মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-১০৬+১০৭

0
734

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০৬)

সদর দরজা খুলে দিল খোদ বেহালা। একটুও ঘাবড়াল না। সুন্দর করে হাসল। মিষ্টি স্বরে সম্বোধন করল,
” দুলাভাই যে! ভালো আছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখে জবাব দিল না। গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে বুঝাল, ভালো আছে। তারপরে অনুমতি চাইল,
” ভেতরে আসব? ”

বেহালা তৎক্ষনাৎ দরজা ছেড়ে দিল। হাসি হাসি মুখে আমন্ত্রণ করল,
” অবশ্যই। ”

এই বাড়িতে আরও কয়েকবার আসা হয়েছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ হলো এই প্রথমবার। মুনছুর সাখাওয়াতের চালচলনে সামান্যতম আড়ষ্টভাব নেই। নিজ দায়িত্বে বসার রুমটা খুঁজে নিয়ে সোফাতে বসল। ইকবাল বসবে কী বসবে না বুঝতে পারছিল না। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মহাজনের পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।

বেহালা পেছনে পড়ে গিয়েছিল। চলার পথটা ফাঁকা হতে দ্রুত কদমে মেহমানদের কাছে গেল। দুলাভাইয়ের উদ্দেশ্যে সুধাল,
” স্বর্ণা আসেনি? ”
” না। ”
” ভাইয়ার কাছে এসেছেন? ও বাড়িতেই আছে। বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি। ”

সে সরে পড়ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত বাঁধা দিল। গলার স্বর খানিক উপরে তুলে জানাল,
” আমি তোর কাছে এসেছি। ”

বেহালা ফিরে তাকাল। বিস্মিত হতে গিয়েও বিচলিত হয়ে পড়ল। তড়িৎগতিতে আরও কয়েক কদম এগিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে সুধাল,
” কিছু কি হয়েছে? স্বর্ণা কেমন আছে, ভাইয়া? ”

এই প্রথম ‘ ভাইয়া ‘ ডাকটা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। জোর করে অগ্রাহ্য করল। অতঃপর বলল,
” ভালো আছে। ”

বেহালা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। বান্ধুবীটার জন্য তার বড্ড মায়া হয়। পরিচয় হওয়ার পর থেকে দেখছে, একের পর এক অঘটন ঘটেই চলেছে। কতটুকুই বয়স! এরমধ্যে দুনিয়ার সকল ভার ভার দুঃখগুলো তার ঝুড়িতেই পড়েছে। কী করে যে সামলে ওঠে! স্বর্ণলতার ধৈর্য ও সহনশক্তি তাকে অবাক করে ছেড়েছে।

এই সময়ে ডাক্তার আল হাদি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার হাতে দুটো বড় ট্রলি ব্যাগ। বসার রুমের দিকে নজর পড়তেই মুখটা বিরক্তে কুঁচকে গেল। বোনের পাশে পৌঁছাতে মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিল। সাথে সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
” এই অসময়ে আমার বাড়ি কেন? কী চাই, মহাজন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল বেহালার দিকে। এতক্ষণে বুঝতে পারল মেয়েটি সাধারণ বেশভূষায় নেই। পরনের শাড়িটা উন্নত মানের, খুব গুছিয়ে পরেছে। মুখে মেকআপের আলতো ছোঁয়াও আছে। সন্দেহ চিত্তে প্রশ্নটা করল,
” কোথাও যাচ্ছিস নাকি? ”
” হ্যাঁ। ”
” কতক্ষণে ফিরবি? ”
” ঠিক বলতে পারছি না। এক, দুই মাস পরে হয়তো আসব। ”
” বাপরে, অনেক সময়! এত সময় তো অপেক্ষা করতে পারব না, বেহালা। যাওয়াটা বন্ধ করে দে। ”

বেহালা মিষ্টি হাসল। সহাস্যে একটা সোফায় বসে পড়ল। তারপরে ভীষণ আন্তরিকতার গলায় বলল,
” দেরি হলেও সমস্যা নেই। আমরা নিজেদের গাড়িতে করেই যাব। শুধু একটু রাত হবে এই যা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। যতক্ষণ ইচ্ছে হয় বসুন। আমি আছি। ”
” যাচ্ছিস কোথায়? ”
” ঢাকা। ”
” বাবার কাছে? ”
” না। হোস্টেলে। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগে সিট পেয়েছি, ভাইয়া। প্রথম বর্ষের ছাত্রী তো, হলে জায়গা পাইনি। তাই আপাতত কাছাকাছি একটা হোস্টেলে ওঠছি। ”

অন্য কেউ হলে হয়তো চমকে ওঠত। খুব প্রশংসা করত। মুনছুর সাখাওয়াত তেমন কিছুই করল না। মুখের গম্ভীর ভাবটা এক মুহূর্তের জন্যও সরল না। উল্টো আরও গাঢ় হলো। সেকেন্ড কয়েক নীরব থেকে বলল,
” বান্ধবীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? ওর পড়াশোনায় তুই খুব সাহায্য করছিলি তো! ”
” আরও করার ইচ্ছে ছিল। স্বর্ণা আমার কাছে পাওনা আছে। স্কুলে থাকতে ও আমার জন্য অনেক করেছে। আমার থেকেও কয়েকগুণে মেধাবী কি না! কিন্তু ভাইয়া, ও তো অনার্সে ভর্তিই হলো না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটু যেন অন্যমনস্ক হলো। এইচএসএসিতে স্বর্ণলতার রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। পছন্দসই বিষয় পেয়ে যেত অনায়াসে। তারপরেও মেয়েটাকে ভর্তি করাতে পারল না। কতভাবে বুঝাল, শুনলই না! বেহালাও কম চেষ্টা করেনি। দুজনকেই সে ফিরিয়ে দিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত চাইলে জোর করে ভর্তি করাতে পারত। ঐ সময়টায় জোরাজুরিতে মন সায় দিচ্ছিল না। দুটো মৃত্যু ঘটনাকে সামলে উঠে কলেজের পড়াটা সম্পন্ন করেছে এটাই বিশাল মনে হচ্ছিল। তাই একটা বছর অবসরে ছেড়ে দিয়েছে। মনমানসিকতা স্বাভাবিক হোক। তারপরে নাহয় আবার বুঝিয়ে ভর্তি করাবে। সহজে রাজি হলে ভালো নাহলে জোর দেখাবে। মাঝপথে পড়াশোনাটা ছাড়তে দিবে না কিছুতেই। দেরি হোক, তবুও শেষ করতে হবে।

” ভাইয়া, স্বর্ণা কি ভর্তির জন্য রাজি হয়েছে? এই বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের অন্যমনস্ক ভাবটা ছুটে গেল। দ্রুত প্রত্যুত্তর করল,
” না। এবছরটা থাক। পরের বছর ভর্তি করাব। ”
” বেশ, যদি ভর্তি হয় আমাকে জানাবেন। আমি গ্রামে চলে আসব। ওর সাথে আবারও পড়ব। ”

ডাক্তার আল হাদি অদূরে দাঁড়িয়ে নীরবে দুজনের কথোকপথন শুনছিল। এবার নীরবতা কাটিয়ে ওঠল। বোনের উদ্দেশ্যে ধমকে ওঠল,
” আবার ভর্তি হবি মানে? ইয়ার ড্রপ দিয়ে পাবলিক ছেড়ে প্রাইভেটে আসবি? তোর কি মাথার তার ছিঁড়ে গেছে? ”

বেহালা ঝটিতে ভাইয়ার দিকে মুখ ফেরাল। মৃদু হেসে নির্ভয়ে বলল,
” বন্ধুর জন্য বন্ধু প্রাণ দেওয়ারও রেকর্ড আছে, ভাইয়া। আর আমি সামান্য ইয়ার ড্রপ দিতে পারব না? ”
” না, পারবি না। ঢাবির সিট প্রাণের চেয়েও দামি। নাহলে প্রতি বছর শয়ে শয়ে স্টুডেন্ট সুইসাইড করত না। ”
” তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন, ভাইয়া? এটা তো অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত। আগে স্বর্ণাকে ভর্তি হতে দাও। পড়ালেখায় ওর যে অনিহা দেখলাম, আর কখনও বই ছুঁবে বলে মনে হয় না। ”

ডাক্তার আল হাদির রাগ কমার বদলে বেড়ে গেল। কী যেন একটা বলার জন্য তেড়েফুঁড়ে আসছিল। মাঝপথে দেয়াল হলো মুনছুর সাখাওয়াত। তার দিকে পিঠ রেখে বেহালার উদ্দেশ্যে বলল,
” ছুঁবে। সামনের বছরেই ছুঁবে। তাই এই অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার নেই। তুই গ্রামে থাক। ”

কথাগুলো শোনাল আদেশের মতো। নড়চড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মুনছুর সাখাওয়াত পেছন ফিরল। ডাক্তার আল হাদির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে পুনরায় বলল,
” এই বাড়িতে থাকা দরকার নেই। আমার বাড়ি চল। ব্যাগপত্র গোছানোই আছে তো। ইচ্ছে হলে নে, না নিলেও সমস্যা নেই। আমি খরচ দিব। স্বর্ণলতার সাথে গিয়ে যা যা প্রয়োজন কিনে নিবি। ”

বেহালা প্রত্যুত্তর করার সুযোগই পেল না। পূর্বে ডাক্তার আল হাদি দারুন তেজে উঠে বলল,
” ও আপনার বাড়ি না, ঢাকা যাবে। সেটাও এখন, এই মুহূ্র্তে। ”

সে মুনছুর সাখাওয়াতকে পাশ কাটিয়ে বোনের একটা হাত চেপে ধরল। জোরপূর্বক টেনে আনতে চেয়েও পারল না। পুরুষালি হাতটির উপরে আরও একটি পুরুষালি হাত পড়ল। অতঃপর বজ্রপাতের মতো কণ্ঠটা বাজল,
” বেহালা, তোর ভাইকে বল আমাদের মাঝে যেন না আসে। রাগের চটে আমি যদি মেরে বসি তোর বান্ধুবী খুব কষ্ট পাবে। স্বর্ণলতা এসব পছন্দ করে না, জানিসই তো। ”

এই দুটো পুরুষ একে-অপরকে সহ্য করতে পারে না। যার একমাত্র কারণ, স্বর্ণলতা। বিষয়টা বেহালার এতদিনে জানা ছিল। আজ স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। বিরোধটা তাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হলেও অগোচরে স্বর্ণলতাই যে মূলে আছে সেটা টের পেতে সময় লাগল না। ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়ার পূর্বে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাড়ির অতিথিকে অসম্মান করার কোনো অভিপ্রায় নেই। তাই আপন ভাইয়ার উদ্দেশ্যে অনুরোধের সুরে বলল,
” ভাইয়া, রুমে যাও। উনার সাথে আমি কথা বলছি তো! তুমি কখনও আমার সিদ্ধান্তে দ্বিমত করোনি। আজও করো না। সবসময়ের মতো আমার উপরে ভরসা রাখ। তুমি ছোট হও এমন কিছুই করব না। কথা দিচ্ছি। ”

ডাক্তার আল হাদি বোনের হাত ছেড়ে দিল। কিন্তু রুমে গেল না। নিজ জায়গায় অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বেহালা এই উপস্থিতিটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুনছুর সাখাওয়াতকে বলল,
” ভাইয়া, দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বসে মাথা ঠান্ডা করুন। ততক্ষণে আমি চা, নাস্তার ব্যবস্থা করছি। ”

সে চট করে রান্নাঘরে চলে গেল। টিয়ামনি এখানে আছে। রাতের রান্না গুছাচ্ছে। বেহালা চা তৈরির ফরমায়েশ দিয়ে বসার রুমে দ্রুত ফিরে গেল। ততক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বের আসনটি বেছে নিয়েছে। বেহালা ধপ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, ‘ দশ মিনিটেই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি রে, স্বর্ণা। তুই বছরের পর বছর উনাকে সামলাচ্ছিস। সত্যি তোর কোনো তুলনা হয় না! ‘

বেহালা পূর্বের সোফাটায় বেছে নিল। বসতেই শুনল,
” আমার সাথে আরও একজন আছে। ও কেও আপ্যায়ন কর। ”

এতক্ষণে ইকবালের দিকে নজর পড়ল। অপ্রস্তুত মুখো ভঙ্গির চেহারাটা চিনছে না। তবুও সমাদরে বসাল। চা, নাস্তা চলে আসতে নিজ হাতে চায়ের কাপটাও এগিয়ে দিল। তারপরে মুনছুর সাখাওয়াতের উদ্দেশ্যে বলল,
” উনার পরিচয় দিলে ভালো হতো না? সম্বোধন ছাড়া কথা বলি কীভাবে? ”
” ও ইকবাল। তোর হবু স্বামী। তুমি, আপনি যা খুশি বলতে পারিস। এই নিয়ে ওর আপত্তি হওয়ার কথা না। মনের দিক দিয়ে আমার থেকে যথেষ্ঠ ভালো। ”

ইকবাল সবে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। কথাগুলো কানে ঢুকতে অসতর্ক হয়ে পড়ল। গরম চায়ে ঠোঁটটা এত বেশি ডুবে গেল যে, পুড়ে ওঠল। যন্ত্রণাটা চায়ের সাথে গিলে নিল তৎক্ষনাৎ। তারপরে তাকাল মহাজনের দিকে। বিস্ফারিত গলায় কী একটা বলতে চাইল। প্রয়োজন পড়ল না। পূর্বে মেয়েলি কণ্ঠস্বরটা বেজে ওঠল,
” কার হবু স্বামী? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চা পান করছে না। করবেও না। তবুও কাপটা এমনভাবে ধরে আছে যেন, বহুদিন পরে আয়েশ করে চা খাচ্ছে। সেভাবেই জবাব দিল,
” তোর। একটু পরে অবশ্য হবু শব্দটা কেটে যাবে। তখন শুধু স্বামী হবে। ”
” কে কাটবে? ”
” কাজী। ”
” কেন? ”

এই উত্তরটা দেওয়ার সুযোগ হলো না। আরও একবার ফোঁড়ন কাটল ডাক্তার আল হাদি। যে বিষয়টা বোন ধরতে পারেনি সেটা সে ধরে ফেলেছে। দ্রুত কদমে কাছে এগিয়ে এসে মুনছুর সাখাওয়াতের উদ্দেশ্যে বলল,
” বেরিয়ে যান। মহাজন, আর একটা সেকেন্ডও আপনাকে এখানে দেখতে চাই না। এখনই বেরিয়ে যাবেন। নাহলে এবার আমার হাত উঠবে। আপনার বউ নিশ্চয় এতে খুশিতে লাফাবে না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। চেয়ে দেখল না পর্যন্ত। শুধু পাশ কেটে মাথাটা হেলে বেহালার দিকে তাকাল। এতেই কাজ হলো। সে জায়গা থেকে উঠে এলো। ভাইয়ার হাত ধরে বলল,
” খুব জ্বালাচ্ছ কিন্তু। বলেছি তো আমার বিষয়টা আমাকে সামলাতে দাও। ”
সে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপরে বোনের দিকে ফিরে হুংকার ছুঁড়ল,
” তুই রুমে যা। নাহলে প্রথমে তোকেই মা রব। ”

বেহালা আঁতকে ওঠল! ভাইকে সে এত কঠোর হতে দেখেনি কখনও। মা রবে তো দূর চোখ রাঙায়নি কখনও। সবসময় স্নেহে রেখেছে। অবাদ স্বাধীনতা দিয়েছে। সেই ভাইটার এই রূপ পিল চমকে দিচ্ছে।

ডাক্তার আল হাদি আবারও চেঁচাল,
” বেহালা, আমি রুমে যেতে বলেছি। ”

এতক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াত সোফা ছেড়ে দাঁড়াল। তারপরে বলল,
” ও যদি এখান থেকে নড়ে তাহলে সোজা আমার বাড়িতে যাবে। বিয়ের কাজ ওখানেই সম্পন্ন হবে। ”

ইকবাল তখনও বসে আছে। বিভ্রান্ত অবস্থায় পড়েছে। কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না। তার করণীয় কী তাও ঠাহর করতে পারছিল না। এই সময়ে আদেশটা পেল,
” ইকবাল, ডাক্তারকে ধর তো। আমি ধরতে গেলেই মেরে বসব! ”

ইকবাল উঠল ঠিকই কিন্তু ডাক্তারকে ধরল না। বিভ্রান্ত কাটাতে বলল,
” আগে বলুন আপনি চাইছেনটা কী। কার বিয়ে হবে? ”
” তোর আর বেহালার। ”
” হঠাৎ আমাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কেন? ”
” এই কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে? বিয়ে করাচ্ছি, চুপচাপ করে নিবি। ”

এই পর্যায়ে বেহালা কথা বলল। ভাইয়াকে ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলল,
” দুঃখিত, ভাইয়া। আমি উনাকে বিয়ে করতে পারব না। ”
” কেন? চেহারাসুরত তো ভালোই। আমার ব্যবসায়ের অর্ধেকটায় ইকবাল সামলাচ্ছে। এতদিন বেতন দিয়েছি। এখন নাহয় লাভের অংশ থেকেও কিছু দিব। ”
” উফ, ভাইয়া। আপনি বুঝতে পারছেন না। ”
” বুঝার মতো কিছু বলেছিস নাকি যে বুঝব? ”

একটু থেমে পুনরায় বলল,
” তুই কি সুবর্ণকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস? ”

বেহালা অতিষ্ঠ গলায় বলল,
” পাগলের মতো কীসব বলছেন! সুবর্ণের কি বিয়ের বয়স হয়েছে? বাচ্চা ছেলে। আমার তো মনে হচ্ছে, ইকবাল ভাইয়ারও হয়নি। ”
” বয়স নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। ”
” আচ্ছা, ভাবব না। কিন্তু আমি আবারও অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি, আমি বিয়ে করব না। শুধু উনাকে না, আমি কাউকে বিয়ে করব না। সহজ কথায় বলতে গেলে, আমি কখনই বিয়ে করব না। ”
” কখনই করবি না? ”
” না। ”
” কেন? তোর কি শারীরিক…”

সে কথাটা শেষ করতে পারল না৷ আচমকা থাবা পড়ল কলারে। ডাক্তার আল হাদি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
” নিজ থেকে বের হবি নাকি আমি ঘাড় ধাক্কা…”

এই কথাটাও শেষ হলো না। পাশ থেকে সবেগে মুখ বরাবর ভারী ঘু ষি পড়ল। ডাক্তার আল হাদি আচমকা আঘাতটা সামলে উঠতে পারল না। মুখসহ দেহের অর্ধেকটায় একপাশে হেলে গেল। এই সুযোগে ইকবাল কলারটা ছাড়িয়ে নিল। তারপরে মুনছুর সাখাওয়াতের উদ্দেশ্যে বলল,
” আমিও বিয়ে করব না। ভাইজান, এখান থেকে চলেন। ”

একটা সেকেন্ড অপেক্ষা করার জন্যও তর সয়ছে না যেন! ইকবাল অনুমতির পরোয়া করল না। ভাইজানের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বাড়ির বাইরে।

______
নিজের বাড়ির উঠোনে জীপটা থামিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত মারমুখী হয়ে ওঠল। ইকবালকে লা থি মা রতে চেয়েও থেমে গেল। কিন্তু একেবারে ছেড়ে দিল না। সমানে চড়-থাপ্পড় মা রতে লাগল। মন ভরে এলে গাল ছেড়ে গলা চে পে ধরল। তারপরে বলল,
” বিয়ে করবি না! আমার কথার উপরে কথা বলিস। এই সাহস কে দিয়েছে? তোর আপা? ”

ইকবাল জবাব দেয় না। মুনছুর সাখাওয়াত হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে বলল,
” তোকে আমি একদিন সত্যি মে রে ফেলব। এভাবে গলা টিপেই মা রব। তারপরে আমার শান্তি হবে। ”
” আজই মেরে ফেলুন না! অশান্তিতে থাকার দরকার কী? মারুন। ”

সে নিজেই হাতদুটো আরও চেপে ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত সেই হাত ছাড়িয়ে নিল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুখ ও গলার ঘামটা মোছার সময়ে শুনল,
” ছেড়ে দিলেন যে! ”
” না ছেড়ে উপায় আছে? তোর মতো আর কেউ তো নেই যে আমার রাগ চুপচাপ সহ্য করবে। আমার বউয়ের থেকে আমাকে বাঁচিয়েও নেবে। ”

________
সদর দরজাটা খোলাই ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত চৌকাঠ পেরুতে শুনল,
” ছার রে আমি ঐদিনই পরথম হাসতে দেখছিলাম। আল্লাহ, আম্মাজান রে কান্ধে নিয়া ক্যামনে ঘুরতাছিল! আমার তো মনে হইছিল পাগল হইয়া গেছে! ”

কণ্ঠটা ময়নার। এবার কলির গলাও পাওয়া গেল। সে সম্মতি দিয়ে বলছে,
” হ, আমারও তাই মনে হইছিল। আমি তো ডরে পাকঘরেও ঢুইক্যা পড়ছিলাম। ”

এবার স্বর্ণলতার গলা সংযুক্ত হলো। সে দুজনের উদ্দেশ্যে বলল,
” উনি হয়তো এত খুশি কোনোদিনও হয়নি। তাই সামলাতে পারেনি। ”

ময়না ও কলি একইসাথে বলল,
” হ, তাই হইবো। ”

সেকেন্ড দুই সময়ের জন্য সবগুলো কণ্ঠ থেমে গেল। তারপরে কলির গলাটা আবারও বেজে ওঠল,
” আপনারে তো অমন পাগলামি করতে দেহি নাই। আপনে কি খুশি হইছিলেন না? ”

উত্তরটা কলি দিল। বলল,
” মনে অয় না। এজন্যই তো বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পরে একটুও কষ্ট পাই নাই। ”
” চুপ থাক। তু্ই কথা কস ক্যান? আমি কি তোরে প্রশ্ন করছি? ”

কলি ধমক দিয়ে ময়নাকে থামিয়ে দিল। তারপরে অত্যন্ত নরম গলায় প্রশ্নটা করল,
” আপনে সবসময় কন, ছার খুব কষ্ট পাইছে। আপনের কথা তো কিছু কন না! আপনে কষ্ট পান নাই? আপনের কান্দন আহে নাই? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাবের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেকেন্ড কয়েক পেরিয়ে যেতেও বউয়ের গলা শুনতে পেল না। সে দোরগোড়া থেকে সরে এলো। নীরবে, নীঃশব্দে বসার রুমটার দিকে পা বাড়াল। তিনটা নারী মুখ চোখে নজরে আসতে শুনল,
” আল্লাহ! আপনে দেহি কাইন্দা দিছেন। থামেন, থামেন না। ছার জানলে আমগো রে জ্যান্ত মা টিতে পুঁইতা ফেলব। ”

কলি ও ময়না কান্না থামাতে অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুতেই থামাতে পারছিল না। আরও বাড়ছিল। এই সময়ে অসচেতনে ময়নার চোখটা পড়ে যায় মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠে,
” আল্লাহ, বাঁচাও। ”

সে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দেয়। তার পেছন পেছন কলিও দৌড় দিল। স্বর্ণলতার এসবে কোনো ধ্যান নেই। সে একমনে কেঁদে যাচ্ছিল। সহসায় পেছন থেকে মাথাটা চেপে ধরে মুনছুর সাখাওয়াত। তারপরে বলল,
” কান্না থামাও। নাহলে ঐ দুটোকে সত্যি জ্যান্ত মা টিতে পুঁতে ফেলব। ”

______
রাতে খেতে বসে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” স্বর্ণলতা, ঢাকা যাবে? ”
” কেন? ”
” তোমার আম্মার কাছে কয়দিন থেকে আসলে। ”
” আপনি যাবেন? ”
” যাব। কিন্তু তোমাকে রেখে চলে আসব। তারপরে যেদিন চলে আসতে ইচ্ছে হবে, বলো। আমি গিয়ে নিয়ে আসব। ”
” আমার সাথে থাকবেন না? ”
” আমি থাকলে তুমি তোমার পরিবারের সাথে মন খুলে মিশতে পারবে না। ”
” ওজুহাত না দিয়ে বলুন, থাকবেন নাকি। ”
” না। ”
” তাহলে যাব না। ”
” কেন? ”

সে নিজ প্লেট থেকে বউকে খায়িয়ে দিচ্ছিল। স্বর্ণলতার সামনে প্লেট নেই। হাতদুটোও ফাঁকা। এই সুযোগে স্বামীর উরুর উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তারপরে পাঞ্জাবির উপর দিয়ে পেটের মধ্যে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,
” আপনি এই বাড়িতে একা আছেন। এই ভাবনাটা নিয়ে আমি এক রাতের জন্যও কোথাও থাকতে পারব না। দুশ্চিন্তায় মরেই যাব। ”

______
প্রায় সাত মাস পরে বসার রুমটায় তিন নারীর আড্ডার আসরটা মুনছুর সাখাওয়াত আবারও দেখতে পেল। এবার কান্নার আভাস নেই। খুব হাসাহাসি হচ্ছে। সে আগ্রহ নিয়ে কয়েক কদম এগুতে কলির গলাটা শুনতে পেল,
” সরমে তো মুখটা পুরা লাল হইয়া গেছে! এমন তো পরথম বারেও দেহি নাই! ”

ময়না সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে নেড়ে বলল,
” ঠিক কইছ, কলিবু। এবার মনে অয় ম্যাডাম খুব খুশি। তাই না, ম্যাডাম? ”

মুনছুর সাখাওয়াত দূর থেকেও দেখল, স্বর্ণলতা দারুন উদ্যমে মাথা নাড়ছে। তারপরে লজ্জায় ডুবা কণ্ঠটায় বলল,
” প্রথমবারে আমি খুশি হওয়ার সুযোগই পাইনি। উনি খুব চিন্তা করছিল। আমার তো আঠারো বছরও হয়নি তখন! ”
” চিন্তার মইধ্যেও কত খুশি হইছিল। এবার তো চিন্তা নাই। আরও বেশি খুশি হইবো। ম্যাডাম, আপনে কিন্তু আসার লগে লগেই কইবেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত পরবর্তী কথাগুলো শোনার ধৈর্য করে উঠতে পারল না। সামনে এগিয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা ঘরে এসো। ”

স্বর্ণলতা তখনই স্বামীর পেছন পেছন রুমে ঢুকল। স্থির হয়ে দাঁড়ানোরও সুযোগ পেল না। প্রশ্নটা উড়ে এলো,
” কী নিয়ে এত লজ্জা পাচ্ছিলে? আমাকে কী বলবে? ”

স্বর্ণলতা বলতে চেয়েও পারল না। হঠাৎ করে এত লজ্জা পাচ্ছে! ঠোঁটদুটো নড়াতেই পারছে না। আঠা দিয়ে একটার সাথে আরেকটা আটকে রেখেছে যেন! এই লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে দিল মুনছুর সাখাওয়াতই। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি আবারও প্রেগন্যান্ট হয়েছ? ”

স্বর্ণলতার মাথা নুয়ানো ছিল। সেভাবে লাজুক হেসে মাথা উপন-নিচ করল। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াত হাতের মোবাইলটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। মুখ দিয়ে বেফাঁসে উচ্চারিত হলো,
” ধ্যাত! ”

আকস্মিক প্রচণ্ড শব্দে স্বর্ণলতা এত চমকাল যে, চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ হয়ে আসে। অজান্তেই দুই কদম পেছনে সরে যায়। কানের কাছে শব্দটা বাজতে সে চোখ খুলল। দূর থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি খুশি হন নি? ”
” না। একটুও না। ”

জবাবটা দিয়ে সে স্বর্ণলতার কাছে এগিয়ে এলো। দুই হাতে কাঁধ জোড়া চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
” স্বর্ণলতা, প্রথমবারে আমি যত খুশি হয়েছিলাম এবার আমি ততটায় অখুশি হয়েছি। রাগে আমার মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০৭)

” তুমি কি আবারও প্রেগন্যান্ট হয়েছ? ”

স্বর্ণলতার মাথা নুয়ানো ছিল। সেভাবে লাজুক হেসে মাথা উপন-নিচ করল। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াত হাতের মোবাইলটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। মুখ দিয়ে বেফাঁসে উচ্চারিত হলো,
” ধ্যাত! ”

আকস্মিক প্রচণ্ড শব্দে স্বর্ণলতা এত চমকাল যে, চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ হয়ে আসে। অজান্তেই দুই কদম পেছনে সরে যায়। কানের কাছে শব্দটা বাজতে সে চোখ খুলল। দূর থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি খুশি হন নি? ”
” না। একটুও না। ”

জবাবটা দিয়ে সে স্বর্ণলতার কাছে এগিয়ে এলো। দুই হাতে কাঁধ জোড়া চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
” স্বর্ণলতা, প্রথমবারে আমি যত খুশি হয়েছিলাম এবার আমি ততটায় অখুশি হয়েছি। রাগে আমার মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। ”

কথাগুলোতে কি বিষ মাখানো ছিল? হয় তো! নিশানাও ছিল বুক বরাবর। একেবারে হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল। মুহূর্তের মধ্যে অসহ্য রকমের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। স্বর্ণলতার চোখদুটিতে অবিশ্বাস্যের ঘোর ছায়া নেমেছে। কথা বেরুচ্ছে না কণ্ঠস্বর দিয়ে। ঠোঁট দুটো পুরোপুরি পাথর বনে গিয়েছে যেন! হাজার চেষ্টায়ও সামান্য নাড়াতে পারল না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়েই আছে শুধু।

মুনছুর সাখাওয়াত কাঁধ ছেড়ে দিল। তপ্ত শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ঘুরে দাঁড়াল অন্য দিকে। ঠিক তখনই স্বর্ণলতা পেছন থেকে বলে ওঠল,
” রাগটা কি আমার প্রেগন্যান্সির খবরের জন্যই নাকি অন্য কোনো কারণ?
” অন্য কোনো কারণ নেই। ”
” সত্যি বলছেন তো? ”
” হঠাৎ মিথ্যা বলতে যাব কেন? ”

বিরস কণ্ঠস্বর কিন্তু পরিষ্কার, দৃঢ়। কোথাও দ্বিধা নেই, ভয় নেই। তবুও স্বর্ণলতা মানতে পারছিল না। দু’কদম এগিয়ে এলো। স্বামীর একটা হাত মুঠোয় নিল। থুতনিতে ঠেকিয়ে মুখটায় তাকাল। অতঃপর কাতর স্বরে পুনরায় বলল,
” দয়া করে কিছু লুকাবেন না। খারাপ কিছু কি ঘটেছে? আপনার ব্যবসা কেমন চলছে? কারও সাথে কি….”

সে পুরো কথাটা শেষ করতে পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত একটানে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপরে জানাল,
” কারও সাথে ঝগড়া হয়নি। ব্যবসাও ভালো চলছে। স্বর্ণলতা, আমি কিছু লুকাচ্ছিও না। আমার মনে যা এসেছে তাই বলেছি। তুমি বিশ্বাস করছ না কেন? সংবাদটা আমাকে একটুও খুশি করতে পারেনি। ”
” কেন? আপনার বাচ্চা চাই না? ”
” না। কখনও না। আমি তো এই নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথাও বলেছি। চিরস্থায়ী কোনো পদ্ধতি আছে নাকি সেটাও জেনেছি। কিন্তু সবগুলোতেই কমবেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে। জেনেশুনে আমি তোমাকে সামান্য ঝুঁকিতেও রাখতে চাই না। তাই বাদ দিয়েছি। নিয়ন্ত্রণের আর সাবধানতার পুরো ভারটাই আমি নিয়েছি। এজন্যে আমার কত সমস্যা হয়, জানো? ”

স্বর্ণলতা মৃদুভাবে দু’পাশে মাথা নাড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” কোন সুখটা ত্যাগ করতে হয়, বুঝো? ”

স্ত্রীর কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা করল না। নিজেই বলতে লাগল,
” বুঝবে না। তুমি তো আর পুরুষ নও! ”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলল,
” আল্লাহও পুরুষ না। নারীও না। তিনি এই পৃথিবীর কোনো কিছুরই মুখাপেক্ষী নয়। তবুও তিনি সব জানেন। সব বুঝেন। এরপরেও আমার এই বিশাল ত্যাগের মূল্য দিলেন না। প্রতিবারই এমন করেছেন। আমি যতবার খুশিমনে কিছু ত্যাগ করেছি ততবারই তিনি খারাপ কিছু ঘটিয়েছেন। ”

বিরস, বিরক্তে ভরপুর কণ্ঠটায় অভিমানেরও আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। একবারে সারাজীবনের অভিযোগ করে বসল যেন! স্বর্ণলতার মায়া হলো। অপরিমেয় দরদে হৃদয় ভাসতে লাগল। কিন্তু প্রকাশ করতে পারল না। দেহমনের বশবর্তী অন্যকিছুতে। সে বেখেয়ালে আবার পিছিয়ে যেতে লাগল। একস্থির স্বামীর মুখটায় চেয়ে আছে। দীর্ঘক্ষণ পরে ঠোঁট নেড়ে সুধাল,
” সত্যি আপনার নিজের রক্ত চাই না? ”
” না। চাই না। আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে? ”

এই প্রশ্নের উত্তর এলো না। স্বর্ণলতা ধপ করে বসে পড়ল। দরজার কাছে, পাকা মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখের কিনার বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ল। মুনছুর সাখাওয়াত এত ঘাবড়াল! দৌড়ে কাছে এগিয়ে এলো। ঝুঁকে পড়ল স্ত্রীর দিকে। কাঁধযুগল চেপে ধরে বলল,
” এখানে বসলে কেন? উঠো। স্বর্ণলতা, আমি উঠতে বলেছি। ”

সে কাঁধ ধরে জোরপূর্বক উঠিয়ে দাঁড় করাল। কিন্তু এক সেকেন্ডও বোধহয় স্থির হলো না। স্বর্ণলতা কাঁধ ছাড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এত জোরে ছুটল! এক পলকেই চোখের আড়াল হয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত ঘটনাটায় এত আশ্চর্য হলো যে, পুরো বিমূঢ় হয়ে গেল। বাইরের শূন্যতায় হতভম্বের মতো চেয়ে থাকল অনেকটা সময়। এই সুযোগে স্বর্ণলতা দাদিজানের রুমটায় ঢুকল। ভেতর থেকে সিটকানি টেনে দিয়ে বিছানায় ওঠল। উপুড় হয়ে শুয়ে নীঃশব্দে কাঁদতে লাগল। দাদিজানের বালিশটা খানিক ভিজে উঠতে গলাটা পেল,
” আবারও উপুড় হয়ে শুয়েছ? সংবাদ দিতে না দিতেই বদঅভ্যেসগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। স্বর্ণলতা, সোজা হও। ”

স্বর্ণলতা সোজা হলো না। শুধু মাথাটা তুলল। গলার আওয়াজ খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছে। অশ্রুসজল চোখে সেদিকে ফিরতে মুখটা দেখতে পেল। দুই হাতে লোহার শিকগুলো কেমন শক্ত করে চেপে আছে! পারলে এখনই একটানে আলগা করে ফেলত। জোরে কুলাচ্ছে না বোধহয়।

মুনছুর সাখাওয়াত বিস্মিত গলায় সুধাল,
” আবার কাঁদছ কেন? তোমাকে বকেছি না মেরেছি? আমি তো শুধু আমার খারাপ লাগাটুকু বুঝালাম। বউকে কি এটুকুও বলতে পারব না? ”

স্বর্ণলতা জবাব দিল না। দৃষ্টি সরিয়ে নিল। দাদিজানের ব্যবহৃত তুলতুলে শিমুল তুলার বালিশটায় মুখ গুঁজে দিল আবারও। নীঃশব্দের কান্নায় আবারও ফুঁপিয়ে উঠতে শুনল,
” দরজা খোলো। এখনই খুলবে। নাহলে আজ আমি সত্যি দরজা ভাঙব। শুধু এই ঘরের না, সব ঘরের দরজা ভাঙব। এই বাড়িতে দরজা নামের কোনো জিনিসের অস্তিত্বই রাখব না। ”
” ভাঙুন। মানা করেছে কে? আমাকে জানানোরই দরকার কী? বাড়ি আপনার, দরজা আপনার, ইচ্ছে আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার। আমি তো কিছুতেই নেই। পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনোভাবেই অংশ নিচ্ছি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত থতমত গলায় প্রত্যুত্তর করল,
” কী বলছ? মাথা ঠিক আছে তোমার? ”
” না। পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিচ্ছেন না কেন? তাহলেই তো জ্বালাতে পারব না। রাগ উঠে যায় এমন সংবাদও দিতে পারব না। ”

স্বর্ণলতার কান্না থেমে গিয়েছে। সে উঠে বসল। এলোমেলো চুলগুলো হাতের মুঠোতে এনে খোঁপা বাঁধল। আঁচলটাও ঠিকঠাক করে মাথায় ঘোমটা দিল। তারপরে জানালার দিকে ফিরল। ভারী আশ্চর্য হয়েছে এমন ভান ধরে বলল,
” এখনও দাঁড়িয়ে আছেন দেখি! দরজাটা ভাঙবেন কখন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত একমনে স্ত্রীর আকস্মিক পরিবর্তন দেখছিল। সহসা গলা পেয়ে চমকে ওঠল। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
” ভাঙার দরকার কী? খুলে দিলেই তো হয়। ”
” না, আমি আপনার দরজা ভাঙা দেখব। যান, ভাঙুন। ”

সে আসন পেতে বসল। দরজার দিকে এমনভাবে মুখ করে আছে যেন, টিভিতে দারুন একটা সিনেমা হচ্ছে। একটা দৃশ্য বা ডায়লগও মিস করা যাবে না। এক বসাতে সবটা দেখে ফেলতে হবে। মুনছুর সাখাওয়াতের রাগ, বিরক্ত সব একধাক্কাতেই পালাল। দৃষ্টি নরম হলো। কণ্ঠস্বর সহজ করে বলল,
” স্বর্ণলতা, আমি দরজা ভাঙব না। ”
” কেন? ”
” ইচ্ছে করছে না। তুমি দরজা খুলে বেরিয়ে এসো। ”
” আমারও খুলতে ইচ্ছে করছে না। ”
” স্বামীর কথা শুনবে না? অবাধ্য বউ হবে? দাদিজান নেই বলে তার শিক্ষাও ভুলে যাবে? ”

স্বর্ণলতার বসার ভঙ্গি ঢিলে হলো। পা জোড়া মাটিতে রাখল। জানালার দিকে পিঠ দেখিয়ে বলল,
” ঔষধ নিয়ে আসুন। ”
” কিসের ওষধ? ”
” বাচ্চা নষ্ট করার ঔষধ। আপনি চান না এমন জিনিস আমি রাখব না। ”
” আচ্ছা, ঔষধ এনে দিব। এখন দরজাটা খুলো। ”
” না। আগে এনে দিন। আমি খাব, তারপরে দরজা খুলব। ”
” কথা দিচ্ছ তো? ”

স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিল না। গলাটা এত ধরে এলো! চোখ থেকে উপচে পড়া পানি নিয়ে মাথা নেড়ে বুঝাল, কথা দিচ্ছে।

______
আধ ঘণ্টার মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত ঔষধের ব্যবস্থা করে ফেলল। জানালা দিয়ে ঔষধের পাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এবার তো দরজা খুলো। ”

স্বর্ণলতা পাতাটা নিল স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে। মানুষ এমন নিষ্ঠুরও হয়? একটুও কি বুকে ব্যথা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে না, কত বড় অন্যায় করছে? আগেরবার কত সুন্দর করে বুঝিয়েছিল, বাচ্চা আল্লাহর তরফ থেকে উপহার হয়। সেই কথাটা কি ভুলে গেল? স্বর্ণলতা কাঁদবে না ভেবেও আবার কেঁদে ফেলল। নিষ্ঠুর মানুষটাকে সেই কান্না দেখানোর ইচ্ছে নেই। তাই ঝট করে জানালা আটকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অস্থির, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ গলাটা ভেসে এলো,
” আবার জানালা আটকালে কেন? স্বর্ণলতা, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে ঔষধ পেলে দরজা খুলবে। কথা রাখছ না কেন? ”

সে অবিরত জানালায় থাপ্পড় মারতে লাগল। পাল্লা দুটো ভেতরে ঠেলতে লাগল সর্বশক্তিতে। বার কয়েক চেষ্টায় আচমকা খুলে গেল। স্বর্ণলতা চকিতে ফিরতে শুনল,
” দরজা খোলো। ”
” আগে ঔষধটা খাই। ”
” এখনও খাওনি? জানালা আটকে করলে কী তাহলে? ”

স্বর্ণলতা হাজার চেষ্টায়ও কান্নাটা লুকাতে পারল না। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
” কয়টা খেতে হবে বলেননি তো। ”
” একটা। এখনই খাও। ”

স্বর্ণলতা কাঁপা হাতে ঔষধের পাতা ভাঙল। মুখে ঢুকানো পর্যন্ত স্বামীর দিকেই চেয়ে ছিল। আশায় ছিল হয়তো থামিয়ে দিবে। দেয়নি। উল্টো বলল,
” বেশি করে পানি খাও। গ্লাসের পুরো পানিটা শেষ করো। ”

পানিটা শেষ হতে মুনছুর সাখাওয়াত তাগাদা দিল,
” খাওয়া শেষ? এবার কথা রাখো। দরজা খুলো। ”

স্বর্ণলতা জায়গা থেকে উঠল না। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে আহাজারি শুরু করে দিল। জানালার কাছে মানুষটা কী বলছে, কী করছে কিছুতেই বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। চেয়ে দেখলও না আর! হৃদয় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ব্যথা হচ্ছে। যতটা কষ্ট হচ্ছে ততটায় ভীত হচ্ছে। স্বামীকে খুশি করতে গিয়ে সে একটা প্রাণকে মেরে ফেলেছে। পৃথিবীর আলো, বাতাসের স্পর্শটুকুও পায়নি। এই ভয়ঙ্কর পাপ মোচন করবে কীভাবে? আল্লাহ কি তাকে কোনদিনও ক্ষমা করবে?

_______
পরেরদিন সকালবেলা। স্বর্ণলতা চোখ মেলে দেখল তার বুকের মধ্যে মাথা রেখে মুনছুর সাখাওয়াত ঘুমাচ্ছে। চিত্তাকর্ষক দৃশ্যটার দর্শন পেল এই প্রথমবার। মানুষটা সবসময় তাকে বুকে টেনে নেয়, আদুরে পরশে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কখনও সেধে এসে স্বর্ণলতার বুকে মাথা রেখে ভার ছেড়ে দেয়নি। ঘুমানোর প্রয়াস চালায়নি। এজন্যই বোধ হয় কখনও বুঝতে পারেনি, ভালোবাসার মানুষকে বুকে ঠাঁই দিতে পারার মধ্যেও অদ্ভুত ভালো লাগা মিশে থাকে। কী মিষ্টি সেই ভালো লাগা! হাত বাড়িয়ে ধরার লোভ হয়। স্বর্ণলতাও লোভ কাতুরে হয়ে পড়ল। একটা হাত নিয়ে রাখল মুনছুর সাখাওয়াতের মাথায়। চুলের মধ্যে আঙুল ডুবে যেতেই চোখ জোড়া খুলে গেল। মাথাটা কিঞ্চিৎ তুলে মিষ্টি করে হাসল। তারপরে বলল,
” জেদ পড়েছে তাহলে! ”

স্বর্ণলতা শুরুতে বুঝতে পারল না। অবোধের মতো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। চেয়ে থাকতে থাকতেই মনে পড়ে গেল সবটা। সহসায় স্বামীকে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,
” সরুন। আমাকে ছুঁবেন না একদম। কাছে আসার চেষ্টাও করবেন না। বদ, খুনি একটা! ”

মুনছুর সাখাওয়াত একচুলও সরল না। উল্টো আরও ঘনিষ্ঠ হলো। এতক্ষণ শুধু মাথার ভারই ছেড়েছিল। এখন পুরো দেহের ভারটায় ছেড়ে দিল। স্বর্ণলতা চোখ, মুখ খিঁচে ফেলল। সেই অবস্থায় ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। নরম, তুলতুলে অংশ জোড়ায় রাজত্ব কতক্ষণ চালাতে পারল হিসেব নেই। কিন্তু আচমকা এমন এক ধাক্কা খেল যে, দীর্ঘ দেহটা টলেই গেল। বিছানার একপাশে হেলে পড়তেই শুনল,
” খেয়ে খেলবেন আমাকে? রাক্ষস আপনি? ”

স্বর্ণলতা তড়িঘড়িতে উঠে বসল। যন্ত্রণার ছাপ তার চোখে, মুখে প্রকট হয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াতের চোখে পড়লেও বিশেষ পাত্তা পেল না। যেভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেভাবেই শুয়ে আছে। একফোঁটাও নড়ল না। হাত বাড়ালেই বউকে ছুঁতে পারে। জোর দেখিয়ে টেনেও আনতে পারে। কিন্তু সে কোনোটায় করল না। মুখে আহ্বান করল,
” স্বর্ণলতা, কাছে আসো। আসো না! ”

কণ্ঠস্বরে প্রবল আকুতি, মিনতি। চোখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। কামনার উত্তাপে ভয়ঙ্কর হয়ে আছে। স্বর্ণলতার গলা শুকিয়ে এলো। ধরা দেওয়ার চিন্তাভাবনাটা জোর করেই উপেক্ষা করল। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। ঠোঁটটা পরখ করার সময়ে শুনল,
” স্বর্ণলতা, আমি তোমাকে কাছে ডেকেছি। তুমি সজ্ঞানে সেই ডাক ফিরিয়ে দিচ্ছ। মনে থাকবে তো? পরে মাফ চাইতে এলে কিন্তু পাবে না। ”

স্বর্ণলতা কথাগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। তবুও সে কাছে গিয়ে বসল। নিচের ঠোঁটটা আঙুল দিয়ে টেনে খানিক বাড়িয়ে বলল,
” দেখেন, কী করেছেন! কোনো সুস্থ মানুষ এমনটা করতে পারে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এবার হাতদুটো গুটিয়ে রাখল না। বউকে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ও জোর করেই বুকের নিচে চেপে ধরল। তারপরে চোখ রাখল ঠোঁটটায়। একই স্থানে দীর্ঘসময় চুমু খাওয়ার ফলে রক্ত জমে গিয়েছে। সে একটুও মায়া দেখাল না। ঐ স্থানে আরও একবার লম্বা চুমু খেয়ে বলল,
” বেশ করেছি। আরও করব। আমি তোমার জন্য পুরো আমিটাকেই বদলে ফেললাম। আর তুমি আমার একটুখানি রাগ সহ্য করতে পার না, আঘাত সহ্য করতে পার না। মুখ ফিরিয়ে নাও সাথে সাথে। দাদিজানকে কখনও মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখেছ? আমি কত বকেছি, ধমকেছি। সব সহ্য করেছে। ভুল বুঝেছে কিন্তু ভালোবাসা কমায়নি? বলো, কমিয়েছে? ”

স্বর্ণলতা ব্যথায় একহাতে ঠোঁট চেপে ধরেছিল। ছলছল চোখে মাথা দু’পাশে নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এজন্যই আমি নির্দ্বিধায় আবারও বকেছি, ধমকেছি। তোমার কি মনে হয়, এমনি এমনি এই দূর্ব্যবহার করতাম? একদমই না। যে রাগটা আমি তোমার উপর দেখাতে পারতাম না, আবার দমিয়েও ফেলতে পারতাম না। সেটা দাদিজানের উপরে ছেড়ে দিয়ে হালকা হতাম। এখন দাদিজান নেই, আমি রাগটা কোথায় ছাড়ব? ”

স্বর্ণলতা ভয়ে ভয়ে সুধাল,
” আপনি কি আমার উপরে রেগে ছিলেন? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” জানি না। ”
” বলুন না! ”
” কতজনের নাম বলব? প্রতিদিনই শ’খানেক লোকের সাথে উঠাবসা করছি। কারও না কারও উপরে রাগ উঠেই যায়। এত রাগ সামলানো যায়! ডাক্তারকে দেখলে তো মনে হয় চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। ”
” সে কী! আবার কী করেছে? ”
” এখন করেনি। অনেক আগেই করেছে। রাগটা অবশ্য একজায়গায় ঝেড়ে ছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি। মনে হচ্ছে…”

কথাটা সম্পূর্ণ করল না। আপন ঠোঁট কামড়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। সাথে সাথে সাত মাসের আগের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। যার সামনে কেউ সরাসরি চোখ মিলিয়ে কথা বলতে পারত না। তারই কলার চেপে ধরেছে অথচ সে একটা সামান্য ধমক পর্যন্ত দেয়নি!

” চুপ করে গেলেন কেন? বলুন না কী করেছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত বউকে ছেড়ে দিল। উঠে বসে বলল,
” তোমার জেনে কী হবে? যাও, আরেক ঘরে গিয়ে দরজা-জানালা আটকে মরা কান্না শুরু করো। ”
” আচ্ছা, আগে কাহিনিটা শুনি? বলুন না। ”

অনেক জোরাজুরির পরে পুরো কাহিনিটা শুনতে পেল। স্বর্ণলতা ভারি রুষ্ট হয়ে বলল,
” বেশ করেছে কলার ধরেছে। ভাইয়ের সামনে বোনকে কেউ অমন বলে? ডাক্তারের জায়গায় আপনি হলে তো মেরেই বসতেন! ”
” এখানেও আমার দোষ? ”
” জি, আপনারাই দোষ। দোষের উপরে দোষ। একে তো জোর করে বিয়ে পড়াতে গিয়েছেন। তার মধ্যে মেয়ের গোপন খুঁত ধরতে চেয়েছেন। আপনি এসব থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারছেন না কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। অসন্তুষ্ট বদনে অন্যদিকে চেয়ে থাকল। স্বর্ণলতা পুনরায় বলল,
” ডাক্তারকে ক্ষমা করে দিন। আর বেহালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। তাহলেই জমিয়ে রাখা রাগটা চলে যাবে। তাহলে অন্যের উপরে অযথা রাগ ঝাড়তে হবে না। ”
” অন্যের উপরে ঝাড়ব কেন? আমি তো আমার বউয়ের কাছে ঝাড়ব। এটুকু ছাড় দেওয়া যায় না? ”
” না। একটুও ছাড় দেওয়া যায় না। পরে একটু থেকে আরেকটু হয়ে যাবে। একসময়ে দেখা যাবে, আপনি যা ছিলেন তাই হয়ে গেছেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বিরস মুখে আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিল। স্বর্ণলতার হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে বলল,
” আল্লাহ! এই রাগ থেকে আপনি আমার পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছেন? ”
” না। ”
” তাহলে? বাচ্চা চান না? ”
” না। ”
” তাই বলে নষ্ট করে দিবেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর দিকে ঘুরে বসল। চোখে চোখ রেখে বলল,
” ওটা বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ঔষধ না ঘুমের ঔষধ ছিল। যে পাপ একদিন তুমি আমাকে করতে দেওনি, সেই পাপ আজ আমিও তোমাকে করতে দিইনি। হিসেব শোধবোধ। কিন্তু এই কথা সত্য, প্রেগন্যান্সির সংবাদটা আমাকে খুশি করতে পারেনি। তোমার খুশির জন্য মিথ্যা বলতে পারতাম। কিন্তু কতদিন সেই মিথ্যা বয়ে বেড়াতাম? একদিন ঠিক ধরা খেতাম। তাই আজই বলে দিলাম। ”

স্বর্ণলতা স্বামীকে জড়িয়ে ধরল। সম্পূর্ণ মুখে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলল,
” এই মুহূর্তে আমি যতটা খুশি হয়েছি এরচেয়েও হাজারগুণ বেশি আপনি খুশি হবেন। শুধু বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আসতে দিন। দেখবেন, খুব আদর করছেন। ভালেবাসছেন। আমার থেকেও বেশি। তখন আমি হিংসে করে বলে দিব, আপনি ওর আগমনের খবর শুনে রাগ করেছিলেন। ”
” ঐ সুযোগ কখনও পাবে না। মুনছুর এই পৃথিবীতে একজনকেই ভালোবেসেছে। সেই মানুষটা তুমি। আমার বউ, আমার সোনাবউ। তোমার জন্য যেই মানুষটা পৃথিবীতে জন্মানোর সুযোগ পেল সেই মানুষটা সবসময়ই তোমার পরে থাকবে। ”

স্বর্ণলতা জবাব দিতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত সুযোগ দিল না। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে দৃঢ়ভাবে বলল,
” এই বাচ্চার জন্য যদি আগের মতো আমাকে দূরে সরিয়ে দেও বা তোমাকে তীব্র যন্ত্রণায় ভুগতে দেখি তাহলে সত্যি বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ঔষধটা খায়িয়ে দিব। এমনভাবে খাওয়াব তুমি টেরও পাবে না। তাই এতদূর ভেব না। তখন কষ্টটা দ্বিগুণ হবে। ”

চলবে