#মায়াতলীর_মোড়ে – ১৫ (১)
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
মাহারিন পিটপিট করে চোখ মেলতেই দেখল দুজন তাহমিদ তার দিকে চেয়ে আছে। মাহারিন ভয় পেয়ে ছিটকে উঠে বসে, পরপর পেছনে যেতেই বিছানার নরম বোর্ডটা পিঠে ঠেকল। উপস্থিত সকলেই মাহারিনকে নিয়ে চিন্তিত। এই চিন্তায় জর্জরিত পরিবেশে আচমকা একজন তাহমিদ হো হো করে হেসে দেয়। তার হাসি দেখে বোকা বনে যায় মাহারিন। এতক্ষণে ভালো করে চাইলো সে। তাহমিদের চেহারার দুজন পাশাপাশি, একজন হাত ভাঙা অবস্থায় দাঁড়ানো এবং আরেকজন হুইলচেয়ারে বসা। বর্তমানে হুইলচেয়ারে বসা ছেলেটাই ঘর কাঁপিয়ে হাসছে। মাহারিনের মাথা একটু একটু করে খুলছে। অস্ফুট স্বরে আওড়াল,
–“আমি কী ঠিক দেখছি? নাকি আসলেই, জ-মজ?”
কিছুটা দূরের হুইলচেয়ারে বসা ছেলেটা যেন মাহারিনের বিড়বিড়ানি পড়তে পারল। সে বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
–“ভয় পাবেন না ভাবী। আমি আপনার দেবর, কোনো নকল মাস্ক-টাস্ক লাগাইনি। আর আপনার হাসবেন্ড এইযে আমার পাশেই।”
মাহারিন তাকাল তাহমিদের দিকে। তাহমিদ এগিয়ে আসল মাহারিনের দিকে। মাহারিনের পাশে বসে তার কপালে হাত ছুঁয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
–“তুমি ঠিক আছ?”
মাহারিন আলতো করে মাথা নাড়ায়। পারভীন এসমস্ত কাণ্ডে ক্ষেপে গেলেন ছোটো ছেলের প্রতি। তিনি গলা উঁচিয়ে শাসালেন,
–“এটা একদম ফালতু মশকরা ছিল তানভীর। তোকে আমি পইপই করে বারণ করেছি এভাবে হুটহাট ভড়কে দেওয়ার কথা চিন্তা করিস না। এখন হিতে-বিপরীত হলে কী হত? আমার ছেলেগুলা হয়েছে একেকটা পাঠার দল, সবকিছুতে মাতলামি!”
হুইলচেয়ারে বসা তানভীর মায়ের কথা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বলল,
–“মাতলামি নেশা না করে করলেই হবে আম্মা। আর তুমি কী যে বলো না, আমি তো যতটা ভেবেছিলাম ভাবীর রিয়েকশন আরও বেশি জোস ছিল আম্মা। দেখলে না, সোজা সেন্সলেস। হাহাহা!”
পারভীন এসে ছেলের কান টানলেন, শক্ত করে মলে দিলেন। এতে তানভীর কানে হাত দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল,
–“আহ আম্মা। ভাবীর সামনে এগুলা কোনো কাজ? আমি বড়ো হয়েছি না?”
–“বড়ো না ছাই, বুদ্ধি এখনো হাঁটুতেই আটকে আছে। আল্লাহ দিছেন দুইটা অকর্মা ছেলে, একটার হাত ভাঙা আরেকটার পা। দূর হ!”
বলেই পারভীন রেগে-মেগে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মাহারিন এতক্ষণে লক্ষ্য করল তানভীরের ডান পায়ে হাঁটু অবধি লম্বা প্লাস্টার, যার ফলস্বরূপ তার সমস্ত চলাচল এখন হুইলচেয়ারেই। এই দুই ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে মাহারিনের সাথে এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে গেল। বাড়িভর্তি মেহমান আর এদিকে নতুন বউ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে, ছিঃ।
তানভীর কিসব আজেবাজে বকে নিজেই হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে চলে গেল। তার সঙ্গে তাহিয়াসহ তাদের বাকি কাজিনরাও। বেচারাদের মেজাজ খুব একটা ভালো না। এত কষ্ট করে ছাদে সব আয়োজন করল। কারেন্ট টানতে গিয়ে বাড়ির লোডশেডিং হলো তাও ছাদে লাইন টানতে সক্ষম হয়েছিল তারা। এর মাঝে মাহারিন সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায় পুরো বাড়িতে সড়গোল পড়ে যায়। এরপর আর কী, বড়োদের কঠিন নিষেধাজ্ঞায় সবকিছু ক্যান্সেল। এতে তারা মাহারিনকে দোষ দিবে নাকি ভাগ্যকে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তবে সব রাগ গিয়ে পড়ল তানভীরের ওপরই। কী দরকার ছিল এই সময়েই বাইরে আসার? সারপ্রাইজ দেবার জন্য তো পুরো জীবন পড়ে ছিল।
–“ভয় পাইয়ে দিয়েছ তুমি।”
তাহমিদের কথায় মাহারিন রেগে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“এটা আমার বলা উচিত ছিল। আপনার ভাই জমজ সেটা আগে বলেননি কেন?”
–“আমি এসবে নেই, তানভীরের দোষ এখানে। এই বাঁদরটার মাথায় ভালো বুদ্ধি কম, শ*তানি বুদ্ধি বেশি।”
–“সে আপনি নিজেও বিশেষ ভালো মানুষ নন।”
তাহমিদ হাত ধরল মাহারিনের। তার নরম হাতের ছোঁয়ায় মাহারিনের সব রাগ কোথায় যেন উবে গেল। সামান্য হাত ধরলেও বুঝি এমন এলোমেলো অনুভূতি নাড়া দেয়? তাহমিদ খুবই শীতল গলায় বলল,
–“মাহারিন।”
মাহারিন একটা ঘোরের মাঝে থেকে বলল,
–“হুঁ?”
–“বারবিকিউর প্ল্যান তো ক্যান্সেল। নান আর তান্দুরী এনে দিব? এখন খাবে?”
মাহারিন কেমন গলে গলে যাচ্ছে তাহমিদের পুরুষালি মধুময় কণ্ঠস্বরে। তাহমিদের এমন নরম গলা ত সে আগে শোনেনি। এই লোক হয় উচ্ছ্বাসে নয়তো তাকে বিরক্ত করেই গেছে আজীবন। তবে আজ এই ভিন্ন রূপ কেন? মাহারিনের তো এই লোকের থেকে ছিটকে দূরে সরে যাবার কথা, তবে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মিইয়ে যাচ্ছে কেন? লোকটা বুঝি জাদুটোনা জানে?
মাহারিন মিনমিন করে বলল,
–“প্ল্যান ক্যান্সেল হলে চিকেন, নান কই পাবেন?”
–“প্ল্যান ক্যান্সেল হয়েছে, খাওয়া নয়। চিকেন মেরিনেট করে তো সেই কখনই রেখে দিয়েছে, সেগুলো তো আর ফেলে রাখা যায় না।”
মাহারিনের নাকে এতক্ষণে মুরগী পোড়ার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ এসে বিঁধল। যার ফলস্বরূপ এখনই খুদায় পেট মুঁচড়ে ওঠে তার। মুরগীগুলো গ্যাঞ্জাম পার্টিরাই কয়লায় ভেজে নিচ্ছে। খাওয়াকে কখনো না বলতে নেই। তাই মেরিনেট করা মুরগী জলে যাবে তার তো প্রশ্নই ওঠে না।
তাহমিদ অবশ্য আর বসেনি। সে রুম থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরেও আসে। বারবিকিউ পার্টি না হলেও এখন সবাই সবার রুমে রুমে বসে তান্দুরী চিকেনের একেকটা পিছ ঝেড়ে দিচ্ছে। মাহারিনও খেল, তাহমিদের আবদারে তাকেও খাইয়ে দিল।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারতেই মাহারিন তার সবথেকে কাছের বান্ধবী স্পৃহাকেই কল করল। স্পৃহা চমকে যায় রাত এগারোটায় মাহারিনের কল পেয়ে। এই মেয়ে রাত-বিরাতে কল করেছে কেন তাকে? আবার কোন কুবুদ্ধি চেপেছে মাথায়? স্পৃহার ভয় হলো শুরুতে। ভেবে নেয় কল ধরবে না। কিন্তু, স্পৃহা তা পারল না। মিনমিন করে দোয়া পড়ে ফোন রিসিভ করল। কানে ফোন ঠেকিয়ে সাবধান করার ভঙ্গিতে বলল,
–“আগেই রিমাইন্ডার দিচ্ছি, এখন তোর বিয়ে হয়ে গেছে। উলটো পালটা কোনো কথা আমি বরখাস্ত করব না। বিয়ের আগে যা খুশি করেছিস সেসব মাফ। এখন ভুলেও মাফ পাওয়ার আশা করবি না।”
স্পৃহার এক নিঃশ্বাসে বলা কথাগুলো শুনে মাহারিন শুরুতে বোকা বনে গেলেও এবার কিছুটা রাগ হয়। সে কী বলতে কল দিয়েছে আর স্পৃহা তাকে কী বলছে। মেয়েটা আসলেই জামাই, জামাই করে পাগল হয়ে গিয়েছে। মাহারিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমি আপনাকে দাওয়াত দিতে কল দিয়েছি আপু। আগামীকাল রিসিপশন, গিলে যাইয়েন।”
স্পৃহা মাহারিনের রাগ ধরতে পারল। ত্যাড়া উত্তর একটাই প্রমাণ দেয়, কিছু তো হয়েছে। স্পৃহা এবার সন্দিহান গলায় বলল,
–“কী হয়েছে বল।”
মাহারিন এতক্ষণে যেন গলায় আটকে থাকা দম ঝেড়ে ফেলল। পরপর ভীষণ উত্তেজিত গলায় বলল,
–“এখানে বিরাট কাণ্ড ঘটে গেছে।”
–“কী?”
–“তাহমিদ সাহেবের ভাইটা জমজ, একদম হুবুহু ওনার মতোই দেখতে।”
স্পৃহা নিজেও চমকে যায় এ কথা শুনে। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“সে কী? তুই জানতি না?”
–“আমি জানলে তো এখন বলতাম না গর্ধব!” মাহারিনের বিরক্তিকর গলা।
–“আচ্ছা, এরপর?”
মাহারিন সমস্তটা খুলে বলল। স্পৃহা সব শুনে মুখ দিয়ে শুরু “এ কী কাণ্ড”-ই বের হলো। পরপর মাহারিনের সেন্সলেস হওয়ার কথা শুনে বলল,
–” তুই স্মার্ট মেয়ে হয়েও জ্ঞান হারিয়েছিস। আমি তো জন্মগতই ভীতুর ডিম। ভূত, জিন এগুলা শুনতে পারি না দেখা ত দূর। তোর জায়গায় আমি থাকলে নির্ঘাত আল্লাহর প্রিয় হয়ে যেতাম।”
–“আমার রাগের ভারে আরেকজন যুক্ত হলো। হুবুহু চেহারার আরেকজন, যার স্বভাবও পুরো বদমাইশি।”
–“স্বামীকে এসব বলতে নেই।”
–“স্বামী না দেবর।”
–“স্বামীর মতোই” বুঝিয়েছ। এজন্য দুলাভাইকে বলার আগেই সাবধান করে দিলাম।”
–“অ্যাঁই, চুপ! তোর এত জ্ঞান শুনতে আসিনি।”
–“হ্যাঁ তাই তো,
ভালো কথা কেইবা
কানে তুলবে?
পরে অকাজ করে বাঁশ খেলে
আমাকেই মনে পড়বে।”
কবিতার মতো হয়ে গেল লাইনগুলো। তবে তাতে বিশেষ প্রভাব পড়ল না মাহারিনের ওপর। সে ধমকে বলল,
–“শাট আপ স্পৃহা। অহেতুক রাগিয়ে দিস না, অলরেডি কিছুক্ষণ আগের ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারিনি।”
দুই বান্ধবীর কথা বেশিক্ষণ আগায়নি, এর আগেই হুট করে কল কেটে দেয় মাহারিন। তার ভীষণ রাগ লাগছে। বান্ধবী হয় সুখ-দুঃখ ভাগ এবং সাপোর্টের জন্য। অথচ এই মেয়েটা তাকে শুধু খোঁটা দিবে। বিয়ে করে মেয়েটা কুটনী স্বভাব পেয়েছে, কী বিচ্ছিরি পরিবর্তন।
তাহমিদ রুমে আসল। তাকে দেখে মাহারিন নিজের রাগ সামলে নেয়৷ তবে সেই রাগ নেভার কোনো উপায় নেই। তাহমিদ আরও আগুনে ঘি ঢেলে বলল,
–“এই, আমাকে চেঞ্জ হতে হেল্প করো।”
মাহারিনও এক বাক্যে বলে দিল,
–“পারব না।”
–“তুমি না পারলেও আমি তোমাকে তুলতে পারব। সো, ফাস্ট!”
–“হুমকি দিচ্ছেন?”
–“বাঘিনী বউদের হুমকি দিতে হয়, নয়তো অবাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু তুমি ত আমার ভালো বউ, তাই হুমকি নয়— সোজা একশনে যাব।”
©লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~
#মায়াতলীর_মোড়ে
পর্ব ১৫ [দ্বিতীয় অংশ]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
তানভীর ঘড়ির কাঁটা গুণে গুণে তাহমিদের থেকে তিন মিনিটের ছোটো। তানভীর জন্মের পরপরই লাইফ সাপোর্টে ছিল, বাঁচার কোনো সম্ভাবনা ছিল না তার৷ কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহর অশেষ রহমতে তার হায়াত ছিল। সেই হায়াতের দরুণ আজও সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে।
তাহমিদ স্বভাবতই একটু শান্ত, বাধ্য হলেও তানভীর ছিল একদম বিপরীত মেরুর মানুষ। বেপরোয়া, চরম অবাধ্য এবং দুষ্টুমির মধ্যে সেরা। তানভীরের বিরুদ্ধে শিক্ষক, আবাসিকের অভিভাবকদের অভিযোগ শুনতে শুনতে পারভীনের কান পচে গিয়েছে। পড়াশোনাতে টেনেটুনে পাশ আর আবাসিকে ছেলে পিটাতে সে ছিল একদম ফার্স্ট। ছেলেটা চরম অভদ্র হলেও পারভীন কখনো বেশি মা-*ধর করতে পারেননি তাকে। একে তো বহু দোয়ার পর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সন্তানকে তাঁর কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অভদ্র, ফাজিল যাই হোক ছেলেটা বেঁচে ত আছে। কিন্তু এভাবেই বা কতদিন? মানুষ বলত বড়ো হলে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু বড়ো হয়ে বিপত্তি যেন আরও বাড়ল। পড়াশোনার গণ্ডি পেরোতেই শুরু হলো নতুন কাহিনী।
তাহমিদ তো নিজের মেধা, পরিশ্রমে ডাক্তার হয়ে যায়। কিন্তু তানভীর তখন পড়াশোনার কেচ্ছা চুকিয়ে ভবঘুরে হয়ে গেল। তাকে কিছুতেই বাবার ব্যবসায় ঢুকানো সম্ভব হলো না। সে উলটো হুটহাট বাড়ি ছেড়ে পালায়, এটা তার নিত্যদিনকার অভ্যেস। এভাবে দেশ, বিদেশ ঘুরতে ঘুরতে আচমকা একটি পেশায় নিয়োজিত হয়ে গেল সে। যেই পেশা তার মতো ভবঘুরে ছেলের ভীষণ পছন্দ।
সময় অনুযায়ী বেশ নামি এক কমিউনিটি সেন্টারে তাহমিদের রিসিপশনের আয়োজন করা হলো। বেবি পিংক রঙের এক সুন্দর, সাদা পাথরের কারুকার্জ করা লেহেঙ্গা পরে স্টেজে বসে আছে মাহারিন। লেহেঙ্গার সাথে ডায়মন্ড কাট জুয়েলারি পরেছে সে। মাহারিনের একেক দিনের লুক অন্যান্য দিনের চাইতেও আরও মোহিত, স্নিগ্ধ হয়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। তার চারপাশে বিচরণ করছে নানান চেনা, অচেনা মুখ। চেনার চাইতে অবশ্য অচেনাই বেশি। এখানে তাহমিদের আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কলিগসহ তারেক সাহেবের পরিচিতজনেও ভরপুর আসর। শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা তাহমিদ এসে এ, ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। মাহারিনের দৌড় ওই সালাম দেওয়া অবধিই। কার কার সাথে পরিচিত হলো সে মুহূর্তের মধ্যেই ভুলে গিয়েছে। এত এত মুখ, এক দেখায় এত মনে থাকে নাকি?
মাহারিনের হাতে ফোন, কিছুক্ষণ আগে মোর্শেদ সাহেবদের আসার খবর জেনে নিয়েছে, তারা জানিয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
তবে মাহারিন বিরক্ত এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে। বসে থাকলেও চলত, কিন্তু মানুষের দাপাদাপি করে তার সঙ্গে ছবি তোলা এবং তার মুখে বারবার কৃত্রিম হাসি ফোটানো ভীষণ কষ্টসাধ্য। এমনিতেই সময়ের আগে এখানে এসেছে সে। তাহমিদের সাথে ফটোগ্রাফির জন্যে। অরায় এক দফা ছবি তোলা হয়েছে তখন নতুন কপোত-কপোতীর। ফটোগ্রাফার সম্ভবত তাহমিদের বন্ধু ছিল। সে মশকরা করে বলেছিল,
–“আরও কয়েকটাদিন সবুর করে পরে বিয়েটা করতি। এখন সুন্দরী বউর পাশে হাত ভাঙা বর, ছবিতে কেমন দেখায়? কী বিচ্ছিরি ব্যাপার স্যাপার।”
এ কথা শুনে তাহমিদ বেশ রমরমে গলায় বলল,
–“বিয়ে আল্লাহর হুকুম। আর কোথাও লেখা নেই যে হাত ভাঙলে বিয়ে করা যাবে না। ইতিহাসে আমার মতো হাত ভাঙা বর ব্যাপারটা বেশ রেয়ার বুঝেছিস? তোকে ছবি তুলতে বলা হয়েছে, তুই তোল। এখন আমি গাছে উলটো হয়ে ঝুলে আছি নাকি সমুদ্রে ভাসছি সেটা তোর দেখার বিষয় না।”
তাহমিদের বন্ধু সেরকম কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা না বললেও মাহারিন কেন যেন ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেছিল। তাইতো, এই লোকের এত বিয়ে করার তাড়া কেন ছিল? ভাঙা হাতের অজুহাতে তাকে খাটানোর জন্য? অবশ্য, এরকম কিছু হলেও মাহারিন অবাক হবে না। কারণ ইতিমধ্যেই তাহমিদ তাকে খাটিয়ে মা*ছে।
তাহমিদ স্টেজে এসে মাহারিনের সাথে কিছু সময়ের জন্যে বসল। সে মাহারিনের পাশে বসার মতো বিশেষ সুযোগ পাচ্ছে না। গেস্টদের আপ্যায়ন, তাদের সময় দিতে হচ্ছে। আজ তাহমিদের গায়ে সাদা শার্টের ওপর কালো স্যুট। চুলগুলো তার জেল দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে সেট করা। তার চুল সেট করে দিয়েছে তানভীর। তানভীর আবার ফ্যাশন সেন্স নিয়ে বেশ সচেতন। দুই ভাইয়ের মধ্যে এই একটা দিকেরই মিল রয়েছে। দুজনই নিজেদের পরিপাটি করে রাখতে ভীষণ পছন্দ করে৷ তাহমিদ যে একজন ডাক্তার, সেটা যেন এক দেখায় কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না। এক দেখায় মনে হবে সে মডেল কিংবা অভিনয়পাড়ার কেউ।
তাহমিদ মাহারিনের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলল,
–“তোমার বাবাকে কল করেছি, জানাল কাছাকাছি আছে৷ কে নাকি বের হতে দেরী করেছে এজন্য সবারই লেট হয়ে গেছে।”
মাহারিন চুপ করে শুনলো শুধু। এদিকে বিরতহীন ছবি তোলা তো হচ্ছেই। এটার কোনো থামাথামি নেই। মাহারিন এতক্ষণে মুখ খুলল, তাহমিদকে বলল,
–“আমি এখান থেকে ছুটি চাই।”
তাহমিদ কিছু বলবে এমন সময়ই একজন বেশ সুন্দরী মেয়ে স্টেজে উঠল। পরনে তার কালো, মোটা জর্জেট শাড়ি। শাড়িটা জর্জেট হলেও শালীন ভাবে শাড়িটা পরেছে সে, শাড়ির প্রতিটা ভাজ এবং তার নির্ভেজাল হাঁটাতে বোঝাই যাচ্ছে সে শাড়িতে কতটা পটু। তাহমিদ উঠে দাঁড়িয়ে আন্তরিকতার সাথে মেয়েটির সাথে হাত মেলালো, যা আবার বিশেষ পছন্দ হলো না মাহারিনের। মেয়েটির স্পষ্ট উচ্চারণ, অমায়িক হাসি তার ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিচ্ছে। দুজনে হাসাহাসি এবং গল্প করার চক্করে মাঝখান থেকে মাহারিনকেই ভুলে বসল, যা মাহারিনের একদমই ভালো লাগল না। সে সহসা মুখ গোমড়া করে ফেলল। তাহমিদ বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মাহারিনের উদ্দেশে বলল,
–“ও হচ্ছে আমার কাজিন, জোনি। জোনিরা ওর নাম, আমরা একই হসপিটালে কলিগ হিসেবে আছি।”
জোনিরা নামের মেয়েটি মিষ্টি হেসে মাহারিনকে বলল,
–“মাহারিন তোমার নাম তাই না? তুমি আমার ছোটো হবে তাই নাম ধরেই বললাম। কিছু মনে করোনি তো?”
মাহারিন হাসার চেষ্টা করে বলল,
–“না, না। ডাকতে পারেন।”
জোনিরা আবারও হেসে বলল, “ভালো লাগল তোমাকে দেখে।”
জোনিরা মাহারিন এবং তাহমিদের সঙ্গে দুটো ছবি তুলে স্টেজ থেকে নেমে গেল। এমন সময়ই মাহারিনের এক ননদ তাকে বলল,
–“তুমি জানো ভাবী, জোনি আপুর সাথে তাহমিদ ভাইয়ের বিয়ে হবার কথা ছিল।”
আগুনে যা ঘি ঢালার তা পুরোদমেই ঢেলে দিল সোহা। মাহারিন একদম চুপসে যায় সাথে সাথে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত জ্বলন অনুভব করছে। সব জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার মতো অনুভূতি।
তাহমিদের বিয়েতে তানভীর স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও ওয়ালিমা মিস দেয়নি সে। বেশ তৈরি হয়ে একাই হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। নানান আত্নীয়-স্বজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে, কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে— বলা চলে বেশ মজাতেই আছে সে। বেশিরভাগ মানুষই তার পা ভাঙার কারণ শুনতে চাইছে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। একজন বলল,
–“শুনেছি পাহাড় থেকে পড়ে পা ভেঙেছ? তা পাহাড় থেকে পড়ে এখনো অক্ষত আছ কী করে?”
তানভীর হাসল। হেসে জবাব দিল,
–“সবই উপরওয়ালার ক্রেডিট। পুরোপুরি পাহাড় থেকে না পড়লেও আরেকটুর জন্যে বেঁচে গেছি৷ আরেকটু হলেই সোজা খাদে পড়তাম। এত উঁচু থেকে খাদে পড়লে আমাকে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ।”
সামনেরজন বেশ অবাক সুরে বলল,
–“ভাগ্যিস আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। সাবধানে চলতে পারো না? ট্যুর গাইডদেরকে সবচেয়ে সচেতন থাকতে হয় জানো না?”
এটুকু জ্ঞানে তানভীর হাসল শুধু, উত্তরে কিছু বলে না। ট্যুর গাইড হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে সে মানুষকে বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কে জানাতে, বলতে পছন্দ করে। এই পছন্দের কারণেই সে প্রায়ই গাইড হিসেবে বেশ অনেক ট্যুর দিয়েছে। কখনো সমুদ্রে কিংবা কখনো পাহাড়ে। সুযোগ পেলে সে বিভিন্ন দেশ থেকেও ঘুরে আসে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে সে একজন ভ্রমণপিপাসু।
মাহারিন এবং তাহমিদ আজ গেল না মোর্শেদ সাহেবদের সঙ্গে। তাহমিদ জানালো আগামীকাল সকালে তারা যাবে। এজন্য মোর্শেদ সাহেবদের একপ্রকার খালি হাতেই ফিরতে হলো। অনুষ্ঠান শেষে বাড়িতে সবাই চলে এলো। সবার সঙ্গে আজ নতুন একজন এসেছে, জোনিরা। পারভীন নিজে তার হাত ধরে এনেছেন। জোনিরা কিছুতেই আসতে চাচ্ছিল না। পারভীন চোখ রাঙিয়ে জোনিরাকে শাসিয়ে বললেন,
–“একদম চুপ! আজ তুই আমার সাথে থাকবি ব্যাস! কতদিন তোকে দেখি না সে খেয়াল আছে? ব্যস্ততা দেখিয়ে একদম ভুলে গেছিস এই মামনিকে। আজ বোন বেঁচে থাকলে ঠিকই আমাদের মনে থাকত।”
পারভীনের অভিমানী অভিযোগে জোনিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
–“মায়ের পর তোমাকে স্থান দিয়েছি মামনি। ভুলে গেছি বলে লজ্জা দিয়ো না। তুমি নিজেও ভালো করে জানো তোমাকে ভোলা অসম্ভব।”
–“তো আসিস না কেন দেখা করতে? যা হওয়ার হয়েছে। এখন যা, নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ রেস্ট কর। খাবার সময়মতো পাঠিয়ে দিব, যা ধকল গিয়েছে।”
–“খাবার পাঠানোর দরকার নেই। আমি লম্বা হতে চাই বিছানায়। ইদানীং হসপিটালে বেশ ধকল গিয়েছে।”
মাহারিন ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে, মাহারিনের পলকহীন নজর সেই চাঁদের পানেই। চোখ-মুখে তার অভিমান লেপ্টে। মুখের শক্ত ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখনো ওই এক কথাতে আটকে আছে। সেই মেয়েটা এখন তাদেরই বাড়িতে। তাহমিদও এখনো ফেরেনি। নির্ঘাত ওই মেয়ের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে? তাহমিদ একসময়ে রুমে আসল। সে চেঞ্জ করে, ফ্রেশ হয়ে এসেছে। কোত্থেকে এসেছে কে জানে? মাহারিনকে দেখতেই তাহমিদ বলল,
–“ওহ, বের হয়েছ তবে ওয়াশরুম থেকে!”
–“সে তো কখনই বের হয়েছি।”
–“আমি তো মাঝে দিয়ে রুমে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি তো ফ্রেশ হতে বিজি ছিলে। এজন্য বাধ্য হয়ে মুবিনের হেল্প নিয়ে ফ্রেশ হতে হয়েছে।”
মাহারিন কিছুটা নরম হয়ে এলো। যাক, তবে সে উলটোই বুঝছিল। মাহারিন বেশি দেরী না করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আজ বেশ ধকল গিয়েছে, ঘুমানো দরকার। তাহমিদও এসে মাহারিনের পাশে শুয়ে মাহারিনকে কাছে টেনে নিল। এতে মাহারিন বিরক্ত হয়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়। এতে বিশেষ মাথা না ঘামিয়ে তাহমিদ বলল,
–“কী ব্যাপার, আজ এত মুখ ভার কেন তোমার?”
–“আমি ঠিকই আছি, আপনার চোখে সমস্যা।”
–“আমার চোখ আর সিক্সথ সেন্স একদম ঠিক আছে। তুমি বলো তোমার কী হয়েছে? এমন মনমরা কেন?”
–“ঠিক থাকলে ঘুমান, খামাখা আমাকে কেন জ্বালাচ্ছেন। ছাড়ুন আমাকে।”
তাহমিদ ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত হাতে কাছে টেনে বলল,
–“বউকে ছেড়ে দিলে পাপ হবে আমার, মোটেই একটাই বউ। সেই বউকে ছাড়ি কী করে? ডিস্টার্ব না করে ঘুমাতে দাও, নয়তো লিমিটক্রস করে ফেললে আমাকে দোষ দিও না।”
মাহারিনের কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল তাহমিদের লাগামহীন কথা-বার্তায়। বিড়বিড় করে বলল, “অসভ্য।”
নিজের বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে তানভীর। হাতে ফোন আর মুখে গুণগুণিয়ে গানের সুর তুলতে ব্যস্ত সে। মুখের উজ্জ্বল ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কোনো এক ব্যাপারে ভীষণ ফুরফুরে মেজাজে আছে। তানভীর ডায়াললিষ্ট ঘাটতে ঘাটতে একটি নাম্বারে কল দিল। নাম্বারটা সেভ নেই, নতুন নাম্বার কি না। তানভীর ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো। তানভীর বেশ স্বতঃস্ফূর্ত গলায় বলল,
–“আজ আপনাকে কালো শাড়িতে কী যে সুন্দর লাগছিল না, আমার তো এত মানুষের মধ্যেও আপনাকে চোখে হারাচ্ছিলাম।”
তানভীরের কথার পিঠে ওপাশ থেকে শক্ত ধমক আসল। এতে তানভীর মিটমিট করে হাসল।
–“এই বেয়াদব ছেলে, তুমি আবারো ফাজলামো শুরু করেছ? কতবার বলেছি আমি তোমার বড়ো হই, ভদ্রভাবে কথা বলবে। থাপ্পড় না খেলে শোধরাবে না তুমি, তাই না?”
জোনিরার বকায় বিশেষ লাভ হলো না। তানভীর তার কথাকে আরও পেচিয়ে বলল,
–“থাপ্পড়টা দিতে খামাখাই দেরী করছেন আপনি। থাপ্পড়ের অযুহাতে হাতের স্পর্শ পাওয়া মন্দ নয়। এক কাজ করুন, আমার ঘরে এসে থাপ্পড়টা দিয়ে যান। আপনিও খুশি, আমিও খুশি।”
–“তানভীর!!”
–“উফ! আপনার মায়াবী কণ্ঠে আমার এই নামটা! একদম সুঁচের মতো বুকে বিঁধে। এই, আরেকবার ডাকুন তো আমার নাম। তানভীর বলুন।”
জোনিরা তাকে ধমক দিবে তো দূর, উলটো তানভীরের কথার মাঝেই ঠাস করে কলটা কেটে দেয়। আর তানভীর ফোনের এপাশে হাসতে হাসতে মাথায় বালিশ চেপে ধরল। জোনিরা নিশ্চয়ই এখন রেগে আগুন হয়ে গিয়েছে?
চলবে~~