মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ পর্ব-৮৭+৮৮+৮৯

0
485

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৭)

মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার পরে। সরাসরি নিজের রুমে ঢুকে দেখল স্বর্ণলতা বিছানায়। কাঠের পালংকের পেছনে পিঠ ঠেকিয়ে একমনে বই পড়ছে। সে ভারি আশ্চর্য হলো। ঢাকা থেকে ফেরার পথে খাওয়ার সময় হয় না অথচ বই বয়ে আনতে ভুলে না! এই মেয়ের কাছে নিজের জীবনের চেয়েও বইয়ের মূল্য বেশি? পড়াশোনার ভূতটা এত বেহায়া কেন? তার অল্পবয়সী সুশ্রী বউটাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়ছে না! মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে বিরক্ত করল না। চুপচাপ গোসলে চলে গেল। বের হয়ে দেখল স্বর্ণলতা এখনও সেই একই কায়দায় বই পড়ছে। স্বামীর আগমনের খবর কি এতক্ষণেও পায়নি? আশ্চর্যের ভাব ও ধৈর্যশক্তি উভয় ফুরিয়ে গেল। ভেজা তোয়ালে জানালায় মেলে রাখতে রাখতে গলা খাঁকারি দিল। সাথে সাথে কিশোরী কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” কাশি হলো নাকি? এখন আবার গোসল করতে গেলেন কেন? সকালে না একবার করলেন? ”

যত্ন ও উৎকণ্ঠায় মোড়ানো বাক্যগুলো ছুঁড়ে দিয়ে স্বর্ণলতা বিছানা থেকে নামল। শিয়রের কাছে ছোট্ট টেবিলে হাতের বইটা রেখে পানির জগটা তুলে নিল। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
” একটু অপেক্ষা করেন। আপনার জন্য গরম পানি নিয়ে আসি। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের কাশি হয়নি। হওয়ার কথাও না। তার একদিনে চারবার গোসল করারও অভ্যাস আছে। কাশির অনুকার শব্দ করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। মেয়েটা কি সত্যি বুঝল না নাকি ইচ্ছে করে তার সামনে থেকে সরে গেল? মুখটায় চিন্তার রঙ পড়তে গিয়েও হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠল। স্বর্ণলতার আচরণে সত্য বা মিথ্যা যাই থাকুক না কেন, যত্ন দেখিয়েছে তো? এতেই সে মহাখুশি। মেয়েটা তার প্রতি সামান্য খেয়াল দেখালেও হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করে। মনে হয়, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সার্থক হয়েছে।

স্বর্ণলতা গরম পানি নিয়ে ফিরে এলো প্রায় সাথে সাথেই। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে বাড়িয়ে ধরতে সে গ্রহণ করল। ভুলটা ভাঙিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। চুপচাপ, নীঃশব্দে কয়েক ঢোক খেল। নিজ হাতে গ্লাসটা টেবিলে রেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল স্ত্রীর পানে। চোখের তারায়, মুখের অভিব্যক্তিকে উৎকণ্ঠার ছাপ লেগে আছে এখনও। এছাড়া অন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি মেয়েটাকে রাগ বা অভিমান কোনোটায় স্পর্শ করতে পারেনি? অথচ সে ভেবে রেখেছিল ভোরবেলা দেওয়া কথাটা রাখতে পারেনি বলে স্বর্ণলতা ভীষণ রাগ করবে। কথা বলবে না, খাবে না, মুখ ফিরিয়ে থাকবে অন্যদিকে। ভাবনার সাথে প্রাপ্ত আচরণ মিলল না বলেই বোধ হয় ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ল। অযথায় ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,
” অনেক দেরি করে ফেলেছি, তাই না? হঠাৎ করে জরুরি…”

তার কথা সম্পূর্ণ হলো না। পূর্বে স্বর্ণলতা বাঁধা দিয়ে বলল,
” স্ত্রীকে খুশি করার জন্য ছোটখাটো মিথ্যা বলা জায়েজ আছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এখন আমি এই মিথ্যাটাও শুনতে চাই না। যদি সত্যি বলতে পারেন তাহলে ঐ বিষয়ে কথা বলুন। নাহলে দরকার নেই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত পুরো থ বনে গেল। মুখ দিয়ে কোনো রা পর্যন্ত বের হচ্ছে না। সমুখের তেজোময়ীর দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে জড়বস্তুতে রূপান্তর হলো যেন! কোনো আওয়াজ নেই, নড়াচড়াও নেই। প্রায় দীর্ঘক্ষণ নীরব সময় কাটানোর পরে স্বর্ণলতাই আগ বাড়িয়ে সুধাল,
” দুপুরে কিছু খেয়েছেন? ”

কণ্ঠটা কানে প্রবেশ করা মাত্র জড়বস্তুটায় প্রাণ সঞ্চয় হলো বোধ হয়। আচমকা স্বর্ণলতার একহাত মুঠোতে পুড়ে আপন কপালে ঠেকাল। অপরাধির মতো মাথাটা নত করে অননুতপ্তের সুরে বলল,
” তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছিল না। ”
” সেটা মুখে বললেই হতো। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের মাথা উঁচু হলো। কপাল থেকে হাতটা নামালেও ছাড়ল না। অন্যহাতটাও মুঠোতে এনে অনাস্থা কণ্ঠে সুধাল,
” তুমি রাজি হতে? ”

স্বর্ণলতা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল প্রথমে। পরক্ষণে কোনো ভণিতা না করে স্পষ্ট গলায় বলল,
” হব না কেন? আমি বিশ্বাস করি, আপনি আমার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন, ওটার সাথে আমার ভালো কিছু জড়িয়ে আছে। সেদিন বুঝিয়ে বলেছিলাম, এরমধ্যে ভুলে গেলেন? ”
” ভুলিনি। ”
” তাহলে এই মিথ্যা নাটক কেন? ”
” ভয় হয়। যদি ভুল বুঝো! ”

স্বর্ণলতা স্বেচ্ছায় নিজের হাত দুটি স্বামীর মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিল। অতঃপর চোখে চোখ রেখে আফসোসের সুরে বলল,
” আমার বিশ্বাসের উপরে আপনার বিশ্বাস আসেনি এখনও! ”

সে মুখ ফিরিয়ে পা ঘুরিয়ে কোথাও একটা যেতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত খপ করে হাতটা ধরে ফেলল। নিজের কাছে টেনে এনে মুখোমুখি দাঁড় করাল। দুইহাতে কোমর জড়িয়ে বুকের মাঝে নাক গুঁজে বলল,
” কালকেও থেকে যাও না, বউ। কথা দিচ্ছি, তোমার মনখারাপ হয় এমন কিছু করব না। ”
” কালকেও? আমার পরীক্ষা তো পরশুদিনই! ”
” কয়টা থেকে? ”
” দুপুর একটা। ”
” অনেক সময়! ফজরের নামাজ পড়ে বের হব। বারোটার মধ্যে পৌঁছে দিব ইনশাআল্লাহ। ”

ইনশাআল্লাহ! শব্দটা কি নিজেকে নাস্তিক দাবি করা মানুষটার মুখ থেকে বেরুল? অজান্তে বা ভুলে উচ্চারণ করেছে নাকি স্বেচ্ছায়? যেটায় হোক, বেরিয়েছে তো! স্বর্ণলতা মনে মনে দারুন খুশি হলো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, গোঁফ কেটে ফেলার পরে যে রূপ দেখতে পাচ্ছে সেটাই তার আসল রূপ। দুই আঙুলের গোঁফটা শুধু যে তার রূপ লুকিয়ে রেখেছিল তাই নয়, ব্যবহারেও কাঠিন্য ও নির্দয়ের খোলস পরিয়ে রেখেছিল। ধীরে ধীরে সেই খোলস একদিন পুরোপুরি খুলে যাবে।

মুনছুর সাখাওয়াত মাথাটা সামান্য তুলল। বউয়ের নীরব মুখের দিকে চেয়ে আশ্বাসের সুরে বলল,
” চিন্তা করো না। রাতের মধ্যে তোমার পড়াশোনার সব ব্যবস্থা করে দিব। শুধু বলো, কী কী লাগবে। ”
” দরকার নেই। আপনি সামনে থাকলে আমার পড়া এমনিতেও হবে না। ”
” তাহলে থাকব না। যতক্ষণ পড়বে ততক্ষণ তোমার সামনে আসব না। তুমি আমাকে পুরো দুইদিন দিচ্ছ, আমি তোমাকে কয়েকটা ঘণ্টা দিতে পারব না? ”

প্রশ্নটা করে সে পূর্বের মতো মুখটা নামিয়ে রাখল। গাঢ় নিঃশ্বাস টানতে তার সমস্ত সত্তা টলমল করে ওঠল। এখান থেকে ভেসে আসা মেয়েলি গন্ধটা এত তীব্র ও নেশালো যে, মুনছুর সাখাওয়াতের পাগল পাগল ঠেকে। দুর্বিষহ উন্মত্ততার ঝড় ওঠে যায় দেহের প্রতিটা শিরা-উপশিরায়। রক্তের স্রোত এত ভয়াবহ গতিতে ছুটতে থাকে যে, তার মনে হয় যতক্ষণ না স্বর্ণলতার কাছে নিজের সবটা উজার করে দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনোকিছুতেই শান্তি পাবে না!

মুনছুর সাখাওয়াত আরও গভীরভাবে মিশে গিয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
” বলুন। ”
” তোমার শরীর এখন কেমন? ”
” ভালো। আলহামদুলিল্লাহ। ”
” রাতের ঐ দুর্বল ভাবটা কেটেছে? ”
” হুম। ”
” ব্যথা কমেছে? ”

স্বর্ণলতা একটু থামল। ব্যথার কথা তো সে বলেনি! জানল কীভাবে? তার এই স্বল্প নীরবতাটুকুও মুনছুর সাখাওয়াত সহ্য করতে পারল না। চকিতে মাথা তুলে উদ্বিগ্ন স্বরে সুধাল,
” কথা বলছ না কেন? এখনও আছে? ”

সে কথা না বলার কারণটা জানাতে পারল না। রাতের মতোই এখনও লজ্জা লাগছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে তীব্র ব্যথায় সে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছিল না সেটা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পুরোপুরি গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল না, কোনোকালে কোমরের নিচে কোনো স্থানে ব্যথার উপদ্রব হয়েছিল। অথচ ব্যথা উপশমের জন্য কিছু করেনি৷ ট্যাবলেট বা সিরাপও খায়নি। ভোরের দিকে ঘুমের মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত কীসের যেন ট্যাবলেট খায়িয়েছে! কিন্তু ততক্ষণে তার কোনো ব্যথায় ছিল না।

স্বর্ণলতা ভাবনা কাটিয়ে নীরবতা ভেঙে জানাল,
” নেই। ”
” একটুও না? ”
” না। ”

মুনছুর সাখাওয়াতের উষ্ণ, দোদুল্যমান অনুভূতিটা আরও তীব্রতর হলো। স্ত্রীর ঠোঁট জোড়ায় তৃষালু দৃষ্টি রেখে দ্রুত জিজ্ঞেস করল,
” নামাজ পড়েছ? ”
” নামাজ! কোনটা? মাগরিবেরটা পড়েছি। এশারের আযান পড়েনি এখনও। ”

সে চোখ বুঁজে ফেলল। স্বর্ণলতার তার মতো ঘন ঘন গোসল করার অভ্যাস নেই। তন্মধ্যে মেয়ে মানুষ, অল্প বয়স। খুব সহজেই শরীর খারাপ হতে পারে। মুনছুর সাখাওয়াত চায় না পরীক্ষার মধ্যে কোনো অসুস্থতায় পড়ুক। গোসল করতে মানা করলে এই মেয়ে শুনবে না। সে এতটুকু নিশ্চয় জানে গোসল ছাড়া নামাজ হবে না। নামাজ ছাড়বেও না। অন্তত এই বিষয়ে যে অটল জেদটা দেখাবে এই ব্যাপারে সুনিশ্চিত। এবাদতে এই মেয়ের নিষ্ঠতা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে!

মুনছুর সাখাওয়াত বক্ষ বিভাজনে এঁটে থাকা মাথাটা সরিয়ে আনল। কোমর প্যাঁচিয়ে থাকা হাতটা ধীরে ধীরে সরিয়ে এনে তাকাল দেয়ালঘড়িটায়। সময়টা দেখে নিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল,
” এশারের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে। আযান শুনে পড়তে হবে এরকম বাধ্যবাধকতা নেই। যাও, নামাজ পড়ে এসো। ”

এই বিষয়ে জ্ঞান তারও আছে। তাই বিতর্কে জড়াল না। বাধ্য মেয়ের মতো ওজু করতে চলে গেল। জায়নামাজ বিছানোর সময়ে মনে পড়ল, দাদিজান একদিন বলেছিলেন, স্বামী ঘরে থাকা অবস্থায় নফল নামাজ পড়া, নফল রোজা রাখার পূর্বে স্বামীকে জানাতে। সে যদি অনুমতি দেয় তাহলে রাখবে নাহয় পরিহার করবে। স্বর্ণলতা নিয়ত বাঁধার আগে জিজ্ঞেস করে নিল,
” নফল পড়ব? ”

মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে জানাল,
” না। ”

_______
রাতের খাবার খাওয়া শেষে ঘুমানোর সময়ে স্বর্ণলতা স্বামীর কাছে আসে। পাশাপাশি শুয়ে নিঃসংকোচে শক্ত চওড়া রোমশ বুকে মাথা রেখে বলল,
” আমাকে রান্নাঘরে ঢোকার অনুমতি দিবেন? ”
” কেন? ”
” আমি রুটি বানানো শিখেছি। ভাবছি, কালকে দাদিজানের জন্য নাস্তা বানাব। ”
” রান্নার লোক থাকতে তুমি বানাতে যাবে কেন? ”
” উনি তো বাধ্য হয়ে ময়নাবুর রান্না খায়। আমি বানিয়ে দিলে খুব খুশি হবেন। একদিনই তো। অনুমতি দিন না! ”

তার আবদারপূর্ণ কণ্ঠস্বর, উচ্ছ্বাসময় মুখভঙ্গি মুনছুর সাখাওয়াতকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। একটু ভেবে বলল,
” দিলাম। কিন্তু মনে রেখ, তোমার শরীরে যদি আগুনের আঁচের সামান্য দাগও পাই তাহলে ঐ রান্নাঘরে ঢোকা আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। ”

এত সহজে অনুমতি পেয়ে যাবে স্বর্ণলতা ভাবতে পারেনি। আনন্দে ঝলমলিয়ে ওঠল চোখের তারা। এই চকচকে তারা দুটি দৃষ্টি কাড়তে মুনছুর সাখাওয়াতের স্মরণে এলো, সে বাসায় ফেরার পথে তারার মতো দেখতে তীব্র সুগন্ধযুক্ত বকুল ফুলের মালা নিয়ে এসেছিল। ভেবেছিল, খুব রাগ দেখালে পছন্দের ফুল দিয়ে ভাঙাবে। কিন্তু ঘটল উল্টো! দরুন মালার কথা ভুলে গেল। স্বর্ণলতার পছন্দের ফুলের দুটি গাছ বাড়িতে লাগালেও ফুল ফোটেনি একটাতেও। বউকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনাটাও জলে ভেসে গেল। মেয়েটা গাছ দুটো দেখে ফেলেছে নাকি কে জানে! দাদিজানের কাছে শুনেছে ফুল ফোটবে শীতকালে। সেই সময় আসতে বেশি দেরি নেই।

মুনছুর সাখাওয়াত উঠে গিয়ে ফুলের মালা আনল। বেশ বড়সড়। সে গলায় পরিয়ে দিতে স্বর্ণলতা বিস্ময় ভরা কণ্ঠে সুধাল,
” আপনি সত্যিকারের ফুলের মালা আনছেন? আমি আরও ভাবছিলাম, আপনার আতর থেকে গন্ধ বের হচ্ছে! ”

সে জবাব দেয় না। মৃদু হাসে। চুপচাপ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে। যত দেখে তত ভয় হয়! ভাবে, স্বর্ণলতা কি সত্যি তার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছে নাকি কল্পনা করছে? যেমন করে মাকে কল্পনা করে ভয় পেত! ভাবনার মধ্যে স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। স্বর্ণলতা তখনও ফুল নিয়ে খেলছে। নাকের কাছে ধরে গভীর নিঃশ্বাস টেনে বলল,
” কী সুন্দর গন্ধ! কেমন শান্তি শান্তি লাগে। দেখেন না! একটু শুঁকে দেখেন। ”

সে বউয়ের ললিত শরীর থেকে ওষ্ঠপুট আলগা করে। ফুলের মালায় নাকটা ছুঁয়িয়ে বলল,
” এরচেয়েও কয়েকশো গুণ বেশি সুন্দর আমার বউয়ের শরীরের গন্ধ। কেমন নেশা ধরিয়ে দেয়। আমার তো পাগল পাগল লাগে! ”

স্বর্ণলতা এত লজ্জা পেল! মালা দিয়ে মুখ ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে গেল। দৃশ্যটা মুনছুর সাখাওয়াতের দারুন উপভোগ্য লাগল। মনে হলো, মেয়েটাকে সে এমন লজ্জায় মুড়ে যেতে দেখেনি কখনও। বিয়ের দিন থেকেই সে স্বর্ণলতার কাছ ঘেষতে চেয়েছে। কখনও পেরেছে, কখনও পারেনি। গতকাল রাতে নিজের মতো করে নারী সৌন্দর্যের সবটায় দেখেছে, ছুঁয়েছে। এক ফোঁটাও বাদ পড়েনি কোথাও। বউটার মধ্যে ভয় দেখেছে, অস্বস্তি দেখেছে কিন্তু বেহিসেবী লজ্জায় রঙিন হতে দেখেনি।

মুনছুর সাখাওয়াত ঠোঁট দিয়ে মালা টেনে ধরতে স্বর্ণলতা বলল,
” মিথ্যা ওজুহাত দেখিয়ে আমাকে আটকে রেখে কী লাভ হলো? আপনি তো সারাদিন বাইরেই ছিলেন! আমার কত একা একা লাগছিল জানেন? খাবারে রুচি আসছিল না। দাদিজান সামনে না থাকলে খাওয়াই হতো না। ” ” না বললে জানব কী করে? কল করে ডাকতে পারতে। ”
” যে ইচ্ছে করে বিনা কারণে বেরিয়ে গেল, সে ডাকলে আসবে এর নিশ্চয়তা কী? আপনি তো আমার কলও ঠিকমতো ধরেন না। ”
” নিশ্চয়তার অভাবে কষ্ট করেছ। ভালো হয়েছে না? ”

স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। ভ্রূ কুঁচকে কপাল দলা পাকিয়ে কতক্ষণ নীরব চেয়ে থাকল। সহসা ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
” দেখি, ছাড়ুন তো। ”

সে প্রায় জোর করে উঠে বসল। মুনছুর সাখাওয়াত কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সুধাল,
” কী হলো? ”

স্বর্ণলতা একেবারে বিছানা থেকে নেমে গেল। জামা ঠিক করে, চুলে খোঁপা করল। অতঃপর ওড়না মাথায় প্যাঁচিয়ে ধীরেসুস্থে বলল,
” কতদিন পরে এলাম! দাদিজানের সাথে ঠিকমতো কথা বলাই হলো না। অসুস্থ মানুষ, জীবনের সমাপ্তিতে আছেন। কত কী বলার থাকতে পারে! যাই, আজকে উনার সাথে ঘুমাই। ”

সে সত্যি সত্যি দরজার দিকে হাঁটা ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাব কাটিয়ে হাত বাড়াতে দেরি হয়ে গেল। স্বর্ণলতাকে নাগালে পেল না। দূর হতে চেঁচাল,
” স্বর্ণলতা, দাঁড়াও। তোমার চালাকি কিন্তু ধরে ফেলেছি। ”

সে দরজা মেলে বাইরে বের হতে হতে বলল,
” বেশ করেছেন। তারপরেও আমি দাঁড়াব না। আমার কষ্টকে ভালো বলেন? এখন আপনিও সারারাত একা একা কষ্ট করেন। সকালে এসে আমিও আপনার কষ্টকে ভালো বলব। ”

স্বর্ণলতা ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করার পর থেকে খাইরুন নিসা রুমের দরজা আটকান না। সামান্য ভেজিয়ে রাখেন। নাতিটা কখন এলো, গেল শুয়ে শুয়ে খেয়াল রাখেন। চোখে পড়ে গেলে রুমে ডেকে আনেন। মাঝেমধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত ডাক ছাড়াও যেত। দাদিজানকে জাগ্রত দেখলে কথাবার্তা হতো। যার মূল বিষয় হতো স্বর্ণলতা।

দরজা খোলা পেয়ে স্বর্ণলতা ভেতরে ঢুকে পড়ল। ত্বরিত দরজা আটকে দিয়ে বিছানার কাছেও পৌঁছাতে পারল না। বন্ধ দরজায় অবিরত ভারী করাঘাত পড়তে লাগল। সেই সাথে উঁচুস্বরে নাম ধরে প্রথমে ডাকাডাকি চলল। তারপরে চাপা স্বরে হুমকিটা ছুঁড়ল,
” তোমার কাছে পৌঁছাতে আমার দেয়াল কাটতে হবে না, স্বর্ণলতা। দরজাটা ভাঙার জন্য আমি একাই যথেষ্ঠ। নিজ দায়িত্বে শান্তি বজায় রেখে বেরিয়ে এসো। অকারণে দাদিজানকে জ্বালিও না। ভয় পাবে। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৮)

” পাগলাটা ক্ষ্যাপল কেন? আবার কী করেছিস, নাতবউ? ”

স্বর্ণলতা চকিতে ঘাড় ফেরাল। লালচে তিলে ভরা কুঁচকানো মুখটা রুমের টিমটিমে আলোতে ভালোই বুঝা যাচ্ছে। ঘোলা ও দুর্বল দৃষ্টির মনিজোড়া দূর হতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বদনখানা কাত করে তার দিকে চেয়ে আছে। দাদিজানের ঘুম ভেঙে গেছে! সে ত্রস্তপায়ে এগিয়ে গেল বিছানায়। দাদিজানের শিয়রের কাছে বসে মাথা নত করে বলল,
” মাফ করেন, আপনাকে বিরক্ত করলাম। ”
” আচ্ছা। এখন বল, কী করেছিস? মুনছুর ক্ষ্যাপছে কেন? ”

স্বর্ণলতা প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” উনার মন চাইছে তাই ক্ষ্যাপছে। রাগারাগি না করলে তো পেটের ভাত হজম হয় না! ”

খাইরুন নিসা তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। নীরবে নাতবউয়ের মুখটা পর্যবেক্ষণ করে আচমকা বললেন,
” কথা দিয়ে কথা লুকানোও শিখে গেছিস। ”

স্বর্ণলতা থতমত খেল। বুঝে গেল শয়িত বৃদ্ধার কাছে ধরা পড়ে গেছে। বিচলিত হয়ে ওঠল মুহূর্তে। একভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। অস্থির চিত্তে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
” মন চাইলে একেবারে বুকের মধ্যে চেপে ধরে থাকবে আবার মন না চাইলে ফোনে দুইটা মিষ্টি কথাও বলবে না। সবসময় নিজের মর্জিমাফিক চলবে। বিপরীত মানুষটার অনুভূতির কোনো দামই নাই। এত স্বার্থপর মানুষ হয়, দাদিজান? উনি কি কখনওই বদলাবে না? সারাজীবন এমনই থাকবে? ”

কথাগুলো অভিযোগের মতো শোনালেও খাইরুন নিসা প্রগাঢ় অভিমানের আঁচ পেলেন। সেই সাথে এটাও ধারণা করলেন, মুনছুর সাখাওয়াত এই মেয়েটার সামনে নিজের পরিবর্তন সুকৌশলে লুকিয়ে রেখেছে। কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না, নশ্বর এই দুনিয়ায় একমাত্র একটি মেয়ের অনুভূতির দাম দিতে গিয়ে সে কতটা খয়িয়েছে! আপন মর্জিতে দু’পায়ে পিষছে প্রতিনিয়ত! অথচ বিনিময়ে সেটাই চাচ্ছে যেটা তার পূর্ব থেকেই প্রাপ্য ছিল। এত কাঠখড় পুড়ানোর দরকার ছিল না। বিধাতার নিয়মে কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর দেহ, মন, চিন্তা-চেতনা সবই তার হওয়ার কথা। তারপরেও হলো না কেন, তিনিই জানেন। হয়তো এটাই তাঁর অভিপ্রায় ছিল। দাদিজান নাতির গোপনীয়তা প্রকাশ্যে আলনেন না। আবার একেবারে কড়া নজরদারিও দিলেন না। ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করলেন। নাতবউয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” কী জানি! কিন্তু তুই যাওয়ার পরে মুনছুর কিন্তু আমার খুব যত্ন-আত্তি করছে। ”
” করবেই তো, আপনাকে খুব ভালোবাসে যে! ”
” ভালোবাসে! আমাকে? জানতাম না তো। কখনও বুঝতে পারিনি। ”
” আমি প্রথমদিন থেকেই জানি। ”
” তোকে বলেছে? ”
” না। আমি নিজে থেকেই বুঝতে পেরেছি। ”

খাইরুন নিসা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুনছুর সাখাওয়াত অনেকদিন পূর্বে তার কাছে আফসোস করে বলেছিল, ‘ তোমার নাতবউকে আমি যেটা বুঝাই ওটা বুঝে না, যেটা বুঝাতে চাই না সেটা ঠিকই বুঝে ফেলে। ‘ আজ যেন সেই কথাটায় পরিষ্কারভাবে মিলে গেল! নিজেকে উদাহরণ বানিয়ে যে কথাটা বুঝাতে চাইলেন স্বর্ণলতা সেটা না বুঝে অন্য কিছু বুঝে বসে আছে।

দাদিজান অনেকটা সময় মৌন থেকে পুনরায় বললেন,
” কাল ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় যাস। ”
” কেন? কোনো দরকারি কাজ আছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”

খাইরুন নিসা মৃদু হাসলেন। চোখে কী যেন একটা ঝিলিক দিয়ে ওঠল। স্বর্ণলতা খেয়াল করল ঠিকই কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু অনুমান করতে পারল না। দ্বিধাগ্রস্ত হতে শুনল,
” যাদু দেখাব। খাঁটি যাদু। যাতে কোনো মিথ্যা বা ধোঁকা নেই। ”

স্বর্ণলতা আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” আপনি যাদুও দেখাতে পারেন? ”

দাদিজান জবাবে আবারও হাসলেন। চোখের মনিদুটো পূর্বের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠল। স্বর্ণলতা এবারও কিছু বুঝে উঠতে পারল না। তার আগেই দরজায় বজ্রাঘাতের মতো শব্দ হলো। সে তীব্র ভয়ে এত কেঁপে ওঠল যে, চোখদুটি আপনাআপনি খিঁচে বন্ধ হয়ে গেল। ভয়টা কয়েক সেকেন্ডই স্থায়ী ছিল। তারপরে প্রচণ্ড বিরক্তে রুপান্তর হলো। দাদিজানের বিছানা ছেড়ে দরজা মেলে দিয়ে বলল,
” এত জ্বালাইতাছেন ক্যান? শান্তিতে দুইডা কথাও কইতে দিবেন না? লুকাইয়া তো আসি নাই। আপনেরে কইয়াই আসছি। ”

হঠাৎ মুখের ভাষা ও কথা বলার ধরণ বদলে যাওয়াই মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। শুধু পূর্ণ দৃষ্টিতে শান্তভাবে চেয়ে আছে বউয়ের বিরক্ত মাখা মুখটায়। চেয়ে থাকতে থাকতে বাস্তবজগৎ থেকে বেরিয়ে গেল। চিন্তাভাবনায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল, সে এতদিন স্বপ্ন দেখেছে। স্বর্ণলতার পড়াশোনার জেদ, ঢাকায় থাকা এসব কিছু ঘটেনি। সবই তার জাগ্রত কল্পনা। ঢাকা থেকে পাগল পাগল হয়ে ছুটে আসা, ভালোবাসার পরীক্ষা দেওয়া ও পরিশেষে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করা এগুলোও মিথ্যা। বানোয়াট। মুনছুর সাখাওয়াত নিজে মনের খেয়ালে বানিয়েছে। যে সুখ বাস্তবে পায়নি সেই সুখ মনে মনে পূরণ করে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে। অজান্তেই, অবচেতনে বর্তমান সময়টাকে অতীতে আটকে ফেলল। যে সময়টায় স্বর্ণলতা তাকে পছন্দ করত না, সামনে আসতে চাইত না৷ জোর করে আনলে এরকম বিরক্ত হতো, রাগ হতো।

মুনছুর সাখাওয়াতের বিভ্রম কাটতে বেশ সময় লাগল। ততক্ষণে স্বর্ণলতা স্বামীর রুমে চলে গিয়েছে। সে তড়িঘড়িতে নিজের রুমে ফিরে গেলেও ভেতরে ঢুকল না। অতীত ও বাস্তবের ঘোরটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করল,
” স্বর্ণলতা, তোমার বয়স কত হলো? ”

সে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে আঁট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে এক ঝলক স্বামীর দিকে চেয়ে জবাব দিল,
” জানি না। ”

জবাব শেষে পুনরায় ঘাড়টা সোজা করে নিল। এই কর্মসাধনের ফলে চুলের ভারী খোঁপাটা মাথার ওড়নাসহ খসে পড়ল। লম্বা, ঘন চুল পিঠময় ছড়িয়ে পড়ার মনোরম দৃশ্যটা মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি এড়াল না। চোখ বুঁজে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপরে রুমের ভেতরে ঢুকল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল স্ত্রীর পেছনে। একহাতে কোমর জড়িয়ে অন্যহাতে চুলের গোছা সরিয়ে নিজের অতি প্রিয় ও প্রার্থিত অংশটায় অধর ছুঁয়িয়ে বলল,
” আমি তোমার কষ্টকে ভালো বলিনি। ”
” সরাসরি বলেননি, খোঁচা মেরে বলেছেন। ”

স্বর্ণলতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল আবারও। স্বামীর কাছ থেকে সরে বিছানায় ওঠল। চোখ বুঁজে গুটিশুটি মেরে শুয়ে কড়া স্বরে জানাল,
” আমি ঘুমাব। কেউ যেন বিরক্ত না করে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত খোলা জানালা বন্ধ করে বিছানায় এলো। স্ত্রীর পাশে শুয়ে বলল,
” ঠিক আছে করব না। কিন্তু তোমাকেও ঐ ছেলেমানুষি বদঅভ্যাসটা ছাড়তে হবে। ওটা আমাকেও খুব বিরক্ত করে। ”

স্বর্ণলতা ঝটিতে চোখ মেলল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কোনটা ছেলেমানুষি? ”
” আমাকে বাইরে রেখে দরজা আটকে দেওয়া। ”
” এটা ছেলেমানুষি? ”
” হ্যাঁ। খুব বিরক্তিকরও! ”

সে চোখ সরিয়ে নিল। কোনো যুক্তিতর্কে গেল না। এই বিরক্তিকর ছেলেমানুষি বদভ্যাসটা স্বর্ণলতার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালি অস্ত্র। একমাত্র এই অস্ত্রের কাছেই তো তার স্বামী বারবার পরাস্ত হয়েছে! এই অস্ত্র সে কিছুতেই ছাড়তে পারবে না। তাই আগের মতো চোখ বুঁজে নিয়ে বলল,
” ছাড়ব না। আপনার বিরক্ত লাগলে দরজার কাছ থেকে সরে যাবেন। আমি তো আটকে রাখি না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক সেকেন্ডও সময় নিল না। স্ত্রীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” আমিও ছাড়ব না। তোমার বিরক্ত লাগলে আমার কাছ থেকে সরে যাও। ”

স্বর্ণলতা জানে এই বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার সাধ্য তার নেই। তারপরেও সে ছোটার জন্য অদম্য চেষ্টাটা করে যাচ্ছিল। এই প্রচেষ্টা চলাকালীন শুনল,
” আমার বাইরে কোনো কাজ ছিল না। তারপরেও সারাটা দিন বাইরে ছিলাম। এই সময় নষ্টের কারণটা যে তুমি, এটা জেনেও অকারণ রাগটা দেখাচ্ছ। এটা কি ঠিক হচ্ছে, স্বর্ণলতা? মুখে জবাব দাও। তোমার কাছে যদি ঠিক মনে হয় তাহলে আমি এখনই তোমাকে ছেড়ে দিব। সারারাতে ভুল করেও স্পর্শ করব না। প্রয়োজনে অন্য রুমে গিয়ে শুব। ”

স্বর্ণলতার পিল চমকে ওঠল। হাঁসফাঁস শ্বাস ও দেহের মোচড়ামুচড়ি থেমে গেল আপনাআপনি। শরীরটা শিথিল হয়ে আসতে বুঝে এলো কতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। দাদিজানের পাগলটা এবার সত্যি ক্ষ্যাপে গেছে। এই মুহূর্তে না সামলালে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়েই ছাড়বে! সমস্যা ও সমস্যার সমাধান উভয়ই জানা সত্ত্বেও সরাসরি হার মানতে চাচ্ছিল না। তাই বলল,
” তাহলে বলেন, কাল সারাদিন বাসায় থাকবেন। ”
” থাকব। ”

স্বর্ণলতা ভাবতেও পারেনি এত সহজে মেনে যাবে। তাই সুযোগটাকে আরও কাজে লাগাতে চাইল। দ্রুত বলল,
” আমার কল ধরবেন। কখনও এড়িয়ে যাবেন না। ”
” যাব না। ”
” ঢাকায় গেলে আমাকে না বলে গ্রামে ফিরবেন না। ”
” ফিরব না। ”

সে আরও কিছু প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার নড়ে উঠা ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে হিঁসিয়ে ওঠল। স্বর্ণলতা থেমে যেতে সে বলল,
” এবার আমার দাবি মেটাও। ”

______
ভোরবেলা। স্বর্ণলতা নামাজ শেষ করে কোরানশরীফটা হাতে নিল। মেলার সময়ে টের পেল, মুনছুর সাখাওয়াত রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অজান্তেই বুকের খুব গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। খুব মনখারাপও হলো। অমূল্য ও পবিত্র কিতাবখানা মানুষটা পাঠ করে না, অন্যের পাঠকে চুপচাপ শ্রবণও করে না। কেমন অধৈর্য হয়ে ঝটপট বেরিয়ে গেল!

তেলাওয়াত শেষ করে স্বর্ণলতা জায়নামাজ থেকে ওঠছিল। সহসায় স্মরণে এলো, গতকাল রাতে দাদিজান বলেছিল এই সময়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। তাহলে নাকি যাদু দেখতে পারবে। খাঁটি যাদু! স্বর্ণলতা আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। দ্রুত কদমে পৌঁছাল বারান্দায়। কেউ নেই। বারান্দা ও উঠোন উভয়ই ফাঁকা। সে ভেবেছিল, দাদিজানকে দেখতে পাবে। তিনিও নেই। স্বর্ণলতা আশাহত হলেও তখনই ফিরে আসল না। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। যতখানি দৃষ্টি যায় ততখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েও যখন অবাক করার মতো কিছু ঘটল না তখনই মনস্থির করল ফিরে যাবে। প্রথমে দেখা করবে দাদিজানের সাথে, তিনি হয়তো এই বিষয়টা ভুলে গেছেন তাই বারান্দায় আসেননি।

স্বর্ণলতা মুখ ফিরিয়ে পা ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল। মূল দরজাটা পার হওয়ার সময়ে কিসের যেন একটা টান অনুভব করল। ভীষণ অনীহা ও অনাগ্রহ দৃষ্টিতে আরও একবার উঠোনের দিকে ছুটে যেতেই সে থমকে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত ঢুকছে গেইট দিয়ে। মাথায় টুপি, পাঞ্জাবির হাতা সম্পূর্ণ মেলা, পায়জামার নিচের ভাঁজটা টাখনুর ওপরে। সাজসজ্জা দেখে যে কেউ বলে দিবে এই লোক কট্টর নামাজি। তাকে আরও অবাক করল তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো। গেইট পার হওয়ার সাথে সাথে টুপি খুলে পকেটে ভরল। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিল কনুই পর্যন্ত। উপুড় হয়ে পায়জামার ভাঁজটাও খুলে ফেলল। স্বর্ণলতা এই চটপটে সম্পন্ন হওয়া কার্যকলাপ দেখছিল খুব মনোযোগে, অপলকে। এই সময়ে দাদিজানের কণ্ঠটা পেল,
” যাদু কেমন লাগল? ”

সে ঘোরের মধ্যে সুধাল,
” এই খাঁটি যাদু কি রোজই দেখতে পারব, দাদিজান? ”
” না। ”

নেতিবাচক উত্তর শুনে স্বর্ণলতার ঘোরভাব ছুটে গেল। তাহলে কি তার ধারণা ভুল? মানুষটা নিয়মিত নামাজ পড়ে না? এই সাজসজ্জা পবিত্র উদ্দেশ্যের জন্য না? আল্লাহর প্রতি নত স্বীকার করার জন্যে না? খাইরুন নিসা নাতবউয়ের মুখ দেখেই তার গোপন প্রশ্ন ও সংশয় বুঝে গেলেন। একগালে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন,
” এই যাদু রোজ দেখতে হলে রোজ এই সময়ে এখানে দাঁড়াতে হবে। তুমি তো কালই ঢাকা চলে যাবে। তাহলে দেখবে কীভাবে? আমি এই অর্থে না বলেছি, নাতবউ। ”

স্বর্ণলতা এই কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বলতে পারল না। শুধু টের পেল চোখদুটি ঝাপসা হয়ে আসছে। হয়তো কেঁদেই ফেলত যদি না মুনছুর সাখাওয়াত চলে আসত। সে এসেই প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” এখানে কী? ”

খাইরুন নিসা ও স্বর্ণলতা উভয়ে চমকে তাকাল। প্রশ্ন শোনা সত্ত্বেও উত্তর দিতে পারল না কেউই। মুনছুর সাখাওয়াত বারান্দায় উঠে এলো। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল,
” এই সময়ে চঞ্চল আসে বাজারের ফরমায়েশ নিতে, জানো না? ”
” জানি। ”
” তাহলে এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এসো। ”

______
স্বর্ণলতা রুমে ঢুকতে মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” তোমার চোখ, নাক এমন লাল হয়ে আছে কেন? সর্দি লাগছে নাকি? ”
” না। ”
” তাহলে? কান্নাকাটি করেছ? ”

সে এই প্রশ্নের জবাব দিল না। বিছানায় গিয়ে বসল, স্বামীর পাশে। মুনছুর সাখাওয়াত তার মাথা থেকে তোয়ালে খুলে দিয়ে বলল,
” নামাজে এত কান্নাকাটি করার কী আছে? আমি জানি, পরীক্ষায় তুমি ভালো করবে। ”

স্বর্ণলতা নামাজে বসে কাঁদেনি। কাঁদলেও সে পরীক্ষার জন্য কাঁদত না। আজ অবধি এই বিষয়ে কান্নাকাটি করেছে বলে মনে হয় না। তার ইচ্ছে হলো স্বামীর ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতে। কিন্তু ভাঙাল না। তাহলে পরবর্তীতে যে প্রশ্নটা করবে সেটার উত্তর সে দিতে পারবে না।

মুনছুর সাখাওয়াত ভেজা চুলগুলো দুইহাতে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
” তোয়ালেটা আরও আগে খুলবে না? এতক্ষণ চুল ভেজা থাকলে তো সর্দি লাগবে। তারপরে পরীক্ষা খারাপ হলে বলবে, আমার দোষ। অথচ ভুল করছ তুমি। ”

স্বর্ণলতা নিজের চুল ছাড়িয়ে নিল। অতঃপর ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমি ভুল করে আপনাকে দোষী বানাই? ”

মুনছুর সাখাওয়াত উত্তর দিল না। বউয়ের মুখের দিকে নীরব চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”
” কোথায় কী হয়েছে? ”
” অল্পতেই চটে যাচ্ছ যে! মুখটাও স্বাভাবিক লাগছে না। পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করছ? বইয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। চঞ্চল নিয়ে আসবে এখনই। ”

স্বর্ণলতা চোখ নামিয়ে ফেলল। পরীক্ষা নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। পুরো বিষয়টা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজ, এখন মনে করিয়ে দিল বলে মনে পড়ল। তাহলে অল্পতে মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণটা কী? স্বর্ণলতা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আয়নায় নিজের মুখটা ভালোভাবে পরখ করে বলল,
” অস্বাভাবিকের কী দেখলেন? আমার তো সব ঠিকই লাগছে! ”

মুনছুর সাখাওয়াত নিজের জায়গা থেকে নড়েনি। স্থির বসে থেকে বউকে নজরে রাখছিল। প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে বলল,
” তুমি কি আজই ঢাকা ফিরে যেতে চাচ্ছ? ”

এতক্ষণে সে উঠে দাঁড়াল। স্বর্ণলতা আয়নার মধ্যে পুরুষ প্রতিবিম্বটায় চেয়ে আছে। শারীরিক গড়ন সেই প্রথম দিকের মতো হলেও মুখের আদলটা বদলে গিয়েছে যেন! তাকানোর ভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, হাতের স্পর্শ সবকিছুই ভীষণ অন্যরকম। কিন্তু খুব আপন আপন লাগে।

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর পেছনে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালেও স্পর্শ করল না। আয়নার ভেতর দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
” তুমি আমার কথাতে থাকলেও আমি ভেবেছিলাম, তুমি খুশি হবে। ঐ খুশিটা দেখতে পারছি না কেন, স্বর্ণলতা? তাহলে কি একটুও খুশি হওনি? এজন্যে রাত থেকে বিরক্ত হয়ে আছ? ”
” আবার রাতের কথা আসছে কেন? সব না ঠিক হয়ে গেল? ”
” আমার জোরাজুরিতে ঠিক হয়েছে। এমনও তো হতে পারে তুমি ঠিক হওয়াটা দেখাতে বাধ্য হয়েছ। ”

তাদের কথোপকথন শেষ হলো না। পূর্বে কলির গলা পাওয়া গেল। সে বাইরে থেকে জানাল, চঞ্চল এসেছে। মহাজনের সাথে দেখা করবে। মুনছুর সাখাওয়াত তখনই ভারী পদধ্বনি ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণলতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মানুষটা ইদানিং অতিরিক্ত জেরা করছে! কোনো উত্তরেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। সবকিছুতে ভিন্ন কিছুর গন্ধ পায় যেন!

প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে মুনছুর সাখাওয়াত ফিরে এলো। স্বর্ণলতা তখনও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আনমনা, উদাসভাবে। চেতন ফিরল স্বামীর হাতের স্পর্শে। কাঁধ চেপে ধরে একপাশে টেনে নিয়ে বলল,
” ঐদিক ফিরে দাঁড়াও তো। নড়াচড়া করবে না একদম। ”

সে তাই করল। চুপচাপ উল্টো ফিরে ভাবছে, কী নিয়ে কথা হচ্ছিল সেটা মনে হয় ভুলে গিয়েছে। চালচলন, গলার স্বর, মেজাজ সবই স্বাভাবিক লাগছে। সেকেন্ড কয়েক পেরুতে স্বর্ণলতা কেঁপে ওঠল। কী একটা ঝিম ধরা শব্দ কানে লাগতে মনে হলো, তার চুল বিশৃঙ্খল ও এলোমেলোভাবে ওড়ছে। সে ঝটিতে পেছন ফেরার চেষ্টা করতে মুনছুর সাখাওয়াত ঘাড় চেপে ধরল। অতঃপর সুধীর কণ্ঠে সাবধান করল,
” নড়তে মানা করেছি। ”
” কী করছেন? ঘাড়ের কাছে এত গরম লাগছে কেন? আল্লাহ! আপনি আমার চুলে আগুন ধরিয়ে দেন নাই তো? ”
” আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়? ”
” না। পাগলের উপরে যদি কিছু থাকে আপনি ওটা। ”
” আচ্ছা। ”

স্বর্ণলতা আবারও পেছনে ফেরার চেষ্টা করল। মুনছুর সাখাওয়াত এবারও আটকে দিয়ে বলল,
” বললে না তো আজই ঢাকা ফিরে যেতে চাও নাকি?

আবার সেই একই প্রশ্ন! কিছু ভুলেনি। শুধু একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল। স্বর্ণলতা গভীর নিঃশ্বাস টানল। মুনছুর সাখাওয়াত পেছন থেকে আবারও কথা বলল,
” স্বর্ণলতা, কথা বলো। তুমি চাইলে এখনই আমরা…”

তাকে বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে দিল না। ঘাড়ে চেপে থাকা হাতের চাপটাকে উপেক্ষা করে স্বর্ণলতা সবেগে পেছন ফিরে বলল,
” আপনার কথা শুনে চলছি এতে আপনি খুশি না? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে এত প্যাঁচ মারেন কেন? শুধু নামাজ পড়লে হবে না, ঘাড় থেকে সয়তানটাকেও নামাতে হবে। বুঝছেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত মুখে জবাব দিতে পারল না। মাথা উপর-নীচ করতে স্বর্ণলতা পুনরায় বলল,
” আমার বই কোথায়? ”
” পড়ার রুমে রেখে আসছি। ”

স্বর্ণলতার চোখ এবার স্বামীর মাথার উপরে গেল। একটা হাত উপরে তুলে আছে। সেই হাতে লম্বা হাতলের মতো একটি যন্ত্র। ঝিম ধরা শব্দটা এই যন্ত্রটি থেকে আসছে। সে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
” এটা কী? ”
” হেয়ার ড্রায়ার। ”

স্বর্ণলতার ভ্রজোড়া কুঁচকে এলো। আগ্রহ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় পেলেন? ”
” চঞ্চলকে দিয়ে আনিয়েছি। ”
” কেন? ”
” তোমার চুল শুকানোর জন্য। ”

স্বর্ণলতা চমকে উঠে চুলে হাত দিল। প্রায় সবগুলোই শুকনো। এতক্ষণ ধরে তাহলে তার চুল শুকাচ্ছিল? এটা মুখে বললে কী হতো? সে আরও মনে মনে কত কী ভাবছিল!

______
মুনছুর সাখাওয়াত একটু পর পর ঘড়ি দেখছে। ঘণ্টার কাঁটা সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটাতে পৌঁছে গেল অথচ তার বউ ফিরছে না। সে দাদিজানের জন্য নাস্তা বানানোর কথা বলে রান্নাঘরে ঢুকেছে। দুটো রুটি বানাতে এত সময় লাগে? মুনছুর সাখাওয়াত শেষবারের মতো ঘড়িতে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরটা সাথেই। দরজা পেরুলে ভেতরে কী চলছে, কারা আছে সবই প্রদর্শন হয়। সে দরজায় দাঁড়িয়ে ময়নার গলা পেল। ভীষণ কাতর স্বরে বলছে,
” হয়ছে। এইবার উডেন। আপনে কাম করতাছেন, এই কথা ছারে জানতে পারলে আমার চাকরি তো যাইবো সাথে হাত দুইডাও থাকবো না। ”

পরের কণ্ঠটা স্বর্ণলতার। সে উল্লসিত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করছে,
” ময়নাবু, ডিস্টার্ব করো না তো। সরো, রুটিগুলা শেষ করতে দাও। তোমাকে কতবার বলব, আমি উনার অনুমতি নিয়া আসছি। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। ”

তাদের কথোপকথন আরও কিছুক্ষণ চলল। তারপরে মুনছুর সাখাওয়াত রান্নাঘরের দরজার মাঝ বরাবর দাঁড়াল। বাইরে থেকে দেখল, স্বর্ণলতা শুধু দুটো রুটি নয় পুরো দুই পাহাড় রুটি বানিয়েছে। তবুও তার বেলা শেষ হয়নি। এখনও চলছে। সে ভেবেই পেল না, এত রুটি দিয়ে কী হবে। তারা বাড়িতে মাত্র তো তিনজন সদস্য!

ময়না ছায়ার উপস্থিত পেয়ে তাকিয়েছিল। সাথে সাথে ভড়কে গেল। হাত-পায়ে কাঁপন ধরতে বজ্রকণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” রান্নাঘর থেকে বের হ। আমি আশপাশেও কাউকে দেখতে চাই না। ”

কলিও ভেতরে ছিল। সে রুটি ভাজছিল। তন্মধ্যে ময়না হাত ধরে টেনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় দৌড়ভঙ্গিতে রান্নাঘরের প্রাঙ্গনটা পার হওয়ার পরে মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে ঢুকল। স্বর্ণলতা ঘটনার আকস্মিকতায় সটান দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মুখের বুলি ফুটল প্রায় আধ মিনিট পরে। জিজ্ঞেস করল,
” আপনি রান্নাঘরে ঢুকেছেন কেন? ”
” তুমি বের হচ্ছ না তাই। ”
” রুটি বানানো শেষ হয় নাই তো। ”
” শেষ করো। ”
” আচ্ছা। আপনি যান। আমি শেষ করে আসছি। ”

স্বর্ণলতা নিজের কাজে পুনরায় মনোযোগ দিয়ে বলল,
” কলিবুকে ফেরত আনেন। এত রুটি আমি একা ভাজলে অনেক সময় লাগবে। আমার তো বানানোও শেষ হয় নাই! ”
” তোমাকে ভাজতে হবে না। ”

কথাটা বলে মুনছুর সাখাওয়াত চুলা থেকে গরম তাওয়া নামিয়ে ফেলল। স্বর্ণলতা খেয়াল করে আবারও উঠে দাঁড়াল। কাছে এগিয়ে দ্রুত গলায় বলল,
” আরে, কী করছেন! তাওয়া নামাচ্ছেন কেন? ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আবার গরম করতে হবে। তখন আরও বেশি সময় লাগবে। আপনি এখান থেকে যান তো। আমি কলিবুকে ডেকে আনছি। ”

স্বর্ণলতাকে যেতে দিল না। দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে মুনছুর সাখাওয়াত জ্বলন্ত আগুনে একের পর এক রুটি সেঁকতে লাগল।

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৮৯)

স্বামীর রুটি সেঁকার পারদর্শিতা ও দ্রুততা দেখে স্বর্ণলতা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। চোখের পলকে এক ভাগ রুটি ভাজা শেষ। কোথাও পুড়ছে না, কাঁচাও থাকছে না। প্রতিটি রুটি বলের মতো ফুলে ওঠছে যেন! এই যাদুকরি কর্ম ক্ষমতা দূর থেকে দেখে পরিপূর্ণ আনন্দ নেওয়া যাচ্ছিল না। সে কাছে এগিয়ে এলো। মুনছুর সাখাওয়াতের একহাত চেপে ধরে আরও কিছু রুটি সেঁকা দেখল। তারপরে আচমকা বলে ওঠল,
” আমিও ভাজব। খুন্তিটা দিন না। ”

কণ্ঠস্বর আহ্লাদিত ও আবদারপূর্ণ। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে পেছনে ঠেলে দিল। অতঃপর ব্যস্ত ও গম্ভীর স্বরে জানাল,
” তুমি পারবে না। ”
” পারব। আপনি আছেন তো, শিখিয়ে দিবেন। ”
” আমি থাকলে তোমার শিখার দরকারটা কী? এসব কাজ তোমার জন্য না। স্বর্ণলতা, দূরে দাঁড়িয়ে থাকো। ”

সে দূরে যাওয়ার পরিবর্তে আরও সামনে এগিয়ে এলো। জোর দেখিয়ে খুন্তিটা নিজের দখলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল। মুনছুর সাখাওয়াত টের পেয়ে ত্বরিতগতিতে খুন্তিসহ হাতটা সরিয়ে নিল। অতঃপর আরও একবার সাবধান করল,
” বললাম তো পারবে না! হাতে তাপ লাগবে। তখন লিখবে কীভাবে? তোমার না কাল পরীক্ষা? ”

এতসব যুক্তি, ভবিষ্যৎ আশঙ্কা কিছুই স্বর্ণলতাকে দমাতে পারছে না। তার জেদি মনোভাব। কৌতূহলপূর্ণ চোখদুটি দিয়ে দেখছে পানির মতো সহজ কাজ। রুটি দাও, উল্টাও, তারপরে তুলে ফেল। এতে হাতে তাপ লাগার কী আছে? সে নাহয় আরেকটু সাবধানে দূর হতেই কাজটা করবে। তবুও করা চাই। বাঁধ ভাঙা উৎসাহ, উদ্দীপনা এড়িয়ে যাবে কী করে? কিশোরী বয়সের দোষ তো এই একটায়। অতিরিক্ত ভয়, কৌতূহল। তারপরে মিলেমিশে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে ফেলা!

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে আবারও পিছনে ঠেলে দিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করল। একটা রুটি সেঁকা শেষ করে তুলেছে। তখনই স্বর্ণলতা একলাফে স্বামীর মেপে দেওয়া সীমাটুকু কাটিয়ে ওঠল। বেলে রাখা একটা কাঁচা রুটি হাত দিয়ে তুলতে তুলতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
” আমি দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আটকানোরও সময় পেল না। পূর্বেই তুলে নেওয়া রুটিটা অতি দ্রুত জ্বলন্ত আগুনে রাখতে চাইল। অতিমাত্রা প্রফুল্লচিত্তে কাজটা করতে গিয়ে হাতটা একটু বেশি আগুনের কাছে চলে গেল। সর্বোচ্চ তাপে জ্বলতে থাকা আগুনের অসহণীয় আঁচ হাতে লাগতে সে আর্তনাদ করে ওঠল। হাত টেনে নিয়ে অবিরত ঘনঘন ঝাড়া দিতে লাগল। চোখ, মুখ খিঁচে ফেলল প্রচণ্ড জ্বালাযন্ত্রণায়। সেকেন্ড দুইও পেরুল না। স্বর্ণলতা হাত ঝাড়া থামিয়ে দিল। মুখের অবস্থা স্বাভাবিক করে স্বামীর দিকে তাকাল। ঠিক তখনই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” শান্তি হয়েছে? ”

স্বর্ণলতার হাতে তখন মরণ যন্ত্রণা চলছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছিল না কিছুতেই। এই সময়ে এই প্রশ্নটা তীরের ফলার মতো বিঁধল যেন! যন্ত্রণা হাত থেকে বেয়ে চলে এলো বুকের মধ্যে। আহা, এভাবে কেউ বলে? সে কি ইচ্ছে করে হাত পুড়িয়েছে? ভুল করে ঘটে গিয়েছে। প্রথমবারে কি সবাই বিজয় লাভ করতে পারে?

মুনছুর সাখাওয়াত খুন্তিটা রেখে দিল। স্ত্রীর আঁচ লাগা হাতটার দিকে একহাত বাড়িয়ে পুনরায় বলল,
” দেখি, কতটুকু পুড়েছ। ”

কণ্ঠটা এত শান্ত, গম্ভীর যে স্বর্ণলতা ভয় পেয়ে গেল। সে ব্যথা পেয়েছে কিংবা কষ্ট পেয়েছে এরকম পরিস্থিতিতে মানুষটাকে বরাবরই অতিশয় উৎকণ্ঠিত, ব্যগ্র হতে দেখেছে। দীর্ঘ সময় একই ধরনের যত্ন পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আচমকা একটু ভিন্ন আচরণ পেয়ে রীতিমতো গলা শুকিয়ে এলো। স্মরণে এলো, রাতের কথাটা। খুব সুন্দরভাবে পরিষ্কারভাবে বলেছিল, সামান্যতম আঁচের দাগ পেলেও রান্নাঘরে চিরতরে ঢোকা নিষেধ হয়ে যাবে। শর্ত ভেঙে ফেলার কারণে কি সেটায় ঘটতে চলেছে? স্বর্ণলতা ত্বরিত হাতটা পেছনে সরিয়ে ভীত গলায় জানাল,
” পুড়েনি। শুধু একটু গরম লেগেছে। অভ্যাস নেই তো….”

তাকে পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিল না। পূর্বে শক্ত গলায় বলল,
” আমি হাত দেখতে চেয়েছি, স্বর্ণলতা। আর কত অবাধ্য হবে? আজকের জন্য অতটুকুই কি যথেষ্ঠ না? ”

স্বামীর অবাধ্য হলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হোন। কথাটা দাদিজানের মুখে অসংখ্যবার শুনেছে। ভয়ঙ্কর সব আজাবের বর্ণনা শোনানোর পর সদুপদেশ দিতেন এই বলে যে, আল্লাহর বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন কোনো কথা ব্যতীত অন্য সব কথায় যেন সায় দেয়। পালনে বাধ্য থাকে। স্বর্ণলতা সর্বদাই চেষ্টা করে দাদিজানের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে। কিন্তু মাঝেমধ্যে কী যে হয়! নিজের মন ব্যতীত অন্য কারও কথায় শুনতে চায় না, মানতে চায় না। তারপরে বুঝতে পারে কত বড় ভুল করেছে। আজ, একটু আগেও সে মনমতো চলতে গিয়ে ভুলটা করে বসল।

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর নীরবতা ও স্থিরতাটুকু বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। সে চাইলে জোর করে স্বর্ণলতার হাতটা দেখতে পারে, এটুকু গায়ের জোর, সম্পর্কের অধিকার উভয়ই আছে। তবুও সে হাত বাড়াল না। তার দিকে একস্থির চেয়ে থেকে অবশিষ্ট কাঁচা রুটিগুলো একসাথে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করল। সাথে সাথে অদ্ভুত কটু গন্ধ ও কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে লাগল রান্নাঘরটায়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্বর্ণলতা এত ঘাবড়ে গেল যে, কী বলবে বা করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তাই লুকিয়ে রাখতে চাওয়া হাতটায় বাড়িয়ে ধরল। সেই সাথে মনেপ্রাণে চাচ্ছিল, কোনো দাগ যেন স্বামীর চোখে না পড়ে।

স্ত্রীর মেলে রাখা হাতটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে দেখতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ঐ হাতটাও দেখাও। ”

স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। ধোঁয়া ও গন্ধে তার গলার ভেতরটা কেমন জানি করছে! নিঃশ্বাস নিতেও খানিক অসুবিধা হচ্ছে। কেউ টের পাওয়ার পূর্বে যত দ্রুত সম্ভব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটা সামলে নিতে হবে।

মুনছুর সাখাওয়াত দুই হাতের তালু একসাথে করতে পার্থক্যটা নজরে পড়ল। আগুনের আঁচে ডানহাতের সম্পূর্ণ তালুটায় লাল হয়ে গিয়েছে। না জানি কতটা জ্বালা করছে! মেয়েটা সহ্য করছে কীভাবে? হাব-ভাবে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। সে তখনই হাতটা টেনে ঠাণ্ডা পানি ঢালল কতক্ষণ। তারপরে চুলাটা নিভিয়ে দিয়ে আদেশের মতো বলল,
” রুমে চলো। ”

স্বর্ণলতা রুমে ঢোকার সময়ে দাদিজানকে দেখতে পেল। ময়নার সাহায্য নিয়ে মন্থরগতিতে এদিকটায় আসছে। চোখাচোখি হতে সে অসহায় দৃষ্টি ছুঁড়ল। বিড়বিড়িয়ে ইশারায় মাফ চেয়ে নিল।

_______
মুনছুর সাখাওয়াত মলম লাগানো হাতটায় একটু পর পর ফুঁ দিচ্ছে। স্বর্ণলতা শর্ত ভাঙার ফলে যে শাস্তিটা পাওয়ার কথা সেটা নিয়ে এখনও কিছু বলেনি। সে আকুলচিত্তে রবের কাছে দোয়া করতে লাগল মানুষটা যেন ভুলে যায়। প্রার্থনার মধ্যে আচমকা বলল,
” রুটিগুলো পুড়লেন কেন? খাবার নষ্ট করলে সংসারের বরকত কমে যায়। ”
” এই নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। তোমার সংসার তো এখানে না, ঢাকাতে। ওখানে আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্য না। তাই আমার দোষে বরকত কমার কথা না। ”

খোঁচাটা বেলের কাঁটার মতো ক্ষতবিক্ষত করে দিল নরম, ছোট্ট বুকটা। রক্ত ঝরেনি তারপরেও কী অসহ্য ব্যথা অনুভব হয়! স্বর্ণলতা নতুন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেও দমে গেল না। কট্টর জবাব দিল,
” গুরুত্বপূর্ণ সদস্য না তারপরেও পুরো সংসারের খরচ চালাচ্ছেন! ঐ বাড়িতে এমন একটা জিনিস নেই যেটা আমার বা আমার আম্মা-আব্বার টাকায় কেনা হয়েছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আরও একবার ফুঁ দিতে যাচ্ছিল। দেওয়া হলো না। ঠোঁটদুটি গোল করা অবস্থায় স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। খোঁচার বিপরীতে খোঁচা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারছে না, যে সংসারে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করছে সেখানে তার এই জেদি, অবাধ্য, সুশ্রী কিশোরী বউটাকেও চাচ্ছে। সে পুরো প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” শুধু দাদিজানের জন্য নাস্তা বানাতে চেয়েছিলে না? তাহলে এত রুটি বানিয়েছ কেন? দাদিজান এক সপ্তাহেও শেষ করতে পারবে না। ”

স্বর্ণলতা চোখ নামিয়ে ফেলল। মুখটা ম্লান করে জবাব দিল,
” শুধু দাদিজানের জন্য না, সবার জন্যে বানিয়েছিলাম। ”
” তুমি, আমি খেলেও শেষ হবে না। ”
” আমরা ছাড়াও এই বাড়িতে আরও অনেকেই আছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটুক্ষণ মৌন থেকে সুধাল,
” তুমি ঝি-চাকরদের জন্যও রুটি বানিয়েছ? এটার তো অনুমতি ছিল না। ”

স্বর্ণলতা ঝটিতে চোখ তুলল। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,
” আপনি কি রাগ করেছেন? আমি ভেবেছিলাম, আর কখনও যদি নাস্তা বানানোর সুযোগ না পাই? তাই প্রথমবারে সবাইকে খাওয়াতে ইচ্ছে হলো। রানিসাহেবা নিজে নাস্তা বানিয়ে খায়িয়েছে! কথাটা মনে পড়লে কেমন খুশি লাগবে ভাবুন তো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভাবনায় গেল না। কোনো জবাবও দিল না। স্বর্ণলতা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে দৃষ্টি নত করে ফেলল। অপরাধ স্বীকার করে মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” আপনার অনুমতি নেওয়ার দরকার ছিল। ভুল হয়েছে, মাফ করে দিন। ”
” এই ভুলের মাফ তখনই পেয়ে গেছিলে যখন আমি রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম। তারপরে যেই ভুলটা করেছ ঐটার কোনো মাফ নেই। ”
” আমি আর কোনোদিনও রান্নাঘরে ঢুকতে পারব না? ”
” না। ”
” মাঝেমধ্যেও না? আপনার জন্য যদি কখনও রান্না করতে ইচ্ছে করে? ”
” তখনও না। ”

স্বর্ণলতার চোখ ছলছল করে ওঠল। মলম লাগানোর পরেও যে যন্ত্রণাটা বিন্দুমাত্র কমেনি, সেই যন্ত্রণা এতক্ষণ সহ্য করে লাভ কী হলো? শাস্তি পেল ঠিকই। সেইসাথে সকলকে নাস্তা খাওয়াবে বলে যে কসরত করল সেটাও জলে ভাসল।

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর অপ্রকাশিত দুঃখ বুঝে গেল টলমল চোখদুটিতে চেয়ে। বাঁধ ভেঙে গাল ভিজিয়ে দেওয়ার পূর্বে জানাল,
” এই সংসারে পরিপূর্ণভাবে ফিরে আসার পরে একদিন ঢুকতে দিব। যত জনকে চাও, নাস্তা খায়িও। ইচ্ছেমতো রুটি বানিও। কিন্তু ভাজব আমি। তুমি আশেপাশেও থাকতে পারবে না। ”

কথাটা শোনামাত্র স্বর্ণলতার চোখদুটিতে বিস্ময় ঝলকে ওঠল। দুঃখ ও আফসোসের মিশ্রিত অশ্রুকণা শুকিয়ে গেল নিমিষে। বড় বড় চোখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে সহসা বলল,
” তখন তো চাঁদনিবুর আব্বা হাসপাতালে থাকবে না। উনাকে দেখতে নিশ্চয় অনেকে ছুটে এসেছে? এই অবস্থায় কি কারও খাবারে মন বসে? কেউ একজন রেঁধে-বেড়ে দিলে অল্প কিছু হলেও খাওয়ানো যায়। আমি ওখানেও নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ”

হঠাৎ চাঁদনির প্রসঙ্গ আসায় মুনছুর কিছুটা বিরক্ত হলো। মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে কাট স্বরে জানাল,
” কেউ খবর পেলে তো আসবে! ওদের তেমন কোনো আত্মীয়ও নেই। ”
” চাঁদনিবুকেও খবর দেন নাই? ”
” না। ”

স্বর্ণলতা হায় হায় করে ওঠল,
” আল্লাহ! কী বলেন? একমাত্র মেয়ে এই অবস্থায় পাশে থাকবে না? যদি সত্যি খারাপ কিছু ঘটে যায়? বাবা-মেয়ে কেউ কাউকে দেখবে না? কত বছর ধরে দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই, ভাবেন তো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাববে কি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন বিরক্ত ছাড়িয়ে অন্য কিছু অনুভব করছে। না চাইতেও সেদিনের গাড়ি দুর্ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে কি? মৃত্যুভয়! তার স্পষ্ট মনে আছে, ঐ মুহূর্তে সে মনেপ্রাণে ধরে নিয়েছিল, মৃত্যুবরণ হবে তার। ঠিক তখনই স্বর্ণলতা আর দাদিজানের মুখটা মনে পড়ে গেল। হৃদয় মাঝে বসবাসরত এই দুজন নারীর জন্য সে পাকাপোক্তভাবে কিছুই করে যেতে পারছে না। কতটা অসহায় হয়ে পড়বে অনুমানও করতে পারছিল না!

স্বর্ণলতা তাগাদা দিয়ে ওঠল,
” কাজটা ঠিক করেন নাই। এখনই চাঁদনিবুকে কল দিয়ে সবটা জানান। ”
” পারব না। ”
” আপনি এমন কেন? ”
” পাষণ্ড? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” পাগল। যেটা ধরেন, ঐটা ছাড়া আর কিছু বুঝেন না! ”

স্বর্ণলতা স্বামীর মোবাইলটা খুঁজে এনে বলল,
” নাম্বার বের করে দেন। আমিই জানাচ্ছি। ”
” ওর নাম্বার নেই। ”
” দাদিজানের কাছে আছে। দাঁড়ান নিয়ে আসি। ”

সে উঠতেও চেয়েও পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত বাঁধা দিয়ে বলল,
” কোথাও যাবে না। চুপচাপ বসে থাকো। আমি দাদিজানের মোবাইল নিয়ে আসছি। ”

______
সকালের নাস্তা শেষ করে স্বর্ণলতা বলল,
” চলেন, আমরাও হাসপাতালে যাই। অসুস্থ মানুষকে দেখতে গেলে আল্লাহ খুশি হয়। চাঁদনিবুর আব্বার ঐ অবস্থার সাথে আপনিও জড়িত। ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যেভাবেই ঘটুক, আপনার হাতেই তো ঘটেছে। ”
” সেজন্যই হাসপাতালের বিল ভরছি। ”
” শুধু বিল পরিশোধ করলে হবে না। আপনি কত ভয় পেয়েছিলেন মনে আছে? সামনে থেকে যদি দেখেন, সুস্থ আছে তাহলে বুকের ভারটা আরও কমবে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাসপাতালে যেতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। উল্টো তার পড়ার সময় নষ্ট হবে এই ওজুহাত দেখাচ্ছিল। স্বর্ণলতা সেই ওজুহাত ঠেলে জোরপূর্বক স্বামীকে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

______
জেলা হাসপাতালে পৌঁছাতে প্রথমে দেখা হলো বেহালার সাথে। অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎে দুজনে যেমন চমকাল তেমন খুশিও হলো। মুনছুর সাখাওয়াতের সামনে একে-অপরকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। খানিক কথা-বার্তা হতে জানতে পারল, বেহালা এসেছে ভাবির সাথে। প্রীতুল সন্তানসম্ভবা। প্রথমবার মা হচ্ছে! শারীরিক নানা পরিবর্তনে সে এখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। খুব দুর্বল ও ভয়ে আছে। তাই ডাক্তার আল হাদি ডাক্তারি কাজে আসার সময়ে বউয়ের সাথে বোনকেও এনেছে। ফেরত যাওয়ার সময়ে একা যেতে হবে না। কেউ একজন পাশে থাকল।

কিছু মিনিট পেরুতে প্রীতুলের সাথেও দেখা হলো। স্বর্ণলতার প্রথমে চোখ পড়ল তার স্ফীত পেটের ওপরে। ঠিক এরকম অবস্থাতে একদিন দেখা হয়েছিল নিলুর সাথে। স্বামী-স্ত্রীর আদর-সোহাগ নিয়ে নানান কথা হয়েছিল। তারপর থেকে মুনছুর সাখাওয়াতের প্রতি অদ্ভুত ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে। এরপরের ঘটনাগুলো মনে করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল বেহালাদের বাড়িতে। ডাক্তার হাদির সাথে শেষ দেখা ছিল। বউটা খুব বকছিল, জিনিসপত্রও ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল। কী নিয়ে যেন বকাঝকা করছিল? মস্তিষ্কে একটু চাপ পড়তে মনে পড়ে গেল আসল কারণটা। সাথে সাথে অজান্তেই আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আদর করলেই কি পেটে বাবু চলে আসে? নিলুর এলো, প্রীতুলবুর এলো। তাহলে কি এখন তার পেটেও বাবু আসবে? ‘ সে চকিতে ঘাড় ফিরে তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও বউয়ের দিকেই চেয়েছিল। চোখাচোখি হতে বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করতে স্বর্ণলতা মাথা নাড়ল। বান্ধুবীর থেকে বিদায় নিয়ে সে স্বামীর কাছে চলে গেল। দোতলায় উঠতে দেখা গেল চাঁদনিকে। তাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছে। সে সামনে এগিয়ে যাবে তখনই মুনছুর সাখাওয়াত হাত চেপে ধরল। একপাশে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তখন থেকে দেখছি সমানে ঠোঁট কামড়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে চাও? ”

স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য হলো। মানুষটা তার এই বদঅভ্যাসের কারণটা এখনও মনে রেখেছে? মুনছুর সাখাওয়াত এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে পুনরায় সুধাল,
” গোপন কিছু? খালি জায়গা লাগবে? ”

সে ডানপাশের গাইনি বিভাগের চেম্বারটা দেখিয়ে বলল,
” ওখানে চলো। ডাক্তারকে বাইরে বের করে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর হাত ধরে ঐদিকে ছুটে যাচ্ছিল। দরজার কাছে পৌঁছাতে স্বর্ণলতা জোর করে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” অত জরুরি কিছু না যে, ডাক্তারের রোগী দেখায় সমস্যা তৈরি করে বলতে হবে। এমনি একটা ভাবনা মাথায় আসছিল। বাসায় গিয়ে বলব। এখন চলেন, চাঁদনিবুর আব্বাকে দেখে আসি। ”
” তাহলে আর একবারও ঠোঁট কামড়াবে না। আমার জিনিসে অযথায় আঘাত করলে আমি সহ্য করব না। ”

______
স্বর্ণলতারা রোগী দেখে বেরিয়ে আসছিল। তখনই চাঁদনি সামনে এসে দাঁড়াল। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে এক ঝলক চেয়ে বলল,
” তোমার বউকে একটু সময়ের জন্য ছাড়বে? আমার একটা কথা বলার ছিল। ”

এই মেয়ের সাথে তার নতুন কোনো ঝামেলা নেই। পুরোনোটাও মিটমাট হয়ে গিয়েছে। তারপরেও কেন জানি সহ্য করতে পারছে না! দৃষ্টিসীমায় এলে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। অসহ্য অনুভূতি ছড়ানো মেয়েটায় কি না তার বউকে চাচ্ছে! একা, আলাদাভাবে। মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর সামনে রাগ দেখাতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বিরক্তটাও লুকাতে পারল না। কঠোর গলায় জানাল,
” আমার সামনে বলতে পারলে, বল। নাহলে সামনে থেকে সরে দাঁড়া। এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করতে চাই না। ”

কথার ধরণ ও মুখভঙ্গিতে চাঁদনি বুঝে গেল উগ্রস্বভাবের পুরুষটাকে সে কিছুতেই রাজি করাতে পারবে না। তাই অন্য পন্থা অবলম্বন করল। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে কাতরোক্তি করল,
” এসো না, প্লিজ। মাত্র দুই মিনিট লাগবে। তোমাকে কথাটা বলা খুব জরুরি। হয়তো এটায় আমাদের শেষ দেখা। আজ না বলতে পারলে আর কখনও বলতে পারব না। সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে! ”

স্বর্ণলতার ভারি মায়া হলো। কৌতূহলও উদ্রেক হলো। কী এমন জরুরি কথা যে, বলতে না পারলে জীবনভর আফসোস থেকে যাবে? সে স্বামীর দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মুনছুর সাখাওয়াত সুধাল,
” আমার অবাধ্য হবে? ”
” না। কিন্তু আপনি অনুমতি দিলে আমার ভালো লাগবে। নাহলে সারাদিন মনখারাপ থাকবে। ”

চলবে