#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৯)
মুনছুর সাখাওয়াত তৈরি ছিল তাই নিচে নেমে গেল। স্বর্ণলতার ঘুম আসছিল না, সারারাত ছটফটে মরেছে। দেহ-মন এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে ভোরবেলা গোসল করে নিয়েছিল। এখন শুধু চুল আঁচড়াল। তারপরে ঝটপটে বোরকা পরে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে আচমকা অবচেতনে চোখজোড়া চলে গেল ইকবালের রুমের দিকে। দরজাটা বন্ধ, বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। এক মুহূর্তের জন্য চঞ্চল পা’জোড়া থমকে গেল। দম আটকে ভাবতে লাগল, ছেলেটা কি পালিয়েছে নাকি কেউ টেনে-ছিঁচড়ে বের করেছে! এই ভাবনার পথে কণ্ঠটা বাজল,
” যাবে তো? ”
স্বর্ণলতা চমকে কেঁপে ওঠল। সম্পূর্ণ দেহ এতটায় দুলে ওঠল যে, মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতেও চক্ষুগোচর করে ফেলল। বিচলিত বদন ও অপ্রতিভ চাহনিটুকু ধরে ফেলামাত্র সন্দেহের বীজ রোপণ হয়ে গেল বুকের জমিনে। স্বর্ণলতার তাড়াহুড়া ভাবটাও খানিক দমে গেল যেন। উদ্যম ও আগ্রহ হারাতে লাগল একটু একটু করে। পায়ের পাতায় আলস্য এসে বসে গেল। চমক ভাব কাটিয়ে উঠলেও একপা নিচে নামতে পারল না।
মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এলো। স্ত্রীর নিকটে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কলেজে যাবে তো? ক্লাসের সময় হয়ে আসছে কিন্তু। ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। ঘাড় ফিরিয়ে আরও একবার তাকাল তালা ঝুলতে থাকা দরজাটায়। গতরাতেও মানুষটাকে জীবিত পেয়েছিল। বেশ সুস্থও। সকাল হতেই উল্টো হয়ে গেল না তো! তার প্রবল ইচ্ছে হলো স্বামীকে জিজ্ঞেস করার। বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করার চেষ্টাও করল কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঠোঁটের কাছে এসে প্রশ্নটা আটকে যেতে লাগল। এবার শুধু আটকাল না, মনে হলো এই মানুষটা সঠিক উত্তরও দিবে না। ভাবনাটায় এত আশ্চর্য হলো! একটা অন্য পুরুষের জন্য তার নিজস্ব পুরুষটার প্রতি অবিশ্বাস জন্মাচ্ছে। সে চোখ ফিরিয়ে সুধাল,
” ইকবাল ভাই যাইবো না? ”
” না। ”
” কেন? উনারও তো যাওয়ার কথা ছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। শুধু টের পেতে লাগল তার বুকটায় কিছু হচ্ছে। স্বর্ণলতার সাথে সে যাচ্ছে এতে হচ্ছে না, তার ইকবালকেও চায়! নীরবতার মাঝে বুকের জমিনে চিঁড় ধরল। সন্দেহের বীজ থেকে কুঁড়ি ফুটছে। সেই কুঁড়িতে অগণিত ধারাল ও তীক্ষ্ণ কাঁটা। যেগুলো সরাসরি ফুঁড়ছে শুধু তার নরম হৃদয়ে অথচ তীব্র ব্যথা হচ্ছে সারা শরীরে। মাথার চুল, হাতে-পায়ের পশমগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না।
স্বর্ণলতা উত্তরের অপেক্ষা করল না। পায়ের আলস্য ঝেড়ে বলল,
” দেরি হইয়া যাইতেছে, চলেন। ”
_______
মহিলা কলেজ। গেইটের ভেতরে ও বাহিরে অল্পবয়সী মেয়েদের ভিড় বেশি। মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে গেল না। জীপটা একটু দূরে দাঁড় করিয়ে গেইট পর্যন্ত হেঁটে এগিয়ে এলো। স্বর্ণলতা একা গেইটটা পার হওয়ার সময়ে পেছনে ফিরল। মানুষটা তার ফেরার অপেক্ষা করবে তো? নাকি এখনই চলে যাবে? প্রশ্নটা মাথায় আসতে তার উপলব্ধি হলো, যেদিন থেকে তার স্বামীর সঙ্গ ভালো লাগতে শুরু করেছে সেদিন থেকে মুনছুর সাখাওয়াত তার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। সেচ্ছায়, বিনা কারণে। সেই দূরত্ব কমিয়ে আনারও সময় পেল না। মনটা এত লোভী হয়ে পড়ল! শরীরেও কী একটা অসুখ হলো কে জানে! স্বামীর সঙ্গতে মন ভরে না, আরও বেশি কিছু চায়। এই চাওয়া পূরণ হতে হতেও হচ্ছে না। এই যন্ত্রণা সে কী করে সামলাবে? অসুখ সারানোর অন্য কোনো উপায় আছে কি?
_______
প্রথম ক্লাসে রেবেকা নামের এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। ক্লাশ শেষে সেই মেয়ের সাথেই কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছিল। সদ্য পরিচিত নতুন বান্ধুবীটির অনর্গল বলে চলা কথাগুলো গুরুত্ব হারাল গেইটের কাছে আসতে। স্বর্ণলতার সকল মনোযোগ পড়ল গেইটের বাইরে। নীরব সন্ধান চলতে লাগল আশপাশটায়। মানুষটা আছে তো! মুহূর্তে অস্থিরতার বাতাস এসে পড়ল দেহমনে। খেয়ালি ও শান্ত ভাবখানাও ছুটে গেল। সে রেবেকার হাতটা ছাড়িয়ে দ্রুত কদমে বাইরে চলে এলো। চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া একপাশ থেকে আরেকপাশে ঘুরেই স্থির হয়ে গেল। নিষ্কম্প ও অটল চাহনি আঠার মতো এঁটে গেল অদূরের জীপটায়। মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে বসে ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে দরজা মেলে নিচে নামল। স্বর্ণলতা এক সেকেন্ডও দেরি করল না। প্রায় দৌড়ভঙ্গিতে ছুটে গেল স্বামীর কাছে। একটা হাত ধরে বলল,
” এখনও দাঁড়াইয়া আছেন! ”
তার কণ্ঠস্বরে একইসাথে বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতা। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করল, তার বউ হাঁপাচ্ছে। ঠিকমতো শ্বাসটাও নিতে পারছে না। গলাটাও শুকিয়ে গিয়েছে বোধহয় স্বরটা কেমন শোনাল! সে উত্তর দেওয়ার বদলে পানি যোগাড়ে তৎপর হলো। জীপে সংরক্ষিত পানির বোতলগুলো থেকে একটা বোতল স্বর্ণলতার দিকে বাড়িয়ে ধরল। সেও ফেরাল না। সাথে সাথে মুখ খুলে পানি খেল কয়েক ঢোক। এই সময়ে রেবেকার আগমন ঘটল। দীর্ঘ ও চওড়া দেহের মানুষটাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করল,
” তোর ভাইয়া নাকি? ”
প্রশ্নটা করে স্বর্ণলতার হাত থেকে পানির বোতলটা প্রায় কেড়ে নিল। মুখ লাগিয়ে ঢকঢকে পানি খেতে খেতে শুনল,
” না। ”
রেবেকা পানি খাওয়ার মাঝে ভ্রূদ্বয় কুঁচকে ফেলল। সন্দেহ ভরা দৃষ্টি সরাসরি পড়ল মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটায়। বোতলটা ফিরিয়ে দিতে দিতে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” তাহলে? আব্বু? ”
এই প্রশ্নটা সে ফিসফিসে গলায় করল না। দরুন মুনছুর সাখাওয়াত স্পষ্টভাবে শুনতে পেল। সাথে এটাও বুঝে গেল, তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। স্বর্ণলতা যে উত্তরটা দিয়েছে সেটাও সে সম্পর্কীয়। একটু আগে তার স্ত্রীর খাওয়া পানি রেবেকা খেয়ে নিচ্ছিল বলে যে রাগটা তৈরি হয়েছিল সেটা নিমিষেই নিভে গেল। ভীষণ আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল স্বর্ণলতার দিকে। এই মেয়েটা অন্য কারও সামনে তাকে স্বামী হিসেবে কখনও স্বীকার করেনি। আজ করবে কি?
রেবেকা ভীষণ চঞ্চল ও অধৈর্য স্বভাবের। কথা শোনার চেয়েও বলতে বেশি ভালোবাসে। আচমকা প্রশ্ন করে যে দুটো নর-নারীকে থমকে দিয়েছে সেটা বুঝতেও পারল না। সে নিজের মতো ধরে নিয়ে বলল,
” ফেইস, বডি ফিটনেস দেখে তো বুঝাই যায় না! এই বয়সেও এত হ্যান্ডসাম! খুব ইয়াং লাগছে তো। তোর বয়সী একটা মেয়ে আছে যে, কেউ বিশ্বাস করবে না। ”
তার এই অকৃত্রিম প্রশংসনীয় বাক্য, অবিশ্বাস্য ও আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠস্বরে মুনছুর সাখাওয়াতের মুখভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারল না। সে একাগ্রভাবে চেয়ে আছে তার বউয়ের দিকে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্বীকৃতপূর্ণ উত্তরটা শোনার জন্য।
রেবেকা বান্ধুবীর পাশ থেকে সরে এসে দাঁড়াল মুনছুর সাখাওয়াতের মুখোমুখি। আরও একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,
” পাঞ্জাবিতেও যে কাউকে এত স্মার্ট লাগতে পারে আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না! ”
সে হাত উঁচিয়ে অঙ্গুলি দ্বারা নির্দেশ করতে করতে পুনরায় বলল,
” আপনার হেয়ার স্টাইলটাও কিন্তু দারুন! আর এই যে, গোঁফটা? পুরো রাজা-বাদশাদের মতো বীরত্ব প্রকাশ করছে। স্বর্ণলতা আপনার মেয়ে এটা কোনোভাবেই হজম করতে পারছি না, আংকেল! আমি তো দূর থেকে দেখেই আপনার উপরে ফিদা হয়ে গেছিলাম। তাই দৌড়ে এলাম পরিচয় নিতে। ভাবলাম, ভাই-টাই কিছু হবেন। এখন তো মনে হচ্ছে ধোঁকা খেয়ে গেলাম! ”
উল্লসিত কণ্ঠস্বরটা আফসোসে পরিণত হলো নিমিষে। আশাহত ভাবখানা মুখে ফুটে উঠতে ভীষণ দুঃখী ও ক্লেশিত দেখাল। মুনছুর সাখাওয়াতের আগ্রহ, অপেক্ষা, ধৈর্য সব এখানে এসে ফুরিয়ে গেল। ক্রোধাগ্নিতে দেহের ভেতরটা পুড়ে গেলেও বাইরে প্রকাশ পেল না এক ফোঁটাও। শুধু শক্ত করে স্বর্ণলতার হাতের কব্জি চেপে ধরে বলল,
” গাড়িতে ওঠে বসো। ”
রেবেকার কণ্ঠটা আবারও বেজে ওঠল,
” ওয়াও! জীপগাড়ি? এই ধরনের গাড়িতো এখন ঢাকাশহরে দেখায় যায় না। এই অমূল্য বস্তুটাও আপনার? ”
সে গাড়ির চারপাশে ঘুরে এসে বলল,
” আপনার ফ্যাশন সেন্স কিন্তু অসাধারণ। আংকেল, আমাকে একটু ড্রাইভ করতে দিবেন? এই সামনে থেকেই চক্কর দিয়ে আসব। আমার ড্রাইভিং স্কিল…”
মুনছুর সাখাওয়াত তাকে কথাটা শেষ করতে দিল না। ধৈর্যই হলো না, অসহণীয় হয়ে উঠেছে এই মেয়েটা ও তার কথাবার্তা। সে অতিষ্ঠ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠল,
” স্বর্ণলতা গাড়িতে বসবে নাকি আজীবন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? ”
সে ঝটপট গাড়িতে উঠে বসল। জীপটা ছুটে চলল সাথে সাথেই। কলেজের প্রাঙ্গন পার হওয়ার পর স্বর্ণলতা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
” আপনার বয়স কত? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে ফিরল। চোখ, মুখ শুকনো। অসন্তোষের গাঢ় ছাপ পড়ে আছে বদ্ধ ঠোঁট, নাকের আগায় ও সংকুচিত ভ্রূযুগলে। সে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” তোমার আব্বু হওয়ার আগের বয়সটা বলব নাকি পরের? ”
” ছি! ছি! কী বলেন এসব? আপনি আমার আব্বু হবেন কেন? আপনি তো আমার স্বামী। ”
” স্বামী হই নাকি? বিশ্বাস হচ্ছে না। ”
স্বর্ণলতা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলছিল। এবার দেহটাও ঘুরিয়ে নিল। অবাক হয়ে সুধাল,
” আল্লাহ! বিশ্বাস-অবিশ্বাস আসল কীভাবে? আপনিই তো আমারে বিয়া করছিলেন। ভুইলা গেছেন? ”
একটু থেমে কণ্ঠ নরম করে পুনরায় বলল,
” বয়স হইলে মানুষের ভুইলা যাওয়ার বাতিক দেখা দেয়। এই নিয়া মনখারাপ করার কিছু নাই। আমি তো আছি, মনে করাইয়া দিব নে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আমচকা ব্রেক কষল। হতভম্ব দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, আমি ত্রিশ পেরিয়েছি মাত্র। এখনও তাগড়া যুবকই আছি। তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, আমি আশি বছরের বুড়া। হাঁটতে-চলতে পারি না। বিছানায় শুয়ে প্রস্রাব-পায়খানা করছি। ”
তার কণ্ঠের চুড়ান্ত হতাশাটুকু স্বর্ণলতা ধরতে পারল না। সহসায় হাসি পেয়ে গেল। নীঃশব্দের মুচকি হাসি। এই হাসির মাঝে কেমন করে যেন প্রীতুলের মুখটা মনে পড়ে গেল। তার কথাগুলোও। ড. আল হাদির মতো সুদর্শন ও তরুণ স্বামী পেয়েও সে খুশি না। কেমন ঝগড়া করছিল! বুড়ো ডেকে তো মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছিল। তার জায়গায় যদি ত্রিশ পার হওয়া এই পাঞ্জাবিওয়ালাকে স্বামী হিসেবে পেত তাহলে কী করত? ভাবনাটা মাথায় আসতে তার মুচকি হাসিটা খিলখিলে পরিণত হলো।
মুনছুর সাখাওয়াতের হতভম্ব ভাবটা মুছে গিয়েও ফিরে এলো। এই মেয়ের হলোটা কী! হঠাৎ এমন শব্দ করে হাসছে কেন? এভাবে তো কখনও হাসতে দেখেনি! বিরক্ত হতে গিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
” থামো। এত সময় ধরে এভাবে হাসতে নেই। মানুষ পাগল বলবে তো! স্বর্ণলতা, আমরা বাড়িতে না রাস্তায় আছি। সবাই শুনছে কিন্তু। ”
তার এই সতর্ক বার্তাতেও কাজ হলো না। স্বর্ণলতা থামছে না কিছুতেই, হেসেই চলছে। মুনছুর সাখাওয়াত না পেরে একটানে বউয়ের নিকাব খুলে ফেলল। অতঃপর বলল,
” এবার হাসো। দেখি, কতক্ষণ হাসতে পার। ”
আবৃত মুখখানা আকস্মিক উন্মুক্ত হয়ে যাওয়াতে স্বর্ণলতা এত লজ্জা পেল! অস্বস্তিতে দেহমন কুঁকড়ে যেতে লাগল যেন! হাসি থেমে গিয়েছিল সাথে সাথে। এবার রাগ হলো, অভিমানও। আশপাশে কত মানুষ! এভাবে মুখ খুলে দিতে পারল? অথচ সে ভুল করে কারও সামনে নিকাব ছাড়া গেলে কেমন করে! রাগে দুনিয়া ধ্বংস করে দিতে চায়। স্বর্ণলতা নিজ হস্তে নিকাব তুলতে তুলতে করুণ স্বরে সুধাল,
” আপনি এমন কেন? ”
” কেমন? ”
” স্বার্থপর। আপনার যেইটায় আনন্দ হইবো শুধু সেই কাজটায় করেন। অন্য কারও আনন্দ হইবো নাকি কষ্ট হইবো চাইয়াও দেখেন না। ”
” সেই অন্য কেউ তুমি না। ”
স্বর্ণলতা এই উত্তরটা ঠিক বুঝতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে থাকলেও মুনছুর সাখাওয়াত বুঝিয়ে দিল না। সে একমনে জীপ চালিয়ে যেতে লাগল।
________
বাড়ির কাছে জীপটা ছুটে এলো। গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকা পর্যন্তও ধৈর্য হলো না। স্বর্ণলতা দূর হতে চেঁচিয়ে বলল,
” ইকবাল ভাই না? উনি গেইটের বাইরে দাঁড়াইয়া কী করতেছে? গাড়ি থামান। ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর কথাটা রাখল। জীপ থামিয়ে নিচে নামল। তার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণলতাও নামল। ইকবাল আরও দুই কদম এগিয়ে এলো। প্রথমে মহাজনের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদর্শন করল। অতঃপর চোখ সরিয়ে আনল বোরকা পরিহিতার দিকে। আঁজলা করে থাকা হাতদুটি সামনে বাড়িয়ে বলল,
” এগুলো আপনার জন্যে। ”
স্বর্ণলতা হাতের দিকে তাকাল আগ্রহ নিয়ে। তারার মতো ছোট ছোট ফুল। কী সুন্দর সুবাস ছড়াচ্ছে! মাত্রই গাছ থেকে পাড়া হয়েছে বোধ হয়। খুব তাজা ও স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সে ছুঁয়ে দেখার জন্য ভীষণ লোভী হয়ে পড়লেও হাত বাড়াল না। দৃষ্টি তুলে জিজ্ঞেস করল,
” আমার জন্যে? আমি তো এই ফুল আনতে বলি নাই। ”
” বলেননি। আমি নিজেই নিয়ে এলাম। এই পাশের বাড়িতেই গাছটা। আপনি সেদিন ওদিক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গন্ধ পেয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন কী ফুল। তাই দেখাতে নিয়ে এলাম। এগুলো বকুল ফুল। ”
সে হাতটা বাড়িয়ে থাকল। স্বর্ণলতা ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাল। মুনছুর সাখাওয়াতের চোখের রঙ ও তাকানোর ভঙ্গি স্বাভাবিক। এক ফোঁটাও রাগের চিহ্ন নেই। তাহলে কি সে ইকবালকে মাফ করে দিয়েছে? এই যে না চাইতেও সেধে ফুল দিচ্ছে এই নিয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না কেন? এই আমূল পরিবর্তনটা ঘটল কীভাবে?
স্বর্ণলতা দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকল। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রেখেও মনের ভেতরটা পড়তে ব্যর্থ হলো। অতঃপর ইকবালের দিকে ফিরে দৃঢ় স্বরে জানাল,
” এই ফুলগুলো নিতে পারতাছি না। আমি খুবই দুঃখিত। ”
তাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেইটের ভেতরে ঢুকল। সহসা পা থামিয়ে পেছনে ঘুরে বলল,
” ইকবাল ভাই? এরপর থেইকা আমি চাই নাই এমন কিছু নিয়া আসবেন না তাইলে কিন্তু আমি খুব রাগ করমু। ”
_______
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর পেছন পেছন রুমে ঢুকল। দরজা আটকাবে তখনই স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি আজকে গ্রামে ফেরত যাইবেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” এখনই যাইবেন? ”
সে সিটকানিতে হাত রেখে মুখ ফেরাল মাথাটা নাড়তে স্বর্ণলতা বলল,
” তাইলে কষ্ট কইরা উপরে আসছেন কেন? আমার আম্মার রান্না করা খাবার তো খাইবেন না! ”
” তুমি খায়িয়ে দিলে খাব। ”
” পারমু না। আমার অনেক ক্লান্ত লাগতেছে, ঘুমামু। ”
সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মিথ্যা বাহানা দেখাতে গিয়ে টের পেল, তার সত্যি ক্লান্ত লাগছে। চোখ বুঁজে আসছে ঘুমে। চোখের পাতা এক করতে করতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ নিজে এখানে থাকবো না, আমারে গ্রামে যাইতে দিবো না। ঠিকমতো আদর-সোহাগও করবো না। তাইলে এত দেখা-সাক্ষাৎের দরকারটা কী? খালি চুমা খাইয়া আর রাগ দেখাইয়া বউ পাইলা ফেলাইব? এত সহজ! ‘
স্বর্ণলতা একপাশ ফিরে হাত-পা গুটিয়ে নিল। চোখ পুরোপুরি বন্ধ করে বলল,
” যাওয়ার সময়ে দরজাটা চাপাইয়া দিয়া যাইয়েন। ”
সে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। এই ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পরে, আম্মার ডাকে। স্বর্ণলতা চোখ মেলে জিজ্ঞেস করল,
” উনি কি চইলা গেছে? ”
” হ। ”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
” এত দেরি কইরা ডাকলা কেন? নামাজের সময় তো পার হইয়া গেছে। ”
” মহাজন ডাকতে মানা করছিল। ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ উঠে বসল। আপনমনে কী সব ভাবল কতক্ষণ। তারপরে মুখটা ঢেকে নিচে নেমে গেল। ইকবাল রুমে ছিল। সে দরজা মেলে দাঁড়াতে বলল,
” উনারে একটা কল করেন তো। ”
এবার স্বর্ণলতা রুমের ভেতরে গেল না। বাইরে অপেক্ষা করল। ইকবাল কল ঢুকিয়ে মোবাইলটা এগিয়ে দিল। ওপাশ থেকে রিসিভ হলো সাথে সাথেই। স্বর্ণলতা স্বামীকে কিছু বলারও সুযোগ দিল না। নিজে বলতে লাগল,
” এই মোবাইলটা আমি নিয়া গেলাম। এখন থেইক্যা আমার কিছু প্রয়োজন হইলে সরাসরি আপনারে বলমু। আপনি পারলে দিয়া যাইবেন নাহলে ইকবাল ভাই রে দিয়া পাঠাইবেন। আমার আর আপনার মাঝে উনি ব্রিজ হইবো না, আমার আর ইকবাল ভাইয়ের মাঝে আপনি ব্রিজ হইবেন। বুঝছেন? ”
সে উত্তরেরও অপেক্ষা করল না। পূর্বেই স্বর্ণলতা জানাল,
” ইকবাল ভাইয়ের অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা কইরা দেন। এই রুমে কলিবু থাকবো। উনারে জলদি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এখন থেইক্যা ইকবাল ভাই না, কলিবুরে সঙ্গে কইরা বাইরে যামু। ”
_____
স্বর্ণলতার কল পেয়েছিল রাস্তার মাঝে। মুনছুর সাখাওয়াত তখনও বাড়ি পৌঁছায়নি। চলন্ত গাড়ি থামিয়ে স্ত্রীর বলা কথাগুলো চুপচাপ শুনছিল। প্রথমে উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায়নি, পরেরবার সুযোগ পেলেও উত্তর দেয়নি। কলটা কেটে যেতে সে ঠিক করল, বাজার থেকে দুটো বকুল ফুলের গাছ নিবে। একটা লাগাবে বাড়ির সামনে, বারান্দার কাছে অবহেলায় পড়ে থাকা বাগানে। আরেকটা লাগাবে তার রুমের পেছনে, জানালা বরাবর।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮০)
সকাল থেকে সুবর্ণ উধাও। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শবনম বেগম নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে দেখেন, সুবর্ণ রুমে নেই। স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো নির্দিষ্ট উত্তর পাননি। পুরো বাড়ি তল্লাশি করেও না পেয়ে ভাবলেন স্কুলে চলে গিয়েছে। যদিও ভাবনাটি অকল্পনীয়, বিস্মিয়কর। তবুও মনে শান্তি দিল। বাড়তি দুঃশ্চিন্তা থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য নিস্তার পেলেন। দুপুর পার হতে দুঃশ্চিন্তাটা প্রবল হয়ে ফিরল। কোনো কাজে মন বসাতে পারছেন না। অস্থির ও উচাটনে হৃদয় ফেটে পড়তে চাইছে যেন! মাথাটাও ঝিম ধরে আছে। তার ঐ একটিই ছেলে। কত আদরের!
শবনম বেগম মেয়ের রুমে ছুটে গেলেন। স্বর্ণলতা তখন ঘুমে, কলেজ থেকে ফিরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কাপড় বদলায় না, মুখে একফোঁটা পানিও দেয় না। ঘণ্টাখানেক ঘুমায়। তারপরে গোসল করে আসরের নামাজ আদায় করার পরে ইচ্ছে হলে কিছু খায়। মাঝে বিরক্ত করা মানা, কলিকে পাহারায় রাখে বিধায় সেই সুযোগও পায় না। আজকে পাহারাদারকে অগ্রাহ্য করে মেয়েকে ডাকতে বাধ্য হলেন।
মায়ের ডাকাডাকিতে স্বর্ণলতার ঘুম ছুটে গেল। ভীষণ আলস্যের সাথে পিটপিটে তাকাল। কপালদ্বয় ও ভ্রূযুগল কুঁচকে বিরক্তের সুরে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়ছে? ”
” সুবর্ণ তো এহনও বাইত ফেরে না! ”
সে হাত-পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছিল, সহসা থেমে গেল। ঘড়ির দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
” এখনও ফিরে নাই? ওর তো ছুটি হয়ছে আরও তিন ঘণ্টা আগে। স্কুলের পরেও কোথাও যাওয়ার কথা ছিল নাকি? ”
” আমি তো কইতে পারমু না! এমন কিছু কয় নাই। স্কুলে যাউনের সময় আমার লগে দেখাও করে নাই। ”
স্বর্ণলতার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল। ঐটুকু ছেলে! গায়ের রঙটা ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ হলেও মুখটা ভারি মিষ্টি! হাসলে চোখদুটি এত জীবন্ত লাগে! মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা ভালোবেসে দুটো প্রাণ বসিয়ে দিয়েছে অক্ষিকোটরে। সে মোবাইলটা খুঁজতে খুঁজতে বলল,
” স্কুল ফাঁকি দিয়া খেলতে যায় নাই তো? পেছনের মাঠটায় দেখছ? ”
” দেখছি রে, মা। সব জায়গায় দেখছি। না পাইয়াই তো ভাবছি, স্কুলে গেছে। এহন শুধু ঐইখানেই দেখা বাকি। এককাজ করি, আমি বরঙ স্কুল থেইক্যা ঘুইরা আসি। ”
কথাটা বলতে বলতে তিনি ফুঁপিয়ে ওঠলেন। ব্যস্তসমস্তে বিছানা থেকে নামলেনও। দরজার দিকে হাঁটা ধরতে স্বর্ণলতা বাঁধা দিল। আদেশের স্বরে বলল,
” আম্মা, তোমার কোথাও যাওয়া লাগবো না। বসো এখানে। ”
মাকে নিজের কাছে বসিয়ে সে মোবাইলে মনোনিবেশ করল। ডায়াললিস্টে সবার উপরে মুনছুর সাখাওয়াতের নাম্বার। কল ঢুকাল এই নাম্বারে। সেকেন্ড পেরুতেই কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” স্বর্ণলতা! কেমন আছ? ”
” ভালো না। ”
মুহূর্তে উদগ্রীবে ডুবে গেল কণ্ঠটা। জিজ্ঞেস করল,
” কেন? কী হয়েছে? ”
স্বর্ণলতা একদমে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। মুনছুর সাখাওয়াত সবটা শুনে বলল,
” চিন্তা করো না। আমি এখনই ইকবালকে স্কুলে পাঠাচ্ছি। ”
ফোন রেখে সে মায়ের দিকে তাকাল। তিনি এখনও কেঁদে চলেছেন। চোখে, মুখে দিশাহারা ভাব! দুশ্চিন্তায় মুখটা শুকিয়ে গেছে। স্বর্ণলতারও চিন্তা হচ্ছে। ভয় ও আতঙ্কে কলিজাটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কয়েকমাস হলো তারা এখানে থাকছে। এখনও পথঘাট ঠিকভাবে চেনা হয়নি। আশপাশের দুই-একজন প্রতিবেশি ছাড়া তেমন কোনো পরিচিতও নেই। এরমধ্যে ছেলেটা কোথায় চলে গেল? অপহরণকারীদের পাল্লায় পড়েনি তো? শহর এলাকায় বাচ্চা চুরির ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সুবর্ণও তেমন কোনো ঘটনা হয়ে যাবে না তো? যদিও সে এত ছোট বাচ্চা না। কৈশোর পেরুচ্ছে, হাত-পায়ে ভালোই লম্বা হয়েছে। কথাবার্তা, চিন্তাভাবনাও বড়দের মতো হচ্ছে। যে ছেলেটা তার পিছ ছাড়ত না, সেই ছেলেটা এখন তার রুমে ঢোকার পূর্বে জিজ্ঞেস করে, ‘ আপা, রুমে আছ? আমি কি ঢুকমু? ‘
মিনিট পনেরোর মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াতের কল এলো। মোবাইলটা স্বর্ণলতার হাতেই ছিল। সে কলটা ধরে জিজ্ঞেস করল,
” পাইছেন? ”
” না। স্কুলে নেই। ইকবাল টিচারদের সাথে কথা বলে জেনেছে, সুবর্ণ নাকি আজ স্কুলেই যায়নি। ”
” তাহলে কই গেছে? ”
” জানি না। বন্ধুদের সাথে কোথাও যেতে পারে, এই বয়সে ছেলেরা এমন বাঁদরামি করে থাকে। তুমি কি কাউকে চিনো? ”
” না। ”
” আচ্ছা, তুমি শান্ত হও। ইকবাল দেখছে ব্যাপারটা। শীঘ্রই খোঁজ পেয়ে যাব। ”
” যদি না পাই? আমার মন বলছে, ও বন্ধুদের সাথে যায় নাই। ”
” তাহলে আর কোথায় যাবে? ”
” জানি না। জানলে কি আপনারে কল করতাম? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের জবাবে কিছু বলল না। চুপ করে থাকল অনেক্ষণ। সহসা উত্তেজিত কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” মনে হচ্ছে, আমি জানি সুবর্ণ কোথায় গেছে। ”
” কোথায়? ”
” আগে শিওর হই? তারপরে জানাচ্ছি। ”
______
মুনছুর সাখাওয়াত যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো। সুবর্ণকে পাওয়া গেল সুয়াপুরে। বেহালাদের বাড়ির পেছনে। উঁচু দেয়াল টপকে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারছে না। তার দেহের চেয়েও ইটের দেয়ালটার উচ্চতা কয়েক ইঞ্চি বেশি। সে পায়ের আঙুলে ভর করার পরেও সমানে যেতে পারছে না!
মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে নীরবে দৃশ্যটা অবলোকন করছে। সুবর্ণ তখনও বুঝতে পারেনি। সে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু দেয়াল ভেদ করে ওপাশটা দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এখনও। সে ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হলো। কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখল, একটা পদ্মফুল পড়ে আছে। সেটা তুলে নিতে নিতে গলা ছেড়ে বলল,
” বাহ! প্রেমিকার জন্য উপহারও যোগাড় হয়ে গেছে। ”
সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। সূর্যের আলো চোখে পড়ে না। ঝাপসা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে বাড়ির পেছনের অংশটা। বাঁশগাছে ছড়াছড়ি জায়গাটায় মানুষজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। সর্বদা নিস্তব্ধ, আলো আঁধারে খেলা চলে। এমন স্থানে আচমকা পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে সুবর্ণ এতটায় চমকাল যে, পায়ের আঙুলগুলো সহ্য করতে পারল না। বল হারিয়ে বেতালে সামনে হেলে পড়ল। দেওয়ালের সাথে বাড়ি খেল নাকটা। সেই অবস্থায় ভয়ার্ত চোখে পেছন ফিরল। পুরুষ কণ্ঠের মানুষটা দেখামাত্র সকল ভয়, জড়তা গায়েব হয়ে গেল। নাকটা টনটন করে ওঠল তখনই। হাত বুলাতে বুলাতে দৃঢ় স্বরে বলল,
” উনি আমার প্রেমিকা না। ”
” তাহলে কী? ”
” আপার বান্ধুবী। ”
” আপার বান্ধুবীর সাথে দেখা করার জন্য ঢাকা থেকে ছুটে এসেছিস? সেটাও কাউকে না জানিয়ে? ”
সুবর্ণের চোখে পানি। এত ব্যথা করছে! নাকের হাড়টা ভেঙে গেল নাকি? সে অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টি জোড়া মেলে থাকল ঠিকই কিন্তু জবাব দিতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলল। সহাস্যে এগিয়ে এসে বলল,
” সালা মিয়া, আমি মনে হয় তোর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। ”
” কী দেখতে পাইলেন? ”
” আমার চেয়েও বড় পাগল সুয়াপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ”
সুবর্ণ এই কথার মর্মার্থটা ধরতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখতে সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল। বলল,
” ঐপাশে যাবি তো? আমি সাহায্য করব। বিনিময়ে কী দিবি? ”
” কী চান? ”
তার বলার ভঙ্গিটা এতটায় দাম্ভিক ছিল যে, মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হলো। পরক্ষণে ব্যঙ্গ করে বলল,
” কী চান! ভাবে তো মনে হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রের সম্রাটের সাথে লেনদেন করছি। যাইহোক, বেশিকিছু দিতে হবে না। শুধু একটা কথা দে। ”
” কী কথা? ”
” কাউকে না বলে বাড়ি থেকে উধাও হবি না। ”
” আচ্ছা। ”
প্রতিশ্রুতি পেয়ে সুবর্ণকে কাঁধে তুলে দেয়ালের উপরে বসিয়ে দিল। সে লাফ দিয়ে নিচে পড়ার পূর্বে বলল,
” আমার ফুলটা দেন, দুলাভাই। ”
______
মাগরিবের আযান পড়েছে। বেহালা নিজের রুমের জানালা বন্ধ করতে এলো। তখনই ছায়াটা নজরে পড়ল। সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল,
” কে ওখানে? ”
সুবর্ণ আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। রুমের আলোটা মুখে পড়তে বেহালা যারপরনাই বিস্মিত হলো। বিস্ফারিত কণ্ঠ থেকে ছিটকে এলো,
” সুবর্ণ! কখন এসেছ? ”
” দুপুরে। ”
” আর কে কে এসেছে? ”
” কেউ না। ”
” তুমি একা এসেছ? ”
সে মাথা নাড়তে বেহালা চুপ হয়ে গেল। খানিক্ষন ভেবে বলল,
” এবাড়িতে এসেছ যে? কোনো দরকার? ”
সুবর্ণ কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগ পেল না। পূর্বেই বেহালা দ্রুত স্বরে বলল,
” তুমি এদিকে কী করছ? বাড়ির সামনের দিকে আসো তো। আমি বের হচ্ছি। ”
বেহালা তখনই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাইরে এলো। সুবর্ণও ততক্ষণে চলে এসেছে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে সামনে আসতে সসংকোচে, লাজুক ভঙ্গিতে ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এটা আপনার জন্য। ”
বেহালা ফুলটা নিল ভীষণ আনমনে, ভাবুক চিত্তে। বাড়িতে ভাইয়া নেই। গেইটে কড়া পাহারা। সুবর্ণকে ঢুকতে দেওয়ার কোনো পোক্ত কারণই খুঁজে পেল না। তাহলে ছেলেটা ঢুকল কীভাবে? সে সন্দেহি কণ্ঠে সুধাল,
” তুমি ভেতরে ঢুকলে কীভাবে? ”
” দেয়াল টপকাইয়া। ”
” অত বড় দেয়াল তুমি একা টপকে ফেললে? ”
” না। দুলাভাই সাহায্য করছে। ”
” উনিও আসছে নাকি? ”
” হ। ঐপাশে দাঁড়াইয়া আছে। ”
বেহালার বিস্ময়ভাব দ্বিগুণ হলো। কৌতূহলীও হলো। বলল,
” তুমি দাঁড়াও, আমি উনার সাথে দেখা করে আসি। ”
তার বাড়ির পেছনে যেতে হলো না। গেইট পার হতে দেখল মানুষটাকে। মসজিদ থেকে বের হচ্ছে। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ না মুনছুর সাখাওয়াত মসজিদের প্রাঙ্গন পার হলো। তারপরে নিজে এগিয়ে গিয়ে সালাম প্রদর্শন করে বলল,
” শুনলাম, পড়াশোনার জন্য স্বর্ণাকে ঢাকা পাঠিয়েছেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে বিরক্ত হলো। অবজ্ঞা দেখিয়ে পাশ কাটতে চেয়েও পারল না। স্মরণে এলো মেয়েটা তার বউয়ের একমাত্র বান্ধুবী। বড্ড পছন্দ করে! অসম্মান করা ঠিক হবে না। জানতে পারলে কষ্ট পাবে। সে ফিরে এসে বলল,
” এতে কি তোর কোনো সমস্যা আছে? ”
” না। আমি খুশি হয়েছি। ওর খুব শখ ছিল কিনা! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। ঠোঁটের আগায় কোনো শব্দই এলো না! মনে হলো, এবার সরে পড়া যায়। কিন্তু যেতে পারল না। বেহালা বলল,
” আমার কিন্তু এটাও স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম, স্বর্ণা ওর মর্জিতে একপাও চলতে পারবে না। অথচ দেখেন, ঢাকায় চলে গেল! কীভাবে সম্ভব হলো? আপনার মধ্যে এই বদলটা আসল কী করে? ”
” আমার মধ্যে বদল আসেনি বলেই ওর মনে এত দুঃখ। সেই দুঃখ তাড়ানোর জন্যই স্বর্ণলতাকেও বদলাতে দিইনি। যাতে ভবিষ্যতে ভুল করেও বলতে না পারে, আমার জন্য ওর ভাবনার জীবনটা বদলে গেছে। ”
সে এবার সত্যি পাশ কাটল। বেহালা তার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আপনি এতটায় বদলে গিয়েছেন যে, বুঝতেও পারছেন না কোথায়, কীভাবে বদল আসছে! ‘
______
খাইরুন নিসা ঘুমানোর সময় হয়েছে। সারাদিনে একটাবারও নাতির দেখা পাননি। অথচ ময়নার মুখে শুনেছে, সে সকাল থেকে বাড়িতে। একবারের জন্যও বাড়ি যায়নি। ছেলেটার হলো কী! অসুখে পড়েনি তো? ঐরুমে তো অন্য কেউ যেতেও পারবে না। এদিকে পা চালিয়ে যে কয়েক কদম হাঁটবেন সেই সাহসটাও করতে পারেন না। শরীরটা এত দুর্বল হয়েছে যে, দাঁড়িয়ে থাকলেও হাঁটু কাঁপতে থাকে। চোখে আঁধার দেখতে পান। ময়না পানির জগটা রাখতে এসেছিল, তাকে দিয়ে নাতিকে ডেকে পাঠালেন।
মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল,
” এখনও ঘুমাওনি? ঔষধ ঠিকমতো নিচ্ছ তো? ”
” আমার কথা ছাড়। আগে বল, তোর কী হয়েছে। ”
সে দাদিজানের বিছানায় বসল। একটা হাতের একের পর এক আঙুল টানতে টানতে বলল,
” আমার আবার কী হবে? ”
” কিছু হয়নি? তাহলে কাজে যাস না কেন? শুনলাম, দিন-রাত বাড়িতেই থাকছিস। কাহিনি কী? খুলে বল তো, কিছু লুকাবি না। ”
” কাহিনি তেমন কিছু না, ব্যবসায় লস হচ্ছে। আমার নগদ টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে, এই নিয়ে একটু চিন্তায় আছি। একবছর আগেও মনে হয়েছিল, আমার যা আছে তাতেই জীবন চলে যাবে। বসে বসে খেলেও অভাব পড়বে না। এখন তো মনে হচ্ছে, এক বছরও যাবে না! ”
” এত দুরবস্থা! হঠাৎ লসে পড়লি কীভাবে? ”
” তোমার নাতবউয়ের কথা শুনে। ”
” স্বর্ণলতার কথাও শুনছিস নাকি? কী বলেছে ও? ”
” বলেছে, সে বাদে এই দুনিয়ার সব মেয়ে মানুষ আমার মা। আর সেই মায়েরাই আমার থেকে টাকা নিয়ে আয়েশ করছে। আসল দিচ্ছে না, সুদও না। এতবড় অন্যায় করেও আমার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করে অথচ আমি কিছু বলতে পারছি না। মায়েদের দিকে তো চোখ রাঙানোও পাপ, তাই না? আমার এই দুর্বলতাও গ্রামের পুরুষরা ধরে ফেলেছে। তাই এখন টাকা ধার নেওয়ার জন্য তারা না এসে তাদের বউ, বাচ্চা, মা কিংবা শাশুড়িকে পাঠাচ্ছে। ”
খাইরুন নিসা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ায় মুখের ভাব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সেই অবস্থায় সুধাল,
” তুইও তো ওদের চালাকি বুঝে গেছিস তারপরেও টাকা দিচ্ছিস কেন? ”
” না দিলে যে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়? মায়ের চোখে পানি সহ্য করা যায় বলো? সেজন্যই তো বাড়ি বসে আছি। ”
তিনি এবার সত্যি হেসে ফেললেন। নাতি যাতে দেখতে না পারে তাই মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে ফেললেন। এই প্রথম নাতির কষ্টে তার কষ্ট হচ্ছে না। উল্টো আনন্দ হচ্ছে। বহুচেষ্টায় হাসি আটকে বললেন,
” বাড়িতে বসে না থেকে নতুন ব্যবসা শুরু কর। লসের ব্যবসা আর কতদিন চালাবি? ”
স্বর্ণলতা দাদিজানের সাথে এখন অবধি দেখা করতে পারেনি। কত অনুরোধ করল, তারপরেও গ্রামে আসার অনুমতি পেল না। একবার কঠিন জেদ করেছিল, তাতেও লাভ হয়নি। উল্টো মুনছুর সাখাওয়াত হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘ তুমি যদি দাদিজানের কাছে যাও, আমি কোনোদিনও দাদিজানের মুখ দেখব না। ‘ এই কঠিন শপথের কারণটা সে আজ অবধি উদ্ধার করতে পারেনি।
দাদিজানকে দেখতে আসতে না পারলেও স্বর্ণলতা রোজই ফোনে কথা বলে। কলটা সে নিজের স্বামীর ফোনেই দেয়। আজকেও দিল। মুনছুর সাখাওয়াত নাম্বার দেখে ফোনটা বাড়িয়ে দিল দাদিজানের দিকে। তিনি ধরতে স্বর্ণলতা বলল,
” উনাকে দিন না, দাদিজান! খুব দরকার। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মোবাইল ফেরত নিল। নিজের কানে ধরে আওয়াজ দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” আপনি ঢাকা আসতেছেন না কেন? ”
” কোনো দরকার? ”
” হ। আপনারে দরকার। গতকাল রাতে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছি। সারাদিনেও ভুলতে পারি নাই। আপনারে খুব মনে পড়তেছে। আসেন না, একটু দেখা দিয়া চইলা যাইবেন, আমি আটকামু না। ”
” এখন? ”
” অনেক রাত হইয়া গেছে, না? আচ্ছা, কাল আসেন? ”
” কাল? পারব না, স্বর্ণলতা। আমার একটা কাজ আছে। ”
” তাহলে পরশু? ”
” পরশুও ব্যস্ত। ”
খাইরুন নিসা একদিকের কথা শুনছেন। তারপরেও কীভাবে যেন টের পেয়ে গেলেন! নাতির কনুইতে চিমটি কেটে ফিসফিসে বললেন,
” মিথ্যা বলিস কেন? আমি জানি, তোর কোনো কাজ নেই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই কথাটা শুনল ঠিকই কোনো জবাব দিল না। শুধু কনুইটা দাদিজানের নাগাল থেকে সরিয়ে নিল। ঐদিকে স্বর্ণলতা হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” তাহলে কবে আসবেন? ”
” দেখি, ফ্রি সময় পাই নাকি। পেলে তোমাকে জানাব। ”
কলটা কেটে গেল। মোবাইল কান থেকে সরতে খাইরুন নিসা বললেন,
” বউয়ের কথায় সাধের ব্যবসা নষ্ট করে ফেলছিস অথচ কাছে ডাকলে যাচ্ছিস না। তোর মনে চলছে কী? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দেয় না। মিটিমিটি হাসে। দাদিজানের কাছ থেকে উঠে পড়তে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাস? ”
” তোমার নাতবউয়ের কাছে। মনে হচ্ছে, তার ফিরে আসার সময় হয়েছে। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮১)
মুনছুর সাখাওয়াত ঢাকায় পৌঁছাল সকালের দিকে। এই সময়ে স্বর্ণলতা কলেজে থাকে। তার ছুটি হয় দুপুর দুইটায়। যে বাড়িতে বউ উপস্থিত নেই, সেই বাড়িতে গিয়ে কী হবে? বউয়ের ডাকে এসেছে, সরাসরি বউয়ের সাথে দেখা করবে, কথা বলবে, সুযোগ পেলে একটু আদরও করবে। পরিশেষে বলবে, ‘ অনেক হয়েছে পড়ালেখা। এবার শ্বশুরবাড়ি চলো, স্বামী নিয়ে সংসার করো। ‘
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। অতঃপর ছুটির ঘণ্টা শোনা গেল। মুনছুর সাখাওয়াত দূরে, জীপের কাছে ছিল। ছাত্রীরা বেরিয়ে আসছে দেখতে পেয়ে কিছুদূর এগিয়ে এলো। যদিও স্বর্ণলতার বাড়ি ফেরার পথ একটায়, দূর হতেও চোখে পড়বে। তবুও মন মানল না। মেয়েটাকে দেখে না অনেকদিন!
কাছে এগিয়ে থেকেও লাভ হলো না। গেইটের ভেতর ও বাহির উভয় অংশটায় ফাঁকা হতে লাগল ধীরে ধীরে। অথচ তার হৃদয়ের রানির দেখা পাচ্ছে না! সে এক জায়গায় স্থির থাকতে পারল না। একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছে। একসময়ে কলেজের মূল গেইটের কাছে পৌঁছে গেল। ক্ষণে ক্ষণে পাশ পরিবর্তন করা চঞ্চল দৃষ্টি জোড়া এবার স্থির হলো গেইটের ভেতরে। মাঠ, ইন্টারমিডিয়েটের ভবনের সিঁড়ি ও বারান্দা সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। ক্যান্টিনের বাহিরটাতেও চোখ বুলানোর সময়ে দারোয়ানের কড়া নজরদারিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” ভদ্রলোক সেজে অভদ্রের মতো আচরণ করছেন কেন? মহিলা কলেজের ভেতরে এভাবে উঁকিঝুঁকি মারা নিষেধ, জানেন না? কোনো দরকার থাকলে সরাসরি কথা বলুন নাহলে সরে পড়ুন। ”
মুনছুর সাখাওয়াতও সময় ব্যয় করল না। তর্কে না জড়িয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” ভেতরে কি কোনো ক্লাস চলছে? ”
” না। ”
” তাহলে আমার বউ বের হচ্ছে না কেন? ”
দারোয়ান প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণে সন্দেহি কণ্ঠে বলল,
” আপনার বউ এখানে পড়ে নাকি? সবাই তো বের হয়ে গেল। আপনার বউ বের হয়নি এখনও? ”
সে সবেগে মাথা নাড়তে নাড়তে জানাল,
” না। ”
” ভেতরে তো কাউকে দেখছি না। আচ্ছা, আপনি দাঁড়ান এখানে আমি একটা চক্কর দিয়ে আসি। ”
কিছুক্ষণ পরে দারোয়ান ফিরে এলো। ভারি চিন্তিত গলায় বলল,
” কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। আপনার বউ কি জানত, আপনি নিতে আসবেন? ”
” না। ”
” তাহলে হয়তো চলে গেছে। ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাননি। ”
______
জীপটা উঠোনে ঢুকল তিনটা নাগাদ। মুনছুর সাখাওয়াত ঝটপট সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল। ছোট্ট মাথায় পাহাড় সমান দুশ্চিন্তার ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, স্বর্ণলতাকে ভিড়ে হারায়নি। মেয়েটা হয়তো কলেজে যায়নি। না যাওয়ার একটা কারণও সে মনে মনে ভেবে ফেলেছে। গতকাল রাতে স্বর্ণলতা ফোনে বলছিল, একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। ভয় ভয়ও পাচ্ছিল। এই ভয় থেকেই অসুখ বাঁধিয়েছে। যেমনটা সে বাঁধাত। মুনছুর সাখাওয়াতের খারাপ স্বপ্ন ছিল, তার আম্মু। যাকে যতবার দেখেছে ততবারই অসুখে পড়েছে। দুনিয়ায় না থেকেও ঐ একটা মানুষই তার দেহমন নাড়িয়ে দিতে পারত!
প্রবল দুশ্চিন্তা, শঙ্কায় জড়িয়ে পড়ে মুনছুর সাখাওয়াত অধৈর্য হয়ে পড়ল। কলিংবেলের সুইচটা টিপে যে অপেক্ষা করবে সেই স্থির ভাবটাও নেই। সে অবিরত ও ঘন ঘন সুইচ টিপতে লাগল। মিনিটের মধ্যে দরজা খুলে দাঁড়াল স্বয়ং স্বর্ণলতা। স্বামীর মুখের দিকে এক ঝলক চেয়ে ভ্রূদ্বয় কুঁচকে ফেলল। বিরক্তিকর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বিরস গলায় বলল,
” আল্লাহ যেমন আপনাকে ধৈর্য দেয় নাই তেমন আমাকে পাখাও দেয় নাই। তাই উড়ে উড়ে আসতে পারলাম না। দুঃখিত। ”
স্ত্রীর ক্ষমাপ্রার্থনার ধরণে সে প্রথমে থতমত খেল। পরক্ষণে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কতদিন পর দেখা! অথচ ভালো করে চেয়েও দেখল না। চোখ, মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দরজা থেকে ফিরিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। স্বস্তি পায়। মুনছুর সাখাওয়াত বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর, অবজ্ঞাসূচক চাহনিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কলেজে যাওনি? ”
স্বর্ণলতা দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। ভেতরের দিকে হেঁটে যেতে যেতে জবাব দিল,
” না। ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে করছিল না। ”
সে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে চলে এসেছে। মুনছুর সাখাওয়াত পেছনে, বউকে অনুসরণ করতে করতে সেও ঢুকল। মুখটা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না বিধায় বুঝতেও পারছে না সুস্থ নাকি অসুস্থ। হাঁটাচলায় ক্লান্তি নেই, দুর্বলতা টের পাওয়া যাচ্ছে না। কণ্ঠস্বরও স্বাভাবিক, পরিষ্কার। অসুস্থতার কোনো লক্ষণই খুঁজে পেল না। তবুও মনের সন্দেহ সম্পূর্ণভাবে দূর করতে জিজ্ঞেস করল,
” ইচ্ছে করেনি বলে যাওনি নাকি অন্য কিছু? ”
স্বর্ণলতা ঝটিতে ঘুরে দাঁড়াল। বুকে হাত বেঁধে, চোখে চোখ রেখে খ্যাঁকিয়ে ওঠল,
” অন্যকিছু আবার কী? একদিন কলেজে না গিয়ে কি বিশাল অন্যায় করে ফেলেছি? সেই অন্যায়ের শাস্তি দিতে বুঝি ছুটে আসছেন? তাহলে দিন না, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ”
রুমের জানালাগুলো খোলা। দুপুরের আলো ঢুকছে সরাসরি, নির্বিঘ্নে। তারপরেও চাঁদের মতো ধবধবে আলো ছড়ানো বাল্বটা জ্বালানো। স্বর্ণলতা ফিরে দাঁড়ানো মাত্র তার মুখটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠল। ঝিলিক দিতে লাগল তার মুখের প্রতিটি সৌন্দর্য। সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোও এত ভালোভাবে চোখে পড়ছে যে মুনছুর সাখাওয়াত উপেক্ষা করতে পারল না। অপলকে নিবিড় দৃষ্টিতে দেখতে লাগল প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর আদুরে মুখখানা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নাক ও চিবুক যত ধারাল হচ্ছে মেয়েটার রূপ ততই খুলছে যেন! স্বচ্ছ ও পবিত্র চোখ জোড়ায় বুদ্ধির ছায়া পড়ছে। গায়ের রঙটাও এত উজ্জ্বল হচ্ছে যেন দিন-রাত জোসনা মেখে রাখছে! একটু একটু করে কিশোরী ছাপ হারিয়ে যাওয়া এই রূপবতীকে দেখতে দেখতে মুনছুর সাখাওয়াত উপলব্ধি করল, মানছুরাকে লিখা চিঠিটা যদি আজকে লিখত তাহলে পুরো চিঠিজুড়ে স্বর্ণলতার রূপের বর্ণনাই থাকত!
স্বর্ণলতা বেশ লম্বাও হয়েছে। এখন চাইলে অনায়াসে স্বামীর গলায় দা ধরতে পারবে। অবশ্য গলা কা টার জন্য দা’য়েরও দরকার নেই। এই রূপের ধারেই তার মরো মরো অবস্থা! স্ত্রীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ ধাঁধিয়ে এলো, গলা শুকিয়ে এলো তবুও মন ভরল না। উপরন্তু হৃদয় আকাশে উত্তাপ হাওয়া শুরু এলো। দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরা আগুন গরম কিছু এমনভাবে ছুটে চলল যে, সে ঘেমে-নেয়ে ওঠল। কপাল বেয়ে ঘামের ধারা গড়িয়ে পড়তে শুনল,
” গোসল করবেন তো? নাকি বাড়ি ঢুকে গোসল করার অভ্যাসটা ছেড়ে দিছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিল। ভীষণ ক্লান্ত সুরে বলল,
” করব। একটু জিরিয়ে নিই। ”
স্বর্ণলতা বিপরীতে কিছু বলল না। নীরবে ফ্যানের সুইচটা ছেড়ে দিল। কাঠের ওয়ারড্রব থেকে পাঞ্জাবি ও তোয়ালে বের করল। স্বামীর কোলের উপর রেখে সরে আসবে তখনই হাতটা চেপে ধরল। সে চমকে তাকাতে শুনল,
” এই শাড়ি কে দিয়েছে? আমি তো কিনে দিইনি! ”
সে ভারি আশ্চর্য হলো! একদেখায় বুঝে গেল এটা তার কেনা শাড়ি নয়? মুনছুর সাখাওয়াত বউকে ঢাকায় আনার পূর্বে ভাড়া বাসাটি সাজিয়েছিল। প্রয়োজন পড়বে এমন সকল কিছু সে মজুদ করেছে। স্বর্ণলতার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র নিজ হাতে কিনেছিল, সযত্নে গুছিয়েছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে, কতগুলো শাড়িও কিনে দিয়েছিল। তন্মধ্যে দুটো সবুজ রঙের। সেই দুটো শাড়ির মধ্যে একটাও স্বর্ণলতা পরেনি।
প্রশ্নটা করে মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বউয়ের হাতটা ধরে সামনে-পেছনে ঘুরিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” এই শাড়ি কোথায় পেয়েছ? ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ভাব কাটিয়ে উঠে জবাব দিল,
” আমি কিনেছি। ”
” তুমি মার্কেটে গেছিলে? ”
” হ ”
” কার সাথে? কবে গেছ? আমাকে তো জানাওনি! ”
একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়ে সে ঘাবড়ে গেল। বিচলিত দেখাল চোখজোড়া। এই দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটিয়েছে পরশুদিন। তার হঠাৎ করে মনে হয়েছিল, সে যে বিবাহিতা এটা বুঝা যায় না। হাতে চুড়ি নেই, নাকে ফুল নেই। তন্মধ্যে স্বামীটিও সাথে থাকে না বিধায় তার ব্যবহার্য কোনো বস্তুও নেই। এই মনে হওয়াটা তাকে এত যন্ত্রণা দিচ্ছিল যে, মা ও কলিকে নিয়ে মার্কেটে চলে যায়। চিনিয়েছে সুবর্ণ। ইকবাল তাকে পথঘাট প্রায় মুখস্থ করিয়ে ফেলেছে। কাঁধে দায়িত্ব পড়লে খুব গুরুত্ব সহকারে পালন করে, একটুও ফাঁকি দেয় না। ছেলেটার এই বিশেষ গুণে স্বর্ণলতা শুরু থেকে মুগ্ধ হয়ে আসছে।
মার্কেটে ঢুকে স্বর্ণলতা স্বামীর জন্য কতগুলো পাঞ্জাবি কিনেছে। কাপড়, নকশা, রঙ সব নিজের পছন্দমতো। এই প্রথম সে বড় মার্কেটে ঢুকেছে। নিজের খেয়াল খুশিমতো কেনাকাটা করেছে। তার এত ভালো লাগছিল যে, পরিবারের সবার জন্যই কিছু না কিছু নিচ্ছিল। কেনাকাটা শেষে বের হবে তখনই মা বলেছিল, ‘ তোর লাইগ্যা কিছু নিলি না? ‘ ব্যস! শাড়িটাও কেনা হয়ে গেল। যদিও সে শুরুতে নিজের পছন্দের রঙের শাড়ি দেখছিল কিন্তু কেনার সময় স্বামীর পছন্দের রঙের শাড়িটিই মনে ধরে গেল।
স্বর্ণলতার গোপন করার ইচ্ছে ছিল না। স্বামীকে চমকে দেওয়ার মনোবাসনা হয়েছিল, তাই আগে থেকে বলেনি। ভেবেছিল, সামনাসামনি বুঝিয়ে বলবে। সেই সময়টা হলো কোথায়? মানুষটা চমকেছে ঠিকই কিন্তু খুশি হয়নি। রাগ করছে কি? সে মুখের দিকে তাকাতে পারল না। দৃষ্টি নত হয়ে গেল আপনাআপনি। সেকেন্ডের মধ্যে বুঝে গেল, এত বড় ঘটনাটা লুকিয়ে ভুল করেছে। তাই ভুল স্বীকার করতেও সময় নিল না। আনত নয়নে সবিনয়ে পুরো কাহিনিটুকু শোনাল। অতঃপর অপরাধীর মুখ বানিয়ে অনুরোধের সুরে বলল,
” মাফ করে দেন। এরকম অন্যায় আর কখনও করব না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মাথা হেঁট করে রাখা কিশোরীর পানে। এই মেয়েটা যত দ্রুত ভুল করে তত দ্রুত মাফও চেয়ে নেয়। তবে বিস্ময়কর গুণ হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। এক ভুল দ্বিতীয়বার করে না। প্রাপ্ত ক্ষমার যথার্থ মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখে। সে এক মুহূর্ত নীরব থেকে আচমকা বলল,
” মাফ করলাম। কিন্তু যে কথাটা দিলে সেটা যেন ঠিক থাকে। ”
স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে বুঝায়, ঠিক থাকবে। কিন্তু নত দৃষ্টি উপরে উঠে না। মাথাও সোজা হয় না। মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হেসে চিবুকে হাত রাখল। মুখটা ঠেলে উপরে তুলে বলল,
” কোথাও যেতে ইচ্ছে করলে আমাকে বলবে। আমি নিয়ে যাব। ”
কথাটা বলে সে গোসলখানায় ঢুকে গেল। স্বর্ণলতা জায়গায় স্থির থেকে ভাবছে, ইচ্ছে করলেই কি যেতে পারবে? মানুষটা তো থাকে সেই কতদূরে! যখনতখন আসা সম্ভব না।
______
গোসল শেষে বেরিয়ে দেখল, স্বর্ণলতা বিছানায় খাবার সাজাচ্ছে। সে ভেজা তোয়ালে বারান্দায় নেড়ে এসে বলল,
” প্লেট একটা কেন? তুমি খাবে না? ”
” কয়টা বাজে দেখছেন? আমার খাওয়া কি এখনও বাকি আছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের সময় দেখার প্রয়োজন নেই। মনে মনে হিসেবটা ধরা আছে এখনও। তাই কথা বাড়াল না। চুপচাপ খাওয়ার আসনে বসে গেল। স্বর্ণলতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
” তুমি খায়িয়ে দিবে না? ”
” দরকার নাই। আজকে আমি রান্না করছি। নিজের হাতে খান। ”
কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকল! অজান্তেই চোখ গিয়ে পড়ল খাবার মেন্যুতে। পোলাও, গরুর মাংস ও ডিমের কোরমা করা হয়েছে। সন্দেহটা এবার ভারী হলো। এই মেয়েটা নিজের মুখে স্বীকার করেছিল, সে রান্না পারে না। স্বীকারোক্তিটা কত মাস পূর্বের ছিল? পাঁচ কী ছয় মাস?
মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” এই সব তুমি রেঁধেছ? নিজের হাতে? ”
” হ। কাটাকাটি থেকে শুরু করে সব। কেউ রান্নাঘরে ঢুকে নাই। বিশ্বাস না হলে কলিবুকে জিজ্ঞেস করেন। ”
মুহূর্তে তার চোয়ালদ্বয় হয়ে গেল। খানিক রুক্ষ গলায় বলল,
” আবার কলিকে টানছ কেন? আমি কি তোমাকে কখনও অবিশ্বাস করেছি? ”
” তাহলে এত প্রশ্ন করছেন কেন? আমি কি আপনাকে কখনও মিথ্যা বলেছি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত নরম হলো। লজ্জাও পেল। কথার প্যাঁচে ভালোই অপদস্থ হলো! মেয়েটা তো যথার্থই বলেছে। তার মনে যদি অবিশ্বাস না থাকত তাহলে প্রশ্নগুলো এলো কেন? এক কথায় মেনে নেওয়া দরকার ছিল।
স্বর্ণলতা পূর্বেই প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়েছিল। মুনছুর সাখাওয়াত প্লেটটা নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি রোজই রান্না করছ? এই ধরনের কাজ করতে নিষেধ করেছিলাম। ভুলে গেছ? ”
” রোজ রান্না করি নাই। শুধু দেখছি, আজই প্রথম রান্না করলাম। ”
সে খাবার মাখছিল। সহসা থেমে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল। এই এতক্ষণে খেয়াল করল, স্বর্ণলতা শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়ি পরেছে। চোখে কাজল টানতে ভুলেনি। মুনছুর সাখাওয়াত গলা সামনে এগিয়ে নিয়ে দেখল, আলতা রাঙা পা দুটিতে তার গড়িয়ে দেওয়া সোনার নুপুরও আছে। দেখতে এত চমৎকার লাগল যে, মনে হলো স্বর্গীয় আভা ছড়াচ্ছে! তার ইচ্ছে হলো এখনই কয়েক শত চুমু খেয়ে নিতে। কিন্তু সমুখে খাবার রেখে নামে কীভাবে? সাহসও পাচ্ছিল না। আবার তীব্র ইচ্ছেটা বিদায় করতেও অপরাগ হচ্ছিল। তাই নরম গলায় বলল,
” দাঁড়িয়ে আছ কেন? এদিকে এসো। আমার কাছে বসো। ”
স্বর্ণলতা বসল ঠিকই কিন্তু দুজনের মাঝে বিস্তর ফারাক রাখল। মুনছুর সাখাওয়াত এত বিরক্ত হলো! প্রকাশ করল না। খানিক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি জানতে আমি আজকে আসব? ”
” কীভাবে জানব? আপনি কি বলছেন? ”
” তাহলে আমার জন্যে রান্না করলে যে? ”
” আপনার জন্য রান্না করি নাই। আমি দেখছিলাম, পারি কি না। আপনি আসলেন দেখে খেতে পারছেন। ”
তার খাওয়া হচ্ছে না। শুধু মেখেই যাচ্ছে। মাখা কতদূর এগুল তাও দেখছে না। সে শুধু স্ত্রীকেই দেখছে। কতদিন পর দেখছে! একটু দেখে মন ভরে? তার মধ্যে একের পর এক ঝটকা খাচ্ছে! ঢাকায় এসেছে ছয়মাসও পেরোয়নি। এরমধ্যে কত কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে! শুদ্ধ ভাষাটাও রপ্ত করে ফেলেছে। শাড়ি পরার ধরণটাও কি আলাদা লাগছে?
স্বর্ণলতার উত্তরগুলো তার পছন্দ হচ্ছে না। সত্যি বলছে না আবার মিথ্যাও না। কৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু মুনছুর সাখাওয়াত যে ধরে ফেলেছে সেটা কি বুঝতে পারছে? আজকের দিনে কলেজে না গিয়ে সে শাড়ি পরেছে, সেজেছে, আবারও রান্নাও করেছে। এসব কিছু কি এমনি এমনি করেছে? নিজের ইচ্ছে হলো তাই? মুনছুর সাখাওয়াত বিশ্বাস করতে পারল না। সে জানে, এইসব কিছুর পেছনে আছে গভীর ভালোবাসা। অথচ মেয়েটা স্বীকার করছে না। যত সহজে নিজের ভুল, অন্যায়গুলো স্বীকার করে নেয় তত সহজে ভালোবাসা প্রকাশ করে না কেন? তার ভারি আফসোস হতে লাগল!
মুনছুর সাখাওয়াত হাত বাড়িয়ে তার প্রকৃতির রানিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
” সত্যি খেয়েছ? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না। ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। স্বামীর পাতের দিকে চেয়ে বলল,
” কখন থেকে শুধু মেখেই যাচ্ছেন? খাবেন না? ”
এবার মুনছুর সাখাওয়াতও জবাব দিল না। আচমকা বিনা বাঁধায় স্ত্রীর শাড়ির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পেট স্পর্শ করল। সামান্য চাপ প্রয়োগ করে বলল,
” খাওয়ার পরে কারও পেট এত নরম থাকে? অনেক চালাকি হয়েছে। আর না। হা করো, আজকে আমি তোমাকে খায়িয়ে দিব। ”
সে সত্যি সত্যি লোকমা বানিয়ে ফেলল। স্বর্ণলতার মুখের সামনে ধরতে শুনল,
” আমাকে আগে দিচ্ছেন কেন? দেখতে চাচ্ছেন, কিছু মিশিয়েছি নাকি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত হাতটা ফিরিয়ে নিল। প্রথম লোকমাটা নিজের মুখে ঢুকিয়ে বলল,
” বড় হচ্ছ, কত কী শিখছ কিন্তু মাথা থেকে পুরোনো গল্প ফেলছ না এখনও! ”
তাদের খাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে। স্বর্ণলতা সবকিছু গুছিয়ে সেরে উঠতে পারল না। পূর্বেই কলি জানাল, একজন ম্যাডাম এসেছে। ড্রয়িং রুমে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে চেয়ে বলল,
” আমাকে পড়াতে এসেছে, যাব? ”
” প্রাইভেট শুরু করেছ নাকি? ”
” এখনও শুরু করি নাই। আপনি বললে আজ থেকে শুরু করব। আমার কথা বলা আছে। দুই বিষয় পড়াবে। আরও একটা পড়া লাগবে। ওটা অন্য ম্যাডাম পড়াবে। এই ম্যাডামের শেষ হলে ঐ ম্যাডাম আসবে। ”
স্বর্ণলতা প্রাইভেটের বিষয়ে জানিয়েছিল। কিন্তু এত দ্রুত ম্যাডামও ঠিক করে ফেলবে বুঝতে পারেনি। মেয়েটা পড়াশোনার ব্যাপারে এত সচেতন কেন? মুনছুর সাখাওয়াত যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে, সেটায় সফল হবে তো? নাকি বাগড়া দিবে? ফোনকলে যেভাবে তাকে ডাকছিল, তার মনে হয়েছিল স্বর্ণলতা কাঁদছে। গ্রামে যাওয়ার জন্যও কত কী করেছিল! এক সময়ে সে এমনটায় তো চেয়েছিল। স্বর্ণলতা তাকে কাছে পাওয়ার জন্য পাগলামি করবে, তার রুমে ঘুমানোর জন্য কান্নাকাটি করবে। সেই ইচ্ছেটা পূরণ হয়েও কি হবে না?
স্বর্ণলতা উত্তরের অপেক্ষায় তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত এসেছে বউকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। যাওয়ার পূর্বে তার পড়াশোনা বিষয়ক এই ইচ্ছেটা না হয় পূরণ হোক। সে মাথা নেড়ে অনুমতি দিয়ে দিল।
_______
স্বর্ণলতার পড়া শেষ হলো প্রায় চার ঘণ্টা পরে। মাঝে দুইবার নামাজ পড়তে এলো ও একবার টয়লেটে গেল। এসবই মুনছুর সাখাওয়াত ধৈর্য সহিত শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। একটুও বাঁধা দেয়নি। শুধু মাঝেমধ্যে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার রূপবতী বউকে কয়েক বার দেখে এসেছে। সমস্যাটা বাঁধল এই দেখা নিয়ে। স্বর্ণলতা রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল,
” দুজনকেই পছন্দ হয়েছে? ”
” মানে? ”
” দুই ম্যাডামকেই তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে দেখলেন! ”
মুনছুর সাখাওয়াত আকাশ থেকে পড়ল যেন! বিস্ফারিত কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” আমি তোমার ম্যাডামদের দেখছিলাম? ”
” হ। আর কাকে দেখবেন? ওখানে তো অন্যকেউ ছিল না। ”
” তুমি ছিলে না? ”
” আমি উল্টো ঘুরে বসছিলাম। দরজা থেকে আমার মুখ দেখা যাচ্ছিল নাকি? আপনি উনাদেরই দেখছিলেন। ”
” স্বর্ণলতা, মিথ্যা দোষারোপ করবে না তো। আমি ওদের দেখছিলাম না। ”
” তাহলে কি নিজেকে দেখাচ্ছিলেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কথায় বের হচ্ছে না। মেয়েটা এমন উল্টাপাল্টা ভাবছে কেন? স্বর্ণলতা নিজেই বলল,
” তাই হবে। নিশ্চয় ভাবছিলেন রেবেকার মতো আমার ম্যাডামরাও দৌড়ে এসে আপনার গোঁফের প্রশংসা করবে, তাই না? আপনি এত গায়ে পড়া! ”
” রেবেকা কে? ”
” এখন রেবেকাকেও চিনতে পারছেন না? খুব অভিনয়ও শিখেছেন দেখি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বড় বড় করে সুধাল,
” আমি অভিনয় করছি? ”
” করছেনই তো। সেদিনেও করেছেন। আপনার যে আমার মতো একটা মেয়ে না, বউ আছে এটা বুঝতে দেননি। চুপচাপ বেশরমের মতো আমার সুন্দরী ক্লাসমেটের দিকে চেয়ে ছিলেন। ”
তার এতক্ষণে ঘটনাটা মনে পড়ল। কিন্তু মেয়েটার নাম যে, রেবেকা এটা কি সেদিন কেউ উল্লেখ করেছিল? করলেই কি তার বউয়ের নাম ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের নাম স্মৃতিতে রাখার প্রয়োজন নেই। মুনছুর সাখাওয়াত নিজেকে নির্দোষ করতে উঠেপড়ে লাগল,
” আমি সেদিন তোমার দিকে চেয়ে ছিলান। আমি যে তোমার বাবা না, স্বামী হই এই স্বাকীরোক্তিটা শোনার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করছিলাম। শুনতে পাইনি তো। ”
” আমার থেকে শুনতে হবে কেন? আপনি বলতে পারেননি? নাকি আপনি বললে সম্পর্ক বদলে যেত? ”
” সম্পর্ক বদলাবে কেন? ”
” তাহলে বলেননি কেন? সুন্দরী মেয়ের থেকে প্রশংসা….”
এই অযথা তর্ক, মিথ্যা দোষ সে সহ্য করতে পারল না। স্বর্ণলতার মুখ চেপে ধরে বলল,
” কী ভেবেছ? রাগিয়ে দিলে আমি বের হয়ে যাব? আজকে কোথাও যাচ্ছি না। পাঁচ মিনিট সময় দেও, তোমার সুন্দরী ক্লাসমেটের প্রশংসায় আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম তাই দেখাচ্ছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তখনই ইকবালকে কল লাগাল। সে ধরতে বলল,
” কাঁচি আর রেজার কিনে নিয়ে আয় তো। ”
” কোথায় আসব? ”
” রানিসাহেবার বাসার নিচে। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮২)
মুনছুর সাখাওয়াত নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে এসে দেখল স্বর্ণলতা নামাজে বসেছে। নামাজরত অবস্থায় স্ত্রীকে অসংখ্যবার পেয়েছে। কিন্তু সরাসরি চেয়ে দেখেনি। দৃষ্টি নত করে ফেলেছে সবসময়। আজ দৃষ্টি নামাল না। পলকও ফেলল না। আবিষ্ট চিত্তে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে এবাদতে নিমগ্ন মুখটায়। কালো বর্ণের হিজাবের মাঝে কিশোরী বদনখানা চন্দ্রপ্রভা ছড়াচ্ছে যেন! সে এই আলো ছড়ানো মুখটায় বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। আবেশে তন্দ্রার মতো চোখদুটি বুঁজে আসতে তার সমস্ত সত্তা অনুভব করল, পবিত্র বিশুদ্ধ আলোয় ডুবে থাকা এই মেয়েটি তার সহধর্মিণী। ইহজনমে ভাগ্যগুণে প্রাপ্ত সবচেয়ে কাছের ও দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী। যার আগাগোড়া, ভেতর-বাহির সবকিছুর দখল পাওয়ার একমাত্র অধিকার রাখে মুনছুর সাখাওয়াত। ভাবনাটা মস্তিষ্কে পাক খেতে তার ঠোঁটের একপাশ হেসে ওঠল। দাম্ভিক ও কুটিলতায় পূর্ণ এই হাসির দেখা পেল না স্বর্ণলতা। সে সিজদাহর জন্য ভূমি কোলে কপাল ঠেকিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত একমুহূর্তও দেরি করল না। ঘন ঘন পায়ে মহাব্যস্তের ভাব ধরে ঢুকে গেল গোসলখানার ভেতরে।
স্বর্ণলতার নামাজ শেষ হয়েছে প্রায় দশ মিনিট হলো। বিছানায় বসে থেকে এই দশ মিনিট ধরে সে গোসলখানার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটার ফিরে আসা, থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা, তারপরে গোসলখানার দরজা আটকে দেওয়া সবটায় সে টের পেয়েছিল। তাই অকারণ অস্থির হলো না। চুপচাপ, ধৈর্য নিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে ভেতরে কী চলছে। পানি পড়ার তেমন শব্দ নেই, কারও সাড়াশব্দও নেই। এত সময় নিয়ে করছেটা কী! গোসল করার কথা না। ঐ ছোট্ট রুমটায় অন্য যা করার প্রয়োজন পড়ে এত সময়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়া উচিত। স্বর্ণলতার ধৈর্য, স্থিরতা সব ফুরিয়ে এলো। সে চপলপায়ে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজায় আঘাত করল। সাথে সাথে ভেতর থেকে কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” প্রায় হয়ে এসেছে। আরেকটু সময় দাও, স্বর্ণলতা। ”
আরও সময় চাই! কুটিরের মতো ঐ ছোট্ট খোপটায় কী এমন রাজকার্য করছে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগছে? এক মগ পানি ঢালার আওয়াজও তো আসছে না। সে ভারি আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” কিসের জন্য সময় দিব? কী করছেন আপনি? দরজা খুলেন তো। ”
কণ্ঠস্বরে প্রগাঢ় সন্দেহ ও অস্থিরতা। চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেছে মসৃণ, কোমল কপালটায়। সে দুই হাতে সমানে থাপ্পড় মারতে লাগল। উচ্চস্বরে পুনরায় কিছু বলার জন্য নরম, চিকন ওষ্ঠযুগল কেঁপে আলগা হওয়া মাত্রই আচমকা দরজাটা খুলে গেল। ভেতরের মানুষটা দরজার সম্পূর্ণ অংশটায় দখল করে ফেলেছে। নিজস্ব কায়দায় দাঁড়িয়ে স্বর্ণলতার চোখে চোখ রেখে বলল,
” অভ্যাস নেই, তাই দেরি হয়ে গেল। ”
স্বর্ণলতার আলগা হওয়া ঠোঁট জোড়া এক হতে পারল না। মাঝের ফাঁকটা আরও বড় হলো স্বামীর দর্শন পেয়ে। সরল, স্বচ্ছ চোখজোড়ায় এমন চমক লেগেছে যে, সে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। চমক ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। সহসা জ্ঞান হারানোর মতো ছোট্ট কিশোরী শরীরটা দুলে উঠল। নিচে পড়ে যাওয়ার ভাব ফুটে উঠলে মুনছুর সাখাওয়াত দ্রুত একহাতে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল। ভারসাম্য সামলে নিয়ে উদগ্রীব হয়ে সুধাল,
” হঠাৎ কী হলো? ঠিক আছ? ”
স্বর্ণলতা নীমিলিত চোখদুটি মেলে রেখে বলল,
” আপনার গোঁফ…”
বাক্যটা অসম্পূর্ণ থেকে গেল নাকি সম্পূর্ণ হলো বুঝা গেল না। কিন্তু মাঝপথে এসে আওয়াজটুকু কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এই ত্রুটিপূর্ণতায় মুনছুর সাখাওয়াতের খুব একটা অসুবিধা হলো না। সে বাক্যের অর্থ ধরে ফেলে সাথে সাথে জবাব দিল,
” কেটে ফেলেছি। এতক্ষণ ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটায় করছিলাম। ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ত্বরিত নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ গোঁফ কাটতে গেলেন কেন? ওটা কী দোষ করছিল? ”
” তোমার সুন্দরী বান্ধুবীকে আকৃষ্ট করছিল। যেটাকে আমি খেয়াল না করলেও তুমি করেছ। তারপরে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছ। অথচ মূল দোষ ছিল এই গোঁফের। তাই শাস্তি দিয়ে প্রমাণ করলাম, তোমার বান্ধুবীর প্রশংসায় আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি। ”
এই কথার প্রেক্ষিতে স্বর্ণলতার কী বলা উচিত? সে তেমন কোনো উত্তরই খুঁজে পেল না। আবার চুপ করে এড়িয়েও যেতে পারল না। আবেগে আপ্লুত হয়ে একটা কথায় বলতে পারল,
” আপনি এত পাগল কেন? ”
সে জবাবে মৃদু হাসল। স্বর্ণলতা দ্বিতীয়বারের মতো দেখতে পেল উগ্র মেজাজের রুক্ষ মুখটায় হাসির উজ্জ্বল রং ছড়াচ্ছে। আগের বার গোঁফ ছিল বিধায় পরিপূর্ণভাবে দেখতে পারেনি। এবার দেখতে পাবে। কিন্তু ভাবনায় গোল খায়িয়ে দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে গাঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস টানতে অনুভব করল তার দেহে শান্তির স্রোত নামছে। স্বস্থি পাচ্ছে চিন্তা-ভাবনারা, গোপন ক্ষ্যাপাটে অনুভূতিরা। সে চোখ বুঁজে আরও একবার নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কি এখন কোনো কাজ আছে? ”
” আমার কোনো কাজ নাই কিন্তু আপনার আছে। ”
উত্তরটা দিয়ে স্বর্ণলতা স্বামীর লোমশ বুকের ওমটুকু স্বেচ্ছায় ত্যাগ করল। নিজেকে আলগা করে ছুটে গেল ওয়ারড্রবের কাছে। একটা ড্রয়ার খুলে দুইহাতে কী যেন খুঁজছে! মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। ভাবল বেচারিকে সাহায্য করবে। প্রয়োজন পড়ল না। কাছে পৌঁছানো মাত্র তার মাথায় কিছু একটা পরিয়ে দিয়ে বলল,
” মাশাআল্লাহ! মনে হচ্ছে, দাদিজানের সেই ছোট্টকালের নাতিকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছি। ”
আচমকা প্রথমবারের মতো বউয়ের থেকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রশংসা পেয়েও তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে চট করে প্রথমে হাত রাখল মাথায়। সন্দেহি চিত্তে কাপড়ের বস্তুটা খুলে আনতে দেখল, ধবধবে সাদা রঙের টুপি। কেউ সযত্নে কুশিকাটা দিয়ে বানিয়েছে। মুহূর্তে তার চোখ, মুখ কুঁচকে এলো। সেই সাথে স্মরণে এলো এই ধরণের শৈল্পিক কাজে পারদর্শী ছিল তার আম্মু। বিবাহের পর শাশুড়ির কাছ থেকে শেখা। অল্প দিনে এত পটুত্ব অর্জন করে যে, শাশুড়ির থেকে অধিক দ্রুত ও নান্দনিক নকশা বানিয়ে ফেলত। গৃহিনী জীবন থেকে বের হয়ে কর্ম জীবনে পা রাখার পরে শখের এই শৈল্পিক দক্ষতা আসতে আসতে ক্ষয়ে আসে। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়া হয়নি। অবসর সময় পেলে ছেলের জন্য কিছু না কিছু বুননের চেষ্টা করতেন। তন্মধ্যে এরকম কয়েকটা টুপি বানিয়ে দিয়েছিলেন।
মুনছুর সাখাওয়াত গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল,
” এটাও কিনেছ? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আমি বানিয়েছি। ”
” তুমি এই কাজও পার? ”
” হ। কিন্তু আর কিছু বানাতে পারি না। শুধু টুপিই পারি। দাদিজান শিখিয়েছে। ”
সে যারপরনাই বিস্মিত হয়ে সুধাল,
” কবে শিখলে? আমি তো কোনোদিন দেখলাম না! ”
” দেখলে কি শিখতে দিতেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াতকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না স্বর্ণলতা। টুপিটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুনরায় মাথায় গলিয়ে দিল। কাছ থেকে খানিকটা সরে এসে গলা ছেড়ে ডাকল,
” বর্ণ? এই বর্ণ? ওজু করতে কয় ঘণ্টা লাগাবি? ”
সুবর্ণ ওজু করে তৈরি ছিল। রুমের বাইরে ঘুরঘুর করছিল। আপার ডাক পেয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল। স্বর্ণলতা ভাইয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
” তোর দুলাভাইও নামাজ পড়বে। সঙ্গে করে নিয়ে যা। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দরজার দিকে ফিরেও তাকাল না। কপাল কুঁচকে, মুখ আঁধার করে নিজ জায়গায় অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। স্বর্ণলতা প্রথমে বিরক্ত হলো, পরক্ষণে হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে ফিসফিসে বলল,
” ছোট ভাইয়ের সামনে আমার মান রাখবেন না? আমি যে বড় গলা করে বলেছি, আপনি আমার সব ভালো কথা শুনেন! ”
তার কপালের কুঞ্চন রেখা আরও বাড়ল। থমথম মুখে কতক্ষণ চেয়ে থেকে সহসা বলল,
” এরপর থেকে গলা বড় করার আগে আমার সাথে পরামর্শ করে নিবে। ”
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময়ে একহাতে সুবর্ণের গলা চেপে ধরল। নিজের সাথে চেপে ধরে সুধাল,
” শালা মিয়ার প্রেমিকার খবর কী? সেদিন দেখা হওয়ার পরে কি আদর-টাদর কিছু করল? ”
সে ভারি বিরক্ত হয়ে নির্ভয় গলায় জবাব দিল,
” উফ! আপনারে কয়বার বলমু, উনি আমার প্রেমিকা না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত হাতের প্যাঁচ আরও শক্ত ও আঁটো করল। অতঃপর মিটিমিটি হাসতে হাসতে গ্রাম্য টানে ব্যঙ্গ সুরে বলল,
” আদর না পাইলে ব্যাডা মানুষ হুদাকামেই এমন চেইত্যা যায়! এই আর নতুন কী? আমি তো চেইত্যা চেইত্যাই যৌবন ফুরাইতাছি। ”
________
রাতে দুজনে একসাথে খেতে বসল। স্বর্ণলতা খাওয়ার মাঝে বলল,
” কলে তো বলছিলেন, খুব ব্যস্ত। আসতে পারবেন না। একরাতেই সব ব্যস্ততা শেষ? নাকি মিথ্যা বলছিলেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত খাওয়া থামিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল। এই কথাটা এতক্ষণে মনে পড়ল? নাকি ইচ্ছে করে বুদ্ধি খাটিয়ে সময়টা বেছে নিয়েছে? অপদস্ত করতে পারল আবার শক্তিশালী একটি ওজুহাতও ঝুলিতে ভরে ফেলল। জায়গামতো সঠিক সময়ে ব্যবহার করে জিতে যাওয়ার দারুন পরিকল্পনা নয় তো? সে দৃষ্টি সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ স্থির করে বলল,
” স্ত্রীর সাথে ছোটখাটো মিথ্যা বলা জায়েজ আছে। ”
” কোন সময়ে জায়েজ আছে ওটাও তো জানা উচিত। ”
মুনছুর সাখাওয়াত শুকনো ঢোক গিলল। কিন্তু গলা ভিজল না। পরপর দু’বার চেষ্টা করেও বিফল হলে বাধ্য হলো পানির গ্লাস টেনে নিতে। ঢকঢক করে খাওয়ার সময়ে বউয়ের দিকে তাকাল চোরা চোখে। সে তার দিকে চেয়ে আছে। নিষ্পলক, পর্যবেক্ষণরত দৃষ্টি। মুখভাব দারুন গম্ভীর, থমথমে। নাকের পাটা ক্রমাগত ফুলছে ও সংকুচিত হচ্ছে। ভাবসাবে মনে হচ্ছে, ভীষণ গুরুতর বিষয়ে গোপন বৈঠক হচ্ছে। রঙ্গতামাশা মূলক কথাবার্তা বলে এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না। সে আস্তে-ধীরে পানির গ্লাস রাখতে রাখতে বলল,
” তুমি বলেছ বলে আসিনি। ”
” তাহলে? ”
” আমার দরকারে এসেছি। ”
” আমার কাছেও আপনার দরকারি কাজ থাকে? কী দরকার? ”
স্বর্ণলতাকে ভীষণ কৌতূহলী দেখাচ্ছে। গম্ভীর, থমথমে ভাবখানা কিছুটা মুছে গিয়েছে। চোখের দৃষ্টির কঠোরতা, নাকের রাগ রাগ ভাবের তীব্রতাও কমে এসেছে। মুনছুর সাখাওয়াত খুশি হলেও আসল কথাটা বলবে না। সে নামাজ পড়ার সময়ে মনস্থির করেছে, কথাটা বলবে আদর-সোহাগ চলাকালীন। একমাত্র ঐ সময়ে মেয়েটা অদ্ভুত রকমের দুর্বল হয়ে পড়ে। চোখে, মুখে সে কী আকুতি-মিনতি ফুটে ওঠে! তার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ মুহূর্তে বউটাকে ঠিকমতো ধরাশায়ী করা যাবে। সহজে হয়ে গেলে ভালো নাহলে লোভ দেখাবে। লজ্জায় ডুবে থাকা গোপন, বন্য ও সুখস্পর্শণীয় আদরের লোভ। যদিও তার মনে হচ্ছে, এখন বললেও স্বর্ণলতা রাজি হয়ে যাবে। স্বামীর কাছে থাকবে বলে তো ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। সে রাখেনি। তারপরেও কি কম জেদ দেখিয়েছে? সেই জেদগুলো সামলাতে মুনছুর সাখাওয়াতকেও জেদি হতে চেয়েছে। এই যেতে পারছে না বলেই হয়তো বাধ্য হয়েছে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে। এছাড়া করবেটা কী? তবুও সে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। অনেকগুলো মাস পেরিয়েছে। মন-মতলব কোনদিকে আছে জানা নেই। যদি মুখের উপর বলে দেয়, পড়ালেখা ছেড়ে কোথাও যাবে না?
মুনছুর সাখাওয়াত অন্য প্রসঙ্গ তুলল,
” ভাবছি, অন্য একটা ব্যবসা ধরব। কিন্তু কোন ব্যবসাটা ধরব বুঝতে পারছি না। তাই ভাবলাম তোমার সাথে পরামর্শ করি। তুমি তো এই বিষয় নিয়ে পড়ছ। দেখি, কতটুকু জ্ঞান অর্জন করলে। ”
” কাঁচামালের ব্যবসা করেন। আপনার কাছে তো প্রচুর জমি। কিতাবনগরের অর্ধেকটায় দখল করে আছেন। অন্যান্য গ্রামেও আছে। পুঁজি তুলনামূলক কম লাগবে। শুধু লোকবল নিয়োগের সময়ে খেয়াল রাখবেন সৎ ও পরিশ্রমী হয় যেন। যাতায়াত ব্যবস্থাটাও উন্নত ও সহজ করতে হবে। বিলের উপরে একটা ব্রিজ করতে পারলে ভালো হয়। আপনার তো অনেক ক্ষমতা, বড় বড় লোকেরাও ভয় পায়, মাথা নুয়িয়ে রাখে। আপনি চেষ্টা করলেই সম্ভব হয়ে যাবে। ঐদিক দিয়ে ঢাকার রাস্তাটা বেশি কাছে মনে হয়, তাই না? ”
সে জবাব দিবে কী আশ্চর্য হয়ে রইল। সমস্যাটা তোলামাত্র মুখস্থ পড়ার মতো গড়গড় করে সমাধান দিয়ে দিচ্ছে। এত দ্রুত, এত গুছিয়ে বলল কীভাবে? এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় করল না তো। মুনছুর সাখাওয়াত একস্থির চেয়ে থেকে সন্দেহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি জানতে আমি এই বিষয়ে কথা বলব? ”
” না। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, আপনাকে বলব এই ব্যবসাটা ধরতে। আইডিয়াটা কয়েকদিন আগেই মাথায় আসছে। আম্মা প্রায় বলে, এদিকে নাকি সবজির দাম অনেক বেশি। দামের তুলনায় গুণগত মান খুবই খারাপ। এই নিয়ে ক্রেতাদের বিরক্তের শেষ নেই! তাদের বিরক্ত দূর হবে এমন পণ্য হাতের নাগালে এনে দিতে পারলে ব্যবসা জমে যাবে। এই নিয়ে আমি অনেক পড়াশোনা, ঘাটাঘাটি করেছি। সব খাতায় টুকেও রেখেছি। খাওয়া শেষ হলে দেখাব। আপনার ভালো লাগলে এই ব্যবসাটায় ধরবেন কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে। বিনিময়ও বলতে পারেন, এত ভালো একটা আইডিয়া দিচ্ছি দাম তো পেতেই পারি। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। মনে হলো শেষ কথাগুলো স্বর্ণলতা না, সে বলছে। পার্থক্য শুধু বিনয়ে, শব্দ প্রয়োগে। সে বিস্ময় ভাব জিয়িয়ে রেখে সুধাল,
” কী লাগবে? ”
” আমি জানি, ঐ জমিগুলো আপনি বৈধভাবে কিনেন নি। দখল করা। আপনার চাষবাসেও জ্ঞান নেই। তাই পরামর্শ থাকবে যে জমিটা ব্যবহার করবেন সেখানে চাষের মূল দায়িত্বে রাখবেন জমির মূল মালিককে। অবশ্যই বেতনে। বেতনের পরিমাণ তার যোগ্যতা অনুযায়ী ধরবেন। আমি যতদূর জানি, জমির প্রতি মালিকের আলাদা টান থাকে, দুর্বলতা থাকে। তারা খুশিমনে কাজ করবে। নিজের সবটা উজার করে দিবে। ভুল করেও তাদের এই আবেগ নষ্ট করবেন না। সুন্দর করে ঘোষণা দিবেন, বেতনের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ আপনার কাছে জমা থাকবে। জমাকৃত অর্থ যখন জমির মূল্যের সমান হবে তখন তাদের জমি দলিলসহ বুঝিয়ে দিবেন। ”
” তোমার চাওয়া কি জমি ফেরত দেওয়া? ”
” হ। ”
” যদি সব ফেরত দিই তাহলে আমার থাকল কী? স্বর্ণলতা, আমার ব্যবসার মূল বিনিয়োগই তো ওটা। ”
” নতুন করে বৈধভাবে কিনবেন। জমির বিপরীতে টাকা তো পাচ্ছেনই। প্রয়োজনে কিছু বাড়তি দিবেন। বিক্রি করলে ভালো নাহলে ইজারায় নিবেন। ইজারায়ও সম্ভব না হলে ওদের উৎপাদনে উৎসাহি করে তাদের থেকে সরাসরি পণ্য কিনবেন। অপশন অনেক আছে। শুধু লাভের পরিমাণ একটু কম-বেশি হবে এই যা। ”
মুনছুর সাখাওয়াত খানিক দমে গেল যেন। ভাবনায়ও ডুবল। স্ত্রীর পরিকল্পনা মন্দ লাগছে না। যুক্তিগুলোও ভালো দিচ্ছে। তারপরেও দ্বিধা রয়ে যাচ্ছে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সে জানে, যত সহজে পরিকল্পনা করা যায় তত সহজে বাস্তবায়ন করা যায় না। বড় বড় সমস্যা তো আছেই, মাঝেমধ্যে ক্ষুদ্র সমস্যাও ব্যবসায় লালবাতি ধরিয়ে দেয়। তারও তো ধরল! সে কি কখনও ভেবেছিল, বিয়ে করে বউয়ের কাছে ধরা খাবে?
স্বর্ণলতা আবারও জোরের সাথে বলল,
” ব্যবসায়ে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তিকেই সৎ ও পরিশ্রমী হতে হবে কিন্তু। মেধা ও শিক্ষাটাও লাগবে। তবে ব্যক্তি বিশেষে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের ভাবনা কাটল। কেন জানি বিরক্ত হয়ে ওঠল। লুকাতে পারল না। খানিক ধমকের মতো বলে ফেলল,
” বার বার এক কথা বলে কী বুঝাতে চাচ্ছ? আমি অসৎ? ”
স্বর্ণলতা মুখ বাঁকিয়ে নির্ভয়ে দ্বিধাহীন গলায় বলল,
” আমি যে সৎ হওয়ার কথা বলছি, সেটাও নন। ”
” মানে? কী বুঝাতে চাচ্ছ? ”
” পরে বুঝাই? আরও বিস্তারিতভাবে? এখন খাওয়া শেষ করেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। ভ্রদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপরে বিনাবাক্যে নীরবে খাওয়া শেষ করতে লাগল। খেতে খেতে আড়চোখে স্ত্রীকে দেখতে দেখতে ভাবছে, এই মেয়েকে সে বিয়ে করেছিল? এর বয়স ষোলো? এই মেয়ে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য মরে যাচ্ছিল? কথাবার্তা, চেহারা সুরত, শারিরীক গড়ন কিছুই মিলছে না যেন! কতদিন পরে এসেছে? একমাসও তো হয়নি। এরমধ্যে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঢাকার বাতাসে এত শক্তি? বছরও তো ঘুরল না! তার হঠাৎ করে কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। বুকের ভেতরের নরম, রক্তাক্ত, অনুভূতিপ্রবণ যন্ত্রটা হঠাৎ দুর্দমনীয়ভাবে কাঁপতে শুরু করলে সে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আর একটা রাতও তোমাকে এখানে থাকতে দিব না। প্রয়োজনে লালবাতি জ্বলা ব্যবসাটাকে নতুনভাবে সামলে নিব কিন্তু তুমি বেসামাল হয়ে গেলে আমি আরও আরও বেসামাল হয়ে যাব।
চলবে