মায়ামঞ্জরী পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
14

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ৩৯

পরিস্থিতি জটিল হলো না। ড্রাগের প্রভাব আচমকাই যেমন অসুস্থ করে দিয়েছিল তেমনি আবার দ্রুত সেটা চলেও গেল। ডেভিডের পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এলো সকালের দিকে।

ইভার মেসেজটা পাঠানোর ঘন্টাখানেকের মধ্যে সেই ‘কোজি’ নামের ব্যক্তি হাজির হয়েছে। এসেই সে ইভার সাথে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে, “হাই, আই অ্যাম লেইজি রকম্যান।”

ইভা হাত মিলিয়ে পরিচিত হয়েছে। লোকটা আসায় ভালোই হয়েছে ইভার। একা বসে থেকে প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিল। লোকটা নানান কথা বলে ব্যস্ত রাখল ওকে। সেই সাথে ভরসা দিয়ে গেল।

ডেভিডের জ্ঞান ফেরার পর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে দেখা করতে দেয়া হলো ইভা আর রকম্যানকে। দুজনকে একসাথে দেখা করতে দিল না অবশ্য। ইভাকে বুঝিয়ে রকম্যান আগে ঢুকল।

রকম্যানকে দেখে হাসল ডেভিড। বলল, “ওদের সাথে মেশার জন্য ড্রাগ নিতেই হতো। আমি জানতাম এটার প্রভাব অল্পক্ষণেই কেটে যায়। তাই পরেরবার দ্বিতীয় গ্যাংয়ের সাথে যখন নিলাম, ভেবেছিলাম কিছু হবে না। প্রথমবার তো, তাই বুঝিনি।”

রকম্যানের জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো। হেঁটে বাড়িতে যেতে পারব এতটাই ভালো।”

“ড্রাগ নিয়ে হসপিটাল অথরিটি যেন কোনো ঝামেলা না করে সেই ব্যবস্থা করব। একটু পরেই রিলিজ পেয়ে যাবে।”

“ধন্যবাদ।”

“তুমি চাইলে এখন প্রোজেক্টটা ছেড়ে দিতে পারো। অলরেডি একবার লাইফ রিস্ক নিয়ে ফেলেছ৷ আমি ওপরমহলে রিপোর্ট করে দেব তোমার জীবন বিপন্ন হয়েছিল কাজটা করতে গিয়ে। তারা কনসিডার করবেন। চাকরি যাবে না তোমার।”

ডেভিডের ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছিল কথাগুলো শুনতে শুনতে। একসময় সে হেসে ফেলল।

রকম্যান ওর চোখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন, “জেদি ছেলে। ছাড়বে না তো প্রোজেক্টটা?”

“আপনি আমার জায়গায় থাকলে আপনিও ছাড়তেন না।”

“দ্যাটস ট্রু! বেস্ট অফ লাক!”

“থ্যাংস!”

“বাই দ্য ওয়ে, তোমার গার্লফ্রেন্ড খুব স্ট্রং অ্যান্ড চার্মিং।”

ডেভিডের গাল সামান্য লাল হলো। সে আর রকম্যানের ভুল শুধরে দিতে গেল না। বলল, “থ্যাংস।”

রকম্যান বিদায় নিলে ভেতরে ঢুকল ইভা। ডেভিডকে দেখে অকারণেই ইভার চোখে জমে উঠল টলটলে পানি। ডেভিড অবাক চোখে চেয়ে দেখল মেয়েটা কাঁদতে শুরু করেছে।

ডেভিড ওর হাত ধরে বলল, “আমি ঠিক আছি ইভা। দেখো, পুরোপুরি ঠিক আছি।”

“আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

ডেভিড গভীর চোখে চেয়ে বলল, “আমাকে হারানোর ভয়?”

“হুম।”

ডেভিড মনে মনে বলল, “তাহলো পুরোপুরি পেতে চাও না কেন ইভা?”

জোরে বলল না কথাটা। হেসে বলল, “হারাচ্ছি না এত সহজে।”

******

অধরার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ ওর শ্বশুরবাড়িতে ফেরার দিন। শিশির অফিস শেষে ওকে নিতে আসবে। অধরার একদিনে খুব আনন্দ হচ্ছে শিশিরের সাথে এতদিন পর আবার একসাথে থাকতে পারবে ভেবে। আবার বাড়ির জন্য মন কেমনও করছে। মা বাবা বোনকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে ভেতরে ভেতরে কষ্ট হচ্ছে। তবে বোধহয় আনন্দটাই বেশি হচ্ছে কারন ঘড়ির কাটাটা বড্ড স্লো মনে হচ্ছে। এ যেন এক জায়গায় বসে আছে, নড়নচড়ন নেই।

শিশির শেষবার ফোন করেছিল দুপুরে। বলেছে আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে চলে আসবে। এখন বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। অধরার ইচ্ছে করছে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে সে কতদূর এলো। কিন্তু আবার লজ্জাও লাগছে। শিশির ভাববে সে কত অধৈর্যই না হয়ে আছে! বিয়ের প্রায় দু’মাস পরেও লজ্জা লজ্জা ভাবটা কাটতে চায় না৷

বিকেলে ওদের চায়ের আড্ডায় আজ উচ্ছ্বলতার সাথে সাথে বিষাদও মাখামাখি। তবুও সময়টা বেশ কেটে গেল!

বিকেলটা পার হতেই অধরার উসখুস শুরু হলো৷ সে ত্রিশ সেকেন্ড পরপর দরজার দিকে তাকায়৷ কখন আসবে সে?

অধরার সব গোছগাছ হয়ে গেছে৷ এখন শুধু বেরিয়ে পড়বে। মাও বোধহয় একটু কনফিউজড। শিশির যদি বেশি রাত করে ফেরে তাহলে রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে। আর যদি সন্ধ্যার মধ্যে এসে এতটা পর যেতে হবে বলে তাড়াহুড়ো করে চলে যায় তাহলে শুধু নাস্তা খাওয়াবে। নাস্তার ব্যবস্থা করা আছে৷ রাতের খাবারের ব্যবস্থা করবে কি না বুঝতে পারছে না।
অধরা এবার ফোন করে ফেলল। শিশির ধরল না৷ আবারও কল করল অধরা৷ উত্তর নেই। এরকম চলল দশ বারোবার। প্রতিবারই রিং হয়ে হয়ে কেটে যায়, শিশির ফোন তোলে না। কোথায় আছে সে? আশ্চর্য তো! জ্যামে পড়ে রয়েছে? কিন্তু ফোন ধরে না কেন? গাড়িতে বসে ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? হাজারটা চিন্তা মাথায় গিজগিজ করতে থাকল তার।

সময় বাড়ার সাথে সাথে অধরার চিন্তাও বাড়তে থাকল পাল্লা দিয়ে। একবার মনে হলো বাড়িতে চলে যায়নি তো? সেখানে ফোন করে দেখল যায়নি৷ রাত বাড়ছে। ক্রমেই বাড়ছে অধরার দুশ্চিন্তা। সেই চিন্তায় ক্রমাগত জমা হচ্ছে আজেবাজে সব আশঙ্কা।

ওর চিন্তাগুলোর অবসান ঘটিয়ে শিশির অবশেষে এলো প্রায় রাত নয়টায়। ওকে দেখতে কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। সবাই চিন্তিত হয়ে ঘিরে ধরল তাকে। “কী হয়েছে? এত দেরি হলো কেন?”

শিশির মৃদু হেসে জবাব দিল, “প্রচন্ড জ্যাম ছিল।”

অধরা ধরে নিল ওদের আর যাওয়া হবে না আজ। সে শিশিরকে গোসলের জন্য তোয়ালে এনে দিতেই শিশির অবাক হয়ে বলল, “গোসল করব কেন? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, বেরিয়ে পড়ি।”

“অদ্ভূত কথা বলছো কেন? এত রাতে এতদূর কেন যাব?”

“কারন আমাদের আজই যাবার কথা ছিল।”

“মা যেতে দেবেন না।”

“আমি আছি তো অধরা। দুই ঘন্টা লাগবে যেতে। এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব৷ এটা এমন কিছু রাত না।”

“আজ থেকে যাই না? কী হবে থাকলে?”

“কিছু না। আমি থাকব না। তুমি যেতে চাইলে এসো।”

অধরা বুঝতে পারল না শিশির কেন জেদ করছে। কেন মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছে। দুপুর পর্যন্ত তো ঠিক ছিল। অবশ্য অফিসের পর দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে এসে এরকম করলে তাকে দোষ দেয়া যায় না। অধরা মাকে গিয়ে বলল তাড়াতাড়ি খাবার পরিবেশন করে দিতে। ওরা বের হবে।

মা অনেক জোরাজোরি করলেন, কিন্তু কাজ হলো না। শিশির খেতেও চাচ্ছিল না। ভদ্রতার জন্য শেষ পর্যন্ত খেতে হলো। খেয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা। পুরো রাস্তায় শিশির কোনো কথা বলল না। মুখ গোঁজ করে রইল। অধরাও পথে কিছু জিজ্ঞেস করল না।

ফেরার পর সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে অধরা নিজেদের ঘরে শুতে গেল। শিশির ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে একপাশ ফিরে। অধরা ফ্রেশ হয়ে রাতের পোশাক পরে এসে ওর পাশে বসল। আলতো করে পিঠে হাত রেখে বলল, “বলবে না কী হয়েছে?”

শিশির বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অধরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। একসময় শিশির বলল, “চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এসেছি অধরা। আমি আবার বেকার হলাম। অভিনন্দন জানাতে পারো।”

*******

এক্সিডেন্টের কারনে পায়ে ব্যথা আর প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ততার অযুহাতে ডেভিড এতদিন সোফিয়ার সাথে ডেটের তারিখ পিছিয়ে গেছে ক্রমাগত। আজ সোফিয়া একেবারে ধরে বসল তাকে।

“তুমি কি আমাকে চাও না?”

ডেভিড গলায় মধু ঝরিয়ে বলল, “অবশ্যই চাই হানি।”

“তাহলে আমরা কেন ডেট করি না? কেন ফোনে কথা বলি না? কাউকে ক্যাম্পাসে বসে ঘন্টাখানেক সময় দিলেই সে গার্লফ্রেন্ড হয়ে যায় না। আমার ধারণা তুমি রিলেশনশিপে সিরিয়াস নও।”

“আমি সিরিয়াস সোফি।”

“তাহলে আজ সন্ধ্যায় আমরা ডিনার ডেটে যাচ্ছি।”

“আজ একটা জরুরি কাজ আছে সোফি। আমরা…”

“আজ যদি তুমি না যাও তাহলে তোমার সাথে আমার সব কেচ্ছা এখানেই শেষ। তবে তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে আমি ক্যাম্পাসে প্রচার করে দেব তুমি একটা ইমপোটেন্ট।”

“সোফি!”

“ইজ ইট ট্রু?”

“নো!”

“দ্যান প্রুভ ইট! আমি তোমার জন্য সন্ধ্যা সাতটায় লাভলক বারে ওয়েট করব।”

ডেভিড ঢোক গিলল। ক্যাম্পাসে এখন আজেবাজে কিছু প্রচার হয়ে সবার চোখে পড়ে যাওয়া যাবে না। যদিও সোফির বয়ফ্রেন্ড হিসেবে সে অনেকের চোখে পড়ে গেছে। তবে সেটা নেগেটিভ পাবলিসিটি নয়। এই ট্যাগে পরিচিত হলে তার অতীত নিয়ে লোকে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিতে পারে। এখন বুদ্ধিমানের কাজ হলো সোফির সাথে ডেটে চলে যাওয়া। কিন্তু সে কেমন করে এটা করবে? সে নিজের সাথে ইভা ছাড়া আর কারো কথা কল্পনা করতে পারে না। সোফি নামক আপদটাকে কেমন করে ঘাড় থেকে নামানো যায় যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৪০

ডেভিড ভয়ে ভয়ে সন্ধ্যাবেলা পৌঁছে গেল লাভলক বারে। জমজমাট হয়ে আছে জায়গাটা। আগে এখানে আসেনি ডেভিড। নানা রঙের আলো, গোল গোল টেবিলে পানীয়ের আসর, তীব্র মিউজিকের সাথে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে নৃত্যরত মহিলা সবই ডেভিডের কাছে তেঁতো লাগছে। এই দেশের বাসিন্দা হয়ে এই বয়সেও সে ভার্জিন ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস না করলেও সত্য। সেজন্য অবশ্য ডেভিডের গোলমেলে অতীত কিছুটা দায়ী। তবে সে এতদিনে নিজেকে উজার করে দিতে চেয়েছিল যে নারীর জন্য তাকে সে পেয়েও পাচ্ছে না। এদিকে যার সাথে জোর করে তাকে ডেট করতে হচ্ছে তাকে সে চাচ্ছে না। সোফির সাথে কি সত্যিই অন্তরঙ্গ হওয়া তার পক্ষে সম্ভব? সে বিকল্প খুঁজতে খুঁজতো এসেছে। কিন্তু মাথা কাজ করছে না।

চারদিকে চাইল সে। আধো অন্ধকার হলেও তার চোখের দৃষ্টি ভীষণ তীক্ষ্ণ। কোথাও সোফিকে দেখতে পেল না। বোধহয় এখনো এসে পৌঁছায়নি। ডেভিডের মস্তিষ্ক এখনো দ্বিধার দোলায় দুলছে। ফিরে যাবে নাকি? আর ফিরে গেলে সোফি তার নামে উল্টোপাল্টা প্রচার করবে। আচ্ছা করলেই কি খুব সমস্যা? করুক না! যদিও তাতে তার ইমেজ খারাপ হবে, সবাই তাকে দলে রাখতে নাই চাইতে পারে! তবুও মন টানছে না।

আরেকবার চারদিকে চাইল সে। আসেনি সোফি। বড় করে শ্বাস টেনে ডেভিড ঠিক করে ফেলল সে চলেই যাবে। মনের বিরুদ্ধে এত বড় স্টেপ নিতে সে পারবে না।

বার থেকে বের হয়ে গেল সে ঝড়ের মতো। আর দরজার কাছাকাছি গিয়েই সজোরে ধাক্কা খেল কারো সাথে। ‘স্যরি’ বলে চাইতেই মুখ হা হয়ে গেল ডেভিডের। আর কেউ নয়, সোফি দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে ডেভিড যতটা না অবাক হলো তারচেয়ে বেশি অবাক হলো ওর সাজপোশাক দেখে। ঝলমলে আঁটোসাঁটো জামা গায়ে। শরীরের প্রতিটা ভাজ ফুটে আছে আকর্ষণীয়ভাবে। বিশেষ করে অর্ধ উন্মুক্ত বক্ষবন্ধনী যে কোনো সময় বিদ্রোহ করে ফেটে গেলেও যেতে পারে। সাজগোজও বাড়াবাড়ি রকমের। গাঢ় লিপস্টিক, স্মোকি চোখ, চোখে বোধহয় লেন্স পরেছে, অন্যরকম লাগছে৷ ও এমনিতেই সুন্দর, এখন ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখাচ্ছে!

ডেভিডকে চেয়ে থাকতে দেখে হাসি ফুটল সোফির ঠোঁটে। সে ওকে ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে দুই হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। ওর খুব কাছাকাছি চলে এলো। ডেভিডের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।

সোফি জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কেমন লাগছে?”

“মারাত্মক!” মন্তব্য করল ডেভিড।

সোফি ডেভিডের গালে আলতো চুমু খেয়ে বলল, “থ্যাংস ডিয়ার। চলো ড্রিঙ্ক করা যাক!”

ডেভিড সোফির পিছু পিছু চলল যন্ত্রের মতো।

********

শীতের শেষ বিকেলটা বড় আদুরে লাগছে। অধরা ওর ঘরের বিছানায় বসে আছে। জানালা গলে দিনের ম্লান হয়ে আসা আলো ঢুকছে। ওর গায়ে একটা কাঁথা জড়ানো। সামনে চায়ের কাপ। আলতো চুমুক দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। চারদিকে পাখির ডাক আর অদ্ভূত নিস্তব্ধতা মিলে এত ভালো লাগছে যে অধরার মনে হচ্ছে বিকেলটা দীর্ঘ হলে বেশ হতো!

দোতলায় সে একা। কয়েকদিন থেকে এখন অভ্যাসমতো হয়ে গেছে৷ শিশিরের চাকরিটা চলে যাবার পরও সে রোজই শহরে যায়৷ হয়তো চাকরির খোঁজেই যায়৷ অধরাকে আর কিছু খুলে বলে না৷ খুব চাপা স্বভাবের হয়ে উঠছে সে দিন দিন। অধরার কষ্ট হয় সেজন্য। সদ্যই বিয়ে হয়েছিল তাদের, এর মাঝে যদি দুজনার মনে দূরত্ব চলে আসে তবে কেমন করে হবে? শিশির হীনমন্যতায় ভোগে, যদিও সেটার কোনো কারন নেই। ওর আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি। তা না হলে আজ হয়তো বড় কোনো পদে থাকত। সে যে আজ বেকার সেজন্য অধরার মনে কোনো গ্লানি নেই। বরং কিঞ্চিৎ গর্বই আছে৷

সেদিনটায় ফিরে গেল অধরা, যেদিন শিশিরের সাথে এবাড়িতে ফিরেছিল সে। শিশির গভীর রাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বহুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছিল।

সেদিন শিশির প্রথমবার জানতে পেরেছিল ওদের অফিসের মালিক তার বাবার এককালের বন্ধু৷ সে চেয়েছিল বাবার যত পুরানো লিংক আছে সব ছেড়ে অন্যত্র চাকরি করতে। এই ভদ্রলোককে সে চিনতও না। তিনিও জুনিয়র পদে চাকরি করা শিশিরের খবর জানতেন না৷ হঠাৎ কোথা থেকে তিনি তাকে আবিষ্কার করলেন কে জানে! দুপুরবেলা সোজা ডেকে পাঠালেন তার নিজের কেবিনে। সেখানে খুব খাতিরযত্ন করে আপ্যায়ন সেরে নানা কথাবার্তার পর তিনি জানালেন শিশির তার অফিসে এই ছোটো পদে চাকরি করে এটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না৷ তিনি ওকে বড় কোনো পদ দিতে চাচ্ছেন। শিশির তাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে এখানেই থাকতে চায়৷ হুট করে বড় পদে গিয়ে বাবার অফিসের মতো ইনসিকিউরড অবস্থায় পড়ে যেতে চায় না। কিন্তু ভদ্রলোক তার কথা শোনার পাত্রই নন। তিনি পারলে তক্ষুনি তাকে নতুন পদে বসিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত শিশির আর কোনো কথাবার্তা না বলে চলে এসেছে। সেদিনই রিজাইন দিয়ে ফিরে এসেছে। এজন্যই তার এত দেরি হয়েছিল ফিরতে। সে জানত ওখানে থাকলে সে নানান সুযোগ সুবিধা পেতে থাকবে যেটা সে একেবারেই চায় না। একটাই আক্ষেপ তার, কেন প্রতি পদে তাকে কেউ না কেউ সাহায্য করতে চলে আসবে? সে নিজের যোগ্যতা প্রমানের সুযোগ কি কোনোদিন পাবে না?

আরেকটা আক্ষেপও হয় তার, বাবার এত লিংক, এত সহৃদয় বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও কেউ কি তাদের কোম্পানিটা ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারল না? এখন খাতির করছে কেন? করে কী বা হবে?

এসব ভাবতে ভাবতে অধরার চোখে পানি চলে এলো। সে চোখ মুছে বাইরের দিকে চাইল। সূর্য ডুবে গেছে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আজানের সময় দোয়া কবুল হয়। অধরা চোখ বুজে তার স্বামীর সর্বাঙ্গীণ সফলতার দোয়া করল।

********

ডেভিড চুপচাপ পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। কেমন যেন লাগছে স্বাদটা। বহুদিন ড্রিঙ্ক করেনি সে। কাজের সূত্রে এসব বারে যাতায়াত থাকলেও সচরাচর ড্রিঙ্ক করে বোধবুদ্ধি লোপ পাবার আশঙ্কায় সে শুধু গ্লাস হাতে বসে সবার সাথে বসে থাকে। কিন্তু আজ খেতে হচ্ছে। সোফির তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে তার গ্লাসের ওপর। এই মেয়ে তাকে কোনোভাবেই ছাড়বে না মনে হচ্ছে।

ওদের উল্টোপাশের টেবিলে একা একটা ছেলে বসে আছে। ওদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে বোধহয় ছেলেটা। সিনিয়র। নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সে চোখ দিয়ে গিলছে সেফিকে। সোফিও যে পাত্তা দিচ্ছে না তা নয়৷ তবে তার মূল মনোযোগ এখন ডেভিডের দিকেই।

দু’পেগ শেষ হতে হতে ক্রমশ সোফি ওর কাছে চলে এলো। ডেভিড খেয়াল করল সোফি ওর হাঁটুর ওপর হাত রেখেছে, ওর হাতটা ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে আসছে। বারের পাশেই একটা হোটেল আছে। রাত কাটাবার জন্য খুবই উপযুক্ত। সম্ভবত সোফি আগেও গেছে সেখানে। সেটাই বলল সে ওর কানের কাছে মুখ এনে। ডেভিডের একটা হাত সে নিজের কোমরে রাখল। তারপর বলল, “তোমাকে আমার কেন ভালো লাগে জানো? কারন তুমি এমনিতে যতই জড়োবস্তুর মতো থাকো থাকো না কেন, হেজিটেট ফিল করতে থাকো না কেন কাজের সময়ে দারুণ একটিভ হতে পারো তা তো আমি তোমার ফার্স্ট কিস থেকেই বুঝতে পেরেছি। এখন তোমাকে পুরোপুরি না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি হবে না আমার।”

ডেভিড এবারো কিছুই বলল না। শুধু ঢোক গিলল। সোফি নিজের মুখটা ডেভিডের মুখে কাছাকাছি নিয়ে এলো বিপজ্জনকভাবে৷

ঠিক তক্ষুনি ডেভিডের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ডভিড ঝট করে সরে গেল সোফির কাছ থেকে। স্ক্রিনের দিকে তাকাল সে। ইভা!

হঠাৎই যেন একটা স্বপ্নদৃশ্য থেকে বেরিয়ে এলো সে। “এক্সকিউজ মি। আর্জেন্ট কল।” বলে সে বার থেকেই বেরিয়ে গেল কল রিসিভ করতে৷ এমনিতেও ভেতরে গানবাজনার শব্দে কথা বলা যেত না।

কল রিসিভ করার পর ইভার রাগ রাগ গলা শোনা গেল, “তোমার শরীর কি পুরোপুরি ভালো হয়েছে? এখনো কেন রাত জেগে কাজ করতে হবে? একটু জলদি ফিরলে কী হয়?”

ডেভিড আমতা আমতা করে বলল, “এইতো এখুনি ফিরব।”

“তাড়াতাড়ি! তুমি না এলে আমার ঘুম হবে না।”

“আসছি বাবা যত দ্রুত পারি পৌঁছে যাচ্ছি। চিন্তা করো না।”

ডেভিড আর পেছনেই ফিরল না। গোল্লায় যাক সোফি! সে সদ্য বার থেকে বের হওয়া এক ছেলের গাড়িতে লিফট নিয়ে চলল বাড়ির দিকে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৪১

ডেভিড বাড়ি ফিরে নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ইভা তখন এপ্রোন পরে রান্নাঘরে কাজ করছে। ডেভিডকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, “ডিনার করেছ?”

“না।”

“ওকে, ডিনার রেডি। ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি সার্ভ করছি।”

ডেভিড ফ্রেশ হতে চলে গেল। পলের মেকআপ তুলতে তার বেশ খানিকটা সময় লাগে। তবুও সে দ্রুত হাতে কাজটা করার চেষ্টা করল। মেকআপ তোলা হলে গোসল সেরে চলে এলো নিচতলায় ডাইনিংয়ে৷ এসেই অবাক হয়ে গেল।

বৈদ্যুতিক বাতিগুলো সব বন্ধ। টেবিলে কতগুলো ক্যান্ডেল জ্বলছে। ফুলদানিতে তাজা লাল গোলাপ। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হবে তাহলে!

ওপর থেকে নেমে আসার শব্দ হতেই তাকাল সে। ইভা নেমে আসছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে৷ এত সুন্দর করে সেজেছে সে! ডেভিড প্রাণভরে দেখল। ওর সাজটা কোনোদিক থেকে উগ্র নয়। কি স্নিগ্ধ, মায়াময়। দেখলেই বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ওর হাত ধরে তেপান্তরে পাড়ি দিয়ে চলে যেতে স্বপ্নের কোনো রাজ্যে। সোফিকে দেখে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল ঠিকই, তবে সেটা শুধুই মোহ ছিল, তাতে প্রেম, ভালোবাসা বা অপার মুগ্ধতা কিছুই ছিল না।

ডেভিডকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খানিকটা লজ্জা পেল ইভা। কেন যেন সাজতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। সে যে ড্রেসটা পরেছে এটা তাকে খালা উপহার দিয়েছেন আমাজনে যাবার আগে। এত সুন্দর জামাটা পরার একটা উপলক্ষ খুঁজছিল সে। ডেভিডের সুস্থতার উপলক্ষে আজ পরে ফেলল। বেশ জমজমাট ডিনারও তৈরি করেছে সে। তার মনের আরেকটা ইচ্ছে অবশ্য আছে, সেটা হবে কি না জানা নেই।

ইভা হেসে বলল, “বসে পড়ো। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

ডেভিড ইভার মুখোমুখি বসল। দু’জন বেশ জমিয়ে খাবার খেল। ডেভিডের মুখে ফুটল প্রশংসার ফুলঝুরি। ইভা যেন কথা বলতে পারছিল না। তার লজ্জা লাগছিল ভীষণ।

খাওয়া শেষে ডেভিড বলল, “তোমাকে দারুণ লাগছে ইভা।”

ইভা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মৃদু কণ্ঠে বলল, “থ্যাংস।”

ইভা এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে গেলে ডেভিড তার হাত থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিল সেগুলো। বলল, “অনেক কাজ করেছ৷ এখন বসো। বাকি কাজ আমি করছি।”

“থ্যাংস।”

ইভা কাজ রেখে লিভিংরুমের দিকে যেতে গিয়েও থমকে গেল ডাইনিংয়ে ডেভিডের ফোনের আলো জ্বলতে দেখে। ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রাখা তাই মেসেজ আসার শব্দ হয়নি। মেসেজটা উপরে ভেসে আছে। সোফির কাছ থেকে মেসেজ এসেছে, “Thanks darling. Today i had the best s*x ever!”

ইভার চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল। কয়েক মিনিট সে বরফের মতো জমে দাঁড়িয়ে রইল ৷ রান্নাঘরে ডেভিডের হাত থেকে হয়তো কিছু পড়ে গেল। সেই শব্দে চমকে উঠল ইভা। ফোনটা জায়গামতো রেখে সে ছুটে চলে গেল ওপরে। ওর চোখ জ্বলছে। নোনা পানি নেমে আসছে গাল বেয়ে। ডেভিডের সোফিকে চুমু খাবার দিনটার সাক্ষী তো সে নিজেই৷ তবুও সে বোকার মতো ডেভিডকে বিশ্বাস করেছে। ভেবেছে সে শুধুই কাজ করছে৷ কাজের জন্য এসবও করতে হয় তার সেটা কখনোই বিশ্বাস হয় না।

আজ সে অনেক যত্ন করে আশা করে সেজেছিল। ভেবেছিল ডেভিডকে প্রপোজ করবে। ওকে জানাবে, ওর অসুস্থতার সময় সে কী ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছে যে তাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না৷

সবকিছু নষ্ট হয়ে গেল। ইভা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে মেঝেতে বসে পড়ল। ভাঙা মন একটু একটু করে জোড়া লাগার পর সেটা আবার ভাঙার মতো কষ্ট বুঝি আর কিছু হয় না।

*******

এই বাড়িতে কোনো শিলপাটা নেই। অথচ অধরার ভীষণ ইচ্ছে করছে শিলপাটায় বাটা ভর্তা খেতে। সকাল থেকে কেন যেন ভর্তার কথাই মনে পড়ছে। শুটকির ভর্তা, রসুন মরিচের ভর্তা, কিংবা ধনেপাতার ভর্তা হলে কি দারুণ হতো!

মাকে বলতেই তিনি বললেন ব্লেন্ডারে করে ফেলতে। কিন্তু ব্লেন্ডারের ভর্তা আর হাতে বাটা ভর্তার স্বাদের আকাশ পাতাল তফাত। তাই সে গেল শিশিরের খোঁজে। ওকে বাজারে পাঠিয়ে একটা শিলপাটা কিনিয়ে আনা গেলে বেশ হয়! শিশির আজকাল বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে বসে ল্যাপটপে কাজ করে।

শিশির বারান্দার রোদে পিঠ দিয়ে বসে কীসব টাইপ করছিল। অধরা পেছন থেকে ওর চোখ ধরে ফেলল। শিশির বলল, “আরে মিমি তুমি এসেছ? অধরা দেখেনি তো আসতে? ও রান্নাঘরে যতক্ষণ কাজ করবে ততক্ষণ আমরা প্রেম করব কেমন?”

অধরা চোখ থেকে হাত সরিয়ে সমানে এসে কোমরে দুই হাত রেখে বলল, “মিমি মানে?”

শিশির জিভ কাটল। “আরে তুমি! আমি তো ভেবেছি… না না কিছু না।”

“তুমি মজা করছো আমার সাথে?”

“তোমার কী মনে হয়?”

“উফ! শোনো না।”

“বলো না।”

“শিলপাটা এনে দাও।”

“কেন?”

“এখন তোমাকে আমি এসব বলতে পারব না। এনে দেবে কি না বলো।”

“দিতে পারি এক শর্তে।”

“কী শর্ত?”

শিশির ইশারায় বুঝিয়ে দিল। অধরা চোখ গরম করে বলল, “লাগবে না যাও। বউয়ের একটা শখ পূরণ করতে পারো না, প্রতিটা কথায় এসব ঘুষ দিতে পারব না হুহ।”

বলে অধরা নিচে নেমে গেলে শিশির হেসে ল্যাপটপ বন্ধ করে নেমে গেল। বাজারে যেতে হবে এখন মহারানীর জন্য।

একতলায় নেমে রান্নাঘরে উঁকি দিল সে। অধরা কাজ করছে। অধরা ফেরার আগে মা দারুণভাবে ঘরের কাজ করতে শুরু করেছিল৷ ফিরে আসছিল তার স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু তার চাকরি চলে যাওয়ার খবরটা মাকে আবার একটা ধাক্কা দিয়েছে। আবারো তিনি নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছেন৷ অধরা, সে, ভাইয়া আর বাবা দিনরাত তার কানের কাছে এটা সেটা বলতে থাকে, ইচ্ছে করে ভুলভাল কাজকর্ম করে, কিন্তু মাকে স্বাভাবিক করা যায় না। শিশিরের এতদিন মনে হয়নি, এখন মনে হচ্ছে মা ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে গেছেন। সব ভালোলাগা মরে গেছে তার। এ থেকে উদ্ধার কেমন করে সম্ভব? কিছুটা ঘাটাঘাটিও করেছে সে মানসিক ডাক্তারদের বিষয়ে। ডাক্তার দেখানো, নিয়মিত কাউন্সেলিং করা, মাকে শহরে নিয়ে যাওয়া-নিয়ে আসা সবটা মিলিয়ে কিভাবে সামলাবে, কত টাকা খরচ হবে তাও একটা প্রশ্ন। ভাইয়া কি ডাক্তার হয়েও দেখে বুঝতে পারছে না? নাকি বুঝলেও কিছু করতে না পারায় চুপ করে আছে? জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে তার বেতন খুব বেশি না। এই টাকার খুব সামান্য অংশই সে বাড়িতে দিতে পারে। ভাবির পেছনে অনেকটা খরচ হয়ে যায়।

শিশির ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকে নির্জন রাস্তা ধরে। মাথার ভেতর সারাক্ষণ গিজগিজ করতে থাকে চিন্তাগুলো। মাঝেমধ্যে মাথা ধরে আসে। ইচ্ছে করে সবকিছু ভুলে কিছু সময় নিজেকে একটু শান্তি দিতে। কিন্তু পারে না। এসবের কারনে অধরার সাথেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সম্পর্কটা স্বাভাবিক রাখার। কিন্তু লাক্সারি থেকে এসে খুব সাধারণ জীবনে মানিয়ে নেয়ার সাথে সাথে সেই একটা আস্ত সংসারের খরচগুলো চালানোর চিন্তা তাকে স্বাভাবিক হতে দেয় না। চাকরিটা চলে যাওয়ায় যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। সে এতদিন বন্ধুবান্ধব কারো থেকে সাহায্য চায়নি৷ এই প্রথম একজনের সাথে কথা বলেছে। সে আমেরিকা থাকে। নামী একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। সেই কোম্পানিতেই একটা রিমোট জবের ব্যবস্থা সে করে দিয়েছে। কিন্তু কাজটা পার্মানেন্ট হবে কি না তা নির্ভর করছে পারফর্মেন্সের ওপর। শিশিরের এই বিষয়ে এক্সপিরিএন্স কম বলে তাকে খাটতে হচ্ছে প্রচুর। কে জানে কী হবে! তার ব্যক্তিগতভাবে এসব চাকরি করতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে নিজেই একটা কিছু শুরু করার। বিজনেস করতে মূলধন লাগবে। সেটা যদিও বন্ধুবান্ধবের থেকে ধার চাইলে জোগাড় হয়ে যাবে, কিন্তু রিস্ক নিতে ভয় হয়। বাবার কোম্পানির ভরাডুবির পর তার ভেতর তৈরি হওয়া ভয়কে সে কিছুতেই জয় করতে পারছে না।

ভাবতে ভাবতে বাজারে চলে এলো সে। শিলপাটা পাওয়া গেল না। সেটা নাকি নদীর ওপাড়ের বাজারে পাওয়া যায়। আজ আর যেতে ইচ্ছে করল না৷ ফিরে যাওয়ার সময় গরম গরম জিলাপি ভাজতে দেখে কিনে নিল সে। অধরা খুব পছন্দ করে জিলাপি।

*********

ডেভিড রান্নাঘর গুছিয়ে এসে দেখল ইভা নেই। ওপরে চলে গেল নাকি? সে ওপরে গিয়ে ইভার ঘরে নক করল, “ইভা!”

ইভা কাঁদছিল। সে চোখ মুছে গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, “বলো। কিছু লাগবে?”

“নিচে এসো, গল্প করা হয়নি আমাদের।”

“আমার ঘুম পাচ্ছে। আরেকদিন কথা হবে।”

ডেভিডের মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝতে পারল না ইভার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে নাকি অন্যকিছু? সে তো বেশ খুশি ছিল একটু আগেও। হঠাৎ কী হলো? যাবার আগে সে আরেকবার কিছু বলতে ইভার দরজার কাছে আসতেই চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। ডেভিড ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আবারো দরজা নক করল, “কী হয়েছে তোমার ইভা?”

কান্না থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত যেন নৈশব্দ ঝুলে রইল দরজার ওপাশে। তারপর ইভার স্বাভাবিক গলা শোনা গেল, “নাথিং। গুড নাইট।”

ডেভিড বুঝতে পারল এই কান্নার কারন তাকে জানতে দেবে না ইভা। কিন্তু হঠাৎ এমন কী হলো?

সে নিজের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। ঘুম পাচ্ছে তার নিজেরও। মোবাইলের কথা মনে হতেই আশেপাশে খুঁজল। নেই। বোধহয় ডাইনিংয়ে রয়ে গেছে। নিচে নেমে মোবাইল হাতে নিতেই মেসেজটা দেখে সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো থমকে গেল। মানে কি এসবের? সে তো চলেই এলো। তবে কিসের কথা বলছে সোফি?

সোফিকে ফোন করল সে। ফোনটা সাথে সাথেই তুলল সোফি। ডেভিড জিজ্ঞেস করল, “কী লিখেছ এসব?”

সোফি বোধহয় প্রচুর ড্রিঙ্ক করেছে। নেশা মাখানো গলায় সে বলল, “তুমি তো একটা ইডিয়ট। চলে গেছো আমাকে ছেড়ে৷ এরপর আর্থার এসেছিল আমার কাছে। সে আগে আমাকে অনেকবার প্রপোজ করেছে। আমি বোকার মতো ওকে রিজেক্ট করে দিয়েছি। আজ তুমি চলে না গেলে আজও করতাম৷ আর করলে হয়তো কোনেদিন জানতেও পারতাম না ও বিছানায় কতটা চমৎকার। এই চমৎকার সন্ধ্যাটার জন্য ইন্ডিরেক্টলি আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। থ্যাংস এগেইন পল!”

ডেভিড ফোন রাখল। মনে পড়ল তাদের পাশের টেবিলে ছেলেটা বসেছিল। আর্থার! আজ ছেলেটা বাঁচিয়ে দিল তাকে। কিন্তু….

কী মনে হতেই বন্ধ করে ফেলা মোবাইলের সুইচ বাটনটা চাপল সে। নোটিফিকেশন বার থেকে মেসেজটা এখনো দেখা যাচ্ছে। তবে কি ইভা এটা দেখেই….

ডেভিডের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু