মাতৃসওা পর্ব-০২

0
13

মাতৃসওা
#পর্বঃ২
সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

“বউ.. শুনলাম বিয়ান ও না-কি পোয়াতি। তোমার তো সাত মাস চলছে। তোমার মায়ের কয় মাস? দুই মা মেয়ে একসাথেই পেট বাঁধালে।”

চাচি শ্বাশুড়ি’র কথা শুনে শরীরে কা’টা দিলো হাসির। কিছু বলতে পারলো না, লজ্জায়। ততক্ষণাৎ হাসির ননদ “নূপুর” ভাইকে উস্কে দিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো,

” তোর শ্বাশুড়ি পোয়াতি ভাই! ভাই তোর শালা চাই না-কি শালী? তোর শ্বাশুড়ি’র মেয়ে হলে খুশী হবি না-কি ছেলে? ইশ! ভাই তুই কত লাকি রে… বাচ্চা কোলে নেওয়ার বয়সে শা’লা/শা’লী কোলে নিয়ে ঘুরতে পারবি। হাহা…”

পাশের রুমে বসে চা খাচ্ছিলো হাসির হাসবেন্ড, শামীম। বোনের কথা শুনে, চায়ের কাপ সশব্দে ফেলে দিলো ফ্লোরে।
নূপুরের কথায় এক সঙ্গে হেসে উঠলো, হাসির শ্বাশুড়ি, চাচি শ্বাশুড়ি। যা দেখে হাসি এবার শক্ত মুখে বললো,

“পবিত্র একটা জিনিস নিয়ে আপনারা এভাবে বাজে মন্তব্য করছেন? উনাদের ছেলে নেই, তাদের একটা ছেলের আশা থাকতেই পারে।”

তান্মধ্যে, শামীম এসে হাসি’র গালে এক থা’প্প’ড় দিয়ে ক্রোধিত কণ্ঠে বললো,

“তুমি তোমার মায়ের সাফাই করছো হাসি? তাদের কোনো আক্কেল নাই? ছি! ছি! আমি ভাবতেই পারছি না। আমাদের একটা রেপুটেশন আছে হাসি, লোকজন এটা কিভাবে নিবে ভাবছো? শ্বশুর-শ্বাশুড়ি’র জন্য এভাবে হেনেস্তা হতে পারবো না আমি। শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষিতের মতো একটা কাজ… তুমি কিছু একটা ব্যাবস্হা করতে বলো তাদের। নয়তো, তোমার কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম!”

শামীম ক্রোধ নিয়েই জায়গা ত্যাগ করলো।
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসি। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে তার। এরিমধ্যে আগুনে ঘি ঢালার মতো শাহনাজ পারভীন কল দিয়েছে মেয়ে’কে । মূলত এ ব্যাপারে কথা বলতে, মেয়ে যেন তার বাবা’কে বুঝায়। কেননা, বড় মেয়ের কথা ফেলতে পারে না শাফায়াত। প্রথম কন্যার প্রতি আলাদা একটা টান রয়েছে বাবার।
মায়ের কল পেয়ে হাসি একরাশ রাগ নিয়ে কল রিসিভ করলো। কোনো বণিতা ছাড়াই বলে উঠলো,

“কেনো কল দিয়েছো আম্মা? এটা কি খুব দরকার ছিলো এখন… তুমি আমার সংসারে অশান্তি’র কারণ হলে আম্মা। তোমার জন্য আজ শামীম আমার গায়ে হাত তুলছে।”

মেয়ের কথা শুনে কেঁপে উঠলো মায়ের হৃদপিন্ড। বিনাবাক্যে কল কে’টে দিলো উনি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লোনাজল। পেটের উপর হাত রেখে বিড়বিড় করে কয়েকটি বাক্য আওড়াল,

“এ কোনো শিক্ষা? এ কোন শিক্ষিত সমাজ? যে শিক্ষিত সমাজ পবিত্র জিনিস, নিষ্পাপ একটা জীবন বি’না’শ করতে ম’রি’য়া হয়ে উঠেছে। নি’ষ্পা’প একটা প্রাণের আগমনে না-কি রেপুটেশন নষ্ট হয় শিক্ষিত সমাজের। গোপনে অ্যা’ব’র’শ’ন করিয়ে একটা বাড়ন্ত প্রাণ’কে ডাস্টবিনে ফেলতে সায় দেয় এই শিক্ষিত সমাজ।
আচ্ছা, এতটা শিক্ষত, এতোটা আধুনিক হওয়া কি খুব দরকার ছিলো আমাদের? যে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে মাতৃত্বের মতো একটা পবিত্র জিনিস’কে অপবিত্র করে মানুষ, এটা নিয়ে হাসাহাসি করে। এই আধুনিকতা কি খুব দরকার ছিলো আমাদের?

বড় মেয়ের কথা আবছা কানে এসেছে বাবার। যে ভয়টা পেয়েছিলো শাফায়াত। চিন্তায় ঘাম জমেছে কপালে তার। না জানি এই খবর শুনে ছোট মেয়ের পাকাপোক্ত বিয়েটা ভে’ঙে যায়। উনি স্ত্রীকে শান্ত ভাবে বুঝাচ্ছে। আজ আর বাহিরে গেলো না।

শাহনাজ পারভীন নির্বাক!নির্জীব! সবাই এমন ভাবে বিষয়’টাকে নিচ্ছে মনে হচ্ছে, “গর্ভধারণ” এটা তার কোনো বড় পাপের ফল। অথচ এই মানুষ গুলোর উচিত ছিলো তাকে সাপোর্ট করা। কিন্তু উল্টো এই সভ্য সমাজ তাকে নিয়ে নোং’রা’মি আলোচনা করছে।

এদের দাপটের কাছে হেরো গেলো শাহনাজ পারভীন। স্বামী, মেয়েরা রিতীমত অ্যা’ব’র’শ’নের জন্য হুমকি দিচ্ছে তাকে। শরীরের কন্ডিশন তার অপরিপক্ক, বাঁচা মরার রিস্ক রয়েছে।এটা যেনোও মৃ’ত্যু’র মুখে যেতে বাধ্য হচ্ছে শাহনাজ পারভীন। তাকে বাধ্য করছে, তার স্বামী, তার আপনজন, এই শিক্ষিত সমাজ।
.
.
পরদিন সকালে ডক্টরের কাছে শাহনাজ পারভীন’কে নিয়ে এসেছে শাফায়াত চেয়ারম্যান। শাহনাজ পারভীন বারংবার চোখ মুছছে আঁচলে। হাসপাতালের নিকট যতটা এগোচ্ছে ততটা নার্ভাস, বুকে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে তার। একসময় একটা বাচ্চার জন্য কতটা কেঁদেছে রবের দরবারে। সেই কান্নার সাক্ষী নির্ঘুম রাতেরা। যখন রব তাকে পুনরায় সুপ্ত অনুভূতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিলো, সেই অনূভুতিটুকু থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাকে। অনাগতের অস্তিত্বের আগমন যেনেও, তাকে হ’ত্যা করা হবে। শাহনাজ পারভীন হঠাৎ করে কেঁদে উঠলো। রবের কাছে আক্ষেপ নিয়ে বললো,

“ইয়া রব! তুমি যদি দিবেই তাহলে কেনো ওকে আগে দিলে না। অসময়ে এই সুখকর মুহুর্তটা কেনো চির অশান্তি আর দুঃখের কারণ হয়ে পাঠালে আমার নিকটে? আমি কি করবো ইয়া রব! সাহায্য কর রব! আমায় সাহায্য করো!”

এরিমধ্যে যেন গায়বী আওয়াজে দূর থেকে আধোঁ আধো মায়াভরা কণ্ঠে কেউ তাকে ডেকে বলছে,

“মা.. ও মা! তুমি আমায় মে’রো না মা। আমাকে তোমার কাছে আসতে দেও মা। তোমার মায়াভরা মুখটা আমাকে দেখতে দেও মা, তোমাকে ছুঁতে দেও। আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করো না মা, করো না!
ওমা তুমি কাঁদছো? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা।
আমার আগমনে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তা-ই না মা? ওরা.. ওরা তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছে, আমাকে মা’রা’র জন্য তা’ড়া দিচ্ছে। মা… ও মা! ওরা তো নি’ষ্ঠু’র। কিন্তু, কিন্তু তুমি তো মমতাময়ী মা! আমি’তো তোমারই সন্তান মা। আমায় মে’রো না মা! আমাকে তুমি বাঁচাও মা! আমাকে বাঁচাও!”

মাথা চেপে দাঁড়িয়ে পড়লো শাহনাজ পারভীন। তাকে ধরলো শাফায়াত। ভয়ে ভয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে উনি অস্পষ্ট স্বরে বললো,

“আমি যাবো না, যাবো না। ও… ও আমায় ডাকছে, মা বলে ডাকছে। আমি যাবো না। ”

শাফায়াত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্ত্রী’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “পাগলামি করো না নাজ।”

এক প্রকার জোর করেই শাহনাজ পারভীন’কে ডক্টরের চেম্বারে নিয়ে এসেছে শাফায়াত।
ডক্টর অথৈ পুনরায় মনযোগ দিয়ে রিপোর্ট দেখে শাফায়াত চেয়ারম্যান’কে বললো,

“অর্ধ বয়স্কে এসে গ’র্ভ ধারণের থেকেও গ’র্ভ’পা’ত করা ভীষণ ঝুকিপূর্ণ মিস্টার শাফায়াত। এতে আপনার স্ত্রী’র লাইফ সংশয়ে রয়েছে। আপনারা কি ভেবে চিন্তে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”

“জ্বি ম্যাডাম। কিচ্ছু করার নেই আমাদের। অ্যা’ব’র’শ’ন’টা করানোটা খুব জরুরী। আপনি ব্যবস্হা করুণ। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”

শাহনাজ পারভীন শক্ত মুখে বসে আছেন। স্বামী’র দিকে একবার চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তার জীবনের চেয়েও এদের রেপুটেশন, সমাজ কি বললো তাদের চিন্তা, এসব বেশি জরুরী। হাহ্!

উনি শেষ বার পেটে হাত বুলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

“তুই মা’কে ক্ষমা করে দিস। তোকে আমি বাঁচাতে পারলাম না রে সোনা। এই পৃথিবীর নিয়ম বড় অদ্ভুত। ”

কিছুক্ষণের মধ্যে ডক্টর কিছু ফর্মালিটি পূরণ করে উনাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। এর আগে অবশ্য শাফায়াত অনেকবার কথা বলতে চেয়েছেন স্ত্রী’র সাথে। কিন্তু শাহনাজ পারভীন ছিলেন নিশ্চুপ। হসপিটালে এসে আর একটা কথাও বলেনি তিনি।

সবার প্রতি এক রাশ অভিমান, অভিযোগ নিয়ে ওই যে ভিতরে গেলেন,চোখ বন্ধ করলেন, এরপর আর চোখ খুলেনি উনি। হসপিটালে থাকা অবস্থায়ই দু’দিন পর মা’রা গেলেন শাহনাজ পারভীন। ডক্টর মৃ’ত্যু’র কারণ হিসেবে চিন্হিত করেছেন, অতিরিক্ত র’ক্ত’ক্ষ’রণ আর দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তার ফলে, হা’র্ট অ্যা’টা’ক করে ছিলেন।

মায়ের মৃ’ত্যু’তে গলা ফা’টি’য়ে কাঁদছে মেয়েরা। স্বামী, আত্মীয়দের চোখ থেকেও পড়ছে দু’ফোঁটা জল। কি অদ্ভুত! এরা কেনো কাঁদছে? একটা মানুষকে খু’ন করে খু’নী গুলো কেনন কাঁদছে। এমন আশ্চর্য নিয়ম পৃথিবীতে! ছি!

মৃ’ত্যু হয়েও যেন শান্তি নেই সদ্য মা’রা যাওয়া মহিলার। এরপর ও থেমে নেই এই সমাজের একদল লোক।

“বুড়ো বয়সে বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়ে ম’রে’ছে চেয়ারম্যানের বউ।”

মৃ’ত্যু মানুষটাকে নিয়ে এসব কানাকানি করতেও ভুলছে না পরশীরা।

চলবে…..