#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৪)
খাইরুন নিসা একমনে তসবিহ গুণছেন৷ হাতের আঙুল কাঁপছে, ঠোঁট নড়ছে অনবরত। বৃদ্ধত্ব চোখজোড়া বুঁজে ছিল, আচমকা খুলে গেল। তসবি পাঠ বন্ধ করে ঘাড়টা ফিরালেন জানালার দিকে। তার কক্ষে দুটো বড় জানালা। একটি দিয়ে বাড়ির উঠোন ও মূল ফটক পর্যন্ত দেখা যায়। তিনি জায়নামাজে বসেই বাহিরে তাকালেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার! মূল ফটক তো দূর, উঠোনটাও দেখা যাচ্ছে না। বাইরের বাল্ব জ্বালানো হয়নি এখনও? বিরক্তে চোখ, মুখ কুঁচকে এলো। অন্তরের অশান্তিটা বাড়ছে। দুশ্চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মস্তিষ্ক। দুপুরের দিকে খবর পান একমাত্র নাতি মুনছুর সাখাওয়াত বিয়ে করছেন। খবরটা বাতাসে ভর করে এসেছে। সরাসরি কেউ বলেনি। এই নিয়ে যে, নাতির সঙ্গে কথা বলবেন সেই উপায়ও নেই। ভোর থেকেই মুনছুর সাখাওয়াত নিরুদ্দেশ। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে, পাহারাদার আবুলকে বাড়ির বাইরে পাঠান নাতির খোঁজে। দেখা হলেই জানাবে, দাদিজান জরুরি তলব করেছে। সে আবুলটা এখনও ফিরেনি। সে কি গ্রাম ছেড়ে শহরে পৌঁছে গেল? খাইরুন নিসা জপমালাটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। জায়নামাজ তোলার জন্য উপুড় হবেন, তখনই শুনলেন,
” ছার আইছে, আম্মাজান। আপনারে ডাকে। দরজায় খাড়াই আছে। ”
গলাটা রুমকির। সে মধ্যবয়স্কা। খাইরুন নিসার একমাত্র ব্যক্তিগত পরিচারিকা। আচম্কা আগমন ও কণ্ঠস্বরে তিনি থমকে গিয়েছিলেন। বুকের মধ্যে চাপও পড়েছিল। নিঃশ্বাস আটকে যায়। কিছু সময় নীরব থেকে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন। এই সুযোগে রুমকি ভেতরে প্রবেশ করে। জায়নামাজে হাত দিতেই তিনি ধ মকে ওঠলেন,
” ধরবি না। দূরে যা। কতবার বলেছি, আমার অনুমতি ছাড়া আমার জিনিসে হাত দিবি না? ”
সে দূরে সরে গেল। মাথা নামিয়ে মিনমিনে জবাব দিল,
” ভুল হইয়া গেছে, আম্মাজান। মাফ কইরা দেন। ”
প্রচণ্ড বি রক্ত ও অসন্তুষ্টের ছাপ পড়ল খাইরুন নিসার বদনে। জপমালা গলায় পড়তে পড়তে বিরস গলায় সুধালেন,
” দরজায় দাঁড়িয়ে কী করে? তার কি ঘরে ঢোকা নিষেধ? এই নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণ করার মতো কেউ কি জন্মায়ছে এই কিতাবগড়ে? ”
” না, আম্মাজান। আমার তো মনে অয়, পুরা বিশশেও জন্মায় নাই। ”
রুমকির ভীত ভাব ছুটে গেছে। তার চোখে, মুখে রসিকতার দীপ্তি। খাইরুন নিসা তার দিকে তাকাতেই বলল,
” লগে কইরা বউ আনছে তো, আম্মাজান। আপনে বরণ না করলে ঢুকায় ক্যামনে? ”
খাইরুন নিসার অন্তরের অশান্তিটা ফিরে এলো ঝড়েরবেগে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেল হঠাৎ করেই। ভেতরে ভেতরে কাঁপুনিটা সামলে ভাবছেন, খবরটা তাহলে সত্যি! মুনছুর বিয়ে করেছে। সেই বউ নিয়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আর এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারলেন না। ছুটে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। চঞ্চল পা জোড়া থামল বাড়ির মূল দরজাটার সামনে। বাইরে আলো দেওয়া হয়েছে। সেই আলোতে দুটো মুখ ঝলমল করছে। একটা মুখ তার নাতি মুনছুর সাখাওয়াতের ও অন্যটি নববধূর। তিনি নববধূর দিকে দৃষ্টিপাত করতেই শুনলেন,
” দাদিজান, ও স্বর্ণলতা। তোমার নাতবউ। এরবেশি জানার থাকলে, ফিরে এসে জানাব। ”
কথাটা বলেই মুনছুর সাখাওয়াত উল্টো ঘুরল। তার পেছনে একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে। খাইরুন নিসা তাদের মধ্যে মাত্র দুজনকে চিনলেন। একজন পান্না ও অন্যজন কাশেম। এই দুজন তার পুরোনো অনুচর।
” ফিরে এসে জানাবি মানে কী? মুনছুর তুই কি বেরুচ্ছিস? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখন ফিরবি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়াল। দাদিজানের দিকে তাকালও কিন্তু উত্তর দিল না। ভূমি কাঁপিয়ে উঠোন পার হয়ে চলে গেল। দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতেই রুমকি বলে ওঠল,
” নতুন বউ একা একা ঘরে ঢুকব, আম্মা? এডা তো ভালা না! সংসারে শান্তি আইব না। ছার রে থামান। ”
খাইরুন নিসা চোখ রা ঙালেন। রুমকি নিভে গেল। একপা পেছনে সরে গেলে, তিনি আদেশ করলেন,
” মিষ্টি আর পানি নিয়ে আয়। ”
স্বর্ণলতার মুখটা বুকের কাছে ঝুঁকে আছে। মাথার ঘোমটা ভ্রূ পর্যন্ত। দাঁড়ানো ভঙ্গিতে অত্যন্ত দুর্বলতা ও ক্লান্তি। খাইরুন নিসার মনে হলো, হালকা ধাক্কাতেই পড়ে যাবে। তাই মিষ্টি ও পানি আসলে রুমকির উদ্দেশ্যে বললেন,
” মেয়েটার পাশে দাঁড়া। ”
সে পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
” আমারেও বরণ করবেন, আম্মাজান? মিষ্টি খাওয়াইবেন? চামুচ দিয়া কাটতে হইব না। হাতে দেন, হা কইরা গিল্লা ফালামু। ”
খাইরুন নিসার ইচ্ছে হলো কষে দুটো চ ড় দিতে। এত কথা বলে! বাচালতারও একটা সীমা থাকে। রুমকি মিনিটের মধ্যে সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলে। তিনি আবারও চোখ রা ঙালেন। সে মুখ ভার করে মাথা নত করে ফেলল। খাইরুন নিসা নাতবউয়ের দিকে মিষ্টি বাড়িয়ে বললেন,
” আগে বিসমিল্লাহ পড়ো। ”
স্বর্ণলতা বিসমিল্লাহ পড়তে পারল না। বড় করে নিশ্বাস টেনে আচমকা চিৎ কার করে ওঠল,
” আম্মা গো! আব্বা গো! আমারে কই পাঠাইলা? আমার তো দম আটকায় যাইতাছে! ”
তার চিৎ কারে গগন কেঁপে ওঠল বোধ হয়। সারাবাড়ির লোক জড়ো হয়ে গেল চোখের পলকে। স্বর্ণলতার এসবে হুঁশ নেই। সে দরজার সামনে বসে পড়ল। হাত-পা ছুঁড়ে বিলাপ করছে। একবার মাকে ডাকছে, একবার বাবাকে ডাকছে, আরেকবার সুবর্ণকে। আকস্মিক ঘটনায় খাইরুন নিসা বাক্যহারা হলেন। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করতে ভুলে গেছেন। অবাক হয়ে চেয়ে দেখছেন, এই বাড়ির নাতবউ, মুনছুরের পত্নী মাটিতে বসে কাঁদছে। বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছুঁড়ছে। তার চেতন ফিরল যখন স্বর্ণলতা কান্না থামিয়ে দাঁড়াল। কেউ কিছু বুঝার আগে দৌড় লাগাল বাড়ির গেইটের দিকে। রাস্তায় নেমে যাওয়ার পূর্বেই তিনি চিৎকার করলেন,
” আরে! কেউ ধর ও কে। বাড়ির বউ পালিয়ে যাচ্ছে তো। ”
ভিড়ের মধ্য থেকে তিন জন দৌড়ে গেল গেইটের দিকে। তন্মধ্যে এগিয়ে আছে রুমকি। সেই গেইট পেরিয়ে স্বর্ণলতার হাতটা ধরতে পারল। বাইরে থেকেই চিৎকার করে জানাল,
” আম্মাজান, ধরছি। তাড়াতাড়ি আহেন, ছুইটা গেল। মাগো মা, গায়ে কী জোর! ”
বাকি দুজনও পৌঁছে গেল তার কাছে। তিনজনে ধরাধরি করে স্বর্ণলতাকে উঠোনে আনল। খাইরুন নিসার প্রেশার বেড়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করছে। সমানে ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে দুর্বল গলায় বললেন,
” বউকে মুনছুরের রুমে নিয়ে আয়। ”
আদেশ করামাত্র তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। পা টিপে টিপে পৌঁছালেন নাতির রুমে। এখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। একমাত্র তিনিই যাওয়া-আসা করেন। স্বর্ণলতা তখনও কাঁদছে। গলায় শব্দ নেই। কণ্ঠটা মিইয়ে এসেছে। কিন্তু হাত-পা মেলে ছোটার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খাইরুন নিসা নাতির বিছানায় বসে পুনরায় আদেশ দিলেন,
” ও কে ভিতরে আনো। আমার কাছে বসাও। ”
স্বর্ণলতাকে দুই হাতে ঝাপটে ধরে আছে রুমকি। অন্যদের থেকে ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। আম্মাজানের সামনে বসানোর চেষ্টা করে বলল,
” বসে না তো, আম্মাজান। ”
তিনি চোখ তুলে তাকালেন ঠিকই কিন্তু দেখতে পেলেন না। সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেলেন বুঝি! বিছানায় দেহটা ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” আমার জন্য পানি আন। ”
রান্নাঘরের জন্য দুজন কাজের লোক বরাদ্দ আছে। তাদের মধ্য থেকে একজন ছুটে গিয়ে পানি আনল। দাদিজানকে সেই পানি একটু খাওয়াল ও বাকিটুকু মাথায় ঢালল। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর তিনি চোখ মেললেন। পুরোপুরি সুস্থ নাহলেও কিছুটা হয়েছেন। মস্তিষ্ক কাজ করছে, চোখেও দেখতে পাচ্ছেন। বুকের ধড়ফড় ভাব কমে এসেছে। এই অবস্থায় বুঝতে পারলেন, দুপুর ও বিকালের ওষুধ না খাওয়ার ফল কতটা ভ য়াবহ। রুমকি বার বার মনে করে দেওয়ার পরও খাননি। একটা চাপা রা গ ও জে দের বশে ওষুধের প্রতি অনাগ্রহ এসেছিল।
খাইরুন নিসা নাতবউয়ের দিকে তাকালেন। সে বসে আছে। মাথায় ঘোমটা নেই, নাকে নথ নেই। চোখের কাজল ও লিপস্টিক ল্যাপ্টে গেছে। প্রায় সবগুলো চুড়িই ভেঙে গেছে। দুই হাত মিলিয়ে টিকে আছে পাঁচটি! বুকের কাছে সরে যাওয়া শাড়িটা ঠিক করে দিয়ে বললেন,
” শান্ত হয়ে বসো। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। ”
স্বর্ণলতা ফুঁপাচ্ছে। চোখের পাতা জোড়া ভেজা। গাল ও বুক ভেসে আছে অশ্রুতে। সে জবাব দিল না, তাকালও না। শুধু হাত-পায়ের ছোটানোর চেষ্টা থামিয়ে দিল। খাইরুন নিসা এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত রাখলেন পরম স্নেহে। নরম ও আদুরে গলায় সুধালেন,
” পানি খাবে? ”
সে চোখ তুলে তাকাল। মাথা নেড়ে বুঝাল খাবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রুমকিকে আদেশ করলেন,
” যা, পানি নিয়ে আয়। ”
” আমি যামু? যদি আবার পালায়? ”
তিনি মৃদু হেসে দৃঢ়ভাবে বললেন,
” কোথাও যাবে না। তুই যা, পানি নিয়ে আয়। ”
সে অনিচ্ছায় মুখ ভার করে পানি আনতে গেল। রুমের বাইরে উপস্থিত থাকা কাজের লোক দুজনের দিকে তাকাতে, তারা চলে গেল। এই ফাঁকে খাইরুন নিসা স্বর্ণলতাকে প্রশ্ন করলেন,
” তুমি কোন গ্রামের মেয়ে? ”
স্বর্ণলতা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কাজলমাখা, ভেজা চোখের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি! তিনি হালকা হেসে বললেন,
” আমি জানি, তুমি এই গ্রামের মেয়ে নও। সেরকম হলে, আমি তোমাকে চিনতাম। ”
এরমধ্যে রুমকি ঢুকল। খাইরুন নিসা পানির গ্লাস হাতে নিলেন প্রথমে। অতঃপর স্বর্ণলতার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। স্বর্ণলতা আড়ষ্টভাবে পানি নিল। ধীরে ধীরে একটু একটু করে পুরো পানিটায় খেল। খালি গ্লাসে ফেরত দিতেই শুনল,
” তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রাম করো। ”
তিনি উঠে গেলেন। রুমকিকে নিয়ে বেরুবেন, সহসা থামলেন। এ রুমের দেয়ালে চেপে থাকা ঘড়িটায় তাকিয়ে বললেন,
” আমি কাপড় পাঠাচ্ছি। শাড়িটা বদলে নিও। মুনছুর কখন আসবে ঠিক নেই। শুধু শুধু এসব পরে বসে থাকতে হবে না। ”
খাইরুন নিসা হাঁটা ধরলেন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছেন, এ কেমন পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়লেন! মুনছুরের আকস্মিক বিয়ে, বউ ঘরে না তুলেই বেরিয়ে যাওয়া, নতুন বউয়ের ঘরে না ঢুকে পালিয়ে যাওয়া সব কয়টা ঘটনাই অস্বাভাবিক, অকল্যাণকর লাগছে।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫)
রুমকির হাতে ভাঁজ করা লালরঙা সুতি শাড়ি। সাথে একটি গয়নার বাক্স। স্বর্ণলতার পাশে রাখতে রাখতে বলল,
” আপনে আহার লগে লগেই আমার কপাল খুইলা গেছে, আপামনি। আমি ছারের রুমে ঢুকছি, পালং ছুঁইছি এইডা তো বিশ্বাসই হইতাছে না। মনে হইতাছে স্বপন দেখতাছি। আপামনি, আমারে একটা চি মটি কাটবেন? ”
স্বর্ণলতার হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজা। মিহি সুরে কাঁদছে, মৃদু মৃদু কাঁপছে। রুমকির উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ও আহ্লাদে ডুবা আবদারে মাথা তুলল হালকাভাবে। সিক্ত চোখজোড়া মেলে দেখল, সে পালঙ্কে বসে আছে। কী সুন্দর নকশা! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। স্বর্ণলতার মন ভালো হলো না। বাবার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী। কাজের স্থান শহরে। সপ্তাহের পাঁচদিন তিনি শহরে থাকেন। দুইদিন গ্রামে, পরিবারের সঙ্গে। বাড়িতে এলে তিনি ছেলেমেয়েদের গল্প শোনান। তার কাজের গল্প। গাছ থেকে কাঠ, কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র বানানো, তাতে রং ও নকশা করার কৌশল সবকিছুই বুঝিয়ে বলেন। স্বর্ণলতা ও সুবর্ণ মন দিয়ে সেই গল্প শুনত ও কল্পনা করে আনন্দ পেত। এরকম পালঙ্কের গল্পও শুনেছে অসংখ্যবার। আজই প্রথম স্বচক্ষে দেখল।
” চি মটি কাটেন না ক্যান? তাইলে কি হাচাই স্বপন দেখতাছি! ”
রুমকি হাতটা সরিয়ে নিচ্ছিল, তখনই স্বর্ণলতা আলতো করে চি মটি কাটল। সে খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠল,
” ও মা গো! এসব সত্যি? আপামনি, আমার কী যে খুশি লাগতাছে! ইচ্ছা করতাছে আপনারে নাইচা দেখাইতে। দেখামু? ”
স্বর্ণলতার ভেজা চোখজোড়ায় বিস্ময় উঁকি মারল। অবাক হয়ে দেখছে মধ্যবয়স্কাকে। পরনে মলিন শাড়ি। আঁচল কোমরে গিঁট দেওয়া। হাতে, পায়ে স্থিরতা নেই। চোখ ও ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। কী যেন একটা বলার জন্য সারাক্ষণই উতলা থাকে।
রুমকি অনুমতির পরোয়া করল না। গুণগুণ করে গান ধরল। কোমরে হাত রেখে নাচছে। কখনও কোমর দুলাচ্ছে, কখনও হাতে তালি দিচ্ছে। স্বর্ণলতার চোখের পানি শুকিয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে ভাবছে, এই বয়সেও কেউ নাচে! লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই। ভ য়ও নেই। সে গান ও নাচ একই সঙ্গে করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠল। বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে বলল,
” কেমন নাচলাম? পছন্দ হয়ছে? ”
স্বর্ণলতা উত্তর দিল না। বিস্ময়ের রেশ কাটেনি এখনও। রুমকি তার কাছে এগিয়ে এলো। গয়নার বাক্সটা সরিয়ে শাড়িটা হাতে নিল। ভাঁজ খুলতে খুলতে বলল,
” এবার শাড়ি বদলাইয়া লন। আমি সাহায্য করতাছি। ”
” পরে বদলামু। ”
তার কণ্ঠ হালকা, ক্লান্ত। চোখ নামিয়ে ফেলল নিচে। অন্যমনস্কভাবটা ফুটে উঠতেই রুমকি বলল,
” আম্মাজান কইছে, শাড়ি বদলাইয়া খাইয়া নিতে। দেরি হইলে রা গ করব। উনি কিন্তু রা গ হইলে চ ড় মারেন। আপনে কি চ ড় খাইতে চান? ”
” আমারে চ ড় মারব? ”
” মা রতেও পারে! ছারের উপর ক্ষ্যাপছে তো। উনি নাই, ঝাল তো আপনের উপরেই মিটাইব। ”
” ক্যান? আমার কী দোষ?
” ছারের লগে বিয়া বইছেন, এডাই আপনার দোষ। ”
স্বর্ণলতা একটু থামল। বুঝতে পারল, রুমকি যাকে স্যার সম্বোধন করছে, সে তার স্বামী। রুমকি তাড়া দিয়ে পুনরায় বলল,
” উঠেন তো, আপামনি। আপনে তো আমারেও চ ড় খাইয়াবেন! আমার কাজ শেষ করতে দেন। জলদি খাড়ান। ”
রুমকি জোর করে তাকে দাঁড় করাল। প্রথমে গয়নাগুলো খুলল। অতঃপর আঁচল ধরতেই স্বর্ণলতা চেঁচাল,
” আমি খুলতাছি। সরেন আপনি। ”
সে একপা সরে দাঁড়াল। স্বর্ণলতার কপাল কুঁচকে গেল। কপট রা গ নিয়ে বলল,
” বাইরে যান। আমি কাপড় বদলাইয়া আপনারে ডাক দিমু। ”
” আপনে বদলাইবেন? আম্মাজান যে আমারে পরাইয়া দিতে কইল? ”
” উনি তো দেখতাছে না! আপনি বাইরে যান। ”
” কে কইল দেখতাছে না? উনি সব দেখতে পারেন। আমাগো দুইডা চোখ, উনার চারডা। দুইডা লগে থাকে, দুইডা ঘুইরা বেড়ায়। আপনে, আমি দেখতে পারমু না। কিন্তু চোখ দুইডা আমাগো ঠিকই দেখতাছে। ”
রুমকি তার কাছে চলে এলো। আঁচলে হাত দিল আবারও। কাঁধ থেকে সরাতে সরাতে বলল,
” আমার সামনে শরম কীসের? আপনের যা, আমারও তা। শরম তো পাইবেন ছারের সামনে। ”
স্বর্ণলতা বাঁধা দিতে চেয়েও, থেমে গেল। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। চাপা গলায় বার বার বলল,
” দরজায় খিল দেন। দরজা খিল দেন। ”
রুমকি ভেতরে ঢোকার সময় দরজা লাগিয়েছিল। শাড়ি খুলতে খুলতে ঘাড় ফেরাল, যদি ভুলে থাকে! না, ভুলেনি। লাগানোই আছে। সে শাড়ি পরানোতে মনোযোগী হলো।
_______
খাইরুন নিসা এই সময়ে ঘুমান। ঘুমানোর দেড় ঘণ্টা আগে খাবার খান। আজ তার নিয়মে বিঘ্ন ঘটেছে। খাওয়া, ওষুধ, ঘুম সবকিছুতেই অনিয়ম চলছে। শরীর ঠিক নেই, মনেও শান্তি নেই। এই অবস্থায় দুটো কথা বলার মতো সঙ্গীও নেই। এত অসহায় লাগছে! মনে হচ্ছে, এই দুনিয়া ত্যাগ করতে পারলেই বাঁচেন। তিনি খাবার সামনে নিয়ে তসবিহ গুণতে শুরু করলেন। তন্মধ্যে স্বর্ণলতা ঢুকল খাবার ঘরে। তার পেছনেই রুমকি। বাহু চেপে ধরে আছে। তার হাব-ভাবে বুঝা যাচ্ছে, ছেড়ে দিলেই স্বর্ণলতা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।
” বসো। ”
খাইরুনন নিসা চোখ বুঁজে ছিলেন। পেছন না ফিরে আদেশ দিয়েছেন। রুমকি ফিসফিসে বলল,
” দেখছেন? না দেইখা বুইঝা ফালাইছে, আমরা আইছি। চোখ দুইডা মনে হয়, আমগো লগেই ঘুরতাছে! ”
স্বর্ণলতাকে ছেড়ে দিল সে। আম্মাজানের পাশের চেয়ারটা টেনে বসিয়ে দিল তাকে। সামনের প্লেট উল্টে খাবার পরিবেশন করছে। স্বর্ণলতা সরাসরি তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। আড়চোখে দেখছে, দাদি শাশুড়িকে। চোখ বুঁজা, সমানে বিড়বিড় করছেন। একই তালে আঙুল দিয়ে তসবিহ গুণছেন। সত্যি কি তার চোখ চারটা? সে শিউরে ওঠল!
” এখন শরীর কেমন? ভালো লাগছে একটু? ”
স্বর্ণলতা মৃদু কাঁপল। সচকিতে তাকাল পাশে। দাদিজানের চোখ বন্ধ তখনও। সে দ্বিধাভরা চোখে তাকাল রুমকির দিকে। প্রশ্নটা কাকে করছে বুঝতে পারছে না। রুমকি বুঝতে পেরে ফিসফিস করল,
” উত্তর দেন না ক্যান? চ ড় খাওয়ার শখ হইছে? ”
সে ভ য়ে চটজলদি উত্তর করল,
” জি, ভালো লাগছে। ”
খাইরুন নিসা চোখ খুললেন। তসবিহ গলায় পরে তাকালেন নাতবউয়ের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন বদনখানি। নাক, চোখ, ঠোঁট সবকিছুই দৃষ্টিনন্দন হলেও খুশি হতে পারলেন না। রুমকির দিকে চেয়ে বললেন,
” বাইরে যা। ডাক দিলে আসবি। ”
সে চলে যাচ্ছিল, সহসা প্রশ্ন করলেন,
” দরজায় আড়ি পাতলে কী হবে? ”
রুমকি কান দুটো হাত দিয়ে আড়াল করে জবাব দিল,
” সরতা দিয়া কান কা টবেন, তারপর পুঁতা দিয়া ছ্যা চবেন। ”
সে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দৌড়ে চলে গেল। বাইরে থেকে দরজা টেনে দেওয়ার শব্দ হতে তিনি বললেন,
” খাবার খাও। খেতে খেতে আমার প্রশ্নের উত্তর দেও, ঠিক আছে? ”
খাবারের প্লেটটা স্বর্ণলতার আরও নিকটে এনে দিলেন। সে আড়ষ্টভাবে হাত রাখল ভাতে। মাখতে মাখতে এক ঝলক তাকাল দাদি শ্বাশুড়ির দিকে। এত ভ য় করছে তার! মনে হচ্ছে, খাবার মুখে দিলেই বমি হবে, তারপর জ্ঞান হারাবে। এরকম ভ য় তো, দা নবটাকে দেখেও লাগেনি!
” তুমি কোন গ্রামের মেয়ে? ”
স্বর্ণলতা আস্তে আস্তে বলল,
” সুয়াপুর। ”
” ওহ, পাশের গ্রামেই থাকো। পরিবারে আর কে কে আছে? ”
” আম্মা, আব্বা, এক ভাই ও এক বোন। ”
” তুমি সবার বড়? ”
” জি না, মেজো। আমার বড়বোন আছে। ”
” বড়বোনের বিয়ে হয়েছে কোথায়? ”
” বিয়া হই নাই। আফা আমগো মতো না। মাথায় বুদ্ধি নাই। ঠিকমতো কথাও কইতে পারে না। আব্বা কইছে, ওরে কোনোদিন বিয়া দিব না। ”
খাইরুন নিসা প্রশ্ন পর্বে বিরতি দিলেন। ভাবলেন, স্বর্ণলতার বড়বোন হয়তো প্রতিবন্ধী। তিনি মুখের সামনে থেকে প্লেট সরিয়ে ফেললেন। আজ রাতে হয়তো খাওয়া হবে না। মাথার ভেতরটা পুরো জ্যাম বেঁধে গিয়েছে। মুনছুর কোন পরিবার থেকে মেয়ে এনেছে! মেয়ের কথা বলার ধরণেই বুঝা যাচ্ছে, মূর্খ পরিবারের মেয়ে। শিষ্টাচারও নেই। মুরুব্বিদের সালাম করার নিয়ম পর্যন্ত জানে না!
” মুনছুর কি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছে? ”
স্বর্ণলতা খাচ্ছে। তার মুখভর্তি ভাত! খাবার থেকে এত ভালো ঘ্রাণ বেরুচ্ছিল যে, সে না খেয়ে থাকতে পারল না। খাবার মুখে নিয়ে চেয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” তাড়াহুড়ো নেই, ধীরে ধীরে উত্তর দেও। ”
তিনি পানির গ্লাসটা টেনে আনলেন স্বর্ণলতার সামনে। সে খাবার চিবুচ্ছে। এরমধ্যে গলায় আটকেও গেল। কাশতে কাশতে পানি টেনে নিয়ে খেল কয়েক ঢোক। তারপরে শুনল,
” মুনছুর চলে যাওয়ার পরে তুমি পালাতে চেয়েছ, কেন? এই বিয়ে তোমার ইচ্ছেতে হয়নি? ”
স্বর্ণলতা সবেগে মাথা নেড়ে জানাল,
” না। উনি তো ভাঙচুর করছেন। আমার আব্বারে ট্যাকা দিয়া লোভে ফালাইয়া বিয়া করছে। ”
তার কথাগুলো শোনাল নালিশের মতো। যেন সামনের মানুষটি বিচারক। দোষীকে শাস্তি দিয়ে, তাকে উদ্ধার করবে। খাইরুন নিসার মুখ কালো হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে, তসবিহ চেপে ধরে কী যেন বিড়বিড় করলেন। অতঃপর প্রশ্ন করলেন,
” তোমার বয়স কত? ”
স্বর্ণলতা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। ভাবল কিছুক্ষণ। প্রশ্নকারীকে পরখ করে বলল,
” বারো। ”
সঙ্গে সঙ্গে মেহেরুন নিসার মুখ থেকে বেফাঁসে উচ্চারিত হলো,
” হায় আল্লাহ! মাফ করো। ”
স্বর্ণলতা শুনতে পেয়ে আগ বাড়িয়ে বলল,
” আমার তো শরীর খারাপও হই নাই, দাদিজান! আম্মা কত কইরা বুঝাইল! আপনের নাতি বুঝল না। জোর কইরা বিয়া করল। আমার গলায় দাও ধইরা কবুল বলাইছে। এমনে কি বিয়া হয়? ”
খাইরুন নিসা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অন্যদিকে ফিরে বিরামহীন ‘ নাউজুবিল্লাহ ‘ পাঠ করছেন। মুনছুরের এই অধঃপতন কিছুতেই মানতে পারছেন না। এসব দেখার আগে মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়েননি কেন, সেই আফসোসে চোখের কোল ভরে এলো। স্মরণে এলো স্বামীর মুখ, পুত্র ও পুত্রবধূর মুখ। ম রে গিয়ে কী জবাব দিবেন তাদের কাছে!
এই ফাঁকে স্বর্ণলতা গোগ্রাসে গিলছে। হঠাৎ করে তার এত ক্ষুধা পেয়েছে! মনে হচ্ছে, টেবিলে সাজানো সকল খাবার এক লোহমায় খেয়ে ফেলতে পারবে। মনটাও ফুরফুরে লাগছে! মাথার উপর থেকে কত বড় বোঝা নামাল, অনুমানও করতে পারছে না। বিয়ে থেকে মুক্তি না পাক, শা স্তি তো দিতে পারবে! আগে শা স্তি পড়ুক, পড়ে না হয়, শেঁকল থেকেও মুক্তির পথ খুঁজে নিবে। এত বড় বাড়ি কোথাও না কোথাও থেকে পথ বেরুবেই।
খাইরুন নিসা গোপনে চোখের অশ্রু মুছলেন। খাবার ফেলে বেরিয়ে গেলেন খাবার রুম থেকে। রুমকির সঙ্গে দেখা হতেই বললেন,
” আজ রাতে তুই মুনছুরের ঘরে ঘুমাবি। বউয়ের বয়স কম, নতুন বাড়ি, নতুন ঘর। একা ঘুমাতে ভ য় পাবে। ”
” একা ঘুমাইব ক্যান, আম্মাজান? ছার আইব না? ”
” আসলে আমার ঘরে পাঠাবি। ”
” আপনার ঘরে ক্যান? বাসর কি আপনার লগে হইব? ”
খাইরুন নিসা তার গালে চ ড় বসিয়ে দিলেন। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
” গাধা একটা! দুইদিন পর, মেয়ে বিয়ে দিবে অথচ কথা বলাই শিখল না। ”
চলবে