মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৬৩+৬৪+৬৫

0
623

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৩)

স্বর্ণলতা দ্বিতীয় কোনো কথা বলল না। বিছানার দিকে হাঁটা ধরল। দুই কদম এগুতেই তার আঁচল টেনে ধরল মুনছুর সাখাওয়াত। সে চমকে পেছন ফিরতেই কাতর কণ্ঠটা বলে ওঠল,
” যেও না। আরেকটু থাকো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বর্ণলতাও তার পাশে দাঁড়াল। বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস, রূপালী আলোতে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে দূরের গাছপালা, পথঘাট, জমিনের নরম ঘাস। আষাঢ়ে পূর্ণিমার এই আদুরে সৌন্দর্যটুকু স্বর্ণলতার চোখে ঠিক ধরা পড়ল না। খানিক্ষণ চেয়ে থেকেই মন ভরে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” তখন থেইক্যা দাঁড়াইয়া আছেন। না ঘুমাইয়া কী এত দেখতাছেন, কন তো। আমি তো কিছুই পাই না! ”
” নিচে তাকিয়ে থাকলে দেখতে পাবে কী করে? উপরে তাকাও। দেখ, চাঁদটাকে আজ অন্যরকম লাগছে। ”

সে চট করে উপরে তাকাল। পূর্ণ চাঁদ! গা ভর্তি জোসনা। ঝকঝকে দেখাচ্ছে রাতের আকাশ। সাদা আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে ছুটোছুটি করা খণ্ড খণ্ড মেঘগুলো। স্বর্ণলতা মুগ্ধ হতে হতেও হলো না। চটপটে দৃঢ় কণ্ঠে জানাল,
” অন্যরকম লাগবো ক্যান? পূর্ণিমা হইলে চাঁদ এরকমই দেখায়। ”
” তাই? ”

তার এই প্রশ্বটা শোনাল ভীষণ হেঁয়ালি, অনাস্থা ধাঁচের। স্বর্ণলতা খানিক দ্বিধায় পড়ল যেন! সে তো বরাবর এমনই দেখে এসেছে। তারপরেও পর্যবেক্ষকের ন্যায় তাকাল। চাঁদের রূপ, সৌন্দর্য আরও গভীরভাবে আঁখিবরণ করছিল, সহসা শুনতে পেল,
” আমি আসলে চাঁদ দেখছিলাম না, কিছু ভাবছিলাম। ”
” কী? ”
” চাঁদ আমাদের চোখের সামনেই থাকে, তারপরেও এর সৌন্দর্য আমরা দূর থেকে উপভোগ করি। কখনই তাকে ছুঁতে পারি না, বুকে আগলে নিতে পারি না। ঠিক তোমার মতো। তাই না, স্বর্ণলতা? ”

সে চমকে ওঠল! বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল স্বামীর পানে। মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টিযুগলও তার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। মুহূর্তেই চোখাচোখি হলো। চাহনি জোড়া একে-অপরের সাথে মিলিত হলো কয়েক সেকেন্ডর জন্য। তারপরেই স্বর্ণলতা চোখ সরিয়ে নিল। বিচলিত দেখাল মুখের ভাব। না চাইতেও বুঝে এলো কত কিছু! ভেতরে ভেতরে এত আশ্চর্য হলো! মানুষটা চাঁদের রূপের সাথে নয়, তার প্রতি তীব্র আক্ষেপের তুলনা করেছে। এরকম করে কেউ কি ভেবেছে কখনও? অল্পক্ষণ নীরব থেকেই আচমকা বলল,
” আমার মতো হইবো ক্যান? চাঁদ কি আমার মতো শাড়ি পরে? কেউ সেই শাড়ির আঁচল চাইপা ধইরা থাকে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করল, স্ত্রীর শাড়ির আঁচলখানি তার হাতের মুঠোতেই আছে। ছাড়েনি এখনও! বিস্মিত দৃষ্টিতে হাত ও আঁচলের দিকে চেয়ে থাকে কতক্ষণ। তারপরেই হাসির রঙটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে ঠোঁট জোড়ায়। স্বর্ণলতা এই উজ্জ্বল রঙ দেখতে পায় না। সে চেয়ে আছে বাইরে, জোসনা গলে পড়া গাছপালার মাথায়। মুনছুর সাখাওয়াত আঁচলটুকু ছাড়ল না। আরও শক্ত করে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,
” আমি যে আমার আম্মুকে ভালোবাসি না, এই কথাটা তোমাকে কে বলেছে? ”
” দাদিজান। ”

তার হাসির রঙটা আরও কয়েক গুণে উজ্জ্বল হলো। স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে, গালে ও চোখ দুটিতে। স্বর্ণলতা এবারও দেখতে পেল না। একমনে চেয়ে আছে জালানার ওপারে, দূরে কোথাও।

মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” আমি যে, আমার আব্বুকে খুব ঘৃণা করতাম এই কথাটা বলেনি? ”

স্বর্ণলতা চকিতে ফিরল। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থেকে জানাল,
” না। ”
” আব্বুকে ঘৃণা করার কারণ কিন্তু ছিল আমার আম্মুই। ”
” ক্যান? উনি কইছিল, ঘিন্না করতে? ”

তার কণ্ঠে প্রবল কৌতূহল, উৎসাহ। মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। ভাবনায় ডুবে গেল বোধ হয়। চোখদুটি ভীষণ আনমনে ও উদাস হয়ে ওঠল। স্বর্ণলতা অসহিষ্ণু হয়ে পুনরায় সুধাল,
” আপনের আম্মায় ঘিন্না করতে কইছিল? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” আম্মু আমার কথা না শোনে, আব্বুর কথা শুনত। এটাই আমার পছন্দ হতো না। ”
” আপনের কথা শুনবো? ক্যান? আপনে তো তখন ছোট। ছোটদের কথা কেউ শুনে? ”
” আম্মুরা শুনে। তারা জানে, সন্তানের কথা না শুনলে তারা খুব অভিমান করে। মায়েরা তো এই অভিমান দেখতে পারে না। তাদের মায়া হয়, কষ্ট হয়। কিন্তু আমার আম্মুর এসব হতো না। আমার মনে হতো, আম্মু আমাকে ভালোবাসে না, তাই আমিও ভালোবাসিনি। ”

স্বর্ণলতা আশ্চর্য হলো খুব। লোকটা এখানেও স্বার্থ দেখছে! মা ও সন্তানের ভালোবাসা হতে হয় নিঃস্বার্থ ধরনের। বিনিময়হীন। একজন ভালোবাসছে না বলে আরেকজন ভালোবাসবে না? জিজ্ঞেস করল,
” আপনের কোন কথা শুনে নাই? ”
” আমি আম্মুকে বলেছিলাম, চাকরি না করতে। শুনেনি। উল্টো একসাথে দুই, তিনটাও করেছে। তারপরেই তো হাতের ঐ বিশ্রী রোগটা হলো! পানিটা পর্যন্ত ধরতে পারে না! আমি বললাম, চিকিৎসা করো। করল না! ”
” উনার কাছে মনে হয় ট্যাকা ছিল না, তাই করতে পারে নাই। ”
” ছিল, স্বর্ণলতা। কিন্তু সব দিয়ে দিত আব্বুকে। আমি মানা করতাম, শুনত না। রাত হলে আব্বু খুব মারত! আমি বলতাম, যেও না। তবুও যেত, তারপরে রাতভর কাঁদত। আম্মুর চোখে ছানি পড়ে গিয়েছিল। চোখে ঠিকমতো দেখত না, তারপরেও টাকার হিসাব করতে চলে যেত ব্যাংকে। কত গোলমাল যে করেছে! মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি। ”
” ইচ্ছে কইরা তো করে নাই, খুব অসহায় হইয়া পড়ছিলেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সুর মেলাল,
” হুম, খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না৷ আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ খোকা, আমার এখন কী করা উচিত? ‘ আমিও সাথে সাথে বলে দিই, ম রে যাও। কীভাবে যে ম রবে, এটাও বুঝতে পারছিল না। শেষে আমিই বললাম, বিষ খাও। ”

স্বর্ণলতা বিস্ফোরণ করল যেন! বলল,
” আপনে বিষ খাইয়া মরতে কইছিলেন? ক্যামনে কইতে পারলেন? আপনের একটুও কষ্ট লাগে নাই? ”
” না। কষ্ট লাগবে কেন? আমি তো আম্মুকে ভালোবাসতাম না। ”
” তাই বইলা মইরা যাইতে কইবেন? আপনের মধ্যে কি আল্লাহ একটুও দয়ামায়া দেয় নাই? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। আঁচলের আরও একটু অংশ গুছিয়ে নিল হাতের মুঠিতে। তারপরে চেয়ে রইল পূর্ণ চাঁদের পানে। স্বর্ণলতা রাগে ফুঁসছে। উত্তর আসছে না দেখে, আরও বেশি রেগে গেল। কিছু একটা বলার জন্য উদ্যত হতেই শুনল,
” তুমি শুধু ম রে যাওয়াটা দেখছ, বেঁচে যাওয়াটা দেখছ না! স্বর্ণলতা, তোমাকে আমি যেটা বুঝাতে চাই, সেটা বুঝো না কেন? ”
” ক্যামনে বাঁচল? মইরা গিয়া আবার বাঁচে ক্যামনে? ”
” বাঁচে। আরও গভীরভাবে চিন্তা করো, তাহলেই বুঝতে পারবে। ”

সে একটু থেমে আবারও বলল,
” আব্বুর পছন্দমত আম্মু চললেও আমি চলিনি। আমি উনার কথা ছোট থেকে মানতাম না, বড় হয়েও মানিনি। এজন্যই এখনও আমি ভালোমতো বেঁচে আছি, ভিন্ন পথে চলছি। ”
” ভিন্ন পথে চইলা কী লাভ, হয়ছেন তো ঐ আপনের আব্বার মতোই। ট্যাকা ছাড়া কিছু বুঝেন না! বউরে পিটান না, কিন্তু তারে ছাড়া সবাইরেই পিটান। ”

স্বর্ণলতা মুখ ঘুরিয়ে নিল। মনে মনে আরও কত কী ভাবল! সহসা সুধাল,
” আপনের আব্বা রে কি আপনি আপনি কইরা কথা কইতেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” এজন্যই কাউরে আপনি আপনি করেন না? নিজের আব্বা রে এত ঘিন্না করতেন?”
” তুমি যতটা ভাবছ, তারচেয়েও কয়েকশো গুণ বেশি ঘুণা করি। ”

স্বর্ণলতা অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে আবারও বলল,
” তাইলে তো আপনের আম্মা রে আরও বেশি ভালোবাসতেন। ”
” ভালোবাসতাম? ”
” হ, এজন্যই কাউরে তুমি তুমি কইরাও কথা কন না। কারও মধ্যে যেমন আব্বা রে দেখতে চান না, তেমন আম্মারেও! ”
” আমি তো তোমাকেও তুমি সম্বোধন করি, স্বর্ণলতা। ”
” হ, আপনে তো আমারেও ভালো…”

কথাটা সম্পূর্ণ করল না। মাঝে থেমে গিয়েও ছাড় পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত চেপে ধরল,
” তোমাকেও কী? বলো। ”

স্বর্ণলতা অস্বস্তি বোধ করছিল। সরে আসার জন্য ছটফট করছিল, কিন্তু পারছিল না। শাড়ির আঁচলটা এখনও তার স্বামীর হাতের মধ্যে আটকে পড়ে আছে। সে ঘন ঘন সেই হাতটায় তাকাচ্ছিল, হঠাৎ বলে ওঠল,
” আপনে তো মানছুরা বুবুরেও তুমি কইরা কইতেন, তাইলে উনারেও ভালোবাসেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে হতাশ হলো। পরক্ষণে চোখ, মুখ কঠোর হয়ে ওঠল। দৃঢ় গলায় বলল,
” না। ”
” তাইলে উনারে তুমি তুমি কইরা কথা কন ক্যান? ”
” কখনও বলিনি। ”
” কইছেন। ”
” অযথা তর্ক করো না। তুমি কি তখন ছিলে? আমার জীবনেই আসোনি। তুমি আসতে আসতে আমি মানছুরাকে তালাক দিয়ে দিয়েছি। ”
” তালাকের পরে কইছেন, আমার কাছে প্রমাণ আছে। আঁচল ছাড়েন, আমি দেখাইতাছি। ”

সে আঁচল ছেড়ে দিল। স্বর্ণলতা ছুটে গিয়ে একটি কাগজ নিয়ে এলো। এটি মুনছুর সাখাওয়াতের লেখা চিঠি। মানছুরা প্রথমে তাকে পড়তে দিয়েছিল, পরে সাথে করে দিয়েও দেয়। স্বর্ণলতা কাগজটি খুলে স্বামীকে দেখাল। সে অবাক হয়ে সুধাল,
” এটা তোমার কাছে কেন? ”
” মানছুরা বুবু দিছে। কইছিল, এইটা পড়লে নাকি আপনের ভালোবাসা বুঝতে পারমু। ভালোবাসা তো ঠিকই বুঝলাম, কিন্তু আমার না। মানছুরা বুবুর। নিজের নামটাও তো কী সুন্দর কইরা লিখছেন! আপনে না কইছিলেন, শুধু দাদিজান আপনের নাম ধইরা কয়? আমারেও কইতে কইছিলেন এখন তো…”

তাকে কথাটা শেষ করতে দিল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। জানালা দিয়ে ফেলে দিতে দিতে বলল,
” ঐ চিঠিটা যখন লিখেছিলাম, তখন আমার মন-প্রাণ জুড়ে শুধু তুমি ছিলে। তাই যা যা লিখেছি সব তোমাকে ভেবেই। যদি ভুল হয়ে থাকে সেটাও তোমাকে ভেবেই। ”

স্বর্ণলতা মুখ বাঁকিয়ে চলে এলো বিছানায়। তার চোখ, মুখের ভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে বিশ্বাস করেনি। মুনছুর সাখাওয়াতও অস্থির চিত্তে এগিয়ে এলো। পাশে বসতে চাইল, স্বর্ণলতা সেই সুযোগ দিল না। ধপাস করে শুয়ে পড়ল। চোখ বুঁজে নিতেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ভুল বুঝাবুঝি শেষ না করে, ঘুমাবে না। স্বর্ণলতা, ওঠো। ”

সে ওঠল না। শুধু একপাশ হতে আরেকপাশ হলো। মুনছুর সাখাওয়াত তার শিয়রের কাছে চলে এলো। বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে আবারও ডাকল। স্বর্ণলতা এবারও ওঠল না। চোখ বুঁজে থাকতে থাকতে আচমকা মনে পড়ল নিলুর কথা, তার করা প্রশ্নগুলোও। সে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, একটাতে আটকে গিয়েছিল। প্রশ্নটা কী যেন ছিল? স্বর্ণলতা চোখ বুঁজে থেকেই স্মরণ করার চেষ্টা করছিল, তন্মধ্যে স্মৃতিতে ধরা দিল হাদিভাই, তারপরে আম্মা ও আব্বা। মুহূর্তেই চোখের পাতা খুলে গেল। স্বামীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনে তো আমারে এক ঘণ্টার সময় দিছিলেন, তাইলে আগেই নিয়া আসলেন ক্যান? আমি তো আম্মার সাথে কথাই কইতে পারি নাই! আব্বার কী জানি হয়ছে, বিছনা থেইক্যা উঠতে পারতাছে না। আম্মায় খাওয়াই দিতাছিল। ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত খেল যেন! অপ্রস্তুত হয়ে ওঠল খুব। চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। স্বর্ণলতার বাবা সুস্থ না, সুস্থ হতেও পারবে না। আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। এর দায় তো একমাত্র তারই। সেই মে রেছিল। স্বর্ণলতা যে এই কথাটা জানত না, খেয়ালই ছিল না! এই মুহূর্তে জানাতেও চায় না। তাই দ্রুত বলল,
” তুমি কি এখনও কথা বলতে চাও? তোমার আম্মাকে ডেকে আনব? ”
” এখন? এই বাড়িতে? ”
” হ্যাঁ, যদি তুমি চাও। ”

সে একটু ভেবে বলল,
” না, থাক। অনেক রাত হইছে। আব্বায় অসুস্থ, তারে একলা রাইখ্যা আসা ঠিকও হইবো না। ”

_______
পরেরদিন ভোরবেলায় স্বর্ণলতা শুনতে পেল, তার মা এসেছে। সে ফজরের নামাজটা শেষ করেই ছুটল মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল,
” আব্বার কী হয়ছে? ”
” পাপে ধরছে। ”

উত্তরটা দিয়েই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। স্বর্ণলতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আম্মার মুখটিতে। প্রায় মিনিটখানেক সময় পরে অধৈর্য গলায় বলল,
” কী হয়ছে, কও না! ”

শবনম বেগম বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলেন না। মেয়ের জোরাজুরিতে বলেই দিলেন, তার বাবা কী কী অন্যায় করেছে। সেই অন্যায়ের জন্য যে, মার খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে এটাও বললেন। কিন্তু সরাসরি মুনছুর সাখাওয়াতের নাম নিলেন না। তারপরেও স্বর্ণলতা সন্দেহ করে বসল। জিজ্ঞেস করল,
” আব্বা রে কি উনি মা রছে? মিথ্যা কইবা না। ”

শবনম বেগম উত্তর দিলেন না। উল্টো খেঁকিয়ে ওঠলেন,
” যেই মারুক, ভুল তো করে নাই। আরও উপকার করছে। আমার মাইয়া, পোলা রে আমার কাছে ফিরাইয়া দিছে। ভিক্ষা যদি করতে হয়, আমি করমু। ওরা করব ক্যান? ”
” তাই বইলা আব্বা রে পঙ্গু কইরা দিবো? তোমরা এখন খাইবা কী? চলবা ক্যামনে? সুবর্ণের পড়ালেখাটা এজন্যই বন্ধ হয়ছিল, তাই না? ”
” ওইটা তোর ভাবতে হইবো না। তুই মন দিয়া সংসার কর। এমনিতেও তোর আব্বায় আমারে ট্যাকাপয়সা দিতো কই? উল্টা আমি যা যোগাড় করতাম তাই কাইড়া নিয়া জুয়া খেলত। বিয়ার সময় আমার বাড়ি থেইক্যা কম গয়না দেয় নাই, নগদ ট্যাকাও দিছিল। সবই তো জুয়ায় ফালাইছে। ”

আব্বার সম্পর্কে এসব সে কখনও শুনেনি। আম্মা বলেনি। তিনি আরও ভালো কথা বলতেন, তাদেরকে কত ভালোবাসেন তাই বুঝাতেন। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সারাক্ষণই চিন্তায় থাকেন, অনেক কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন এমন বলতেন। আজ কী হলো! স্বর্ণলতা শুরুতে বিশ্বাসই করতে পারল না। পরক্ষণে মনে পড়ল, সে এই বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছে তার আব্বার জন্যই। দুই লাখ টাকার কাছেই তো সে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল!

স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” আব্বায় কি শুরু থেইক্যাই এমন ছিল? ”
” হ, বিয়ার আগে থেইক্যাই। ”
” তারপরেও থাকছ? তুমি তো চইলা যাইতে পারতা। ”
” চেষ্টা করছি, পারি নাই। ”
” ক্যান? আব্বায় আটকাই তো? ”
” না। ভালোবাসায় আটকাইতো। বিয়ের দিন থেইক্যাই আমার খুব যত্ন করত, আদর করত। দেখতেও তো সুন্দর আছিল! আমি তারে লগে লগে ভালোবাইসা ফেলাইছিলাম রে, মা! ভালোবাসা মানুষরে দুর্বল কইরা দেয়। আমিও দুর্বল হইয়া গেলাম। তোর বাপে রে কিছু কইতে পারি নাই, ছাইড়াও যাইতে পারি নাই। আমি কষ্ট পাইতাম, কানতাম, কিন্তু তোর আব্বা ফিইরাও চাইত না। পুরুষ মানুষ এমনই বুঝলি, মা? যা পাওয়ার জন্য ওরা জীবনডা পর্যন্ত দিয়া দিতে পারে, তারে পাওয়ার পর সামান্য যত্নও করতে চায় না। ভাঙা জিনিসের মতো অবহেলায় ফেলাইয়া রাখে! ”

এখানে স্বর্ণলতার কী বলা উচিত জানে না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই প্রার্থনা করল, ‘ হে আল্লাহ, উনি যতদিন না তোমার পথে ফিরছে ততদিন উনার জন্য আমার হৃদয়ে একবিন্দুও ভালোবাসা দিও না। ‘

_______
রাতে মুনছুর সাখাওয়াত ফিরবে না। দাদিজানকে খবরটা দিয়েছে ফোনে। সাথে কড়াভাবে বলে দিয়েছে, স্বর্ণলতা যেন তার সাথেই ঘুমায়। সেই আদেশ পালনে দাদিজান ও নাতবউ একসাথে শুয়েছে। খাইরুন নিসা চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ ঘুম আসল না স্বর্ণলতার। এই রুমটা হঠাৎ করেই তার ভীষণ অচেনা ও নতুন লাগছে। বিছানাটাও অন্যরকম আরাম। তার ঠিক ভালো লাগছে না। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে শোয়ার পরেও চোখ বুঁজে থাকতে পারছে না। ভয় হচ্ছে, বার বার মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে দাদিজানের গলা প্যাঁচিয়ে ধরবে। বয়স্ক মানুষ, দুর্বল শরীর। কিছু যদি হয়ে যায়!

স্বর্ণলতা ভয়ে ভয়ে চোখ বুঁজে থাকল। ঠিক তখনই নিলুর প্রশ্নটা ঘণ্টার ন্যায় কানে বাজল, ‘ খুব আদর সোহাগ করে নাকি? ‘ মুহূর্তেই চোখের পাতাগুলো আলগা হয়ে গেল। মনে পড়ল, বেশ কয়েকদিন ধরে তার দানবের মতো স্বামীটা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল। তার ঘুম না আসার পেছনে আসল কারণ এটা না তো! সে কি ঐ শক্তপোক্ত হাতটির অবিরত কোমল স্পর্শটায় অভ্যস্ত হয়ে গেল? তার ঘুমের অবস্থা আরও খারাপ হলো। ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস হতে লাগল। একভাবে একপাশে দুই মিনিটও থাকতে পারছিল না। স্বর্ণলতা বিরক্ত হয়ে উঠে বসল। জানালার পর্দা টেনে বাইরে তাকাবে তখনই দাদিজানের মোবাইল বেজে ওঠল। মোবাইলটা তার শিথানে ছিল। স্বর্ণলতা শুনতে পেয়েই হাত বাড়াল। কলটা ধরেই সুধাল,
” আপনে সত্যি আসবেন না? ”

ওপাশ থেকে বিস্মিত কণ্ঠস্বরটা বেজে ওঠল,
” তুমি এখনও ঘুমাওনি? ”
” না। ”
” কেন? পড়তে বসে গেছ নাকি? স্বর্ণলতা, রাত জেগে পড়াশোনা আমার পছন্দ না। আর কতবার বললে শুনবে? ”
” পড়তে বসি নাই। ”
” তাহলে? কী করছ? ”
” কিছুই না। ”
” এমনি এমনি জেগে আছ? এটা কী ধরনের অভ্যাস? ”

স্বর্ণলতা জবাব দিতে পারল না। চুপ হয়ে গেল। তার যে এতক্ষণ অশান্তি হচ্ছিল, সেটা আচমকায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেল। সে বুঝতে পারামাত্র আশ্চর্যও হলো।

” স্বর্ণলতা? ”
” এমনি এমনি জাগি নাই। আমার ঘুম আইতাছে না। ”
” এখনও ঘুম আসছে না? কয়টা বাজে জানো? তুমি তো আরও আগেই ঘুমিয়ে পড়ো। ”

সে আবারও চুপ হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করল না। বলল,
” দাদিজানকে দাও তো। ”
” ক্যান? ”
” আমি বলে দিচ্ছি, তোমার মাথায় যেন একটু হাত বুলিয়ে দেয়। ”
” লাগবো না। ”
” লাগবে৷ দাদিজানকে মোবাইলটা দাও। ”
” পারমু না। উনি ঘুমাইতাছে। ”
” তাতে কী? তুমি বলো, আমি কথা বলব। ”
” কইলাম তো পারমু না। ”

সে চট করে কলটা কেটে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত আবার কল দিলে, স্বর্ণলতা মোবাইলটায় বন্ধ করে দিল।

_____
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরল ভোরের দিকে। সূয্যিমামার ঘুম ভাঙেনি তখনও। চারপাশে ঠাণ্ডা, ঝড়ো বাতাস। বৃষ্টি নামতে পারে, আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। মাঝেমধ্যেই মেঘ ডাকছে। সে সরাসরি গিয়ে দাঁড়াল দাদিজানের রুমের সামনে। দরজায় মৃদু টোকা দিতেই খাইরুন নিসার গলা পাওয়া গেল। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে দরজাও খুলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকতেই শুনতে পেল,
” তুই তো বলেছিলি, আজকে ফিরবি না। ”
” আজকে না, গতকালে ফিরব না বলেছিলাম। ”

খাইরুন নিসা বিভ্রমে পড়ে গেলেন যেন! আজকে আর গতকালের মধ্যের পার্থক্যটা ঠিক বের করতে পারছিলেন না। এই দোটানা ও সংশয়ের মধ্যে দেখলেন, মুনছুর সাখাওয়াত তার নাতবউকে কোলে তুলে নিচ্ছে। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
” আরে, কী করছিস! মেয়েটা মাত্রই ঘুমাল। ”

সে জবাব দিল না। সোজা নিয়ে এলো তার রুমে, বিছানায়। স্বর্ণলতাকে শুয়িয়ে দিয়েই মুনছুর সাখাওয়াতও তার পাশে শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ নীরবে চেয়ে থেকে আকস্মিক কিশোরী দেহটা একহাতে টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিল সাথে সাথেই। চোখ বুঁজে পরম স্নেহে চুমু খেল স্বর্ণলতার অগোছাল মসৃণ চুলে। তারপরে বলল,
” স্বর্ণলতা, আমাকে ছাড়া তোমার ঘুম আসছে না। এর মানে কী বুঝতে পারছ? ”

ঘুমন্ত দেহটা নড়ল না। সামান্য আওয়াজও করল না। ভীষণ শান্তভাবে চুপচাপ পড়ে আছে মুনছুর সাখাওয়াতের লোমশ, ঘর্মাক্ত বুকটায়। সে একটু অপেক্ষা করে পুনরায় বলল,
” আমি জানি, তুমি ঘুমাওনি। স্বর্ণলতা কথা বলো। তুমি সত্যি মানেটা বুঝতে পারছ না? ”

সাথে সাথে পরিষ্কার, মুক্ত কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” আমি কি কইছি, আপনেরে ছাড়া ঘুম আসতাছে না? আমার তো দাদিজানের পাশে ঘুম আসতাছিল না। এই ঘরে আমি একাও ঘুমাইতে পারি। কতদিন ঘুমাছিও। আপনের জন্যই তো ঐ ঘরে ঘুমাইতে হইলো। ঘর বদল হইলে ঘুমে সমস্যা হয়, বুঝছেন? ”
” হুম, বুঝলাম। আমি যে তোমাকে আমার কথাটা কোনোদিনও বুঝাতে পারব না, এই ব্যাপারে সুনিশ্চিত হলাম৷ ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৪)

স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙল দরজা খোলার শব্দে। সে পিটপিটে চাইতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াতকে। পরিপাটে সাজ, দরজা মেলে বেরুচ্ছে। স্বর্ণলতা হুড়মুড়ে উঠে বসল। ত্বরিত সুধাল,
” কই যান? ”

মুনছুর সাখাওয়াত বেরিয়ে পড়েছে প্রায়। একপা চৌকাঠের বাইরে, অন্যপা ফেলবে। উঁচু হয়েও থেমে গেল। ঝটিতে ফিরল পেছনে। মুহূর্তেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। চুম্বকের মতো তীব্র আকর্ষণ বোধ করছে স্ত্রীর প্রতি। এই অল্প বয়সী কিশোরীর এলোমেলো চুল, ঢিলেঢালা বসার ভঙ্গি, আলস্য চাহনি ও ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বরটা মায়ারাজ্য তৈরি করেছে যেন! যেখানে একবার ঢুকে পড়লে ফেরার পথ খুঁজে পায় না। সে অপলক চেয়ে থেকেই এক শব্দে প্রত্যুত্তর দিল,
” কাজে। ”
” ফিরবেন কোন বেলা? ”
” দুপুরেই ফেরার ইচ্ছে। দেরি হলে সন্ধ্যা হবে। ”

স্বর্ণলতা থেমে গেল। নতুন করে কিছু বলছে না। ভেতরে ভেতরে এত উশখুশ হচ্ছে! স্বামীর দিকে চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল কয়েকবার। মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কিছু লাগবে? ”

সে মাথা নাড়ল। ছড়িয়ে থাকা অগোছাল চুলগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে আড়চোখে দেখছিল। প্রথমবারে ধরা না পড়লেও দ্বিতীয়বারেই ধরা পড়ে গেল। সাথে সাথে ঘাবড়ে গেল। অপ্রতিভ হলো। দ্রুত দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে চুলগুলো খোঁপা করতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত তার সামনে এসে বসল। অতঃপর সুধাল,
” কিছু লাগলে বলো। আমি আসার সময় নিয়ে আসব। ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। সে শাড়িটাও টেনে টেনে ঠিক করতে করতে ভাবল, এক সময় এই মানুষটার উপস্থিতিতে সে প্রচণ্ড বিরক্ত হতো, রাগ হতো। মনে মনে সারাক্ষণই দোয়া করত, লোকটা যেন বাড়ি না ফিরে। আজ সেই মানুষটাকে তার বাইরে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। আবার মানাও করতে পারছে না! এ কেমন যন্ত্রণায় পড়ে গেল? এই মানুষটা বাড়ি থাকলে তার কী? কী করাবে একে দিয়ে? সেরকম কোনো দরকারি কাজও তো মনে পড়ছে না।

” স্বর্ণলতা? ”

সে সম্বিৎ ফিরে পেয়েই আচমকা বলল,
” কিছু লাগবো না। কখন আইবেন জানা থাকলে দাদিজান রে কইতে পারমু। উনি মাঝেমধ্যে জিগায়। ”
” এই কারণে আমাকে আটকালে? আর কিছু না? ”

তার কণ্ঠে অবিশ্বাসের ছায়া, সন্দেহ। ভ্রূজোড়া কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে স্ত্রীর মুখপানে। যেন এখনই আসল উদ্দেশ্যটা বের হয়ে আসবে!

স্বর্ণলতা থতমত খেল। ইতস্তত বোধ করছিল। সহসা বলল,
” আটকাইলাম কই? আমি তো শুধু জিগাইলাম! ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূযুগল সিধা হলেও চোখের আকার স্বাভাবিক হলো না। উল্টো দৃষ্টি জোড়া গাঢ় হলো। অপলক, একটিও কাঁপছে না। মুগ্ধতায় রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। অন্য দিনের তুলনায় স্বর্ণলতা আজ বেশি ঘুমিয়েছে। চোখের কোল, নাকের পা’টা ও ঠোঁট দুটি কিঞ্চিৎ ফোলা দেখাচ্ছে। সম্পূর্ণ মুখটায় চটচটে, গালের উঁচু স্থান ও নাকের চূড়া ভীষণ চকচক করছে। এই সাধারণ ও নৈমিত্তিক রূপটাও তাকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলল। স্বর্ণলতা আবেদনময়ী নারী হিসেবে ধরা দিল। মুনছুর সাখাওয়াত মোহাবিষ্টের ন্যায় হাত বাড়িয়ে তার ঠোঁট স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” কী মুছেন? আমি তো লিপস্টিক দেই নাই। ”

তার দৃষ্টি কাঁপল। মোহভাব ছুটে গেল। ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে মাথা টেনে আনল নিজের দিকে। কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
” আমার মধ্যে যে এত ধৈর্য আছে, তোমাকে বিয়ে না করলে জানতামই না। এরচেয়েও বড় আশ্চর্যের বিষয় কী জানো? আমি এই ধৈর্যটাকে ভীষণ উপভোগ করছি, প্রশান্তি অনুভব করছি। ”

স্বর্ণলতা বিপরীতে কিছু বলতে পারল না। কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখানোর সুযোগ পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত তখনই তড়িঘড়িতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা চুপ করে বসে থাকতে পারল না। কী একটা কৌতূহল, তীব্র টানে স্বামীর পিছু পিছু ছুটতে লাগল। মূল দরজাটায় এসে দাঁড়াতেই দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত উঠোনে নেমে গিয়েছে। জীপটা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে ত্বরিত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ থামল। পেছন ফিরে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখ? ঘরে যাও। ”

সে শুনল ঠিকই। কিন্তু একপাও নড়ল না। মুখের ভাবখানা এমন যে, কিছুই শুনেনি। মুনছুর সাখাওয়াত কয়েক কদম এগিয়ে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” এসব তোমাকে কে শেখাচ্ছে? আমি বের হওয়ার সময় তুমি ঘরে থাকবে। আমার আশেপাশেও যেন দেখতে না পাই। ”
” ক্যান? আমি কি অলক্ষুণে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের জবাব দিল না। অন্যকিছুও বলল না। চেঁচিয়ে ডাকল,
” দাদিজান, তোমার নাতবউকে ঘরে নিয়ে যাও তো। ”

_______
দুপুরে বাড়ির কর্তা ফিরল না। স্বর্ণলতা অপেক্ষা করল, দাদিজানকে একাই খাওয়াল। তারপরে ক্ষুধাটা টের পেল না, খাওয়ার কথাও মনে পড়ল না। বিকেলে দাদিজানের সাথে সময় কাটাচ্ছিল, হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
” আপনে কি উনারে ছুঁইতে মানা করছেন, দাদিজান? ”

খাইরুন নিসা প্রথমে অবাক হলেন। পরক্ষণে দ্বিধায় পড়লেন। স্মৃতিশক্তিতে বেজায় চাপ ফেলেও কিছু উদ্ধার হলো না। পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
” কাকে ছুঁতে মানা করেছি? ”
” আপনের নাতি রে। উনি তো আমারে ছোঁয় না। ”

শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করল, মানা নুয়ে, ক্ষীণ গলায়, বিছানার চাদর খুঁটতে খুঁটতে। খাইরুন নিসা তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। নাতবউয়ের দিকে নীরবে চেয়ে থাকলেন কতক্ষণ। তারপরে বিস্মিত কণ্ঠস্বরটা বাজল,
” মুনছুর তোমাকে এখনও স্পর্শ করেনি? এতদিন ধরে তো একসাথে থাকছ! ”

স্বর্ণলতার কণ্ঠস্বরটা থেমে গেল। সংশয়াপন্ন দেখাল মুখমন্ডল। মুনছুর সাখাওয়াত একেবারেই যে ছোঁয় না, এমন না। ছুঁয়েছে, চুমুও খেয়েছে অনেকবার। কিন্তু নিলু যে আদর-সোহাগের কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা পায়নি এখনও। দাদিজানকে কীভাবে বুঝাবে বুঝতে পারছিল না। লজ্জায় দেহমন আড়ষ্ট হয়ে আসল, কণ্ঠস্বর অবশ হয়ে গেল। তাই চুপ করে মাথা নাড়ল দুইপাশে। খাইরুন নিসা সাথে সাথেই বললেন,
” আমি মানা করতে যাব কেন? আমার মানা শোনার মতো ছেলে ও? তুমি বাঁধা দেওনি তো? ”

স্বর্ণলতা দ্রুত হাত নেড়ে চটপটে বলল,
” না, না। আমি বাঁধা দিতে যামু কোন সাহসে? আপনে না মানা করছেন? উনি আপনের মানা না শুনলেও, আমি তো শুনি। ”
” তাহলে? সমস্যা কী? মুনছুর তো নিজ থেকে দূরে থাকবে না। ওর মধ্যে ঐ ধৈর্যটায় নেই। ”

সে জবাব দিল না। চুপ করে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত তার থেকে দূরে থাকে না। কাছ ঘেষেই থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুমু খায়। ইদানিং তো ঘুমানোর সময় স্বর্ণলতার মাথাটা টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে। কী কী যেন বলেও, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এত ঘুম পায়! সজাগ হলেও চোখ মেলতে পারে না৷ আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে হাজার চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারে না।

খাইরুন নিসা একটু ভেবে পুনরায় বললেন,
” অসুখ করল নাকি! ”
” কই না তো! সুস্থ মানুষের মতো সাইজ্যা গুইজ্যা কাজে গেছে। একটুও শরীর টলে নাই। চোখগুলাও তো লাল দেখলাম না! ”
” এই অসুখে শরীর টলে না রে, নাতবউ। ”
” তাইলে? ”
” বউয়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না। ”

তিনি একটু থেমে আবারও বললেন,
” মানছুরার বেলায় আমার সন্দেহ হয়েছিল। শুনছিলাম, বিয়ের পরে একসাথে থাকার পরেও নাকি শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। এত সুন্দর মেয়ে! যেকোনো ছেলে আকৃষ্ট হবে, অথচ মুনছুর হলো না। তখনই অস্বাভাবিক লেগেছিল। ”

স্বর্ণলতা একমত পোষণ করল,
” হ, আমিও তো তাই শুনলাম। ”
” হুম। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করার পরে তো ওর মধ্যে অন্যরকম লক্ষণ দেখেছিলাম! মনে হয়েছিল, আমার ধারণা ভুল। এখন তো….”

তিনি কথাটা সম্পূর্ণ করলেন না। নিজেই সেচ্ছায় থেমে গেলেন। অতঃপর গম্ভীর স্বরে আদেশের মতো বললেন,
” মুনছুর ফিরলে আমার কাছে পাঠিও। ”

______
মুনছুর সাখাওয়াত সন্ধ্যাবেলায় ফিরল কিন্তু স্বর্ণলতা দাদিজানের কাছে পাঠাল না। এইটুকু সময়ের মধ্যে সে উপলব্ধি করল, দাদিজানের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি। যত মনে পড়ছে, তত লজ্জা পাচ্ছে। সে ভেবেই পাচ্ছে না, হঠাৎ করে দাদিজানকে এই বিষয়টা বলল কেন! তার মাথায় এসব এলো কখন?

রাতে ঘুমানোর সময় স্বর্ণলতা বলল,
” স্কুলের ছুটি শেষ হয় নাই? ক্লাসও শুরু হইয়া গেছে মনে হয়। আপনে তো আমারে স্কুলে নিতাছেন না! কী চাইতাছেন, কন তো। পড়লেখা ছাইড়া দিমু? ”
” না। ”
” তাইলে? বাসায় পরীক্ষা দেই, কিন্তু রেজাল্ট পাই না! এমন পরীক্ষা দিয়া কী লাভ? ”

মুনছুর সাখাওয়াত উঠে বসল। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। ভেতরে ভেতরে ঘাবড়েও গেল খানিকটা। রেজাল্ট শীট সে এনেছে, কিন্তু দেখানোর সাহস পাচ্ছে না। মেয়েটা এত পড়াশোনা করেও দুই বিষয়ে ফেইল করেছে। কীভাবে ঘটল অঘটনটা? এই খবর শুনলে স্বর্ণলতা পুরো দায়টায় তার দিকে ঠেলে দিবে, এই বিষয়ে সে পুরো নিশ্চিত। তাই হেডমাস্টারকে বলে পাশ নাম্বার বসিয়েছে। তারপরেও দেখাচ্ছে না। মেয়েটা যদি কোনোভাবে বুঝে যায়?

মুনছুর সাখাওয়াত গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
” তুমি কাল থেকেই ক্লাস করবে। ”

স্বর্ণলতাও উঠে বসল। আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উচ্চারণ করল,
” সত্যি? আমারে স্কুলে নিয়া যাইবেন? ”
” না। স্কুল তোমার কাছে নিয়া আসব। ”

_____
পরেরদিন দুপুর থেকেই বাড়িতে এক এক করে শিক্ষক আসতে লাগল। প্রত্যেকেই স্বর্ণলতার স্কুলের শিক্ষক। ক্লাস সাজানো হলো উঠোনের কাঁঠাল গাছটার নিচে। শিক্ষার্থীদের জন্যে সারি সারি বেঞ্চ, শিক্ষকদের জন্যে চেয়ার, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড, চক সবকিছুরই ব্যবস্থা করা হলো। স্বর্ণলতা প্রথমে অবাক হলো, পরক্ষণে তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়িতেই আছে, ব্ল্যাকবোর্ডের পাশের একটা চেয়ারে বুক টানটান করে বসে আছে। তার দিকে চাইতেই সে চোখ পাকাল প্রথমে। তারপরে ইশারায় ডাকল নিজের কাছে। মুনছুর সাখাওয়াত সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারল না। বেঞ্চে তার পাশে বসতেই শুনল,
” কী করছেন এগুলা? মানুষরে কষ্ট দিয়া আপনের এত আনন্দ হয় ক্যামনে? ”
” কাকে কষ্ট দিলাম? ”
” স্যারদের দিতাছেন। আমারে একা পড়ানোর জন্য সবাইরে এত দূরে ডাইকা আনছেন? এটা কষ্ট দেওয়া হইল না? ”
” তোমাকে তো দিচ্ছি না! নিজেরটা নিয়ে খুশি থাকো। ”
” পারমু না। এটা কোনো ক্লাস হইল? আমি একা স্টুডেন্ট! এই ক্লাস আমি করমু না। ”
” একা হবে কেন? আমি আছি, সুবর্ণ আছে। ”
” আপনেরা টেনে পড়েন? ”
” পড়লে সমস্যা কী? সেই কোন জনমে টেনে ছিলাম! কী কী পড়েছি মনেও তো নেই। আরেকবার পড়লে সব মনে পড়বে। তোমার ভাইয়েরও তো সমস্যা হওয়ার কথা না। একলাফে চার ক্লাস পেরিয়ে টেনে উঠে গেল! ওর তো খুশি হওয়ার কথা। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চট করে সামনের বেঞ্চের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে আনল। গলা ছেড়ে ডাকল,
” সালা মিয়া? ক্লাস করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে? ”

সে সাথে সাথে মহাআনন্দের সাথে মাথা নাড়তে নাড়তে জবাব দিল,
” না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক স্ত্রীর দিকে চেয়ে পুনরায় বলল,
” ক্লাস শেষে তোর এই লাল গেঞ্জিটা খুলে দিয়ে যাবি। ”

স্বর্ণলতা পাশ থেকে প্রশ্ন করল,
” ক্যান? ”
” পুড়িয়ে দিব। তুমি জানো না, ছেলেদের টকটকে লাল রঙের কাপড় পরা নিষেধ? ”

সে আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” কে নিষেধ করল? ”
” হযরত মুহাম্মদ (স)। ”

স্বর্ণলতা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলে মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” বিশ্বাস না হলে দাদিজানকে জিজ্ঞেস করো। তোমার পছন্দ হলেই তো নবীজির নিষেধাজ্ঞা বদলে যাবে না! ”

সে ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিসফিসে বলল,
” আল্লাহ রে মানে না কিন্তু নবীজির কথা ঠিকই ধইরা আছে। নিজের স্বার্থ পূরণে এই লোক সব করতে পারে! ”

_______
রাতে খাবার খাওয়ার পরে স্বর্ণলতাকে ডেকে পাঠালেন খাইরুন নিসা। সে হেঁটে এসে দরজায় দাঁড়াতেই তিনি বললেন,
” ভেতরে এসে বসো। তোমার সাথে কথা আছে। ”

স্বর্ণলতা নীরবে হেঁটে এলো ভেতরে। বিছানায় বসল আলগোছে। শরীর ছেড়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে রাখল। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। শাড়ির আঁচল একহাতের আঙুলে প্যাঁচাচ্ছে। দাদিজান তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,
” মুনছুরের সাথে আমার কথা হয়েছে। ”

স্বর্ণলতা ঝটিতে দৃষ্টি তুলল। মনে মনে যা ভেবে এত লজ্জা পাচ্ছিল, অস্বস্থিতে কাদা হচ্ছিল, তাই সত্য হয়ে কানে প্রবেশ করল! খাইরুন নিসা আধশোয়া ছিলেন। এবার উঠে বসলেন। হাতের তসবিহটা গলায় পরতে পরতে বললেন,
” তোমার স্বামীকে আমি পেলেপুষে বড় করেছি, তারপরেও বলব, মুনছুরকে আমি পুরোপুরি চিনি না। ওর সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে দুটো কথা বলতে পারব না। কিন্তু মানছুরা! ”

তিনি থামলেন, ভারী ও প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বললেন,
” ওর সম্পর্কে যা বলব, সবই ঠিক ও সত্য। কোনোদিনও বদলাবে না। মেয়েটাকে আমি খুব স্নেহ করি, স্বর্ণলতা। ও কে নিয়ে মন্দ ভাবনা রেখ না। ”
” আমি মন্দ ভাবনা রাখছি? ”
” মুনছুরের কথা শুনে তো তাই মনে হলো। তুমি নাকি ও কে জড়িয়ে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করছ? এসব তো ভালো লক্ষণ না, সম্পর্কে ফাটল ধরে। ”

স্বর্ণলতা কী একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। এত রাগ হলো, বিরক্তও ধরল। সে মানছুরা বুবুকে নিয়ে যা যা বলেছে, সেগুলো মন থেকে না। এমনিই মজা করে বলেছে, মুনছুর সাখাওয়াতকে রাগানোর জন্য। স্বর্ণলতা খেয়াল করেছে, এই এক বিষয়ে মানুষটা ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে! তাকে বুঝানোর জন্য দোষমুক্ত হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে, জানপ্রাণ দিয়ে দিতে চায়। এই বিষয়টা তার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া সে যত যাই বলুক না কেন, দোষী তো তার স্বামীকেই বানিয়েছে। কখনও বলেনি, মানছুরা বুবু ভুল, দোষ করেছে। তারপরেও এই কথাটা দাদিজানকে বলতে পারল? স্ত্রীর নামে মিথ্যা অভিযোগ করাই বুঝি ভালোবাসা?

খাইরুন নিসা পুনরায় বললেন,
” ঐ মেয়েটাকে ভুল বুঝো না। ও তো মুনছুরের বউ থাকা অবস্থায়ও জোর দেখিয়ে অধিকার চায়নি, এখন তো তালাক হয়ে গেছে। এরপরেও তোমাদের মাঝে আসবে? অসম্ভব। অযথায় দুশ্চিন্তা, সন্দেহ ছাড়া কিছুই না। মানছুরার মতো সৎ ও আল্লাহ ভীরু মেয়ে আমি জীবনে দুটো দেখিনি, বুঝলে? আমরা কাবিনের টাকা পাঠিয়েছিলাম, ফেরত দিয়েছে। এক টাকাও রাখেনি। উল্টো যোগাযোগ রাখতেও নিষেধ করেছে। আমাদের ধর্মে একটা নিয়ম আছে, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর অন্য জায়গায় বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত প্রথম স্বামীকেই ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়, মানছুরা এই দায় থেকেও মুক্ত করে দিয়েছে। যে এতকিছু ছেড়ে দিল, সে তোমাদের কাছে কী চাইতে পারে, বলো? ”

স্বর্ণলতার আচমকা মনে পড়ে গেল, সেই রাতটা, মানছুরা বুবুর সাথে কাটানো সময়, কথপোকথন এমনকি তার ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়াটাও। সে দাদিজানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
” উনার তো আম্মা মইরা গেছে, আব্বারও খোঁজ নাই। তাইলে সংসার চলে ক্যামনে? ”
” সেলাইয়ের কাজ করে, ছোটদের আরবি শেখায়। শুনছি, একটা মহিলা মাদরাসায়ও শিক্ষকতা করছে। এটা তো করতেই হবে, ছোট ভাইটাকে পড়াতে চায়। টাকা লাগবে তো! ”
” উনার ভাই কিসে পড়ে, দাদিজান? ”
” এসএসসি দিছে মনে হয়। আমার কাছে এখনকার খোঁজ নাই। গ্রামে তো কলেজ নেই। পড়তে চাইলে শহরে যেতে হবে। অনেক টাকার ব্যাপার! ”
” আপনেরা ঐ ট্যাকা দিলে? ”
” মানছুরা নিবে না। যে নিজের পাওনা খরচ নিল না, সে কি ভাইয়ের জন্য হাত পাতবে? ”

_____

স্বর্ণলতা রুমে ফিরে এসে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত একটা খাতায় কী যেন লিখছে! খাতা ও কলম দুটোই স্বর্ণলতার। সে দরজা আটকাতে আটকাতে প্রশ্ন করল,
” কী লিখেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এত চমকে ওঠল! খাতা বন্ধ করে দূরে ফেলে দিল। স্বর্ণলতা অবাক হয়ে পুনরায় সুধাল,
” এত চমকাইলেন ক্যান? কী করতাছিলেন? আমার নোট নষ্ট কইরা দেন নাই তো? ”

সে দৌড়ে এলো। এখানে তিন, চারটে খাতা। সবগুলোই এলোমেলো হয়ে পড়ে ছিল। স্বর্ণলতা সবগুলো ঘাটতে ঘাটতে অধৈর্য গলায় বলল,
” কোনটা নিছিলেন? কন না ক্যান? ”

মুনছুর সাখাওয়াত বলল না। উল্টো সবগুলো খাতা কেড়ে নিয়ে আরও উলটপালট করল প্রথমে। তারপরে অন্য বইগুলোসহ সবকিছু সরিয়ে দিয়ে বলল,
” অনেক পড়াশুনা হয়েছে, এবার ঘুমাবে। তুমি শোও, আমি আলো নেভাচ্ছি। ”

সে আলো নেভাতে চলে গেল। সুইচে চাপ দেওয়ার পূর্বে একবার তাকাল বিছানায়। স্বর্ণলতা শোয়নি। উল্টো হাত দুটো বুকে বেঁধে চোখ, মুখ শক্ত করে বসে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” কী হলো? ঘুমাবে না? আরও পড়বে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আমার আপনের লগে কথা আছে। ”
” আমি কি কথা বলতে মানা করেছি? শুয়ে পড়ো, আলোটা নিভিয়ে তোমার কাছেই তো আসব। ”

স্বর্ণলতা দ্বিমত করল না। চুপচাপ শুয়ে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত আলো নিভিয়ে পাশে শুতেই সে বলল,
” আমি ক্লাস করমু না, প্রাইভেট পরমু। ”
” কেন? ওরা কি ঠিকমতো পড়াচ্ছে না? ক্লাসে তো তুমি একাই, প্রাইভেটের মতোই। ”
” ওটাই তো। একা পড়লে তো প্রাইভেটের মতো ক্লাস মনে হইবোই। আমি এরকম ক্লাস করমু না। ”
” আচ্ছা, আমি আরও কয়েকজন স্টুডেন্ট এনে দিব। এতেও যদি কম মনে হয়, তাহলে আমাদের বাড়িতে তো মানুষের অভাব নেই। সবাইকে তোমার ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিব। এখন থেকে ওরাও পড়াশুনা করবে। ”

স্বর্ণলতা বিরক্তের চরম পর্যায়ে চলে গেল। এক মুহূর্তের জন্যই কথাই বলতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াতের মতো তারও মনে হলো, সে যা বুঝাতে চাচ্ছে, তার স্বামী তা বুঝতে পারছে না।

” কথা শেষ? সমস্যা মিটমাট হয়ে গেছ তো। এবার ঘুমাই? ”
” হয় নাই। আমি ক্লাস করমু না মানে করমু না। সারা দুনিয়ারে বসাইয়া দিলেও করমু না। ”
” কেন? হঠাৎ করে ক্লাসের উপরে এত অনিহা এলো কেন? ”
” প্রাইভেট পরমু তাই। এক স্যারের কাছে সব বিষয় পরমু। ”
” কোন স্যার? ”
” ইকবাল স্যার। ”
” তোমার আব্বা আবার স্যার হলো কবে? ”
” উফ, আমার আব্বা না। ”
” তাহলে? এই নামে তো তোমার স্কুলে কোন স্যার নেই। ”
” উনি স্কুলের স্যার না। ”
” তাহলে? ”
” মানছুরা বুবুর ভাই। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের কণ্ঠটা থেমে গেল। স্বর্ণলতা তার দিকেই চেয়ে কথা বলছিল। আলো না থাকায় মুখের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারল না। বলে চলল,
” এখন আমারে পড়াইবো, তারপরে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় হইলে আপনে উনারে ধমকাইয়া ভর্তি করাইবেন। মানছুরা বুবুর অনেক ইচ্ছা, উনার ভাইরে পড়াশুনা করাইবো। কিন্তু উনি তো পড়তে চায় না! এই নিয়া বুবুর অনেক কষ্ট। ”
” স্বর্ণলতা, ঘুমাও। ”
” আপনে তো হ, না কিছুই কইলেন না। ”
” বলার মতো কথা এটা? তোমার মাথা থেকে মানছুরার ভূতটা কবে যাবে? ”
” উনারে এই উপকারটা কইরা দিলেই, চইলা যাইবো। ”
” তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে, তারপরেও বলছি, তোমার এই চাওয়াটা রাখতে পারব না। ঐ পরিবারের সাথে সামান্য যোগাযোগটাও রাখতে চাই না আর তুমি চাচ্ছ, ইকবালকে এই বাড়িতে নিয়ে আসি? ”
” হ, উনারে আনতে কইছি, মানছুরা বুবু রে তো আনতে কই নাই। ”
” এই নিয়ে আমি একটা কথাও শুনতে চাই না। চুপ করে ঘুমাবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর কাছ থেকে সামান্য দূরে চলে এলো। স্বর্ণলতা অন্ধকারেও টের পেয়ে বলল,
” আরে রাগ করতাছেন ক্যান? এমনি কি আনতে কইছি? ইকবাল ভাই বিপথে যাইতাছে। মানছুরা বুবু উনারে সামলাইতে পারবো না। আর তো কেউ নাইও সাহায্য করার মতো। দাদিজানের কাছে শুনলাম, আপনের থেইক্যা ট্যাকাপয়সাও নিতে রাজি না। তাই আমি প্রাইভেট পড়মু। আপনে বেতন দিবেন। তারপরে একটু ভয় দেখাইয়া কলেজে ভর্তি করাইবেন। আর কিছু না, এইটুকুই তো। আপনে রে তো সবাই ভ য় পায়। উনিও পাইবো। ”

সে জবাবে নিরুত্তরই থেকে গেল। স্বর্ণলতা চুপ করে অপেক্ষা করল। তারপরে আরও কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। ভাবতে বসল, কীভাবে রাজি করানো যায়। সহসায় মনে পড়ল, মুনছুর সাখাওয়াত একদিন বলেছিল, হাত ধরে বললেই সে তার কথাটা শুনত। এখন কি হাত ধরবে? স্বর্ণলতা হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে আনল। মনে হলো, এটা অনেক বড় চাওয়া। হাত ধরলেও রাজি হবে না। তাহলে কী ধরবে? সে নীরবে আরও কিছুক্ষণ ভাবল। তারপরে আচমকায় মুনছুর সাখাওয়াতের কাছে চেপে এলো। ঘনিষ্ঠ হয়েই বুকে মাথা রাখল প্রথমে, তারপরে একহাতে শরীরের যতটুকু পারল ততটায় প্যাঁচিয়ে ধরে চুপচাপ পড়ে রইল। একটা কথাও বলল না।

মুনছুর সাখাওয়াত শুরুতে কোনো প্রতিক্রিয়ায় দেখাল না। চোখ বুঁজে শক্ত হয়ে ছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ এই নির্বিকার, কঠোর ভাবটা ধরে রাখতে পারল না। তার বউটা নিজ থেকে প্রথমবারের মতো কাছে এসেছে, জড়িয়ে ধরেছে। এরপরেও কি হৃদয়ে কিছু ঘটবে না? শরীরে উষ্ণ কিছু বয়ে চলবে না? সে দুই হাতে তার কিশোরী বধূকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। অতঃপর হালকা ও নরম গলায় ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
” হুম? ”
” এই যে আচমকা কাছে এসে আমাকে দুর্বল করে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে? চালাকি হয়ে যাচ্ছে না? আমাকে বোকা বানিও না! ”
” যে এতকিছু বুইঝা ফালাই, সে আবার বোকা হয় নাকি? আপনে জাইনা-বুইঝা জ্ঞান খরচ কইরা আমার কথাটা রাখতাছেন। ”
” তোমার কথাটা রাখছি, এই কথাটা কিন্তু এখনও বলিনি। ”

স্বর্ণলতা মুখ তুলে তাকাল প্রথমে। তারপরে স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে সরে পড়তে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত হাতের বাঁধন দ্বিগুণ শক্ত করে বলল,
” নিজে থেকেই ধরা দিয়েছ। এখন ধরে রাখব নাকি ছেড়ে দিব সম্পূর্ণটায় আমার ব্যাপার, আমার ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল। জোর দেখানোর অধিকারটাও আমারই। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৫)

স্বর্ণলতা স্বামীর হাতের বাঁধন থেকে ছোটার জন্য খুব চেষ্টা করছে। ধস্তবিধ্বস্ত চলছে মুনছুর সাখাওয়াতের চওড়া, লোমশ উন্মুক্ত বুকের স্পর্শে থেকেই। তার ঐ বলিষ্ঠ হাত ও পেশিবলের কাছে স্বর্ণলতার ছোট্ট কোমল দেহের জেদটা পেরে উঠছে না কিছুতেই। যত আলগা হতে চাচ্ছে ততই যেন সুঁইয়ের মতো গেঁথে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে শরীরের শক্তি, মনের বল। হাঁপিয়ে ওঠল একটুতেই। ঘেমে উঠে নাজেহাল অবস্থা! সে বাধ্য হলো থামতে। ছুটে যাওয়ার প্রচেষ্টা বন্ধ করে বুকটাতে মাথা ফেলল। গভীর নিঃশ্বাস টানল দু’বার। অতঃপর আক্ষেপের মতো উচ্চারণ করল,
” হাত দুইটা লোহা দিয়া বানানো নাকি! ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ঠোঁটে হাসির টান পড়ল। দম্ভের ভাব ফুটে ওঠল সম্পূর্ণ মুখটায়। হাতের বাঁধন ঢিলে করে জবাব দিল,
” না। ”
” তাইলে এত শক্ত ক্যান? ”
” তুমি একটু বেশিই নরম তো, তাই অন্য সবকিছু শক্ত লাগছে। ”

স্বর্ণলতা ঠোঁট বাঁকাল। রাগ ও জেদ মিশে নিঃশ্বাস উত্তপ্ত হয়ে উঠল মুহূর্তে। এত জোরে জোরে টানছে ও ফেলছে যে, মুনছুর সাখাওয়াতের ঘন পশমগুলো ভেদ করে চামড়ায় গিয়ে বাড়ি খাচ্ছে। সে টের পেয়েই ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
” আবার ডাকেন ক্যান? চুপ কইরাই তো আছি। ”
” চুপ করে থাকতে ভালো লাগছে? ”
” হ। ”
” আমার তো ভালো লাগছে না! ”
” তাইলে যা ভালো লাগে তাই করেন। ”

তার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্ত, অবহেলা। মুনছুর সাখাওয়াত বুঝতে পেরেও পাত্তা দিল না। উপেক্ষা করল জোর করেই। তারপরে আচমকা স্বর্ণলতার কোমর চেপে ধরে চরকির মতো ঘুরে গেল। দুজনের অবস্থান বদলে গেল চোখের পলকে। স্বর্ণলতা নিচে, বিছানায়। মুনছুর সাখাওয়াত তার উপরে। ঝুঁকে আছে। মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব, শরীরের ভর নিজের হাঁটুতে রেখে সুধাল,
” তোমাকে একটু দেখি? ”
” আমারে কোনোদিন দেখেন নাই? ”
” এভাবে দেখিনি। ”

উত্তরটা দিয়েই সে নিজের ফোনটা হাতে নিল। টর্চ জ্বেলে স্বর্ণলতার মুখে ফেলতেই সে নড়ে ওঠল। চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে নিল। সম্পূর্ণ মুখটায় কুঁচকে এলো বিরক্তে। জিজ্ঞেস করল,
” আরে কী করতাছেন? চোখের মধ্যে লাইট ধরতাছেন ক্যান? সরান না! ”

মুনছুর সাখাওয়াত আলো সরাল না। আরও কাছে এগিয়ে নিয়ে এলো ফোনটা। স্বর্ণলতা সয়তে পারল না একটুও। ভীষণ অধৈর্য হয়ে ওঠল। চোখ বুঁজা অবস্থায় অন্ধের মতো হাত নেড়ে আলোর উৎসটা খুঁজছিল। মুনছুর সাখাওয়াত সেই হাতের ছোট্ট ছোট্ট আঙুলের ফাঁকে নিজের হাত গলিয়ে দিল প্রথমে। তারপরে টর্চ জ্বালানো অবস্থায় মোবাইলটা পাশে রেখে বলল,
” সরিয়েছি, এবার তাকাও। ”

সে তাকাল। কঠোর দৃষ্টি, রুষ্ট মুখ। অসন্তুষ্টের ছাপটা এত পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ছে যে, মুনছুর সাখাওয়াত নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠিক তখনই শুনল,
” ঘরের আলোতে আমারে দেখা যায় না যে, মোবাইলের আলো দিয়া দেখতে হইবো? ”

এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে কাতর স্বরে অনুরোধের মতো বলল,
” একটু চুপ থাকবে? ”

স্বর্ণলতা সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল,
” ক্যান? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের উত্তরটাও দিল না। স্ত্রীর রাগে, ক্ষোভে শক্ত ও বন্ধ হয়ে থাকা ওষ্ঠাধরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল আগ্রাসির ন্যায়। কাছাকাছি পৌঁছেও স্পর্শ করতে পারল না। পূর্বেই বন্ধ চোখের তারায় ফুটে উঠল স্বর্ণলতার অসন্তুষ্ট ও রুষ্ট মুখ, কঠোর দৃষ্টি জোড়া। সে আশাহত হলো, প্রবল হতাশায় ও আক্ষেপে পড়ে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল শক্তভাবে। পাথরের মতো শক্ত ও নিশ্চল হয়ে আটকে গেল লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে এসেও। স্বামীর গভীর স্পর্শে এসেও মেয়েটা এত নির্লিপ্ত হয় কী করে? স্বর্ণলতা কি সত্যি বুঝতে পারছে না, তার স্বামী কী চাই, কী করার জন্য উন্মাদ হয়ে আছে? মুনছুর সাখাওয়াতের স্পর্শের ধরন, অঙ্গভঙ্গিমা দেখেই তো টের পেয়ে যাওয়ার কথা। পাবে কী করে? স্বর্ণলতার মনোযোগ তার দিকে নয়, ফোনের টর্চের দিকেই তো পড়ে আছে!

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ মেলল ঠিকই কিন্তু স্ত্রীর দিকে তাকাল না। হাতটা ছেড়ে দিতে দিতে ভাবছে, অল্পবয়সী মেয়েটাকে বিয়ে করে ভুল করল কি? হয়তো তার মধ্যে ঐ ধরনের অনুভূতিই তৈরি হয়নি! ভাবনার মধ্যেও সে মাথা ঝাঁকাল। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ তুমি তো অতটাও ছোট না, স্বর্ণলতা। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মতো বয়স ও শরীর তোমার হয়েছে। তারপরেও তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন? আমি তো জোর করেও দূরত্ব কাটিয়ে উঠতে পারছি না! আমি কি তোমার এতই অপছন্দ? ‘
সে স্ত্রীর কাছ থেকে পুরোপুরি সরে এলো। বিছানা থেকে নেমে রুমের আলো জ্বালাল। একটা পাঞ্জাবি শরীরে গলিয়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরতে শুনল,
” কী হইলো? কই যাইতাছেন? ”
” বাইরে। ”
” ক্যান? ”

সে জবাব দিল না। দরজা মেলে বাইরে পা রাখতে পুনরায় শুনল,
” ছাতা লইয়া যান। বাইরে তো বৃষ্টি হইতাছে। ভিজ্যা যাইবেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত থামল। খুব ইচ্ছে হলো যাওয়ার পূর্বে স্ত্রীর মুখখানা দেখতে। সেই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখল নিজ ইচ্ছায়, জোরপূর্বক। পেছন না ফিরেই গম্ভীর কণ্ঠে জানাল,
” লাগবে না। ”

স্বর্ণলতা ছাতা নিয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। স্বামীর মানাটুকু শুনতে ইচ্ছে করছিল না। জোর করে ছাতা ধরিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় হলো। রুম থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত মূল দরজা মেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে আর সামনে এগুতে পারল না। স্বামীর নিষেধাজ্ঞাটা মনে পড়ে গেল। বলেছিল, সে বের হওয়ার সময় যেন স্বর্ণলতা আশপাশে না থাকে।

মুনছুর সাখাওয়াত সেই রাতে বাড়ি ফিরল না। স্বর্ণলতা সারারাত অপেক্ষা করল। একটুও ঘুমাল না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে শুধু একটা কথায় ভাবল, সে এমন কী বলল বা করল যে, তার স্বামী আদর করতে চেয়েও করল না? তার যতটুকু মনে পড়ে, লজ্জায় চোখ বুঁজে ফেলেছিল। লজ্জা পাওয়া কি অন্যায়?

_______
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরল ভোরের দিকে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে। স্বর্ণলতা জেগেই ছিল। দরজাটাও লাগায়নি। সারারাতই খোলা পড়ে ছিল। স্বামীর পদ ভারে ভূমি কাঁপুনিটা টের পেল কয়েক মাস পড়ে। সে চমকে উঠে বসতেই শুনল,
” তোমার প্রাইভেট মাস্টারকে নিয়ে এসেছি। ”

স্বর্ণলতা শুরুতে বুঝল না। অবোধের মতো জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” ইকবালকে নিয়ে এসেছি। ”

সে অত্যাশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” মাঝরাতে বৃষ্টির মইধ্যে উনারে আনতে গেছিলেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। নীরবে চেয়ে থাকল কতক্ষণ তার স্ত্রীর বিস্মিত মুখটায়। অতঃপর বলল,
” ভর্তি হওয়া পর্যন্তই কিন্তু। এরপরে এই আপদসহ তার পরিবারের কেউ যেন তোমার স্মৃতিতেও না থাকে। ”
” থাকবো না। ”

স্বর্ণলতা স্বামীকে গামছা এনে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত গামছা নিতে নিতে সুধাল,
” দাদিজান কিছু বলেছে? ”
” না। ”
” তাহলে মুখটা এমন লাগছে কেন? শেষমেশ জিত তো তোমারই হলো, খুশি হচ্ছ না কেন? ”

স্বর্ণলতা গামছাটা ফিরিয়ে নিল। ভেজা কাঁধটা নিজ হাতে মুছে দিতে দিতে বলল,
” খুশি হওয়ার মতো কিছু ঘটে নাই। ”

মুনছুর সাখাওয়াতকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। গামছাটা কাঁধে ফেলে দিয়ে পুনরায় বলল,
” পুরা ভিজ্যা গেছেন। মুইছা কাজ হইবো না। গোসল দিয়া আসেন। ”

সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তখনই। চপলপায়ে। সোজা হেঁটে গেল দাদিজানের রুমের কাছে। তিনি দরজা খুলেননি তখনও। আযান পড়েছে, ওযু করছে হয়তো। অথবা নামাজ পড়ছে। স্বর্ণলতা বুঝতে পারছিল তার অপেক্ষা করা উচিত। তারপরেও করতে পারল না। অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজায় আঘাত করল। খাইরুন নিসা দরজা খুলে দাঁড়াতেই স্বর্ণলতা বলল,
” দাদিজান, আমার কান্না আইতাছে। ”

তার গলা ধরে এলো। চোখদুটি অশ্রুতে টলমল হয়ে ওঠল। দাদিজান হাত ধরে তাকে ভেতরে আনলেন। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সুধালেন,
” মুনছুর বকছে? ”

স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিতে চেয়েও পারল না। স্বর বের হচ্ছিল না। কাঁপছে খুব, ব্যথা ব্যথাও অনুভব হচ্ছে। সে টলমল দৃষ্টিতে মাথা নাড়ল মন্থরগতিতে। খাইরুন নিসা কপাল কুঁচকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তাহলে কান্না আসছে কেন? ”

স্বর্ণলতা অত্যন্ত ক্ষীণ ও কম্পিত স্বরে জানাল,
” জানি না। উনারে দেখার পর থেইক্যাই কান্না আসতাছে! ”

কথাটা শেষ করা মাত্র তার চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এলো।

_______
মুনছুর সাখাওয়াতের পাশের রুমটায় তার বাবা থাকত। তিনি মারা যাওয়ার পরে রুমটায় তালা লাগানো হয়। ভেতরের জিনিসপত্র কিছুই সরানো হয়নি, গুছানোও হয়নি। যেভাবে পড়ে ছিল, সেভাবেই রেখেছিল এতদিন। আজকে প্রথমবারের মতো রুমের তালা খোলা হলো। ভেতরের সব জিনিসপত্র একে একে বের করা হলো। রুম পরিষ্কার করার পরে নতুন জিনিসপত্র ঢুকল। দুটো চেয়ার, একটি টেবিল, বুকশেলফ ও ছোট্ট বিছানা। সবগুলোই কাঠের, নতুন করে বানানো। স্বর্ণলতার বই-খাতাসহ পড়াশোনার যাবতীয় সামগ্রী এই রুমে সাজিয়ে রাখা হলো। ইকবালের সাথে স্বর্ণলতার দেখাও হলো এখানেই। নতুন চেয়ার ও টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসেছে। স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” আপনে কি নিজ থেইক্যা আইলেন নাকি জোর কইরা টাইন্যা আনছে? ”

ইকবাল নিচের দিকে চেয়ে ছিল। দৃষ্টি তুলল এতক্ষণে। হাতদুটো টেবিলের উপরে রেখে বলল,
” বেঁধে আনছে। ”

স্বর্ণলতা অবাক হয়ে দেখল, তার হাতদুটি এখনও বাঁধা। সে চট করে দ্রুত হস্তে বাঁধন খোলার জন্য উদ্যত হলো। রশির মাথাটা ধরতেও পারল না। পূর্বেই ঝড়ের গতিতে ছুটে এলো মুনসুর সাখাওয়াত। সে বিছানায় বসে দুজনকে দেখছিল ও শুনছিল। সে বাঁধন খুলে দিতে দিতে বলল,
” বেঁধে রেখেছিলাম বলেই এখনও বসে আছে। ”
” পাও বাঁইন্ধা রাখছেন নাকি? ”
” এতকিছু জেনে তোমার কি লাভ? তুমি যা চাচ্ছ, তা পেলেই তো হলো। ”
” জোর কইরা কাউরে দিয়া পড়ানো যায় নাকি? পায়েরটাও খুইল্যা দেন। ”
” আমাকে এখন ওর পাও ধরতে হবে? ”
” অন্য কাউরে ডাক দেন। ”

এই পর্যায়ে ইকবাল কথা বলল,
” কাউকে ডাকতে হবে না। আমি খুলছি। ”

সে খোলা হাতে নিজের পায়ের বাঁধন খুলল। অতঃপর মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে চেয়ে বলল,
” আমি পালাব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ”
” এত দ্রুত মত পাল্টাল কীভাবে? মতলব কী? মনে মনে কী পরিকল্পনা করছিস? ”
” কিছুই না। আমি শুধু আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাই। কতদিন আটকে রাখতে চাচ্ছেন? ”

এই প্রশ্নের উত্তরটা স্বর্ণলতা দিল,
” পাঁচ মাস। ”

ইকবাল আরও একবার তাকাল স্বর্ণলতার দিকে। মুখটা ঢাকা, শুধু চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। এই প্রাণোচ্ছল, নির্মল চোখদুটি আরও একবার দেখেছিল, তাদের বাসায়। মনে হচ্ছিল, জোসনার পবিত্র আলোর সবটায় ঐ চোখদুটিতে পুঞ্জীভূত হয়েছিল! সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে আনল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। তারপরে বলল,
” পাঁচ মাস! এতদিন আপনার এখানে আমি কী করব? ”
” জানি না। তোর রানিসাহেবাকেই জিজ্ঞেস কর। ”

অনুমতি পেয়ে সে আরও একবার তাকাল কিশোরী, কৌতূহলপূর্ণ চেখদুটিতে। প্রশ্ন করতে হলো না, স্বর্ণলতা নিজেই বলল,
” আমারে পড়াইবেন। দাদিজানের কাছে শুনছি, আপনিও কমার্সের স্টুডেন্ট। আমারে এই গ্রুপের সাবজেক্টগুলো পড়ালেই চলবো। হিসাববিজ্ঞানের অংকগুলো মাথায় ঢুকাইতে পারতাছি না। স্কুলের স্যার কী বুঝায়, কিছুই বুঝি নাই। পরীক্ষায় ফেইল করছি। ”

শেষ কথাটায় মুনছুর সাখাওয়াত চমকে ওঠল। এই মেয়ে জানল কী করে যে, ফেইল করেছে? সে তো বলেনি। স্কুলের শিক্ষক বলে দেয়নি তো? তার ভাবনার মধ্যে ইকবালের কণ্ঠটা বাজল,
” কোথায় ভুল হয়েছে? খাতা দেখছেন? ”
” না। উনি তো আনে নাই। রেজাল্টটাও দেখি নাই এখন পর্যন্ত। ”
” তাহলে জানলেন কীভাবে? ”
” পরীক্ষার দেওয়ার সময় আমি পাশ নাম্বারের উত্তরই করতে পারি নাই। তাহলে পামু ক্যামনে? ”

দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। বই-পত্রও ঘাটাঘাটি চলল। মুনছুর সাখাওয়াত টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বিরক্ত ও বিরস মুখে সবই শ্রবণ করছিল, সহসা তার স্ত্রী ইকবালকে স্যার বলে সম্বোধন করতেই সে রেগে গেল। বলল,
” স্যার ডাকছ কেন? এই বাড়িতে সবাই আমাকে স্যার বলে ডাকে না? স্বর্ণলতা, তুমি ইকবালকে স্যার বলে ডাকবে না। আমি কিন্তু সহ্য করব না। ঘাড় ধরে বের করে দিব। ”
” তাইলে কী ডাকমু? ”
” নাম ধইরা ডাকো। ”
” ইকবাল তো আমার আব্বার নাম। নাম ধইরা ডাকি ক্যামনে? ”
” জানি না। যা খুশি ডাকো, কিন্তু স্যার বলতে পারবে না। ব্যস। ”

স্বর্ণলতা একটু ভেবে বলল,
” আমার তো বড় ভাই নাই। উনারে ভাইজান কইয়া ডাকমু নে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের রাগ আরও বেড়ে গেল। কিন্তু প্রকাশ পেল বিস্ময়ের মতো করে। বলল,
” ভাইয়ের সাথে আবার জান লাগাচ্ছ কেন? ”

চলবে