মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৬৬+৬৭

0
460

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৬)

স্বর্ণলতার পড়াশুনা ভালোই চলছে। ইকবাল নিয়মিত দুইবেলা পড়াচ্ছে। এছাড়াও কোথাও আটকে গেলে, বুঝতে অসুবিধা হলে সময়-অসময়ে ছুটে যাচ্ছে। সে ধৈর্য ধরে বুঝিয়েও দিচ্ছে। বিরক্ত দেখায় না কখনও। এই প্রাইভেট নিয়ে কোনো পক্ষেরই অভিযোগ নেই। অভিযোগটা অন্য বিষয়ে, সেটাও স্বর্ণলতার। রাতে মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরলে সে বলল,
” দাদিজানরে এত কষ্ট দিতাছেন ক্যান? ”

সে অবাক হয়ে সুধাল,
” আমি কষ্ট দিচ্ছি? কীভাবে? ”
” এই যে আপনে বাড়ি না থাকলে দাদিজানরে পড়ার ঘরে বসাইয়া রাখেন! উনি বুড়া মানুষ, অসুস্থ। শরীরে গরমও বেশি। এতক্ষণ বোরকা পইরা বইসা থাকতে পারে? ঘুম আইসা পড়ে না? ”

এত পরিষ্কার করে কষ্টের কারণটা উল্লেখ করা সত্ত্বেও মুনছুর সাখাওয়াত বুঝতে পারল না। চোখেই পড়ল না! তার মনোযোগ আটকে গেল অন্যদিকে। বলল,
” দাদিজান বসে বসে ঘুমায়? কবে থেকে? তুমি বলোনি কেন এতদিন? ”

মুহূর্তেই তার চোখ, মুখের অবস্থা অন্যরকম হয়ে গেল। হাতদ্বয়ে মুঠ পাকিয়ে এলো। দাঁড়ানোর ভঙ্গি, চোখের চাহনি, শ্বাস-প্রশ্বাস সবকিছুতেই অস্থিরতা, চঞ্চলতা। ভাবখানা এমন, শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। স্বর্ণলতা বিছানা গুছাচ্ছিল। তাই জবাবটা দিতে দেরি হচ্ছিল। তন্মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত দরজার দিকে হাঁটা ধরল। সে টের পেয়ে দ্রুত সুধাল,
” কই যান? ”
” তুমি শোও, আমি আসছি। ”
” আমার কথা শেষ হয় নাই তো। ”
” এসে শুনছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানের রুমের দরজায় খটখট করতে লাগল। খাইরুন নিসা শুয়ে পড়ে ছিলেন। উঠে দরজা মেলতে খানিক সময় লাগল। এই সময়টুকুও মানতে পারল না। অসহ্য ঠেকল। রাগ বাড়ল, ধৈর্যের বাঁধ সম্পূর্ণটায় ভেঙে গেল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাল সাথে সাথে। দরজার ওপাশে বয়স্ক, মমতাময় মুখটায় চেয়েও মায়া হলো না একটুও। রা গের চোটে মনের মধ্যে যা যা আসল, সবই উগলে দিল। অবিরত, দ্বিধাহীন। যতক্ষণ না হৃদয়টা শান্ত হলো ততক্ষণ বকে চলল। দাদিজানের হাতের তসবিহটা টেনে ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করার পর মুখটা বন্ধ হলো। অতঃপর ঘন ঘন পা ফেলে ফিরে গেল নিজের রুমটায়। দরজা ভেজানো, আলো নেভানো। অন্ধকার ঘন রুমটা নীরব, কারও চলাচলের শব্দ নেই। ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। সে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। পরক্ষণে ভয়ের আলতো স্পর্শ পড়ল বুকজুড়ে। সে দ্রুত দরজা আটকে বিছানায় ওঠল। স্বর্ণলতার কাছ ঘেষে শুয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”

সে সাথে সাথেই সাড়া দিল,
” আমি ঘুমাইলে আপনের এত ডাকা লাগা ক্যান? সারা দুনিয়ার মানুষের ঘুম নষ্ট কইরা মন ভরে না? আমারটাও নষ্ট করতে হয়। ”
” ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি? তোমার তো কথা বলা বাকি ছিল। বলবে না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” যে কথার মাঝে চইলা যায় তারে আমি পরের কথা কই না। ”
” দরকার পড়েছিল, তাই গিয়েছিলাম। কথা শুনব না, এমন বলিনি তো। ”

স্বর্ণলতার রা গ কমার বদলে আরও বাড়ল। আগের চেয়েও দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলল,
” আপনে যদি আর একটা কথা কন, তাইলে আমি ঘুমামু না। সারারাত চোখ মেইল্যা চাইয়া থাকমু। ”

______
সকালবেলা। মুনছুর সাখাওয়াত কাজে বের হবে। জীপে উঠতে নজর পড়ল দূরে, বাড়ির এককোণে। ইকবাল উবু হয়ে কী যেন করছে! সে কৌতূহলী হলো। দৃষ্টি স্থির করতেই দৃশ্যটা বুঝে এলো। ইকবালের সামনে দুটো বিড়াল। বাচ্চা, একই বয়সের। গায়ের রঙও এক রকমের, ধবধবে সাদা। একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। কোনো কারণে ভয় পেয়েছে বোধ হয়। ইকবাল তাদের শরীরে হাত বুলাচ্ছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলছেও! সে দূর হতে শুনতে পাচ্ছে না।

মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থেকে নামল। ইকবালের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
” এই বাড়িতে বিড়াল আনা নিষেধ। জানিস না? ”

সে চমকে ফিরল ঠিকই কিন্তু ভ য় পেল না। উঠে দাঁড়িয়ে চুপ করে থাকল শুধু। মুনছুর সাখাওয়াতই পুনরায় বলল,
” পশুপাখি খুব পছন্দ নাকি? প্রথমবার পাখি দেখলাম, তারপরে কুকুরে বাচ্চা, এখন বিড়াল! ”

ইকবাল দৃষ্টি তুলল। বিরস মুখ বানিয়ে বলল,
” আপনার তো খুব অপছন্দ। তাই মে রে ফেলেন। এগুলোও মে রে ফেলবেন? কবর দেওয়ার অনুমতি পাব তো? ”

সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। ভ্রূদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ল কয়েকটা। খানিক্ষণ চুপ থেকে আপনমনে প্রশ্নটা করল, ‘ সেদিনের কুকুরের বাচ্চাটা সত্যি মারা গেছিল নাকি? স্বর্ণলতার ভয়টা সত্যি হয়ে গেল? ‘ মুহূর্তেই শিউরে ওঠল। মেয়েটা জানতে পারলে কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে কে জানে! মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে হলো, ছেলেটাকে মানা করে দেয়। কথাটা যেন তার স্ত্রীকে না জানায়। কিন্তু বলতে পারল না। আত্মসম্ভ্রমে লাগছিল। মনে হলো, নিষেধটা অনুরোধের মতো শুনাবে। ছেলেটা এমনিতে অন্যরকম। অবাধ্য ধরনের। বুকের মধ্যে তেজ আছে, কিন্তু ঠিকমতো জ্বলে উঠেনি এখনও। সে বিড়ালগুলোর দিকে চেয়ে প্রত্যুত্তর করল,
” না। যেখান থেকে এনেছ সেখানে ফেলে দিয়ে এসো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ফিরে যেতে চেয়েও থামল। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি ইংলিশ কেমন পার? ”
” সব থেকে ভালো। ”
” তাহলে স্বর্ণলতাকে এই সাবজেক্টটায়ও সময় দিও। ও সবচেয়ে কম নম্বর পেয়ে ফেল করেছে ইংলিশেই। ”

ইকবাল জবাবে কিছুই বলল না। নীরবে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মহাজনের দিকে। আচমকা সুধাল,
” একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ”
” কী? ”
” উনি কি আমার আপার থেকেও বেশি সুন্দরী? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি জ্বলে ওঠল মুহূর্তেই। কত বড় স্পর্ধা! তার স্ত্রীর সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে চায়! পেট বরাবর লা থি মারতে পারলে শান্তি পেত। কিন্তু মা রল না, একটু পরেই স্বর্ণলতাকে পড়াবে। যদি টের পেয়ে যায়? সে ঠোঁট কামড়ে রাগটা নিয়ন্ত্রণে আনল। অতঃপর শীতল গলায় দৃঢ়ভাবে বলল,
” স্বর্ণলতার কাছে আমার ভালোবাসা আছে। এবার হিসেব কর, কে বেশি সুন্দরী। ”

______
সন্ধ্যাবেলা। স্বর্ণলতা একমনে পড়ছে। নিজের রুমেই, বিছানার ওপরে। মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ঢুকে বলল,
” বই গুছাও। ”
” ক্যান? ”

সে বিছানায় বসল। পাঞ্জাবির বোতাম দুটো খুলে দিল দ্রুত হস্তে। খুব ঘেমেছে, হাওয়া লাগলে তাড়াতাড়ি শুকাবে। তারপরে জবাবটা দিল,
” আমার কাছে এসে বসো। কথা আছে। ”

স্বর্ণলতা একচুলও নড়ল না। বই-খাতা কিছুই বন্ধ করল না। শুধু ঘাড়টা ফিরিয়ে বলল,
” কাছে বইসা কথা শুনতে হইবো ক্যান? আপনের কি গলা ভাইঙ্গা গেছে? গলা দিয়া কথা বাইর হয় না? ”
” এসো না, স্বর্ণলতা! শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না, প্লিজ। ”

কণ্ঠটা শান্ত, মিনতিপূর্ণ। স্বর্ণলতা প্রত্যাখ্যান করতে পারল না। বই বন্ধ করে এগিয়ে এলো। পা দুটো নিচে নামিয়ে স্বামীর পাশে বসেই তাগাদা দিল,
” তাড়াতাড়ি বলেন। ”
” আমার দিকে তাকাও। ”

স্বর্ণলতা তাকাল। চাহনিতে প্রবল অনীহা, উদাসীনতা। বুঝায় যাচ্ছে, সে বলল বলেই তাকাল। দায়মুক্ত হচ্ছে! মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” শুধু পড়াশোনায় করবে? স্বামীর যত্ন করতে হবে না? ঘেমে-নেয়ে এলাম যে একটু পানিও তো খাওয়ালে না! ”

স্বর্ণলতা বিছানা থেকে নেমে পড়ল। পানি আনার জন্য উদ্যত হতেই মুনছুর সাখাওয়াত আটকাল। হাত ধরে বলল,
” আগে ঘামটা তো মুছে দাও। ”

সে বিনাবাক্যে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিল। তারপরে পানি আনার জন্য যেতে চাইল। এবারও যেতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার কোমর চেপে ধরে টেনে আনল নিজের কাছে। ঊরুতে বসিয়ে বলল,
” একটা জরুরি কাজে ঢাকায় যেতে হবে। দুদিন লাগবে কাজ শেষ হতে। তুমি দাদিজানের সাথে ঘুমিও। আমি বলে দিয়ে যাব, তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। ”

স্বর্ণলতা এখানে কখনও বসেনি। ঘর ভর্তি আলোর মধ্যে সম্পূর্ণ জ্ঞানে স্বামীর এত কাছেও আসেনি। তার ভারি অস্বস্তি হচ্ছিল। লজ্জায় দেহমন অসাড় হয়ে পড়ছে। শ্বাসটা আটকেই যাচ্ছিল, সহসা কথাগুলো কানে প্রবেশ করল। নিমিষেই সকল অনুভূতি হারিয়ে গেল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” দুইদিন বাড়ি ফিরবেন না? ”
” না। ”
” আমার যে পরীক্ষা চলতাছে? ”
” একটা পরীক্ষা বাড়িতে দিবে। পরেরগুলো আবার স্কুলে দিও। আমি নিয়ে যাব। ”

স্বর্ণলতার মুখটা কালো হয়ে গেল। দৃষ্টি সরে গেল অন্যদিকে। চিবুকটাও নেমে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে থুতনিতে হাত রাখল। নিজের দিকে ফিরিয়ে সুধাল,
” ঢাকা থেকে তোমার জন্য কী আনব? ”
” কিছু না। ”
” এটা তো রাগের কথা। বলো না, তোমার কী চাই? ”
” বললাম তো, কিছু লাগবো না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাতটা থুতনি থেকে সরিয়ে গালে রাখল। সম্পূর্ণ মুখটায় চোখ বুলিয়ে বলল,
” এই রাগটা কি বাড়িতে বসে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে সেজন্যে নাকি…”

তাকে পুরো কথাটা শেষ করতে দিল না। পূর্বেই প্রবল অভিমান নিয়ে স্বর্ণলতা বলল,
” আপনে বলছিলেন, এই পরীক্ষাটা স্কুলেই দেওয়াইবেন! ”

তার প্রথমে খারাপ লাগল। অপরাধবোধটা শুরু হতে চেয়েও হলো না। অন্য ভাবনা চলে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত যে দুইদিন বাড়ি আসবে না, এই নিয়ে কোনো দুঃখ নেই, খারাপ লাগা নেই। তার যত চিন্তা, অনুভূতির প্রকাশ সব ঐ পড়ালেখা নিয়ে। এখনও! এত কিছু করার পরেও? স্বর্ণলতার হৃদয়ে সে জায়গা পাবে কি ছায়াও ফেলতে পারেনি!

মুনছুর সাখাওয়াত এই ব্যর্থতা আর বয়ে বেড়াতে পারল না। অপ্রকাশে রাখারও ধৈর্য হলো না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” স্বর্ণলতা, আমাকে তোমার ভালো লাগে না? ”

সে সঙ্গে সঙ্গে নিষ্ঠুরের মতো জবাব দিল,
” না। ”
” একটুও না? ”
” না। ”
” কী করলে ভালো লাগবে?
” জানি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের মনখারাপ হলো। বিষণ্ণ দেখাল চোখজোড়া। স্ত্রীর কোমর থেকে হাতটা সরিয়ে নিতে সে উঠে সরে গেল। দরজার কাছে পৌঁছে আচমকা বলল,
” আমারে বুকে নিয়া যে, মাথায় হাত বুলাইয়া ঘুম পাড়াইয়া দেন? শুধু ঐটাই ভালো লাগে। ”

কথাটা বলে সে চটপটে বেরিয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত পেছন থেকে সমানে ডাকতে লাগল,
” স্বর্ণলতা? স্বর্ণলতা, শুনো। দাঁড়াও বলছি। স্বর্ণলতা! ”

সে শুনল ঠিকই কিন্তু দাঁড়াল না। চপলপায়ে হেঁটে এলো দাদিজানের রুমের কাছে। পেছনে স্বামীর পদধ্বনি টের পেয়ে দ্রুত ঢুকে গেল ভেতরে। খাইরুন নিসা বিছানায় শুয়ে ছিলেন। নাতবউয়ের আচমকা আগমনে একটু অবাকই হলেন। কিছু জিজ্ঞেস করারও সময় পেলেন না। দরজা আড়াল করে দাঁড়াল মুনছুর সাখাওয়াত।

স্বর্ণলতা খেয়াল করে বিছানায় উঠে গেল। দাদিজানের ওপরপাশে বসে বলল,
” দাদিজান? উনি ঢাকায় যাইবো। আপনের কিছু লাগবো নাকি তাই শুনতে আসছে। ”

খাইরুন নিসা আরেক দফা অবাক হলেন। ছেলেটা ঢাকায় একেবারেই যায় না, এরকম না। হাতেগোণা কয়েকবার গিয়েছে। অনেক সময় পরপর, খুব প্রয়োজনে। আজ হঠাৎ যাচ্ছে কেন? প্রশ্নটা মনে উদয় হলেও প্রকাশ করলেন না। শঙ্কা ও দুশ্চিন্তাটুকুও হৃদয়ে বন্দি করে রাখলেন। নাতির সাথে এবার কঠোর রা গ করেছেন। কথাবার্তা বলছেন না অনেকদিন ধরেই। সংকল্প করেছেন, সেধে এসে ক্ষমা না চাইলে রা গটা পড়তে দিবেন না কিছুতেই।

মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানের দিকে তাকালেও কিছু বলল না। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
” ঘরে এসো। ”
” আগে তো শুনেন, দাদিজানের কিছু লাগবো নাকি। ”
” লাগবে না। ”
” দাদিজান বলছে এই কথা? আমি তো শুনলাম না। ”

সে দাদিজানের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,
” দাদিজান, বলছেন? ”

খাইরুন নিসা শক্ত গলায় বললেন,
” ঘরে যাও। স্বামী ডাকলে সাথে সাথে যেতে হয়। বুঝছ? সবকিছুতে এত হেলাফেলা করতে হয় না। ”

স্বর্ণলতা মনখারাপ করে নেমে এলো। স্বামীর পাশ কেটে যাওয়ার সময় ফিসফিসে বলল,
” দাদিজান আপনের সাথে কথা বলে না ক্যান? ঘরে আইসা কারণটা বলবেন নাহয় তারে দিয়া কথা বলাইবেন। ”

______

মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ফিরল পাঁচ মিনিট পরেই। স্বর্ণলতা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কথা বলছে? ”
” হুম। ”
” কী বলছে? ”
” ঢাকা থেকে তসবিহ নিয়ে আসতে বলল। ”

স্বর্ণলতার মুখটা খুশিতে ঝলমল করে ওঠল। চোখের তারাদুটিও উজ্জ্বল। ঠোঁট জোড়ায় মিষ্টি হাসিটা উঁকি দিয়েও হারিয়ে যাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ঠিক করে হাসো। আমি দেখে যাই। তোমাকে তো এখনও হাসতেই দেখলাম না! ”

স্বর্ণলতার উঁকিঝুঁকি মারা হাসিটাও গায়েব হয়ে গেল। অন্যদিকে ফিরে বলল,
” আপনে কি আজকেই যাবেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখন? ”
” একটু পরেই। ”
” কিছু গুছাইয়া দেওয়া লাগবো? ”
” না। আমি কোথাও কিছু নিয়ে যাই না। প্রয়োজন পড়লে কিনে নিই। ”
” তাইলে তো আমার কোনো কাজই নাই। পড়তে বসি? ”

স্বর্ণলতা এই এতক্ষণে স্বামীর দিকে ফিরল। সেটাও ভুলে, বেখেয়ালে। মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে চেয়েই কথা বলছিল। ফিরতেই চোখে চোখ পড়ে গেল। স্বর্ণলতা দৃষ্টি নামিয়ে নিতেই সে বলল,
” তোমার জন্য কী আনব বললে না তো? ”
” বলায় লাগবো? ”
” হুম। বলো। ”
” তাইলে আলতা নিয়া আইসেন। আপনে যে আইনা দিছিলেন? ঐটা আমার হাত লাইগা পইড়া গেছে। ”
” কবে? বলোনি কেন? ”
” যদি রাগ করেন? বকা দেন? এই ভয়ে বলি নাই। ”
” সামান্য আলতার জন্য তোমাকে বকা দিব? তোমার মাথায় এটা আসল কীভাবে? ”
” সামান্য বলতাছেন ক্যান? আপনে তো শখ কইরা আনছিলেন। শখের জিনিস সামান্য হয় না। ”

শেষ কথাটায় কী ছিল, মুনছুর সাখাওয়াত জানে না। কিন্তু হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিল যেন! সেই আগুন নিভানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। সে এগিয়ে এসে বিনা বাঁধায় স্বর্ণলতাকে জড়িয়ে ধরল। দুই হাতের শক্ত বাঁধনে, গভীরভাবে। এই শান্তিটুকু বেশিক্ষণ টিকল না। স্বর্ণলতা অস্ফুটে বলল,
” ব্যথা পাইতাছি তো! ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাতের বাঁধন ঢিলা করে বলল,
” স্বর্ণলতা, আমার সাথে যাবে? ”
” কই? ”
” ঢাকা। ”

সে চমকে মুখ তুলল। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে দেখল, সে চোখ বুঁজে আছে। দ্বিধা নিয়ে বলল,
” ক্যামনে যামু? আমার তো কালকে পরীক্ষা! ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ মেলল। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল,
” বাসায়ই তো দিবে। পরে দিও? ”
” এই পরীক্ষার পরেই আমার বোর্ড পরীক্ষা। প্রস্তুতি নিতে হইবো। এই পরীক্ষা শেষ হলেই তো বুঝতে পারমু, আমি কতটা প্রস্তুত। সেই অনুযায়ী পড়াশুনা করতে হইবো। এখন এটায় যদি দেরি হয়, তাইলে বোর্ডের জন্য প্রস্তুতি নিমু কখন? ”

আবারও পড়াশুনা! এই পড়াশোনা কি তার প্রতিদ্বন্দ্বী? বার বার হেরে যাচ্ছে এর কাছেই। স্বর্ণলতা কি তার কথা ভাববে না? তার অনুভূতির দাম দিবে না? হুট করে যে, বউটাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে এই নিয়ে কি মুনছুর সাখাওয়াতের ঝামেলা হবে না? কোথায় থাকবে, কীভাবে রাখবে কিছু ভেবেছে? তারপরেও তো নিয়ে যেতে চাচ্ছে! স্বর্ণলতার মতো কি অযুহাত বানিয়েছে? তার ভারী অভিমান হলো। এমন প্রগাঢ় অভিমান এর আগে কখনও হয়নি।

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে ছেড়ে দিল। বিছানার উপরে এলেমেলোভাবে পড়ে থাকা বইগুলো আরও এলোমেলো করে দিল। গোসল করে, নতুন পাঞ্জাবি পরে প্রস্তুত হওয়ার চিন্তাটাও বাদ দিয়ে তখনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

_______
স্বর্ণলতার আগামীকাল গণিত পরীক্ষা। সে একমনে অংক কষছিল। সহসা রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, মুনছুর সাখাওয়াত। ক্লান্ত মুখ, ঘর্মাক্ত শরীর, হাতভর্তি শপিংব্যাগ। সেগুলো বিছানায় ঢিল মেরে বলল,
” আমাকে কল দাওনি কেন? ”
” কল দিতে বলছিলেন? ”
” না বললে দিবে না? ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। সে অংক কষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পানির মতো সহজ অংকটায় সে মিলাতে পারল না। তিনবার কাটল। নতুন করে আবার শুরু করতেই শুনল,
” এটা পরে আসো। যাও। ”

সে মুখ তুলল না। হাত বাড়িয়ে ব্যাগটাও নিল না। চুপচাপ অংকে ভুল করে চলেছে। মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খাতাটা কেড়ে নিয়ে বলল,
” কথা শুনবে না? ”

স্বর্ণলতা ধপ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভীষণ অনিচ্ছায় ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে তাকাল। শাড়ি! সবুজ রঙের, সিল্ক কাপড়ের। সাথে দুই মুঠো চুড়ি ও একটা আলতার কৌটো। সে প্রথমে আলতাটায় বের করল। সাথে সাথে ভুলে গেল, এই লোকটা কল করে দাদিজানের সাথে কথা বলেছে ঠিকই। কিন্তু তাকে চায়নি, কথাও বলেনি। অথচ সে আগ্রহ নিয়ে দাদিজানের পাশেই বসে ছিল!

” পছন্দ হয়নি? ”

স্বর্ণলতা এবার শাড়িটা বের করল। মেলে দেখতে দেখতে বলল,
” এখনই পরতে হইবো? ”
” হ্যাঁ। আমার ভালো লাগবে। ”
” কিন্তু আমার যে পড়া বাকি? কালকেই অংক পরীক্ষা। একটা অংক কিছুতেই মেলাতে পারতাছি না! ইকবাল ভাই বলছে, ওটা আসতে পারে। উনিও তো বাড়ি নাই। আপনে ঢাকায় যাওয়ার পরে একদিনও পড়াতে আসে নাই। ”
” আমি মিলিয়ে দিচ্ছি। ”
” আপনে পারবেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ক্লান্ত ও শ্রান্ত শরীরেই স্ত্রীর খাতাটা টেনে নিল। তারপরে ঠাঁট বজায় রেখে বলল,
” তোমার স্বামী খুব বেশি পড়েনি কিন্তু মূর্খও না। কলেজ টপকেছে। ”
” তাইলে আপনে মিলান। আমি শাড়িটা পইরা আসি। ”

তার কণ্ঠ ঝরঝরে, উচ্ছাসে ভরপুর। চোখ, মুখে দারুন উৎসাহ ও আনন্দের ঝিলিক। এত দ্রুত মেয়েটা সব ভুলে খুশি হয়ে যাবে মুনছুর সাখাওয়াত ভাবতে পারেনি।

স্বর্ণলতা শাড়ি পরতে চলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত অংক মিলিয়ে ফেলল দুই মিনিটে। তারপরে বই-খাতা বন্ধ করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল স্ত্রীর বেরিয়ে আসার। কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলে গেল। স্বর্ণলতা বের হলো না। মাথাটা কিঞ্চিৎ বের করে ডাকল,
” শুনছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত দ্রুত জবাব দিল,
” হ্যাঁ, বলো না! ”
” এটা কী শাড়ি আনছেন? আমি তো পইরা শেষ করতে পারতাছি না। খুইলা যাইতাছে বার বার। ”
” খুলে যাবে কেন? ছেঁড়া নাকি? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আমি কী জানি? আপনে শাড়ি আনছেন। আপনে জানেন। ”
” আমি তো জানি না। ”
” তাইলে খুইল্যা ফেললাম! ”

সে স্বর্ণলতার কাছে এগিয়ে এলো। শশব্যস্তে বলল,
” এই না। একটু যত্ন করে পরো। খুলবে না। ”

দরজাটা লেগে গেল। আরও কিছুক্ষণ পরে স্বর্ণলতা উঁকি মেরে বলল,
” যত্ন কইরাও হইতাছে না! আমি কোনোভাবেই আটকাইতে পারতাছি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কী বলবে বুঝতে পারছে না। শাড়ি খুলে যাওয়ার পেছনে রহস্য কী হতে পারে? কাপড়? সে এবার সুতির কাপড়ের শাড়ি আনেনি। তার ভাবনার মধ্যে স্বর্ণলতা বলল,
” সিপটিপিন দিয়া আটকানো যাইবো। ”
” কোথায় রেখেছ, বলো। আমি দিচ্ছি। ”
” আমার কাছে নাই। ময়নাবুর কাছে থাকতে পারে। নিয়া আসেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত অবাক হয়ে সুধাল,
” আমি ময়নার কাছে সেইফটি পিন চাইতে যাব? আমি? ”
” তাইলে কি আমি যামু? ”
” তার চেয়ে ভালো তোমার শাড়ি পরতে হবে না। বের হয়ে আসো। আমি কালকে সেইফটি পিন এনে দিব। পরে পরো। ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। দরজা আটকে দিতে চেয়েও দিল না। আবারও উঁকি দিয়ে বলল,
” দাদিজানের কাছে সুঁই-সুতা আছে মনে হয়। নিয়া আসেন। নাকি এটাও পারবেন না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো সুঁই-সুতো এনে দিল। স্বর্ণলতা আবারও দরজা আটকে দিল। এবার দরজা খুলল অনেক সময় পরে। উঁকি দিল না। সশরীরে বেরিয়ে এলো। সে শাড়িটা পরেছে। খুব সুন্দর করে, যত্ন নিয়ে। মুনছুর সাখাওয়াতের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কেমন লাগতাছে? ”
” অন্যরকম। ”
” অন্যরকম আবার কী? খারাপ লাগতাছে? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” তুমি যে বড় হচ্ছ, সেটা বুঝা যাচ্ছে। ”
” কী বলেন, কিছুই বুঝি না! ”
” মাথা থেকে পড়ার চিন্তা বাদ দেও, তাহলেই বুঝবে। ততক্ষণে আমি গোসল করে আসি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করে এসে দেখল, স্বর্ণলতা পটের বিবি হয়ে বসে আছে। বিছানায় বই-খাতা কিছু নেই। সে জিজ্ঞেস করল,
” পড়া শেষ? ”
” না। ঘুইরা আইসা পরমু। ”
” ঘুরে এসে পড়বে মানে? কে ঘুরতে নিয়ে যাবে। ”
” আপনে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগই পেল না। স্বর্ণলতা বিছানা থেকে নেমে বলল,
” ঘুরতে নিয়া যাইবেন না? তাইলে সাজাইলেন ক্যান? ”
” আমার দেখতে ইচ্ছে…”

সে কথাটা শেষ করতে পারল না। স্বর্ণলতা গোসলখানায় ঢুকে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নতুন শাড়ি খুলে, পুরানটা কোনোমতে প্যাঁচিয়ে বেরিয়ে এলো। তুলে রাখা বই-খাতা মেলে পুনরায় পড়তে বসে গেল।

তার এই পুরো কার্যক্রমটা মুনছুর সাখাওয়াত দেখল নীরবে। আশ্চর্য হয়ে। একটা মানুষের মনোভাব এত দ্রুত বদলায় কীভাবে?

______
গণিত পরীক্ষাটা স্বর্ণলতা স্কুলে দিল। সবার সাথে বসে। মুনছুর সাখাওয়াত নিয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষা শেষে বের হতে সে বলল,
” চলো, ঘুরতে যাই। ”
” কোন জায়গায়? ”
” তুমি যেখানে বলবে সেখানেই। ”

স্বর্ণলতা একটু ভেবে বলল,
” ঠিক আছে। এমন জায়গায় নিয়া যান, যেখানে আপনে কোনোদিনও যান নাই। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৭)

মুনছুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে অনেকদূর এগুল, বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ফেলল। তারপরেও সে যায়নি এমন কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে পারছে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। সূর্য তার উত্তাপ হারিয়ে ডুবতে শুরু করেছে। একটু পরেই চারপাশ ধোঁয়ার মতো ঝাপসা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসবে।

স্বর্ণলতা পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে কিছু খায়নি। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। পানির পিপাসায়ও পেয়েছে। তন্মধ্যে এত সময় ধরে একভাবে ঝিম ধরে বসে আছে! পিঠ ও কোমর উভয় ধরে এলো। প্রচণ্ড বিরক্ত, ক্লান্তি ও ক্ষুধায় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। খানিক চেঁচিয়ে বলল,
” কোথায় নিয়া যাইতাছেন? আসমানে নিয়া গেলেও তো এত সময় লাগে না! ”

সাথে সাথে জীপ থেমে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিকে চেয়ে প্রত্যুত্তর করল,
” চলে এসেছি। দেখ তো জায়গাটা চিনতে পারছ নাকি? ”

স্বর্ণলতা সিটে হেলান দিয়ে চোখ, মুখ কুঁচকে ছিল। এবার পিঠটা আলগা করে সামনে ঝুঁকে এলো। প্রবল উৎসাহ ও উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকাল সামনে। মুহূর্তেই কাচ ভাঙার মতো করে তার সকল আনন্দ, আশা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সে ফুঁসে উঠে বলল,
” কোথায় নিয়া আসছেন? এটা তো আমাদের সুয়াপুর। এই মসজিদে আমি আরবি পড়ছি। এখানে আমি কই ঘুরমু? ভেতরেই ঢুকতে দিব না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থেকে নামল। স্ত্রীর পাশের দরজাটা মেলে দাঁড়িয়ে বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু স্বর্ণলতা, আমি এখানেও কোনোদিন আসিনি। ”

স্বর্ণলতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ভাবনায় পড়ে গেল। সে যতদূর জানে, আশপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় মসজিদ। একমাত্র এই মসজিদেই জুম্মার নামাজ পড়ায়। দূর-দূরান্ত থেকে নামাজিরা ছুটে আসে। জামাতে অংশ নেয়। শুক্রবারে সুয়াপুরের মহিলারা বিকেলের আগে রাস্তায় বের হতেই পারে না! সে আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” আপনে কোনোদিন জুম্মার নামাজ পড়েন নাই? ”
” না। ”
” অন্য নামাজ? ”
” না। যে আল্লাহকেই মানে না, সে নামাজ পড়বে কোন খুশিতে? ”

স্বর্ণলতা জীপ থেকে নামতে নামতে বলল,
” দুঃখেও তো পড়তে পারেন। ”
” আমার কোনো দুঃখ নেই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর হাত ধরে খানিক বাঁ দিকে নিয়ে গেল। অতঃপর একহাত উঁচু করে সামনে ইশারা করে জানাল,
” আমি ঐ বাড়িটাতেও কোনোদিন যাইনি। তুমি ওখানেও ঘুরতে পারতে, কিন্তু আমি ভেতরে যেতে দিব না। ”
” ক্যান? ”
” আমার দিকে না তাকিয়ে বাড়িটার দিকে তাকাও, তাহলে নিজেই উত্তর পেয়ে যাবে। ”

স্বর্ণলতা চট করে দৃষ্টি সরিয়ে আনল সামনে। মুহূর্তেই শীতল হয়ে এলো দেহমন। বাড়িটা ডাক্তার আল হাদির। এই মসজিদটার পাশেই যে ডাক্তারের বাড়ি এতদিন খেয়ালই করেনি! ভাবনাতেও আসেনি। আজ এভাবে নজরে বন্দী করে দিল সেই মানুষটা। যে ডাক্তার হাদিকে সহ্য করতে পারে না। হিংসায় জ্বলেপুড়ে যায়। তার অগোচরে এই দুটো মানুষের সম্পর্ক কেমন? মারামারি পর্যায়ে পৌঁছেছে কি?

” তোমার পছন্দসই দুটো জায়গা দেখালাম। অথচ কোনোটাতেই ঘুরতে পারছ না। একটায় অন্যরা ঢুকতে দিবে না, আরেকটায় আমি ঢুকতে দিব না। কী অদ্ভুত, তাই না? ”

স্বর্ণলতা লম্বা নিঃশ্বাস টানল প্রথমে। তারপরে স্বামীর দিকে ফিরে সহজ কিন্তু দীপ্ত স্বরে বলল,
” অদ্ভুত হইবো ক্যান? আমি বাইরে থেকে ঘুরতাছি আপনি ভেতর থেইক্যা ঘুইরা আসেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত খেল যেন! মুখের ভাব বদলে গেল নিমিষেই। বুকে বাঁধা থাকা হাতদুটো নেমে গেল আপনাআপনি। সন্দেহের জলটা হৃদয় ভিজিয়ে উঠার পূর্বে স্বর্ণলতা দ্রুত বলল,
” এই বাড়িতে আপনের দেখার মতো কিছু নাই। মসজিদে যান। ”

সে হতভম্ব কণ্ঠে সুধাল,
” আমি মসজিদে যাব? ”
” হ, যাবেন। একটু পরে সন্ধ্যার আযান পড়বো। নামাজটাও পইড়া আসবেন। ”
” নামাজও পড়ব? ”

স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে নেড়ে বলল,
” জি, পড়বেন। আপনের জীবনে সুখ নাই, দুঃখও নাই। কিন্তু আমার জীবনে আছে। আজকের পরীক্ষাটা ভালো হয় নাই। মনে হইতাছে, পরীক্ষায় ফেইল করমু। আপনে নামাজ পইড়া আল্লাহরে বলবেন, আমারে যাতে পাশ করাইয়া দেয়। ”
” পাশ করার জন্য আল্লাহকে লাগবে না। আমিই পাশ করিয়ে দিতে পারব। ”
” না। আপনের পাশ আমি নিমু না। আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনের কোনো ধারণা নাই। এই রেজাল্ট আমার ভবিষ্যতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ঐটা শুধু আল্লাহই জানে। আপনে দুইহাত তুইলা খাস দিলে আমার জন্য দোয়া করবেন। ফেইল বা পাশ যেটা আমার জন্যে মঙ্গল ওটাই যেন হয়। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তের জন্য বুদ্ধি শূণ্য হয়ে পড়ল। কথার খেই হারিয়ে ফেলল। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বোকার মতো চেয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। এই মেয়ে কী বলছে, বুঝাচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একবার বলছে, পাশ লাগবে। আবার বলছে, ফেইল মঙ্গল হলে সেটায় দেয় যেন! তার হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যে আযান পড়ল। এক এক করে নামাজি ব্যক্তিরা আসতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
” জীপে ওঠো। আমাদের সরতে হবে। ”

তার ব্যস্তভাব, উদ্বিগ্নতা উভয়কে থামিয়ে দিল স্বর্ণলতার জেদি কণ্ঠটা। একরোখা স্বভাবটা। চটপটে দৃঢ় গলায় বলল,
” কোথাও যামু না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জীপের কাছে চলে গিয়েছিল। ভেবে নিয়েছিল, স্বর্ণলতা তার পিছু পিছু চলে এসেছে। অথচ সে নিজ জায়গা থেকে একচুলও নড়েনি। উল্টো মুখের নিকাব খুলে নিয়েছে। দাঁড়ানো ভঙ্গিও আঁটোসাঁটো, দৃঢ়বদ্ধ। সে ঘন পা ফেলে এগিয়ে এলো। স্ত্রীর নিকাবটা নিজেই দ্রুতহস্তে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
” এখন জেদের সময় না, স্বর্ণলতা। চলো। মানুষজনে ভরে যাচ্ছে। সবকটা পুরুষ মানুষ। আমি চাই না, ওরা কেউ তোমাকে দেখুক। ”

স্বর্ণলতা আচমকা প্রায় পড়ে ফেলা নিকাবটাও টেনে খুলে ফেলে বলল,
” আমি চাই, সবাই আমাকে দেখুক। আপনে তো আল্লাহরেই মানেন না, তাইলে তার দেওয়া নিয়মকানুন আমারে দিয়া পালন করাইবেন ক্যান? আজ থেইক্যা কোনো পর্দা করমু না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের এত রাগ হলো! চোখদুটি আগুনের মতো জ্বলে ওঠল। কাঁপতে লাগল দৃঢ় চোয়ালদ্বয়। মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছে না। স্বর্ণলতা ভয়ে শিউরে ওঠল। আতঙ্ক ফুটে ওঠল মুখটায়। চেয়ে থাকতে পারল না জ্বলন্ত চোখদুটিতে। দৃষ্টি নামিয়ে জবুথবু হয়ে গেল। সেই অবস্থায় মেঘের গর্জনের মতো কণ্ঠটা শুনতে পেল,
” চুপচাপ জীপে গিয়ে বসো। এখনই। ”

স্বর্ণলতার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল। চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে নিতেই ভিন্ন কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” কী হচ্ছে এখানে? মহাজন, এটা নামাজের জায়গা, প্রেমের জায়গা না। নিজে নামাজ পড়বেন না বলে অন্যদেরও পড়তে দিবেন না? মসজিদের শান্তিটুকুও নষ্ট করবেন? আপনার বউকে নিয়ে অন্য কোথাও প্রেম করুন, প্লিজ। অন্যদের বিব্রত করবেন না। ”

উভয়েই চমকে তাকাল। মুখটায় চোখ পড়তেই স্বর্ণলতার আত্মা শুকিয়ে এলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে তেড়ে গেল। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা নাক বরাবর ছুটে যাবে তখনই স্বর্ণলতা চেঁচিয়ে বলল,
” আমার রাগ হাদিভাইয়ের উপরে দেখাইতাছেন ক্যান? মারার হইলে আমারে মারেন। ”

তার তীব্রগতিতে ছুটে যাওয়া হাতটা থেমে গেল ডাক্তার হাদির নাকের কাছেই। সে একচুলও ঘাবড়ায়নি। পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাও করেনি। দৃঢ়বদ্ধ হয়ে, বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি নির্ভয় ও ধারাল। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিকে ফিরতেই সে পুনরায় বলল,
” উনি তো ভুল কিছু বলে নাই। এই সময়ে মহিলারা মসজিদের আশপাশে থাকে না। আপনিও তো আমারে সরতে বললেন। আমি সরি নাই। দোষ উনার না, আপনারও না। আমার। মারার হইলে আমারে মারেন। ”

কথাটা বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলল। লজ্জা, অস্বস্থি, ভয়, রাগ, বিরক্ত সবকিছুই চারপাশ থেকে চেপে ধরল যেন! তাদের ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে গিয়েছে। নামাজ পড়তে আসা প্রায় প্রতিটি মানুষই তাদের দিকে চেয়ে আছে। সে এতটায় ভেঙে পড়ল যে, মাটিতে বসে পড়ল।

মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে দেখছিল ঠিকই কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিল না। কেমন যেন জমে গেল! এই সময়ে ডাক্তার হাদি তার কানের কাছে ফিসফিসে বলল,
” আমাকে পরে মারবেন, আগে স্বর্ণাকে ধরুন। ও কাঁদছে। দেখতে পারছেন না? এরকম পরিস্থিতিতে ও কখনই পড়েনি। ভয় পেয়ে গেছে তো! ”

তার টনক নড়ল। চেতন ফিরল সাথে সাথেই। সে দৌড়ে গিয়ে স্বর্ণলতাকে কোলে তুলে নিল। জীপে বসিয়ে মসজিদের প্রাঙ্গনটা দ্রুত পার হলো। তারপরে নির্জন ও জনমানব নেই এমন স্থানে থামল। স্বর্ণলতা তখনও বেহুঁশের মতো কাঁদছে। হাত-পাসহ পুরো দেহটায় ঠাণ্ডা, ক্রমশ কাঁপছে। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
” থামো। কিছু হয়নি। স্বর্ণলতা, প্লিজ থামো। ”

স্বর্ণলতা থামতে পারছে না। তার চোখে দৃশ্যটা ছবির মতো স্থায়ীভাবে সেঁটে আছে। কিছুতেই সরাতে পারছে না। এত অশ্রু ঝরছে, তবুও দৃশ্যটা মুছছে না। মুনছুর সাখাওয়াত দুইহাতে শক্ত করে চেপে ধরে থাকল। তারপরেও দেহের কাঁপন, কান্নাত গতি দমাতে পারল না। প্রায় মিনিটখানেক সময় চুপ থেকে আচমকা বলল,
” কান্না থামালে আমি এখনই নামাজ পড়ে আসব। ”

স্বর্ণলতা অশ্রুসিক্ত নয়নে চমকে ওঠল। মাথা তুলে ভেজা কণ্ঠে টেনে টেনে বলল,
” নামাজের সময় শেষ! ”
” এশারেরটা পড়ব। ওয়াক্ত শুরু হতে বেশি সময় নেই। ”
” আমার খিদা লাগছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। আরও গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরল স্ত্রীর কোমল শরীরটা। চোখ বুঁজে মাথায় গভীর ও দীর্ঘ চুমু খেল। অতঃপর কাতর স্বরে অনুনয়ের মতো বলল,
” এভাবে আর কখনও কাঁদবে না। ”

_______
স্বর্ণলতার পরীক্ষা শেষ। প্রাইভেটের শিক্ষকের থেকেও দুইদিন ছুটি নিল। তারপরে দাদিজানের রুমে গিয়ে বলল,
” এই শাড়িটা সুন্দর কইরা পড়াইয়া দিবেন? ”

কণ্ঠটায় অনুরোধের চেয়েও আবদারের রসটায় বেশি। খাইরুন নিসা মৃদু হাসলেন। বিছানায় বসে শাড়িটা হাতে নিলেন। মেলে দেখতে দেখতে বললেন,
” সুন্দর তো! কবে আনল? এতদিন দেখিনি যে? ”
” পড়তেই তো পারি নাই, দেখবেন ক্যামনে? অনেক পিছলা! শুধু খুইল্যা যায়। ”
” সুতির না যে, তাই পিছলে যায়। সেইফটি পিন লাগবে। ”

স্বর্ণলতা সেইফটি পিন দিল। শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ, চুড়ি দেখে খাইরুন নিসা মুগ্ধ হলেন। মেয়েটা তাহলে সাজতেও শিখছে! তিনি শাড়ি পরিয়ে চুলটাও আঁচড়ে দিয়ে বললেন,
” খোলায় থাকুক। এই শাড়ির সাথে ভালো মানাচ্ছে। ”

সে আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলল,
” একদিন অল্প সময়ের জন্য শাড়িটা পরছিলাম। উনি দেইখ্যা বলছিল, এই শাড়িটা পড়লে নাকি বুঝা যায়, আমি বড় হইতাছি। সত্যি বুঝা যায়, দাদিজান? ”

খাইরুন নিসা এক পলকে স্বর্ণলতার আপাদমস্তক পরখ করলেন। শাড়ির কাপড়টা একটু পাতলা। দেহের গড়ন আবছা বুঝা যায়। মুনছুর কি তাই দেখে কথাটা বলল? নাকি অন্যকিছু? তার চোখে ভিন্ন কিছু পড়ল না। নাতবউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” হুম। শুধু শাড়িতে না তোমার কথাবার্তা, চালচলনেও বুঝা যায়। ইকবাল কি তোমাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেও শেখাচ্ছে? ”
” হ। বলল, ঢাকায় নাকি সবাই শুদ্ধ কইরা কথা বলে। তাই এখন থেইক্যাই চর্চা করতে হইবো। ”

________
মুনছুর সাখাওয়াত বেরিয়েছিল সন্ধ্যার দিকে। তাই বাড়ি ফিরতে মাঝরাত হলো। রুমে ঢুকে দেখল, স্ত্রী ঘুমাচ্ছে। বসে বসে, হাঁটুতে মাথা ফেলে। সে প্রথমে ডাকবে নাকি কাপড় বদলে আসবে বুঝতে পারছিল না। ক্ষণকাল স্বর্ণলতার ঘুমন্ত মুখটায় চেয়ে থাকল। চেয়ে থাকতে থাকতে সে প্রবল ঘোরে চলে গেল। নিরতিশয় লোভে পড়ল। স্ত্রীর কোমল ত্বক ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ! সে ঝুঁকে এসে চুমু খেল স্বর্ণলতার নরম গালে। সাথে সাথে তার ঘুম ছুটে গেল। নড়ে উঠতেই মুনছুর সাখাওয়াত সতর্ক হয়ে পড়ল। দ্রুত সরে গিয়ে বলল,
” গোসল করে আসি। ”

গোসলখানা থেকে বের হতেই শুনল,
” আপনি কি আমার সাথে কিছু করেছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত যারপরনাই বিস্মিত হলো। এত সাবধানে, আলগোছে ঠোঁট ছুঁয়াল তারপরেও টের পেয়ে গেল? এই মেয়ের ঘুম এত পাতলা হলো কবে থেকে? আজকাল ঘুমের মধ্যে নড়ছেও কম। একভাবে শুয়ে রাত পার করে ফেলছে। মাঝরাতে তার যে কাছে পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে। পূরণ করতে না পারায় কতটা হতাশ হয়, সেই কথাগুলোও ফিসফিসে ঠিকমতো বলতে পারে না।

স্বর্ণলতা উত্তরের অপেক্ষায় আছে। তার পথ আটকে রেখেছে। পাশ কেটে গেলেও আবার কী ভেবে বসে কে জানে! মতিগতির তো ঠিক নেই। মুনছুর সাখাওয়াত এতক্ষণে খেয়াল করল, তার বউ সবুজ রঙের শাড়িটা পরেছে। যেটা সে ঢাকা থেকে পছন্দ করে কিনে এনেছিল।

” কী হইলো? থম মাইরা আছেন ক্যান? বলেন, কী করেছেন? ”

সে খানিক ইতস্তত করে হঠাৎ বলে ওঠল,
” তোমার সাথে আবার কী করব? ”
” কিছু করেন নাই? মিথ্যা বলবেন না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তার সামনে থেকে সরে যেতে বাধ্য হলো। চোখে কাজল পরেছে! ঘনকালো তীর ঘেষা চোখের কোলদুটি সরোবরের মতো শান্ত ও স্বচ্ছ লাগছে। এত মায়া, এত গভীর! ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়। সে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে বলল,
” শুয়ে পড়ো। আলো নেভাই। ”

সে শশব্যস্তভাবে বলল,
” না। আমার কথা আছে। আলোটা থাক। ”

চলবে