মায়াতলীর মোড়ে পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
31

#মায়াতলীর_মোড়ে – [শেষাংশ]
লাবিবা ওয়াহিদ

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

সেন্টমার্টিনে আজ তাহমিদদের প্রথম দিন। কটেজ অবধি আসতে ভাঙা রাস্তার বাজে ঝাকুনি পোহাতে হয়েছে। ঝাকুনির জ্বালায় মাহারিন বাম হাতের কনুইতে ব্যথাও পেয়েছে। এই কষ্টটা লাঘব হয়েছে অবশ্য কটেজে পৌঁছে। রং-বেরঙের নানান গাছ-গাছালির মাঝে অত্যন্ত সুন্দর কারুকার্জে গড়া প্রতিটি কটেজ। যেহেতু তারা কাপল তাই কাপল কটেজই বুক করা ছিল। এই নিরিবিলি অঞ্চলে সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে সমুদ্র এখান থেকে বেশি দূরে নয়। আড়াইটা নাগাদ চেক ইন করে তারা নিজেদের রুমে পৌঁছে যায়। রুমে এসে দেখে বিছানা গোলাপ ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো। ফুলের পাঁপড়ির লাভ শেপের ওপর দুটো তোয়াল দিয়ে হাস বানিয়েছে। এ দেখে তাহমিদের মুখে দুষ্টু হাসি ফুটে। তা দেখে মাহারিন তৎক্ষণাৎ একটা হাসকে দ্রুত তোয়াল বানিয়ে মুখ মুছতে থাকে। মিনমিন করে বলল,
–“উফ, কী গরম।”

তাহমিদ হেসে দিয়ে বলল,
–“না বোঝার ভং ধরিও না। এখন যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও।”

মাহারিন দ্রুত তাই করল, ভীষণ খুদা লেগেছে তার। দুজনে ফ্রেশ হয়েই তাদের কটেজ থেকে বেরিয়ে রিসোর্টের লাউঞ্জের দিকে গেল। সেখানে তাদের দুপুরের খাবার প্রস্তুত করে রাখা। ওদের আগে থেকে মেন্যু, লাঞ্চ এখানে করবে কি না বলে দেওয়া হয়। মিনিমাম এখানে আসার আগে। নয়তো সাথে সাথে বললে ওরা ব্যবস্থা নেয় না। এখানকার বেশিরভাগ রিসোর্টেই এই নিয়ম। তাহমিদ মাহারিনের ইচ্ছেতে ভাত, কয়েক পদের ভর্তা, ডাল আর রূপচাঁদা মাছ রেখেছিল। আর ড্রিংকসে রেখেছিল অরেঞ্জ জুস, চা আর পানি। ওরা বসতেই খাবার পরিবেশন করতে সময় লাগেনি। তাহমিদ ভর্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তানভীর বলেছিল ওদের রান্না খুব সুস্বাদু হয়। এজন্য ভাবলাম আজকে এখানেই লাঞ্চ ডিনার সেরে নিব। রাতে সি-ফুড খাব, কী বলো?”

তানভীরের কথা বলতে না বলতেই তানভীরের কল এলো। তাহমিদ কল রিসিভ করতেই তানভীর ইডিয়েট মার্কা হাসি দিয়ে বলল,
–“কী ভাই! পৌঁছে গেছিস?”
–“হ্যাঁ। সবে খেতে বসলাম।”
–“ওদের এখনই ডিনারের কথা বলে দিবি।”
–“হুঁ।”
–” তারপর, রুম কেমন ছিল?”
–“ভালো।”
–“ভালো??” তানভীর সুর টেনে বলল।
–“শাট আপ, কল কাট।”
–“ঠিক আছে, করলাম না ডিস্টার্ব। হ্যাপি জার্নি। তাড়াতাড়ি চাচ্চু বানা। আমার মেয়ের সাথে তোর ছেলের বিয়ে দিব। আমার মেয়ের শাশুড়ি ভাবীর মতো সুইট মানুষই হবে। কোনো জল্লাদ বেটির ছেলের কাছে আমার মেয়ে দিব না।”

তাহমিদ মাহারিনের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল, “তোর ভাবী এমনিতেই জল্লাদ।”

মাহারিন ভ্রু কুচকে বলল, “কিছু বললেন?”
তাহমিদ এক গাল হেসে না বোধক মাথা নাড়ায়। এরপর তানভীরের উদ্দেশে বলল,
–“আগে তোর নিজের বিয়ে পাকা কর, এরপর মেয়ে-ছেলের প্ল্যান করিস। ওদিকে জোনিরাকে পটানোর খবর নাই সে আমার সাথে নাটকের কথা বলে।”

–“পটে তো গেছেই, এ আর নতুন কী?”
–“পটে গেছে? ওয়ান্ডারফুল। এখন ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে দ্যাখ পটে যাওয়া পাখিকে কেউ উড়াল দিয়ে নিয়ে গেল নাকি।”

তানভীর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাহমিদ খট করে কল কেটে দিল। মাহারিন তাহমিদের কথা শুনে বলল,
–“জোনিরা আপুকে নিয়ে কী বললেন?”
–“জোনিরাকে মামারা বিয়ে দিতে চাচ্ছে। সেটাই বোঝালাম তানভীরকে। এবার অন্তত এই মূর্খটা আমাদের প্রাইভেসি দিবে। জায়গামতো তীর ছুঁড়েছি।”

বলেই তাহমিদ চোখ টিপ দেয়। মাহারিন বিষম খেল। তাহমিদ মুখে হাত দিয়ে হেসে বলল, “খাও তো তুমি। এখনই বিষম খেলে হয় নাকি? তুমি না সাহসী মেয়ে, আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন?”

খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা চলে গেল সমুদ্র উপভোগ করতে। রিসোর্টের ভেতর দিয়েই বিচে যাওয়া যায়, শুধু মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হয়। মাহারিন মুগ্ধ চোখে চারপাশ দেখছে শুধু। সে কক্সবাজার আসলেও কখনো সেন্টমার্টিন আসেনি। ভাগ্যক্রমে এবার আসলেও এসেছে শুধু তাহমিদের সঙ্গে। তাহমিদ তার হাত আগলে নেয় নিজের হাতে। মাহারিন তাকাতেই তাহমিদ বলল,
–“বাচ্চা মানুষ তুমি, যদি হারিয়ে যাও? বউকে তো আর হারাতে পারি না।”

মাহারিন মুখে কিছু না বললেও অন্যদিকে ফিরে মুচকি হাসল। আজকের নীল আকাশে সাদা মেঘের পাশে মেঘলাটে ভাবও রয়েছে , তার ওপর এই বিচের দূর দূরান্তে কেউ নেই। মাহারিনের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে এই অপার সৌন্দর্য দেখে। নীল আকাশ আর নীল সমুদ্র অদূরে একসাথে মিশেছে। সঙ্গে ঠান্ডা শীতল বাতাস তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। আহা! আল্লাহর সৃষ্টি কত নিখুঁত, কত সুন্দর।

তাহমিদ আচমকা মাহারিনের কোমর টেনে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করল। মাহারিন চমকে গেলে তাহমিদ বলল,
–“পরনারীর মতো এত দূরে দূরে থাকো কেন? একসাথে সমুদ্র উপভোগ করতে না পারলে মজা আছে?”

–“আপনার হাতের প্লাস্টার খোলাই উচিত হয়নি।”
–“আচ্ছা তাই?”

বলেই তাহমিদ আচমকা তাকে পাজাকোলে তুলে নেয়। মাহারিন ভয়ে আর্তনাদ করে উঠে। তাহমিদ হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,
–“আহা বউ, আমিই তো। কেউ তোমাকে তুলে নিয়ে যায়নি।”
–“নামান আমাকে, এক্ষুণি নামান।”
–“কেন ফেলে দিব ভাবছ?”
–“আপনাকে দিয়ে সব সম্ভব।”
–“উহু, হানিমুনে এসে বউকে কোল থেকে ফেলে দিলে আমার বিরাট বদনাম হবে যে। তোমাকে ফেলব না।”

তাদের এই মধুর সময়টা বেশিক্ষণ টিকলো না। আচমকাই আকাশের রং বদলে যায়। কাছে কোথাও মেঘের কঠিন গর্জন কানে আসে। ঝড়ের মতো হয়ে যায় চারপাশ। অল্প করে স্রোত তোলা সমুদ্র হঠাৎ-ই কেমন ভয়ংকর স্রোত তোলা শুরু করেছে। সেসব দেখে মাহারিন ভয়াতুর গলায় বলল,
–“ঝড় নামবে হয়তো, চলুন এখান থেকে।”

তবে খুশি দেখাল তাহমিদকে। বৃষ্টির মাঝেই ত সমুদ্রের আসল মজা। এজন্য সে শিস বাজিয়ে উঠল। মাহারিন বলল,
–“প্লিজ চলেন এখান থেকে।”
–“কেন যাব? কত রোমান্টিক ওয়েদার। এই ওয়েদার তো তোমার আমার জন্যেই।”

বলেই তাহমিদ চুমু খেল। মাহারিন তার বুকে থাবা বসিয়ে দিয়ে বলল, “অসভ্য।”
–“তোমার জন্যই।”

ওরা বেশিক্ষণ থাকে না সেখানে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজেই কটেজে ফিরে আসে। ওরা ফিরতেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামল। তাহমিদের মাথা ভিজেছে দেখে মাহারিন নিজেই তোয়াল দিয়ে তার মাথা মুছে দেয়। তাহমিদ তা দেখে মুচকি হেসে বলল,
–“পরিপূর্ণ বউ বউ লাগছে তোমায়।”
–“বাজে বকা বন্ধ করুন, মাথা ভিজিয়ে এসেছেন সে খেয়াল আছে?”
–“ঝাড়িও দাও আবার যত্নও নাও। তোমার এত রূপ কেন বলো তো?”
–“মেয়েদের অনেক রূপ থাকে। তারা ভালোবাসতেও জানে আবার ক্ষেত্রবিশেষে বিসর্জনও দিতে পারে।”

–“তুমি তবে এখন কোন লিস্টে আছ?”
–“কোনোটাতেই না।”
–“মিথ্যে।”
–“আপনাকে মিথ্যে বলতে যেন ঠ্যাকা পড়েছে আমার।”

দুপুরটা আচমকাই বৃষ্টির তোপে রাতের মতো হয়ে গেছে। কটেজের টিনে মুষলধারে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটার ঝমঝম শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে মেঘ ডাকছে প্রচুর। ইলেক্ট্রিসিটি বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় নিয়েছে। রিসোর্টের ওরা চেয়েও কোনোভাবে জেনারেটর চালাতে পারেনি, জেনারেটরে নাকি কী সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই বলা যায় রুমটাও অন্ধকার, তবে শীতল। রিসোর্টের ম্যানেজার তাহমিদকে কল করে বেশ কয়েকবার সরি জানিয়েছে। তবে এসবে তাহমিদের বিন্দুমাত্র সমস্যা হচ্ছে না। বরং সবকিছু মিলিয়ে তার বেশ দারুণ অনুভূতি হচ্ছে।

মাহারিন তখন তাদের বারান্দার কাচের দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে। সে বেশ মন দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। সেন্টমার্টিনে এসে এত সুন্দর বৃষ্টির অভিজ্ঞতা পাবে সে ভাবতে পারেনি। একটু পরপর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতেও কার্পণ্য করছে না সে। আকস্মিক তাহমিদ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তাহমিদের হাত জোড়া তার পেটে বিচরণ করছে। মাহারিন চমকে যায়, সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত দেহ কেমন শিউরে ওঠে। তাহমিদের ভারী নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে পড়ছে যার ফলে মাহারিন আরও নেতিয়ে যাচ্ছে। সে তাহমিদকে দূরে ঠেলে দিতে গিয়েও পারল না। তাহমিদ অস্বাভাবিক শীতল, ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
–“আজকের বৃষ্টিটা তোমার মতোই সুন্দর মাহারিন।”

তাহমিদ মাহারিনের গলায় চুমু খেল। মাহারিনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। তাহমিদ নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভরপুর গাল মাহারিনের গালে ঘষতেই মাহারিন নড়ে উঠল। তা দেখে তাহমিদ হাসল। বলল,
–“জানো, তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন মনে হচ্ছিল তুমিই সেই মেয়ে— যার নামে আমার হৃদয় বুকড হয়ে গেছে। এই বুকিং আর কোনো ক্রমেই ক্যান্সেল করা সম্ভব নয়। সারাজীবনের জন্যে এই হৃদয়ে একটা নামই গেঁথে গেছে, সে হলো মাহারিন। বউ, আল্লাহর পরিকল্পনা এত সুন্দর কী করে হলো বলো তো?”

মাহারিন কিছু বলতে পারল না, শুধু চোখ বুজে তাহমিদের সমস্ত কথা অনুভব করছে। সঙ্গে অনুভব করছে তাহমিদের গাঢ় স্পর্শ। তাহমিদ আবারও মাহারিনের ঘাড়ে, গলায় চুমু দিল। অতঃপর কানে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল, “মে আই?”

—————————-
তাহমিদের কথাকে তানভীর বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। এর মাঝে তার একটা ট্যুরের ডাক পড়ল। ছোটোখাটো ট্যুর সীতাকুণ্ডে, এজন্য সে নিজের রিফ্রেশমেন্টের জন্য ঘুরে এলো সেখান থেকে। এমনিতেও এতদিন বাড়িতে থেকে তার একঘেয়েমি চলে এসেছে। যাওয়ার আগে অবশ্য জোনিরার থেকে জোর করে সময় আদায় করেছে। তারা একসাথে বসে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিল। জোনিরার বিরক্ত মুখ দেখতে দেখতে এখন তার বিরক্ত মুখটাই তার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে গিয়েছে। তাই তো এবারও জোনিরাকে প্রচন্ড রকম ক্ষেপিয়ে দিয়ে সে একদিন দিব্যি ঘুরেছে। এভাবে মাসখানেক পেরিয়ে যায়। একই মাসে তানভীর তিনটে ট্যুর দিয়েছে মায়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও। আরেকটা ট্যুরের প্ল্যান চলছিল তার, সে নিয়ে ভাবতে ভাবতে লিভিংরুমে আসতেই শুনতে পায় পারভীন তাঁর বড়ো ভাইয়ের সাথে ভিডিওকলে কথা বলছে। তাদের পরিষ্কার, স্পষ্ট কথা-বার্তা তানভীরের কান অবধি পৌঁছাতে বেশি বেগ পেতে হলো না। পারভীন তানভীরের জন্য মেয়ে দেখেছেন যা তানভীর টেরও পায়নি। আরেকটা দুঃসংবাদ হচ্ছে জোনিরার জন্য ছেলে দেখেছে মামারা, মোটামুটি সেই ছেলের সাথেই জোনিরার বিয়ে ঠিক। এ কথা শুনে তানভীরের মাথা ঠিক থাকবে না স্বাভাবিক।

সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে মায়ের থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়। মাকে কিছু বলতে না দিয়ে সে তেজী গলায় বলল,
–“আমি জোনিরাকে ভালোবাসি, আমিই জোনিরাকে বিয়ে করব। তাই জোনিরাকে অন্য কোথাও বিয়ের দেবার কথা স্বপ্নেও চিন্তা করবেন না। জোনিরা শুধুই আমার, মামা।”

বলেই মায়ের হাতে ফোন দিয়ে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল। তানভীরের আচমকা আগমন, আচমকা এতগুলা কথা বলে আবার চলে যাওয়া সবটাই ভাই-বোনের মাথার ওপর দিয়ে গেল। মামা তো হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
–“এটা তাহমিদ ছিল নাকি তানভীর?”

এরকম হতবুদ্ধি মুহূর্তে দূর থেকে মাহারিন হেসে ফেলল। তাহিয়া কোত্থেকে এসে মায়ের পাশে বসতেই পারভীন রাগ দেখালেন,
–“তানভীরটার কী মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? কিসব বলে গেছে?”

তাহিয়া এতদিনে বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। পারভীনও মেয়েকে ছোটো বলে ট্রিট করেননি। পারিবারিক সমস্ত বিষয়ে মেয়ে তাঁর বন্ধু। মেয়ের সাথে তিনি সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন যাতে মেয়ে কখনোই তাঁর সামনে আনকম্ফোর্ট ফিল না করে। তাহিয়া তাই নিজ স্বভাবেই বলল,
–“এটা সত্যি মা। ভাইয়া আসলেই জোনিরা আপুকে পছন্দ করে। হসপিটালে তো ভাইয়া আর আপু ফেমাস জুটি। ভাইয়া দুই বছর ধরে আপুকে পছন্দ করে। কিন্তু আপু তাকে এড়িয়ে যায়।”

তানভীর হসপিটাল এসে দেখতে পায় ক্যান্টিনে জোনিরা এক অচেনা লোকের সাথে বসা। আর জোনিরাও তার সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। তানভীর মায়েদের কল থেকেই জানতে পেরেছে জোনিরার সাথে সেই ছেলে আজ দেখা করবে। তার কথাই ঠিক হলো। তানভীর গরম মেজাজ নিয়ে আচমকা চেয়ার টেনে জোনিরার পাশে গিয়ে বসল। এতে জোনিরা এবং আগন্তুক দুজনেই চমকে যায়। তানভীর সেসব বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সামনের লোকটার উদ্দেশে বলল,
–“হু আর ইউ? আমার হবু বউয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলার পারমিশন আপনাকে কে দিয়েছে?”

লোকটা অবাক হয়। কপালে ভাজ ফেলে বলল,
–“এক্সকিউজ মি?”
–“কিসের এক্সকিউজ মি? নিজের ভুড়ি দেখছিস ব্যাটা? এই ভুড়ি নিয়ে কচি মেয়ে বিয়ে করার সাধ জাগছে তোর? এক্ষুণি ফুট হ বুইড়া! আমার জোনিরার আশেপাশেও যদি তোকে কখনো দেখেছি তো তোর ভুড়ি খুলে ফুটবল খেলব আমি। বিদায় হ!”

জোনিরা জোরে চিমটি কাটল তানভীরকে। রেগে ধমক দিয়ে বলল,
–“পাগল হয়েছ তুমি? উনি আমার পেশেন্টের হাসবেন্ড, তুমি কোন সাহসে তাকে এভাবে বলছ? সবকিছু তোমার কাছে তামাশা মনে হয়? স্যে সরি!”

তানভীর মুখ থমথমে করে সরি বলল। তবে লোকটা হেসে উড়িয়ে দিলেন, বেশ মজার মানুষ তিনি। তিনি তাঁর আরও দুই বাচ্চার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওদের একজনের বয়স বারো আরেকজনের বয়স নয়। তানভীর বেশ লজ্জিত হয় নিজের কর্মকাণ্ডে। তবে জোনিরা আজ ভয়াবহ রকম রেগে আছে। সে তানভীরের কোনো কথাই শুনতে চাইছে না।

তানভীর তার হাত ধরতে নিলে জোনিরা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
–“কী পেয়েছ কী তুমি সব? তোমার বাবার টাকার পুতুল? এত যে বিয়ে বিয়ে করো তুমি নিজে আজ অবধি কয় টাকা ইনকাম করেছ? বিয়ে করে বউকে খাওয়াবা কী তুমি? মানুষের আত্মসম্মানবোধ থাকে তানভীর, যা তুমি খুইয়ে বসেছ। কোন মুখে আবার তুমি আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখো? বাবার হোটেলে খেতে খেতে এখন সবকিছু এতই সহজ হয়ে গেছে? এক্ষুনি আমার সামনে থেকে দূর হও তুমি! আর কখনো নিজের মুখ দেখাবে না।”

বলেই জোনিরা চোখে জল নিয়ে বুকে হাত চেপে ছুটে চলে যায়। সে টেরও পায় না তানভীর কতটা আহত হয়ে তার পানে চেয়ে আছে। জোনিরাও আজ নিজ বুকে পাথর চেপে তাকে কথা শুনিয়েছে। চলে যাক তানভীর, তার থেকে বহুদূরে। তানভীরের মতো শুকতারাদের সবসময় ভালো থাকতে হয়। তাদের জীবন সবসময়ই রঙিন হবে। তার মতো বেরং নয়।

জোনিরার কথাগুলো তানভীরের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। সে নিজের ট্রাভেল এজেন্সির পাশাপাশি এখন বাবার বিজনেসেও যোগ দিয়েছে। যতটা সম্ভব বাবাকে সাহায্য করছে সে। এতে তারেক সাহেব ভীষণ সন্তুষ্ট ছেলের প্রতি। এত বছর ছেলেকে কত মানানোর চেষ্টা করেছে অথচ ছেলে মানতেই চায়নি এখানে আসার জন্য। কিছু তো হয়েছে যার জন্য তাঁর ছেলে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবুও তারেক সাহেব সব ভুলে ছেলের সঙ্গ দিচ্ছেন। এখন তার দুই ছেলেই সমান পরিশ্রমী। তানভীর আগে থেকে যে অনেকটা চুপসে গিয়েছে তা যেন কেউ টেরই পায়নি। হয়তোবা টের পেয়েছে, তবে সচরাচর তা কেউ প্রকাশ করছে না। তানভীর ক্রমশই কেমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। তাইতো এর মাঝে তাহমিদ তার সাথে একান্তে বসল। ভাইকে সঙ্গ দিয়ে বলল,
–“এই কাজ, কাজ করে আর কতদিন?”

তানভীর যথেষ্ট সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
–“যতদিন না যোগ্য হচ্ছি।”
–“তানভীর, তুই না সত্যিই মাথা-মোটা।”
–“তা কেন মনে হলো?”
–“জোনিরা তোকে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ওগুলা বলেছে, তা কী তুই বুঝতে পারছিস না?”
–“এতটাও মাথা-মোটা নই যে বুঝতে পারব না। আমি এত দ্রুত জোনিরার পিছু ছাড়ব ভাবলি কী করে?”
–“তাহলে এই পরিবর্তন?”
–“পরিবর্তন কতটা হয়েছি বলতে পারব না, তবে নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলব যাতে দ্বিতীয়বার সেসব কথা জোনিরা মুখেও না আনে। আমি অফিশিয়ালি তার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাব। বাবা-মায়ের হাত ধরেই।”

তাহমিদ হাসল। তানভীর জানেও না তার অজানাতে এই পরিবারে কত কী ঘটে যাচ্ছে। জানার কথাও কয় অবশ্য। কেউ চায়ও না তানভীর কিছু জানুক। তাহমিদ হেসে বলল,
–“কাজ ছাড়, এবার অন্তত কোথাও গিয়ে ঘুরে আয়। কয়েকমাস তো এখানেই পড়ে রইলি।”

তানভীর ল্যাপটপে মুখ গুজে বলল,
–“দেখি প্ল্যান হচ্ছে। সেন্টমার্টিন যেতে পারি। সেন্টমার্টিন আমার মন খারাপের মেডিসিন, ওখানে আমার সমস্ত দুঃখ ভাসিয়ে আসব।”

তানভীর সেন্টমার্টিন যেতেই তাদের বাড়িতে সুসংবাদ এলো। বাড়িতে নতুন সদস্য আসতে চলেছে। এ নিয়ে দুই বাড়িতে যেন আচমকা ইদ লেগেছে। খবর পেতেই মোর্শেদ সাহেব তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে কতশত মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন। মাহারিন তখনো কোনো এক ঘোরে আটকে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার মধ্যে আরো একজনের অস্তিত্ব আছে। তারেক সাহেব তো অত্যন্ত খুশিতে বেয়াইকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন,
–“মিষ্টি আপনি কেন আনলেন বেয়াই মশাই? মিষ্টি তো আমার নিয়ে যাওয়ার কথা।”
–“আরে একজন মিষ্টি আনলেই হলো। আমি আবার নানা হবার খুশিতে সব নিয়ম ভুলে গেছি।”

মাহারিন দূরে বসে সবার আনন্দ দেখছে। তার প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তাহমিদ। সে তো বাবা হবার খুশিতে কী থেকে কী করবে ভেবেই পাচ্ছে না। সকাল থেকে পাগলামি দেখেই যাচ্ছে তার। মাহারিনের মা মেয়ের পাশে বসা। বর্ষা, তুলিও মাহারিনের সাথে নানান গল্প করছে বাবুকে নিয়ে। মাহারিন আনমনে নিজের পেটে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল,
–“তোর আসার খবর যে এত আনন্দের হবে তা তো জানতাম না! তুই শুধু আমার খুশি নস, দুটো পরিবারের খুশি হতে চলেছিস।”

তানভীর তো সেন্টমার্টিন থেকেই কল করেছে। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,
–“ড্যাম ব্রো! আমি আগে জানলে কখনোই সেন্টমার্টিন আসতাম না। আমি চাচ্চু হবো! তোর বাচ্চা তোকে আর আমাকে দেখে কনফিউজড হবে যে, কে বাবা? হাহা! আমার যে তড় সইছে না। আমি দুইদিনের মধ্যেই আসছি।”

রাতে তাহমিদ মাহারিনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। সে উচ্ছ্বাসে মাহারিনকে অত্যন্ত যত্ন করেছে সারাদিন। মাহারিনও নীরবে সে সমস্ত যত্নের মজা নিয়েছে। তাহমিদ আক্ষেপ করে বলল,
–“আমার বাচ্চার মা হয়ে যাচ্ছ অথচ এখনো ভালোবাসি মুখ ফুটে বললে না।”
–“কেন? না বললে কী হবে?”
–“আমার বুঝি শুনতে ইচ্ছে করে না?”
–“আপনার এই ইচ্ছে রাখার কোনো শখ নেই আমার।”
–“থাক, বলতে হবে না তোমাকে। আমি তো আর বাচ্চা নই যে নিজ দায়িত্বে বুঝতে পারব না।”
–“তাই? তা কী কী বুঝলেন?”
–“এই ধরো, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো তা অনুভব করতে পারি। আমার জন্য রাতে না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করো, আমি আসলে একসাথে খাবার খাও। আমাকে বিরক্তি দেখালেও আমার পছন্দের খাবারগুলা তুমিও পছন্দ করো, আমার পছন্দের রঙেই সবসময় নিজেকে সাজাও। ক্ষেত্রবিশেষে ফুল কিনে না আনলে অভিমান করো, অভিমান না ভাঙালে আরও গাল ফুলাও। তুমি বলো, আর কত উদাহরণ চাও।”

মাহারিন লজ্জা পেল। লজ্জায় মুখ লুকালো তাহমিদের বুকে। তাহমিদ হেসে বলল,
–“এই দেখো, এইযে লজ্জা পাচ্ছ.. এটাও আমাকে ভালোবাসার প্রমাণ। যাও, তোমার হয়ে আমিই বলে দিচ্ছি। ভালোবাসি তোমায় মায়া!”
–“মায়া কে?”

তাহমিদ হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,
–“অবশ্যই তুমি আমার বউ। তুমি পুরো মানুষটাই মায়া মায়া। আর মানুষ গভীর মায়ায় না জড়ালে ভালোবাসবে কী করে শুনি?”

—————————-
একদিন পরেই জোনিরা তানভীরকে কল করল। তানভীর তখন লঞ্চে উঠেছে, কক্সবাজার আসার উদ্দেশে। তানভীর এতদিন পর জোনিরার কল পেয়ে চমকালেও নিজেকে সামলে নেয়। কল রিসিভ করে ভারিক্কি গলায় বলল,
–“বলো!”
–“কেমন আছ?”
–“ভালো, আপনি?”
–“আমিও ভালো। কোথায় আছ?”
–“কোথায় আছি তা জেনে কী করবেন? আমি তো আপনার কেউ নই!”
–“তোমাকে বলেছি না সোজা প্রশ্ন করলে সোজা উত্তর দিবে? আবারও ত্যাড়ামি দেখাচ্ছ কেন?”
–“আমার কথা কথা স্টাইলই এমন। আপনার জন্য বদলাতে যাব কেন?”

জোনিরা ভীষণ রেগে গেল, তবে বিশেষ কিছু বলল না। নিজেকে সামলে বলল, “সেন্ট মার্টিন থেকে কবে ফিরছ?”
–“কেন? আমাকে মিস করছেন?”
–“না।”
–“তবে? আপনি জেনে কী করবেন?”
–“খুব তেজ বেড়েছে তোমার না? মুখে মুখে তর্ক করছ?”

তানভীর কিছুটা দমে গিয়ে বলল,
–“সেন্টমার্টিন থেকে রওনা হচ্ছি।”
জোনিরা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সাবধানে এসো। কক্সবাজার এসে আমাকে কল করবে।”

তানভীর ভ্রু কুচকে বলল,
–“তা কেন?”
–“কিছু জিনিস আনাব তোমাকে কক্সবাজার থেকে।”
–“যদি কখনো না ফিরি? সমুদ্রে কোথাও হারিয়ে যাই, আমাকে মিস করবেন না জোনিরা? আমাকে ভালো না বাসার আক্ষেপ করবেন না?”

জোনিরার বুক কেঁপে ওঠে তানভীরের এহেম কথা শুনে। সে কোনোক্রমে চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে কল কেটে দেয়। সে আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। সে কক্সবাজারেই আছে। তাকে এখন বঁধুরূপে সাজানো হচ্ছে। তার দু’হাত ভর্তি লাল টকটকে মেহেন্দি। হ্যাঁ, সে বউ সাজছে.. তানভীরের বউ। যা তানভীর এখনো জানে না। সবাই তানভীরের থেকে লুকিয়েছে— তাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে। বিয়েটা কক্সবাজারেই হবে। তানভীর আসলেই বঁধুরূপে জোনিরাকে দেখবে। তানভীর যখন নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত তখন পারভীন এবং তারেক সাহেব ব্যস্ত ছিলেন ছেলের খুশি সাজাতে। জোনিরা শুরুতে রাজি হয়নি। বারংবার বাস্তবতা তাকে এসবের দিকে এগিয়ে যেতে ভড়কে দিচ্ছিল। সে প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় পায়, ভীষণ করে। কিন্তু সবার বোঝানোতে সে রাজি হয়। পারভীন নিজে যেহেতু তার কাছে ছেলের খুশি চাচ্ছে সে কোন মুখে ফিরিয়ে দিবে? যেখানে মানুষটা তাকে আপাদকস্তক ঋনি করে রেখেছে? ওদের এই সম্পর্ক নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলে তার সমস্যা থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।

দুপুর নাগাদ জোনিরা একদম তৈরি হয়ে যায়। সে বারবার ঘড়ি দেখছে। ওদিকে বাকিরাও নিজেদের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। বিয়েটা একটা রিসোর্টেই হবে। অল্প সংখ্যক, ঘরের মানুষরাই থাকবে এই বিয়েতে। যোহরের পরপর হুজুর আসবেন বিয়ে পড়াতে। জোনিরা বারবার ঘড়ি দেখছে। তানভীর আসতে বেশি দেরী নেই। যত সময় এগোচ্ছে ততই জোনিরার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। কিছুক্ষণ পরই তানভীরের সাথে তার নতুন জীবন শুরু হবে। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এটা কী আসলেই সত্য নাকি স্বপ্ন? নাকি ভ্রম? সে নিজমনে তানভীরকে নিয়ে সুখের স্বপ্ন সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিনিট দশেকের মাঝে জোনিরার মামা হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। তাঁর মুখটা অস্বাভাবিক, থমথমে ভাব। তিনি ভাঙা গলায় বললেন,
–“তানভীরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লঞ্চে আরেকজনকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজেই সমুদ্রে পড়ে গিয়েছে।”
জোনিরার মনে হলো সে এই পৃথিবীর কোথাও নেই। তার দুনিয়াটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসল। এক পলকেই সে জ্ঞান হারালো।

পরিশিষ্টঃ

কক্সবাজারের আকাশ আজ বেশ পরিষ্কার। কাঠফাটা রোদে বালু পা ছুঁতেই তা পুড়ে যাবার উপক্রম। এই কাঠফাটা রোদের দুপুরে বিচের কাছেই, ছাউনিতে তানভীর এবং জোনিরার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ে শেষ করে সবাই চলে গেলেও জোনিরা এবং তানভীর একই স্থানে বসা। বিচের এ পাশটায় মানুষজন নেই। বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও জোনিরা এখনো কাঁদছে, তবে তানভীরের কাছ ঘেঁষছে না। তানভীরের চুল এখনো ভেজা। ভেজা, বালুতে মাখোমাখো গায়ে সে কোনোক্রমে শুধু সাদা পাঞ্জাবিটা জড়িয়েছে। সে যতবার জোনিরার কাছে যাচ্ছে জোনিরা তাকে ততবার দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। জোনিরা ধমক দিয়ে বলল, “ছুঁবে না আমায়! এত বাজে মশকরা কেউ করে?”

তানভীর হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,
–“তো আর কী করতাম? আপনারা আমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারবেন আর আমি দিতে পারব না? আচ্ছা সরি না, কাছে আসো বউ.. দূরে থাকার জন্য তো বিয়ে করিনি।”

–“তোমাকে বিয়ে করাই আমার উচিত হয়নি। লঞ্চ থেকে পড়েছ ভালো কথা, তাই বলে তোমায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এটা কেমন মজা? জীবন নিয়ে এমন মিথ্যাচার! আমার কী অবস্থা হয়েছে ভাবতে পারছ?”

–“সরি, সরি! এই দেখেন কান ধরছি। আমি জানতাম নাকি ওই ফাজিলে আমি নিখোঁজ বলে চালিয়ে দিবে বাসায়। যতক্ষণে যোগাযোগ করলাম ততক্ষণে দেখি ঘটনা বিগড়ে গেছে। এজন্যই তো বিচের পাড়ে এভাবে বিয়েটা সেরে ফেললাম। রাগ করে না জান। শোনো আমার কথা।”

জোনিরা কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। তানভীরও কম যায় না। তাই সে জোনিরাকে আচমকা কোলে তুলে নিজের কোলে বসায়, এমন ভাবে ধরে রেখেছে যে জোনিরা নড়াচড়াও করতে পারছে না। তা দেখে তানভীর এক গাল হেসে বলল,
–“দেখেছেন, যতই আমায় বাচ্চা বলুন না কেন আমি একবার ধরলে আপনি ছাড় পাবেন না। তাই খামাখা আমার সাথে এখন থেকে লাগবেন না।”

জোনিরা চুপসে গেল। হঠাৎ হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে তানভীরকে জড়িয়ে ধরল সে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–“আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম তানভীর। ভেবেছিলাম এই বুঝি তোমাকেও হারিয়ে ফেললাম। নিজেকে খুব অপয়া লাগে আমার। মাকে হারালাম, বাবা থেকেও নেই.. তুমি হারিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম কী করে?”

–“ভালোবাসেন আমাকে?”
–“খুব। তুমি ছেলেটা ছোটো হলেও তোমাকে ঘিরেই আমার দুনিয়া। তোমার মতো আপন আর কেউ নেই আমার।”

তানভীরের মনে হলো সে যেন এক জনমের সুখ একসাথে হাতে পেয়ে গেল। সে নিজের ভালোবাসা দিয়ে তার জোনিরাকে যে জিতে নিয়েছে। তানভীর জোনিরার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
–“কথা দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতীত আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না জোনি। আমি তোমায় ঘিরেই বাঁচব, অনেকদূর যে পথচলা বাকি আমাদের।”

–“আল্লাহ আমাদের কখনো আলাদা না করুক।”
–“আমিন। এখন কী এই রোদেই বাসর সারতে চাইছ? প্লিজ চলো এখান থেকে। বালিতে রীতিমতো আমার গা চুলকাচ্ছে। গোসল দিতে হবে তো!”

জোনিরা হাসল। তানভীরের কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
–“অসভ্য।”
–“এই অসভ্যই এখন ড. জোনিরার একমাত্র বর। উফ, কী যে আনন্দ হচ্ছে না।”

বলেই আবারও জোনিরাকে কোলে নিয়ে সে সমুদ্রের পাড়ে যায়। স্রোতের পানি তানভীরের পা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। তানভীর মুক্ত ঝরা হাসিতে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে বলল,
–“এই দেখো সমুদ্র, আমার ভালোবাসা এখন আমার বউ। আমার একমাত্র বউ!”

জোনিরা লজ্জায় লাল হয়ে আশেপাশে তাকাল। দূরের মানুষরাও এখন এদিকে তাকিয়ে আছে। কী লজ্জা, কী লজ্জা! কিন্তু তার সদ্য বিয়ে করা বরের এক ফোঁটাও লজ্জা নেই, বিন্দুমাত্রও না। চরম অসভ্য সে। আর তার ভালোবাসাতে কার্পণ্য নেই, পুরো খাঁটি।

সমাপ্ত।