মরুর বুকে পুষ্প পরাগ পর্ব-১৯+২০+২১+২২

0
929

#মরুর_বুকে_পুষ্প_পরাগ
পর্ব (১৯)

” আমার বউ কাঁদে কেন? কী হয়েছে ওর? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি এসে থামল দাদিজানের মুখটায়। কপট রা গ নিয়ে জেরা করল,
” দাদিজান, তুমি কিছু বলেছ? ”
” শুধু বলিনি, মে রেছিও। অর্ধেক চুল টে নে ছিঁ ড়ে ফেলেছি৷ ”

তার কৌতুকমাখা কণ্ঠস্বরটা সে ধরতে পারল না। রা গের ভাব বাড়ল। রসজ্ঞানহীন মুখ। চোখদুটি বেজায় শুষ্ক, শূভ্র কোলে হালকা লালচে রঙের পোঁচ পড়েছে। দাদিজানের মনে হলো, মুনছুর যখন রা গ করে, গোঁফটা আরও মোটা ও কালো হয়ে যায়। কোণদুটি ধনুকের মতো বেঁকে তলোয়ারের মতো ধারাল হয়। হাত পড়লেই কেটে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি নাতির বলিষ্ঠ বাজুতে চাপড় মে রে বললেন,
” গাধার বাচ্চা! দেখছিস না, তোর বউ পেঁয়াজ কাটছে? পেঁয়াজ কাটলে সবার চোখেই পানি আসে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি নরম হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল স্ত্রীর দিকে। সে পিঁড়াতে বসে আছে। এক পায়ের তলায় ধা রাল লোহার বটি। পাশেই একটি ছোট্ট সিরামিকের বাটি৷ অর্ধেকাংশ পানিতে পূর্ণ, তাতেই গোটা কয়েক পেঁয়াজ ভেজানো। স্বর্ণলতা ছোট্ট ও নরম হাতে সেই পেঁয়াজ কুঁচিকুঁচি করে রাখছে, আরেকটি সিরামিকের বাটিতে। হাত কাঁপছে, সময় নিচ্ছে বেশি। ফাঁকে ফাঁকে চোখের পানি মুছছে, নাক টানছে। প্রথম দর্শনেই বুঝা যায়, মেয়েটি পেঁয়াজ কাটায় অপটু ও অনভিজ্ঞ। মুনছুর সাখাওয়াতও বুঝতে পেরে বলল,
” ও পারছে না, কষ্ট হচ্ছে। দাদিজান, এই কাজগুলো তুমি তো অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পার। ঝিগুলো কী করছে? ”
” ঝিগুলো শেখাচ্ছে। যে কাজ পারে না, সে কাজ কষ্টেরই হয়। তাই বলে, এড়িয়ে গেলে হবে না। আমি চাই, স্বর্ণলতা সব কাজে পটু হোক। ”
” পেঁয়াজ কাটায় পটু হয়ে, কোন রাজ্য জয় করবে শুনি? রাজ্য জয় করার জন্য তো, আমি আছি। আমার বউ শুধু জয়ের আনন্দে হাসবে, আরাম করে উৎযাপন করবে। ”
” এই বয়সে শুয়ে-বসে আরাম করলে, আমার বয়সে কী করবে? মুনছুর তুই কিন্তু আবারও আমার কাজে হস্তক্ষেপ করছিস। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখ কুঁচকে গেল। বিরক্তে বদ মেজাজি ভাবটা একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। দাদিজানের কাজকর্ম স্রেফ ছেলেমানুষি ঠেকছে। সে উদ্ধুদ্ধ হয়ে ওঠল। রুক্ষ গলায় প্রতিবাদ করল,
” হস্তক্ষেপ করছি না। শুধু বুঝিয়ে দিচ্ছি, স্বর্ণলতা একা নয়। ওর হয়ে লড়ার জন্য আমি আছি। তুমি অযথায় মনের খুশিতে কোণঠাসা করে রাখতে পারবে না। যে কাজটা না করলেও হচ্ছে, সেই কাজটায় ও কে দিয়ে করানোর দরকারটা কী? শেখানোর মতো আরও অনেক কিছু আছে। সেগুলো শেখাও। ”
” এখন কি তুই আমাকে শেখাবি, বাড়ির বউকে দিয়ে কী কী করাব? ”
” প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই শেখাব। কারণ ছাড়াই আমার বউ খেটে খেটে ম রবে, এতো আমি সহ্য করব না। ”
” সামান্য পেঁয়াজ কাটতে দিয়েছি, এতেই অসহ্য হয়ে পড়েছে? ”
” গরম পানি দিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন পেঁয়াজ কাটাচ্ছ, এরপর আরও কী কী করাবে কে জানে! ”
” তোর হাবভাবে মনে হচ্ছে, আমি অ ত্যাচারী মহিলা। ”
” অ ত্যাচারী মহিলা না, অ ত্যাচারী বুড়ি। নিজেকে মহিলা দাবি করে বুঝাতে চাচ্ছ, তোমার বয়স চল্লিশ? সমস্যা কী তোমার, দাদিজান? একবার স্বর্ণলতার বয়স কমাচ্ছ, আরেকবার নিজের। ”
” আমি বয়স কমাচ্ছি? ”
” হ্যাঁ, কমাচ্ছ। এখন নিজের কমালে, সেদিন স্বর্ণলতার। বয়স কমিয়ে কী সুখ পাচ্ছ, বলো তো! ”

দাদিজানের মেজাজটা চ টে গেল। এই ছেলেকে দুদিন আগেও বাড়িতে পাওয়া যেত না। দিনরাত বসে থেকেও দুটো কথা বলানো যেত না। সেই ছেলে এখন বাড়ির বাইরের রাস্তাটা দেখতেও যাচ্ছে না। বউকে নিয়ে এবেলা, ওবেলা ঝগড়া করে যাচ্ছে! তিনি যা করছেন তাই ভুল, মহা অন্যায় হিসেবে প্রমাণ করতে চাচ্ছে। মেয়ে মানুষ বেশি সময় বাড়ির বাইরে থাকলে যেমন চোখে লাগে, ছেলে মানুষ বেশি সময় বাড়ির ভেতরে থাকলেও তেমন চোখে লাগে। খাইরুন নিসা প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন,

” তোর কোনো কাজ নেই? ব্যবসায় কী শিকায় তুলেছিস? ”
” এত বড় শিকা কি এই বাড়িতে আছে যে, ব্যবসায় তোলা যাবে? ”
” থাকলে কি সত্যি তুলে রাখতি? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না৷ আড়চোখে তাকাল স্ত্রীর দিকে। তার পেঁয়াজ কাটা শেষ হয়নি এখনও। নাক টানা বেড়েছে। মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে। আধখোলা খোঁপাটা কাজের ঝক্কিতে মৃদু নড়ছে। এই সাধারণ, তুচ্ছ দৃশ্যটাও এত উপভোগ্য লাগছে যে, ইচ্ছে করছে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে জনম ভর।

” মুনছুর? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। ”

তার চোখের পলক পড়ল। দাদিজানের দিকে ফিরল না। প্রশ্নটা মনে থাকা সত্ত্বেও জবাব দিতে ইচ্ছে হলো না। চেঁচিয়ে ওঠল,
” এই, তোদের কি প্রাণের মায়া নেই? আমার বউ কাজ করছে, তোরা চেয়ে চেয়ে দেখছিস! সব কয়টার চাকরি খেয়ে দিব। বেতনটাও পাবি না৷ ”

গলা শুনেই ভ য়ে ত্রস্ত হয় কলি। পা বিছিয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। স্বর্ণলতার থেকে বটি ও আধ কাটা পেঁয়াজটা কেড়ে নিয়ে কাতর সুরে বলল,
” ক্ষমা কইরা দেন, ছার। এমন ভুল আর হইব না। ”

কলি দ্রুত হস্তে পেঁয়াজ কাটছে। চোখের পলকে আধা কাটা পেঁয়াজ কুঁচিকুঁচি হয়ে গেল। আরও একটি বাটি থেকে তুলে নিতে নিতে ডাকল,
” ময়না? কাঁচামরিচ কই? ডিম কি মরিচ ছাড়ায় ভাজা হইব? ঝুড়ি থেইকা কয়ডা কাঁচামরিচ ধুইয়া দে। ”

বর্তমানে রান্নাঘরে দুজন কাজের লোক। তন্মধ্যে রান্নার কাজে আছে কলি। থালাবাসন ও তরিতরকারি ধোয়াসহ টুকটাক যাবতীয় কাজ দেখে ময়না। খাইরুন নিসার মেজাজ ঠিক হওয়ার বদলে আরও চড়াও হলো। নাতির উদ্দেশ্যে রু ষ্ট গলায় বললেন,
” সংসারটা তাহলে তুই দেখ, আমি ঘরে চললাম। ইচ্ছে হয়, বেলা বুঝে খাবার পাঠাস। না পাঠালেও সমস্যা নেই। বাঁচবই আর কতদিন! এতদিন তো খেয়েই বাঁচলাম, শেষবেলা নাহয় না খেয়ে বাঁচলাম। ”

মতামত জানিয়ে তিনি হাঁটা ধরলেন। মুনছুর সাখাওয়াত আটকাল না। একবারটি চেয়েও দেখল না। তার মন ও মনোযোগ ঐ রান্নাঘরেই পড়ে আছে। স্বর্ণলতা আগের মতোই পিঠ দেখিয়ে বসে আছে। দাঁড়াচ্ছে না, বেরও হচ্ছে না৷ তার চাঁদ মুখখানা দেখার জন্য সেই কখন থেকে ছটফট করছে। মেয়েটা কি একটুও টের পাচ্ছে না? স্বামী-স্ত্রীর তো দুই দেহ, এক প্রাণ হয়। এক দেহের ব্যথা, যন্ত্রণা আরেক দেহকে বুঝাতে হয় না। নিজে থেকেই বুঝে যায়। সে হতাশায় গড়িয়ে পড়ল যেন! এতকাল মানুষ তাকে নির্দয় বলেছে। সে গায়ে মাখেনি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আজ চোখের সামনে এক জলজ্যান্ত নির্দয়া বসে আছে। কী আশ্চর্য! নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলে বুঝি এত খারাপ লাগে?

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর থেকে মনোযোগ সরাল জোর করে। দাদিজান তার রুমের কাছে পৌঁছে গিয়েছে প্রায়। সে দৌড়ে গিয়ে পথ রোধ করল। অন্যদিকে চেয়ে বলল,
” সংসার তোমার, সংসারটাকে চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও তোমার। আমি কিছু বলব না। ”
” কথা দিচ্ছিস? ”
” দিচ্ছি। ”

খাইরুন নিসা নাতির কান টেনে ধরলেন। মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
” কথা দিচ্ছিস তো? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভীষণ অনিচ্ছায়, নিরস গলায় প্রত্যুত্তর করল,
” হ্যাঁ, দিচ্ছি। কিন্তু..”
” কোনো কিন্তু নেই, মুনছুর। তোকে বুঝতে হবে, স্বর্ণলতা এই বাড়ির বউ। বউদের সংসারের সব কাজ জানতে হয়৷ করা, না করা পরের বিষয়। তোর মা নেই, দাদিজান আছে। দাদিজানের বয়স হয়েছে। যেকোনো সময় কবরের বাসিন্দা হবে। তাই বেঁচে থাকতেই সবকিছু শিখিয়ে দিতে চায়। যাতে ভবিষ্যতে সংসার ও তোর দেখভাল করতে পারে। যেকোনো পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারে। এখন তোর টাকা আছে, কাজের লোক আছে। ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। তখন? তোর শয্যাসঙ্গী হওয়ার পাশাপাশি রান্নাঘর, বাড়ির উঠোন এমনকি কলপাড়টাও সামলাতে হবে। আমি চাই তোরা সুখী হ। হাসিখুশি জীবনযাপন কর। এইটুকু নিশ্চয়তা পেলে ম রে গেলেও শান্তি। কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ধৈর্যটা এখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল। ভীষণ অধৈর্য ও ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,
” আমার শুধু স্বর্ণলতাকে চাই। আর কিছু না। তুমি ও কে বলে দাও, আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে, আমি নিজেকে জ্বালিয়ে দিব। ”
” নিজেকে জ্বা লিয়ে দিবি? ”

সে একটু যেন চমকাল! থমকে গেল কণ্ঠস্বর, বুকের শ্বাস। বেফাঁসে বলে ফেলা কথাটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। যে নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের স্বার্থ নষ্ট করতে দু’বার ভাবে না, সেই নিজের ক্ষতি করতে চাচ্ছে; একটি অল্প বয়সী, বিমুখ মেয়ের জন্য। দাদিজান তখনও জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত মাথাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বলল,
” তোমাদের জ্বা লিয়ে দিব। সব কয়টাকে জ্বা লিয়ে দিব। একটাও রক্ষা পাবে না। এই মুনছুর যা বলে, তার চেয়েও বেশি করে। কথাটা তোমার নাতবউকে জানিয়ে দিও। ”

সে গটগটে চলে যাচ্ছিল। সহসা থামল, সরাসরি তাকাল রান্নাঘরে। মেয়েটা এখনও আগের মতোই বসে আছে। হাত খালি অথচ ঘোমটা ঠিক করেনি। খোঁপাটা পুরো খুলে গিয়েছে। পাটের দড়ির মতো প্যাঁচ খেয়ে পড়ে আছে পিঠে। এসবে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই! মুনছুর সাখাওয়াত মুখে কিছু বলল না। কিন্তু খাবার টেবিলের পায়ায় সজোরে লা থি মা রল। ঝাঁকি খেয়ে দুটো গ্লাস পড়ে গেল। বিন্যাসিত চামচগুলো তুমুল শব্দ তুলে এলোমেলো হলো। চাঁদনি দৌড়ে এসে দাদিজানকে বলল,
” কালো যাদু বিশ্বাস করো? ”

খাইরুন নিসা জবাব দিলেন না। ঘাড় ফিরে তাকালেন শুধু। চাঁদনি আত্মবিশ্বাসের সাথে পুনরায় বলল,
” তোমার আদরের নাতবউ, মুনছুরকে কালো যাদু করেছে। সেজন্যই বাঘ, মোষের মতো আচরণ করছে৷ ”

তিনি এবারও জবাব দিলেন না। অনেক বেলা হয়েছে। এবার নাস্তাটা সেরে নিতে হয়। রান্না কতদূর এগুল, জানা দরকার। রুমকি থাকাকালে এই কাজগুলো সেই করত। তিনি শুধু ঠিক সময়ে এসে টেবিলে বসতেন। বাকি সব তদারকি রুমকিই করত।

খাইরুন নিসা একপাও আগাতে পারলেন না। ঝড়ের গতিতে উদয় হলো মুনছুর সাখাওয়াতের। সোজা গিয়ে বসল খাবার টেবিলে। নিজ থেকেই বলল,
” দাদিজান, নাস্তা দেও। ”

তিনি আরম্ভে চমকে ছিলেন। পর মুহূর্তে সামলে ওঠে বললেন,
” দিচ্ছি। একটু বস। ”

আজ নাস্তায় খিচুড়ি ও ডিম ভাজা হয়েছে। কলি স্যারের গলা পেয়েই খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা শুরু করে দিল। ময়না তাকে বোল, চামচ এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছে। খাইরুন নিসা ততক্ষণে রান্নাঘরের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে বললেন,
” জোঁকের মতো এক জায়গায় সেঁধে আছ যে! তোমার জামাই খাবারের জন্য বসে আছে। যাও, খাবারটা বেড়ে দাও। ”

ডাক পেয়ে সে ছিটকে ওঠেছিল। এবার কান্না পেয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে, এখান থেকে উঠলেই লজ্জা পাবে। ভীষণ অপমানিত হবে। তার রক্তস্রাব হচ্ছে ভোর থেকেই। কী করে সামাল দিবে বুঝে উঠতে পারছিল না। একবার ভেবেছিল, চাঁদনিবুকে জানাবে। সাহসে কুলাতে পারল না। যদি দাদিজানকে বলে দেয়? তাহলে তো প্রমাণ হয়ে যাবে, সে মিথ্যা বলেছে। তার বয়স বারো নয়, স্বামীর সাথে থাকার মতো শরীর তৈরি হয়েছে৷ এরপরেই দা নবের সাথে তৈরি করা দূরত্বটা মিটে যাবে। দাদিজান সেঁধে পাঠাবে মুনছুর সাখাওয়াতের ঘরে। এরপূর্বে মিথ্যা নাটক করার জন্য কঠিন শাস্তিও দিবেন নিশ্চয়?

” আরে! এখনও নড়ছ না যে? খুব অবাধ্য তো তুমি। উঠো বলছি। ”

চাঁদনিও এগিয়ে এলো তার নিকট। পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটল,
” উঠবে কেন? সে তো নবাবজাদী! মুনছুর কারও কথা শুনে না, মুনছুরের বউও শুনবে না। আহা, কী মিল। একেবারে সোনায় সোহাগা। ”

মেহেরুন নিসা তাকে ধ মকাল,
” উফ, চুপ করবি? তুইও তো নাস্তা করবি। যা, টেবিলে গিয়ে বস। ”

সে ভেংচি কেটে সরে এলো। কলি টেবিলে খিচুড়ি ও ডিম ভাজা দিয়ে এসেছে। এখন শুধু পাতে বেড়ে খাবে। এই কাজটা করবে নাকি সংশয়ে আছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
” আম্মা, আমি বাইড়া দিমু? ”

জবাবটা তিনি দিতে পারলেন না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত বলে ওঠল,
” হাত ভে ঙে দিব একদম। আমাকে বেড়ে খাওয়াবে কত বড় সাহস! তুই কি আমার বউ? ”

কলি দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটে এলো। বুকে হাত দিয়ে এমনভাবে শ্বাস ছাড়ছে যেন, মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এসেছে! খাইরুন নিসা তার দিকে কটমটে চেয়ে বললেন,
” কার সামনে কী বলতে হয়, এটুকু না বুঝলে হাতটা একদিন ঠিকই ভা ঙবে। ”

তারপরে মনোযোগ আনলেন স্বর্ণলতার দিকে। মুহূর্তেই বিরক্তের সাথে রা গটা মিশে গেল। বললেন,
” তুমি তো আমাকে অ ত্যাচারী বুড়ি বানিয়ে ছাড়বে! যে শা সনটা ছেলের বউকে করিনি, সেই শা সনটা নাতির বউকে করতে হবে দেখছি। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্প_পরাগ
পর্ব (২০)

স্বর্ণলতার দিকে দাদিজান ঝুঁকে আছেন। চোখ, মুখ কুঁচকানো। বিরক্ত বুঝা গেলেও, রা গটা বুঝা যায় না। মুখের চামড়া কুঁচকানো, লাল তিল ছড়িয়ে আছে পুরোটা জুড়ে। ধূসর রঙ চোখটায় স্নেহ ও মমতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে সবসময়। ঘিঙা রঙা নরম কাপড়ের শাড়ি পরিহিতা বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন,

” কী হলো? পাথর হয়ে গেলে নাকি? মুখেও জবান নেই দেখছি! কী হয়েছে তোমার? ”

দাদিজান তার কাঁধে হাত রাখলেন। নরম, কোমল ঈষদুষ্ণ স্পর্শ! স্বর্ণলতা টের পাওয়া মাত্র চোখদুটি অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠল। কিছু একটা বলা দরকার। মানুষটা রা গে চেঁচাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্লান্ত ঠেকছে। স্বর্ণলতা মাথা তুলতে চেয়েও পারল না। তার এত ভ য় লাগছে! মনে হচ্ছে, খু নের আসামি। মাথা তুললেই ধরা পড়বে। তারপরে ফাঁ সিতে ঝুলিয়ে দিবে। দাদিজানের স্পর্শ শক্ত হলো। কাঁধটা খা মচে ধরে সবলে পেছনে টানতে টানতে বললেন,
” এই মেয়ে, আমার দিকে তাকাও। দেখি, কী হয়েছে তোমার। ”

টান খেয়ে শরীরটা আরও শক্ত হয়ে গেল। পেছনে ফিরল না। চোখ বুঁজে নিয়ে বহুকষ্টে উচ্চারণ করল,
” উনারে একটু ডাইকা দিবেন, দাদিজান? ”
” কাকে? ”

স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারল না। মনে হলো, কেউ তার কণ্ঠনালিটা হাতের মুঠোয় নিয়েছে। অতঃপর অগাধ খুশিতে চিপে ধরছে পাঁচ সেকেন্ডের জন্য। ছাড়ছে দুই সেকেন্ডের জন্য। এই নির্মম খেলাটা ক্রমাগত চলছে। দুই সেকেন্ডের জন্য ছাড়তেই চটজলদি বলল,
” আপনার নাতিকে। ”

দাদিজানের হাতের চাপটা কোমল হলো প্রথমে। তারপরে সরে গেল। স্বর্ণলতা না দেখেও বুঝতে পারছে, তিনি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। বিস্মিত ভাবটা কণ্ঠে প্রকাশ পেল সন্দেহের মতো। জিজ্ঞেস করলেন,
” মুনছুরকে ডেকে দিব? ”

সে মুখে জবাব দিতে পারল না৷ টের পেল শুধু, পাঁচ সেকেন্ত ও দুই সেকেন্ডের খেলাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অদৃশ্য হাতটা এখন বরফে পরিণত হয়েছে। কী দারুন ভাবে কণ্ঠনালির সরু পথে বরফের টুকরো বিছিয়ে রেখেছে! কথা বলতে চাইলেই খোঁচা লাগছে বুকের মধ্যে! স্বর্ণলতা সেই ব্যথা সহ্য করতে পারবে না৷ তাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাল। দাদিজান তার দিকে চেয়ে থেকেই ডাকল,
” মুনছুর? এদিকে আয়। ”

দাদিজানের বিস্ময় ভাবটা বৃষ্টির মতো ঝমঝম করে নামল মুনছুরের চোখে, মুখে। সে ঠিক করে শুনতে পায়নি এমনভাবে সুধাল,
” দাদিজান, আমাকে কিছু বলছ? ”
” হ্যাঁ, তোকেই বলছি। এদিকে আয়। ”

সে উঠে দাঁড়াল। চেয়ার সরিয়ে হাঁটা ধরেও থমকে গেল। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পুনরায় সুধাল,
” আমাকে আসতে বলছ তো? ”

দাদিজান রে গে গেলেন। দৃষ্টির সাথে সাথে তিনিও ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বললেন,
” না, এই বাড়িতে আরও একটা মুনছুর আছে। তাকে আসতে বলছি। কোথায় সে? এখনও আসছে না কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত দেরি করল না৷ স্ত্রীর কাছাকাছি থাকার জন্য সারাক্ষণই উন্মুখ হয়ে থাকে৷ ভাগ্য সহায় হয় না, সুযোগও পায় না। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখার চমৎকার মুহূর্তটা এই জীবনে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। মেয়েটা তার দিকে ভালো করে তাকাবে তো দূর, তার দিকে ফিরেও থাকে না! এই অন্য দিকে ফিরে থাকা, মাথা নুয়িয়ে রাখার কারণটা যদি লজ্জা হতো, সে হাত দিয়ে সুন্দর করে লজ্জার সবটা মুছে দিত। কিন্তু কারণটা যে লজ্জা নয়, এই ব্যাপারে সে সুনিশ্চিত। মুনছুর সাখাওয়াত চার কদমেই তাদের নিকটে পৌঁছে গেল। ইচ্ছে করে দাদিজানের পাশে দাঁড়াল। স্বর্ণলতার মুখটা এখান থেকে ভালোভাবে দেখা যাবে। মুখটায় চেয়ে বলল,

” কী হয়েছে, বলো। ”
” আমি কী জানি! হয়ছে তো তোর বউয়ের। ও কেই জিজ্ঞেস কর। ”

এতক্ষণ সে চোরা চোখে দেখছিল স্বর্ণলতাকে। এবার সরাসরি তাকাল। মুহূর্তেই উদ্বিগ্ন ছড়িয়ে পড়ল মুখটায়। অস্থির চিত্তে সুধাল,
” আমি জিজ্ঞেস করলে, বলবে? ”
” না বললে ডাক পাঠিয়েছে কেন? জিজ্ঞেস কর। তখন থেকে মূর্তির মতো বসে আছে। নড়ছে না, কথাও বলছে না। আমার তো ভ য় করছে। জ্বিন-ভূতে আঁচড় করল না তো? নতুন বউয়ের দিকে ওদের বেশি নজর থাকে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের হৃদয়োদ্যানে বসন্ত নামল বুঝি! কোকিলের মিষ্টি মিহি ডাকটাও শুনতে পাচ্ছে যেন! স্বর্ণলতা তাকে ডাক পাঠিয়েছে। আনন্দে তার বুক ফুলে ওঠছে। চোখদুটি হীরের মতো জ্যোতি ছড়াচ্ছে। সে রান্নাঘরের দরজার সামনে বসে পড়ল। মাথা নিচু করে থাকা কিশোরীর দিকে চেয়ে বলল,
” স্বর্ণলতা, আমাকে ডেকেছ? ”

দাদিজানের মুখ হাঁ হয়ে গেল। চোখদুটি কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। এই নিরুত্তাপ, সুশীতল কণ্ঠস্বরটা মুনছুরের গলা থেকেই বেরিয়েছে কী!

স্বর্ণলতা বন্ধ চোখের পাতা মেলল। ধীরেসুস্থে আড়ষ্টের সাথে তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। চোখে চোখ পড়ামাত্র পাতা জোড়া এক করে ফেলল। মাথাটা কিঞ্চিৎ নামিয়ে মৃদু সুরে বলল,
” জি। ”
” কিছু বলবে? ”
” জি। ”
” বলো। আমি শুনছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আরেকটু চেপে এলো স্ত্রীর দিকে। সে এত আস্তে ও ক্ষীণ গলায় কথা বলছে যে, তার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। কাছে আসতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠল। মুখটা এত মলিন ও শুকনো লাগছে! ঠোঁটের একপাশ কামড়াচ্ছে বার বার। কামড়ানো স্থানটা ফুলে গেছে। লালচে-ধূসর দেখাচ্ছে।

” তোমার কি শরীর খারাপ করছে? ”

স্বর্ণলতা চমকে তাকাল। ঠোঁট কামড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা কি বুঝে গেছে, তার শরীর খারাপ? কিছু দেখে ফেলেনি তো? তাহলে তো অন্যরাও দেখে ফেলবে। সে ভ য়ে অতি দ্রুত বলল,
” এখান থাইকা সবাইরে যাইতে কন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত রান্নাঘরের ভেতরে তাকাল। কলি ও ময়নাও কাজ ফেলে তাদের দিকে চেয়েছিল। স্যারের শানিত দৃষ্টিতে পড়তে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত আগের মতো নরম সুরে জানাল,
” চলে গেছে। এবার বলো। ”

স্বর্ণলতা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। শব্দগুলো ঠোঁটের কাছে জিহ্বার নিচে সেঁধিয়ে গেল যেন! দাদিজানের দেহাবয়বটাকে অনুভব করতে পারছে। পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন এখনও। চাঁদনি দূরের খাবার টেবিলটায় বসে আছে। গ্লাসের মধ্যে চামচ দিয়ে বাড়ি মেরে টুংটাং শব্দ করছে ও গান গাচ্ছে। গানের কথাগুলো স্পষ্ট নয়। কিন্তু সুরটা বুঝা যায়। মোল্লাবাড়ির বউ ছবির মধ্যে দ্বিতীয় বউটা গান শুরু করে। চাঁদনি রাতে। পুকুরপাড়ে সিঁড়ির ধাপে বসে থাকে। পরনে হলুদ, কালো ও খয়েরি রঙের শাড়ি, কানে গোলাপি রঙের শাপলা, পায়ে মোটা নুপুর৷ কী সুন্দর নেচে নেচে গান গায়! স্বর্ণলতার গানের কথা মনে নেই, এছাড়া সব কিছু মুখস্থ। সে ভেবেছিল, দ্বিতীয় বউটার মতো একজোড়া নুপুর বানাবে। কিন্তু বাবার কাছে বলতে পারেনি, নিশ্চয় অনেক টাকা লাগবে! স্বর্ণলতা ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখে। ভাবে, বড় হয়ে চাকরি করে অনেক টাকা উপার্জন করবে। তারপর এরকম দুই জোড়া নুপুর বানাবে। একজোড়া তার ও আরেক জোড়া আপুর।

” স্বর্ণলতা? কী বলতে চাও, বলো। ”
” কমু, আগে সবাইরে যাইতে কন। ”

মুনছুর সাখাওয়াত রান্নাঘরের দিকে তাকাল আবারও। কেউ নেই। আর কাকে যেতে বলছে? দাদিজানকে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতে শুনল,
” কী সাহস হয়েছে, দেখেছিস? দুদিন হলো না বউ হয়ে এসেছে, এখনই আমাকে আদেশ করছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত শান্তভাবে প্রতিবাদ করল,
” তোমাকে আদেশ করেনি, দাদিজান। আমাকে করেছে। আর আমি আদেশটা পালনও করছি। ঘরে যাও। ”
” যাব না। কী এমন কথা যে, আমার সামনে বলা যাচ্ছে না? এতদিন তো আমার সামনেই ভ য়ে কাঁপত! আজ আমাকে বলছে, চলে যেতে। কাহিনি কী? মনের মধ্যে কী আছে, আমি শুনব। ”

সে দাদিজানকে প্রতুত্তর করল না। তার পেছনে দৃষ্টি ছুঁড়ে হুং কার ছাড়ল,
” আমি এলে ঐ গ্লাসটা তোর মাথায় ভা ঙব। তারপর চামচ দিয়ে তবলা বাজাব। ”

চাঁদনি দূর থেকেই জবাব দিল,
” ভাঙো। একটা কেন, একশটা ভাঙো। এই গ্লাস ভাঙার অযুহাতে যে, আমার কাছে আসতে চাচ্ছ সেটা তোমার বউ ঠিকই বুঝেছে। বয়স কম হলেও, মাথার মগজটা ভালোই চলে কিন্তু। ”

সে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল দাদিজানের দিকে। তপ্তসুরে শা সাল,
” ঐ বেয়াদবটাকে নিয়ে ভেতরে যাবে নাকি সত্যি সত্যি মাথা ফা টিয়ে দিব? ”

খাইরুন নিসার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। চাঁদনির জন্য যেতে হলো। মুনছুর তাকে আঘাত করবে না জানে। সেই সাথে এটাও জানে, চাঁদনিকে চাইলে যে রক্ষাও করতে পারবেন না। ছেলেটার রা গ মাথায় চড়ে গেলেই অঘটনটা ঘটে যাবে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই চাঁদনিকে নিয়ে রুমে ঢুকলেন। মুনছুর সাখাওয়াত বউয়ের দিকে মনোনিবেশ করল। বলল,
” এবার বলো। ”

স্বর্ণলতা নিজে একবার চারপাশে চোখ বুলাল। কাউকে দেখতে না পেয়ে উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘর থেকে বেরুতেই শুনল,
” আরে, পালাচ্ছ নাকি? আমার থেকে পালানো এত সহজ? ”

সে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল ভীষণ আলস্যভঙ্গিতে। গোঁফে হাত বুলিয়ে তার দিকে এগুতে ধরলেই বলল,
” আমি পালাইতাছি না। ”
” তাহলে? ”

স্বর্ণলতা একহাত উঁচু করল। রান্নাঘরে যে পিঁড়াতে বসে ছিল, সেটার দিকে তাক করে বলল,
” আমার কাছে কোনো ব্যবস্থা নাই। মায়ের কাছে যাইতে হইব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত পিঁড়ার দিকে তাকাল। লাল র ক্তের শুকনো ছাপ পড়ে আছে৷ শুরুতে বুঝতে পারল না। স্ত্রীর দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি রাখা মাত্র বুঝে ফেলল। প্রশ্নটা আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,
” তোমার কি পিরিয়ড চলছে? ”

সে হাত নামিয়ে ফেলল। মাথাটাও। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যে মানুষটার দিকে সে তাকাতেও চায় না, সেই মানুষটাকেই তার ব্যক্তিগত রঙ দেখাতে হচ্ছে!

” মায়ের কাছে যাওয়া যাবে না। ”

স্বর্ণলতা চোখ তুলে তাকাল। কাতর দৃষ্টি! অসহায় কণ্ঠে বলল,
” মারে আসতে কন। ”
” তারও আসা যাবে না। ”
” তাইলে আমি কী করমু? এমনে শাড়ি মাইখা ঘুইরা বেড়ামু? ”

মুনছুর সাখাওয়াত খানিক চমকাল যেন! কণ্ঠটা এত পরিষ্কার! দুর্বিনীত শোনাচ্ছে। লজ্জা, ভ য় কিছু নেই। মুখ ও চোখের ভাবে উদ্ধত। স্বর্ণলতা একপা এগিয়ে এলো। চোখের পলক ফেলছে না। পূর্বের মতো দীপ্ত ও পরিষ্কার কণ্ঠে পুনরায় বলল,
” চুপ কইরা আছেন ক্যান? জবাব দেন। আমি কি এমনেই ঘুইরা বেড়ামু?

মুনছুর সাখাওয়াত হাসল। বিজয়ের হাসি। এই আড়ষ্টহীন দীপ্ত কণ্ঠস্বর, এই নির্ভয়া চাহনিটাই তো সে চায়!

” ঘুরো। কিন্তু শুধু আমার সামনে। বউ আমার, তার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোও আমার। ”

স্বর্ণলতার ভ্রদ্বয় কুঞ্চিত হলো। ঘৃণায় নাক, মুখ কুঁচকে গিয়েছে। কী বলবে বা করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভেবেছিল, তার সঠিক বয়সটা যে জানে, তার কাছেই সত্যটা প্রকাশ পাক। এখন কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। তার যে কী পরিমাণে লজ্জা হচ্ছে, অস্বস্থি হচ্ছে এই দানবটা বুঝতেই পারছে না!

মুনছুর সাখাওয়াত হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল খাবার টেবিলের সামনে। একটা চেয়ার টেনে বের করে বলল,
” এখানে বসো। ”

স্বর্ণলতা বসবে না। বসার মতো অবস্থায় নেই। পিঁড়াতে ভরেছে, চেয়ারেও ভরবে। সে তো জেনেবুঝে সবকিছু অপবিত্র করতে পারে না!

” আমার ঘরে বসবে? ”

সে চমকে তাকাল। মুনছুর সাখাওয়াত চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলো। রান্নাঘরের পাশেই তার রুম। স্বর্ণলতা দাঁড়িয়ে আছে, সেই রুমের দরজার মুখোমুখিতেই। দরজাটা বন্ধ। তালা ঝুলছে। সে উত্তর দিল না। তবুও তালাটা খুলে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত দরজার পাল্লা ঠেলে দিয়ে বলল,
” যখন মায়ের দায়িত্বে ছিলে, তখন মা তোমাকে সামলেছে। এখন আমার দায়িত্বে আছ, আমিই সামলাব। ভেতরে গিয়ে বসো, আমি ব্যবস্থা করছি। ”

ঐ রুমটায় স্বর্ণলতা যেতে চায় না। দাদিজানও মানা করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার একমাত্র সাহায্যকারী মুনছুর সাখাওয়াত। তার কথা ফেলে দিলে, তার পরিকল্পনায় ব্যঘাত ঘটবে, লজ্জাও পাবে। স্বর্ণলতা পিঁড়াটা নিতে যাবে, তখনই শুনল,
” ওটার ব্যবস্থাও আমি করছি। তুমি ঘরে বসো। আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও। ”

সে তর্কে গেল না। তার মন ও শরীর দুটোই ক্লান্ত ও নাজুক। সকাল থেকে কিছু খায়নি। পেটের ব্যথাটাও সম্পূর্ণ ছাড়েনি। মাঝেমধ্যেই চিনচিন করে ওঠছে। স্বর্ণলতা ধীর পদক্ষেপে মুনছুর সাখাওয়াতের রুমে ঢুকল। বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে পড়তে পুনরায় শুনল,
” বসে পড়ো। লাল রঙটাকে আমার কাছে দাগ মনে হয় না। ”

স্বর্ণলতা বসে পড়ল। বসে বসে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত দরজাটা ভেজিয়ে দিচ্ছে। বাইরে থেকে তালা লাগানোর শব্দ পেয়েও ভড়কাল না। মনে হচ্ছে, সে বেঁচে গিয়েছে। খু নের আসামী হয়নি, ফাঁ সিতেও ঝুলতে হয়নি। কিন্তু দাদিজান? তিনি যদি জেনে যান, সে এই রুমে ঢুকেছে। তাহলে কী জবাব দিবে? এক বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আরেক বিপদ ডেকে আনল না তো! স্বর্ণলতা ভাবনার মধ্যে বেখেয়ালে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ডানপাশে কাত হতে হতে ভাবছে, যত সহজে এই ঘরে ঢুকল তত সহজে বের হতে পারবে তো? মুহূর্তেই মুনছুর সাখাওয়াতের মুখটা স্মরণে এলো, কণ্ঠটাও। এত শান্ত, বিনয় এলো কোথা থেকে? বেশ সমীহ করে কথা বলছিল, হাঁটছিল। এই প্রথমবার তার হাঁটার সময় ভূমি কাঁপেনি। নাকি কেঁপেছিল, সে টের পায়নি? ভাবনা ও প্রশ্নগুলো মনের ঘরে জমা হতে হতে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল। কখন যে, দরজার তালা খুলে গেল, এই রুমের মালিকটি চলে এলো সে টেরই পেল না। গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে রইল।

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২১)

ঘুমের মধ্যে স্বর্ণলতা অদ্ভুত ও বী ভৎস এক স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নের মধ্যে দুজন মুনছুর সাখাওয়াত। দুজনের চেহারা একই হলেও লেবাস আলাদা। একজনের পরনে ধবধবে সাদা রঙের নরম সুতির ফতুয়া ও লুঙ্গি। চোখে পুরু কালো ফ্রেমের চশমা। ঠোঁটের ওপর গোঁফটা নেই। মসৃণ ও তেলতেলের শোভন চেহারা। মায়া ও আদর এসে বসে আছে যেন গাল দুখানা ও থুতনিতে। চোখ পড়লেই ছুঁতে ইচ্ছে করে। বুকের মধ্যে মাথাটা চেপে ধরতে ইচ্ছে হয়। অতঃপর চোখজোড়া বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস টানলেই বুকটা প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়ে আসবে। স্বর্ণলতা অবাক হয়ে দেখল, এই মুনছুর সাখাওয়াত তার পাশেই শুয়ে আছে। গভীর ঘুমে বিভোর। মাথার নিচে দুটো কা টা পা। কা টা স্থান থেকে গলগলে র ক্ত পড়ছে! সে অন্য মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে তাকাল। তার লেবাস অত্যন্ত খারাপ। পরনে ছেঁড়া ও ময়লামাখা সেন্ডো গেঞ্জি। নিচে লুঙ্গি বা প্যান্ট কিছু নেই। এক টুকরো অন্তর্বাস! সেখান থেকে বিদঘুটে গন্ধ বেরোচ্ছে। স্বর্ণলতা নাক চেপে ধরতে শুনল, ‘ টাকা খাবি? আমার কাছে অনেক টাকা। নে, টাকা খা। ‘ সে আরও একবার অবাক হলো, এই ভিখিরি সাজের মানুষটির হাতে ছোট্ট একটি কালো রঙের থলে। সেখান থেকে বান্ডিল বান্ডিল টাকা বের করছে ও স্বর্ণলতার কোলের উপর ছুঁড়ে মারছে। ঠোঁটের উপরের গোঁফটা অতি মাত্রায় বড় হওয়ায় ঠোঁট ঢেকে গেছে। কী বিশ্রী সেই গোঁফ! বালুকণায় মাখামাখি! টাকা সাধার সময় বিকট শব্দে হাসছে। হাসির চোটে গোঁফের ফাঁক থেকে ঠোঁটজোড়া বের হতেই সে শিউরে ওঠল! এত কালো ঠোঁট হয় কারও! স্বর্ণলতা ভ য়ে কাঁপছে, ঘামছে। ভীত ও করুণ চোখে একবার পাশে ও আরেকবার পায়ের কাছে তাকাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে সুবর্ণের গলা পেল। চিৎকার করে বলছে, ‘ আফা, কল্লাডা কা টো। আমি তোমারে উঁচা কইরা ধরছি তো। কল্লায় কো পটা দেও। এক কো পে দুইডা কল্লা ফালাইবা। স্বর্ণলতা টের পেল, তার শরীরটা উপরে উঠছে। উপর থেকেই ক্রমান্বয়ে দুজন মুনছুর সাখাওয়াতকে দেখতে দেখতে আচমকা চেঁচিয়ে ওঠল। ঠিক তখনই ঘুম ছুটে গেল, স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটল। চোখ মেলতেই দেখল, আরও একটি মুনছুর সাখাওয়াত। বিছানার কাছেই চেয়ার টেনে বসা। বুক উঁচু ও ঘাড় সোজা করে পেছনে হেলে থাকলেও চোখদুটি চুম্বকের ন্যায় বিঁধে আছে তার মুখটায়। সে আরেকদফা ভ য় পেল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। বিছানা থেকে নেমে পালানোর প্রস্তুতি নিতেই শুনল,
” তুমি একদম আদুরীর মতো ঘুমাও। ”

সে থমকে গেল। একপা মেঝেতে ফেলল ধীরে ধীরে। চেয়ারে বসে থাকা মানুষটির দিকে তাকাতে পুনরায় শুনল,
” আদুরীও এরকম হাত, পা পেটের কাছে জমিয়ে ঘুমাত। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেই নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসত। মৃদু মৃদু শরীর কাঁপত। ওর তো আমার কাছ ঘেষে থাকা খুব পছন্দ। সুযোগ পেলেই বুকের উপর উঠে যেত। যতক্ষণ না আমি বকতাম, ততক্ষণ বুকের উপর থেকে সরত না। ”

স্বর্ণলতা এক ফাঁকে নিজের হাতে চিমটি কাটল। ব্যথা আছে। এই মুনছুর সাখাওয়াত স্বপ্ন নয়, সত্যি! সে বাস্তবে আছে। এইটুকু টের পাওয়া মাত্র ঘুমানোর আগের ঘটনাগুলোও মনে পড়ে গেল। এই রুমে, এই বিছানায় থাকার কারণটাও স্মরণ হতেই বলল,
” আপনি এখনও এইখানেই বইসা আছেন? আমার লাইগা কোনো ব্যবস্থা যোগাড় করেন নাই? ”
” করেছি। এই তো, আমার কাছেই আছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ডানহাতটা বাড়াল। হাতে দুটি ব্যাগ। একটা পলিথিনের ও আরেকটি বাদামি কাগজের। স্বর্ণলতা বিভ্রান্ত সুরে সুধাল,
” কোনটা আমার? ”
” দুটোই। ”

সে শুরুতে হাত দিয়ে স্পর্শ করল না। দূর হতে দেখার চেষ্টা করল। মুনছুর সাখাওয়াত বুঝতে পেরে বলল,
” আমি কি বের করে দেখাব? ”

স্বর্ণলতা ছোঁ মেরে ব্যাগ দুটি নিল। শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে ফেলল চট করে। অতঃপর সংশয় চিত্তে সুধাল,
” আপনার বাথরুম ব্যবহার করমু? ”
” অবশ্যই। শুধু বাথরুম কেন, এই ঘরের সবকিছুই ব্যবহার করতে পার। এই অধিকার তুমি বিয়ের রাতেই পেয়েছ। ”

সে ঠোঁট বাঁকাল। মুখ কুঁচকাল। এই ঘরের কিছুই ব্যবহার করতে চায় না। বিপদে পড়ে স্নাগারটা ব্যবহার করছে যে, সেটাও ঋণ হিসেবে ধরে নিল। সময় ও সুযোগ পেলে ঠিক শোধ করে দিবে। যাকে সে স্বামী হিসেবে মানে না, তার কিছুই গ্রহণ করবে না। স্নাগারও না। স্বর্ণলতা উঠে দাঁড়াতেই শুনল,
” এই ঘরে কিন্তু আমিও থাকি। মন চাইলে আমাকেও ব্যবহার করতে পার। ”

সে বিরক্ত সুরে প্রত্যুত্তর করল,
” করছিই তো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। বউয়ের কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে বলল,
” দূর থেকে এত অল্প ব্যবহার নয়, কাছ থেকে আরও বেশি ব্যবহারও করতে পার। এই ধরো, তোমার শরীরে জড়িয়ে থাকা শাড়ির মতো। ”

স্বর্ণলতা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল প্রথমে। পরক্ষণে পরনের শাড়িটায় চোখ বুলিয়ে বলল,
” শাড়ির মতো ব্যবহার করমু ক্যামনে? আপনি কি শাড়ি? শাড়ি হইলেও তো ব্যবহার করতাম না। এই কাপড়টা আমার পছন্দ না, হাঁটতে হাঁটতে পায়ের মইধ্যে প্যাঁচ খায়! কাম করতে গেলেই ঘোমটা পইড়া যায়, আঁচল খুইলা যায়। ”

তার বাক্য প্রকাশে প্রচণ্ড বিরক্ত, তীব্র ক্ষো ভ। মুনছুর সাখাওয়াত কী বুঝাল, সেটাই ধরতে পারেনি। সে আরম্ভে হতাশ হলেও পর মুহূর্তে খুশি হলো। মেয়েটাকে এখনও ভ য়, লজ্জা স্পর্শ করতে পারেনি। এজন্যই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারছে। নিজের মনের ভাব ও কামনাকে দ্রুত লুকিয়ে ফেলল। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি কি শাড়ি পরতে চাচ্ছ না? ”
” শাড়ি পরমু না তো কি করমু? খালি শরীরে ঘুইরা বেড়ামু? ”

তার পাল্টা প্রশ্নে খানিক দমে গেল মুনছুর সাখাওয়াত। কণ্ঠে ও চোখে বেজায় তেজ! এই তেজস্বিনী তার ঘরে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ভাবতেই তার বুকের ভেতরটা আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠল। চোখে, মুখে সেই আনন্দের দ্যুতিও প্রকাশ পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, এই রুমেই আজীবনের জন্য বন্দি করে ফেলতে। বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললে কেমন হয়? একটু নাহয় চামড়ায় কা টার দাগ পড়ল, র ক্ত গড়াল। কিন্তু মনের প্রবল সাধ তো পূরণ হলো! মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল দরজায়। ভেজানো আছে, সিটকানিটা তুলে দিলেই হবে। কার সাধ্য আছে, সেই সিটকানি খুলে এই রুমে ঢুকে?

” কী আনছেন এইটা! আমার কাপড়ের ত্যানা কই? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ভাবনায় ফাটল ধরল। ঘাড় ফেরাল ডানে। স্বর্ণলতা তার কাছে নেই। গোসলখানার ভেতরে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। মুখটায় ভীষণ অসন্তুষ্টের ছাপ।

” কথা কন না ক্যান? এই তুলার খ্যাতা দিয়া কী করমু? র ক্ত পরিষ্কার করমু? আমার কি শরীর কাইটা গেছে? বুইড়া হইয়া গেছেন এখনও শরীর খারাপ কী বুঝেন না? অথচ বিদেশি গো মতোন ইংলিশে ট্রান্সলেট তো ঠিকই করলেন! ”

মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিতীয় বারের মতো হতাশ হলেন। কিন্তু ভেঙে পড়লেন না, অধৈর্যও হলেন না। কেন জানি রা গটাও প্রকাশ পাচ্ছে না! কণ্ঠটাও কেউ বোধ হয় বরফ গলা পানিতে ধুয়ে দিয়েছে। সবসময়ের মতো ঝাঁজালো ও কর্কশতার ছিটেফোঁটাও নেই। সে কয়েক কদম এগিয়ে ধীরে ও শান্তভাবে বলল,
” ওটা তুলার খ্যাতা নয়, স্বর্ণলতা। ”
” তাইলে কি তুলার চাদ্দর? গায়ে দিমু? একহাত সমান চাদ্দর আনছেন আমার জন্য? ”
” ওটা চাদরও না। যেই প্যাকেটের মধ্যে ছিল, ওটার গায়ে ব্যবহারের পদ্ধতি লেখা আছে। কষ্ট করে পড়ো। ”
” বাথরুমে বইসা পড়ালেখা করমু? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়ল। মেয়েটা হঠাৎ করেই মাত্রাতিরিক্ত অধৈর্য হয়ে পড়েছে যেন! এত রা গ ও বিরক্ত পেল কোথায়? মেজাজ তো সাত আসমান ছুঁয়ে ফেলেছে! নিজে থেকে বুঝছে না, সে বুঝালেও ধৈর্য নিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে না। এক ঘণ্টা আগেও তো শান্তশিষ্ট, বোকাসোকা মেয়ে ছিল! সে দরজার কাছে পৌঁছে গেল একদম। একহাত বাড়িয়ে বলল,
” আমি পড়ে দিচ্ছি। প্যাকেটটা দাও। ”
” আপনি পইড়া দিবেন ক্যান? আপনার কী মনে হয়, আমি পড়তে পারি না? আমার ক্লাসে আমি সবচেয়ে ভালো রিডিং পড়তে পারি। বাংলা ও ইংরেজি দুইডাই। বুঝছেন? ”
” তাই নাকি! তাহলে পড়ে শুনাও। দেখি, কেমন ভালো রিডিং পার। ”
” ক্যান? আপনারে শুনামু ক্যান? আপনি কি আমার স্যার লাগেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াতকে কিছু বলার সুযোগই দিল না। সে সশব্দে দরজা আটকে দিল। মিনিট পাঁচেক পর বের হয়ে বলল,
” দুই নাম্বার জিনিস দিছেন! যদি আবারও বিপদে পড়ি, আপনার কল্লাডা সত্যি কা ইটা ফালামু। কিপ্টা বুইড়া! দুই ট্যাকা খরচ কইরা কাপড়ের ত্যানা আনতে পারল না! গাছ থেইকা তুলা পাইড়া আনছে। ”

স্বর্ণলতা শা সাতে শা সাতে দরজা খুলল। বাইরে বের হতে ধরতেই শুনল,
” শাড়িটা বদলাবে না? ”

সে থমকে গেল। নিজের দিকে চেয়ে বলল,
” ক্যামনে বদলামু? আপনি তো তুলার শাড়ি আনেন নাই। ”
” কাপড়ের তো এনেছি। তুমি কি অন্য ব্যাগটি খুলোনি? ”

স্বর্ণলতার হঠাৎ মনে পড়ল, দুটো ব্যাগই খুলে দেখেছিল। একটাতে শাড়ি দেখে পাত্তা দেয়নি। একবারের জন্যও মনে হয়নি, ওটাও তার প্রয়োজন। এখন মনে পড়তেই ফিরে গেল গোসলখানায়। নতুন শাড়ি পরে বেরিয়ে এলো বাইরে। রুমের আলোতে দেখতে পেল, রঙ ও নকশা আগের শাড়িটার মতোই। শুধু চকচকে ভাবটা বেশি! স্বর্ণলতা বিস্মিতনেত্রে চাইল, স্বামীর দিকে। সে টের পেয়েই বলল,
” দাদিজানের চোখের জ্যোতি এতটাও ভালো নয় যে, শাড়িটা নতুন নাকি পুরানো চিনে ফেলবে। ”
” চাঁদনিবু? উনার তো কাঁচা চোখ! ”
” ও নিজের সাজ ছাড়া আর কারও সাজে নজর দেয় না। দিলেও ভ য় নেই। আমি আছি তো, চোখ উ পরে ফেলব। সেদিন যে, সন্নাটা দিয়েছিলাম যত্ন করে রেখেছ তো? ”

স্বর্ণলতা আঁতকে ওঠল। বুক কাঁপছে। চোখ, মুখ ভ য়ে লাল ও গরম হয়ে আসছে। চাঁদনিবুর চিকন করে কাজল টানা চোখজোড়া মনে পড়তেই বলল,
” নজর দিবো না। চাঁদনিবুকে নজর দিতে দিমু না। ”

সে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। দাদিজানের রুমের কাছে আসতেই দেখল, দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে সিটকানি তোলা। দুম দুম শব্দ বাজছে সমানতালে। লোকটা কি দরজা বন্ধ করে বাইরে গিয়েছিল? কতক্ষণ বাইরে ছিল? স্বর্ণলতা হিসেব করতে পারছে না। সে তো ঘুমিয়ে পড়েছিল! সময়ের হিসেবটা একেবারেই নেই। একবার কি জিজ্ঞাসা করে আসবে?

” তুমি রান্নাঘরে যাও। আমি দাদিজানকে সামলাচ্ছি। ”

স্বর্ণলতা যাবে কি যাবে না বুঝতে পারছে না। একবার সাহায্য করেছে বলে কি সব কথা শুনতে হবে? সে জেদ ধরে অবাধ্যের মতো জবাব দিল,
” যামু না। দেখি, ক্যামনে সামলান! ”
” সত্যিই দেখবে? ”
” না, মিথ্যা মিথ্যা দেখমু। আমার তো চোখ নাই, সত্যিকারে দেখমু ক্যামনে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভ্রূদ্বয় কুঁচকে চেয়ে থাকল তার মুখপানে। প্রায় মিনিটখানেক পর বলল,
” আদুরী রা গ করলেও মুখটা এরকম অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখত। আমার কোনো কথাই শুনত না। খাবারটা পর্যন্ত খেত না! ”

স্বর্ণলতা মুখ সিধা করল। র ক্তিম চোখে এক ঝলক চেয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। বসার পিঁড়াটাও বদলে ফেলা হয়েছে। নতুন কাঠের গন্ধ পাচ্ছে সে। তার মতো অন্য কেউ কি এই গন্ধটা পাবে না? সে ভাবনার মধ্যে পিঁড়ায় বসল। অবসর সময় ও শরীরের আরাম পেতেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো যেন! পিঁপড়ার মতো আদুরী নামটা কা মড়ে ধরল মস্তিষ্কে। কে এই আদুরী? মহাজনের বউ না তো! বউ হলে তো এই বাড়িতে আধিপত্য থাকত। সেরকম কোনো নারীর দেখা পায়নি তো সে! তাহলে কি অন্য বাড়িতে রেখেছে? মহাজনের কতগুলো বাড়ি? এই চিন্তা-ভাবনার মধ্যে সিটকানি খোলার শব্দটা প্রবেশ করল কর্ণপথে। মুহূর্তেই সকল ভাবনা হাওয়াই মিঠার মতো মিলিয়ে গেল। কান খাড়া করে মনোযোগ স্থির করল দাদিজানের রুমের দিকে। সেকেন্ড দশেক পর নীরবতা ভেঙে বৃদ্ধার কণ্ঠটা পাওয়া গেল,
” দরজা আটকেছে কে? ”
” আমি। ”
” কেন? ”
” তোমার নাতবউকে নিয়ে বাসর করছিলাম তো, যদি বিরক্ত করো? তাই দরজা আটকে দিলাম। বের হতে পারবে না। আমাদের বিরক্তও করতে পারবে না। ”

স্বর্ণলতার দেহটা ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠল। লোকটা এত খারাপ! সামলানোর কথা বলে ফাঁসিয়ে দিল!

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২২)

” মুনছুর কী বলছে এসব? স্বর্ণলতা, তোমরা কি সত্যি বাসর করেছ? ”

স্বর্ণলতার দেহ আরেকদফা আলোড়িত হলো। সচকিত দৃষ্টি পড়ল দাদিজানের মুখটায়। তিনি তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। কুঁজার মতো মাথা ঝুঁকানো, পিঠ বাঁকানো। চোখ, মুখে স্পষ্ট রা গ ও বিরক্ত। স্বর্ণলতা সাথে সাথে উত্তর দিল না। নীরবে আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল। মাথাটা কিঞ্চিৎ নামিয়ে বাধ্যতা ও বিনয়ভাব প্রকাশ করল। আড় চোখে একবারটি তাকাল, দূরের রুক্ষমূর্তিটার দিকে। মিটিমিটি হাসছে কি! মোটা গোঁফটার ঠিক করে বুঝা যাচ্ছে না। চোখের তারা দুটিতে হাস্যোচ্ছটা!

” চুপ করে থাকবে না। জবাব দাও। মুনছুর যা বলছে, সব সত্যি? ”

স্বর্ণলতার নিরুত্তর থাকার প্রবৃত্তি থাকলেও, সম্ভব হলো না। মাথাটা দুইপাশে দুলে ওঠল। খাইরুন নিসার রাগের মাত্রা কমল বুঝি! কণ্ঠের কর্কশতা মৃদু কমিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
” তাহলে কি মিথ্যা বলেছে? ”
” মিথ্যাও না, দাদিজান। ”

অবশেষে স্বর্ণলতার ঠোঁট দুটিও নড়ে ওঠল। কণ্ঠটা বেজে উঠতেই খাইরুন নিসার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। এই সময় চাঁদনিও এসে দাঁড়াল দাদিজানের পাশে। ধ মকে উঠল,
” সত্য না, মিথ্যাও না। তাহলে কী? তুমি তো মুনছুরের চেয়েও ভ য়ঙ্কর! কথা দিয়ে মানুষের হৃদয় চেপে ধরো। ”

কথাটা বলেই দাদিজানের পিঠে হাত রাখল। সান্ত্বনা দিতে বলল,
” এত ভ য় পাচ্ছ কেন, দাদিজান? এই বাড়িতে চাঁদনি থাকতে মুনছুর অন্য কাউকে বিছানায় জায়গা দিবে না। ”

খাইরুন নিসা ক্ষিপ্র গতিতে চ ড় বসিয়ে দিলেন চাঁদনির গালে। তারপরে চেঁচালেন,
” বেলাজ মেয়ে! কতবার বলেছি, আমার সামনে এসব বলবি না। কথা কানে যায় না? ”

মুনছুর সাখাওয়াত এগিয়ে এলো। ভীষণ আগ্রহের সাথে বলল,
” ঠিক বলেছ, দাদিজান। ওর মতো কানকা টা স্বভাবের মেয়ে এই গ্রামে আর একটাও নেই। তুমি শুধু অনুমতি দাও, চাঁদনিকে গেইটের বাইরে ফেলে আসি। ”

খাইরুন নিসার এই কথাটাও পছন্দ হলো না। চোখ পাকিয়ে তাকালেন নাতির দিকে। একস্থির চেয়ে থেকে গরম নিশ্বাস ছাড়লেন কতগুলো। অতঃপর চাঁদনির উদ্দেশ্যে বললেন,
” দূরে গিয়ে দাঁড়া। তোর ছায়া মারালেও পাপ হবে। ”

সে দূরে গেল না। মুখ বাঁকিয়ে, বুকে হাত বাঁধল। আঁটো ভঙ্গিতে একস্থির দাঁড়িয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াতের ইচ্ছে হলো, বোম মে রে মেয়েটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে! আগ বাড়িয়ে সব ব্যাপারে ফোড়ন কাটা সহ্য হচ্ছে না একদম।

খাইরুন নিসার জিজ্ঞাসা পর্ব পুনরায় আরম্ভ হলো। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,
” মুনছুর কি জোর করে তোমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেছিল? ”
” না, আমি নিজেই গেছি। ”

দাদিজান আশ্চর্য হলেন। চোখের আকার বাড়ল, মুখে টান টান ভাব আসল। মেয়েটা কী বলছে! সেধে মুনছুরের রুমে গিয়েছে? সাহস তো ভালোই হয়েছে। নিজ থেকে ডেকে পাঠাচ্ছে আবার ঘরেও যাচ্ছে৷ তার মনে হলো, বাসরের কথাটা সত্যি হলেও বিস্মিত হবেন না।

” ঘরে গিয়েছিলে কেন? ”
” একটা দরকারে। ”
” কী দরকার? ”

স্বর্ণলতার চটপটে উত্তরের ভঙ্গিটা এখানে স্থগিত হলো। চোখ তুলে এক ঝলক দেখল, দাদিজানকে। এই মানুষটার প্রতি তার বুকের মধ্যে শ্রদ্ধা জমেছে। শ্রদ্ধেয় মানুষকে মিথ্যা বলতে নেই, ধোঁকাও দিতে নেই। সে চোখ নামিয়ে নিল। কণ্ঠের আওয়াজ কমিয়ে ধীরে বলল,
” ব্যক্তিগত দরকার, দাদিজান। আপনা রে কওয়া যাইব না। ”

খাইরুন নিসার চোখ কপালে উঠে গেল যেন! দুই ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু ফাঁকও সৃষ্টি হলো। এইটুকু মেয়ে ব্যক্তিগত দরকারও বুঝে গেল অথচ স্বামী কী, স্বামীর ভালোবাসা কী এসব বুঝে না। সংসারের খুঁটিনাটি সব তো তিনিই শেখাচ্ছেন! স্বর্ণলতা দাদিজানকে পরবর্তী প্রশ্নে যাওয়ার সুযোগ দিল না। মাথাটা খানিক এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসে বলল,
” উনি সুযোগ নিতে চাইছিল, দাদিজান! ”
” সুযোগ? ”

স্বর্ণলতা আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। মুখের কাছে হাত দিয়ে আগের চেয়েও অধিক আস্তে বলল,
” আমারে জড়াইয়া ধরতে চাইছিল। সাধারণ জড়ানো না, শাড়ির মতোন পুরা শরীর ছুঁইয়া জড়ানো। ব্লাউজ আর শায়া থাকব নাকি এইটা কইতে পারে নাই। তার আগেই তো আমি পালাইয়া আইছি। আমার মা’ই কইছে, এসব পাপ। ”

খাইরুন নিসা আবারও চোখ পাকিয়ে তাকালেন নাতির দিকে। মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রজোড়া কুঁচকে এলো। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দাদিজানের দিকে। খুব একটা দূরে দাঁড়িয়ে নেই সে। তবুও স্বর্ণলতার ফিসফিসের কথাটা শুনতে পায়নি। ভাবছে, কী এমন বলল যে, দাদিজান রে গে গেলেন! তিনি ক্ষিপ্রপায়ে এগিয়ে এলেন। নাতির এক কান টেনে ধরে বললেন,
” তোর থেকে এটা আশা করিনি, মুনছুর। তুই তো শিক্ষিত ছেলে। ডিগ্রি পাশ দিয়েছিস। এরপরও এই মূর্খতা? ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রতি বাদ করল,
” কী মূর্খামি করলাম? ”
” রাতেই তো জানালাম, তোর বউয়ের বয়স কম। ঋতুস্রাব হয়নি। ঋতুস্রাব না হলে যে, স্বামীর সাথে থাকা যায় না এটাও ভেঙে বলতে হবে? ”
” এই তথ্যটা তোমাকে কে দিয়েছে? ”
” কাউকে দিতে হবে কেন? পড়াশুনা আছে, অভিজ্ঞতাও আছে। দুইদিন পর, কবরবাসী হব এখনও অজানা থাকবে নাকি? ”

সে দ্রুত মাথা নাড়ল। অধৈর্য হলো খুব। দাদিজান প্রশ্নটা বুঝেনি। মুনছুর সাখাওয়াত জানতে চাচ্ছিল, স্বর্ণলতার ব্যাপারে। তাড়াহুড়োতে প্রশ্নটা আরও একবার করতে চেয়েও থেমে গেল। মনে পড়ে গেল, স্বর্ণলতার পরিবারের সাথে দাদিজানের দেখা হয়নি। তার সম্পর্কে জানা, অজানা তথ্যগুলো দুজন ব্যক্তিই দিতে পারে। একজন সে ও অন্যজন স্বর্ণলতা। এতক্ষণে বুঝে এলো, স্বর্ণলতাকে যতটা বোকাসোকা, বাচ্চা মেয়ে ভেবে এসেছে ততটাও সে নয়। বিয়ের রাতে বিয়ে ভাঙার জন্য যে মেয়ে বরকে চিঠি লিখতে পারে, ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদ করে উঠতে পারে, সেই মেয়ে বাচ্চা হতেই পারে না! এখানে এসে মেয়েটার ভাবভঙ্গিতে সেও প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। ঠিক যেমন দাদিজান হয়েছেন! মুনছুর সাখাওয়াত কথা বাড়াল না। চালাক মেয়েটা কোন দোষে দোষী করেছে, স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট হতেও চায় না। তার ইচ্ছেতে নাহয় একটু দোষী হলো। জবাবটা অন্যভাবে দেওয়া যাবে। দাদিজানতে বলল,
” ভুল হয়েছে। এখন কী শা স্তি দিতে চাও? ”

খাইরুন নিসা কান ছেড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সহসা বললেন,
” স্বর্ণলতার সাথে কথা বন্ধ। ”
” এত ছোট শা স্তি? ওর সাথে তো আমার এমনিতেই কথা হয় না। তুমি আমার দাদিজান হয়েও শা স্তি দেওয়ায় এত কাঁচা! ”

তিনি চটজলদি বললেন,
” ওর মুখ দেখা বন্ধ। আজ থেকে স্বর্ণলতা ঘরের মধ্যেও বোরকা পরে থাকবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের হৃদয়ে নাড়া পড়ল বুঝি! চমকে উঠে দ্রুততার সহিত বলল,
” এই শা স্তি মানি না। স্বর্ণলতা আমার বউ, আমি ওর স্বামী। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোরকা আসবে কেন? দাদিজান, অন্য শা স্তি দাও। ”

খাইরুন নিসা দৃঢ় স্বরে জানালেন,
” না। এই শা স্তিই নিতে হবে। ”
” বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে না? ”
” এবার প্রমাণ হলো তো তোর দাদিজান শা স্তি দিতেও পাকা? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের আত্ম অহামিকার উত্তাপে বুকের ভেতরটা ঝ লসে যাচ্ছে যেন! আহত ভাবটা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। অন্যভাবে ঢাকার চেষ্টা করল,
” আমার শা স্তির ভাগ স্বর্ণলতাকে দিচ্ছ কেন? যে গরম পড়েছে! দিন-রাত বোরকা পরে থাকলে তো আমার বউয়ের শরীর সিদ্ধ হয়ে যাবে। ”
” তোর ভাগের শা স্তি না, ওর ভাগেরটায় পাবে। আমি মানা করেছিলাম, তোর ঘরে যেতে। তারপরও গিয়েছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জানে, স্বর্ণলতা সেধে যায়নি। বিপদে পড়ে গিয়েছে। চাইলেই বিপদটা প্রকাশ করে দিতে পারে। কিন্তু করবে না। যে ঢেকেছে, সেই আলগা করুক! তার প্রতিবাদের চেষ্টা এখানেই শেষ হলো। নীরবে বেরিয়ে যেতে চেয়েও থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
” দাদিজান? আমি চাই, আমার বউ নামাজি হোক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে নাকি খেয়াল করো তো। ”

স্বর্ণলতা চমকে তাকাল স্বামীর দিকে। মুখটা দেখতে পেল না। সদর দরজা পার হয়ে গেছে। পাল্লাটা মৃদু নড়ছে। সেই কম্পিত পাল্লার দিকে চেয়ে থাকা অবস্থায় মায়ের কথা মনে পড়ল। তার প্রথম মাসিক রক্তস্রাব ঘটেছিল দেড় বছর আগে। তখনই মা বলে দিয়েছিল, এই অবস্থায় নামাজ পড়তে হয় না। আরবি লেখা আছে এমন বইও পড়তে হয় না।

” তোমার শাড়ির আঁচল বাম দিকে ছিল না? এখন ডান দিকে আসল কীভাবে? ”

চাঁদনির কণ্ঠ পেয়ে তার সম্বিৎ ফিরল। সাথে সাথে ভীত হয়ে পড়ল। চোখ দুটি আপনাআপনি চলে গেল চাঁদনির আঁখিদ্বয়ে। কী সুন্দর কাজল টানা! অক্ষিকোল এত স্বচ্ছ! মনি জোড়া কালো ভ্রমরের শরীরের মতো চকচকে। এই সুন্দর মনি দুটি উপরে ফেললে কেমন লাগবে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতে শিউরে ওঠল। কম্পিত গলায় বলল,
” আমার যেই দিকে আপনারও তো সেই দিকে, চাঁদনিবু। ভালো কইরা দেখেন। ”

চাঁদনি তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। স্বর্ণলতার ডান দিকের আঁচল ও তার বাম দিকের আঁচল একই দিকে পড়েছে। চাঁদনি শুরুতে বিব্রত হলো। পর মুহূর্তে হিসেবটা মিলিয়ে ফেললেও, প্রকাশ করতে পারল না। স্বর্ণলতা তার সামনে থেকে সরে পড়েছে অনেক্ষণ আগেই।

_______
দুপুরবেলা খাবার টেবিলে মুনছুর সাখাওয়াতকে পাওয়া গেল না। দাদিজান ও চাঁদনি খেতে বসেছে। স্বর্ণলতা খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিল সহসা দাদিজান বললেন,
” তুমিও খেতে বসো। বাকিটা আমরা নিয়ে নিব। ”

সে খেতে বসল কিন্তু খেল না। যোহরের আযান পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। দাদিজান খাবার শেষ করেই নামাজে বসবেন। স্বর্ণলতাকেও বসতে হবে। এখান থেকে সে ছুটি নিবে কী উপায়ে?

চলবে