#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২)
স্বর্ণলতা চৌকির নিচ থেকে দা’টা বের করল। আঁচল দিয়ে ঢেকে এগিয়ে গেল হারিকেনের কাছে। দরজার দিকে এক পলক চেয়ে আঁচলখানি সরাল। আলোর সংস্পর্শে আসতেই হীরের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠল ধারাল অংশটা। কী তীক্ষ্ণ! শান দেওয়ার পর ব্যবহার করা হয়নি। সে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতে চাইল, তখনই সুবর্ণের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” আফা, ও আফা। দেখ, দুলাভাই কী দিছে। ”
সে শুরুতে ভ য়ে কেঁপে ওঠেছিল। ত্বরিত আঁচল দিয়ে দা’টা ঢেকে ফেলেছিল। ভাইয়ের উজ্জ্বল ও আনন্দিত মুখটা দেখে ভয়টা কাটল। বিস্ময় নিয়ে তাকাল তার হাতের মাঝে। একটি একশ টাকার নোট। নতুন ও চকচকে। সামান্যতম ভাঁজ পড়েনি কোথাও। সে সন্দেহে পতিত হলো। কণ্ঠ খাদে নিয়ে সুধাল,
” ট্যাকা কই পাইলি? ”
” দুলাভাই দিছে, কইলাম না? হের কাছে তো মেলা ট্যাকা! মোটা মোটা বান্ডিল রাইখা পাঞ্জাবির পকেট ফুলাইয়া রাখছে। আমারে ওইখান থেইকা একটা বাইর কইরা দিল। ”
” ট্যাকা দিল ক্যান? তুই খাওন চাস নাই? ”
” চাইছিলাম। কইল, নাই। ট্যাকা দিয়া কইল, দোকান থেইকা কিননা খাইতে। ”
স্বর্ণলতা কীরূপ প্রতিক্রিয়া করবে বুঝতে পারছে না। চুপচাপ তাকিয়ে আছে ভাইয়ের হাতের নোটটির দিকে। সে কী খুশি! বার বার চোখের সামনে ধরছে আর হাসছে। চোখদুটিতে আশ্চর্য রকমের জ্যাতি বের হচ্ছে। সুবর্ণের মুখের ছাঁচ হুবহু বোনের মতো। নাক, চোখ, ঠোঁট সব এক। এমনকি চোখের উপরে মোটা লতার মতো ভ্রযুগলের মাপও একই। শুধু গায়ের রঙটাই মিলল না! স্বর্ণলতা দিনের মতো ফর্সা ও সুবর্ণ রাতের মতো আঁধার।
” এই ট্যাকা দিয়া তো, পুরা দোকান তুইলা আনা যাইব, আফা। কোনডা থুইয়া কোনডা খামু? আফা, তুমি কী খাইবা কও। আমিও ওইডাই খামু৷ ”
” আমি কিছু খামু না, তুইও খাবি না। ”
সুবর্ণের চোখের সেই আশ্চর্য রকমের জ্যোতিটা হারিয়ে গেল। মুখের হাসিটুকুও মিলিয়ে গেল। কালো মুখ আরও কালো করে জিজ্ঞেস করল,
” ক্যান? ”
” এই ট্যাকা মাগনা পাইছস তাই। আর আমরা মাগনা ট্যাকা দিয়া কিছু খাই না। ”
সুবর্ণের ভ্রূযুগল কুঁচকে গেল প্রথমে। পরক্ষণেই তেজে উঠে প্রতিবাদ করল,
” মাগনা হইব ক্যান? আমি তো কাম করছি। তুমি না কইলা, আমি ফিরিতে কাম করি না? ”
স্বর্ণলতা একটুক্ষণ দ্বিধায় জড়িয়ে পড়ল। ভাইয়ের কথাটা একেবারে ফেলা দেওয়া যায় না। সে অবশ্যই কাজ করছে। দুজনের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যমই তো সুবর্ণ। স্বর্ণলতা ভাইয়ের দিকে ঝুঁকল। মিষ্টি হেসে আদুরে স্বরে বলল,
” ঠিক কথা। কাম তো করছস। কিন্তু কামের চেয়েও দাম বেশি হইয়া গেছে। এই ট্যাকা ফেরত দিয়া, দশ টাকা চাইয়া নিবি। ওটাই ঠিক দাম। ”
সুবর্ণের মুখের আঁধার কমল না। হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই মনখারাপে পরিণত হলো। মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও, সামনাসামনি নিতে হচ্ছে। আপুকে সে কত ভালোবাসে! সব কথা শোনে, মানে। মাথা নত করে দরজার দিকে ফিরে যাচ্ছিল ধীর গতিতে সহসা শুনল,
” শুধু ট্যাকাই দিল? আর কিছু দেয় নাই? ”
সুবর্ণ থমকে গেল। হঠাৎ মনে পড়েছে এমন তাড়াহুড়ায় লুঙ্গির গিঁট খুলল। ভাঁজ করা দুটো কাগজ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
” দিছে তো। নেও, এগুলা তোমার। ”
স্বর্ণলতা সেগুলো নিল। ভাঁজ খুলে দেখল, একটা চিঠি ও অন্যটা প্রিন্ট করা কোনো কাগজ। সে প্রথমে চিঠিটাই পড়ল। তাতে লেখা,
‘ তোমার চোখে পনেরো হলেও, আমার চোখে আঠারো। আশা করছি, আইন আমার পক্ষেই কথা বলবে। ‘
লেখাটুকু পড়ে সে আশ্চর্য হলো। তার চোখে পনেরো আরেকজনের চোখে আঠারো হয় কী করে? এই গ্রামের সকলেই জানে, সে পনেরো বছরের কিশোরী। পাশের বাড়ির নিলু আর সে তো একসঙ্গেই জন্মেছে। এক দাইয়ের হাতেই নাড়ি কে টেছে। একজনকে দেখলেই আরেকজনের কথা মনে করে সবাই।
” তুমি কি কিছু দিবা নাকি চইলা যামু? আমার বেজায় খিধা লাগছে, আফা। ট্যাকাডা নিয়াই দোকানে দৌড় দিমু। ”
স্বর্ণলতা ভাইয়ের দিকে না চেয়েই বিরক্ত ও গম্ভীর সুরে বলল,
” আরেকটু খাড়া। দেখতে দে আমারে। ”
সে প্রিন্ট করা কাগজটিতে মনোযোগ দিল এবার। এখানে কলমের কালিতেও লেখা আছে। এই কালি দিয়েই তার নাম, জন্ম তারিখ, জন্ম স্থানসহ আরও অনেক কিছু লেখা। সব তথ্যই তার সম্পর্কে। স্বর্ণলতা আরেকটু মনোযোগি হলো। খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই আবিষ্কার করে ফেলল, এটা তার জন্মসনদ। নতুন করে বানানো। জন্ম তারিখ পরিবর্তন করা। নকল নয় তো? সে খেয়াল করল, নিচে নীল কালির সিল মারা। সাথেই কালো কালি দিয়ে সাইন করা। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল! ভাবছে, এত বড় অন্যায় কাজ কীভাবে করল? এত সহজে বৈ ধ প্রক্রিয়ায় কারও বয়স বাড়ানো যায়? সে তৎক্ষনাৎ আরেকটি কাগজ ছিঁড়ল খাতা থেকে। তাতে লিখল,
‘ জনাব মহাজন,
আঠারো বয়স মানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। সেই অধিকার মা, বাবাও খর্ব করতে পারে না। আমার বিয়ে, আমার মতই প্রধান। অথচ এই বিয়েতে আমার মত আছে কী নেই, কেউ জানতেও চেষ্টা করেনি।
আমি সজ্ঞানে পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছি, এই বিয়েটা আমি করব না। এরপরও যদি কেউ জোর করে, আমি পুলিশ ডাকব। ‘
স্বর্ণলতা কাগজটা ভাঁজ করে ভাইয়ের হাতে দিল। ভেতরে ভেতরে সে কাঁপছে! থানা চিনে না। পুলিশ কীভাবে ডাকতে হয় জানেও না। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এই প্রথম। ঠিকমতো সামলাতে পারবে তো? লোকটাকে ভ য় দেখানোর জন্যই কথাটা বলেছে। স্বর্ণলতার মনে হচ্ছে, লোকটা ক্ষমতাশালী হলেও ভালো কাজ করে না। এই ধরনের মানুষরা পুলিশকে ভ য় পায়। সুবর্ণ কাগজ নিতেই সে সাবধান করল,
” ট্যাকা চাইতে হইব না। কাগজ দিয়াই দৌড় দিয়া চইলা আইবি। তোরে আমি ট্যাকা দিমু। ”
” সত্ত দিবা? ”
” হ, দিমু। ”
এবারে ভাইকে সে দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিল। উঠোনে মানুষজন তেমন নেই। শোরগোল থেমে গিয়েছে। টেবিল ভাঙা। চেয়ার পড়ে আছে এলোমেলোভাবে। প্লেট ও গ্লাস একটাও আস্ত নেই। সব টুকরো টুকরো। এই সবকিছুতেই খাবারের উচ্ছিষ্ট লেগে আছে। যেন কেউ যত্ন করে সকল স্থানে ছিটিয়ে দিয়েছে। সে যত দেখছিল তত ভ য়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল! মা, বাবা কোথাও নেই। পরিচিত কাউকেও দেখা যাচ্ছে না। সেই রুক্ষমূর্তি ও দলবলটাও কি উধাও হয়ে গেল? বিয়েটা কি এমনিতে ভেঙে গিয়েছে? সব ভেঙেচুড়ে চলে যায়নি তো? স্বর্ণলতার ভারি আফসোস হলো। বিয়েটা ভেঙে গেলে তার মতামতের গুরুত্ব নেই। চিঠি পৌঁছানোরও দরকার নেই। সে দুয়ারের চৌকাঠ পেরুল অতি দ্রুত। আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে চেঁচাল,
” বর্ণ? বর্ণ রে? কই গেলি, ভাই। ফেরত আয়। কাগজ নিয়া ফেরত আয়। ”
সে তখনই এলো না। আরও মিনিট পাঁচেক পর বাতাসের বেগে দৌড়ে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” দুলাভাই আইতে দিল না। জোর কইরা এইডা ধরাইয়া দিল। দেখ তো, কী! ”
স্বর্ণলতা ভাইকে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। মহাজন যায়নি, এখনও এই বাড়িতেই আছে। এরমানে বিয়েটা এখনও ভাঙেনি! সে চটজলদি কাগজটা নিল। এটাতে টাকার ছবি আছে উপরের দিকে। কাগজটাও বেশ মোটা ও ভারী। ছোট ছোট অক্ষরের ঠাসাঠাসি। মহাজনের হাতের লেখা নয়, অন্য কারও। সে হারিকেনের আলোর কাছে দৌড়াল। বেশ মনোযোগ দিয়ে সময় নিয়ে পড়ল ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারল না কিছুই। খাঁটি সাধু ভাষা ও কঠিন শব্দের ব্যবহার হয়েছে। সে এসবে পরিচিত নয়। শুধু এইটুকু বুঝল, তাকে নিয়েই এসব কিছু লেখা। মূল বিষয় স্বর্ণলতা। সে বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরল। ভাইয়ের দিকে চেয়ে বিপন্ন সুরে বলল,
” কী আনছস? কিছুই তো বুঝি না। মহাজন মুখে কিছু কয় নাই? ”
” কয়ছে তো। ”
” কী কয়ছে? ”
” কয়ছে, তোমার উপর তোমার অধিকার নাই। ”
” এইডার মানে কী, বর্ণ? আমার উপর আমার অধিকার না থাকলে, কার আছে? ”
সুবর্ণ মাথা চুলকাল। হয়তো মানে খোঁজার চেষ্টা করছে। প্রায় আধ মিনিট পর বলল,
” কাগজ আমারে দেও। আমি একটু পইড়া দেখি। ”
সে কাগজটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। স্বর্ণলতা দূরে সরিয়ে নিল। মুখ ভেংচি কেটে সুর করে বলল,
” ওরে আমার মাস্টারটা! এহনও বানান কইরা রিডিং পড়ে, হেই আইছে এই কঠিন চিডি পড়ত। দূরে সর। আমি আরেকবার পইড়া দেখি। ”
স্বর্ণলতা আরও একবার পড়া শুরু করল। এবার শব্দ ও ভাষা আগের চেয়ে সহজ লাগছে। পড়ার মাঝেই শবনম বেগম ঘরে ঢুকলেন হন্তদন্ত হয়ে। সুবর্ণকে ধ মকে বের করে বললেন,
” আরে, পড়তে বইছস নাকি? কাজী আইতাছে। মাথার ওড়নাডা পর। ঘোমটা দে। ”
বলতে বলতে তিনি মেয়ের সামনে থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিলেন। দুমড়েমুচড়ে ঢিল মেরে রাখলেন তাকের ওপর। স্বর্ণলতার মাথা উঁচু হয়ে গেল। চোখ গিয়ে বিঁধল সেই তাকের ওপরেই। শবনম বেগম মাথার ওপর হাত রেখে চাপ দিয়ে বললেন,
” নিচা হ। মাইয়া মানুষ মাথা উঁচা করলেই বিপদ! পুরুষ মানুষ হিংস্র হইয়া যায়। ”
মাথায় ওড়নাটাও তিনিই পরিয়ে দিলেন। নাকে নথ আটকে দিলেন। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে পুনরায় বললেন,
” আরেকটু ভিতরে গিয়া ব। শান্ত হইয়া থাকবি। যতক্ষণ না কাজী কিছু কইব ততক্ষণ চুপ কইরা থাকবি। একটা কথাও কইবি না, মনে থাকব? ”
স্বর্ণলতা হাঁসফাঁস করছিল। তার মন ঐ তাকের উপরেই পড়ে আছে। কাগজটায় কী লেখা ছিল? পুরোটা পড়তে পারল না। মা কেড়ে নেওয়ার সময় নিচের দিকে চোখ পড়েছিল। দুটো স্বাক্ষর ছিল সেখানে। একটিতে গুটিকয়েক আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ইকবাল হাসান। অন্যটিতে মুনছুর সাখাওয়াত।
কয়েক জোড়া পায়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই ঘরের দিকেই আসছে। শবনম বেগম মেয়ের ঘোমটা টেনে বড় করলেন। অতঃপর একপাশে সরে গেলেন চট করে। তখনই কাজী সাহেবের কণ্ঠ পাওয়া গেল। সালাম দিলেন। স্বর্ণলতা সালামের উত্তর দিল মৃদু স্বরে। ঘোমটার আড়ালে থেকেই দরজার দিকে তাকাল। আবছা, অস্পষ্টভাবে দেখল, তিনটি পুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তিনজনেই পাঞ্জাবি পরা। প্রথমজন একটু এগিয়ে। হাতে খাতা ও মাথায় টুপি। মুখে লম্বা দাড়ি আছে। অন্য দুজন একটু পেছনে। আরও আবছা ও অস্পষ্ট দেখালেও স্বর্ণলতার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তার বার বার মনে হতে লাগল, পেছনের ডানপাশের লোকটি সকলের চেনা মহাজন, সুবর্ণের দুলাভাই। কিছু সময়ের মধ্যে স্বর্ণলতার স্বামীও হয়ে যাবে। তার সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল, কণ্টিকার ন্যায় শক্ত হয়ে গেল সকল লোমকূপ! শ্বাস আটকে আসছে। ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে।
চলবে