মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-১০৩+১০৪+১০৫

0
687

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০৩)

স্বর্ণলতা একছুটে দাদিজানের রুমে এলো। বিছানায় উঠে বৃদ্ধার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠল। অবিরাম গড়িয়ে পড়া চোখের অশ্রুতে ভিজতে লাগল দাদিজানের সাদা নরম বালিশটা। মেয়েটা ওখানে মুখ গুঁজে সমানে কেঁদে চলেছে।

খাইরুন নিসা চোখ বুজে একমনে ইস্তেগফার করছিলেন। গলার কাছে আঁটো বাঁধন, কানের কাছে কান্নার মিহি সুরে মনঃসংযোগে বিচ্ছিন্ন ঘটল। ইস্তেগফার থামিয়ে মুদিত চোখ জোড়া মেললেন। কুঁচকানো মুখটা বিরক্তে আরও কুঁচকে গেল। ভারি অতিষ্ঠ গলায় বলে ওঠলেন,
” একজন পা ধরে কাঁদছে, আরেকজন গলা ধরে কাঁদছে! সমস্যা কী? আমাকে এত জ্বালাচ্ছিস কেন? তোদের কোন বাড়া ভাতে আমি ছাই দিয়েছি? ”

স্বর্ণলতা জানে এই রাগ, বিরক্ত, ধমক সবই মিছামিছি। শক্ত থাকার চেষ্টা মাত্র। একটু পরেই কাঁপা হাতের স্নেহের স্পর্শ পড়বে মাথায়, পিঠে। মানুষটা বড্ড ভালো মনের। বুকের ভেতরটায় একফোঁটাও খারাপ নেই। বরাবরই ঠাণ্ডা মেজাজে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। যেদিন এই বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিল সেদিন থেকে এই মানুষটা তার পক্ষে কথা বলেছেন, তার হয়ে লড়েছেন। শুধু বর্তমানে নয় ভবিষ্যতেও যেন তার জীবন কোনো ধরনের ঝুঁকিতে না পড়ে সেই ব্যাপারেও সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। এজন্যে নাতির কাছে কম কথা শুনেননি, অপমানিত হয়েছেন অসংখ্যবার। তবুও নাতবউটাকে একা ছেড়ে দেননি। বিস্ময়কর ধৈর্য ও সহনশক্তির পরিচয় দিয়ে প্রতিবারই আরও শক্ত করে হাত ধরে ছিলেন। দাদিজানকে যদি পাশে না পেত তাহলে এই বাড়িতে তার জীবনধারণ কেমন হতো? মুনছুর সাখাওয়াতের আচার-ব্যবহারই কেমন হতো? স্বর্ণলতা কল্পনা করতে গেলেও ভয় পায়, দম আটকে আসে।

খাইরুন নিসা প্রায় মিনিটখানেক সময় পরে সুধালেন,
” নাতবউ? মাথাব্যথাটা কি আবারও বেড়েছে? ”

স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিল না। বালিশে মুখ গুঁজে থেকে সবেগে মাথা নাড়ল। দাদিজানের দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হতে কান্নার বেগ বাড়ল। শাড়ি জড়িয়ে থাকা শরীরটা এত কাঁপছে! ফুঁপানো শব্দগুলোও বুঝি রুমের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে! বাইরে কেউ আছে নাকি কে জানে! বাড়ির বউ এই ভর সন্ধ্যায় কেঁদেকেটে দুনিয়া ভাসিয়ে ফেলছে। এটা কি লজ্জার না? বয়সটা তো পনেরোতে আটকে নেই। কয়েক মাস পরে ফুটফুটে বাচ্চার জননী হয়ে যাবে। এখনও এত আবেগি, অবুঝ মনের থাকলে চলবে? দাদিজান পরম স্নেহে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” এভাবে উপুড় হয়ে শোয়া ভালো না, নাতবউ। এখন তো তুই পোয়াতি। তোর, পেটের বাচ্চা দুজনের জন্যই ক্ষতি। সোজা হ। ”

স্বর্ণলতা এই আদেশটা রাখল। গলা ছেড়ে দিয়ে চিত হলো। দুই হাতে চোখের পানি মুছল নিজ উদ্যোগেই। কিন্তু কান্নাটা কিছুতেই থামাতে পারছে না। এত কষ্ট হচ্ছে কেন? হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন! খাইরুন নিসা একটু সময় দিয়ে পুনরায় বললেন,
” কান্না দেখি কমছেই না! শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। ”
” মুনছুর? ”
” হুম। ”
” এটা তো ওর পুরোনো স্বভাব। এজন্যে এত কান্নার কী আছে? ”

স্বর্ণলতার ফুঁপানি থেমে গেল আচমকা। দাদিজানের দিকে স্থির চেয়ে থেকে বলল,
” দল পাল্টে ফেলেছেন নাকি! ”
” কিসের? ”
” হঠাৎ নাতির পক্ষে কথা বলছেন যে? ”

খাইরুন নিসা ম্লান হাসলেন। নাতবউয়ের কান টেনে ধরে বললেন,
” কারও পক্ষে কথা বলছি না। তোর যেটুকু বুঝের দরকার, ঐটুকু দিচ্ছি। ”

স্বর্ণলতা কান ছাড়িয়ে নিল। দাদিজানের বুকে মাথা রেখে একহাতে পেট জড়িয়ে ধরল। অতঃপর ভারি অভিমানি গলায় বলল,
” যা ইচ্ছে হয়, বুঝান। কিন্তু আমিও বলে দিচ্ছি, ঐ ঘরে আর কখনও যাব না। উনি ডাকলেও যাব না। জোর করে নিতে আসলে আপনি আমাকে এভাবে ধরে রাখবেন। একেবারেই ছাড়বেন না। ”
” হ্যাঁ, তারপরে তোর জামাই বুড়ো মানুষটাকে তুলে আছাড় মারুক! ”
” পারবে না। ”
” তুই আটকাবি? ”
” হুম। ”
” তাহলে নিজের বেলায়ও আটকে নিস। আমাকে তোদের মাঝে টানিস না। ”

স্বর্ণলতা মাথা তুলল। অভিযোগের মতো বলল,
” যুদ্ধের ময়দানে আমাকে একা ছেড়ে দিবেন? আপনিও কিন্তু খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন! ”

______
বয়স বাড়লে ঘুম কমে আসে। খাইরুন নিসার চোখ থেকে ঘুম একেবারেই পালিয়ে গেল যেন! শুধু সময়-অসময়ে ঝিমিয়ে থাকেন। স্বর্ণলতারও ঘুমের নিয়মে ব্যাঘাত ঘটেছে। জোর করেও ঠিক রাখতে পারছে না। উল্টো হাঁপিয়ে উঠে দাদিজানকে সঙ্গ দিচ্ছে। গল্পগুজব, হাসি-তামাশা ভালোই চলছিল সহসায় দরজায় টোকা পড়ল। উভয়ে চমকে উঠে একই স্বরে সুধাল,
” কে? ”
” আমি। ”

কলি নিচে পাটির বিছানায় শুয়ে ছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পায়নি। ঘুমে বিভোর ছিল। কিন্তু পুরুষ কণ্ঠটা কান স্পর্শ করতে হুড়মুড়ে ওঠল। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে থাকা অসম বয়সের নারী দুজনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” দরজা কি খুইলা দিমু? ”

স্বর্ণলতা বলল,
” না। ”

খাইরুন নিসা বললেন,
” দে। ”

দুজনের থেকে ভিন্ন আদেশ পেয়ে কলি দ্বিধায় পড়ে গেল। কারটা ফেলবে, কারটা ধরবে? তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল বিপদে ফেলা মানুষটাই। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে দৃঢ় স্বরে জানাল,
” স্বর্ণলতা বের হও। আমি অপেক্ষা করছি। ”

স্বর্ণলতা বিছানায় শুয়ে থেকে চেঁচাল,
” আমি কারও রুমে যাব না। এখানেই ঘুমাব। ”
” রুমে যেতে হবে না। ”
” তাহলে কোথায় যাব? ”
” বাইরে। ”
” বাইরে কোথায়? ”
” যেখানে তোমার যেতে ইচ্ছে হবে। ”

স্বর্ণলতার বুঝতে একটু সময় লাগল। কিন্তু বুঝে আসার পরে এক সেকেন্ডও দেরি করল না। দারুন উৎসাহে চঞ্চল পায়ে রুম রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত ততক্ষণে উঠোনে নেমে গিয়েছে। স্বর্ণলতাও সেদিকে হাঁটা ধরল। বারান্দায় পৌঁছাতে পেছন থেকে কলি ডেকে ওঠল। চেঁচিয়ে জানাল,
” আম্মাজান কইল, বোরকা পইরা যাইতে। এই সময়ে নাকি রাত-বিরাতে বাইরে ঘুরা ঠিক না। সারাক্ষণ দুয়া-দুরুদও পড়তে কইল। ”

________

বাড়ির গেইটের বাইরে পা রেখে মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে? ”
” ঐ স্কুলটায়। গাছটাতে কি এখনও ফুল আছে? ”
” না। ওটা দেবকাঞ্চন গাছ। শুধু হেমন্তকালেই ফুল ফোটে। ”

কিছুদূর এগুতে স্বর্ণলতা খেয়াল করল তার পাশাপাশি হাঁটতে থাকা মানুষটা পিছিয়ে পড়েছে। সে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফেরাতেই শুনল,
” আছি। এগোও। ”
” ভয় করে। ”
” আমি আগে থাকলে আরও ভয় পাবে। পেছন থেকে যদি তোমাকে কেউ টেনে নিয়ে যায়? ”

স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল। দ্রুত স্বামীর পেছনে তাকাল। কিছু দেখা যায় না! সবকিছু আঁধারে ঢাকা। সে আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
” আজকে চাঁদ ওঠেনি! ”
” উঠেছিল। কিছুক্ষণ আগে মেঘে ঢেকে নিল। মনে হয় বৃষ্টি হবে। ”

স্বর্ণলতা আঁতকে উঠে বলল,
” বৃষ্টি হলে বাসায় ফিরব কীভাবে? ”
” তোমার কি ফেরার খুব তাড়া? ঘুম পেয়েছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ঘন ঘন কদম ফেলে নারী ছায়ামূর্তিটার পাশাপাশি হলো। দুজনের মধ্যে একহাতের মতো দূরত্ব রেখে সুধাল,
” তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

আজকে সাথে করে টর্চ নিয়ে এসেছে। টর্চের গোল আলোটা মাটিতে স্থির করা। স্বর্ণলতা সেই আলোতে স্বামীর খালি হাতটার দিকে তাকাল। কতবার যে এই হাতটা তার হাত ধরেছে হিসেব নেই! কিন্তু প্রতিবারই চমকেছে। মানুষটা হাত ধরার আগে কখনও বলেনি। ইঙ্গিতও দেয়নি। ভাবখানা এমন ছিল, ইচ্ছে হয়েছে, ধরেছে। এত বলার কী আছে? স্বর্ণলতারও ইচ্ছে হলো সেরকমই জোর দেখিয়ে হাতটা ধরতে। যদিও মুনছুর সাখাওয়াত তাকে স্পর্শ করতে মানা করেনি, শুধু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। স্বর্ণলতা ভেবেছে কাছে গেলেও দূরে সরিয়ে দিবে।

মুনছুর সাখাওয়াত টর্চের আলো সামনে ফেলে বলল,
” ভোরের দিকে আমি ঢাকা যাব। বাড়ি ফিরব দুইদিন পরে। দাদিজানের খেয়াল রেখ, সাথে নিজেরও। কোনো সমস্যা হলে আমাকে কল করবে। সাথে সাথে ফেরত আসব। জরুরি কাজেই যাচ্ছি। কিন্তু তোমার চেয়ে জরুরি না। মনে থাকবে? ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। মনখারাপ নিয়ে ছোট ছোট কদমে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। দুইদিন মানুষটাকে দেখতে পাবে না! একরুমে না থাকুক, একবাড়িতে থাকত। ইচ্ছে হলে কেউ না কেউ উঁকি মেরে মুখটা দেখেছে। কখনও লুকিয়ে, নীরবে। কখনও প্রকাশে, নানান ওজুহাতে। এখন সেটাও হবে না।

আরও কিছুদূর এগুতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। বৃষ্টির ছাঁট এত পাতলা যে স্বর্ণলতার বোরকা ভেদ করে শরীর স্পর্শ করতে পারছিল না। তাই টেরও পাচ্ছিল না। প্রথমে খেয়াল করল মুনছুর সাখাওয়াতই। সাথে সাথে অঘোষিতভাবে নির্দ্বিধায় বেখেয়ালি মেয়েটাকে কাছে টেনে আনল। নিজের শরীর দিয়ে যতটা সম্ভব ঢেকে বলল,
” বাড়ি ফিরতে ফিরতে পুরো ভিজে যাব। একটু জোরে পা চালাও। সামনেই মুদির দোকানটা। ”

স্বর্ণলতা আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদটা এখনও দেখা যাচ্ছে না। বজ্রপাতও হচ্ছে না। বাতাসের বেগ আহামরি বেশি না, বৃষ্টি পড়ার মুগ্ধকর ছন্দও শোনা যাচ্ছে না। তারপরেও তার হাতদুটি ভিজে ওঠছে। এ কেমন বৃষ্টি! টর্চের আলোয় বৃষ্টি কনার নৃত্য দেখতে দেখতে মোহঘোরে চলে যাচ্ছিল তখনই বজ্রপাতের মতো আদেশটা পড়ল,
” হাতগুলো আমার পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাও। এখন জ্বর-সর্দিতে পড়ার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। ”

_______
প্রথমে দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছিল। মাথা, শরীর বেঁচে গেলেও পা দুটো রক্ষা পাচ্ছিল না। মাটিতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে এসে পা ও বোরকার নিচের অংশ ভিজিয়ে দিচ্ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে বলল,
” বেঞ্চটায় পা তুলে বসো। ”

বেঞ্চটা ছাউনির প্রায় কিনারে। দমকা হাওয়া উঠলে বৃষ্টি উড়ে এসে পুরো শরীরই ভিজিয়ে দিবে। যদিও এখন বাতাস নেই কিন্তু বৃষ্টি ঘন হয়ে আসছে। যেকোনো সময়ে ঝমঝমে নামতে পারে। বিপদে পড়ার আগেই উদ্ধারের ব্যবস্থা করা ভালো হবে। দোকানটা বন্ধ হলেও তালা ঝুলানো নেই। মুনছুর সাখাওয়াত দরজা খুলে ভেতরে আলো ফেলল। তেমন কোনো জিনিসপত্র নেই, প্রায় ফাঁকা। মেঝেতে ধূলোর পাতলা আস্তরণ পড়েছে। টর্চের আলো কোনায় কোনায় ফেলতে ছোট্ট, ক্ষয়ে আসা ঝাড়ুটার দেখা পেল। সেটার দিকে চেয়েই বউয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখল,
” ভেতরে এসে বসবে? ”
” খুব ছোট। বাতাস ঢুকবে না। অন্ধকারও তো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত দোকানের সামনের দিকের বড় বড় পাল্লা দুটো খুলে দিল। তারপরে স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এখনও দম আটকে আসবে? ”

সে বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল দোকানটায়। মনে হচ্ছে একপাশের পুরো দেয়ালটায় খুলে ফেলা হয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত জবাবের অপেক্ষা করল না। ধূলো পরিষ্কার করে বৃষ্টির পানিতে হাত ধুয়ে বলল,
” ভিতরে গিয়ে বসো। বৃষ্টি পুরোপুরি না থামলে রাস্তায় নামব না। ”

স্বর্ণলতা আস্তেধীরে দোকানে ওঠল। ভেতরের দিকে চেপে বসে ডাকল,
” আপনিও আসেন। ”
” না। ”
” কেন? ”
” আমার গায়ে বিশ্রী গন্ধ। তুমি সহ্য করতে পারবে না। ”
” একটু আগেই তো পারলাম। আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন না? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের এতক্ষণে চেতন ফিরল যেন! ক্ষণকাল নীরব থেকে দোকানের দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল। দারুন কৌতূহলে সুধাল,
” গন্ধ পাওনি? ”

স্বর্ণলতা মুখ এগিয়ে গভীর নিঃশ্বাস টেনে বলল,
” তখন পাইনি। এখনও পাচ্ছি না। গন্ধটা মনে হয় বাড়ির ভেতরে থাকলেই পাই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত মাথা নুয়িয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকল। খানিক দূরত্ব রেখে বসে বলল,
” এখন দেখ তো গন্ধ পাও নাকি। ”

স্বর্ণলতা শ্বাস টেনে বলল,
” না। ”
” আমাকে খুশি করতে মিথ্যা বলো না। আমি কিন্তু এখন তোমাকে জড়িয়ে ধরব। পরে বমি আসলেও ছাড়ব না। ”

স্বর্ণলতা জোর গলায় জানাল,
” আমি একটুও মিথ্যা বলছি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সত্যি জড়িয়ে ধরল। চোখ বুজে সেও গাঢ় নিঃশ্বাস টেনে বলল,
” তোমার শরীরের গন্ধটা কিন্তু আমি এখনও পাচ্ছি। স্বর্ণলতা, ঘুমের সময় এই গন্ধটা আমি খুব মিস করি। আমরা আবার একসাথে ঘুমাব কবে? তোমার এই সমস্যাটা যাচ্ছে না কেন? ”

স্বর্ণলতা পাঞ্জাবির গলার দিকের বোতাম দুটো খুলল। একটা হাত গলিয়ে লোমশ বুকে আদুরে স্পর্শ দিতে দিতে বলল,
” যাবে। আরেকটু ধৈর্য ধরুন। এই অদ্ভুত সমস্যাগুলো প্রেগন্যান্সির তিন, চার মাস পরে আস্তে আস্তে কেটে যায়। ডাক্তার বলল তো, শুনেননি? ”

মুনছুর সাখাওয়াত বউকে ছেড়ে দিল। বুকের কাছের হাতটা সরিয়ে বোতাম দুটো পুনরায় লাগাতে লাগাতে বলল,
” তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। ”
” কী কথা? ”
” ওটা পরে বলছি। আগে বলো, কাঁদছিলে কেন? ”
” কখন? ”
” সন্ধ্যাবেলা। দাদিজানকে গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে যে কথাগুলো বলেছ সেগুলো আবার বলো তো। ”

স্বর্ণলতার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ল,
” আপনি সব শুনেছেন? কিন্তু ওগুলো তো আমাদের গোপন আলাপ ছিল। ”
” তাই নাকি! ভেতরে গোপন আলাপ চলছে, বাইরে থেকে কানে এলেও শোনা যাবে না। এরকম কোনো নোটিশ পাইনি তো। ”

কণ্ঠে স্পষ্ট খোঁচা, বিদ্রুপের আঁচ। স্বর্ণলতা বুঝেও বুঝি ধ্যান দিতে পারল না। মনে মনে কল্পনা করতে লাগল কত জোরে কাঁদলে, কত জোরে কথা বললে বাইরে থেকেও শোনা যায়। ভাবতে ভাবতেই লজ্জার আবরণে মুড়ে যাচ্ছিল। সহসায় মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” আমার কোনো ব্যবহারে কষ্ট নিও না, এটা আমি অনুরোধ করে বলেছিলাম না? ”

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় প্রশ্নটা ঠিক বুঝল না যেন! অন্যমনস্কের মতো আওয়াজ দিল,
” হুম? ”
” অনুরোধ করেছিলাম নাকি বলো। ”
” করেছেন। ”
” তাহলে কষ্ট নিলে কেন? স্বর্ণলতা, আমি তো আমার দুর্বলতাটাও বুঝিয়ে বলেছিলাম! ”

এতক্ষণে অন্যমনস্কতা কেটে গিয়েছে। প্রসঙ্গ ধরে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যার ঘটনাটা আরও একবার বিষিয়ে দিল হৃদয়টা। স্বর্ণলতা চোখ বুজে গোপন ব্যথাটা সহ্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাই জবাব দিতে পারে না। আপনমনে বিড়বিড় করে, ‘ মনের উপরে কারও নিয়ন্ত্রণ চলে না। ‘

মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের দিকে চেয়ে থাকলেও ভারী অর্থবহ কথাটা শুনতে পেল না। খানিক তেজে উঠে প্রশ্নটা করল,
” আমি কি অমানুষের মতো আচরণ করেছি? ”
” না। ”
” তাহলে এত কান্নাকাটি কেন? ”
” আমি ভেবেছিলাম, আপনি ধৈর্যহারা হয়ে আমার শরীরে আঘাত করবেন। কিন্তু আপনি তো আমার হৃদয়ে আঘাত করেছেন। বউকে কেউ এভাবে ঘর থেকে বের করে দেয়? আমি সেধে গিয়ে ছিলাম ঐ ঘরে। আপনাকে কাছে টানতে চেয়েছিলাম। ”
” এই কথাটা তো বলোনি! ”
” যে দেখে বুঝে না তাকে বলেও বুঝানো যায় না। ”
” দেখলাম তো আমাকে দেখে কেমন নাক চেপে ধরে ছিলে! ”
” আপনার ধ্যানমন এখন শুধু আমার এই নাক আর গন্ধেই আটকে গেছে। এজন্যে আর কিছু দেখতে পান না। ”
” আমি ইচ্ছে করে আটকাইনি। তুমি জোর করে আটকে দিয়েছ। কানের কাছে ঐ একটা কথায় তো একশোবার বলেছ! ”

স্বর্ণলতা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। তারপরে হতাশার গলায় বলল,
” ওটা নিয়েই পড়ে থাকেন। এখন যে কী বলেছি সেটার দাম দেওয়া দরকার নেই। ”

সে একটু দূরে সরে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে আনল সামনে। বৃষ্টি কমেছে নাকি বেড়েছে বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু টিনের চালে দারুন সুরেলা ছন্দ তুলেছে। ভেজা মাটির গন্ধটা মন মাতিয়ে দিচ্ছে। মাটির গন্ধও যে এমন সুন্দর হয় স্বর্ণলতা আজ, এই মুহূর্তে জানল। নিবিষ্টমনে বৃষ্টি ঝরার শব্দ শুনছিল। সেই সাথে নিঃশ্বাসের সাথে সোঁদা গন্ধটা টেনে নিচ্ছিল। কখন যে চোখ বন্ধ করে নিল বুঝতেই পারল না। ঘুম ঘুম ভাবটা প্রায় এসেই পড়েছিল তখনই পেটে ঠান্ডা স্পর্শ পড়ল। সর্বাঙ্গ এমনভাবে শিউরে ওঠল যে, স্বর্ণলতার ঘুম ভাব কেটে গেল। চকিতে পাশে চাইতে হ্যাচকা টান খেল। বেসামালে মাথা গিয়ে বাড়ি খেল শক্ত, চওড়া লোমশ বুকে। মাথাটা তুলতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত অন্য হাতে চেপে ধরে থেকে আবদারের মতো বলল,
” আমার সাথে চলো। ”
” কোথায়? ”
” ঢাকা। ”
” আচ্ছা। ”
” কেন নিয়ে যাচ্ছি শুনতে চাইলে না? ”
” ভালো কোনো কারণই হবে। ”
” তারপরেও শোনা উচিত। ”
” দরকার নেই। ”
” দরকার আছে, স্বর্ণলতা। আমার জরুরি কথা এটাই। ”

এবার যেন একটু খটকা লাগল। স্বামীর বুকে মাথা ছুঁয়িয়ে রেখে চোখ তুলে তাকাল। টর্চের আলোয় মুখটা ভারি পবিত্র লাগছে। মুনছুর সাখাওয়াত এই চোখের দিকে চেয়ে থাকতে পারল না। অন্যদিকে চেয়ে বলল,
” মাত্র দেড় মাসেই আমি হাঁপিয়ে ওঠেছি। আমি আর একদিনও এসব সহ্য করতে পারব না। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে…”

স্বর্ণলতা ঝড়ের গতিতে মুখটা চেপে ধরল। একহাতে ধরে শান্তি পেল না। দুই হাতে আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” আল্লাহর কসম লাগে, কথাটা গিলে ফেলেন। এটা যেন ভুল করেও আমার কানে না আসে তাহলে আপনাকে সত্যি অমানুষ মনে হবে। ”

তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়াতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
” হোক। তবুও আমি সিদ্ধান্ত বদলাব না। ”
” হঠাৎ এত ক্ষ্যাপে গেলেন কেন? কী হয়েছে? দাদিজানের কাছে ঘুমাচ্ছি বলে রাগ করেছেন? ঘুমাব না। আপনার কাছেই থাকব। বমি-টমিও হবে না। আমি ঠিক সয়ে নিব। ”
” কতদিন সয়বে? এখনও কত সময় বাকি! সব থেকে বড় কথা আমি তোমাকে হারাতে পারব না। ”
” আমি হারাতে যাব কেন? আমি কি বাচ্চা? ”
” শুধু বাচ্চা হলেই হারায় না। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়েও হারায়। তুমি যেই নিলুর উদাহরণ দিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলে, সেই নিলু বেঁচে নেই। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে। ”

স্বর্ণলতার কথাটা বিশ্বাসই হলো না। পাগলের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
” আপনি মিথ্যা বলছেন। ”
” তুমি কি সেদিন সত্যি বলেছিলে? ভেবে বলো তো, নিলুর সাথে তোমার শেষ কবে দেখা হয়েছিল। ”

স্বর্ণলতা ভাবতে ভাবতেই বরফের মতো জমে গেল। বিয়ের পরে নিলুর সাথে একবারই দেখা হয়েছিল। পোয়াতি অবস্থায়। তাহলে সেদিন বাচ্চা নিয়ে সুখে আছে কথাটা বলল কীভাবে? এত বড় মিথ্যাটা অজান্তেই গলা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি।

মুনছুর সাখাওয়াত কাঁধে হাত রাখল। সাথে সাথে স্বর্ণলতা হাত সরিয়ে দিল। কী যেন একটা বলতে চেয়েও পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে নিজেই স্বামীর কাছে এলো। মুখটা দুই হাতে আগলে ধরে বলল,
” আমার কিছু হবে না। বিশ্বাস করুন। এই বাচ্চা আল্লাহর তরফ থেকে উপহার। এভাবে ফিরিয়ে দিবেন না। আল্লাহ নারাজ হলে আমরা একসাথে থেকেও সুখী হব না। কার মৃত্যু কীভাবে লেখা আছে কেউ জানে না। জানলেও ঠেকাতে পারবে না। মানুষের ঐ শক্তি আল্লাহ দেয়নি। আমি কী বলছি, আপনি কি বুঝতে পারছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের হাতদুটি ধরে মোহাবিষ্টের মতো মাথাটা উপর-নীচ নাড়ল। স্বর্ণলতা আরও শক্তভাবে গালদুটো চেপে ধরে অধৈর্য গলায় বলল,
” তাহলে সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছেন না কেন? ”
” বদলেছি। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। এবার শান্ত হও। কান্না থামাও।

ডাক্তার আল হাদির শেষের কথাটা এমনভাবে বুকে বিঁধে ছিল যে, মুনছুর সাখাওয়াত কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। তারপরে স্বর্ণলতার অস্বাভাবিক রকমের অসুস্থতা, মানসিক পরিবর্তন দেখে ভয় পাচ্ছিল। বার বার মনে হচ্ছিল, সত্যি ভুল হয়েছে। জলদি এই ভুল শোধরানো দরকার। বাচ্চা নষ্ট করার পরিকল্পনাটা তখনও আসেনি। হঠাৎ কী মনে করে নিলুর খোঁজ নেয়। তারপরেই সিদ্ধান্তটা নিতে এক সেকেন্ডও দেরি করেনি।

স্বর্ণলতা শান্ত হলেও চোখের পানি থামছিল না। আজকে অনেক কেঁদে ফেলেছে। মাথাটা কেমন ভার ভার ঠেকছে। ব্যথাটা আবার ফিরে আসবে না তো? অসহ্য যন্ত্রণাটা আবার কতদিন থাকবে একমাত্র আল্লাহই জানে।

মুনছুর সাখাওয়াত মুখের নিকাবটা খুলে দিল। চোখের পানিতে গলা অবধি ভিজে গিয়েছে। সে হাত দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বলল,
” এত কষ্ট পাবে জানলে কথাটা বলতাম না। ”
” আমার আদর নিতে ইচ্ছে করছে। ”

হাতটা এক মুহূর্তের জন্য হাতটা থেমে গেল। বিস্ময় ভাবটা ফুটেও ফুটল না। ঠোঁট মেলে হেসে ফেলল। তারপরে কপালে চুমু খেল। স্বর্ণলতা সাথে সাথে জানাল,
” এটুকুতে হবে না। ”
” আচ্ছা, বাসায় গিয়ে আদর দিয়ে মন ভরে দিব। ”
” আমার এখনই চাই। ”

এবার বিস্ময়ভাবটা পরিষ্কারভাবে ধরা দিল। এক পলকে নিজেদের অবস্থানটা দেখে নিয়ে বলল,
” কোথায় আছি ভুলে গেছ? ”

টর্চের আলোতে দোকান ও আশপাশটা দেখিয়ে বলল,
” একটু অপেক্ষা করো। বৃষ্টি থামলেই আমরা বাড়ি ফিরব। ”
” পারব না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত অসহায়ভাবে বলল,
” আমাকে উসকাচ্ছ কেন? ভালো আছি ভালো লাগছে না? ”
” না। এখন, এই মুহূর্তে আদর না করলে আগামী এক বছরেও কাছ ঘেষতে দিব না। ”
” আরে এত ক্ষ্যাপলে কেন? আমার রূপটা তোমার মধ্যে দেখলে আমার খুব ভয় হয়। ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত সেই মুখ ফিরিয়ে এনে ঠোঁটে গভীর চুম্বন বসিয়ে বলল,
” আচ্ছা, দিও না। তবুও এখানে এরচেয়ে বেশি কিছু করতে পারব না। ”

_______
স্বর্ণলতা কলেজে এলো প্রায় একমাস পরে। পরীক্ষা শুরু হবে। সেই দরকারে আসা। কাজ শেষে সে মানবিক বিভাগের দিকে এগুল। বেহালা স্কুলে থাকতে ব্যবসায়ের ছাত্রী ছিল। ইন্টারে এসে মানবিকে চলে গিয়েছে। তাই দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। আবার কবে আসবে জানে না, তাই দেখা করতে ইচ্ছে হলো। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সংবাদটাও শুনেছে নাকি জানে না। দেখা করে সরাসরি বলবে এই অভিপ্রায়ে ছুটছিল। সিঁড়িপথে দেখা হয়ে গেল আল হাদির সাথে। চোখে চোখ পড়লেও দাঁড়াল না এক মুহূর্ত। পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। স্বর্ণলতাই পেছন ডাকল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপরে কিছু বলবে তখনই কোথাও থেকে মুনছুর সাখাওয়াতের আগমন ঘটল। দুজনের দিকে এক ঝলক চেয়ে বলল,
” বাসায় চলো। ”

স্বর্ণলতা স্বামীর কাছে গেল। কানের কাছে ফিসফিসে বলল,
” চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখেন, উনাকে কেমন কথা শোনায়! ”

মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের হাত ধরল। টেনে জায়গাটা থেকে সরতে সরতে বলল,
” অন্য সময় বলো। ”
” এখন কী সমস্যা? আস্তে হাঁটুন না। হোঁচট খাব তো। ”

হাঁটার গতি কমল। কিন্তু হাত ছাড়ল না। এক সেকেন্ডের জন্যও থামলও না কোথাও। বউকে নিয়ে সোজা জীপে বসল। ইঞ্জিন চালু করতে করতে শুনল,
” আপনাকে কেমন যেন লাগছে! আমার দিকে ফিরেন তো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ফিরল না। সুধীর গলায় বলল,
” চুপচাপ বসে থাকো। ”

______
জীপটা থামল বাড়ির গেইট থেকে বেশ দূরে। স্বর্ণলতা কিছু বলবে তার পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” আমি শুনেছি, মেয়েরা পেটে বাচ্চা এলেই মা হয়ে যায়। এরমানে তুমিও মা হয়ে গেছ। এই বাচ্চার যাতে ক্ষতি না হয় এজন্যে তুমি এখন সব করতে পারবে। পারবে না, স্বর্ণলতা? ”

সে পেটে হাত রেখে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিল,
” পারব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে কপালে চুমু খেল। তারপরে চোখে চোখ রেখে বলল,
” তাহলে দেখিয়ে দাও। ”
” কাকে? কী দেখাব? ”

প্রশ্ন দুটো করেই স্বর্ণলতা স্বামীর চোখে তাকাল। সাথে সাথে বুক কেঁপে ওঠল। অস্থির হয়ে আরও একটি প্রশ্ন করল,
” আপনার চোখে কী হয়েছে? আল্লাহ! এমন লাল তো রেগে গেলেও হয় না। পোকা ঢুকেছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দেয় না। পকেট থেকে একটা আংটি বের করল। স্বর্ণলতার হাতের আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলল,
” এটা আজ থেকে তোমার। ”

স্বর্ণলতা আংটির দিকে চেয়ে বলল,
” এটা তো দাদিজানের আংটিটা! আপনি পেলেন কীভাবে? উনার সাথে কথা হয়েছিল, সময় হলে আমি নিজে চেয়ে নিব। ”
” সময় হয়ে গেছিল। কিন্তু তুমি চাইতে দেরি করে ফেলেছ। ”
” মানে? কী বলেন? কিছু বুঝি না কেন? আমাদের মধ্যে আপনি এলেন কীভাবে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। নীরবে চেয়ে রইল শুধু। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ যে কথাটা আমি বলতে পারছি না, সেই কথাটা তোমার নিজের থেকেই বুঝে নিতে হবে। আজ তোমাকে ছাড় দিতে পারব না। এটুকু স্বার্থপর না হলে আমি নিজেকে সামলাতে পারব না। ‘

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০৪)

প্রায় পনেরো বছর পরে মুনছুর সাখাওয়াত মসজিদে প্রবেশ করেছে, স্বেচ্ছায় নামাজ পড়েছে। সংবাদটা খাইরুন নিসাকে এতটায় খুশি করেছিল যে, স্বর্ণলতাকে তৎক্ষনাৎ পুরস্কৃত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। ঐ মুহূর্তে হাতের কাছে দামি কিছু ছিল না। কিনিয়ে আনার ধৈর্যও হচ্ছিল না। তাই নিজ হাতের স্বর্ণের আংটিটা খুলে নাতবউয়ের হাতে পরিয়ে দেন। সাথে এটাও জানান, এই আংটি ওজনে অল্প। পুরোনোও। কিতু দাদিজানের কাছে অমূল্য। কারণ, এই আংটি তার বিবাহের উপহার। বিয়ের রাতে নতুন বউয়ের মুখ দেখে স্বয়ং দাদাজান ভালোবেসে পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই যে পরলেন এরপরে আর খোলা হয়নি। সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়ে গেছে, পুরোনো হয়েছে, রঙটা মলিন হয়ে এসেছে কিন্তু তার কাছে ভালোবাসার সৌন্দর্য একআনাও কমেনি। দাদিজান এই আংটি কাউকে ছুঁয়েও দেখতে দিতেন না। সেই অমূল্য, সযতনের বিরল ভালোবাসার ছোট্ট খনিটায় নিজ হাতে খুলে নাতবউকে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ এটা তোমার। আমি খুশি হয়ে দিলাম। ইচ্ছে হলে যত্নে রেখ ‘ স্বর্ণলতা এই আনন্দ নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছিল না। রাতে স্বামীর সামনে প্রকাশ করে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে জানতে পারে মুনছুর সাখাওয়াতের মায়ের মৃত্যুর সাথে সে জড়িত। আত্মহত্যার জন্য দারুনভাবে উস্কেছে। এমনকি নিজ হাতে বিষ কিনেও দিয়েছে। ঘটনাটা স্বর্ণলতাকে এত কষ্ট দিয়েছিল যে, সকাল বেলায় দাদিজানকে আংটি ফিরিয়ে দেয়। সাথে দৃঢ়ভাবে এটাও বলে, যেদিন তার নাতি পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর পথে আসবে সেদিনই এই আংটি গ্রহণ করবে। এর পূর্বে দাদিজান জোর করলেও সে নিবে না। সময় হলে নিজেই চেয়ে নিবে।

স্বর্ণলতা হাতের আংটির দিকে তাকায়, পরক্ষণে স্বামীর মুখের দিকে। হাজার চেষ্টায়ও বুঝে উঠতে পারে না। অস্থিরতায় বুকটা ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে আছে। আরও একবার আংটির দিকে চেয়ে সুধাল,
” দাদিজান নিজের হাতে আপনাকে দিয়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দেয় না। চুপচাপ শীতল দৃষ্টিতে স্ত্রীর চোখজোড়ায় চেয়ে থাকে। মেয়েটার মধ্যকার সমস্ত শান্তি, স্থিরতা সামান্য আংটিটা এক লহমায় শুষে নিল যেন! স্বর্ণলতা চরম অধৈর্য হয়ে বলল,
” আপনি তো কিছুই বলছেন না! আমি দাদিজানের কাছ থেকেই শুনে আসি। ”

তাড়াহুড়ায় গাড়ি থেকে নেমে পড়তে চাইল, পারল না। পা জোড়া মাটি স্পর্শ করার আগেই মুনছুর সাখাওয়াত হাত চেপে ধরল। স্বর্ণলতা চকিতে ঘাড় ফেরাল। খানিক বিরক্ত নিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মুনছুর সাখাওয়াত সেই চোখে চোখ মিলিয়ে রেখে হাতটা টেনে নিল মুখের কাছে। উল্টো পিঠে আলতো চুমু খেল। নিকাবে ঢাকা মুখটায় আরও একবার এলো-মেলো চুমুতে ভরিয়ে দিল। তারপরে বউকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” শান্ত হও। নাহলে কোথাও যেতে দিব না। ”

স্বর্ণলতা চোখ বুজল। গভীর নিঃশ্বাস টানতে টের পেল, তার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে ছুটছে। এত অস্থিরতা কেন? একটা আংটিই তো! সেটাও দাদিজানের। তার যা ইচ্ছে হয় তাই করতে পারে। এখানে স্বর্ণলতার কর্তৃত্ব ফলানোটা কি ঠিক হচ্ছে? বুড়ো মানুষ, দীর্ঘ অসুস্থতায় শরীর ও মন উভয় ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আংটির বিষয়টা ভুলে যাওয়ার শঙ্কায় পেয়েছিল বোধহয়। তাই দায় এড়াতে নাতির কাছে দিয়েছে। তার ভাবনার মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” বাচ্চার ভালোর জন্য মা সব করতে পারে। তুমিও পারবে বলেছ। স্বর্ণলতা, কথাটা ভুলে যেও না কিন্তু। ”

স্বর্ণলতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। সোজা হয়ে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বার বার বাচ্চা টেনে আনছেন কেন? আপনাকেও ঠিক লাগছে না। কী হয়েছে, বলুন না। ”

গাড়িতে বসে থেকেই আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে এনে পুনরায় বলল,
” দিনেরবেলা এই রাস্তার মধ্যে হঠাৎ এত চুমু খাচ্ছেন কেন? বার বার জড়িয়েও ধরছেন। আমরা তো বাড়ির সামনেই। ভেতরে গিয়েও তো আদর করা যেত। ”
” যাও। তোমার এখন যাওয়া উচিত। ”
” আপনি যাবেন না? ”
” যাব। তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি। ”

স্বর্ণলতা কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় কাটিয়ে দিল। মানুষটাকে সে আজ একেবারেই বুঝতে পারল না! খুব অন্যরকম লাগছে। পা দুটো মাটিতে পড়ামাত্র ভেতর থেকে তাগাদা এলো। হাতের আংটিটা নাড়াচাড়া করতে করতে বাড়ির দিকে হেঁটে চলছিল। কিছুদূর এগুতে দেখল, গেইটটা খোলা। আশপাশে দারোয়ান নেই। বিস্তীর্ণ উঠোনের এক ঝলক স্বর্ণলতা দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছিল। বরাবরের মতো ফাঁকা, নির্জন। জনপ্রাণীর ছায়া নেই, আওয়াজ নেই। দুপুর পেরুচ্ছে। এই সময়ে বাড়ির মানুষগুলো রান্নাঘর ও খাবার ঘরে ব্যস্ত থাকে। স্বর্ণলতা জানে, তারপরেও তার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠল। মনে হলো, কী যেন একটা ঘটেছে। সে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু অনুভব করছে। ঠিক এই সময়ে দমকা হাওয়ার সাথে একটা তীব্র গন্ধ উড়ে এলো। স্বর্ণলতার নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল নিমিষেই। সে থমকে গেল আচমকা, চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নিল। সাথে সাথে সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। প্রশ্ন অসংখ্য কিন্তু উত্তর একটাই! স্বর্ণলতা সামনে এগুতে পারল না। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল বাড়ির গেইটের কাছে।

মুনছুর সাখাওয়াত তখনও গাড়ির মধ্যে বসে ছিল। স্ত্রীকে নজরে রাখছিল। এবার গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হলো। দৌড়ে এসে স্বর্ণলতাকে তুলে দাঁড় করাল প্রথমে। তারপরে আদেশের মতো উচ্চারণ করল,
” চলো। ”

স্বর্ণলতা সেই আদেশ পালনে বিলম্ব করল। মাথা তুলে টলমল চোখে কান্না প্রায় কণ্ঠে সুধাল,
” এটা কি আগরবাতির গন্ধ? ”
” হ্যাঁ। ”

স্বর্ণলতার হাত দুটো স্বামীর বুকের কাছে নিথরভাবে গুটানো ছিল। আচমকায় দেহের সবটুকু শক্তি গিয়ে জমা হলো হাতদুটিতে। আক্রমণ করে বসল মুনছুর সাখাওয়াতের বুকে। পাঞ্জাবিসহ বুকটা খামচে ধরে অনুনয়ের গলায় বলল,
” শুধু একবার বলুন, আমি যা ভাবছি তা ভুল। ”
” সত্যি। ”

বুক থেকে হাতদুটি ধূলোর মতো ঝরে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” স্বর্ণলতা, ঠিকভাবে হাঁটো। আমাকে জানাজার ব্যবস্থাও করতে হবে। তোমাকে আনতে গিয়ে পুরো কাজটায় থেমে আছে। ”

ধীর কদমের হাঁটাটুকুও থেমে গেল। স্বর্ণলতা দুই চোখে অশ্রুর বর্ষণ তৈরি করে জানাল,
” আমার ভয় করছে। বুঝ হওয়ার পরে আমি আপন মানুষ হারাইনি। আমার কেমন আচরণ করতে হবে, আমি জানি না! ”
” স্বাভাবিক থাকবে। কান্নাকাটি করার দরকার নেই। যে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেও যে পৃথিবীতে আসবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত নিজ হাতে চোখের পানি মুছে দিচ্ছিল। স্বর্ণলতা সেই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
” পারব না। আমার কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দাদিজানের রুহের সাথে আমার হৃদয়টাও ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। ”
” নেয়নি। ওটা তোমার মনের ভুল। স্বর্ণলতা, আমাকে দেখ। আমি কি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলেছি? আমি পারলে তুমি পারবে না কেন? ”
” স্বার্থপররা কাঁদতে জানে না। আমি আপনার মতো স্বার্থপর না। তাই কাঁদব। যতক্ষণ না কষ্টটা দূর হচ্ছে ততক্ষণ কাঁদব। ”

বৃষ্টির ধারার মতো চোখদুটি থেকে আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। উঠোন পর্যন্ত মুনছুর সাখাওয়াতের সাহায্যে এলেও বাকি পথটা সে একায় পার হলো। পাগলের মতো দৌড়ে, স্বামীকে পেছনে ফেলে।

_____
জানাজার কাজ সম্পন্ন হয় রাতের বেলা। সকলে বাড়ি ফিরলেও মুনছুর সাখাওয়াত ফিরল না। তাকে বাড়ির উঠোনে পা রাখতে দেখা গেল ভোরবেলা। সূর্য তখনও তার সোনালী প্রভা ধরাতে ছড়িয়ে দেয়নি। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে, কোথায় কোথায় উত্তপ্ততার ঝড় উঠানো যায়। এই সময়ে ভূতের মতো আগমন ঘটল ইকবালের। সমুখে দাঁড়িয়ে পথ আগলে ভীষণ উৎকন্ঠার সাথে সুধাল,
” কোথায় ছিলেন? সারা গ্রাম চষেছি, কোথাও পাইনি তো! গ্রামের বাইরে গেছিলেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূ কুঁচকে ফেলল বিরক্তে। পরক্ষণে ক্রোধাগ্নি জ্বলে উঠল চোখজোড়ায়। বুকের কাছে থাবা দিয়ে হুংকার ছাড়ল,
” আমি কোথায় যাই, না যাই সেই কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে? আমাকে প্রশ্ন করিস! এই দুঃসাহস দেখানোর সময়ে তোর বুক কাঁপেনি? দিব গলা থেকে মাথাটা আলাদা করে? বল, দিব? ”

ইকবাল ভয় পায় না। কিন্তু অকৃত্রিম বিনয়ে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। অতঃপর হালকা স্বরে জানাল,
” আপা সারারাত কেঁদেছে আর আপনাকে খুঁজেছে। দুইবার তো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিল! আমরা কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের মেজাজ পড়ল। হাতের থাবাটা ঢিল করে জিজ্ঞেস করল,
” এখনও কাঁদছে? ”
” হ্যাঁ। দাঁতে খিল লেগে গেছিল কয়েকবার। আন্টি সেই খিল ছুটাতে ছুটাতে আঙুল কেটে ফেলেছে। রক্ত পড়া থামছে না। আমি কি একবার ডাক্তার ডেকে আনব? আপাকেও দেখানো দরকার। উনার অবস্থা খুবই খারাপ। চোখ মেলে রাখতে পারছে না। হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। সরিষা তেলে কতক্ষণ চলবে? মনে হয় স্যালাইন দেওয়া লাগবে। ”
” দরকার নেই। ”

সে নিষেধাজ্ঞা জারি করে চলে যাচ্ছিল। সহসা ফিরে এলো। ইকবালের গলাটা দুইহাতে প্রবল বেগে চেপে ধরে চাপা শাসল,
” ফের যদি আমার বউকে নিয়ে তোর মধ্যে বিন্দু পরিমাণের দুশ্চিন্তা দেখি তাহলে এভাবে মেরে ফেলব। ”

______
সদর দরজার পাশে দাদিজানের রুমটা। কান্নার মিহি সুর ঐদিক থেকে ভেসে আসছে। মুনছুর সাখাওয়াত ভারি রুষ্ট হলো। মেয়েটা এখনও ঐ রুমে কী করে? দাদিজানের প্রাণহীন মুখটা দেখিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল। কড়া স্বরে জানিয়েছিল, এই রুমে যেন ভুল করেও পা না রাখে। সেই আদেশ খণ্ডন হয়েছে কি রাতের বেলাতেই?

রুমের দরজার কাছে স্বর্ণলতার বাবাকে দেখা গেল। বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ঢাকার নামি ও দামী হাসপাতালে দীর্ঘ আধুনিক চিকিৎসার ফলে কিছু উন্নতি ঘটেছে। দাঁড়াতে পারেন। একটু একটু হাঁটতেও পারেন। মুনছুর সাখাওয়াতের উপস্থিতি তিনিই প্রথমে খেয়াল করলেন। দরজার কাছ থেকে সরে যেতে যেতে প্রফুল্লচিত্তে জানালেন,
” মহাজন আইছে। স্বর্ণার মা? বর্ণ রে নিয়া ঘর থেইকা বাইর হও। ”

প্রথমে বের হলো সুবর্ণ। দুলাভাইয়ের সাথে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল,
” আপারে লাগতেছে পেত্নির মতো আর আপনারে লাগতেছে ভূতের মতো। কে যেন বলছিল, ভূত-পেত্নি মানুষের মধ্যে থাকে। আমি বিশ্বাস করি নাই। এখন মনে হইতেছে, সত্যিই বলছিল। ”

কথা শেষ হতে মাথায় চাপড় পড়ল। সুবর্ণ বিরক্ত নিয়ে ঘাড় ফেরাতে শবনম বেগম চোখ পাকালেন। সাথে সাথে কিশোর চোখ জোড়া নত হয়ে গেল। মা, ছেলের পিছু পিছু কলি ও ময়নাও বেরিয়ে গেল। রুম পুরোপুরি খালি হওয়ার পরে মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে প্রবেশ করল। দরজা আটকানোর প্রয়োজন নেই, ভেতরে কেউ ঢুকবে তো দূর উঁকি মারারও সাহস নেই কারও। সে জানে, তবুও দরজায় খিল টানল। তারপরে স্বর্ণলতার শিয়রের কাছে বসল। মেয়েটা উপুড় হয়ে কাঁদছে। পরনের শাড়ির অবস্থা করুণ! কোনোমতে শরীরে জড়িয়ে আছে মাত্র। এলোমেলো চুলের বিনিটা বড্ড ঢিলে। রাবার নেই। জোরপূর্বক একে-অপরের সাথে আটকে রেখেছে এমনভাব। বউয়ের এই অসংযত সাজ, অবস্থান কোনোটায় সহজে মানতে পারছিল না। চরম বিরক্তে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ দাদি মরল আমার অথচ কেঁদেকেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দাঁতে খিল লাগাচ্ছে আরেকজন। এই দুনিয়ায় রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় কোনো সম্পর্ক হয় নাকি? ‘ সে আলগোছে মাথায় হাত রাখল। কপট রাগ নিয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, সোজা হও। এভাবে কতবার শুয়েছ যে, দাদিজান মৃত্যুকালেও আমাকে বলে গেছে, তোমার শোয়ার ব্যাপারে যেন খেয়াল রাখি? ”

স্বামীর স্পর্শ, কণ্ঠস্বর পেয়ে স্বর্ণলতা ঝড়ের বেগে উঠে বসল। মুখটায় ক্ষণকাল নীরব চেয়ে থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরল। তারপরে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। চোখের পানিতে পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ভিজে উঠতে মুনছুর সাখাওয়াতের বিরক্ত ভাবটা কেটে গেল। কণ্ঠ থেকে রাগ সরিয়ে মাথা নামিয়ে স্ত্রীর কানের কাছে ফিসফিসে বলল,
” হয়তো হয়। নাহলে রাত ফুরিয়ে যায় কিন্তু তোমার চোখের পানি ফুরায় না কেন? ”

প্রশ্নটা মনের গোপনে কিন্তু উত্তরটা সামনাসামনি প্রকাশ পেল। যার আগামাথা কিছুই ধরতে পারল না। স্বর্ণলতা কান্নায় বিগলিত কণ্ঠে ক্ষীণ সুরে সুধাল,
” কী হয়? ”
” রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় সম্পর্ক। যেটা তোমার আর দাদিজানের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে বউকে বুক থেকে সরাল। মুখটায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে হতাশ হলো। ইকবাল একটা শব্দও মিথ্যা বলেনি। মেয়েটার শুধু হাত-পা না সারা শরীরটায় বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। গলাও বসে গিয়েছে। মাত্রই বলা শব্দ দুটো শুনিয়েছে খুব ভেজা ও ফাঁপা। ঠোঁটদুটো নীলচে হয়ে ফুলে গিয়েছে। থরথরে কাঁপছে। সে চট করে দুইহাতে সম্পূর্ণ দেহটায় আগলে নিয়ে বলল,
” আমার ঘরে চলো। ”
” না। ”
” কেন? ”
” এখানে থাকব কয়েক দিন। ”
” না। এই ঘরে তালা দিব। ”

স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত নীরব থেকে আচমকা বলল,
” আমি তালা দিতে দিব না। ”
” আমাকে বাঁধা দিবে? ”
” হ্যাঁ। এই ঘরের মালিক তো আমি, তাই না? আপনি নিজেই কাল বলেছেন, দাদিজান উনার সবকিছু আমাকে দিয়ে গেছে। ”
” তাই বলে নিজের ঘর ছেড়ে দিতে হবে? ”
” ছাড়ছি না। বলেছি এখানে কয়েকদিন থাকব। অনুমতি দিন না, আমার ভালো লাগবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটুক্ষণের জন্য চুপ থাকল। আপনমনে ভেবে সহসা বলল,
” ঠিক আছে। তাহলে এখন কান্নাকাটি বন্ধ করো। সারারাতই তো কেঁদেছ মন ভরেনি? ”

স্বর্ণলতার হঠাৎই মনে পড়ল যেন! চটজলদি জিজ্ঞেস করল,
” আপনি রাতে কোথায় ছিলেন? ”
” গুদামে। ”
” কেন? ”
” কাজ ছিল। ”
” দাদিজান যে সবসময় বলত আপনি উনাকে ভালোবাসেন না। ঐটা তাহলে সত্যি? ”
” হয়তো। ”
” আল্লাহ কি আপনার বুকে সত্যি হৃদয় দেয়নি? ”
” না। এজন্যে শোকদুঃখ, ব্যথা-যন্ত্রণা আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। ”
” আমি মরে গেলেও এমন পাষান থাকবেন? এক ফোঁটাও কান্না করবেন না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। চোয়ালদ্বয় দৃঢ় করে বলল,
” মৃতের ঘরে থাকলে মানুষের মনে এসবই ঘুরে। উঠো, এখনই আমাদের ঘরে যাব। ”
” যাব না। আপনার সমস্যা হলে আমাকে জোর করে নিয়ে যান। বাঁধা দিব না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের চোখে, মুখে বিস্ময়ের আলো জ্বলে ওঠল। এক মুহূর্ত নীরব থেকে বিস্মিত গলায় বলল,
” এরকম তো আগের স্বর্ণলতা বলত। হঠাৎ ঐ রূপে ফিরে গেলে কেন? ”

স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। শুধু মুখ ফিরিয়ে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হতাশ হলো। তারপরে দাদিজানের ব্যবহৃত একটা কাঁথা নিয়ে এলো। বউকে জোর করে শুয়িয়ে দিয়ে কাঁথাসহ পুরো দেহটা নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল,
” যেখানে খুশি থাকো। তবুও এই শোক থেকে বেরিয়ে এসো। নাহলে আমি গুদামেই রাত কাটাব। ”

_______
খাইরুন নিসার মৃত্যুর দুইদিন পরে বেহালার আগমন ঘটল। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়িতেই ছিল। উঠোনের কাঁঠাল গাছটার নিচে ব্যবসায় সম্পর্কিত আলোচনায় বসে ছিল। বেহালা নজরে আসতে আলোচনা ছেড়ে উঠে এলো। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
” কী চাই? ”
” স্বর্ণলতার সাথে দেখা করতে এলাম। দাদিজানের খবরটা পেয়ে খুব খারাপ লেগেছে। ওর মুখে অনেক প্রশংসা শুনেছি। খুব ভালোবাসত। ”
” খবরটা কে দিল? ”
” সুবর্ণ। ”
” বাহ! আসতে না আসতে গোপনে দেখা করাও শেষ? ”

মুহূর্তে বেহালার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। এবার সে একা আসেনি। সাথে করে টিয়ামনিকে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটাকে চোখের ইশারায় দূরে পাঠাল প্রথমে। তারপরে জবাবটা দিল,
” গোপনে দেখা করিনি। ওর সাথে বাজারে দেখা হয়েছে। বাজারে কত মানুষ থাকে জানেন নিশ্চয়? ”
” ঐ মানুষের মাঝে তোর ভাই ছিল না, সুবর্ণের পরিবারেরও কেউ ছিল না। ঐ হিসাবে গোপন দেখায় হয়। ”

বেহালা দারুন রেগে গেল। উত্তেজিত হয়ে কী একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। যতটা সম্ভব রাগটাকে সংযত করে প্রত্যুত্তর করল,
” আমি আপনাকে শুরু থেকে মন থেকে সম্মান করে এসেছি। ভবিষ্যতেও করতে চাই। তাই অনুরোধ করব এই ধরনের নোংরা ইঙ্গিতে কথা বলবেন না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল,
” আমি নোংরা ইঙ্গিত কথা বলেছি? ”
” জি। শুধু আমাকে না, সুবর্ণকেও বলেছেন। ও ধরতে পারেনি বলে যে আমিও ধরতে পারব না। এটা ভুল। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমাদের বয়সের পার্থক্য কতটা। একটা বাচ্চা ছেলের মধ্যে আপনি জোরপূর্বক খারাপ প্রভাব ফেলছেন। এটা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। সম্পর্কে ও আপনার শালা হয়। আপনার বউয়ের একমাত্র আদরের ভাই। তাই ও কে নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে হাজারবার ভাববেন। ”
” তুই বলতে চাচ্ছিস তোরা প্রেমে পড়িসনি আমি জোর করে প্রেমে ফেলছি? ”
” জি। ঐটুকু বাচ্চা প্রেমের বুঝে কী? আমিই বা ওর প্রেমে পড়তে যাব কেন? আমাকে কি পাগল মনে হয়? ”
” বেশ, কথাটা মনে রাখব। ”
” এখন কি আমি ভেতরে যেতে পারি? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখে জবাব দিল না। ইশারায় অনুমতি দিয়ে আলোচনায় ফিরে যাচ্ছিল। সহসায় পেছন ফিরে বলল,
” তোর বান্ধুবীকে পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিস তো। বই-খাতা থেকে যেভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে আবারও নির্ঘাত ফেইল করবে। ”

_______
স্বর্ণলতার চালচলন সহজ হয়েছে। নাওয়া-খাওয়াতেও মনোযোগী হচ্ছে। স্বামীর দেখাশোনা করছে। পড়ালেখায় মন ফিরছে। পরীক্ষাও দিচ্ছে। সবই পূর্বের মতো চললেও দাদিজানের রুম থেকে বের হতে চাচ্ছে না কিছুতেই। মুনছুর সাখাওয়াত হাজার বুঝিয়েও মানাতে পারছে না। জোর করতে ধরলেই বলবে,
” ঐ ঘরে গেলেই মনে হবে দাদিজান নেই। আমার খুব কান্না পাবে। আপনি চান আমি দিন-রাত কান্না করে অসুস্থ হয়ে পড়ি? পরে পরীক্ষায় ফেইল করলেই তো বকবেন। ”

এই কথার বিপরীতে কী বলা যায়? মনে আঘাত লেগে গেলেও সমস্যা। অন্তঃসত্ত্বার তিনমাস পেরিয়ে গিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করেছে স্বর্ণলতার পেট সামান্য ফুলেছে। বাচ্চার কি শরীর হতে শুরু করেছে? সে মাঝেমধ্যে পেটের দিকেই একস্থির চেয়ে থাকে। কিছুই দেখা যায় না, ধবধমে কোমল পেটটাও না। তারপরেও এখানে চেয়ে থাকতে ভালো লাগে। এখনও দেখছিল। সহসায় হাত দিয়ে শাড়িটা সরাল। উন্মুক্ত পেটটা দৃষ্টিসীমা আসতেই দৃষ্টি কেঁপে ওঠল। চট করে দৃষ্টি সরে এলো স্বর্ণলতার মুখে। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত মুখটা আরও কাছে এগিয়ে নিল। তারপরে হালকা স্বরে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”

একবার, দুইবার, তিনবার। কোনো বারেই স্বর্ণলতা সাড়া দিল না। সামান্য নড়লও না। মুনছুর সাখাওয়াত এবার ভারি অধৈর্য হয়ে ওঠল। স্বর্ণলতার একগালে হাত রেখে একাধারে ডেকে চলল,
” বউ, এই বউ? সোনাবউ? শোনো না! ”

এতক্ষণে স্বর্ণলতা সামান্য নড়ল। কিন্তু সাড়া দিল না। মুনছুর সাখাওয়াত চট করে চোখে পরপর চুমু খেয়ে বলল,
” তাকাও। আমাকে দেখ। ”

সে চোখের পাতা সামান্যও মেলল না। উল্টো বিরক্তে মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ফিরে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে নিজের দিকে ফিরিয়ে আবারও ডাকতে লাগল। স্বর্ণলতার বিরক্ত এবার কণ্ঠে ধরা পড়ল,
” উফ! এত বিরক্ত করছেন কেন? ”

স্বর্ণলতার একটা হাত নিজের গলায় ছুঁয়িয়ে কাতর স্বরে জানাল,
” আমার খুব ইচ্ছে করছে। ”
” ইচ্ছে করলে করুন। ”
” তুমি তো চোখই মেলছ না! এভাবে ঘুমের মধ্যে করতে পারব না। তোমার সাড়া না পেলে মনে হয় জোর করছি। তখন নিজেকে খুব ছোট লাগবে। ”

এতগুলো কথা স্বর্ণলতার কানে ঢুকলই না বোধ হয়। সে আবারও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত আরও একবার ডাকতে গিয়ে থেমে গেল। ঘুমানোর চেষ্টা করেও বিফল হচ্ছিল বার বার। তারপরে বিছানা থেকে উঠে বসল কতক্ষণ। তাতেও শান্তি না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল।

_______
সকালবেলা। মুনছুর সাখাওয়াতের মাথায় তেল ম্যাসাজ করতে করতে স্বর্ণলতা বলল,
” আপনারও মাথাব্যথা হয়? ”
” আমার হওয়া মানা নাকি? ”
” না। কিন্তু কখনও শুনিনি তো। ”
” তোমাকে বিয়ে করার পর থেকেই হচ্ছে। কখনও বলিনি তাই শুনোনি। ”
” বলেননি কেন? ”
” বলে কী হতো? এমন দরদ দেখাতে? উল্টো খুশিতে নাচতে। ”

স্বর্ণলতার হাত থেমে গেল। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বিস্ফারিত কণ্ঠে সুধাল,
” আমি নাচতাম? ”
” অবশ্যই নাচতে। তখন তো আমাকে তোমার সহ্যই হতো না। ”
” তাই বলে কারও অসুখে নাচব? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। স্ত্রীর থেমে থাকা হাতদুটো নাড়িয়ে দিল। স্বর্ণলতা ইশারা বুঝতে পেরে আবারও চুলের মাঝে আঙুল চালাতে লাগল। সেভাবেই জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ মাথাব্যথা হলো কেন? ”
” ঘুম হয়নি। ”
” নিশ্চয় ব্যবসার চিন্তা করেছেন? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

প্রশ্নটা করলেও উত্তরের অপেক্ষা করল না। মাথা থেকে হাত সরিয়ে দ্রুত বলল,
” আপনি শুয়ে বিশ্রাম করুন। আমি একগ্লাস দুধ নিয়ে আসি। গরম দুধ খেলে মাথাব্যথা সেরে যায়। তারপরে একটা লম্বা ঘুম দিবেন। দেখবেন, শরীর-মন সব সুস্থ। ”

সে তেলের পেয়ালাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দরজার কাছে পৌঁছাতেই শুনল,
” দরজাটা আটকাও। ”

স্বর্ণলতা থমকে গিয়ে পেছন ফিরল। সাথে সাথে পুনরায় শুনল,
” ভেতর থেকে আটকাও। ”
” কেন? ”
” আগে আটকাও তারপরে বলছি। ”

কথা মতো কাজ শেষ করে স্বর্ণলতা বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত কিনার ধরে বসেছিল। সেভাবেই বলল,
” ঢাকায় থাকতে যে ঘুমের একটা বদঅভ্যেস করেছিলে, মনে আছে? ”
” হ্যাঁ। এখানে এসে ঠিক হয়ে গেছে তো। ”
” হয়েছিল। এই ঘরে শোয়ার পরে সেটা আবারও ফিরে এসেছে। ”
” তাই নাকি! নামাজ কাযা করেছি নাকি? ”

স্বর্ণলতা মনে করার চেষ্টা করছিল। সেই সময় মুনছুর সাখাওয়াত বউকে টেনে এনে বসাল উরুতে। তারপরে বলল,
” না। আদর কাযা করেছ। ”

স্বর্ণলতা কথার অর্থটা ঠিক ধরতে পারল না। চুপ করে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তখনই শুনল,
” ঢাকার বাসায় আমাকে একবার পাগলের মতো আদর করছিলে, মনে আছে? ”

সে জবাব দেয় না। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। মুনছুর সাখাওয়াত আবারও বলল,
” আমি কিন্তু খুব উপভোগ করছিলাম। কিন্তু পুরোপুরি হলো না। তার আগেই তোমাকে থামাতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজ তো সেই বাধ্যবাধকতা নেই। স্বর্ণলতা, আরেকবার পাগল হবে? আমি কিন্তু বাবা হব এই সুখবরের আনন্দটা তোমার সাথে এখনও ভাগ করতে পারিনি! প্রথমে গন্ধ আটকাল, তারপরে মৃত্যু শোকে। ”
” এখন? কীভাবে? ঐটার কারণ তো অন্য কিছু ছিল। আপনি নিজেই বলেছিলেন। ”
” ওটা লাগবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করছি, তুমি শুধু আমাকে দেখ। ”

স্বর্ণলতা এত লজ্জা পেল! চোখ বন্ধ করে ফেলল। সেই মুহূর্তে অনুভব করল তার পিঠে, কোমরে পাখির পালকের মতো হালকা, নরম স্পর্শটা বিচরণ করতে শুরু করেছে। শিউরে উঠে অজান্তেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াত দাঁতের মধ্যে আঙুল দিয়ে টোকা মারল। স্বর্ণলতা ঠোঁট ছেড়ে দিতেই বলল,
” বলেছি না, আমার জিনিসে তুমি কামড় দিবে না? ”

তারপরে বউকে কোলে তুলে নিল। রুমের দরজা খুলতে খুলতে বলল,
” এখানে না, আমাদের ঘরে চলো। নাহলে দাদিজান সব দেখে নিবে! ”

______
সন্ধ্যাবেলা। মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরেছে মাত্র। গোসলে যাবে তখনই খেয়াল করল স্বর্ণলতা কোমরে ধরে হাঁটাহাঁটি করছে। সে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারল না। আরও কতক্ষণ খেয়াল করে প্রশ্ন টা করল,
” কোমর ব্যথা করছে নাকি? ”
” হ্যাঁ। ”
” করবেই তো! নিশ্চয় খালি বাসা পেয়ে খুব কাজটাজ করা হচ্ছে? বলার মতো তো কেউ নেই। ”
” কিছু করছি না। ”
” তাহলে? ”
” জানি না। হঠাৎ করে ব্যথাটা হচ্ছে। মাথাব্যথার মতো এটাও অনেকদিন থাকবে নাকি? ”

মুনছুর সাখাওয়াত গোসলের যাওয়ার প্রস্তুতি ফেলে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কবে থেকে হচ্ছে? ”
” পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর থেকে। ”
” পিরিয়ড! স্বর্ণলতা, এই সময়ে পিরিয়ড হয় না। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০৫)

” পিরিয়ড! স্বর্ণলতা, এই সময়ে পিরিয়ড হয় না। ”
” আমার তো হচ্ছে। ”

কণ্ঠটা নিরুদ্বেগ, অকপট। স্বর্ণলতা বিছানায় বসল আস্তেধীরে, খুব সতর্কের সাথে। তারপরেও চোখ, মুখ খিঁচে এলো তীব্র ব্যথায়। শ্বাস রুদ্ধ করে ব্যথাটা সয়ে নিচ্ছিল তখনই বিস্ময়াপন্ন কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” হচ্ছে মানে কী? তোমার কি এখনও প্রতি মাসেই হচ্ছে? ”
” হ্যাঁ। ”

উত্তরের সাথে শ্বাসটাও মুক্তি পেল বুঝি। বড় বড় শ্বাস টেনে নেওয়ার সময়ে কিছু মনে পড়েছে। এমন তাড়াহুড়ায় আবারও বলল,
” শুধু এক মাস হয়নি। প্রেগন্যান্সির খবর পাওয়ার পরের মাসটা। তারপর থেকে আবারও হচ্ছে। কিন্তু অনিয়মিত। নির্দিষ্ট তারিখ নেই। যখন-তখন হয়। আবার দুইদিনও থাকছে না। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এবারই তিনদিন চলছে। ”
” তিনদিন! ”

কণ্ঠস্বর থেকে বোম বেরুল যেন! শব্দটা এত জোরে শোনাল যে, স্বর্ণলতা চমকে ওঠল। সচকিতে স্বামীর দিকে তাকালেও মুখটা দেখা হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত গোসল ছাড়ায় ধোয়া পাঞ্জাবি পরে নিল। তারপরে একটা বোরকা এনে স্ত্রীকে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
” হাসপাতালে যেতে হবে। ”
” এখন? অনেক দূর! ফিরতে ফিরতে মাঝরাত হয়ে যাবে। ”
” হোক। ”
” সকালে যাই? খুব ব্যথা হচ্ছে। রাস্তার যা অবস্থা! সামান্য ঝাঁকি খেলেও জান বেরিয়ে যাবে। ”
” ঝাঁকি খাবে না। আস্তে চালাব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত নিজ হাতে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ তৈরি করল। জীপের কাছে নিয়ে গেল কোলে করে। কোমরে সামান্য ব্যথাও দিতে চাচ্ছিল না। তাই সময় নিয়ে যতটা সম্ভব সাবধানে বসিয়ে দিল। অতঃপর নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন সচল হয়ে উঠল চোখের পলকে। জীপটা বাড়ির প্রাঙ্গন পার হতে স্বর্ণলতা বলল,
” এত অস্থির হচ্ছেন কেন? এই সময়ে একটু-আধটু কোমর ব্যথা হয়। ”
” কার থেকে শুনেছ? ”

প্রশ্নের উত্তর এলো না। মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক স্ত্রীর দিকে তাকাল। বেজায় অন্যমনস্ক। খুব ভাবছে কি না! সে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বলল,
” মনে পড়ছে না তো? পড়বেও না। কারণ, এই সময়ে কোমর ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক না। ”

স্বর্ণলতা চমকে পাশে ফিরল। তারপরে চেয়েই রইল। একবারের জন্যও পলক ঝাপটাচ্ছে না, দৃষ্টি নড়ছে না। মুখ থেকে একটি শব্দও বের হচ্ছে না। স্তম্ভিত হয়ে পরের কথাটা শুনল।
” পিরিয়ডও হয় না। তুমি যেটাকে পিরিয়ডের রক্ত ভাবছ, ওটা পিরিয়ডের রক্ত না। এজন্যই হঠাৎ ভাঙছে, হঠাৎ বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। কোমর ব্যথাটা…”

মুনছুর সাখাওয়াত কথার ফাঁকে স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিল। সাথে সাথে থেমে গেল। বাক্যটা সম্পূর্ণ করার সাহসই পেল না। যে বিপদের ভয়টা নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছিল সেই বিপদটা স্বর্ণলতা আঁচ করে ফেলেছে। অথচ সে চাচ্ছিল না মেয়েটা এই নিয়ে একফোঁটাও দুশ্চিন্তা করুক। তাই যথেষ্ঠ সাবধানতা অবলম্বন করছিল। বাড়ি থেকে বের হতেই সেই সাবধানতা সরে গেল। কথায় কথায় অজান্তেই ভয়ের বাতাসটা নিজ হাতেই ঠেলে দিল যেন!

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর গালে হাত রাখল। পরম স্নেহে স্পর্শটুকু গভীর করে আশ্বাসের সুরে বলল,
” ভয় নেই। আমি আছি তো। সব ঠিক করে দিব। ”

স্বর্ণলতা চোখ বুজে ফেলল। কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তে ফুঁপিয়ে ওঠল। স্বামীর হাতটা আরও শক্তভাবে গালের সাথে চেপে ধরে বলল,
” বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি জানতাম না এই সময়ে পিরিয়ড হয় না। ”
” দাদিজান বলেনি? ”
” না। ”
” ডাক্তার? ”
” উনিও তো বলেনি! ”

মুনছুর সাখাওয়াত ঝটিতে হাত সরিয়ে নিল। গাড়ির গতি বাড়িয়ে ক্ষোভিত কণ্ঠে বলল,
” তাহলে মাসে দুইবার যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকছ। তখন ঠিক কোন গুরুত্বপূর্ণ লেকচারটা দেয় যে, এই সামান্য তথ্যটা জানানোরও সুযোগ পায়নি? ”

স্বর্ণলতা কিছু বলার সুযোগ পেল না। পূর্বেই ক্রোধে জ্বলে উঠা কণ্ঠটা পুনরায় বেজে ওঠল,
” আমার বাচ্চার যদি কিছু হয়েছে। ওর ডাক্তারি আমি…”

কথাটা শেষ হলো না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। এত অল্পতে কি রাগ পড়ে? দেহের শিরা-উপশিরায় রক্তের সাথে জ্বলন্ত আগুন ছুটছে যে! এই আগুন কীভাবে নেভাবে? স্বর্ণলতার সামনে তো দুটো অসভ্য শব্দও উচ্চারণ করতে পারছে না। মেয়েটা কেন যে এত ভালো আর নরম মনের হলো!

_______
হাসপাতালে পৌঁছায়নি তখনও। আরও মিনিট কয়েক লাগবে। শহরের চকচকে পাকা ও চওড়া রাস্তাটা ধরে জীপটা ছুটছিল মধ্যম গতিতে। সহসায় ব্রেক পড়ল। স্বর্ণলতা চোখ বুজে ছিল। দুশ্চিন্তায় ভর্তি মাথাটা স্বামীর কাঁধে ফেলে রেখেছিল। এবার তুলল। আশপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
” চলে এসেছি? ”

কণ্ঠটায় মৃদু সন্দেহ, উৎকণ্ঠা। মুনছুর সাখাওয়াত পাশ ফিরল না। সামনে চেয়ে আছে একধ্যানে। কী যেন এক গভীর চিন্তায় মন ও মস্তিষ্ক আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে। প্রশ্নটা বোধ হয় শুনলই না। স্বর্ণলতা নিজ উদ্যোগে পথঘাট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর সন্ধান চালিয়ে পুনরায় বলল,
” হাসপাতাল দেখা যায় না তো! কোথায় এসেছেন? পথ ভুলে গেছেন? ”
” না। ”
” তাহলে? এখানে থামলেন কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত গভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপরে দৃষ্টি জোড়া নিবদ্ধ করল বউয়ের মুখটায়। কয়েক মুহূর্ত নীরবে নিবিড়ভাবে চেয়ে থেকে আচমকা বলল,
” আমার হঠাৎই মনে পড়ল, এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কেউ না! ”

স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য হলো প্রথমে। পর মুহূর্তে দেহের ভিতরটা এত কেঁপে ওঠল! মায়া ও দরদে চোখের কোল টইটম্বুর হয়ে ওঠল। ঝাপসা হতে লাগল দৃষ্টি জোড়া। কখনও কখনও সত্য এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে কেন? মানা যায় না। আবার ফেলাও যায় না। সে দু’হাতে স্বামীর মুখটা চেপে ধরল। অতঃপর গভীর স্নেহে সুধাল,
” দাদিজানের কথা মনে পড়ছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। শুধু স্থির দৃষ্টি জোড়া নামিয়ে ফেলল। স্বর্ণলতা এগিয়ে গিয়ে কপালে চুমু খেল। তারপরে মাথাটা টেনে আনল বুকের কাছে। বাবরি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত আবেশে চোখ বুজে নিল। তারপরে বলল,
” তোমাকে বিয়ে করায় দাদিজান খুব রাগ করেছিল। কষ্টও পেয়েছিল। মন থেকে মানতেই পারছিল না। ”
” জানি। ”
” ঠিক তোমার মতো। তুমিও তো বিয়েটা মানছিলে না! আমার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে কম চেষ্টা তো করোনি! ”
” অবুঝ ছিলাম তো। স্বামী, সংসারের গুরুত্ব জানতাম না। ”
” এখন জানো। কে বুঝাল? দাদিজান। স্বর্ণলতা, ঐ সময়ে যদি দাদিজান না থাকত তাহলে কী হতো? তুমি হয়তো পালানোর পথ খুঁজে পেয়ে পালিয়ে যেতে। আমাকে কখনই ভালোবাসতে না। তখন আমি কী করতাম? একা একা জীবনটাকে কতদূরই বা বয়ে বেড়াতে পারতাম? একদিন ঠিক ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজতাম। সেদিন আমার জন্য কাঁদার মতোও কেউ থাকত না। কেউ না। তুমিও না! ”

স্বর্ণলতা মাথাটা আরও শক্তভাবে চেয়ে ধরল। বাবরি চুলে গভীর চুম্বন করে বলল,
” বুড়ো মানুষটা মারা যাওয়ার পরে বুঝলেন, আপনাকে কতটা ভালোবাসত! ”
” বুঝ হওয়ার পরেই বুঝেছি। ”
” তাহলে সবসময় দুর্ব্যবহার করেছেন কেন? কত কষ্ট পেত জানেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দেয় না। ভিন্ন কিছু বলেও না। নীরবে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে। স্বর্ণলতাই নীরবতা ভেঙে বলল,
” নাকি আপনিও খুব ভালোবাসতেন। স্বীকার করতে চাইতেন না তাই দুর্ব্যবহার করতেন। যেমনটা আপনার আম্মুর সাথেও করেছেন। ভালোবাসা প্রকাশে আপনার এত অনিহা কেন? ”

নরম বুক থেকে মাথাটা ঝটিতে সরে এলো। ভ্রূজোড়া কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে ফেলল সাথে সাথে। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই না বলে দুর্ব্যবহার করি? ”
” হ্যাঁ। ”
” তোমাকে ভালোবাসি না? ”
” বাসেন তো। ”
” এরমানে দুর্ব্যবহারও করি। ”

স্বর্ণলতা সবেগে দ্রুত দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
” না। একটুও দুর্ব্যবহার করেন না। ”
” তাহলে ভালোবাসি না। ”
” ভালোবাসেন তো। ”
” তাহলে দুর্ব্যবহার করছি না কেন? ”
” ওটা তো আপনি জানেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জীপ চালু করল আবারও। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে ছুটতে ছুটতে বলল,
” মনে হয় দাদিজান আর আম্মুর মতো অত বেশি ভালোবাসি না। ”
” হয় তো। ”
” এখন বলো এই অল্প ভালোবাসা চলবে নাকি আরও বেশি চাই? ”

স্বর্ণলতা এক সেকেন্ডও সময় নিল না। চট করে জানিয়ে দিল,
” আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে স্ত্রীর দিকে তাকাল। সেও হাসছে। চোখদুটিতে ভয় বা উৎকণ্ঠা কোনোটারই আঁচ নেই। এটাই তো চাচ্ছিল। দারুনভাবে সফল হয়েছে।

______
গাইনোকোলজির চেম্বারটা দ্বিতীয় তলায়। মুনছুর সাখাওয়াত বউকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠল প্রচণ্ড বিরক্তে। এত গুরুত্বপূর্ণ চেম্বারটা দোতলায় হবে কেন? আশ্চর্য! মেয়ে-বউদের কত ধরনের ব্যথা হয়। এত ব্যথা নিয়ে সিঁড়ি বাইতে ইচ্ছে করে? লিফটও নেই। মুনছুর সাখাওয়াতের মনে হলো, আগে যদি জানত বউ কোমর ব্যথা নিয়ে এই হাসপাতালে আসবে তাহলে সে একাই লিফটের ব্যবস্থা করে দিত।

সিঁড়িপথটা শেষ হতে মুনছুর সাখাওয়াত সুদৃঢ় কণ্ঠে বলল,
” চেম্বারে ঢোকার পরে যাই ঘটুক না কেন বের হওয়ার সাথে সাথে ভুলে যাবে। স্বর্ণলতা, আমি আবারও বলছি যাই ঘটুক না কেন। ”

স্বর্ণলতা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী ঘটবে আপনি জানেন? ”
” না। ”
” তাহলে এমন আদেশ দিচ্ছেন কেন? ”
” তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই। এই দুঃখটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছি না। খুব আদর লাগবে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টায় আদরে ডুবে থাকতে হবে। এক মিনিটের জন্যও থামা যাবে না। বুঝেছ? ”

স্বর্ণলতা জবাবে কিছু বলতে পারল না। হতভম্বের মতো চেয়ে থাকল। মানুষটা কি এবার সত্যি পাগল হয়ে গেল? নাহলে বউকে ডাক্তার দেখাতে এসে আদরে ডুবে যেতে চাইবে কেন? এই বিষয়টা মাথায় আসছে কীভাবে?

মুনছুর সাখাওয়াত একটুক্ষণ ভাবার অভিনয় করে পুনরায় বলল,
” আমি ঠিক করেছি, দুইদিন কাজে যাব না। বাড়ি থাকব। আর এই দুইদিন তুমি আমাকে খুব আদর করবে, খেয়াল রাখবে, যত্ন করবে। ঠিক যেমনটা আমি তোমাকে করেছিলাম? তেমন। তোমার অবশ্য আমাকে জোর করা দরকার নেই। আমি নিজে থেকেই সময়টা দিলাম। একটুও ফাঁকি দিব না। দেখ, চৌকাঠ পেরিয়ে উঠোন পর্যন্ত যাব না। সারাদিন আমার ঘরেই থাকব। আমাদের বিছানায়। কাঁথার নিচে তোমার সাথে একেবারে ল্যাপ্টে থাকব। ”
” শুধু শুয়েই থাকবেন? খাওয়া, গোসল সব বাদ? রোজা রাখবেন নাকি? রোজা রাখলেও তো সেহরি, ইফতার করতে হয়। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভারি হতাশ হলো। রোজা আর আদর কি একসাথে চলে? কাঁথার নিচের ঘটনাটা কি বুঝল না? আরও পরিষ্কার করে বলবে? এখন অবশ্য বললেও দোষ হবে না। মেয়েটা তো আঠারো পেরিয়ে গিয়েছে। কয়েকমাস পরে সন্তানের জননী হবে। এখন নিজেদের মধ্যে সবধরনের কথায় সরাসরি বলা যায়। এত ইশারা-ইঙ্গিতের প্রয়োজন নেই। তার সরাসরি কথাটা বলা হলো না। স্বর্ণলতা ভারি অধৈর্য গলায় বলল,
” আপনার বাড়ি, আপনার ব্যবসা। যা ইচ্ছে হয় করুন। আমার তো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি যে একটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর কি দিবেন? না দিলে বলে দিন। আমি ভুলে যাই। ”
” উত্তর তো দিলামই। ”
” কখন? শুনলাম না তো। আবার বলুন। ”
” আমার দুইদিন শুরু হবে তুমি চেম্বার থেকে বেরোনোর পরপরই। তাই ভেতরের কোনো ঘটনা মনে রেখে দিলে আমাকে ঠিকমতো আদর করতে পারবে না। এই ফাঁকি আমি সহ্য করব না। তাই চেম্বারের ভেতরের কাহিনি ভেতরেরই শেষ করবে। মনে থাকবে? ”
” এভাবে বলছেন কেন? আমার ভয় করছে। দাদিজানের বেলায়ও আপনি…”

মুনছুর সাখাওয়াত ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতেই বলল,
” কোনো ভয় নেই। তোমার পাশে আমি আছি। আমার পাশে তুমি আছ। এতে সন্তুষ্ট নও? আরও চাই? ”

স্বর্ণলতা মাথাটা দু’পাশে মৃদু নাড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে নিল। কপালে চুমু খাওয়ার জন্য এগিয়েও ফিরে এলো। খানিক অভিমানের সুরেই বলল,
” আদর করে কী লাভ? তোমার তো মন ভুলে না! যা ইচ্ছে হয় তাই করো। ”

স্বর্ণলতা এই এতদিন পরে বুঝল, দাদিজানের মৃত্যু সংবাদ দেওয়া বাদ দিয়ে মাঝ রাস্তায় জীপে বসিয়ে পাগলের মতো আদর করেছিল কেন। সে সত্যই আদরের মান রাখতে পারেনি। দাদিজানের প্রাণহীন মুখটা দেখার সাথে সাথে স্বামীর প্রতিটি সতর্কবার্তাও ভুলে গিয়েছিল।

_______
স্বামী-স্ত্রী যে বিপদের আঁচ পেয়েছিল সেটাই ঘটল। স্বর্ণলতার গর্ভপাত হয়েছে। তথ্যটা শোনার পরে মুনছুর সাখাওয়াত ভারি অস্থির হয়ে পড়েছিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে সে যৌনসংগমে খুব সক্রিয় ছিল। প্রায় প্রতিদিনই বউয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। গর্ভপাতের মূল কারণ এটা না তো! এই অস্থিরতা মিনিট দুইয়ের মধ্যে কেটে গেল। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তখন স্বর্ণলতায় ভীষণ আড়ষ্টের সাথে বলল,
” সপ্তাহ দুই হলো আমরা একসাথে থাকছি। এই কারণে কি…”
” না। সহবাসের সাথে গর্ভপাতের কোনো সম্পর্ক নেই। এই সময়ে এটা আরও ভালো। মায়ের মানসিক অবস্থা দৃঢ় হয়। ”
” তাহলে কি মানসিক ধাক্কা? দাদিজান মারা যাওয়াই আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ”
” না। গর্ভপাতের সাথে মানসিক পরিস্থিতিরও সম্পর্ক নেই। ”

এই পর্যায়ে মুনছুর সাখাওয়াত ভারি রুষ্ট হয়ে ওঠল। চরম বিরক্তের সাথে খেঁকিয়ে ওঠল,
” তাহলে হলো কেন? আসল সমস্যাটা কোথায়? ঠিক করে বল নাহলে কিন্তু…”

কথার লাগাম টানল স্বর্ণলতা। হাতের মধ্যে খুব জোরে চাপ দিয়ে বলল,
” আপনি খুব ঘামছেন! বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি কথা শেষ করে আসছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চেয়ার ছেড়ে একচুলও নড়ল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আরও আঁট হয়ে বসে থাকল। স্বর্ণলতার এত হাসি পেল! ঠোঁট চেপে সেই হাসি আটকাল। তারপরে কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
” যদি সত্যি চান চেম্বার থেকে বেরিয়ে সব ভুলে যাই তাহলে এখনই বাইরে যান। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে বেরিয়ে গেল।

_______
স্বর্ণলতা জীপে উঠে বলল,
” দুটো সংবাদ দিই? তারপরে সব ভুলে যাব। ”
” বলো। ”
” পেটে বাচ্চা নিয়ে এতদূরে পরীক্ষা দিতে যাওয়া ঠিক হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই চার ঘণ্টার মতো জার্নি করতে হয়েছে। ডাক্তার বলল, গর্ভাবস্থায় বেশি বেশি ভ্রমণ করলে গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে। ”
” এই কথা এত দিনে বলছে কেন? আগে কী করেছিল? মৌনব্রত রেখেছিল? সুই দিয়ে না খোঁচালে মুখ খুলবে না? ”
” একটাতেই এত রেগে গেছেন? পরেরটা শুনলে তো.. থাক বলব না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে ফিরে বসল। রাগে চোখ, মুখের অবস্থা ভয়াবহ। এই রাগের পেছনে যে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা কি মুখে বলতে হয়? স্বর্ণলতার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল। সাথে সাথে চোখের ভেতরটা খচখচ করতে লাগল। যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে। সে চট করে মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিল।

মুনছুর সাখাওয়াত হাত দিয়ে মুখটা ফিরিয়ে আনল নিজের দিকে। তারপরে কঠোর হয়ে বলল,
” দ্বিতীয় সংবাদটা বলো। এখনই। নাহলে ডাক্তারকে কী করে ফেলব আমি নিজেও জানি না। স্বর্ণলতা, প্রচণ্ড রাগে আমার মাথাব্যথা করছে। আমি কিন্তু এটা তোমার জন্য সহ্য করছি। ”
” তাহলে বলুন, আমার মতো আপনিও সব ভুলে যাবেন। ”
” ভুলে যাব। ”
” কথা দিচ্ছেন কিন্তু। ”
” দিলাম। এবার তো বলো। ”

স্বর্ণলতার কান্নাটা চোখের মধ্যেই শুকিয়ে গেল। স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে জানাল,
” আপনার ঐ আদরের দুইদিন পেছাতে হবে। ডাক্তার বলেছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে ওসব করা যাবে না। ”
” আচ্ছা, পিছিয়ে দিলাম। ”
” সত্যি? একটুও রাগ করেননি? ”
” রাগ করব কেন? এটাতে আমার বউয়ের ভালো থাকা জড়িয়ে আছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এবার গাড়ির ইঞ্জিন সক্রিয় করল। জীপটা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তাটা ধরল। কিছুদূর এগিয়ে বউয়ের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
” এই কথাটা ডাক্তার নিজে থেকে বলল নাকি তুমি খুঁচিয়ে বের করলে? ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। উল্টো তাগাদার সুরে বলল,
” আমি ভুলে যাচ্ছি। আপনিও ভুলে যান। ”

মুনছুর সাখাওয়াত যা বুঝার বুঝে গিয়েছে। তাই কথা বাড়াল না।

______
জীপটা উঠোনে এসে থামল ঠিক বারোটায়। স্বর্ণলতা রুমে ঢুকে বলল,
” আপনি গোসলটা সেরে ফেলেন। আমি খাবার বাড়ছি। ”

সে একপাও এগুতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপরে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি চাও আমি অভুক্ত থাকি? ”
” না। ”
” তাহলে শুয়ে পড়ো। আমি যতক্ষণ না ডাকব ততক্ষণ উঠবে না। ”
” ক্লান্ত লাগছে। যদি ঘুমিয়ে পড়ি? ”
” ঔষধ আছে না? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে তো ডাকতেই হবে। আচ্ছা, গোসল পরে করি। আগে খাবার নিয়ে আসি। ”

স্বর্ণলতা মানা করল। সে শুনলই না। দ্রুত কদমে রান্নাঘরে ছুটে গেল।

______
বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ঘুমে বিঘ্ন ঘটাল মুনছুর সাখাওয়াত। বউকে ডেকে তুলে অসহায় গলায় বলল,
” আমি তো ভুলতে পারছি না, বউ। ডাক্তার খুব বিরক্ত করছে। একটা থাপ্পড় দিয়ে আসি? শুধু একটায় দিব। ”

স্বর্ণলতা কপাল দলা করে কতক্ষণ চেয়ে রইল। তারপরে চোখ বুজে সহসায় বলল,
” আচ্ছা। ”
” সত্যি যাব? ”
” যান। ”

মুনছুর সাখাওয়াত তবুও বিশ্বাস করতে পারল না যেন! বুক থেকে বউয়ের মাথাটা তুলে ধরে বলল,
” স্বর্ণলতা, চোখ মেল। ঘুমের ঘোরে অনুমতি দিবে তারপরে সকালে মনখারাপ করবে এটা তো হবে না। ”

স্বর্ণলতা চোখ মেলল। বড় বড় করে চেয়ে বলল,
” আমি জেগে থেকে বলেছি। আপনি যান। কিন্তু গায়ে হাত তুলবেন না। মেয়ে মানুষ তো! হাত তোলা বাদে যা করতে পারেন তাই করেন। ”
” চাকরি খেয়ে দিব? ”
” এটা ভালো হবে। ”
” সার্টিফিকেটগুলো পুড়িয়ে দিব? তাহলে আর কোথাও বসতে পারবে না। ”
” এটা তো আরও ভালো হবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদি উঠে বসল। বউয়ের শরীর ভালো করে ছুঁয়ে বলল,
” জ্বর তো আসেনি। তাহলে যা বলছি তাই মেনে নিচ্ছ কেন? ঔষধের প্রভাব নাকি? ”
” না। ”
” তাহলে এত ক্ষ্যাপলে কেন? ”

স্বর্ণলতা একটু থেমে বলল,
” প্রীতুলবুর বাচ্চাটা পেটে মারা গেছে। ”
” এই প্রীতুলটা আবার কে? ”
” হাদিভাইয়ের বউ। আপনিই তো বিয়ে দিলেন। মনে নেই? ”
” কী জানি! আমি তো আর নাম শুনতে যাইনি। ”

দায়সারা উত্তর, বুঝায় যাচ্ছে এই মেয়ের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। তারপরেও স্বর্ণলতা বলতে লাগল,
” ঐ ডাক্তারের কাছেই তো চিকিৎসাধীন ছিল। অথচ এটুকু বুঝিয়ে বলল না, ডেলিভারির তারিখের আগেও পানি ভাঙতে পারে। ব্যথা ছাড়ায়। প্রীতুলবুও নিজে বিষয়টা ধরতে পারেনি। এদিকে পানি শুকিয়ে বাচ্চাটা পেটেই মরে গেল। আমার তো মাত্র চার মাসের মতো হয়েছিল। প্রীতুলবুর প্রায় আটমাস চলছিল। পেটের মধ্যে বাচ্চার নড়চড়াও টের পেত। তাহলে বুঝুন উনার কতটা কষ্ট হয়েছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এসব বুঝাবুঝিতে গেল না। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” ওর জামাই তো নিজেই ডাক্তার। ”
” অন্য বিভাগের। ”
” তাই বলে কি এই সামান্য জ্ঞানও থাকবে না? ”
” কী জানি! হয়তো আপনার মতো ভেবেছিল, ডাক্তার বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই নিজে থেকে বলেনি। ”
” আমি আবার কী বলিনি? ”
” ঐ যে, প্রেগ্ন্যাসির সময়ে পিরিয়ড হয় না। এটা তো আপনিও আমাকে বলতে পারতেন। ”

মুহূর্তে মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখের রঙ বদলে গেল। চরম বিরক্ত হয়ে বলল,
” দুনিয়ায় যা কিছুই ঘটুক না কেন, ঘুরেফিরে দোষটা আমার কাঁধেই দিতে হবে? ”
” না। ”
” মাত্রই তো দিলে। ”
” আমি শুধু সত্যি বলি আপনি দোষটা টের পেয়ে যান। তারপরে স্বীকার করতে পারেন না আবার অস্বীকারও করতে পারেন না। তাই অযথায় রেগে যান। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে স্বর্ণলতা ডাকল,
” কোথায় যান? ”
” ডাক্তারের সর্বনাশ করতে। ”
” এখন? কয়টা বাজে দেখেছেন? উনি কি এখনও হাসপাতালে আপনার জন্যে বসে আছে? ”
” তাহলে বাসায় যাব। ”

_______
এক রাতের বেলা। স্বর্ণলতা স্বামীর সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বলল,
” কিতাবগড়ের স্কুলটা কি অনেক দূরে? ”
” কিছুটা। কেন? ”
” ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বউকে নিয়ে স্কুলের পথে হাঁটা ধরল। স্বর্ণলতা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
” ঐ জায়গাটা কি এখনও খালি পড়ে আছে? ”
” হুম। ”
” আমাকে দিবেন? ”
” ওটা তো তোমার নামেই আছে। প্রথম যেদিন দেখলে সেদিনই তোমাকে দিয়ে দিলাম না? ”
” ওটা তো এমনিই বলেছিলেন। ”
” এমনি বলতে যাব কেন? জায়গা নিয়ে কেউ মজা করে? স্বর্ণলতা, অবাক করলে কিন্তু। ”
” সত্যি দিয়ে দিলেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাঁটা থামিয়ে দিল। বউয়ের সমুখে দাঁড়াতেই রাগ রাগ ভাবটা চলে গেল। জোসনার আলোয় মুখটা ভারি স্নিগ্ধ, পবিত্র লাগছে। সে রূপের মোহে পড়ে কী যে বলতে চাইল সেটাও ভুলে গেল। স্বর্ণলতায় ঘোর কাটাল। বলল,
” ওখানে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র খুলি? গ্রামের মেয়ে-বউদের কষ্ট করে শহরে যেতে হবে না। ছোটখাটো বিষয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সেবা নিতে পারবে। ”
” খুলো। কিন্তু একটা শর্ত আছে। ”
” কী? ”
” তোমার ওখানে কোনো কাজ থাকবে না। মন চাইলে মাঝেমধ্যে যেতে পার। কিন্তু আমার সাথে। আমি যতক্ষণ সময় দিতে পারব ততক্ষণই ঘুরতে পারবে। ”
” এটা কোনো শর্ত হলো? তার চেয়ে ভালো শুনাত যদি বলতেন, খুলতে দিব না। ”
” আচ্ছা, দিব না। ”

স্বর্ণলতা অস্থির হয়ে সুধাল,
” সত্যি দিবেন না? ”
” শর্ত মানলে দিব। ”
” ওরকম হয় নাকি? আমি দায়িত্ব নিয়ে খুলব আর আমিই থাকব না? ”
” তোমাকে দায়িত্ব নিতে দিচ্ছে কে? তুমি শুধু বলবে, কী কী করা লাগবে। আমি সেই রকম ব্যবস্থা করে দিব। বাকিটা ওখানে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকেরাই দেখবে। ”

স্বর্ণলতা জবাবে কিছু বলল না। কয়েক কদম সামনে এগিয়ে বলল,
” বাড়ি চলুন। ”
” স্কুলে যাবে না? ”
” ইচ্ছে করছে না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্ত থামল। বউকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেই আসল ঘটনা ধরে ফেলল। সাথে সাথে কাঁধ জড়িয়ে ধরল। কাছে টেনে একটা হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলল,
” আমি খুব স্বার্থপর? ”
” হুম। একটুও বদলাননি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলে। স্কুলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
” আমি তোমার সাথে সর্বক্ষণ থাকতে চাই। কাজের জন্য ওটা তো সম্ভব হয় না। তখন আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিই এই ভেবে যে, আমি সশরীরে তোমার সাথে না থাকলেও চিন্তাভাবনায় আছি। তুমি অন্য কোনো কাজে যোগ দিলে এই সান্ত্বনাটা থাকবে না। তখন তোমার চিন্তাভাবনায় আমার জায়গায় অন্য কিছু চলে আসবে। এটা মানতে আমার কষ্ট হবে। আমার কাজে মন বসবে না। ”
” তাই বলে কিছুই করব না? বাড়ির কাজেও হাত দিতে দেন না। এভাবে ঘরে শুয়েবসে একটা মানুষের দিন কাটে? আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আমার মনখারাপ হয়ে যায়। সময় কাটতেই চায় না। এত অসহ্য লাগে! ”
” সারাক্ষণ শুয়েবসে থাকবে কেন? হাঁটাহাঁটি করবে। কতবড় বাড়ি! তাতেও মন না ভরলে বারান্দায় যাবে। উঠোনে যাবে। আমি আবুলকে বলে দিব এখন থেকে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিবে। ”
” শুধু হাঁটলে হয় নাকি? কথা বলার জন্যও তো কাউকে চাই। আগে তো ইচ্ছে হলেই দাদিজানের কাছে চলে যেতান। এখন উনিও নেই। ”
” কথা বলার মানুষ লাগবে তো? আচ্ছা, ওটাও দিচ্ছি। ”

স্বর্ণলতা আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” মানুষ ভাড়া করবেন নাকি? ”
” ভাড়া মানুষ দিয়ে যদি কাজ হতো তাহলে কলি, ময়না দিয়েই হয়ে যেত। ওরাও যেহেতু তোমার মন ভরাতে পারছে না তাহলে ভাড়া হয় না এমন মানুষ লাগবে। ”
” কে সে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

_______
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা। ইকবাল ঢাকা থেকে গ্রামে এলো জরুরি তলবে। মহাজনের সাথে দেখা হলো গুদামঘরে। কোনো কথাবার্তা হলো না। জীপে বসিয়ে ছুটে চলল ডাক্তার আল হাদির বাসায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল,
” তোর বয়স কত? ”
” বিশ। ”
” একুশের কাছাকাছিই তো। সমস্যা হবে না। তোকে অবশ্য বয়স দিয়ে মাপা যায় না। বয়সের চেয়ে মাথাটা বেশি পাকা। ”

চলবে