মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-৯৭+৯৮+৯৯

0
632

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৭)

স্বর্ণলতা একমুঠো বকুল ফুল তুলে নাক ডুবিয়ে দিল। গভীর নিঃশ্বাসের সাথে প্রিয় ফুলের সুগন্ধটুকু টেনে নিল ভীষণ আহ্লাদে, প্রাণ ভরে। অতঃপর কল লাগাল স্বামীর নাম্বারে। এই প্রথমবার এক রিংয়েই মানুষটাকে পেল। কণ্ঠটা ভেসে আসতে ত্বরিত সুধাল,
” কোথায় আছেন? ”
” রাস্তায়। ”
” গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন? ”
” হ্যাঁ। ”

স্বর্ণলতার চনমনে চিত্তের প্রবল ভাবাবেগ অনুভূতিটা হারিয়ে গেল। বদনখানায় ভেসে উঠা অপরিসীম আনন্দের হলকাটুকুও গায়েব হয়ে গেল আচমকা। সে হাত থেকে ফুলগুলো রেখে দিল। চিপস ও পানির বোতলটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে পুনরায় সুধাল,
” কখন এসেছিলেন? ”
” ভোরের দিকে। ”
” আমাকে ডাকেননি কেন? ফজরের নামাজটাও পড়তে পারিনি। ”
” ডাকলেই বকা খেতে তাই ডাকিনি। ”

স্বর্ণলতা থতমত খেল যেন! তটস্থ হলো সাথে সাথে। চিপস ও পানির বোতল থেকে হাত সরিয়ে নিল। ফোনের দিকে পুরোপুরি মনোযোগ রেখে আবারও জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ বকবেন কেন? ”
” হাড় কাঁপানো শীতে স্লিভলেস নাইটি পরে ঘুমিয়েছ। শরীরে আর কিছু দাওনি। কম্বলটা তো পাশেই ভাঁজ করা ছিল। মেলে শুধু গায়ে জড়াবে সেটুকুও পারনি। এত অলস হয়েছ কবে থেকে? জ্বরটা নিশ্চয় এই কারণেই এসেছে? ”

স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। উদাস হয়ে পড়ে। চিত্ত-চেতনায় উঁকি মারে গতকালের রাতটুকু। ঐ পোশাকটা পরার পর তার মধ্যে শুধু শারীরিক পরিবর্তনই না, মানসিক পরিবর্তনও এসেছিল। প্রবল ঠান্ডায় হাত-পা জমে আসছিল তারপরেও উঠে গিয়ে রুমের সব ক’টা জানালা খুলে দেয়। অবাদ সুযোগ পেয়ে হুড়মুড়ে প্রবেশ করে হীম শীতল বাতাস। স্বর্ণলতা এত কাঁপছিল! চোখ খুলে রাখতে পারছিল না, দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছিল। তবুও সে জানালার কাছ থেকে সরেনি। শরীরে উষ্ণ কাপড়ও জড়ায়নি। এই দুুর্বিষহ কষ্টের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছিল। এই অদ্ভুত আনন্দের পেছনের কারণটা সে এখনও উদ্ঘাটন করতে পারছে না।

স্বর্ণলতা উদাস ভাব কাটিয়ে ওঠল নিজ জোরেই। তারপরে বলল,
” আচ্ছা, রাখছি। ”
” কেন? ”
” গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা ঠিক না। ”

কলটা কেটে গেল সাথে সাথে। স্বর্ণলতা মোবাইলটা কান থেকে নামাল ধীরেসুস্থে। টেবিলের উপরে রাখার জন্য উদ্যত হতেই একটা বার্তা এসে ঢুকল। মুনছুর সাখাওয়াতের নাম্বার থেকেই এসেছে। সে ভারি আশ্চর্য হলো। এই মানুষটা তো ফোনে কথা বলতে চাই না ঠিকমতো। তন্মধ্যে মেসেজও লিখে ফেলল? গুরুত্বপূর্ণ কিছু না তো! মুহূ্র্তের মধ্যে প্রবল দুশ্চিন্তা গ্রাস করে ফেলল। সে ঝটপটে বার্তার বাক্সটা খুলল। মুনছুর সাখাওয়াত লিখেছে,
‘ দিনের আলোয় তোমার গোপন সৌন্দর্যগুলো এত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে কেন? আমি বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারি না। মনে হয়, চোখে আগুন লেগে গেছে। এখনই চোখ না বুঁজলে দৃষ্টিশক্তি হারাব। ‘

স্বর্ণলতা উত্তরে লিখল,
‘ প্রশংসা করলেন নাকি নিন্দা? বুঝতেই তো পারলাম না! ‘
‘ প্রশংসা করারই সাহস পাচ্ছি না। আর তুমি নিন্দা নিয়ে পড়ে আছ! স্বর্ণলতা, এমন অপার্থিব সৌন্দর্য আমাকে আর কখনও দেখিও না যার কোনো উপমাই পৃথিবীতে নেই। ‘

স্বর্ণলতার মন খারাপ বাড়ল। ঐ পোশাকটায় তাকে এত বিচ্ছিরি লাগল যে, স্বামী একদেখায় পরতে নিষেধ করে দিল! সে বার্তা আদান-প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। ইচ্ছে হলো মোবাইলটা রেখে দেয়। পারল না। কি একটা অদৃশ্য টানে হাতের আঙুলগুলো লিখে চলল,
‘ এজন্যই বুঝি আমাকে কাছে টেনে আদর করেননি? ‘
‘ কাছে টেনেছি কিন্তু আদর করিনি। ‘
‘ কেন? কতদিন পরে আমার কাছে এসেছেন! হিসেব আছে? প্রায় চার মাস। ‘
‘ তিন মাস ষোল দিন। কিন্তু স্বর্ণলতা, প্রচণ্ড জ্বর ও শীতে কাঁপতে থাকা বউটা যদি উন্মাদগ্রস্থ স্বামীকে সামলাতে না পারত? বেসামালে কোনোভাবে শরীরে দাগ পড়ে যেত তাহলে কষ্টটা তো স্বামীটারই হতো। তাই নিজেই নিজেকে সামলেছি। কষ্ট হয়েছে কিন্তু পেরেছি। সামলানোর সময়ে টের পেয়েছি, আমাকে আমার চেয়েও ভালো সামলাতে পার তুমি। ঐ সময়ে তোমার বাধ্য হতে পারলে এত সুখ পাই! মনে হয়, এরচেয়েও বড় কোনো সুখ আমার জীবনে নেই। ‘

স্বর্ণলতা এর বিপরীতে কিছু লিখতে পারল না। তার হাত কাঁপছে। চোখে অশ্রু টলমল করছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। চোখের তারা দুটি এত চঞ্চল হয়েছে যে, মোবাইলের দিকে এক সেকেন্ডের জন্যও স্থির হচ্ছে না। এমন বাঁধনহারা আনন্দ, সুখ সুখ বোধ বুঝি সতেরো বছরের জীবনে এই প্রথম হলো। মুনছুর সাখাওয়াতকে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ আপনি আমার সামনে এত নরম হবেন না, এত সহজ স্বীকারোক্তি দিবেন না। তাহলে আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাব। ‘

স্বর্ণলতা মোবাইল ফেলে দিয়ে তখনই ওজু করতে চলে গেল। এই আনন্দঘন মুহূর্তটুকু পাওয়ার সৌভাগ্য করে দিল যিনি তার কাছে এখনই মাথা নত করতে হবে। দু’হাত তুলে হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে না পারলে সে বোধ হয় সত্যি পাগল হয়ে যাবে।

দুই রাকাত নফল নামাজে স্বর্ণলতা অনেক সময় কাটিয়ে দিল। সালামটা ফেরানোও সম্পূর্ণ হলো না। তন্মধ্যে মোবাইলটা বেজে ওঠল। স্বর্ণলতা মোনাজাত বাকি রাখতে বাধ্য হলো। কারণ, কলটা অন্য কেউ নয় তার স্বামীই করেছে। মানুষটার যে আজকে কী হয়েছে একমাত্র আল্লাহই জানেন! এক মুহূর্তের জন্যও মোবাইলটা রাখতে পারছে না। স্বর্ণলতা কলটা ধরতেই শুনল,
” কী করছ? ”
” নামাজ পড়ছিলাম। ”
” এখন? কোন নামাজ? যোহরের ওয়াক্ত তো শুরু হয়নি। ”
” নফল পড়ছিলাম। ”

কণ্ঠটা থেমে গেল। একটা শব্দও ভেসে এলো না। শুধু ফোঁস ফোঁস আওয়াজে নিঃশ্বাস পড়ছে। স্বর্ণলতা এই নীরবতা সহ্য করতে পারছিল না। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠছিল যেন! নীরবতা ভাঙার জন্য সে আগ বাড়িয়ে কিছু একটা চাইল। সম্ভব হলো না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত বলে ওঠল,
” আমার সাথে কথা বন্ধ করে তুমি নফল নামাজ পড়ছ? অনুমতি চাইলে না তো! ঢাকার বাসায় উঠতেই দাদিজানের শিক্ষা ভুলে গেছ? ”
” ভুলিনি। আমি আপনার জন্যই নামাজ পড়ছিলাম। তাছাড়া গাড়ি চালানোর সময়ে ফোন টিপা ঠিক না। তখন থেকে কলে কথা বলছেন, মেসেজ করছেন যদি এক্সিডেন্ট করেন? ”
” করবই তো। আরেকবার যদি কথা বলা বন্ধ করো তাহলে সত্যি এক্সিডেন্ট করব। ”
” আল্লাহ! পাগল হলেন নাকি? ”
” হ্যাঁ। যতক্ষণ না আমি নিজ থেকে কল কাটব ততক্ষণ তুমি কথা বলবে। বুঝতে পেরেছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কথা বলো। ”
” কী বলব? ”
” যা ইচ্ছে হয়, বলো। কিন্তু চুপ থাকবে না তাহলে আমার মেজাজ খারাপ হবে। তখন বকাঝকা করলে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। ”

স্বর্ণলতা হেসে ফেলল। মনেমনে বলল, ‘ আপনি এখন বকলেও আমি মনখাপার করব না। দাদিজান বলেছে, সম্পর্ক যত পুরোনো হয় ভালোবাসা তত গভীর হয়। ভালোবাসা গভীর হয়ে গেলে লজ্জা, ভয়, সংকোচ এগুলো কমতে থাকে। আমাদেরও কমছে। ‘

________
মাঘ মাসের এক চাঁদনি রাতে মুনছুর সাখাওয়াত সেই যে আনমনা হয়েছিল, কুড়াল ফেলে একা একাই জোছনা বিলাসে মত্ত হয়েছিল এরপরে তার জীবনে আর জোছনা রাত আসেনি। আসার সুযোগই দিল না। নতুন ব্যবসা নিয়ে বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দিনের আলো, রাতের অন্ধকার সবই এক বোধ হতে লাগল। আকাশে চাঁদ ওঠল কী ওঠল না এই চিন্তাভাবনাটাও মনে উদ্রেক হওয়ার সময় নেই। বাড়ি ফেরার আগ্রহ হারিয়েছিল স্বর্ণলতা ঢাকা যাওয়ার পরেই। এবার সময়ও বের করতে পারে না যেন! সময় ভাগ হয়ে গিয়েছে ক্ষেত, গুদাম আর বাজারেই। নিয়মিত ঢাকাও যাওয়া-আসা চলছে। কিন্তু ঐ ব্যবসার কাজেই। এর বাইরে কিছু ঘটছে না, নিজেও ঘটাচ্ছে না। অক্লান্ত শ্রম, হিসাব ছাড়া সময়, পানির মতো অর্থ খরচ করে ব্যবসাটা মাত্রই গুছিয়ে এনেছে ঠিক সেই সময়ে রাতেরবেলা আকস্মিক আগমন ঘটল ইকবালের। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়িতেই আছে। সপ্তাহখানেক পরে এসেছে। দাদিজানের আবেগি কথাবার্তার মায়ায় পড়ে ফেঁসে গিয়েছিল।

মুনছুর সাখাওয়াত রাতের খাবার খাচ্ছিল। ইকবালকে দেখে সে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। খাওয়া বন্ধ করে খানিক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল,
” তোকে কি আসতে বলেছিলাম? ”
” না। ”

খাবার টেবিলে খাইরুন নিসাও ছিলেন। দেহে শক্তি নেই, বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও নাতির খাতিরযত্নে একফোঁটাও ছাড় দিতে চান না। কতদিন পরে এলো ছেলেটা! বাড়ির খাবার পেটে পড়ছে না বললেই চলে। বাইরে কী খাচ্ছে না খাচ্ছে! তাই নিজ হাতে যতটা পারছেন এগিয়ে দিচ্ছেন। স্নেহের বুলি আওড়াচ্ছেন থেমে থেমে। এবার নাতির প্লেট থেকে নজর সরিয়ে বললেন,
” ডাকলেই আসতে হবে? বাড়িতে মেহমান আসা ভালো। মেহমানের সাথে আল্লাহর রহমতও আসে। এই রহমত সব বাড়িতে আসে না। ভাগ্য লাগে। ”

এটুকু বলে একটু দম নিলেন। ইকবালের দিকে চেয়ে খালি একটা চেয়ার ইশারা করলেন। বসার জন্য অনুমতি দিয়েই পুনরায় বললেন,
” চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সারাদিনে পেটে কিছুই পড়েনি। বসে পড় তো। খেতে খেতে বাকি কথা সারবি নাহয়। ”

সে চেয়ারে বসল না। সম্মানে নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ডাকিনি তারপরেও হাজিরা দিতে এসেছিস! কোনো অঘটন ঘটিয়েছিস? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” একটা সংবাদ দিতে এসেছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মানসপটে স্বর্ণলতার মুখটা ভেসে ওঠল। ঠিক তখনই মনে পড়ল, স্বর্ণলতার সাথে কথা হয় না অনেক দিন। শেষবার বউটায় কল করেছিল। কয়েকবার। ইচ্ছে করে ধরেনি। সে যতদূর বুঝেছে, স্বর্ণলতার যখন তাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে তখন ঘন ঘন কল করে। ঐ মুহূর্তে সে কাঁচামাল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সারছিল। তাই বউয়ের মুখ থেকে আহ্বানটা শুনতে চায়নি। শুনলে মিটিং শেষ করা হতো না। পিছিয়ে পড়ত অনেক। একই ব্যস্ততা কতদিন চালাবে? তাই একবারে সবটা শেষ করতে চেয়েছিল। শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন তার কাছে অবসর সময় আছে। ভেবেছিল, দাদিজানের সাথে দেখা করে স্বর্ণলতাকে একটা কল করবে। কিন্তু বুড়ো মানুষটা অসুস্থ শরীর নিয়ে তাকে টেনে আনল খাবার টেবিলে। না খায়িয়ে ছাড়ছিলই না। আজকাল দাদিজানের উপর মেজাজ গরম করতে পারে না। মুখটা দেখলেই ছোটবেলার সময়ে চলে যায়। ঐ সময়ের চেহারার সাথে এখনকারটা মেলানোই যায় না। যত দিন যাচ্ছে শারীরিক দুর্বলতা বাড়ছে, মুখের আদল বদলাচ্ছে, কথাবার্তাও পরিষ্কার করে বলতে পারছে না, কোথাও বেঁধে পড়ছে যেন! দাঁত পরে গিয়েছে নাকি কে জানে! তার এসব দেখা বা জানার সময় কোথায়?

মুনছুর সাখাওয়াত ভাতের প্লেটটা দূরে সরিয়ে নিল প্রথমে। তারপরে জিজ্ঞেস করল,
” স্বর্ণলতা পাঠিয়েছে? ”
” না। আমি নিজেই সংবাদটা নিয়ে এলাম। উনি এই নিয়ে আমাকে কিছু বলেনি। ”
” সংবাদটা কী? ”

ইকবাল এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। দাদিজানের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপরে ক্ষীণ স্বরে জানাল,
” আপা পরীক্ষায় ফেইল করেছে। একটা, দুটো বিষয়ে না সব বিষয়ে ফেইল করেছে। কলেজ থেকে অভিভাবক ডেকে পাঠিয়েছে। আমার মনে হলো, এই কথাটা আপনি জানেন না। উনি হয়তো লজ্জায়….”

সে কথা সম্পন্ন করতে পারল না। বুকে ভারি থাবা পড়ল। পরনের শার্ট কুঁচকে প্রায় সম্পূর্ণ অংশটায় হাতের থাবার মধ্যে ঢুকে গেল। কাঁখতলির সেলাইয়ে এমন টান খেল যে, ইকবাল নিজেও শার্টের মতো কুঁচকে গিয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠল। দুই হাতে মুনছুর সাখাওয়াতের হাতটা চেপে ধরতে শুনল,
” এখান থেকে গিয়ে যে পরীক্ষাটা দিল, ওটাই তো পাশ এসেছে। ঠিক মতো পড়া হয়নি তারপরেও পাশ করেছে। তাহলে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেইল এলো কেন? আমি পরীক্ষার সময়ে ফোনে পর্যন্ত কথা বলিনি! পড়ালেখার এত সময় পেয়েও ফেইল আসে কীভাবে? ”

শেষ প্রশ্নটা বজ্রপাতের মতো ভয়ঙ্কর শোনাল। দাদিজান এত ভয় পেলেন যে, বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন কোনো সাহায্য ছাড়াই। ভীতগ্রস্থ চোখদুটি নাতির দিকে স্থিরও হতে পারল না। ইকবালের নাক বরাবর ঘুষি পড়ল। একবার, দুইবার, তিনবার। ছেলেটা বাঁধা দেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছিল না। খাইরুন নিসা জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে চেঁচালেন,
” ফেইল করেছে তোর বউ, ও কে মারছিস কেন? ওর কী দোষ? ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রশ্নটা শুনলই না যেন! সমানে চড়-থাপ্পড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। কোমরের কাছে সবেগে লাথি মেরে অগ্নি ঝরা কণ্ঠে বলল,
” তোমার মেহমান রহমত না এনে খারাপ সংবাদ বয়ে এনেছে, এটাই ওর দোষ। ”

সে আরও কতগুলো লাথি মারল। এতেও তার মন ভরল না, মেজাজ শান্ত হলো না। ফোঁস ফোঁসে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। চোখ দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়বে এমনভাব। অস্থির চিত্তে আশপাশে কী যেন খুঁজল। কাঙ্ক্ষিত বস্তু না পেয়ে দৌড়ে এলো খাবার টেবিলের কাছে। একটা চেয়ার টেনে ধরতে খাইরুন নিসা শরীরের সর্বস্ব শক্তি একত্র করে চেঁচালেন,
” মুনছুর শান্ত হ। ছেলেটা মরে যাবে তো! আর মারিস না। ”

ততক্ষণে সে দুই হাতে চেয়ার তুলে নিয়েছে মাথার উপরে। এই সময়ে ইকবাল আহত অবস্থায় দাদিজানের উদ্দেশ্যে বলল,
” আটকাবেন না, দাদিজান। উনাকে রাগ ঝাড়তে দিন। আমি বুঝতে ভুল করেছি। আপা লজ্জায় না এই রাগের ভয়েই উনাকে কিছু বলেননি। রাগটা আমার উপরে পড়ুক। ”

সে কথাটা শেষ করা মাত্রই মুনছুর সাখাওয়াত কাঠের চেয়ারটা মুখের উপর ছুঁড়ে মারল। তারপরে দাদিজানের দিকে ফিরে বলল,
” আমার বউয়ের জন্য দরদটা দেখছ? এখন বুঝতে পেরেছ মেরেছি কেন? ”

খাইরুন নিসা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ময়না ভয়ে দূরে চলে গিয়েছিল। এখন দৌড়ে এলো। দাদিজান গায়ে হাত দিতে দিলেন না। ক্ষণকাল চুপ থেকে আপনমনে বিড়বিড়ালেন,
” কিছু বদলায়নি! কিছু না! আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে ময়নাকে আদেশ করল,
” দাদিজানকে ঘরে নিয়ে যা। আমি বাড়ি ফেরার আগে ঘর থেকে একপাও যেন বাইরে না পড়ে। ”

ভূমি কাঁপিয়ে গটগটিয়ে মূল দরজার দিকে হাঁটা ধরলে খাইরুন নিসা বললেন,
” এখন ঢাকা যাস না, মুনছুর। মেজাজ ঠিক কর আগে। মেয়েটার সাথে ফোনে একটু কথা বলে নে। তারপরে….”

পরের কথাটুকু আর বলা হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তও না থেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৮)

মুনছুর সাখাওয়াত ঢাকায় পৌঁছাল শেষ রাতের দিকে। আকাশে ভোরের আলোর আভাস ফুটছে মাত্র! বাড়ির উঠোন, গাছগাছালি, সিঁড়িপথ ডুবে আছে গাঢ় অন্ধকারে। থেমে থেমে শরীর ছুঁয়ে দেওয়া বাতাসে হিমঝুরি ফুলের মাতাল মাতাল গন্ধটা বড্ড নাকে লাগছে। ফুলের মধ্যে একমাত্র বেলি ফুলের গন্ধ ও সৌন্দর্যটায় মুনছুর সাখাওয়াতের মন কেড়েছিল। তারপর থেকেই সে বেলি ফুলের সুগন্ধি মিশ্রিত আতর মাখত। সেই আতর স্বর্ণলতার ভালো লাগল না। নাক কুঁচকে অকপটে জানিয়েও দিল। প্রায় এক যুগের লালিত অভ্যাসটা ছেড়ে দিল তৎক্ষনাৎ। কোনো বাক্য ব্যয় করল না, ওজরও দেখাল না। এরপরে দীর্ঘ সময় ফুলের প্রতি কোনো আকর্ষণ বোধ করেনি। গন্ধও টের পায়নি। বছরখানেক আগে জানতে পেরেছিল স্বর্ণলতার বকুল ফুল পছন্দ। সেই সময় থেকে বকুল ফুলের প্রতি আচমকা অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা অনুভব করতে লাগল। এই ভালো লাগা থেকে অন্যান্য ফুলের সৌন্দর্যেও আকর্ষণ বোধ করে। আলাদা গন্ধ টের পায়। নিঃশ্বাসের সাথে এই গন্ধ মিশে গেলে শক্ত বক্ষের ভেতরে নরম ও আদুরে কিছু একটার ঘুর্ণন চলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ। ঐ সময়টা চোখ বুঁজলে শুধু বউয়ের মুখটায় মনে পড়ে। ইচ্ছে করে বুকের মধ্যে বিরামহীন ঘুরতে থাকা নরম ও আদুরে অনুভূতিটা পুরোটায় স্বর্ণলতার মুখটায় ঢেলে দিতে। দূরে থাকায় সম্ভব হয়ে উঠেনি আজও।

মুনছুর সাখাওয়াত নাকে হাত দিয়ে সিঁড়িপথটা ধরল। হিমঝুরির মধুগন্ধী নিঃশ্বাসের সাথে মিশাতে চাচ্ছে না। বুকের আগুন এতদূর অবধি বয়ে নিয়ে এসেছে। শেষ মুহূর্তে নিভতে দিবে না কিছুতেই। মেয়েটা পড়ার নামে তার কত বড় ক্ষতি করেছে সেটা বুঝিয়ে দিবে, ক্ষতিপূরণও কাটবে। দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা এমনি এমনি ছেড়ে দিয়ে কী লাভ হলো সেই জবাবটাও লাগবে। ব্যবসায় নিয়ে পড়ছে তো! সময়ের মূল্য তার থেকে ভালো কে জানবে?

বাড়ির মূল দরজা খুলে দিল সুবর্ণ। আদুড় গা। ঘুমে ঢুলছে, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চোখ পিটপিট করে সময় নিয়ে দেখল দরজার বাইরের স্থির দীর্ঘকায় শরীরের মানুষটাকে। চোখে, মুখের ক্রোধ ভাবটা বোধ হয় ধরতে পারল না। খানিক বিরক্ত সুরে সুধাল,
” আপনি সবসময় এমন অসময়ে আসেন কেন? ”
” তোর খুব সমস্যা হয় নাকি? ”
” হ। শুধু আমার না, বাড়ির সবার সমস্যা হয়। ”
” তাই নাকি!

মুনছুর সাখাওয়াত দরজার ভেতরে ঢুকল। ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়াতে শুনল,
” হ। আমরা কেউ ঘুমাতে পারি না। ”

সে একটু থামল। ঘাড় ফিরে তাকাল সুবর্ণের দিকে। ভ্রূ জোড়া সামান্য কুঁচকে সন্দেহি কণ্ঠে বলল,
” আমি আসি তোর আপার কাছে। ঘুমের সমস্যা ওর হতেই পারে, স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তোদের হচ্ছে কেন? সব মিলে কি রাত জেগে দরজায় আড়ি পাতিস? ”
” ছি! আমরা ওসব করতে যাব কেন? আম্মা তো সেই কবেই বইলা দিছিল, আপনি আসলে আপার রুমের সামনে দিয়াও হাঁটা যাইবো না। ”
” তাহলে? তোদের সমস্যাটা কী? ”

সুবর্ণ দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে। এখন সামনে এগিয়ে এসে বলল,
” আপনি আসছেন বুঝতে পারলে আব্বা ঘুমাইতে পারে না। আমারেও ঘুমাইতে দেয় না। ঘুম থেইকা তুইলা মাথার কাছে বসাইয়া রাখবো আর একটু পরপরে বলবো, ‘ কোনোহানে যাইস না বাজান। ‘ হাতটা শক্ত কইরা ধইরা থাকে। টয়লেটেও যাইতে দেয় না। আর আম্মা তো এক সেকেন্ডের জন্যও এক জায়গায় দাঁড়াইবো না। হয় পুরা বাড়ি পাক খাইবো নাহলে রান্নাঘরে কাম করবো। তখন পারলে সারা দুনিয়ার তরকারির পদ রান্না করবো। কিন্তু খাইতে বসলে দেখা যাইবো ভাতটায় রান্না করে নাই। ভাত ছাড়া এত পদ কী দিয়া খাব, বলেন তো! ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূযুগল আরও কুঁচকে গেল। দৃষ্টিজোড়া একস্থির ও তীক্ষ্ণ হতে বুঝে গেল, এই বাড়ির ভীত মানুষগুলো এখনও ভীতই রয়ে গিয়েছে। এতগুলো বছরেও বুঝতে পারেনি, সে এই বাড়িতে আসে মহাজন হিসেবে না, স্বর্ণলতার স্বামী হিসেবে। মুনছুর সাখাওয়াত হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” তোর আম্মা আর বড় আপাকে স্বর্ণলতার রুম থেকে বের করে রুম খালি কর। জলদি। ”
” খালিই আছে। আম্মারা ঐ রুমে নাই। ”

সে স্বর্ণলতার রুমের দিকে পা বাড়াল। দূর থেকে দেখল দরজাটা আধ খোলা হয়ে আছে। পায়ের গতি ঘন করতে করতে বলল,
” ওদের তোর রুমে পাঠাল কখন? স্বর্ণলতা কি জেনে গিয়েছে আমি আসছি? ”
” জানি না। কিন্তু আম্মাদের আমাদের রুমে না, নিচতলায় কলিবুর রুমে পাঠাইছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের চলনপথে আরও একবার বাঁধা পড়ল। সে থেমে যেতে বাধ্য হলো। পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল,
” কবে? ”
” দুই মাস তো হইবোই। ”
” এতদিন ধরে তোর আপা একা ঘুমাচ্ছে? ”
” হ। ”

সুবর্ণের মায়া মায়া মুখ, সুন্দর কণ্ঠস্বর, সরল মুখোভিব্যক্তির মধ্যে পড়ে মুনছুর সাখাওয়াতের ক্রোধের তাপ খানিক কমে এসেছিল। শেষ তথ্যটা কেরোসিনের মতো কাজ করল যেন! বুকের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল আবারও। স্বর্ণলতা শুধু পরীক্ষার ফলাফলই না, একা ঘুমানোর কথাটাও লুকিয়েছে। গত দুই মাস সে একটু বেশি ব্যস্ত ছিল, বউয়ের সাথে কম কথা হয়েছে। কিন্তু একেবারেই হয়নি এমন তো না। তাহলে এই কথাটা বলল না কেন? মুহূর্তের মধ্যে চোখ দুটো রাঙা হয়ে ওঠল। চোয়ালদ্বয় শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। একহাতে এক ধাক্কায় পুরো দরজাটা মেলে ফেলল। দৃষ্টি জোড়া সরাসরি গিয়ে পড়ল বিছানায়। সাথে সাথে পিল চমকে ওঠল। স্বর্ণলতা বিছানায় নেই! শূণ্য বিছানায় বইপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। একটাও আস্ত নেই। সবগুলোই ছেঁড়া, টুকরো টুকরো। বিছানার চাদর একপাশে নেমে গিয়েছে। বালিশ দুটো পড়ে আছে মেঝেতে। একটা থেকে অর্ধেক তুলা বেরিয়ে সম্পূর্ণ মেঝেটায় নোংরা করে ফেলেছে। মুনছুর সাখাওয়াতের হৃদস্পন্দন থমকে গেল। গলা শুকিয়ে এলো। অদম্য রাগ প্রবল দুশ্চিন্তায় রূপ নিয়ে ফেলল নিমেষে। চট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল রুমের অন্যপ্রান্তে। স্বর্ণলতা নজরে এলো। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পাল্লাগুলো মেলা। কপালটা ঠেকানো লোহার গরাদে। জেগেই আছে। চোখ দুটি মেলা। উদাস মুখভঙ্গিতে চেয়ে মুনছুর সাখাওয়াত শ্বাসটা ছাড়ল। তারপরে দরজার কাছ থেকে সরে এলো নীঃশব্দে। সুবর্ণ নিজের রুমে ঢুকছিল। তাকে পাঁজাকোলা করে মূল দরজা ডিঙিয়ে বাইরে এলো। সিঁড়ি মুখে দাঁড় করিয়ে দরজাটা আটকে দিল বাইরে থেকে। তারপরে প্রশ্নটা করল,
” তোর আপার কী হয়েছে? ”

সে নির্দ্বিধায় অকপটে জবাব দিল,
” মনে হয় পাগল হইয়া গেছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সজোরে একটা থাপ্পড় দিতে চেয়েও পারল না। মনে হলো, মানুষটা অন্য কেউ হলেও মুখের আদলটা হুবহু তার বউয়ের মতো। নাক, চোখ, ঠোঁট সব এক। শুধু গায়ের রঙটা একটু কালো। পুরুষের গড়নের হওয়ায় একদেখায় সঙ্গে সঙ্গে বুঝা যায় না। কিন্তু কিছু সেকেন্ড চেয়ে থাকলে যে কেউ বলে দিবে, এরা দুজন আপন ভাই-বোন। পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।

থাপ্পড়ের জন্য তোলা হাতটা দিয়ে সুবর্ণের গাল চেপে ধরল। আস্তে, সাবধানে। তারপরে মৃদু হাসি দিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” তোর আপার কী হয়েছে? ঠিক করে বল। উল্টাপাল্টা কিছু বলিস না। মেজাজ ঠিক নেই রে, শালা মিয়া। ”

সে বোধহয় দুলাভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝল। তাই পাগল শব্দটা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করল না। একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে বলল,
” আপা ঠিকমতো খায় না, গোসলও করে না। খালি ঘুমায় আর ঘুমায়। কেউ ডাকলে চেঁচামেচি করে, ঘরের জিনিস ভাঙে। কারও সাথে কথা বলে না। জানালার কাছে দাঁড়াইয়া কী যেন ভাবে! ভাবতে ভাবতে আবার কান্নাও করে। ”
” নামাজ পড়ে না? ”
” পড়ে। শুধু নামাজটাই সময়মতো পড়ে। কোরান পড়া বাদ দিছে মনে হয়। শুনতে পাই না। আম্মা আমারে ঐ রুমে যাইতে মানা করছে তাই দেখতেও পারি না। ”
” কতদিন ধরে চলছে এসব? ”
” আম্মারা নিচ তলায় যাওয়ার আগে থেইকা। ”
” অনেক দিন তো! আমাকে জানাসনি কেন? ”
” আপা মানা করছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটুক্ষণের জন্য জিজ্ঞাসা পর্ব থামাল। আপনমনে কিছুক্ষণ ভাবনার কাজ সেরে বলল,
” মেয়ে যে সেধে নষ্ট হচ্ছে, তোর আম্মা দুই-একটা চড় থাপ্পড় দেয়নি? ”
” না। কিন্তু মাঝেমধ্যে বকে। ”
” মারাও দরকার ছিল। ”
” আমারও তাই মনে হয়ছিল। আম্মারে বলতেই উল্টা আমারে মাইর দিয়া বলছে, মেয়েমানুষের বিয়ে হইলে নাকি বাপ-মায়ের মারার অধিকার নাই। জামাইয়ের কাছে জবাব দিতে হয়। আম্মায় তো আপনারে খুব ভয় পায়। সামনেই দাঁড়াইতে পারে না। আবার মাইরা জবাব দিবো কীভাবে? তাই মারে নাই। ”

মূল দরজার সিটকানি খুলে দুজনেই ভেতরে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের রুমের দিকে দ্বিতীয়বারের মতো পা বাড়াল। একটু এগিয়ে ফিরে এলো। সুবর্ণের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসে সুধাল,
” হাত-পা কাটেনি তো? ”
” না। আপা পুরা পাগল হয় নাই এখনও। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ, মুখ খিঁচে নিল। তার সামনে তার বউকে বার বার পাগল বলছে। অথচ সে কিছুই বলতে পারছে না। এত সাহস কোথায় পেল? সে আবারও ঝুঁকে এলো। একটা কানের লতি আলতোভাবে ধরে নিচু সুরে বলল,
” আজকে আর আমার সামনে আসিস না। ”
” কেন? ”
” খুব মার খাবি। ”

______
স্বর্ণলতা এখনও একই ভঙ্গিতে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত যে রুমে ঢুকেছে, বিছানায় বসে তাকেই পর্যবেক্ষণ করছে সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না।

প্রায় মিনিট পাঁচ ধরে মুনছুর সাখাওয়াত নির্নিমেষ বউকে দেখল। চোখের সামনে খোঁপাটা খুলে পিঠে বাড়ি খেতে তার ধ্যান ভাঙল। সাথে সাথে ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”

সে ভীষণ চমকাল। গরাদে মাথাটা ঠুকে গেল একদম। ব্যথাটাকে গুরুত্ব দিল না। ঝটিতে ঘাড় ফেরাতে চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটায়। অপলকে ক্ষণকাল নীরব চেয়ে থাকল। মুখে কিছু বলল না, ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করল না। মাটির পুতুলের মতো স্থির, প্রাণহীন দেখাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত এই ভঙ্গিটাকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। তাই আবারও ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা। ”

সে আবারও চমকাল। সামান্য কাঁপলও। তারপরে ছুটে এলো বিছানার কাছে। স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুধাল,
” কখন এসেছেন? ”
” কিছুক্ষণ আগে। ”

স্বর্ণলতা স্বামীর মুখে হাত রাখল। কপাল ছুঁয়ে গালে হাতটা নিয়ে আসতে অস্থির হয়ে পড়ল। পুনরায় সুধাল,
” মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? সকালে কিছু খাননি? ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর হাতের ওপর একটা হাত রাখল। নিজের গালের সাথে গাঢ়ভাবে চেপে ধরে প্রত্যুত্তর করল,
” সকাল হয়নি, স্বর্ণলতা। রাতের শেষ প্রহর চলছে এখনও। ”

সে চট করে দেয়ালঘড়িতে দৃষ্টি রাখল। ঘণ্টার কাঁটা সবে চারটা ছুঁয়েছে। সময়ের হিসাবে এত বড় ভুল? লজ্জায় স্বর্ণলতার ফ্যাকাশে মুখটাও রাঙা হয়ে ওঠল। তৎক্ষনাৎ স্বামীর দিকে ফিরতে পারল না। ঘড়ির দিকে এমন একমনে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকায় মুনছুর সাখাওয়াতের মনে সন্দেহ হলো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সুধাল,
” তুমি কি ঘড়িটাও বুঝতে পারছ না? ”
” পারছি। ”
” তাহলে এভাবে কী দেখছ? আমার দিকে তাকাও তো। ”

স্বর্ণলতার তাকাতে হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত নিজেই মুখটা নিজের দিকে ঘুরাল। কাছ থেকে ভালো করে চাইতে বুঝল, খুব শুকিয়ে গিয়েছে। মুখটা এত মলিন! উজ্জ্বলতা নেই বললেই চলে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়েছে। পাতা জোড়া কি ভেজা? চোখের কোণে অশ্রুর দানা এখনও চিকচিক করছে যে! তাহলে কি সুবর্ণ যা যা বলেছে সব সত্যি? তার ভাবনার মধ্যে স্বর্ণলতা নিজের হাতটা সরিয়ে নিল স্বামীর গাল থেকে। সামান্য দূরত্ব তৈরি করে বলল,
” নিশ্চয় রাতে না খেয়ে বেরিয়েছেন? গোসল করে আসুন। আমি খাবার দিচ্ছি। ”

সে আরও দূরে চলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত একটুও বাঁধা দিল না। দূর হতে বসে বসে দেখল, স্বর্ণলতা ওয়ারড্রবের দিকে এগুচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে খুলে যাওয়া খোঁপাটা আবারও করে ফেলল। তারপরে একটা ড্রয়ার খুলে অস্থিরভাবে কী যেন খুঁজতে লাগল! মুনছুর সাখাওয়াত চেয়ে থাকতে থাকতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ খাবার আনতে যাচ্ছিল না? তাহলে ড্রয়ারের মধ্যে কী খুঁজছে? ওখানে কি কাপড়ের বদলে খাবার রাখছে? নাকি ওয়ারড্রবকেই রান্নাঘর ভাবছে? দুটোই তো অস্বাভাবিক আচরণ! একজন সুস্থ মানুষ এতটা অসচেতন হয় কী করে? স্বর্ণলতা কি তাহলে সত্যি…’ সে ভাবনার মধ্যে শিউরে ওঠল। গা ঝাড়া দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনই চোখে পড়ল, স্বর্ণলতা ড্রয়ার থেকে পাঞ্জাবি বের করেছে। ওয়ারড্রবের উপরে রেখে আরও কী একটা যেন খুঁজছে! মুনছুর সাখাওয়াত স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েটা খাবার নয় তার জন্য কাপড় বের করছে। গোসল করতে বলল যে! এরমানে সুস্থ আছে, হুঁশেও আছে। সে তখনই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল স্ত্রীর নিকটে। পেছনে ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নামিয়ে ঠোঁট ছুঁয়াল তার প্রিয় ও প্রার্থিত স্থানটায়।

পুরো ছয় মাস পরে স্বর্ণলতার ব্যক্তিগত পুরুষটির আচমকা নরম ও উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে প্রথমে চমকাল। পর মুহূর্তে কাঁটা দিয়ে ওঠল সর্বাঙ্গে। থমকে গেল হাতের কাজ। চোখ দুটি বুঝে এলো আপনাআপনি। পায়ে ভর দিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ওয়ারড্রবে ঠেস দিয়ে শরীরের সম্পূর্ণ ভরটুকু ছেড়ে দিয়ে বহুকষ্টে দাঁড়িয়ে রইল। এত অল্প, হালকা স্পর্শে মন ও শরীর উভয়ের অবস্থা এমন করুণ হয়ে ওঠল কীভাবে? সে মনে মনে ভারি আশ্চর্য হলো।

স্বর্ণলতার এই নীরব, অপ্রকাশিত যুদ্ধে আরও ধরাশায়ী করতে বোধ হয় মুনছুর সাখাওয়াত একের পর এক চুমু খেতে লাগল। জামার গলাটা একহাতে টেনে সামান্য সরাতে সে এত কেঁপে ওঠল! মুনছুর সাখাওয়াত টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরিয়ে ধরল। তারপরে কানের কাছে মুখ নিয়ে সুধাল,
” পরীক্ষায় ফেইল এলো কেন? টিচাররা ইচ্ছে করে নাম্বার দেয়নি? ”
” না। ”
” রোল নাম্বার ভুল লিখেছ? ”
” না। ”
” তাহলে? স্বর্ণলতা, সত্যিটা বলো। গোপন করো না কিছু। আমি তোমার স্বামী। তোমার মুনছুর সাখাওয়াত। আমার কাছে ভয় কিসের? লজ্জা হওয়ারও কথা না। তুমি জানো, আমার কাছে তুমি সবার উর্ধ্বে। তোমাকে খুশি করতে আমি নিজের স্বার্থকে পায়ে পিষেছি। আমার জন্যে এরচেয়েও বড় ত্যাগ আর কিছুই হতে পারে না। তোমার পড়ালেখায় আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তোমার শখ হয়েছে, করছ। ভালো হলেও তোমার অর্জন, খারাপ হলেও তোমার অর্জন। এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। ”

স্বর্ণলতার হাত দুটো তখনও ড্রয়ারের ভেতরেই। আগের মতো খোঁজার কাজটা শুরু করে প্রত্যুত্তর করল,
” আগ্রহ নেই তাহলে প্রশ্ন করছেন কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। ঝটপট চুমু খেল বউয়ের কানে, কানের আশপাশের স্থানগুলোতে। স্বর্ণলতার অনুভূতির সাগরে আবারও জলোচ্ছ্বাস শুরু হলো বুঝি। সামলে উঠতে এত বিপাকে পড়তে হচ্ছে! সে হাতের কাজ আবারও থামিয়ে চোখ বুঁজে ফেলল। এই সুযোগে মুনছুর সাখাওয়াত হাতদুটিও বের করে আনল ড্রয়ার থেকে। হাতসমেত বউকে আবারও গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আগ্রহ দেখাতে তুমি বাধ্য করেছ। ”
” কীভাবে? আমি এই ব্যাপারে আপনাকে কিছুই বলিনি। ”
” না বলেই তো নিজের ক্ষতিটা করেছ। তোমার ক্ষতি মানেই আমার ক্ষতি। আমার ক্ষতি হচ্ছে বুঝেও আগ্রহ দেখাব না? স্বর্ণলতা, আমি শুধু কারণটা জানতে চাই। সব বিষয়ে ফেইল এলো কীভাবে? তুমি ওরকম দুর্বল ছাত্রী নও। ”

স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত চুপ থেকে জানাল,
” আমি লিখতে পারিনি। ”
” কেন? অসুস্থ ছিলে নাকি হাত কেটে গেছিল? ”
” একটাও না। ”
” তাহলে? ”
” আমার কোনো প্রশ্নই কমন পড়েনি। বানিয়ে লেখার মতো জ্ঞানটুকুও ছিল না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত খুব অবাক হলো। বউকে ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে ঘুরাল। অতঃপর প্রবল আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল,
” একটাও কমন পড়েনি? ”

স্বর্ণলতা চোখ নামিয়ে নিল। মাথাটা বুকের দিকে ঝুঁকে গেল আপনাআপনি। সেই অবস্থায় জবাব দিল,
” না। ”
” বইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন এসেছিল নাকি? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আমি পরীক্ষার সময়ে কিছু পড়িনি। ”
” আগে পড়েছ তো? তোমার ওতেই পাশ নাম্বার চলে আসার কথা। আমি শুনেছি, তুমি খুব মেধাবী। এমন অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা পরীক্ষার আগের রাতে না পড়ে নিজেকে চাপমুক্ত রাখে। পরীক্ষায় ভালো করার এটাও একটা কৌশল। আমি নিজেও এমন করতাম। ”
” আপনিও খুব মেধাবী ছিলেন? ”
” আমাকে টানছ কেন? আমি তো উদাহরণ দিলাম। নিজেকে দিয়ে উদাহরণ দিলে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। তুমি তোমার কথা বলো। মনে হচ্ছে, আসল কারণটা এখনও বলোনি। কী লুকাচ্ছ? ”
” কিছুই না। আমি পরীক্ষার সময়ে পড়িনি, আগেও পড়িনি। কখনই পড়িনি। ”

তার মাথাটা সোজা হয়ে গেল। কণ্ঠস্বরটা শোনাল খুব জোরে। চোখে, মুখে স্পষ্ট বিরক্ত ফুটে উঠলেও মুনছুর সাখাওয়াত দমে যেতে পারল না। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কয়দিন আগে না পরীক্ষা দিলে? অর্ধেক বই তো তখনই পড়া হয়ে গেছিল। ”
” হয়েছিল, পরে ভুলে গেছি। আমার কিছু মনে নেই, কিছু শিখতেও পারছি না। ”
” কেন? ”
” আপনার জন্য। ”
” আমি কী করলাম? আমি তোমার কাছে আসিনি, ফোনেও তেমন কথা বলিনি। ”
” বলেননি কেন? আসেননি কেন? এজন্যই তো পড়ায় মন বসাতে পারিনি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত খেল যেন! এক মুহূর্তের জন্য বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। বোধশক্তিও লোপ পেল বুঝি। মাথায় কিছুই ঢুকল না। অবোধের মতো জানাল,
” এরকম তো আগে…”

তাকে কথা শেষ করতে দিল না। পূর্বেই স্বর্ণলতা প্রতিবাদ করে ওঠল,
” আগে কি আমাকে দুই দিনের জন্য নিজের কাছে রেখেছেন? দিন-রাত আদর করেছেন? যত্ন করে চুল শুকিয়ে দিয়েছেন? রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেলে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখেছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের মাথায় তখনও পরিষ্কার হয়ে বিষয়টা ধরা পড়ল না। সে বোকার মতো বলে ফেলল,
” এগুলো করে কি দোষ করে ফেললাম? আমার কাছে তো এগুলো ভালোবাসা মনে হয়েছে। ”
” তখন দোষ করেননি। আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দোষ করেছেন। আপনার উচিত ছিল আমাকে একেবারে রেখে দেওয়া নাহয় এখানে এসে ভালোবাসা। আপনি আসেননি, আমাকেও যেতে দেননি। ভালোবাসার অভাবে রেখেছেন। আমি এই অভাবটা সহ্য করতে পারিনি। পড়তে বসলে আপনাকে পাশে পেতে ইচ্ছে করত, গোসল করে বের হলে আপনার কাছে চুল শুকাতে ইচ্ছে করত। ঘুমানোর সময় আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করত, ঘুম ভেঙে গেলে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করত। দিনের পরে দিন কেটেছে আমি কিছুই পাইনি। আপনি দুইদিনে আমাকে যা দিয়েছেন আমি ছয় মাসেও তা ভুলতে পারিনি। মাঝে একবার এলেন চোখের দেখাও পেলাম না! নিজে তো ঠিকই দেখে গেলেন। আপনি নিজের স্বার্থ একটুও পায়ে পিষেননি। ইচ্ছে হলে আমাকে নিজের কাছে যত্ন করে রাখছেন, ইচ্ছে নাহলে আমাকে ফেলে দিচ্ছেন। এগুলো কি স্বার্থপরতা না? প্রশ্রয় শুধু আপনি না আমিও দিয়েছি। আপনি শুধু আমাকে বিরক্তই না, পুরো পাগল বানিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে, আপনার সবকিছুকে এত অসহ্য লাগছে! আত্মহত্যা পাপ না হলে এতদিনে মরে…”
” স্বর্ণলতা! ”

মুনছুর সাখাওয়াত ধমকে ওঠে পুনরায় বলল,
” আমাকে যা খুশি বলো কিন্তু আমার বউকে নিয়ে কিছু বলবে না। এমনিতেই ওর অনেক ক্ষতি করে ফেলেছ। আমি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি না। ”
” তাহলে তাকাবেন না। কেউ তো জোর করেনি। ”

স্বর্ণলতা ওড়না দিয়ে লম্বা ঘোমটা টানল। এতেই ক্ষান্ত হলো না। সম্পূর্ণ উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
” আর দেখতে পারবেন না, এবার শান্তি? ”
” আমার শান্তি লাগবে না। ওটা তুমি নেও। আমি দিচ্ছি। ”

কথাটা বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মূল দরজার সিটকানি খোলার শব্দ কানে পৌঁছাতে স্বর্ণলতা ঘাবড়ে গেল। একটু আগে বলা কথাগুলো মাথার মধ্যে বৈদ্যুতিক পাখার মতো ঘুরতে লাগল। সেকেন্ড কয়েক পেরুতে বুঝে এলো বেফাঁসে কথাগুলো বলে কত বড় অন্যায় করেছে। মানুষটা নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছে? এমনিতেই ধরা দিচ্ছিল না এখন তো আরও দিবে না। আর যদি কখনই না আসে? ভয়ে, আতঙ্কে স্বর্ণলতার নাভিশ্বাস উঠে গেল। তখনই দৌড়ে গেল দরজার কাছে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে। দরজার কাছে কেউ নেই! সে সিঁড়ি কেটে নিচেও নামল। উঠোনে জীপটা পর্যন্ত নেই। খালি উঠোনটায় বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। এত কষ্ট লাগছিল! মনে হচ্ছিল, ঐ উঠোনটা তার বুকের ভেতরে। যেখানে কেউ নেই। তাকে বুঝার মতো, ভালোবাসার মতো কেউ নেই। সবটা ফাঁকা!

স্বর্ণলতার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, এখনই মারা যাবে। মৃত্যুর যন্ত্রণা তাহলে এমনই হয়? টলমল চোখে, এলোমেলো পায়ে রুমের মধ্যে ঢুকতেই ভয়ে চমকে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসে আছে। বুকের প্রবল চাপটা সামলে স্বামীর কাছে এগিয়ে গেল। ভালো করে মুখের দিকে চেয়ে বুঝার চেষ্টা করছে, মানুষটা সত্যি ফিরে এসেছে নাকি সে কল্পনা করছে। শরীর ছুঁয়ে পরীক্ষা করার জন্য একটা হাত সবে তুলেছিল সেটায় মুনছুর সাখাওয়াত দুই হাতে চেপে ধরল। মুখের কাছে টেনে চুমু খেল। তারপরে অসহায় গলায় বলল,
” বলেছিলাম না, তোমার সাথে পুরোপুরি মিশে গেলে আমি আলাদা থাকতে পারব না? পারছি না, বউ। অনেক চেষ্টা করেছি। তোমার মতো করে বুঝাতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস করো, শুধু এই কারণেই আমি তোমার থেকে দূরে থেকেছি। আর কোনো কারণ নেই। এবার আমাকে রেখে দাও। তোমারও তো আমাকে প্রয়োজন।

স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” রেখে দিব মানে! আপনি কি এখন থেকে ঢাকাতেই থাকবেন? ”
” হ্যাঁ। ”
” আপনার ব্যবসা-বাণিজ্য সামলাবে কে? ”
” জানি না। ”
” আর দাদিজান? উনাকে দেখাশুনা করবে কে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত আরও দিশাহারা হয়ে নিরুপায় গলায় জানাল,
” আমি সত্যি জানি না, জানতেও চাই না। আমি শুধু শান্তি চাই। ওটা দুনিয়ার আর কোথাও নেই, একমাত্র তোমার কাছেই আছে। ”

স্বর্ণলতা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। এখানে কী বলা উচিত বুঝতে পারছিল না। তাই চুপ করে শুধু চেয়েই থাকে স্বামীর মুখপানে। মুনছুর সাখাওয়াত অধৈর্য হয়ে সুধাল,
” কিছু বলছ না কেন? আমাকে রাখবে না? ”
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি। ”
” আচ্ছা, আমি জাগিয়ে দিচ্ছি। ”

সে হাত বাড়িয়ে স্ত্রীর কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল। নিজের কাছে টেনে এনে একপায়ে বসাল। তারপরে চুমু খেল কপালে, ভেজা চোখ জোড়ায়, অভিমানে ফোলা গাল ও নাকে। সর্বশেষে ঠোঁট জোড়ায় আলতো, ছোট ছোট চুমু দিতে লাগল।

এই থেমে থেমে, ছোট ছোট, অল্প স্পর্শের চুম্বনে স্বর্ণলতা খুশি হতে পারল না। সে বরাবরই আগ্রাসী চুম্বন পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছে। সেই গভীর অবিরত স্পর্শ পাওয়ার জন্য এত কাতর হয়ে পড়ল যে, একহাতে মুনছুর সাখাওয়াতের গলা চেপে ধরল। অন্যহাত ডুবিয়ে দিল তার বাবরি কাটা চুলে। তারপরে তৃষ্ণার্তের মতো নিজেই নিজের পাওনাটুকু আদায় করার কাজে নেমে পড়ল।

মুনছুর সাখাওয়াতের এই মুহূর্তে এই অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার কোনো অভিপ্রায় ছিল না। তাই যথেষ্ট সংযমের সাথে স্ত্রীকে আদর করছিল। মান ভাঙার জন্যে, ভুল বুঝাবুঝিটুকু কাটিয়ে উভয়ের ভালোবাসা প্রকাশে আনার জন্য। কিন্তু স্ত্রীর দিক থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে তার সংযমের সর্বশেষ সুতোটাও ছিঁড়ে গেল। মনের সকল রাগ, অভিমান, দ্বিধা, বাঁধা সবকিছুকে অতিক্রম করে দুজনেই যখন উষ্ণ চাহিদা পূরণে উন্মত্ত ঠিক তখনই মুনছুর সাখাওয়াত কিছু টের পেল। নিজেকে দ্রুত সামলে উঠে বলল,
” স্বর্ণলতা, তোমার পিরিয়ড চলছে? ”

ছোট্ট একটা প্রশ্ন অথচ স্বর্ণলতার কানে প্রবেশ করল ফুটন্ত তরলের মতো। সে ছিটকে সরে যেতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত ছাড়ল না। কোমরটা চেপে ধরে বসিয়ে রেখে সুধাল,
” আমাকে বলোনি কেন? কবে থেকে চলছে? ”

স্বর্ণলতা উত্তর দিতে পারল না। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে ভাবছে, এত বড় ভুল কীভাবে করল? তার স্পষ্ট মনে আছে, ভুলটা সেই করেছে। সেই এগিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে। সামান্য ছোঁয়াতে এত বেসামাল হয়ে পড়েছিল? মানুষটা তাকে নিশ্চয় বেহায়া, নির্লজ্জ মনে করছে? এই লজ্জা, অপমান সে সয়বে কীভাবে?

” স্বর্ণলতা? ”

স্বর্ণলতার স্থবির ভাব কাটল ঠিকই কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর কাছ থেকে পালাতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত এবারও ছাড়ল না। বুকে টেনে নিল জোর করে। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” সব ঠিক আছে। লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। স্বর্ণলতা, এই সময়ে অনেক মেয়েই তীব্র যৌন চাহিদা অনুভব করে। এটা স্বাভাবিক। শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ভুল করা যাবে না। আমি আছি তো তোমার পাশে। সবসময় থাকব, আর কখনও দূরে যাব না। এখন বলো, আমাকে রাখবে কি না। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯৯)

” সব ঠিক আছে। লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। স্বর্ণলতা, এই সময়ে অনেক মেয়েই তীব্র যৌন চাহিদা অনুভব করে। এটা স্বাভাবিক। শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ভুল করা যাবে না। আমি আছি তো তোমার পাশে। সবসময় থাকব, আর কখনও দূরে যাব না। এখন বলো, আমাকে রাখবে কি না। ”

এবারেও প্রশ্নের উত্তর এলো না। ভিন্ন কোনো শব্দ বা বাক্যও উচ্চারিত হলো না। স্বামীর কাঁধ ও গলার সংলগ্ন স্থানটাতে মুখ গুঁজে স্বর্ণলতা কেঁদেই চলেছে। এত ফুঁপাচ্ছে! সমানে নাক টানছে। হেঁচকি উঠে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

মুনছুর সাখাওয়াতের পরনে পাঞ্জাবি নেই। উষ্ণতা বিনিময়ের মুহূর্তে স্বর্ণলতার উৎসাহে খোলা হয়েছিল। সেই কথাটা বেমালুম ভুলে গেল। দীর্ঘ ও অবিরত ক্রন্দনরত অবস্থায় উন্মুক্ত বুকটায় হাতড়াতে লাগল। কাপড় না পেয়ে বুকের ঘনকালো পশমগুলোই খামচে ধরল। মুঠোতে আসে না। জোরপূর্বক মুঠোতে টেনে আনলেও বেশিক্ষণ থাকে না। ফসকে যায়। স্বর্ণলতা এই অযাচিত কর্মটা ঘটাচ্ছে অবচেতনেই। মুনছুর সাখাওয়াত ব্যথা পাচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে চোখ খিঁচে নিচ্ছে। তবুও মুখে কিছু বলল না। স্ত্রীর হাতটাও সরাল না। এভাবেই ছেড়ে দিল। এই মুহূর্তে তার সম্পূর্ণ ধ্যানটায় স্বর্ণলতাকে স্বাভাবিক করানোতেই আছে। মেয়েটা এত কেন লজ্জা পাচ্ছে! কতভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে, কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। কান্নার বেগ বেড়েই চলছে যেন!

যে পাগলাটে অনুভূতির জন্য স্বর্ণলতা নির্লজ্জের মতো আচরণ করে বসল, অপমানিত হলো সেই অনুভূতিটা এখনও তাড়িয়ে দিতে পারেনি। শিরায় শিরায় জোঁকের মতো কামড়ে ধরে আছে। মুনছুর সাখাওয়াতের হাতের পরম স্নেহের স্পর্শটা মাথা বেয়ে পিঠে পড়লে শিউরে ওঠছে। স্বর্ণলতা কিছুতেই মন সরাতে পারছিল না। পাছে আবারও বেতাল হয়ে ভুল করে বসে এই ভয়ে ত্বরিত স্বামীর হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল। তারপরে নিজের হাতদুটো নিয়ে গেল পেছনে। সর্বক্ষণ আড়ালে থাকা টুকরো কাপড়ের দুই অংশ একসাথে করার চেষ্টা করতেই শুনল,
” আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জামার হুকগুলোও লাগিয়ে দিল। মেঝেতে পড়ে থাকা ওড়না এনে পুরো শরীরটা মুড়ে দিতে দিতে ভাবল, বুঝিয়ে কাজ হচ্ছে না তাহলে অন্য উপায় ধরা যাক। খানিক ভেবে সহসায় বলে ওঠল,
” তোমাকে দেখে আদুরীর কথা মনে পড়ে গেল। খুব ছোট বয়সে পেয়েছিলাম। শরীরটা এত ছোট ও নরম ছিল যে দুইহাতে ধরে রাখতে ভয় হতো। তাই বুকে নিয়ে বাইরে যেতাম। ভয়টা ওর মধ্যেও ছিল মনে হয়। তাই নিজে থেকেই মিশে থাকত। একটুও নড়ত না। তখন অবশ্য আমার বুকে পশম ছিল না। চামড়াতেই নখ আঁচড়ে পড়ে থাকত। ব্যথা লাগত, আঁচড়ের দাগ পড়ে যেত। দাদিজান দেখে খুব রাগ করত। আদুরীকে ফেলে আসতে বলত। আমি ফেলতে পারতাম না। মায়া লাগত যে! ”

এখানে এসে থামল। খেয়াল করল স্বর্ণলতার দেহের ঝাঁকুনি থেমে গিয়েছে। ফুঁপানির সুরটাও বেজায় মৃদু। ঠিকমতো খেয়াল না করলে কানে পৌঁছাচ্ছে না। মুনছুর সাখাওয়াত তার পোষ্য প্রাণীটাকে নিয়ে আরও বেশ কিছু গল্প শোনাল। পুরোনো স্মৃতি ঘাটতে ঘাটতে সেই ভয়ঙ্কর বিভৎস ঘটনাটাও মনে পড়ে গেল। এত ভালোবাসার, আদরের বিড়ালটাকে তার অসহ্য লাগতে শুরু করেছিল মায়ের জন্য। মাকে সে কখনও ভালোবেসে নাকি আজও বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু মায়ের কষ্ট দেখতে পারত না। বাবা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ওজুহাত ধরে বকত, মারত। তার এত রাগ হতো! ইচ্ছে করত গলা টিপে ধরতে। ঐ বয়সে মুনছুর সাখাওয়াতের রাগ বুকের ভেতরেই জমাট বেঁধে থাকত। প্রকাশ করার দুঃসাহসটা হয়ে ওঠত না। একমাত্র দাদিজানই প্রকাশ্যে ও গোপনে উভয়ভাবেই ভালোবাসত। কাজের চাপে মা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে পারত না। তাই দাদিজান সর্বদায় চেষ্টা করতেন খাওয়ার সময়ে ভালো কিছু দিতে। বাড়িতে ভালো কোনো রান্না হলে মায়ের জন্য উঠিয়ে রাখতেন, বাজারের টাকা বাঁচিয়ে মাঝেমধ্যে দুধ কিনে আনতেন। শরীরটা যে একেবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! সামান্য পরিমাণে দুধ খাওয়াতে পারলেও মনে হতো, একটু বুঝি গায়ে জোর এলো। এই উঠিয়ে রাখা খাবারটুকু আদুরী খেয়ে নিত। খেতে না পারলে ফেলে দিয়ে নষ্ট করত। দাদিজান ইচ্ছেমতো বকাঝকা করে রাগ মিটিয়ে ফেললেও মুনছুর সাখাওয়াত পারত না। সেই রাগ বুকের মধ্যে এত পরিমাণে জমে গেল যে, একদিন ভয়াবহ হয়ে প্রকাশ পেল। বাবার প্রতি রাগটাও এসে পড়ল আদুরীর ওপরে। এক মুহূর্তের জন্য নিয়ন্ত্রণ হারাতেই খুনির তকমা পেয়ে গেল। এরপর থেকে মুনছুর সাখাওয়াত বুকের মধ্যে রাগ জমানোর কৌশল ভুলে গেল।

________
স্বর্ণলতা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মুনছুর সাখাওয়াত ভেবেছিল, বিছানায় শুয়িয়ে দিবে। পর মুহূর্তে মত পাল্টেছে। যদি ঘুম ভেঙে যায়? আবার কাঁদতে শুরু করে? এই ভয়ে সে স্বর্ণলতাকে বুক থেকে সরানোর সাহস পায়নি। কাঁধে গুঁজে থাকা মাথাটার পেছনে হাত রেখে অতি সাবধানে এগিয়ে যায় শিথানের দিকে। খাটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকতে থাকতে সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ঘুম ভাঙল খোলা জানালা দিয়ে গড়িয়ে আসা সকালের ফকফকা আলোতে। সূর্যের তেজস্বী রশ্মি এসে পড়েছে পায়ের পাতায়। মিনিটের মধ্যে এত গরম হয়ে ওঠল যে, মনে হলো আগুন ধরে গিয়েছে। সে বিরক্ত মুখে পা জোড়া সরিয়ে তাকাল দেয়ালঘড়িটায়। দশটা পেরিয়ে গিয়েছে। এতটা সময় ধরে ঘুমানোর পরেও মনে হচ্ছে, মাত্রই তো চোখ বুঁজেছিল!

স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙেনি। স্বামীর কোলের মধ্যে গুটিশুটি মেরে গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। মাথাটা কাঁধ থেকে সরে এসে পড়েছে বুক ও পেটের মাঝামাঝিতে। মুনছুর সাখাওয়াত এতক্ষণে মুখটা দেখার সুযোগ পেল। কেঁদেকেটে চোখ, মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। গালের মধ্যে অশ্রুধারা বয়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে এখনও। হঠাৎ হঠাৎ ঠোঁট কেঁপে ওঠছে। সে হাত বাড়িয়ে গালের শুকনো, খড়খড়ে দাগগুলো মুছে দিল। তারপরে চোখ বুঁজে গভীর স্নেহে চুমু খেল চুলের মাঝে। এই সময়ে মনে পড়ল সুবর্ণের কথাগুলো। স্বর্ণলতা গ্রাম থেকে আসার পর থেকে বড্ড ঘুমকাতুরে হয়ে পড়েছে। যখন-তখন যেখানেসেখানে ঘুমিয়ে পড়ছে। ঐদিকে খাওয়া, গোসলে এসেছে প্রবল অনীহা। এই বদঅভ্যাসগুলো যত দ্রুত সম্ভব বদলাতে হবে। মুনছুর সাখাওয়াত এখন থেকেই শুরু করতে চাইল। তাই স্বর্ণলতাকে ডাকতে লাগল। সে নড়লচড়ল ঠিকই কিন্তু ঘুম থেকে ওঠল না। অবিরত ডাকার তোপে পড়ে একসময়ে বিরক্ত সুরে বলে ওঠল,
” এমন করছেন কেন? আরেকটু ঘুমাতে দিন না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কঠোর হয়ে ওঠল,
” আর এক সেকেন্ডও ঘুমাতে দিব না। সকালের নাস্তা কি দুপুরে সারবে? স্বর্ণলতা, ওঠো। ”

সে এবার হাত দিয়ে ঠেলতে লাগত। মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে সোজা করে ফেলল। স্বর্ণলতার এতেও ঘুম ভাঙে না। হাতের মধ্যে ভর ছেড়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত এত আশ্চর্য হলো! হঠাৎ করে এমন ঘুমের পাগল হলো কীভাবে? নেশা করলেও এতক্ষণে ছুটে যাওয়ার কথা। সে আরও কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল। কাজ না হওয়ায় শেষে বাধ্য হয়ে কানের কাছে চেঁচাল,
” স্বর্ণলতা, তোমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। কতদিন ধরে গোসল করো না? ”

এই কৌশলটা কাজে দিল। স্বর্ণলতা ঘুমে কাহিল হওয়া চোখদুটো ঝটিতে মেলল। বড় বড় চোখে অপলক দৃষ্টি স্থির হতে মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূ উঁচিয়ে ছোট্ট করে সুধাল,
” কতদিন? ”

স্বর্ণলতা ভাবনার অথৈ সাগরে তলিয়ে গেল যেন! সমানে মাথা চুলকে, ভ্রূ কুঁচকেও সঠিক সংখ্যাটা হিসাবে আনতে পারল না। অবোধের মতো মুখভঙ্গিতে করুণ দৃষ্টি রাখতে মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” মনে পড়ছে না? ”
” না। ”
” মনে করারও দরকার নেই। যাও, গোসল করে এসো। ”
” এখন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখে কোনো জবাব দিল। স্ত্রী কোলে পা দুটো জমিয়ে এলোমেলোভাবে বসে ছিল। সেই অবস্থায় অভিনব কায়দায় স্বর্ণলতাকে সোজা গোসলখানায় নামিয়ে দিল। পানির কলটা ছেড়ে দিয়ে শরীরটা সামান্য ভিজিয়েও দিল যাতে গোসল করতে বাধ্য হয়। গোসলখানার দরজা চাপিয়ে বাইরে আসতে নজরে পড়ল রুমের অগোছাল বিছানা, নোংরা মেঝে, ড্রেসিং টেবিলের এলোমেলো প্রসাধনী। সে তাৎক্ষণিক সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে ভাবল, বিয়ের দিন থেকেই বউকে ভালোবেসেছে। কতভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে! বুঝেনি। দুই বছরেও যেই হৃদয়ে সামান্যতম আঁচও ফেলতে পারেনি, দুই দিনে সেই হৃদয়সহ মাথাটাও আউলে গিয়েছে। এতটা প্রভাব ফেলার কারণ কী? দৈহিক চাহিদা? স্বর্ণলতার কি ঐদিকে ঝোঁক বেশি? সর্বনাশ! এই মেয়েকে তো এক মুহূর্তের জন্যও আলাদা রাখা যাবে না। দাদিজান কি এই ভয়ে বাচ্চার বিষয়টা তুলে এনেছিলেন?

মুনছুর সাখাওয়াত আপন ভাবনায় ডুবে থেকে পুরো রুম গুছিয়ে ফেলল। মেঝে ঝাড়ু দেওয়ার জন্য ঝাড়ুটা হাতে নিল। তখনই কলি দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে এমনভঙ্গিতে বলল,
” আমার কাজ আপনে করতাছেন ক্যান? ছার, ঝাড়ুডা আমারে দেন। আমি ঝাড় দিতাছি। ”

সে ঝাড়ু দিল না। কড়া চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমার রুম কোনোদিন ঝাড়ু দিছিস? ”
” না। ”
” ভেতরে ঢুকতে পেরেছিস? ”
” না। ”
” তাহলে এই রুমে ঢুকলি কোন সাহসে? ”

কলি ভয়ে একেবারে গুটিয়ে গেল। মাথাটা এতটায় নেমে গেল যে, বুকটা প্রায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে করছিল, ঝাড়ু দিয়ে ঘণ্টাখানেক পেটায়। কিন্তু সাহস হলো না। বউটা এই রুমেই আছে। গোসল করছে। কলি তার একমাত্র পরিচারিকা। সামান্য আঘাত পেলেও টের পেয়ে যাবে। এই মুহূর্তে কোনো মনমালিন্য চাচ্ছে না। এখানে থেকে যাওয়ার জন্য যে, অনুমতি চাইল সেটাও পায়নি এখনও।

গোসলখানার দরজা খোলার শব্দ হতে মুনছুর সাখাওয়াত ঝটপটে বলল,
” নাস্তা নিয়ে আয়। ”

________
স্বর্ণলতার চুল শুকিয়ে দিতে দিতে মুনছুর সাখাওয়াত প্রশ্নটা আবারও জিজ্ঞেস করল। এবার সাথে সাথে উত্তর এলো,
” না। রাখা যাবে না। ”
” কেন? ”
” আপনার গ্রামে থাকা বেশি জরুরি। ওখানে দাদিজান আছেন। কাঁচামালের ব্যবসাটাও নতুন। ঠিকঠাকমতো সময় না দিলে গুছানো ব্যবসাও লসে পড়ে। আপনিও পড়বেন। ওটার সাথে এখন শুধু আপনি না গ্রামের আরও একশটা পরিবার জড়িয়ে আছে। এখন আপনার নেওয়া প্রতিটা সিদ্ধান্তে শুধু আপনার না ওদের স্বার্থও জুড়ে থাকবে। তাই শুধু নিজের কথা ভাবা বন্ধ করুন। ”
” পারব না। ”

স্বর্ণলতা পেছনে ঘাড় ফেরাল। স্বামীর চোখের দিকে চোখ রেখে জোর গলায় বলল,
” পারতে হবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হেয়ার ড্রায়ারটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখল। তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে স্বর্ণলতার দিকে ফিরল। তারপরে আচমকা দুই কাঁধ ধরে সুধাল,
” তুমি ঘুমাতে চেয়েছিলে না? যাও, ঘুমাও। ”
” ঘুমাব। কিন্তু এই রুমে না, আপনার রুমে। নাস্তা করে আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিব। ”

স্বর্ণলতা আরও কাছে এগিয়ে এলো। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পুনরায় বলল,
” আপনার এখানে থাকতে হবে না। আমি আপনার সাথে থাকব। আপনার গ্রামে, আপনার বাড়িতে, আপনার রুমে। তারপরে রোজ রাতে আপনার বিছানায়, আপনার পাশে শুয়ে ঘুমাব। এখন বলেন আমাকে নিবেন কি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্তও দেরি করল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,
” না। ”
” কেন? ”
” ওখানে গেলে তোমার স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ”
” ভাঙুক। ”
” তুমি কষ্ট পাবে, স্বর্ণলতা। ”
” পাব না। ”
” পাবে। আজ নয়তো কাল ঠিকই বলবে, আমি তোমার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছি। এই দোষে যদি আমাকে সামান্য পরিমাণেও অবহেলা করো, আমি সয়তে পারব না। ”
” বলব না। বিশ্বাস করুন। আমি বুঝে গেছি, আমার স্বপ্নের চেয়েও আপনি বেশি মূল্যবান। যে স্বপ্ন পূরণে, স্বপ্নের চেয়েও অধিক মূল্যের কিছু ত্যাগ করতে হয় সেই স্বপ্ন পূরণে সুখবোধ হয় না। কোনো আনন্দ পাওয়া যায় না। সারাজীবন আফসোস আর হতাশা বয়ে বেড়াতে হয়। আমি এই ভারী অনুভূতিগুলো বয়ে বেড়াতে পারব না। আমি যে সুখের খোঁজে ঢাকা এসেছিলাম এরচেয়েও হাজারগুণ বেশি সুখের খোঁজ পেয়েছি গ্রামে, আপনার কাছে। ”

এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার পরেও মুনছুর সাখাওয়াত নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। চোখে, মুখে দ্বিধা ও শঙ্কার রেশ দেখা যাচ্ছিল। স্বর্ণলতাকে কিছু একটা বলার জন্য উদ্যত হচ্ছিল তখনই স্বর্ণলতা আচমকা পা জড়িয়ে ধরল। কেঁদে ফেলল সাথে সাথে। কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলল,
” আপনি চেয়েছিলেন না, আপনার ঘরে যাওয়ার জন্য আমি যেন পাগলের মতো কান্নাকাটি করি? দেখুন, আমি কাঁদছি। আপনার পায়ে ধরে কাঁদছি। এবার তো মেনে যান! ”

মুনছুর সাখাওয়াত ঘটনার আকস্মিকতায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। কোনো প্রতিক্রিয়ায় দেখাতে পারছিল না। স্বর্ণলতা এমন একটা কাজ করে বসবে স্বপ্নেও ভাবেনি। হেরে গিয়েও জিতে যাওয়া বুঝি একেই বলে। সে বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠল ঠিকই কিন্তু বউকে পায়ের কাছ থেকে সরাল না। নিজেও বসে পড়ল। স্বর্ণলতার একটা পা টেনে আনল নিজের কোলের ওপর। তারপরে মৃদু হেসে বলল,
” আমি তোমার পা ধরলে তুমি লজ্জা পাও, তুমি আমার পা ধরাতেও আমি লজ্জা পেয়েছি। কিন্তু দুজনের লজ্জা পাওয়ার কারণ এক হলো না কেন? ”

স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। নীরবে অশ্রু ঝরাতে থাকে। এই প্রথম তার কান্নায় মুনছুর সাখাওয়াতের মায়া হলো না। উৎকণ্ঠা বোধ হলো না। এমনভাবে চেয়ে চেয়ে দেখল যেন কত শতাব্দী ধরে এই দৃশ্যটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল।

________
স্বর্ণলতা ব্যাগ গুছাতে চাইলে মুনছুর সাখাওয়াত বাঁধা দিল। সে শুনল না। নিজের প্রয়োজনীয় সকল কিছু একে একে ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল,
” এগুলো এখানে কে পরবে? পড়ে পড়ে নষ্ট হবে। এত অপচয় করা ভালো না। আল্লাহ পছন্দ করে না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। স্বর্ণলতা খেয়াল করে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? সে সাথে সাথে বলল,
” গিরগিটি চিনো? ”
” চিনি। সামনে থেকে দেখিনি। কিন্তু শুনেছি, এই প্রাণী নাকি মুহূর্তের মধ্যে গায়ের রঙ বদলে ফেলতে পারে। ”
” হুম। একদম তোমার মতো। তুমিও মুহূর্তের মধ্যে আচরণ বদলে ফেল। ”

স্বর্ণলতা ব্যাগের চেইন লাগাচ্ছিল। মাঝপথে থেমে গিয়ে তাকাল স্বামীর দিকে। ক্ষণকাল চিন্তা করে সন্দেহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি আমাকে গিরগিটি বললেন? ”
” না। গিরগিটিকে স্বর্ণলতা বলেছি। পড়ালেখা ছাড়তে না ছাড়তেই মাথা থেকে সব বুদ্ধি বের হয়ে গেছে। সাধারণ তুলনাও ধরতে পারছ না! ”

______
স্বর্ণলতার গোছগাছ শেষ। সকলের থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে জিজ্ঞেস করল,
” বর্ণ আপনাকে ভয় পায় না কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত অবাক হয়েছে এমন মুখভঙ্গি করে সুধাল,
” ভয় পায় না? ”
” না। ”
” এই কথা ও নিজের মুখে বলেছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” ডাকো তো জিজ্ঞেস করি। ”

সে সুবর্ণের নাম ধরে হাঁক দিয়ে স্বামীর পাশে বসল। নিচু স্বরে বলল,
” ও কিন্তু একেবারে স্কুলে যাচ্ছে না। আমি চলে গেলে পুরো বাদ দিয়ে দিবে। আপনি ধমকে দিয়ে যান তাহলে একদিনও কামাই দিবে না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু মাথা নেড়ে বুঝাল, ধমকে দিবে। সেই সাথে এটাও ধরে নিল সুবর্ণ এমুখো হবেই না। এই বাড়ি ঢুকে যেভাবে শাসিয়েছিল, ভয়ে তার সামনে আসার কথা না। তাকে পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত করে সুবর্ণ রুমে ঢুকল। দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে সুধাল,
” আপা, ডাকছিলা? ”

স্বর্ণলতা কপট গাম্ভীর্যের ভাব ধরে বলল,
” আমি না তোর দুলাভাই ডেকেছে। কী যেন বলবে। ”

সে তখনই চোখ সরিয়ে আনল দুলাভাইয়ের দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ময়ে পুরো থ বনে গেল। স্বর্ণলতা তাহলে ঠিকই বলেছে, এই ছেলে তাকে একফোঁটাও ভয় পায় না!

সুবর্ণের হাতে বোধ হয় সময় কম। তাই অধৈর্য ভঙ্গিতে তাগাদা দিল,
” দুলাভাই জলদি বলেন। ”
” খুব তাড়া নাকি? ”
” হ। ফুটবল ম্যাচ আছে। সময় মতো না গেলে বাদ দিয়া দিবো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক ঘড়িটা দেখে বলল,
” এখন তোর স্কুলে থাকার কথা না? ”
” হ। ”
” তাহলে স্কুলে যাসনি কেন? ”
” ভালো লাগে না। ”
” কেন? ”
” ক্লাসের সবাই আমাকে খুব বুরক্ত করে। ”
” এই বয়সেই মেয়েরা তোকে বিরক্ত করে? ”
” শুধু মেয়েরা না ছেলেরাও বিরক্ত করে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত যেন আকাশ থেকে পড়ল! এক পলক স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল,
” বাপ রে! তোর রূপের এত কদর? ”
” ধুর! কী বলেন বুঝি না। রূপের কদর হইবো কেন? ”
” তাহলে বিরক্ত করার কারণ কী? ”
” আমি বয়সে বড়, লম্বায়ও বড়। এখন তো এই দাড়ি মোচ নিয়েও যন্ত্রণা করে। আম্মারে বললাম, কাইটা দিতে দিল না। বলে আরও বড় হোক। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মূল বিষয়টা এতক্ষণে ধরতে পারল বোধ হয়। জিজ্ঞেস করল,
” তুই কোন ক্লাসে? ”
” সেভেনে। ”
” সেভেনেই দাড়ি মোচ গজিয়ে ফেলেছিস? তুই তো খুব চালু! তোর প্রেমিকা খুব তাড়া দিচ্ছিল নাকি? ”

সুবর্ণ এত বিরক্ত হলো যে, দুলাভাইয়ের থেকে মুখটায় সরিয়ে নিল। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে অভিযোগের মতো বলল,
” আপা, দুলাভাই রে বইলা দেও উনি আমার প্রেমিকা নয়। ”
” কে তোর প্রেমিকা না? ”
” তোমার বান্ধুবী। ”

উত্তরটা দিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা পেছন থেকে কতবার ডাকল, শুনল না। ছেলেটা বড় হতে হতে কি অসভ্যও হয়ে যাচ্ছে? মুনছুর সাখাওয়াত পেছন থেকে বলল,
” ওর বয়সের সাথে ক্লাসটা মিলছে না। আরও উপরে ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিতে। ”
” নিচের ক্লাসের পড়াই তো পারে না। ঠেলে ঠেলে এতদূর এনেছি। উপরের ক্লাসে ভর্তি করলে ঠেলেও কাজ হবে না। ”

_________
শ্বশুরবাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো। স্বর্ণলতা হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে ছুটল দাদিজানের রুমে। গল্পগুজবে কতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতে পারল না আচমকা দরজার কাছ থেকে কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” বউ নিয়ে এলাম আমি অথচ সময় কাটাচ্ছে দাদিজান। পরোপকারটা কি আল্লাহ আমাকে দিয়ে জোর করেই করাবেন? ”

চলবে