মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৯০+৯১+৯২+৯৩

0
655

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯০)

মুনছুর সাখাওয়াত সুধাল,
” আমার অবাধ্য হবে? ”
” না। কিন্তু আপনি অনুমতি দিলে আমার ভালো লাগবে। নাহলে সারাদিন মনখারাপ থাকবে। ”

এত সাবলীলভাবে নিরেট সত্য প্রকাশ করার দুর্লভ গুণটা স্বর্ণলতা ভালোই আয়ত্ত করেছে। এই গুণের অধিকারী শুরু থেকে ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরও দৃঢ়, আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মেয়েটার ভালো গুণগুলো মুনছুর সাখাওয়াতকে যেমন আকৃষ্ট করে তেমন ফাঁদেও ফেলে। এখনও ফেলল। সে জেনেবুঝে সজ্ঞানে কী করে চাইবে বউটার মন খারাপ হোক? অজান্তেই ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে। স্ত্রীর দিকে নীরব চেয়ে থেকে গম্ভীরতর কণ্ঠে বলল,
” অনুমতি দিলাম। কিন্তু কোথাও যেতে পারবে না। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। আমি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াব। চোখের আড়াল হওয়া যাবে না। চলবে? ”

স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ কোনো মতামত দিতে পারল না। চোখ সরিয়ে আনল চাঁদনির পানে। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি স্থির করতে সে হেসে ফেলল। সহাস্যে চোখের পাতা ফেলে, মাথা নেড়ে বুঝাল চলবে। স্বর্ণলতার চোখ, মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। স্বামীর দিকে চোখ ফিরিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানাল,
” চলবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তও দেরি করল না। ঘনঘন পা ফেলে কয়েক হাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। স্বর্ণলতা তখনও তার দিকে চেয়েছিল। চোখের ইশারায় জানাল, আলাপকাল যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে। সে নীরব ইশারা বুঝে নিয়ে তাকাল চাঁদনির পানে। তাকে মুখে কিছু বলতে হলো না। নিজ উদ্যোগে কথা আরম্ভ করল,
” মুনছুর তোমাকে মন থেকে ভালোবাসে এটা প্রথম দিনই বুঝে গেছিলাম কিন্তু ভালোবাসতে গিয়ে যে, নিজের আত্মসম্মান বিলিয়ে দিয়ে এতটা বাধ্য হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি। স্বামীকে এভাবে পাওয়ার জন্য বউদের কত সাধনা করতে হয়, জানো? তবুও যদি পেত! স্বর্ণলতা, বুঝতে পারছ তুমি কতটা সৌভাগ্যশালী? কোনো সাধনা ছাড়াই মুনছুর…”

পুরো কথাটা শেষ হলো না। স্বর্ণলতা একপ্রকার বাধ্য হলো মাঝপথে থামিয়ে দিতে। নিজের স্বামীর নাম অন্য একটা মেয়ের মুখে শুনতে ভালো লাগছে না। মুনছুর সাখাওয়াত কথায় কথায় একদিন বলেছিল, তার নাম ধরে ডাকে একমাত্র দাদিজান। তারপরে যদি কারও ঢাকার অনুমতি থাকে সেই মানুষটা স্বর্ণলতা। যদিও সে আজ অবধি নাম ধরে ডাকেনি, তবুও অধিকারটা অন্য কারও সাথে ভাগাভাগি করতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই চাঁদনির কথার মাঝে আচমকা বলে ওঠল,
” উনি আপনার থেকে বয়সে বড় হবে না? এমন নাম ধরে ডাকছেন কেন? খারাপ শোনাচ্ছে। হয় নামের সাথে কিছু যোগ করুন, নাহয় ছেড়ে দিন। আমি নিজ জ্ঞানে বুঝে নিব কার কথা বলছেন। ”

নির্ভয়, তেজোময় কণ্ঠস্বর ও শুদ্ধ উচ্চারণে ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় চাঁদনি প্রথমে আশ্চর্য হলো। থমথমে হয়ে ওঠল সুন্দর, পরিপূর্ণ নারী মুখটা। বছর দুয়েক আগে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেয়েটির সাথে। বয়সে ও শারীরিক সৌন্দর্যে তার থেকে অনেকটায় পিছিয়ে ছিল। ছোট নজরে দেখেছে। বেজায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও বিনয় ভাব কাটেনি এক মুহূর্তের জন্য। চোখে, গলায় তেজের ভাব টের পেত কিন্তু পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়নি। আজ আচমকা সেই তেজ এত বিস্ময়করভাবে প্রকাশ পেল যে, চাঁদনি কয়েক মুহূর্তের জন্য কথাই বলতে পারল না। নির্বোধের মতো কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখল কালো বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা মেয়েটাকে।

নীরবে, বিনা বাক্যব্যয়ে সময় খরচ করতে স্বর্ণলতা ইচ্ছুক নয়। দূরে অপেক্ষারত স্বামীর দিকে না চেয়েও তার অস্থিরতা ও অধৈর্যতা টের পাচ্ছিল। তাই নিজেই পুনরায় কথা বলল,
” চাঁদনিবু, আপনি কি এই কথাটা বলার জন্য আমাকে আটকেছেন? ”

তার এতক্ষণে হুঁশ ফিরল যেন! হেসে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। সহাস্যে জানাল,
” না। ”
” তাহলে? ”
” অন্য কথা বলব। ”
” বলুন। আমি শুনছি। শুধু অনুরোধ করব, যে কথাটা বলছেন সরাসরি ঐ কথাটায় বলবেন। প্যাঁচিয়ে দেরি করবেন না। ”

চাঁদনির হাসি বাড়ল। নীঃশব্দের হাসিতে এবার মিষ্টি, মন ভুলানো সুরেলা আওয়াজও যোগ হলো। স্বর্ণলতা একসময়ে এই মুখ, হাসি, প্রতিটি সাজে মুগ্ধ হতো। মনে হতো পৃথিবার সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে দেখছে! আজ কেন জানি, এই সৌন্দর্যে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করছে না। উপরন্তু বেজায় বিরক্ত হচ্ছে।

চাঁদনি হাসতে হাসতে বলল,
” একটা সত্যি কথা বলবো তাই দেরি হচ্ছে। তোমার মতো সর্বদা সত্য বলে অভ্যাস নেই তো। ”
” তাহলে অভ্যাস করুন। এই অভ্যাস আপনার ইহকাল ও পরকাল দুই জীবনকেই সুন্দর করবে। ”

সে এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলল না। মাথাটা নেড়ে সম্মতি দিল শুধু। তারপরে হঠাৎ হাসি থামিয়ে স্বর্ণলতার ডানহাতটা চেপে ধরল। গলার স্বর নিচু করে আকুল আবেদন রাখল,
” কথা দাও, এই সত্যিটা ও কে কখনও জানতে দিবে না। ”

ও সম্বোধন দিয়ে কাকে বুঝাচ্ছে স্বর্ণলতার বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হলো না। অজান্তেই মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে চোখ চলে গেল। সেদিকে চেয়ে থেকে সুধাল,
” কোন কথাটা? ”
” যেটা বলার জন্য তোমাকে আটকালাম। স্বর্ণলতা, আমি জানি বসতবাড়ির পরিবর্তে যে টাকা পেয়েছি তার পেছনে তোমার হাত আছে। ”
” না। দাদিজান চেয়েছিল তাই পেয়েছেন। ”
” দাদিজান তো শুরু থেকে চেয়েছিল আমার জন্য কিছু করতে, পারেনি। এবার পেরেছে। কারণ, তুমিও সাথে ছিলে। টাকা দিয়েও যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না, তাকে পেতেও যে তুমি সাহায্য করেছ, এটাও জানি। ”

স্বর্ণলতা এই কথাটার সঠিক নির্দেশনা বা অর্থটা বুঝে উঠতে পারল না। ভ্রূুদ্বয় কুঁচকে চেয়ে থাকলে চাঁদনি জানাল,
” আব্বার কথা বলছি। আমি জানতাম, আব্বা বেঁচে আছে। সুস্থও আছে। পাগলের কাহিনি মিথ্যা, বানোয়াট। ওর কাছে ছিল, তাই না? ”

এই প্রশ্নের উত্তরটা জানা থাকলেও বলতে ইচ্ছে হলো না। মুগ্ধ হয়ে দেখল কৃতজ্ঞপূর্ণ মুখটা। কাছের মানুষ সুস্থ বা অসুস্থ যে অবস্থায় থাকুক না কেন তার উপস্থিতিতেই বুকটা নির্ভার লাগে, স্বস্থির নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। সে মুগ্ধতা দমিয়ে নীরবে দৃষ্টি নামিয়ে নিতে চাঁদনির ব্যাকুল কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেল,
” আমার জন্য অনেক করেছ। কোনো স্বার্থ নেই, তারপরেও করেছ। এর বিনিময়ে আমি তোমাকে একটু শান্তি দিতে চাই। ”
” শান্তি! আমার তো কোনো অশান্তি নেই, চাঁদনিবু। ”
” আছে। ছোট তো তাই ধরতে পারনি এখনও। বউরা স্বামীর সকল খারাপ গুণ সয়ে নিতে পারে কিন্তু চরিত্রের দাগ সয়তে পারে না। তুমিও পারবে না। অবুঝ বয়সে বউ হয়েছ তাই একটু বেখেয়ালি আছ। আরেকটু বয়স হোক, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হোক তখনই খেয়ালটা ফিরবে। ”

স্বর্ণলতা এখনও পুরো কথাটা ধরতে পারেনি তবুও বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল, গলা শুকিয়ে এলো, পলক ফেলতে ভুলে গেল। সমুখের হাত ধরে থাকা ব্যাকুল নারী কণ্ঠধারীর দিকে একস্থির চেয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে ওঠল। দ্রুত বলল,
” কী বলতে চাচ্ছেন, সেটাই বলুন না! ”

চাঁদনিও দেরি করল না। কোনো রকমের ভণিতায় না গিয়ে সরাসরি বলল,
” তোমার স্বামী নির্দোষ। আমার সাথে কিছু হয়নি। ঐ ঘটনাটা মিথ্যা। ”

এই প্রথম কোনো সত্যকে স্বর্ণলতা বিশ্বাস করতে পারছে না। বুঝে ফেলা বিষয়টাকেও দুর্বোধ্য লাগছে। ক্ষণকাল নীরব, স্তব্ধ থেকে সুধাল,
” মজা করছেন? ”
” না। সত্যি বলছি। আমাকে বিশ্বাস করো। ”
” আমি উনাকেও বিশ্বাস করি। উনি আমার কাছে মিথ্যা বলতে পারে না। ”
” ও নিজেও সত্যিটা জানে না। ”
” না জেনেই মিথ্যা বলে বেড়াবে? সেটাও নিজের বউয়ের কাছে। আচ্ছা মানলাম, আপনার সাথে কিছু করেনি। তাহলে আপনি সন্তান সম্ভাবনা হলেন কীভাবে? ওটা যে মিথ্যা না, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। হাদিভাই নিজে বলেছেন, আপনার অ্যাবরশন করিয়েছে। ”
” এটা সত্যি। কিন্তু বাচ্চাটা ওর ছিল না। ”
” তাহলে কার ছিল? আসমান ভাইয়ের? ”
” না। ওর হলে তো নষ্ট করতে হতো না, স্বর্ণলতা। ঐ সময় আমার বিয়ে হলেও আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। এজন্যেই তো মুনছুরকে আরও একটা মিথ্যা বলেছি। ”

স্বর্ণলতা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সত্য-মিথ্যার এই ভয়ানক আলাপটায় সে শান্ত থাকতে পারছে না। প্রচণ্ড উত্তেজনায় তার বুক কাঁপছে, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চোখের মণিজোড়া চাঁদনির দিকে নিবদ্ধ হলেও মুখের কোনো এক অংশে স্থির থাকতে পারছে না। পলক ফেলছে ঘনঘন। শ্বাসকার্য চলছে অনিয়মিতভাবে। কখনও রুদ্ধ হয়ে আসছে কখনও অস্বাভাবিক গতিতে ছুটছে।

স্বর্ণলতা উত্তেজনাবশত চাঁদনির আরও কাছে চলে গেল। নিজের হাতটা এখনও তার মুঠোতেই ছিল। সেই হাতের উপর অন্যহাতটা রাখতে গিয়ে খামচে ধরে ফেলল। রুদ্ধশ্বাসে সুধাল,
” প্রথম মিথ্যাটা কী ছিল, চাঁদনিবু? ”
” আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। ”
” আপনি বললেন, আর উনি মেনে নিল? ”
” না মেনে উপায় ছিল না। ঐ রুমটাতে শুধু আমরা দুজনেই ছিলাম। আমার পক্ষে সাক্ষীও ছিল যে। ”
” সাক্ষী! কে এই সাক্ষ্য দিয়েছিল? ”
” কাশেম। ”

স্বর্ণলতার হাতের খামচির আঁচড় ঢিলা হলো খানিকটা। কাশেম নামটা পরিচিত ঠেকছে। কানের কাছে বহুবার উচ্চারণ হয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াতই করেছিল। চেহারাটা ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু বিয়ের দিন থেকেই এই নামটা ঘনঘন শুনে এসেছে। সম্ভবত তার খাস লোক ছিল। সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকত। ঢাকায় যাওয়ার পরে এই নামটা শুনছে না। মুনছুর সাখাওয়াত এখন একা একা চলাফেরা করে। এর বিশেষ কোনো কারণ আছে নাকি সে জানে না। কখনও আগ্রহ দেখায়নি।

স্বর্ণলতা ভাবনা থেকে বেরিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” উনি মিথ্যা সাক্ষী দিবে কেন? আপনার আত্মীয় হয়? ”
” না। ”
” টাকা খেয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

চাঁদনি একটু থামল। চোখ বন্ধ করল। লম্বা দম নিতে নিতে নিজের সাথে বুঝাপড়া করে নিল। অতঃপর বলল,
” ঐ বাচ্চাটা কাশেমের ছিল। ”

স্বর্ণলতা আকাশ থেকে পড়ল যেন! বিস্ফারিত দেখাল মুখটা। পরক্ষণে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল চোখদুটিতে। চাঁদনির থেকে উভয় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বলল,
” উনি তাহলে আপনার প্রেমিক ছিল। ”
” না। ওর মতো পিশাচ আমার প্রেমিক হতে যাবে কেন? ”
” তাহলে কী? পরিষ্কার করে বলছেন না কেন? তখন থেকে প্যাঁচিয়ে যাচ্ছেন! চাঁদনিবু, আমাকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। কোথাও থামবেন না, বাদও দিবেন না। ”

কণ্ঠটায় কী ছিল সে জানে না। কিন্তু কথা বলা পুতুলের মতো গড়গড় করে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। যার মূল বিষয়টা ছিল এরকম। সেদিন মুনছুর সাখাওয়াতরা সত্যি মদ খেয়ে আমোদে ফুর্তি করছিল। সহসা খবর আসে, খাইরুন নিসা নাতির খোঁজ করছে। ঐ বয়সে মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানকে ভয় করত। তন্মধ্যে প্রথমবারের মতো মদ খেয়েছে! লজ্জা, ভয়, শঙ্কা সবমিলিয়ে সে তখনই মদের আসর থেকে বেরিয়ে যায়। একটা রুমে লুকিয়ে পড়ে। এই সময়ে ঘটনাস্থলে খাইরুন নিসার পূর্বে চাঁদনি উপস্থিত হয়। মুনছুর সাখাওয়াতের খোঁজ করতে কাশেম একটা রুম দেখিয়ে দেয়। চাঁদনি সেই রুমে গিয়ে দেখে কেউ নেই। মুহূর্তে বুঝে যায়, তার সাথে মশকরা হচ্ছে। রাগে-দুঃখে বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারল না, কাশেম আটকে ফেলল। তারপরে প্রবল ধ্বস্তবিধ্বস্তের মধ্যে ধ র্ষণের স্বীকার হয়। নারী সম্মান হারিয়ে ফেলে। কাশেম জানত চাঁদনি ভালোবাসার কাঙাল। মুনছুর সাখাওয়াতকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাকে পাওয়ার জন্য নিজেকে ছোট করতে এক মুহূর্তও দেরি করবে না। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল। সবার কাছে বলে বেড়াল, চাঁদনি ও মুনছুরের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। সময়, ভাগ্য, পরিস্থিতি, ঘটনা সবকিছু এমনভাবে মিলে গেল যে, সবাই তার কথা বিশ্বাস করল। কারও কোনো সন্দেহ হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত এতটায় নেশাগ্রস্ত ছিল যে, শুরুতে কিছু বুঝতে পারল না। পরে যখন বুঝে এলো তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেয়েও স্বার্থোদ্বারের দিকে বেশি মনোযোগী হলো।

স্বর্ণলতা সব শুনে বলল,
” কী পরিমাণে স্বার্থ লোভী হলে মানুষ এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে আমি অনুমানও করতে পারছি না! ”

সে চাঁদনির কাছ থেকে সরে যেতে উদ্যত হয়েও থামল। অনুতপ্তের আগুনে ঝলসে যাওয়া মুখটায় চেয়ে বলল,
” আপনি আমার চেয়েও অধিক সৌভাগ্যশালী। আপনার এই কুকর্মের কথা জেনেশুনে আসমান ভাই আপনাকে গ্রহণ করেছে। হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে আপনার বাধ্যও হয়েছে। এই একই কাজটা যদি আমি করতাম, উনি আমার দিকে ফিরেও তাকাতেন না। ”

______
মুনছুর সাখাওয়াত জীপটা চালু করে বলল,
” কী এমন শুনাল যে, আমার সাথে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। মিথ্যাবাদিটা নিশ্চয় আমার নামে খারাপ কিছু বলেছে! এজন্যে ওর কাছে তোমাকে ছাড়তে চাইনি। আর কয়েক ঘণ্টা! তারপরে ভোর হবে, তুমিও চলে যাবে। এই কয়েক ঘণ্টাও শান্তিতে কাটাতে পারব না। প্যাঁচ লাগিয়ে দিল। ”

কণ্ঠস্বরে প্রবল আফসোস, দুঃখ। স্বর্ণলতা টের পেয়েও ফিরে তাকাল না। সে খোলা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আছে। দৃষ্টি বাইরে স্থির রেখে সুধীর কণ্ঠে কথা বলল,
” খারাপ কিছু বলেনি। ”
” তাহলে কথা বলছ না কেন? তুমি বলেছিলে, অনুমতি দিলে খুশি হবে। সেই খুশিটা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না কেন? স্বর্ণলতা, এদিকে তাকাও। আমি তোমার খুশি দেখতে চাই। ”

সে ভীষণ অনিচ্ছায়, অবহেলায় মুখ ফেরাল। স্বামীর মুখটায় চোখ পড়তে মুখে মেঘ জমতে লাগল। মনে পড়ল, একটা মিথ্যা গল্পের খপ্পরে পড়ে এই মানুষটাকে কতটা কষ্ট দিয়েছিল, হেয় করেছিল। অভ্যস্ত নয়, তারপরেও তাদের ছোট ঘরটায় বসে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আধুনিক পাখা ছিল না, বাতি ছিল না, দামি খাবার ছিল না। গরমে অতিষ্ঠ হয়েছে, কুপির ম্লান আলোয় বিরক্ত হয়েছে, চিনির টলটলে সরবত দেখে নাক কুঁচকেছে তবুও সরে আসেনি। সারারাত জেগেছে, তাকে মানানোর জন্য কত কীই না করেছিল! ঘটনাগুলো একে একে মনে পড়তে তার বুক ভেঙে কান্না এলো। নিজেকে সামলাতে পারল না কিছুতেই। চোখ বেয়ে অশ্রুর ঢল নেমে এলো। কান্নারত অবস্থায় আচমকা স্বামীকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল যে, মুনছুর সাখাওয়াত টাল সামলাতে হিমশিম খেল। আরেকটু হলে দুর্ঘটনা ঘটে যেত! সে প্রথমে অতি সত্বর গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামাল
অতঃপর স্ত্রীর পিঠ ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ কী হলো? চলন্ত গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে এমন করে কেউ? যদি এক্সিডেন্ট করতাম? ”

স্বর্ণলতা কোনো জবাব দিল না। একমনে কেঁদে চলেছে। তার কান্না টের পেতে মুনছুর সাখাওয়াতের কয়েক সেকেন্ড লাগল। সহসা হাত দিয়ে মাথা তুলতে বুক কেঁপে ওঠল। ব্যাকুল হয়ে সুধাল,
” কাঁদছ কেন? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছ? ”

স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে স্বামীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাথাটা বুকের কাছে রাখতেও পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বের মতো হাত দিয়ে তুলে বলল,
” চাঁদনি খারাপ কিছু বলেছে? ”

স্বর্ণলতা কান্নার দমকে কথাই বলতে পারছে না। সমানে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। এই উত্তরটাও সে মুখে দিতে পারল না। মাথা নাড়তে মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” তোমার একটা হাত ধরেছিল তো! পোড়া জায়গাটায় ব্যথা দিয়েছে, না? তুমি একটু থামো। ওর একটা না দুইটা হাতই আমি কেটে ফেলব। ”

সে গাড়িটা পুনরায় চালু করল। সত্যি হাসপাতালের দিকে ঘুরতে নিলে স্বর্ণলতা আটকাল। বহুকষ্টে উচ্চারণ করল,
” চাঁদনিবু কিছু করেনি। ”
” তাহলে? কী হয়েছে, বলো। না বললে বুঝব কীভাবে? ”

প্রশ্নটা করা মাত্র মনে পড়ল স্বর্ণলতা আরও একবার এমন রাস্তার মধ্যে কান্না করেছিল। তখন সে মসজিদে নামাজ পড়বে কথা দিয়ে থামিয়েছিল। এখনও কি সেই পন্থা অবলম্বন করবে? মুনছুর সাখাওয়াত রাস্তার দুই ধারে চোখ বুলিয়ে বলল,
” এখানে কোনো মসজিদ নেই, যোহরের আজানও পড়েনি। নামাজ পড়ার কথা দিলেও তো পড়তে পারব না, বউ। এখন তোমার কান্না থামাই কী করে? ”
” বাড়ি যাব। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যান। ”
” বাড়ি যাওয়ার জন্য কাঁদছ? ঐদিকেই তো যাচ্ছিলাম। ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। যতটা সম্ভব অশ্রুপাত কমিয়ে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখল। একহাতে পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে ফিসফিসে বলল, ‘ আমাকে মাফ করে দিন। ‘

______
বাড়ির উঠোনে জীপটা থামতে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” কাশেম ভাইকে কি চাকরি থেকে বাদ দিয়েছেন? ”
” না। ”
” তাহলে এখন দেখি না যে! আগে তো সারাক্ষণই আপনার সাথে থাকত। ”
” এখনও থাকে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে বাইরে বের হলে কাউকে সঙ্গে নিই না। তাহলে আমার সাথে তুমি মন খুলে মিশতে পার না। ”
” উনি কি বিবাহিত। ”
” হ্যাঁ। ”
” বাচ্চা আছে? ”
” না। বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ”
” কেন? ”

এই পর্যায়ে এসে মুনছুর সাখাওয়াত থমকাল। স্ত্রীর দিকে গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে সুধাল,
” হঠাৎ ও কে নিয়ে এত আগ্রহ কেন? ”
” দরকার আছে। উনাকে ডাকেন তো। ”
” আগে বলো, কী দরকার। ”
” উনার মুখটা দেখব। যাতে চেনা থাকে। ”
” চেনা থাকার জন্য একটা পরপুরুষকে সেধে দেখতে চাচ্ছ? বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্য কোনো কারণ আছে। স্বর্ণলতা, আসল কারণটা বলো। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯১)

স্বর্ণলতা কথা দিয়েছিল চাঁদনির গোপন কথাটা স্বামীকে জানাবে না। প্রতিশ্রুতি ভাঙার অভ্যাস নেই বিধায় এই গোপনীয়তাও রক্ষা পাবে। কিন্তু যার জন্য নির্দোষ স্বামীকে কষ্ট দিয়েছে, ছোট করেছে তাকে একেবারে ছেড়ে দেয় কী করে? নিজের স্বামীকেও স্বর্ণলতা সামান্যতম ছাড় দেয়নি। চাইলে পূর্ণরূপে ছাড় দিতে পারত। গল্পের ঐ অংশে মেয়ের সম্মতি ছিল। তবুও তার অবুঝ মন ছাড় দিতে পারেনি। ছোটবেলা থেকে জেনেছে বিবাহ পূর্বে দুটো নর-নারীর ঘনিষ্ঠ হওয়া ঘোর অন্যায়। ঐ জানা কথাটা মনের মধ্যে এমন প্রভাব ফেলল যে, স্বর্ণলতা কঠোর হতে বাধ্য হয়েছিল। সত্যিকারের ঘটনাটা আরও ভয়ানক, কুৎসিত। মেয়ের অমতে জোর করে ধর্ষণ, অতঃপর আবেগকে অস্ত্র বানিয়ে চাঁদনি ও মুনছুর সাখাওয়াত উভয়কে ফাঁসিয়ে নিজে বেঁচে যাওয়া। দুটোই বড় অপরাধ, মাফের অযোগ্য। স্বর্ণলতা মাফ করার দিকে বড্ড উদারমনা! কাশেম নিজের ভুল বুঝতে পেরে যদি মাফ চেয়ে নিত তাহলেও হয়তো মাফ পেত। অন্যায়কারী মাফ চায়নি। এত বছরেরও যে আপন কর্মে ভুল খুঁজে পায় না, অনুতপ্ত হয় না সে কোনোকালেই ন্যায়-অন্যায়ের তফাৎ বুঝবে না। কঠিন শাস্তির মাধ্যমে বুঝাতে হবে। শাস্তি দেওয়ার বেলায় স্বর্ণলতা ভীষণ অপটু, অজ্ঞ। সতেরো বছর বয়সে সেই রকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। কঠিনতর শাস্তি কী হতে পারে জানে না। অথচ তার কঠিন হতেও কঠিনতর শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে!

স্বর্ণলতা ও মুনছুর সাখাওয়াত উভয়ই জীপে বসে আছে তখনও। জীপটা উঠোনে, স্থির হয়ে থেমে আছে। দুজনে একে-অপরের দিকে চেয়ে থাকলেও দৃষ্টি ও চিন্তা-ভাবনায় ছিল অন্যকিছু। সহসা স্বর্ণলতা অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উঠে বলল,
” কাশেম ভাই একটা দোষ করেছে। আমি চাই, আপনি উনাকে শাস্তি দেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের কপালে ভাঁজ পড়ল। স্ত্রীর দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিটা আরও গভীর ও সন্দেহপূর্ণ হলো। কাশেমের সাথে এই মেয়ের কোনো লেনাদেনা নেই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভাবে যোগাযোগ থাকারও কথা না। তাহলে দোষ করে বসল কীভাবে? তার ইচ্ছে হয় বিষয়টা পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে। কিন্তু সমুখের কিশোরীর গলার স্বর ও চাহনির ধরণে ভিন্নতা দেখছে। এরকমটা সে আর কখনও দেখেনি। মুনছুর সাখাওয়াত নিজের ইচ্ছে ও অপরিসীম কৌতূহল যথাসম্ভব সামলে উঠে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার সাথে দোষ করেছে? ”
” না। অন্য কারও সাথে। ”
” কার সাথে? ”
” বলা যাবে না। ”

এখানে এসে মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূযুগলও কুঁচকে এলো। চোখজোড়া ছোট ছোট করে সন্দিহানে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” নিষেধ আছে। ”

স্বর্ণলতা মিথ্যা বলতে পারল না। সত্যের মাধ্যমে গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা করছে। তার নিজ ও সামনের কৌতূহলী যুবার প্রতি আস্থা আছে। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিক থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছিল না। কেমন যেন রহস্য ও ধোঁয়াশায় জড়িয়ে পড়ল! কতক্ষণ নীরব থেকে আচমকা বলল,
” দোষটা কী সেটা তো বলবে? ”
” ধ র্ষণ করেছে। ”

শব্দ দুটো শোনামাত্র তার চোখ দুটি বড় হয়ে গেল। বিস্ফারিত নেত্রজোড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে এই ধরনের দোষ কাশেম করতে পারে না। তার বহু বছরের পুরোনো, বিশ্বস্ত খাস লোক। দিনের শুরু ও শেষ পুরো সময়টায় মহাজনের সাথে কাটায়। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত সব ধরনের কাজের সাথে সে সম্পৃক্ত। যদি ঘটিয়ে থাকেও সবার আগে তার কানে আসবে। সে বিস্ময় ভাব ধরে রেখে সুধাল,
” তুমি স্বচক্ষে দেখেছ? ”
” না। কিন্তু ঘটনা মিথ্যা না, এই ব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত। ”

মুনছুর সাখাওয়াত অস্থির চিত্তে কি যেন একটা বলতে চাইল। স্বর্ণলতা সুযোগ দিল না। পূর্বে আটকে দিয়ে দ্রুত বলল,
” আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না? আপনার মনে হচ্ছে, আমি মিথ্যা বলছি? ”
” না। যে নিজের জন্যও মিথ্যা বলে না সে অন্যের জন্য মিথ্যা বলবে কেন? সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আমি ভাবছি, এরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল অথচ আমি আঁচও পেলাম না! ”
” যে সময়ে এই অনাচার ঘটিয়েছে সেই সময়ে আপনি মহাজন হয়ে উঠেননি। এখনকার মতো ধূর্ততা, ক্ষমতা, সম্পদও ছিল না। তাই হয়তো আঁচ পাননি। ”

জবাবটা দেওয়ার সাথে সাথে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ তখন যদি আঁচটা পেতেন! তাহলে আজকে আপনার জীবনটাও অন্যরকম হতো। হয়তো কখনও সুদ ব্যবসায়ী মহাজন হয়েই উঠতেন না। ‘

মুনছুর সাখাওয়াত এতক্ষণে চোখদুটি সরাল। জীপ থেকে নামল একলাফে। স্ত্রীর দিকে ঘুরে এসে একহাত বাড়িয়ে ধরল সাহায্য প্রদানে। স্বর্ণলতা উঠোনের মাটিতে পা রেখে স্থির হয়ে দাঁড়াতে শুনল,
” অনেক পুরোনো ঘটনা! এত দিনে এসে তোমাকে কে বলল? এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করো না। আমাদের করার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ঘরে চলো। ”

কণ্ঠটায় কী নিদারুন অবহেলা, করুণার অভাব। ঝামেলা থেকে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। স্বামীর থেকে এহেন আচরণটুকু স্বর্ণলতা মানতে পারল না। পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে কঠোর গলায় জবাব দিল,
” ঘটনা হোক পুরোনো বা নতুন। কিন্তু অন্যায় করেছে, শাস্তি পেতে হবে। তখন শাস্তি দেওয়ার মতো কেউ ছিল না তাই বেঁচে গিয়েছে। এখন আছে। সেটা আপনি। আমি চাই আপনি শাস্তি দিন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছিল। সহসা স্ত্রীর চাওয়া শুনে থমকে গেল। চোখদুটিতে চাইতে তেজের তাপে ঝলসে দিল যেন! দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে, এই মেয়ে নিজের চাওয়া পূরণ না করে একচুলও নড়বে না। অনেকদিন পরে তার চিরাচরিত ভয়ঙ্কর জেদি মনোভাবের দেখা পেল। খুশি, অখুশি কোনো অনুভূতি টের পাচ্ছে না। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল,
” আমি মারামারি ছেড়ে দিয়েছি। ”
” ওগুলো আপনার অন্যায় ছিল, নিজ স্বার্থে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। ছেড়ে দেওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। আজকে ন্যায়ের পক্ষে কারও গায়ে হাত দিবেন। ভালো কাজে ক্ষমতা দেখাবেন। আমার সাথে আরও অনেকে খুশি হবে। ”

সে স্বর্ণলতার কাছে এগিয়ে এলো। তেজঃপূর্ণ চোখজোড়ায় চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি সত্যি চাও, আমি কাশেমকে মা রি? ”
” আমি চাই, আপনি কাশেম নামের ধর্ষককে মা রেন। ”
” কতটা? ”
” শুধু দেহে প্রাণ থাকলেই হলো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তও দেরি করল না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কাশেমের নাম্বারে কল ঢুকাল। সে বাড়ির কাছেই ছিল, অন্যান্য ছোকরাদের সঙ্গে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। সহসা মহাজনের ডাক পেয়ে দৌড়ে এলো। সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াতেও পারল না, পূর্বেই সজোরে চ ড় বসাল বামগালে। আঘাতটা করে স্বর্ণলতার দিকে ফিরল। সেই আগের মতোই অটল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে একফোঁটা ভয় নেই। পলক জোড়া একবারের জন্যও কাঁপছে না! মুনছুর সাখাওয়াত এত আশ্চর্য হলো! যেই মেয়েটা মারের শব্দ শুনেও ভয়ে কাঁপত, চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিত, নীরবে অশ্রু জড়াত সেই মেয়ে আগ্রহ নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে আছে। বুকের মধ্যে এত সাহস জন্মাল কীভাবে? সে আরও কয়েকটা চ ড়-থা প্পড় মারল। প্রতি আঘাতের পরে স্ত্রীর দিকে এক ঝলকের জন্য তাকাচ্ছিল। স্বর্ণলতা বিষয়টা খেয়াল করে ভাবল, তার সামনে হয়তো মারতে সংকোচ বোধ করছে। এজন্যে থা প্পড়ের ওজন এতই হালকা হচ্ছে যে, কাশেম এতগুলো থা প্পড় খেয়েও একচুল নড়েনি। শুধু অবোধের মতো চোখ বড় বড় করে মহাজনের দিকে চেয়ে আছে।

স্বর্ণলতা চটজলদি জায়গাটা থেকে সরে এলো। উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় উঠতে সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল। অসভ্য ভাষায় উচ্চারিত শব্দগুলো আকাশ-বাতাসে এমনভাবে মুখরিত হয়ে উঠল যে, সে কান চেপে ধরল। মারামারি ছেড়ে দেওয়ার নমুনা এই? গালাগালির চরম শদগুলো ভুলেনি একটাও। এই মুখ দিয়েই কি তার সাথে ভালোবাসার কথা বলে? বের হয় কী করে? সে সদর দরজায় পৌঁছাতেই কাশেমের মরণ চিৎকারগুলোও কানে আসল।

_______
প্রায় মিনিট পনেরো পরে মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ঢুকল। স্বর্ণলতা বোরকা খুলে তার অপেক্ষাতে ছিল। পায়ের আওয়াজ পেয়ে চকিতে ফিরল। ঘেমে নেয়ে ওঠেছে একদম। মুখ থেকে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। হাঁপাচ্ছেও খুব। কতটা মা রল! বেঁচে আছে তো? তার সুধানোর সাহস হলো না। চপলপায়ে হেঁটে গিয়ে প্রথমে পাখা ছেড়ে দিল। অতঃপর গ্লাসে পানি ঢেলে স্বামীর দিকে বাড়িয়ে ধরল।

মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসে ঢকঢক করে পানি খেল। গ্লাস রাখা মাত্র স্বর্ণলতা তার সামনে এলো। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে সযতনে মুখের ঘাম মুছতে লাগল। সে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। এই যত্নটা তার এত ভালো লাগে! একেবারে হৃদয়টা বরফ জলে ধুয়ে দেয়। মুদিত চোখে ভাবে সে মনেমনে চেয়েছে বউটা তার খেয়াল রাখুক, যত্ন করুক, ভালোবাসুক। চাওয়া পূরণে সর্বদা সচেষ্টও থেকেছে। কিন্তু কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি তার এই চাওয়া এত দ্রুত ও পরিপূর্ণভাবে পূরণ হবে। এখনও স্বপ্ন বলে বোধ হয়। বিশ্বাসই হতে চায় না, এই সুখ তার ভাগ্যে ছিল, খুব সহজে পেয়েও গিয়েছে।

স্বর্ণলতা গলাটাও মুছে দিল। বুকের কাছের বোতাম দুটি খুলতে মুনছুর সাখাওয়াত একহাতে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল। আরও কাছে টেনে এনে একপায়ের ঊরুতে বসাল। ঠোঁটের দিকে চাইতে দেখল, একপাশটা লাল হয়ে সামান্য ফুলে আছে। ফোলাস্থানে আঙুল বুলিয়ে সুধাল,
” এবার বলো, আমার এখানে জখম করলে কেন? ”

সে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আপনি ওটা এখনও মনে রেখেছেন? ”
” ভুলে যাওয়ার কথা ছিল? ”

এই প্রশ্নের জবাবে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। অবুঝের মতো চেয়ে থাকলে মুনছুর সাখাওয়াত তাড়া দিল,
” স্বর্ণলতা, বলো। ”
” তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ”
” বেশ, অগুরুত্বপূর্ণ কথাটায় আমি শুনব। বলো। ”

সে একটু থেমে বলল,
” আমার মতো প্রীতুলবুও পড়াশোনা করে। বয়সে খুব বড় হবে না। এখনই বাচ্চা নিয়ে নিল! ”
” ওর বাচ্চার সাথে তোমার ঠোঁট কামড়ানোর সম্পর্ক কী? ”
” আমার বিষয়টা ভালো লাগেনি। হাদিভাই শিক্ষিত, ডাক্তারি করছে। শহুরে চালচলনেও অভ্যস্ত। এই রকম একটা মানুষও যদি এত দ্রুত বাচ্চা নিয়ে নেয় তাহলে…”

এখানে এসে সে ইচ্ছে করে থেমে গেল। স্বামীর মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করে চুপ থাকল। ভেবেছিল, পরের কথাটুকু শোনার জন্য আগ্রহ দেখাবে। তেমন কিছুই ঘটল না। তাকে সম্পূর্ণ হতাশ করে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” তুমি ডাক্তারকে ভেবে ঠোঁট কামড়েছ? বিয়ের এতদিন পরে ভালোবাসায় মাখামাখি করেও আমাকে এই কথাটা শুনতে হলো? ”

মুহূ্র্তে তার চোখ, মুখ শক্ত হয়ে গেল। ঠোঁটের উপরে হাতের স্পর্শটা এত দেবে গেল যে, সে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াতের এতেও হুঁশ এলো না। দুর্দমনীয় রাগে নিঃশ্বাস গরম হয়ে ওঠেছে। স্বর্ণলতা বুঝে গেল ঘটনা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। স্বামীর হাতটা জোর করে সরিয়ে দ্রুত বলল,
” কারও কথা ভেবে ঠোঁট কামড়াইনি। আমি ভাবছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলব। আপনারও কি এখনই বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা আছে নাকি। হাসপাতালের মধ্যে কথাটা বলে উঠতে পারছিলাম না বলে অজান্তে ঠোঁটে কামড় পড়ে গেছে। আপনি জানতেন, এটা আমার বদঅভ্যাস। ”

তার রাগ খানিকটা কমলেও মুখের কঠোর ভাবটা কাটল না। গম্ভীরস্বরে জানাল,
” নেই। ”
” সত্যি? ”
” এত অবাক হওয়ার কী আছে? বাচ্চা বিয়ে করে যে অভাবে ভুগেছি। সেটা আগে পুষিয়ে নিই, তারপরে বাচ্চা-টাচ্চা নিয়ে ভাবা যাবে। ”

স্বর্ণলতা এত খুশি হলো! সেই সাথে উপলব্ধি করল, শুধু শিক্ষিত বা আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক হলেই সব সিদ্ধান্ত সঠিক ও প্রশংসনীয় হয় না।

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর অধরের ফোলা স্থানে আলতো চুমু খেল প্রথমে। পরক্ষণে গভীর চুম্বনে ডুবে গেল। সেকেন্ড কয়েক পেরুতে টের পেল, স্বর্ণলতা সাড়া দিচ্ছে না। উল্টো ঠোঁট জোড়া শক্ত হয়ে একে অপরের সাথে মিলে আছে। সে আপন ঠোঁট জোড়া সরিয়ে নিতে দেখল, স্বর্ণলতা চোখ বুঁজে আছে। একমনে কী যেন বিড়বিড়ও করছে। মুনছুর সাখাওয়াতের বুদ্ধিভ্রষ্ট হলো, পর মুহূর্তে বউকে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? কী হলো? ”

এই ডাকেরও প্রত্যুত্তর না করতে সে ভয় পেয়ে গেল। গালে ক্রমাগত মৃদু থাপ্পড় দিয়ে আরও একবার ডাকতে স্বর্ণলতা স্বামীর ঠোঁটের উপরে হাত রাখল। চোখের ইশারায় বুঝাল চুপ থাকতে। মুনছুর সাখাওয়াত কথা শুনল। প্রায় মিনিটখানেক সময় পরে স্বর্ণলতা ধপ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আজানের জবাব দিচ্ছিলাম। ”

চুপ থাকা মানুষটা এবার কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলল যেন! অবাক চোখে স্বর্ণলতার দিকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়াল। গোসলখানার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
” আমার আদরের জবাব দেওয়া লাগবে না। তুমি আজানেরই জবাব দেও। ঐ যে আরেকটা আজান হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ তো? ”

সে গোসলখানার দরজা আটকাতে গিয়েও আটকাল না। কী একটা মনে পড়েছে এমনভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো। স্বর্ণলতা এগিয়ে এসে তোয়ালেটা কাঁধে রাখতে রাখতে বলল,
” যেকোনো একটার জবাব দিলেই হয়। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এবার পুরোদমে হতাশ হলো। পুনরায় গোসলখানায় ঢুকে বলল,
” আমি পাগল হলেও মাথার মধ্যে জ্ঞান বুদ্ধি ছিল। তুমি আমার সেটাও নষ্ট করে দিচ্ছ! ”

______
প্রায় আধঘণ্টা পরে মুনছুর সাখাওয়াত গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলতে দেখল, স্বর্ণলতা পূর্বের স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ম্লান, চোখটা টলমল। তাকে দেখতে পেয়ে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি রাগ করেছেন? ”

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” তুমি সেই তখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছ? ”
” হ। ”
” কেন? ”
” মনে হলো আপনি রাগ করেছেন। ”

তার ধারণা মিথ্যা না। মুনছুর সাখাওয়াত সত্যি রাগ করেছিল। বউয়ের মুখের অবস্থা ও কণ্ঠস্বরের অস্থিরতা দেখে পুরো রাগ পানি হয়ে গেল। কিন্তু স্বীকার করল না। বলল,
” নামাজ শেষ করো। ”
” আগে রাগ ভাঙেন। নাহলে নামাজে মন বসবে না। ”

সে একটুক্ষণ ভেবে বলল,
” দাদিজানের রুমে যাও। আমি গতকাল দুইটা ব্যাগ রেখে আসছিলাম। নিয়ে এসো। ”
” তাহলে রাগ ভাঙবেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। বিনা বাক্যে মুখের দিকে একস্থির চেয়ে থাকল। স্বর্ণলতা সেই চোখে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। রুম থেকে বেরিয়ে গেল চটজলদি। দাদিজানের রুমে ঢুকে দেখল তিনি বিছানায় বসে বসে নামাজ পড়ছেন। সে বিছানায় খালি অংশে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। খাইরুন নিসা সালাম ফিরিয়ে নাতবউয়ের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে স্বর্ণলতা তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। শোয়াবস্থায় দাদিজানের মুখের দিকে চেয়ে বলল,
” দুইদিনও পার হলো না, দাদিজান! এখনই আমাকে চোখ রাঙায়, বিরক্ত দেখায়, রাগও করে। দুইমাস পার হলে তো ধমকাবে, গালাগাল করবে, হয়তো হাতও তুলবে। আমি তো চোখ রাঙানোই সহ্য করতে পারছি না, দাদিজান। ঐসব কীভাবে সহ্য করব? আমার কপালে কি এসবও আছে? আল্লাহ! ভাবলেই তো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯২)

” দুইদিনও পার হলো না, দাদিজান! এখনই আমাকে চোখ রাঙায়, বিরক্ত দেখায়, রাগও করে। দুইমাস পার হলে তো ধ মকাবে, গালাগাল করবে, হয়তো হাতও তুলবে। আমি তো চোখ রাঙানোই সহ্য করতে পারছি না, দাদিজান। ঐসব কীভাবে সহ্য করব? আমার কপালে কি এসবও আছে? আল্লাহ! ভাবলেই তো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ”

দাদিজান ক্রমাগত মৃদু কাঁপতে থাকা নরম ঈষদুষ্ণ হাতটা রাখলেন নাতবউয়ের কপালের ওপর। আলগোছে পরম মমতায় চুলের মধ্যে হাতখানা চালনা করতে করতে বললেন,
” হাত তুলবে না। ”

তার দৃঢ় কণ্ঠের আশ্বাসটুকু স্বর্ণলতাকে শান্ত করতে পারল না। আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ল। একটা হাতের আঙুল নিম্ন ঠোঁটের এককোণে রেখে বলল,
” বিশ্বাস হয় না, দাদিজান। একটু আগেই এখানে ব্যথা দিয়েছে। ”
” হাত দিয়ে? ”
” হ। এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে…”

সে কথাটা শেষ করল না। চোখ দুটি খিঁচে বন্ধ করে নিল। ভীত, উত্তেজিত মুখটা এতটায় কুঁচকে গেল যে, খাইরুন নিসার মনে হলো মেয়েটা এখনও ব্যথাটা অনুভব করতে পাচ্ছে। মুনছুর কি সত্যি বউকে মা রতে শুরু করেছে? ঘুরেফিরে কি সেই বাবার রূপটায় ধরছে! তিনি প্রবল আতঙ্কে শিউরে ওঠলেন। সহসায় ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
” আরেকবার যদি হাত দিয়ে ব্যথা দেয় আমাকে জানাবি। প্রয়োজনে হাত কে টে ওর রুমে ফেলে রাখব। তবুও ঘরের বউকে মা রতে দিব না। যার জন্যে আমি মেয়ে তুল্য বউমাকে হারিয়েছি তারই ছেলের জন্য নাতবউকে হারাতে পারব না। আমি বেঁচে থাকতে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হবে না। ”

স্বর্ণলতা যারপরনাই বিস্মিত হলো। শোয়া থেকে উঠে বসল। দাদিজানের মুখের দিকে ঝুকে বিস্ফারিত গলায় সুধাল,
” আপনি উনার হাত কা টবেন? ”
” কা টব। ”

সে তখনই মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। কেউ নেই, কথাটা কতদূর গেল কে জানে! স্বর্ণলতা চটজলদি দরজাটা আটকে দিয়ে এসে চাপা স্বরে বলল,
” এই কথাটা আর কখনও বলবেন না। উনি শুনতে পেলে কী করবে একমাত্র আল্লাহই জানেন! বাড়িতে এখন আপনি আর উনিই, নতুন কোনো অঘটন না ঘটুক। ”

এটুকু বলে সে দাদিজানকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল। বয়সের ভারে একাধিক দীর্ঘ ভাঁজ পড়া কপালখানায় গভীর চুমু খেল। অতঃপর কৃতজ্ঞতা পূর্ণ কণ্ঠে জানাল,
” আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন! দাদিজান, দোয়া করবেন এই ভালোবাসার দাম যেন আমি রাখতে পারি। ”

খাইরুন নিসা মৃদু হাসলেন। নাতবউয়ের জড়িয়ে রাখা একটা হাতের উপরে হাত রেখে শান্ত গলায় সুধালেন,
” মা রল কেন? ”
” মা রেনি। রাগ উঠেছিল, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই ব্যথা দিয়ে ফেলেছে। আমার দোষ ছিল। ”
” ঠিক তো? ”
” হ। ”
” তাহলে এখন থেকে দোষ করা বন্ধ কর। জানিসই তো, ছেলেটার রাগ বেশি। এতদিন যার-তার উপরে রাগ ঝেড়ে নিজেকে হালকা করেছে। এখন সেই সুযোগ নেই। তাই রাগ উঠে গেলে তোর উপরেই পড়বে। ”
” আমাকে অমন করে মা রবে? ”
” না। কিন্তু নাতবউ, শুধু হাত দিয়ে মা রলেই আঘাত পায় এরকম না। কথা দিয়ে আঘাত করা যায়, নীরব চালেও আঘাত করা যায়। তাই সাবধান! ”

স্বর্ণলতার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। দাদিজান খেয়াল করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিষ্টি হেসে বুঝিয়ে বললেন,
” সম্পর্ক যত পুরোনো হবে ভালোবাসা তত গভীর হবে। এই গভীর ভালোবাসায় লজ্জা কেটে যায়, দ্বিধা কেটে যায়, হারানোর ভয় কমে যায়। মুনছুরের মধ্যেও এই পরিবর্তনটা ঘটছে। এতদিন শুধু ভালোবেসেছে, শাসন করতে পারেনি। ভয় পেত, যদি তুই দুঃখ পাস। আরও দূরে সরে যাস। এখন সেই ভয়টা কেটে গেছে। তাই চাইলেও রাগটা মনের মধ্যে দাবিয়ে রাখতে পারছে না। স্বর্ণা, আমার নাতিটাকে ভুল বুঝিস না। ”

সে জবাবে কিছু বলল না। পূর্ণ দৃষ্টিতে দাদিজানের মুখের দিকে নীরবে চেয়ে থাকল। খাইরুন নিসা আরও কিছুক্ষণ নাতবউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরিশেষে বললেন,
” পরিবর্তনটা হয়তো তোর মধ্যেও এসেছে। কিন্তু তুই বুঝতে পারছিস না। বুঝার কথাও না। মানুষ নিজের চেয়েও অন্যকে লক্ষ্য করে বেশি। ”

স্বর্ণলতা মনে মনে যে প্রবল অভিমান পুষে রেখেছিল, এক মুহূর্তে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেল। যার পুরো কৃতিত্বটায় সমুখে বসে থাকা বৃদ্ধার। সে আরও একবার দাদিজানকে জড়িয়ে ধরল, কপালে চুম্বন করল। তারপরে যে কারণে এসেছিল, সেই কাজে মনোনিবেশ করল। সেই অবস্থায় শুনতে পেল,
” মুনছুর মনে হয় তোর কাছে কিছু চাচ্ছে, বলতে পারছে না বলেই মনে হয় মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। একটু দেখিস তো, কী চায়। ”

______
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু অন্যমনস্ক হতে শুনল,
” এই ব্যাগ দুইটা আনতে বলেছিলেন? ”

সে সচকিত দৃষ্টি রাখল ব্যাগ দুটিতে। হাত বাড়িয়ে নিয়ে ভেতরটা পরখ করছিল। সহসায় পুনরায় শুনতে পেল,
” দাদিজান আপনাকে দেখা করতে বলল। ”
” এখনই? ”

স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিল না। মাথাটা সম্মতিতে নাড়ল শুধু। মুনছুর সাখাওয়াত খানিক বিরক্ত হলো কিন্তু উপেক্ষা করতে পারল না। ভ্রূদ্বয় ও কপালের মাঝে শীর্ণ ভাঁজ ফেলে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ দুটি বিছানায় রেখে বলল,
” নামাজ শেষ করো। ”

সে দরজার দিকে হাঁটা ধরেছিল। হঠাৎ থামতে হলো স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে। সে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল,
” আপনার রাগ কি ভেঙেছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাকাল প্রশ্নকর্ত্রীর চোখদুটিতে। জবাবে কিছুই বলল না। নীরব চাহনি দীর্ঘ হতে স্বর্ণলতা বিচলিত হয়ে ওঠল। বোকা হেসে বলল,
” নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। ”

তারপরে ব্যস্তভঙ্গিতে ছুটে গেল ওজু সারতে।

______
খাইরুন নিসা নাতির উপস্থিতি টের পেয়ে সরাসরি প্রশ্নটা করলেন,
” কাশেমকে নাকি মে রেছিস? ”
” হ্যাঁ। ”
” হঠাৎ! শুনলাম, মার সহ্য করতে না পেরে নাকি ছেলেটা মারাই গেছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। রুমের এককোণে ময়না দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে। সেদিকে তাকাতে কৌতূহলী দৃষ্টিজোড়া চট করে নিচে নেমে গেল। শরীরটা সরে গেল আরও পেছনে। তার বুঝতে বাকি রইল না, মিথ্যা তথ্যটা কার মাধ্যমে দাদিজানের কাছে পৌঁছেছে। মুহূর্তে রাগ উঠে গেল। কিন্তু প্রকাশ পেল না একবিন্দুও। দাঁত কিড়মিড়ে রাগ সংবরণ করে জবাব দিল,
” মারা যায়নি। শুধু অজ্ঞান হয়েছে। ”
” এত মে রেছিস! বাড়ির উঠোনে? স্বর্ণলতা যে এখানেই আছে, ভুলে গেছিস? ভয় পেয়েছে নিশ্চয়? এই নিয়ে কি তোদের মধ্যে…”

খাইরুন নিসা কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। পূর্বে নাতির কণ্ঠস্বরটা বেজে ওঠল,
” ভয় পায়নি, আরও খুশি হয়েছে। তোমার নাতবউই বলেছিল, মা রতে। ”
” কী বলছিস! ”

তার কণ্ঠস্বরে আকাশ মাপের বিস্ময়, অবিশ্বাস। চোখদুটি অজান্তেই বড় হয়ে ওঠেছে। মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে হাসল। পর মুহূর্তে জানাল,
” স্বর্ণলতার কথায় আমি হাত তুলেছিলাম। কিন্তু মা রতে পারছিলাম না। ও যে দোষ দেখিয়েছিল, সেটা পরিষ্কার ছিল না। তাই আমার মধ্যে রাগ আসছিল না। ”
” মা রতে পারছিলি না? তাহলে কি এমনিই অজ্ঞান হয়ে গেল? ”
” না। মা রের চোটে অজ্ঞান হয়েছে। রাগটা তো পরে এলো, যখন তোমার নাতবউ আমার কাছ থেকে সরে গেল, তখনই দোষটা ধরতে পারলাম। ”
” কোন দোষ? কাশেম কী করেছে? ”
” একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে আমাকে ফাঁসিয়েছে। ”

খাইরুন নিসার বিস্ময় ভাব এবার আতঙ্কে রূপ নিল। হায় হায় করে ওঠলেন,
” কবে ঘটল এসব? আমি তো কিছুই জানি না! সর্বনাশটা করল কার? ”
” চাঁদনির। ”

নামটা উচ্চারণ হওয়া মাত্র তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সেকেন্ড কয়েকের মাঝে বুঝে গেলেন, নতুন কোনো ঘটনা নিয়ে কথা হচ্ছে না। যা ঘটার তা বহু বছর পূর্বে ঘটে গিয়েছিল। তিনি প্রবল কৌতূহলে নাতির দিকে ঝুঁকে এলেন। পুরোপুরি রহস্য উন্মোচন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। সুধালেন,
” এত বছর পরে এই কথাটা জানলি কীভাবে? ”
” তোমার নাতবউ বলেছে। সে অবশ্য এতকিছু বলেনি। আমাকে ও চাঁদনিকে আড়াল করেছে। ”
” কেন? স্বর্ণলতা এতকিছু জানল কীভাবে? ”
” বুঝতে পারছ না এখনও? ”

বৃদ্ধার কণ্ঠ থেকে আপনাআপনি নামটা বের হয়ে এলো,
” চাঁদনি! ”
” হ্যাঁ। ও নিজেই বলেছে। সাথে এটাও বুঝে গিয়েছিল, আমি জেনে গেলে ওর সাথে কী হতে পারে। তাই নিজেকে বাঁচাতে স্বর্ণলতাকে নিষেধ করেছে, আমাকে যেন না বলে। বলেনিও। কিন্তু পুরো লুকাতেও পারেনি। ভুলটা এখানেই করে ফেলেছে। আসল কাহিনি ধরতে যে, আমার দুই মিনিটও লাগবে না বুঝতে পারেনি। যে মেয়েটা আমার সাথে বেরুচ্ছে সেই মেয়েটা কার সাথে মিশছে, কী ধরণের কথাবার্তা বলছে এটুকু জানতে পারব না, বুঝতে পারব না? মুনছুর কি অতটায় বোকা? ”

সে আপন মনে পুরো ঘটনাটা যেমন করে সাজিয়েছিল তেমনটায় দাদিজানকে বুঝিয়ে বলল। সবটা শুনে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” চাঁদনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, তোদের ভালোর জন্য সত্যটা স্বীকারও করেছে। ও কে মাফ করে দে, নাতভাই। ”
” মাফ না করে উপায় আছে? কিছু করলেই তো চাঁদনি ভাববে, আমার বউ কথা রাখেনি। আমি চাই না, আমার বউটাকে ওর মতো তুচ্ছ কেউ খারাপ ভাবুক। স্বর্ণলতাকে বিয়ে করলাম আমি অথচ শুরু থেকে উপকার করে যাচ্ছে চাঁদনির! ”

_______
মুনছুর সাখাওয়াত দুটো ব্যাগই বউয়ের হাতে দিয়ে বলল,
” একটাতে দুইটা শাড়ি আছে। যেটা ভালো লাগে পরে এসো। ”
” এখনই? ”

স্বর্ণলতা প্রশ্নটা করল ঠিকই কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করল না। মানুষটার হঠাৎ করে যে কী হলো! মুখের চেয়েও বেশি কথা বলছে চোখ দিয়ে। এটাই কি নীরব চালে আঘাত করা? দাদিজান এই আচরণের কথাই কি বলেছিল?

শাড়ি দুটো ভিন্ন রঙের। একটা সবুজ ও একটা লাল। স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য! দুটো রঙই দুজনের পছন্দের। এখন সে কোনটা পরবে? দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে স্বামীর দিকে তাকাল। মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে চেয়েছিল। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞেস করল,
” পছন্দ হয়নি? ”
” হয়েছে। ”
” তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ”

এই প্রশ্নের জবাব দিল না। মনস্থির করল, স্বামীর পছন্দের রঙের শাড়িটায় পরবে। এতে যদি রাগটা পড়ে! স্বর্ণলতা সবুজ শাড়িটা বের করতে করতে সুধাল,
” আরেকটা ব্যাগে কী? পাঞ্জাবি? আপনি পরবেন না? ”
” পাঞ্জাবি না। ”
” তাহলে? ”
” খুলে দেখ। ”

স্বর্ণলতা এই ব্যাগের ভেতরেও হাত দিল। সাথে সাথে একটি ভাঁজ করা আরেকটি কাপড় বের হলো। খুব নরম, স্পর্শ পড়লে আরাম লাগছে। রঙটাও খুল হালকা, ফর্সা শরীরে একেবারে মিশে থাকবে। সে ভাঁজ মেলতে আরেক দফায় আশ্চর্য হলো। জিজ্ঞেস করল,
” এটা কার জন্যে এনেছেন? ”

উত্তরটা মুনছুর সাখাওয়াত সরাসরি দিল না। খানিক বিরক্ত, অপ্রসন্ন বদনে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” তুমি ছাড়া আর কারও জন্য আমি কিছু কিনেছি? দেখেছ কখনও? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

স্বর্ণলতা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল না। সেকেন্ড কয়েক পেরুতে আচমকা বলল,
” আল্লাহ! ঢাকার বাসাতেও এরকম দুটো জামা ছিল। ওগুলোও আমার জন্যে কিনেছিলেন? ”

তার কথা বলার ধরণে মুনছুর সাখাওয়াত বুঝে গেল, কিছু একটা ঘটেছে। ত্বরিত সুধাল,
” ওগুলো দিয়ে কী করেছ? স্বর্ণলতা একদম চোখ নামাবে না। উত্তরটা দাও। জলদি। ”

সে চোখ নামাতে গিয়েও ঝটিতে তুলে ফেলল। স্বামীর দিকে জোর করে চেয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে বলল,
” কলিবুকে দিয়ে দিয়েছি। ”

উত্তরটা বজ্রাঘাত করল যেন! মুনছুর সাখাওয়াত কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতে পারল না। স্তম্ভিত হয়ে নীরব চেয়ে থাকল স্ত্রীর দিকে। একস্থির নিষ্পলক দৃষ্টি জোড়া ধীরে ধীরে প্রবল হতাশায় রূপ নিল। ব্যথিত কণ্ঠে জানাল,
” এই রকম একটা ড্রেসের দাম তোমার এই দুটো শাড়ির চেয়েও বেশি। ”

একটু থেমে পুনরায় বলল,
” দামটাও গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার জন্য আনা জিনিস অন্য কেউ পরছে! এটা আমার জন্য কতটা কষ্টের বুঝতে পারছ? এর আগেও তুমি এমন করেছ। খারাপ লাগলেও তখন মেনে নিতে পেরেছিলাম। কারণ, ঐ সময়ে তোমার বয়স আরও কম ছিল। ধরে নিয়েছিলাম, আমাকে বুঝে উঠতে পারনি। কিন্তু এখন! স্বর্ণলতা, আমি মানতে পারছি না। ”

সে হাতের জিনিসপত্র রেখে স্বামীর কাছে ছুটে এলো। একটা হাতে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
” মাফ করে দিন। এরকম ভুল আর কখনও করব না। ”

কাতর স্বরে ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে স্বর্ণলতা কেঁদে ফেলল। আজকের দিনটা তার এত খারাপ যাচ্ছে কেন? একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে আর মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছে! কষ্ট কি সেও পাচ্ছে না? মুনছুর সাখাওয়াত উষ্ণ পানির স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠল। দ্রুত অন্য হাতে স্ত্রীর মাথা সোজা করল। দুই চোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ছে যেন! মুহূর্তে তার রাগ পানি হয়ে গেল। দুইহাতে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
” শাড়ি পরে এসো। মাফ করে দিব। ”

স্বর্ণলতার কান্না পুরোপুরি থামেনি। চোখের পানি কমে আসলেও ফুঁপানি বন্ধ হয়নি। সেভাবেই সবুজ রঙের শাড়িটা নিয়ে গোসলখানার দিকে যেতে চাইল। একপা বাড়ানোর মাত্রই মুনছুর সাখাওয়াত হাত ধরে আটকে দিল। কাছে টেনে বুকে মাথাটা চেপে ধরে বলল,
” আগে কান্না থামাও। ”

_______
স্বর্ণলতা গোসলখানায় ঢুকেছে পাঁচ মিনিটও হয়নি। এরমধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত সমানে দরজায় থাপড়াতে লাগল। ভেতরের মানুষটা একরকম অতিষ্ঠ হয়ে দরজার সিটকানি খুলল। মৃদু ফাঁক করে মাথাটা কিঞ্চিৎ বের করে সুধাল,
” কী হয়েছে? ”
” শাড়ি পরা দেখব। ”
” পরতেই তো দিচ্ছেন না! দেখাব কীভাবে? দুই মিনিটে কেউ শাড়ি পরতে পারে? কোমরেই গুঁজা শেষ হয়নি। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের কথাটা এই অল্পবয়সী মেয়েটা বুঝতে পারেনি। বুঝার কথাও না। এই ধরনের আবদার সে এর আগে কখনও শুনেনি। তাই ভেবেছে বাক্যে কিংবা শব্দ সাজানোতে ভুল হয়েছে। অজান্তে সুধরে নিয়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াতের আবদারটা এবার আদেশের মতো শোনাল,
” আমি তোমার শাড়ি পরা দেখব। বাইরে এসো। ”

স্বর্ণলতা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। পর মুহূর্তে নিজের অবস্থা কল্পনা করে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠল। প্রথমে ভাবল, দরজাটা মুখের উপরে আটকে দিয়ে নিজেকে সযতনে শাড়ি দিয়ে মুড়িয়ে বের হয়ে আসবে। পরক্ষণে ভাবনা বদলে ফেলল। লজ্জার রঙটা যথাসম্ভব মুছে নিয়ে বলল,
” তাহলে রাগ ভাঙবেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত খেল যেন! এখনও রাগ ধরে রেখেছে নাকি? বউকে পরীক্ষার মধ্যেও বাড়িতে আটকে রেখেছে কি রাগ দেখিয়ে বেড়ানোর জন্যে? সে অবোধের মতো সুধাল,
” কোন রাগ? ”
” আপনার আদরের জবাব না দিয়ে আজানের জবাব দিলাম বলে যে রাগটা হলো? ঐটা। এখনও তো ভাঙলেন না! ”

সে এক মুহূর্তও সময় না নিয়ে বলল,
” ভাঙব। ”

স্বর্ণলতা দরজার ফাঁক থেকে মাথা সরিয়ে নিল। ভাঁজ খোলা শাড়িটা এলোমেলো করে গুটিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক চেয়ে বিছানার কাছে ফিরে এলো। এককোণে বসে বলল,
” এদিকে এসো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে পরো। দেখি, তুমি শাড়ি পরায় কতটা পটু হয়েছ! ”

সে স্বামীর কথামতো রুমের মাঝে এলো। রুমটায় একটা বৈদ্যুতিক আলো সারাক্ষণই জ্বলে। তন্মধ্যে জানালা দুটো খোলা। দিনের আলোতেও পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এত আলোতে রুমের প্রতিটি বস্তু দারুন পরিষ্কার ও ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে। স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখা শাড়ি ছেড়ে দিল। তারপরে শাড়ি পরায় মনোযোগী হয়ে পড়ল। শাড়ির একপাশ কোমরে গুঁজা ছিল। এখন সে উপুড় হয়ে আঁচলখানি খুঁজছে।

মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে দর্শকের মতো কৌতূহল দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চেয়ে ছিল। তার প্রতিটি কার্যকপালই গভীর মনোযোগে দেখছিল। এক পলকের জন্য দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরেনি। স্বর্ণলতা আঁচল খুঁজে নিয়ে সোজা হতে চোখ ধাঁধিয়ে ওঠল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এই মেয়েটি তার চিরচেনা বউটি নয়। দিনের আলোয় ঝলকে উঠা অন্য কেউ। যার সুশ্রী মুখ, ব্লাউজ ও ছায়ায় আবৃত দেহাংশ, অনাবৃত গলদেশ- বাজু – উদর সবকিছুতেই ভিন্নতা রয়েছে। নারী সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠতা অর্জন করে বসে আছে প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। মুহূর্তেই যেকোনো পুরুষকে কামনায় উন্মাদ করে তুলতে পারে! মুনছুর সাখাওয়াতের পায়ের তলা থেকে মাথার চুলের গোড়া পর্যন্ত শিরশির করে ওঠল। সে এত চমকাল! প্রথমবারের মতো এই মেয়েটির সাথে পুরোপুরিভাবে মিশে যাওয়ার পূর্বে সে এই শরীরের সাথে চেনাজানা সেরেছিল। তখনও তার ভেতরটা এভাবে নড়ে ওঠেনি। এরপরে আরও কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। এত সময়ে তার সবকিছু মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। এমনটায় ধরে নিয়েছিল। কিন্তু আজ, এই দুপুরবেলা দিনের আলোতে সবকিছু কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে! মনে হচ্ছে এই মেয়েটা বড্ড অচেনা, দূরের। তার সম্পর্কে কিছুই জানে না।

স্বর্ণলতা আঁচলের অংশ মেপে নিয়ে হাতের আঙুলে কুঁচি সাজাচ্ছিল
সহসায় কণ্ঠটা পেল,
” থামো। ”

সে চমকে উঠে স্বামীর দিকে চাইতে পুনরায় শুনল,
” আমি পরাব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তখনই বিছানা থেকে নামল। স্ত্রীর দিকে না গিয়ে প্রথমে রুমের জানালাগুলো আটকে দিল। রুমের আলো কিছুটা কমে আসতে স্বস্থি পেল। চোখ বুঁজে মনের সাথে ক্ষণকাল শলাপরামর্শ করে স্বর্ণলতার কাছে গেল। সাথে সাথে প্রশ্নটা উড়ে এলো,
” আপনি পারেন? ”
” না। ”
” তাহলে পরাবেন কীভাবে? ”
” তুমি বলে দাও। ”

সে কুঁচির অংশটুকু স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিল। কীভাবে, কতটা মাপ নিয়ে কুঁচির স্তরগুলো সাজাবে সেটাও ধীরে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত ততক্ষণে হাঁটু মুড়ে বসে গিয়েছে। স্ত্রীর কথামতো কুঁচির বিন্যাস করতে করতে সুধাল,
” কী মনে করে কলিকে ওগুলো দিয়েছিলে? তোমার কি একটুও পছন্দ হয়নি? ”
” একেবারে অপছন্দও হয়নি। কাপড় ভালো, রঙগুলোও সুন্দর। কিন্তু হাতা নেই একটারও। গলাগুলোও বড়। আমি ভাবলাম, আপনি খেয়াল করেননি হয়তো। তাই কলিবুকে দিয়ে দিই। সাথে কিছু টাকা দিয়ে বলি, হাতা লাগিয়ে নিতে। আমার লাগানোর সময় নাই। কোথা থেকে লাগাতে হবে জানিও না। এভাবে তো পরে ঘরের মধ্যে ঘুরতে পারব না। আম্মা, আব্বা আছে। সুবর্ণও তো বড় হয়েছে! ”
” এগুলোকে নাইটি বলে, স্বর্ণলতা। সবসময় পরার জন্যে কিনে না কেউ। শুধু রাতে পরে, ঘুমানোর সময়ে। ঐ সময়ে সুবর্ণ তোমার রুমে আসার কথা না। আমি খেয়াল করে হাতা ছাড়া নিয়ে ছিলাম। কারণ, ঐ সময়ে গরম চলছিল। ঢাকার ঐদিকে গরম আরও বেশি পড়ে। ভেবেছিলাম, তুমি আরাম পাবে। ঘুম ভালো হবে। ”

যুক্তিসহিত নিজের দিকের কথাটা উগলে দিলেও নিজের কাছে ভারমুক্ত হতে পারল না। একটা দোষ খুঁজে বের করে ফেলল ঠিকই। স্বর্ণলতার পরিবারে সদস্য বেশি। তার উচিত ছিল দুই রুমের না, তিন রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেওয়া। তাহলে স্বর্ণলতা আলাদা একটা রুমে, নিজের মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারত। মুনছুর সাখাওয়াতও যখন-তখন উঠলে লজ্জা বা সংকোচে পড়তে হতো না।

স্বর্ণলতা আগপাছ কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করল,
” এখন তো গরম নেই। ঠান্ডা পড়ছে। তাহলে এটা হাতা ছাড়া আনছেন কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মাথা তুলল। স্ত্রীর দিকে চেয়ে থাকল। ঐ প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে বলল,
” কুঁচি সাজানো হয়ে গেছে। এখন কী করব? ”

স্বর্ণলতা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,
” এখানে গুঁজে দিন। ”

সে দেখানো স্থানটায় কুঁচি নিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু গুঁজতে পারল না। হাতের মুঠো থেকে সব বেরিয়ে পড়ে গেল। স্বর্ণলতা স্বামীর কুঁচিসহ হাতের দিকে চেয়েছিল। এহেন কাণ্ডে সে যেমন বিস্মিত হলো তেমন আতঙ্কিতও হলো। মুনছুর সাখাওয়াতের খালি হাতটা দুইহাতে চেপে ধরে বলল,
” আল্লাহ! কী হয়েছে আপনার? এমন কাঁপছেন কেন? ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৩)

” আল্লাহ! কী হয়েছে আপনার? এমন কাঁপছেন কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখটা তুলল। স্ত্রীর উদ্বিগ্ন ও অস্থির মুখভঙ্গিতে তার দুর্বলতা আরও কয়েকগুণে বেড়ে গেল। বেজায় অসহায়ত্ব ফুটে ওঠল নিষ্পলক দৃষ্টিযুগলে। কয়েক পল নীরব থেকে কাতর স্বরে জানাল,
” আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারছি না। ”
” কেন? ”

তার দৃষ্টি কেঁপে ওঠল, গলা শুকিয়ে এলো। রুদ্ধ হয়ে এলো শ্বাস, ফুরিয়ে এলো বাকশক্তি। যান্ত্রিকের মতো চোখ নাড়িয়ে স্বর্ণলতার সম্পূর্ণ দেহটা দেখল। অতঃপর চিন্তিত ও কৌতূহল মিশেল চোখজোড়ায় চেয়ে আগের কণ্ঠে বলল,
” মনে হচ্ছে, তুমি জান্নাতের কোনো পবিত্র ফুল। আর আমি জাহান্নামের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাপিষ্ঠ। তোমাকে স্পর্শ করব কী দূর থেকে তাকানোও নিষেধ, ঘোর অন্যায়। ”
” কী বলেন এসব! কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ”

স্বর্ণলতার অস্থিরতা বাড়ে, মুখটা নিম্নমুখী ঝুঁকে আসে। অজান্তেই স্বামীর হাতখানা আরও শক্ত করে ধরে। মুনছুর সাখাওয়াত সেই হাতটা জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নিল। বুকটা ঢিলা করে মাথাটা নুয়িয়ে ফেলল। ধপ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে অধোবদনে বলল,
” আমি তোমার যোগ্য না। ”

এই এতক্ষণে স্বর্ণলতার মস্তিষ্কে প্রতিটি বাক্যের সঠিক ও পরিষ্কার অর্থ ধরা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সেও হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। স্বামীর মুখটায় চোখদুটি স্থির করতে বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল। গোঁফহীন রুক্ষ মুখটা ভারী ম্লান, ক্লেশিত। দু’গালে সমৃদ্ধ খোঁচা খোঁচা দাড়ির একেকটা ডগাকে ব্যর্থের ফলা মনে হচ্ছে। স্বর্ণলতা দ্রুত গাল দু’খানায় হাত রাখল। যতটা পারল দাড়িগুলো ঢেকে নিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলল,
” কী বললেন এটা! কোন দিক দিয়ে আপনার নিজেকে অযোগ্য মনে হলো? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ব্যাকুলার দিকে তাকাল ঠিকই কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করল না। স্বর্ণলতাই পুনরায় বলল,
” হঠাৎ এই যোগ্যতার প্রশ্ন এলো কেন? আমি কি কোনো বিষয় নিয়ে অহংকার করেছি? চুপ থাকবেন না। দয়া করে বলুন। আমার জানা দরকার। ”
” না, অহংকার করোনি। ”
” তাহলে? ”
” আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি। ”

উত্তরটা দিয়েই মুনছুর সাখাওয়াত চোখ সরিয়ে নিল। স্বর্ণলতার এত খারাপ লাগল! উগ্র হয়ে ওঠল নরম, শান্ত হৃদয়টা। হাতের চাপ আরও শক্ত করে স্বামীর মুখটা নিজের দিকে টেনে আনল। তারপরে কঠোর হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ কী এমন বুঝলেন যে, আমার দিকে ঠিকভাবে তাকাতেও পারছেন না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আরও একবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলো। আপন গালে আঁট হয়ে গেঁথে থাকা কোমল হাতের উপরে নিজের হাত রেখে বলল,
” তুমি রূপে-গুণে অনন্যা। এই গ্রামে একটি মেয়েও নেই যার সাথে তোমার তুলনা করা যায়। ঐ যোগ্যতাই কারও নেই। গ্রাম বলছি কেন? আমার তো মনে হয়, পুরো পৃথিবীতেই নেই। তুমি তুলনাহীন, স্বর্ণলতা! ”

সে যারপরনাই বিস্মিত হলো। স্বামীর থেকে পাওয়া এই অকাট্য, অকৃত্রিম প্রশংশা পেয়ে মুখের কঠোরতা খসে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল সম্পূর্ণ বদনখানায়। চোখের দৃষ্টি নরম হতে স্মরণে এলো এরকমই একটি কথা কয়েকমাস পূর্বে ইকবাল বলেছিল। সাথে এটাও স্বীকার করেছিল, কথাটা তার স্বামী মুনছুর সাখাওয়াতেরই। স্বর্ণলতা বিস্ময় ও লজ্জা ভাবটুকু বেশিক্ষণ বয়ে বেড়াতে পারল না। বেসামাল স্বামীটিকে সামলে উঠার জন্য দ্রুত বলল,
” এই রূপ-গুণের জন্যই তো আপনার দৃষ্টি কাড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতিটি স্ত্রীই চায়, তার স্বামীর চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়ে থাকতে। এটা স্বাভাবিক। যোগ্য-অযোগ্যের মাপকাঠি নয়। ”
” হয়তো। কিন্তু তুমি এটাকেও ছাড়িয়ে গেছ। ধর্মের কাছে যেভাবে মাথা নুয়াচ্ছ! আমি আগে চমকাতাম, এখন তো রীতিমতো ভয় পাচ্ছি। আমি কল্পনাও করতে পারিনি তুমি এতটা নেককার স্ত্রী হয়ে ওঠবে। যদি সামান্যতমও আঁচ পেতাম তাহলে তোমাকে বিয়ে করতাম না। আমি ভুল করেছি। তোমাকে বিয়ে করা উচিত হয়নি। ”
” ভুল! আপনি নেককার স্ত্রী পেয়ে খুশি নন? ”

স্বর্ণলতার চোখ ছলছলে, ঠোঁট জোড়া কাঁপছে! কথাটা হুলের ন্যায় কোথায় গিয়ে বিঁধেছে মুনছুর সাখাওয়াত টের পেয়েছে। তারপরেও নিজের জবানকে আটকাতে পারল না। বলল,
” আমি ভীত। মাত্রই বললাম। ”
” কেন? আমি কি কোনোভাবে আপনার ক্ষতি করেছি? ”
” না। ”
” তাহলে? সমস্যাটা কী? আমাকে বুঝিয়ে বলুন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্ত চুপ থাকল। এই নীরবতার পুরো সময়টায় সে চোখ বুঁজে ছিল। আপনমনে কত কী যে ভাবল! সহসায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ঠোঁট জোড়ার ফাঁক দিয়ে। চোখের পাতা মেলে স্বর্ণলতার দিকে তাকাল। অতঃপর অভিযোগের মতো করে নিস্তেজ গলায় বলল,
” আমি তোমার দিকে তাকালে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। যার আগাগোড়া পাপে গড়া। কোথাও এক ইঞ্চি পরিমাণ অংশেও ভালো কোনো গুণ নেই, ভালো কাজ নেই। স্বর্ণলতা, আমি এতটা খারাপ! আমি ভয় পাচ্ছি, তুমি না আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করো! ”
” এটা তো ভালো লক্ষণ। ”

অপরিসীম আনন্দ ও বিস্ময়ে মিশেল কণ্ঠটায় দারুন উত্তেজিত শোনাল। মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে চমকে ওঠল। পর মুহূর্তে বোকার মতো চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
” কোনটা ভালো গুণ? ”

স্বর্ণলতা মৃদু হাসল। রয়েসয়ে ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে বলল,
” প্রথমে জেনে রাখুন, আল্লাহ তা’য়ালা পাপকে ঘৃণা করতে বলেছে পাপীকে না। তারপরে জানুন, একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেকে কখনও জ্ঞানী বলে দাবি করতে পারে না। জ্ঞানের লোভ এতটায় প্রবল থাকে যে, সারাক্ষণ জ্ঞানের অভাবে ভুগতে থাকে। ঠিক সেই রকম একজন প্রকৃত ভালো মানুষ নিজেকে ভালো মানুষের কাতারে ফেলতে পারে না। নিজের মধ্যে ভালোর চেয়েও খারাপ গুণগুলোই চোখে পড়ে বেশি। আপনার চোখেও পড়ছে। এটাই আপনার ভালো গুণ। এর ফলে কী হবে বলুন তো? ”
” কী হবে? ”
” খারাপ গুণগুলো বর্জন করার চেষ্টায় থাকবেন। আপনি সেটাই করছেন। ”
” কীভাবে? ”

স্বর্ণলতা আবারও হাসল। স্বামীর এই বোকা গোছের মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, কৌতূহল ও উৎসাহপনা চাহনিটুকু এত ভালো লাগছে! তার সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটায় মরে গেল। ঠোঁট চেপে কতক্ষণ হেসে বলল,
” বলব না। ”
” কেন? ”
” তাহলে আপনার ভালো হওয়ার গোপন প্রচেষ্টাটুকু হারিয়ে যাবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূদ্বয় কুঁচকে গেল। মুখের ভাবে রুক্ষতা ফিরে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। স্বর্ণলতা চটজলদি ভ্রূ দু’খানা আঙুল দিয়ে টেনে সোজা করতে করতে বলল,
” আমি কী থেকে কী হয়েছি জানি না। ভালো হয়েছি নাকি খারাপ হয়েছি তাও বুঝতে পারছি না। কিন্তু এতটুকু জানি, আমার পরিবর্তনের পেছনে পুরো কৃতিত্বটায় আপনার। আপনি যদি আমাকে বিয়ে না করতেন তাহলে দাদিজানের মতো চমৎকার মানুষটির সাথে দেখা হতো না। উনার থেকে কিছু শেখা হতো না, সুশাসনও পাওয়া হতো না। বিয়ের আগে আম্মা আমাকে ভোরবেলা মসজিদে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিত কিন্তু নিয়মিত কোরান তেলাওয়াতে উৎসাহ করেনি। নামাজের নিয়ম-কানুন শিখে উঠলেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে বাধ্য করত না কেউ। ভদ্র বেশে চলতে শেখালেও পর্দা করতে বলেনি কখনও। এই শিক্ষাগুলো পেয়েছি দাদিজানের থেকে। মানছুরাবু, ইকবাল ভাইও অনেক কিছু শিখিয়েছি। উনাদেরও পেয়েছি আপনার জন্যই। ”

ভ্রূজোড়া সোজা হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে স্বর্ণলতা হাত সরিয়ে নিল। স্বামীর চোখে চোখ রেখে পুনরায় বলল,
” আমি বলছি বলেই কৃতিত্ব পেয়ে গেছেন এমন না কিন্তু। আল্লাহর তরফ থেকে আমি আপনার দায়িত্ব হয়েছি। এখন আমি ভালো হলে যেমন প্রশংসার ভাগ পাবেন খারাপ হলেও নিন্দার ভাগ পাবেন। বিবাহের এটাও একটা নিয়ম। আমাদের মৃত্যুর পরেও এই ভাগের অংশ আপনার হিসাবের ঝুলিতে থাকবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রত্যুত্তরে নীরব হয়ে গেল। মুখের মধ্যে গম্ভীর ভাবটা ফুটে উঠতে নীরবতা ভেঙে বলল,
” কী থেকে যে কী বললে, কিছুই বুঝলাম না। মনে হলো মাথার উপর দিয়ে কথার হাওয়া উড়ে গেল। এই কঠিন ধাঁচের কথাগুলোও কে শেখাচ্ছে? এটুকু বয়সে এত অত্যাচার? পাগল হয়ে যাবে তো! ”
” পাগলে পাগলে বন্ধুত্ব ভালো হয়। ”

স্বর্ণলতা উঠে দাঁড়াল। শাড়িটা পুনরায় গুছিয়ে নিতে নিতে বলল,
” শাড়ি পরানো শেষ করেন। দুপুরও গড়িয়ে গেল। এবার একটু পড়তে বসা দরকার। ”
” তুমি পরে নাও। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইল, পারল না। স্বর্নলতা খেয়াল করে হাত ধরে আটকে ফেলল। তারপরে সুধাল,
” ভয় কাটেনি এখনও? ”

সে জবাব দিল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। স্বর্ণলতা শাড়ির স্তুপটা একপাশে ঠেলে দিয়ে স্বামীর আরও নিকটে এলো। সম্মুখে দাঁড়িয়ে নত হওয়া মাথাটা আচমকা বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
” আপনি দূরে সরে গেলে আমি যতই নামাজ পড়ি, কোরান পড়ি, পর্দা করি না কেন কোনো কিছুতেই শান্তি পাব না। তৃপ্তি লাভ করতে পারব না। স্ত্রীর জন্য স্বামীর হক পালন করা অতি জরুরি। এটাও এক ধরনের এবাদত। দয়া করে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না। আমি কষ্ট পাব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রথম থেকে খেয়াল করেছে বউয়ের বুকের খাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। সেই ঘামে নাকের আগাটা ভিজে উঠতে অদ্ভুত তীব্র মাদক মাদক গন্ধ ছড়ায়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন গরম হয়ে উঠে দেহাভ্যন্তরে বয়ে চলা রক্ত নদী। জাগতিক চিন্তা-ভাবনা থমকে দিয়ে কী একটা পাওয়ার জন্য উন্মাদ করে তোলে। একবার উন্মাদগ্রস্থ হয়ে পড়লে নিজেকে সামলানো বড্ড কষ্টকর, অসম্ভব প্রায়। এই মুহূর্তে সে ঐ গন্ধটা চাচ্ছিল না। তাই নিঃশ্বাস আটকে থাকল। মাথাটা জোরপূর্বক সরিয়ে নিতে চাইল। স্বর্ণলতা সরাতে দিল না। একহাতে মাথা চেপে ধরে আরেক হাতে পিঠটা জড়িয়ে ধরতে সে হকচকিয়ে গেল। পাঞ্জাবির গলার নিচে হাতটা ছুঁয়াতে বুক কেঁপে ওঠল। অস্থির চিত্তে শঙ্কিত গলায় দ্রুত বলল,
” আপনার শরীর এত গরম কেন? জ্বরটা কি আবার ফেরত আসছে? এজন্যই কাঁপছিলেন। না বুঝে কী সব উল্টাপাল্টা বললেন! এবার আপনাকে ডাক্তার দেখাতেই হবে। এত ঘন ঘন জ্বর আসা ভালো লক্ষণ নয়। ”
” স্বর্ণলতা, তুমি আবারও ভুল করছ। এটা জ্বর নয়। ”
” তাহলে? ”

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না এলেও স্বর্ণলতা কীভাবে যেন বুঝে গেল! স্বামীর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল,
” আমাকে কাছে টানছেন না কেন? আজান পড়তে দেরি আছে। ”
” জানি। ”
” তাহলে? মন টানছে না? ”
” মনও টানছে। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলব। প্রথমবারের মতো! তখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। এটা ভালো না। আমি উন্মাদ অবস্থায় তোমাকে কাছে টানব না। পরে আমার খারাপ লাগে। ঐদিনও লেগেছিল। সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকার পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল। তোমার দিকে তাকালেই মনে হতো, আমি সত্যি একটা রাক্ষস। ”

সে স্ত্রীর মুখ থেকে আবারও চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। ধপ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে অনুরোধের মতো বলল,
” দিনের আলোতে এই সাজে তুমি কখনই আমার সামনে আসবে না। আমি বললেও শুনতে হবে না। ”
” অবাধ্য হব? ”
” হবে। এই ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়ে রাখলাম। ”

স্বর্ণলতা এই অনুমতি পেয়ে ভালো-মন্দ কোনো প্রতিক্রিয়ায় দেখাল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” নিয়ন্ত্রণেরও একটা সীমা থাকে। আপনি ওটা ছুঁয়ে ফেলেছেন। এরপরেও খুশি হতে পারছেন না? আমার বিবাহিত সহপাঠীদের কাছে শুনেছি, এই বিষয়ে পুরুষরা নাকি খুব অধৈর্য হয়। বিয়ের রাতেই বউদের উপর হামলে পড়ে। সম্মতিও চায় না। খুব ভালো স্বামীরা বউয়ের মনের অবস্থা বুঝে দুই-তিন দিন সময় দেয়। আর আপনি তো আমাকে প্রায় দুই বছর সময় দিয়েছেন। আমার মতে নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়ে সকল ভালো পুরুষদের মধ্যে আপনি শ্রেষ্ঠ । শুধু এই ব্যাপারে না, অন্য সব দিক দিয়েও ভালো। যেই শুনে আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আপনি আমাকে ঢাকা রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন সেই অবাক হয়। মনে মনে আমার ভাগ্যকে ঈর্ষাও করে। রেবেকা তো পারলে আমার থেকে আপনাকে কেড়ে নেয়! আপনার শারীরিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল, তারপরে যখন শুনল আপনি আমার স্বামী তখন পুরো পাগল হয়ে গেছে। ”
” স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছ তাহলে! ”

স্বর্ণলতা এই কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলল না। ইচ্ছেই হলো না। তার ভারী মনখারাপ হলো এই ভেবে যে, খোলা মনে প্রশংসা করেও মানুষটাকে খুশি করতে পারল না! ব্যাপারটা সে হজমই করতে পারল না। বলল,
” বউরা স্বামীকে নিয়ে অন্যের কাছে সর্বক্ষণ প্রশংসা করতে পারে কিন্তু সরাসরি স্বামীর সামনে করে না। ভয় পায়, যদি ভাব বেড়ে যায়? আমি সেই ভয় কাটিয়ে এতগুলো প্রশংসা করলাম। আর আপনি একটু হাসলেনও না! ”
” প্রশংসা পেলে হাসতে হয় নাকি? জানতাম না। কাউকে তো মন থেকে আমার প্রশংসা করতে দেখিনি। ”

কথাটায় কী ছিল স্বর্ণলতা জানে না। কিন্তু মায়াতে বুকটা পূর্ণ হয়ে ওঠল। চট করে স্বামীকে আরও একবার জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে বুকের মাঝে বৃষ্টির ছাটের মতো অবিরত এলোমেলো নরম আদর জমতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত মাথা ঝুঁকে বউয়ের খোলা পেটে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,
” মাঝে মাঝে তোমাকে এত ভালোবাসতে ইচ্ছে করে যে, নিজেকে পাগল পাগল লাগে! ”

পরের কথাটা সে মনে মনে বলল, ‘ স্বর্ণলতা, আমি দাদিজানের না আমার বউয়ের পাগল। আমার বউটা কত কী বুঝে অথচ এটা বুঝে না! ‘

_______
সবুজ শাড়িটা ভেজা, শুকাতে দেওয়া হয়েছে। স্বর্ণলতাকে এবার লাল শাড়িটায় পরতে হচ্ছে। কুঁচি সাজানোর দায়িত্বটা সেধে এসে নিল মুনছুর সাখাওয়াতই। সে যে একটা অনুমতি দিয়েছিল, স্বর্ণলতা ইচ্ছে করে সেটা ভুলে রইল। স্বামীকেও কিছু মনে করার সুযোগ দিচ্ছে না। নিজে থেকে বিরক্ত করছে। সুন্দর করে গুছিয়ে তোলা কুঁচিটাও ছেড়ে দিয়ে বলছে, হয়নি। আরও ভালো করে তুলতে হবে। কুঁচি যত সুন্দর হবে, শাড়ি পরাও তত সুন্দর হবে।

মুনছুর সাখাওয়াত ধৈর্য নিয়ে একমনে বার বার নতুন করে কুঁচি গুছাচ্ছে। সহসায় স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” এখন যদি শুনেন আমার একটা প্রেমিক আছে তাহলে কী করবেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের কর্মরত হাতদুটি থমকে গেল। ঝটিতে চোখ উপরে তুলতে সে পুনরায় বলল,
” রাতের অন্ধকারে ঐ প্রেমিকের সাথে যদি পালিয়ে যাই তাহলে খুঁজে বের করবেন নিশ্চয়? তারপরে কার মাথাটা আগে ফেলবেন? আমার নাকি আমার প্রেমিকের? ”

হাত থেকে শাড়ির কুঁচির গোছা পড়ে গেল। মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া এলোমেলো কুঁচির স্তরগুলোতে এক ঝলক চেয়ে স্বর্ণলতা অধৈর্য কণ্ঠে আবারও বলল,
” বলুন না, কার মাথা আগে ফেলবেন! ”

মুনছুর সাখাওয়াত চমকানো ভাব কাটিয়ে ওঠল। আরও একবার কুঁচি গুছিয়ে নিতে নিতে নির্দ্বিধায় জানাল,
” আমার। ”
” কেন? এখানে তো আপনি নির্দোষ। দোষ করেছি শুধু আমরা। ”
” দোষ করার সুযোগ দিয়েছে কে? আমি! মরার মতো না ঘুমালে তো পালাতে পারতে না। ”
” মনে করুন, আপনি বাড়িতে নেই। কোনো এক কাজে গ্রামের বাইরে গেছেন। রাতে ফিরবেন না। এই সুযোগেই আমি পালিয়েছি। ”
” তাহলে দাদিজানের। ”

স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল। ঐ অসুস্থ, বৃদ্ধ মানুষটা চলে এলো কীভাবে? সে ভীত ভাবটা যথাসম্ভব লুকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? উনার দোষটা কোথায়? ”
” আমার অজান্তে তোমাকে দেখাশুনা করার মূল দায়িত্বটা দাদিজানেরই। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনো সমস্যা হলে দোষ তো তার উপরেই পড়বে, তাই না? ”

সে এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কাঠের পুতুলের মতো শক্ত ও নিশ্চল হয়ে গেল। এই সুযোগে মুনছুর সাখাওয়াত কুঁচির গোছাটা কোমর বরাবর গুঁজে দিল। অতঃপর আবারও বলল,
” এরপরে একে একে বাড়ির সকল ঝি ও দারোয়ানের মাথা কাটব। তারপরে তোমার পরিবারের সবার মাথা কাটব। ইকবালের মাথাও বাঁচবে না। তোমার প্রেমিকের মাথাটা তো খুব আনন্দ নিয়ে কাটব। সবশেষে আমারটা। ”

স্বর্ণলতার গা গুলিয়ে এলো। মাথাটাও চক্কর দিয়ে ওঠল যেন! সে দ্রুত পায়ে বিছানার কাছে গেল। এক কিনার ধরে বসে কতক্ষণ চুপ থাকল। নিজেকে স্বাভাবিক করার পরে জিজ্ঞেস করল,
” সবাইকে শাস্তি দিবেন? মাফ করবেন না কাউকে? ”
” না। ”
” তাহলে তো মিলল না। ”
” কী মিলল না? ”
” গল্পের নায়কের সাথে আপনার কিছুই মিলে না। ”
” কোন গল্প? ”

স্বর্ণলতা হাত বাড়াল বেড সাইড টেবিলটার দিকে। পানির জগের পাশে একটা বই। সেই বইটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,
” এই বইয়ের গল্প। আমি ভাবলাম, গল্পের নায়কের সাথে আপনার কোনো মিল আছে। আমাকে দিয়ে বইটা পড়িয়ে সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছুই তো মিল পেলাম না! নায়কের ব্যবহার পুরো উল্টো। কাউকে মারবে তো দূর চোখও রাঙায় না। যতবড় অন্যায় করুক না কেন, সবাইকে মাফ করে দেয়। ওটাই তার একমাত্র পেশা যেন! মাফ না করলে মাইনে কাটা যাবে। এমনকি বউটা যে তার পুরোনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাবে সেটাও জানত, তবুও কিছু বলেনি। পালিয়ে যাওয়ার পরেও মাফ করে দেয়। বউটাকে মুখ ফুটে বলতেও হয়নি, নিজে গিয়ে ফিরিয়ে আনে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বইয়ের দিকে তাকাল। বড় করে লেখা ‘ স্বামী। নিচে লেখকের নাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একটা সুশীলা মেয়ের সুশ্রী মুখটাও ছাপানো। কী সুন্দর দেখতে! একদেখায় তার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। নাম দেখে ভেবেছিল, স্বামীকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় তাই নিয়ে বুঝি কিছু লেখা আছে। তাই স্বর্ণলতাকে দিয়েছিল। তখন তো মেয়েটা তাকে দেখতেই পারত না! মনে আশা জন্মেছিল, বই পড়ে কিছু শিখবে। সেই বইয়ে নাকি বউ প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়!

মুনছুর সাখাওয়াতের এতক্ষণে খেয়াল হলো, গতকাল সন্ধ্যায় মেয়েটা একমনে কলেজের বই না, এই বইটি পড়ছিল। সে তখনই বইটা ছোঁ মেরে নিল। দ্রুত টেনেটুনে কয়েক ভাগে ছিন্ন করে ফেলল। তারপরে ঢিল মেরে ফেলে দিল খোলা জানালা দিয়ে। ঘটনাটায় স্বর্ণলতা প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়। পর মুহূর্তে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

________
স্বর্ণলতা পড়ার রুমটায় ঢুকল সন্ধ্যার পরে। ঢুকে আশ্চর্য হলো! কাঠের ছোট্ট বুকশেলফটা আগে ছিল না। নতুন রাখা হয়েছে। মাঝের তাকটাতে তার দশম শ্রেণিতে ব্যবহার করা সকল বই, খাতা, কলম সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সে কাচ সরিয়ে সবগুলো হাতিয়ে দেখতে লাগল। যত দেখছিল, ততই পুরোনো দিনের কথা মনে হচ্ছিল। বেশি পুরোনো স্মৃতি নয় তারপরেও মনে হচ্ছে, কত জনম আগের ঘটনাগুলো! বেশ কিছু সময় চলে গেল স্মৃতিচারণেই। এখানে থাকলে যে তার পড়ায় মন বসবে না বুঝতে সময় লাগল না। তাই প্রয়োজনীয় বই, খাতা তুলে নিয়ে নিজেদের রুমে ঢুকল। মুনছুর সাখাওয়াত তখন রুমেই। বউকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
” পড়া শেষ? ”
” না। এখানে পড়ব। ”

বলতে বলতে সে বিছানায় উঠে বসল। বই, খাতা মেলে পড়ার কাজও শুরু করে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত ক্ষণকাল স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইল। বছর দেড়েক আগেও এই বিছানায় এমন উবু হয়ে একটা মেয়ে পড়ত। মেয়েটি খোঁপা ঠিক করে বাঁধতে পারত না। বার বার খসে পড়ত। দরুন ঘোমটাও ঠিকমতো থাকত না। শাড়ি ঠিকমতো পড়তে পারত না। আঁচল ঢিলে হয়ে যেত, কুঁচি এলোমেলো হয়ে যেত। খাতার দিকে ঝুকে লিখতে গেলেই পেটের অর্ধেক সৌন্দর্য ঝলমলিয়ে ওঠত। ঐ সৌন্দর্যটা তাকে এত প্রবলভাবে টানত যে, নিজেকে সামলাতে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠত। তারপরেও সে সামলে উঠেছে প্রতিবার।

মুনছুর সাখাওয়াত কথা দিয়েছিল, বউ পড়ার সময়ে সে সামনে থাকবে না। সেই কথা রাখতে সে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। দরজার দিকে এগুনোর পূর্বে স্বর্ণলতার দিকে তাকাল। ঘোমটা নেই, খোঁপাটা ভালোই শক্ত। খসে পড়ছে না। শাড়িটাও কী সুন্দর শরীরের সাথে মিশে আছে। কোথাও একটু এলোমেলো হয়নি। কুঁচিটাও সে সযতনে হাঁটুর নিচে গুছিয়ে রেখেছে। পেটের সৌন্দর্য একবিন্দুও দেখা গেল না। একটা হাত দিয়ে শাড়ির প্রান্ত চেপে রেখেছে। এত অল্প সময়ে এত ভালো গুছানো না শিখলেও পারত! সে হতাশ মনে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

________
মাঝরাতে স্বর্ণলতার ঘুম ভেঙে। পানি খেয়ে এসে পুনরায় স্বামীর বুকে মাথা রাখল। চোখ বুঁজতেই মনে পড়ল, আর কয়েক ঘণ্টা! তারপরে সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। স্বামী, দাদি শাশুড়িকে আবার এত কাছ থেকে আপনভাবে দেখতে পাবে কবে জানে না। তার মন ভার হতে লাগল। চোখের কোণে কান্না জমতে লাগল। শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক কার্য ক্ষমতায় খানিক বিঘ্ন ঘটল। আপনমনের শোকটা তাকে কতটা দুর্বল করে দিচ্ছে টের পাচ্ছিল। দ্রুত মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করতে চাইল। ঘুম আসবে না, পুরোপুরি ছুটে গিয়েছে। তাই অন্যকিছুতে মন বসাতে হবে। কী করা যায়! পড়তে বসলে রুমে আলো জ্বালাতে হবে। ঘুমের মানুষটার সমস্যা হবে। স্বর্ণলতা অনেক ভেবেচিন্তেও কিছু বের করতে পারল না। এমন হতাশা পূর্ণ অবস্থায় তার চোখ পড়ল স্বামীর বুকটায়। ডিমলাইটের আলোয় ভালোয় নজরে পড়ছে। ঘনকালো পশমে পুরো বুকটায় ঢেকে আছে। একটা মানুষের বুকে এত পশম হয় কী করে? শরীরের সব পশম এখানে জমা করা হয়েছে যেন! খুব ছোট বেলায় পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলা করার সময়ে শুনেছিল, যে ছেলের বুকে পশম হয় তার হৃদয়ে খুব মায়া হয়। সেই হিসেব করলে এই মানুষটার হৃদয়ে তো শুধু মায়ায় থাকার কথা। নেই তো!

স্বর্ণলতা বুকের মধ্যে হাত বুলাতে লাগল। ভালোই লাগছে। নরম, ওম ও আদুরে। সে একমনে খেলতে লাগল। হাতের আঙুলগুলো প্রায় ডুবে যায়! খেলতে খেলতে সহসায় আঙুলের ফাঁকে পড়া পশমগুলো চাপ দিয়ে ধরে উপরে টান মারল। সাথে সাথে ঘুমন্ত মানুষটা মৃদু আর্তনাদ করে ওঠল। স্বর্ণলতা চমকে মুখের দিকে তাকাল। ঘুম ভেঙে গিয়েছে। চোখের পাতা খুলে যেতেই সে ঘাবড়ে গেল। বুকের উপর থেকে সরে যেতে চাইলে মুনছুর সাখাওয়াত আটকে ফেলল। জিজ্ঞেস করল,
” ঘুম ভাঙল কখন? ”
” অনেক্ষণ। ”
” আমাকে ডাকোনি কেন? ”

স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। মনখারাপের ভাব ধরে রইল। মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,
” চোখ বন্ধ করো। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। ”

সে মাথায় হাতটা রাখতেও পারল না। স্বর্ণলতা বুক থেকে মাথা সরিয়ে বলল,
” আমি ঘুমাব না। ”
” কেন? ”
” পড়তে বসব। ”
” এখন? একটু আগেই তো ঘুমালে। ভোরের দিকে ঢাকা যেতে হবে। তারপরে তোমাকে পরীক্ষাও দিতে হবে। ঘুম কম হলে শরীর খারাপ লাগবে। ”
” লাগবে না। আমার অভ্যাস আছে। ঢাকার বাসায় আমার প্রায় এমন ঘুম ছুটে যায় তখন কেউ ঘুম পাড়িয়ে দেয় না। তাই পড়তেই বসা হয়। একদিনও শরীর খারাপ লাগেনি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
” কাউকে জানিয়েছ একথা? ”
” জানাতে চেয়েছিলাম। কেউ তো আমার কলই ধরে নাই। বেশিরভাগ সময় ফোন বন্ধই পেয়েছি। আল্লাহ আমার কোনো শত্রুর স্বামীকেও এমন পাষণ্ড মন না দিক। ”
” শত্রুও বানিয়েছ নাকি? ”
” উফ! ওটা তো কথার কথা বললাম। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হাসল। উঠে বসতে বসতে মনে মনে বলল, ‘ আল্লাহ তোমার শত্রুর স্বামীর বউয়ের মনেও এমন স্বপ্ন না দিক, যার জন্য স্বামীর থেকে আলাদা থাকতে হয়। ‘ সে বিছানা থেকে নামল। রুমে আলো জ্বালিয়ে দরজার দিকে এগুতে শুনল,
” কোথায় যান? ”
” বাইরে। পড়া শেষ হলে ডাক দিও। ”
” কোথাও যেতে হবে না। বিছানায় আসেন। আমি পড়তে বসব না। ”

সে থেমে গেল। পেছনে ফিরে সুধাল,
” সত্যি পড়বে না? ”
” না। ইচ্ছে করছে না। ”
” তাহলে তুমিও উঠে এসো। ”
” কেন? ”
” বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তোমাকে তো আমার গ্রামটায় ঘুরিয়ে দেখানো হলো না! যে গ্রামের বউ হয়েছ সেই গ্রামের পথঘাট ঠিকমতো চেনা না থাকলে হয়? ”
” এতরাতে আপনি আমাকে গ্রাম ঘুরাবেন? সবাই তো ঘুমাচ্ছে! রাস্তাঘাটে কেউ নাই। ”
” সেজন্যেই তো নিয়ে যাচ্ছি। বোরকা পরতে হবে না। যেভাবে আছ সেভাবেই চলো। শুধু মাথায় ঘোমটাটা রাখো। তাহলে জ্বীন-ভূতেও আমার সুন্দরী বউয়ের দিকে নজর দিতে পারবে না। ”

চলবে