ধীরে নিচে নামল। স্ত্রীর দিকে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বুঁজতেই আশা বাড়ল। বার বার মনে হলো, সকালের মতো এখনও তাকে জড়িয়ে ধরবে। সে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু সেই অপেক্ষা ফুরাচ্ছে না। রাত কেটে যাচ্ছে ঠিকই। একসময় অধৈর্য হয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
সে ঘাড় ফিরে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” কাপড় খুইল্যা দাঁড়ামু? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মেজাজ চটে গেল। রাগের ভাবটা চোখে, মুখে ফুটে উঠতেও চেয়েও ওঠল না। যথাসম্ভব সামলে প্রত্যুত্তর করল,
” না। ”
” তাইলে ডাকেন ক্যান? দেখতাছেন না, ঘুমাইতাছি? ”
সে উঠে বসল। ঘন ঘন শ্বাস টানছে ও ফেলছে। আচমকা এত রাগ আসছে কোথা থেকে? নিয়ন্ত্রণই করতে পারছে না যেন! স্বর্ণলতার সামনে সে বরাবরই শান্ত থেকেছে। ধৈর্য ধরেছে। আজকে উল্টো প্রতিক্রিয়া আসছে কেন? মুনছুর সাখাওয়াত বসে থেকে স্ত্রীর দিকে না চেয়েই বলল,
” দাদিজানের রুমে গিয়ে ঘুমাও। ”
সাথে সাথে ঝাঁজাল কণ্ঠটা বাজল,
” ক্যান? আমারে এখন পছন্দ হইতাছে না? না হইলে নাই। আমি এখানেই ঘুমামু। আপনের সমস্যা হইলে, আপনে গিয়া দাদিজানের রুমে ঘুমান। ”
চলবে