#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৩)
ভ য় ও আ তঙ্কে স্বর্ণলতার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। একটু পানির স্পর্শ না পেলেই নয়। ঘরে মেয়ে মানুষ বলতে সে আর মা। মা একটু দূরে তাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচুমাচু হয়ে। আঁচল দিয়ে মোড়ানো মাথাটা নুয়ে আছে বুকের কাছে। আড় চোখে নজর রাখছেন মেয়ের ওপর। স্বর্ণলতা পিপাসার কথাটা জানানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। ভারি দুর্বল লাগছে! বুকটা চৈত্রের খরার মতো ফেটে যাওয়ার উপক্রম! ঘোমটার আড়ালে একবার ডাকল,
” আম্মা? ”
গলার সুর এত মৃদু ও চাপা হয়ে বেরুল যে ঘোমটার আড়ালেই আটকা পড়ল। কেউ শুনতে পেল না। স্বর্ণলতা ব্যাপারটা সহজেই ধরে ফেলল। তাই ঘোমটা সরানোর সিদ্ধান্ত নিল। হাতদুটো উঁচু করা মাত্রই শবনম বেগম ধ মকে ওঠলেন,
” স্বর্ণা! ঘোমটা ধরে না৷ চুপ কইরা বইয়া থাক। কাজী সাহেব কী কয় শুন। ”
স্বর্ণলতার হাতজোড়া নিচে নেমে গেল। শিথিল হয়ে পড়ে আছে কোলের ওপর। এই সময় কাজী সাহেব বিবাহের খুতবা পাঠ করা আরম্ভ করলেন। অতঃপর মেয়ের পরিচয় ও দেনমোহরের পরিমাণ উল্লেখ করছিলেন, সহসা মেঘের গর্জনের ন্যায় কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” কাজী, থাম। এতকিছু বলার দরকার কী? মেয়ের পরিচয় কি মেয়ে জানে না? নতুন করে শেখাতে হবে? তুই কাজী না শিক্ষক? ”
আচমকা হুং কারে কাজীর হাত থেকে খাতা পড়ে গেল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল,
” এটা নিয়ম, মহাজন। মেয়ের অভিভাবক ও বরের সামনে মেয়ের পরিচয়, দেনমোহর উল্লেখ করে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করা সুন্নত। এতে আল্লাহর তরফ থেকে রহমত ও বরকত আসে। ”
মহাজনের মেজাজ শান্ত হওয়ার বদলে আরও বেশি উত্তপ্ত হলো। অধৈর্য্য ভাব ফুটে ওঠল কপালের ভাঁজে ও চোখের কোটরে। গরম নিশ্বাস ফেলে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এলো কাজীর সামনে। একপাশে থেকে পাঞ্জাবির গলাটা থা বা দিয়ে ধরে মস্তক টেনে নিল নিজের কাছে। চাপা কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে শাসাল,
” জীবনের মায়া থাকলে, যা বলছি তাই কর। নিয়ম, সুন্নত, আল্লাহর রহমত এসব অন্য কাউকে শোনানোর সময় ও সুযোগ দুটোই পাবি। ”
চোখের পলকেই কাজী ঘেমে ওঠল। ভ য়ার্ত দেখাল চোখজোড়া। ঘন ঘন ঢোক গিলল। মৃদু মাথা নেড়ে টেনে টেনে বললেন,
” জি, মহাজন। ”
স্বর্ণলতা ঘোমটার আড়াল থেকে সবই শুনছে। যত শুনছে, তত হৃদস্পন্দন বাড়ছে। শরীরের ঘাম শুকিয়ে গেল আচমকা। অনুভব করছে, তার ঠাণ্ডা লাগছে। হাত, পা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে! এই দা নবের মতো দেখতে মানুষটা কোনো নিয়মের ধার ধারে না। আল্লাহর রহমত, নবীর সুন্নতকে পর্যন্ত তুচ্ছ করে!
মহাজনের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কাজী দ্রুত হস্তে খাতা তুলল। কোনো কিছু পড়া বা লেখার মধ্যে গেল না। কনের দিকে চেয়ে সরাসরি বলল,
” মা, কবুল বলো। ”
স্বর্ণলতা আশ্চর্য না হয়ে পারল না। এত সংক্ষেপেও বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়? সে অনেকগুলো বিয়েতে উপস্থিত ছিল, এরকম ঘটনা কোথাও ঘটেনি। কাজী ও মহাজন উভয়ে কবুল শোনার জন্য অধীরচিত্তে অপেক্ষা করছে। কনের এসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে শান্ত ও সুস্থির হয়ে বসে আছে। মুখে শব্দ নেই। যত চিন্তা, ভাবনা সব মন ও মস্তিষ্কের ভেতরেই তা ণ্ডব চালাচ্ছে। বাইরে কোনো আভাস নেই। শবনম বেগম দূর হতে নত মাথায় বললেন,
” মনে হয় ভ য় পাইতাছে। একা বইয়া আছে, বয়সও তো কম। মহাজন, আমি স্বর্নার লগে বসি? ”
উত্তরটা সঙ্গে সঙ্গেই এলো,
” না। একপাও বাড়াবি না। পাশে কারও বসা লাগলে আমি বসব। ”
বলতে বলতে সে এগিয়ে এলো চৌকির কাছে। ভারী ওজনের দেহটা উপরে উঠতেই পুরো চৌকিটা কেঁপে ওঠল। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা এত জোরে শোনাল যে, স্বর্ণলতার মনে হলো চৌকিটা এখনই ভেঙে পড়বে! ভাঙেনি। কপাল ভালো, আল্লাহ রক্ষা করেছে। মহাজন তার পাশে বসল পা মুড়িয়ে। বুক উঁচু ও মেরুদণ্ড টানটান করে। স্বর্ণলতার ঘা ঘেষে বসেনি, দূরত্বও খুব একটা রাখেনি। যতটুকু দূরে থাকলে নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায় ততটুকুই দূরত্বে আছে তারা। সেকেন্ড দুই পেরুতেই বেলি ফুলের কড়া সুবাস এসে লাগল স্বর্ণলতার নাকে। অস্বস্তি ভাবটা তীব্র হলো তখনই। সে পাশে সরে যেতে চাইল, পারল না। মহাজন খপ করে হাত ধরে বলল,
” সকাল থেকে মেজাজটা খারাপ। তুমি আর ঝামেলা করো না তো। তাড়াতাড়ি কবুল বলো। ”
এ প্রথম কণ্ঠটায় তে জের স্পর্শ পেল না স্বর্ণলতা। রা গ বা জেদ কিছুই নেই। বিরক্ত ও অনুরোধ মিলেমিশে আছে। মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো বিরক্তে ঢাকা পড়েছে অনুরোধের নরম ভাবটা। কণ্ঠস্বরের এই বদলটায় স্বর্ণলতার ভ য়টাকে লুকিয়ে ফেলল। নির্ভয়ে পরিষ্কার গলায় প্রত্যুত্তর করল,
” না, আগে কন ঐ ট্যাকার ছবি ছাপানো কাগজটায় কী আছে? ”
সে জোরে বললেও কথাগুলো ফিসফিসে শোনা যাচ্ছে। মহাজন তার দিকে ফিরতে বাধ্য হলো। ঘোমটার আড়ালে থাকা মুখটাকে দেখার নিষ্ফল চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,
” পড়োনি? ”
স্বর্ণলতা সত্য লুকাল না। সরাসরি জানাল,
” পড়ছি কিন্তু বুঝতে পারি নাই। এত কঠিন শব্দ ব্যবহার করছেন ক্যান? আমি কি বড় ক্লাসে পড়ি? ”
মহাজন তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। চুপচাপ গম্ভীরমুখে চেয়ে আছে ঘোমটার দিকে। সে জানে, স্বর্ণলতা দশম শ্রেণিতে পড়ছে মাত্র। কিছুক্ষণ এভাবে বসে থেকে আচমকা বলল,
” পড়ো না? চিঠি পড়ে তো মনে হলো, বড় ক্লাসও পাশ করে ফেলেছ। পনেরো বছরের মেয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা বুঝে গেল অথচ সামান্য চুক্তিপত্র বুঝল না! মানতে পারছি না। ”
মহাজনের কণ্ঠে এখন বিরক্তও নেই। অধৈর্যের যে একটা অস্থিরতা ছিল সেটাও হারিয়ে গেছে কোথাও। সহজ, প্রাঞ্জল কণ্ঠস্বর। বসার ভঙ্গিটাও সামান্য বদলে গেছে। স্বর্ণলতা কথাবার্তা এগিয়ে নিল,
” চুক্তিপত্র কী? আমি তো বইয়ে এ রকম পত্র নিয়া কোনো পড়া পাই নাই। ”
” এটা বইয়ের না, জীবনের পড়া, স্বর্ণলতা। আমার বাড়ি চলো, তোমাকে আমি জীবনের সকল পড়া শিখিয়ে দিব। ”
মহাজন কাজীর দিকে তাকাল। চোখ রা ঙাতেই তিনি বললেন,
” মা, কবুল বলো। ”
স্বর্ণলতা ঘোমটার মধ্যে থেকেই চেঁচিয়ে ওঠল,
” না, কমু না। আগে চুক্তিপত্র কী, বুইঝা লই। তারপর কমু। ”
শবনম বেগম দূর হতে ধ মকে ওঠলেন,
” আবার পড়া? মাথার মইধ্যে কি পড়া ছাড়া কিছু নাই তোর? কতবার কইছি? শান্ত হইয়া ব, কাজীর ক…”
তিনি শাসনবাণী সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। পূর্বেই মহাজন গ র্জে ওঠলেন,
” ঐ মহিলা চুপ। আমার বউ যা ইচ্ছে হয়, বলবে। দিনরাত পড়া নিয়ে থাকবে, তোর সমস্যা কী? আরেকটা কথা বললে, ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দিব। ”
স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল! তার মাকে ‘ তুই ‘ সম্বোধন করছে। বিশ্রী ব্যবহার করছে। একজন নারী হিসেবে তো দূর, তার মা হিসেবেও বিন্দুমাত্র সম্মান দিচ্ছে না। এতগুলো বাইরের লোকের সামনে কেমন শা সাচ্ছে! নিজের ঘর থেকে বের করে দেওয়ার হু মকি দিচ্ছে। বাবা কোথায় তার? স্বর্ণলতা মাথা নেড়ে নেড়ে চারপাশে বাবাকে খুঁজল। সুবর্ণও কি নেই আশেপাশে?
” চুক্তিপত্র দলিলের মতো। কোনো সম্পদ বা সেবা সেচ্ছায় দেওয়ার বৈধ লিখিত পদ্ধতি। ”
স্বর্ণলতা বাবাকে খুঁজে পায়নি। ঘরের ভেতর ও দরজার কাছে নেই। জানালার বাইরেও দেখা যাচ্ছে না। সে সন্ধানের কাজ থামিয়ে বলল,
” ওইখানে দুইটা স্বাক্ষর ছিল। একটা আমার আব্বার, আরেকটা কার? ”
” অবশ্যই আমার। ইকবাল তো আমাকেই দিছে। ”
স্বর্ণলতা আরেক দফা শিউরে ওঠল। এই লোকটা তার বাবার নাম ধরে বলছে। বয়সে কি দুজন একই? তার মনে হচ্ছে না। মানুষের ক্ষমতা হলে বুঝি ব্যবহারের এমন অধঃপতন ঘটে! সে জিজ্ঞেস করল,
” আব্বায় কী দিছে আপনারে? ”
” তোমাকে। বিনিময়ে দুই লক্ষ টাকাও নিয়েছে। চুক্তিপত্রে লেখা আছে, তুমি যে তার মেয়ে এই দাবি করতে পারবে না কখনও। আরও অনেক কিছু আছে, তোমাকে এসব বুঝতে হবে না। আমি আছি তো, সব সামলে নিব। তুমি শুধু কবুল বলে, আমার ঘরে ঢুকো। ”
স্বর্ণলতার বুকের ভেতরটায় র ক্তের মিছিল হচ্ছে যেন! মাথাটাও ঘুরছে বোধ হয়। চোখের ওপরের পর্দাটা এবার কানেও পড়ল বুঝি? পরিষ্কার করে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কী বলছে, পাশের লোকটা? সে বিক্রি হয়ে গেছে? বাজারের পণ্যের মতো দরদাম করে কিনে নিয়েছে? অসম্ভব তার বাবা এমনটা কখনও করতে পারে না। বাবা তাকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। একটু দেরি করে ঘরে ফিরলেই তো পাগল হয়ে যায়! তার পছন্দের খাসির মাংস খাওয়াবে বলে, ইদের দিন অন্য বাড়িতে গিয়ে খাসি কাটার ফরমায়েশ খাটে। রোজ সকালে আদর করে ঘুম ভাঙায় তো বাবাই!
” পু লিশ ডাকবে বলেছিলে না? ডাকো। আমার সমস্যা নেই, থানাতে আমার অ্যাপায়ন ভালোই হয়। ওখানকার রঙচা আমার খুব পছন্দ। অনেক দিন হলো খাওয়া হয়নি, আজ খেয়ে আসলে মন্দ হবে না। কিন্তু তোমার বাবা? তার জিভে সয়বে তো, স্বর্ণলতা? তার তো উভয় সংকট চলছে। পনেরো বছর দেখালেও ফাঁসবে, আঠারো বছর দেখালেও ফাঁসবে। ”
স্বর্ণলতা ইতিমধ্যে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে ফেলেছে। সেই অবস্থায় বলল,
” আমার আব্বা এমন করতে পারে না। আপনি ফাঁসাইছেন! চাল খাটাইয়া ফাঁসাইছেন। ”
মহাজনের দৃষ্টি সামনে চলে গেল। আগের মতো আঁটোভঙ্গিতে বসল। মুখের ভাব ক ঠোর করে বলল,
” সঠিক উত্তরটা বাবার কাছ থেকেই জেনে নিও। এবার বিবাহকার্য সম্পন্ন করতে সাহায্য করো। ”
স্বর্ণলতা বসা থেকে উঠে পড়তে চাইল। মহাজন টের পেয়েই হাতটা ধরে ফেলল আবারও। জোর করে বসিয়ে রেখে বলল,
” তুমি কি চাও, সত্যি পু লিশ ডাকি? পু লিশ এলে হয়তো তুমি বেঁচে যাবে কিন্তু তোমার বাবা-মা বাঁচবে না। চৌদ্দ শিকে আজীবন বন্দি থাকার ব্যবস্থা করে দিব। ”
” আব্বা-আম্মাও বাঁচব। আমি বাঁচামু। প্রমাণ কইরা দিমু, আপনি জোর কইরা এসব করাইছেন। ”
মহাজনের ধৈর্য পুরোপুরি ভেঙে গেল। শবনম বেগমের দিকে অ গ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,
” তোর মেয়েকে থামাবি? নাকি সত্যি পুলিশ ডেকে আনব? ”
এবার সে দরজার দিকে ফিরে তীব্র হুং কার ছাড়ল,
” পান্না? জুয়াড়িটাকে ধরে নিয়ে আয় তো। এত জ্বালা আর ভালো লাগছে না। এক কো পে সব শেষ করে দিব! ”
শবনম বেগমের আত্মা কেঁপে ওঠল! দৌড়ে এলেন মেয়ের কাছে। ঘোমটা সরিয়ে অজস্র চুমু খেলেন মুখে। বুকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত বললেন,
” মহাজন কোনো চাল খাটায় নাই রে, মা। সব সত্যি। তোর বাপে সাইধা ট্যাকা নিছে। হেই তো শুধু তোরে বিয়া করতে চাইছিল। আর কিছু কয় নাই। তোর বাপেই….”
কান্নার চাপে গলা বন্ধ হয়ে গেল বুঝি। পরের শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারলেন না। মেয়ের মুখটা দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে অসহায় ও করুণ চোখে চেয়ে থাকলেন শুধু। স্বর্ণলতা সেই অশ্রুভেজা মমতাময়ীর চোখজোড়ায় চেয়ে ভাবছে, কাকে বিশ্বাস করবে! আজ সকালেও বাবা ঘুম ভাঙিয়েছে। বিয়ের খবরটাও সেই দিয়েছে। সাথে এটাও জানিয়েছে, এই বিয়ে ঠিক করেছে তার মা। সেজন্যই তো মায়ের ওপর তার রা গ!
প্রায় মিনিটখানেক সময় কাঠের পুতুলের মতো স্তব্ধ থেকে আচমকা বলল,
” কবুল, আমি মহাজনকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করলাম। ”
” তোমার স্বামীর নাম মহাজন না, মুনছুর সাখাওয়াত। ”
স্বর্ণলতা মায়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পুনরায় বলল,
” আমি মুনছুর সাখাওয়াতকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করলাম। ”
চলবে