#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১০)
মুনছুর বউয়ের হাতটা বগল তলায় চেপে ধরল। যেন সে মানুষ না, কোনো প্রিয় বস্তু। ব্যবহার করলে ক্ষয়ে যাবে, দূরে সরিয়ে রাখলে অন্তরে অশান্তি হবে। স্বর্ণলতা তার অনেকখানি কাছে চলে গেছে। পিঠের আলতো স্পর্শ পড়ছে স্বর্ণলতার বুকে। আতরের কড়া গন্ধটা নাকে আসছে। শ্বাস ভারী হয়ে উঠতে মুখ ঘুরিয়ে নিল পেছনে। দাদিজান আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত! মুখে রা নেই। নাতির এই আচরণ, কথাবার্তা বড্ড অচেনা ঠেকছে। স্বর্ণলতাকে নিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ঢুকে পড়েছিল প্রায়। ঠিক তখনই দাদিজান চিৎকার করলেন,
” মানব। ”
সে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে তাকাল। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি! খাইরুন নিসা তার কাছে পৌঁছালেন দ্রুত কদমে। বললেন,
” তোর বউকে নাতবউ হিসেবে মেনে নিব। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের ভাব বদলাল না। রুক্ষ ও কঠোর। উচ্চতায় দাদিজানের চেয়ে অনেকটায় বেশি। পাশাপাশি বটগাছ ও চারাগাছের মতো। মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বলল,
” এখনও মেনে নেওনি? ”
” না। আমার একটা শর্ত আছে। যদি রাখিস, তাহলে মেনে নিব। ”
তার মাথা আগের মতো উঁচু হলো। মুহূর্তেই বুকটা টানটান হয়ে ওঠল। শক্ত চোয়ালদ্বয় নাড়িয়ে বলল,
” তোমার শর্ত রাখা তো দূর, শোনার জন্য সময় ও ধৈর্য কোনোটায় নেই। দাদিজান, তুমি এত ঝামেলা করছ কেন, বলতো। তুমি কি চাও আমি চিরকুমার থাকি? ”
” সেটা তো কখনই সম্ভব নয়, মুনছুর। সেই সুযোগ হারিয়েছিস, তিন বছর আগেই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মুখ থেকে শক্ত খোলসটা আচমকা ঝরে পড়ল যেন। চট করে তাকাল স্বর্ণলতার দিকে। সে চেয়ে আছে দাদিজানের দিকে। মুখের ভাব অবুঝ শিশুর মতো। চোখ দুটি পড়া যাচ্ছে না। মুনছুর সাখাওয়াত তার হাত ছেড়ে দিল। দাদিজানকে টেনে নিয়ে এলো একটু দূরে। চাপা স্বরে বলল,
” তুমি অতিরিক্ত কথা বলছ, দাদিজান। মুখে লাগাম দাও। নাহলে ভালো হবে না। ”
” কেন? মিথ্যা বলেছি কিছু নাকি কাহিনি বানিয়েছি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত অন্যদিকে ফিরে দাঁড়াল। হাত দুটি মু ষ্টিবদ্ধ হলো। ক্রো ধে চোখদুটি অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” কী চাও? ”
” আপাতত তোর বউকে পেলেই হবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কী একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কা মড়ে ধরে থাকল কতক্ষণ। দাদিজান আরেকটু খোঁচা দিলেন,
” মা রতে ইচ্ছে করছে? মা র, এটাই তো বাকি আছে। এখন ঐ মেয়েটি সব, আমি কিছু না৷ অবশ্য, আগেও কিছু ছিলাম না।
তার কণ্ঠে দুঃখবোধ। বিষাদের গাঢ় ছায়া নেমেছে মুখটায়। হতাশার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন এমনভাবে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। পিঠ ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” আবেগি কথাবার্তা বন্ধ করো, দাদিজান। স্বর্ণলতাকে দিয়ে তোমার কী কাজ? ওর সঙ্গে ঘুমিয়ে তোমার ফায়দাটা কী, সেটাই তো বুঝতে পারছি না! দাদাজান হলেও একটা কথা ছিল, বউ ভেবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে পারত। ”
” তোর বউকে দাদাজান জড়িয়ে শুয়ে থাকত? ”
খাইরুন নিসা প্রশ্নটা করে ‘ আস্তাগফিরুল্লাহ ‘ পড়লেন তিনবার। গলায় ঝুলিয়ে রাখা তহবি হাতে নিলেট চট করে। বিস্ফারিত চোখ জোড়া নাতির দিকে স্থির করে বিড়বিড় করছেন আপনমনে। মুনছুর সাখাওয়াত প্রতিক্রিয়া খুব একটা প্রকাশ পেল না। কপালে শীর্ণ ভাঁজ ফেলে সহজভাবে বলল,
” থাকতেই পারে। সমস্যা কোথায়? দাদাজান পুরুষ মানুষ তো? পুরুষের শরীরি গান মৃত্যু পর্যন্ত চলে। ”
” মুনছুর! মুখ সামলে কথা বল। যার নামে এসব বলছিস, সে আমার স্বামী। পরলোকবাসী। ”
দাদিজানের কণ্ঠস্বর উচ্চে, চোখে আ গুন জ্বলছে যেন! কী সুন্দর মার্জিত ভাষায় হু মকি দিয়ে ফেলল। মুনছুর সাখাওয়াত একপাশে ঠোঁট টেনে হাসল। ব্যঙ্গ করে বলল,
” মা রতে ইচ্ছে করছে? মা র। ”
সে মাথা নিচু করে গাল বাড়িয়ে দিল। খাইরুন নিসা মা রলেন না। শক্ত মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন। ঘন ঘন শ্বাস ছাড়লেন। মুনছুর সাখাওয়াত একটুক্ষণ অপেক্ষা করল। দাদিজানের দিকে চেয়ে আছে নীরবে। সহসা মাথা তুলে বলল,
” তোমার স্বামীর নামে দুটো মাত্র কথা বললাম, এতেই রা গে ফেটে পড়ছ। এদিকে আমার আস্ত বউটাকে চুপচাপ দিয়ে দিতে বলছ। এটা কি সুবিচার হলো, দাদিজান? ”
খাইরুন নিসার চোখের চাহনি ঘুরে এলো নাতির কাছে। বিস্ময়ের চাপে মনিদুটি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কী ভালো চাল দিল! কৌশলে বিচার ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হাসল। দাদিজান, কথার চালে হেরে গিয়েছে। তার ভারি আনন্দ হচ্ছে। আত্মগর্বে চওড়া বুকটা আরও চওড়া দেখাচ্ছে। এতে তার মন ভরল না। মাথাটা নুয়ে গেলেই শান্তিতে বুকটা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠবে। শান্ত ও সুধীর গলায় সুধাল,
” উত্তর দাও, দাদিজান। নিজের বেলায় ষোল আনা, আমার বেলায় এক আনাও নেই, কেন? ”
খাইরুন নিসা থতমত খেয়ে বসে আছেন। ভীষণ বিব্রতবোধ করছেন। আড়ষ্ট হয়ে এলো কণ্ঠস্বর। মাথাটা নুয়েই পড়ছিল, তখনই ভারী কিছু পড়ার শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো,
” ধুর বাল! করলেনটা কী? সব বাজার তো পইড়া গেল। দেইখা চলতে পারেন না? আল্লাহ কি আপনারে চোখ দেই নাই? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ দুটো তীরের তী ক্ষ্ণ ফ লার মতো গিয়ে বিঁধল দূরে। বড় দরজাটার কাছে। দাদিজানকে নিয়ে সে খাবার রুমের এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়িতে মোট চারটি রুম। তন্মধ্যে প্রথম ও শেষ রুম দুটি সে ও দাদিজান ব্যবহার করছে। মাঝের পাশাপাশি দুটো ফাঁকা। দরজায় তালা দেওয়া। খাবার রুম বেশ বড় ও লম্বা হওয়া সত্ত্বেও বড় দরজাটা দেখা যায়। সে দূর হতে দেখল, বড় দরজাটির সামনে চঞ্চল দাঁড়িয়ে আছে বিরক্ত মুখে। তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্ণলতা। মাথার ঘোমটা কাঁধে পড়ে আছে। চোখদুটি খিঁচে বন্ধ করে আছে। চঞ্চল এই বাড়ির পুরোনো কাজের লোক। তার প্রধান কাজ, বাজার করা। সপ্তাহে তিনদিন হাঁট বসে। তিনদিনই চঞ্চল বাজারে যায়। টাটকা শাকসবজি ও জ্যান্ত মাছ কিনে আনে বড়, গোল পাত্র ভরে। পাত্রটি তার মাথায় থাকে। এখন নিচে পড়ে আছে। জ্যান্ত মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শাকসবজিও ভালো অবস্থাতে নেই। দাদিজান খেয়াল করে দূর হতে জিজ্ঞেস করলেন,
” চঞ্চল, পড়ে গেলি নাকি? কতবার বলেছি, সাবধানে আসবি নাহয় প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে যাবি। দিলি তো, নোংরা করে! ”
সে কয়েক কদম এগিয়ে এলো। অভিযোগ তুলে বলল,
” আমি পড়ি নাই, আম্মাজান। এই মাইয়াডা ধা ক্কা দিছে। আল্লাহই মনে হয়, চোখ দেয় নাই। কানা মাইয়া কাজে নিছ ক্যান? ওই ধাক্কা খাওয়া আর দেওয়া ছাড়া করবটা কী? ”
কথাটা শেষ হওয়া মাত্র ঝড়েরবেগে ছুটে গেল মুনছুর সাখাওয়াত। একহাত চলে গেল চঞ্চলের গলায়। টুঁটি চে পে ধরে উঁচুতে তুলে নিল চোখের পলকে। পা দুটি মাটিতে থেকে উপরে উঠতেই তার কণ্ঠরোধ হলো। সম্পূর্ণ মুখটা র ক্তের মতো লাল হয়ে উঠার পর বলল,
” ভিতরে আসার অনুমতি দিয়েছে কে? ”
দাদিজান দুর্বল শরীর নিয়ে দৌড়ে আসতে বাধ্য হলেন। পিঠ চা পড়ে চটজলদি বললেন,
” আমি বলেছি। মুনছুর ছাড়, ম রে যাবে ছেলেটা। ”
সে ছাড়ছে না। দুর্দমনীয় রা গে মস্তিষ্ক বিগড়ে গিয়েছে যেন! কোনো দিকে তাকাচ্ছে না, কারও কথাও শুনছে না। শরীরটা পাহাড়ের মতো শক্ত ও অনড়। খাইরুন নিসার হাতের আঘাত বালির মতো ঝরে পড়ছে। ভ য়ে ও আতঙ্কে তার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। চেঁচাতে চেঁচাতে ক্লান্ত! হাতটাও অবশ হয়ে পড়েছে যেন! তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায় চোখে তাকালেন স্বর্ণলতার দিকে। সে অন্যদিকে ফিরে আছে, চোখদুটি এখনও বন্ধ। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে ডাকলেন,
” স্বর্ণলতা? মুনছুরকে থামাও। নাহলে চঞ্চলকে মে রে ফেলবে। চোখের সামনে খু ন হতে দেখতে পারব না আমি। ”
চাপা ও ক্ষীণ কণ্ঠটায় আকুতি, অসহায়ত্ব। স্বর্ণলতা চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারছিল, কী ঘটছে। সরাসরি দেখার সাহস পাচ্ছিল না। এবার চোখ মেলতে বাধ্য হলো। স্বামীর দিকে না চেয়ে বলল,
” আমি পালাইতাছিলাম। উনি সামনে আইসা আমারে আটকাইয়া দিছে। আপনার উপকার করছে। ছাইড়া দেন। ”
চঞ্চলের নিঃশ্বাস থেমে গেছে। চোখের আকার অস্বাভাবিক রকমের বড় দেখাচ্ছে। মার্বেলের মতো মনিদুটো ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জিভ বেরিয়ে দেহ থেকে আত্মা পালিয়ে যাচ্ছিল, এই সময় তাকে ছেড়ে দিল। ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত অবাক কণ্ঠে সুধাল,
” তুমি পালাচ্ছিলে? ”
স্বর্ণলতার এবার বুক কেঁপে ওঠল। গলা শুকিয়ে এলো। যতটা পারল পেছনে সরে গেল। দেয়ালের সঙ্গে পিঠটা ঠেকে যাওয়ার পর নিচু স্বরে উত্তর দিল,
” হ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার দিকে এগিয়ে গেল। একহাতে থুতনি চেপে ধরল আচমকা। মুখটা উঁচু করে পুনরায় সুধাল,
” তুমি পালাচ্ছিলে? ”
স্বর্ণলতা চোখদুটি আবারও খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। শ্বাসরোধ হয়ে আছে তার। কথা বেরুচ্ছে না। দুই হাতে শাড়ি খামচে ধরে মাথাটা দুলাতে পারল শুধু। সঙ্গে সঙ্গে মুনছুর সাখাওয়াত হাত সরিয়ে নিল। দাদিজানের দিকে চেয়ে বলল,
” তোমার শর্তে আমি রাজি। শুধু কথা দাও, স্বর্ণলতা যেদিন আমার ঘরে আসবে সেদিন ওর শুধু শরীর না, মনের কর্তৃত্বও পাব। যে সাহস নিয়ে, পালানোর মতো অন্যায় কাজ করেছে সেই সাহস নিয়ে, এই বাড়িতে থেকে যাওয়ার জন্য আমার কাছে কান্নাকাটি করবে। প্রতিবার নিঃশ্বাস টেনে নেওয়ার পূর্বে আমার নামে হাজারবার জিকির করবে। ”
খাইরুন নিসা আশ্চর্য হয়ে সুধালেন,
” তোর নামে জিকির করবে? ”
” হ্যাঁ, করবে। ”
” তুই কি পাগল হলি? এতটুকু মেয়ে, তোর নাম ধরবে! ঠিক বয়সে বিয়ে করলে, ওর বয়সী একটা মেয়ে থাকত তোর। ”
” ঠিক বয়সে বিয়ে হয়নি যেহেতু মেয়ের কথা ভাবছ কেন? আমার মাথা নষ্ট না করলে তোমাদের শান্তি হয় না? কী চাও, আমি মত পাল্টে ফেলি? ”
খাইরুন নিসা তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিলেন না। একটুক্ষণ দ্রুত ভাবনায় ডুবলেন। নাতির চাওয়া পূরণ হবে নাকি, নিশ্চিত হতে পারছেন না। কিন্তু মেয়েটা তো রক্ষা পাবে! এই ছেলে বাইরে তার সামনেই যে আচরণ করছে, ঘরে একা পেলে না জানি কী করবে! তিনি ভাবনা থেকে বেরিয়ে চটপটে বললেন,
” কথা দিলাম, তোর চাওয়ায় পূরণ হবে। তুই শুধু স্বর্ণলতাকে স্বাধীনভাবে এই বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরার অনুমতি দে। বাকিটা আমি দেখে নেব। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ ঘুরিয়ে দেখল বালিকা বধূকে। সে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটি খোলা হলেও দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে জমিনে। তার দিকে চেয়ে থেকে জবাব দিল,
” দিলাম। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১১)
মুনছুর সাখাওয়াত নাস্তার টেবিলে এসে দেখল, স্বর্ণলতা দাদিজানের নাস্তা সাজাচ্ছে। দুটো শুকনো রুটি ও এক বাটি সবজি তরকারি। সে দাদিজানের উল্টো দিকে বসল৷ খাইরুন নিসা চোখ তুলে দেখলেন নাতিকে। একভাবে চেয়ে আছে, স্বর্ণলতার দিকে। পলক পড়ছে না। অন্য কোথাও ধ্যান নেই। তিনিও দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলেন নাতবউয়ের দিকে। লাল রঙের সুতির শাড়িটিই পরনে আছে এখনও। কুঁচকে বেহাল অবস্থা! কেউ দেখলে বুঝবে না নতুন শাড়ি এটি, গতকালই প্রথম ভাঁজ খোলা হয়েছে। রাতের সাজ ধোয়নি পর্যন্ত মেয়েটা! চোখের কাজল ও ঠোঁটের লিপস্টিক ঘেটে গেছে। মুখটা অপরিষ্কার ও ফিকে দেখাচ্ছে। আহামরি সুন্দর না, তারপরও মুনছুর কী দেখছে এত যত্ন করে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতে শুনল,
” বাড়িতে কি ঝিয়ের অভাব পড়ছে, দাদিজান? ”
তার চোখের পলক কেঁপে ওঠল। চট করে দৃষ্টি সরে গেল নাতির মুখের দিকে। অবাক হয়ে সুধালেন,
” কেন? কী হয়েছে? ”
” বাড়ির বউ খাওয়া বাদ দিয়ে কাজ করছে। ”
খাইরুন নিসার মুখের ভাব কঠিন হলো। স্বর্ণলতা দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পাশে। খাবার বেড়ে দিচ্ছে। এই সামান্য কাজ করতে কি ঝিয়ের প্রয়োজন? বাড়ির বউয়ের কাজই তো যত্ন করে রান্না করা, খাবার বেড়ে দেওয়া। পরিবারের সদস্যদের কখন, কী প্রয়োজন খেয়াল রাখা। এতটুকু যদি না করে, তাহলে সংসারটা গড়ে উঠবে কীভাবে? মায়া তৈরি হয় যত্ন থেকে, ভালোবাসা তৈরি হয় মায়া থেকে, বিশ্বাস তৈরি হয় ভালোবাসা থেকে। সংসারের চারটি দেয়াল হলো মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও যত্ন। কোনো একটায় ফাটল ধরলে বাকিগুলোও নড়বড়ে হয়ে যায়। শুধু বিয়ে করে বউ আনলেই হবে না, সংসারের দেয়ালগুলোও খাড়া করে ধরে রাখার যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়। তবেই না সে সুখী, আদর্শ স্বামী।
” এই কাজটা আমি করেছি, তোর মাও করেছে। তখন ঝিয়ের কথা মনে পড়েনি, আজ পড়ছে কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানের দিকে তাকাল। নির্লজ্জের মতো অপকটে বলল,
” তখন তো আমার বউ ছিল না, দাদিজান। বউ থাকলে ঠিকই মনে পড়ত। স্বর্ণলতাকে খেতে বসতে বলো, আমি কাউকে ডাকছি। সে তোমাকে খাবার বেড়ে দিবে। ”
” আমি অন্য কারও হাতে খাব না৷ আমার জিনিস ছুঁতেও দিব না। হয় তোর বউ করবে, নাহয় আমি নিজেই করব৷ ”
” আবার শুরু করলে? তোমার ব্যবহারে মনে হচ্ছে, স্বর্ণলতা তোমার সতীন। দাদাজান তোমাকে ঠকিয়ে ও কে বিয়ে করেছে। সব ভালোবাসাও পাচ্ছে। তুমি এটা কিছুতেই মানতে পারছ না। ঈ র্ষায় শরীর পু ড়ে যাচ্ছে। সেই জ্বালা কমাতে স্বর্ণলতাকে দিয়ে কাজ করাতে চাচ্ছ, কষ্ট দিতে চাচ্ছ। ”
” যা খুশি ভাব, কিন্তু আমার কথা নড়চড় হবে না। ”
দৃঢ়প্রত্যয়ে কথাটা বলেই চোখটা নামিয়ে নিলেন৷ তার হঠাৎই স্মরণ হলো, মুনছুরকে অনেকদিন পর নাস্তার টেবিলে পেলেন। ছেলেটার জীবনে দিনরাত বলতে কিছু নেই। সময়ের হিসেবও নেই। যখন ইচ্ছে হয় বেরিয়ে যায়। ফেরার নামগন্ধ থাকে না৷
” গতকালও তো স্বর্ণলতা ছিল না, তখন তোমার কাজ কে করেছে? ”
” রুমকি। সেটাও কি তোর সহ্য হয়েছে? সোজা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলি। ”
” ও এলে, আমার বউকে মুক্তি দিবে? ”
” দেখি। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চাহনি তীক্ষ্ণ হলো। মৃদু শাসানির সুরে বলল,
” দেখি বললে হবে না, দাদিজান। নিশ্চিত হয়ে বলো। তাহলে রুমকির দ্রুত ফেরার ব্যবস্থা করছি৷ ”
খাইরুন নিসা তৎক্ষনাৎ জবাব দিলেন না৷ নীরবে চেয়ে আছেন নাতির দিকে। মুখের ভাবটা কি বদলাচ্ছে? কণ্ঠস্বরের ঝাঁজ কমে এসেছে নাকি? তিনি স্বর্ণলতার দিকে তাকাতেও ভুললেন না। তার কাজ শেষ। নাস্তার প্লেট সাজানো হয়ে গিয়েছে অথচ একবারটি বলছে না, তার সামনে এগিয়েও দিচ্ছে না। তিনি নিজেই প্লেটটি টেনে নিলেন। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, রুমকিকে সম্পূর্ণ সুস্থতা দান করবেন। সেটিও মুনছুরের হাত দিয়ে। ভেতরে ভেতরে খুশি লাগলেও মুখটা গম্ভীর করে বললেন,
” রুমকি এলে, তোর বউয়ের ছুটি। কিন্তু যতদিন না ফিরছে, ততদিন আমার সব কাজ করবে। তুই বাঁধা হবি না। ”
” ঠিক আছে। ”
ছোট্ট উত্তরটা প্রদান করে সে উঠে দাঁড়াল। চেয়ার সরিয়ে বেরিয়ে আসতে তিনি উদ্বিগ্ন গলায় সুধালেন,
” চলে যাচ্ছিস নাকি, খাবি না? ”
” আমাকে কেউ খাবার দিলে তো, খাব। খালি প্লেটে আর কতক্ষণ বসে থাকব? ”
শক্ত গলায় কথাটা বললেও খাইরুন নিসা গুপ্ত অভিমানের আঁচ পেলেন। তার ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠল। ছেলেটার মধ্যে অভিমান বেঁচে আছে তাহলে! তিনি মন গলাতে চাইলেন,
” আহা, রাগ করছিস কেন? বস, খাবার দিবে। এত অধৈর্য হলে চলবে? ”
তখনই স্বর্ণলতার দিকে ফিরে চটপটে আদেশ করলেন,
” মুনছুরের প্লেটটাও সাজিয়ে দাও। ”
সেই সুযোগ পেল না৷ তার পূর্বেই মুনছুর খাবার টেবিল ছাড়ল। দাদিজান দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছন ডেকে বললেন,
” বেরুচ্ছিস নাকি? ”
সে বড় দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। বাইরে তার দলবল অপেক্ষা করছে। মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। দাদিজান টের পেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আসবি কখন? ”
” জানি না। আসলে দেখতেই পারবে। ”
” ঠিক আছে। আমি স্বর্ণলতাকে নিয়ে একটু বেরুব। ”
সে থমকে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল স্বর্ণলতার দিকে। মাথাটা এখনও গুঁজেই আছে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে আড়ষ্টতা, মুখে অসহায় ও বাধ্যতা গ্রহণের তাগিদ। চাহনি সরে এলো দাদিজানের দিকে। জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় যাবে? ”
” জেলা হাসপাতালে। রুমকিকে দেখতে যাব। ”
” তুমি যাও। স্বর্ণলতা যাবে না। ”
” যাবে। একটু আগে কী কথা হলো, নাতভাই? ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিরক্ত হলো। ভ্রদ্বয় বেঁকে গেল আপনাআপনি। চোখদুটো দেখাচ্ছে ছোট ছোট। দাদিজান সুযোগটাকে ভালোই কাজে লাগাচ্ছে! গোঁফে আঙুল রেখে গম্ভীরমুখে বলল,
” ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাচ্ছি। ”
” তুইও যাবি? ভালোই হবে, রুমকি দেখলে খুশি হবে। ”
” ছোটলোক মেয়েছেলের খুশি দিয়ে আমার কী কাজ? এসব ন্যাকামি কথাবার্তা আমার সামনে বলবে না তো। ”
সে বড় দরজা দিয়ে নেমে গেল। দরজার আড়ালে পৌঁছাতেই স্বর্ণলতা বলল,
” দাদিজান, উনি হাঁটলে মাটি কাঁপে ক্যান? উনারে কি মাটিও ভ য় পায়? ”
খাইরুন নিসা কী জবাব দিবেন ভেবে পেলেন না। আচমকা হেসে ফেললেন। বয়সের রেখা পড়া নরম ঠোঁট জোড়ায় সেই হাসি অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। স্বর্ণলতার মনে হলো, এত সুন্দর হাসি সে আর কখনও দেখেনি।
________
বেলা দশটা। ফাল্গুনের দাপুটে সূর্য মাথার উপরে। স্বর্ণলতা দুই মিনিটেই ঘেমে ওঠল। গরমে হাঁসফাঁস করছে। এই প্রথম সে বোরকা পরেছে। বোরকাটি এনে দিয়েছে মুনছুর সাখাওয়াত। মাপে ঠিক হয়নি, বেশ ঢোলা। তার জীপগাড়িতে ভালোই বাতাস! নেকাব উড়ছে। শরীর দুলছে। স্বর্ণলতা খেয়াল করল, গাড়িটিও কাঁপছে। দাদিজান তার পাশেই বসে আছেন। সে মুখ এগিয়ে নিল তার কাছে। ফিসফিসে বলল,
” উনি তো এহন হাঁটতাছে না, তাও গাড়ি কাঁপে ক্যান? ”
” মুনছুর হাঁটলে জমিন কাঁপে, গাড়িতে বসলে গাড়ি কাঁপে। ”
” ক্যান? কাঁপানো ছাড়া কি উনি কোনো কাজ করতে পারে না? ”
” না। ”
স্বর্ণলতা মুখ সরিয়ে নিল। নেকাব বাঁধা এত শক্ত হয়েছে যে, তার মাথা ধরে গেছে। কানের কাছে ব্যথাও হচ্ছে। এই জিনিসটি না পরলে কি হতো না? এই সময় সামনে থেকে কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” দাদিজান, ভালো করে ধরে বসো। সামনের রাস্তা ভাঙা। ”
খাইরুন নিসা আগে থেকেই ধরে ছিলেন। রাস্তাটা তার চেনা। কতবার যে, এসেছে! হিসেব নেই। মুনছুরের বাবার প্রাণটা তো জেলা হাসপাতাল থেকেই ত্যাগ করল! তিনি স্বর্ণলতাকে সাবধান করলেন,
” ভালো করে ধরে বসো। ”
সে কোথায় ধরবে বুঝতে পারছিল না। তাই দাদিজানকেই চেপে ধরল। সাথে সাথে ধ মক খেল,
” আরে কী করিস? গোসল-টোসল তো কিছুই করিসনি। ছাড়, আমাকে। ”
ঠিক তখনই গাড়ির ব্রেক কষে বসল মুনছুর সাখাওয়াত। পেছনে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল দাদিজানের দিকে। তিনি কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলেন,
” এখানে থামালি কেন? ”
” হাসপাতালে যাব না। ”
” কেন? গাড়ি নষ্ট হলো নাকি? ”
” না। ঠিকই আছে। ”
” তাহলে? ”
” আমার বউ তোমাকে ধরলে যদি সমস্যা হয়, তাহলে তুমি আমার গাড়িতে বসলেও সমস্যা। গোসল তো তুমিও করোনি। ”
তিনি হতভম্ব হলেন। পরক্ষণে অপমানে মুখ কালো হলো। রা গ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” ও আর আমি এক? ”
” একই তো। ও মেয়ে, তুমিও মেয়ে। ওরমধ্যে যা আছে, তোমার মধ্যেও তা আছে। পার্থক্য শুধু বয়সে। সম্পর্কেও। তুমি আমার দাদিজান হও, স্বর্ণলতা আমার বউ। ”
খাইরুন নিসা ক্ষেপে গেলেন। রা গটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না কিছুতে। জীপ থেকে সোজা নেমে পড়লেন। রোদের মধ্যে হাঁটা ধরলেন সামনে। স্বর্ণলতা ভ য়ে ও আ তঙ্কে পাথর হয়ে গেল। ইচ্ছে তো হলো, দাদিজানকে আটকাতে। কিন্তু পারল না। আড়চোখে তাকাল সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে। তার দিকে চেয়ে আছে। ধরা পড়তে শুনল,
” চুপচাপ বসে থাকো। এটা আমাদের দাদি, নাতির সমস্যা। আমরাই মিটমাট করব। তুমি মাঝে আসবে না। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১২)
দাদিজান কয়েক কদম হেঁটেই হাঁপিয়ে ওঠলেন। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে! এক সেকেন্ডের জন্য থামলেন। দম নিলেন জোরে জোরে। অতঃপর ঘাড় বাঁকা করে মাথা তুললেন ঊর্ধ্বে। রোদ্দুরের তাপে শরীর ঝলসে যাচ্ছে যেন! সূর্যটা আকাশেই আছে, নাকি নিচে নেমে আসছে সেটাই পরখ করে দেখছেন। মুনছুর সাখাওয়াত তার পেছন পেছন আসছিল। জীপের গতি কমানো। দাদিজানকে থামতে দেখে জীপ টান দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পাশাপাশি হয়ে বলল,
” অনেক রা গ হয়েছে, এবার জীপে উঠে বসো। ”
খাইরুন নিসা এত সহজে হার মানতে নারাজ। মুখ ঝামটা মেরে হাঁটা শুরু করলেন। রোদের তাপ যত বাড়ছে পায়ের জোর ততই কমছে। শরীর এত দ্রুত কাহিল হয়ে উঠবে ভাবতে পারেননি। লাল মাটির মসৃণ রাস্তা। সারি সারি রেন্ট্রি ও কাঁঠাল গাছ। পাতা নেই বললেই চলে। শীতের শেষে পাতা ঝরা শুরু হয়েছিল, এখনও ঝরছে! ফাঁকে ফাঁকে কচি পাতা উঁকি দিচ্ছে। রোদ্রের আলোয় কী দারুন চকচকে দেখাচ্ছে!
” এখান থেকে মেইন রোডে উঠতে আধা ঘণ্টা লাগবে, দাদিজান। মেইন রোডে উঠার পর আরও এক ঘণ্টা। এতক্ষণ হাঁটতে পারবে তো? ”
খাইরুন নিসা চ ড়া মেজাজে উত্তর দিলেন,
” আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না। তুই তোর বউকে নিয়ে ভাব। ”
” এই যে! আবারও আমার বউকে নিয়ে পড়লে। ও তোমার কী ক্ষতিটা যে করেছে, সেটাই বুঝছি না। ”
” ও ক্ষতি করতে যাবে কেন? ক্ষতি তো করেছিস তুই। রক্ত হয়ে রক্তকে অপমান করিস! দাম দিস না। এই দিন দেখার জন্যই তো বেঁচে আছি এখনও! ”
তিনি আবারও থেমে গেলেন। নাভিশ্বাস উঠে গেছে। গলাটাকে মরুভূতির মতো শুকনো ও উত্তপ্ত লাগছে। এভাবে হয়তো দশ মিনিটও টিকতে পারবেন না। খাইরুন নিসা সামনে এগুনোর সাহস পাচ্ছেন না। হৃদযন্ত্রটায় গোলমেলে লাগছে। ধীরগতিতে পা দুটোকে টেনে নিয়ে গেলেন কাঁঠাল গাছের নিচে। ছায়া নেই, বাতাস নেই। গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। স্বর্ণলতার মতো তার পরনেও কালো রঙের ঢিলেঢালা বোরকা। মাথায় নেকাব বাঁধা। নেকাবের বাঁধন খোলার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। আশ্চর্য, তার হাতটা নড়ছে না!
মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থামাল। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো দ্রুত। দাদিজানের কাছে পৌঁছে গলাটা জড়িয়ে ধরল। তার জীপকে অনুসরণ করছিল দুটো মোটর সাইকেল। কয়েক গজ দূরত্ব রেখে ধেয়ে আসছিল। প্রত্যেকটিতে তিনজন করে যাত্রী। তাকে থামতে দেখে মোটর সাইকেল দুটোও থেমে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত তাদের দিকে চেয়ে বলল,
” পানি আন কেউ। জলদি পানি আন। ”
আদেশ দিতে দিতে দাদিজানের নেকাব খুলে দিল সে। মুখটা ভাপে সিদ্ধ কাঁচা মাংসের মতো দেখাচ্ছে। লাল টকটকে, ঘামে ভেজা। চোখের চাহনি অত্যধিক দুর্বল। পালকযুগল বন্ধ হয়ে আসছে। মুনছুর সাখাওয়াত গালে মৃদু ও ঘনঘন থা প্পড় দিতে দিতে ডাকল,
” দাদিজান? আমার দিকে তাকাও। তাকাও না! ”
এরমধ্যে পান্না দৌড়ে এসে জানাল,
” মহাজন, এইখানে পানি কই পামু? আশপাশে বাড়িঘর, দোকানপাট কিছুই নাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একহাত বাড়িয়ে তার শার্টের গলা চেপে ধরল। নিজের মুখের কাছে টেনে এনে রক্তিম চোখে শা সাল,
” আমি পানি আনতে বলেছি, আনবি। এত কথা কিসের? প্রা ণের মায়া নেই? ”
সজোরে ধা ক্কা দিয়ে ছেড়ে দিল। সে টাল সামলাতে পারল না। কয়েক কদম পেছনে ছিটকে পড়ল রাস্তার কিনারে। ঢালু রাস্তা! আকড়ে ধরার মতো কিছু নেই। সে দুইহাতে মাটি খামচে ধরেও বাঁচতে পারল না। গড়িয়ে পড়ল নিচে। তার এই বিপন্ন অবস্থা ও মহাজনের বি কৃত মেজাজের চাক্ষুষ সাক্ষী হলো অন্যরা। সামনে এগুনোর সা হস পেল না। দূর হতেই অপেক্ষায় আছে, মহাজনের পরবর্তী আদেশের।
মুনছুর সাখাওয়াত দেখল, দাদিজানের চোখ বন্ধ। শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে। মাথা এলে আছে তার কাঁধে। সে ব্যাকুল হয়ে আরও কয়েকবার থা প্পড় দিল দুই গালে। সাড়াশব্দ না পেয়ে কোলে তুলে নিল তখনই। জীপের পেছনে পৌঁছে তাকাল স্বর্ণলতার দিকে। সে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। নেকাবে ঢাকা মুখ। খোলা চোখদুটি তার দিকে পড়তে বলল,
” দাদিজান অজ্ঞান হয়ে গেছে। ভালো করে ধরে থাকো। ”
স্বর্ণলতা কিছু বুঝার আগেই, দাদিজানকে তার কাছে বসিয়ে দিল। মাথাটা কাঁধে রেখে, তার একটা হাত টেনে আনল মাথার কাছে। অন্যহাত দিয়ে কোমরটা প্যাঁচিয়ে দিয়ে পুনরায় বলল,
” যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে! আমি জোরে গাড়ি চালাব। গাড়ি ঝাঁকি খাবে। ভয় পেও না। বড় রাস্তায় উঠলেই ঝাঁকি খাবে না আর। ঠিক আছে? ”
স্বর্ণলতা কিছু বলতে পারল না। রোবটের মতো দুইহাত দিয়ে দাদিজানকে চেপে ধরে আছে। একটুও নড়ছে না। নিশ্বাস নিচ্ছে ধীরে। পলক ফেলছে থেমে থেমে। তার বার বার মনে হচ্ছে, মুনছুর সাখাওয়াত জীপ থেকে নামলেই দাদিজান ছুটে যাবে। গড়িয়ে পড়বে রাস্তায়। তারপর কী হবে? সে শুকনো ঢোক গিলল। মানুষটা সামনে থেকে যাচ্ছে না। তার দিকে চেয়ে আছে। উত্তরের অপেক্ষা করছে কী? এরমধ্যে কণ্ঠস্বরটা আবারও বাজল,
” স্বর্ণলতা, জবাব দাও। আমি কী বুঝাতে পেরেছি? নিজেকেসহ দাদিজানকে সামলাতে পারবে তো? ”
সে চোখ তুলল। ভীত ও অনাস্থার চাহনি! মুনছুর সাখাওয়াত কী বুঝল কে জানে! আচমকা হাঁক তুলল,
” কাশেম? জীপে ওঠ। ”
সে মোটরসাইকেলে বসে ছিল। ডাক পেয়ে নামল। দৌড়ে এসে প্রশ্ন করল,
” কুনদিকে উঠমু? ”
” সামনে। গাড়ি চালা। ”
” আমি? ”
থতমত কণ্ঠস্বর! কাশেমকে ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও, গাড়ি চালানোর সুযোগ হয়নি তার। চার বছর ধরে সে বডিগার্ডের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাজনের সাথে। শুরুতে খুব করে চাইত, যে পেশায় নিয়োগ পেয়েছে সেই কাজটা করতে। মাস গড়াতেই সেই চাওয়া বদলে গেছে। মহাজন এত জোরে জীপ চালায় যে, তার পেছনে বসলেও বুক কাঁপে। মৃ ত্যুপথ দেখতে পায়। চোখ বন্ধ করেও শান্তি নেই। মনে হয়, অন্ধকার কবরে বসে আছে। এরচেয়ে বডিগার্ডের মতো থাকা ঢের ভালো। রগ চটা মানুষ! কথার চেয়েও হাত চলে বেশি। কিন্তু সবসময় ডাক পড়ে না। যখন পড়ে তখন জিহ্বার আগা নাচায় আল্লাহ আল্লাহ জপে।
মুনছুর সাখাওয়াত জীপের উপর দাঁড়িয়ে থেকে গ রম চাহনি ছুঁড়ল। সে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দৌড়ে গিয়ে বসল জীপের সামনে, ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন চালু করতেই শুনল,
” সোজা ছুটবি। কোথাও থামবি না। গতি বাড়া। ”
সে আদেশ মোতাবেক গতি বাড়াল। সামনে ছুটে যেতে যেতে সুধাল,
” কোথাও থামমু না? সামনে যদি কেউ চইলা আসে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানের পাশে বসেছিল। ইঞ্জিন চালু হতেই হাত বাড়াল স্বর্ণলতার দিকে। দাদিজানকেসহ তার কোমর চেপে ধরে টেনে আনল খানিকটা। তারপরে উত্তর দিল,
” উড়িয়ে দিবি। ”
উত্তরটা কানে পৌঁছাতে স্বর্ণলতা চমকে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত টের পেয়ে বলল,
” আমি ধরে আছি, তারপরও কাঁপছ! আমি কি তোমার পাশে আসব? ”
জীপ ঝাঁকি খাচ্ছে, ছুটছে সর্বোচ্চ গতিতে। শোঁ শোঁ শব্দ উঠেছে কানের কাছে। স্বর্ণলতার কাছে প্রশ্নটা পৌঁছাল নরম হয়ে, যত্নের সাগরে ডুবতে ডুবতে। সে মাথা ঘুরিয়ে ফেলল অন্যদিকে। কোমরে চেপে থাকা হাতটা টেনে সরিয়ে বলল,
” না। দাদিজান কইছে, আপনার আশেপাশে না থাকতে। ”
” এখন দাদিজানের জ্ঞান নেই, দেখতে পাবে না। আসি? ”
স্বর্ণলতার মাথাটা আবারও ঘুরল। এবার স্বামীর দিকে। চোখের চাহনি অস্বাভাবিক রকমের বড়। বিস্ময়ের জ্যোতি বেরুচ্ছে সম্পূর্ণ বদনখানি থেকে।
” একটু সময়ের জন্য জ্ঞান হারাইছে, এরমধ্যেই কুপ্রস্তাব দেওয়া শুরু করছেন? দাদিজানের জ্ঞান ফিরতে দেন। সব কইয়া দিমু। ”
” আমি কুপ্রস্তাব দিয়েছি? ”
” অবশ্যই দিছেন। একটা কুমারি মাইয়ার পাশে বসতে চাওয়া কুপ্রস্তাবই। আপনার বাপ-মা শিখাই নাই? ”
” শিখাইছে। কিন্তু তুমি তো কুমারি নও, স্বর্ণলতা। তোমার বিয়ে হয়েছে। এখন তুমি বিবাহিত। আমার বউ। বউয়ের পাশে বসার জন্য প্রস্তাব রাখতে হয় না। এমনি বসা যায়। আমি ভদ্রতা দেখিয়ে, প্রস্তাব দিলাম। ”
স্বর্ণলতার ভ্রূযুগল কচি লতার মতো বেঁকে গেল। বিরক্তের একটা ভাব ফুটেও ফুটছে না। সূর্যের কড়া আলো এসে পড়েছে মুনছুর সাখাওয়াতের মুখে। শক্ত চোয়ালের রুক্ষ মুখটা ঝলমল করছে। মাঝেমধ্যে গাছের ডালের ছায়া পড়ছে। তখন বেজায় গোমড়া লাগছে। আলো, ছায়ার স্পর্শে আচানক রঙ বদলের খেলাটা ভালো লাগছে। তার হঠাৎ করে মনে হলো, মুখটা রুক্ষ নয়। নরম, মসৃণ, লালিত্যপূর্ণ চেহারা। রঙটাও এতটা মরা নয়। পাকা ধানের মতো উজ্জ্বল। মোটা গোঁফটা না থাকলে শান্তশিষ্ট, সুবোধ বালকের মতো দেখাত। এই সময় ক্যাঁক করে একটা শব্দ হলো। স্বর্ণলতার কিশোরী দেহ ও মনটা আরও একবার চমকে ওঠল। ঘাড়টা ঝটিতে সামনের দিকে ফিরতে শুনল,
” উড়াই দিছি, মহাজন। রাজহাঁসের দল আইছিল। চার-পাঁচটা মাটিতে মিশশা গেছে। তাজা র ক্ত ছিটটা আইছে! বাড়িত ফিরা গাড়িটা ধুইতে হইব। আপনার তো..”
” চুপ শালা। আর একটা কথা বললে জবান কে ড়ে নিব। তুই অনেক বেশি কথা বলিস। ”
তাকে ধ মকে থামিয়ে স্বর্ণলতার ওপাশের গালে হাত রাখল। জোর করে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
” ভ য় পেও না। ও মজা করছে। চামচা তো! মহাজনকে খুশি করতে পারলেই বেতন বেড়ে যাবে, এই লোভে মিথ্যা বলছে। ”
স্বর্ণলতা চুপ হয়ে গেল। সে শব্দ পেয়েছে, মৃ ত্যুর পূর্বের আর্তনাদ শুনেছে। রাজহাঁসগুলো কি সত্যি মাটির সাথে মিশে গিয়েছে? আহা রে! বোবা প্রাণীগুলো কি জানত, এই রাস্তায় মৃ ত্যু লেখা আছে? জানলে আসত না।
জীপ বড় ও ব্যস্ত রাস্তায় উঠে গেল। ঢালাই করা রাস্তা। বছর দুই হলো পাকা হয়েছে। এখনও কী পরিষ্কার, চকচকে! স্বর্ণলতা উল্টোদিকের রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছে। বাবার মুখে এই রাস্তার গল্পও শুনেছিল। ঢাকা শহরে যাওয়ার রাস্তা এটাই। নব্বই টাকা দিলেই টিকেট দিবে। সেই টিকেট ব্যবহার করে বাসে উঠতে হবে। বড় বাস! সোজা গিয়ে নামিয়ে দিবে শহরের মুখে। স্বর্ণলতা মাথাটা আরেকটু উঁচু করল। টিকেট বেচাকেনা কোথায় হয়, খুঁজছে। পেল না। কিন্তু বড় বড় দুটো বাস তাদেরকে ডিঙিয়ে যেতে দেখল। ছোটবাসও আছে। বেশিদূর গেল না। একটু সামনে গিয়েই থেমে গেল। সে অবাক হয়ে দেখল, সেখানে তিন চাকার রিকশা দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো। বাবার মুখে রিকশার গল্পও শুনেছে। বইয়ে ছবি দেখেছে। তাদের গ্রামের রাস্তায় এই রিকশা নেই। ঠেলাগাড়ি অথবা ভ্যান! উঠলে মাথায় রোদ লাগে, বৃষ্টি পড়ে। রিকশায় উঠলে হুড তোলে দেওয়া যায়। রোদ লাগবে না, বৃষ্টিও পড়বে না। আহা, কী আশ্চর্যজনক যান!
যেখানে ছোটবাস থেমেছিল সেখানে তাদের জীপটাও থেমে গেল। মোটরসাইকেল দুটোও থামল। মুনছুর সাখাওয়াতকে আদেশ করতে হলো না। একজন নেমে দৌড় লাগাল দোকানে। রাস্তার কিনারে। সারি সারি দোকানঘাট। হোটেল, চায়ের ও মুদির দোকান সবই আছে।
” মহাজন, পানি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত পানির বোতল নিল। দাদিজানের মুখে ছেটাল, মাথায় ঢালল। অতঃপর স্বর্ণলতার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” একটু পানি খাও। ”
সে দুই চোখ মেলে বাইরের আশ্চর্যজনক সৌন্দর্য দেখছিল। মুগ্ধ ও কৌতূহলী দৃষ্টি কাঁপল তার কণ্ঠে। বোতলের দিকে এক পলক চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। তখনই দাদিজানের চোখ পিটপিট করতে লাগল। ঠোঁট দুটো হালকা মেলে অস্পষ্ট ও ক্ষীণ সুরে উচ্চারণ করল,
” পানি। ”
স্বর্ণলতা চট করে বোতলটা কে ড়ে নিল। দাদিজানের মুখের সামনে ধরে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলল,
” এই তো পানি। দাদিজান, একটু হাঁ করেন। ”
তিনি হাঁ করলেন। সে অল্প অল্প করে পানি ঢেলে দিল মুখে। মুনছুর সাখাওয়াত নীরবে দেখছিল। খাইরুন নিসা পানি পান করে একটু সুস্থবোধ করছেন। ধীরেসুস্থে উঠে বসতেই সে বলল,
” যার ছোঁয়াকে ঘৃণা করলে, তার কাঁধে মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলে। তোমার সতীনের মনে মায়া-দয়া আছে ভালোই। ”
সে জীপ থেকে লাফিয়ে নামল। কাশেমকে সরিয়ে নিজে বসল ড্রাইভার সিটে। ভেতর থেকে বলল,
” শার্ট খোল। ”
কাশেম এক ঝলকে চারপাশটা দেখে বলল,
” এইখানে শার্ট খুলমু? ”
” হ্যাঁ, খুলবি। খোল। ”
সে মুখ কালো করে শার্ট খুলল। মহাজন সেই শার্ট ছো মেরে নিল। তারপর বলল,
” প্যান্ট খোল। ”
কাশেম আঁতকে ওঠল। কান্নাপ্রায় গলায় অনুরোধ করল,
” মাফ কইরা দেন, মহাজন। আর ভুল হইব না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত সেই অনুরোধ রাখল না। জানালা গলিয়ে মাথা বের করতে মোটরসাইকেল থেকে দুজন নেমে এলো। তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল অন্যত্র। জীপ ছুটিয়ে নিতে নিতে সে আদেশ করল,
” ও কে ন্যাংটা করে ছেড়ে দে। আমার কাছে ফেরত আসতে আসতে শিখে ফেলবে, কখন কী বলতে হয়। শু য়োরের বাচ্চার জন্য বউয়ের সাথে ভাবটা হতে হতেও হলো না! ”
শেষের বাক্যটা নিচু স্বরে বলেছে। দাদিজান শুনতে পাননি, প্রথমগুলো শুনেই ফোঁড়ন কাটল,
” কাকে ন্যাংটা করবে! কেন? মুনছুর, তুই কি ভালো হবি না? বউয়ের সামনে কী বলছিস, কী করছিস? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নগুলো জবাব দিল না। বলল,
” তোমার শরীর দুর্বল। আমাকে ভালো বানানো বাদ দিয়ে, তোমার সতীনকে ধরে থাকো। ”
স্বর্ণলতা কানের কাছে ফিসফিস করে বলে দিল,
” কাশেম ভাইকে ন্যাংটা করবে। ”
খাইরুন নিসা আবারও উত্তেজিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” কাশেমে আবার কী করছে? ও তো ভদ্র, শিক্ষিত পোলা। ”
স্বর্ণলতা আবারও কানের কাছে মুখ নিল। ফিসফিস করে বলল,
” রাজহাঁস মাইরা দোষ করছে। ”
” রাজহাঁস মা রছে? হায় আল্লাহ! গজব পড়বে তো। ”
” গজব আপনার নাতির উপরেই পড়বো। উনি মা রতে কইছেন! দোষ করছে নিজে, শাস্তি দিতাছে আরেকজনরে। ”
স্বর্ণলতা মুখ ভেংচাল। মুনছুর সাখাওয়াত গাড়ি থামিয়ে দিল আচমকা। পেছনে ফিরে বলল,
” বলেছিলাম, আমার আর দাদিজানের মাঝে আসবে না। তারপরও এলে! ”
চলবে