#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১৬)
মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ির কোনো কাজে হাত দেয় না৷ উপস্থিতও থাকে না। তার যত কাজ, তদারকি সব বাইরে। বাড়ি থেকে ভোরে বের হয়, নিশিতে ফিরে। কখনও দাদিজানের সাথে দেখা করে, টুকটাক কথা বলে। কখনও দেখাই করল না। ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে হাওয়া। দাদিজান হয়তো জানতেই পারল না! তিনি দিবানিশি চিন্তিত ও শঙ্কিত হয়ে থাকলেন।
আজ রাতে মুনছুর সাখাওয়াতকে কাজে পাওয়া গেল। দাদিজান রুমের মধ্যে বসেও তার হাঁটাচলা, হু মকি-ধ মকি শুনতে পাচ্ছেন। কাকে যেন একটা চ ড়ও মা রল! সেই শব্দে স্বর্ণলতা ও দাদিজান দুজনেই চমকে কেঁপে ওঠল। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকল ক্ষণকাল। চাঁদনির মধ্যে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে স্বাভাবিক , নির্লিপ্ত। আশেপাশের কোনো শব্দই কানে ঢুকছে না বোধ হয়। একমনে চুল আঁচড়ে যাচ্ছে। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করল,
” গন্ধটা সুন্দর না, মুনছুরের বউ? ”
স্বর্ণলতা আরও একবার কেঁপে ওঠল। সচকিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল চাঁদনির ওপর। অবুঝের মতো প্রশ্ন করল,
” জি? ”
চাঁদনি চুলে চিরুনি চালানো বন্ধ করল। আয়নায় স্বর্ণলতাকে দেখা যাচ্ছে। সে বসে আছে, দাদিজানের কাছে। বিছানার এককোণে। দুজনের মধ্যে একহাতের মতো দূরত্ব থাকায় দাদিজান আয়নার সীমানায় পড়েনি। চাঁদনি মৃদু হেসে চুলগুলো দুই হাতে নেড়ে পুনরায় সুধাল,
” গন্ধটা সুন্দর না? ”
” কিসের গন্ধ? ”
” আমার চুলের। পাচ্ছ না? এত দূরে বসে থাকলে পাবে কীভাবে? কাছে আসো। ”
স্বর্ণলতা নেমে এলো। চোখ দুটি আপনাআপনি চলে গেল চাঁদনির চুলে। ঘন কালো কেশগুচ্ছ। রেশম তন্তুর মতো মজবুত ও উজ্জ্বল। পিঠটাকে এত ভালোভাবে ঢেকে ফেলেছে যে, এক ইঞ্চিও দেখা যাচ্ছে না। লম্বায় হাঁটু ছুঁবে অনায়াসে। সে মুগ্ধ না হয়ে পারল না। এতক্ষণ বেনি করা ছিল বিধায় লম্বার মাপটা সঠিকভাবে বুঝা যায়নি। চাঁদনি তার উপস্থিতি পেয়ে সাগ্রহে বলল,
” আরও কাছে আসো। এক বোতল শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়েছি। গন্ধ না ছড়ালে হলো কিছু? আমার স্বামীর টাকাগুলো এমনি এমনি জলে ভাসবে নাকি! ”
স্বর্ণলতার আরও কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই৷ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকেই গন্ধ পাচ্ছে। মিষ্টি গন্ধ। নাকে লাগলেই আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। অপ্রবিত্তে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। শরীরের ক্লান্তি পালিয়ে যায়। স্বর্ণলতার শরীরটাও সতেজ হয়ে ওঠল। মন হলো চনমনে। চাঁদনিকে খুশি করতে আরও একপা এগিয়ে বলল,
” পাইতাছি। ভালা গন্ধ তো। মন চাই, খাইয়া ফেলাই। ”
চাঁদনির মুখের হাসি হাসি ভাবটা ফিরে এলো। লজ্জার লালচে রঙ স্পষ্ট হলো গাল ও নাকের আগায়। চোখের ভেতরটায় অদ্ভুত সুন্দর প্রভা ছড়াচ্ছে। স্বর্ণলতা পেছন থেকেও সেই মুখটা দেখতে পাচ্ছিল আয়নাতে। এত নিবিড়ভাবে আকণ্ঠ মুগ্ধ দৃষ্টিতে কোনো নারীকে এর আগে দেখেনি। এই মুখ, এই মেয়েটি তার এত ভালো লাগছে কেন!
” ঝিদের এই এক দোষ! যা দেখে, তাই খেয়ে ফেলতে চায়। ওদের পেটে কি আল্লাহ তলানি দেয়নি? সারাক্ষণ ক্ষিধে লেগেই থাকে! ”
খাইরুন নিসা নীরবে একাগ্রতায় তসবিহ পাঠ করছিলেন। চাঁদনির কথাটা কানে ঢুকতেই ধ মকে ওঠলেন,
” চাঁদনি! জিভ সামলে কথা বল। মুনছুর কিন্তু বাইরেই আছে। দেখা যাবে, আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে তোর জিভটা পড়ে আছে মাটিতে। ”
সে চট করে ঘাড় ফেরাল। টুল ছেড়ে উঠে এলো বিছানার কাছে। নির্ভয়ে নিঃসংকোচে বলল,
” এর আগে মুনছুরের ঠোঁট চেটে দিব। তারপরে জিভ মাটিতে পড়ে থাকলেও সমস্যা নেই। আমার আত্মাটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ”
খাইরুন নিসা তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। ধীরেসুস্থে তসবিহর শেষ গুটি পর্যন্ত গুণলেন। অতঃপর তসবিহটি গলায় পরে নরম গলায় বললেন,
” আমার কাছে আয়। ”
চাঁদনি তখনই বিছানায় উঠে গেল। দাদিজানের কাছে বসে, ভীষণ কৌতূহলে সুধাল,
” গোপন কথা বলবে? ”
প্রশ্নটা শেষ হতেই সশব্দের চ ড় পড়ল ডানগালে। এতেও শান্তি মিলল না খাইরুন নিসার। কানটা সর্বশক্তিতে টেনে ধরে রুষ্টগলায় বললেন,
” বিয়ে হয়েছে, স্বামী আছে। এরপরও স্বভাব বদলাল না তোর! অন্য পুরুষের দিকে নজর দিস এখনও। আল্লাহ কি তোর মধ্যে এক চিমটি লজ্জাও দেয়নি? ”
চাঁদনি চ ড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এখন দাঁত বের করে হাসছে। কানের লতি ব্যথায় লাল হলো নাকি ছিঁড়ে গেল এসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। হাসতে হাসতে নির্লজ্জের মতো বলল,
” ঐটা কোনো স্বামী হলো, দাদিজান? দিনের বেলা হাবলার মতো চেয়ে থাকে। রাতের বেলা পা ধরে বসে থাকে। আমি যা বলব, তাই। ওর কোনো কথা নেই। বাঁধা নেই। এই যে, তোমার ডাক পেয়ে চলে এলাম, একবারও জানতে চায়নি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। উল্টো আমার ব্যাগপত্র গুছাল। সেগুলো নিজেই বয়ে দিয়ে গেল। ”
বাতাস লাগলেই মোমের আগুন যেমন ধুপ করে নিভে যায়? খাইরুন নিসার রাগটাও তেমনিভাবে নিভে গেল। কান ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” জানতে চাওয়ার কী আছে? আসমান সব জানেই। আমি বলেছি না? তাছাড়া তুই দেখতে কত সুন্দর! তোর দিকে তাকাবে না তো কার দিকে তাকাবে? অন্যের বউয়ের দিকে? তোর মতো আসমানের চরিত্র খারাপ না, বুঝছিস? সেরকম হলে তোকে আমরা ওর কাছে বিয়ে দিতাম নাকি? কী ভালো ছেলে! কত ভালোবাসে! তোদের নামও কী দারুন মিল! আসমান আর চাঁদনি। এত কিছু পেয়েও মন ভরে না? ”
” না, ভরে না। মন যা চায়, তাই যদি না পাই মন ভরবে কীভাবে? ”
” এভাবে বলতে নেই, চাঁদনি। আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়। পরে দেখবি, যা আছে তাও নেই। শূণ্য হাতে বসে আছিস। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝ। ”
” এই পোকা খাওয়া দুর্বল দাঁতের মর্ম বুঝে লাভ নেই, দাদিজান। মাড়িতে ব্যথা হবে, খাওয়া দাওয়া করে শান্তি নেই। তার থেকে ভালো এটা উপরে ফেলা। আমার তো তোমার নাতির মতো দাঁত চাই। নিজ থেকে না বসলে, ডাক্তার দিয়ে বসাব। ”
দাদিজান আরও একটি চ ড় মারলেন। এবার বামহাতে। তিনি একই সাথে বিরক্ত ও রা গান্বিত। জোরে শ্বাস টেনে চেঁচালেন,
” আমার চোখের সামনে থেকে সর। এই দুনিয়ায় যত মাথা নষ্ট পোলাপান আছে, সব আমার কাছেই আসে কেন! ”
চাঁদনি জায়গা থেকে একটুও নড়ল না। শব্দ করে হেসে দিল। সেই হাসির শব্দে তিনি আরও রে গে গেলেন। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে বললেন,
” এই পাগলকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও, এখনই। ”
সে দৌড়ে এলো। চাঁদনির একহাত ধরে টানতে টানতে বলল,
” এদিকে আসেন। দাদিজান খুব রাই গা গেছে। ”
সে বাঁধা দিল না। বাধ্য মেয়ের মতো নামল। বাইরে মুনছুর সাখাওয়াতের গলা পাওয়া যাচ্ছে এখনও। স্বর্ণলতা বাইরে যেতে সাহস পেল না। চাঁদনিকে নিয়ে গোসলখানার দিকে এগুল। ভেতরে ঢুকিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অনুরোধের সুরে বলল,
” কষ্ট কইরা দাঁড়াইয়া থাকেন। দাদিজানের রা গটা কমলে, বাইর হইয়া আইসেন। উনি বুড়া মানুষ, শরীরটাও ভালা না। একটু দয়া করেন। ”
চাঁদনি দাঁড়িয়ে থেকে হাসতেই লাগল। সে ভেবেই পাচ্ছে না, মুনছুর কী দেখে এই মেয়েকে বিয়ে করেছে। রূপে, গুণে তার ধারেকাছেও নেই। মাথার ভেতরটাও তো ফাঁকা! স্বর্ণলতার সামনেই তো, দাদিজানের সাথে কথাবার্তা চলল। এত স্পষ্ট করে বলার পরও কি বুঝেনি, সে মুনছুরকে ভালোবাসে?
_________
রাত দশটার মধ্যে চাঁদনির থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। খবরটা নিয়ে এলো মুনছুর সাখাওয়াত। দাদিজান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। পাশের রুমের দরজা খোলা। ভেতর থেকে সাদা আলোর ফুলকি বেরিয়ে আসছে। চাঁদনি পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এলো স্বর্ণলতার হাত ধরে। তাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল প্রবল আগ্রহে। রুমের মধ্যে দুটো কাঠের খাট। আকারে ছোট কিন্তু একই মাপের। একটাতে খুব সুন্দর কারুকার্য খচিত, অন্যটি সাদামাটা। কারুকার্য খচিত খাটের পাশে একটি ছোট গোলাকার টেবিল। সেখানে একটি ফুলদানি, চার্জার ফ্যান, পানি ভর্তি কাচের জগ ও একটি খালি গ্লাস। ফুলদানিতে গোটা কয়েক তরতাজা গোলাপ ফুল। সাদামাটা খাটটির পাশেও একটি একই ধরনের টেবিল আছে। তাতে শুধু একটি প্লাস্টিকের জগ। পানি নেই, গ্লাসও না। চাঁদনি এক দেখায় বুঝে ফেলল, মুনছুর সাখাওয়াত চায় না, বউয়ের সাথে গা লাগিয়ে ঘুমাক। তাই আলাদা খাটের ব্যবস্থা হয়েছে। সেই সাথে এটাও বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে, দুজনের অবস্থান কতটা উঁচু ও নিচুতে। চাঁদনি এই নিয়ে মুখে কিছু বলল না। সোজা গিয়ে শুয়ে পড়ল কারুকার্য খচিত খাটটিতে। ফুলদানি থেকে একটা গোলাপ তুলে কানে পরতে পরতে বলল,
” মুনছুর, গাঢ় লাল রঙের ফুল আনতে পারলে না? আমার শাড়ির সাথে তো মিলল না! আচ্ছা, এবারের মতো মাফ করলাম। পরেরবার মিলিয়ে আনবে, কেমন? ”
দুর্দমনীয় রা গে মুনছুর সাখাওয়াতের চোয়াল কাঁপছে। গলার হাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে ভাসছে। হাতদুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে। ইচ্ছে তো করছে, ঘু সি মে রে মুখের আদল বদলে দেয় নাহয় গলা টি পে দম বের করে দেয়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় হচ্ছে না। স্বর্ণলতা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠিক মাঝে। ভেতরে ঢুকতে হলে তাকে ডেঙাতে হবে। যা করার সব তার সামনেই করতে হবে। খাইরুন নিসা বিপদ আঁচ করতে পেরে দ্রুত বললেন,
” দুটো খাট কেন? ঘর তো ভরে গেছে এই খাটেই। বাতাস ঢুকবে কীভাবে? গরম পড়তে শুরু করেছে না? মুনছুর, একটা খাট এখনই সরানোর ব্যবস্থা কর। ”
” কেন? ওরা দুজন না? তাহলে আরেকটা ঘর খুলে দিচ্ছি। স্বর্ণলতা ওখানে ঘুমাবে। ”
” দুজন হলে দুটো ঘর লাগবে? ওরা তো দুজনই মেয়ে। একসাথে থাকলে সমস্যা কী? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সমস্যার কথা জানাতে চাইল, সুযোগ পেল না। তার পূর্বেই দাদিজান বললেন,
” শুধু বড়লোকি দেখালে হবে না, পাণ্ডিত্যও দেখাতে হবে। অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করেছিস, তার মনের অবস্থাও তো বুঝতে হবে। ”
” কীভাবে বুঝব? তুমি তো ধারেকাছেই ঘেষতে দেও না! বউ আমার অথচ অধিকার দেখাচ্ছ তুমি! গা ঘেষে থাকবে চাঁদনি! ”
খাইরুন নিসা হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। ভাবছেন, কী যুগ এলো! ছেলেমেয়েদের জিভে কোনো লাগাম নেই। চক্ষুচর্মে লজ্জা নেই। বড়ছোট মানে না, ঘরে-বাইরে দেখে না। যা ইচ্ছে হয়, শুধু বলে যায়।
” মন বড় আশ্চর্য জিনিস, নাতভাই। চোখে দেখা যায় না। যে জিনিস চোখে দেখা যায় না, সেই জিনিস বুঝতে হয় চোখ বন্ধ করে। অনুভব করতে হয় হৃদয় দিয়ে। তোর মনে হচ্ছে, স্বর্ণলতার কাছে থাকলে সব বুঝে যাবি। বিষয়টা এরকম না। ”
” তাহলে? ”
দাদিজান গম্ভীরমুখে বললেন,
” ধৈর্য ধরতে হবে। সময় দিতে হবে। স্বর্ণলতা কী চাই, ও নিজেও জানে না৷ ওর মন স্থির হোক, শান্ত হোক। তারপরে নাহয় তোর চাওয়ার কথা বলিস। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক তাকাল স্ত্রীর দিকে। সে এখনও দরজার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদনি কী করছে, একধ্যানে তাই দেখছে৷ একবারের জন্যও পিছু ফিরছে না। তারা কী বলছে, এসব কি শুনছে না? নিজে থেকে শুনলেও তো বুঝতে পারত, তার জন্য মুনছুর কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে! স্বর্ণলতার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দাদিজানের হাত ধরল। একটু দূরে টেনে এনে বলল,
” তুমি কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ, আমি বুঝতে পারছি। আমিও চাই না, এখনই আমাদের বাচ্চা হোক। স্বর্ণলতা যে ছোট, বয়স কম আমার মাথায়ও আছে। ঐদিকটা আমি সামলে নিব। চাঁদনিকে ফেরত পাঠাও। আমার বউ…”
” বাচ্চা তো পরে, আমি তারও আগের বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি। ঐ মেয়ের যে শুধু বয়স কম, তাই নয়। ওর তো ঋতুস্রাবও হয়নি এখনও। ”
দাদিজান কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এই কয়টা শব্দ উচ্চারণ করিয়েই হাঁপিয়ে উঠেছেন যেন! তিনি এত খোলাখুলি কথাগুলো বলতে চাননি বিধায় চাঁদনিকে ডেকে এনেছিলেন। স্বামী কী, স্বামীর সোহাগ কী, তার সাথে কীভাবে চলতে হবে, কী কী দায়িত্ব পালন করতে হবে এসব কিছুই মেয়েটাকে শিখিয়ে দিতে হবে। তার ধারণা, যে মেয়ের ঋতুস্রাব হয়নি, সেই মেয়ে এসবের কিছুই বুঝে না। মুনছুর সাখাওয়াতকে তৎক্ষনাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে ছিল। যখন কথা বলতে চাইল, তখনই খাইরুন নিসা বললেন,
” যে মেয়ে তোর হাঁটার শব্দ পেলে ভ য়ে কাঁপে, সেই মেয়ে তোর পাশে ঘুমাবে কী করে? তুই চেয়েছিলি না, স্বর্ণলতা নিজ থেকে তোর কাছে আসুক? তাহলে প্রথমে তোর হাঁটা বদলা। পায়ের পাতা এমনভাবে ফেলবি যেন মাটিও টের না পায়, তুই হাঁটছিস। ”
_______
দাদিজানের কথামতো একটা খাট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। রাত্রে চাঁদনি ও স্বর্ণলতা একসাথে পাশাপাশি শুয়েছিল। সহসা চাঁদনি প্রশ্ন করল,
” মুনছুরের বউ, তোমার জানতে ইচ্ছে হয় না আমি কে? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে প্রশ্ন করো না কেন? ”
স্বর্ণলতা ইচ্ছে করে কৌতূহলটা দমিয়ে রেখেছে। সে এই বিয়ে মানে না, এই বাড়িতে থাকবে না। তাহলে এই বাড়ির মানুষগুলোর সম্পর্কে জেনে কী করবে? উপরন্তু যত জানবে, মাথায় তত গেঁথে থাকবে। স্মৃতি থেকে ঝেড়ে ফেলতে কষ্ট হবে। এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতে চাঁদনির পরিচয় নিয়ে জাগ্রত হওয়া কৌতূহলটা দমে রেখেছিল। চাঁদনি নিজে থেকেই বলল,
” আমি হলাম তোমার জামাইয়ের প্রেমিকা। প্রেমিকা কী বুঝো তো? ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১৭)
” আমি হলাম তোমার জামাইয়ের প্রেমিকা। প্রেমিকা কী বুঝো তো? ”
স্বর্ণলতার চোখ বড় বড় হলো প্রথমে। বিস্ময়ের প্রস্ফুটিত আভা ছড়িয়ে পড়ল সম্পূর্ণ মুখটায়। পরক্ষণে প্রভা হারাতে লাগল ধীরে ধীরে। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। নির্লিপ্ত স্বরে জানাল,
” না। ”
চাঁদনি হতাশার উচ্চ স্থানে পৌঁছে গেল যেন! একটা হাত গিয়ে ঠেকল কপালে। দুজনে একই বিছানায় শুয়ে আছে। খাটের চওড়া কম হওয়ায় দুজনের মধ্যে দূরত্ব যৎসামান্য। সে ঐটুকুও পূরণ করে ফেলল। স্বর্ণলতার কোমর চেপে ধরে টেনে আনল নিজের দিকে। বুকের সাথে পিঠটা মিশিয়ে, পায়ের ওপর পা রাখল। অতঃপর কাঁধের কাছে থুতনি রেখে ফিসফিসে সুধাল,
” বন্ধু বুঝো? ”
স্বর্ণলতা স্থির থাকতে পারছে না৷ নিঃশ্বাস টানতে ভারি কষ্ট হচ্ছে। এত গাঢ় ও শক্তভাবে মাকেও জড়িয়ে ধরা হয়নি তার। খুব ছোট থাকতে, মাকে জড়িয়ে ঘুমাত। তখন সুবর্ণের জন্মও হয়নি। স্বর্ণলতার স্পষ্ট মনে আছে, শুধু পেটের ওপর হাত রাখত। বেশি ভয় করলে, শাড়িটা খামচে ধরে রাখত। মাঝেমধ্যে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকত। সে মুখে শব্দটা আনতেই পারল না। মনে হলো, চাঁদনি গলাটাও চেপে ধরে আছে। তার নরম ঈষৎ উষ্ণ দেহের স্পর্শে স্বর্ণলতার ঘামও হচ্ছে! কোনোরূপে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, নাকের সাহায্যে সুর টেনে উত্তর দিল,
” উহু। ”
চাঁদনির হাতের বাঁধন আরও শক্ত হলো। মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল,
” প্রেমিকা বন্ধুর চেয়েও আপন। সুযোগ পেলেই যাকে ছোঁয়া যায়, চুমু খাওয়া যায়। জড়িয়ে ধরে একে-অপরের সাথে মিশে যাওয়া যায়। নীরবে নিঃশ্বাস বিনিময় করে মনের গোপন চাওয়াগুলো পূরণ করা যায়। ”
” আমি আপনার প্রেমিকা না তো! ছাড়েন। উফ, দম আটকাইয়া মারবেন নাকি? ”
কথাটা বলে সে চাঁদনির হাতটা সরিয়ে দিল এক ঝটকায়। উঠে বসে পা’টাও সরাল। বিছানা থেকে নেমে গেল হুড়মুড়ে। তারপরে অন্যদিকে চেয়ে অপ্রস্তুতভাবে বলল,
” আপনি উপরে ঘুমান। আমি নিচে শুইতাছি। ”
চাঁদনি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে উঠে বসল। স্বর্ণলতার একহাত ধরে টেনে বসাল পাশে। কৌতুকের মতো বলল,
” দাদিজান বলছিল, তুমি নাকি শিশু। তাই পরিক্ষা করছিলাম। তুমি ফেইল করেছ। ”
” মানে? ”
তার হাসি কমার বদলে বাড়ল। প্রশ্নটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল,
” তুমি মুনছুর না, মুনছুরের বউ। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমার সাথে কিছু করব না। ভালো করে বসো। আমার আর তোমার জামাইয়ের প্রেমের গল্প শুনো। ”
স্বর্ণলতার ঘাম শুকায়নি তখনও। কপাল, নাকের আগা ও ঠোঁটের উপরে মুক্তোর দানার মতো চিকচিক করছে। ঠোঁটদুটি মৃদু কাঁপছে। নিঃশ্বাস অস্বাভাবিক, হৃদস্পন্দনের গতিরও কমার লক্ষণ নেই। ভীষণ অস্বস্তি ও অনাগ্রহে বসে থাকল। চাঁদনি তার মুখটায় চেয়ে থেকে সুধাল,
” তোমার বয়স কত? ”
” বারো। ”
” সত্যি তোমার শরীর খারাপ হয়নি এখনও? ”
স্বর্ণলতার এই সময় খেয়াল হলো, দুপুর থেকে তার তলপেটে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারছে না, পায়ে ঝিনঝিন ধরে যাচ্ছে। চাঁদনির প্রশ্নটা শোনামাত্র সেই ব্যথা প্রচণ্ডে পৌঁছে গেল। ব্যথা ও যন্ত্রণা বিদ্যুৎ বেগে ছুটে যাচ্ছে পুরো শরীরটায়। সে ব্যথা আড়াল করতে চোখদুটি বন্ধ করে নিল। সেই সময় মায়ের মুখটা বিদ্যুৎপ্রভার মতো জ্বলে ওঠল। প্রথমবার এই ব্যথা উঠেছিল ঘুমের মধ্যে। সারারাত কাতরেছে। এক মুহূর্তের জন্য নিজে ঘুমায়নি, মাকেও ঘুমাতে দেয়নি। তিনি মাথার কাছে বসে ছিলেন। চুলে হাত বুলাচ্ছিলেন ও দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দিচ্ছিলেন। স্বর্ণলতা চোখ খুলে বিরক্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আপনাগো প্রেমের গল্পে কি আমার শরীর খারাপও লাগব? ”
চাঁদনি তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। ঠোঁট টিপে হাসল শুধু। তারপরে বলল,
” না। শুধু তুমি থাকো। নাহলে গল্পটা বলব কাকে? ”
” আছি, কন। ”
চাঁদনি হাসিটা নিয়ন্ত্রণে আনল। মুখজুড়ে আনন্দের স্নিগ্ধ রশ্নি ধরে রেখে বলল,
” মুনছুর আর আমার বড় হওয়া, পড়ালেখা সব একসাথেই। ”
” পড়ালেখা একলগে? উনি যে কইল, আপনি স্কুলের মাঠও দেখেন নাই? ”
” ওটা কথার কথা। একসাথে ভর্তি হয়েছি, কিছুদিন ক্লাসও করেছি। তারপর আর যাইনি। পড়া পারতাম না। রোজ স্যারের কাছে মার খেতাম। ”
এটুকু বলে চাঁদনি থেমে গেল। পর্যবেক্ষকের ন্যায় চেয়ে আছে স্বর্ণলতার মুখটায়। পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তার দৃষ্টি সামনে। উদাসীন ভাব। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, মেয়েটাকে যতটা বোকা ভেবেছে ততটাও না। তাদের কথাবার্তায় হস্তক্ষেপ করে না, কৌতূহলও দেখায় না। অথচ মনে রাখে সবই।
” গল্প কি শেষ? আমার ঘুম ধরতাছে। ”
চাঁদনির ধ্যান ভাঙল। বলল,
” এখনই কিসের ঘুম? আজ তো আমরা সারারাত জেগে থাকব, গল্প করব। মন দিয়ে শুনো। ”
স্বর্ণলতা নিরুত্তর। ব্যথাটা এত বেড়েছে যে, কান্না পাচ্ছে। বহুকষ্টে সেই কান্না ও ব্যথার ভাবটা লুকিয়ে রাখছে। চাঁদনি নিজ থেকেই বলল,
” পড়ালেখা ভালো লাগবে কীভাবে বলো? তোমার জামাই আমার বইখাতা ছিঁড়ে ফেলত। ক্লাস থেকে টেনে নিয়ে যেত, পুকুরপাড়ে। বাঁশঝাড়ের পেছনে। তারপর সমানে চুমু খেত! ”
গল্প বলার ফাঁকে সে স্বর্ণলতার দিকে সন্ধানী দৃষ্টি রাখছিল। মেয়েটার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। রোবটের মতো বসে আছে, চুপচাপ শুনছে। সে গলার স্বর বাড়িয়ে বলল,
” শুরুতে চুমু খেত গালে। তারপর তো ঠোঁটে খেতে লাগল! একবার কী হয়েছে জানো? ”
” কী হয়ছে? ”
প্রশ্নটা সে ইচ্ছে করে বলেছে। বুঝার চেষ্টা করছিল, মেয়েটা শুনছে নাকি। সাড়া পেয়ে তার উৎসাহ বাড়ল। লজ্জা জড়িয়ে পড়ল কণ্ঠস্বরে,
” আমাকে মুনছুরের রুমে টেনে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে সে কি পাগলামি! ”
” আপনারে মারছে? ”
চাঁদনির কণ্ঠ থেকে লজ্জা হারিয়ে গেল। উচ্চস্বরে হেসে ওঠল। যেন সে দারুন একটা হাসির কথা শুনেছে। হাসতে হাসতে বলল,
” না গো, মারবে কেন? প্রেমিকাকে কেউ মারে? ”
” মারে না? ”
” না। শুধু আদর করে। দরজা বন্ধ করে আমাকে পাগলের মতো আদর করল। তারপর আমার থেকে কথা নিল, বড় হয়ে আমি যেন মুনছুরকেই বিয়ে করি। শুধু ওরই বউ হব। ”
স্বর্ণলতার মুখটা ফিরল তার দিকে। আশ্চর্যের একটা ভাব ফুটেও ফুটছে না যেন! কাঠ স্বরে সুধাল,
” আপনারা তখন ছোট? ”
চাঁদনি জোরের সাথে গর্ব নিয়ে বলল,
” ছোটই তো। আমার মাত্র একবার শরীর খারাপ হয়ছে। মুনছুরের দাড়ি, মোচ কিছুই উঠেনি। ”
স্বর্ণলতা হাই তুলে বলল,
” বাকি গল্প কাল রাইতে শুনমু নে, এখন ঘুমাই। ”
সে নিচে নেমে যাচ্ছিল। চাঁদনি আটকাল। আগের মতো চেপে বসিয়ে বলল,
” কাল আরেক গল্প শুনাব। এটা আজকেই শেষ করি। নাহলে মজা পাবে না। ”
স্বর্ণলতার অগত্যা বসে থাকতে হলো। ভীষণ অনীহা ও অনাগ্রহে বলল,
” তাড়াতাড়ি কন। ঘুমে তো আমার চোখ বুঁইজা আসতাছে। পরে দেখবেন, বইসা বইসা ঘুমাইতাছি। ”
চাঁদনি গল্পের পরের অংশে গেল। বলল,
” আমাদের এই বন্ধ দরজার আদর অনেক দিন চলল। তারপরেই বিপদটা এলো! আমরা ধরা পড়লাম। পুরো গ্রামের মানুষ হাজির হলো, মুনছুরের বাড়িতে। আমার বাবার তো মাথায় হাত! মান-সম্মান সব গেছে। মেয়ের কী হবে? অন্য কেউ তো বিয়ে করবে না! যদি আত্মহত্যা করি? এই ভয়ে, মুনছুরকে মেয়ের জামাই হিসেবে মানতে চাইল। সে বেঁকে বসল ঠিক এখানে। আমাকে বিয়ে করবে না। ”
স্বর্ণলতার আগ্রহ পাওয়া গেল এই অংশে। জিজ্ঞেস করল,
” ক্যান? উনি তো আপনারে বিয়া করার পণ নিছিল। ”
” নিয়েছিল কিন্তু লোভে পড়ে ভুলে গেছে। আমার বাবার তো অনেক টাকা। এই যে, ঘরটা? এটা আমার বাবারই। আশেপাশে যত সম্পত্তি আছে, এই সব আমাদের ছিল। মুনছুররা তখন গরিব। ওর বাবা আমার বাবার জমিতে কাজ করে। সুযোগ পেয়েই মালিক হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগল। বাবা তখন অসহায়! মেয়ের জন্য সব কোরবান করতে রাজি। মুনছুর যা যা চায়, সব দিয়ে দিল। ”
” তারপর বিয়ে হলো? ”
চাঁদনি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল। দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
” না। ওর লোভ ছিল আমার শরীরে আর বাবার সম্পত্তিতে। দুটোই পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাই ধোঁকাটা দিতে পারল। আমাদের দুজনকেই শূণ্য হাতে গ্রাম থেকে বের করে দিল। ”
স্বর্ণলতার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। আরও একবার মুখটা ফিরে এলো চাঁদনির পানে। সন্দেহি গলায় সুধাল,
” বাইর কইরা দিছে? দাদিজান যে কইল, আপনার বিয়া তারা দিছে। ”
চাঁদনি থতমত খেল! একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
” মিথ্যা বলছে। ”
” আপনি তো প্রতিবাদ করেন নাই। ”
” বুড়ো মানুষ, কষ্ট পাবে। তাছাড়া বয়স হয়েছে, সব ভুলে গেছে হয়তো। আমাকে এতদিন পর ডেকে পাঠাল, তাই আর মনে করাতে ইচ্ছে হলো না। ”
স্বর্ণলতা বিছানা থেকে একটা বালিশ নিল। এই বাড়ির মেঝে পাকা, সিমেন্ট দিয়ে পালিশ করানো। শরীরে মাটি লাগার ভয় নেই। তাই পাটি বা কাঁথা খুঁজে সময় নষ্ট করল না। তার শরীর ও মন দুটোই ক্লান্ত ও অবসাদ লাগছে। ব্যথাটাকে ভুলতে হলেও ঘুমানো প্রয়োজন। সে মেঝেতে বালিশ রেখে শুয়ে পড়ল। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। চাঁদনি খাটের উপর থেকে জিজ্ঞেস করল,
” কে? ”
সাথে সাথে বজ্রকণ্ঠটা ভেসে এলো,
” আমি। দরজা খোল। ”
স্বর্ণলতা চোখ বন্ধ অবস্থায় কেঁপে ওঠল। দ্রুত উঠে বসে, অনুরোধের সুরে বলল,
” দরজা খুইলেন না। দয়া করেন। ”
চাঁদনি ঠোঁট টিপে হাসল। কিছু বলার পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াতের গলাটা আবারও ভেসে এলো,
” চাঁদনি? দরজা খোল। জলদি। ”
স্বর্ণলতার আকুতি, মিনতি বাড়ল। চাঁদনি সেই সব উপেক্ষা করে বলল,
” এত ভয় পাচ্ছ কেন? মুনছুর তোমার কাছে না, আমার কাছে আসছে। কত বছরের পুরোনো প্রেম! এতদিন পর প্রেমিকাকে কাছে পেয়ে ছেড়ে দিবে? এখন তো আমি আরও সুন্দরী হয়েছি। পরিপূর্ণ যুবতি নারী। চাইলেও চোখ ফেরানো যায় না। ”
তার চোখে আত্ম অহংকারের জ্যোতি। মুখায়বে আত্মপ্রত্যয়। ধীর পদক্ষেপে এগুল বন্ধ দরজার কাছে। সিটকানিতে হাত দেওয়ার পূর্বে এক ঝলক দেখল স্বর্ণলতাকে। ঠোঁটের হাসিটা চওড়া করে একটানে খুলে ফেলল সেটি। দরজার পাল্লা তাকে টানতে হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত নিজেই ধাক্কা দিল। তার মুখটা দৃষ্টিতে ধরা পড়ার পূর্বেই স্বর্ণলতা বিছানায় উঠে গেল। একদম কর্ণারে বসে শুনল,
” এটা ধর। ”
চাঁদনি জিজ্ঞেস করল,
” কী এটা? ”
” চিঠি। ”
” চিঠি! আমার জন্য প্রেমপত্র এনেছ? ”
তার কণ্ঠস্বর সীমাহীন বিস্ময় ও আনন্দে দোল খাচ্ছে যেন! মুনছুর সাখাওয়াত দরজাটা আরেকটু ভেতরের দিকে ঠেলে দিল। স্বর্ণলতাকে এতক্ষণ পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছিল না। এবার পাচ্ছে। বিছানার পেছনে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। মুখটা হাঁটুতে গুঁজা। খোলা চুল এলোমেলো হয়ে দুপাশে নেমে এসেছে। তার দিকে চেয়ে বলল,
” আমার বউকে চিঠিটা পড়ে শোনা। ”
চাঁদনি বেঁকে বসল যেন! বেজায় অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত গলায় সুধাল,
” আমার প্রেমপত্র ও কে শুনাব কেন? ”
” আমি চাই, তোর আর আমার ভালোবাসার গভীরতা স্বর্ণলতাও জানুক। ”
” ওর জেনে কাজ কী? ও তো এসব বুঝেই না! ”
মুনছুর সাখাওয়াতের কণ্ঠস্বর খানিকটা উপরে ওঠল। কিঞ্চিৎ রুষ্টতাও ধরা পড়ল,
” এত কথা বলছিস কেন? পড়ে শুনাতে বলেছি, শুনাবি। নাকি পড়তেই জানিস না? বাংলায় লিখেছি, পড়তে পারবি তো? না পারলে, স্বর্ণলতাকে দে। ও পড়তে পারে। ”
চাঁদনি চটজলদি বলল,
” না, কাউকে দিতে হবে না৷ আমি বাংলা পড়তে পারি। তুমি জানো না? ”
” তাহলে সময় নষ্ট করছিস কেন? পড়া শুরু কর। ”
চাঁদনি কাগজের ভাঁজ খুলছে। মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি ফিরে এলো গুটিয়ে থাকা মেয়েটির ওপর। এখন বসার ভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। দুই হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১৮)
চাঁদনি চিঠির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ভ্রূদ্বয় ও কপালের মধ্যবর্তী অংশ কুঞ্চিত। চোখজেড়া দেখাচ্ছে ছোট ছোট। মেয়েটা বাংলা পড়তে পারে ঠিক, কিন্তু দ্রুততা নেই। খানিক সময় নিয়ে, টেনে টেনে পড়ে। সে পড়ার জন্য পুরো প্রস্তুত সেই সময় মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” কাকে শুনাবি? স্বর্ণলতা তো কান চেপে ধরে আছে। দে, চিঠিটা ফেরত নিয়ে যাই। ”
সে চিঠি নেওয়ার জন্য হাত বাড়ানোর অভিনয় করল। এতেই কাজ হলো। চাঁদনি চিঠিসহ হাতটা পেছনে সরিয়ে নিল। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে বিরক্ত হলো শুরুতে। পর মুহূর্তে অসহায়ত্ব ফুটল বনদজুড়ে। খানিক চাঞ্চল্য ও গোঁ ধরা কণ্ঠে বলল,
” চিঠি ফেরত নিবে কেন? ও শুনবে। এখনই শুনবে৷ এই দেখ। ”
সে ত্বরিতগতিতে পৌঁছাল স্বর্ণলতার কাছে। কান থেকে একহাত টেনে সরিয়ে বলল,
” আমার গল্প শেষ হয়নি। এখনই হাঁপিয়ে পড়লে হবে? চুপচাপ শুনো। ”
চাঁদনি একটা হাত ধরেই থাকল। স্বর্ণলতা চাইলেও কান চেপে ধরতে পারল না। এখন একটা কান ফাঁকা ও শ্রবণযোগ্য। সেই সুযোগে চাঁদনি চিঠিটাতে অভিনিবিষ্ট হলো। আনন্দে আপ্লুত ও সাগ্রহে পড়তে আরম্ভ করল,
‘ প্রিয় স্বর্ণলতা ‘
শব্দ দুটো উচ্চারণ করে কণ্ঠটা থমকে গেল। মাথাটা উঁচু হলো। বিভ্রান্ত ও সন্দিগ্ধ দৃষ্টি উড়ে গিয়ে পড়ল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। সে মৃদু হাসল। আশ্বাসের ইঙ্গিত প্রকাশ করল, চোখের পলক ফেলে। চাঁদনির বিভ্রান্ত ভাব কাটল না। আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই কণ্ঠস্বরে। খানিক বাঁধা বাঁধা ও টেনে টেনে শব্দগুলো উচ্চারণ করে গেল,
‘ শুরুতেই ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। ছোট থেকেই আমি দুষ্টপ্রকৃতির মানুষ। নানানভাবে মানুষকে জ্বালাতন করি। কথা শুরু করি মিথ্যা দিয়ে, শেষও করি মিথ্যা দিয়ে। একটু আগে আপনাকে যে প্রেমের গল্পটা শোনালাম ওটাও মিথ্যা দিয়ে সাজানো। মাত্রই উপলব্ধি করলাম, সবাইকে মিথ্যা বললেও আপনাকে বলা যাবে না। আপনি মুনছুরের বউ, আমার প্রিয় ভাবি। আপনাকে শুধু ভালোবাসা যায়, সম্মান করা যায়। এছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করাও পাপ। বিশাল অন্যায়। সেই অন্যায়ের একমাত্র শা স্তি আমার জিভ কে টে নেওয়া। তারপর সেই জিভ পুকুরের পুঁটি মাছকে খায়িয়ে দেওয়া। ‘
এখানে এসে চাঁদনির কণ্ঠস্বর রোধ হলো। কোনোরূপ আওয়াজ বের হচ্ছে না। মাথাটা উঁচু হলো আবারও। বিস্ময়ে স্তব্ধ মুখ, থমকানো দৃষ্টি। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে তাকাতেই বজ্রকণ্ঠটা হুং কার ছাড়ল,
” থামবি না। এক সেকেন্ডের জন্য থামলেও জিভটা কা টা পড়বে। পুঁটিমাছ জিভ খেতে না চাইলে পেট চিঁ ড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ”
চাঁদনির গলা শুকিয়ে এলো। হাত-পায়ে কাঁপুনি ওঠল। মানুষটার রা গকে সে বরাবরই অবহেলা করে, দুই-একটা চ ড়-থা প্পড় হজম করে নেয় হাসিমুখে। আজ সেই সাহস বা ইচ্ছে কোনোটায় জায়গা পেল না বুকের মধ্যে। শুধু টের পেল, নিঃশ্বাস থমকে গেছে। হৃদস্পন্দন ছুটছে তুমুল বেগে। মাটির পুতুলের মতো দেহ ও মন উভয়ে অসার ও নিশ্চলে রূপান্তর হচ্ছে৷ আরও একটু সময় দিলে সে চেতন হারাবে। তারপরে কী হবে, জানে না। মুনছুর কি আগের চেয়েও অধিক ভ য়ঙ্কর হয়ে উঠেছে? নৃ শংসতা বেড়েছে? হৃদয়ের বেঁচে থাকা যৎসামান্য মায়া, দয়া, প্রেম, ভালোবাসাও নিঃশেষ হয়ে এসেছে? হতেই পারে। যে হৃদয় ভালোবাসা ও সম্পর্কের সুতায় বাঁধা পড়ে না, সেই হৃদয় মরুর বুকের চেয়েও অধিক রসবোধশূণ্য, উত্তপ্ত। চাঁদনি ভ য়ে ভ য়ে পরের অংশটুকু পড়তে লাগল,
‘ এবার সত্যি গল্পটা শুনেন। মুনছুরের থেকে আমি গুণে গুণে পাঁচ বছরের ছোট। আমি স্কুলে থাকতেই সে কলেজ পাশ করে ফেলেছে। দেরিতে স্কুলে ভর্তি ও এক ক্লাসে তিন বছর পড়ছি। এই তিন বছরেও তার দেখা মেলেনি কখনও। আমাদের যত দেখা, সব আমার আগ্রহেই। ওর বাড়িতে নাহয় খেলার মাঠে। আমিই স্কুলের নাম করে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। গায়ে পড়ে কথা বলতাম। সে পাত্তা দিত না৷ চোখ মেলে দেখত না পর্যন্ত! আমার এসব সহ্য হতো না, খানিকটা বাড়াবাড়ি করতে গিয়েই চ ড় খেতাম! তার রা গ এতেও কমত না। আমার বইপত্র ছিঁড়ে ফেলত। কতবার যে, চুল টেনে ছিঁড়েছে হিসেব নেই! তবুও হাল ছাড়তাম না। মাঝেমধ্যে নির্জন রাস্তায় একা পেলে অসভ্যের মতো ঝাপ্টে ধরতাম। ইচ্ছেমতো চুমু খেতাম। এসব বেশিদিন সহ্য করতে পারল না সে, বাঁশঝাড়ের পেছনে বেঁধে রাখল একদিন। সারারাত আমি ওখানে, কেউ খুঁজে পেল না। আমার বাবা, মা তো মেয়ে হারিয়ে পাগল প্রায়। সেই অবস্থায় মুনছুর তাদের ডেকে পাঠাল। আমাকে খুঁজে দিবে, এমন সান্ত্বনা দিল। কিন্তু একটা শর্ত আছে৷ শর্তটা হলো, এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে বিয়ে দিতে হবে। বাবা, মা তখন ভীষণ অসহায়, নিরুপায়। মেয়েকে পেলেই যথেষ্ট, শান্তি। মুনছুরের কথামতো, আমার বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো। আমি নীরবে মেনে নিতে পারছিলাম না। রা গে, দুঃখে ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে ওর বাড়ি চলে যাই। দাদিজান ও আংকেলকে মুখের উপর জানিয়ে দিই, আজ থেকে আমি এই বাড়িতে থাকব। মুনছুরের ঘরে, তার সাথে। এখন ইচ্ছে হয়, আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করো। নাহলে চোখের লাজ ভুলে চুপচাপ সহ্য করো। এই খবর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মুনছুর এই নিয়ে কিছু বলছে না। দিব্যি বাসায় আছে, নিজের কাজ করছে। আমি যে তার ঘরে, চোখেই পড়ছে না যেন! খবর পেয়ে আমার বাবা, মা ছুটে এলো। আসমানের পরিবারও। বাবা আমাকে নিতে এলে, আমি যাব না বলে জিদ ধরলাম। জোরজবরদস্তিও কাজ হচ্ছে না। শেষে বাধ্য হয়ে মুনছুরের শরণাপন্ন হলো। সেই নির্দ্বিধায় জানাল, আমি চাইলে থাকতে পারি, কিন্তু বিবাহ ছাড়া। সে আমাকে কখনও বিয়ে করবে না। এই কথা শুনে, বাবার তো মাথায় হাত! নিজের সম্মান ও মেয়ের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে পায়ে পড়তে হলো মুনছুরের। সে জানাল, দুটোই বাঁচিয়ে দিবে। কিন্তু তাকে যে, সম্মানহানি ও অপদস্ত করার চেষ্টা করেছি এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাদের বাড়িটা লিখে দিতে হবে। বাবা, মা বিনা বিচারে রাজি হয়ে গেলেন। সেই দিনই মাঝরাতে আসমানের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। নতুন সংসার হলো। মুনছুরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে ও কখনও ভালোবাসেনি, ভবিষ্যতে ভালোবাসবেও না। আমি সবার চোখে সুন্দরী হলেও, ওর চোখে কুৎসিত। কাকের চেয়েও বিশ্রী। বিয়ের পর মেয়েরা মহিলা হয়, আমি হয়েছি হাতির বাচ্চা৷ এই ভরা, ফোলা শরীর নিয়ে হেঁটে গেলে পুরুষের চোখে কামনার উত্তেজনা জাগে না, ভয়ে দরজার পেছনে তারা লুকিয়ে পড়ে৷ তারপরও আমি বেহায়ার মতো পুরুষদের সামনে কোমর দুলিয়ে হাঁটি! এই সত্যি গল্পটা বলতে বলতে আমার মধ্যে প্রথমবারের মতো ঘৃণা হচ্ছে। নিজের আচার-আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার প্রতি প্রবল ঘৃণা হচ্ছে।লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসছে। সেই সাথে উপলব্ধি করতে পারছি, আপনাকে মিথ্যা গল্প শোনানো কতবড় পাপ হয়েছে। অনুতপ্তে আমার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলছে। এই আগুন নেভাতে হলে, মাফ পেতেই হবে। এমনি এমনি মাফ করলে হবে না, সাথে দুটো চড়ও মা রতে হবে। আমার প্রাণপ্রিয় ভাবি, আমি মন থেকে চাই আপনি আমার এই দুইগালে দুটো কষে চ ড় মারুন, অতঃপর মুখে বলুন মাফ করেছি।
ইতি,
আপনার একমাত্র আদরের ক্ষমাপ্রার্থী ননদ ‘
চিঠি শেষ করতে করতে চাঁদনির ডর-ভ য় সব তুলোর মতো উড়ে গেল। আগের মতো দুঃসাহসিকা হয়ে ওঠল নিমিষেই। অশ্বের ন্যায় দ্রুততম গতিতে ছুটে এলো মুনছুর সাখাওয়াতের নিকটে। সে তখনও দাঁড়িয়ে আছে দুয়ারের কাছটায়। আগ্রহান্বিত বদন এদিকে ফেরানো। তৃষালু দৃষ্টি বিঁধে আছে স্বর্ণলতার দিকে। চাঁদনি তার মুখের কাছে দুই হাত তুলে চিঠিখানা ছিঁড়ে কয়েক টুকরো করল। শূণ্যে উড়িয়ে দিল সবগুলো টুকরো। অতঃপর গাল পেতে দিয়ে বলল,
” আমি যাকে ভালোবাসি, শুধু সেই এই গালে চ ড় মা রতে পারে। তুমি দুটো কেন, দুশোটা চ ড় মা র। আমি ভাতের মতো হজম করে ফেলব। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখের ভাব বদলে গেল। চোয়াল শক্ত করে চর্বণ তুলে বলল,
” আমি না, স্বর্ণলতাই মা রবে৷ সেটাও এখনই। এক মিনিটের মধ্যে নাহয় তোকে তুলে নিয়ে বাইরে ফেলে আসব। দাদিজানকে ডাকার সুযোগও পাবি না। ”
চাঁদনি বিস্ময়াপন্ন হলো। মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটা স্পর্শ করতে চাইল, সে মাথা পিছিয়ে জানাল,
” পাঁচ সেকেন্ড চলে গেছে। তোর হাতে আর পঞ্চান্ন সেকেন্ড আছে। তুই জানিস, আমি যা বলি তার চেয়েও বেশি করে থাকি। হতে পারে, জিভের বদলে পুরো তোকেই পুঁটি মাছকে দান করে ফেললাম! ”
চাঁদনির মধ্যে ভীত ভাব স্পষ্ট হতে লাগল। খানিক চাঞ্চল্যতা ফুটে ওঠল চোখের তারায় ও দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে। কী যেন একটা ভাবতে ভাবতে আচমকা দাদিজানকে ডাকতে শুরু করে দিল। দ্বিতীয়বার ডাকতেই মুনছুর সাখাওয়াতের শা সানো কণ্ঠটা ঘণ্টার ন্যায় জোরাল ও তীব্র হয়ে বাজল,
” আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, তখন দাদিজান তো দূর নিজেকেও তোয়াক্কা করি না৷ চাঁদনি, সময় অন্যদিকে নষ্ট না করে, স্বর্ণলতার কাছে যা। হাতে, পায়ে ধরে ক্ষমা চা। ”
স্বর্ণলতার ধৈর্য ও সহ্যের সীমানায় ধস নামল বুঝি! সে খাট থেকে নেমে এলো ধীরেসুস্থে। দুজনের থেকে দুটো গল্প শুনেছে। দুজনেই দাবি করছে, সত্যি বলছে। অথচ বিশ্বাস করার মতো কোনো প্রমাণ দেয়নি। মুখের কথায় কাকে বিশ্বাস করবে? অবশ্য বিশ্বাস করেই বা লাভ কী! এদের প্রেম নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এই মুহূর্তে তার একমাত্র চাওয়া, একটা সুন্দর ও নীরব রাতযাপনের। যেই রাতে সে স্বস্থির সাথে আরাম করে কয়েক ঘণ্টার জন্য নিদ্রায় যেতে পারবে। সে চাঁদনিকে টেনে ভেতরে আনল। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে না চেয়েই বলল,
” আপনার চ ড় খাইতে হইব না, মাফও চাইতে হইব না। আমার কাছে আপনার কোনো অন্যায় নাই, চাঁদনিবু। ”
কথাটা বলেই দরজা আটকে দিল। অতঃপর বন্ধ দরজার ওপাশের মানুষটার উদ্দেশ্যে বলল,
” এই দরজায় ঠকঠকানি বন্ধ করলে খুশি হমু। ”
” ঠিক আছে, ঠকঠকাব না৷ কিন্তু যাকে তাকে বু ডাকা আমার পছন্দ নয়। চাঁদনিকে তুমি নাম ধরে ডাকবে। একহাত দূরত্ব রেখে শুবে। ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না৷ মুখ ভেংচে বিছানায় ওঠল। চাঁদনিকে টেনে বসিয়ে বলল,
” অনেক রাত হইছে, আসো ঘুমাই৷ ”
সে বসতে চেয়েও বসল না। সন্ধানী দৃষ্টি ঘুরাল পুরো রুমটায়। কোথাও আয়না নেই, নিজেকে দেখবে কীভাবে! দাঁত দিয়ে আপন ঠোঁট কামড়ে ধরল চিন্তা ও অস্থিরতায়। চিঠিতে ওসব কী লেখা ছিল? মুনছুরের চোখে সে এত খারাপ দেখতে! চাঁদনি একহাত দূরে সরে গেল। খোঁপা খুলে চুলগুলো ছড়িয়ে রাখল পিঠময়। শাড়ির কুঁচি ঠিক করল, টেনে ভাঁজগুলো ছাড়াল। ফুলদানি থেকে আরেকটা গোলাপ নিয়ে কানে গুঁজল৷ পরিশেষে হাসি হাসি মুখে তাকাল স্বর্ণলতার দিকে। মিষ্ট ও আহ্লাদিত কণ্ঠে সুধাল,
” আমি কি অনেক মোটা হয়ে গেছি? গায়ের রঙটা হাতির বাচ্চার মতো ম রে এসেছে? ”
স্বর্ণলতা হেসে ফেলল। সেই হাসিতে মুখটা ঝলমল করছে। চোখের কোলগুলো এত স্বচ্ছ ও নির্মল দেখাচ্ছে যে, চাঁদনি বিস্মিত হলো। মেয়েটার মুখের নিখুঁত ছাচটা বুঝি, হাসলেই চোখে পড়ে!
” না, ম রে নাই। আপনি দেখতে পারুল বিবির মতো সুন্দর। ”
চাঁদনি জিজ্ঞেস করল,
” পারুল বিবি কে? ”
” একটা ছবির নায়কা। আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাইছিলাম। আব্বায় খুশি হইয়া, তার দোস্তের বাড়িতে নিয়া গেছিল। উনার বাড়িতে সিডি আছে। আব্বায় ঐ সিডিতে আমারে ছবিটা দেখাইছিল। ”
” কী ছবি? ”
স্বর্ণলতা একটুক্ষণ নীরবে ভাবল। কিছু মনে করতে পারল না বোধ হয়। মনখারাপের সুরে বলল,
” মনে নাই তো, চাঁদনিবু। কিন্তু ছবিতে নায়কা দুইটা। দুইজনের বিয়া হয় এক নায়কের লগে। বড় বউয়ের বাচ্চা নষ্ট হইয়া যায় বার বার। বাড়ির যে মুরুব্বি লোক ছিল? সে বিরক্ত হইয়া নায়কে রে আরেকটা বিয়া করায়। ঐ বউ দেখতে খুব সুন্দর, চালাক। কাউরে ডরায় না। ঠিক আপনার মতো। ওর নাম থাকে পারুল বিবি। ”
চাঁদনির সংসার শহর এলাকায়। এক রুমের একটি কামরায় ভাড়া থাকে। আসমানের একটি কসমেটিকসের দোকান আছে। সকালে যায়, দুপুরে আসে। খেয়েদেয়ে আবারও বের হয় বিকালের দিকে। ফিরতে প্রায় রাত হয়৷ সংসারে অন্য কোনো সদস্য নেই। চাঁদনির সময় কাটে ভীষণ আলস্যতায়৷ একা একা। আসমান বিয়ের শুরুর দিকে একটি টিভি এনে দিয়েছিল। সাথে সিডি-ক্যাসেড। কয়েক মাস যেতেই ডিসের লাইন লাগিয়ে দেয়। তারপর থেকে চাঁদনির অবসর ও আলস্য সময় কাটে টিভি দেখতে দেখতে। রোজ দুই, তিনটে বাংলা ছবি না দেখলেই নয়। সেই হিসেবে তার অসংখ্য ছবি দেখা হয়েছে। স্বর্ণলতার থেকে স্বল্প বাক্যের কাহিনি শুনেই ছবিটি ধরে ফেলল। আগ্রহের সাথে সংশয় নিয়ে সুধাল,
” মোল্লা বাড়ির বউ নাকি? ”
স্বর্ণলতারও চট করে মনে পড়ে গেছে এমনভাবে সম্মতি দিল,
” হ, ঠিক ধরছেন। ঐটাই। ”
” আমি অনেকবার দেখেছি। আমার যে বছর বিয়ে হলো, সে বছরেই মুক্তি পেয়েছে। আমি অবশ্য আরও পরে দেখেছিলাম, আসমানের বাড়িতে। তোমার মতো সিডি দিয়ে। ”
” তাইলে তো, পারুল বিবি রে চিনছেনই। ”
” হ্যাঁ। কিন্তু ওর আসল নাম শাবনুর৷ কী সুন্দর দেখতে! নাচতেও পারে খুব। আমি তো নাচতে পারি না। ”
নাচের কথা আসতেই রুমকির মুখটা মনে পড়ল। সাথে সাথে স্বর্ণলতার হাসি হাসি মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। রাজ্যের ক্লান্তি ও ঘুম এসে জড়ো হলো শরীরে ও চোখে। আলগোছে বালিশে মাথা রেখে বলল,
” চাঁদনিবু, আমার ঘুম ধরছে৷ ঘুমাইলাম। ”
__________
মুনছুর সাখাওয়াত বসার রুমে এলো। সে বাইরে থেকে দেখেছে, স্বর্ণলতা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। সকাল থেকে মেয়েটার দেখা পায়নি, মনটা বড্ড আনচান করছিল। জরুরি কাজে বের হবে, ঘরের বউকে না দেখে বেরুলে চলে! দাদিজান ও চাঁদনি খাবার টেবিলে বসে আছেন। নাস্তা আসেনি এখনও। কিছু একটা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছে। নিচু গলায়, ফিসফিস ভঙ্গিতে গোপন বৈঠকের মতো। তার পায়ের শব্দ পেয়ে উভয়ে চমকে ওঠলেন। ভীষণ অপ্রস্তুতভাবে দাদিজান বললেন,
” নাস্তা করে যাবি? আয়, বস। ”
মুনছুর সাখাওয়াত নিরুত্তর। সামনে চেয়ারটা ফাঁকা থাকতেও বসল না। সন্দেহি ও অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে তাকাল চাঁদনির দিকে। সে মুখ ঝামটা মারল প্রথমে। পরক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। খাওয়ার স্থান ত্যাগ করতে করতে বলল,
” আমি একটু পরে খাব। তোমাদের হলে ডাক দিও। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এসবে পাত্তা দিল না। সে সরাসরি তাকাল রান্নাঘরের দিকে। হাট করে থাকা দরজার ফাঁক দিয়ে স্বর্ণলতাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠল,
” আমার বউ কাঁদে কেন? কী হয়েছে ওর? ”
চলবে