#মায়াতলীর_মোড়ে
|০২| [কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
লাবিবা ওয়াহিদ
কথা ছিল শোকে জর্জরিত হয়ে মাহারিন সারা দিন মুখে কিছু তুলবে না। কিন্তু সে খাওয়া বন্ধ করলো না। উলটো নিজ হাতে সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না করল। বিরিয়ানি রান্না অবধি থেমে থাকেনি সে। চাচীর বাড়ি থেকে বাকিদের দাওয়াত দিয়ে আনিয়ে সবাইকে নিজ থেকে খাবার সার্ভ করল। নিজেও বসে সবার সাথে মিলে খেতে শুরু করে সে। মোরশেদ সাহেব রাতে দ্রুতই ফিরেছিলেন থানা থেকে। তাই মাহারিনের এই রান্না-বান্না মিস দিতে হয়নি। খাবার টেবিলেও রান্নার সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করলেন মোরশেদ সাহেব। কথায় কথায় বলছেন, “আমার মেয়ের রান্নার হাত কত ভালো। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করলে মন্দ হতো না।”
মাহারিন অধরে এক চিলতে হাসি নিয়ে বিরিয়ানির লোকমা তুলছে মুখে। সবাই ভাবছে মাহারিন বেশ খুশি তার বিয়ে নিয়ে। কিন্তু আয়েশা বেগমের মোটেও এরকম কিছু মনে হলো না। বরঞ্চ এই মুহূর্তে বাপ-মেয়ে দুজনকেই পাগল লাগছে তার কাছে। তিনি খাচ্ছেন কম বাপ-মেয়ের অঙ্গি-ভঙ্গি দেখছেন বেশি। তাদের দুজনকে নিয়ে এত বছর যাবৎ সংসার করছেন কি না। আগে এক পাগলের সংসার করেছেন এখন দুই পাগল নিয়ে সংসার করছেন। আয়েশা বেগমকে এবার দুশ্চিন্তা জেঁকে ধরেছে। মেয়েটা কী করতে চলেছে আল্লাহ ভালো জানে। তীব্র ঝড় আসার আগ মুহূর্তে যেমন প্রকৃতি নীরব, ঠান্ডা থাকে এখনকার পরিস্থিতিও যেন তাই। উপরওয়ালা কী রেখেছেন কপালে কে জানে?
খাওয়া-দাওয়ার পর বর্ষা এবং তুলি আসলো মাহারিনের ঘরে। মাহারিন তখন ওয়াশরুম থেকে মুখ ধুঁয়ে বেরিয়েছে। মাহারিনের চাচাতো বোন ওরা। বর্ষা এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং তুলি পড়ছে সবে ক্লাস টেনে। ছোটো হলেও এরা ভীষণ ধূর্ত এবং দুনিয়ার সমস্ত আজেবাজে ভাবনা তাদের জ্ঞানের পাল্লায় বেশি। তুলি তো সুখের ঢেঁকুর তুলে মাহারিনের উদ্দেশে বলল,
–“আপু, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বিয়ে করতে রাজি না। অথচ তুমি বিয়ে উপলক্ষ্যে এত সুন্দর ট্রিট দিলে! তুমি জানো আজ আমার কত বিরিয়ানি খাওয়ার ক্রেভিংস হচ্ছিল?”
বর্ষাও পরপর বলল, “হ্যাঁ, তুলি ঠিক বলেছে। এর জন্যে তো আপুকে গিফট দেওয়া চাই। যাও আপু, তোমাকে হাত ভাঙা দুলাভাইয়ের নাম্বার এনে দিব।”
মাহারিন তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
–“এত কষ্ট করতে হবে না তোদের। আমি নিজেই নাম্বার আনতে যাচ্ছি বাবার কাছে।”
বর্ষা, তুলি দুজনেই চমকে যায় মাহারিনের এ কথা শুনে। কখনো শুনেনি মেয়েরা হবু বরের নাম্বার চাইতে যায় নিজের বাবার কাছে। সেখানে মাহারিন তো মোরশেদ সাহেবকে ভয় পায়, তাঁকে মেনে চলে। বর্ষা অস্ফুট স্বরে বলল,
–“তুমি না জেঠাকে ভয় পাও আপু।”
মাহারিন ওড়নাটা মাথায় নিয়ে চাইল বোনদের দিকে। মাহারিনের চোখ-মুখ এবার ভালো ঠেকছে না। চোখে কেমন চাপা ক্রোধ জমে আছে তার। মাহারিন বলল,
–“এবার ভয়ের দেয়াল নড়বড়ে। অতি শীঘ্রই ভাঙবে।”
বর্ষা মাহারিনকে তেমন ঘাটতে পারল না। এর আগেই তাদের মা এসে বাসায় ফেরার তাড়া দিলো। অগত্যা, দুই বোন মায়ের সঙ্গে বাসায় ফিরে গেল। মোরশেদ সাহেবরা দুই ভাই দুই বোন। দুই ভাই নিজেদের বাড়িতে দুই ফ্লোর মিলে থাকেন। বর্ষাদের ফ্ল্যাট চারতলায় আর মাহারিনরা তিনতলায়। এছাড়া এই সাত তলার বাকি সব ফ্লোর ভাড়ায় দেওয়া।
বর্ষারা চলে যাওয়ার পর মাহারিন বাবাদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা খোলাই ছিল। ঘরের এক পাশে বসে মোরশেদ সাহেব কেসের ফাইল ঘাটছিলেন আর আয়েশা বেগম বিছানা ঠিক করছিলেন। মাহারিন দরজায় নক করতেই দুজন নিজেদের ব্যস্ততা ছেড়ে দরজার দিকে তাকাল। মাহারিন সহসা মায়ের উদ্দেশে বলল,
–“তাহমিদ সাহেবের নাম্বারটা পাওয়া যাবে আম্মু?”
আয়েশা বেগম অল্প নয়, বরং অনেকটা চমকালেন মেয়ের কথা শুনে। চমকে কিছু বলতে চাইলে মোরশেদ সাহেব খুশি খুশি নিজের মোবাইলটা হাতে তুলে বললেন,
–“নাম্বারটা মেসেজ করে দিচ্ছি তোমাকে।”
মাহারিন অধর প্রসারিত করে হাসল। অতঃপর নিজের রুমের দিকে চলে যায়। যতই নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে ততই মাহারিনের হাসি-খুশি মুখমন্ডলের পরিবর্তন শুরু হতে লাগল। শেষমেষ হাসি-খুশি মুখখানায় এখন রাগ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে।
মাহারিন দরজাটা আটকালো অত্যন্ত জোরে। সেই শব্দ মোরশেদ সাহেবের ঘর অবধি পৌঁছে যায়। আয়েশা বেগম এতে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু মোরশেদ সাহেব অধর হেলিয়ে হাসলেন। আয়েশা বেগম এবার বললেন,
–“বাপ-মেয়ে মিলে কী শুরু করেছেন আপনারা? বিয়ে নিয়ে মেয়ে এমন করছে কেন? ছেলে তো ভালোই!”
মোরশেদ সাহেব ফাইলে চোখ বুলিয়ে হেসে বললেন, “এটা আমার এবং আমার মেয়ের পার্সোনাল ম্যাটার আয়েশা। মাহারিনকে যা খুশি করতে দাও।”
আয়েশা বেগম এবার চটে গেলেন। বিছানায় সোজা শুয়ে পড়ে মিনমিন করে বললেন, “আপনারা যা খুশি করেন। আমার কী?”
তাহমিদকে মাহারিন কল করল। রিং হতে হতে আপনা-আপনি কেটে যাচ্ছে। কী ব্যাপার? মাহারিনের ভ্রু কুচকে যায়। কল ধরছে না কেন? পরপর আরও দু’বার কল করল মাহারিন। ওপাশ থেকে তাও কোনো সাড়া পায়নি সে। মাহারিনের চট করে মনে পড়ল হাত ভাঙার কথা। নিশ্চয়ই ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। তবুও মাহারিনের কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোক তাকে ইগনোর করছে। এই লোককে মাহারিন বিয়ে করবে না বলেছে, তাও কেন বিয়ে করার জন্য এতটা উঠে পড়ে লেগেছে? সমস্যা কী তার? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই মাহারিনের।
মাহারিন কিছুতেই নিজের রাগ সামলাতে পারছে না। একসময় মাহারিনও বাবার সঙ্গে এই অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার পণ করল। সে নিজেকে জিতে দেখাবেই। যতই ধাক্কা আসুক। বালিশের কাছে ফোনটা ফেলে মাহারিন ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমটা ভাঙল একদম কাকভোরে। চোখ বন্ধ অবস্থায় মাহারিনের ভ্রু কুচকে গেল। ফোনের অসহ্যকর রিংটোন। মাহারিন এপাশ ওপাশ করলো কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারল না রিংটোনের শব্দে। উপায় না পেয়ে ফোন কানে দিলো সে। নাম্বারটা পরখ করেই বুঝেছে ঘুম নষ্ট করার কারণ তাহমিদ। বিরক্তিকর এবং ঘুমে ভাসা গলায় বলল,
–“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে তাহমিদের উত্তর এলো,
–“রাতে এতবার কল দিলেন? ইমার্জেন্সি কিছু?”
মাহারিন কপাল কুচকানো অবস্থায় চাপা স্বরে বলল, “না।”
–“আম এক্সট্রেমলি সরি, রাতে মেডিসিন নেওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”
মাহারিন তখনো ঘুমের ঘোরে। বলল,
–“সরি, টরি বলার জন্য এই অসময়ে কল দিয়েছেন?”
তাহমিদ কিছুটা নীরব থেকে বলল,
–“ঘুম পুরোপুরি হলে কল কিংবা টেক্সট করবেন।”
মাহারিন হু হা কিছু বলেই ফোন বালিশের পাশে রেখে দেয়। তাহমিদ মিনিট এক মাহারিনের উত্তরের অপেক্ষা করে কল কেটে দেয়।
মাহারিন ঘুম থেকে উঠল বেলা এগারোটায়। সচরাচর সে এত বেলা করে ঘুমোয় না। তবে আজ কেন যেন ঘুমালো। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকলে যেন ঘুম চোখ ছাড়তে চায় না। মাহারিন ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখল মা বসে টিভি দেখছেন। বাবা নেই, হয়তো থানায় চলে গিয়েছে। ফ্রিজ খুলতেই চট করেই তাহমিদের কথা মনে পড়ল। সে ফ্রিজ বন্ধ করে আবারও রুমের দিকে ছুট দিল।
তাহমিদকে কল করল সে। তাহমিদের কাছেই বোধ হয় ফোন ছিল। তাহমিদ কল রিসিভ করে বলল,
–“ঘুম ভেঙেছে?”
মাহারিন বলল, “হুঁ। তবে আমি আপনাকে কিছু একটা বলেছিলাম সেদিন।”
তাহমিদ মনে করার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ, কিছু তো বলতে নিচ্ছিলেন তখনই আমার কল এসেছিল। পরবর্তীকে জিজ্ঞেস করারও সময় হয়নি।”
মাহারিন হতভম্ভ হয়ে পড়ে তাহমিদের মুখে এ কথা শুনে। তাহমিদ তাহলে মাহারিনের সেই গুছানো এক বাক্য শুনেইনি? অথচ মাহারিন কতটা স্বস্তিতে ছিল এই ভেবে যে তাহমিদ বিয়ের জন্য না করে দিবে। গতকাল রাগও হচ্ছিল এই ভেবে যে তাহমিদ সব জেনেও বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে। মাহারিনের ধ্যান ভাঙে তাহমিদের কথায়।
–“মাহারিন? আর ইউ ওকে?”
মাহারিন অতি দ্রুত সামলে নিলো নিজেকে।
–“হ্যাঁ বলুন।”
–“বলবেন তো আপনি। কী বলতে নিচ্ছিলেন সেদিন?”
তাহমিদকে বেশ ঠান্ডা স্বভাবের মনে হলো মাহারিনের। তাই ভাবল তাহমিদকে কাটিয়ে দেওয়া সহজ হবে। সবকিছু ভেবে-চিন্তে মাহারিন বলল,
–“আজ লাঞ্চে দেখা করবেন আমার সাথে? কোনো রেস্টুরেন্টে?”
–“শিওর। বিয়ের আগে দেখা তো এমনিতেও করতাম আমি। ভাগ্যিস আপনি আগে বললেন।”
মাহারিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয় তাহমিদের এ কথা শুনে। সে কী বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলছে? মুহূর্তেই সেসব চিন্তা উপড়ে ফেলল সে। কেনই বা বলবে না? হাতে যে সময় নেই। দুজন মিলে রেস্টুরেন্ট সিলেক্ট করে একটি নির্দিষ্ট সময়ও ঠিক করে ফেলল। মাহারিন তখনই তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায়। নাস্তাটাও আর বাসায় করেনি। এ নিয়ে আয়েশা বেগম চেঁচামেঁচিও করলেন,
–“এই নবাবের বেটি! এত খেটে রুটি, ভাঁজি বানালাম। সেসব মুখে না তুলে নির্লজ্জের মতো বেরিয়ে যাচ্ছিস কেন? খেয়ে যা! শুধু শুধু রুটি গুলো যে নষ্ট হবে। মাহারিন!”
মাহারিনের কান পর্যন্ত আর পৌঁছালো না সেসব কথা। এদিকে আয়েশা বেগম ঘরে বসে ফুঁসে গেল।
মাহারিন ইচ্ছে করেই লেট করে পৌঁছায় নির্ধারিত রেস্টুরেন্টের সামনে। ইচ্ছে ছিল তাহমিদকে শিক্ষা দিবে। বোঝাবে এরকম দেরী করা মেয়ে বিয়ে করা তার জন্য কতটা অশান্তির। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে তাহমিদ তখনো আসেনি। মাহারিন বিরক্ত হলো। অপেক্ষা করার কথা ছিল তাহমিদের অথচ অপেক্ষা করছে সে নিজে। মাহারিন বিড়বিড় করে বলল,
–“হাত ভাঙা ডক্টরটা একটুও শান্তি দিচ্ছে না আমায়।”
মাহারিন ঘনঘন হাতঘড়িতে সময় দেখল। দুপুরের রোদের প্রবল তাপের মতো সময়ও যেন কাটছে না। তাহমিদ আসল দশ মিনিট পর। সিএনজিতে করে। ভাড়া মিটিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে মুহূর্তেই মাহারিনের সামনে এলো। মাহারিন প্রথম দিনের মতো সেজে নেই। এজন্যই হয়তো রোদের তাপে গালের লালাভ বর্ণ একটু বেশিই চোখে লাগছে। তাহমিদ ব্যস্ত গলায় বলল,
–“দুঃখিত। একটু হসপিটাল গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ফিরতেই দেরী হয়ে গেছে।”
হসপিটালের কথা শুনে মাহারিন কিছুটা দমে যায়। তাই বিরক্তি প্রকাশ না করে মিনমিন করে বলল,
–“ইট’স ওকে।”
তাহমিদকে পাঞ্জাবির পর আজ ফর্মাল শার্টে দেখল মাহারিন। সাদা শার্ট, ইন করা আর কালো প্যান্ট। চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো, তবে বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে তাহমিদের এক হাত ঝুলে আছে। এই হাত ঝুলে থাকাটা যেন একদমই মানাচ্ছে না তাহমিদকে। মাহারিনের খুব করে জানতে ইচ্ছে করে তাহমিদের হাত কী করে ভাঙল? তবে কী ভেবে আর জিজ্ঞেস করা হয় না।
মাহারিন সেসব ভুলে তাহমিদের সাথে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। নিজেদের পছন্দসই এক টেবিলে গিয়ে বসল। তাহমিদ মাহারিনকে জিজ্ঞেস করল,
–“কী খাবেন? চা নাকি কফি?”
রেস্টুরেন্টে এসে তাহমিদ চা-কফি সাধছে, তাও লাঞ্চের সময়ে। মাহারিন কী বলবে খুঁজে পেল না। তাহমিদ যেন মাহারিনের মুখ দেখেই বুঝে ফেলল সবটা। তাহমিদ অধর বাঁকিয়ে হেসে বলল,
–“আচ্ছা, ঠিক আছে। মেন্যু দেখে কী খাবেন বলুন। আজ আপনার পছন্দতেই লাঞ্চ করব।”
মাহারিন তাহমিদের পছন্দের তোয়াক্কা করল না। সে মেন্যু দেখে নিজের পছন্দসই খাবার অর্ডার করল। তাহমিদ মাহারিনের পছন্দকেই গুরুত্ব দিল। তাহমিদের সামনে পড়ে মাহারিন তার সাজানো গুছানো কথা হারিয়ে ফেলেছে। কী থেকে কী করবে বুঝে পেল না। তাই কথা শুরু করতে বলল,
–“হাত ভাঙা অবস্থায় হসপিটাল গিয়েছেন যে? ছুটি নেননি?”
তাহমিদ একপলক মাহারিনের দিকে চেয়ে নজর সরিয়ে বলল, “পেশেন্ট ছিল।”
মাহারিন আন্দাজে বলল,
–“আপনি কী নিউরোলজিস্ট?”
তাহমিদ হেসে বলল, “নাহ। অর্থোপিডিক্স।”
মাহারিন চট করে ধরতে পারল না। কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে অবাক হলো। হাড়ের ডাক্তার কি না নিজেই হাত ভেঙে বসে আছে? এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!
মাহারিন এসেছিল বিয়ে ভাঙতে, অথচ সে এখন তাহমিদের পেশা এবং ভাঙা হাত নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। খাবার আসতেই তার হুঁশ ফিরে। এক চামচ খাবার মুখে তুলে মাহারিন বলল,
–“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।”
তাহমিদও খাচ্ছিল। মাহারিনের কথা শুনে খাবার গলায় আটকাতে আটকাতে বেঁচেছে। চট করে তাকাল সে মাহারিনের দিকে। মাহারিন তখন খেতে ব্যস্ত। কী নির্দ্বিধায় কথাটা বলেছে সে, আসলেই মেয়েটার মধ্যে দম আছে। তাহমিদ পানিটা খেয়ে বলল,
–“আমার ভাঙা হাত নিয়ে কোনো অভিযোগ?”
মাহারিন চোখ তুলে তাকাল তাহমিদের দিকে। পরপর বলল,
–“না, মুড নেই আপনাকে বিয়ে করার।”
হাসে তাহমিদ, এ কথা শুনে। বলল,
–“কিন্তু আমার আপনাকে বিয়ে করার খুব মুড আছে।”
মাহারিন তার বাম হাতের অনামিকা আঙুল দেখালো। খালি আঙুল দেখিয়ে বলল,
–“আপনার মায়ের দেওয়া আংটিটাও আমি খুলে ফেলেছি। তাই আশা রাখছি আপনি বিয়েটা ভেঙে দিবেন। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। আমার মর্জির বিরুদ্ধে এই বিয়েটা হতে যাচ্ছে।”
তাহমিদের মধ্যে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে নিজের মতো করে খেতে খেতে বলল,
–“আচ্ছা, কোনো ব্যাপার না। আংটির নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না, খুলে রাখলেও কোনো অভিযোগ নেই। আর মর্জির বিষয়টা আপনার পরিবারকে গিয়ে বলুন। আমার সাধ্যি আছে তাই আমি আপনাকেই বিয়ে করব, মাহারিন।”
মাহারিন এবার রেগে যায়। লোকটা নিজেকে যতটা শান্ত-শিষ্ট দেখায় তেমন মানুষ সে নন। বরঞ্চ বোঝা গেল ভীষণ ত্যাড়া প্রকৃতির। মাহারিন এবার চটে গিয়ে বলল,
–“আমার মর্জি ছাড়া আপনি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন?”
তাহমিদ খাবার গিলে মাহারিনের রাগী মুখটার দিকে তাকাল। ঘাড় কিছুটা কাত করে নড়েচড়ে বলল, “কেন নয়? বয়ফ্রেন্ড আছে?”
মাহারিন মুখ ফসকে বলে ফেলল, “না।”
–“তবে? অন্য কোনো কারণ? প্লিজ ভাঙা হাতের অযুহাত দিবেন না। আপনাকে দেখতে যাওয়ার আগেরদিনই হাত ভেঙেছে। বেশিদিন এমনিতেও নেই প্লাস্টার খোলার।”
মাহারিন চোখ রাঙিয়ে বলল, “আমার আপনাকে পছন্দ না।”
–“হয়ে যাবে পছন্দ। আর?”
মাহারিন কিছু বলল না এবার। ফুঁসতে ফুঁসতে নীরবে খাওয়া পুরোটা শেষ করল। তাহমিদও মাহারিনের খাওয়া দেখতে দেখতে খেলো। মাহারিন যতই রেগে থাকুক না কেন খাবারের উপর কখনোই রাগ দেখায় না। এজন্য অসহ্য লোকটার সামনে বসা সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে খাবারটা সেরে ফেলল। তাহমিদ মানি ব্যাগ বের করার আগেই মাহারিন খাবারের বিল দিয়ে দেয়। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উঠল। অতঃপর বলল,
–“আপনাকে আমি বিয়ে করব না, এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন। আসছি।”
©লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—