#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬)
রুমকি মেঝেতে শীতল পাটি বিছাল। কাঁখে করে আনা বালিশটা তার উপর রেখে বলল,
” কইছিলাম না, কপাল খুইলা গেছে? যে ঘরের দরজার সামনে আসলেও বুক কাঁপত, সেই ঘরের ভেতরে আমি। বিছানা পাইতা শুইতাছি। আপামনি, আপনারে শুধু নাচ দেখালে হইব না। আরও বড় কিছু করতে হইব। কন, কী করমু? কী করলে আপনার ঋণ শোধ হইব। ”
স্বর্ণলতা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দাদিজানের কক্ষের মতো এখানেও দুটো জানালা। একটা পালংকের কাছে। শুয়ে থেকেও বাইরের গাছপালা, আকাশ দেখা যায়। আরেকটা অন্যপাশে। একটু ওপরে। স্বর্ণলতা পা উঁচিয়ে দেখছে, রাস্তাঘাট দেখা যায় নাকি। পালানোর পথটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। রুমকির কথাগুলো তার কানে ঢুকছে না। তার মন ও চেতন সব এই জানালার ওপাশটায় পড়ে আছে। কোনো আলো নেই। চাঁদের ম্লান আলোয় সবকিছু ছায়ার মতো দেখাচ্ছে।
রুমকি পাটি থেকে সরল। হেঁটে গেল জানালার কাছে। এক পলক স্বর্ণলতাকে দেখে, সেও কৌতূহলী চিত্তে উঁকি মারল ওপাশটায়। চঞ্চল তারাদুটি নাড়িয়ে বলল,
” কী খুঁজেন, আপামনি? আমারে কন, বাইর কইরা দিতাছি। এই বাড়ির সবকিছুই আমার মুখস্থ। ”
আচমকা কানের কাছে কণ্ঠস্বর পেয়ে সে ঘাবড়ে গেল। ঝটিতে ফিরল পাশে। রুমকিকে উঁকি মারতে দেখে, আরও ভ য় পেয়ে গেল। মনে হলো, তার মনের মধ্যে গড়া পরিকল্পনা ধরা পড়েছে। স্বর্ণলতা জানালার পাশ থেকে সরে এলো দ্রুত। আমতা আমতা করে বলল,
” কই, কিছু খুঁজি না। ”
” সত্য কইতাছেন? ”
স্বর্ণলতার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। শ্বাসনালীতে চাপ পড়ছে। মুক্তর মতো ঘামের দানা ঝিলিক দিচ্ছে কপাল ও গলায়। খোলা চুলগুলো দুই হাতে কানের পাশে গুঁজে বলল,
” হ, সত্য। ”
রুমকি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। হতাশ দেখাল মুখের ভাব। আপামনির কোনো কাজেই আসছে না! সে পালংকের কাছে এলো ধীরপায়ে। বিছানার চাদর টেনে ধরে বলল,
” তাইলে ঘুমাইয়া পড়েন, অনেক রাত হইছে। ভোরে আবার উঠতে হইব। ”
” ক্যান? ভোরবেলা কী আছে? ”
” নমজ আছে। ফজরের নমজ পড়তে হইব। এই বাড়িতে সবাই ভোরে উইঠা নমজ পড়ে। আপনারও পড়তে হইব। আম্মাজানের হুকুম। তারপর আর ঘুমাইতে পারবেন না। লুকাইয়া ঘুমাইলেও আম্মাজানের নজরে পইড়া যায়। ক্যামনে, কন তো? ”
স্বর্ণলতা একটু ভাবার চেষ্টা করেও থেমে গেল। ক্লান্তি লাগছে, আগ্রহ পাচ্ছে না। নতুন কোনো চিন্তাভাবনাতে ঢুকতে পারছে না। মন ও মস্তিষ্কে চরকির ন্যায় একটা কথাই ঘুরছে, পালাতে হবে! সে ভাবনা ফেলে প্রশ্ন করল,
” নজরে পড়ে ক্যামনে? ”
” লুকানো চোখ দিয়া। আপনারে কইলাম না? উনার দুইডা চোখ ঘুইরা বেড়ায়? ”
স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিল না। উদাসভাবে মাথা নাড়ল। লুকানো চোখ দুটোর কথা বিশ্বাস করতে চায় না সে। এরকম কখনও হয় না। এমনটা সে দেখেনি, বইপুস্তকেও পড়েনি। দাদি বেঁচে থাকতে রাজা, রানি, ভূতের গল্প শুনিয়েছেন, কিন্তু কোনো গল্পে চার চোখ ছিল না।
” এইডা কী? দাউ! বালিশের তলায় দাউ রাখছে ক্যাডা? ”
রুমকির চাপা চিৎকার। বিস্ময়ে চোখের আকার বেড়ে গিয়েছে। স্বর্ণলতা প্রায় লাফিয়ে পৌঁছাল পালংকের কাছে। চিলের মতো ছোঁ মেরে দা’টা নিল। আঁচলের তলায় লুকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। সুবর্ণের দেওয়া দা’টা নিয়ে আসতে পারেনি। মাপে অনেক বড় ও ভারী! দুই হাতে আগলে রাখতে কষ্ট হয়। আঁচলের তলায় লুকালেও বুঝা যায়। বিবাহের সময় থেকে মুনছুর সাখাওয়াত তার সঙ্গে। এক সেকেন্ডের জন্যও দূরে সরছিল না। এই অবস্থায় দা’টা কীভাবে বয়ে আনে? সেজন্য বুদ্ধি করে নিজেদের রান্নাঘর থেকে এই দা’টা এনেছে। মাপে ছোট ও হালকা। অনেক দিনের পুরোনো হওয়ায় মরিচা পড়েছে। এক কো পে গলা কা টবে না, স্বর্ণলতা জানে। তবুও খালি হাতের চেয়ে কিছু থাকা ভালো। কো পের ভ য় দেখাতে পারবে। র ক্ত না বেরুলেও, জখম হবে। য ন্ত্রণায় কাতরাবে।
” ছার রাখছে মনে হয়। তার কাছে তো পি স্তলও থাকে! ”
” পি স্তল! ”
স্বর্ণলতার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। রুমকি বালিশের কভার টেনে টেনে ঠিক করছে। সেই অবস্থায় বলল,
” হ। ছুরি, বেত, করাত, তলোয়ার সবই থাকে। যেগুলা দিয়া মানুষ মা রা যায়। আমি হুনছি, দৈনিকই সে পাঁচ-দশটা কইরা মানুষ মা রে। র ক্ত দিয়া জামা-কাপড় মাইখা ফালায়। তারপর বাসায় আইসা সাবান দিয়া ডইলা ডইলা সেই র ক্ত উঠায়। আম্মাজান ছাড়া সেই র ক্ত কেউ দেখতে পায় না। আমি কত রাত জাগলাম! দরজার কুনায় পলাইয়া থাকলাম, তাও দেখতে পাইলাম না। কপাল খারাপ হইলে যা হয় আর কী! ”
দানবটা মানুষও খু ন করে! স্বর্ণলতার কণ্ঠরোধ হলো। হাত, পা অসাড় হয়ে আসছে। জায়গা থেকে একচুলও নড়ল না। চোখ সরিয়ে যে অন্যত্র দেখবে, সেটাও পারছে না৷ মনে হচ্ছে, হুট করেই শরীর থেকে আত্মা পালিয়েছে।
রুমকি পালংক থেকে নেমে বলল,
” আপামনি বিছনা কইরা দিছি, শুইয়া পড়েন। ”
সে জড়বস্তুর মতো স্থির, নিশ্চল। শুধু ঠোঁট দুটো নেড়ে সুধাল,
” আপনি শুইবেন না? ”
” হ, আপনি উপরে উইঠা গেলেই শুইয়া পড়মু। আমি তো ঘুমে চোখ মেইলা রাখতে পারতাছি না। আপনার জন্য জোর কইরা চাইয়া আছি। আপামনি, আপনি কি ঘরের মধ্যে আরও কতক্ষণ ঘুরঘুর করবেন? ”
স্বর্ণলতা উত্তর দিতে পারল না। পূর্বেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। সে ও রুমকি একই সঙ্গে চমকে ওঠল। ঝটিতে পেছন ফিরতেই দেখল, দাদিজান দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ, মুখ ফোলা ও অন্ধকার। অসন্তুষ্ট ও বিরক্তের ভাঁজগুলো সরছেই না। খাইরুন নিসা দুজনের দিকে দৃষ্টি ঘুরালেন প্রথমে। অতঃপর রুমকির দিকে চেয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,
” নাতবউকে আমার রুমে নিয়ে আয়। ”
সে দ্রুত কদমে এগিয়ে এলো। সোৎসাহে সুধাল,
” ক্যান, আম্মাজান? উনি কি আপনার লগে ঘুমাইব? ”
তিনি নিরুত্তর। বিরক্তের চাহনি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভাবটা এমন, ‘ দুনিয়া উল্টেপাল্টে যাবে কিন্তু তুমি বদলাবে না। ‘ খাইরুন নিসা নিজের কক্ষের দিকে হাঁটছেন। তাকে অনুসরণ করছে, স্বর্ণলতা ও রুমকি। হিসেবমতে, আজকে মুনছুর ও স্বর্ণলতার বাসর রাত। এই রাতে স্বামী-স্ত্রীর দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয়। এটি মুস্তাহাব। মুনছুর সাখাওয়াত মসজিদে যায় না, ফরজ নামাজ আদায় করে না। তার মুখে আল্লাহ রাসূলের নামও শোনা যায় না৷ নাস্তিকের মতো জীবনধারণ করে। খাইরুন নিসা এটা নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট, রাগান্বিতও। চোখের সামনে একমাত্র নাতি বিপথে যাচ্ছে, তিনি আটকাতে পারছেন না। ফেরাতে পারছেন না। চেষ্টা তো কম করেননি!
স্বর্ণলতা রুমে ঢুকতেই বললেন,
” ওযু করে আসো। নামাজ পড়বে। ”
রুমকি পাশ থেকে বলল,
” এহন কী নমজ পড়ব, আম্মাজান? ফজরের আযান দেয় নাই তো! ”
খাইরুন নিসা রে গে গেলেন। ধ মকের সুরে বললেন,
” একটা চড়ে হয়নি? আরেকটা চড় খেতে চাস? ”
সে মিইয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি নামিয়ে নিল। আনত মাথায় চুপ থাকলে তিনি পুনরায় বললেন,
” ও কে ওযুর পানি দে। ”
স্বর্ণলতা ওযু করতে গেল। খাইরুন নিসা জায়নামাজটা বিছিয়ে দিলেন। মুনছুর কখন আসবে ঠিক নেই। আসলেও নামাজটা আদৌ আদায় করবেন নাকি সন্দেহ। তাই ঠিক করেছেন, স্বর্ণলতাকে একাই নামাজ পড়াবেন। কবুল করার ইচ্ছা মহান আল্লাহর।
_______
নামাজ শেষ হতে স্বর্ণলতা ও রুমকিকে আগের কক্ষে পাঠানো হলো। রুমকি পাটির উপর শুয়ে বিড়বিড় করছে,
” নামাজ পড়ানোর লাইগা ওই ঘরে টাইনা নিয়া গেছে। এই ঘরে পড়লে কী হইত? ঘুমটাই ছুইটা গেল আমার। বড়লোক মানুষরা ছোটলোকের আরাম সহ্য করতে পারে না! ”
স্বর্ণলতা পালংকে শুয়ে আছে। আলো জ্বালানো, সে নেভাতে মানা করেছে। ঘরটা বেশ বড়! সেই অনুযায়ী আসবাবপত্র তেমন নেই। একটা পালংক, ড্রেসিং টেবিল আর বুকশেলফ। বুকশেলফ ভর্তি বই। সাজানো গোছানো নেই। এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। নিচে দুটো ড্রয়ার। তালা দেওয়া। তালার মধ্যে চাবি ঝুলছে। স্বর্ণলতার চোখ পড়ল চাবির গোছাই। অনেকগুলো চাবি। ছোট, বড়, মাঝারি। বিভিন্ন ডিজাইনের। তার ইচ্ছে হলো চাবিটা কব্জা করে রাখে। বলা তো যায় না কখন কাজে লেগে যায়! রুমকির জন্য সাহস পাচ্ছে না। সে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি নিচে ঘুমাইবেন? আমার লগে উপরে আহেন। ”
রুমকি মাথা তুলল। বিস্ময়ের আভা ফুটিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
” মাথা খারাপ! আপনার লগে শুই তারপর সকাল বেলা আমার মাথাডা আলাদা পইরা থাকুক, তাই না? ”
স্বর্ণলতা শিউরে ওঠল। সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ক্যান? মাথা আলাদা হইব ক্যান? আমি ছু রি নাকি ক রাত যে, লগে শুইলেই মাথা আলাদা হইয়া যাইব। ”
” আপনে ছু রি না, ক রাতও না। আপনে ভালা মানুষ। দেখতেও মাশাআল্লাহ সুন্দর আছেন। কিন্তু আপনের যে জামাই! তার ছু রি, দাউ, ক রাত এসব কিছু লাগব না। আমার ঘাড়টা মুচুর দিয়া মাথাডা আলাদা কইরা দিব। ”
উত্তরটা দিয়ে রুমকি বালিশে মাথা রাখল। চোখ বুঁজে নিল তখনই। পায়ের কাছে কাঁথাটা আলগোছে টেনে নিল শরীরে। স্বর্ণলতা তখনও বসে আছে পালংকের মাঝামাঝিতে। সংশয় কাটেনি। বোকার মতো চেয়ে আছে রুমকির মুখটায়। সারল্য কণ্ঠের সহজ উত্তরটা মাথায় ঢুকছে না এখনও।
মাঝরাত অবধি স্বর্ণলতা পালংকেই শুয়ে রইল। ঘুম আসছে না। মনের মধ্যে অস্থিরতা। হাঁসফাঁস লাগছে খুব। বাবা, মায়ের কথা মনে পড়ছে। সুবর্ণ কী করছে এখন? সে চলে আসায় কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়! মায়ের আঁচল ধরে কাঁদছে। মায়ের কাছে তার ঐ একটাই তো বায়না! কাঁদার সময় আঁচলখানি চাই। বাকি সব বায়না স্বর্ণলতার কাছে।
মাঝরাতে স্বর্ণলতা উঠে পড়ল। চুপচাপ সন্তর্পণে শুয়ে পড়ল রুমকির পাশে। এবার শান্তি লাগছে। অস্থিরতা কমেছে। ভ য় লাগছে না। মনে হচ্ছে, মা পাশে আছে। এই তো মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, কপালে আদর করে দিবে। সে ঘুমিয়েই পড়েছিল প্রায়। হঠাৎ দরজা মেলার শব্দ হলো। ভারী পদাঘাতের শব্দ পৌঁছাল কানে। স্বর্ণলতার ঘুম ছুটে গেল তখনই। কিন্তু চোখের পাতা মেলতে সাহস পাচ্ছে না। ভ য়ে গুটিয়ে নিল সমস্ত শরীরটা। একহাতে আকড়ে ধরল রুমকিকে। আরও কাছে চেপে গেল তার। শরীরের সঙ্গে বিঁধে গিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করছে, ‘ এটা স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন! দানবটা আসেনি। আসবে না। ‘ এই সময়ে রুমকির শরীরটা প্রচণ্ড বেগে ঝাঁকি খেল। স্বর্ণলতার শরীরটাও কেঁপে ওঠল। হাতটা সরেই যাচ্ছিল প্রায়! আরও জোরে খামচে ধরতে শুনল,
” শা লী! ওঠ। আমার রুমে ঘুমাস! এত বড় স্পর্ধা। নেংটা করে শ কুনের কাছে ফেলে দিব। ”
শব্দগুলো স্ফুরিত হলো বজ্রপাতের মতো। স্বর্ণলতার কান সহ্য করতে পারল না। সে রুমকিকে ছেড়ে নিজের কান চেপে ধরল। মানুষটা এত নির্দয়, ব র্বর। বুনো জাতের মতো ব্যবহার। অকথ্য মুখের ভাষা! রুমকি ঘুমের ঘোরে ধরফরিয়ে উঠে বসল। সামনের মানুষটাকে দেখার সুযোগও পেল না। তার পূর্বেই আরেকটা লা থি খেল কোমরে। মুনছুর সাখাওয়াত পূর্বের চেয়েও কঠিন ও অশিষ্টভাবে গালাগাল দিয়ে বলল,
” এখনও বসে আছিস! কাপড় খোল। দেখি, বুকের পাটা কত বড় হয়েছে। ”
লা থি খেয়ে তার কোমরের হাড় নড়ে ওঠছে। বিদ্যুৎ বেগে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে শিরা উপশিরায়। চোখে অন্ধকার দেখছে। জলের ধারা বয়ছে দুই চোখে। সেই অবস্থায় শাড়ির আঁচল বুকের কাছে চেপে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। দাদিজানের আদেশ মনে পড়ল না, বলতেও পারল না। মরণপণ চেষ্টা চলছে ইজ্জত বাঁচানোতে। চৌকাঠ পেরুতেই পায়ের বল হারিয়ে গেল। মুখ থু বড়ে পড়ল কক্ষের বাইরে। পাকা মেঝে। কপাল ও নাকে আ ঘাত লাগল, ডান হাতটা পড়ল বেকায়দায়। জ্ঞান হারানোর পূর্বে দরজায় খিল টানার শব্দ পেল। সেই সঙ্গে স্বর্ণলতার চিৎকারটাও কানে পৌঁছাল,
” রুমকিবু, যাইও না। আমারে একা থুইয়া যাইও না। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭)
স্বর্ণলতা মেঝেতে বসে আছে এখনও। পিঠ ঠেকে আছে বুকশেলফের ড্রয়ারের কাছে। চোখদুটি থেকে সমানে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মুখখানা আ তঙ্কগ্রস্ত, ভী ত। পা দুটো টেনে নিয়ে বসে আছে কুঁজাদের মতো। মৃদু মৃদু শরীর কাঁপছে। শ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।
” স্বর্ণলতা, নিচে কী করছ? উপরে উঠো। ”
নিস্তেজ কণ্ঠস্বর। সমুদ্রের গর্জনের মতো শীতল, শ্রুতিমধুর। স্নেহ ও আদর উপচে পড়ছে যেন! যে কারও মন ভুলিয়ে দিবে। স্বর্ণলতাও এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। মাথা তুলে তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। কাঠখোট্টা বদন। চোখজোড়া ভ য়ানক লাল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটানোর চেষ্টা। ভালোমন্দ মিলে গেলে কী বীভৎস রূপ তৈরি হয়, স্বর্ণলতা সেটাই দেখে ফেলল।
মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে এগিয়ে আসছে। স্বর্ণলতা খেয়াল করল, ভূমি কাঁপছে! বুকশেলফের কাচ ঝাঁকি খেয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। লোকটি হাঁটলেই মাটি কাঁপে। আশেপাশের জিনিস নড়েচড়ে। সে কি সত্যিকারের দৈত্য! মুনছুর সাখাওয়াত ঝুঁকে এলো। স্ত্রীর হাত ধরার জন্য উদ্যত হতেই স্বর্ণলতা চেঁচিয়ে ওঠল,
” ধরবেন না। সরেন। আমার সামনে থেইকা সরেন। ”
এত জোরে চেঁচাল যে, মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হলো। একহাতের আঙুল কানে প্রবেশ করল তৎক্ষনাৎ। যথেষ্ট শান্ত ও ধৈর্য ধরে বলল,
” আস্তে। আমার কান ফেটে গেল। স্বর্ণলতা, চুপ। ”
সে চুপ করল না। মুখে চিৎকার নিয়ে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে ছুটতেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” থেমে যাও। ওখানেই থেমে যাও। আমি চাই না, এই অবস্থায় কেউ তোমাকে দেখুক। ”
স্বর্ণলতা শুনল না। দরজার কাছে পৌঁছে গেল। লোহার মোটা দরজা। সিটকানি উল্টো চামচের মতো। নাড়লে ভারি শব্দ হয়! সে সিটকানি ধরতেই টন করে শব্দ তুলল। দ্রুত হস্তে একটানে খুলে ফেলতেই পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠের চাপা হুং কার এলো,
” যে কয়টা চোখ তোমাকে দেখবে, সব কয়টা চোখ সন্না দিয়ে উ পরে ফেলব। ”
তার হাত থমকে গেল। কপাল ঠেকাল দরজার সঙ্গে। তীক্ষ্ণ নাকে মৃদু আঘাত পেতেই ফুঁপিয়ে ওঠল। কান্নায় ভেঙে পড়ে অসহায় গলায় বলল,
” আমারে ছাইড়া দেন। দয়া কইরা, ছাইড়া দেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ধীর পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে এলো। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল নববধূর পেছনে। কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
” আমি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করব না, তুমি আমার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ”
সে মুখ সরিয়ে নিল। দরজার সিটকানি খোলা ছিল, এবার পাল্লা টেনে ধরল। স্বর্ণলতা লাফিয়ে সরে গেল একপাশে। বাইরে আলোর ব্যবস্থা আছে। হলদে আলোতে দেখা যাচ্ছে রুমকির নিথর দেহটা। এঁকেবেঁকে আছে পা দুটি ও হাত জোড়া। পরনের শাড়ি এলোমেলো। শাড়ি উঠে গেছে হাঁটুর কাছে। কালো রঙের শায়া বেরিয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত চৌকাঠের বাইরে পা রাখল। রুমকির দেহটা লা থি দিয়ে সরিয়ে দিল দূরে। পরিশেষে পকেট থেকে চিমটা বের করল। স্বর্ণলতার হাতে দিয়ে বলল,
” গোসলে যাচ্ছি। বিশ মিনিটের মতো সময় পাচ্ছ। যেখানে খুশি যাও। ফিরে এসে ঐ পালংকে বসবে। মাথায় ঘোমটা ও মুখে লজ্জার রঙ থাকবে। আমি এসে ঘোমটা তুলে লজ্জায় রাঙা মুখটা দেখব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত গোসলখানার দিকে হেঁটে চলে গেল। একবারের জন্যও পেছন ফিরল না। সে নিশ্চিত স্বর্ণলতা বাইরে যাবে না। যে পা শেকল ছাড়ায় আটকে যায়, সেই পায়ে শেকল পড়ানো বোকামি। সময় নষ্ট।
________
তৃতীয়বার লা থি খেয়ে রুমকির জ্ঞান ফিরে এলো। শরীর ব্যথায় টনটন করছে। কোমরটা নাড়াতেই পারছে না। সে দূর হতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াতের দোর খোলা। ভেতর থেকে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। কারও ছায়া নেই, সাড়াশব্দও নেই। কতক্ষণ অচেতন ছিল? স্বর্ণলতা ঠিক আছে তো? ছোট্ট মেয়ে, ভীষণ মায়া মুখটায়! মনটা মোমের মতো নরম ও সাদা। ঐ বিশাল দেহের নরপিশাচের ভার সামলাতে পারবে? আঘাত সহ্য করতে পারবে? চিন্তায় তার মনের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠল। সাহস বাড়ল, জোর পেল শরীরে। মনে পড়ল, এই মেয়েটার জন্য বড় কিছু করার সংকল্প করেছিল। সেই সংকল্প রক্ষা করার উপযুক্ত সময় এসেছে। রুমকি উঠে দাঁড়াতে পারল না। কোমরটাকে এত ভারী লাগছে! মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সকল ভারী বস্তু এসে জমেছে এই কোমরে। সে বসে থেকেই হাতে ভর দিয়ে দিয়ে এগুল। কয়েক গজ দূরে আম্মাজানের কক্ষ। স্বর্ণলতার পক্ষে কথা বলার অধিকার ও সাহস রাখেন একমাত্র তিনি। যাকে মুনছুর সাখাওয়াত ভ য় না পেলেও সহজে এড়িয়ে যেতে পারে না। পোকামাকড় ভেবে আঘাত করতে পারে না।
প্রায় মিনিট খানেক সময় পর কাঙ্ক্ষিত কক্ষের সামনে পৌঁছাল রুমকি। দরজার কাছে বসে জিরিয়ে নিতে বাধ্য হলো কয়েক সেকেন্ড। চোখে অন্ধকার দেখছে। হাত তুলে যে, দরজায় থা প্পড় দিবে সে বলটুকুও পাচ্ছে না। হঠাৎ করেই নাভিশ্বাস ওঠল। প্রবল যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ওঠল নারী শরীরটা। কণ্ঠস্বর বাঁধা পড়ে গেল। সর্বশক্তি ও প্রাণাধিক চেষ্টায় একটি শব্দও বের করতে পারল না। তুলে রাখা মাথা ও সোজা রাখা মেরুদণ্ড নুয়ে পড়ছে। সে বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছে না। শরীর ও মন এক নয়, আলাদা। এই কথাটার সঠিক ও সত্য হিসেবে প্রমাণ পেল আজ, এই মুহূর্তে। তার মন যা চাইছে, শরীর তা চাইছে না। রুমকির চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসছে। পাতা জোড়া এক হওয়া মাত্র সে শেষ চেষ্টা করল। গলা চিঁড়ে যায় এমন ধাক্কা দিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করল,
” আম্মাজান! ”
_________
মুনছুর সাখাওয়াত বিশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলো। তার পরনে ধবধবে সাদা রঙের নতুন লুঙ্গি ও সেন্ডো গেঞ্জি। চুল ও গোঁফ ভেজা। গামছা ভাঁজ হয়ে পড়ে আছে উন্মুক্ত কাঁধে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। গামছাটা ফেলে সহজ ও সাবলীল কণ্ঠস্বরে বলল,
” শাড়িটা বদলে বেনারসি পরতে পারতে। তোমার বিয়ের বেনারসি কিনতে ঢাকা গিয়েছিলাম। কতদূরের পথ! যানজটের কী অবস্থা, জানোই তো। ”
সে কথা বলতে বলতে আতর মাখল। চিরুনি দিয়ে ভেজা চুল আঁচড়াল। গোঁফেও চিরুনির দাঁত বসিয়ে তাকাল আয়নায়। স্বর্ণলতাকে দেখা যাচ্ছে। পালংকের ঠিক মাঝামাঝিতে চুপচাপ বসে আছে। একহাত ঘোমটা টানা। তার দিকে চেয়েই একপেশে হাসল। বলল,
” কথা বলতে পার। তোমার কণ্ঠ শুনলে আমার কান আরাম পায়, হৃদয় শান্ত হয়। র ক্ত ঠাণ্ডা হয়। মনে হয়, অবসর পেলাম একটু। চট করে ঘুমিয়ে নিই। ”
স্বর্ণলতার দিক থেকে কোনো শব্দ উড়ে এলো না। সে গাছের মতো; প্রাণ থাকতেও নিস্তব্ধ, নিশ্চল। কেউ এলে নির্দ্বিধায় ঠাঁই দিবে, বাতাস দিবে, ছায়া দিবে। কিন্তু নিজে উঠে যাবে না। দু’টো কথা বলবে না। মুনছুর সাখাওয়াত চোখ ফেরাল। চিরুনিটা রেখে হেঁটে গেল বিছানার কাছে। পালংকে উঠে বসল না তখনই। পা জোড়া মেঝেতে রেখে নীরব বসে থাকল কতক্ষণ। অতঃপর বলল,
” স্বর্ণলতা, কথা বলো। আমি তোমার কণ্ঠ শুনতে চাই। ”
সে এবারও কথা বলল না। মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূযুগল বেঁকে গেল। কপালের মাঝের অংশে ভাঁজ পড়ল। কাঠখোট্টা চেহারা আরও বেশি কঠোর হয়ে ওঠল। পা তুলে নিল চট করে। স্বর্ণলতার কাছে পৌঁছে ঘোমটা সরিয়ে দিতে সে শা সাল,
” কাছে আইবেন না। খবরদার আমারে ছুঁইবার চেষ্টা করবেন না। আমি কিন্তু কোপ দিমু, আপনার গলা কাইটা ফেলমু। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ভ য় পেল না। মৃদু চমকাল শুরুতে। নতুন বউয়ের ঘোমটার আড়ালে পুরোনো মরিচা পড়া ইঞ্চি মাপের দা! মেহেদি হাতের নরম আঙুলের মাঝে মন্দ লাগছে না। সে রসিকতার সুরে বলল,
” এই দা দিয়ে মুনছুরের গ লা তো দূর চুলও কা টতে পারবে না। স্বর্ণলতা, মেজাজ গরম করো না। ফেলে দেও ওটা। ”
স্বর্ণলতা তাকে ডিঙিয়ে নিচে নামল। গোসলখানার দিকে সরে যেতে যেতে বলল,
” কা টে কী কা টে না, ওইটা সময় হইলে বুঝবেন। আমি কিন্তু সাবধান করতাছি, আমার কাছে আইবেন না। ”
সে দা’টা সামনে বাড়িয়ে রাখল। অস্ত্রের মতো। সঠিক সময়ে ব্যবহার করবে। মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা থেকে নামল। তার মুখে ভ য়ের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। নির্ভাবনার রুক্ষ মুখ। গলার স্বর ও শব্দ ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখল। স্বর্ণলতার দিকে এগুতে এগুতে বলল,
” হাত কাঁপছে কেন? ঠিকমতো ধরো। পড়ে গেলে পায়ে লাগবে। ”
তার দৃষ্টি গিয়ে আটকাল পায়ে। সেখানে চেয়ে থেকে মুগ্ধ ধরা গলায় বলল,
” কী সুন্দর সাদা পা! আলতার রঙটা এত ভালো ফুটেছে! ইচ্ছে করছে, বালিশ বানাতে। আমার রুমে কোনো বালিশ নেই। স্বর্ণলতা, আমি দুটো নরম ও কোমল বালিশের মালিক হয়েছি। তোমার জন্যেই আমি এই অমূল্য বস্তু পেলাম। আমার আনন্দ হচ্ছে। দা’টা ফেল, আমার কাছে আসো। আমরা এই আনন্দের মুহূর্তটুকু উপভোগ করি। ”
স্বর্ণলতা বিভ্রমে পড়ে গেল। কিছু বলতে পারছে না, করতেও পারছে না। অবাক চোখে চেয়ে আছে সামনের মানুষটির দিকে। পা কখনও বালিশ হয়? অমূল্য বস্তু হয়? এই লোকটা নির্ঘাত পাগল! অবচেতনে ডুবতেই স্বর্ণলতার হাত ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছিল। হাত ফসকে দা’য়ের মুখটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। সহসা ধ মক এলো,
” এই মেয়ে, কী করছ? শক্ত করে ধরো। পড়ে যাচ্ছে তো! পা ফেটে যাবে। শক্ত করে ধরো, বলছি। ”
সে তটস্থ হলো। চেতনে ফিরল। পরিস্থিতি দ্রুত বুঝে নিয়ে দা’য়ের অবস্থান ঠিক করল। পালংকের দিকে চেয়ে জোর গলায় প্রতিবাদ করল,
” মিথ্যা। ঐ তো বালিশ। আপনার রুমে দুইডা বালিশ আছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি সরল না৷ তার মুখের দিকে চেয়ে শান্ত ও দৃঢ় স্বরে জানাল,
” ওগুল আমার না। দাদিজান তোমার জন্য রেখেছেন। ”
স্বর্ণলতা এই বিষয়ে তর্কবিতর্কে এগুতে চাইল না। সে জানে, কথাবার্তা যতদূরই এগোক, শেষ অবধি নিজেকে বলি দিতে হবে এই মাথা নষ্ট দানবটার কাছে। সেই সঙ্গে এটাও বুঝে গেল, অস্ত্র বাছাই কাজে ব্যর্থ হয়েছে। এটা দিয়ে তাকে কোনোভাবেই কাবু করা যাবে না। ঠিক তখনই মাথায় অন্য বুদ্ধিটা এলো। আচমকা দা’য়ের ধারাল অংশ নিজের গলার কাছে ধরে বলল,
” আপনার চুল কা টা না গেলেও আমার গলা কা টা যাইব। আপনি যাইবেন নাকি আমার গলা কা ইটা এখানে মইরা পইড়া থাকমু। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের ভাব বদলে গেল। ধোঁয়ার মতো আবছা একটা রঙ এসে পড়ছে। অস্থিরতা ধরা পড়ছে চোখে, মুখে। সে লুকাতে চেয়েও পারল না। বড় বড় পা ফেলে চলে এলো স্বর্ণলতার নিকটে। খপ করে চেপে ধরল দা’টা। নিজের আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
” ছাড়ো। সত্যি কে টে যাবে। এটা খেলনা নয়, স্বর্ণলতা। আমাকে দেও, দেও বলছি। ”
স্বর্ণলতা এত সহজে হেরে যেতে চায় না। শুরুতে ভ য় দেখানের জন্য হলেও এবার বুঝি জেদে পড়ে গেল। মনে হতে লাগল, এই দৈত্যের মতো দেখতে মানুষটার কাছ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এটা। নিজেকে শেষ করে দিলে মুক্তি, শান্তি।
দুজনের হাতাহাতি চললেও দা’য়ের দখলদারি পেল মুনছুর সাখাওয়াত। বিজয় বেশে দা উপরে তুলতে স্বর্ণলতা ঘামতে লাগল। এক ধ্যানে দু্র্বল চোখে চেয়ে আছে, স্বামীর হাতের দিকে। গলগলে র ক্ত বেরুচ্ছে। বৃষ্টির ধারার ন্যায় মেঝেতে পড়তেই সে অস্পষ্ট ও ভীত স্বরে উচ্চারণ করল,
” র ক্ত! ”
সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুঁজে এলো। শরীরের বল হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল নিচে।
চলবে