#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৩)
খাওয়ার পালা শেষ করে স্বর্ণলতা বিছানায় উঠে বসল। তার হাতে একটি খাতা ও কলম। খাতাটিতে সে ব্যবসায়িক পরিকল্পনার সকল খুঁটিনাটি লিখে রেখেছে। বিজ্ঞ মুখে ভীষণ আগ্রহের সাথে একনাগাড়ে স্বামীকে বুঝিয়ে যাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে। ক্রমাগত দৃষ্টি বদলাচ্ছে আঁকিবুঁকি চলা খাতাটিতে ও স্ত্রীর অনবরত নড়ে চলা মুখটিতে। এত তথ্য মেয়েটি পেল কোথায়? কী সুন্দরভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবহার করেছে! ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর সমস্যার সমাধানের জন্যও একাধিক কৌশল সাজিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে না ব্যবসায় জগতে নতুন, ভুল করেও পায়ের ধূলো পড়েনি এখনও! মাঠ পর্যায়ে না গিয়ে গোটা কয়েক বই পড়ে কি এই জ্ঞানালাভ করা সম্ভব? সে আশ্চর্য ভাবটুকু লুকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” এই পুরো পরিকল্পনা তুমি একা করেছ? ঘরে বসে? বই থেকে পড়ে পড়ে? ”
” না। বইয়ের মধ্যে কি এত সবকিছু থাকে? ওখানে শুধু সাধারণ ধারণা দেওয়া আছে। ”
” তাহলে? ”
” ইকবাল ভাই সাহায্য করেছে। ”
ইকবাল! নামটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র লুকিয়ে রাখা আশ্চর্য ভাবটুকু সন্দেহের ঘনঘটায় হারিয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত স্থির থাকতে পারল না। নিশ্চুপ ভাব কাটিয়ে প্রশ্ন করল,
” ইকবালের সাথেও আলোচনা হয়েছে নাকি? আমাকে তো বলোনি! কথা হচ্ছে কোথায়? বাসায় নাকি বাইরে? ”
তার কণ্ঠস্বরের স্পষ্ট রাগ, বিদ্রুপ। স্বর্ণলতা বুঝতে পেরেও ভয় পেল না। অবিচল মুখভঙ্গিতে মৃদু হেসে জবাব দিল,
” বাইরে। ”
শব্দটা উচ্চারণ করে সে চেয়ে আছে উগ্রমূর্তির পানে। চোখজোড়া জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলে উঠে তৎক্ষনাৎ নিভে গেল। ক্রোধ সামলাতে কতটা বেগ হতে হচ্ছে বুঝতে পেরে ভারি মায়া হলো। কাঁপতে থাকা চোয়ালদ্বয়ে নরম ঈষদুষ্ণ হাতটা ছোঁয়াতে কণ্ঠটা আচমকা বেজে ওঠল,
” তোমরা বাইরে কথা বলছ? আমাকে না জানিয়ে? ”
স্বর্ণলতা ছিটকে ওঠল। হাতটা সরে এলো অজান্তেই। নিজেকে সামলানোর সময়ও পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” স্বর্ণলতা, তুমি কথা দিয়েছিলে ইকবালের সাথে সরাসরি কথা বলবে না। খুব প্রয়োজন পড়লে আমার মাধ্যমে জানাবে। সেটা কি ভুলে গেছ? ”
” ভুলিনি। শুধু আপনার স্থানে সুবর্ণকে ব্যবহার করেছি। আমার প্রশ্নগুলো লিখে ও কে দিয়ে পাঠিয়েছি। ইকবাল ভাই উত্তর খুঁজে বের করে দিয়েছে। এটুকুই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে ধীরে ধীরে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। নিঃশ্বাসের মতো হালকা হয়ে এলো তার রাগ, অভিযোগ, সন্দেহ সবকিছু। স্বর্ণলতা খেয়াল করল স্বামীর মুখের রং বদলাচ্ছে। সাথে সাথে বাকি কথাটুকু উতরে দিল,
” আপনার মাধ্যমেও উত্তর আনা যেত কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। আমি জানি, সুদের ব্যবসা ছাড়া আপনার অন্য কোনো ব্যবসায় আগ্রহ নেই। আমাকে শুরুতেই থামিয়ে দিতেন। ”
” এখন আগ্রহ জাগাতে পারলে? ”
” আমার নতুন করে আগ্রহ জাগানোর দরকার নেই। আপনি সঙ্গে করে নিয়েই আসছেন। আমি শুধু সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছি। ”
” তাই নাকি! মনে হচ্ছে, সিদ্ধান্ত কোনদিকে যাবে ওটাও বুঝে গেছ? ”
স্বর্ণলতা জবাবে হাসল। মুনছুর সাখাওয়াত মুগ্ধ হতে পারল না। কেমন যেন দ্বিধায় পড়ে গেল। মেয়েটার আত্মবিশ্বাস এত প্রখর লাগছে কেন? তাহলে কি সত্যি বুঝে গিয়েছে, সে কোন সিদ্ধান্তটা নিবে! স্বর্ণলতা হাসি থামিয়ে বলল,
” কাঁচামালের ব্যবসাটা আপনি একা হাতে সামলাতে পারবেন না। আপনার একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী লাগবে। যে ঢাকা কিংবা গ্রামের দিকটা সামলাবে। এই সঙ্গী হিসেবে ইকবাল ভাইকে নিতে পারেন। উনার পড়ালেখায় একদমই মনোযোগ নেই। কলেজ যায় না, ঠিকমতো পড়াশোনাও করে না। সুযোগ পেলে গ্রামে দৌড় দেয়। আপনার ভয়ে এখনও ছাত্রজীবনে নামটা রেখেছে। ”
” অনেককিছু জানো দেখছি! ”
বক্রোক্তিটা প্রকাশ করে মুনছুর সাখাওয়াত স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঠোঁটের উপরে হাত বুলাল। ঘন, রুক্ষ চুলের গোছার স্পর্শ না পেয়ে চমকে ওঠল। যুগ যুগ ধরে লালিত বাদশাহী গোঁফটা যে কিছু ঘণ্টা আগে কেটে ফেলেছে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। মনে পড়তে চমকানো ভাবটা কাটিয়ে ওঠল। স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ টের পেয়ে গেল, তার এই জানার বিষয় মানুষটার পছন্দ হচ্ছে না। তাই দ্রুত নিজেকে দোষমুক্ত করতে বলল,
” আমি সেধে জানি নাই। সুবর্ণ জানাইছে। ”
” আর কী জানিয়েছে? ”
” ইকবাল ভাই গ্রাম থেকে অসংখ্য পাখি আর বিড়ালের বাচ্চা আনছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সেগুলোর লালনপালন করছে। ”
এই পর্যায়ে মুনছুর সাখাওয়াতের কপালের মাঝে শীর্ণ ভাঁজ পড়ল। মুহূর্তে চিন্তিত হয়ে ওঠল মুখখানি। পশুপাখির প্রতি ছেলেটার যত্ন, মায়া স্বচক্ষে দেখেছে অসংখ্যবার। স্বর্ণলতা খানিক সামনে এগিয়ে এলো। স্বামীর ভাঁজ করে ফেলে রাখা হাঁটুর উপরে একটা হাত রেখে বলল,
” আমার মন বলছে, ইকবাল ভাই পড়াশোনা করে ভালো কিছু করতে পারবেন না। ইচ্ছাও নাই। উনাকে আপনার ব্যবসায় নেন। ঠকবেন না। উনিও তো ব্যবসায় শাখায় পড়ছে। মাথা ভালো, পরিশ্রমও করতে পারে। দেখবেন, আপনারই লাভ হবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” বয়স কম। তুমি যে স্থানে ভাবছ, ওটা সামলাতে পারবে না। ”
” যখন পারবে তখনই দিবেন। আপাতত আপনার সঙ্গে রাখেন। তাহলে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলবে। তারপরে নাহয় সুযোগ, সময় বুঝে গ্রামের দিকের দায়িত্বটা উনাকে বুঝিয়ে দিবেন। ”
” ইকবালকে গ্রামে পাঠালে এদিকটা কে দেখবে? ”
” আপনি। ”
এক শব্দের উত্তরটা দিয়ে সে একগাল হাসল। স্বামীর দিকে আরও একটু চেপে বসে আহ্লাদিত কণ্ঠে বলল,
” তখন কিন্তু দাদিজানকেও নিয়ে আসবেন। আমরা সবাই একসাথে ঢাকা থাকব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ময়ে থ বনে গেল। এই দীর্ঘ ব্যবসায়িক আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাকে ঢাকায় টেনে আনা? যাকে সে আজ, এই অন্ধকার রাতে ঢাকা থেকে চিরতরে নিয়ে যাওয়ার শুভক্ষণের অপেক্ষায় আছে, সেই মেয়ে উল্টো তাকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সুকৌশলে ভবিষ্যৎ ইচ্ছের কথাও জানিয়ে দিল অথচ সে এখনকার ইচ্ছের কথা জানাতে পারছে না। এই হার, পিছিয়ে পড়াটুকু সে মানতে পারল না। নিজের এঁটে রাখা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হতে দেখল, স্বর্ণলতার পরনে দুপুরের পরা শাড়িটি নেই। মুখের সাজ, হাতের চুড়ি এমনকি পায়ের নুপুর জোড়াও খুলে ফেলেছে। সে আরেক দফা আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” শাড়ি বদলেছ কখন? ”
” খাওয়া শেষ করেই তো বদলালাম। দেখেন নাই? ”
” আমার সামনে বদলেছ? ”
” না। ”
” তাহলে দেখব কীভাবে? ”
স্বর্ণলতা থতমত খেল যেন! পরক্ষণে নিজেকে সামলে বিরক্ত গলায় বলল,
” আমি বদলানোর সময়ের কথা বলি নাই। তারপরে…”
তাকে কথা শেষ করতে দিল না। পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত দ্রুত গলায় বলল,
” বদলেছ কেন? আমার থেকে অনুমতি নিয়েছ? ”
স্বামীর এই হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে দেওয়া, একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে যাওয়াকে স্বর্ণলতা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছিল না। চমকে চমকে ওঠছিল। শেষটায় একেবারে ভয় পায়িয়ে দিল যেন! ফ্যাকাশে বদনে দৃষ্টি নত করে জানাল,
” না। সুতির শাড়ি ছিল না তো ভাবলাম, ঘুমে অস্বস্থি হবে তাই….”
অপরাধি কণ্ঠের উচ্চারিত বাক্যটা সম্পূর্ণ হলো না। নিজ উদ্যোগে মাঝপথে থামিয়ে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত নিজের ঠাঁট বজায় রেখে আদেশের মতো বলল,
” যাও, শাড়িটা পরে এসো। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। আদেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখনই। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি আনতে চলে গেল। এই সময়ে মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো কাঠের নকশাযুক্ত আলমারিটায়। প্রথম ড্রয়ারের এককোণে দুটো রাতের পোশাক রাখা আছে। স্যাটিন কাপড়ের ভীষণ আরামদায়ক। সে নিজ হাতে কিনেছিল, সযত্নে ভাঁজ করে রেখেছিলও। স্বর্ণলতা কি দেখেনি? নাকি ইচ্ছে করে পরেনি?
স্বর্ণলতা শাড়ি হাতে গোসলখানার দিকে এগুচ্ছিল সহসা শুনতে পেল,
” কোথায় যাচ্ছ? ”
সে হাতের ইশারায় জায়গাটা দেখাতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” কোথাও যেতে হবে না। এখানে পরো। ”
” আপনার সামনে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুখে জবাব দিল না। ভ্রূজোড়া কুঁচকে ফেলতে স্বর্ণলতা দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। ভীতমুখে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। গলার ওড়না দিয়ে আয়নাটা ঢেকে ফেলল। টুলটা খানিক কাছে টেনে এনে রাখল শাড়িটা। বিরক্তমাখা চোখের দিকে দাঁড়াল পিঠ দেখিয়ে। জামা খোলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। পেছনের চেইন খুলবে তখনই কণ্ঠটা বাজল,
” দরকার নেই। আলো নিভিয়ে বিছানায় এসো। ”
স্বর্ণলতা রুদ্ধশ্বাসটা ছাড়ল। স্বামীকে কাছে চায়, নিজের সবটা সমর্পণও করতে চাই কিন্তু এভাবে না। আরেকটু হলেই সে কেঁদে ফেলেছিল! চোখে জমে থাকা অশ্রুটুকু মুছল রুমের আলো নেভানোর পরে। গোপনে, সন্তর্পণে।
_______
স্বর্ণলতা বিছানায় শুয়ে বলল,
” আপনাকে না বলে শাড়ি খোলা ঠিক হয় নাই। মাফ করে দেন। আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি। এরকম ভুল আর কখনও হবে না। ”
পাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। সে শুয়েছিল চিৎ হয়ে। এবার ডানপাশে ফিরল। সাথে সাথে চমকে ওঠল। মানুষটা তার দিকে ফিরে আছে। ডিম লাইটের নীল আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে। হাতের উপরে মাথা রেখে একস্থির চেয়ে আছে স্বর্ণলতার পানেই। সে চমকানো ভাবটা সামলে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি রাগ করেছেন? ”
এতক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াতের ঠোঁটদুটো নড়ল। কণ্ঠনালির জ্যাম মুক্ত করে হালকা স্বরে জানাল,
” না। ”
” তাহলে শাড়ি পরতে মানা করলেন কেন? ”
তার উত্তরটা জানা কিন্তু দিল না। কী করে বলবে, ঐ মুহূর্তে স্বর্ণলতাকে মানছুরা মনে হয়েছিল। ঐ মেয়েটা তো এভাবে তার সামনে কাপড় খুলত!
স্বর্ণলতা প্রবল আগ্রহ নিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছিল। এই নিশ্চুপতা, প্রতিক্রিয়াহীন শুধু গভীর শ্বাস ফেলার শব্দটাকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। নীরবতা ঠেলে অধৈর্য গলায় বলে ওঠল,
” উত্তর কমন পড়েনি? বানাচ্ছেন? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” ভাবছি, যে কাপড়টা একটু পরে তোমার শরীরে থাকবেই না সেটা নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিকে হাত বাড়াতে সে ছিটকে দূরে সরে গেল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চাপা গলায় শাসাল,
” ছুঁবেন না। ”
সে স্বর্ণলতাকে জোর করে স্পর্শ করল না, হাত ফিরিয়েও আনল না। গভীর হতাশায় পতিত হয়ে সুধাল,
” কেন? ”
” আপনি ঠিকমতো আদর করতে পারেন না। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের হতাশা এবার আশ্চর্যে রূপান্তর হলো। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থাকে পিঠ দেখিয়ে রাখা মেয়েটির দিকে। একটু আগে যে ইঙ্গিতটা দিল, সে কি বুঝেনি? এর চেয়েও পরিষ্কার ভাষায় বলবে? মনে মনে পরিষ্কার ভাষাটা খুঁজতে খুঁজতে বলল,
” স্বর্ণলতা, তুমি ভুল বুঝছ। ”
” তাহলে সত্যিটা বুঝান। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কয়েক ইঞ্চি উপরে থামিয়ে রাখা হাতটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল কিশোরীর কটিদেশে। অবাধ বিচরণ করতে করতে মুখটা নিয়ে গেল কানের কাছে। ফিসফিস গলায় বলল,
” তোমার সাথে একেবারে মিশে যেতে চাচ্ছিলাম না। একবার যদি মিশে যাই গো, বউ তাহলে নিজেকে আর কখনও আলাদা করতে পারব না। ”
” তাহলে চুমু খেতে আসেন কেন? আমাকে ধরবেনও না। ছাড়েন। ”
সে ছাড়ল না। আরও গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরল। উষ্ণ চুম্বনের বর্ষণ নামিয়ে দিল। মিশে যেতে যেতে তো মেয়েটিকে রাজি করাতে হবে! এরজন্যে এটুকু জোর, কর্তৃত্ব প্রয়োগ করা অতি জরুরি।
আদরের সমুদ্রে স্বর্ণলতার রাগ, জেদ, অভিমান ডুবে মরেছে। প্রতিবাদের বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকুও যখন ফুরিয়ে এলো তখনই মুনছুর সাখাওয়াত নিজেকে সামলাল। গাঢ়স্বরে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
তৎক্ষনাৎ কোনো উত্তর এলো না। প্রায় সেকেন্ড দুই পরে মৃদু আওয়াজটা ভেসে এলো,
” হুম? ”
” আমাকে ভালোবাস? ”
” হুম। ”
” প্রমাণ কর। ”
স্বর্ণলতার খিঁচে বন্ধ করে রাখা চোখের কপাট দুটো খুলে গেল ঝটিতে। বিস্ময়পূর্ণ চাহনি। ঘন ঘন শ্বাস ফেলা মুখটা থেকে বুলেটের মতো শব্দটা বের হলো,
” আবার? ”
” হ্যাঁ। এবার আগের চেয়েও দ্বিগুণ কঠিন পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তোমার খুব কষ্ট হবে। মনে হয় পারবে না। ”
সে উত্তরটা দেওয়ার পূর্বে কয়েক মুহূর্ত নীরব চেয়ে থাকল। সহসা বলল,
” আপনি যদি আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারেন তাহলে পারব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কথার ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীর কণ্ঠপাশ উষ্ণ স্পর্শে ভরিয়ে দিচ্ছিল। শ্বাসের টানে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দেওয়া বক্ষ বিভাজনের ক্ষীণ আভাসটুকুতে সবে ঠোঁট ছুঁয়াবে তখনই স্বর্ণলতার উত্তরটা কানে প্রবেশ করে। তড়াক করে মাথা উঠে গেল। স্ত্রীর কথার প্যাঁচে যে আবারও আটকে গেছে বুঝামাত্র তার উষ্ণ চাহিদা হারিয়ে গেল। দেহমন সবই শান্ত হয়ে এলো ধীরে ধীরে। স্বর্ণলতা খেয়াল করে ভারি অভিমানি গলায় বলল,
” দেখেছেন? আমি কিছু ভুল বুঝিনি! ”
মুনছুর সাখাওয়াত দোষ খণ্ডণ করতে বলল,
” আমার শরীর খারাপ লাগছে। পানি খাওয়াতে পারবে? ”
মুহূর্তে স্বর্ণলতার অভিমান ঢাকা পড়ে গেল প্রবল দুশ্চিন্তায়। স্বামীর পীড়িত মুখটা দুই হাতে আগলে ব্যাকুল স্বরে বলল,
” পারব। এখনই দিচ্ছি। ”
সে স্বামীর বাঁধন থেকে ছুটল নিজ দায়িত্বে। বিছানা থেকে উঠে বসতে দেখল, বেড সাইড টেবিলে পানি নেই। খাওয়ার সময়ে পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঘুমানোর প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল না। ভেবেছিল, ঘুমানোর আগে এনে রাখবে। এখন খালি জগ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিতে গিয়েও পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত হাত ধরে আটকাল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি পেছনে রাখতে সে উঠে বসল। স্বর্ণলতার জামার পেছনের চেইনটা একটানে আটকে দিয়ে বলল,
” যাও। ”
রাতে মুনছুর সাখাওয়াত একফোঁটাও ঘুমায়নি। শুধু এপাশ-ওপাশ করেছে। কখনও স্ত্রীকে গভীরভাবে জড়িয়ে রেখেছে, কখনও ছেড়ে দিয়েছে। স্বর্ণলতা প্রথমে খারাপ লাগার কারণ উদ্ধারের চেষ্টা করেছে, পারেনি। মানুষটা পরিষ্কার করে কিছু বলেনি, শরীরেও অসুস্থতার তেমন কোনো লক্ষণ পায়নি। একবার ডাক্তারের কথাও তুলেছিল। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে না করে দেয়। বাধ্য হয়ে স্বর্ণলতা সারারাত জেগে থেকে চুপচাপ স্বামীর যন্ত্রণা সহ্য করেছে। ফজরের আযান পড়া পর্যন্তও মুনছুর সাখাওয়াত জেগে ছিল। স্বর্ণলতা নামাজ শেষ করে এসে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
______
স্বর্ণলতার কলেজে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে। সে তৈরি, শুধু নাস্তা খাওয়া বাকি। এদিকে মুনছুর সাখাওয়াত তখনও গভীর ঘুমে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। শিয়রের কাছে বসে থেকে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখেছে। জ্বর আসেনি, স্বাভাবিকই লেগেছে। সে আরও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে মাথায় হাত রাখল। চুলে আঙুল চালাতে চালাতে ডাকল,
” এই যে, শুনছেন? উঠুন। অনেক বেলা হয়েছে তো! নাস্তা খেয়ে আবার শুয়ে পড়বেন নাহয়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুখে আওয়াজ করল না। হাত দিয়ে স্ত্রীর পা দুটো টেনে সেখানে মাথা রাখল। পুনরায় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে স্বর্ণলতা খানিক বিরক্ত হলো। এভাবে পায়ে মাথা রাখাটা পছন্দ করে উঠতে পারছে না এখনও। তার ইচ্ছে হলো পা দুটি টেনে সরিয়ে দেয় কিন্তু পারছে না। শরীরটা এখন কেমন জানে না যে! সে আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে সহসা ডাকল,
” শুনছেন? আপনার শরীর খারাপটা এখনও আছে? ”
এবার জবাব এলো,
” না। ”
সাথে সাথে স্বর্ণলতা পা দুটো সবলে টেনে নিল। মুনছুর সাখাওয়াতের ঘুম ছুটে গেল। কপাল কুঁচকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে স্বর্ণলতা চোখ সরিয়ে নিল। তখনই প্রশ্নটা তীরের বেগে ছুটে এলো,
” পা সরিয়ে নিলে কেন? ”
” অনেক ঘুমিয়েছেন। এখন উঠেন, খাবেন। আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
সে আস্তে-ধীরে উঠে বসল। স্ত্রীর মুখটায় নীরবে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
” আজকে ক্লাস করতেই হবে? ”
” জি। আগামী সপ্তাহে আমার পরীক্ষা। আজকে শর্টকাট চূড়ান্ত সাজেশন দিবে। না গেলে পাব না। কাল শুক্রবার। শনিবারে যদি কারও দয়া হয়, তাহলে পেতে পারি। ততদিনে অনেক পিছিয়ে যাব। এখন আপনি বলেন, ক্লাস করতে যাব কী যাব না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত অতিষ্ঠ গলায় বলল,
” তোমার নিজের সিদ্ধান্ত সবসময় আমার উপরে চাপিয়ে দাও কেন? এটা কিন্তু অন্যায় হচ্ছে। ”
স্বর্ণলতা অবুঝের মতো সুধাল,
” আসলেই? আমি যে ছোটবেলা থেকে শিখেছি, বড়রা সামনে থাকলে তাদের মতামতের গুরুত্ব দিতে। আপনি আমার থেকে বয়সে বড়, ভরণপোষণের দায়িত্বে আছেন, অভিভাবকের মতোই। আমার কিসে ভালো, কিসে খারাপ এসব আমার থেকেও আপনি ভালো বুঝবেন। আমি এখনও আঠারোতেও পড়িনি। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া ঠিক হবে? ”
এবার কথার প্যাঁচে পড়ে হারতে নারাজ। তাই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমি নিজের স্বার্থটাই আগে বুঝি। জানো নিশ্চয়? ”
” জানি। সাথে এটাও জানি, আমি আপনার স্বার্থের মধ্যে পড়ি। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৪)
সুবর্ণ মহাখুশি। আনন্দে চোখ, মুখ ঝলমল করছে। এই প্রথম সে জীপে করে স্কুলে যাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত জীপের গতি মধ্য পর্যায়ে রেখে পেছনে ফিরল। সুবর্ণের দিকে চেয়ে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” তোর আপা আমার কী হয়? ”
সে ধ্যানমগ্ন হয়ে রাস্তার আশপাশের সৌন্দর্য দেখছে। এই পথে রোজ স্কুলে যাচ্ছে, আসছে। দুইপাশের সারি সারি গাছপালা, ছোট-বড় দোকান, বাসাবাড়ি, মসজিদ সবকিছুই চেনা। তারপরেও মনে হলো আজ নতুনভাবে চিনছে, জানছে। কী সুন্দর দেখতে! নদীর ঢেউয়ের মতো দুলে চলছে যেন!
সুবর্ণ ডাক শুনতে পায়নি তাই সাড়া দিচ্ছে না। বিষয়টা ধরতে পেরে স্বর্ণলতা ধমকে ওঠল,
” বর্ণ? ঐদিকে কী দেখিস? তোকে ডাকে না? ”
সে চকিতে সামনে ফিরে অপ্রস্তুতভাবে সুধাল,
” কে ডাকে? ”
স্বর্ণলতা কিড়মিড়িয়ে বলল,
” তোর দুলাভাই। ”
সুবর্ণের দৃষ্টি তৎক্ষনাৎ দুলাভাইয়ের দিকে সরে গেল। সে মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। চোখদুটি সামনে, সতর্কসহিত শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চলছে। সামনের মোড়টা ঘুরলে স্কুলের মূল ফটকটা দেখা যাবে। মুনছুর সাখাওয়াত এই সামান্য দূরত্বটুকু পার হলো নীঃশব্দে, কারও দিকে না তাকিয়ে। নীলরঙা গেইটটার কাছে গাড়ি থামিয়ে ঘাড় ফেরাল। সরাসরি তাকাল স্ত্রীর আদরের একমাত্র ছোট ভাইয়ের দিকে। সুবর্ণ তখনও প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতেই চেয়েছিল। চোখাচোখি হতে উল্লাসের জেল্লাটুকু মুছে গেল কৃষ্ণাভ মুখাবয়ব থেকে। নতুন গজানো পাতার মতো কচি, সজীব চোখজোড়া নত হয়ে আসতে পূর্বের প্রশ্নটা আবারও জিজ্ঞেস করল,
” তোর আপা আমার কী হয়? ”
সে আনত নয়নে সবিনয়ে স্পষ্টভাবে জবাব দিল,
” বউ। ”
” আমি তোর আপার কী হই? ”
” জামাই। ”
” বউদের কাছে তাদের জামাই ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের গল্প করা বারণ, জানিস না? ”
সুবর্ণ ঝটিতে চোখ তুলল। বিস্ময় নিয়ে একস্থির চেয়ে থাকল দুলাভাইয়ের মুখটায়। যত বড় হচ্ছে তত নতুন নতুন জ্ঞানার্জন করছে। কখনও ইচ্ছায় প্রবল আকর্ষণ থেকে, কখনও অনিচ্ছায় প্রবল তিক্ততা থেকে। জামাই-বউয়ের এই রহস্যময় সম্পর্কটার প্রতি আগ্রহ বা অনাগ্রহ কোনো ধরনের অনুভূতি কাজ করেনি এখনও। আপা ও দুলাভাইকে দেখে বুঝেছে, এরা যখন একসাথে থাকে তখন অন্যদের আশপাশে থাকতে নেই। এত বড় নিষেধাজ্ঞার পরেও যে, আরও বারণ থাকতে পারে সে অনুমানও করতে পারেনি। সুবর্ণ দু’পাশে মৃদু মাথা নেড়ে বলল,
” না। ”
” এখন জেনেছিস তো? আজকে থেকে মেনে চলবি। আর কখনও যেন শুনি না, আমি ছাড়া অন্য কারও গল্প করেছিস। মনে থাকবে? ”
” থাকবো। ”
” আর যদি ভুলে যাস তাহলে কিন্তু খুব মারব। তোকে না, তোর ঐ বেশি কথা বলা মেয়েটাকে। যাকে সুযোগ পেলে অসভ্যের মতো পদ্মফুল দিস। ”
” পদ্মফুল দিলে অসভ্য হয়ে যায়? ”
এই পর্যায়ে মুনছুর সাখাওয়াত কণ্ঠরোধ করল। আড়চোখে পাশে চাইতে বুঝল সঙ্গিনীটি তার দিকে চেয়ে আছে। কিশোর ছেলেটির চেয়েও এই কিশোরী মেয়েটির কৌতূহল কয়েকগুণে বেশি। সে চাপা হেসে প্রত্যুত্তর করল,
” যদি প্রেমিকা মনে করে দিস তাহলে অসভ্য হবি না। ”
” উনি আমার প্রেমিকা না। ”
উত্তরটা দিয়ে সুবর্ণ জীপ থেকে একলাফে নেমে পড়ল। গটগটিয়ে স্কুলের গেইটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। স্বর্ণলতা চোখ বড় বড় করে ভাইকে দেখে যাচ্ছিল। আড়াল হতে স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,
” আপনারা কাকে নিয়ে কথা বলছিলেন? এই প্রেমিকাটা কে? সুবর্ণ কাকে ফুল দেয়? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না। নিষ্পলকে চেয়ে থাকে উৎকণ্ঠিতার দিকে। প্রায় আধা মিনিট পরে গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে সহসা প্রত্যুত্ত করল,
” যে আমার গোপনীয়তা রক্ষা করে আমিও তার গোপনীয়তা রক্ষা করি। ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল প্রথমে। পরক্ষণে একইসাথে দ্বিধা ও সন্দেহে পতিত হলো। পূর্বেরও চেয়েও অধিক কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সুধাল,
” মানে কী? কোন গোপনীয়তার কথা বলছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এবারও জবাব দিতে দেরি করল। গাড়িটা বড় রাস্তায় উঠে গিয়েছে। এখান থেকে স্বর্ণলতার কলেজ বেশি দূরে নয়। সোজা পথ, যানজটের ঝামেলা নেই। যে গতিতে জীপ ছুটছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট লাগবে। সে একহাতে স্টিয়ারিং সামলে অন্যহাত রাখল স্ত্রীর বামহাতের ওপরে। নরম, ছোট আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙুল গলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” খারাপ স্বপ্নটা কী ছিল, স্বর্ণলতা? ”
স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল যেন! সত্যান্বেষী ভাবখানা হারিয়ে গেল নিমিষে। কালো নিকাবের মাঝে আবরুহীন চোখজোড়ায় ভয় ফুটে উঠতে সে চোখ সরিয়ে নিল। ডানপাশে দখল করা জানালার অংশে ঠেসে গিয়ে উচ্চারণ করল,
” মনে নাই। ”
কণ্ঠটা কাঁপছে। শব্দদুটো বের হলো ভীষণ হালকা সুরে। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল,
” কী দেখেছ? আমি মারা যাচ্ছি? ”
স্বর্ণলতা চকিতে ফিরল। লুকানো সত্যটা বুঝে গেল কীভাবে? সে কি সেদিন কলের মধ্যে স্বপ্নের কথাটা বলে দিয়েছিল? স্বর্ণলতার ঠিক মনে পড়ছিল না, মনে করার সুযোগও পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত পাশ থেকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” হয়নি? তারমানে মারা গেছি। কী সৌভাগ্য আমার! প্রথমবারের মতো বউয়ের স্বপ্নে ঢুকলাম সেটাও মরালাশ হয়ে। ”
তার হতাশা মাখানো কণ্ঠস্বরে স্বর্ণলতার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না। এটা প্রথমবার নয়, দ্বিতীয়বার। তার স্পষ্ট মনে আছে, শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে প্রথমবার বাধ্য হয়ে যেদিন স্বামীর রুমের বিছানায় ঘুমিয়েছিল সেদিনও একটি স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্নে মানুষটা বেঁচে ছিল, একই রকম দেখতে দুটো আলাদা দেহে ধরা দিয়েছিল। বেশভূষা ও কার্যকলাপে একটার চেয়ে আরেকটা কম ভয়ানক ছিল না! স্বপ্নটা স্মরণে আসতে স্বর্ণলতা আরও একবার শিউরে ওঠল। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আপনি আমার সুন্দর সুখকর স্বপ্ন হবেন কবে? ‘
মুনছুর সাখাওয়াত আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
” আমি মারা যাওয়ার পরে কী হলো? বিয়ে করেছ? বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে নিশ্চয়? স্বর্ণলতা, তোমার দ্বিতীয় স্বামীকে কি আমি চিনি? ”
স্বর্ণলতা আশ্চর্য হয়ে বলল,
” কীসব বলছেন! এক স্বপ্নে এতকিছু হয় নাকি? ”
” তাহলে কতদূর হয়েছে? বাসর করেছ? আমি তো অর্ধেক আদর করেই মারা গেলাম। ও কি পুরো আদরটা করেছে? উফ! বলছ না কেন? স্বর্ণলতা, আমি স্বপ্নটা শুনতে চাই। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কোনোকিছু বাদ দিবে না বলে দিচ্ছি। আমি কিন্তু ধরে…”
তার একনাগাড়ে বলা চলা কথাগুলো শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না। স্বর্ণলতা মুখ চেপে ধরে অসহ্য ভাবে চেঁচিয়ে ওঠল,
” থামেন। এসব কিছু হয় নাই। আমি বিয়েও করি নাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
” তাহলে? আমার মৃত্যুতেই স্বপ্ন শেষ? ”
” বার বার মারা যাওয়ার কথাটা বলছেন কীভাবে? ভয় লাগে না আপনার? বুক কাঁপে না? ”
” ভয় লাগবে কেন? মারা যাওয়া তো স্বাভাবিক ঘটনা। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই একদিন না একদিন মারা যাবে। ”
” সব প্রাণীর তো কবর হবে না, আজাব হবে না, হাশরের ময়দানে নিজ কর্ম ফলের হিসাবও পাবে না! ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্ত থামল। নিকাবে আবৃত মুখখানা নীরবে অবলোকন করে রাশভারি গলায় বলল,
” আমি জিজ্ঞেস করেছি, তারপরে কী হলো? আমি মারা যাওয়ার পরে কী ঘটেছে? ”
স্বর্ণলতাও কথা বাড়াল না। ভয়, শঙ্কা কাটিয়ে এখন বিরক্তের মগডালে উঠে বসে আছে। সে নিজের সিটে মাথা এলিয়ে বলল,
” গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। ”
” কাকে? ”
” আমাকে আর দাদিজানকে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মেজাজ চড়ে গেল। কাজটা যে স্বপ্নে, অবাস্তবে ঘটেছে সেটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। রাগে, আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,
” আমার পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করেছে? এত বড় স্পর্ধা কে দেখিয়েছে? নাম বলো। এখনই। ”
স্বর্ণলতা সংশোধন করে দিল,
” কে না, বলুন কারা। ”
সে চটজলদি শিখে ফেলেছে এমনভঙ্গিতে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কারা? ”
” যাদের উপরে আপনি বছরের পর বছর অত্যাচার করে আসছেন তারা। এখন হিসেবের খাতা ঘেটে নাম, পরিচয় বের করে নিন। ”
জীপটা কলেজের কাছে থেমে ছিল। কথার তালে তালে কখন যে, কলেজে চলে এসেছে স্বর্ণলতা বুঝতে পারেনি। গাড়ি স্থির আছে নাকি চলছে সেটাও টের পায়নি। রুক্ষ বদনের অধৈর্যশীল মানুষটার একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়ে বাইরে দৃষ্টি রাখারও সময় পায়নি। এতক্ষণে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতে পরিচিত ফটকটা নজরে পড়ল। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল বাসা থেকে বের হওয়ার কারণটি। সে তৎক্ষনাৎ ব্যস্তভঙ্গিতে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। গেইটের দিকে রওনা দিবে তখনই বাতাসে ভেসে এলো কণ্ঠস্বরটা,
” স্বর্ণলতা? ”
সে থেমে পেছন ফিরতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” স্বপ্নটা সত্যি হওয়ার আগে জেদটা আবারও দেখাও। ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” যে ব্যাপারটা আমি এখনও বলে উঠতে পারিনি। ”
সূর্যের তীক্ষ্ণ কিরণ সরাসরি চোখে পড়ায় স্বর্ণলতা ঠিকভাবে তাকাতে পারছিল না। একহাত কপালে ঠেকিয়ে একপা এগিয়ে এলো। উঁচু গলায় পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কোন ব্যাপারটা? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দেওয়ার বদলে আকাশের দিকে তাকাল। সূর্যের চেয়েও তীব্রতর দৃষ্টি ফেলে ভাবছে, যাকে সে একবিন্দু কষ্ট দিতে পারে না তাকে ঐ দূরের বস্তুটা কষ্ট দিচ্ছে। দূরে আছে বলেই রক্ষা পেয়ে গেল!
স্বর্ণলতা আরও এক কদম এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তখনই ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজতে লাগল। গেইট বন্ধ করে দেওয়ার সময় হয়েছে। দারোয়ান চিৎকার করে ছাত্রীদের ভেতরে ঢোকার তাগাদা দিচ্ছে। বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অল্পসংখ্যক ছাত্রীরা দ্রুতপদে ঠেলাঠেলি করে ভেতরে ঢুকছে। স্বর্ণলতা স্বামীর দিকে আরও এক মুহূর্ত চেয়ে থাকল। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে সেও পা বাড়াল ফটকমুখী।
______
ছুটির পরে মুনছুর সাখাওয়াতকে বাইরে দেখা গেল না। জীপটাও নেই। স্বর্ণলতা রিকশা করে বাসায় ফিরল। নিজের রুমে ঢুকতে দেখল, বিছানার উপরে একটা ছাতা রাখা। ছাতার নিচে ভাঁজ করা একটি কাগজ চাপা দেওয়া। সে কৌতূহলী চিত্তে কাগজটা বের করল। ভাঁজ খুলতে হতাশ হলো। কিছু লেখা নেই। পুরোটা খালি, সাদা ফকফকা। সে বার বার এপিঠ-ওপিঠ দেখতে দেখতে চেঁচাল,
” আম্মা? ”
শবনম বেগম ড্রয়িং রুমে ছিলেন। ডাক পেয়ে দৌড়ে আসলেন। স্বর্ণলতাও ততক্ষণে দরজার কাছে চলে এসেছিল। মুখোমুখি হতে সে জিজ্ঞেস করল,
” ওটা কার ছাতা? ”
” কোনটা? ”
স্বর্ণলতা হাতের ইশারায় দেখাতে শবনম বেগম দূর হতে এক ঝলক চেয়ে বললেন,
” জানি না তো। এই বাসায় কোনো ছাতি নাই। আমার কিনতেও মনে থাহে না। সুবর্ণ ডেইলিই তো ছাতি চায়, আমি দিতে পারি না! ”
স্বর্ণলতা চুপ হয়ে গেল। রুমে ফেরত এসে ছাতাটা হাতে নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। সহসা খালি কাগজটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে সুধাল,
” আমি কলেজে যাওয়ার পরে উনি আসছিল? ”
” মহাজন? হ, আইছিল তো। কিন্তু থাকে নাই বেশিক্ষণ। রুমে ঢুইক্যাই বাইর হইয়া গেছে গা। ”
” যাওয়ার সময়ে কিছু বলে নাই? ”
” না। ”
ছাতাটা যে মুনছুর সাখাওয়াতই রেখে গিয়েছে এটা বুঝে এলেও খালি কাগজ ফেলে যাওয়ার কারণ উদ্ঘাটন করতে পারল না। গ্রামে ফিরে গেল নাকি তাও স্পষ্ট না। সে কতক্ষণ চিন্তিত মুখে বসে থাকল। তারপরে ফোন তুলে নিয়ে কল লাগাল। রিং হলো ঠিকই ধরল না। অনেকদিন পর হৃদয় কামড়ে ধরার মতো ঘটনাটা ঘটল। মানুষটা কি আবারও তার কল ধরা বন্ধ করে দিল?
_____
স্বর্ণলতা গোসলখানায় ঢুকে যারপরনাই বিস্মিত হলো। মুনছুর সাখাওয়াত পাঞ্জাবি ফেলে গিয়েছে, যেটা সে গ্রাম থেকে আসার পথে পরে এসেছিল। ধোয়াও হয়নি। বিবাহের পরে এরকম ঘটনা ঘটেনি কখনও। সবসময় দেখে এসেছে, নিজের কাপড় নিজে ধুয়েছে। সাথে সাথে, কখনও ফেলে রাখেনি। সে হাত বাড়িয়ে পাঞ্জাবিটা নিল। ধুয়ে দিবে নাকি ভাবছে। কোথায় গিয়েছে জানে না, যদি ফেরত আসে? রাগ করবে কি? স্বর্ণলতা ভাবনার মধ্যে মনস্থির করল, রাগ করলে সে সয়ে নিবে। তবুও আজকে পাঞ্জাবিটা নিজ হাতে ধুবে। পানিতে ভিজানোর পূর্বে একটা পকেটে হাত ঢুকাল। বেশ কিছু টাকা ও কাগজপত্র বেরিয়ে এলো। অন্য পকেটে টাকাপয়সা পেল না, কাগজও না। শুধু একটা চারকোনা ছোট্ট প্যাকেট পেল। প্যাকেটের উপরে অসভ্য ধরনের ছবি। সে চেয়ে থাকতে পারল না। দৃষ্টি সরিয়ে প্যাকেটটা প্রথমে হাতের মুঠোয় নিল। তারপরে ঝটপটে টাকাগুলো যেখানে রেখেছে সেখানে রাখল।
সাবানের গুড়ো মিশানো পানিতে পাঞ্জাবিটা ভিজানোর সময়ে স্মরণে এলো এক সহপাঠীর কথা। ক্লাস শুরু হওয়ার প্রথম দিকের ঘটনা। নতুন নতুন সব মুখের সাথে পরিচয় হচ্ছে। স্বর্ণলতা বিবাহিত, তন্মধ্যে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে নিজের মায়েদের সাথে থাকছে। তথ্যটা যে শুনছে সেই অবাক হচ্ছিল। সহসা একজন বলে ওঠল, ‘ হাসবেন্ড ফেলে একা থাকো? তোমার তো খুব সাহস! কিন্তু পুরুষ মানুষকে একলা ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। ওরা থাকতে পারে না। পরে নষ্ট হয়ে যায়। ‘
নষ্ট শব্দটি ঠিক কোন অর্থে ব্যবহার করেছিল স্বর্ণলতা সেদিন বুঝতে পারেনি। তাই ভয়ও পায়নি। তার মনে হয়েছিল, ঐ লোকটা তো এমনিতেই বদমেজাজি, দয়ামায়া নেই, নাস্তিক ধরনের। এরচেয়েও নষ্ট কী হতে পারে! আজ মনে হচ্ছে সঠিক অর্থটা ধরতে পেরেছে। সে পাঞ্জাবি রেখে আবারও তাকাল প্যাকেটটির দিকে। এই অসভ্য ধরনের ছবি ছাপানো প্যাকেটটার মধ্যে কী থাকতে পারে সে অনুমানও করতে পারছে না। কোন কাজে ব্যবহার করার জন্যে পকেটে নিয়ে ঘুরছে এটাও ভেবে পাচ্ছে না। নেশা জাতীয় কিছু কি? এই নিয়ে তার কিছুটা পড়াশোনা আছে কিন্তু কখনও তো দেখেনি! নেশাদ্রব্যের প্যাকেটে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের কামাতুর দৃশ্য থাকবে কেন? দৃশ্যটায় চেয়ে থাকতে থাকতে মাথার মধ্যে আরও একটা চিন্তা এসে গেল। সে তখনই ছুটে গেল রুমে। মোবাইল তুলে কল লাগাল দাদিজানকে। একটু দেরি হলেও প্রথমবারেই ধরলেন। স্বর্ণলতা সাধারণ কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞেস করল,
” দাদিজান, উনি কি বাড়িতে? ”
” না। মুনছুর কি আজই ফিরছে? ”
” মনে হয়। আমাকে কিছু বলে যায় নাই। ”
ওপাশটা চুপ হয়ে গেল। স্বর্ণলতাও চুপ থাকায় দীর্ঘশ্বাস পড়ার শব্দটাও শুনতে পেল। ভাবল, সেই পুরানো দুশ্চিন্তা। নাতিটা এখনও সুধরাচ্ছে না! ক্ষণকাল চুপ থেকে আচমকা বলল,
” উনার মনে হয় সত্যি ঐ রোগ হয়েছে। ”
” রোগ! কোন রোগ? ”
” যে রোগ হলে বউয়ের সাথে কিছু করতে মন চায় না। ”
” কী বলো! মুনছুর বলছে এই কথা? ”
” না। ”
” তাহলে বুঝলে কীভাবে? ”
” উনার পকেটে খারাপ ছবিওয়ালা একটা ঔষধের প্যাকেট পেয়েছি। ”
” নাম কী? ”
স্বর্ণলতা নামটা ফট করে বলতে চেয়েও পারল না। মনে হলো সঠিক নামটা সে মনে করতে পারছে না। ঔষধের নাম ভুল বলা ঠিক হবে না। সে মোবাইল হাতে গোসলখানার দিকে যেতে যেতে বলল,
” ভুলে গেছি। দাঁড়ান, দেখে বলছি। ”
ওপাশটা আচমকা থেমে গেল। সেকেন্ড কয়েক পরে ভারী, দুর্বল কণ্ঠটা বলে ওঠল,
” মুনছুর এসেছে। মনে হয় আমার ঘরের দিকেই আসছে। তুমি দেখে রাখো, পরে জানিও। ”
সাথে সাথে কলটা কেটে গেল। স্বর্ণলতা মোবাইল কান থেকে নামায়নি তখনও। নামটা পড়ে আগামাথা কিছু না বুঝলেও কৌতূহলী করে তুলল। কাঁধ দিয়ে মোবাইলটা কানে ঠেকিয়ে রেখে দুইহাতের সাহায্যে প্যাকেটের মুখ খুলল। মুখ বন্ধ আরও একটি প্যাকেট পেয়েও যখন কোনো ধারণা করতে পারল না তখন ডেসক্রিপশন পত্রটা বের করল। এখানে প্যাকেটে থাকা ঔষধটির সম্পর্কে বর্ণনা থাকার কথা। বাবার জন্যে আনা ঔষধের শিশিগুলোর সঙ্গে থাকে। সুবর্ণকে পড়তে দেখেছে অনেকবার। স্বর্ণলতা ভাঁজ খুলল ঠিকই কিন্তু পড়তে পারল না। দৃষ্টিসীমায় স্পষ্ট রগরগে স্থিরচিত্রগুলো আসতে এত কেঁপে ওঠল যে, কান থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। সাথে সাথে কাগজটা দুমড়েমুচড়ে টয়লেটে ফেলে দিল। দাদিজানকে পরে কল দেওয়ার কথাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল।
______
কলটা এলো দুপুরবেলা। দাদিজানের মোবাইল থেকে। পরীক্ষার জন্য দুইদিন আগেই স্বর্ণলতাদের বন্ধ দিয়েছে। সে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সহসা কল পেয়ে বই থেকে মনোযোগ সরাল। কলটা ধরতেই শুনল,
” তোমাদের কি ঝগড়া হয়েছে? ”
স্বর্ণলতা আকাশ থেকে পড়ল যেন! মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে তার অসংখ্যবার কথার লড়াই হয়েছে। কিন্তু কখনও মনে হয়নি ওটা ঝগড়া। আজ হঠাৎ এই শব্দটা প্রশ্নের মতো এলো কেন? সে দ্রুত জানাল,
” গ্রামে ফেরার পরে উনি আমার কলই ধরে নাই, দাদিজান। ঝগড়া হবে কখন? ”
কল ধরছে না কেন এই নিয়ে খাইরুন নিসা কিছু বললেন না। ছেলেটা যে ইচ্ছে করে নিজ স্বার্থে কল ধরে না এটা তার অজানা নয়। শুরু থেকে করে এসেছে। বদঅভ্যেসের তো শেষ নেই!
দাদিজান কান্না প্রায় কণ্ঠে বললেন,
” তাহলে ছেলেটার কী হলো? সেই যে এসে ঘরে ঢুকল আর তো বের হচ্ছে না। দুইদিন ধরে খাওয়া নেই। ময়নাকে দিয়ে ডাকাই, আমি ডাকি উত্তরও দেয় না। নাতবউ, আমার ভয় করছে। মুনছুর তো এমন করেনি কখনও। ভালে-মন্দ কিছু হয়ে গেলে সামলাবে কে? আমার শরীরের যে অবস্থা দুইটা মিনিট সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারি না। ”
এই সময়ে কলি এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। প্রাইভেটের ম্যাডাম এসেছে জানাতে স্বর্ণলতা বলল,
” বিদায় করে দাও, কলিবু। আমাদের এখনই গ্রামে যেতে হবে। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৫)
স্বর্ণলতা শ্বশুরবাড়ির গেইটটা পারও হতে পারল না, মসজিদ থেকে আযান ভেসে এলো। তার ত্রস্তব্যস্ত পা দুটি থমকে গেল আচমকা। কালো বোরকায় আবৃত দেহটা স্থির হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। চোখদুটি আবেশে বন্ধ করে একমনে শুনতে লাগল সুমধুর সুরটুকু। গভীর মনোযোগে আযানের জবাব দিতে দিতে ভাবছে, কত মাস পরে হৃদয় শীতল হয়ে আসা এই পরিচিত আহ্বানটা শুনতে পেল! কলি তাকে অনুসরণ করে চলছিল। সহসা থেমে যাওয়াই সে একই সাথে বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল। সুধাল,
” রানিসাহেবা, খাড়াইয়া পড়লেন ক্যান? শরীর খারাপ লাগতাছে? ”
আযান শেষ হয়নি তখনও। স্বর্ণলতা জবাবের মাঝে কথা বলা পছন্দ করে না। মনেযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই অস্থিরতা প্রকাশ পাওয়া কণ্ঠস্বরের বিপরীতে কিছু বলল না। কলির চিন্তা এবার দুশ্চিন্তায় পতিত হলো। ত্বরিত পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়াল। রানিসাহেবার কাঁধ ছুঁয়ে পরীক্ষকের ন্যায় দুষ্টি বুলাতে লাগল মুখটায়। নিকাবে ঢাকা থাকায় কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। ক্রমশ কাঁপতে থাকা বন্ধ চোখ জোড়ায় চেয়ে থেকে বলল,
” এইজন্যই কইছিলাম, কয়ডা খাইয়া লন। পথডা কি কম দূরের? বইয়া থাকতে থাকতে ভরা পেটও খালি হইয়া যায়। কোমরের কথা আর কী কমু! আমি তো ঠিকমতো হাঁটতেও পারতাছি না। মনডা চাইতাছে এইহানেই শুইয়া পড়ি। ”
” এখানে না, তোমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ”
স্বর্ণলতার আযানের জবাব দেওয়া সমাপ্ত হয়েছে। স্থবির ভাব কাটিয়ে বাড়ির মূল ফটক পার হলো। উঠোনে পদছাপ ফেলতে দাদিজানকে নজরে এলো। ময়নার সাহায্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বার্ধক্যের ভার ও অসুস্থতায় দেহটা সোজা হয়ে থাকতে পারছে না। কুঁজোদের মতো সামনে ঝুঁকে পড়েছে। তার ভারি মায়া হলো। সহানুভূতি দৃষ্টি জোড়া ছুঁড়তে বুঝল, কয়েক মাসের ব্যবধানে মানুষটা বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুড়িয়ে গেছেন যেন! সে দ্রুত কদমে উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় ওঠল। এই বাড়ির একমাত্র বয়োজ্যেষ্ঠ আপনবোধের মানুষটাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরতে শুনল,
” আগে পাগলটাকে সামলা। ”
” উনি কি রুম থেকে বেরিয়েছেন? ”
” না। ”
স্বর্ণলতা দাদি শাশুড়িকে ছেড়ে দাঁড়াল। স্বামীর রুমের দিকে না গিয়ে দাদিজানের রুমের দিকে যাচ্ছে। দরজা খোলায় ছিল, ভেতরে প্রবেশ করে নিকাব খুলল। বোরকায় হাত লাগাতে খাইরুন নিসা তাগাদা দিলেন,
” আর দেরি করিস না, নাতবউ! এবার ওর কাছে যা। ”
” এশারের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে। আগে নামাজটা পড়ি। ”
” এই মুহূর্তে নামাজের চেয়েও জান বাঁচানো বেশি জরুরি। আগে ওটা কর। নামাজের সময় শেষ হতে দেরি আছে। ”
তার কণ্ঠে একই সাথে প্রবল উৎকণ্ঠা ও বিরক্ত। স্বর্ণলতা বুঝতে পেরে কাছে এগিয়ে এলো। ক্রমাগত কাঁপতে থাকা বৃদ্ধ হাতটা চেপে ধরে বলল,
” আমার খুব ভয় করছে, দাদিজান। মনে হচ্ছে উনি আমার ডাকেও সাড়া দিবেন না। তাই নামাজের মাধ্যমে পরম করুণাময় আল্লাহর দ্বারস্থ হতে চাই। দুই হাত তুলে সাহায্য প্রার্থনা করব যেন আমার মনে হওয়াটা ভুল প্রমাণিত হয়। তিনি মহা ক্ষমতাবান, অলৌকিক শক্তি দ্বারা ঘটে যাওয়া ঘটনাও বদলে দিতে পারেন। একমাত্র তার করুণা পেলেই আমার মনের ধারণাটা পুরোপুরি ভুল হবে। আমি সেই করুণা পাওয়ার জন্য আরেকটু দেরি করব। দাদিজান, আপনি কি বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে কোন কাজটা আমার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ? ”
খাইরুন নিসা মুখে জবাব দিতে পারলেন না। ঘোলা, দুর্বল চাহনি স্থির রেখে একপাশে সরে গেলেন। স্বর্ণলতা এই নীরব প্রতিক্রিয়াকে অনুমতি ও প্রশ্রয় ভেবে ওজু করতে চলে গেল। এত সময় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না খাইরুন নিসার পক্ষে। ঝিয়ের সাহায্যে ধীরেসুস্থে বসলেন আপন বিছানায়। ততক্ষণে স্বর্ণলতা নামাজ শুরু করে দিয়েছে। একটু সুস্থির ও আরাম পেতে বৃদ্ধ চোখজোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নামাজে নিমগ্ন কিশোরী মেয়েটিকে, তার একমাত্র নাতির প্রাণপ্রিয় স্ত্রী! বৈবাহিক সূত্রে এই বাড়িতে পা দেওয়ার বয়স হয়েছে প্রায় দুই বছর। বাড়ন্ত বয়সে এসেছিল। রোজই একটু একটু করে বদলাচ্ছিল মুখের আদল, শরীরের গড়ন ও চালচলন। কিন্তু বিস্ময়কর পরিবর্তনটা ঘটেছে বোধহয় ঢাকায় পদার্পন করার পর। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে এটায় তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। দীর্ঘ সময় চোখের আড়ালে থেকেছে বলেই কি না জানেন না, কিন্তু পরিবর্তনটা স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে। শুধু যে রূপ-লাবণ্য বেড়েছে তাই নয় চোখের চাহনি, হাঁটার ধরন, বচনভঙ্গি ও বেশভূষায় আশ্চর্য ধরনের দৃঢ়তা এসেছে। সমুখের মানুষটাকে খুব টানে, আকৃষ্ট করে। না চাইতেও সমীহ, মান্যবর চলে আসে। নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে থাকতে মানতে বাধ্য হলেন মুনছুর সাখাওয়াত ঢাকা থেকে ফিরে একাধারে স্ত্রীর যে প্রশংসা করে যেত সেগুলো মিথ্যা নয়। এক ফোঁটাও অতিরিক্ত নয়। চোখের সামনে সত্যকে পেয়ে উপলব্ধি হলো যতটুকু বলার দরকার ছিল ততটুকুও পূর্ণভাবে বলতে পারেনি। কত কী বাকি রয়ে গেছে!
খাইরুন নিসার হঠাৎই চাঁদনির কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটা সুযোগ পেলেই স্বর্ণলতাকে হেয় করেছে! বিশেষ ইঙ্গিত ছিল চেহারা ও শারীরিক গঠনের প্রতি। এক মুহূর্তের জন্য তারও মনে হয়েছিল, চাঁদনি ঠিক। এই নিয়ে গোপনে আক্ষেপও করেছিলেন। আজ বুঝি সেই গোপন আক্ষেপটাও মিটে গেল। গর্বের সঙ্গে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আজ যদি আমার নাতবউটাকে দেখতি, হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেতি! ‘
স্বর্ণলতা মোনাজাতের জন্য হাত একসাথে করতে কেঁদে ফেলল। নীরব কান্নায় শুধু অশ্রু ঝরে চলেছে। ফুঁপিয়ে উঠতে দেহটা কাঁপতে লাগল। সেই কম্পনরত দেহটায় চেয়ে খাইরুন নিসা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা ঢাকায় যাওয়ার পরে তার একটায় দুশ্চিন্তা ছিল। আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তা ও স্বামীকে ভুলে যায় কী না! সে ভুলবে কি আরও বেশি একাগ্র হয়েছে। তার সেই একমাত্র দুশ্চিন্তাটাও দূর হয়ে গেল। মনেপ্রাণে মেনে নিলেন, জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটি ভালো দিক থাকে। স্বর্ণলতার ঢাকায় যাওয়ার পেছনে ভালো দিকটা বোধহয় এটাই। স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া।
_______
মুনছুর সাখাওয়াতের দরজায় সমানে করাঘাত চলছে। সেই সাথে উচ্চস্বরে ডাকাডাকিও। কিন্তু দরজা খুলছে না, কোনো সাড়াশব্দও আসছে না। স্বর্ণলতা কান্নাপ্রায় কণ্ঠে বলল,
” আল্লাহ আমার ডাক শুনেনি, দাদিজান। যা ভেবেছিলাম তাই হলো। উনি আমার ডাকেও সাড়া দিচ্ছেন না! ”
খাইরুন নিসা কী বলে সান্ত্বনা দিবেন বুঝতে পারছেন না। তার নিজের অবস্থাও চূড়ান্ত পর্যায়ে। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়েছিল সেই দুইদিন আগেই। আর বোধহয় গরম করতে পারেননি। কষ্ট করে যে শ্বাসটুকু টেনে যাচ্ছিলেন এবার বুঝি সেই বলটুকুও হারিয়ে ফেললেন। জীবদ্দশায় আপনা মানুষ তো কম হারাননি! শেষ সম্বল হিসেবে ছিল এই নাতিটায়। এখন কি তাকেও… তিনি আর ভাবতে পারলেন না। চোখদুটি সিক্ত হয়ে উঠতে শুনলেন,
” দরজা ভাঙতে হবে। ”
বাক্যটা উচ্চারণ করে স্বর্ণলতা চঞ্চল মণিজোড়া আশপাশে ফেলল। এই কাজ তাকে দিয়ে হবে না, শক্তপোক্ত কাউকে লাগবে। এই মুহূর্তে বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। তাই কলির উদ্দেশ্যে বলল,
” দারোয়ান চাচাকে ডেকে আনো। দরজা ভাঙতে হবে। এখনই। দৌড় দেও, কলিবু। ”
সে আদেশ পালনে উদ্যত হওয়ার পূর্বে খাইরুন নিসা বললেন,
” বাড়ির ভেতরে পুরুষ মানুষ ঢোকাবে? মুনছুর জানলে খুব রাগ করবে। ”
স্বর্ণলতা অসহায় গলায় বলল,
” তাহলে কী করব? এই দরজা মেয়ে মানুষের পক্ষে ভাঙা সম্ভব না যে! ”
” যে দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় পায় সেই দরজা ভেঙে ফেলবে? ”
” এছাড়া উপায় কী? ”
খাইরুন নিসা জবাব দিতে পারলেন না। দৃষ্টি নত করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। ছেলেটা এ কী মসিবত টেনে আনল! স্বর্ণলতা ক্ষণকাল নীরব থেকে কলির উদ্দেশ্যে বলল,
” দরজা না দেয়াল কাটতে হবে। দারোয়ান চাচাকে বলো, জলদি লোকবল নিয়ে আসতে। ”
বৃদ্ধ চোখ জোড়া চকিতে উপরে উঠলেও মুখে কিছু বললেন না। নীরবে অবিরত ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন। স্বর্ণলতা তার এই নীরব প্রতিক্রিয়াকেও সম্মতি ধরে নিল।
______
মুনছুর সাখাওয়াতের পাশের রুমটায় স্বর্ণলতা পড়ার কাজে ব্যবহার করেছে। সেই রুমে দুজন অপরিচিত পুরুষ লোক ঢুকল। তাদের হাতে ভারী যন্ত্র ও সরঞ্জাম। বাড়ির কোনো মেয়েলোকই তাদের সামনে গেল না। পুরো সময়টা সাথে ছিল পাহারাদার আবুল। দুই রুমের সংলগ্ন দেয়ালটা এমনভাবে কাটা হলো যে, একটা মানুষ অনায়াসে ঢুকতে পারবে। কাজ শেষে বাইরের লোকরা বিদায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণলতা রুমটায় প্রবেশ করল। গাঢ় অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ে না। ভ্যাপসা গরম ও গন্ধ ছড়াচ্ছে। কারও উপস্থিতিও টের পাওয়া যাচ্ছে না। স্বর্ণলতা ভয়ে ভয়ে শ্বাসটুকু রুদ্ধ করে প্রথমে জানালা খুলে দিল। মুহূর্তেই হুড়মুড়িয়ে একদলা বাতাস উড়ে এলো। আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া এক টুকরো চাঁদ দেখা গেলেও আলো পাওয়া গেল না তেমন। রুমের অন্ধকার এক ফোঁটাও কমল না। সে দেয়াল হাতড়ে সুইচবোর্ডের কাছে পৌঁছাল। আলোটা জ্বলে উঠার সঙ্গে সঙ্গে শীতল কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” তোমার স্বপ্নে আমি কীভাবে মারা গেছিলাম? ”
স্বর্ণলতা এত চমকাল! এক মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন থেমে গেল। ঐ মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কেউ বুকের ভেতরের নরম মাংসল যন্ত্রটা এমনভাবে খামচে ধরেছে যে সে অসহণীয় ব্যথায় জ্ঞান হারাবে। জ্ঞান না হারালেও অস্বাভাবিক রকমের স্থির হয়ে গিয়েছিল। এই ভাবটা কাটিয়ে উঠতে প্রায় মিনিটখানেক সময় লাগল। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে তেড়ে আসতে আসতে বলল,
” আপনার দেখি জ্ঞান আছে তারপরেও সাড়া দেন নাই কেন? অযথায় দেয়াল কাটতে হলো। আমাদের এত কষ্ট দিয়ে কী হাসিল করলেন শুনি! ”
প্রচণ্ড রাগ ও আক্রোশে তার ঠোঁট কাঁপছে, নাক ফুলছে। অগ্নি ঝরা চক্ষুতে তাকিয়েও মুনছুর সাখাওয়াতের কোন হেলদোল হলো না। দৃষ্টি সরিয়ে নিল স্বাভাবিকভাবেই। সে মাথার নিচে দুই হাত রেখে শুয়ে আছে। স্বর্ণলতা শিয়রের কাছে এসে দাঁড়াতে শুনল,
” স্বর্ণলতা, আমি একটা প্রশ্ন করেছি। বলো, আমি কীভাবে মারা গেছিলাম। ”
” আপনি এখনও ঐ স্বপ্ন নিয়ে পড়ে আছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না। তবে নড়ল। আচমকা উঠে বসল স্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে। তারপরে আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল,
” গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছিলাম, তাই না? ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। এই উত্তরটা পেল কোথায়? সে তো দেয়নি! এই সময়ে দাদিজানের গলা পাওয়া গেল বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। দুর্বল কম্পিত কণ্ঠে ডাকছেন,
” নাতবউ? দরজাটা খোল। আর তো পারছি না! ”
মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি ঘুরে গেল ঐদিকে। চাপা হুংকার ছুঁড়ে বলল,
” আমি সুস্থ আছি। দাদিজান, রুমে যাও। দরজার কাছে কারও ছায়াও যেন না পড়ে। ”
এতক্ষণে স্বর্ণলতা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে বলল,
” যদি সুস্থই থাকেন তাহলে বৃদ্ধ মানুষটাকে এত কষ্ট দিলেন কেন? কত ভয় পেয়েছে, জানেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি পুনরায় বউয়ের দিকে ফিরে এলো। প্রশ্নগুলো শোনা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল,
” তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আমি সত্যি এক্সিডেন্ট করেছি। ”
” কী বলছেন! কবে, কোথায়? ”
” এই গ্রামেই, ঢাকা থেকে ফেরার পথে। ”
স্বর্ণলতা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। স্বামীর কাছে এগিয়ে এলো। অস্থিরচিত্তে সারাদেহে হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
” কোথাও লাগেনি তো আপনার? ”
” না। আমার কিছু হয়নি। কিন্তু যে গাড়ির সামনে এসেছিল সে হয়তো মারা গেছে। ”
স্বর্ণলতা আরও একদফা চমকাল। ভীতিগ্রস্ত দেখাল চোখজোড়া। স্বামীর শরীরে অবলীলায় বিচরণ করা হাতদুটি অকস্মাৎ থমকে গেল। আপনাআপনি সরে পড়ে গেল নিম্নমুখী। এই চমক, জড়তা ভাব আপনা থেকে কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। তখনই মুনছুর সাখাওয়াত দুই হাত মেলে চোখের সামনে ধরে বলল,
” এই হাতে আমি অসংখ্য মানুষকে পিটিয়েছি। হাত-পা ভেঙে সারা জীবনের জন্য অচলও করে দিয়েছি কিন্তু কখনও প্রাণ নিইনি। সুযোগ ছিল, ক্ষমতা দিয়ে খুনের মতো অপরাধও আমি ঢাকতে পারতাম। ডিসমিস করতে পারতাম কিন্তু আমি ঐকাজ করিনি। কিন্তু সেদিন! বিশ্বাস করো, স্বর্ণলতা। কাউকে ধমকানোর মতো অবস্থাতেও ছিলাম না, তারপরেও অঘটনটা ঘটে গেল। কীভাবে যে সামনে চলে এলো আমি বুঝতে পারিনি, এত চেষ্টা করলাম বাঁচাতে! ”
” এই গ্রামের মানুষ? আমি কি তাকে চিনি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। শুকনো, শান্ত চোখে নীরব চেয়ে থেকে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কে সে? ”
” চাঁদনির বাবা। ”
স্বর্ণলতা চোখ বুঁজে ফেলল। দুই হাতে নিজের জামা খামচে ধরে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করা মাত্র মুনছুর সাখাওয়াত দুই হাতে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে অস্পষ্টভাবে বলল,
” আমাকে বাঁচাও, বউ। ও আমাকে নিতে এসেছে। ”
স্বর্ণলতা চোখ খুলে ফেলল। ভাবল, পুলিশ এসেছে খুনের অপরাধে গ্রেফতার করতে। দ্রুত ভীত, শঙ্কিত চোখজোড়া আশপাশে ঘুরাল। কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে সুধাল,
” কোথায়? ”
” ঐ যে দরজার কাছে। কী ভয়ঙ্কর দেখতে, স্বর্ণলতা। আমার ভয় করছে। ”
কথাটা বলে সে হাতের বাঁধন এত শক্ত করল যে, স্বর্ণলতার হাঁসফাঁস করতে লাগল। দীর্ঘকায় শরীরটা লুকিয়ে ফেলার কী প্রচেষ্টায় না চালাচ্ছে! কাঁপছেও খুব। এরকম ভয় তো সে তার আম্মুকে দেখলে পেত। স্বর্ণলতা ঝটিতে তাকাল দরজার কাছে। কেউ নেই! কোনো শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। সে আশ্বাস দিয়ে বলল,
” ওখানে কেউ নেই। দেখুন। ”
” আছে। ”
” কে? আপনার আম্মু? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আজরাইল। ”
স্বর্ণলতার কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ছিটকে পড়ল,
” আজরাইল! ”
” হ্যাঁ। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার পিছু নিয়েছে। ওর চাঁদনির বাবাকে না, আমাকে চাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত শক্ত বাঁধনটাকে আরও দৃঢ় করল। বুকের মধ্যে আরও সেঁধে গিয়ে বলল,
” তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। আমি এখনই মরতে চাই না, স্বর্ণলতা। আমাকে বাঁচাও। ও কে বলো চলে যেতে। ”
এমন কঠিন চাপ স্বর্ণলতা সহ্য করতে পারছে না। ঘেমে নেয়ে ওঠেছে প্রথম দিকেই। এবার শরীরটা কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে! দৃষ্টিশক্তিও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছিল। সে বাধ্য হয়ে নিজেকে মুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াতের দুই বাহু চেপে ধরার পরই খেয়াল করল, তার কিনে দেওয়া পাঞ্জাবিটাই পরে আছে এখনও। এরমানে কি সে এখন পর্যন্ত গোসল করেনি? দাদিজান তো বলেছিল খাওয়াদাওয়াও করেনি। নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে বদ্ধ রুমে করছিল কী? মনে তো হচ্ছে ঘুমায়নিও। চিন্তাভাবনার মধ্যে সুচের মতো খোঁচা দিল মুনছুর সাখাওয়াতের শরীরের অত্যধিক উষ্ণ তাপমাত্রা। সাথে সাথে স্বর্ণলতার বুদ্ধি খেলে গেল। বুঝে এলো, খালি পেটে ঘুম হারিয়ে প্রচণ্ড জ্বরে পড়ে মানুষটা কল্পনায় আবোলতাবোল দেখছে। স্বর্ণলতাও সেই কল্পনায় অংশে নিয়ে দ্রুত বলল,
” চলে গেছে। আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। চেয়ে দেখুন না একবার। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একটু একটু করে মাথা তুলল। ভীত, কম্পিত দৃষ্টি জোড়া দরজার দিকে ফেলতেই হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো। এই সুযোগে স্বর্ণলতা হা করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিল। ওড়না দিয়ে মুখ ও গলার ঘাম মুছে নিয়ে বলল,
” এভাবে কেউ ধরে? আরেকটু হলে মরে যাচ্ছিলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে স্বর্ণলতা দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরল। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
” চলে গেছে না? ”
সে কোনো জবাব দিল না। শান্ত ও হালকা দৃষ্টিতে চেয়েই রইল শুধু। স্বর্ণলতা হাত বাড়িয়ে বাহু ছুঁয়ে বলল,
” আর আসবে না। শুয়ে পড়ুন। আমি কাঁথাটা নিয়ে আসি। আপনার তো খুব শীত করছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিনাবাক্যে শুয়ে পড়ল ঠিকই কিন্তু স্ত্রীকে কাঁথা আনতে দিল না। একটা হাত ধরে থেকে বলল,
” বিশ্বাস করো, আমি ও কে ইচ্ছে করে মারিনি। আমি তো মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। ”
মুক্ত শব্দটার সাথে যে মৃত্যু জড়িয়ে থাকতে পারে এটা এই মানুষটাই তো জানিয়েছিল। কথাটা মনে পড়ে যেতে সে কেঁপে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত বুঝতে পেরে তখনই সংশোধন করে দিল,
” এই মুক্তি মানে মৃত্যু না, স্বর্ণলতা। ”
” তাহলে? ”
” চাঁদনির বাবা আমার কাছে বন্দি ছিল। তুমি বলেছিলে না, যাদের উপরে বছরের পর বছর অত্যাচার করেছি তারা তোমাকে আর দাদিজানকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে? ঐ স্বপ্নটা মিথ্যা করার জন্য আমি চাঁদনি ও মানছুরার বাবাকে বন্দিদশা থেকে চিরতরে মুক্ত করে দিই। তারপরে জীপ নিয়ে আমার বাড়ির দিকে আসছিলাম তখনই হঠাৎ করে চাঁদনির বাবা…”
মুনছুর সাখাওয়াত পুরো কথাটা শেষ করল না। চোখ বুঁজে ফেলল। স্বর্ণলতা খেয়াল করল, মানুষটা আবারও কাঁপছে! সে এত আশ্চর্য হলো। ঐ ঘটনার দিন এই মানুষটা বলেছিল, মৃত্যুকে সে ভয় পায় না। এটা নাকি স্বাভাবিক ঘটনা। অথচ আজ শব্দটাও উচ্চারণ করতে গিয়ে ভয়ে কাঁপছে। এজন্যই হয়তো বলে, কোনো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে হয় না, অহংকার দেখাতে হয় না। সৃষ্টিকর্তা চাইলে চোখের পলকে সব বদলে দিতে পারে।
স্বর্ণলতা কাঁপতে থাকা হাতটায় অন্যহাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
” উনি কি সাথে সাথে মারা গেছেন? ”
” জানি না। ”
” আপনি দেখেননি? ”
” না। আমি ঐদিকে তাকাতেই তো আজরাইলটাকে দেখলাম! ভয়ে গাড়ি নিয়ে পালানোর সময়ে কাশেমকে বলেছিলাম, হাতপাতালে নিয়ে যেতে। ”
” তারপরে খোঁজ নেননি কী অবস্থা? ”
” না। ”
” এখনই নিন। আমার মন বলছে, উনি বেঁচে আছে। ”
সে নিজে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দিল। নাম্বারটাও খুঁজে কল লাগিয়ে কানের কাছে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” কথা বলুন। ততক্ষণে আমি খাবার নিয়ে আসি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মোবাইলটা হাতে নিল ঠিকই কিন্তু স্ত্রীর হাতটা এবারও ছাড়ল না। স্বর্ণলতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে থাকল। জোরাজুরি করল না। মাথার মধ্যে এখনও কাল্পনিক চিন্তা আছে নাকি বুঝতে পারছে না। কথা শেষ হয়েছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
” বেঁচে আছে তো? ”
” হুম। কোমায় আছে। ”
” দেখলেন? না জেনেই এতদিন ভুল ভাবনা নিয়ে বসে ছিলেন। এবার উঠুন, গোসল করুন। আমি আপনার জন্য খাবা…”
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মুনছুর সাখাওয়াত আচমকা বলে ওঠল,
” ঘুমাব। আমার খুব ঘুম পেয়েছে। ”
বলতে বলতে সে স্বর্ণলতার হাতের উপরে মাথা রেখে চোখ বুঁজল। মিনিটের মধ্যে বুক দাবিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল। ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে স্বর্ণলতা খানিক স্বস্থি পেল। ভাবল, ঘুম থেকে উঠলে স্বপ্নের মতো বাস্তবিক কল্পনাকেও ভুলে যাবে। এই সুযোগে প্রথমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিল। তারপরে মুনছুর সাখাওয়াতের কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রাটা মাপল। একটুও কমেনি। বরঞ্চ বেড়েছে। এর আগেও মানুষটা জ্বরে পড়েছিল, কিন্তু এত খারাপ অবস্থাও হয়নি। তাপমাত্রাটাও অনেক বেশি ঠেকল। স্বর্ণলতার মনে হলো, এই জ্বর ডাক্তার না দেখালে যাবে না। তাই স্বামীর পড়ে থাকা মোবাইলটা তুলে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে রিসিভ হতে সে প্রথমে সালাম দিল। তারপরে চটজলদিতে বলল,
” হাদিভাই, এই বাসায় একটু আসতে পারবেন? উনার খুব জ্বর! আপনি না দেখলে…”
সে কথাটা শেষ করতে পারল না। ঘুমন্ত মানুষটা জেগে উঠে থাবা দিয়ে মোবাইলটা কেড়ে নিল। দূরে ছুঁড়ে মেরে বলল,
” ওর নাম্বারটা এখনও মুখস্থ আছে কেন? ”
স্বর্ণলতা প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও সুযোগ পেল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত এক হ্যাঁচকায় স্ত্রীকে নিজের বুকের নিচে ফেলল। তারপরে শক্ত গলায় প্রশ্নটা করল,
” দাদিজানকে কী বলেছ? ”
এক দোষ থেকে উদ্ধার পেল না তন্মধ্যে আরেক দোষ এসে পড়ল! স্বর্ণলতা এত ঘাবড়ে গেল যে, বুঝতেই পারল না কোন বিষয়ে প্রশ্ন করছে। ভীষণ অসহায় কণ্ঠে অবোধের মতো সুধাল,
” কী বলেছি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আমি অসুস্থ? আমার মধ্যে যৌন অক্ষমতা রয়েছে? ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৬)
দানবের মতো দীর্ঘকায় শরীরের বাস্তবিক ভারটা স্বর্ণলতা এই প্রথম অনুভব করল। মুনছুর সাখাওয়াত অসংখ্যবার এভাবে কাছে এসেছে কিন্তু নিষ্ঠুরের মতো নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেয়নি কখনও। স্বর্ণলতা চোখ, মুখ খিঁচে ভারটা সয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। এই দম আটকানো মুহূর্তে তার গভীর উপলব্ধি হলো, মানুষটা নিজেকে কোথায়, কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রেখে চলেছে তা প্রকাশ না করলে স্বর্ণলতা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। এই যেমন আজকে প্রকাশ করল বলেই বুঝল, এভাবে কাছে আসার পেছনেও কতটা যত্ন বরাদ্দ ছিল! কতটা সংযমী ছিল! গোপনে সতর্কতা অবলম্বন করে এসেছে সর্বদায়।
স্বর্ণলতা কোনো রকমে চোখের পলক জোড়া ফাঁকা করে স্বামীর দিকে তাকাল। মুখটা ক্রমশ মৃদু কাঁপছে! রক্তিম চোখ জোড়ায় এক ফোঁটা দয়া-মায়ার আঁচ নেই। ফোঁস করে উত্তাপ নিঃশ্বাস ফেলছে তার করুণ মুখের ওপরেই। এই ভয়ঙ্কর রূপ ও আচরণ প্রকাশের কারণ কি অসুস্থতা নাকি ভীষণ ব্যক্তিগত বিষয়টা? যা নিয়ে সে দাদিজানের সাথে ফোনালাপ করেছিল! অল্পসময়ের সন্দেহপ্রবণ আলাপটুকুর বিষয় এই রগচটা জানল কীভাবে? দাদিজান সরাসরি বলেছেন নাকি ফোনে কথা চলাকালীন শুনে ফেলেছিল? ঐ সময় তো তিনি দাদিজানের কাছেই যাচ্ছিল!
স্বর্ণলতা গভীর নিঃশ্বাস টেনে বহুকষ্টে ক্ষীণ আওয়াজে টেনে টেনে বলল,
” আপনি ভুল বুঝছেন! ”
” আমি ভুল বুঝছি? ”
” হ্যাঁ। ”
উত্তরটা দিয়ে সে মুনছুর সাখাওয়াতের দুইবাহু খামচে ধরল। সবলে ঠেলা দিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বলল,
” পেটে খুব চাপ লাগছে! একটু সরেন। আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। ”
সে সামান্য সরল। তাতে ভারের আহামরি কোনো পরিবর্তন এলো না। কিন্তু স্বর্ণলতার শ্বাসের গতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়াতে স্বস্থি পেল। শরীর ও কণ্ঠে কিঞ্চিৎ জোর সঞ্চয় করে বলল,
” প্রথম ভুল বুঝেছেন দাদিজান, তারপরে আমি। এখন আপনি। ”
” কীভাবে? ”
স্বর্ণলতা পুরো ঘটনাটায় বিস্তারিতভাবে ধীরে ধীরে শোনাল। সুযোগ পেয়েও যে সে তার প্রথম বউ মানছুরার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেনি, এই নিয়ে সন্দেহের সূচনা ঘটে খাইরুন নিসার মনে। তারপরে স্বর্ণলতার সাথেও একই কাজ করায় এই সন্দেহ গোপন রাখতে পারেন না। নাতবউয়ের কাছে প্রকাশ করেন। ঐ সময়ে সে গুরুত্ব না দিলেও বুকের কোথাও সন্দেহটা নুড়ি পাথরের মতো আটকে ছিল। ঢাকায় আসার পরে সেটা বিশাল আকারে রূপ নেয়। স্বর্ণলতা মুখ ফুটে চাওয়ার পরেও দৈহিক সুখটুকু পাচ্ছিল না, ঠিক সেই মুহূর্তে মুনছুর সাখাওয়াতের পকেটে নিষিদ্ধ ধরনের ছবি ছাপানো প্যাকেটটা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। কোনো রকমের যাচাই-বাছাই না করে দাদিজানকে জানিয়ে দেয়। পরবর্তীতে যখন বুঝতে পারে প্যাকেটটিতে ঔষধ নয় অন্যকিছু আছে তখন লজ্জায় দাদিজানকে জানাতে পারেনি।
সব শুনে মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” এখন তাহলে জানো ওটা কিসের প্যাকেট ছিল? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। উল্টো জিজ্ঞেস করল,
” আপনি পুরো প্রস্তুত ছিলেন তারপরেও কিছু করেননি কেন? আমি কি কোনো ভুল করেছিলাম? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” উত্তরটা তোমাকে দিয়ে এসেছিলাম, স্বর্ণলতা। ”
” কখন? আমার মনে পড়ছে না। ”
” ভাব। ”
সে সত্যি ভাবতে শুরু করে দিল। নিজের অবস্থান ও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে চেতনা ও হৃদয় একটু সরে যেতেই উষ্ণ স্পর্শের ঢল নেমে এলো মুখজুড়ে। সচেতন হয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোরও সুযোগ পেল না। কেঁপে উঠা অধরযুগল এমনভাবে দখলে চলে গেল যে, স্বর্ণলতার বুঁজে আসা চোখের পাতার তলে ঢাকার ভাড়া বাসাটি স্থিরচিত্রের মতো ভেসে ওঠল। তারপরে সেখানকার গোসলখানা ও একটি জেদি, বেপরোয়া, হিংস্র স্পর্শের কথা মনে হলো। তাদের প্রথম ঠোঁটের পরিচয় ছিল অথচ কেউ কাউকে বুঝে উঠতে পারেনি! প্রবল অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল বড্ড বাজে ও ভুলভাবে। এরপরে কত কী ঘটে গেল! স্বর্ণলতার একে একে সবই নতুনভাবে মনে পড়ছিল। সহসায় তার গলার ওড়নায় হাত পড়ল। সে আরও একবার সচেতন হয়ে ওঠল। দ্রুত স্বামীর হাতটা আটকে দিয়ে বলল,
” আপনি অসুস্থ, জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। শারীরিকভাবেও দুর্বল। ”
” শরীর পুড়ে যাওয়ার কারণ শুধু জ্বর নয়, স্বর্ণলতা। ”
” তাহলে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলল। স্বর্ণলতা ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। ভেবেই পাচ্ছে না, হাসি পাওয়ার মতো কী ঘটেছে! সে এখন পর্যন্ত যা করেছে, যা বলেছে সবই স্বামীর শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে। কার্যকলাপ এখনও অসঙ্গতিপূর্ণ। মুখটাও এমন বানিয়ে রেখেছে যে, বুঝতে পারছে না হুঁশে আছে নাকি বেহুঁশে। তার তো কল্পনার রাজ্য তৈরি করতে ঘুমেরও দরকার হয় না। জেগে থেকে আম্মাকে দেখে, আজরাইলকে দেখে। একবার বলেছিল, বউকেও দেখে।
মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের কুঞ্চিত ভ্রূযুগলের মাঝে চুমু খেয়ে বলল,
” একটু পরে বুঝতে পারবে আমি কতটা দুর্বল। তার আগে বলো, তুমি সুস্থ তো? ”
স্বর্ণলতা হতভম্ব হয়ে জবাব দিল,
” আমার আবার কী হবে! ”
সাথে সাথে স্ত্রীর আটকে রাখা হাতটার উপরে সে অন্যহাতটা রাখল। জোরপূর্বক ধীরে ধীরে হাতসহ ওড়না সরিয়ে দিতে দিতে বলল,
” পুরুষ মানুষ সবধরনের অপমান সহ্য করে নিতে পারে কিন্তু পৌরুষের অপমান সহ্য করতে পারে না। এক মুহূর্তের জন্যও না। এখন হোক সেটা বুঝে অথবা অবুঝে। ”
________
মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করে এসে দেখল, স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিবে তখনই ঘুমন্ত কিশোরী দেহটা বেখেয়ালে একপাশে কাত হলো। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটা চোখে পড়ল। চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। মুহূর্তেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল। চুল মোছার কাজে ব্যবহার করা তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল স্ত্রীর নিকট। কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীরে, মোলায়েম কণ্ঠে ডাকতে লাগল। স্বর্ণলতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। তাই সাড়া দিতে দেরি করল। বরাবরের মতো হালকা স্বরে আওয়াজ দিল,
” হুম। ”
” তখন আমি অসুস্থ বলতে কী বুঝিয়েছি ধরতে পারনি? ”
এবার কোনো জবাব এলো না, আওয়াজও না। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে এতই ব্যাকুল হয়ে পড়ল যে, তার ধৈর্য্য হচ্ছিল না। বাহু চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে খানিক উঁচুস্বরে ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? উঠো। উঠে বসো, বলছি। ”
সে ধরফড়িয়ে উঠে বসল। ভীতিগ্রস্ত চোখ জোড়া দ্রুত পুরো রুমে বুলিয়ে এনে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত কথা বাড়াল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কি পিরিয়ড চলছে? ”
” না। ”
উত্তরটা শোনামাত্র নিজের উপরে বিরক্ত হলো। পিরিয়ড চললে সে নিজেই বুঝতে পারত! পৌরুষের উত্তেজনায় এতটাও অনিয়ন্ত্রিত হয়নি যে, বিবেক হারিয়ে জন্তুদের মতো ক্ষিধে মিটাবে। সে নিয়ন্ত্রণে ছিল, সচেতনও। মুনছুর সাখাওয়াত বিরক্ত সরিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” ডেট কবে? আজ, কালকে হওয়ার কথা নাকি? ”
” না। ”
সঙ্গে সঙ্গে সে দাঁত দিয়ে আপন ঠোঁট কামড়ে ধরল। দাগের ভিন্ন কারণ স্পষ্ট হওয়া মাত্র তার সচেতনতার দাম্ভিক ভাবটাও কাচ ভাঙার মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, যে প্রস্তুতি ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কারণে তার পৌরুষ সন্দেহের মুখোমুখি হয় সেই প্রস্তুতি আজ ছিল না। দারুন তৃপ্ত ও সুখানুভবের খোলামেলা আসঙ্গ মুহূর্তটা তার ভবিষ্যতের জন্য আতঙ্ক হয়ে গিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত ভাবনার মধ্যে স্ত্রীর দিকে তাকাল। সে বসে নেই। বিছানার চাদর খামচে ধরে টেনে এনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে আবারও। তার এত মায়া লাগল! দুইদিন আগেও যে কিশোরীকে তরুণী মনে হয়েছিল সেই কিশোরীকে এখন শিশু বোধ হচ্ছে। অসচেতনার কারণে যদি সত্যি আরেক প্রাণের আগমন ঘটে তাহলে কী হবে? মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের হালকা বা পোক্ত কোনো উত্তরই তৈরি হতে দিল না। পূর্বে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। স্বর্ণলতাকে আরও একবার জাগিয়ে বলল,
” এসো, তোমাকে গোসল করিয়ে দিই। ”
সে চোখ খুলে থাকলেও ঘুমের ভাবের মধ্যে ছিল। কিঞ্চিৎ ঝিমাচ্ছিলও। স্বামীর আহ্বানে পুরোপুরি ঘুম কেটে গেল। সোজা হয়ে বসে চোখ বড় বড় করে সুধাল,
” আপনি আমাকে গোসল করিয়ে দিবেন? ”
” দিলাম। সমস্যা কী? আমাদের মধ্যে গোপন কিছু নেই। ”
” গোপন নাই বলে কি আমি গোসল করতে ভুলে গেছি? আপনাকে গোসল করিয়ে দিতে হবে? ”
” ভুলোনি। কিন্তু তুমি এখন একা গোসল করতে পারবে না। সাহায্য লাগবে। ”
” কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার মুখোমুখি বসে ছিল। এবার উঠে একটু দূরে সরে বলল,
” উঠে দাঁড়াও। তাহলে বুঝতে পারবে। ”
স্বর্ণলতা ভ্রূ কুঁচকে দ্বিধাভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপরে সটান উঠে দাঁড়াল। এক সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। আলোকিত রুমটায় আচমকা আঁধার নেমে এলো। মাথা পাক দিয়ে উঠামাত্র সর্বাঙ্গ এত কেঁপে ওঠল যে, সে তাল সামলাতে পারল না। অজান্তেই ধপাস করে বসে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত দৌড়ে এসে পাশে বসল। স্ত্রীর দুর্বল দেহটা একহাতে প্যাঁচিয়ে ধরতে টের পেল, এখনও কাঁপছে! স্বর্ণলতা মাথাটা স্বামীর কাঁধে রেখে কতক্ষণ জিরিয়ে নিল। একটু স্বাভাবিক হতে বলল,
” সকালে গোসল করব। ”
” না। এখন করবে। ”
কণ্ঠটা এত কড়া ও দৃঢ় শোনাল যে, স্বর্ণলতা আশ্চর্য হলো। মানুষটা এখনও তার সাথে কঠোর আচরণ করছে! নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েও কি মাফ পায়নি? সে মাথা তুলে দেখতে চাইল মুখটা। মুহূর্তে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। দুই দিন পরে দীর্ঘ গোসলের পরিচ্ছন্নতা, বহু আকাঙ্ক্ষিত আরাধ্য মুহূর্তটা অর্জনের ফলে শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তির কোমল আভা মিলেমিশে বদনখানা এত স্নিগ্ধ, দীপ্তিমান ও প্রাণপূর্ণ লাগছে যে, স্বর্ণলতা মুগ্ধতায় ডুবে গেল। মোহগ্রস্ত অবস্থায় স্মরণে এলো, রুমকিবুর কথা, বিনা দোষে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তাকে দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথম স্বামীর জীপে বসা, দাদিজান রাগ করে রোদ্দুরে হাঁটতে গিয়ে অজ্ঞান হওয়া, স্বর্ণলতার ভয় পাওয়া ও মুনছুর সাখাওয়াত তার পাশে এসে বসা। তারপরে বিরক্তিকর মুহূর্তে রোদ্দুরের কাঁঠাল পাতার সঙ্গে আলোছায়া খেলার মুহূর্তে আচমকা রুক্ষ মূর্তিটা সৌম্য মূর্তি হয়ে ধরা দিয়েছিল। সাথে সাথে হারিয়েও গিয়েছিল। তাই স্বর্ণলতা আজকের মতো সেদিন মুগ্ধ হতে পারেনি।
” স্বর্ণলতা? চলো। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট করো না। ”
স্বামীর ডাকে তার দৃষ্টি কাঁপল। মোহভাব ছুটে যাওয়ার পরেও বুঝল, মুখটা থেকে সৌম্য দর্শনের এক ফোঁটাও হারায়নি। আরও বেশি স্পষ্ট হচ্ছে যেন! এর কারণ কী? সে অনেকটা সময় নীরব কাটিয়ে আপনা থেকে বিড়বিড় করল, ‘ গোঁফের নিচে যে গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে ছিলেন সেটা আমি দেখে ফেলেছি ‘
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিকে চেয়ে ছিল। বিড়বিড় করার কারণে ঠোঁটের ক্রমাগত নড়চড়া ও ক্ষীণ আওয়াজ উভয়ই টের পেল কিন্তু বুঝল না কিছুই। কৌতূহলী চিত্তে জিজ্ঞেস করল,
” কী বলছ? ”
স্বর্ণলতা চট করে নিজেকে সামলে বলল,
” আপনাকে বলার হলে তো শুনতেনই। ”
সে এই নিয়ে কথা আগাতে চাইল না। আগ্রহ নেই। তার মন ও চেতনা পড়ে আছে অন্য কিছুতে। তীব্রতর উত্তেজনাবশত সে যে ভুল করেছে সেটা যত দ্রুত সম্ভব কাটিয়ে ওঠা। সবার আগে স্বর্ণলতার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া জরুরি। ভ্রূণঘ্ন ঘটাতে এটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুনছুর সাখাওয়াত দমে গিয়েছে এমনভাবে বলল,
” আচ্ছা, চলো গোসল করবে। ”
” আমি একা করব। আপনি শুধু আমাকে গোসলখানায় দিয়ে আসুন। ”
” ভেতরে থাকি? তোমার কী লাগল না লাগল এগিয়ে দিলাম। ”
” না। ”
” তাহলে দরজা খোলা থাকবে। ”
” না। ”
” এখন এই জেদটা কিন্তু ভালো লাগছে না, স্বর্ণলতা! ”
সে একটু চমকে ওঠল যেন! আবারও সেই কড়া ও দৃঢ় কণ্ঠস্বর। এই মানুষটা কি এখন থেকে তার সাথে এভাবেই কথা বলবে? তাহলে কি তার অবুঝ সময়ের ভাবনাটায় ঠিক ছিল? নরম ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত যত্ন, ভালোবাসা এসব কিছুই ছিল শান্তিপূর্ণভাবে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করা। তারপরে এক নিমিষে সবই শেষ! আপন ভাবনায় তার মুখ টা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে ওঠছিল। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে নরম হলো। দু’হাতে গাল ছুঁয়ে বলল,
” সিটকানিটা অন্তত খোলা রাখো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি না ডাকলে ভেতরে ঢুকব না। ”
স্বর্ণলতা মোহগ্রস্তের মতো জবাব দিল,
” আচ্ছা। ”
_______
গোসল শেষে স্বর্ণলতাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিল। শরীরে পাতলা নরম কাঁথাটা মেলে দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এখন ঘুমাও। আমি একটু আসছি। ”
” কোথায় যান? ”
” বাইরে। একটু কাজ আছে। ”
” এতরাতে বাইরে যাবেন? আপনার না শরীর খারাপ? ”
সে হাতের ইশারায় ঘড়ি দেখাল। ঘণ্টার কাঁটা’টা বারোটাও স্পর্শ করেনি এখনও। স্বর্ণলতা তাজ্জব বনে গেল। সে ভেবেছিল, এখন রাতের শেষ প্রহর চলছে। এই সময়ে মুনছুর সাখাওয়াত তার একটা হাত নিয়ে নিজের গলা ছুঁয়িয়ে বলল,
” কী হয়েছে আমার? ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। সেই ভীষণ উত্তাপে তার শরীরে ঘামিয়ে তোলা গরম ভাবটা কোথায় গেল? তাপমাত্রা এত স্বাভাবিক যে, মনে হবে না এই শরীরে কখনও জ্বর এসে ছিল! মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হেসে বলল,
” আসছি। থাকো। ”
দরজা চাপিয়ে দিয়ে মুখ ফেরাতে দাদিজানের মুখোমুখি হলো। তিনি ময়নার সাহায্যে দাঁড়িয়ে আছেন। নাতিকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে বললেন,
” নিজে খাবি না, বউকেও খেতে দিবি না। সংসারের খরচ তো তোরা না খেয়েই বাঁচিয়ে দিবি। ”
” স্বর্ণলতা খায়নি? ”
” খাওয়ার সময়ে পেয়েছে? এসেই তোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কলির মুখে শুনলাম, দুপুরেও খায়নি। খালি পেটে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে হলো দাদিজানকে দিয়ে খাবারটা রুমের ভেতরে পাঠিয়ে দিতপ। কিন্তু মেয়ের যে অবস্থা! ঘুমে সারাক্ষণই ঢুলছে। এতক্ষণে হয়তো আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় এই বৃদ্ধার পক্ষে খাওয়ানো সম্ভব হবে না। তাই নিজের গমন পথের বাঁধাটা আবারও মেনে নিয়ে কলির উদ্দেশ্যে বলল,
” খাবার বেড়ে নিয়ে আয়। ”
খাইরুন নিসার আদেশে খাবার বেড়ে রেখেছিল অনেক আগেই। এখন বাড়ির কর্তার আদেশে দৌড়ে নিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত ভাতের প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকে দেখল, স্বর্ণলতা বিছানায় নেই। সে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে নিমগ্ন হয়ে পড়েছে। একটু আগেও যে মেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না সেই মেয়ে ক্রমাগত উঠবস করে সুবিনীতভাবে সিজদাহ্ দিয়ে যাচ্ছে।
________
সকালের নাস্তা সেরে খাইরুন নিসা বারান্দায় বসে ছিলেন। আজকাল তার বড্ড শীত লাগে। হাড়ের যুগলবন্দীতেও অসহণীয় ব্যথা করে। তাই খুব সকালে নাস্তা সেরে বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে থাকেন। শরীরে রোদের তাপ নেন। বেশ আরাম লাগে! এই সময়ে মুনছুর সাখাওয়াতের জীপ এসে থামল উঠোনটায়। ভূমি কাঁপিয়ে সোজা বাড়ির মূল দরজাটায় ঢুকেই ফিরে এলো সাথে সাথে। দাদিজানের দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বলল,
” আমি যে এসেছিলাম, তোমার নাতবউকে বলো না। ”
” কেন? আমি হঠাৎ মিথ্যা বলতে যাব কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের জবাব দিল না। ভোরের দিকে বেরুনোর সময়ে স্বর্ণলতা জানিয়েছিল, পরশুদিন থেকে তার পরীক্ষা শুরু। আজকে ঢাকা ফিরতে পারলে ভালো হবে। সেও আগপাছ চিন্তা না করে তৎক্ষনাৎ বলেছিল, নাস্তা খাওয়া শেষ করে তৈরি হয়ে থাকতে। সেই কথা রাখতে বাড়ি ফেরা হলেও তার এখন বউকে ঢাকা রেখে আসতে ইচ্ছে করছে না।
নাতির এই আকস্মিক বোবা হয়ে যাওয়াটাকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না। শরীরের সাথে সাথে ধৈর্য ও সহনশক্তিও ক্ষয়ে আসছে ধীরে ধীরে। খাইরুন নিসা পুনরায় বললেন,
” গাড়ির শব্দ শুনলেই তো বুঝা যায় তুই বাড়ি এসেছিস। এতক্ষণে স্বর্ণলতা তোকে দেখেও ফেলেছে মনে হয়। আমার রুমেই ছিল মেয়েটা। বোরকা পরছিল। আজকে নাকি ঢাকায় দিয়ে আসবি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তাৎক্ষণিক দরজার কাছ থেকে সরে এলো। বারান্দা থেকে লাফিয়ে উঠোনে নেমে বলল,
” তাহলে বলো, এসেছিলাম কিন্তু হঠাৎ একটা জরুরি কাজ পড়ায় আবার যেতে হচ্ছে। কখন ফিরব ঠিক নেই। সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারলে নিয়ে যাব। ”
চলবে