মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব-৬০+৬১+৬২

0
5

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#পর্ব_৬০
#ইশরাত_জাহান
🦋
মোহন সরদারকে দাফন করে এসেছে রাজ ও মাহমুদ সরদার।বাড়ির অবস্থা এখন নিরব।মাহমুদ সরদার ভাইয়ের মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছেন।মিলি কান্না করছে তার বাবা মা দুজনেই আজ মারা গেছে।তারেক সামলাতে থাকে মিলিকে।মৌ নিজেও এখন কান্না করছে।মোহন সরদারের মৃত্যুর সময় বাবা বলে সম্বোধন করা হয়।জীবনে এই প্রথম ও শেষ সে তার বাবাকে বাবা বলে ডেকেছে।মাকে তো কাছেই পেলো না।অবশ্য মা যখন পরিচয় জানতে পারে তখন তো তার মধ্যে অনুতপ্ত দেখা যায় না।এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে সোনালী নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।কারাগারে থাকার চেয়ে সে নিজেকে একেবারে শেষ করে দিলো।রাজ ব্যাগ প্যাক করছে।তাকে কাজের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে।মায়া সেগুলো দেখতে থাকে।রাজকে ব্যাগ গোছানোতে সাহায্য করতে থাকে মায়া।রাজ বাইরে যেতে চায়নি।মায়ার কথায় সে রাজি হয়।মায়ার ভাষ্যমতে,”তুমি এখন দেশের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছো।তোমার মায়াবতী ছাড়াও আরো এক দুনিয়া আছে তোমার।আর ওটা তোমার দেশের অসহায় জনগণ। এদেরকেও তো রক্ষা করতে হবে।তুমি কাল খুলনায় যাও।আমি এদিকটা সামলাতে পারবো।তোমার মায়াবতী কিন্তু ভীতু না।সে একজন বাঘিনী।”

মায়ার কোমর ধরে টেনে রাজ নিজের কাছে এনে বলে,”আমি আমার বাঘিনীকে খুব ভালো করেই জানি।বাঘিনীর এক একটা গর্জন যে এই সরদার বাড়িকে কাঁপিয়ে তোলে । এটাই তো তার আস্ত এক প্রমাণ।আমার কথা এটা না।কাকা মারা গেছে।আমাদের বংশীয় ব্যবসাটা আবার ওপেন করতে হবে।সাথে মায়ের ফর্মুলা সপরিবারে একসাথে পাবলিক করতে হবে।আদ্র আসবে সিয়ার জন্য প্রস্তাব নিয়ে।এখন এই সময়টাতে কিভাবে বের হই?”

মায়া আশ্বস্ত দিয়ে বলে,”চিন্তা করোনা তো।আমি তারপর তোমার আরো পার্টনার তো আছে।তুমি আসার পর ফর্মুলা পাবলিক করা হবে আর সিয়াকে দেখতে আসবে।এখন তুমি যাও।ওদিকটার লোকেদের সেবা করাটাও তো তোমার কর্তব্য।”

“অনলি ফর মায়াবতী।আমার মায়াবতীর ইচ্ছাটাই তাহলে পূরণ হোক।”
বলেই মায়াকে কোলে নেয় রাজ।ভুলে যায় সারা দিনের কথা।

সিয়ার থেকে মোহন সরদার ও সোনালীর কুকর্মের কথা শুনলো হিয়া।তবে পুরোটা না।সোনালী যে ড্রাগ সাপ্লাই ও নারী পাচার করতো এগুলো শুনলো।মানিকের বিষয়ে জেনে হিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যায়।তারপর সবাই মিলে একসাথে মানিকের সাথে কথা বলে।মানিক একটি আশ্রমে বড় হয়।প্রাপ্ত বয়স হতেই তাকে নিজের দুই নাম্বার ব্যাবসায় ছোটখাটো কর্মচারী করে রাখে বিভান।জিনিসপত্র আনা নেওয়ার কাজ এক কথায় সার্ভেন্ট এর সমস্ত কাজ মানিক করত।মানিক একটু বুঝ হবার পর থেকে জানতো তার কোনো পরিবার নেই।বিভান ওকে আশ্রম থেকে আনার পর কাজ দেয় তাই বিভানকে মহৎ ভাবতো মানিক।মালিনীর থেকে আসল সত্যি জানার পর রুদ্র ও জেসি গিয়ে বিভানের ব্যাবসা সম্পর্কে লন্ডনের পুলিশের কাছে প্রমাণ সহ সবকিছু জানিয়ে দেয়।বিভানের লন্ডনের অনৈতিক কাজ বন্ধ করা হয়।এরপর মানিককে সবকিছু খুলে বলে রুদ্র ও জেসি।রুদ্রর কার্ড দেখে ওকে বিশ্বাস করে মানিক।বাংলাদেশে আসার পর রুদ্র আবার মিথ্যে সেজে যোগ দেয় সোনালীর কাজে। আর মানিককে রাজ নিজের মতো আলাদা স্থানে রেখে দেয়।অন্যদিকে মালিনী ও মায়া মিলে অভিনয় করতে থাকে সোনালী ও বিভানের সামনে।জাতে করে মানিকের সম্পর্কে কোনো সন্দেহ সোনালীর না হয়।

সকালে,
কাজের সুত্রে ঢাকার বাইরে যাবে বলে রেডি হচ্ছে রাজ।মায়া তাকিয়ে আছে রাজের মুখের দিকে।রাজ এটা দেখে ম্লান হেসে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো বউকে রেখে যেতে ইচ্ছা করবে না মায়াবতী।বউকে দুষ্টুভাবে পেতে চায় মন।”

চোখ ছোট ছোট করে মায়া বলে,”এভাবে তাকিয়ে থাকতেই তোমার মধ্যে বান্দর নাচ শুরু হয়ে গেছে।”

মায়ার হাত ধরে নিজের কাছে এনে রাজ বলে,”বউ ছাড়া একমাস একা থাকব।এই শাহমীর রাজের বক্ষ যে থাকবে শূন্য।এটা কি তুমি বুঝো?”

“তোমাকে ছাড়া এই মায়াও যে শূন্য মন্ত্রী মশাই।তবে সবার ভালোর কথা চিন্তা করতে হবে তো।”

“জনগণের সেবা করার পর আমি সুযোগ পাবো তো?”

“কিসের?”

“বাথরুম বিলাসের।”(দুষ্টু হেসে রাজ বলে)

মায়া অবাক হয়ে যায়।সিরিয়াস মোমেন্টে এসেও রাজকে এমন বলতে হবে।রাজের বুকে আলতোভাবে মার দিয়ে মায়া বলে,”লাগাম দিতে শিখুন মন্ত্রী মশাই।”

“লাগাম দিলে তো বউ পাওয়া যায় না।তাই আমি লাগাম দিবো না।এই মন্ত্রী মশাই লাগামহীনই থাকবে।তাহলে দিনে চারপাঁচ বার করে বাথরুম বিলাস করতে পারব।”

“আপনি কি আর কোনো জায়গা পান না?এই এক বাথরুম বিলাস।কি বিশ্রী লাগে!”(নাকমুখ কুঁচকে বলে)

“শোনো মায়াবতী আমার এই বাথরুমে ইয়া বড় একটা বাথটাব আছে।যেটার পিছনে লাখ টাকা খরচ করেছি আমি।বলি টাকা কি আমার গাছে ফলে যে বউ নিয়ে লাখ টাকার বাথটাব থুয়ে অন্য জায়গায় রোমান্স করবো!তাই আমি ওই বাথটাবে বসেই তোমার সাথে বাথরুম বিলাস করবো।যে যা বলে বলুক মন্ত্রী তার টাকা উশুল করেই ছাড়বে।দেখি কার বাপের কি?”

“হয়েছে এবার চলুন।”

“বাথরুম বিলাসে?”

“আরে ধুর না।আপনাকে তো এখন যেতে হবে।বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।”

“কাজ শেষ করে এসে বাথরুম বিলাস করতে দিবে তো,মায়াবতী?”

মায়া কিছু বলতে যাবে ওমনি ওদের গেটে নক করে পিয়াশ।রাজ ঘুরে দাঁড়ায় দরজার দিকে। পিয়াশকে দেখে বলে,”বউকে কি রোমান্টিক বিদায়টাও দিতে দিবে না পিয়ু বেবী?এত জেলাস তুমি আমার মায়াবতীর প্রতি!”

পিয়াশ বিষম খেলো।এই রক্তবতী আকারে মায়াবতীর প্রতি জেলাস ফিল।তাও আবার বেচারা পিয়াশ!আদৌ সম্ভব? পিয়াশ বলে ওঠে,”আসলে আপনার গাড়ি চলে এসেছে।সময় হয়ে গেছে তো তাই।”

পিয়াশের দিকে কিলার লুক দিয়ে রাজ বলে,”বেচে গেছো তোমার বউ এখন তোমাকে বাবা ডাক শোনাবে।তানাহলে আমার শ্যালিকা থেকে তোমাকে আলাদা করে ওর জীবনে বেটার কোনো ছেলে এনে দিতাম।”

বিড়ালের মত মুখ করে পিয়াশ।রাজ এটা দেখে বলে,”অন্তত এই শিক্ষা তুমি পেতে যে একজন বরের কাছ থেকে তার বউকে আলাদা করলে কেমন ফিলিংস হয়।তুমি যখন আমার আর মায়াবতীর রোমান্সের সময় হাজির হও তখন মনে হয় এক ভিলেন এসে আমাদের জীবনে ধীন তানা বলে বর্জ্যপাত শুরু করেছে।”

নাদান এক অসহায় ছেলেকে রাজ ভিলেন বানিয়ে দিলো।পিয়াশ বেচারা পারছে না মুখের উপর মুক্ষম জবাব দিতে।কিন্তু সে মনে মনে ঠিকই কয়েকটা গালি দিয়েই দেয়।মনে মনে আওড়ায়,”ব্যাটা লুচ্চা মন্ত্রী।তুই তোর বউকে নিয়ে যা খুশি কর আমি কোথায় বাধা দেই?আমি তো কাজের সিডিউল অনুসারে তোর কাছে আসি।বলি তোর কাজে হেল্প করলেও বলবি বউ থেকে দূরে থাকতে আবার না করলেও বলবি বউ থেকে দূরে থাকতে।আমরা বর বউ তো তোদের জ্বালায় প্রেম করতে পারি না।এর বেলায় কি চোখ গাছে থাকে?”

কিন্তু না কথাগুলো পিয়াশ জোরে জোরে বলতে পারেনি।বেচারার চাকরি যে আর থাকবে না।মায়া তার হাতের কোনা দিয়ে রাজকে আলতো খোঁচা দিয়ে বলে,”মুখে একটু তো লাগাম দিন।আপনার ভাইরা ভাই হয়।এখন চলুন সময় হয়েছে।”

বলেই মায়া চলে যায় বাইরে।রাজ ড্রেসিং টেবিল থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে দিয়ে পিয়াশের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঘরের মধ্যে সানগ্লাস পরেছি কেনো জানো?”

পিয়াশ প্রশ্নবোধক হয়ে তাকিয়ে আছে রাজের দিকে।রাজ যেতে যেতে বলে,”তোমাদের মত নির্বোধ যারা রোমান্স করতে পারে না উল্টো রোমান্সের বারোটা বাজায় তাদেরকে ইগনোর করতে।আই ইগনোর ইউ পিয়ু বেবী।”

ভেবাচেকা খেয়ে গেলো পিয়াশ।রাজ ওটা দেখে দুষ্টু হেসে বলে,”সারাদিক ভেবাচেকা খেয়েই পেট ভড়াবে।তোমার জীবনে কোনো উন্নতি হবে না।চলো এবার।”

বলেই চলে যায় রাজ। পিয়াশ ওখানে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,”এই জন্যই তো বিয়ের তিন মাসের মাথায় আমি বউকে প্রেগনেন্ট বানিয়েছি।ব্যাটা মন্ত্রী লু চু কথা বলেও বাবা হতে পারলি না।দম থাকলে আগে বাবা হয়ে আমার সামনে আয়।তারপর নাহয় দেখা যাবে কে রোমান্সে পটু।”

সিড়ির কাছে যেয়ে রাজ তার পা চালানো থেমে দাড়ায়।পিছনে ঘুরে নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে পিয়াশ দাড়িয়ে আছে।রাজের এভাবে থেকে যাওয়া দেখে পিয়াশ ঘাবড়ে যায়।রাজ এক চোখ টিপ দিয়ে বলে,”আমি দুনিয়ায় আর কারো মনের কথা বুঝি বা না বুঝি তোমার মনের কথা খুব ভালোভাবে বুঝি পিয়ু বেবী। টেনশন নট কাজ শেষ করে ফিরে আসি একবার।তোমাকে আমি আংকেল বানিয়ে ছাড়বো।তখন হবে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।এই শাহমীর রাজের পুরুষত্বে আঘাত করেছো তুমি।তোমাকে ফেইল করে দিবো আমি।”

চলে যায় রাজ।হাফ ছেড়ে বাঁচে পিয়াশ।তারপর রাজের ল্যাগেজ নিয়ে বের হয়।নিচে এসে রাজ সবার সামনে দাঁড়ায়।মাহমুদ সরদারকে জড়িয়ে ধরে রাজ বলে,”আসি বাবা।”

রাজের মাথায় হাত রেখে মাহমুদ সরদার বলেন,”সাবধানে যেও।তোমার জন্য অপেক্ষা করবে তোমার মায়াবতী।”

রাজ মাথা নাড়িয়ে একটু ভাবুক হয়ে থেমে গেলো।মাহমুদ সরদার ও বাড়ির বাকিরা এটা দেখে বলে ওঠে,”কি হয়েছে?”

রাজ কিছু একটা ভেবে পিয়াশের দিকে তাকালে পিয়াশ পকেট থেকে বের করে বলে,”আমার কাছে ছিলো।কিন্তু আপনি আজকে দিবেন এটা ভাবিনি।”

রাজ বাম ভ্রু উচু করে বলে,”কেনো এটা আজকে দিবো না তো কবে দিবো?”

মায়া সন্দেহ দৃষ্টি দিয়ে বলে,”এটা কি?”

“হানিমুন প্যাকেজ।”

সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে একজন আরেকজনকে দেখতে থাকে।মাহমুদ সরদার বলেন,”এখন তুমি জনগণের সেবা করতে যাচ্ছ।এর ভিতরে বউকে নিয়ে হানিমুনে যেতে চাও!ফিরে এসেও তো যেতে পারতে হানিমুনে।”

অবাক হয়ে রাজ বলে,”তোমাকে কে বলল আমি আমার বউকে নিয়ে হানিমুনে যাবো?”

“তাহলে কার বউকে নিয়ে হানিমুনে যাবে?”(মায়া ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলে)

রাজ মায়াকে দেখে ভয় পাওয়া চেহারা করে বলে,”আরে এটাতে আমার বউ নেই আমিও নেই।মানে এটা আমাদের হানিমুন টিকিট না।”

“তাহলে কার?”

“বাবা মায়ের হানিমুন টিকিট।”

মাহমুদ সরদার বিষম খেলেন।সাথে মালিনী নিজেও।সিয়া হিয়া মুখ টিপে হেসে দেয়।শাহানা পারভীন সোফায় বসে আছেন।এখনও কিছুটা দুর্বল তিনি।রাজের এমন কথা শুনে তিনি নিজেও লজ্জা পান।মালিনী কিছু না বলে শাহানা পারভীনের পাশে এসে বসে।মাহমুদ সরদার তেজ দেখিয়ে বলেন,”লজ্জা করে না এই বয়সে বাবাকে হানিমুনে পাঠাতে?”

“তোমার লজ্জা করে না বউকে ঘরে আটকে রাখতে।মা আমার তোমাকে বিয়ে করে এখনও নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে।মাকে নিয়ে সামান্য হানিমুন করতে পারোনি আবার আসো ছেলেকে লাজলজ্জা শেখাতে?এমন লজ্জা নিয়ে কাপুরুষের মতো ঘরে বসে থাকতে পারবো না আমি।”

“তুমি আমাকে ইনডাইরেক্টলি কাপুরুষ বললে?”

“ডাইরেক্ট বললে কি বাবা ছেলের সম্পর্ক চিরজীবন থাকবে?তাই তো ভয়ে ভয়ে ইনডাইরেক্টলি বলেছি।”

“শাট আপ।”

“ইংলিশ বলতেই তো এটা শিখেছো।বউকে কিভাবে হাসিখুশি রাখা যায় এটা কি আদৌ শিখেছো?শোনো বাবা!লক্ষী বরের মত এখন বউকে নিয়ে হানিমুন করে আসবে।কোনো দ্বিমত শুনতে চাই না।মাকে হ্যাপি রাখাটাও একজন সন্তানের দায়িত্ব।”(শেষের কথাটি রাজ একটু নরম কণ্ঠে বলে)

মাহমুদ সরদার যেনো স্তব্ধ হয়ে গেল।রাজের শেষ কথাটি একদম ঠিক।সে কখনও মালিনীর সাথে বাইরে ঘুরতে যায়নি।এখন যখন সব ঠিক হয়েছে রাজ চায় তার মায়ের জীবনে থেকে যাওয়া কমতিগুলো পূরণ হোক তাহলে তিনি কেনো বাধা দিবেন।স্ত্রী হিসেবে এই অধিকারগুলো মালিনী পায়।মালিনী মলিন দৃষ্টি দিয়ে দেখছে রাজকে।ছোট বেলায় রাজকে আদর করতে পারেনি।মানিককে নিয়ে চিন্তায় থাকে সে।একদিকে বরের মৃত্যুর শোক আরেকদিকে ছেলে।মাথা কাজ করেনি তার।কিন্তু রাজকে তিনি ভালোবাসেন।রাজের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকেন।ঠোঁট কামড়ে কান্না করতে করতে রাজের কাছে এসে রাজের মাথায় হাত রেখে বলে,”আমি তোর ভালো মা হতে পারিনি।কিভাবে হবো বল?আমি যে শুধু আমার ছেলেটাকে নিয়ে ভেবেছিলাম।ওকে নিয়েই আতঙ্কে থাকতাম।তোকে আমার বোনের শূন্যতা পূরণ করে দেইনি।আমার প্রতি অনেক অভিযোগ তোর তাই না?”

মানিক দেখলো এই দৃশ্য।তার নিজের কাছেও খারাপ লাগছে।সে তো এসবের কিছুই জানে না।মায়ের কষ্টটা দেখে তার নিজেরও খারাপ লাগছে এখন।রাজ মলিন হেসে মালিনীর হাত ধরে বলে,”মায়ের প্রতি কোনোদিন অভিযোগ রাখা যায়? মা তার সন্তানকে ইচ্ছা করে দূরে ঠেলে রাখেনা।কোনো কারণ না হলে কি কেউ এমন করে?আমি কোনো অভিযোগ রাখিনি তোমার প্রতি।আমার মনে হয় মানিক নিজেও কোনো অভিযোগ করবে না।”

মানিক এগিয়ে এসে বলে,”আমি যদি জানতাম আমার মা আমার জন্য অপেক্ষায় আছে।আমার একটা পরিবার আছে।বিশ্বাস করো অনেক আগেই ছুটে আসতাম।ছেলে হিসেবে আমিও আমার মাকে হ্যাপি রাখতে পারিনি।”

“আমরা সবাই যে পরিস্থিতির স্বীকার ছিলাম।তবে শেষ ভালো যার সব ভালো তার।”(কথাটি বলেন মাহমুদ সরদার।)

রাজ এবার হাতঘড়ি দেখে নেয়।তারপর পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,”তাহলে আমি আসি এবার।আচ্ছা বাবা হানিমুনে যেয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে আমাদের দেখাবে।এই বয়সে এসে নিজে বাবা না হই বাবার হানিমুনটা তো দেখবো।”

“তোমাকে কে বলেছিলো আমাদের জন্য হানিমুনের ব্যাবস্থা করতে?”

“ছেলে হয়ে আমার একটা দায়িত্ব থাকে।বাবা মা নিরামিষ জীবন কাটিয়ে এখন একটুতেই ঝগড়া করে মাথা ফাটাবে।এই বয়সে এসে ছেলে হয়ে এসব দেখতে তো আমার বুকটা ফেটে যায়।”

“তোমার বুকটা একটু বেশি ফেটে যাচ্ছে।”

রাজ কথা না বাড়িয়ে মাহমুদ সরদারের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,”শোনো বাবা,হানিমুনে যেতে দিচ্ছি মানে এই না যে নিজের বয়সের সীমা লঙ্ঘন করে দিবে। খবরদার বাবা হওয়ার বয়সে আমাকে ভাই বানাবে না।ছেলে নির্যাতন কেসে ফাঁসিয়ে দিবো কিন্তু তাহলে।হানিমুন থেকে এসে একদম প্রস্তুতি নিবে তোমার নাতি নাতনির সেবা করার জন্য।

মাহমুদ সরদারের মন চাচ্ছে এবার দেওয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে মারা যেতে।রাজকে উদ্দেশ্য করে বলেন,”থ্রেট দিচ্ছ তুমি আমাকে?বাবা হই আমি তোমার।”

“আমি তো জানি তুমি আমার বাবা।এতবার পাবলিক করতে হবে না।বেশি পাবলিক করলে লোকে আবার সন্দেহ করে বসবে।তখন আমার ছেলে মেয়েরাও তোমাকে দাদা বলতে নাকোজ করবে।”

দুই হাত এক করে মাহমুদ সরদার বলেন,”পুত্র আমার তাড়াতাড়ি বিদায় হও।তুমিই হবে বাবা।আমি হবো দাদা।তাও তোমার মুখে লাগামহীন কোনো কথা শুনতে আমি রাজি না।”

রাজ দুষ্টু হেসে চলে যায় বাইরে।গাড়িতে উঠে বসে।জানালা দিয়ে মায়াকে দেখে হাসি দিয়ে বাড়ির সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায়।মায়া মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে বলে,”বাই মন্ত্রী মশাই।”

গাড়ি চলতে শুরু করেছে।রাজ এখনও দেখছে মায়াকে।মায়া নিজেও দেখছে রাজকে।রাজের গাড়ি চোখের আড়াল হতেই মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় মায়ার।

চলবে…?

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#পর্ব_৬১
#ইশরাত_জাহান
🦋
শাহানা পারভীনের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে মায়া।খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন শাহানা পারভীন।রাজ যাওয়ার পর থেকে শাহানা পারভীনকে নিয়ে মায়া নিজের বাসায় থাকে।সরদার বাড়িতে থাকার জন্য সবাই অনেক অনুরোধ করেছিলো।কিন্তু শাহানা পারভীন নিজের আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে থাকেন নি।তার ভাষ্যমতে,”যে বাড়িটা এখন আমার মেয়ের শশুরবাড়ি যে বাড়িতে আমার পরিচয় নিঃশেষ হয়ে গেছে,সেই বাড়িতে থাকার কোনো মানে নেই।আমি আমার মেয়ের কষ্টে গড়া বাড়িতেই থাকবো।”

অগত্যা কেউ কথা বাড়ালো না।এই একমাস শাহানা পারভীন আর মায়া একসাথে সময় কাটিয়েছে।কাল রাজ আসবে।এছাড়া সিয়াকে দেখতে আদ্রর দাদা দাদী আসবেন।তাই মায়া সরদার বাড়িতে চলে যাবে।শাহানা পারভীনের হাঁটুর উপর হাত রেখে তার উপর মাথা রাখা।ওই অবস্থায় মায়া বলে,”কাল মন্ত্রী মশাই আসবে।আর তারপর তোমার সাথে এভাবে থাকতে পারবো না।তুমি কি একা একা থাকতে পারবে মা?”

মায়ার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শাহানা পারভীন বলেন,”কেনো পারবো না?একটা না একটা সময় তো আমাদের একাই থাকতে হবে।আজ নাহয় কাল একা থাকার জন্য নিজেকে অভ্যস্ত করা উচিত। তুই নিজেও তো একা ছিলি।”

“না মা।আমি একা ছিলাম না।আমার সাথে হাসি ছিলো।তোমার মত করে আমার ঢাল হয়েছিলো।কিন্তু আফসোস!ছেলের প্রতারণার শিকার হলো।এমন সন্তান না জন্মানো ভালো,যে তার মাকে খুন করে।”

শাহানা পারভীনের চোখের সামনে হাসির মুখটা ভেসে উঠলো।কখনও ভুলতে পারবে না হাসিকে।হাসি ছিলো বলে মায়া আজ নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে।শাহানা পারভীনের মত করে মায়ার সাথে ছিলো হাসি।একসাথে তিনজনকে সামলানো কম কিছু না।কিছু একটা ভেবে মায়া বলে,”আচ্ছা মা ওইদিন রাতে তুমি সরদার বাড়িতে কেনো গিয়েছিলে?মানে তুমি তো বলেছিলে আমাদের শত্রুদের আগে শাস্তি দিয়ে তারপর ঐ সিক্রেট রুমে যাবে।কারণ ওই রুমের কথা কেউ জানে না।ফর্মুলা ওই রুমটাতেই সেফ।তাহলে আমাদের কাউকে না জানিয়ে কেনো গিয়েছিলে তুমি?”

শাহানা পারভীনের মনে পড়ে গেলো পুরোনো কথা।বলতে থাকেন সেদিনের ঘটনাগুলো।
“তুই ঢাকায় আসার পর শাহমীর আসে।ঠিক তার কয়েক মাস পর শাহমীর চলে যায় সিলেট।বড়ভাই(মাহমুদ সরদার)আমার কাছ থেকে তোর খোঁজ নিতেন। শাহমীর আর তোর বিয়ে নিয়েই কথা বলি আমরা।শাহমীর গ্র্যাজুয়েশন করেছে আর তোর আঠারো বছরে পা দিলে তোদের বিয়ে দিবো।কিন্তু এর মধ্যে শাহমীরের ইচ্ছা ছিলো দেশের সেবা করাটা।মানে মন্ত্রী হবে।আইডল হিসেবে নিজের নানাকে দেখেছিলো।কিন্তু চলাফেরার ধাচ ছিলো তোদের দাদুর মত।যেহেতু তখন দেশে এসেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ে তাই ওকে বেশি প্রেশার দিতে চাইনি। আমিই বড়ভাইকে বলেছিলাম যে আগে শাহমীর ওর সব ঝামেলা শেষ করুক তারপর বিয়ের কথা উঠবে। শাহমীর তো তোকে দেখার জন্য উতলা হয়ে থাকতো।প্রায় প্রায় তোর জন্য আমাদের শিবচরে আসতো।এদিকে আমি আর তুই মিলে ঢাকায় একটা কোম্পানি ওপেন করার চেষ্টায় থাকি।এভাবে চলতে চলতে কোম্পানি ওপেনিংয়ের অর্ধেক কাজ হয়।একদিন আমার কাছে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে।আমি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে,”সিক্রেট রুমের খোঁজ সোনালী পেয়ে গেছে।”

কলটা আসে মালিনীর ফোন থেকে।আমি ভেবেছিলাম মালিনী বলেছিলো কথাগুলো।কয়েক বছর হয়ে যায় ওর ভয়েস শুনিনি।তাই চিনতেও পারিনি যে ওটা সোনালী ছিলো।আমি ছুটে যাই ওই বাসায়।মালিনীর ব্যাপারে আমি তখনও কিছু জানতাম না।আমি জানতাম ও এসবের ভিতরে নেই।হয়তো পরে সব জেনে আমাকে খোঁজ দিয়েছে।কারণ আমার সাথে অল্প স্বল্প কথা হতো।মালিনী প্রায় চুপ থাকতো।ব্যাপারটা কেমন যেনো লাগতো আমার কাছে।কল দিয়ে চুপ থেকে আবার কল কাটা আমি কিছুই বুঝতাম না।ওই বাড়িতে আমি বউ হয়ে যাওয়ার পর একবার বলেছিলো,”এই সংসারে এসেছো ভালো কথা।বুঝেশুনে পদক্ষেপ রেখো।এখানে কুকুর শেয়ালের হামলা আছে।”

আমি না ওর ওই কথাগুলোকে বুঝে উঠতে পারতাম না।প্রায় অন্য মনষ্ক থাকতো ও। শাহমীরকে তেমন দেখতো না।মা ছাড়া শাহমীরকে দেখলেও মায়া লাগতো।তাই আমি ওর সাথে বেশি থাকতাম।তখনও মালিনী আমাকে বলত,”নিজের লোকের দিকে নজর দেও।”

আমি ভাবতাম ও হিংসা করছে তাই এমন বলে।সরদার বাড়ি থেকে আসার পর একদিন আমাকে কল দিয়ে অনেক কান্না করে।কিন্তু কিছু বলতে পারে না।শুধু কান্না করে।আমি তখনও বুঝিনি কিছু।ওদিকে রুদ্রের কথা জানার পর ওর বাবা মাকে সাহায্য করতে থাকি।তখন মালিনী আমাকে একটা এসএমএস দেয়।লেখা থাকে,”যা করবে সাবধানে।কিছু ভিডিও আর ছবি দিচ্ছি এগুলো তাড়াতাড়ি নিজের কাছে সেভ করে রাখো।আমি ডিলিট করে দিবো।আর হ্যাঁ আমাকে কল করে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।এই বাড়ির চারপাশে সবার কান পাতা থাকে।আমি কোনো কিছুই বলতে পারবো না।আমি নিজেও হাত পা বেঁধে আছি।”

মালিনীর ম্যাসেজের বানান অনেক ভুল।বোঝা যায় দ্রুত লিখেছে।আমি তখন বুঝতে পারলাম মালিনী নিজেও এসবের মধ্যে ফেসে আছে।নাহলে এভাবে নিজে থেকে কেনো বললো।ওই প্রমাণ পেয়েই আমি পুলিশ নিয়ে ডাক্তারদের ধরিয়ে দেই।এই ভুলের জন্য তখন এলার্ট হয়ে যায় সোনালী।সবকিছু না জানলেও শত্রু দমন করতে হবে এটা বুঝে যায়।তাই তখন শেষ করে দেয় আদ্র রুদের বাবা মাকে।সেদিন যখন সবাই লাশ নিয়ে কান্নাকাটি করে মালিনী আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে বলে,”প্রমাণগুলো তোমাকে দিয়েছিলাম যাতে তুমি রুদ্রকে নিয়ে যেতে পারো।তুমি এই ভুলটা না করলেও পারতে।এই রকম যদি সবকিছু কাছে পাওয়া যেতো তাহলে আমি আজ চুপ থাকতাম না।এরা অনেক ধূর্ত।এদের দমন করা সহজ না।আমরা যাই করবো এরা তার থেকেও কয়েক কদম এগিয়ে।দয়া করে এখন আর কিছু করো না।আমি শেষ হয়ে যাবো।”

মালিনীর এমন ম্যাসেজ দেখে আমি সিদ্ধান্ত নেই ওদের মত করেই আড়ালে ওদের শেষ করতে হবে।তাই অদ্রকে পাঠিয়ে দিলাম ওর দাদা দাদীর কাছে আর আমরাও চুপ থাকলাম।যেহেতু ওই বাড়িতে কোনো কথা আড়াল থাকে না সব সোনালী জেনে যায় হিডেন ক্যামেরার জন্য তাই আমিও চুপ হয়ে যাই।কিন্তু সোনালীর পিছনে লোক রাখি।ধীরে ধীরে সোনালীর ব্যাবসায় লস হয়।এই যেমন নারীগুলোকে পাচার করতে পারে না।তার আগে পুলিশ হাজির হয়।ড্রাগ সাপ্লাই করার আগে পুলিশ খবর পেয়ে যায়।তাই তখন সোনালী ওর এই কাজগুলো বন্ধ করে দেয়।খোঁজ করতে থাকে আমাকে।সেদিন মালিনীর ফোন দিয়ে আমাকে কল দিয়েছিলো।কারণ সোনালী জেনে যায় মালিনী আমাকে এলার্ট করেছে।মালিনীর ফোনে সব ডিলিট হলেও আমার দেওয়া শেষ ম্যাসেজটি সোনালী দেখে নেয়।কারণ আমি ম্যাসেজ করার সাথে সাথে সোনালী ফোন নিয়ে দেখে ফেলে।যার ফলে মালিনী বিপদে পড়ে যায়।সোনালী আমাকে ফ্যাক কল দেয়।আমিও ছুটে যাই ওই রাতে।ওই বাড়িতে যেয়ে যখনই আমি ওই রুমের দিকে যাবো আমার হাত ধরে টান দেয় মালিনী।আমি অবাক হয়ে যাই।এক এক করে আমাকে সবকিছু খুলে বলে মালিনী।সাথে এটাও বলে,”মিনার মারা যাওয়ার আগে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে যায় যেটা আমার বাবার বাসায় পৌঁছায়।সেই চিঠি বিভান পেয়ে যায়।ওখানে মিনার লিখেছিলো,”রোহিনী এই ফর্মুলা রাজের দাদুর কাছে রেখেছে।যেই লকারে রাখা আছে ওটার পাসওয়ার্ড রাজের দাদু জানে।কারণ রোহিনীর মৃত্যুর দিন রোহিনী ওটা ওর শ্বশুরের কাছে দিয়ে বাইরে যায়।আর রোহিনীর গাড়ি ব্লাস্ট হয়ে যায়।যেটা বিভান করিয়েছে।রাজের দাদু ওটা নিজের সিক্রেট রুমে রেখেছে।এই রুম কোথায় অবস্থিত আমি জানি না।আমি বেঁচে থাকব কি না জানি না।আমার বাবা মাকে ওই বিভান শেষ করে দিয়েছে।আমি তোমার বোনের সাথে কোনো বাজে সম্পর্কে ছিলাম না।বিশ্বাস করো তোমাদের রূপ একই হলেও আমার মন সব সময় তোমাকে চেয়েছে।তোমার ভিতরের চঞ্চলতা আমাকে উন্মাদ করে দিত।ইচ্ছা ছিলো এই ফর্মুলা দেশের কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিয়ে তোমাকে নিয়ে সুখের রাজ্যে পারি দিবো।দেশের মানুষ ফ্রেশ খাবার খেয়ে রোগমুক্ত থাকবে।এটা মনে হয় পূরণ হবে না।সাথে তোমাকে নিয়েও আমার আর সংসার করা হলো না।তুমি আমার জীবনে ফিরে আসো বা না আসো এই ফর্মুলা বাজে লোকদের থেকে বাঁচিয়ে রেখো।আমাদের দেশের খাদ্যের মধ্যে এখন এত ভেজাল যে দেশের লোক এখন ভিন্ন রোগে ভুগছে।আমি একজন কৃষি বৈজ্ঞানিক হিসেবে এই দেশের সুরক্ষা চাই।বিদেশে এটা বিক্রি করে দেশের ক্ষতি করতে চাই না।অন্তত নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে পারব না।কেউ যেনো ফর্মুলার অসৎ ব্যাবহার না করে এটা দেখো।”

এই চিঠি বিভান বাংলাদেশ এসে দেখতে পায়।বছর কয়েক পর দেশে এসে ঘুরে যেতো।ঠিক তখন বিভান জেনে যায় সব।কারণ বাবা(রাজের দাদুর) ফোন বিভানের কাছে ছিলো।আমিও জানতাম না বাবা কাকে কল করে সব বলেছে।বিভান সন্দেহের বসে আবার যায় বাবার কাছে।তখন শুনে নেয় শেষের কথা।তারপর বিভান কিছু বলার আগে বাবা মারা যান।ওই ফোনটা সূত্র হিসেবে রেখে দেয়।বাবার লাস্ট কল নাম্বার আর আমার ফোনের ম্যাসেজে তোমার নাম্বার একই।এটা দেখে সোনালী আর বিভান বুঝে যায় তুমি সব জানো।ওইদিন থেকে প্ল্যান করে তোমাকে খোঁজ করার।আমার সাথেও মানিককে আর দেখা করতে দেয় না।যা একটু ভিডিও কলে মানিকের পিছন পাশ বা ওর অস্তিত্ব দেখতাম তাও বন্ধ হয়ে যায়।রাজ এসেছে বলে সোনালী সাবধানে চলেছে এই কয়দিন।আমার ফোন ওর কাছে ছিলো।তাই আজকে তোমাকে ও ফ্যাক কল দিয়েছে।তুমি পালিয়ে যাও।এই রুমের খোঁজ ওরা পেলেও পাসওয়ার্ড তুমি না বলা অব্দি ওরা ফর্মুলা পাবে না।তুমি পালাও বোন।তোমার মোহকে নিয়ে দূরে থাকো।”

মালিনীর কথা শেষ হতে না হতেই আমার চোখ যায় সোনালীর দরজার দিকে।যেখানে আমি সোনালীর অবয়ব দেখছিলাম।কিছু মাথায় আসেনি আমার।আমাকে যাতে পাসওয়ার্ড নিয়ে বেশি কিচ্ছু না বলে তাই আমি বলি,”আমি তো পাসওয়ার্ড জানি না।ওইদিন মোহর সাথে ওর দাদু কথা বলেছিল।পাসওয়ার্ড আমি না মোহ জানে।”

আমি তখন এগুলো বলেছিলাম কারণ তোর নাম এখন মায়া।তোকে ওরা খুঁজে পাবে না। তাই আমি তোর নামে সব বলে দেই। আর তুই তো শিবচরে যাবি না।ওরা আমাদের ফ্যাক্টরির খোঁজ পাবে না।কারণ আমার ফ্যাক্টরির নাম প্লাটানো হয়।যেটা তোর নামে।তাই কেউ সন্দেহ করতে পারবে না যে মায়া আসল মোহ।সোনালী তখন হামলা করলো আমাকে মেরে ফেলার জন্য।আমি তখন ওখান থেকে পালিয়ে যাই।সুযোগটা আমাকে মালিনী করে দেয়।ও সোনালীর সামনে এসে বাধা দিতে থাকে।তখন আমার পিছন থেকে শুট করে দেয় সোনালী।দ্বিতীয়বার শুট করতে যাবে সোনালীর হাত ধরে বাধা দেয় মালিনী।ওই সুযোগে আমি পালিয়ে আসি।তোকে কল করে কিছু কথা বলি।কিন্তু আমার গায়ে শক্তি কমে আসে।তাই স্পষ্ট কিছু বলতে পারি না।তোর সাথে কথা বলতে বলতে আমার মাথায় আঘাত অনুভব করি।পিছনে তাকিয়ে দেখি সোনালী আর ওর লোকজন।বাবাকে মেরে ওরা বাবার ফোন কালেক্ট করে শত্রু ধরার সূত্র পেয়েছে।আমি এই ভুল করতে চাই না।তাই আমি সাথে সাথে ফোনটা দূরে ছুড়ে মারি। যাতে ওদের নাগালে না আসে।ওরা ফোনটা পেলে জেনে যেতো যে তুই মোহ।”

“আজ সবকিছুর দমন হয়েছে তাই না মা?”

“হ্যাঁ।কিন্তু আমাদের শত্রু দমন হলেও পৃথিবীতে এমন অনেক নিকৃষ্ট ব্যাক্তি আছে যাদের দ্বারা অন্যরা বিপদে আছে।”

“আমার হাতে যদি এমন ক্ষমতা থাকতো যে ওই নিকৃষ্ট লোকদের ধরে মেরে ফেলব আমি সত্যি তাই করতাম।”

“তুই তো তাই করিস।আমি কোমায় থাকলে কি হবে তোর সব কথা শুনতাম।আমার মেয়ে যে কি না ছিলো সহজ সরল সে যে এতগুলো অন্যায়ের বিচার করে এটা ভেবেই আমি অবাক লাগে।”

“যাদের হাতে আইন কেনা থাকে তাদেরকে এভাবেই দমন করতে হয় মা।”

শাহানা পারভীন মায়াকে আদর করতে করতে বলেন,”আমার মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে।বিয়েও হয়েছে তার।এখন আমি নানু ডাক শুনতে চাই।”

“হ্যাঁ শুনবে তো।আমাদের মৌয়ের ছেলেটা বড় হোক তোমাকে নানু বলবে।”

“আমার সামনে বোকা সাজা হচ্ছে না?তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছ আমি কি বলছি।তোমার স্বামীও তো তাই চায়।”

মায়া আলতো হেসে বলে,”তোমাদের ইচ্ছাটাও যদি পূরণ হয় কেমন হবে মা?”

“আমি তো অনেক খুশি হব।আমার মৌ মা তো ছেলে জন্ম দিয়েছে।এখন মায়া মা কি জন্ম দিবে দেখার বাকি।তোদের পরিপূর্ণ সংসার দেখতে পেলেই আমি খুশি।”

শাহানা পারভীনের হাত মায়া নিজের পেটের উপর রেখে বলে,”এখানে তোমার নাতি বা নাতনী আছে মা।”

খুশি হয়ে শাহানা পারভীন বলেন,”তুই আগে বলিসনি কেনো?”

“ভেবেছিলাম মন্ত্রী মশাই আসলে জানাবো।ও তো কাল আসবে।ওকে সারপ্রাইজ দিবো।কিন্তু তোমার থেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে না।”

শাহানা পারভীন তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলো রান্নাঘরে।যেতে যেতে বলে,”আমি এই রাতেই পায়েস রান্না করব।আমার মেয়ের আজ শুভ দিন।মিষ্টি না খেলে কি হয়?”

মায়া হেসে দেয়।ঠিক তখন মায়ার ফোন ম্যাসেজ করে রাজ,”আমার বক্ষের শূন্যতা পূর্ণ করতে আমি আসছি মায়াবতী।”

মায়া কিছু ইমোজি দিলো।রাজ আবার লিখেছে,”এবার আমি বাবা ডাক শুনেই ছাড়বো।নাহলে জনগণ বলবে মন্ত্রী বাচ্চা দিতে অক্ষম।ওরা তো জানে না মন্ত্রীর বউ মন্ত্রীকে বাবা ডাক শোনানো থেকে বহিস্কার করেছে।এবার নিজের অধিকার আদায় করেই ছাড়বো।আমি বাবা হওয়ার অধিকার রাখি।আমার বাচ্চা চাই।”

“আপনি পাগল হয়ে গেছেন মন্ত্রী মশাই।”

“এই মন্ত্রী শাহমীর রাজের একটাই স্লোগান,বাচ্চা চাই বাচ্চা চাই।বাচ্চা ছাড়া মায়াবতীর উপায় নাই।”

মায়া হাসতে থাকে। পেটে হাত রেখে বলে,”তোর বাবা কাল আসবে।সারপ্রাইজ দিবো দুজনে মিলে।”

তারপর রাজকে ম্যাসেজ দিলো,”তাড়াতাড়ি আসবেন মন্ত্রী মশাই।কাল সিয়াকে দেখতে আসবে আদ্রর দাদা দাদী।আংটি পরিয়ে যাবে।”

চলবে…?

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#পর্ব_৬২
#ইশরাত_জাহান
🦋
নতুন বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে আদ্র আর রুদ্র।চোখ তাদের বাড়িটির দিকে।পাঞ্জাবি পরে দাড়িয়ে আছে একসাথে দুই ভাই।রুদ্র বাড়িটির দিকে চোখ রেখেই বলে,”বাবা মা বেঁচে থাকলে আজ আমরাও একসাথে পুরো পরিবার তোমার বউ দেখতে যেতাম। আর সেটা এই বাড়ি থেকেই।তাই না ভাই?”

বাবা মায়ের চেহারা ভেসে আসতেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো আদ্রর।এক আঙ্গুল উচু করে রুদ্রকে দেখিয়ে বলে,”ওই কোনাটায় একটা ঘর ছিল।ওখানে বাবা মা থাকতো।আমি যখন স্কুলে যেতাম মা ওই জানালা দিয়ে আমাকে দুই হাত নাড়িয়ে বিদায় দিতো।আমি আর বাবা ঠিক এই জায়গাটায় দাড়িয়ে হাসি মুখে মাকে টাটা বলে গাড়িতে উঠতাম।”

“তুমি তো তাও মা বাবার থেকে কিছু মুহূর্ত পেয়েছো।আমি আমার পুরো ছোটবেলাটা হারালাম।না পেলাম আপন বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা না পেলাম পালিত বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা।”

রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আদ্র বলে,”মা তোর জন্য অনেক ছোটাছুটি করেছে ভাই।শেষমেষ নিজের জীবনটাই দিয়ে দিতে হলো তার ছোট ছেলেকে পেতে।”

চোখ বেয়ে পানি পড়লো রুদ্রর।নিজের হাতে পানি মুছে বলে,”চলো ভাবীকে দেখতে যেতে হবে তো।তোমার প্রেয়সীকে পাওয়া তো এখনও বাকি।”

মৃদু হেসে আদ্র বলে,”হুম।দাদা দাদী আসুক আগে।”
বলতে না বলতেই আদ্র ও রুদ্রের দাদা দাদী এসেছেন।একসাথে দুই নাতিকে জড়িয়ে ধরেন তারা।তারপর গাড়িতে উঠে রওনা দেন সরদার বাড়ির দিকে।

আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখে লজ্জাবতী হয়ে আছে সিয়া।পাশেই দাড়িয়ে আছে মিলি ও হিয়া।মৌ বিছানায় বসে ওর ছেলে প্রলয়কে নিয়ে।মায়া তার সাথে খেলছে।সিয়ার মাথায় টোকা দিয়ে মিলি বলে,”এত লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আছিস কেনো?আমরা বোনেরাই তো আছি এখানে।”

হিয়া দুষ্টুমি করে বলে,”বুঝতে পারছিস না?এগুলো আসলে ঢং করছে।ওনার মনে তো প্রথম দিনেই মনে লাড্ডু ফুটেছিল।শুধু অবুঝের ভান ধরে ছিলো।”

সিয়া চোখ রাঙিয়ে বলে,”একটু বেশি বলছিস না তুই?”

হিয়া দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলে,”আমি বেশি বলছি তাই না!তোর তো গাইনোলজি হওয়ার ইচ্ছা ছিলো।তুই অর্থোপেডিক নিয়ে পড়ছিস কেনো বল?”

“আমার ভাগ্যে ছিলো তাই আমি এই সাবজেক্ট নিয়েছি।এটার মানে অন্য কিছু না।”

প্রলয়ের ছোট ছোট আঙুল খুটছিলো মায়া। মাত্র চারদিন আগেই প্রলয় এই পৃথিবীর মুখ দেখেছে।পিয়াশের ছেলের নাম প্রলয় দিয়েছে।এটা পিয়াশের ইচ্ছাতেই হয়েছে।এই ছোট প্রলয়ের নরম তুলতুলে লাল বর্ণের হাত ধরে মায়া ম্লান হেসে বলে,”তোমার ভাগ্যটা তো তুমি নিজে গড়ে নিয়েছো সিয়া।ঠিক যেমন আমি আমার মন্ত্রী মশাইকে পেয়েছি।উদ্দেশ্য না থাকলে তো সফলতা আসে না।”

ভাবীর কথাতে মুখ থেকে কিছু বের হচ্ছে না সিয়ার।হিয়া চশমা চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে,”এখন কি বলবি?গুরুজন কিছু বলেছে বলে চুপ থাকবি তাই না!”

চোখ ছোট ছোট করে লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে সিয়া বলে,”এমন ভাবে বলছিস যেনো তোর সময় আসবে না।আমার পরে তোর টার্ন।মনে রাখিস এটা।”

ভ্রু কুচকে হিয়া বলে,”আমার এমন কেউ নেই যে আমার টার্ন আসবে।বাবা বলেছিলো তো অনেক আগেই যে আমাকে পড়াশোনা করাবে।যেদিন কাউকে ভালো লাগবে সেদিনের কথা ভিন্ন।”

মায়া তাকালো হিয়ার দিকে।হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কিন্তু তুমিও তো ভালোবাসো..”

মায়া কিছু বলতে যাবে তার আগে হিয়া বলে ওঠে,”না ভাবী।ওটা মোহ ছিলো।ভালোবাসা মনে করে আমি আমার ক্যারিয়ার হারাতে চাই না।”

“তুই এভাবে কেনো বলছিস হিয়া?সব তো পাল্টে গেছে।রুদ্র ভাই..”

সিয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হিয়া বলে,”ওনার নামটাও শুনতে চাই না।নষ্ট পুরুষ একটা।আমাকে তো ঠকিয়েছে পুরো পরিবারকে ঠকিয়েছে।প্রতারক নষ্ট পুরুষ।”

কথাগুলো বলতেই হিয়ার চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে।উল্টোদিকে ঘুরে হিয়া চোখের পানি মুছে নেয়।মায়া এসে সিয়ার কানে কানে বলে,”রুদ্রর পরিচয় বলোনি তুমি?”

মাথায় হাত দিয়ে সিয়া বলে,”কিভাবে কি করবো বলো?সেই মেডিকেল যাওয়া আসা আবার মৌ আপুকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হয়। আর ম্যাডাম নিজেও তো কলেজ ভর্তি হয়ে ব্যাস্ত হয়।উপন্যাস ছাড়া আমাকে কখনও সময় দেয় ও।ওর জন্য মার্কেটটাও আমাকেই করতে হয়।ওর তো খালি নিজের জন্য পছন্দ করে ওই উপন্যাসের বই কিনবে।আমি তো ভেবেছি তোমরা বলেছো।”

“আমি আর মিলি তো নতুন করে ব্যাবসার কাজে হাত লাগিয়েছিলাম।অন্যদিকে আমার ফ্যাশন হাউজের ব্যাবসা তো আছেই।অবশ্য আমাদের ব্যাস্ততায় যখন কিছু জানেনি তাহলে আজকে হিয়ার জন্য সারপ্রাইজ থাকবে।”(মায়া বলে ওঠে)

উত্তেজিত হয়ে হাসি দিয়ে সিয়া বলে,”একদম ঠিক বলেছো।আজ হিয়া ওর নষ্ট পুরুষের আসল পরিচয় পেয়ে অনেক বড় সারপ্রাইজ পাবে।”

সবার আড্ডার মাঝেই পিয়াশ এসে বলে,”বস এসেছে ম্যাম।মাত্র গাড়ি ঢুকলো বাড়ির ভিতর।”

রাজ এসেছে শুনে শাড়ি পরা অবস্থায় দৌড় দেয় মায়া।সিড়ির কাছে আসতেই দেখতে পেলো ঘামে ভিজে আছে রাজ।সাদা পাঞ্জাবি ঘামে একাকার।সিড়ির দিকে চোখ যেতেই রাজ তার হাত দুই দিকে মেলিয়ে বলে,”আমার বক্ষে তোমাকে স্বাগতম মায়াবতী।”

শাড়ির কুচীগুলো একটু উচু করে এক এক সিড়ি পার করে রাজের কাছে পৌঁছায় মায়া।এক লাফে জাপটে ধরে রাজকে। রাজও মায়াকে আঁকড়ে নেয় নিজের বাহুডোরে।রাজের কপাল বরাবর মায়ার ওষ্ঠ।মায়া চারপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই।এই সুযোগে নিজের মনের ইচ্ছামত ভালোবাসার পরশ দিতে থাকে রাজের ললাটে।শুধু তাই না বেখেয়ালে রাজের নাকের কোনা এমনকি গালেও ভালোবাসার পরশ একে দেয় মায়া।কিছুক্ষণ এমন করে থেমে যায়।রাজ এবার মায়াকে নামিয়ে মায়ার মুখে দুই হাত রেখে বলে,”আমি একমাত্র মন্ত্রী যে তার বউ দ্বারা অপহরণ হতে থাকে।অবশ্য আমি এটাতে নিজেকে গর্ববোধ করি।”

হেসে দেয় মায়া।জোরে চিল্লিয়ে ডাকে সবাইকে।রান্নাঘরে কাজ করছে মেইড।তাদেরকে তদারকী করে শাহানা পারভীন ও মালিনী।মায়া জোরে জোরে বলছে,”মন্ত্রী মশাই এসেছে।তোমরা সবাই কোথায়?”

মায়ার কণ্ঠ পেয়ে একে একে সবাই বের হয়।একজন সার্ভেন্ট আসতেই মায়া বলে,”মন্ত্রী মশাইয়ের জন্য আমি যে শরবত করেছি ওটা নিয়ে আসো।”

সার্ভেন্ট মাথা নাড়িয়ে নিয়ে আসে শরবত।মালিনী এসে জড়িয়ে ধরে রাজকে।সবার সাথে আলাপ করে রাজ আসে মাহমুদ সরদারের কাছে।মাহমুদ সরদারকে জড়িয়ে রাজ বলে,”তোমাদের প্রত্যেকটা রোমান্টিক পিক আমি দেখেছি বাবা।”

অবাক হয়ে যায় মাহমুদ সরদার।তিনি তো কোনো ছবি বা ভিডিও করেননি। এ ছেলেকে কে দিলো ছবি?রাজকে প্রশ্ন করেন,”কিভাবে?”

দুষ্টু হেসে রাজ বলে,”কি মনে করো তুমি আমাকে?আমি তোমার কেয়ারলেস ছেলে?না বাবা না।আমি দায়িত্বশীল একজন ছেলে।তাই তো তোমাদের পিছনে আলাদা লোক লাগিয়ে রেখেছিলাম।”

চোখ বড় বড় হয়ে যায় মাহমুদ সরদারের।মালিনী এসে কান ধরে টান দেয় রাজের।মাহমুদ সরদার মালিনীকে সাপোর্ট করে বলেন,”আরো জোরে টান দেও কান।বাবা মায়ের হানিমুনে কেউ লোক লাগায়?”

মালিনী কান ছাড়তেই রাজ কানে হাত দিয়ে ডলতে থাকে।তারপর বলে,”এমনভাবে বলছো যেনো আমি তোমাদের পার্সোনাল মোমেন্ট দেখেছি।লাগামহীন হতে পারি কিন্তু বিবেকহীন না।”

“চুপ করো বেয়াদপ ছেলে।যে ছেলে লাগামহীন হয় সে বিবেকহীনের উপরে ছাড়া কম কিছু না।”

“ধুর বাবা।তোমাদের সেফটির জন্য এতকিছু করলাম।আমাকেই করো দোষারোপ!এমনিতে তো বউ নিয়ে কখনও মধুচন্দ্রিমা করবে না।ছেলে হয়ে আমি যেটা করেছি তাতে তোমার গর্ববোধ করা উচিত।এমন ছেলে লাখে একটা।”

“এই লাখ ছেলের একটা ছেলে আমাকে কেনো দিলো খোদা!”

“তোমার বংশের বাতি জ্বালাতে আমাকেই প্রয়োজন বাবা।”

বলেই দৌড়ে নিজের ঘরে গেলো রাজ।মাহমুদ সরদারের ঠিক নেই।এখনই হয়তো ঠাস করে বুড়ো ছেলের গাল লাল করে দিতে পারে।মাহমুদ সরদার কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন,”বিয়ের দুদিন আগেও ছেলে আমার ছিলো অবুঝ খোকা।বউ পেয়ে ছেলে আমার হয়ে গেলো পাকা।”

ফ্রেশ হয়ে রাজ এসে বসলো হলরুমে।এই তো আর পাঁচ মিনিট।তারপর আদ্র ও তার পরিবার আসবে।কল করে খোঁজ নিয়েছে রাজ।শাহানা পারভীন এসে খোচা দিচ্ছে মায়াকে।মায়া মাথা নাড়িয়ে না করতে থাকে।রাজ এটা লক্ষ্য করে বলে,”আমার বউটা হঠাৎ লজ্জা পাচ্ছে কেনো!কিছু কি হয়েছে?”

মায়া এবার শাহানা পারভীনের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার এই লাগামহীন জামাইকে কিছু বলতে সাহস পাই না মা।জনসম্মুখে উল্টা পাল্টা বলে দেয়।”

চোখ ছোট ছোট করে রাজ বলে,”উচিত কথার মূল্য নেই।যাই হোক বলো কি হয়েছে?”

মায়া তার দুইহাত এক করে আঙুল গোটাতে গোটাতে বলে,”এই বাড়িতে নতুন সদস্য আসতে চলেছে মন্ত্রী মশাই।”

রাজ একবার করে সবার মুখের দিকে তাকালো।সব শেষে মাহমুদ সরদারকে আসতে দেখলো।পাশে হাসিখুশি মালিনীকেও।সোফা থেকে এক লাফে উঠে দাড়ায় রাজ।হকচকিয়ে তাকালো বাড়ির সবাই।সিয়া হিয়া মিলি মৌ ওরা এখনও ঘরে।হলরুমে মায়া রাজ সহ বাকি বড়রা আছে।রাজ আতঙ্কের সাথে বলে,”ছিঃ বাবা!তোমাকে আমি দাদু বানাতে চেয়েছিলাম।তুমি আমাকে ভাই বানিয়ে দিলে।এই সমাজে আমি এখন মুখ দেখাবো কিভাবে!লোকে বলবে,বাবা হওয়ার সময় যার সে হতে পারে নাই বাবা।বাবা যার হবার কথা না সে হতে চলেছে আবারও বাবা।”

রাজের কথার কিছু বুঝতে পারল না মাহমুদ সরদার।মায়া বুঝতে পারল ব্যাপারটা।শাহানা পারভীনকে ইশারা করে বলে,”দেখেছো মা?এই কারণেই আমি তোমাদের সামনে ওকে কিছু বলতে চাইনি।ব্যাটা লাগামহীন।”

শাহানা পারভীন এবার রাজকে বলে,”ওরে বাপ তোর বাপ হতে যাচ্ছে না বাপ।তুই হবি বাপ।”

এতবার বাপ বাপ শুনে একটু কনফিউজড রাজ।কিছুক্ষণ মনোব্রত পালন করে আবারও লাফিয়ে বলে,”মানে আপনা টাইম আয়েগা?আমিও এবার বাবা হব?”

লজ্জায় মাথা নিচু করলো মায়া।রাজ খুশিতে মাহমুদ সরদারকে জড়িয়ে ধরে।তারপর সার্ভেন্টকে বলে বাসায় আরো মিষ্টি আনতে।কিছু একটা ভাবতেই রাজের মনে পরে তার তো এখনও এক মাসের দূরত্ব মোচন করতে পারেনি।মনের আবেগে বলে ফেলে,”তাহলে বাথরুম বিলাস এর কি হবে?”

রাজের কথার মাথা মুন্ডু বুঝতে পারল না কেউ।কিন্তু মায়া বুঝতে পারল।ক্ষিপ্ত হয়ে তাকালো রাজের দিকে।রাজ ঠোটটা বাচ্চাদের মত করে তাকালো মায়ার দিকে।মায়া হাতে থাকা ফোন দিয়ে ম্যাসেজ করে রাজকে,”বাচ্চা আসতে চলেছে আমাদের।এখন তো একটু সংযত রাখো নিজেকে।”

“বিয়ের পর বউকে নিয়ে না করতে পারলাম মধুচন্দ্রিমা না ঠিকভাবে হলো বাথরুম বিলাস।এটা তো বিনা বাক্যে বজ্রপাতের মত করে বাচ্চা হাজির হলো।”

“এই তুমি না এতদিন বাচ্চা বাচ্চা করেছো?এখন বাচ্চার বাপ হতে যেয়ে খুশি হচ্ছো না কেনো?”

“বাচ্চা নিবো বলেছি।কিন্তু প্রোসেসিং এত ফাস্ট হয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারিনি।আমি ছক্কা মারতে না মারতেই আমার বাচ্চা আমাকে আরেক ম্যাচ দেখিয়ে দিলো।”

“লাগামহীন মন্ত্রী মশাই।”

চারপাশে ঢাক ঢোল বাজতে শুরু হলো।সবাই বুঝে গেলো আদ্র ও রুদ্র এসেছে।যেহেতু সরদার বাড়ির বিয়ের দেখাশোনার আয়োজন চলছে।তাই তাদেরকে জমজমাট ভাবেই প্রস্তুতি নিতে হয়।গেটের সামনে কিছু লোক রেখে দেওয়া ছিলো।যারা বরযাত্রী দেখলেই ঢাক ঢোল বাজাতে থাকবে।রাজ হাতদুটো উচু করে নাচতে নাচতে জোরে জোরে পিয়াশ ও তারেককে ডেকে বলে,”পিয়ু বেবী চলো তাহলে।তারেক ভাই আসো।আমাদের ভাইরা ভাইকে ওয়েলকাম করতে হবে তো।”

পিয়াশ ও তারেক চলে যায় রাজের সাথে।ঘরে বসে ঢোল বাজার শব্দ পেলো মেয়েরা।হিয়া বলে ওঠে,”ওই দেখ বোন।তোর বর চল এসেছে।”

সিয়া মনে মনে বলে,”শুধু আমার বর না।তোর বরও এসেছে বোন।শুধু তোর সারপ্রাইজের অপেক্ষা।”

গেট থেকে আদ্রদের ওয়েলকাম করে সরদার বাড়ির সদস্য।রাজ পিয়াশ তারেক এখনও নাচতে থাকে।গাড়ি থেকে বের হয়ে রুদ্রও সামিল হয় রাজের সাথে।সবাইকে এভাবে খুশিতে নাচতে দেখে মাহমুদ সরদার খুশি হন।শুধু কল্পনায় ভেসে আসে মোহন সরদারের চেহারা।মোহন সরদার কোনো ভুল না করলে আজ এই মহা খুশিতে তিনিও থাকতেন।বাবা হারানোর পর এক চাপা কষ্ট থাকে মাহমুদ সরদারের মনে।আজ ভাই মারা যাওয়াতে একই কষ্ট হচ্ছে তার।হিয়া আর মিলি চলে এসেছে হলরুমে।সিয়ার কাছে মৌ আছে।সিয়াকে ডাকলেই মৌ তাকে নিচে নিয়ে আসবে।খুশিতে খুশিতে নিচে নামে হিয়া ও মিলি।হলরুমে এসে বসেছে আদ্র রুদ্র ও তাদের দাদা দাদী।হিয়া ও মিলি এসে সালাম দিলো তাদের।তারপর আদ্রর পাশে তাকাতেই হিয়ার চোখমুখ মোলিন হয়ে আসে।ঠোঁট দুটো ফাঁকা হয়ে যায় হিয়ার।হুশ ফিরে আসে রুদ্রের চোখ টিপ দেওয়াতে।ক্ষিপ্ত হয়ে হিয়া বলে,”এই নষ্ট পুরুষ এখানে কি করছে?”

একটু জোরেই বলে হিয়া।খোপ করে হাত চেপে ধরে মিলি।দাদা দাদী কিছু মনে করতে পারে তাই।হিয়া হাত ছাড়িয়ে বলে,”আটকাচ্ছো কেনো আমাকে?তোমার ভাই নষ্ট পুরুষ বলে আমি তাকে কিছু বলতে পারবো না?ওনাকে তো ভাইয়া বের করেও দিয়েছে।আবার কেনো এসেছে?”

দাদা দাদী অবাক হয়ে তাকালো এদিক ওদিক।আদ্র ফিসফিসিয়ে বলে,”এটা হিয়া।রুদ্রর হিয়াপাখি।ব্যাটা রুদ্র অভিনয় করতে করতে ওর সামনে হয়েছে নষ্ট পুরুষ।মানে হিয়ার মন ভেঙ্গে দেওয়ার অভিনয় করেছিলো তাই।”

বাকিটা বুঝে গেলো দাদা দাদী।দাদী তখন দুষ্টুমি করে চোখ রাঙিয়ে বলে,”তোমার তো দেখছি অনেক সাহস মেয়ে।আমার নাতিকে তুমি অপমান করো।”

“হ্যাঁ আপনার নাতি তো নষ্ট পুরুষ তাই..”

আর কিছু না বলে অবাক হয়ে হিয়া বলে,”আপনার নাতি মানে?আমি তো আদ্র ভাইকে কিছু বলিনি।রুদ্র ভাইকে বলেছি।”

“ওটাও আমার নাতি।আমার ছোট নাতি।”

গাল হা করে চশমাটা ঠিক করে হিয়া।তারপর সবার দিকে তাকালো।সবাই হাসতে থাকে।মায়া এসে সবকিছু খুলে বলে হিয়াকে।রুদ্রর আসল পরিচয়।রুদ্রর বর্তমান চাকরি সহ সাহায্যের কথাটাও বলে মায়া।রুদ্র তাকায় না হিয়ার দিকে।ওর চোখ ফ্লোরের দিকে।রাজ এসে হিয়ার মাথায় হাত রেখে বলে,”তোর কষ্টটা আমরা সেদিন উপলব্ধি করেও চুপ ছিলাম বোন।তোকে সত্যিটা বলিনি কারণ তোর মন এতই নরম যে যার প্রতি তোর ঘৃণা আসে তাকে সরাসরি দেখিয়ে দিতি।আসল সত্যটা জানলে আমাদের মত শক্ত থেকে অভিনয় করে যেতে পারতি না।এতে ওরা এলার্ট হয়ে যেত তাই।”

হিয়ার চোখ ভিজে এসেছে।রুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে সে।চশমা চোখেই চোখের পানি ফেলছে।অস্পষ্ট সুরে বলে,”রু রুদ্র ভাই।”

রুদ্র এখনও তাকায়নি।হিয়ার এই আস্তে করে ডাক তার কান অব্দি পৌঁছায়নি।হিয়া ধরে নিলো রুদ্র অভিমান করেছে।কষ্ট হলো হিয়ার।এতদিন করা বাজে ব্যবহারের সাথে হয়তো আজকের ব্যাবহার রুদ্রের মনে দাগ কেটে নিয়েছে।বড় লম্বা গাউন পরেছিলো হিয়া।পায়ের নিচে অব্দি চলে যায় গাউনের ঘের।দুই হাত দিয়ে উচু করে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলো।হিয়ার একেক পদক্ষেপ কর্ণপাত হলো রুদ্রের।মাথা উচু করে দেখলো হিয়াকে যেতে।কিছু না বলে চুপ আছে সে।রাজ এসে রুদ্রের পিঠে চাপড় মেরে বলে,”ভাই আমার তাড়াতাড়ি যাও হিসাব মেটাতে।যদি থাকো রাজি তবেই তোমার জন্যও ডাকবো আমি কাজী।”

রুদ্র সবার দিকে তাকালো।সবার সম্মতি পেয়ে হিয়ার ঘরের দিকে দৌড় দিলো রুদ্র।

চলবে…?