মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-০১

0
2049

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (১)

” দাউ দিয়া কী করবা, আফা? ”
” তোর দুলাভাইয়ের গলা কা টমু। ”

সুবর্ণ আঁতকে ওঠল। বিস্ফারিত চোখদুটিতে ভয়া বহ আতঙ্ক! বুকের ভেতরটায় ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। বারো বছরের বালক সে। অবুঝ ও সরল মন ঠিকই জানে, কারও গলা কা টা ভালো কাজ নয়। ভীত ও শ ঙ্কিত চিত্তে কাছ ঘেষে বসল আপুর। ফিসফিসের মতো করে বলল,
” ক্যামনে কা টবা? দুলাভাইয়ের গলা অনেক উঁচায়। নাগাল পাবা না। ”
” নাগাল পামু না? ঠিকমতো মাপছস? ”
” হ। আমার মাথা হের কোমরে পড়ে মাত্র। ”

স্বর্ণলতা চৌকি থেকে নামল লাফিয়ে। মুহূর্তেই কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। আলতায় সাজানো পা দুখানা একসাথে করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নাকের নথ খুলে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কানের পাশে লম্বা হয়ে ঝুলছে! মাথায় গেঁথে দেওয়া বিয়ের ওড়নাটা একটানে খুলে ফেলল। অতঃপর ভাইকে আদেশ করল,
” নিচে নাইমা আয়। আমার পাশে খাড়া। ”

সুবর্ণ চটজলদি নিচে নেমে এলো। আপুর পাশে দাঁড়িয়ে সপ্রশ্নে চেয়ে থাকল মুখটায়। ঠোঁটদুটি টকটকে লাল, চোখের কিনার গাঢ় কালো। সিঁথির মাঝে সোনালি রঙের মোটা করে কী ওটা? হারিকেনের আলোয় কেমন চিকচিক করছে! সবমিলিয়ে আপুকে দেখতে এত ভালো লাগছে! ঠিক যেন, মন্ডপে সেজেগুজে বসে থাকা দেবমূর্তি। চোখ ধাধানো আলো ছড়াচ্ছে মুখ থেকে।

স্বর্ণলতা একহাতে ভাইয়ের মাথা চেপে ধরল নিজের সঙ্গে। অন্যহাতে নিজের উচ্চতা মাপল ভীষণ মনোযোগ ও গুরুত্ব দিয়ে। অতঃপর আগ্রহান্বিতা ন্যায় বলল,
” তোর থেইকা আমি আধহাত বেশি লম্বা। এখনও কি গলা নাগাল পামু না? ”

সুবর্ণের ধ্যান কাটল। ভাবুক হয়ে ওঠল মুহূর্তেই। অনেক্ষণ চোখ বুজে থেকে আচমকা বাল্যসুলভ কণ্ঠে বলল,
” না, পাইবা না। দুলাভাইয়ের পাহাড়ের মতোন শরীর। তুমি কি পাহাড় ছুঁইতে পারবা? ”

স্বর্ণলতা উত্তর দিল না। মুখ ভার করে বসল চৌকির কিনারে। হাঁটু টেনে নিল তখনই। আলতা ও মেহেদী রাঙা হাতদুটি সহ থুঁতনি রাখল সেখানে। রিনিঝিনি শব্দে আরও একবার গুঞ্জিত হলো ঘরটা। এই সময়েই আগমন ঘটল শবনম বেগমের। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
” কান্দিস না, মা। বয়স হইলে সব মাইয়ারই বিয়া হয়। বাপের বাড়ি ছাইড়া শওরবাড়ি যাইতে হয়। ”

স্বর্ণলতা মায়ের হাতটা সরিয়ে দিল এক ঝটকায়। মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। রা গ ও অভিমানে শক্ত হয়ে এলো কুমকুমে সজ্জিত মুখটা। নাক ফুলিয়ে চোখ লাল করে বলল,
” আমি কানতাছি না। সরো এখান থেইকা, আম্মা। তোমারে আমার সহ্য হইতাছে না। ”

শবনম বেগম কেঁদে ফেললেন। দুই চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু গড়াচ্ছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বললেন,
” এত রা গ? আম্মার উপর এত রা গ? এই রা গ নিয়াই কি বাপের বাড়ি ছাড়বি? ”
” হ। তাই করমু। তুমি কথার খেলাফ করছ। তোমার লগে আমার কোনো কথা নাই। ঘর থেইকা বাইর হও। ”

শবনম বেগমের কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। মেয়েটার মাথা ভালো। পড়াশুনায়ও খুব আগ্রহী ছিল। এই গ্রামে সরকারি স্কুল নেই, অন্য গ্রামে আছে। অনেক দূরের পথ। সেখানে যেতে হয় পায়ে হেঁটে, নৌকা দিয়ে বিল পেরিয়ে। স্বর্ণলতা কখনই ক্লান্ত হতো না। অনীহা দেখাত না। রোজ স্কুলে যেত, বাড়ি এসে ভাইকেও পড়াত। তার পড়ার প্রতি এই আশ্চর্যজনক স্পৃহা দেখে মুগ্ধ হয়ে একদিন বলেছিলেন, ‘ পড়, মা। ভালা কইরা পড়। তোরে আমি শহরে পাঠামু। কলেজে ভর্তি করামু। ‘ স্বর্ণলতাও উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল, ‘ পড়া শেষ কইরা বড় চাকরি করমু। তোমাগোরে নিয়া, একসঙ্গে শহরে থাকমু। খুব মজা হইব, আম্মা। আমি শুনছি, শহরে সব পাকা ঘর। গ্যাসের চুলায় রাঁনধে। তোমার ধোঁয়ার মধ্যে কষ্ট কইরা রাঁনতে হইব না। ‘ মেয়েটা যে সেই কথাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে, বুকে লালন করছে ঘুনাক্ষরেও টের পাননি।

সুবর্ণ জানালার শিঁক ধরে বাইরে চেয়েছিল। উঠোনে কী সুন্দর রঙবেরঙের আলো জ্বলছে! রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানোও হয়েছে। সারি সারি চেয়ার ও টেবিল পাতা। সবগুলোই খালি। মা বলেছে, এখানে বরপক্ষরা বসে খাবে। কী খাবে সেটা বলেনি। সুবর্ণ নিজেই জেনেছে। চুপটি করে রান্নার স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক্ষণ। প্রথমে এক চুলায় গরুর মাংসের ঝোল ও অন্য চুলায় মুগডাল রান্না করেছে। তারপরে ডিমের কোরমা ও পোলাও বসিয়েছে। কত বড় বড় পাতিল! সুবর্ণ এর আগে এত বড় পাতিলে রান্না দেখেনি। খাবারগুলো দেখেই তার জিভে পানি চলে এলো। মরণ ক্ষুধা পেয়ে গেল তখনই। ইচ্ছে করছিল, আঙুলে ভরিয়ে একটু চেটে নিতে। পারল না। বাবা দেখে ফেলল। চোখ রা ঙাতেই সে ছুটে পালিয়ে এলো আপুর কাছে।

” বরযাত্রী আইতাছে, আম্মা। চলো, বাইরে চলো। ”

সুবর্ণ জানালার শিক ধরেই উত্তেজিত কণ্ঠে খবরটা দিল। অতঃপর সরে এলো দ্রুত। আম্মা ও আপুকে ফেলেই দৌড়ে চলে গেল বাইরে। তার পেছন পেছন শবনম বেগমও চলে গেলেন ব্যস্তভঙ্গিতে। ঘরটা ফাঁকা হতেই স্বর্ণলতার চোখদুটো অশ্রুতে ভরে গেল। ভরা নদীর মতো টলমল করছে। বুকের ভেতরটায় এত যন্ত্রণা হচ্ছে! মনে হচ্ছে, কেউ আ গুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই আ গুনে শুধু দেহের ভেতরটা না, বুকের মধ্যে গচ্ছিত রাখা স্বপ্নগুলোও পুড়ছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়া মাত্রই সুবর্ণের গলা পাওয়া গেল আবারও। জানালা দিয়ে বড় একটা দা ঢুকিয়ে বলল,
” সব থেইকা বড় দাউ আনছি। আফা, ধরো। পইড়া গেল তো! কত্ত ভারী! দেখছ? ”

স্বর্ণলতা চটজলদি চোখ মুছল। চৌকির ওপরে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে পৌঁছাল। দা’টা নিতে নিতে সুধাল,
” এত বড় দাউ কই পাইলি? ”
” রাঁন্ধার কাছ থেইকা চুরি করছি। কেউ দেখে নাই। জলদি সামলাই ফেল। ”

ছোট ভাইয়ের কথামতো সে দা’টা চৌকির নিচে লুকাল। ঘরের দরজার দিকে এক পলক চেয়ে খেয়াল করল, কেউ দেখেছে কি না। দেখেনি, নিশ্চিত হয়ে চৌকির উপরে ওঠল আবারও। সুবর্ণ তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। স্বর্ণলতা বলল,
” দাউ আইনা কী হইব? তুই না কইলি, গলা নাগাল পামু না? ”
” গলা কা টার সময় আমারে ডাক দিও। আমি তোমারে উঁচা কইরা ধরমু। তাইলেই নাগাল পাবা। ”

সুবর্ণ দৌড়ে চলে গেল। উঠোনে বেশ হইচই হচ্ছে। স্বর্ণলতা কৌতুহলী হলো। এক ঝলক উঁকি দিতেই পুরুষালি কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” কাকে খুঁজছ? তোমার বর এদিকে। ”

সে চমকে ওঠল। সচকিত দৃষ্টিতে পেছন ফিরতেই বুকটা কেঁপে ওঠল। দোরগোড়ায় সুদীর্ঘ এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি ও পায়জামা। ঠোঁটের ওপর সিপাহীদের মতো মোটা ও কোণ বাঁকা গোঁফ। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল। চেহারায় এক ফোঁটা মায়া ও সহানুভূতি নেই। কী ভয়া নক চাহনি! স্বর্ণলতা ভ য়ে ঘামতে শুরু করল। গলাটা শুকিয়ে আসছে। কোথাও ছুটে পালাতে পারছে না। একটাই ঘর, একটাই দরজা। দরজার সামনেই তো রুক্ষমূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে!

স্বর্ণলতার নীরবতায় যুবকটি আনন্দ পেল বুঝি। ঠোঁটের কোণে টান পড়ল। নীঃশব্দের মৃদু হাসি নিয়ে সামনে এগুতে চাইল। এক পা বাড়াতেই শুনতে পেল,
” মহাজন? সবাই খাইতে বইছে। আপনিও বইবেন তো? চলেন। ”

বাঁধা পেয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্বর্ণলতার ভীত, ঘর্মাক্ত মুখটায় চেয়েই গর্জে ওঠল,
” আগে বিয়ে তারপর খাওয়া। সবকটাকে চেয়ার থেকে টেনে তুল। মুখের সামনে থেকে খাবার ছিনিয়ে নে। কত্ত বড় স্পর্ধা! আমার অনুমতি ছাড়ায় খেতে বসে পড়ে। যত্তসব হাভাতের দল নিয়ে ঘুরছি! খাবার দেখলেই দশ হাত লম্বা জিভ বেরিয়ে আসে। ”

বিকট গর্জন ও তীব্র ক্রো ধে স্বর্ণলতার রুহ কেঁপে ওঠল। ভয়া বহ আত ঙ্কে মুখ হয়ে ওঠল ফ্যাকাশে ও রক্তশূণ্য। শ্বাসকার্য বন্ধ হওয়ামাত্রই ভ য়ঙ্কর রূপের যুবকটি মাটি কাঁপিয়ে চলে গেল। মুহূর্তেই উত্তাপিত ঘরে শীতল হাওয়া ঢুকতে শুরু করল। টের পেল, মস্তিষ্কে আলোড়ন শুরু হয়েছে। এই লোকটি তার সম্পূর্ণ অচেনা নয়, কোথাও দেখেছে। সে মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করল। প্রায় মিনিট পাচেক পর মনে পড়ল, তিন বছর আগের একটি ঘটনা৷ তখন সে বারো বছরের কিশোরী। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা শুরু হয় দুপুর দুইটা থেকে। চলে পুরো দুই ঘণ্টা। বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দূরে! ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। তেমনি এক সন্ধ্যামুখো সময়ে বিলের কাছে আসে। ঘাটে নৌকা নেই, মাঝিও নেই। সে অপেক্ষা করছিল। সহসা গোঙানির শব্দ পেল। মুহূর্তেই কান দুটো সজাগ হয়ে ওঠল। আশেপাশে কেউ নেই। আম্মা বার বার করে বলে দিয়েছে, নির্জন জায়গায় একা থাকতে না। বিপদ হলে কেউ বাঁচাতে আসবে না। অন্ধকার হওয়ার আগেই ঘরে ফিরতে। দরকার হলে, পরীক্ষার খাতায় কম লিখবে। সে কম লিখতে পারেনি। সব চেনা প্রশ্ন পড়েছিল।

গোঙানির শব্দটা আরও একবার হতেই স্বর্ণলতা দাঁড়িয়ে পড়ল। সচেতন হয়ে দেখতে লাগল আশপাশটা। কোথাও মানুষের ছায়া নেই। জন্তু জানোয়ারও না। সে বিলের পানির কাছে এগিয়ে গেল। নৌকা আসলেই চট করে উঠে পড়বে। এদিকে নৌকারও দেখা নেই। আচমকা নৌকা চলে গেল কোথায়? সে আশ্চর্য হলো। সেই সঙ্গে ভীতুও হয়ে ওঠল। নৌকা না আসলে বাসায় ফিরবে কীভাবে? তার কান্না আরম্ভ হবে, এই সময় গোঙানির শব্দটা আবারও শুনতে পেল। এবার স্পষ্ট ও জোরাল। স্বর্ণলতা না চাইতেও মাথাটা ডান দিকে ঘুরে গেল। সূর্যাস্তের শেষ আলোয় একটি মানবদেহ দেখতে পেল, বিলের কিনারে। মাথার দিকটা তীরে ও পায়ের দিকটা পানিতেই ভাসছে। সে দৌড়ে চলে গেল সেখানে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মানুষটার দেহে কাপড় নেই, সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। কেউ নির্মমভাবে মেরেছে! র ক্তে রাঙা হয়ে আছে, কাছের পানিটুকুও। স্বর্ণলতা প্রথমে ভ য় পেল, লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিল। পরক্ষণেই মায়া এসে ভর করল কিশোরী মনটায়। মাথার স্কার্ফটা তার কোমরের উপর রাখল দূর থেকেই। পরিশেষে মুমূর্ষু মানুষটির কাছে বসে সুধাল,
” আপনার কী হইছে? আপনার বাড়ি কই? ”

আ ঘাতে জর্জরিত মানুষটি দুর্বল গলায় অস্পষ্টভাবে বলেছিল,
” আমাকে বাঁচাও। ”

বাঁচার এই আকুল প্রার্থনাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি স্বর্ণলতা। মায়ায় ডুবে যাওয়া হৃদয়টা তাকে সাহসী করে তুলল। প্রথমে চেষ্টা করল মানুষটিকে বসাতে, পারল না। এত ভারী ও শক্ত শরীর! সে কাঁধজোড়া খা মচে ধরেও সামান্য নড়াতে পারেনি। তার এই প্রাণাধিক চেষ্টায় মৃত্যুমুখী মানুষটিকে আবারও কথা বলাল। সে বলল,
” কাউকে ডাকো। ”

বিলের পাড়ে কেউ নেই। কারও আসার অপেক্ষায় থাকলে যদি, মানুষটি সত্যি মা রা যায়? এই ভ য়ে স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়েছিল বড় রাস্তার দিকে। সেখান থেকে দুজন লোক জোগাড় করেছিল অনেকটা সময় নিয়ে। অতঃপর তাদের সাহায্যে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই দেখা হয়, বাবার সঙ্গে। মেয়ের বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে, খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যান হাসপাতালে। বাবা ও মেয়ে হাসপাতাল থেকে বেরুনোর পূর্বে দেখা করেছিল অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে। চিকিৎসাধীন থাকায় কথা হয়নি। কিন্তু দূর থেকে স্বর্ণলতা মুখটা দেখেছিল এক ঝলক!

” আফা, বাইরে তো গ্যাঞ্জাম লাগছে! দুলাভাই, সব খাওন ফালাই দিছে। আমি কিছু খাইতে পামু না! ”

সুবর্ণের আফসোস ঝরা কণ্ঠস্বরে স্বর্ণলতার স্মৃতিচারণ বন্ধ হলো। ভাইকে চৌকির উপর বসিয়ে দিয়ে আনন্দিত সুরে বলল,
” খাইতে পাবি। আমি খাওয়ামু তোরে। ”
” ক্যামনে? দুলাভাই, তোমার কাছে খাওন রাইখা গেছে? ”

সুবর্ণ উঠান থেকে দেখেছিল, মহাজন এই ঘরে ঢুকছে। সে মহাজনকে চিনে। বাবার সঙ্গে দুইবার মহাজনের বাড়ি গিয়েছিল।

স্বর্ণলতা ঘরের এককোণে ছুটে গেল। এখানে একটি কাঠের তাক আছে। তাকের উপর স্বর্ণলতা বই, খাতা ও কলম গুছিয়ে রাখে। সেখান থেকে একটি খাতা ও কলম নিতে নিতে প্রশ্ন করল,
” তোর দুলাভাইয়ের নাম কী রে? ”
” জানি না তো, আফা। সব্বাই মহাজন কইয়া ডাকে। ”

সে গোটা হরফে লিখল,
‘ জনাব মহাজন,
আমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করতে হবে না। আমি আপনাকে ও আপনাকে করা সাহায্য দুটোই ভুলে গিয়েছি। এর বিনিময়ে কিছু চাই না।

ইতি
স্বর্ণলতা ‘

কাগজটা সুবর্ণের হাতে দিয়ে বলল,
” মহাজনকে দিয়া আয়। ”
” তাইলে খাওন দিব? ”

স্বর্ণলতা মিথ্যা বলল,
” হ, দিব। ”

সুবর্ণ দৌড়ে চলে গেল। চোখের আড়াল হতেই স্বর্ণলতা চিন্তায় পড়ে গেল। কাগজটা পড়ে, ভাইকে ধম কাবে না তো! প্রথম দর্শনে মায়া হলেও দ্বিতীয় দর্শনে ভ য় সৃষ্টি করেছে। তার সামনেই কেমন চিৎকার করে, ধম কাচ্ছিল! তার এই চিন্তার মধ্যেই সুবর্ণ চলে এলো। মনখারাপের সুরে বলল,
” খাউন দেয় নাই, আফা। আরেকটা কাগজ দিছে। দেখ। ”

স্বর্ণলতা দ্রুত হস্তে কাগজের ভাঁজ খুলল। এটা তার হাতের লেখা নয়, অন্য কারও। মহাজনের না তো? সে চটজলদি পড়তে শুরু করল। তাতে বিনা সম্বোধনে লেখা,

‘ আমি কাউকে দয়া দেখাই না। ফ্রিতে সাহায্যও নিই না। তোমার সাহায্যের মূল্য ধরেছিল, তোমার বাবা। হাসপাতালে থেকেই পরিশোধ করেছিলাম। ‘

স্বর্ণলতা নতুন কাগজ নিয়ে সময় নষ্ট করল না। এটার অপর পৃষ্ঠায় লিখল,

‘ দেখুন, আমি অনেক ছোট। মাত্র পনেরো বছর হয়েছে। আঠারো বছরের নিচে বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। এটা অন্যায় কাজ। পুলিশ জানলে, আপনার ও আমার আব্বা, আম্মার জেল হবে। ‘

লেখা শেষে কাগজটা ভাঁজ করল। সুবর্ণের হাতে দিয়ে বলল,
” খাউন না চাইলে, দিব না তো। কাগজটা দিয়াই কইবি, আমি ফ্রিতে কাম করি না। ”

সে মহাউৎসাহে আবারও দৌড়ে চলে গেল। স্বর্ণলতা এবার ভাইকে নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছে। হায় হুতাশে ম রছে! এই বদ মেজাজি, দৈত্যের মতো বিশাল দেহের মানুষটার সঙ্গে তার বিয়ে হবে? মা কী করে পারল, এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে?

চলবে