#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭১)
ইকবাল চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল,
” আমি চাই না, আমার আপার মতো আপনিও ডিভোর্সি হোন। কষ্টকর জীবন পান। কিন্তু আমি অবশ্যই চাই, আপার মতো আপনি জ্ঞানী হোন। ধৈর্যশীল হোন। প্রবল আত্মসম্মানবোধ অর্জন করুন। এজন্যে আপনাকে পড়ালেখা করতে হবে। পরশুদিন বোর্ড পরীক্ষা দিতেও যেতে হবে। একটা বিষয়ের পরীক্ষা যদি ছুটে যায়, তাহলে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একটা মেয়ের জন্য এক বছর নষ্ট করা মানে অনেক কিছু। জীবন থেকে বড় কিছু হারিয়ে ফেলার সমতুল্য। ভাগ্য চাকাও সম্পূর্ণ উল্টোপথে ঘুরে যেতে পারে। রানিসাহেবা, পরীক্ষাটা দিবেন তো? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিতে পারে না। চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। মাথা নুয়ে আসে। বুকের গভীর থেকে ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। ইকবাল খানিক্ষন অপেক্ষা করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরে। দরজার কাছে পৌঁছে হঠাৎ থমকে গিয়ে ঘাড় ফিরায়। সুধীর ও দৃঢ়স্বরে পুনরায় বলল,
” আপনি যদি পরীক্ষা না দেন আমিও কলেজে ভর্তি হব না। এখন মহাজন যদি আমার হাত, পা ভাঙে বা গলায় ছুরি চালিয়েও দেয় আমি বাঁধা দিব না। চুপচাপ আত্মবলি দিব। ”
স্বর্ণলতা আঁতকে ওঠল। দু’কদম এগিয়ে এলো অজান্তেই। বিস্ফারিত কণ্ঠে সুধাল,
” পাগল হলেন নাকি! ”
” না। আপনার স্বামী আমার শিক্ষকতায় প্রশ্ন তুলেছে। আমি সেটারই উত্তর দিব। ”
” এভাবে? হু মকি দিয়া? উনার থেইক্যা শিখছেন এসব? ”
” হয়তো। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ভালো। ”
ইকবাল রুম থেকে বেরিয়ে এলো। উঠোনে নামতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত এখনও কাঁঠালতলাতে আছে। কিন্তু আগের মতো বসে নেই। সে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছে একমনে! মুখটা এদিকেই কিন্তু দৃষ্টি উদাস, আনমনা। ইকবাল দ্রুতপদে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
” আপনার জন্য চিঠি পাঠিয়েছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু চমকাল। চেতন ফিরতেই নিজেকে দ্রুত ধাতস্থ করে নিল। খানিক দ্বিধার সহিত চিঠিটা হাতে নিল ঠিকই কিন্তু ভাঁজ খুলল না। জিজ্ঞেস করল,
” পরীক্ষা দিতে রাজি হয়নি? ”
” হয়েছে। ”
সাথে সাথে হাতটা মুঠো পেকে গেল। ভেতরের নরম কাগজটা দুমড়েমুচড়ে বন্দি হলো সেই মুঠোতে। পূর্ণ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একভাবে চেয়ে থাকল ইকবালের মুখটায়। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে গেল। একবারের জন্যও দৃষ্টি কাঁপল না, পলক পড়ল না। সহসা নীরবতা ভেঙে মুনছুর সাখাওয়াতই প্রথমে কথা বলল,
” ঢাকা গিয়েছিস কখনও? ”
” না। ”
” এখন থেকে যাবি। আজ, এখনই গেলে কেমন হয়? ”
প্রশ্নটা করে সে দলা পাকানো কাগজটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে পুড়ল। অতঃপর ইকবালকে নিয়ে হাঁটা ধরল বাড়ির মূল ফটকটার দিকে। তার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি, সন্দেহ মনোভাব কিছুই খেয়াল করল না।
_______
স্বর্ণলতা নিজেদের রুমে ঢুকে প্রথমে পরনের জামাটা বদলাল। সাদা পানির বার কয়েক ঝটকা দিল মুখটায়। তারপরে চুল আঁচড়াল, চোখে কাজলও পরল। পরিপাটি সাজে রুম থেকে বের হওয়ার পূর্বে উঁকি মারল বাইরে। পাগলটা এসেই পড়ল নাকি! ভারি অধৈর্য যে!
মুনছুর সাখাওয়াত আসেনি। সে চপলপায়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরে। দুপুরের রান্না শেষ হয়েছে, বাড়া হয়নি। সে ধোয়া প্লেটে যত্ন করে ভাত ও তরকারি সাজাল। মনে মনে স্থির করেছে, আজ সে স্বামীকে মুখে ভাত তুলে খায়িয়ে দিবে। ভাতের প্লেটটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। সাথে সাথে বুকের ভেতরে ধুকপুক আরম্ভ হয়ে গেল। উচাটন সৃষ্টি হলো চিত্তচেতনায়। লজ্জার আবরণ পড়ল সম্পূর্ণ শরীরটায়। খুশি ও ভয় একইসাথে এমনভাবে মিশে গেল যে, সে অস্বস্থিতে পড়ে গিয়েছে। ঘেমেনেয়ে উঠছে বার বার। স্বর্ণলতা ওড়না দিয়ে সেই ঘাম মুছতে মুছতে ঘন ঘন তাকাল দরজাটায়। পাল্লাটা সামান্য চাপানো। দূর হতেও মানুষটার ছায়া দেখা যাবে। সে কানদুটিও খাড়া করে আছে। তবুও কারও পায়ের আওয়াজ পাচ্ছে না, ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। অপেক্ষার সময় যত দীর্ঘ হচ্ছিল সে তত অস্থির ও অধৈর্য হয়ে ওঠছিল। অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বিছানা থেকে নামতেই শুনল,
” খাওয়ার সময়ে এখানে কী করো, নাতবউ? খেতে আসো। ”
স্বর্ণলতা ছিটকে ওঠল। হাতের প্লেটটাও কাঁপল। গ্লাস থেকে তো কয়েক ফোঁটা পানিও লাফিয়েও পড়ল। সে সচকিতে সামনে চাইতে দেখল, খাইরুন নিসা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। সে প্রথমে আশাহত হলো। অপ্রতিভ দেখাল অপেক্ষারত চোখজোড়া। পরক্ষণে নিজেকে সামলে উঠে দ্রুত জানাল,
” আমি তো ভাত নিয়া আসছি। উনি আর আমি আজকে রুমে খামু। ”
” রুমে খাওয়ার ইচ্ছা কি মুনছুরের? ”
” হ। ”
” কোনবেলা খেতে চেয়েছে? এখন তো দেখলাম, বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ”
স্বর্ণলতা আরেকদফা চমকে ওঠল। এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। তাহলে কি সে তার চিঠিটা পায়নি? ইকবাল ভাই পৌঁছে দিতে দেরি করে ফেলেছে? স্বর্ণলতা সন্দেহ ভাব কাটিয়ে উঠতে চাইল। জিজ্ঞেস করল,
” উনি কি একায় গেলেন? কোনো জরুরি দরকার পড়ছে? ”
” জানি না। আমাকে কিছু বলে যায়নি। কিন্তু একা যায়নি। ইকবালকে সাথে নিয়ে গিয়েছে। ”
স্বর্ণলতা চিন্তায় পড়ে গেল। ঘটনাটা ঠিক ধরতে পারছে না। মুনছুর সাখাওয়াত কি চিঠিটা পায়নি? নাকি পেয়েও পড়েনি? সে ভাতের প্লেটটা বিছানায় রেখে খাইরুন নিসার উদ্দেশ্যে বলল,
” জরুরি কাজে গেছে মনে হয়। তাই বইলাও যাইতে পারে নাই। চলেন, আপনেরে খাইতে দেই। আমি উনার সাথে খামু। জলদিই চইলা আসবো। ”
_______
দুপুর গড়িয়ে রাত হলো কিন্তু স্বর্ণলতার অপেক্ষা ফুরাল না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে সে গরম ভাত ঠাণ্ডা করল, তরকারি নষ্ট করল। এরমধ্যে দাদিজান কয়েকবার খাওয়ার জন্য তাগাদা দিয়ে গেলেন। সে শুনেনি, কেমন যেন জেদে পড়ে গেল! একা খাবে না কিছুতেই। সে দেখতে চায় কতক্ষণ অপেক্ষা করাতে পারে।
ঘুমানোর পূর্বে খাইরুন নিসা নাতবউয়ের সাথে দেখা করতে এলেন। স্বর্ণলতা তখন বসে বসে ঝিমুচ্ছে। ভাতের প্লেট থেকে কখন যে, ঢাকনা সরে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি। মাছি ভনভন করছে। তিনি প্লেটটা তুলে নিয়ে মৃদু সুরে ডাকলেন,
” স্বর্ণলতা? ”
সে এতটায় চমকে ওঠল যে, বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকের ভেতরটায় ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল। হতবুদ্ধি ভাবটা কাটল দাদিজানের কণ্ঠস্বরে। তিনি নরম ও স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন,
” অনেক রাত হয়েছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, মুনছুর মনে হয় আজকে আসবে না। ”
” আসবো না! ক্যামনে জানলেন? উনি বলছে? কল করছিল নাকি? ”
প্রবল উত্তেজনায় চটপটে একাধিক প্রশ্ন গুলো করেও শান্তি হলো না। সে দাদিজানের ঘা ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়ল একদম। ভীষণ উৎসুক ও কৌতূহলী দৃষ্টিজোড়া এমনভাবে তাক করে আছে যে, এখনই উত্তরগুলো দিতে হবে। নাহলে গলায় ফাঁসি পড়তে পারে!
খাইরুন নিসা খানিক ঘাবড়ে গেলেন। এক শব্দে উত্তর করলেন,
” না। ”
” তাইলে? ”
” অনুমান করছি। মুনছুর তো এখন সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসে। ”
স্বর্ণলতার উৎসাহী মুখখানা নিভে গেল। হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো। চুপচাপ ও নীরব হয়ে যেতে খাইরুন নিসা বললেন,
” ঘুমিয়ে পড়ো। ও আসলে তোমাকে ডাকবেই। ”
” আমার ঘুম আসবো না, দাদিজান। ”
” তাহলে পড়াশুনা করো। পরশু পরীক্ষা না? ”
সে জবাব দিল না। বাধ্য মেয়ের মতো বই নিয়ে বসল। দাদিজান আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছিলেন। সহসা স্বর্ণলতা ডেকে ওঠল। ভীষণ কাতর স্বরে সুধাল,
” একটা কল করমু? ”
খাইরুন নিসা হেসে ফেললেন। মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে স্বর্ণলতা প্রায় দৌড়ভঙ্গিতে ছুটে গেল দাদিজানের রুমে। মোবাইলটা বের করে কল লাগাল। একবারে ধরল না, দুইবারেও না। তিনবারে ধরল কিন্তু এপাশের কণ্ঠ বা কথাটা শোনার প্রয়োজন মনে করল না। ভীষণ ব্যস্ত ও অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
” আমি ফিরব না, দাদিজান। তোমার নাতবউকে বলো দরজা আটকে শুয়ে পড়তে। ”
কথাটা বলে কল কেটে দিল। স্বর্ণলতার এত খারাপ লাগল! আবারও ব্যস্ততা দেখাচ্ছে? রাগ দেখানোর সুযোগটাও পেল না! সে পুনরায় কল লাগাল। এবারও ধরল তৃতীয়বার রিংয়ে। ধরার সাথে সাথে বলল,
” বিরক্ত করো না, দাদিজান। মোবাইল অফ করে রাখব কিন্তু। ”
স্বর্ণলতা এবারও কিছু বলার সুযোগ পেল না। রাগ ও দুঃখে তার চোখ ভরে গেল নোনা পানিতে। ফোঁটা ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ল। দাদিজান দেখার পূর্বে মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। ভীষণ সাবধানে ও গোপনে ওড়না দিয়ে সেই পানি মুছে নিয়ে আবারও কল লাগাল। ঢুকল না। ফোনটা বন্ধ।
______
পরীক্ষার দিন। সকালবেলা। স্বর্ণলতা শুকনো মুখে নাস্তা সাজিয়ে দিলেন দাদিজানকে। তিনি খেতে খেতে বললেন,
” তুমিও বসো। ”
” আমি পরে খামু। ”
” পরে খাও তো? কলি বলল, তুমি খাওয়াদাওয়ায় খুব অনিয়ম করছ। মুখটাও তো শুকিয়ে গেছে। রাতে ঘুমাচ্ছ কখন? ”
স্বর্ণলতা চুপ করে থাকে। কী জবাব দিবে? সে তো নিজেও জানে না কখন ঘুমাচ্ছে! রাতভর বই নিয়ে বসে থাকলেও পড়া হচ্ছে না কিছুই। অন্যদিকে ঘুমটাও কোথায় যে পালাল! কিছুতেই ধরে আনতে পারে না। খুব চেষ্টা করেও ঘুম আসে না আবার জেগে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছে বুঝতেও পারছে না।
খাইরুন নিসা পুনরায় বললেন,
” তোমাদের মধ্যে কী ঝগড়া হয়েছে? ”
স্বর্ণলতা কেঁপে ওঠল খুব। এই প্রশ্নের উত্তরটাও খুঁজে পেল না। ঝগড়ার মতো কিছু একটা হয়েছিল, তার রেশ কাটেনি এখনও। কিন্তু সে পুরোদমে মিটমাটের চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্ভব হচ্ছে না। মানুষটা বাড়ি ফিরছে না। ফোনেও পাচ্ছে না। সেই যে, মোবাইলটা বন্ধ করেছে আর খুলেনি। এদিকে ইকবাল ভাইয়েরও খোঁজ-খবর নেই। চিঠিটা কী করল সেটাও পরিষ্কারভাবে জানতে পারছে না!
স্বর্ণলতা কোনোমতে জবাব দিল,
” না। ”
” তাহলে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকছ কেন? মুনছুর তো এই প্রথম বাড়ির বাইরে থাকছে না। ”
সে এখানেও নিশ্চুপের ভূমিকায় পালন করল। খাইরুন নিসা নিজেই নাতবউয়ের জন্য নাস্তা সাজালেন। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে তার মুখের সামনে ধরে বললেন,
” স্বামী দূরে থাকলে সব বউয়েরই খারাপ লাগে। তোমাদের তো আবার নতুন বিয়ে। আরও বেশি খারাপ লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তো খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলে হবে না। ”
স্বর্ণলতা খাবারটা মুখে নিয়ে ম্লান স্বরে প্রতিবাদ করল,
” এখনও নতুন আছে নাকি? কয়দিন পরে তো একবছর হইবো। ”
” হুম, বিয়ে পুরোনো হয়ে গেলেও ভাবটা তো নতুন। ”
সে না চাইতেও লজ্জায় মুড়ে গেল যেন! শুকনো ও মলিন ঠোঁটজোড়ায় মৃদু হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠল। এই সময়ে খাইরুন নিসা বললেন,
” তোমার তো পরীক্ষার সময় হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হবে কখন? ”
স্বর্ণলতার হাসিটুকু গায়েব হয়ে গেল। মনখারাপের সুরে বলল,
” তৈরি হয়ে কী হইবো? আমারে যে নিয়া যাইবো সেই তো বাড়ি নাই। ”
” আসতে কতক্ষণ? মুনছুর সব ভুলে গেলেও তোমার কথা ভুলবে না। তোমাকে দেওয়া কথাও ভাঙবে না। খাওয়া শেষ করে তৈরি হয়ে নাও। দেখবে ঠিক সময়ে পাগল হাজির। ”
খাইরুন নিসার কথা সত্যি হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে ঢুকল বাড়ির উঠোনে। সাথে ইকবালও আছে। দুজনের কেউ বাড়ির ভেতরে ঢুকল না। কাঁঠালতলাতে গিয়ে বসল। খবর পেয়ে স্বর্ণলতার দিশাহারা অবস্থা। সে দাদিজানকে বিশ্বাস করে তৈরি হয়নি। গোসলটা পর্যন্ত করেনি! এদিকে পরীক্ষার সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনই বের না হলে দেরি হয়ে যাবে। স্বর্ণলতা ঝটপটে নিজের জামাটা বদলাল শুধু। তার উপরে বোরকা পরে ফাইলপত্র গুছিয়ে দাদিজানের কাছে গেল। অনুরোধের সুরে বলল,
” আমার তো ভয় করতাছে। দাদিজান আপনেও সাথে আসেন না। ”
খাইরুন নিসা অমত করলেন না। নাতবউকে নিয়ে হেঁটে গেলেন মুনছুর সাখাওয়াতের কাছে। প্রথমে নাতিকে বেশ কিছুক্ষণ ধমকালেন। তারপরে বললেন,
” এখনও বসে আছিস যে? সময়ও কি তোর মতো বসে থাকবে? মেয়েটাকে নিয়ে যা। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ”
সে এতক্ষণ চুপচাপ ধমকগুলো হজম করে নিচ্ছিল। এবার মুখ ফিরিয়ে নিল ইকবালের দিকে। তার উদ্দেশ্যে বলল,
” তোর আপাকে নিয়ে পরীক্ষার কেন্দ্রে যা। ”
সে অত্যাশ্চর্য হয়ে উচ্চারণ করল,
” আমি! ”
” হ্যাঁ। আলামিন জীপ চালাবে। ”
এতক্ষণে স্বর্ণলতা মুখ খুলল। জিজ্ঞেস করল,
” আপনে আমার সাথে যাইবেন না? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সরাসরি উত্তরটা দিতে পারল না। এড়িয়েও যেতে পারল না। সেই সাহস কি তার আছে? সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমার বাড়িতে কাজ আছে। ”
স্বর্ণলতা এত অবাক হলো! অবিশ্বাস্য ঠেকল সামনের মানুষ ও কণ্ঠটাকে। হতভম্ব দৃষ্টিটা কাঁপল ইকবালের কণ্ঠস্বরে,
” আপা, আসুন। দয়া করে আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিন্তু। এরচেয়েও বেশি দেরি হলে পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢুকতে দিবে না। ”
সে মুখে কিছু বলল না। মাথাও নাড়ল না। যন্ত্রমানবের মতো আদেশ শিরোধার্য করে ইকবালের পিছু পিছু হেঁটে চলল। মুনছুর সাখাওয়াত জায়গায় দাঁড়িয়ে একস্থির তার চলে যাওয়ায় দেখছিল। হঠাৎ স্বর্ণলতা মুখ ফেরাচ্ছে বুঝতে পেরে সে চোখ সরিয়ে নিল। ব্যস্তচালে বাড়ির বারান্দার দিকে হাঁটা ধরল। খাইরুন নিসা তাকে অনুসরণ করতে করতে প্রশ্ন করলেন,
” বাড়ির বউ অন্য পুরুষের সাথে বাইরে যাচ্ছে। এটা কি ভালো দেখাচ্ছে? ”
সে এক মুহূর্ত থামল। পর মুহূর্তে হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল,
” তোমার নাতবউ বাড়ির বাইরের সবার সাথে মিশতে চায়। ইকবাল তো আমাদের বাড়িরই লোক! শুরুটা ও কে দিয়েই হোক। আমরাও অভ্যস্ত হই। ”
_______
মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করতে গিয়ে দেখল, স্বর্ণলতার পরিহিত কাপড় খুলে জড়ো করে রাখা। ধোয়া হয়নি, ভেজানোও হয়নি। সে হাত বাড়িয়ে কাপড়গুলো নিল। কতক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপরে হঠাৎ করে বুকের ভেতরটায় কী যেন ঘটল! সে গোসল করার চিন্তা বাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো। স্বর্ণলতার কাপড়গুলো বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজল। সাথে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭২)
স্বর্ণলতা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে দেখল, ইকবাল গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে রাস্তার কাছে জীপটাও দাঁড়ানো। আলামিন বসে আছে ড্রাইভিং সিটে। চোখে চোখ পড়তে সে হাসল। কপালে হাত ঠেকিয়ে সালামও প্রদর্শন করল।
ইকবাল এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” আপা, পরীক্ষা কেমন হলো? ”
স্বর্ণলতার জীপ থেকে দৃষ্টি সরে এলো। খানিক বিরক্ত ও রাগ মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ আপা ডাকা শুরু করছেন কেন? উনার এসব পছন্দ না। আপনেরে ভাই ডাকি বাধ্য হইয়া। তাতেও উনার শরীর জ্বইলা যায়! ”
ইকবাল মৃদু হেসে বলল,
” চিন্তা করবেন না। মহাজন নিজেই বলেছে, আপনাকে যেন আপা ডাকি। ”
স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য হলো! চোখ দুটি কপালে উঠার উপক্রম হলো। কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ে স্তব্ধ থেকে সুধাল,
” কবে বলল? ”
” আজকে। ”
পরীক্ষার সময় শেষ। দলে দলে ছাত্র-ছাত্রীরা বের হচ্ছে, অভিভাবকদের সাথে দেখা করছে, কথা বলছে। অধিকাংশরাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা ভীষণ অশান্ত, ব্যস্ত ও তীব্র হট্টগোলে রূপান্তর হলো। ইকবাল হাত উঁচিয়ে জীপটা দেখিয়ে সেদিকে হাঁটা ধরল। স্বর্ণলতা হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল,
” আপনে কি এই দুইদিন উনার সাথে ছিলেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” কই ছিলেন? ”
” বলা যাবে না, আপা। নিষেধ আছে। ”
তারা দুজনেই জীপে উঠে বসল। জীপটা চলা শুরু করার পর স্বর্ণলতা পুনরায় সুধাল,
” কে মানা করছে? উনি? ”
ইকবাল এক ঝলক তাকাল কৌতূহলী ও প্রশ্নে ঠাসা চোখদুটিতে। তারপরে হেসে ফেলল। হাসতেই থাকল। মুখে কোনো শব্দ নেই, ইশারা নেই। যেন হাসিটিই প্রশ্নের উত্তর! স্বর্ণলতাও দ্বিতীয় কোনো কথা বলল না। মলিন মুখে নিশ্চুপ বসে থাকল অনেক্ষণ। সহসা সুধাল,
” আমার থেইক্যা এমন কিছু লুকাইতাছেন না তো, যেইটা জানতে পারলে আমি কষ্ট পামু? ”
” না। ”
” সত্যি বলতাছেন তো, ইকবাল ভাই? ”
সে আবারও হাসল। অনুচ্চ ও চাপা হাসি। অতঃপর পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আপনার এই ভয়টা কি অবিশ্বাস নাকি ঈর্ষা? ”
” একটাও না। ”
” তাহলে? ”
” দুর্বলতা। করুণাও বলতে পারেন। না চাইতেও উনার জীবনে এমন এমন নারী আসছে, যাদের রূপ ও গুণের কাছে আমি কিছুই না। তারপরেও নাকি উনি ওগোরে ভালোবাসে নাই, আমারে ভালোবাসছে। এই ভালোবাসা কতদিন টিকবো আল্লাহই জানে! ”
” আপনার ভয়টা তাহলে উনার চরিত্রে না, ভালোবাসায়! মহাজন যে আপনাকে ভালোবাসে এটায় এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি, তাই তো? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিতে পারে না। দৃষ্টি নামিয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকে। ইকবাল তার এই নত চোখজোড়ায় চেয়ে থেকে বলল,
” আমারও শুরুতে বিশ্বাস হয়নি। পরে যখন বিশ্বাস হলো? তখনই মহাজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার মধ্যে এমন কী আছে যা আমার আপার মধ্যে ছিল না। উত্তরে কী বলেছিল জানেন? ”
তার দৃষ্টি উঠে এলো আবারও। পূর্বের মতো প্রবল কৌতূহল ও আগ্রহ দখল করে নিল নয়ন দু’খানা। ইকবাল খেয়াল করে মৃদু হাসল। অতঃপর জানাল,
” ভালোবাসা। আপনার কাছে নাকি উনার ভালোবাসা আছে। আমার তো মনে হয়, রূপ ও গুণের চেয়েও হাজারগুণ বেশি সৌন্দর্য বহন করছে এই ভালোবাসা। যেটা স্বয়ং মহাজন আপনার কাছে জমা রেখেছে। এরপরেও আপনার মধ্যে দুর্বলতা কাজ করে কীভাবে? অন্য কারও সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না। আপনার পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা কারও নেই। মহাজন আপনাকে অতুলনীয়া হিসেবে রূপান্তর করেছে। ”
স্বর্ণলতার চোখের পলক পড়া থেমে গেল। বিস্ময়ের আভায় মণিজোড়া চিকচিক করছে। ইকবাল এই চাহনিতে চেয়ে থাকতে পারল না। কিসের যেন ভারী আঘাত পড়ল শক্ত বক্ষের নরম হৃদয়টায়। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল অন্যদিকে। মৃদু সুরে হালকাভাবে উচ্চারণ করল,
” যত্ন করুন। ”
” কিসের যত্ন করমু? ”
” মহাজনের ভালোবাসার। যেটা আপনার কাছে জমা রেখেছে। ধূলোময়লা পড়তে দিবেন না। মনে রাখবেন, ধূলোর উপরে ধূলো পড়লে সহজে পরিষ্কার করা যায় না। পরিষ্কার করলেও আগের মতো চকচকে ভাব থাকে না, মলিনতার স্পর্শ থেকেই যায়। ”
জীপটা একেবারে বাড়ির উঠোনে এসে থামল। স্বর্ণলতা নামার তোরজোর করছিল। সহসা চিঠির কথাটা মনে পড়ল। সাথে সাথে প্রশ্নটা করল,
” উনারে কি চিঠিটা দিতে পারেন নাই? ”
” দিয়েছি তো। আপনি দেওয়ার সাথে সাথেই দিয়েছিলাম। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কিছু হয়েছে? ”
” না। আমি ভাবছিলাম, কিছু হইবো। কিন্তু হই নাই। ”
ইকবাল কথাটার অর্থ ঠিকমতো ধরতে পারল না। অবুঝভঙ্গিতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। স্বর্ণলতা আপন ভাবনায় বিভোর। বাস্তবজগৎ থেকে ছিটকে পড়েছে যেন! উদাস দৃষ্টিতে বেখেয়ালে জীপ থেকে নামার সময়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়! ইকবাল বাঁচাল। হাতটা ধরে সাবধানে নামিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটা যে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুনছুর সাখাওয়াত প্রত্যক্ষ করছে, দুজনের কেউই দেখতে পেল না।
স্বর্ণলতা উঠোনে দু’পা নামিয়ে দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” উনি কি চিঠিটা পড়ে নাই? ”
” আমার সামনে পড়েনি। ভাঁজটাও খুলেনি। সোজা পকেটে চালান করে দিয়েছিল। পরে একা একা পড়েছে নাকি জানি না। এই বিষয়ে মহাজন আমাকে কিছু বলেননি। ”
________
স্বামীকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বর্ণলতা প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণে খুশিতে নেচে ওঠল হৃদয়টা। সে প্রায় দৌড় ভঙ্গিতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিকাবটা একটানে খুলে ফেলল। ভীষণ আহ্লাদ ও উচ্ছ্বাসে ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল ঠিকই কিন্তু কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত গম্ভীর ও শক্ত গলায় বলল,
” স্বর্ণলতা ঘরে যাও। ”
” আপনেও আসেন। আমার আপনের সাথে কথা আছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিতীয় কোনো বাক্য উচ্চারণ করল না। অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধে তার দীর্ঘ শরীরটা কাঁপছে। চোখ ও শ্বাস থেকে যেন স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছে! স্বর্ণলতাকে পাশ কাটিয়ে যে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামবে সেই ধৈর্যটাও হলো না। সে বারান্দা থেকে নামল লাফিয়ে। ভারী ও লম্বা পদ ছাপ ফেলে জীপের দিয়ে যাচ্ছিল। উঠোনের মাঝামাঝিতে আসতে স্বর্ণলতার হুঁশ এলো। সঙ্গে সঙ্গে ভবিতব্য ঘটনা বুঝে ফেলে আঁতকে ওঠল। স্বামীকে গায়ের জোরে আটকাতে পারবে না, তাই চেঁচিয়ে বলল,
” ইকবাল ভাই ইচ্ছা কইরা আমার হাত ধরে নাই। আমি পইড়া যাইতে ছিলাম, তাই বাধ্য হইয়া হাত ধইরা বাঁচাইছে। আমারে বাঁচানো যদি উনার অপরাধ হয় তাইলে উনারে শাস্তি দিয়েন। সাথে এটাও বইলা আসবেন, আমি পইড়া মইরা গেলেও আপনের কোনো যায় আসে না। ”
______
ইকবালকে শাস্তি দিয়েছিল নাকি দেয়নি স্বর্ণলতা জানে না। দুজনের কারও সাথে তার দেখা হয়নি, কথা হয়নি। সেই রাতেও সে স্বামীর জন্য সারারাত অপেক্ষা করেছে। মুনছুর সাখাওয়াত আসেনি। স্বর্ণলতা সকালবেলা দাদিজানের কাছে শুনেছে, সে নাকি বাড়িতেই ছিল। ঘুমিয়েছিল পড়ার রুমে। অন্য রুমে ঘুমানোর কারণটা উদ্ঘাটন করতে পারেনি। তার স্পষ্ট মনে আছে, রুমের দরজা খোলা ছিল। স্বর্ণলতা এত কষ্ট পেল যে, তখনই কান্না করে দিল। কিছুতেই আটকাতে পারল না। খাইরুন নিসা হতভম্ব হয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে যে কাছে টানবেন, সান্ত্বনা দিবেন সেই জ্ঞানটাও হলো না।
এই একই ঘটনা একটানা কয়েক রাত ঘটে চলল। মুনছুর সাখাওয়াত কখন এসে ঘুমিয়ে পড়ত, শুরুর দিকে স্বর্ণলতা খুব একটা টের পেত না। জেগে থেকে বার বার উঁকি মারত পাশের দরজায়। যেরাতে টের পেত, সেইরাতে দরজায় ঠকঠক করত, ডাকাডাকি করত। মুনছুর সাখাওয়াত কখনও সাড়া দিত, কখনও দিত না। কিন্তু দরজা খুলে বের হয়নি একদিনও। স্বর্ণলতা চালাকি করে যদি পড়ার রুমে বসে থাকত, সেও চালাকি করে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ত।
খাইরুন নিসা একদিন নাতিকে চেপে ধরলেন। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তোদের মধ্যে কী হয়েছে বলতো। আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না! তুই কিছু বলছিস না। তোর বউকে জিজ্ঞেস করলেই কেঁদেকেটে একশা হচ্ছে। ”
” স্বর্ণলতা কি খুব কাঁদছে, দাদিজান? ”
কণ্ঠটায় কি কৌতুক ছিল নাকি ব্যাকুলতা? তিনি আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারলেন না। কিন্তু চোখের দৃষ্টি এত শীতল! মুখভঙ্গিতে একফোঁটা কাঠিন্যতাও নেই। গোঁফের আকারটাও এলোমেলো ও অমসৃণ দেখাচ্ছে। খাইরুন নিসা খেঁকিয়ে ওঠলেন,
” শুধু কি কাঁদছে? মেয়েটা তো খাওয়া, ঘুম একেবারে ছেড়েই দিয়েছে! শরীরে যা একটু রক্ত-মাংস হয়েছিল সেটুকুও এতদিনে শুকিয়ে এসেছে। একদেখায় মনে হবে, বয়স বাড়ার বদলে কমে গেছে। যেমন এনেছিলি তেমনিই আছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দৃষ্টি নত করে চলে যাচ্ছিল। দাদিজান আটকে বললেন,
” জবাব না দিয়ে পালাচ্ছিস কেন? মুনছুর, কী হয়েছে বল আমাকে। স্বর্ণলতা হঠাৎ করে কী এমন করল যে, এত কষ্ট দিচ্ছিস? ”
” আমি কষ্ট দিচ্ছি? ”
” তাহলে কি আমি দিচ্ছি? দেখছিস না, তোকে ছাড়া থাকতে পারছে না? নিজের অযত্ন করছে। ”
” ওসব আমার জন্য করছে না, দাদিজান। ”
” তাহলে কার জন্যে? ”
” ওর স্বপ্নের জন্য। ”
উত্তরটা দিয়ে সে পড়ার রুমে ঢুকে পড়ল। দরজা আটকাবে তখনই খাইরুন নিসা বললেন,
” আবারও এই ঘরে শুচ্ছিস! স্বর্ণলতা কি সবসময় একাই ঘুমাবে? তোর সমস্যা থাকলে আমার রুমে থাকতে বল। আমি বললে তো শুনবে না। ”
” তোমার বলতেও হবে না। ও একা একা ঢাকা থাকতে পারলে বাড়িতে একা আলাদা রুমে ঘুমাতে পারবে না? ”
______
পরীক্ষা শেষ হতে স্বর্ণলতা জানতে পারল, সে ঢাকা যাচ্ছে। খবরটা পেল ইকবালের কাছে। সব বন্দোবস্ত করেছে সে-ই। স্বর্ণলতা যেদিন চাইবে সেদিনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারবে। এখন শুধু তার মতের অপেক্ষা।
খবরটা পাওয়ার পর স্বর্ণলতার মধ্যে আনন্দ বা দুঃখ কোনো পক্ষের অনুভূতিই কাজ করল না। এত স্বাভাবিক ও সহজ চালে নিজের রুমে ফিরল যে, মনে হলো রোজই এই ধরনের খবর শুনছে। প্রতিক্রিয়া শুরু হলো, আরও দুইদিন পরে। প্রথমে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো। তারপরে অচেতন হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। তার পাশে দিন-রাত বসে থাকল খাইরুন নিসা। ঔষধপত্র ও ডাক্তার নিয়ে ছুটোছুটি করল ইকবাল। অসুস্থে কাতর হওয়া চোখজোড়া মেলে একপলকের জন্যও মুনছুর সাখাওয়াতকে দেখতে পেল না।
এই জ্বরে স্বর্ণলতার শরীর কাবু হলেও মন কাবু হলো না। প্রগাঢ় অভিমানে ছেয়ে গেল নরম হৃদয়টা। এত ক্লান্তি চলে এলো সবকিছুতে যে, মনস্থির করে ফেলল সে ঢাকা যাবে। পরেরদিন সকালে ইকবালকে ডেকে পাঠিয়ে বলল,
” আমারে ঢাকায় নিয়া যাইবো কে? আপনে তো? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে চলেন। ”
” এখন? ”
” হ। আপনের অসুবিধা থাকলে বলেন, আমি একাই চইলা যামু। শুধু ঠিকানাটা বুঝাইয়া দেন। নাকি ওটাও পারবেন না? ”
ইকবাল প্রথমে হকচকিয়ে গেল। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে দ্রুত বলল,
” আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার তো এখন এই একটায় কাজ। কিন্তু, আপা? মহাজন তো বাড়ি নেই। তার অনুমতি ছাড়া আপনাকে নিয়ে বের হই কীভাবে? ”
” তার অনুমতি লাগবো কেন? আপনে না বলছিলেন, আমার মত হইলেই যাইতে পারমু? ”
তার এই বেপরোয়া, জেদি কণ্ঠস্বর ও যুক্তিবাদী উত্তরে ইকবাল নিজের ন্যায়পরায়ণ থেকে সরে গেল। স্বর্ণলতার স্বচ্ছ চোখের তীক্ষ্ণ চাহনিতে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
” চলুন। ”
স্বর্ণলতা বের হতে চেয়েও থামল। টেবিলের উপর পড়ে থাকা খাতাটা নিয়ে তাতে লিখল,
‘ আমার কাছে আপনার কোনো ভালোবাসা নেই। এই দাবিটা যদি কখনও করতে শুনেছি, তাহলে দা দিয়ে আপনার গলা কাটব। কাটব মানে কাটবই। ঢাকায় নিশ্চয় ধারাল দা পাওয়া যায়? এতদিন আমার থেকে যেভাবে দূরে ছিলেন, সারাজীবনই থাকুন। ভুল করেও আমার চোখের সামনে আসবেন না। অন্তত গলাটা বাঁচাতে হলেও আমার এই সাবধান বাণীটা শুনে চলবেন।
স্বর্ণলতা ‘
স্বর্ণলতা পড়ার রুম থেকে বেরিয়ে সোজা হেঁটে গেল দাদিজানের রুমে। তার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” আপনের নাতি আসলে এইটা পইড়া শুনাইবেন। উনার তো আমার চিঠি পড়ারও সময় হয় না। কত ব্যস্ত লোক! ”
খাইরুন নিসা কত কী বললেন! স্বর্ণলতা কিছুই মানল না। হাতটাও ধরে থাকল কতবার! স্বর্ণলতা হাত ছাড়িয়ে নিল প্রতিবারই। এই বুড়ো মানুষটার কাছে সে গায়ের জোরে জিতে গেল। ইকবালকে নিয়ে সত্যি সত্যি ঢাকার পথে রওনা হয়ে গেল।
_______
সন্ধ্যার মধ্যে স্বর্ণলতারা ঢাকায় পৌঁছে গেল। ইকবাল তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ভাড়া বাড়িটিতে। দোতলা পুরোনো ধাঁচের বাড়ি। সামনে ছোট্ট উঠোন। চারপাশে মোটা দেয়ালে ঘেরাও দেওয়া। বাড়িওয়ালা থাকে না। স্বর্ণলতা থাকবে ওপরে। ইকবাল থাকবে নিচ তলায়। তারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল, হঠাৎ সুবর্ণকে দেখা গেল নিচে নামছে। স্বর্ণলতা অত্যাশ্চর্য হয়ে উচ্চারণ করল,
” সুবর্ণ! ”
ইকবাল তার পেছনে পেছনে উঠছিল। সিঁড়ির একধাপ পিছিয়ে। নিচ থেকে উত্তর করল,
” শুধু সুবর্ণ না, আপনার পুরো পরিবারই এখানে আছে। আপনার সাথে থাকবে। ”
সে উপর থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল নিচে। কৃতজ্ঞতা উপচে পড়ছে যেন! ইকবাল এই দৃষ্টিতে চোখ মিলিয়ে রাখতে পারল না। বুকের কোথাও নড়ে উঠল আচমকায়! তার কি কোনো অসুখ করেছে? বুকের ভেতরের কোনো হাড় ভেঙে যায়নি তো? এই ব্যথাটা নতুন। আগে কখনও অনুভব করেনি।
” ওরাও কি আজকে আসছে? ”
” না। যেদিন থেকে বাসা নেওয়া হয়েছে সেদিন থেকে। আপা, দাঁড়িয়ে থাকবেন না। উপরে চলুন। রাত হয়ে আসছে। আপনার আম্মারা অপেক্ষাও করছে। ”
সুবর্ণ নেমে এসে আপুর হাত ধরল। টেনে উঠাল দোতলায়। বড় দরজাটা খোলায় ছিল, শবনম বেগম দাঁড়িয়ে মেয়ের অপেক্ষা করছিলেন। স্বর্ণলতার মুখটা নজরে আসতেই তিনি দৌড়ে এলেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে রুমের ভেতরে ঢুকলেন। স্বর্ণলতা চোখে অশ্রু নিয়েও চমকে ওঠল। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে দেখল, প্রতিটা রুমে দামি আসবাবপত্রে সাজানো। রান্নাঘরটাও তৈজসপত্রে ভরপুর। সবকিছু নতুন ও ঝকঝকে হওয়া সত্ত্বেও মনে হচ্ছে, এগুলো অনেককাল থেকে এখানে আছে। বছরের পর বছর ধরে সাংসারিক কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে।
সময় যত গড়াতে লাগল, স্বর্ণলতার আশ্চর্য ভঙ্গি ততই বাড়তে লাগল। এখানে দুটো রুম। তন্মধ্যে একটা সাজানো হয়েছে যেন তারই জন্যে! তার প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসই একাধিক সংখ্যায় আছে। এতসব কখন গুছানো হয়েছে? ইকবাল জানল কীভাবে? সে তো আজ অবধি তার মুখটায় ঠিক করে দেখেনি!
_______
প্রায় দেড় মাস পরে স্বর্ণলতা তৃপ্তি করে ভাত খেল। মায়ের হাতে রান্না খেল কতমাস পরে সেটাও মনে করতে পারল না! শবনম বেগম বিছানা গুছিয়ে মেয়েকে ডাকলেন,
” আয়, শুইয়া পড় মা। ”
বিছানার একপাশে মা ও মাঝে মাধবীলতা শুয়ে আছে। স্বর্ণলতা উঠে বলল,
” তুমি মাঝখানে আসো, আম্মা। তোমারে জড়াইয়া ধইরা ঘুমামু। ”
তিনি দ্বিমত পোষণ করলেন না। বাধ্য বাচ্চার মতো চুপচাপ বড় মেয়েকে একটু পাশে ঠেলে দিলেন। তিনি মাঝে এসে শুয়ে পড়লেন সাথে সাথে। স্বর্ণলতা আলোটা নিভিয়ে বিছানায় যাবে এই সময়ে কলিংবেল বেজে ওঠল। একসাথে কয়েকবার। বাজতেই লাগল! স্বর্ণলতা মায়ের দিকে চেয়ে সন্দেহি গলায় বলল,
” মনে হয় ইকবাল ভাই আসছে। তুমি থাকো, আমি দেখতাছি। ”
সে ঘনঘন পা ফেলে এগিয়ে গেল মূল দরজাটার কাছে। এত অধৈর্য ভাবে কলিংবেল চাপছে, দরকারি কিছু হবে। সে শেষের দিকে প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল। ওপাশের মানুষটার মুখটা নজরে আসতেই বরফের মতো জমে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে বসল। অপলক, একভাবে চেয়ে থেকে আচমকা বলল,
” আপনেরে আসতে মানা করছিলাম না? ”
” কোথায়? এই চিঠিতে তো আসতে বলেছ। ”
স্বর্ণলতা ভ্রুজোড়া কুঁচকে তাকাল চিঠিটায়। ড্রয়িংরুমের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবুও এক পলকে বুঝে গেল, এটা তার প্রথম লেখার চিঠিটা। এই চিঠি পড়ার সময় হলো এতদিনে? সে ছোঁ মেরে চিঠিটা নিতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত বুঝতে পেরে চিঠিসহ হাতটা সরিয়ে নিল। দ্রুত কায়দায় পকেটে ভরে রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ল। নিজ দায়িত্বে দরজায় সিটকানি তুলে বউকে জড়িয়ে ধরার জন্য দুই হাত বাড়াতে শুনল,
” স্বর্ণা? ক্যাডা আইল? ইক…”
পুরো কথাটা শেষ হলো না। এরপূর্বেই শাশুড়ি ও মেয়ে জামাইয়ের চোখাচোখি হলো। মুনছুর সাখাওয়াত নিজেকে সামলে নিল। স্বর্ণলতার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কাছের রুমটায়। ভেতরে চেয়ে দেখল, মাধবীলতা শুয়ে আছে। চোখদুটি খোলা! সে বউকে টেনে নিয়ে পাশের রুমটায় গেল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল, সুবর্ণ ও তার বাবা শুয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত প্রচণ্ড বিরক্ত ও অধৈর্য হয়ে বউকে নিয়ে এলো রান্নাঘরে। এখানে এসেও শান্তি পেল না। শবনম বেগমের আতঙ্কিত চোখ জোড়া দূর হতেও তাদের দিকে নিবদ্ধ। তার ইচ্ছে হলো চোখদুটি উপড়ে ফেলে দিতে! স্বর্ণলতার মা না হলে হয়তো এতক্ষণে উপড়ে ফেলতও। এখন তো ধমক দিয়ে বলতেও পারছে না, রুমে গিয়ে দরজা আটকে বসে থাক।
মুনছুর সাখাওয়াত শেষমেশ বউকে নিয়ে ঢুকল গোসলখানায়। দরজা আটকে দিয়ে দুই হাতে গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
” মাফ করে দাও, বউ। ”
স্বর্ণলতা এই বাঁধনটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টাটুকুও করতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে অস্পষ্টভাবে আবারও বলল,
” বউ, মাফ করে দাও। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৩)
মুনছুর সাখাওয়াত শেষমেশ বউকে নিয়ে ঢুকল গোসলখানায়। দরজা আটকে দিয়ে দুই হাতে গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
” মাফ করে দাও, বউ। ”
স্বর্ণলতা এই বাঁধনটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টাটুকুও করতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে অস্পষ্টভাবে আবারও বলল,
” বউ, মাফ করে দাও। ”
নরম ও আলতো চুম্বন হঠাৎ করে আগ্রাসী পর্যায়ে চলে গেল। মাঝের ক্ষণিকের যে বিরতি পর্ব চলছিল সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত গভীর স্পর্শ, ঘনিষ্ঠ আদরটুকু শুরুতে স্বর্ণলতা অনুভবই করতে পারল না। পাথরের মতো অনুভূতিহীন ও অসাড়তায় পরিণত হয়েছিল। যতক্ষণে সে অনুভূতি ফিরে পেল ততক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াত হয়ে ওঠল উন্মাদ, বেপরোয়া। ধৈর্য্য ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিরাজ করতে চাচ্ছে স্ত্রীর অধরযুগলে।
প্রবল অনুভূতিতে ডুবে থাকা সত্ত্বেও অপটু ও অনভিজ্ঞ স্বর্ণলতা তাল মিলিয়ে উঠতে পারল না। অতিষ্ঠ হয়ে উঠল কিছুক্ষণের মধ্যেই। স্বামীর অবিরত ঘনঘন ওষ্ঠাধরের স্পর্শ ও দীর্ঘ দেহের চাপটা সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়ল। শ্বাসে এমন টান পড়ল যে সে বাধ্য হলো মুনছুর সাখাওয়াতকে সরিয়ে দিতে। দুইহাতে সবলে তার বুক বরাবর ধাক্কা দিয়েই চেঁচাল,
” আমারে খাইয়া ফেলাইবেন? রাক্ষস আপনে? ”
প্রশ্ন দুটি মুনছুর সাখাওয়াতের কানে প্রবেশ করলেও মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলতে পারল না। তাই অর্থ উদ্ধার হলো না, জবাবও এলো না। সে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে অবোধের মতো চেয়ে রইল। স্বর্ণলতা জোরে জোরে শ্বাস টেনে দেহমন স্বাভাবিক করার চেষ্টার মাঝেই জিজ্ঞেস করল,
” ঠোঁটে কী ভরাইয়া আনছেন? আমার ঠোঁট জ্বলতাছে কেন? ”
সে তৎক্ষনাৎ কল ছেড়ে পানির ঝটকা দিতে লাগল মুখে। ঠোঁটে কয়েক বার ডলা দিয়ে আবারও পানি দিয়ে ধুয়ে নিল। ওড়না দিয়ে ভেজা মুখটা মুছতে মুছতে সে গোসলখানার দরজা খুলে ফেলল। বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে বলল,
” আমি আপনেরে মাফ করি নাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের ঘোর কাটল এতক্ষণে। বউয়ের পিছ ধরতে ধরতে ভাবল, রাগ ভাঙার বদলে কি আরও বেড়ে গেল? দাদিজান তো বলেছিল, রাগ ভাঙতে হয় আদর করে। সে তো আদরই করল!
স্বর্ণলতা বাইরে বেরুতে দেখল, শবনম বেগম বড় মেয়েকে নিয়ে অন্য রুমে যাচ্ছে। তার ভারি লজ্জা লাগল! মায়ের সামনেই তো দানবটা তাকে নিয়ে গোসলখানায় ঢুকল। ভেতরে কী ঘটেছে নিশ্চয় আন্দাজ করে ফেলেছে? ইশ! তার মাথা নুয়ে একেবারে বুকের কাছে চলে এলো। সামনের ফাঁকা রুমটায় ঢুকল নীঃশব্দে। চোরের মতো দৃষ্টি বাঁচিয়ে।
মুনছুর সাখাওয়াতও ঢুকল সাথে সাথেই। দরজায় সিটকানি লাগানোর শব্দে স্বর্ণলতা কেঁপে ওঠল। কিন্তু বুঝতে দিল না। পেছনে না চেয়েই মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বলল,
” এখন তো খুব পিছ পিছ ঘুরতাছেন, জ্বরে যখন হাসপাতালে পইড়া ছিলাম তখন কই ছিলেন? কবরস্থানে? আমার জন্য কবর খুড়তাছিলেন? ”
” না। তোমার কাছে ছিলাম। মাথার পেছনে। ”
” দেখলাম না তো! ”
” মাথা ঘুরালে তো দেখতে পারবে। তুমি ছাড়া সবাই দেখেছে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলত। করোনি তো! ”
স্বর্ণলতা পেছন ফিরল। সাথে সাথে নাকটা ঠেকে গেল মুনছুর সাখাওয়াতের বুকে। মানুষটা এত কাছে কখন এলো? সে হকচকিয়ে গেল। কাঁটা দিয়ে ওঠল সর্বাঙ্গে। হৃদস্পন্দন এত দ্রুত ছুটছে যে, ইচ্ছে হলো হাত দিয়ে বুকের বা’পাশটা খামচে ধরে থাকতে! চোখদুটি তুলে মুখটা দেখতেও পারছে না। এত লজ্জা, এত অস্বস্থি কোথা থেকে এলো?
স্বর্ণলতা চট করে উল্টো ঘুরে গেল। তখনই দৃষ্টি পড়ল বিছানায়। স্মরণে এলো, এই মানুষটা খুব পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে। প্রতিদিনই বিছানার চাদর বদলায়। এই চাদরটা আজকে বিছানো হলেও অন্য শরীরের স্পর্শ পড়েছে। কিছুক্ষণ আগেও তার বড় আপু ও আম্মা শুয়ে ছিল। সে ব্যস্তপায়ে এগিয়ে গেল রুমের অন্যপ্রান্তে। তুলে রাখা নতুন চাদরগুলো থেকে একটা নিয়ে এলো। ব্যবহৃত চাদরটা তুলে নতুনটা বিছাবে তখনই ডাক পেল,
” স্বর্ণলতা? ”
সে ব্যস্তভঙ্গিতে ঘাড় ফিরে তাকাল। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি রাখতে মুনছুর সাখাওয়াত কাতর স্বরে সুধাল,
” তোমার ঠোঁটে আরেকবার চুমু খাই? ”
স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল। হাত ফসকে চাদরটা নিচে পড়ে গেল। সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে হাত বাড়িয়ে চাদর উঠাতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এসে সেই হাতটা চেপে ধরে আটকাল। নিজে বিছানায় বসে স্বর্ণলতাকে বসাল নিজের ঊরুতে। অতঃপর নরম গলায় ফিসফিসের মতো বলল,
” এবার সাবধানে খাব। একটুও জ্বলবে না। ”
সে জবাবে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। শুধু টের পাচ্ছিল তার কণ্ঠনালীতে কথারা জ্যাম বাঁধিয়ে ফেলছে কিন্তু ঠোঁটের আগায় পৌঁছাতে পারছে না। সে কি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল? তার এই বেহাল দশার মাঝে মুনছুর সাখাওয়াত আরও একটি সাহসী কাজ করে বসল। স্বর্ণলতার গলা থেকে ওড়না খুলে নিয়ে বলল,
” মুখে বলবে নাকি তোমার চিঠিটাকে সম্মতিপত্র ধরে নিব? ”
স্বর্ণলতা এখানেও নিরুত্তর। চুপচাপ, একভাবে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে থাকলেও তার শরীরজুড়ে যে অনুভূতির ঝড় বয়ে চলছে, সেটা সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে। একমনে চায়ছে মানুষটাকে নিজে থেকে কাছে টেনে নিয়ে এই ভালো লাগাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ দিতে। আরেকমনে চায়ছে দৌড়ে পালিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ে নিজেকে শান্ত করতে।
স্বর্ণলতার উন্মুক্ত কমনীয় কাঁধযুগল ও স্ফীত বক্ষোজ আকর্ষণ সৃষ্টি করলেও মুনছুর সাখাওয়াত ঠোঁট ছুঁয়াল ঘাড়ে। খোঁপা থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট চুলের মাঝে। তার ভীষণ প্রিয় ও প্রার্থিত স্থানটা! যতবার নজরে এসেছে ততবারই আদর করার জন্য ভেতরে ভেতরে মরেছে। স্বর্ণলতাকেও কি কম যন্ত্রণা দিয়েছে? ঘুমের মাঝে ডেকে তার এই চাওয়ার কথা রোজ রাতেই শুনাত। ভাগ্যিস, মেয়েটার ঘুম ভাঙলেই সব ভুলে যেত!
মুনছুর সাখাওয়াত আদর করার মাঝে স্ত্রীর মুখটা নিজের দিকে ঘুরাল। ঠোঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল,
” কথা বলো, স্বর্ণলতা। ”
এই তৃষালু দৃষ্টি, সম্মোহনী কণ্ঠস্বর ও পেটের কাছে গভীর স্পর্শকে সে কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারছে না আবার সজ্ঞানে সায়ও দিতে পারছে না। সে করুণ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে উপলব্ধি করল, মানুষটার এত কাছে আছে বলেই হয়তো এই অবস্থা। সে আচমকা উঠে সরে গেল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে সম্মতিসূচক বাক্যটা উচ্চারণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ঠিক তখনই শুনল,
” তোমার মনে হয় ভালো লাগছে না। ”
কথাটা বলে সে রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা ক্ষণকাল স্থবির হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। সহসা ছুটে বেরিয়ে এসে দেখল, মূল দরজাটা খোলা। এরমধ্যে শবনম বেগমও রুম থেকে বেরিয়ে ছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কই গেল? ”
” জানি না। ”
________
সেই রাতে মুনছুর সাখাওয়াত ফিরল না। স্বর্ণলতা সারারাত অপেক্ষা করল। এই রুমে আম্মা ও আপাকে ফিরিয়ে আনল না। তার মন বলছিল, মানুষটা ফিরবে। এতদূর থেকে এভাবে ছুটে এলো, ছোট্ট একটা ভুল বুঝাবুঝি থেকে একেবারে চলে যেতে পারে না। অন্তত এই কারণ দেখিয়ে তো না! তার সেই অনুমান ভুল প্রমাণিত হলো রাত কেটে যেতেই। মানুষটা সত্যি ফিরেনি।
পরেরদিন সকালে স্বর্ণলতা নিচে নামল। তার কাছে মোবাইল নেই, ইকবালের কাছে থাকতে পারে। সে ঠিক করেছে, মানুষটাকে কল করবে। ভুল বুঝাবুঝিটা শোধরে নিবে। তারপরে একসাথে বাড়ি ফিরে যাবে। এখানে আসাটাও হয়েছিল, ভুল বুঝাবুঝি থেকে। এইসব ঝামেলা যত দ্রুত সম্ভব মেটানো দরকার।
দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো। কলিংবেল নেই। স্বর্ণলতা দরজায় ঠকঠক করল। একবার, দুইবার, তিনবার। কেউ খুলছে না। ভেতর থেকে সাড়াও আসছে না। স্বর্ণলতা দরজাটা আবারও পরখ করল। ভেতর থেকেই লাগানো। তাহলে খুলছে না কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো? সে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল। অস্থির চিত্তে দরজায় লাগাতার থাপ্পড় দিতে দিতে ডাকল,
” ইকবাল ভাই? ”
ঠিক তখনই পেছন থেকে কণ্ঠটা বাজল,
” ও ঘুমাচ্ছে। ”
স্বর্ণলতা চকিতে পেছন ফিরল। সচকিত দৃষ্টিতে দেখল, কণ্ঠের মালিকটি তার স্বামী। যার সাথে কথা বলার জন্য এখানে আসা। সে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল,
” আপনে বাড়ি যান নাই? ”
” না। ”
” তাইলে সারারাত কই ছিলেন? ”
” ইকবালের সাথে। ”
স্বর্ণলতার বিস্ময় এবার আতঙ্কে রূপ নিল। কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” উনি দরজা খুলতাছে না কেন? কী করছেন উনার সাথে? ”
” কিছু করার কথা ছিল নাকি? ”
সে আরও কাছে এগিয়ে এলো। শাসানোর মতো কণ্ঠে বলল,
” একদম বোকা সাজার চেষ্টা করবেন না। কী করছে আপনে মনে হয় জানেন না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একটু থেমে বলল,
” আমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে নিয়ে এসে অনেক বড় দোষ করেছে। এত বড় দোষের শাস্তি কী দিব তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই মাফ করে দিছি। ”
” মিথ্যা। ”
” আমাকে অবিশ্বাস করছ? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। মুখ ঘুরিয়ে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
” যে জেদের কাছে মুনছুর সাখাওয়াতই জিততে পারে না সেই জেদের কাছে ইকবাল জিতে যাবে? তাহলে হারটা আমারই হতো। ইকবাল তো নিজে হেরে গিয়ে আমাকে জিতিয়ে দিল। তাই খুশি হয়ে মাফ করে দিছি। ”
স্বর্ণলতার এখনও বিশ্বাস হলো না। মনের মধ্যে খুঁতখুঁতে ভাবটা থেকেই গেল। কিন্তু প্রকাশ করল না। বলল,
” উপরে আসেন। ”
” না। ”
” কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। ম্লান মুখে দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বর্ণলতা কপট রাগ নিয়ে বলল,
” তাইলে এখানে কী করতাছেন? গ্রামে ফেরত যান। ”
” যাব। তোমাকে একটা দা কিনে দিয়ে চলে যাব। যাতে আবার আসলে গলাটা কাটতে পার। ”
সে জবাবে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল। এই লোকটার মধ্যে কি অভিমান নামক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে? হতে পারে। ভালোবাসার সাথে তো অভিমান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” আপনে তাইলে সত্যি উপরে যাবেন না? ”
” না। ”
” তাইলে চলেন, দা কিইনা দিবেন। ”
______
জীপটা বাড়ির উঠোনেই দাঁড়িয়ে ছিল। স্বর্ণলতা উঠে বসে জিজ্ঞেস করল,
” আপনে কি জীপে কইরাই আসছেন? ”
” হ্যাঁ। এজন্যে আসতে দেরি হয়ে গেল। ”
জবাবটা দিয়ে সে স্বর্ণলতার একটা হাত ধরল। বুকের কাছে টেনে নিয়ে সুধাল,
” তোমার কি সত্যি ভালো লাগেনি? ”
মুহূর্তে স্বর্ণলতার হাত-পা শিরশির করে ওঠল। অবশ হতে লাগল বোরকায় আবৃত দেহটা। মনে পড়ে গেল রাতের সকল ঘটনা, প্রতিটা মুহূর্ত, উষ্ণ ছোঁয়াগুলো। এই হাতটা দিয়েই তো তার ওড়না খুলেছিল। ভাবনাটা মাথায় আসতে সে হাত টেনে ছাড়িয়ে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত থম মেরে গেল। স্ত্রীর দিকে তাকাতেও লজ্জা হচ্ছে। স্বামীর স্পর্শ যদি ভালো না লাগে তাহলে সংসার গড়ে উঠবে কীভাবে? ভালোবাসা তো দূর সামান্য মায়াও তৈরি হবে না। তার বাকি জীবনটাও কি কাটবে এভাবে দূরে দূরে থেকেই?
জীপটা বাড়ি থেকে বের হয়ে পাকা রাস্তা ধরল। একপাশ দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে মুনছুর সাখাওয়াত কথা বলল,
” স্বর্ণলতা, চুপ করে থেকো না। আমার স্পষ্ট জবাব চাই। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, উত্তর দিতেই হবে। ”
” উত্তর দেওয়ার জন্যই তো উপরে ডাকছিলাম, আসেন নাই কেন? এখন আর দিমু না। ”
” সত্যি? একথা আগে বলবে না? ”
সে জীপ ঘুরিয়ে নিল উল্টোপথে। বাড়িমুখো ছুটতে ছুটতে বলল,
” বাড়িতে গিয়ে শুনতে হবে? এখন বলা যায় না? ”
” না। ”
” তাহলে অন্য কথা বলো। ”
” কী? ”
” দাদিজান বলছিল, তুমি পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছাড়োনি। ঐ বাড়িটাতে থাকতে চাও না, তাই এই ওযুহাত দেখিয়ে ছেড়েছ। কথাটা কি সত্যি? ”
স্বর্ণলতা আকাশ থেকে পড়ল যেন! এই রকম কিছু সে দাদিজানকে বলেনি। ঢাকায় যে আসবে এই নিয়েও তেমন কথাবার্তা হয়নি। তাহলে আচমকা এরকম একটা মিথ্যা কথা বলল কেন? তিনি তো মিথ্যা কথা বলার মানুষ না। প্যাঁচ লাগানোরও মানুষ না। নিশ্চয় কোনো বড় কারণ আছে। এখন সে পক্ষ নিবে নাকি বিপক্ষ? স্বর্ণলতা দ্বিধায় পড়ে গিয়ে বলল,
” এই উত্তরটা কি এখনই দিতে হইবো? ”
” না। ঐটা দিলেও হবে। দুটোর মধ্যে একটা তো দিতেই হবে। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৪)
স্বর্ণলতার মনে হলো দাদিজানের সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হত। মিথ্যা বলার পেছনের স্পষ্ট কারণটা জানতে পারত। তখন বুঝা যেত এই মিথ্যাটাকে কোনদিকে চালিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এই লোকের সামনে প্রশ্নটা করবে কীভাবে? যদি বুঝে যায় তখন আরেক ঝামেলা। দাদিজানকে খুব বকবে! আড়ালে গিয়ে কথা বললেও সন্দেহ করবে। সমস্যা ঘুরেফিরে ঐ একই। সে গভীর ভাবনায় ডুবে নিজেই কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছিল। সহসা মনে পড়ল, ঐ বাড়িতে সে নয় স্বয়ং দাদিজানই থাকতে চান না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এই বাড়ির মালিক মুনছুর সাখাওয়াত না। সে অবৈধ উপায়ে মালিকানা নিয়েছে। অন্যকে ঠকিয়ে নিজে আয়েশ করার মধ্যে সুখ থাকতে পারে কিন্তু শান্তি নেই। তিনি কি তাহলে এই অশান্তি থেকে বাঁচার জন্য তার দ্বারস্থ হয়েছেন? সে আচমকা সুধাল,
” দাদিজানের শরীর কেমন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত গাড়ি চালাতে চালাতে ব্যস্ত ও দায়সারা কণ্ঠে জবাব দিল,
” ভালো। ”
” সত্যি তো? এখানে আসার আগে উনার সাথে দেখা করছিলেন? ”
” দেখা না হলে তোমার চিঠিটা পেলাম কীভাবে? স্বর্ণলতা, উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মন ভুলানোর চেষ্টা করবে না। আমি কিন্তু সেই সুযোগ দিচ্ছি না। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। ”
স্বর্ণলতাও সময় নষ্ট করল না। চট করে স্পষ্ট গলায় জানাল,
” দাদিজানের কথাটা সত্য। আমি আসলেই ঐ বাড়ি থাকতে চাই না। ”
তারা বাড়ির কাছে চলে এসেছে। গেইটটা খোলাই ছিল। মুনসুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” ঐ বাড়িটা তো আপনার না তাই। ”
সে আচমকা ব্রেক কষল! স্বর্ণলতা ধকলটা সামলাতে পারল না। সিট থেকে দেহটা ছিটকে গেল। মাথাটা এতটায় সামনে হেলে পড়ল যে, কপাল ও নাকে বাড়ি খেল। তার চাপা আর্তনাদ ও ভয়কে এই প্রথম মুনছুর সাখাওয়াত পাত্তা দিল না। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে প্রশ্নটা করল,
” ঐ বাড়ি আমার না? ”
স্বর্ণলতা ভালোই ব্যথা পেয়েছে। চোখের কোলদুটি পূর্ণ হয়ে উঠল নোনা পানিতে। দিনের আলোয় অশ্রু কণাগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠতে মুনছুর সাখাওয়াতের নজর পড়ল। জোর করেও মন সরিয়ে নিতে পারল না। স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এলো। কপালে চুম্বন করে অপরাধির সুরে বলল,
” স্যরি, আমি আসলে… অনেক ব্যথা করছে? ”
সে এই প্রশ্নের জবাব দিল না। অভিমানে বুকটা টনটন করে ওঠল। স্বামীর থেকে পাওয়া প্রথম শারীরিক আঘাতটা কি ইচ্ছাকৃত ছিল নাকি অনিচ্ছাকৃত? স্বর্ণলতা বুঝে উঠতে পারছিল না। অভিমান ও আহতের ছাপ মেশানো টলমল চোখে শুধু চেয়েই থাকে। মুনছুর সাখাওয়াত নাকটা স্পর্শ করতে যাচ্ছিল তখনই সে কথা বলল,
” ঐ বাড়িটা আপনার না, চাঁদনিবুগো। উনার আব্বারে লিইখ্যা দিতে বাধ্য করছেন। বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা দেন নাই। তাইলে আপনার হই কীভাবে? ”
সে বাড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে নিল মন্থরগতিতে। চোখের চাহনি স্ত্রীর দিকে স্থির করা। পলক পড়ছে না, কাঁপছেও না। স্নেহপূর্ণ কোমল দৃষ্টিটা মুহূর্তেই তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠল। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করল না। স্বর্ণলতা তার এই চাহনি, ভঙ্গি কোনোটাতেই বিচলিত হলো না। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
” অন্যায়ভাবে কারও বসতবাড়ি দখল কইরা থাকা ঠিক না। ঐ বাড়িটা ফেরত দিয়া দেন। ”
” অসম্ভব। ”
শব্দটা উচ্চারণ করামাত্র তার চোখের পলক পড়ল। স্ত্রীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে শুনল,
” আপনি চাইলেই সম্ভব। দিয়া দেন না! ”
স্বর্ণলতার মিনতি পূর্ণ কণ্ঠস্বরে তার দৃষ্টি ফিরে এলো আবারও। চোখের পানিগুলো নেই। শুকিয়ে গিয়েছে। ব্যথাটা কি তাহলে চলে গেছে? মুনছুর সাখাওয়াত হাত দিয়ে স্ত্রীর নিকাব খুলে ফেলল। কপালের মাঝে ও নাকের আগাটুকু টকটকে লাল দেখাচ্ছে। খানিকটা ফুলেও ওঠেছে। সেখানে স্পর্শ করতে করতে বলল,
” ঐবাড়ি ও জমিটা আগের মতো নেই, স্বর্ণলতা। আমি প্রতিদিনই কিছু না কিছু সংস্কার করে এসেছি। এসবে আমার প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। সময়ও তো নষ্ট হয়েছে, তাই না? সবচেয়ে বড় কথা ওটা আমার পরিচয়, আমার ঠিকানা। তুমি চাও আমার পরিচয়, ঠিকানা অন্য কাউকে দিয়ে দিই? ওখানে আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে! দাদিজানেরও বয়স হয়েছে, শরীরটা বেশি ভালো না। এই সময়ে তাকে নিয়ে আমি কোথায় ওঠব? ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। আপনমনে খানিক ভেবে বলল,
” তাইলে দাম পরিশোধ কইরা দেন। ”
” কাকে দিব? বাড়ির মালিকেরই তো খোঁজ নেই! ”
” খোঁজ নাই? ”
প্রশ্নটা শুনে মুনছুর সাখাওয়াত হকচকিয়ে গেল। চোখের তারা দুটি হলো চঞ্চল, অপ্রতিভ। স্বর্ণলতার বুঝতে বাকি রইল না, তার অনুমানই সঠিক। চাঁদনিবু ও মানছুরাবুর বাবা এই মানুষটার কাছেই আছে। কোন অবস্থায় আছে সেটা জানার প্রতি আগ্রহী হলেও প্রকাশ করল না। তার বিচক্ষণ চিন্তাধারা বলছে, এই মুহূর্তে এই প্রসঙ্গটা তোলা ঠিক হবে না। ঘটনার বহমান চলে যাবে ভিন্নপথে। সে চটজলদিতে বলল,
” চাঁদনিবুর খোঁজ আছে তো? উনারে দিয়া দেন। বাপের সম্পত্তি তো উনিই পাইবেন। ”
ঘাবড়ে যাওয়া বিব্রত মুখটা কঠোর হয়ে ওঠল মুহূর্তেই। সেই প্রথম দিকের মতো রুক্ষ ও কাঠিন্য ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল শুষ্ক চোখ জোড়ায়। মুনছুর সাখাওয়াত সামনের দিকে চেয়ে কাঠ স্বরে আদেশ করল,
” নামো। ”
স্বর্ণলতা অবোধের মতো প্রশ্ন করল,
” হুম? ”
” গাড়ি থেকে নামো। ”
সে নামল। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা শক্তপোক্ত গড়নের মানুষটার দিকে চাইতে শুনল,
” যে আজ অবধি স্বামীকেই গ্রহণ করতে পারেনি সে শ্বশুরবাড়িকে আপন ভাববে কীভাবে? কারণ যেটায় হোক, তুমি আমার অনুমতি ছাড়ায় ঐ বাড়ি ছেড়েছ। এর চেয়ে জঘন্যতম সত্য আর কিছুই হতে পারে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থেকে নামল না। ইঞ্জিন সচল করে একটানে বাড়ির গেইটটা পেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা হতবাক হয়ে গেল। ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে নীরবে চেয়ে থাকল অনেক্ষণ। সহসা স্মরণে এলো ইকবালের কথা। সে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ইকবালের রুমের সামনে পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়ল। এবার অপেক্ষা করতে হলো না। ইকবাল সাথে সাথে দরজা খুলে দাঁড়াল। স্বর্ণলতা অবাক হয়ে দেখল, তার এক হাত ও এক পা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ঠোঁটের একপাশ কা টা। গলায় হাতের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ভাসছে।
________
স্বর্ণলতার পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। সে খুব ভালো করেছে। শুধু ইসলাম শিক্ষা বাদে বাকি সবগুলোতেই ‘ এ প্লাস ‘ এসেছে। সে ভেবেই পাচ্ছে না, ধর্মীয় বিষয়ে কম নাম্বার পেল কীভাবে। তার যতদূর মনে পড়ে, সবচেয়ে ভালো লিখেছে এই পরীক্ষাতেই। তার মলিন মুখটা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল ইকবালের প্রশংসিত কণ্ঠস্বরে। সে বলল,
” আমি জানতাম, আপনি ভালো করবেন। কিন্তু এত ভালো করবেন বুঝতে পারিনি। আপনি কিন্তু দারুন মেধাবী ছাত্রী! মহাজনের উচিত আপনাকে এখানকার সবচেয়ে ভালো কলেজটায় ভর্তি করানো। যাতে আপনার মেধা আরও বেশি বিকশিত হতে পারে। তাহলেই তো দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আসতে পারবেন। আপা, আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী? কিছু নির্ধারণ করেছেন? এখন কিন্তু দেশের উন্নতিতে মেয়েরাও বিস্ময়কর ভূমিকা রাখছে। ”
স্বর্ণলতার এই কথাগুলো ভালো লাগছিল না। তার মন ও মস্তিষ্ক দখল করে আছে মুনছুর সাখাওয়াত। মানুষটা সেই যে গেল আর আসেনি। মাঝে একবার দাদিজানের সাথে কথা হয়েছিল। ইকবালের ফোন দিয়ে। তাতেই জানতে পারে, তার অনুমানটায় ঠিক আছে। খাইরুন নিসা চাচ্ছিলেন, এই সুযোগে বাসস্থান বৈধ করতে নাহয় ছেড়ে দিতে।
স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” উনারে কি খবরটা দিছেন? ”
” না। এখনই দিচ্ছি। ”
ইকবাল মোবাইল বের করলেও কল ঢুকাতে পারল না। পূর্বেই স্বর্ণলতা বলল,
” এভাবে না, ইকবাল ভাই। আমি উনার সামনে দাঁড়াইয়া খবরটা দিতে চাই। ”
” তাহলে তো উনাকে আসতে বলতে হবে। ”
” দরকার নাই। আমিই যামু। ”
” আপনি যাবেন? ”
স্বর্ণলতা দৃঢ়তার সাথে মাথা নাড়ে। ইকবাল খেয়াল করল, তার চোখ-মুখে উপচে পড়া আনন্দ, খুশি। এই প্রফুল্ল কণ্ঠস্বর, ঝলমলে দৃষ্টিজোড়া পরীক্ষার ফলাফলের জন্য নয় অন্য কিছু। সেটা কি মহাজন? মুহূর্তেই সে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
” এখন যাওয়া কি ঠিক হবে? আপনার ভর্তির কার্যাবলি শুরু করতে হবে যে। ”
” করুন। ”
” যদি ফিরতে না দেয়? ”
” ফিরমু না। আমি আরও আগে চইলা যাইতাম। দাদিজানের জন্য যাই নাই। দেখতাছিলাম, দূরে থাইক্যা উনার ইচ্ছাটা পূরণ করা যায় নাকি। মনে হইতাছে, দাদিজানের ইচ্ছাটা অপূর্ণই থাইকা যাইবো! উনি আমারে ছাড়া থাকতে পারবো কিন্তু বাড়ি ফেরত দিতে পারবো না। ”
শেষ কথাটা উচ্চারণের সময় তার গলাটা কেঁপে ওঠল। ইকবাল টের পেয়ে সুধাল,
” আপনি কি কাঁদছেন? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের রুমের দিকে হাঁটার প্রস্তুতি নিয়েও থেমে গিয়ে বলল,
” আপনি কিন্তু কথা দিছিলেন আমি পরীক্ষা দিলে আপনি পড়াশোনাটা করবেন। এখন কথা রাখুন। আমার কথা চিন্তা করতে হইবো না। ”
ইকবালও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। স্বর্ণলতার আনত নয়ন দুটোতে চেয়ে থেকে গাঢ় স্বরে সুধাল,
” সত্যি যাচ্ছেন? ”
” হ ”
” আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি। ”
” শুধু আমি যাইতাছি কিন্তু। আপনি এখানে থাইকা ভর্তি হোন। সাথে আমার পরিবারের একটু খোঁজ-খবর রাখেন। আব্বা আর আপার চিকিৎসা চলতাছে। আম্মা একা সামলাইতে পারবো না। সুবর্ণটাও তো ছোট। পথঘাট তেমন চিনে না। ”
” সে আমি চিনিয়ে দিব সমস্যা নেই। কিন্তু, আপা। আপনাকে আমি একা ছাড়ছি না। মহাজন জানলে খুব ক্ষ্যাপবে। আগেরবার সাথে করে এনেও ছাড় পাইনি, মরতে মরতে বেঁচেছি। এবার একা ছেড়ে দিলে জান নিতে এক মুহূর্তও ভাববেন না। ”
________
রাতের বেলা। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরল দুইদিন পরে। শরীর ও মন ভীষণ ক্লান্ত, অবসন্ন। বিষণ্ণতায় নুয়ে পড়েছে ধারাল চিবুকটা। চোখের দৃষ্টি দুর্বল ও ঘোলাটে। জীপ থেকে নামতেই মনে হলো দেহের সবটা শক্তি, উদ্যম ফুরিয়ে এসেছে। উঠোনের দীর্ঘ পথটা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে একদমই ইচ্ছে করছিল না। সে পা ঘুরিয়ে চলে গেল কাঁঠাল তলায়। ফাঁকা চেয়ারগুলোর মধ্যে একটাতে বসে পড়তেই শব্দটা কানে পৌঁছাল। চকিতে তাকাল সামনে। সাথে সাথে নজরে এলো আলতায় রাঙানো খালি পা জোড়া। বাইরের আলোতে সোনার নুপুর জোড়া সূর্যের মতো কিরণ ছড়াচ্ছে। সে আশ্চর্য হলো। নিচু দৃষ্টি জোড়া ধীরে ধীরে উপরে উঠতে বিমোহিত হলো। স্বর্ণলতা! লাল সুতি শাড়ি জড়ানো কিশোরী দেহটা বিনীত চালে এদিকে এগিয়ে আসছে। মুখটা থেকে কি স্বর্গীয় আভা বেরুচ্ছে?
স্বর্ণলতা হেঁটে এসে দাঁড়াল স্বামীর সম্মুখে। ভীষণ কোমল ও শান্ত স্বরে বলল,
” আমি খাওয়াইয়া দিমু? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের নিষ্পলক দৃষ্টি জোড়া কাঁপলেও মোহাবিষ্ট ছুটল না। মুগ্ধ ছড়ানো কণ্ঠে বলল,
” কতদিন পর তোমাকে শাড়িতে দেখলাম! ”
স্বর্ণলতা মিষ্টি হাসল। ভাত মাখতে মাখতে বলল,
” কতদিন পর? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। তার মুগ্ধ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল স্বর্ণলতার হাতে। মেয়েটা চুড়িও পরেছে? ভাত মাখার সময় কী সুন্দর শব্দ করছে!
” হাঁ করুন। ”
সে হাঁ করল না। অপলকে চেয়ে রইল স্বর্ণলতার মুখটায়। এই সাজে মেয়েটা প্রায় আসে। ভাত ধরে থাকে মুখের সামনে। তারপরে সে হাঁ করলেই উধাও হয়ে যায়। মুনছুর সাখাওয়াত ঠিক করল আজকে হাঁ করবে না। এই মুখটা মন ভরে দেখবে।
স্বর্ণলতা মুখের সামনে ভাত ধরে আছে। অপেক্ষা করতে করতে কপালের মাঝে ভাঁজ পড়ে গেল। বিরক্তে কুঁচকে গেল ভ্রূযুগল। খানিক রাগ নিয়ে বলল,
” কী হইল? হাঁ করেন না কেন? ”
” হাঁ করলেই তো চলে যাবে! ”
” কই যামু? ”
” জানি না। ”
উত্তরটা দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর হাত থেকে প্লেটটা ছিনিয়ে নিল। অন্য একটা চেয়ারে রেখে স্বর্ণলতাকে জড়িয়ে ধরল। মাথাটা পড়ল বুকের কাছে। সেখানে মুখ ডুবিয়ে রেখে বলল,
” তুমি আমাকে অবহেলা করো, অবাধ্য হও, কষ্ট দাও আমি সয়ে নিব। কিন্তু ফেলে যেও না। আমি থাকতে পারি না, স্বর্ণলতা। ”
” কেন? ভয় পান? ”
” হ্যাঁ। ”
” আপনার আম্মা কি এখনও আসে? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
সে মাথা তুলল। স্বর্ণলতার মুখের দিকে চেয়ে বলল,
” মনে হয় আমি মারা যাচ্ছি। আমি চোখ বুঁজলেই দরজার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে। স্বর্ণলতা, ওটা কি আজরাইল? আমার জান কবজ করতে আসে? ”
” ধুর! আজরাইলন হইবো কেন? মনে হয় দাদিজান দাঁড়াইয়া থাকে। আপনারে কত ভালোবাসেন! ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই জবাবের প্রতিবাদ করতে চেয়েও থেমে গেল। মনে পড়ল ভিন্ন কিছু। মুহূর্তে তার দৃষ্টি জোড়া ও মুখের ভাব হয়ে গেল অন্যরকম। সে তৎক্ষনাৎ নাক ঠেকাল স্বর্ণলতার বুকের কাছটায়। গভীরভাবে শ্বাস টানতেই তীব্র সুঘ্রাণটা পেল আবারও। মুহূর্তেই তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সেই অবস্থায় শুনতে পেল, বুকের ভেতরে অবিরত ছুটতে থাকা হৃদস্পন্দনের শব্দগুলোও। এই মেয়ে যে তার কল্পনা নয় বাস্তব এটা বুঝামাত্র যেমন বিস্মিত হলো। তেমন লজ্জায়ও পড়ল। এতক্ষণ ধরে সে কীসব বলে যাচ্ছিল? সে লজ্জা থেকে বাঁচতে বলল,
” ভাত খাব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত নিজেই ভাতের প্লেটটা স্ত্রীর হাতে ফিরিয়ে দিল। স্বর্ণলতা বিনাবাক্যে নিঃসংকোচে ভীষণ যত্নের সাথে স্বামীকে খায়িয়ে দিচ্ছে। সে খেতে খেতে ভাবছে, স্বর্ণলতা সত্যি এসেছে? পুরো বিষয়টা স্বপ্ন না তো? হয়তো ঘুমের ঘোরে দেখছে, তাই নারী শরীরের গন্ধ, হৃদস্পন্দনটাও টের পাচ্ছে। এই সময়ে স্বর্ণলতা বলল,
” আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বাইর হইছে। ”
” তাই নাকি? কবে? ”
” কালকে। ”
” কী এসেছে? এ প্লাস? ”
সে মুখে ভাত দিতে যাচ্ছিল। আচমকা থমকে গেল। অবাক কণ্ঠে সুধাল,
” আপনি জানেন? কে বলল? ইকবাল ভাই? ”
ইকবাল! তার বাস্তব ও অবাস্তবের সমস্যাটা দূর করতে পারবে একমাত্র ইকবালই। সে তখনই পকেট থেকে মোবাইল বের করল। ইকবালের নাম্বারে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে ধরতে সে ফিসফিসে সুধাল,
” তোর আপা কোথায়? ”
” আপনার বাড়িতে। ”
সে সাথে সাথে কল কেটে দিল। স্বর্ণলতা কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে টেনেধরে নিয়ে এলো নিজের রুমে। দরজায় সিটকানি তুলে জিজ্ঞেস করল,
” কখন এসেছ? ”
” কালকে। ”
” কালকে! আমাকে খবর দাওনি কেন? ”
” কল দিছিলাম। ঢুকে নাই। আপনার মোবাইল বন্ধ দেখাইতাছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একটু দমল। একটুক্ষণ নীরব থেকে পুনরায় প্রশ্ন করল,
” কেন এসেছ? আমার পরাজয় দেখতে? ”
” পরাজয়! আপনি কি যুদ্ধে গেছিলেন? ”
” নতুন করে যুদ্ধে যেতে হবে কেন? তোমাকে বিয়ে করার পর থেকেই তো যুদ্ধের ময়দানে আছি! ”
স্বর্ণলতা কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। সে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে স্বামীর মুখপানে। সহসা মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” খবরটা কে দিল? দাদিজান? ”
” কিসের খবর? ”
” চাঁদনিকে বাড়ির দাম পাঠিয়েছি যে সেই খবর। ”
” সত্যি পাঠাইছেন? ”
সে জবাব দিল না। স্বর্ণলতার সামনে থেকে সরে গেল। তোয়ালে খুঁজে নিয়ে গোসলখানাতে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” দেখা তো হয়ে গেছে। এবার যেতে পার। ”
সে কয়েক কদম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কই যামু? ”
” যেখান থেকে এসেছ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত গোসলখানার কাছ থেকে ফেরত এলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। স্বর্ণলতার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” নাও, কল করো। ”
” কারে? ”
” ইকবালকে। তোমাকে নিয়ে যাওয়া-আসা তো সেই করছে, তাই না? ”
সে জবাব দিতে পারল না। ফুঁপিয়ে ওঠল। চোখের কিনার ধরে অশ্রু ধারা নামতে লাগল নিমিষেই। মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে থতমত খেল। পরক্ষণে দিশাহারাভাবে ছুটে এলো স্ত্রীর কাছে। মুখটা স্পর্শ করতে চেয়েও করল না। নিজেকে সামলে নিয়ে সুধাল,
” কী হলো? কাঁদছ কেন? ”
স্বর্ণলতা সাথে সাথে জবাব দিল না। খানিকক্ষণ নীঃশব্দে কাঁদল। তারপরে স্বামীর বুকের কাছে মুখ গুঁজে বলল,
” আপনি আমারে তাড়াইয়া দিতাছেন। ”
” তাড়াচ্ছি না, তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছি। তুমি তো এমনটায় চাও! ”
” এখন তো চাই নাই। ”
” একটু পরেই চায়বে। ”
সে আরও ঘনিষ্ঠ হলো। স্বামীর দীর্ঘ শরীরটা দুই হাতে ঝাপটে ধরে বলল,
” না। আর কোনো সময় চামু না। আপনি যেমনে বলবেন তেমনেই চলমু। আমি ঢাকা থেইক্যা একেবারে চইলা আসছি। আপনি না চাইলে পড়ালেখাও করমু না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। কিছু মুহূর্তের জন্য কথা বলতে পারল না, কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারল না। পাথরের মতো শক্ত ও নিশ্চল হয়ে থাকল। স্বর্ণলতার কান্নার গতি কমছিল না, খুব ফুঁপাচ্ছিল। সে এতক্ষণে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল। প্রথমে মাথায় ও পরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। মুখটা বুক থেকে তুলতেই স্বর্ণলতা বলল,
” আস্তে চুমু খাবেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলল। সে মূলত চুমু খাওয়ার উদ্দেশ্যে মুখটা তুলেনি, তার মনে এই ইচ্ছেটা আসেওনি। স্বর্ণলতা এই হাসি দেখতে পেল না। তার চোখ বুঁজা, কান্নায় ভেজা সম্পূর্ণ মুখটা। এই অবস্থায় শুনতে পেল,
” আচ্ছা, তুমি বসো। আমি গোসল করে আসছি। ”
” না। আগে আদর দেন। ”
” দুই মিনিট তো দাও। আমি দুইদিন পরে বাসায় ফিরেছি! ”
” না, দিমু না। ”
এই পর্যায়ে তার মনে সন্দেহ হলো। জিজ্ঞেস করল,
” এমন করছ কেন? তোমাকে কেউ শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয়নি তো? স্বর্ণলতা, সত্যি বলো। আমি পরে জানতে পারলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। ”
” কেউ শিখাইয়া দেয় নাই। যা করছি, সব আমার ইচ্ছাতে। আপনি আদর দিতে না চাইলে না কইরা দেন। এত বাহানা…”
সে কথাটা শেষও করতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত আচমকা তার কাছে চলে এলো। গভীরভাবে চুমু খেল স্বর্ণলতার ঠোঁট জোড়ায়।
চলবে