#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৪)
বাড়ির উঠোনে পা ফেলতে স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল। মাঝ রাত্রির শীতল হাওয়া সরাসরি স্পর্শ করছে ছোট্ট কোমল দেহটায়। মুহূর্তের মধ্যে কাঁটার ন্যায় সটান দাঁড়িয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। আশ্চর্য রকমের কম্পন শুরু হলো দেহমনে। বেচারি বেজায় চমকাল! সামনে অগ্রসরই হতে পারল না। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল উঠোনের মধ্যিখানে।
খুব যে ঠাণ্ডা লাগছে তেমন নয়। হেমন্তের বাতাস মায়ের শরীরের ওমের মতো আরামদায়ক হয়। কিছুক্ষণ গায়ে মাখালে মন-প্রাণ জুড়িয়ে আসে। অথচ তার বেলায় হলো উল্টো! হৃদয় জুড়ে কিসের এক অশান্তির ঝড় বয়ছে। কারণটা উদ্ঘাটন করে উঠতে পারছে না বিধায় সামলাতেও পারছে না। কম্পনরত অবস্থায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শুনতে পেল,
” কী সুন্দর বাতাস! শরীরটা একেবারে জুড়িয়ে গেল। মনেই হচ্ছে না ঘুম থেকে উঠে এসেছি। ”
নরম কণ্ঠের সহজ স্বীকারোক্তি দিয়েও মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারল না। এই নিয়ে তার মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না। চোখদুটি ছুটে চলে গেল বারান্দার কাছের বাগানটায়। বকুল গাছটা ভালোই বড় হয়েছে। পাতায় পাতায় ছেয়ে আছে। এখন ফুল ফুটলেই হয়। শীতকাল আসতে তো বেশি দেরি নেই। হেমন্তের বাতাসে শীতের সুবাস পাচ্ছে যেন!
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বুঁজে বুক ভরে নিঃশ্বাস টানল। তারপরে তাকাল স্ত্রীর দিকে। মুহূর্তে কপালের মাঝে কুঞ্চন তৈরি হলো। মেয়েটা এখনও এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে কেন? সে আগ্রহের সহিত এগিয়ে যেতে যেতে সুধাল,
” দাঁড়িয়ে পড়লে যে? ঘুরতে যাবে না? ”
স্বর্ণলতা হকচকিয়ে উঠে আচমকা বলল,
” পারব না। ”
” কী পারবে না? ”
” এভাবে বাইরে যেতে পারব না। আমার ভয় করছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এতক্ষণে বউয়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। একহাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। বাহুতে কিঞ্চিৎ চাপ প্রয়োগ করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
” আমি থাকতে কিসের ভয়? ”
” আল্লাহর। দুর্ভাগ্যবশত যদি কেউ চলে আসে? আমাকে এই রূপে দেখে নেয়? আমি খুব কষ্ট পাব। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেও লজ্জা করবে। ”
এতটুকু বলে সে পাশ ফিরল। দৃষ্টিযুগল উপরে তুলে স্বামীর দিকে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে পুনরায় জানাল,
” বোরকাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দিন-রাতের পার্থক্যটা চোখে পড়ছে না। শুধু শাড়ি পরে খোলা আকাশের নিচে আমি হাঁটতে পারব না। ঘোমটাও একভাবে থাকছে না। দেখুন, কেমন খুলে পড়ছে! আমার খুব অস্বস্থি লাগছে। ”
” যা পরলে স্বস্থি লাগবে, নিশ্চিন্তে আমার সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারবে তাই পরে এসো। আমার কোনো আপত্তি নেই। ”
স্বর্ণলতা খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠল। কৃতজ্ঞতায় হেসে ওঠল চোখের কোল ও ঠোঁট জোড়া। অনুমতি পেয়ে এক মুহূর্তও দেরি করল না। ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। বোরকাটা পরার সময়ে মনে পড়ল, মুনছুর সাখাওয়াত চেয়েছিল শাড়ি পরা অবস্থায় বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনবে। সেই ইচ্ছেটা পুরোপুরি পূরণ করতে না পারলেও আংশিক করা যায়। সে বোরকা রেখে শুধু হিজাবটা পরে নিল। এতেই তার মাথা থেকে কোমর অবধি খুব সুন্দরভাবে ঢেকে গেল। গভীর রাত, জনমানবের উপস্থিতি থাকার কথা না। কারও নজরে পড়ারও সুযোগ নেই। তবুও মনের শান্তির জন্য একুটু ব্যবস্থা গ্রহণ করল। পাশাপাশি স্বামীর খুশির জন্য কিছুটা ছাড়ও দিল।
বাড়ির মূল দরজায় পৌঁছে স্বর্ণলতা বাইরে তাকাল। মানুষটা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় উন্মুক্ত চওড়া বুকটা ভালোই চোখে পড়ে। ঘনকালো পশমগুলো বাতাসের স্পর্শ পেয়ে কেমন জ্যান্ত হয়ে ওঠেছে! চিকন লতার মতো খেয়ালখুশিতে দুলছে। তার পা দুটো আবারও থমকে গেল। ফিসফিসে বলল, ‘ জ্বীনেরা শুধু সুন্দরী বউয়ের উপরে নজর দেয় না, সুদর্শন স্বামীর উপরেও নজর দেয়। ‘ সে তৎক্ষনাৎ আবারও রুমে ছুটে গেল। নতুন ভাঁজ করা একটা পাঞ্জাবি নিয়ে বেরিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াতের হাতে দিয়ে বলল,
” এটা পরে নিন। ”
” কী দরকার? বুকে বাতাসটা ভালো লাগছে। ”
তার কণ্ঠস্বর, কথা বলার ধরনে বুঝা যাচ্ছে, মানুষটার সত্যিই শান্তি লাগছে। তবুও স্বর্ণলতা মানতে পারল না। অনুরোধের সুরে বলল,
” পরে নিন না। ”
” কেন? এত রাতে আমাকে দেখার জন্য কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে নেই, জীবজন্তুও না। ”
” আমি আছি তো। এই যে আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। আমি দেখলে হবে না? আরও কাউকে চাই? ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ময়ে থ বনে গেল। কোনো উত্তর দিতে পারল না। সেকেন্ড কয়েক নীরব সময় কাটিয়ে পাঞ্জাবিটা শরীরে গলিয়ে দিল। অতঃপর স্ত্রীর হাত ধরে বাড়ির মূল ফটকটা পার হতে হতে বলল,
” আমাকে দেখবে বলেছিলে না? তাহলে দেখ। নিচের দিকে চেয়ে আছ কেন? ”
” নিচে না তাকিয়ে হাঁটব? যদি পড়ে যাই? ”
” ওটা দেখার দায়িত্ব আমার। তুমি তোমার কথা রাখ। ”
_______
রাতের আকাশে মস্ত চাঁদ। ভরা জোসনায় অন্ধকারটা হারিয়ে গিয়েছে প্রায়। কাঁচা রাস্তা, জেঁকে আসা ঘাস, দুপাশের দুলতে থাকা ছোট ছোট গাছ, ঝোপ সবই স্পষ্ট চোখে পড়ে। মাঝেমধ্যে দল ছোটা জোনাকিপোকারও দেখা মিলছে। মুনছুর সাখাওয়াত নির্বিঘ্নে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে। তার মধ্যে ভয়, দ্বিধা কোনো কিছুরই আভাস নেই। স্বর্ণলতা যত এগুচ্ছে তত ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে। স্বামীর দিকে যতটা পারছে চেপে থাকছে। নীরব নিস্তব্ধ রাতে শুকনো পাতার মর্মর শব্দটাও ঢোলের মতো কানে বাজছে। যতবার বাঁশ বাগান চোখে পড়ল ততবারই গা ছমছম করে ওঠল। শেয়ালের ডাক কানে আসতে স্বামীর হাত খামচে ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হেসে বলল,
” ঢাকা গিয়ে শুধু উন্নতি না অবনতিও হয়েছে। ”
স্বর্ণলতা চকিতে তাকাতে সে স্পষ্ট করে বুঝাল,
” গ্রামে জন্মেছ, বড় হয়েছ তারপরেও সামান্য শেয়ালের ডাক শুনে ভয়ে কাঁপছ! এই ভয়টা কি ঢাকা যাওয়ার পরে জন্মাল নাকি আগে থেকেই? ”
সে চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা গলায় প্রত্যুত্তর করল,
” আগে থেকেই। আমি কখনও রাতের বেলা বাড়ির বাইরে বের হই নাই। মাঝেমধ্যে সুবর্ণ ঘুম থেকে তুলত। ও রান্নাঘরের পেছনে যেত। আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিতাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত হাঁটা থামিয়ে দিয়ে বলল,
” তাহলে এদিকে না যাই। ”
” কেন? ”
” সামনে জঙ্গল পড়বে। ”
” আপনি তো বলেছিলেন গ্রাম দেখাবেন তাহলে জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? ”
কথার মাঝে সে অন্যপথটা ধরল। এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
” জঙ্গলে না। তোমাকে নিয়ে বিলের পাড়ে যাচ্ছিলাম। এদিক দিয়ে তাড়াতাড়ি হতো। ”
বিলের পাড়! বিলটা তো স্বর্ণলতাদের গ্রামের কাছে। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হবে। সপরিবারে ঢাকায় চলে যাওয়াই ঐবাড়িটাতে আর যাওয়া হয়নি। অথচ ওখানেও তার কত স্মৃতি! পুরো শৈশব কাটিয়েছে। কৈশোরকালটা শেষ করতে পারেনি। হঠাৎ এক রাতের মধ্যে বিয়ে করে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। স্বর্ণলতা না চাইতেও একে একে সমস্ত ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল। ভেতরে ভেতরে দারুন পুলকিতও হচ্ছিল। সহসায় থমকে গিয়ে আবদার ভঙ্গিতে বলল,
” ঐদিক দিয়েই চলুন না! তাড়াডাড়ি গেলে বেশি সময় থাকতে পারব। ”
” না। জঙ্গলে শুধু শেয়াল না আরও অনেক কিছুই ডাকে। ”
______
মুনছুর সাখাওয়াত বউকে নিয়ে এলো কিতাবগড়ের একমাত্র স্কুলটায়। এক সময়ে এটা কার্যকর ছিল। গ্রামের বাচ্চারা দল বেঁধে পড়তে আসত। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে নতুন উদ্যোগে কেউ এগিয়ে আসেনি। পড়াশোনার কার্যক্রমও শুরু হয়নি। বছর কয়েক পেরুতে জানা যায়, স্কুলটা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপরে গড়া। এখন সে অধিকার চায়। স্কুলের ঘর ভেঙে দেয়ালও তুলে দেওয়া হয়। সেই সম্পত্তির দখল হাত ঘুরে আসে মুনছুর সাখাওয়াতের কাছেই। বিশাল মাঠের মতো এই খোলা জায়গাটার বর্তমান মালিক সে নিজেই।
স্কুল মাঠের দেয়াল ঘেষে একটি দেবকাঞ্চন গাছ। খাটো কিন্তু বিস্তর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে। গোড়াতে কতগুলো লোহার উঁচু ও নিচু বেঞ্চ জমিয়ে রাখা হয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত সবগুলো অন্যদিকে ফেলে দিল। শুধু ভালো ও পরিষ্কার দেখে একটা বেঞ্চ রাখল গাছের নিচে। বউকে নিয়ে বসল সেখানেই। একটু জিরিয়ে বলল,
” জায়গাটা চিনে রাখ। ”
” কেন? ”
” আমার কোনো কাজে আসছে না। যদি তোমার কাজে আসে, জানিও। ”
” এটা আপনার? ”
” হ্যাঁ, সব থেকে দূরের। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বিলের উপরে যদি ব্রিজ হয় তাহলে সবচেয়ে দামিও হয়ে যাবে। ”
স্বর্ণলতার জমি বা জমির দাম কোনোটাতেই আগ্রহ নেই। স্বামীর কথা রাখতে এক ঝলকে যতটা পারল দেখে নিল। তারপরে সুধাল,
” আমরা বিলের কাছে যাব না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আবার ফিরতেও হবে হেঁটে হেঁটে। আমি গাড়ি আনিনি। পকেটে মোবাইলটাও নেই যে, কাউকে বলব গাড়িটা নিয়ে আসতে। ”
সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। স্বামীর মুখের সামনে এসে বলল,
” কোথায় ক্লান্ত হয়েছি? এটুকু হেঁটে কেউ ক্লান্ত হয়? বিলে চলুন। আমার ফিরতে একটুও কষ্ট হবে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার মুখের দিকে চেয়েছিল। এবার বুকের দিকে তাকাল। শ্বাসের সাথে উঠানামাটুকু পরখ করে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি সর্বোচ্চ কত সময় হেঁটেছ? ”
” অনেক। স্কুলে তো রোজই হেঁটে যেতাম, আসতাম। একদিনও বন্ধ দিই নাই। ”
” তোমার বাসা থেকে স্কুলে যেতে লাগে বিশ মিনিটের মতো। আমার সাথে হাঁটছ এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। ”
স্বর্ণলতা দমে গেল। মুখটা নামিয়ে নিতে নিতে বলল,
” বিশ মিনিট আপনার জন্য হবে। আমার জন্য আরও বেশি। ”
” এখন তো দুজন একসাথেই এসেছি, তাই না? ”
সে কোনো জবাব দিল না। মুনছুর সাখাওয়াত ধরে নিল, মেয়েটা হিসেব বুঝে গিয়েছে। তাই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে আনল। কোলের উপর বসিয়ে বলল,
” এখানে ভালো লাগছে না? ”
স্বর্ণলতা মিথ্যা বলতে পারল না। ক্ষীণ স্বরে জানাল,
” না। ”
” কেন? ”
উত্তরটা আসার পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের থুতনিতে হাত রাখল। ঠেলে মুখটা সোজা করে পুনরায় বলল,
” আমার দিকে চেয়ে বলো। আমি জানি, তুমি সত্যি বলতে ভয় পাও না। ”
এটুকু উৎসাহ ও প্রশ্রয়ে সে নতুন উদ্যমে সাহসী হয়ে ওঠল যেন! স্বামীর চোখে চোখ রেখে নির্দ্বিধায় জানাল,
” বিলে গেলে আমাদের বাড়িটা পড়ত। একটু দেখতাম! কেউ তো থাকে না। না জানি কী অবস্থায় আছে! ”
মুনছুর সাখাওয়াত থুতনি থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। কোমরটা চেপে ধরে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বলল,
” ভালো অবস্থাতেই আছে। আমি থাকতে তোমার এসবে চিন্তা কেন, স্বর্ণলতা? ”
সে উত্তরের পরোয়া না করে পুনরায় বলল,
” যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেই রাস্তা ধরে বিলে গেলে তোমাদের বাড়িটা পড়বে না। তারপরেও যদি বিলে যেতে চাও, চলো। তুমি হাঁটতে পারলে আমার নিয়ে যেতে সমস্যা নেই। ”
” যাব না। ”
” তাহলে মুখ থেকে মনখারাপটা সরাও। এতদূর হেঁটে এলাম তোমার মনখারাপ দেখতে? ”
” কীভাবে সরাব? হাত দিয়ে তো মনখারাপ আনি নাই যে, এখন ফেলে দিব। ”
” তাহলে আমি ফেলে দিই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বউকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। পাশে বসিয়ে আদেশের সুরে বলল,
” একটা পা উপরে তুলো। ”
স্বর্ণলতা সাথে সাথে আদেশ মেনে নিল। একপা তুলে স্বামীর দিকে তাকাতে বিস্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াতের হাতে আলতার কৌটো! সে স্ত্রীর পায়ের উপর থেকে শাড়ির পাড়ের অংশটা একহাতে সরাল। তারপরে ঝুঁকে এলো পায়ের দিকে। সযতনে গভীর মনোযোগে আলতার আলপনা আঁকতে লাগল ধবধবে আভা ছড়ানো মসৃণ কোমল পায়ে। এই অবস্থায় বিস্ময়কর কণ্ঠটা বাজল,
” আলতা পেলেন কোথায়? ”
” পকেটে। ”
” আমি তো পকেটে ভরি নাই। ”
” আমি ভরেছি। কিন্তু পায়জামার পকেটে। তখন অবশ্য জানতাম না, তোমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে এতদূর চলে আসব! ”
স্বর্ণলতার এতক্ষণে খেয়াল হলো, এই মানুষটাকে সে খুব একটা হাঁটতে দেখেনি। যেখানে যাক, যেমন রাস্তায় ধরুক না কেন সবসময় জীপ ব্যবহার করেছে। অথচ আজ, অন্ধকার রাতে এতটা পথ হেঁটে এসেছে। তার হাত ধরে, ধীরে ধীরে, গল্প করতে করতে। ক্লান্ত তো তার হওয়ার কথা, যে অভ্যস্ত নয়। সে তাৎক্ষণিক দরদ ভরা কণ্ঠে সুধাল,
” আপনার কি পা ব্যথা করছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত আলতা পরা থামিয়ে স্ত্রীর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন, উদ্ভট কিছু দেখছে। প্রায় সেকেন্ড দুই পরে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” হঠাৎ পা ব্যথা করবে কেন? ”
” কতদূর হাঁটলেন! ”
তার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। স্বর্ণলতার অন্য পা’টা নিজের হাতে বেঞ্চে তুলে নিতে নিতে বলল,
” কী বুঝালাম আর কী বুঝলে! ”
” কী বুঝিয়েছেন? ”
” যা বুঝনি। ”
” কী বুঝিনি? ”
” যা বুঝিয়েছি। ”
” কী বুঝিয়েছেন? ”
” যা বুঝনি। ”
” কী বুঝিনি? ”
” যা বুঝিয়েছি। ”
স্বর্ণলতা না বুঝার বিষয়টা বুঝার জন্য এতটায় আগ্রহী হয়ে পড়ল যে বুঝতেই পারছিল না, তাদের প্রশ্ন ও উত্তর ঘুরেফিরে একই হচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে মিটিমিটি হাসছিল। কিন্তু স্ত্রীর এই বেহাল দশা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। তাই বাধ্য হয়ে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখল। অতঃপর চিন্তিত ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” সত্যি কি জ্বীনে ধরল? একই প্রশ্ন বার বার করছ কেন? ”
সে আঙুল সরিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
” বুঝছি না তাই করছি। এতে জ্বীনে ধরার কী আছে? ”
” ধরতেও পারে। সুগন্ধি ফুলের মাঝে সুন্দরী বসে আছে। আশপাশে মানুষ তো দূর ঘরবাড়িও নেই। এত ভালো সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন? আমি হলে তো এক সেকেন্ডও দেরি করতাম না। ”
সুগন্ধি ফুল! কোথায়? সে চট করে আশপাশে দৃষ্টি বুলাল। কোথাও কোনো গাছই নেই, ফুল আসবে কোথা থেকে? শুধু মাটিজুড়ে সবুজ নরম ঘাস। শিশিরে ভিজে উঠেছে ইতিমধ্যে। সে ঘাসের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আচমকা জোসনার আলোয় কী যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠল! চক্ষুদ্বয় মেলে ভালো করে চাইতে দেখল, বেগুনি পাপড়ির ফুল। কী সুন্দর! অসংখ্য! চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে! স্বর্ণলতা মাথা তুলে উপরে তাকাল। তাকিয়েই রইল। নির্নিমেষ! এমন চমৎকার আয়োজন সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নতেও দেখেনি।
মুনছুর সাখাওয়াতের আলতা দেওয়া শেষ। কৌটোটা পুনরায় পকেটে ভরে চাইল স্ত্রীর দিকে। সাথে সাথে হেসে ফেলল। নীঃশব্দের, মুগ্ধতা ছড়ানো। তারপরে বউয়ের মাথাটা সোজা করে সুধাল,
” এখানে ভালো লাগছে? ”
সে ভীষণ খুশিতে গলে গিয়ে সুর টেনে বলল,
” খুব। ”
” আরও কিছুক্ষণ থাকতে চাও? ”
” অনেক্ষণ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আর কোনো জবাব দিল না। চুপ করে বসে থাকল হাত-পা গুটিয়ে। স্বর্ণলতাকে স্পর্শে বা শব্দে কোনোভাবে বাঁধা দিল না। এটুকু প্রশ্রয়ে তার আনন্দ আরও বেড়ে গেল। বেঞ্চ থেকে নেমে খালি পায়ে ভেজা ঘাসে কতক্ষণ হেঁটে বেড়াল, ফুল কুড়িয়ে আঁচলে জমাল, গুণগুণ করে কী যেন গাইলও। মুনছুর সাখাওয়াত ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। শুধু আশ্চর্য হয়ে মনে মনে ভাবল, মেয়েটা কি গানও শিখেছে?
_____
স্কুল থেকে বেরিয়ে স্বর্ণলতা বলল,
” এদিকে আপনার কোনো পরিচিত নাই? ”
” না। কেন? ”
” পানি খেতে ইচ্ছে করছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত থামল। বউয়ের মাথাটা কাঁধ থেকে তুলে দিয়ে সরাসরি তাকাল মুখটায়। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কখন থেকে? ”
” যখন ঐ স্কুলে ঢুকলাম তখন থেকেই। ”
” বলোনি কেন? স্বর্ণলতা, তোমার কথা বেজে যাচ্ছে। বুঝতে পারছ? ”
সে উত্তর দিতে চেয়েও পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত মুখে হাত রেখে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” কথা বলো না। গলা আরও শুকিয়ে যাবে। ”
পুনরায় হাঁটা ধরে বলল,
” সামনে একটা দোকান আছে। ”
স্বর্ণলতা চুপ করে থাকতে পারল না। স্বামীকে অনুসরণ করতে করতে বলল,
” এতরাতে কি দোকান খোলা থাকবে? কারও বাড়ি…”
কথাটা শেষও করতে পারল না। কাশি উঠে গেল। অল্প, সাথে সাথে বন্ধও হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত অস্থির হয়ে ওঠল। পিঠ বুলিয়ে দিতে দিতে অপরাধি কণ্ঠে বিড়বিড় করল,
” তোমাকে নিয়ে খালি হাতে এতদূর আসা ঠিক হয়নি। অন্তত একটা পানির বোতল নিয়ে আসা উচিত ছিল। ”
” আপনি এমন করছেন কেন? আমার তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ”
” হচ্ছে। নাহলে তো কাশতে না! ”
স্বর্ণলতা আরও কী যেন বলতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত কড়া চোখে তাকাল। শাসানোর সুরে বলল,
” আর একটা কথাও বলবে না। দোকানটা সামনেই। কষ্ট করে এগোও। ”
মানুষটার দুশ্চিন্তা, ব্যাকুলতা সবই চোখে পড়ার মতো। স্বর্ণলতার এত মায়া লাগল! সে কথাটা মেনে নিল। বাকি পথটা চুপচাপ হেঁটে চলল। মিনিট পাঁচের মধ্যে দোকানটা পাওয়া গেল। বেশি বড় নয়। টিন ও বাঁশ দিয়ে বানানো। অল্প ছাউনি ঘেরা। নিচে একটি ছোট্ট বাঁশের বেঞ্চও আছে। তিনজন অনায়াসে বসতে পারবে। মুনছুর সাখাওয়াত বউকে বেঞ্চটায় বসাল। তারপরে আশপাশে সন্ধানী দৃষ্টি ছুঁড়তে লাগল। স্বর্ণলতা নীরবে চেয়ে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা বুঝে এলো। সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উত্তেজিত কণ্ঠে সুধাল,
” তালা ভাঙবেন? ”
ততক্ষণে আধ ভাঙা ইটের যোগাড় হয়ে গিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত সেটা নিয়ে তালায় বাড়ি মারতে মারতে বলল,
” কথা বলতে নিষেধ করেছি। ”
ছোট্ট লোহার তালা। ভাঙতে বেশি কসরত করতে হলো না। দোকানে ঢোকার দরজাটা খুলে প্রথমে পানির সন্ধান চালাল। সেই অবস্থায় পুনরায় বলল,
” যেই বাড়ির পানি আমি খাই না, সেই বাড়ির পানি আমার বউও খাবে না। আমার চেয়েও আমার কাছে ওর মূল্য বেশি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকতে স্বর্ণলতা আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতরে উঁকি দিতে দিতে ভাবছে, গ্রামাঞ্চলের দোকানে পানি থাকে? এখানে পানি কিনে খায় কে? সন্দেহটা আসামাত্র মনে মনে দোয়া করল, কেউ কিনে না খেলেও তার জন্যে একটা বোতল হলেও যেন থাকে। নাহলে ঐ পাগলটাকে সামলাবে কীভাবে?
পানি পাওয়া গেল। মুনছুর সাখাওয়াত বোতল হাতে নিয়ে মুখ খুলে ধরল বউয়ের সামনে। সে বোতলটা নিল ঠিকই কিন্তু খেল না। স্বামীর দিকে চেয়ে সুধাল,
” আমরা কি চুরি করছি? ”
” না। জীবন বাঁচাচ্ছি। ”
” মরে যাওয়ার মতোও কিছু হয়নি। কারও অনুপস্থিততে না জানিয়ে তার জিনিস নেওয়া তো চুরিই। আমি এই পানি খেতে পারব না। ”
” এখন দোকানদারকে পাব কোথায়? ”
” তাহলে পানি নিব না। বাসায় চলুন। ”
” যাব। আগে পানিটা খাও। দোকানদার আমার পরিচিত। আমি ওর কাছে পাওনাও আছি। টাকা কেটে দিব। ”
” ঐ হিসাবের সাথে এই হিসাব হবে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। স্ত্রীর কাছে এসে শাসিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, পানি খাও। এবার কিন্তু আমার মেজাজ গরম হচ্ছে। ”
” হবেই তো। সব পেয়ে গেছেন না? ”
সে আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” কী পেয়ে গেছি? ”
“আমার দেহ, মন, চিন্তাভাবনা সব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এত বিরক্ত হলো যে, নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা কেড়ে নিল। স্বর্ণলতার ঠোঁটে ঠেকিয়ে কঠোর স্বরে বলল,
” হা করো। ”
সে মুখ পেছনে সরিয়ে দ্রুত বলল,
” না। আগে দাম পরিশোধ করেন। ”
” কাল করব। ”
” কাল তো আপনি ঢাকা যাবেন। ”
” তাহলে পরশু করব। ”
” করবেন না। টাকার বিষয়ে আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না। ”
” কী বলছ, বুঝতে পারছ? এই পানির দাম কত হবে? দশ কি বারো টাকা। এই কটা টাকা আমি মেরে দিব? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। মুনছুর সাখাওয়াত জোর করতে গিয়েও থেমে গেল। এটা কি জোর করে খাওয়ানোর মতো খাবার? যদি নাকে-মুখে উঠে যায়? সে যত বিরক্ত হলো, তত হতাশও হলো। বোতলটা সরিয়ে এনে বলল,
” তুমি একবার কথা দিয়েছিলে না, এই ধরনের জেদ করবে না? ”
” এই জেদের সাথে আমার কোনো স্বার্থ নেই। হয় পানির দাম পরিশোধ করুন। নাহয় বাড়ি চলুন। ”
” এখান থেকে বাড়ি কতদূর, জানো? পানি পিপাসায় তুমি অজ্ঞান হয়ে যেতে পার। হাঁটার শক্তিও পাবে না। এখন রইল পানির দাম। কোথা থেকে দিব? পাঞ্জাবি তুমি এনে দিয়েছ। যেটাই একটা টাকাও নেই। ”
” তাহলে অন্য কিছু দিন। যেটা দিয়ে দাম শোধ হয়। ”
” কী দিব। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। স্বামীর একটা হাত উপরে তুলে বলল,
” এই আংটিটা স্বর্ণের না? এটা দিয়ে যান। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আঁতকে ওঠল যেন! ব্যবসায়ের শুরুর দিকে কেনা আংটিটা। শুধু যে স্বর্ণ দিয়ে বানিয়েছে তা নয়। উপরে বসানো পাথরটাও খুব দামি। বার্মার রুবি পাথর। অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিল। সে হাতটা টেনে নিয়ে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল,
” বারো টাকার পানিকে তুমি লাখ টাকা বানিয়ে দিয়েছ। ”
সে আংটিটা খুলে দোকানের ভেতর ছুঁড়ে মারল।
_________
রাত প্রায় শেষ হতে চলল। স্বর্ণলতারা তখনও মুদির দোকানটার কাছেই। বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে। পাশাপাশি, সামান্য দূরত্ব রেখে। নীরবতা ভেঙে স্বর্ণলতা বলল,
” একটা চিপস নিব? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে না চেয়েই বলল,
” যে দাম দিয়েছি পুরো দোকানটায় নিতে পার। ”
সে বেঞ্চি থেকে নেমে একটা চিপসের প্যাকেট নিল। স্বামীর কাছে ফিরে আসতে নজর পড়ল হাতটায়। একটা আংটির জন্য এত রাগ হওয়ার কথা না। নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ আছে। স্বর্ণলতা এই নিয়ে ঘাটাঘাটি করল না। বহুদিন ধরে যা চেয়েছিল তা পেয়েছে। মুখ ফুটে সুন্দর করে যদি বলত, ছেলেদের স্বর্ণের আংটি পরা ঠিক না। ক্ষতি হয়, তাহলে কি শুনত? স্বর্ণলতা অনিশ্চিত কার্যক্রমটাকে নিশ্চিত করে ভারি খুশি। মুনছুর সাখাওয়াতের একটা হাত ধরে বলল,
” চলেন, বাড়ি যাই। ”
” যাব। চিপসটা খাও, আরেকটু জিরিয়ে নাও। ”
” না। এখনই যেতে হবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিকে তাকাল। পর্যবেক্ষকের ন্যায় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,
” জরুরি কিছু? ”
স্বর্ণলতা সবেগে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
” হ। ”
সে বেঞ্চ থেকে নেমে পড়ল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
” এখন টয়লেট কোথায় পাব? ”
স্বর্ণলতা আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” টয়লেট দিয়ে কী হবে? ”
” টয়লেট ছাড়া জরুরি কাজ সারবে কোথায়? ”
” ধুর! ওসব কিছু না। ”
” তাহলে? ”
স্বর্ণলতা চিপসের কোণা চিবুতে চিবুতে লাজুক কণ্ঠে বলল,
” আমার আদর নিতে ইচ্ছে করছে। ”
আকস্মিক অপ্রত্যাশিত ইচ্ছের কথাটা মুনছুর সাখাওয়াত হজম করতে পারল না। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে সুধাল,
” কী নিতে ইচ্ছে করছে? ”
” আদর। ”
একই শব্দ দ্বিতীয়বার শোনামাত্র সে স্বর্ণলতাকে কাছে টেনে নিল। ঠোঁটের দিকে এগুতে ধরলে স্বর্ণলতা চিপস দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল। তারপরে দ্রুত জানাল,
” এখানে না, বাড়িতে চলুন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চিপসটা কেড়ে নিয়ে বলল,
” বাড়ি অনেক দূর। তোমাকে এতক্ষণ অপেক্ষায় রাখতে পারব না। আমার ধৈর্য হবে না। ”
” অপেক্ষা আমার। ধৈর্যও তো আমারই ধরার কথা। ”
তার এই কথাটা সে শুনলই না যেন। আরও একবার স্বর্ণলতার দিকে এগুতে ধরলে সে দূরে সরে গেল। দোকানের ছাউনি থেকে বেরিয়ে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বলল,
” আপনি এত পাগল কেন? কেউ দেখে নিলে? ”
” কেউ দেখবে না। এই সময়ে এখানে কে আসবে। স্বর্ণলতা, আমার কাছে এসো। বেশি কিছু করব না। শুধু যে ঠোঁট দিয়ে আদর চাইলে সেখানেই আদর করব। ”
সে মুখ বাঁকিয়ে আরও দূরে সরে গেল। বাড়ির পথের দিকে হাঁটাও ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত দৌড়ে এসে পাশাপাশি হলো। চিপসের প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
” জ্বীনটা বোধ হয় সত্যিই আঁচড় করেছে। ”
স্বর্ণলতা পাশে ফিরতে সে পুনরায় বলল,
” আমার বউ আমাকে অনেকভাবে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু আদর করতে গেলে কখনও মুখ ঠেলে দেয়নি। ”
” কখনও সেধে আদরও চায়নি। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৫)
বাড়ির কাছের পথটায় এসে মুনছুর সাখাওয়াত অকস্মাৎ স্ত্রীকে পিঠে তুলে নিল। স্বর্ণলতা এত ঘাবড়াল! চিপসের প্যাকেটটা ফসকে গেল হাত থেকে। সেই দিকে খেয়ালও দিতে পারল না। দুই হাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরল অজান্তেই। ভয়, লজ্জায় মুচড়ে পড়ে চাপা চিৎকার করে ওঠল,
” আল্লাহ! কী করেন? নামান। আমার ভয় করছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত নামাল না। একহাতে বউকে আরও শক্ত করে ধরে নিচু হলো। অন্যহাতে চিপসের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে হাঁটা ধরল বাড়ির উদ্দেশ্যে। চাঁদের আলো পথ দেখাচ্ছে, শীতল হাওয়া শরীর জুড়াচ্ছে, ঝিঁঝিঁপোকারা সংগীত আসর সাজিয়েছে। এর চেয়েও বর্ণিল, রোমাঞ্চিত আয়োজন কী হতে পারে!
বাড়ির গেইটের ভেতরে পা রেখে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ইসলামে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কীয় বিধানগুলোর মধ্যে একটাই আমার মনে ধরেছিল। ”
স্বর্ণলতা ভয়ে চোখ বুঁজে ছিল। মুখ নামিয়ে রেখেছিল স্বামীর ঘাড়ে, বাবরি কাটা চুলের ফাঁকে। এতক্ষণে মুখ উঠাল। কানের দিকে এগিয়ে এসে সুধাল,
” কোনটা? ”
” স্বামী ডাকলে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেওয়ার বিধানটা। তুমিও তো এতদিন ভালোই মানছিলে। আজকে হঠাৎ কী হলো? হাত দিয়ে বাঁধা দিয়েছ, মুখে না করেছ, দূরেও সরে গিয়েছ। সাহসটা বেশি হয়ে গেল না? ”
গভীর, সুধীর কণ্ঠস্বর। একফোঁটা রাগ বা বিরক্তের স্পর্শ নেই। তারপরেও স্বর্ণলতার ভয় হলো। বুক কেঁপে ওঠল। প্রবল অনুশোচনায় অশান্ত হয়ে ওঠল ছোট্ট নরম কিশোরী হৃদয়খানা। এতটা পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু দোকানটায় ফেলে আসা শব্দ ক’টা ভুলেনি এখনও। সবকিছু মুখস্থ করে রেখেছিল যেন, এখন গড়গড় করে আওড়াচ্ছে। মানুষটাকে কি সে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে?
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে পিঠে বয়ে উঠোন পার হচ্ছে। অপেক্ষার সময় বেশি দীর্ঘ করতে চাইল না। তাই নীরবতা ভেঙে ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”
তৎক্ষনাৎ উত্তরটা কানের কাছে উড়ে এলো,
” আমি বাঁধা দিয়েছি কিন্তু ফিরিয়ে দিই নাই। ঐ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, সঠিক স্থানটা মনে করিয়ে দেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবারের ডাকটা তো স্বামীর না, স্ত্রীর ছিল। তাই পছন্দের জায়গাটার কথাও বলেছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের ধীর ও সাবধানে ফেলা পা দুটো থমকে গেল। স্ত্রীকে পেছন থেকে সামনে ঘুরিয়ে আনল চোখের পলকে। অতঃপর চোখে চোখ রেখে অবিশ্বাস্য সুরে সুধাল,
” এই বাড়িটা তোমার পছন্দ? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিল নীরবে, মাথা নেড়ে। তারপরে চটপটে পুনরায় বলল,
” সবচেয়ে বেশি পছন্দ আপনার ঘরটা। ঐ ঘরের বালিশ ছাড়া বিছানা, আলমারির ভেতরে পাশাপাশি ভাঁজে থাকা পাঞ্জাবি ও শাড়িগুলো দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আপনার সাথে রাগ হলে আমি ওগুলোর দিকে তাকাই। সাথে সাথে আমার রাগ পড়ে যায়। এজন্যই আপনাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারি না। এবার ঢাকা গিয়ে আমার রুমের বিছানা থেকেও বালিশ…”
” চুপ। আর কোনো কথা নয়। এতক্ষণ যেমন চুপ ছিলে এখনও এমন চুপ থাকো। ”
” কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। ঢাকার নাম শুনে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে। একেবারে সহ্য করতে পারছে না। যদি বুঝতে পারত, স্বর্ণলতা তার রুমের সাথে ঢাকার রুমটাকেও টেনে আনবে তাহলে আরও আগেই থামিয়ে দিত। এই মুহূর্তে ঢাকা সম্পর্কীয় কিছু শুনতে চায় না।
_____
মুনছুর সাখাওয়াত মুদির দোকানে থেকে যে কঠোর ধৈর্য ধারণ করেছিল সেটা ভেঙে গুড়িয়ে পড়ল নিজেদের রুমে ঢুকেই। দরজাটা পর্যন্ত আটকাল না! বউকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে হিজাব খুলে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চুমু খেতে লাগল নরম অধরযুগলে।
স্বর্ণলতা আপন শরীরে স্বামীর হিংস্রতা টের পায় এই ওষ্ঠ চুম্বনের সময়ে। একমাত্র এই স্থানে এই মুহূর্তটায় মনে হয় তার প্রতি যত রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, বিরক্ত আছে সবটা বের করে আনে। সেই সাথে বুঝিয়ে দেয় তার প্রতি মুনছুর সাখাওয়াতের অধিকার ও কর্তৃত্বের সঠিক পরিমাপটা। যা সে অজান্তেও উপেক্ষা করতে পারবে না। জোর করেও ভুলে থাকতে পারবে না।
স্বর্ণলতা বসে আছে দরজার মুখোমুখি। বেখেয়ালে চোখটা পড়ে যেতেই চমকে ওঠল। চোখটা আর বন্ধ হলো না। হাত বাড়িয়ে কিংবা উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করার সুযোগ নেই। স্বামীকে থামিয়ে যে, কথাটা বলবে সেই সাহসটাও করে উঠতে পারছে না। শুধু একবার না করেছিল বলে কত কথা শোনাল! এতেও মন ভরেনি বোধ হয়। প্রতিটা স্পর্শে তাকে কাঁপিয়ে তুলছে। কোনো উপায় না পেয়ে চট করে মুনছুর সাখাওয়াতের একটা হাত এনে রাখল কাঁধে, আঁচলের ওপরে। স্বর্ণলতা এতদিনে বুঝেছে স্বামীর হৃদয়ে মায়ার দ্বার খুলে যায় তার কাপড়ে হাত পড়লে। মুহূর্তের মধ্যে হিংস্রতা হারিয়ে যায়। প্রতিটি স্পর্শ হয় নরম ও যত্নের। এত হালকাভাবে দেহের মধ্যে আদুরে পরশ পড়ে যে, স্বর্ণলতার মনে হয় কোনো পুরুষ হাত বা ঠোঁট নয় পাখির পালক অবাদে বিচরণ করে চলেছে।
শাড়ির আঁচলটা বুক থেকে সরে যেতেই স্বর্ণলতার ঠোঁটদুটি মুক্ত হলো। সাথে সাথে কথা ফুটল,
” দরজাটা খোলা তো! ”
” হুম।
” লাগিয়ে দিন না! ”
” পরে। ”
” ততক্ষণে যদি কেউ চলে আসে? ”
” আসবে না। ”
” এত নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে? এটা তো রাস্তা না, মুদির দোকানও না। আমাদের বাসা। কত মানুষ থাকে! কারও যদি রান্নাঘরে দরকার পড়ে? ”
একনাগাড়ে এতগুলো কথা কানে প্রবেশ করতে মুনছুর সাখাওয়াত ভারি বিরক্ত হলো। মেজাজ চটে গেল নিমিষেই। কিছুতেই দমাতে পারল না। মুখ তুলে চোখ রাঙিয়ে বলল,
” কার এত সাহস হয়েছে যে, আমার রুমে উঁকি মারবে? ”
স্বর্ণলতা একেবারে নিভে গেল। নতুন করে কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
” আমি তোমাকে যত প্রশ্রয় দিচ্ছি তুমি তত আমাকে বিরক্ত করা শিখছ। ”
স্বর্ণলতা মিনমিনে বলল,
” ভাব দেখলে মনে হয়, আশপাশে কোনো মানুষ না পুতুল আর রোবট ছেড়ে রেখেছে। উনি যেমন ভাববেন সবসময় তেমনই আচরণ করবে। ভিন্ন কোনো আচরণ আসতেই পারে না, ফাংশনই তো দেয়নি! ”
মুনছুর সাখাওয়াত দরজা আটকে প্রত্যুত্তর করল,
” টাকার লোভ থাকলে মানুষও পুতুল হয়। কষ্ট করে রোবট বানাতে হয় না। তোমার লোভ নেই, তাই এখনও মানুষ আছ। ভিন্ন আচরণ করে আমাকে বিরক্তও করছ। ”
সে আলোটাও নিভিয়ে দিল। স্ত্রীর কাছে এসে বলল,
” এবার আমিও কিছু দেখতে পারব না। শান্তি? ”
” না। ”
” কেন? ”
” আপনি যদি না দেখেন, তাহলে আমার মূল্য থাকল কোথায়? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে নিজের মোবাইলের টর্চের আলো জ্বালাল। স্বর্ণলতার মুখের সামনে ধরে বলল,
” আদর চেয়ে কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ? এই পরীক্ষা দিতে দিতেই তো রাত ফুরিয়ে যাচ্ছে, আদরটা দিব কখন? ”
_______
স্বর্ণলতা স্বামীর বাহুবন্ধনে থেকে বলল,
” একটু পরে ফজরের আজান পড়বে। চলেন, তাহাজ্জুদ পড়ি। শুনেছি, তাহাজ্জুদ ও ফজর একসাথে আদায় করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দ্রুত পাওয়া যায়। ”
” না। ”
” কেন? ”
” আল্লাহর কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। ”
” আমার আছে। ”
স্বর্ণলতা বন্ধন থেকে ছাড়া পেতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত ছাড়ল না। উভয়ের শরীরে ল্যাপ্টে থাকা কাঁথাটা গলা অবধি ছিল। সে টেনে মুখগুলোও ঢেকে ফেলল। অতঃপর স্ত্রীর শরীরের সাথে আরও গভীরভাবে মিশে গিয়ে বলল,
” এখন কোথাও যাবে না। ”
” এখন না উঠলে নামাজের সময়টা ধরতে পারব না। ”
” ধরতে হবে না। আমার কাছে থাকো। এই সুখ থেকে তুমি আমাকে দিনের পর দিন বঞ্চিত করেছ, সেটারই শাস্তি পাবে এখন। তাছাড়া আজকে তুমি দুইবার গোসল করে ফেলেছ। এখন আরও একবার করবে। একটু পরে আবারও করবে? তোমার তো নিউমোনিয়া হয়ে যাবে! ”
” একটু পরে আবার করব কেন? ”
কাঁথার ভেতরে আলো নেই। গাঢ় অন্ধকার। মুনছুর সাখাওয়াত চেষ্টা করেও স্ত্রীর মুখটা দেখতে পেল না। তবুও ক্ষণকাল চেয়ে থেকে বলল,
” আবার করার প্রয়োজন পড়তে পারে না? তুমি তো আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ। এই ঘরে, এই বিছানায়, এইভাবে পাব অনেকদিন পরে। অনেক মাসও হতে পারে। ”
” অনেক মাস! আপনি আমার সাথে দেখা করতে যাবেন না? ”
প্রশ্নের কোনো উত্তর এলো না। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,
” ঘুমিয়ে পড়ো। ”
” এখন? আজান পড়তে বেশি দেরি নাই। উঠতে পারব না। ”
” আমি ডেকে দিব। ”
” যদি আপনিও উঠতে না পারেন? ”
” আমি ঘুমাব না। ”
” কেন? ”
” তোমাকে ঘুমাতে দেখব। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম, সেদিন তুমি ঘুমাচ্ছিলে। বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছিলে। গায়ে সে কী জ্বর! ঠান্ডায় খুব কাঁপছিলে। অথচ শরীরে কিছু নেই। আমার এত মায়া লাগল! ইচ্ছে হলো তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরি। আমার শরীরের ওম দিয়ে তোমার ঠান্ডা কমিয়ে দিই। চাইলেই ধরা যেত। বাঁধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তারপরেও ধরিনি। কেন, জানো? ”
” কেন? ”
” ঐ একপলকে বুঝে গেছিলাম, এক বার জড়িয়ে ধরে আমার কিছু হবে না। মন পুরোই খালি থাকবে। আমার তোমাকে সারাজীবন জড়িয়ে থাকতে হবে। সেজন্যই তোমাকে বিয়ে করে আমার কাছে নিয়ে আসি। কিন্তু কপাল খারাপ! যে লোভে বিয়ে করলাম সেটাই কপালে জুটল না। ”
এত সামান্য কারণেও কেউ কাউকে বিয়ে করে নেয়? স্বর্ণলতা প্রথমে আশ্চর্য হলো। পর মুহূর্তে প্রবল দরদে মন-মেজাজ ভিজে ওঠল। মনে হলো, সত্যি সে দোষী। স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমাকে মাফ করে দিন। এখন থেকে আপনি যেমন বলবেন, আমি তেমনভাবেই চলব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে বলল,
” ঘুমাও। ”
________
জীপে উঠার আগে স্বর্ণলতা দাদিজানের সাথে দেখা করতে এলো। তিনি নাতবউয়ের দিকে এক ঝলক চেয়ে বললেন,
” তোমার সাথে পরে কথা বলছি। মুনছুরকে আমার কাছে পাঠাও। ”
মুনছুর সাখাওয়াত রুমের বাইরে ছিল। স্ত্রীকে মুখ ফুটে বলতে হলো না। সে নিজে থেকে দাদিজানের রুমে ঢুকল। খাইরুন নিসা বিছানায় আধশোয়া আছেন। নাতিকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলেন। সে পাশে বসতে জিজ্ঞেস করল,
” বউটা তো নিজ থেকেই এলো, তারপরেও আটকে রাখতে পারলি না? ”
” না। ”
” থেকে যেতে বলেছিলি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সামনের দিকে চেয়ে নীরব থাকল। খাইরুন নিসা নাতিকে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন। অতঃপর বললেন,
” মেয়েটাকে এভাবে একলা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, মুনছুর। আমার ভয় হচ্ছে। তোদের এবার বাচ্চা নেওয়া দরকার। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি ঝটিতে ফিরে এলো দাদিজানের দিকে। এই সুযোগে খাইরুন নিসা আরও বললেন,
” স্বর্ণার বয়স কম। দেখতে সুন্দরী। গুণবতীও হয়ে ওঠেছে। পুরুষরা একদেখায় কামনা করে বসবে। ”
” কেউ দেখবে না। ও আমাকে কথা দিয়েছে। ”
” সেই কথা ভাঙতে কতদিন? শরীরের না মনের পর্দা করছে বলেই এখনও তোর কথায় উঠবস করছে। ওটা ভেঙে গেলে শরীরেরটাও ছুটে যাবে। তখন মুখের কথা তো দূর কাগজেরও দাম থাকবে না। ”
” মনের পর্দাও ভাঙবে না। ”
” এত নিশ্চিত হচ্ছিস কীভাবে? ওটা ঢাকা শহর। ওখানের মানুষ কেমন জানিস না? ভদ্র সাজে চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে। তারপরে সুযোগ বুঝে পর্দা ঠেলে ভাব জমাতে দুইদিনও সময় নিবে না। একবার শুধু…”
কথার মাঝে মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েও থেমে গেল। পুনরায় বিছানায় বসে বলল,
” গ্রামে থেকে তোমারও অবনতি ঘটেছে। মূর্খদের মতো আচরণ করতে শুরু করেছ। ”
এটুকু বলে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। রুমময় পায়চারি করে আবারও বলল,
” স্বর্ণলতার বয়স কত? মাত্র সতেরো! বাচ্চা নেওয়ার মতো শারীরিক গড়ন হয়েছে? ”
” মানসিকভাবে হয়েছে। সতেরো বয়সে ও যতটা বুঝে, তুই ত্রিশ পেরিয়েও বুঝিস না। এখনও বুঝছিস না। এই কথাগুলো আমি যদি তোর বউকে বলতাম, ও সাথে সাথে মেনে নিত। আর তুই? পাগলের মতো মাটি কাঁপাচ্ছিস! ”
মুনছুর সাখাওয়াত ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলল,
” মানসিকভাবেও হয়নি, দাদিজান। ওর মনে, মাথায় পড়ালেখা ছাড়া আর কিছু নেই। আমিও নেই। আমাকে যে দেখতে পাও? ওটা আমাকে জোর করে ঢুকাতে হয়। ”
সে দাদিজানের কাছে বসল। একটু থেমে বড় করে নিঃশ্বাস টেনে পুনরায় বলল,
” স্বর্ণলতা তোমাকে সম্মান করে, তাই সব কথা শুনে। এর মানে এই নয়, সব কথা বুঝে ফেলেছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আবারও উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়েও আবার ফিরে এলো। দাদিজানের দিকে খানিক ঝুঁকে বলল,
” আমি ও কে পড়াচ্ছি, এই নিয়ে ওর সহপাঠীরা হিংসা করে। এই কথাটা যেই আনন্দ নিয়ে, গর্ব করে বলেছে বাচ্চা এলে সব শেষ হয়ে যাবে, দাদিজান। মুখে হয়তো বলবে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব ভেঙে পড়বে। আমি ওই ভাঙনটা দেখতে পারব না। ”
” বাচ্চা নিয়েও অনেক মেয়েরা পড়ালেখা করে। ”
” কী বলছ, ভেবে বলছ তো? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে বলব, তুমি পাগল হয়ে গেছ। নাহলে কোনোদিন বুঝতেই পারনি, আমার মনের মধ্যে কী চলে। ”
” কীভাবে বুঝব? মুখ ফুটে কখনও বলেছিস? নাকি আমাকে বুঝে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিস? বউকে নিয়ে যা একটু কিছু বলিস, ওটাও ঠেকে গিয়ে। ”
” আবারও ঠেকে গিয়ে বলছি, স্বর্ণলতা পড়ালেখা করতে গিয়ে আমাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারছে না এটাই আমার সহ্য হয় না। মনে হয়, পৃথিবীর সকল স্কুল-কলেজ জ্বালিয়ে দিই। মাস্টারদের গুম করে দিই। তাহলে ভাবো, পড়ালেখার জন্য আমাকে ও আমার বাচ্চাকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারছে না তখন আমার সহ্যটা কতদিন টিকবে। ”
________
স্বর্ণলতারা ঢাকায় পৌঁছাল পরীক্ষার একঘণ্টা আগে। মুনছুর সাখাওয়াত জীপটা থামাল কলেজ থেকে বেশ দূরে, নিরিবিলি পাশটায়। তারপরে চেয়ে রইল ঘুমন্ত মুখটায়। সেকেন্ড কয়েক পেরুতে খেয়াল করল, স্বর্ণলতার মুখে রোদ পড়ছে। বিরক্তে কপাল কুঁচকে নিলেও ঘুম ভাঙছে না। রাত জেগে পড়া, ঘুরাঘুরি, তারপরে আদরের মাঝে পড়ে মেয়েটা ঠিকমতো ঘুমাতেই পারল না! সারা রাস্তা ঘুমিয়েও অভাবটা পুষাচ্ছে না যেন! ভালোবাসা কি অত্যাচার হয়ে গেল? মুনছুর সাখাওয়াত কতটা স্বার্থপর, একরাতেই বুঝিয়ে ফেলল না তো!
বাড়িতে যে বই-খাতা স্বর্ণলতা ব্যবহার করেছে সেগুলো নিয়ে এসেছিল। কোলেই পড়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত একটা খাতা তুলে বউয়ের মুখের উপর ধরে থেকে বলল,
” বাচ্চা না, দাদিজান। নতুন গাড়ি কেনার সময় হয়েছে। ”
পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক পনেরো মিনিট পূর্বে স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙল। মুনছুর সাখাওয়াতই বাধ্য হলো ডেকে দিতে। সে দ্রুত গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল,
” আরও আগে ডাকবেন না! আমার আগে তো স্যার ঢুকে যাবে। ”
স্বর্ণলতা গেইটের দিকে ছুট লাগাল। বেশিদূর এগুতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত চেঁচিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, বাড়ি চলো। পরীক্ষা দিতে হবে না। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৬)
স্বর্ণলতা গেইটের দিকে ছুট লাগাল। বেশিদূর এগুতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত চেঁচিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, বাড়ি চলো। পরীক্ষা দিতে হবে না। ”
তার ব্যতিব্যস্তে ছুটে চলা পা দুটি সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল। ঘাড় ফিরে এক মুহূর্ত দ্বিধায় কাটিয়ে দিল। সহসা চড়কি বেগে সম্পূর্ণ দেহটায় ঘুরে গেল। দ্রুত কদমে প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়াল জীপের কাছে। সামনের সিটের খোলা জানালা দিয়ে উঁকি মারল ভেতরে। উদ্বেগপূর্ণ চোখ জোড়া স্বামীর মুখের উপর নিবদ্ধ করে ব্যাকুল স্বরে সুধাল,
” কোনো খারাপ সংবাদ এসেছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সিট ছেড়ে জানালার কাছে এগিয়ে এলো। স্ত্রীর একটা হাত টেনে নিয়ে রাখল গলায়। স্বর্ণলতা প্রথমে বুঝল না। ভ্রূ কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। স্বামীর দিক থেকে নতুন করে কোনো কথা বা ইশারা না আসায় সে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠল, বিচলিতের ভাব ফুটে ওঠল সম্পূর্ণ মুখটায়। ঠিক এই সময়ে মস্তিষ্কে ঘণ্টা বাজার মতো কী যেন একটা ঝনাৎ করে ওঠল। স্বর্ণলতা ত্বরিত বেগে পাঞ্জাবির কলারের নিচে স্পর্শ করল। সাথে সাথে চমকে ওঠল। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠল পুরো দেহটা। চোখের আকার দেখাল অস্বাভাবিক মাপের বড়। মুখ ফসকে বিস্ফারিত আওয়াজটা বেরিয়ে এলো,
” আল্লাহ! এখন এখানে কীভাবে হবে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। নীরব ও আগ্রহান্বিত গাঢ় দৃষ্টি জোড়া স্থির হয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিটা দেখা দিয়েও লুকিয়ে পড়ছে বার বার। স্বর্ণলতার দিশাহারা অবস্থা! অস্থির হয়ে উঠেছে চিত্তচেতনা। এসবে নজরই পড়ছে না। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চঞ্চল দৃষ্টি জোড়া ঘুরছে একবার পেছনে কলেজের গেইটটাই, আরেকবার সমুখের স্বামীটির মুখটায়। এই সময়ে পরীক্ষা হলে সতর্ক ঘণ্টা পড়ল। ঘণ্টার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে কানে প্রবেশ করা মাত্র সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল। পিছুটান কাটিয়ে উঠে স্বর্ণলতা বলল,
” দরজা খুলেন। বাড়ি তো কাছেই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত নির্দ্বিধায় দরজা খুলে দিল। বউ পাশে বসতে নিজ হাতে গাড়ির দরজা আটকে দিয়ে বলল,
” এখানের বাড়ি না, গ্রামের বাড়ি চলো। ”
স্বর্ণলতা আশ্চর্য হয়ে বলল,
” অনেক দূর তো! এত সময় অপেক্ষা করতে পারবেন? ”
” তুমি যাবে নাকি বলো। পরীক্ষা শুরু হতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি আছে। ”
স্বর্ণলতা আরও একবার কলেজের গেইটের দিকে তাকাল। ফাঁকা, কোনো ছাত্রীকে দেখা যাচ্ছে না। দারোয়ান গেইটটা বন্ধ করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। সে চোখ বুঁজে নিল। শ্বাসটা রুদ্ধ করে জানাল,
” যাব। একটা বিষয়ই তো! ফেইল হলে কিছু হবে না। জরিমানা দিয়ে অনুরোধ করলে আবারও পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হতে পারে। ”
” যদি অনুরোধ করারও সুযোগ না পাও? ”
স্বর্ণলতা ঝটিতে চোখ মেলল। পাশ ফিরে চাইতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ফেইল না, অনুপস্থিত আসবে। সবগুলো বিষয়েই। স্বর্ণলতা, বাড়ি গেলে ঢাকায় ফিরতে পারবে না। পড়ালেখা একেবারে বন্ধ। এখন বলো, যাবে কী যাবে না। অবশ্যই মুখে বলবে। দুই মিনিট সময় দিলাম, ভালো করে ভেবে তারপরে জানাও। ”
স্বর্ণলতার রুদ্ধশ্বাসটা মুক্ত হলো না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। পলক জোড়া আড়ষ্ট হয়ে আছে। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে একস্থির চেয়ে থাকতে থাকতে দাদিজানের কথাটা স্মরণে এলো। বলেছিলেন, এই মানুষটার তার থেকে কিছু চাওয়ার আছে। চাইতে পারছে না বলেই মনমেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। চাওয়াটা কি তাহলে এটাই? সে প্রশ্নটা মনে রাখতে পারল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” আপনি চান, আমি গ্রামে ফিরে যাই? ”
” হ্যাঁ। ”
” চলুন। শুধু শুধু দুই মিনিট সময় নষ্ট করতে হবে না। আমার বিশ্বাস, আমাদের ভালোর জন্যই আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ”
” পরে আফসোস করবে না তো? ”
” না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর নিকাব বাঁধা মুখটা নিজের দিকে ঘুরাল। অতঃপর দৃশ্যমান চোখদুটিতে চেয়ে থেকে বলল,
” আমার দিকে চেয়ে বলো। সত্যি আফসোস করবে না? ”
স্বর্ণলতা অনুভূতিহীন শুষ্ক চোখ জোড়ায় চেয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে পুনরায় উচ্চারণ করল,
” না। ”
সাথে সাথে জীপের দরজা খুলে গেল। স্বর্ণলতা চমকে তাকাল খোলা দরজার পানে। পর মুহূর্তে স্বামীর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি রাখতে শুনল,
” পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর দেরি করো না। যাও। ”
সে সিট থেকে একচুলও নড়ল না। উল্টো বরফের মতো শক্ত হয়ে গেল। কোনোমতে ঠোঁট দুটো নেড়ে সুধাল,
” বাড়ি যাব না? ”
” না। ”
” কেন? এটা তো আপনারই চাওয়া ছিল। ”
” চাওয়া বদলে গেছে। এখন আমি চাই, তুমি পরীক্ষা দাও। ”
” এত জলদি চাওয়া বদলে গেল? ”
প্রশ্নটা করে সে মুনছুর সাখাওয়াতের গলায় হাতটা রাখল। দু’পাশটা স্পর্শ করতে করতে বলল,
” এটার কী হবে? ”
” কিছুই না। তুমি এবারও বুঝতে ভুল করেছ, স্বর্ণলতা। এটা ভয় ছিল। ”
” ভয়! কিসের ভয়? ”
” এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি যত সহজে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি তত সহজে বাঁধতে পারব না। তোমার সাথে জোরাজুরি করতে আমার আগে ভালো লাগত না, এখন ভাবলেও বিরক্ত লাগে। তুমি আমাকে সেই বিরক্ত থেকে বাঁচালে। ”
স্বর্ণলতার এতেও মনের সন্দেহ দূর হলো না। তাপমাত্রাটা একটুও কমেনি, উল্টো বেড়েছে! সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
” ভয় হলে মানুষের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। ”
” যাদের ঠাণ্ডা হয় ওরা নিশ্চয় স্বর্ণলতার স্বামী নয়? ”
” কী আশ্চর্য! এত মানুষ আমার স্বামী হতে যাবে কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের জবাব দিল না। দুষ্টু হাসিটা এতক্ষণের ঠোঁটের কোণে পরিপূর্ণ হয়ে দেখা দিল। স্বর্ণলতার নজরেও পড়ল। কিন্তু ভালোমতো উপভোগ করতে পারল না। পূর্বে গাড়িতে থাকা বই-খাতাগুলো তার কোলের উপর রেখে মুনছুর সাখাওয়াত তাগাদা দিল নামার জন্য। সে এতক্ষণে নামল। কলেজের দিকে অগ্রসর হয়েও থেমে গেল। হাতের বই-খাতার দিকে তাকিয়ে ভাবল, এগুলো এখন নিয়ে কী লাভ? সে বাড়ি থেকে বয়ে এনেছিল রাস্তার মধ্যে পড়বে। ঘুমিয়ে গিয়েছিল বিধায় পড়া হয়নি। এখন তাড়াহুড়ায় কোথায় গিয়ে রাখবে? তাই আবারও ফিরে এলো স্বামীর কাছেই। বই-খাতাগুলো ফেরত দেওয়ার সময়ে একটা খাতায় চোখ পড়ল। খাতাটি তার দশম শ্রেণির। গতকাল পড়ার রুমে গিয়ে পুরোনো বই-খাতা হাতিয়ে দেখার সময়ে আচমকা মনে পড়ে যায়, তার অনুপস্থিতে মুনছুর সাখাওয়াত একদিন তার কোনো এক খাতায় কী যেন করছিল। স্বর্ণলতা হঠাৎ চলে আসায় সে ঘাবড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে খাতা বন্ধ করে অন্য খাতাগুলোর সাথে মিলিয়ে ফেলে। ঐদিন স্বর্ণলতা বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিলেও গতকাল গুরুত্ব দিল। নিজের পড়ার সময় নষ্ট করে সব ক’টা খাতার প্রতিটা পৃষ্ঠা পরখ করে দেখেছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে একটা পৃষ্ঠাতে এসে তার তল্লাশি থেমে যায়। সে অবাক হয়ে দেখল, পৃষ্ঠাটিতে একটা বউয়ের মুখের আদলের একটি মুখ অঙ্কন করা। ঘোমটা টানা কিন্তু চোখ, নাক, ঠোঁট কিছুই নেই। সম্ভবত আঁকার সময় পায়নি অথবা আঁকার চেষ্টাই করেনি। তবে বিস্ময়কর বিষয়টি হলো অঙ্কনটির প্রতিটা টান সাধারণ বা স্বাভাবিক নয়। ছোট্ট অক্ষরে লেখা, ‘ বউ ‘ শব্দটি উল্টেপাল্টে, বাঁকিয়ে নানানভাবে লিখে লিখে পুরো অঙ্কনটা শেষ করেছে। এই শৈল্পিক গুণ স্বর্ণলতার নেই। ভাবনাতেও আসেনি কখনও। তাই একদেখায় বুঝে গেল এই অসাধ্য সাধনটায় ঘটিয়েছিল সেদিন। স্বর্ণলতার অঙ্কনটা এত পছন্দ হলো যে, সে খাতাটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। এখন আবার ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে ভেবে মনখারাপ হলো। তৎক্ষনাৎ আরও একবার দেখবে বলে দ্রুত খাতাটির পৃষ্ঠা উল্টাল। কাঙ্ক্ষিত ছবিটা পেয়ে যেতেই চোখদুটি স্থির হয়ে গেল। সেকেন্ড দুই পেরুতে লক্ষ করল, ছবিতে তার নাম নেই। নামের পরিবর্তে লেখা, ‘ আদর দাও ‘ এই একটি বাক্যকেই অসংখ্যবার নানান ভঙ্গিতে লিখে পুরো অঙ্কনটা করা হয়েছে। সে হতভম্ব চোখে স্বামীর দিকে চাইতে মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূ নেড়ে সুধাল,
” কী? ”
তার মুখভঙ্গি সহজ, স্বাভাবিক। দুষ্টুমি বা রহস্যের কোনো ছায়া নেই। ভাবখানা এমন এই অঙ্কনের পাশ দিয়েও যায়নি কখনও। অথচ স্বর্ণলতা নিশ্চিত, ছবির শব্দ দুটো বদলে দিয়েছে এই মানুষটাই। কিন্তু বদলাল কখন? সে না চাইতেও মাথার মধ্যে গতকালের প্রতিটা মুহূর্ত একে একে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এরমধ্যে নতুন উপলব্ধি হলো, বিবাহের পরে মুনছুর সাখাওয়াত তাকে অসংখ্যবার চুমু খেয়েছে। গভীরভাবে আদরও করেছে কিন্তু স্বর্ণলতা? সে লজ্জা-শরম ভেঙে শুধু চাইতেই পেরেছে। কখনও সেধে নিজ থেকে একটা চুমুও খায়নি। মানুষটা কি অঙ্কনের মাধ্যমে সেটাই বুঝিয়ে দিল?
স্বর্ণলতা খাতা বন্ধ করে ফেলল। স্বামীর হাতে ফেরত দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল আবারও। আশপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
” চোখ বন্ধ করেন। ”
” কেন? ”
” করেন না! ”
অনুরোধ রক্ষা হলো। মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বুঁজল। স্বর্ণলতা তখনই এগিয়ে গিয়ে স্বামীর গালে প্রথমবারের মতো আলতো চুমু খেল। তারপরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” সাবধানে যাবেন। বাড়িতে পৌঁছে আমাকে একটা কল করবেন। ”
স্বর্ণলতা গাড়ি থেকে নেমে পড়তে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত একহাত ধরে ফেলে বলল,
” তাহলে কথা দাও, এক্সিডেন্ট করে আমি মরে গেলেও তুমি কখনও বিয়ে করবে না। অন্য কেউ তোমাকে বিয়ে করবে, আদর করবে, বাচ্চা হওয়াবে এসব আমি সহ্য করতে পারব না। মরেই যাব! ”
কথা-বার্তা কোথা থেকে কোথায় চলে গেল! কথা শুনে মনে হচ্ছে, স্বর্ণলতা সাবধানে যেতে বলেনি। বলেছে, অসাবধানে যেতে। তারপরে দুর্ঘটনায় সেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে। সে এত আশ্চর্য হলো! বলতে চাইল, ‘ আপনি এত পাগল কেন? ‘ কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
” মানুষ একবার মারা গেলে আবারও মারা যায় কীভাবে? ”
সাথে সাথে প্রশ্নটা এলো,
” তুমি তাহলে ধরেই নিয়েছ আমি আজকে মারা যাব? ”
স্বর্ণলতা সঙ্গে সঙ্গে দাঁত দিয়ে জীভ কামড়ে ধরল। তারপরে মাফ চাইতে চাইতে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। গাড়ি থেমে নেমে হাত দিয়ে কান দুটো চেপে ধরল। কিছু বলবে না, শুনবে না। পেছনে তাকিয়েও দেখবে না। পাগলের সাথে থেকে থেকে সেও বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে!
________
মুনছুর সাখাওয়াত কাঁচামালের ব্যবসায়টায় ধরল। এই নিয়ে তার বেজায় ব্যস্ততা চলছে। খুব প্রয়োজন ব্যতীত বাড়িমুখো হচ্ছে না। এরমধ্যে একরাতে স্বর্ণলতার কল এলো। সে তখন বিলের পাড়ে। ব্রিজ বানানো নিয়ে আলোচনা চলছে। শীঘ্রই কাজও শুরু হয়ে যাবে। এই নিয়ে একটা বিশেষ দরকারে এসেছিল। সাথে উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গও আছে। সকলকে উপেক্ষা করে মুনছুর সাখাওয়াত কলটা ধরল। সাথে সাথে ওপাশ থেকে স্বর্ণলতা জানাল,
” আমার পরীক্ষা শেষ। ”
” ভালো। ”
” কিছুদিন কলেজ বন্ধও আছে। আপনি আসবেন? ”
” না। সময় নেই। খুব ব্যস্ত।
” তাহলে আমি আসি? ”
এই পর্যায়ে মুনছুর সাখাওয়াত থমকাল যেন! কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সুধাল,
” বন্ধ কতদিন? ”
” বারো দিন। ”
” মাত্র? আমার পোষাবে না। ”
স্বর্ণলতা কণ্ঠটা অভিযোগের মতো ভেসে এলো,
” দুইদিনে পুষিয়ে গেলে, বারোদিনে পোষাবে না কেন? ”
” কে বলল দুইদিনে পুষিয়ে গেছে? ”
” যায়নি? ”
” না। আমার তো আরও অভাব বেড়েছে। ”
” তাহলে আমার কাছে আসছেন না কেন? ”
” মাত্রই তো বললাম, স্বর্ণলতা। ”
” তাহলে বলে দিন কতদিনে পোষাবে। আমি বাকি দিনগুলো ছুটি নিব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আবারও থমকে গেল। নীরবে আপনমনে বলল, ‘ তোমার পড়ালেখায় মন ভরে গেলে আমার একদিনেই পুষিয়ে যাবে। একটা সময় পরে তুমি আবারও চলে যাবে, এই চিন্তাটা.. স্বর্ণলতা, শুধু এই চিন্তাটা আমার মাথায় চাই না। কখনও না। ‘
” কী হলো? বলছেন না কেন? ”
স্ত্রীর পুনরায় কণ্ঠ পেয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” একটা কাজে আছি। পরে কল দিচ্ছি। ”
কলটা কেটে দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত আকাশের দিকে মুখ করে বলল,
‘ তুমি তাহাজ্জুদে আল্লাহকে চাও, আমি আল্লাহর কাছে আমার ঘরে তোমার সাথে তাহাজ্জুদ চাইলাম। এখন দেখি আল্লাহ তার এই পাপী বান্দাকে কতদিন অপেক্ষা করায়। ‘
_________
মুনছুর সাখাওয়াতের বহুল প্রতিক্ষীত শীতকাল চলে এসেছে। বকুল গাছে প্রথমবারের মতো ফুলও ফুটেছে। তীব্র গন্ধে সারা বাড়ি দিন-রাত ডুবে থাকে। বাতাসের দাপট বাড়লে গন্ধের সাথে গোটা কয়েক ফুলও উড়ে আসে খোলা জানালা দিয়ে। সেই ফুল চোখে পড়ে গেলে মুনছুর সাখাওয়াত ভারি অস্থির হয়ে পড়ে। ঘুমাতে পারে না। সারারাত এপাশ-ওপাশ করে। এই নতুন যন্ত্রণায় অতীষ্ঠ হয়ে ভাবে গাছগুলো কেটে ফেলবে। কাটার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরও হয়, কিন্তু গাছের কাছে যাওয়া হয় না। সে বেখেয়ালে হেঁটে চলে যায় কাঁঠালতলায়। সারারাত কাটিয়ে দেয় চেয়ারে বসে।
এমনই এক যন্ত্রণাদায়ক রাতে মুনছুর সাখাওয়াত কুড়াল হাতে নিয়ে বেরুল। আকাশে তখন মস্ত চাঁদ। মাঘীপূর্ণিমার মন ভোলানো সৌন্দর্য চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে ধরনীর বুকে। মুনছুর সাখাওয়াত এতটায় ভুলে গেল যে, সে কুড়াল ফেলে দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে এলো। ভীষণ অন্যমনস্ক চালে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো কিতাবগড়ের স্কুলের মাঠে। কতক্ষণ বসে ছিল হিসেব নেই। ফেরার পথে তার পানির তৃষ্ণা পেল। সেই তৃষ্ণা মেটাতে চলে এলো মুদি দোকানটায়। তালা ভেঙে একটা পানির বোতল নিল, একটা চিপসের প্যাকেটও। কিন্তু কোনোটায় খাওয়া হলো না। বাঁশের বেঞ্চিতে বসে থেকে ভাবতে লাগল, পানি ও চিপসের মূল্য পরিশোধ করবে কীভাবে। তার পকেটে আজ টাকা আছে। কিন্তু ঐ ক’টা টাকা দিয়ে এই লাখ টাকা দামি বোতলের দাম শোধ হয়? তার হাতে আংটি নেই। অন্য কোনো দামি অলংকারও নেই। মুনছুর সাখাওয়াত অনেক্ষণ ভেবেও কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ভাবল, বউকে কল দিবে। আগের মতো এবারও নিশ্চয় কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারবে।
মুনছুর সাখাওয়াত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল ঠিকই কিন্তু বউকে কল করতে হলো না। নিজেই উপায় খুঁজে পেয়েছে এমনভঙ্গিতে হেসে ফেলল। বিজয় হাসি সহিত মোবাইলটা দোকানে ছুঁড়ে মারবে তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠল। স্বর্ণলতা কল করেছে। নাম্বারটা চোখে পড়তে তার হুঁশ ফিরল। চট করে ঘড়িটা দেখে নিল, দেড়টা বাজে। এতরাতে কল করল কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো? সে দ্রুত কলটা ধরে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”
” ঘুম আসছে না।
” আর কিছু না? ”
” না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপরে জিজ্ঞেস করল,
” পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” এই চিন্তায় ঘুম আসছে না মনে হয়। ”
ওপাশটা নীরব হয়ে যায়। মুনছুর সাখাওয়াতও আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না। হাতের মধ্যে থাকা চিপসের প্যাকেট, পানির বোতলে একধ্যানে চেয়ে থাকে। সহসায় ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
” হুম? ”
” আমাকে ভালোবাস? ”
” হ্যাঁ। ”
” কতটা? ”
” যতটা ভালোবাসলে কাউকে মনে পড়লেই দমটা বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এরচেয়ে মৃত্যুও শান্তির, স্বস্থির। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের কণ্ঠস্বর আবারও আটকে যায়। কোনো কথা বেরুতে চায় না। অথচ বুকের মধ্যে কত কথা জমে আছে! মেয়েটা আজকাল কল দিচ্ছে খুব কম। একবার জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, ‘ কল দিয়ে কী লাভ? আপনি তো কথায় বলেন না। কাজের ওজুহাতে কল কেটে দেন। তারপরে আর কলও করেন না। আমি শুধু শুধু অপেক্ষা করি। ‘ এবারের নীরবতা কেউই ভাঙল না। উল্টো কলটা কেটে গেল। সাথে সাথে একটা বার্তা ঢুকল। স্বর্ণলতা লিখেছে,
‘ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ‘
তারপরে আরও একটা বার্তা এলো,
‘ আপনি না আসুন অন্তত মৃত্যুকে পাঠিয়ে দিন। আমি ডাকলে তো পাপী হয়ে যাব। ‘
__________
স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই মায়ের গলা পেল,
” কী পরছিস এইডা? আল্লাহ, লজ্জায় তো আমারই চোখ নাইমা যাইতাছে! সুবর্ণ দেখতে পাইলে কী হইবো? ওই আজ স্কুলে যায় নাই। ”
সে মোচড়ামুচড়ি বন্ধ করে নিজের দিকে তাকাল। সাথে সাথে পাথরের মূর্তির মতো স্থির ও শক্ত হয়ে গেল। ঢাকায় আসার পরে স্বামীকে বলে ঐ বাড়ি রেখে আসা শাড়ি দুটিও চেয়ে এনেছিল। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে করে অত্যাধুনিক ফ্যাশনের রাতের পোশাকটাও পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে কখনও পরেনি। কিন্তু গতরাতে কী হলো কে জানে! কনকনে শীতে এই হাতাবিহীন, গলা বড় লজ্জায় মোড়া বস্ত্রটায় পরতে ইচ্ছে হলো। পরার পরে তার শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন এলো। প্রথমে মনে হলো ভীষণ দুর্বল লাগছে, হাঁটাচলা করতে ইচ্ছে করছে না। বইয়ে চোখ স্থির করলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, মাথা ঘুরাচ্ছিল। সে বাধ্য হয়ে বিছানায় যেতেই শরীরের তাপমাত্রাও বেড়ে গেল। সন্দেহ হলো তার জ্বর আসছে। স্বর্ণলতা সচরাচর জ্বর-সর্দিতে পড়ে না। তন্মধ্যে এই পোশাকটা পরবে বলে আম্মা ও আপুকে অন্য রুমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই সাথে নিষেধও করেছিল, সকালের আগে এই রুমে যেন ভুলেও পা না রাখে। এমতাবস্থায় তার মুনছুর সাখাওয়াতকেই মনে পড়ল। কল করে কথা হলো ঠিকই কিন্তু জ্বরের কথাটা তোলা হলো না।
শবনম বেগম বিছানা গুছাতে গুছাতে মেয়েকে আরও একবার জামা বদলানোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। স্বর্ণলতা প্রথমে নিজের দেহের তাপমাত্রা মাপল। জ্বর নেই! আসেনি বোধ হয়। সন্দেহটা ভুল ছিল। তারপরে গোসলখানার দিকে ছুটল। একেবারে গোসল করে জামা বদলে বেরিয়ে আসতে নাকে গন্ধটা লাগল। পরিচিত, বড্ড প্রিয়। অজান্তেই সন্ধানী দৃষ্টি ঘুরতে লাগল রুমে। বেশি সময় খরচ করতে হলো না। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা পাওয়া গেল শিথানের কাছের ছোট্ট টেবিলটায়। সে দৌড়ে এলো, শুধু বকুল ফুলই না। সাথে একটা পানির বোতল ও একটা চিপসের প্যাকেটও রাখা।
চলবে