#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮)
স্বর্ণলতা জ্ঞান হারিয়েছে। কিশোরী দেহটা মাটিতে লুটিয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত চটজলদি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না। সে হকচকিয়ে গিয়েছে। বিস্ময়াপন্ন বদনে চেয়ে আছে নিচে। দা’টা এখনও তার কাছে। উর্ধ্বমুখী করা। প্রায় মিনিট খানেক পর হৃদয়ে গরম খুন্তির ছ্যাকার মতো কিছু অনুভব করল। কেঁপে ওঠল বুকের ভেতরটা। অস্থিরতার দমকা হাওয়া ঢুকল বক্ষগহ্বরে। সঙ্গে সঙ্গে দা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। দৌড়ে গিয়ে বসল বালিকা বধূর নিকটে। মাথা ও বুক ঝুঁকে পড়ল মুখটার কাছে। ভীতিবিহ্বল হয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? কী হলো? চোখ মেল। ”
সে সাড়া দিল না। বন্ধ থাকা চোখের পালক জোড়া আলগা হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকল। সহসা দুই হাতে আগলে নিল স্বর্ণলতার মাথাটা। সামান্য উপরে তুলে কানের দিকে মুখ ফিরিয়ে পুনরায় ডাকল,
” স্বর্ণলতা? চোখ মেল, কথা বলো। আমাকে কি শুনতে পাচ্ছ না? ”
এই সময়ে দরজায় কড়া পড়ল। লোহার পাল্লায় ঘন ঘন আ ঘাত করে ডাকছে কেউ,
” মুনছুর? নাতভাই? ঘুমালি নাকি? দরজাটা খোল। ”
সে চকিতে পেছন ফিরল। দরজার দিকে চেয়ে থেকে কণ্ঠস্বরটা চিনে ফেলল। দাদিজান ডাকছেন। এতরাতে দাদিজান ডাকে কেন? স্বর্ণলতার মাথাটা ধরে থেকে জবাব দিল,
” এখন খুলতে পারব না। পরে এসো, দাদিজান। ”
মিথ্যে বিরক্ত ও রা গের ভাব ধরতে চেয়েও পারল না৷ কণ্ঠটা শোনাল ভীত, কাঁপা। মুনছুর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। খাইরুন নিসা দরজা থেকে সরেননি। আগের চেয়েও অধিক বলে দরজায় আ ঘাত করছেন ও চিৎকার করে ডাকছেন।
” দরজা খোল, মুনছুর। আমার জরুরি কথা আছে। ”
সে তৎক্ষনাৎ স্ত্রীকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তাকাল মুখটায়। প্রাণহীন, নিষ্প্রভ বদনখানা একপাশে কাত হয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত হাত দিয়ে ধরে সোজা করে দিল। পাগুলোও ঠিক করে, শাড়ি দিয়ে ঢেকে এগুল দরজার দিকে। সিটকানি খুলে, পাল্লা টেনে ধরে হালকা ফাঁক করল। সেদিকে মাথা গলিয়ে দিয়ে বলল,
” তোমার রুমে যাও, আমি আসছি। ”
তিনি এক ঝলক তাকালেন নাতির দিকে। সন্ধানী দৃষ্টি! কী দেখলেন কে জানে! সহসা বললেন,
” চোরের মতো উঁকি দিয়ে আছিস কেন? এ রুমে কি চুরি করতে ঢুকেছিস? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের কপাল দলা হলো। ভারি বিরক্ত নিয়ে জবাব দিল,
” নিজের রুমে চুরি করতে যাব কেন? এখানে যা আছে, সবই তো আমার। ”
খাইরুন নিসা দরজায় মৃদু ধা ক্কা দিয়ে বললেন,
” দরজা থেকে সর। দেখি, তোর রুমে কী কী আছে। ”
সে সরতে চাইল না। পাল্লা শক্ত করে ধরল। আঁটোভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল,
” এখন না। কাল দেখ। তোমার নাতবউ ঘুমাচ্ছে। শব্দ হলে জেগে যাবে। ”
” তাহলে আরও ভালো। ওর সঙ্গেও কথা আছে। ”
” কী কথা? আমাকে বলো। আমি ও কে বলে দিব। ”
” তুই বললে হবে না, আমাকে বলতে হবে। মুনছুর সর, আমাকে ঢুকতে দে। ”
সে আটকাতে চেয়েও পারল না৷ বাড়াবাড়ি করলে সন্দেহে পড়ে যাবে বুঝে এলো। সেই সঙ্গে আশ্চর্যও হলো। দাদিজানকে সে ভ য় পাচ্ছে কবে থেকে? খাইরুন নিসা ভেতরে ঢুকে দেখলেন, স্বর্ণলতা ঘুমাচ্ছে। পালংকের কাছাকাছি পৌঁছাতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” বলেছিলাম না, ঘুমাচ্ছে? এবার বিশ্বাস হলো? ”
খাইরুন নিসা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন না। স্বর্ণলতাকে ভালোভাবে পরখ করছেন। সন্দেহে ভরা চোখদুটি মানতে চাচ্ছে না, মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। তিনি নাতির দিকেও তাকালেন। মুখের ভাবটা অন্য রকম। মিটিমিটি হাসছে যেন! এরকম করে সে হাসে না। গোঁফ নাড়ছে ঘনঘন। নাতিকে বললেন,
” তোর বউকে একটু ডেকে দে। আমার কথা আছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের জোর করে ধরে রাখা হাসিটা উবে গেল। অস্থিরতা প্রকাশ পেল, চোখের তাড়ায় ও কণ্ঠে। বলল,
” একটু আগেই ঘুমিয়েছে, এখন ডাকলে শরীর খারাপ করবে। ঘুম থেকে…”
সে বাক্যটা শেষ করতে পারল না। পূর্বেই দাদিজান বলে ওঠলেন,
” তোর হাতে কী হয়েছে? দেখি। ”
তিনি হাত টেনে নিলেন। কব্জির কাছে অনেকখানি কেটে গেছে। র ক্ত ঝরছে এখনও। এতক্ষণে নজর পড়ল মেঝেতে। ফোঁটা ফোঁটা র ক্ত ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গাজুড়ে। একটু দূরে দা’য়ের খোঁজটাও পেয়ে গেলেন। মুহূর্তে আঁতকে ওঠলেন। শঙ্কিত গলায় বললেন,
” কী হচ্ছে এখানে? মুনছুর, আমার থেকে লুকাবি না কিছু। ”
তিনি উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। ফিরে এলেন স্বর্ণলতার কাছে। পাশে বসে একাধারে ডাকছেন। সে নড়ছে না, সাড়া দিচ্ছে না। প্রায় মিনিট খানিক চেষ্টা করে অসহায় কণ্ঠে সুধালেন,
” ওর সঙ্গে কী করেছিস? সাড়া দিচ্ছে না কেন? মেয়েটা বেঁচে আছে তো? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। দরজার দিকে ছুটে গিয়ে হাঁক ছাড়ল,
” কাশেম? এই কাশেম। শু য়োরের বাচ্চা! ম রে গেছিস নাকি? আমার যদি বাইরে বেরুতে হয়, তাহলে কিন্তু..”
কাশেম দৌড়ে এলো। আলোতে মুখটা দেখিয়ে দ্রুত বলল,
” মহাজন, মাফ করবেন। টয়লেটে গেছিলাম। ”
সে চোখ পাকিয়ে কণ্ঠ তুলে আরও দুই, তিনটে অশ্রাব্য ভাষায় গা লাগাল দিল। অতঃপর আদেশ করল,
” ডাক্তার নিয়ে আয়। ”
” এতরাতে ডাক্তারখানা তো বন্ধ। ”
” মুখে মুখে খুব জবাব দেওয়া হচ্ছে। জিভ বেশি বড় হয়ে গেছে, না? এদিকে আয়। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে এলো। হাত নেড়ে ডাকছে। কাশেম ভ য় পেয়ে পেছনে সরে গেল। আঁধারে লুকিয়ে বলল,
” যাইতাছি, মহাজন। এহনই যাইতাছি। ”
তার দৌড়ে যাওয়ার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। আরও কতদূর এগিয়ে গেল। উঠোন দেখা যাচ্ছে। কাশেম গেইটটা পার হচ্ছে। সঙ্গে আলামিনও আছে। নতুন ছেলে, কিছুদিন হলো কাজে ঢুকেছে। মুনছুর সাখাওয়াত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।
_______
আধ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার এলো বাড়িতে। মুনছুর সাখাওয়াত বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। স্বর্ণলতা এখন দাদিজানের রুমে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত কোলে করে দিয়ে এসেছে। দাদিজানের আদেশ ছিল। ডাক্তার নিয়ে কক্ষের সামনে পৌঁছে দেখে দরজা লাগানো। ভেতর থেকে সিটকানি তোলা। সে চিন্তিত বদনে কড়া নাড়ল। সঙ্গে গলা ছেড়ে ডাকছে,
” দাদিজান? দরজা খোল। ডাক্তার আসছে। ”
খাইরুন নিসা দরজা খুললেন না। স্বর্ণলতার জ্ঞান ফিরেছে। পানি খাচ্ছে। চোখে, মুখে ভ য়টা এখনও জীবিত। কণ্ঠ পেয়েই ঘাবড়ে গেল। পানি রেখে দিয়ে অসহায় চোখে তাকাল দাদি শাশুড়ির দিকে। তিনি জবাব দিলেন,
” আগে রুমকির চিকিৎসা কর। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক মুহূর্ত চুপ থাকল। পরক্ষণে সমানে দরজায় লা থি মারতে মারতে বলল,
” আমি কিন্তু দরজা ভাঙব। ”
” যা খুশি কর। রুমকির চিকিৎসা না হলে, তোর বউয়েরও চিকিৎসা হবে না। ঐ মেয়েটা আমাকে আম্মাজান ডাকে। আমি মেয়ের মতো স্নেহ করি। এটা কি তোর অজানা? তোর সাহস কী করে হলো, ওর গায়ে হাত তোলা? ”
” আমি হাত তুলিনি, পা তুলছি। দরজা না খুললে হাতও তুলব। নাক দিয়ে যে, এখনও বাতাস নিচ্ছে ওটাও বন্ধ করে দিব। ”
খাইরুন নিসা হতাশ হলেন। কণ্ঠটা এত উগ্র, এত বেপরোয়া! জঙ্গলের জন্তু, জানোয়ারও হয়তো এমন হয় না। তারা অন্তত মানুষকে ভ য় পায়। শিকার হওয়ার ভ য় না থাকলে আ ক্রমণ করে না। তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকল প্রথমে। মুহূর্তে চমকে ওঠল। স্বর্ণলতা বসে আছে। মাথায় ওড়না, শরীরে কাঁথা দেওয়া। চোখদুটি নিচে নামানো। সে কাছে গিয়ে বসল। মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” জ্ঞান ফিরল কখন? আমাকে ডাকনি কেন? ”
উৎকণ্ঠায় ভেজা কণ্ঠস্বর। সে চোখ তুলে তাকাতে পারল না। গাল চেপে ধরে রাখা হাতটা এত ঠাণ্ডা! সাপের চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে কি? স্বর্ণলতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে ঝাপসা দেখছে। মনে হচ্ছে, আবার জ্ঞান হারাবে। খাইরুন নিসা পেছন থেকে বললেন,
” মাত্রই ফিরেছে। র ক্ত দেখে ভ য় পেয়েছে। অন্য কোনো সমস্যা নেই। ”
” ডাক্তার কি ফেরত পাঠাব, দাদিজান। ”
তিনি উত্তর দিলেন না। হঠাৎ করে তার কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছে। এই পৃথিবীতে আপন বলতে এই মানুষটাই। একমাত্র নাতি। বংশের শেষ প্রদীপ। অথচ সেই প্রদীপের আলোতে আরাম নেই, শান্তি নেই। চারপাশে অশান্তি ছড়িয়ে রেখেছে। পুড়িয়ে দিতে চায় সবকিছু। খাইরুন নিসা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। ডাক্তার তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানা ক্লান্ত, চোখজোড়ায় রাজ্যের ঘুম। ঝিমুচ্ছে! তিনি ডাকলেন,
” ডাক্তার, এদিকে আস। রোগী এখানে। ”
রুমকি তখনও তার কক্ষের বাইরে পড়ে আছে। জ্ঞান নেই, অচেতন। যন্ত্রণায় মুখটা কালো হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটাও বুঝি ফুরিয়ে এসেছে!
_______
দাদিজান বেরিয়ে যেতে মুনছুর সাখাওয়াত উঠে এলো। দরজায় সিটকানি তুলে ফিরে এলো পালংকে। স্বর্ণলতার কাছ ঘেষে বসে বলল,
” তুমি র ক্ত দেখলে ভ য় পাও? ”
স্বর্ণলতার শরীর গুলিয়ে এলো। আতরের গন্ধটা এত অহস্য লাগছে! চুলে কি তেল দিয়েছে? বিশ্রী সুবাস বেরুচ্ছে। স্পর্শটাও ভালো লাগছে না। ঘেন্না ধরছে। বার বার রুমকির মুখটা মনে পড়ছে। বয়সে তার মায়ের কাছাকাছি হবে। কেমন করে পারল, লা থি মা রতে! ঝাঁটা দিয়ে ময়লাও বোধ হয় এত অবহেলায় সরায় না। সে ময়লার চেয়েও তুচ্ছ!
” স্বর্ণলতা, কথা বলো। তোমার এই চুপ থাকা আমি সহ্য করতে পারি না। বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে। মনে হয়, সব শেষ করে দিই। ”
এই সময় দাদিজানের গলা পাওয়া গেল। দরজায় শক্ত থাপ্পড় দিয়ে বলছেন,
” আমি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব? শেষমেশ কি কপালে এটাই লেখা ছিল? ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা থেকে নামল। সিটকানি খুলে দিয়ে বলল,
” তুমি এত জ্বালাচ্ছ কেন, দাদিজান? বউয়ের সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলতে পারব না? ”
” না, পারবি না। ”
সে আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” মানে কি? তুমিই তো নাতবউয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগছিলে! ”
” যার জন্য উঠেপড়ে লাগছিলাম, সে ও নয়। এটা কি মুখে বলতে হবে? ”
খাইরুন নিসার কণ্ঠস্বর বেশ জোরে বাজছে। মুনছুর সাখাওয়াত চট করে তাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। রুমকির চিকিৎসা চলছে সেখানে। সে এক ঝলক দেখে বিরক্তে মুখ কুঁচকে নিয়ে বলল,
” ও যেন, আর কখনও আমার রুমে না যায়। ওখানে শুধু স্বর্ণলতা ঢুকতে পারবে। আর কেউ না। তুমিও না। ”
” স্বর্ণলতাও ঢুকবে না। ”
কথাটা বলে তিনি তাকালেন পাশে। ডাক্তারের পরীক্ষা শেষ হয়নি এখনও। গম্ভীর ও বিরক্ত মুখে কাজ সারছেন। মুনছুর সাখাওয়াত ডেকে না পাঠালে, এই লোক আসত না। খাটে শুয়ে নাক ডাকত। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ কুঁড়ে ও আরামপ্রিয় মানুষ। মুনছুর সাখাওয়াত কিছু একটা বলার জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। তিনি চোখের ইশারায় থামালেন। অতঃপর বললেন,
” ডাক্তার, আর কতক্ষণ লাগবে? ”
তিনি ব্যস্তসুরে জবাব দিলেন,
” এই তো হয়ে গেছে। আর দুই মিনিট। ”
দুই মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব হলো না মুনছুর সাখাওয়াতের। দাদিজানকে টেনে নিয়ে এলো খাবার রুমে। ফিসফিসের মতো সুধাল,
” কী হয়েছে? এমন করছ কেন? ”
” আমি তো কিছু করছি না। সিংহের মতো গর্জে উঠা কণ্ঠস্বরটা বিড়ালের মতে হয়ে গেল কেন? ”
” দাদিজান! কী বলবে, পরিষ্কার করে বলো। ”
তাঁর বলার মতো অনেক কিছুই আছে। প্রথমত, স্বর্ণলতাকে নাতবউ হিসেবে মানতে পারছেন না। কচি মেয়ে, নাজুক মন। দেখতেও আহামরি সুন্দর না। মুনছুরকে ঘায়েল করার মতো কোনো অ স্ত্রই নেই এই মেয়ের কাছে। তিনি চেয়েছিলেন রূপে, গুণে অনন্যা কাউকে। যে যাদুমন্ত্রের মতো মুনছুরকে বেঁধে রাখবে। সঠিক পথে টেনে আনবে। হৃদয়ে প্রেম জাগাবে। সেই প্রেমে হিংস্রতা শুষে নিয়ে মায়া বাড়াবে। দরদ বাড়াবে।
” স্বর্ণলতা আমার সঙ্গে ঘুমাবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের রা গ উঠে গেল। কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠতে গিয়েও, আটকে গেল। ধৈর্য ধরে স্বাভাবিক কণ্ঠে সুধাল,
” কেন? ”
” স্বামীর সঙ্গে থাকার বয়স হয়নি ওর। বাচ্চা একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে এলেই সব হয়ে যায় না, মুনছুর। তোর থেকে আমি এটা আশা করিনি। এই বয়সে এনে, এত বড় ধাক্কাটা না দিলেও পারতি। ”
” কী আশ্চর্য! বাচ্চা হবে কেন? ”
” বাচ্চা না? বারো বছরের একটা মেয়ে তো বাচ্চাই হয়। এটুকু জ্ঞান আমার আছে। ”
” আরে! বারো বছর হতে যাবে কেন? স্বর্ণলতা পনেরো বছরের কিশোরী। ”
খাইরুন নিসা একটু থমকালেন। নাতির দিকে চেয়ে আছেন দ্বিধা নিয়ে। কারটা বিশ্বাস করবেন, নাতি নাকি নাতবউ? মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” বারো বছরের খবরটা তোমাকে কে দিয়েছে? ”
তিনি সরাসরি নাম প্রকাশ করতে সাহস পেলেন না। বললেন,
” বলতে হবে কেন? দেখে বুঝেছি। দেখে তো মনে হয় না, ওর বয়স পনেরো। তোর মতো। তোকে দেখেও মনে হয় না, তুই ঊনত্রিশ বছরের যুবক। ”
” আরও কম বুঝা যায়? ”
তার কণ্ঠে কৌতূহল, রসিকতার আলতো পোচ। খাইরুন নিসা মুখ শক্ত করে বললেন,
” না। চল্লিশ বছরের বুড়া মনে হয়। দাড়ি নেই অথচ জঙ্গলের মতো গোঁফ রেখে বসে আছিস! ”
মুনছুর সাখাওয়াত নিজের গোঁফে হাত দিল। এত সাধের গোঁফকে জঙ্গল মনে হলো? এরমধ্যে ডাক্তার এলো। একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরে বললেন,
” কোমরের অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। বাসায় রেখে চিকিৎসা সম্ভব নয়। ”
কাগজটা মুনছুর সাখাওয়াত নিল। ধ মক দিয়ে বলল,
” দেখছিস না, মিটিং চলে? কত বড় বেয়াদব! মাঝখানে কথা বলছিস। বের হ, নাহলে.. ”
” যাচ্ছি, স্যার। ”
সে দৌড়ভঙ্গিমায় বেরিয়ে গেল। খাইরুন নিসা প্রশ্ন করলেন,
” ওর ফি দিলি না? ”
” কিসের ফি? গ্রামে থাকতে পারছে, এটাই তো বেশি। ”
খাইরুন নিসা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। মুনছুর সাখাওয়াত পিছু নিলে বললেন,
” পেছন পেছন এসে লাভ নেই, স্বর্ণলতা তোর রুমে যাবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে, আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। এত জ্বালাতন আর সহ্য করতে পারছি না। ”
” যাবে না কেন, সেই কারণটা তো বলবে। ”
খাইরুন নিসা জবাব দিলেন না। স্বর্ণলতার ঋতুস্রাব হয়নি। ঋতুস্রাব না হলে মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারে না, এই কথাটা নাতিকে কীভাবে বলবেন? তার মুখে বড্ড বাঁধছে!
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৯)
দাদিজান মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। সে তাজ্জব ভঙ্গিতে চেয়ে আছে বন্ধ দরজায়। নিষ্ঠুর ব্যবহার! দাদিজানের হৃদয় এত কঠিন হলো কবে? সে দরজায় মৃদু আঘাত করল। নরম স্বরে ডাকল,
” দাদিজান? শোনো না? ও দাদিজান। ”
খাইরুন নিসা ভেতরে ঢুকে পালংকের এক কিনারে বসলেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। শরীরটা মাঝেমধ্যে কেঁপে ওঠছে। থেমে থেমে তপ্ত শ্বাস বেরুচ্ছে। আজ অনেক কথা বলেছেন, চেঁচিয়েছেনও। দুশ্চিন্তায় মাথাটা নুয়ে পড়েছে যেন! এত ভ য়, এত আ তঙ্ক এই বুড়ো বয়সে কি সয়তে পারে? তিনি একটু জিরিয়ে তাকালেন স্বর্ণলতার দিকে। সে তার দিকে চেয়ে আছে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি! কাঁথাটা গলা অবধি টানা। মাথায় ঘোমটা নেই। নীরবে নিঃশ্বাস টানছে ও ফেলছে। এই সময় দরজায় আবারও আঘাত করল মুনছুর সাখাওয়াত। আগের নরম কণ্ঠস্বরটায় এবার আহ্লাদের ছোঁয়াও আছে,
” শোনো না। আমার একটাই তো আবদার। পূরণ করে দেও। তারপর নাহয় ফাঁ সি দিও। ”
” ফাঁ সি! ”
শব্দটা বেরুল স্বর্ণলতার কণ্ঠ থেকে। সে দরজার দিকে চেয়ে আছে। যতবার আঘাত পড়ছে ততবার ছিটকে ওঠছে। খাইরুন নিসা ম্লান হেসে বললেন,
” ভ য় নেই, সত্যিকারের ফাঁ সি চায়ছে না। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের গলাটা আবার ভেসে ওঠল,
” মন নরম করো, দাদিজান। ”
খাইরুন নিসা জবাব দিলেন,
” ঘুমাতে যা, মুনছুর। নাটক করে লাভ নেই। নাটকের বয়স পেরিয়ে এসেছিস। এখন তো বাড়িতে বউও আছে। ”
কথাগুলো বলে দম নিলেন। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে আবছাভাবে দেখছেন, মুনছুর সাখাওয়াতের ছেলেবেলা। ছোট থেকেই সে দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। বাবা, মা দুজনেই ছিলেন চাকরিজীবী। লালন-পালনের সম্পূর্ণ ভার পড়েছিল দাদিজানের ওপর। আদর ও শা সন দুটোই সমান তালে চলেছে। এত জ্বালাত! তিনি হাঁপিয়ে ওঠতেন। গায়ে হাত তুলেননি কখনও। রা গের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে রুমের মধ্যে বন্দি করে রাখতেন। তখন এভাবে ডাকত। ঠিক এই গলায়, এরকম আদুরে কণ্ঠে।
” তুমি সেই বউ ডা কাতি করেছ। রাত-দুপুরে গলায় ছু রি ধরে বউ ডা কাতি করেছ। ”
” আমি গলায় ছু রি ধরেছি? ”
” ধরেছই তো। অদৃশ্য ছু রি। নাহলে তোমার কথায় বউকে ঘর থেকে বের করি। এই দাদিজান, তুমি কি ঝাড়ফুঁকের যাদুটা আয়ত্ত করে ফেলেছ? ”
” সেই ভাগ্য কি আছে? এই বাড়িতে জায়নামাজ বিছাতেও আমার ভ য় হয়। চারপাশ নোংরা! ”
” কী বলছ! চাকরগুলো আবার ফাঁকি দেওয়া শুরু করেছে? সকালটা হতে দেও, সবগুলোর হাত কে টে দেব। ”
খাইরুন নিসা উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে গিয়ে বললেন,
” ওদের হাত কে টে এই বাড়ি পরিষ্কার হবে না৷ তোর হাত কা টতে হবে। ”
” আচ্ছা, কা টো। দা নিয়ে আসছি, দরজা খোলো। ”
তিনি গভীর নিশ্বাস ছাড়লেন। নিরাশ মনে ফিরে এলেন বিছানায়। স্বর্ণলতার থেকে সামান্য দূরত্ব নিয়ে শুয়ে পড়লেন। সে তখনও বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে দাদিজানের কার্যকলাপ। সহসা ধ মক খেল,
” অনেক দেখেছ, এবার ঘুমাও। ”
স্বর্ণলতা চট করে শুয়ে পড়ল। কাঁথাটা মুখের উপর নিতে পুনরায় শুনল,
” শরীর খারাপ না হলে, স্বামীর সঙ্গে ঘুমানো যায় না। বুঝছ? মুনছুর এসব মানবে না। বললে আরও বেশি জ্বালাবে। তাই সতর্ক থাকবে। মুনছুরের থেকে দূরে থাকবে। ”
” জি, আচ্ছা। ”
খাইরুন নিসা দরজা, জানালা একসঙ্গে বন্ধ করতে পারেন না। তার দম আটকে আসে, ভ য় হয়। উঠোনের দিকের জানালাটি সারারাতই খোলা থাকে। স্বর্ণলতা সেই জানালার পানে চেয়েছিল। আচমকা বাইরের আলো নিভে এলো। সে অন্ধকারকে ভ য় পায় না। তাদের বাড়ি প্রায় সময় অন্ধকার থাকত। কেরাসিনের অনেক দাম। রোজ রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পুষানো যায় না। তাই সন্ধ্যার আগেই স্বর্ণলতা ও সুবর্ণ বই নিয়ে বসত৷ মা রাতের রান্না শেষ করত। মাগরিবের আযান দিলে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। যেদিন বাবা আসতেন, সেদিন অন্ধকারে শুয়ে গল্প শুনাতেন। স্বর্ণলতার ভালোই লাগল। অন্ধকারে কল্পনার আলো ফুটে ভালো। মনের মতো রঙ ছড়ানো যায়। বাবার মুখে শোনা গল্পের প্রতিটি চরিত্র, বস্তুর মধ্যে সে আলো জ্বালত, মনমতো রঙ বসাত।
জানালার পাশে কারও চলার শব্দ হচ্ছে। একটু থামছে, একটু হাঁটছে। স্বর্ণলতার কান সজাগ হলো। মনে হলো, আচমকা বাইরের আলো নিভে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। অন্য কোনো কারণ আছে। তার মাথার নিচে একটা হাত রাখা। বালিশে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত নয়। চুলের গোড়ায় গরম ভাঁপ বেরুচ্ছিল, এত অস্থির লাগছিল! তাই বালিশ সরিয়ে একটা হাত রাখে নিচে। এবার সেই হাতটা বের করল। মাথাটা সামান্য উঁচু করে একস্থির চেয়ে আছে জানালায়। মন বলছে, কিছু একটা দেখতে পাবে। প্রায় সেকেন্ড কয়েক পরেই দিয়াশলাইটা জ্বলে ওঠল। আগুনের হলকায় মুনছুরের মুখটা জ্বলে উঠতেই স্বর্ণলতা চেঁচাল,
” দাদিজান! ”
সে মাথা নামিয়ে ফেলেছে। ঘেষে এসেছে খাইরুন নিসার দিকে। এক হাতে বুড়ো শরীরটা আকড়ে ধরল। চেঁচানোর শব্দেই তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এবার যেন, দেহের হাড়গুলোও ভেঙে যাবে! এত জোরে ধরেছে যে, তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি রে গে চেঁচালেন,
” এই মেয়ে, ছাড়। দম আটকে মা রবি নাকি? ”
সেই মুহূর্তে জানালার কাছ থেকে কণ্ঠটা আগুনের শিখার মতো উত্তাপ নিয়ে ছুটে এলো,
” দাদিজান, সাবধান। আমার বউয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না। ”
তিনি ভ য় পেলেন না। রা গের মাত্রা বাড়ল। স্বর্ণলতার হাতটা সরিয়ে উঠে এলেন জানালার পাশে। প্রথমে পর্দা ফেললেন। শান্তি পেলেন না। জানালাটাও বন্ধ করার পর বললেন,
” ফের যদি তোর গলা শুনেছি, তাহলে এর থেকেও খারাপভাবে কথা বলব। দেখি, তুই আমার কী ক্ষতিটা করতে পারিস। ”
_________
ফজরের আযান পড়লে খাইরুন নিসার ঘুম ভাঙল। পাশ ফিরে চেয়ে দেখলেন, স্বর্ণলতা হাত-পা গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। শাড়ি ঠিক নেই কোথাও। পেট, পিঠ, হাঁটু সব উদাম। আঁচল খুলে ঝুলছে মাটির দিকে। তার শুরুতে মায়া হলো। পর মুহূর্তে বিরক্ত হলেন। যে মেয়ে ঘুমানের সময় কাপড় সামলাতে পারে না, সে কীভাবে মুনছুরকে সামলাবে! তিনি বাহু চেপে ধরে ডাকলেন,
” এই মেয়ে? ওঠো। ”
স্বর্ণলতা ধড়মড়িয়ে ওঠল। ভীত ও চঞ্চল চোখজোড়া ঘুরছে পুরো রুমটায়। কোথায় আছে সে? মনে করতে সময় লাগছে। তন্মধ্যে খাইরুন নিসা বললেন,
” আমি ওযু করব। যাও, পানি গরম করে আনো। আমার ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা নিষেধ। ”
স্বর্ণলতা তখনই জবাব দিল না৷ আগ্রহ নিয়ে দেখছে, দাদিজানকে। কাল রাতের বিয়ে, শ্বশুরবাড়ি আগমন, রুমকি, এ ঘরে আসার কারণ সবকিছু মনে পড়েনি এখনও। তার এই নিস্তব্ধতা, নিশ্চল আচরণ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না খাইরুন নিসা। ভ্রূদ্বয় বাঁকিয়ে শুকনো কণ্ঠে বললেন,
” পুতুলের মতো থম মেরে আছ কেন? যাও, পানি গরম করে নিয়ে আসো। ”
স্বর্ণলতা আদেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দরজার দিকে ছুটতে শুনল,
” আরে, শাড়িটা ঠিক করো। মাথায় ঘোমটা দাও। এই বাড়িতে শুধু তুমি থাকো না। আরও অনেকে থাকে। ওদের চোখ আছে, কানা না। ”
সে থেমে গেল। আঁচলটা যেভাবে পারল কাঁধে দিল। মাথায় ঘোমটা টেনে রুম থেকে বেরুবে সহসা ঘাড় ফেরাল,
” রান্নাঘর কোনদিকে, দাদিজান? ”
খাইরুন নিসা কপালে হাত রাখলেন। রান্নাঘরে তার যাওয়া-আসা নেই। প্রয়োজনীয় সবকিছু রুমকি ব্যবস্থা করে রাখত। মুখ ফুটে বলতে হতো না। মেয়েটা সময়ের আগেই সব করে ফেলত। আজ রুমকি নেই। কোমর ভেঙে পড়ে আছে ঘরের বাইরে। আছে তো! নাকি মুনছুর জিন্দা দা ফন করে আপদ বিদায় করেছে? করতে পারে। খাইরুন নিসা ভ য়ে কেঁপে ওঠলেন! নাতির সম্পর্কে এসব কী ভাবছেন! সে কি এতটায় খারাপ হয়ে গিয়েছে?
খাইরুন নিসা নিচে নেমে এলেন রয়েসয়ে। স্বর্ণলতার শাড়ির আঁচল ঠিক করে দেওয়া হয়নি। প্যাঁচিয়ে আছে পেটের কাছে। প্যাঁচ খুলে ঠিকমতো পরিয়ে দিয়ে বললেন,
” সবার আগে শাড়ি পরা শিখতে হবে। ”
তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রথমে তাকালেন ডানে, গতরাতে রুমকি যেখানে শুয়ে ছিল। নেই। জায়গাটা পরিষ্কার ও ভেজা। মাত্রই পানি দিয়ে ধোয়া হয়েছে। খাইরুন নিসার চোখদুটো স্থির হয়ে গেল। দেহটা এত ভার হয়ে ওঠল আচমকা! সন্দেহটা পুরোপুরি মিলে গেল নাকি! তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন প্রায়। সহসা দুটো শক্তপোক্ত হাত আটকে দিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” রুমকি বেঁচে আছে৷ জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। চাইলে দেখতে যেতে পার। আম্মাজান বলে ডাকত, এটুকু সহানুভূতি তোমার থেকে আশা করতেই পারে। তাই না, দাদিজান? ”
তার হৃদয় শান্ত হলো। মনে ভ য় দূরীভূত হতে শরীরের ভারটা কমে গেল। বল ফিরে আসছে। এই ফাঁকে নাতির মাথায় থা প্পড় মা রলেন কয়েকটা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
” এত সহজে পটাতে পারবি না৷ মুনছুর, সর। আমার নামাজে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
স্বর্ণলতা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। দাদিজানের কথামতো তার কি সরে যাওয়া উচিত? সরে গেলে পানি গরম করবে কীভাবে? তিনি তো ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করতে পারবেন না৷
মুনছুর তার নুয়ে রাখা মুখটায় চাইল। অতঃপর দাদিজানের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোমাকে আটকেছে কে? যাও, নামাজ পড়ো। ”
সে একটু ডানে সরে এলো। স্বর্ণলতার মুখোমুখি দাঁড়াল। খাইরুন নিসা দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন,
” তোর বউও নামাজ পড়বে। ”
” না, পড়বে না। ”
জবাবটা দিয়েই সে বউয়ের হাত ধরল। স্বর্ণলতার নিশ্বাস আটকে গেল। মাথা তুলে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। খাইরুন নিসা হাতের দিকে চেয়ে কঠোর হলেন। বললেন,
” তুই কি চাস, তোর বউকে অস্বীকার করি? ”
” তোমার অস্বীকারে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি স্বীকার করেছি, ও আমার বউ। এতেই চলবে। ”
সে বউকে নিয়ে চলে যেতে চাইল। হাতে টান খেয়ে স্বর্ণলতার কণ্ঠ জীবিত হলো। স্পষ্ট স্বরে বলল,
” চলব না। আমি শুধু আপনার বউ না, দাদিজানের নাতবউ হইতে চাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত থামল। বিরক্তের মুখ বানিয়ে বলল,
” আমার বউ মানেই তো দাদিজানের নাতবউ। নতুন করে হওয়ার কী আছে? তুমি কি চাচ্ছ, আবার বিয়ে করি? ”
স্বর্ণলতা এক ঝলক তাকাল দাদিজানের দিকে। এই মানুষটা, একমাত্র এই মানুষটার সঙ্গই পারে, তাকে রক্ষা করতে। সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নিতে। একটু রা গী কিন্তু মনের দিক থেকে ভালো। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলল,
” না। দাদিজান যতদ্দিন না, আমারে আপনার বউ হিসেবে মানছে ততদিন দাদিজানের কাছে থাকি? ”
শেষের দিকে কণ্ঠস্বরটা এত বেশি কোমল ও মধুর শোনাল যে, মুনছুর সাখাওয়াত কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে শুধু। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, স্বর্ণলতা এত মিষ্টি করে তার সঙ্গে কথা বলছে। এরমধ্যে দাদিজানের সঙ্গে ইশারায় কথা হয়ে গেল, স্বর্ণলতার। তিনি চট করে বললেন,
” মানব না৷ আমার কাছে থাকলেও মানব না। তোমার না আছে গুণ, না আছে রূপ। কী দেখে নাতবউ হিসেবে মানব। ”
” ঠিক আছে, মানতে হবে না। তোমার কাছে থাকতেও হবে না। আমার বউ, আমার কাছেই থাকবে। স্বর্ণলতা এসো। ”
চলবে