মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
1759

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
অন্তিম পর্ব

প্রেগন্যান্সির সময় যত এগুচ্ছে, স্বর্ণলতার খাওয়ার পরিমাণও তত বাড়ছে। ক্ষুধাটা সে একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। সেই সাথে তাল মিলিয়ে শরীরের স্থূলত্ব ও ওজনটাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নিয়ে মুনছুর সাখাওয়াতের কোনো অভিমত নেই। স্বর্ণলতা নিজেই বিরক্ত! আয়নায় তাকালে নিজেকে চিন্তেই পারে না যেন! একটা মানুষ হুট করে এত পেটুক হয় কীভাবে? আরেকটু মোটা হলে সে স্বামীকে ছাড়িয়ে যাবে। এটা কি শাস্তি? একটা সময়ে সে মুনছুর সাখাওয়াতকে দানব বলে আখ্যায়িত করেছিল। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে না তো! হতেও পারে। মানুষের শারীরিক গড়ন আল্লাহ প্রদত্ত। তার সৃষ্টি নিয়ে বিদ্রুপ করলে পাপ তো হবেই। সেই হিসেবে স্বর্ণলতাও পাপ করেছে। এই উপলব্ধিটা হলো প্রেগন্যান্সির ছয় মাস পরে। সাথে সাথে স্বামীর থেকে মাফ চাইল। অপরাধের বিষয়টা শুনে মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
” এই অপরাধের মাফ হবে না। ”
” কেন? ”
” মাফ করলে যদি খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়? স্বাস্থ্য কমে যায়? ”
” আমি তো সেটাই চাচ্ছি। ”
” আমি চাচ্ছি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর গাল টেনে দিয়ে পুনরায় বলল,
” তোমার এই ফোলা ফোলা গালদুটো আমার খুব পছন্দ হয়েছে। থাকুক না কয়দিন! বাচ্চা হয়ে গেলে এমনিতেই শুকিয়ে যাবে। এখন শরীরকে কষ্ট দিয়ে খাওয়া কমাতে হবে না। ইচ্ছে হচ্ছে খেয়ে নাও। শাড়ি-গয়না তো ভুল করেও চাও না। খেয়েদেয়ে নাহয় তোমার স্বামীর অর্থ ভান্ডার ফুরালে। যদিও খরচটা চোখেই পড়ে না, কিন্তু হিসাবে আসে তো। এতেই শান্তি! ”

______
সাত মাসে পা দেওয়ার পরে স্বর্ণলতা তৃতীয় বারের মতো হাসপাতালে এলো। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করল, ওজন মাপল। ডাক্তার রিপোর্ট ও ওজনের মাপটা দেখে জানাল, ওজনটা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি। কমাতে পারলে ভালো হয়। খাবার গ্রহণে আরেকটু সচেতন হতে হবে। নাহলে প্রসবের সময়ে বাচ্চা ও মা উভয়ই ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি নতুন করে খাবারের চার্ট বানিয়ে দিলেন। সেই সাথে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করার পরামর্শ দিলেন।

স্বর্ণলতা চার্ট ও পরামর্শ উভয়ই মেনে চলতে লাগল। শুরুতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে মানিয়ে যেতে লাগল। হাঁটাহাঁটিতে সঙ্গ দিল মুনছুর সাখাওয়াত। ফজরের নামাজ শেষ করে স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হাত ধরে, পায়ে পা মিলিয়ে প্রায় আধঘণ্টার মতো হাঁটে। এই সময়ে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে, আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে। নির্মল বাতাসে মন ও শরীর উভয় ঠান্ডা হয়, পুলকিত অনুভব করে।

_____
আজকে ফজরের নামাজ পড়ার সময়ে স্বর্ণলতা ঝিমুচ্ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত খেয়াল করে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়। হাঁটতে যেতে হবে না, এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এই যে, হঠাৎ নিয়মটা ছুটে গেল? স্বর্ণলতার ভালো লাগল না। সারাদিন হাঁসফাঁস করে বিকালে ঘর থেকে বের হলো। স্বামী বাসায় নেই, একা একা গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নামতে পারল না। তাই কলিকে নিয়ে উঠোনটায় চক্কর দিচ্ছে। কিছু সময় পরে ময়নাও যোগ দিল। পুরো উঠোনটা দুইবারও চক্কর দেওয়া হলো না। আচমকা মুনছুর সাখাওয়াতের আবির্ভাব হলো। মাস দুই ধরে সে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরছে। আজ বোধ হয় আরও একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। জীপটা যাথাস্থানে রেখে স্ত্রীর দিকে পা বাড়াল।

কাছাকাছি আসতে স্বর্ণলতা সালাম দিল। মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হেসে মাথা নেড়ে নীরবে উত্তরটা দিল। তারপরে সুধাল,
” বাইরে যাবে? ”
” এখন? কেউ সামনে পড়লে আমার খুব লজ্জা লাগবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আবার হাসে। পেটের দিকে তাকায়। এখানে বাচ্চা এসেছে জানার পরে মেয়েটা কত খুশি হয়েছিল! সেই খুশি এখনও বিদ্যমান। সময়ে সময়ে বাড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে লজ্জাটাও বাড়ছে যেন! কারও সাথে সেচ্ছায় দেখা করতে চায় না। ভোরবেলা হাঁটার সময়ে কেউ যদি সামনে চলে আসে হাত দিয়ে পেটটা ঢাকে প্রথমে। তারপরে স্বামীর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। এই লজ্জার কারণ মুনছুর সাখাওয়াত ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু খুব উপভোগ করে!

মুনছুর সাখাওয়াত হাসিটা ধরে রেখে জবাব দিল,
” বেশিদূর যাব না। এই বাড়ির পাশটায় ঘুরব। এদিকটায় অপ্রয়োজনে কারও আসার কথা না। তারপরেও যদি চলে আসে, আমি তোমাকে লুকিয়ে ফেলব। চলবে না? ”

স্বর্ণলতা জবাব দেয় না। ঠোঁট টিপে হেসে চোখটা অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। মুনছুর সাখাওয়াত সময় নষ্ট করতে চাইল না। ব্যস্ত গলায় জানাল,
” এখানেই থাকো। আমি তোমার বোরকাটা নিয়ে আসি। ”

ময়না ও কলি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গৃহ কর্তা দূরে সরতে বলেনি, তারাও নিজ উদ্যোগে সরেনি। মুনছুর সাখাওয়াত চলে যাওয়ার পরে ময়না বলল,
” আমি এই বাড়ি আসার পরে ছাররে কোনোদিন হাসতে দেহি নাই। দুই মিনিটও শান্ত থাকতে দেহি নাই। সারাক্ষণই রাগে গজগজ করত! আর এহন, হাসি ছাড়া কথাই কয় না। শ্যাষ কবে যে রাগ দেখাইছিল ঐডাও মনে পড়ে না। ”

স্বর্ণলতা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করে। তখনই কলি সম্মতি দিয়ে বলল,
” ঠিক কইছস, ময়না। আমগো ছারের ব্যবহার পুরাই বদলাইয়া গেছে। ”
” শুধু ব্যবহার না, কলিবু। চেহারাখানাও বদলাইয়া গেছে। কী সুন্দর দেখতে লাগে! মন চায় শুধু তাকাইয়াই থাকি। ”
” ছার আগেও সুন্দর ছিল। কিন্তু ভয়ের ঠ্যালায় মুখের দিকে তাকাইতে পারছ নাই, তাই জানতেও পারছ নাই। এহন রাগ নাই, ভয়ও নাই। তাই তাকানো যায়। ”

ময়না একটু বুঝি চমকায়। প্রবল বিস্ময় ও উৎসাহে চঞ্চল হয়ে ওঠে। উত্তেজিত কণ্ঠে সুধাল,
” আগেও সুন্দর ছিল জানলা ক্যামনে? তুমি কি ছাররে ভয় পাইতা না? আগেও তাকাইয়া দেখতা? ”
” হ। কিন্তু বেশি আগে না। ঐ গোঁফটা ফালাইয়া দেওয়ার পরে। ছারের রাগ তো তখন থেইক্যাই একেবারে কইমা গেছিল। ”
” কী কও! আমি তো খেয়ালই করি নাই। ”

দুজনের কথাবার্তা থামে না। ততক্ষণ চলল যতক্ষণ না মুনছুর সাখাওয়াত বোরকা নিয়ে ফিরে এলো। স্বর্ণলতা নীরবে ভারি মনোযোগে শুধু শুনেই গেল। বিপরীতে কিছু বলল, থামালও না। প্রশ্রয়টা বোধহয় এজন্যেই পেল।

_______
গেইটের বাইরে পা রেখে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” ওরা কত বছর ধরে এই বাড়ি কাজ করে? ”
” কারা? ”
” কলিবু আর ময়নাবু। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটু থামল। স্ত্রীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থির করে জিজ্ঞেস করল,
” হঠাৎ ওদের নিয়ে এত কৌতূহল কেন? ”
” কৌতূহল দেখানো যাবে না? নিষেধ? ”
” না। ”
” তাহলে বলুন। আমার জানতে ইচ্ছে করছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত খানিক ভেবে জানাল,
” ঠিক মনে নেই। অনেক বছর হবে। এই ধরো, পাঁচ-ছয় বছর। ”
” তাহলে তো খুব কম বয়স থেকে কাজ করছে! পরিবার নেই ওদের? ”
” আছে। ”
” দেখা করতে যায় না? ”
” না। ”
” কেন? ”
” অনুমতি নেই। ”

এই পর্যায়ে স্বর্ণলতা থামল। পা দুটো স্থির করে স্বামীর দিকে ফিরল। মুখটায় ক্ষণকাল চেয়ে থেকে বলল,
” কিনে নিয়েছেন? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” কাজে ঢোকার সময় শর্ত ছিল, আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না। ওরা মেনে চলছে। ”
” তাই বলে এত বছর ধরে আটকে রাখবেন? ওদের বুঝি পরিবারের কথা মনে পড়ে না? খারাপ লাগে না, কষ্ট হয় না? ”
” তাতে আমার কী, স্বর্ণলতা? আমি তো জোর করে আটকাইনি। সেচ্ছায় এসেছে। এমনি এমনি না, টাকা নিয়েছে। এখন ওদের খারাপ লাগছে নাকি কষ্ট হচ্ছে এসব দেখার দায়িত্ব তো আমার না। যদি থাকতে না চায়, জানাতে বলো। বিদায় করে দিই। ”

স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। পায়ের আড়ষ্টতা ভাঙল। ভাবুক চিত্তে, ছোট্ট ছোট্ট পদ ছাপ ফেলে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। সহসায় জিজ্ঞেস করল,
” বিয়ে দিয়ে দিন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণে বিরক্ত ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” হঠাৎ আমি বিয়ে দিতে যাব কেন? আমি কি ওদের অভিভাবক? ”
” যেই শর্তে এত বছর ধরে কাজ করাচ্ছেন, সেই হিসেবে অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও পেয়েছেন। পাত্র দেখুন, যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের আয়োজন করুন। ”
” কী থেকে কী বলছ, মাথায় ঢুকছে না। বিয়ে দিয়ে দিলে বাড়ির কাজ কে করবে? তোমার দেখাশোনার ভারটাও তো ওদের উপরেই পড়েছে। ”
” নতুন কাউকে আনবেন। বিবাহিত, বয়স্ক দেখে। পরিবার নেই এমন হলে আরও ভালো হয়। নাহলে ছুটির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ”
” সম্ভব না। তোমার ডেলিভারির সময় এগিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে নতুন কাউকে আনা ঠিক হবে না। ওদের সাথে তোমার বোঝাপড়া ভালো হয়েছে। কখন, কী করতে হবে এই জ্ঞানটাও আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে। আমি যদি নাও থাকি, ওরা সামলে নিতে পারবে বলেও আমার ধারণা। ”
” বেশ, তাহলে এমন কোথাও বিয়ে দিন যাতে ওরা কাজের পাশাপাশি নিজের সংসারও সামলাতে পারবে। সেই সাথে কাজের নির্দিষ্ট সময় ও ছুটির ব্যবস্থা করুন। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের এখানেও আপত্তি আছে। কিন্তু প্রকাশ করল না। মেয়েটার চোখ, মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে কোনো হেঁয়ালি করছে না। খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। এই মুহূর্তে ভিন্ন মত পেলে রেগে যাবে। তারপরে কী করে বসবে কে জানে! তাই চুপ থাকায়ই শ্রেয়। পরবর্তীতে সঠিক সময় ও সুযোগে বুঝিয়ে বলা যাবে।

______
স্বর্ণলতা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারল না। ক্লান্ত হয়ে পড়ল। পা দুটো ইদানিং ফোলা ফোলা বোধ হচ্ছে। পানি জমতে পারে। এই সময়ে প্রায় গর্ভবতীদেরই এই সমস্যাটা হয়।

এতক্ষণ মুনছুর সাখাওয়াতের হাত ধরে হাঁটছিল। গেইটের ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র মাথাটা এলিয়ে দিল। দেহের প্রায় সবটুকু ভার ছেড়ে দিতেই শুনল,
” খারাপ লাগছে? কোলে তুলব? ”
” না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কথা শুনল না। বউকে কোলে তুলে নিল আচমকা। বাড়ির উঠোন, বারান্দা, ড্রয়িংরুম সবটায় পার হলো এভাবে। কোনোদিকে তাকাল না। সোজা এগিয়ে চলল নিজেদের রুমের দিকে। কিন্তু স্বর্ণলতা? কোলে থেকেও খেয়াল করল, ময়নাকে। বারান্দা থেকে কাপড় সরাচ্ছিল। এই এক হাত দূর দিয়েই যাচ্ছিল তারা। তারপরেও একটু সরল না। অপ্রস্তুতও হলো না। কাপড় হাতে ভীষণ আগ্রহের সাথে এদিকেই চেয়ে ছিল। ঐ নিষ্পলক দৃষ্টিতে কী ছিল জানে না। কিন্তু মাথার মধ্যে কেমন করে যেন গেঁথে গেল!

________
রাতে ঘুমানোর সময়ে স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” রান্নাঘরটা সরানো যায় না? ”
” রান্নাঘর সরাবে? কেন? গন্ধের সমস্যা…”

কথাটা শেষ হলো না। পূর্বেই স্বর্ণলতা চটজলদিতে বলল,
” গন্ধের সমস্যা না। মনে হলো, ওটা এবার সরানো দরকার। আমাদের রুমের সাথেই। যেতে-আসতে চোখে পড়ে। ”
” এটাই তো ভালো। কেউ কাজে ফাঁকি দিতে পারবে না। ধরা পড়ার ভয়ে থাকবে। ”
” ওটা নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। সরাতে পারবেন নাকি তাই বলুন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। স্ত্রীর মুখের দিকে ঝুঁকে এলো। নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে সন্দেহি কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
” বিকেল থেকে দেখছি, উল্টাপাল্টা কথা বলছ। সমস্যা কী? ওরা কিছু করেছে? ”
” না। ”
” কিছু করে থাকলে বলো। একদম লুকাবে না, স্বর্ণলতা। তোমার জন্য ওদের আমি ছাড় দিয়ে যাচ্ছি। নাহলে রান্নাঘর ছাড়া আর কোথাও ওদের দেখলেই পিটাতাম। ”
” কিছু করেনি। ”
” তাহলে রান্নাঘর সরাতে চাচ্ছ কেন? বিয়েও তো দিতে চাচ্ছ। হঠাৎ এই প্রসঙ্গগুলো আসছে কেন? কিছু তো একটা হয়েছে। স্বর্ণলতা, আমি শুনতে চাই। বলো। ”

স্বর্ণলতা স্বামীর চোখে চোখ রাখল। বার দুয়েক ঢোক গিলে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” আমি ভয় পাচ্ছি। ”
” কিসের ভয়? ”

মুনছুর সাখাওয়াত চট করে বউয়ের একটা গালে হাত রাখল। আলতো চাপে আশ্বস্ত স্পর্শ রাখল। কপালে গাঢ় চুমু খেল। তারপরে নরম স্বরে বলল,
” আমি থাকতে তোমার কীসের ভয়, বউ? কিছু ঘটে থাকলে বলো। আমি ঠিক সমাধান করে দিব। একটুও রাগ করব না। কথা দিচ্ছি তো, এবার বলো। ”

স্বর্ণলতা একটু সময় নিল, দ্বিধায় ভুগল। তবুও আর লুকাল না। ধীরেসুস্থে বলল,
” বাড়িতে কোনো মুরুব্বি নেই। আমিও সুস্থ, স্বাভাবিক না। এই অবস্থায় দুটো অবিবাহিত মেয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। যদি কোনো বিপদ ঘটে? আমার ভয় করছে। ”
” ঝিগুলোর কথা বলছ? ওদের আবার কী বিপদ ঘটবে? বিপদ ঘটানোর মতো এই বাড়িতে কে আছে? বাইরে থেকে কারও আসারও সুযোগ নেই। কড়া পাহারা আছে। ”

স্বর্ণলতা বিপরীতে কিছু বলল না। নিরুত্তরই থাকল। মুনছুর সাখাওয়াত বিষয়টাকে উপেক্ষা করতে চাইল। স্ত্রীর কাছ থেকে সরতে চেয়েও সরল না। সহসায় কিছু মনে পড়েছে এমনভঙ্গিতে বলল,
” তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ? ”

সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। বউকেও তুলে বসাল। তারপরে অস্থির ভঙ্গিতে বলল,
” এই মুহূর্তটা সত্যি, স্বপ্ন না? স্বর্ণলতা, সত্যি হলে আমি খুব কষ্ট পেলাম। তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বুজল। কতক্ষণ নীরব বসে থেকে বিছানা থেকে নেমে গেল। রুমময় পায়চারি করে স্বর্ণলতার দিকে তাকাল। একস্থির, একভাবে চেয়ে থেকে পুনরায় বলল,
” মজা করছ না। সন্দেহটা একেবারে সত্যি! তারপরেও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এত বছর পরে এই চিনলে আমাকে? যদি মানছুরা হতো, চাঁদনি হতো তাহলেও কোনোভাবে নিজেকে শান্ত করতাম। ওদের ছেড়ে, বাড়ির ঝিকে নিয়ে সন্দেহ করছ। রুচিরও তো একটা ব্যাপার থাকে, স্বর্ণলতা। আল্লাহ! ধৈর্যের পরীক্ষা যে এত কঠিনও হয় জানতাম না। কী যে করব, বুঝতে পারছি না। ”

স্বর্ণলতা বিছানা থেকে নামল। ক্রমাগত হেঁটে চলা মানবটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। অতঃপর বলল,
” শান্ত হোন। আমাকে বুঝিয়ে বলতে দিন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে সরিয়ে দিল। মুখোমুখি হয়ে সুধাল,
” এখনও বুঝানোর বাকি আছে? ”

বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পুনরায় বলল,
” বিয়ের আগে হলেও মানতাম। ঐ বয়সে একটু বেপরোয়া ছিলাম। কিন্তু এখন! বিয়ের পরে! কীভাবে ভাবতে পারলে? ”
” ছেলেদের চরিত্রে ঢিলে হয় বিয়ের পরেই। ”

কথাটা উচ্চারিত হলো হালকা স্বরে, ফিসফিসের মতো। মুনছুর সাখাওয়াত পরিষ্কারভাবে বুঝল না। খেঁকিয়ে ওঠল,
” কী বলছ? জোরে বলো। আমি শুনি, তুমি আরও কী কী বলতে পার। ”

স্বর্ণলতা দুই হাতে স্বামীর খোলা বাজু চেপে ধরল। জোর করে বসাল বিছানার কিনারায়। তারপরে মুখটা দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
” শান্ত হয়ে শুনুন। আমি আপনাকে সন্দেহ করিনি। ”
” তাহলে কাকে সন্দেহ করেছ? আমি ছাড়া এই বাড়িতে আর কোনো পুরুষ নেই। ”
” কাউকে সন্দেহ করিনি। আমি শুধু একটা আশঙ্কার কথা জানিয়েছি। মাথা ঠান্ডা করে বুঝার চেষ্টা করুন। কলিবু আর ময়নাবু আমার থেকে বড় কিন্তু খুব বেশি বয়স না। তরুণী বলা যায়। এই বয়সে কি পুরুষ সঙ্গ চাইতে পারে না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। মুখ বাঁকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল অন্যদিকে। চোখের তারা, নাকের আগা ও চোয়াদ্বয়ের রাগের আভাস স্পষ্ট হয়ে আছে। স্বর্ণলতা খেয়াল করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এই মানুষটা মাঝেমধ্যে একেবারে অবুঝের মতো আচরণ করে। তখন স্বর্ণলতাকে প্রচণ্ড ধৈর্যশীল হতে হয়। নাহলে বুঝাতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে!

স্বর্ণলতা মুখটা নিজের দিকে ফেরাল না। হাতগুলোও সরিয়ে নিল। পাশে বসে ঊরুর উপরে একটা হাত রেখে বলল,
” আপনি নিজেকে দিয়ে বা আমাকে দিয়ে বুঝুন না। আমি তো সতেরো বছরেই দৈহিক চাহিদা টের পেয়েছি। সেজন্যে আপনার প্রতি আগ্রহ এসেছিল। আপনিও আমার কাছ ঘেষতে পেরেছেন। এই কাছাকাছি হওয়ার পেছনে তো শুধু ভালোবাসা ছিল না, তাই না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এখনও অবুঝ রইল। বউয়ের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সরে গেল না। খাটের কিনারায় হাঁটু ঘেষে পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বর্ণলতা একটা হাতের আঙুলের মাঝে নিজের আঙুলদ্বয় গলিয়ে দিয়ে বলল,
” আমার বেলায় আপনি ছিলেন, আপনার বেলায় আমি ছিলাম। তাই অন্যদিকে মন যায়নি। কিন্তু ওদের বেলায় কেউ নেই। মনের মধ্যে কী চলে, সেটা কি প্রকাশ না করলে বুঝব? হতেও তো পারে পুরুষ সঙ্গ তীব্রভাবে চাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। ভয়, লজ্জা দুটোয় কাজ করছে। এই চাওয়া পূরণ না হলে একদিন ঠিকই ভয় কেটে যাবে। লজ্জাও থাকবে না। তখন যদি লজ্জাজনক কিছু ঘটিয়ে ফেলে? আমি এই বিপদের কথায় বলছিলাম। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বুঝল কী বুঝেনি, বুঝা যাচ্ছে না। স্বর্ণলতা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। কোনো উত্তর না আসলে বলল,
” বেশ, আপনাকে বুঝতে হবে না। আপনি চান তো, আমি কোনো ছেলের সামনে না যাই? এখন আমিও চাই, আপনি কোনো মেয়ের সামনে যাবেন না। ”
” কোন মেয়ের সামনে গেলাম? ”
” কলিবু আর ময়নাবুর সামনে রোজ কম করে হলেও চারবার যাচ্ছেন। ওরা কি মেয়ে না? এখন তো ওরা আপনাকে ভয়ও পায় না। নির্লজ্জের মতো চেয়ে থাকে। আমার বাড়িতে এসব সহ্য করব না। হয় নিজেকে আমার মতো আগাগোড়া মুড়ে রাখুন। নাহয় রান্নাঘর সরিয়ে দিন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হতবাক হয়ে গেল। কিছু সেকেন্ডের জন্য কথাই বলতে পারল না। বিস্ময়ভাব কাটল অট্টহাসিতে। হাসতে হাসতে বলল,
” আসল কথা তাহলে এটা? স্বর্ণলতা, আমি জানতাম তোমার মধ্যে হিংসে বলতে কোনো অনুভূতি নেই। আজ সেটা ভুল প্রমাণিত হলো। ”

স্বর্ণলতা ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। কথাটা ঠিক পছন্দ হলো না। এখানে হিংসা প্রকাশ পেল কীভাবে, সেটাই ভাবছে। মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের পাশে বসল। একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরল। অন্যহাতে থুতনি ছুঁয়ে বলল,
” বিয়ে দিব, রান্নাঘরও সরাব। ”

একটু থেমে আবারও বলল,
” উহুঁ, শুধু রান্নাঘর সরিয়ে কী হবে? পুরো বাড়ির নকশায় বদলে ফেলব। তুমি শুধু বলে দাও, কেমন বাড়ি চাও। ”
” যা ইচ্ছে হয় করুন, শুধু এই ঘর আর দাদিজানের ঘরে কেউ যেন হাত না লাগায়। যতদিন বাঁচব, এ দুটোকে আমি এমনভাবেই চাই। ”

______
স্বর্ণলতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। খবরটা পেয়ে বেহালা গ্রামে ফেরত আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আসা হয়নি। মুনছুর সাখাওয়াতই মানা করেছে। জোর করে ভর্তি করানো যায়, বইপত্র কিনে দেওয়া যায়। কিন্তু মাথার মধ্যে পড়া তো ঢুকানো যায় না। এই অনিশ্চিত ছাত্রীর জন্য নিশ্চিত ছাত্রীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চায় না। মানা সত্ত্বেও বেহালা একবার এসেছিল। বান্ধুবীর সাথে দেখা করে ঢাকা ফিরে যায়। তারপরে গাড়ি চালানো শিখে নেয়। সেই যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরছে প্রায় তিন মাস পর।

বিলের কাছের ব্রিজটা পাকা কিন্তু খুব চওড়া নয়। দুটো বিপরীতমুখী বড় গাড়ি একসাথে যেতে পারে না। একটাকে থামাতে হয়। বেহালা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, তাই সেই এগিয়ে গেল। ধীর গতিতে এগুতে এগুতে জীপটার দিকে তাকাল। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে চেয়েই সালাম দিল। সে ফিরল ঠিকই কিন্তু উত্তর নিল না। বেহালা গাড়িটা থামিয়ে পুনরায় কথা বলল,
” ভাইয়া, ভালো আছেন? ”
” আবার থামলি কেন? উড়িয়ে দিব? ”
” খুব তাড়া দেখছি। কোথায় যাচ্ছেন? ”
” তুই এত বেশি কথা বলিস কেন? গাড়ি স্টার্ট দে। নাহলে সত্যি উড়িয়ে দিব। মাথা-টাথা ঠিক নেই। ”

বেহালা এবার সত্যি ভড়কাল। মুখটা ফিরিয়ে নিল গাড়ির ভেতরে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পূর্বে আরও একবার তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। চোখে, মুখে সে কী উৎকণ্ঠা! বার বার পেছনে তাকাচ্ছে। এতক্ষণে বেহালাও পেছনে দেখার চেষ্টা করল। সাথে সাথে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল। চলন্ত গাড়িটা আচমকা ব্রেক কষলেও খানিকটা এগিয়েই গেল। সেই অবস্থায় ঝটপটে দরজা খুলে নেমে পড়ল। জীপের পেছনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” স্বর্ণা! কী হয়েছে ওর? ”

স্বর্ণলতার সাথে ময়না ও কলিও আছে। একজন জবাব দিল,
” ব্যথা উঠছে, আপা। ”
” কখন? ”
” সকাল থেইক্যা! ”
” আল্লাহ! এতক্ষণে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ”
” হাসপাতালে। ম্যাডামে কইছিল, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে। ছার রাজি হয় নাই। ”
” কেন? ”

এই প্রশ্নের উত্তর শোনার সময় হলো না। বেহালার ব্যক্তিগত সাদা রঙের গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। সে আওয়াজ পেয়ে পাশ ফিরতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত চালাচ্ছে গাড়িটা। তার চোখে, মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চরম বিরক্ত, রাগ, দুশ্চিন্তা মিলেমিশে উদ্ভ্রমের মতো দেখাচ্ছে। বেহালা গাড়ির পেছনে দৌড় দিল। শাড়ি পরায় অভ্যস্ত বলে একটুও পায়ে আটকাল না।

গাড়িটা থামল ঠিক ব্রিজের শেষ মাথায়। তারপরে মুনছুর সাখাওয়াত দরজা খুলে নেমে এলো। নিজের জীপের দিকে হাঁটা ধরল। ততক্ষণে বেহালা কাছে পৌঁছে গিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” স্বর্ণাকে আমার গাড়িতে তোলেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কোনো প্রত্যুত্তর করল না। একবার চেয়েও দেখল না। ঘন ঘন, বড় বড় কদম ফেলে ব্যস্তভঙ্গিতে ছুটছে নিজের জীপের দিকে। সেই অবস্থায় পুনরায় বলল,
” কী রোদ দেখছেন? ওর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। হাসপাতাল যেতে কম করে হলেও এক ঘণ্টা লাগবে। আপনার জীপ জোরে চালাতে খুব ঝাঁকি খাবে। স্বর্ণার প্রসবব্যথা বেড়ে যাবে। বাচ্চাটারও ক্ষতি হতে পারে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের জীপের দরজা খোলায় ছিল। এক লাফে উঠে বসল। স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে বলল,
” তুই দশ মিনিট দেরি করে দিয়েছিস। দোয়া কর, স্বর্ণলতা যাতে সুস্থ থাকে। নাহলে থাপড়ে তোর দম বের করে ফেলব। ”

বেহালা জীপের জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল। একটা হাত চেপে ধরে বলল,
” পাগল হয়েন না। আমার কথাটা শুনুন। একটা মিনিট ভাবুন তো! নাহলে পরে আফসোস করেও লাভ হবে না। স্বর্ণার অবস্থা দেখছেন? যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে। এই মুহূর্তে একটু আরাম দরকার। যেটা এই জীপে পাচ্ছে না। সাহসও দরকার, ওটা তো আপনি। আমি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ওর কাছে বসুন। আপনিই তো স্বর্ণার একমাত্র অবলম্বন। এই সময়ে আপনাদের কাছে থাকা খুব প্রয়োজন। ভাইয়া, নেমে আসুন। দেরি করবেন না। নামুন। ”

জীপটা ছুটতে লাগল। ব্রিজটা পার হয়েই থেমে গেল। বেহালা ঝটিতে পেছন ঘুরল। সাথে সাথে লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটদুটো হেসে ফেলল। পাগলটাকে বুঝাতে পেরেছে!

_______
স্বর্ণলতাকে সিজারিয়ান বিভাগে ঢোকানো হয়েছে। বেহালা ও মুনছুর সাখাওয়াত বাইরে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ একজন নার্স বেরিয়ে এলো। পেশেন্টের নাম নিয়ে অভিভাবকের খোঁজ করছে। নার্সটি মুনছুর সাখাওয়াতের কাছেই, এক ডাকেই সাড়া দেওয়ার কথা। কিন্তু তেমন কিছু হচ্ছে না। মাথা তুলে দৃষ্টি নাড়িয়ে দেখছে না পর্যন্ত। বেহালার ফোনে কল এসেছিল। ভাইয়ার কল। বাড়ি না গিয়ে যে, হাসপাতালে এসেছে তথ্যটা জানানো দরকার। তাই একটু সরে গিয়ে কথা সারছিল। নার্সের ডাকটা প্রথমে শুনতে পায়নি। যতক্ষণে শুনল ততক্ষণে নার্স চরম বিরক্তে পৌঁছে গিয়েছে। সে খেয়াল করে মোবাইল কানে নিয়ে দৌড়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াতকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
” উনি অভিভাবক। পেশেন্টের হাসবেন্ড হয়। ”

নার্সের বিরক্ত এবার রাগে পরিণত হলো। প্রয়োজনটা ধমকের সুরে জানাল। এতেও মুনছুর সাখাওয়াতের মধ্যে একবিন্দু বিকার দেখা গেল না। টুলে বসার পরে সেই যে দৃষ্টি মেঝেতে স্থির করেছে, সেই দৃষ্টি আর সরেনি। কাঁপছেও না। মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটো পায়ের মাঝে পড়ে আছে। চওড়া টানটান বুকটা একেবারে শিথিল হয়ে গিয়েছে। বেহালা একদেখায় বুঝে ফেলল, এই মানুষটার শুধু শরীরই এখানে পড়ে আছে। চিত্তচেতনা হারিয়ে গিয়েছে অন্য কোথাও। যেখানকার ঠিকানা স্বয়ং মুনছুর সাখাওয়াতও জানে না!

বেহালা কাছে এগিয়ে এলো। কাঁধে আলতো হাত রেখে উঁচুস্বরে ডাকল,
” ভাইয়া? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভীষণ চমকাল। সর্বাঙ্গ এত ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে ওঠল যে, বেহালা ভয়ে হাত সরিয়ে ফেলল। এক কদম পেছনে সরে দাঁড়িয়ে দেখল, মাথাটা তুলেছে। তার দিকেই জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়েও আছে। মুখোভঙ্গি, চাহনি সবকিছুই শিশুসুলভ ঠেকছে। দুনিয়াতে মাত্রই পদার্পণ করেছে, এখনও জানা বা দেখা হয়নি কিছু। সেই কাজ সারতেই প্রবল আগ্রহে নিষ্পাপ চোখে চেয়ে আছে বেহালার দিকে। এই রূপ একেবারে অচেনা, ভাবনাতেও আসেনি কখনও। বেহালার সয়ে নিতে খানিক সময় লাগল। সেকেন্ড কয়েক পরে নরম স্বরে জানাল,
” উনি আপনাকে কিছু বলেছে। শুনেছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে দুইপাশে মাথা নাড়ল। বেহালার বিস্ময় এবার আকাশ ছুঁলো। যেই মেয়ের জন্য এত পাগলামি সেই মেয়ের জীবন-মরণ লড়াইয়ে পাশে থাকবে কী, মাথা থেকেই পুরো বেরিয়ে গিয়েছে। ভালোবাসা মানুষকে এমন বিস্ময়কর পরিবর্তনও দেয়?

নার্সের সাথে বেহালা কথা বলল। বিরাট দায়িত্ব, কঠিনও। অভিজ্ঞ কেউ হলে ভালো হয়। তার মতো অল্প বয়সী, তন্মধ্যে মেয়ে! সামলাতে পারবে না। হিমশিম খেতে হবে। যদি ছুটাছুটির প্রয়োজন হয়? মুনছুর সাখাওয়াতকে একা রেখে যেতেও ভয় হচ্ছে। এত নীরবতা ভালো লক্ষণ নয়। দুনিয়ায় না থেকেও দুনিয়া লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। অতীতটা তো অজানা নয়!

নার্স ভেতরে ঢুকে পড়তে বেহালা আরও একবার এগিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াতের উদ্দেশ্যে বলল,
” ইকবাল ভাইকে খবর দেননি? উনি এখনও আসছেন না কেন? আপনার খুব কাছের তো! ”

এই প্রশ্নের জবাব এলো না। মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বের মতো দিন-দুনিয়া ভুলে মেঝের দিকে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। বেহালা শরীরে হাত রাখতে গিয়েও রাখল না। চট করে নিজের ফোন থেকে ভাইয়ার নাম্বারে কল দিল। ধরতেই বলল,
” সিজারিয়ান বিভাগের দিকে আয় তো। খুব দরকার। ”

_____
ডাক্তার আল হাদি এই হাসপাতালেই আছে। নিজ কাজে বেজায় ব্যস্ত। একের পর এক রোগী দেখছিল। এক মিনিটের জন্য বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগ নেই। কেবিনের বাইরে লম্বা লাইন! তিনটের মধ্যে লাইনটা ছাটাই করতে হবে। গুরুতর ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও বোনের ডাককে অগ্রাহ্য করতে পারল না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেহালার সামনে উপস্থিত হলো। তারপরে বলল,
” বাড়ি না গিয়ে এখানে কী? এক্সিডেন্ট করিসনি তো? কোথায় লেগেছে দেখি? ”

মুহূর্তের মধ্যে অস্থির হয়ে পড়ল। প্রবল দুশ্চিন্তায় গ্রাস করে নিল গম্ভীর, শান্ত, পরিচ্ছন্ন মুখটা। বোনের হাতটা পরখ করে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠতেই শুনল,
” কিছু হয়নি আমার। ”
” তাহলে? ”

বেহালা দৃষ্টি সরিয়ে নিল টুলে বসা অন্যমনস্ক পুরুষটার দিকে। তারপরে বলল,
” উনার মনে হয় তোমার সাহায্য লাগবে। ”

ডাক্তার আল হাদি বোনের ইশারা করা মানুষটার দিকে তাকাল। সাথে সাথে চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো। প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বলল,
” যে একাই চারটা গ্রাম মাথায় তুলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার আবার অন্যের সাহায্য লাগে নাকি! ”
” লাগে রে, ভাইয়া। অন্তত এই মুহূর্তে লাগবেই। ”
” কেন? কী হয়েছে? মরে যাচ্ছে নাকি! ”
” ওরকমই। ”

উত্তরটা দেওয়ার সময়ে বেহালা হেসে ফেলল। এই পরিস্থিতিতে হাসিটা বড্ড অশোভন লাগছে। সে জানে, বুঝছেও। তবুও হাসিটা আটকে রাখতে পারল না। মন ভরে হেসে নিয়ে ভাইয়াকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে দিল। ডাক্তার আল হাদি দায়িত্ব পালনে বাধ্য হলো মিনিট কয়েক গড়াতেই।

______
ঘণ্টা কয়েক পরে স্বয়ং ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। তার হাতে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু। ফুলের মতো নরম, টকটকে ছোট্ট দেহখানা। বেহালা দৌড়ে এলো। মুখখানা দেখেই চোখে পানি চলে এলো। আনন্দের অশ্রুতে চিকচিক করা দৃষ্টিটুকু বাচ্চার দিকে নিবদ্ধ রেখেই সুধাল,
” কোলে নেওয়া যাবে? ”
” এজন্যই তো এলাম। পেশেন্ট তো পারলে আমার গলায় ছুরি ধরে! শরীরে শক্তি নেই বলে বেঁচে গেলাম। এখন বলুন, বাচ্চার বাবা কে? তার কোলেই দিতে বলেছে। ”

বেহালার আনন্দ বাড়ে। চোখ ছেড়ে পুরো মুখে বিস্তীর্ণ হয়। চাপা হেসে হাত উঁচিয়ে টুলের পুরুষটির দিকে ইশারা করে। কিন্তু ডাক্তারের পূর্বে সেই কাছে এগিয়ে গেল। তার ধ্যান ভাঙতে হলো শরীরে স্পর্শ করেই। আরও একবার চমকে শরীর ঝাঁকি দিল। বেহালা দ্রুত বলল,
” বাবা হয়ে গেছেন! মুখটা তুলে হাতটা পাতুন। ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে হবে তো! ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখ তুলল। কিন্তু হাত পাতল না। ডাক্তার বাচ্চাটাকে এগিয়ে দেওয়ার পরেও সে কোলে নিল না। শুধু এক ঝলকের জন্য মুখটায় তাকাল। তারপরে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে অনড় ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠল,
” আমার বউ কোথায়? ”
” ভেতরেই আছে, স্যার। কোথাও পালিয়ে যায়নি। সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। নরমাল ডেলিভারি হওয়ায় জ্ঞানটাও…”

শেষের কথাগুলো শোনার ধৈর্য হলো না। কারও অনুমতির পরোয়া না করে মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেহালা সেদিকে চেয়ে থেকে ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমার যদি কখনও বিয়ে করার ইচ্ছে হয়, তাহলে উনার মতো ছেলে খুঁজে দিবি, ভাইয়া। নাহলে বিয়েই করব না। ”

ডাক্তার আল হাদি ভারি অসন্তুষ্টের গলায় দৃঢ়ভাবে বলল,
” করিস না। তবুও জান থাকতে এমন অসৎ, ক্ষমতা ও অর্থ লোভী, বেয়াদব ছেলের কাছে তোকে বিয়ে দিব না। ”
” তোর চোখে শুধু খারাপটায় পড়ে কেন? ”
” খারাপ আছে তাই পড়ে। ”
” কোনো খারাপ নেই। একসময় ছিল, তখন স্বর্ণা উনার জীবনে ছিল না। স্বর্ণাকে বিয়ে করার পরে পুরো বদলে গিয়েছে। ”
” শুধু বদল দেখেই পাগল হয়ে যাস না। এর পেছনে স্বর্ণাকে কত কী বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেটা আমার চেয়েও ভালো তোর জানার কথা। বান্ধুবী হয় তো! ”
” সেই বিসর্জনে কী পরিমাণ সুখ লুকিয়ে আছে সেটাও জানি, ভাইয়া। বিয়ের পরে স্বর্ণার সাথে আমার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। সেটা আবারও শুরু হলো কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পরে। বিভাগ বদলে ফেলায় দেখা-সাক্ষাৎে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু যতটুকু হয়েছে, যতটা সময় ওকে পেয়েছি ততটুকু সময়ে আমি শুধু মহাজনের সম্পর্কে শুনেছি। স্বর্ণা মুখ খুললে শুধু উনার কথায় বের হতো। তখন যদি ওর মুখটা একবারের জন্য দেখতি, ভাইয়া! নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বউটাকে দেখছিস। ”

ডাক্তার আল হাদির বিরক্তের ভাবটা মিলিয়ে যাচ্ছে। বেহালা আরও বলল,
” বিয়ের পরে স্বর্ণার সাথে তোর অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। কিন্তু কখনও ওর মধ্যে সুখীভাবটা খুঁজিসনি, সবসময় দুঃখে পীড়িত অসুখীভাবটা খুঁজেছিস। আর মহাজনকে বকেছিস, খারাপ ব্যবহার করেছিস। এক বারের জন্যও বুঝার চেষ্টা করিসনি, আসলেই উনি ওসবের যোগ্য কি না! এই নিয়ে কিন্তু স্বর্ণা তোর উপরে খুবই বিরক্ত। রেগেও আছে। শুধু স্বামীর নিষেধ মেনেছে বলে রাগটা ঝাড়তে পারেনি। তবে অভিযোগ করেছে আমার কাছে। ”
” আমার নামে অভিযোগ করেছে? ”
” হুম। বকতেও বলেছে। কী কী বলে বকব সেগুলোও শিখিয়ে দিয়েছে। ”
” শুনি, কী কী শেখাল! ”

বেহালা শুনাল না। মিষ্টি করে হাসল। ভাইয়ের একটা হাত ধরে বলল,
” আমি জানি, তুই স্বর্ণাকে এখনও ভালোবাসিস। সেই সাথে এটাও বিশ্বাস করিস, তোর কাছে বিয়ে হলে খুব সুখে রাখতি। আমিও বিশ্বাস করি, কিন্তু ওর সুখ লেখা ছিল অন্য কারও সাথে। সেটাই পেয়েছে। এখানে তোর, আমার কিছু করার নেই। এখন শুধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নে, স্বর্ণা সুখে আছে। দেখবি, তোর হৃদয়ের গুপ্ত অনুতাপ, আক্ষেপ সব মিটে গেছে। ”

______
স্বর্ণলতা স্বামীকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল,
” আপনার হাত খালি কেন? আমাদের বাচ্চা কোথায়? ”
” জানি না! ”

মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের কাছে বসল। নিবিড় দৃষ্টিতে মুখটায় চেয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে একটা হাত ধরে বলল,
” কষ্ট কমেছে? ”

স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। বিরক্তে চোখ, মুখ কুঁচকে বলল,
” আপনি কোলে নেননি? ”
” না। ”
” কেন? ”
” ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল, আম্মুকে দেখছি। শুধু মাপে ছোট। ”
” কী বলছেন! ডাক্তার যে বলল, আমার ছেলে হয়েছে? ”
” ছেলেই তো। ”
” তাহলে আম্মুকে দেখবেন কেন? ”
” বোকার মতো কথা বলছ কেন? ছেলেরা কি শুধু ছেলেদের মতোই দেখতে হয়? মেয়েদের গড়ন পায় না? ”
” পায় তো। আপনিও পেয়েছেন। দাদিজানের কাছে শুনেছি, আপনি দেখতে আপনার আম্মুর মতো হয়েছেন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। হাতটা সরিয়ে নিল। দৃষ্টিও নামিয়ে ফেলল। আম্মুর প্রসঙ্গ এলে তার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে! ভালো লাগে নাকি খারাপ লাগে বুঝতে পারে না।

স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” ছেলের কানে আজান দিছেন? ”
” না। ”
” পারেন না? ”
” পারি। ”
” তাহলে দেননি কেন এখনও? ”
” আমাকেই দিতে হবে? ”
” না। আপনি ছাড়া সবাইকে দিতে হবে। ছেলে তো সবার ভাগে চলে গেছে, তাই না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
” পেট থেকে বাচ্চাটা বেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু মেজাজ থেকে খিটখিটে ভাবটা বেরোয়নি। আর কতদিন সহ্য করব? ”
” সারাজীবন। ”

_______
বেহালা বান্ধুবীর সাথে দেখা করেছে। এবার বাড়ি যেতে হয়। সে মহাজনের থেকে বিদায় নিতে চাইল। মুনছুর সাখাওয়াত ফোনালাপে ব্যস্ত আছে। বেহালা পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে কথাটা শুনল,
” কীভাবে সম্ভব জানি না, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে আমার গাড়ি চাই। লাল রঙেরই হয় যেন। নাহলে তোকে গাড়ির নিচে ফেলে পিষব বলে দিলাম! ”

বেহালা হেসে ফেলল। নীরবতা ভেঙে বলল,
” আমার গাড়িতে উঠে মান গেছে নাকি, ভাইয়া? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মোবাইল হাতে মাথা ঘুরাল। সাথে সাথে শুনল,
” যে গাড়ি গ্রামের পথে চললেই আপনার মান যেত সেই গাড়িতে চড়ে হাসপাতাল এসেছেন, মান তো যাওয়ারই কথা। গাড়ি ভাঙা পাগলটা তাহলে আপনিই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কিছু না বলে সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল। একপা এগিয়ে ফিরে চাইল। বলল,
” গাড়িটা আসতে দে। তারপরে তোকে দিনের মধ্যে দুই বেলা বাড়ি টু হাসপাতালে, হাসপাতাল টু বাড়িতে চক্কর দেওয়াব। ”
” এতে যদি আপনার মান ফিরে, তাহলে আমি রাজি। কিন্তু ভাইয়া, গাড়ির রঙটা বদলালে ভালো হতো না? লাল রঙটা দেখতে খুবই বিশ্রী লাগবে। ”
” তোর চোখে বিশ্রী লাগলেই কী, আর সুন্দর লাগলেই কী। যার জন্য গাড়ি নিচ্ছি তার পছন্দ হলেই হলো। ”
” রংটা কি স্বর্ণা পছন্দ করেছে? ”
” না। কিন্তু ওর পছন্দের রং লাল। ”

_______
মাঝরাতে বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। কান্না শুনে স্বর্ণলতা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। বাবুর মুখে দুধ দিতেই কান্না থেমে গেল। স্বর্ণলতা বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। সহসায় চোখটা খুলে যায়। সামনে তাকাতে দেখে মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে চেয়ে আছে। তার এত লজ্জা লাগল! চট করে বাচ্চাসহ অন্যদিকে ফিরে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” ওদিকে ফিরলে কেন? আমি কি বাইরের মানুষ? নাকি তোমার শরীরের কোনো কিছু দেখা বাকি আছে? ”
” চুপ করে ঘুমান তো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ঘুমাল না। উঠে বসল। গাঢ় চোখে চেয়ে রইল স্বর্ণলতার ঘাড়ে। চুলের বেনিটা ঢিলে হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে ছোট ছোট চুলগুলো বাঁধন মুক্ত হয়ে পড়েছে। ঘামে ভিজে বিছিয়ে আছে ফর্সা মসৃণ চামড়ায়। মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এসে ঠোঁট ছুঁয়াল তার প্রিয় ও প্রার্থিত স্থানটায়। তারপরে অনুযোগের মতো বলল,
” সেই কবে দেখেছি! এতদিনে ভুলেই গেছি সব। আজ একটু দেখতে দাও না, বউ। চল্লিশ দিন শেষ হয়নি? আমার তো মনে হচ্ছে, প্রতিদিনই চল্লিশ দিন করে শেষ হচ্ছে। ”
” ছেচল্লিশ দিন হয়েছে। ”
” সত্যি? বলোনি কেন? ”
” আমি ভাবলাম, আপনি হিসাব রাখছেন। ”
” রাখছিলাম তো। কিন্তু হাজার পেরিয়ে এসেও শুনি, আটদিন হয়েছে। ভালো লাগে, বলো? তারপর থেকে বাদ দিয়েছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা থেকে নামল। হাত পেতে বলল,
” দাও, কলির কাছে দিয়ে আসি। ”
” চুপচাপ বসে থাকুন, আমি দিয়ে আসছি। ”

________
দীর্ঘ সময় পরে স্বামীর গাঢ় স্পর্শ পেয়ে স্বর্ণলতা খুব কাঁপছিল। লজ্জায় মুচড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে পুরোপুরি মেলে দিবে ঠিক তখনই মুনছুর সাখাওয়াত সরে গেল। স্বর্ণলতা ঘন ঘন শ্বাস ফেলে সুধাল,
” কী হয়েছে? ”
” তোমার ছেলে কাঁদছে। যাও, নিয়ে এসো। ”

স্বর্ণলতাও নিজেকে দ্রুত সামলে নিল। কাপড় ঠিক করতে করতে বলল,
” কোথায় কাঁদছে? আমি শুনতে পাচ্ছি না তো। ”
” আমি পেয়েছি। যাও। ”

বাচ্চাটা সত্যি কেঁদেছিল। কিন্তু খুবই অল্প সময়ের জন্য। এক কোল থেকে আরেক কোলে যেতে যতক্ষণ লাগে ততক্ষণের জন্য। স্বর্ণলতা এত আশ্চর্য হলো! এটুকু কান্নাও মানুষটা শুনে ফেলল? ঐরকম চরম মুহূর্তে!

মুনছুর সাখাওয়াত পাঞ্জাবি পরে বিছানায় বসে ছিল। বাবুকে বাড়ি আনার পরে মানুষটা একটু ভদ্র হয়েছে। রাতে ঘুমানোর সময়েও পাঞ্জাবি খুলে না। স্বর্ণলতা কোলের উপরে বাবুটাকে রেখে বলল,
” আমি ঘুমালাম। বাবা, ছেলে কেউ বিরক্ত করবেন না। ”

সে সত্যি শুয়ে পড়ল। চোখ বুজতেই শুনল,
” অন্যের বাচ্চারা কেঁদে বুঝায় আমি ওদের পছন্দ করছি না। আর তোমার ছেলে প্রস্রাব করে বুঝায়! চিন্তাভাবনা এত নিম্ন পর্যায়ে কেন? কার স্বভাব পেয়েছে? ”

স্বর্ণলতা চোখ বুজেই জবাব দিল,
” এত তোমার ছেলে, তোমার ছেলে বলেন কেন? আপনার কিছু হয় না? ”
” হয় তো, আমার রক্ত। ”
” নামটাম রাখবেন না নাকি? ”
” রাখো। মানা তো করিনি! ”
” আপনি রাখুন। ”
” ভুলেও না। মুতে-টুতে শরীরে গন্ধ করে দেয় যে, তার নাম আমি ভুল করেও রাখব না। পেটে থেকেই যড়যন্ত্র করেছিল, তোমার কাছে যেতে দিবে না। হাত, পায়ে জোর আসেনি তাই আসল যন্ত্র ব্যবহার করছে! এরকম ফাজিল আমার বাপ-দাদার বংশে কেউ ছিল না। ”
” বাপ-দাদা টানছেন কেন? আপনি নিজেই তো এমন ছিলেন। ভুলে গেলেন? গল্পটা তো নিজেই বলে ছিলেন! ”

স্বর্ণলতা আর কোনো কথা বলে না। ঘুমানোর চেষ্টা করে। চোখ বুজেও টের পায় বাচ্চাকে বিছানায় শুয়িয়েছে। দুই মিনিট যেতেই বাচ্চাটা কেঁদে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত বউকে ডাকল। একবারই! সাড়া না পেয়ে ছেলের দিকে মনোযোগী হলো। অসহায় গলায় নিচু স্বরে বলল,
” আরাম করে ঘুমানোর জন্যই তো বিছানায় শুয়ালাম। উঠে গেলি কেন? এখন আমি কীভাবে তুলব? হাতে ধরব নাকি পায়ে? যে নরম হয়েছিস! হাড়-টাড় কিছুই তো টের পাই না। যদি গলে যাস? খুলে গেলেও তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোর মায়ের যে মেজাজ হয়েছে! আমাকে আগুন ছাড়ায় পুড়িয়ে দিবে। থাম না, বাপ! মা বিরক্ত হচ্ছে তো। ঘুমাতে দে। জেগে গেলে কিন্তু খুব মারব। তোর মাও বাঁচাতে পারবে না। ”

স্বর্ণলতা মৃদু চোখ মেলে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আর হাসে। কোলে নিতে পারছে না বলে নিজেই উপুড় হয়ে ছেলের বুকের সাথে মিশে আছে। হাত, পা খুলে যাওয়ার ভয়ে মরছে কিন্তু নিজের বিশাল দেহটা ছোট্ট দেহে মিলাতে ভয় পাচ্ছে না। একটু অসাবধান হলে তো সত্যি গলে যাবে! আশঙ্কটা মাথায় এলেও স্বর্ণলতা ঘাবড়াল না। কারণ, সে জানে বেহুঁশের মতো আদর করার সময়ে বউয়ের দেহে ভার ছাড়ার ব্যাপারে যে মানুষটা সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে পারে, সেই মানুষটা হুঁশে থেকে আপন রক্তের দেহে ভার ছাড়ার ব্যাপারে আরও কঠোর সতর্ক অবলম্বন করতে পারে।

স্বর্ণলতা অন্যপাশ ফিরতে ফিরতে বলল,
” ভুল করেও আদর করবেন না। তাহলেই কিন্তু আমি বলে দিব, আপনি ওর আগমনে অখুশি ছিলেন। কয়েকবার মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমাকে খুব জ্বালিয়েছেনও। ”
” ছেলে মাকে আদর করতে দিবে না। মা ছেলেকে আদর করতে দিবে না। তাহলে আমি তোমাদের সাথে থাকছি কেন? বেরিয়ে যাই। ”
” যান। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ছেলের কাছ থেকে সরে গেল। বিছানা থেকে নেমে হাঁটা ধরল দরজার কাছে। বের হতে গিয়েও বের হলো না। শরীরের পাঞ্জাবি খুলে মেঝেতে ঢিল মারল। চরম বিরক্তের রূপে ঠোঁট থেকে শব্দটা বেরিয়ে এলো,
” ধ্যাৎ! ”

স্বর্ণলতা হেসে ফেলল। শব্দ করে। হাসতে হাসতে উঠে বসে বলল,
” আমি দরজা খুলে দিব? ”
” দাও, নামাজ-টামাজ পড়ছ না তো তাই হৃদয়ের দয়ামায়াও ফুরিয়ে গেছে। নাহলে অসুস্থ মানুষকে কেউ বের করে দিতে পারে! ”

স্বর্ণলতার হাসি থেমে গেল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
” আপনি অসুস্থ নাকি? কী হয়েছে? বলেননি তো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত নিজের গলায় হাত ছুঁয়িয়ে বলল,
” বিশ্বাস না হলে এসে দেখে যাও। ”

স্বর্ণলতা প্রায় দৌড়ে এলো। খালি শরীরে হাতিয়ে বলল,
” আল্লাহ! জ্বরটা কখন এলো? পাশেই তো শুয়ে ছিলেন। একবারও টের পাইনি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত দুই হাতে স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরল। তারপরে কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিসে গলায় বলল,
” সংসার করছ, বাচ্চা পালছ তারপরেও জ্বরের তাপ কোনটা আর আদরের তাপ কোনটা বুঝে উঠতে পারলে না! ”

সমাপ্তি