মায়ামঞ্জরী পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
10

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ৪৭

শিশিরের একটা স্বভাব হলো কোনো কাজে বাঁধা পেলে সেটা আরো বেশি করে করা। যেটা করার কথা একবার ভেবে ফেলেছে তা না করা পর্যন্ত সে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাবে না৷ বিজনেসের কাজে হাত দেবার পর থেকে এই ব্যাপারটা তাকে অনেকটা এগিয়ে দিল। বিজনেসে ধৈর্য আর ডেসপারেশন অনেক জরুরি৷ যদিও সেজন্য কিছু জায়গায় ঝামেলায় পড়তে হয়, কিন্তু দিনশেষে খাতায় লাভের পাতাটাই ভারী হয়৷ শিশির তার নতুন জার্নিটা রীতিমতো উপভোগ করতে শুরু করল। মাঝে কিছুদিন ঘরে বসে অভক্তি ধরে গিয়েছিল। এখন বেশিরভাগ কাজই বাইরে করতে হয়৷ প্রচুর ছোটাছুটি, ভীষণ পরিশ্রম হয়। তবুও দিনশেষে মনে অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজ করে। রোজ রোজ নতুন সব আইডিয়া মাথায় আসে৷ সে এই বিজনেসটা সাজাবে একেবারে নিজের মতো।

বাবাও অনেক সাহায্য করছে তাকে৷ দু-তিনবার তার সাথে বেরও হয়েছে কিছু কাজে। ডাক্তার বলেছেন তিনি এখন অনেকটাই রিকভার করে ফেলেছেন। শারীরিক ধাক্কাটা সেরে গেলেও মানসিক ধাক্কাটা অনেক বড় ছিল৷ সেটাও সেরে উঠবে যদি শিশিরের কাজটা দাঁড়িয়ে যায় তো। শিশির সেটার জন্যও দিনরাত খাটছে। বাবাকে প্রশ্ন করলে, কোনো সমস্যার সমাধান চাইলে বাবা খুশি হন এটা বুঝতে পেরেই সে যেগুলো জানে সেগুলোও বাবাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছে। বাবার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। তিনি যেমন একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন, শিশিরও তাই করছে৷ তাই পুরানো উত্তেজনা আর নস্টালজিয়া কাজ করছে প্রতিক্ষেত্রে।

মাঝে অধরার সাথে সবটা ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছিল শিশির৷ যার কারনে এই প্রচন্ড ব্যস্ততাতেও স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটা ভালো আছে তার। যদিও মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো মনোমালিন্য হয়, তবে শিশিরের মনে হয় এটুকু না হলে সবকিছু একেবারে পানসে হয়ে যেত।

আজ শিশির একটু দ্রুতই বাড়িতে চলে এলো। আজকের কাজটা হয়নি, আগামীকাল ভোর ভোর থাকতে বের হয়ে যেতে হবে। তাছাড়া আজ দুপুরে খাওয়াও হয়নি বলে ক্ষুধা লেগেছে৷ ফিরে মা বা অধরাকে বলতে হবে কিছু করে দিতে। বাড়ি ফিরে সে অদ্ভুত তবে মজার এক ঘটনা দেখল।

এক ফুচকাওয়ালা তার গাড়িসহ দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির গেটের ভেতর। বাগানে বসে তার তিন মক্কেল বসে প্লেটের পর প্লেট ফুচকা সাবাড় করছেন৷ ঘটনা কী জানতে চাইলে জানা গেল সেই যে বহুদিন আগে মেলায় গিয়ে শাওলী চটপটি খেয়েছিল, সেটা তার হঠাৎ খেতে ভীষণ মন চাইছে। শাওন তাই দুনিয়াদারি খুঁজে সেই চটপটিওয়ালাকে ধরে এনেছে। এখানে এলে দেখা গেছে চটপটির চেয়ে লোকটা ফুচকা ভালো বানায়। সেটাই খাওয়া চলছে। শাওলীর সাথে যোগ দিয়েছে মা আর অধরা। পাল্লা দিয়ে ফুচকা খাচ্ছে এরা৷ ফুচকাওয়ালা যাবার সময় আবার দেখা গেল শাওলী তার ফোন নাম্বার রেখে দিচ্ছে!

শিশির ততক্ষণে ওপরে গিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিল। এদের আনন্দ দেখে তার খিদেটা চেপে রাখল। তবে একটু পরেই দেখা গেল নিচে খেতে ডাকা হয়েছে তাকে। খাবার খাওয়ার সময় মায়ের গল্প শুনতে শুনতে শিশিরের মন পুরানো দিনগুলোতে ফিরে গেল৷ এখন পুরানো দিনের মতো মনে শান্তি লাগছে। তবে কি তার ওপর চেপে বসা সেই ভয়াবহ মানসিক চাপটা সরে গেল?

রাতে অধরা শুতে এসে মশারি গুঁজতে গুঁজতে বলল, “আজ খুব মজা হলো, জানো? তবে শুক্রবারটা তুমি বাড়িতে থেকো। তোমায় ছাড়া ভালো লাগে না৷ আজ তুমি থাকলে দিনটা একেবারে ফার্স্টক্লাস হতো।”

“কী কী করলে আজ?”

অধরা গল্প করতে থাকল। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে শিশিরের। অধরার গল্প শুনতে শুনতে তাই তার চোখ লেগে এলো। অধরা একসময় খেয়াল করল শ্রোতা নিরব। ওদিক থেকে মিহি নাক ডাকার সুর ভেসে আসছে। অধরা মমতা নিয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। আহা! ঘুমুলে কত সুন্দর লাগে ওকে! বুকে ব্যথা ব্যথা করে অধরার। সে আলতো করে শিশিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙে শিশিরের। কোনো এলার্ম ছাড়াই এত ভোরে উঠতে পারে বলে অবাক লাগে তার। বুকের ওপর অধরা শুয়ে আছে। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। অধরা ঘুমের ভেতর অস্ফুটে কিছু বলে ওঠে।

শিশিরের হঠাৎ মনে হয়, অধরার সাথে যদি কোনোদিন তার দেখাই না হতো তাহলে জীবনটা এখন কেমন হতো?

**********

ডেভিড একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছে। ঘরে একটা মাত্র লাইট। টেবিল ল্যাম্প। ল্যাম্পটা তার মুখের দিকে ফেরানো। সে বসে আছে চেয়ারে। হাত পা বাঁধা। সামনে একটা টেবিল। সেই টেবিলের ওপরেই ল্যাম্পটা রাখা। আর আছে এক গ্লাস পানি, একটা প্লেটে কিছু খাবার। ডেভিড মাত্রই খাবার শেষ করেছে। দুটো লোক এখানে ধরে এনেছিল তাকে। খাওয়া শেষ হবার পরপরই তারা তার হাত দুটো বেঁধে ফেলেছে। এবার লোক দুটো চলে গেল। দরজা খুলে প্রবেশ করল অন্য এক লোক। সে এসে বসল ডেভিডের ঠিক উল্টোপাশে। সেদিকে আলো যাচ্ছে না। তবুও লোকটা পরিচয় লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কালো কাপড় দিয়ে তার মুখ ঢাকা। মাথায় কালো টুপি। চোখে কালো মোটা কাচের চশমা। চোখ দেখেও চেনার উপায় নেই। ভালো করে অবশ্য দেখাই যাচ্ছে না। ডেভিড যতটা পারে তবু দেখার চেষ্টা করল। নিশ্চয়ই ব্যক্তিটি পরিচিত। নয়তো এভাবে লুকিয়ে আসত না। ইউনিভার্সিটির কেউ কি?

লোকটা এবার মুখ খুলল। ডেভিড তার গলার আওয়াজ চেনার চেষ্টা করল। কিন্তু এর গলার আওয়াজ যেমনই হোক, এখন সেটা বিকৃত করে কথা বলছে। খুব সম্ভবত এই বিকৃত গলার স্বরটাও বেশ চর্চা করে তৈরি করা। তাই আনাড়ির মতো হুট করে আসল গলার স্বর বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

লোকটা বলল, “কেমন আছো ডেভিড?”

ডেভিড কোনো জবাব দিল না। লোকটা এবার জিজ্ঞেস করল, “কোথায় আছো জানো?”

ডেভিড এবারও জবাব দিল না। লোকটা সামান্য হাসল। হাসিটা অত মেকি মনে হলো না। বরং ডেভিডের কাছে খানিক পরিচিতই মনে হলো।

লোকটা বলল, “বুঝলাম, তুমি কাজের কথায় আসতে চাইছো। আমিও তাই চাই। আমি জানি তোমার কাছে যা যা ইনফরমেশন আছে সবটা তুমি অন্য কারো কাছেও ট্রান্সফার করেছ। সে কে?”

ডেভিড কোনো জবাব দিল না। লোকটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “সে কি তোমার গার্লফ্রেন্ড?”

ডেভিড এতক্ষণে বলল, “আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”

“ইভা পার্কার তাহলে কে?”

“ফ্রেন্ড।”

“ওকে! সে তোমার ফ্রেন্ড না আর কিছু তা জানার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তবে ফ্রেন্ডের কাছে কিছু আছে কি না সে ব্যাপারে অবশ্যই আগ্রহ আছে।”

“ওর কাছে কিছু নেই। আমি কি এত বোকা নাকি যে ওর কাছে এসব রাখব? ও এসবের কিছুই জানে না।”

“দ্যাটস গুড। তাহলে কে? তোমার কোনো সিনিয়র?”

ডেভিড জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না।

লোকটা এবার জানতে চাইল, “তুমি ঠিক কতদূর পৌঁছেছো ডেভিড? লাস্ট যার নাম জানতে পেরেছ সে কে?”

জবাব নেই।

“ড্রাগ ডিলারদের দলে নিশ্চয়ই একজন গাদ্দার আছে যে তোমাকে বেশ অনেক ইনফরমেশন পাস করেছে তার নাম কী”

জবাব নেই।

“তুমি কি নিজের বিপর নিজেই ডেকে আনতে চাও?”

জবাব নেই।

লোকটা আচমকা সজোরে টেবিল চাপড়ে বলল, “ফাজলামো পেয়েছ তুমি? কথা না বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

“কী করবে তুমি?”

লোকটা এবার সজোরে চড় মারল ডেভিডের গালে।

ব্যথায় ডেভিডের কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। তবুও সে হাসল। হেসে বলল, “মারবে? মারো! একেবারে মেরে ফেলো।”

“তোমার মতো শ*য়*তা*নের বাচ্চাকে একেবারে মেরে ফেলব? এতটা আশা করো কী করে? তোমাকে মারব তিলে তিলে একটু একটু করে।”

“যেভাবে ইচ্ছে মারো। আমার কোনো পিছুটান নেই।”

“তোমার গার্লফ্রেন্ড?”

“আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”

“তোমার গার্লফ্রেন্ড এখন কোথায়?”

“জানি না।”

“তাকে কোথায় লুকিয়েছ?”

“গর্ধবের মতো কথা বলছো তুমি। আমি নিজে যে তোমার কাছে ধরা পড়ব তাই জানতাম না। ওকে লুকাব কখন?”

“তাহলে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন?”

“আমি জানি না।”

“তোমার তথ্যগুলো কাকে কাকে দিয়েছ?”

“কাউকে না।”

বলার সাথে সাথে অপর গালে আরেকটা চড় খেল সজোরে।

এবার সে হাততালি দিতেই বাইরে থেকে অন্য লোক দুটো এসে ঢুকল। ডেভিডকে ধরে উল্টো করে ঝুলিয়ে দিল ছাদের একটা হূকের সাথে। একটু আগেই খেয়েছিল সে। খাবার মনে হচ্ছে সব গলা দিয়ে নেমে পড়বে। মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে। সে টের পেল তাকে মারা হচ্ছে নির্দয়ভাবে। অসহ্য যন্ত্রণায় বোধশক্তি ভোঁতা হয়ে যেতে লাগল তার। এর মাঝেও মনে প্রশ্ন জেগে রইল। ইভা কোথায়?

*********

জ্ঞান হারিয়েছিল ডেভিড। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে একটা শক্ত কিছুর ওপর শুয়ে আছে। উঠে বসল অনেক কষ্টে। সাথে সাথেই বমি করে উগড়ে দিল ভেতরের গরলটুকু। পাশেই একটা গ্লাসে পানি ছিল। পানি পান করল কোনোমতে। পুরো শরীর ব্যথায় টনটন করছে। হাত পা নাড়তেও ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছে। মারের বিভীষিকা মনে পড়তেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল তার। এমনটা আবারও নিশ্চয়ই হবে! মুখ না খুললে তাকে মার খেয়েই যেতে হবে। কিন্তু সে তো মুখ খুলবে না।

আবারও প্রশ্নটা মাথায় ধাক্কা দিল, “ইভা কোথায়? কোথায় থাকতে পারে?”

বসে থাকতে পারল না বেশিক্ষণ সে। আবারও শুয়ে পড়ল। শরীরটা ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে।

আবার যখন ডেভিডের ঘুম ভাঙল তখনও সে সেই শক্ত বিছানার ওপরেই শুয়ে আছে। তাকে ডাকছিল কে যেন। তাকাতেই সে চমকে উঠল চেহারাটা দেখে। এই লোকটাই গতদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সে চিনতে পারেনি। কেন চিনতে পারেনি? চেনা উচিত ছিল!

লোকটা একগাল হেসে বলল, “তুমি গেম খেলতে পছন্দ করো ডেভিড? চলো চমৎকার একটা গেম খেলি। জিতলে তুমি মুক্তি পাবে, হারলে তোমার প্রিয়তমা মুক্তি পাবে। মুক্তি মানে বুঝতে পারছো তো? হা হা হা….”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৪৮

অধরা অফিস থেকে বের হয়ে দেখল আকাশ মেঘলা। চমৎকার বাতাস বইছে। বাতাসে উড়ছে ধুলো, ঝরা পাতা আর গুমোট দিনের অস্বস্তি। ওর অফিসের পাশে একটা লম্বা কৃষ্ণচূড়া গাছভর্তি ফুলেরা লাল রঙের বাড়াবাড়ি দাপট দেখিয়ে পুরো এলাকাটা রাজকীয় করে রেখেছিল। আজ সেই ফুলের লাল পাপড়িতে ছেয়ে আছে রাজপথ। অধরার মন আপনাআপনি ফুরফুরে হয়ে গেল। দিনশেষের ধকল উবে গেল মুহূর্তেই। সে ঠিক করল আজ বাসে ঝুলে ঝুলে যাবে না। প্রথম বেতন পাওয়া গেছে, একদিন ক্যাবে করে চলে গেলে খারাপ হয় না। সে ফোন বের করে উবার কল করল।

আনমনা হয়ে প্রকৃতি দেখছিল, হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। শিশির!

“তুমি এখানে?”

“আসতে পারি না?” ভুরু তুলে বলল শিশির।

“আই ডিডন্ট এক্সপেক্ট ইউ হিয়ার।”

“তো কাকে এক্সপেক্ট করেছিলেন?”

অধরা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমরা একজন হ্যান্ডসাম মেল কলিগ আছে। তার আসার কথা ছিল।”

শিশির একপেশে হাসি হেসে বলল, “তাই নাকি? কোথায় দেখছি না তো আশেপাশে। অন্য কারো সাথে চলে গেল নাকি?”

“হুহ…”

“আমার ধারণা আমার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল তার সাথেই গেছে।”

“তোমার সাথে মেয়ে মানে?”

“ছিল একটা মেয়ে…”

অধরা শিশিরকে একটা ধাক্কা দিল। শিশিরের কিছু হলো না, অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। বরং অধরাই উল্টো একটু দূরে সরে গেল। সানগ্লাসে দারুণ লাগছে শিশিরকে। সে হাসতে হাসতে বলল, “যে ভেলোসিটিতে তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়েছ, আমি তার অর্ধেক দিলেও তোমার কী হবে ভেবেছ?”

“তুমি কোন মেয়ের সাথে এসেছ সত্যি করে বলোতো?”

“আরেহ, নিজে মজা করতে শুরু করে এখন আমার ফাজলামো নিতে পারছো না কেন?”

অধরা মুখ গোঁজ করেই টপিক বদলে ফেলল। “এখানে এসেছ কেন হঠাৎ? কাজ ছিল না তোমার?”

“কাজেই এসেছি। এক প্রফেসরের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। সাউথ আমেরিকায় থাকেন, এখন দেশে এসেছেন। অর্গানিক ফার্মিং নিয়েই তার পড়াশুনা, কাজকারবার। ভাইয়ার রেফারেন্সে পেয়েছি তার খবর৷ একবার চেষ্টাতে এপয়েন্টমেন্টও পেয়ে গেছি। ঘন্টাখানেক সময় দিলেন আমাকে। অনেক কিছু জানতে পেরেছি। কনফিডেন্স বাড়ছে বুঝলে!”

“বাহ! দারুণ তো! কী কী জানলে?”

“বাড়ি ফিরে বলব। খুব ইন্টারেস্টিং আলোচনা হয়েছে আজ।”

অধরার গাড়ি চলে এলো। সে গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, “‌যাবে নাকি যে মেয়ের সাথে এসেছ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে?”

শিশির উঠে বসল।

অধরা জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাসটা আস্তে আস্তে ঝড়ে রূপ নিচ্ছে। এই ঝড়ের এক আলাদা রকমের প্রলয়ঙ্কারী সৌন্দর্য আছে।

হঠাৎ একটা গাছের ভ্যান চোখে পড়তেই গাড়ি থামাল অধরা। ভ্যানওয়ালা বোধহয় ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দ্রুত চালাচ্ছিলেন ভ্যানটা। অধরা তাকেও থামিয়ে একটা গাছ কিনে দ্রুত ফিরল।

শিশির বলল, “তোমার মাথার ঠিক আছে? এখন গাছ কেনার সময়?”

অধরা দাঁত বের করে হেসে বলল, “গতকাল বেতন পেয়ে সবার জন্য কিছু না কিছু কিনলাম। তবে মায়ামঞ্জরীর জন্য কিছু কেনা হয়নি। মায়ামঞ্জরীতে বাগানবিলাস নেই। এটা লাগালে দেখলে দেখবে ওর সৌন্দর্য কত বাড়ে!”

শিশির আপনমনে হাসতে হাসতে বলল, “পাগল!”

*********

ডেভিড আর রকম্যান মুখোমুখি বসে আছে। রকম্যান সামনে আসতেই অনেক না মেলা সূত্রগুলো মিলে গেছে ডেভিডের। কেন এই কেস সে বারবার, হাজারবার চেষ্টা করেও সমাধান করতে পারছিল না, কেন তার বহু প্রচেষ্টা শুরুতেই বিফল হয়ে যেত সব বুঝতে পারল। মনে পড়ল যেসব সিদ্ধান্ত সে হুটহাট নিয়েছে, রকম্যানকে রিপোর্ট করার সময় পায়নি সেগুলোই কাজে লেগেছে। এতদিন এসব সে ভাবেইনি। ভাবলে অনেক আগেই ব্যাপারটার মিমাংসা হয়ে যেত। নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছে হলো ডেভিডের।

রকম্যান হেসে বলল, “তুমি জেনকে চেনো ডেভিড?”

ডেভিড বিরক্ত মুখে তাকাল।

রকম্যান বলল, “বিরক্ত হবে না… জেন আমার গার্লফ্রেন্ড। তোমার অবশ্য চেনার কথা নয়। জেন ভীষণ ট্যালেন্টেড এন্ড সেক্সি! তোমার গার্লফ্রেন্ডের মতো অল্পবয়সেই বুড়ি নয়। কিন্তু কী জানো, ওর মনটা অনেক নরম। আজ তোমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখে ওর কষ্ট হয়েছে। তাই আমাকে আবদার করেছে তোমাকে একটা সুযোগ দেবার জন্য।”

“মানে?”

“মানে তোমাকে খুব দ্রুতই পরোপারে পাঠিয়ে দেবার প্ল্যান ছিল আমার। জেন এই ব্যাপারে সবই জানে। সে বলল, কাজটা ঠিক হবে না। সে যেমন ট্যালেন্টেড, তেমনই ট্যালেন্টের খাতির করতে জানে। তোমার কাজ দেখে তার তোমার জন্য সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে।”

“তো?”

“তো… তো… আই অ্যাম জেলাস! আচ্ছা, খুলেই বলি। ইভাকে আমার সিক্রেট এরিয়াতে নিয়ে এসেছিলাম এটা জানার জন্য যে সে এই প্রোজেক্টের ব্যাপারে কতটুকু জানে। বেহুশ করে জেন ওকে হিপনোটাইজ করে দেখেছে মেয়েটা কিছুই জানে না। কিন্তু একই সাথে এটাও জেনেছে যে সে তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তখন জেন আমাকে বলেছে, তোমাকে এভাবে মেরে ফেলাটা তোমার আর ইভার জন্য ইনজাস্টিস হবে। সে তার নিজের তৈরি একটা গেম প্ল্যান দিয়েছে আমাকে। ভার্চুয়াল গেম। তবে সাধারণ কিছু না। হয় এসপার নয় ওসপার টাইপ কিছু। গেমটা খেললে হয় তুমি জিতবে, তোমার গার্লফ্রেন্ডকেও ফিরে পাবে। আমি হারব। আর যদি তুমি হারো তাহলে তোমার সাথে সাথে ইভাকেও হারতে পারো। তখন দু’জন একসাথে শেষ হবে।”

ডেভিড চোখমুখ শক্ত করে বলল, “আমাকে মেরে ফেলো। আমি এসব গেম খেলব না।”

রকম্যান ঘর কাঁপিয়ে হেসে বলল, “সেটা পসিবল না মিস্টার স্পাইক। তোমাকে যে খেলতেই হবে। এটাই একমাত্র পথ।”

ডেভিড বিষ দৃষ্টিতে তাকাল রকম্যানের দিকে। ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে তার। অন্যদিকে ইভার জন্য দুশ্চিন্তায় মাথা টনটন করছে। এই শয়তানটা ইভার সাথে কী করেছে কে জানে! নিজের ওপর এত রাগ তার কখনো হয়নি। তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এসব হচ্ছে। তার কখনোই উচিত হয়নি তার এই বিপজ্জনক জীবনে ইভাকে জড়িয়ে ফেলার।

“কী ভাবছ?” রকম্যানের কথায় সম্বিত ফিরল ডেভিডের। তবে কোনে উত্তর দিল না সে।

রকম্যান চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বলল, “এই ঘরেই একটা দরজা আছে। সাধারণ কোনো দরজা না, শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট কোড দিয়ে সেটা খোলে। কোডটা না পেলে এটা কোনোভাবেই খোলা সম্ভব না, একমাত্র ডিনামাইট দিয়ে এই বিল্ডিং উড়িয়ে না দিলে। তুমি জেনে আনন্দ পাবে যে সেই দরজার ওপাশেই আছে ইভা। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

তোমার সামনে এখন একটা স্ক্রিনে কিছু দৃশ্য ফুটে উঠবে। কিছু প্রশ্ন আসবে যেগুলোর সঠিক উত্তর তোমাকে দিতে হবে। তিনটা অপশন থাকবে, অপশনগুলোর মধ্যে বেছে নিতে হবে যে কোনো একটা। যদি উত্তর সঠিক হয়, তাহলে স্ক্রিনে সবুজ রঙ ভেসে উঠবে, আর দরজায় প্রথম কোডটা ইনপুট হয়ে যাবে। যদি স্ক্রিনে হলুদ রঙ দেখা যায় তাহলে দরজার কোড ভুল হবে, তখন তুমি ইভাকে বাঁচাতে পারলেও নিজে মরবে। কিন্তু যদি লাল রঙ দেখা যায়, তাহলে তোমারা দু’জনেই মরবে।

যদি প্রথম রাউন্ডে জিতে যাও তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে, দ্বিতীয়টা জিতলে শেষটা। সেটাও জিতলে দরজার তিনটা কোড ইনপুট হয়ে যাবে, আর দরজা খুলে যাবে। তুমি ইভার কাছে চলে যেতে পারবে। আর আমি নিজে থাকব ওপাশের একটা ঘরে। এই দরজাটা খুললে আমার ঘরের দরজা আপনাআপনি লক হয়ে যাবে, যেটা খোলার কোনো উপায় আমার থাকবে না। হয় আমি মরব, কিংবা জেনের কাছ থেকে ওই দরজার কোড জেনে তুমি আমার সাথে যা ইচ্ছে করবে। নাও গেম ইজ ইয়োর্স! ব্যাড লাক ডিয়ার জুনিয়র!”

রকম্যান বেরিয়ে গেলে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হবার থেকে বলা ভালো দেয়ালের সাথে মিশে গেল। বোঝার উপায় নেই ওখানে কোনো দরজা আছে। এরকম হয়তো আরেকটা দরজা আছে যার ওপাড়ে আছে ইভা।

আচ্ছা, সত্যিই কি আছে? নাকি সবটাই রকম্যানের শয়তানি? মিথ্যে বলছে?

বেশি ভাবার সময় পেল না ডেভিড। সামনে কোথা থেকে একটা স্ক্রিন জ্বলে উঠল। একটা ভিডিও প্লে হয়ে গেল। সাথে একটা প্রশ্ন।

ভিডিওটা একটা ঘরের। তাতে তিনজন মানুষ বসে আছে। একজন ডেভিডের অতি বিশ্বস্ত পুরানো কলিগ মাইক, দ্বিতীয়জন ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রী কাইলি, যে ড্রাগ এডিক্ট হয়েও তাকে তার প্রজেক্টে অনেক সাহায্য করেছে, এমনকি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে একবার বাঁচিয়েছে। আর তৃতীয়জন রকম্যান।

প্রথমে মাইক কথা বলল, “হাই ডেভিড, আমি তোমার থেকে প্রজেক্টটা কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম বলে ওপরমহলে তোমার ইমেজ খারাপ করেছি। তোমার চাকরির যে নড়বড়ে অবস্থা সেজন্য রকম্যানের থেকে আমি বেশি দায়ি। স্যরি ব্রো!”

কাইলি বলল, “ডেভিড, আমি তোমাকে কিছু ভুল তথ্য দিয়েছি। আমি একজন এডিক্ট। আর আমি কখনোই চাইব না ড্রাগ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাক। তোমাকে সাহায্যের নাম করে আমি তোমার প্রজেক্ট বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। স্যরি!”

এবার রকম্যান বলল, “এখন পাশার দান উল্টে গেলেও আমি সবসময় তোমার ভালোই চাইতাম ডেভিড!”

নিচের লেখাগুলো এবার পড়ল সে। “এদের মধ্যে একজন সত্য বলছে, একজন মিথ্যা বলছে, একজন সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বলছে। সত্য চুজ করলে স্ক্রিন সবুজ হবে, মিথ্যা চুজ করলে লাল, আর সত্য মিথ্যার মিক্সচার চুজ করলে হবে হলুদ।”

সাথে একটা টাইমার সেট করা, যেখানে সময় মাত্র তিন মিনিট।

ভিডিওটা বারবার শুরু থেকে প্লে হতে লাগল। ডেভিডের হাতে রিমোট। হাতটা কাঁপছে তার। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল মস্তিষ্ক সচল রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৪৯

ডেভিড ঠান্ডা মাথায় আবার পুরো ভিডিও দেখল। সাথে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল। ভিডিওটা সম্পূর্ণরূপে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে তৈরি বলে মুখ চোখের ভাব দেখে সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যা বের করার ওই কথার মধ্যে থেকেই বের করতে হবে।

মাইকের কথা শুনে প্রথমেই তার মাথায় একটা ঘটনা ক্লিক করে গেল। একটা মিশনে তারা দু’জন একসাথে কাজ করছিল। পাহাড়ি এলাকায় বরফের মধ্যে শত্রুদের আস্তানায় আটকে পড়েছিল ওরা দুজন। অনেক চেষ্টার পর সেখান থেকে ছুটে আসার সুযোগ হয়েছিল, তাও কেবল একজনের। ব্যাপারটা মাইকের হাতে ছিল। মাইক তখন নিজে না পালিয়ে ডেভিডকে সুযোগ করে দিয়েছিল। বলে দিয়েছিল, তুমি আমার থেকে বেশি যোগ্য। তুমিই কেসটা সেলভ করতে পারবে। আর যদি মরে যাই তবে আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিও। অবশ্য ডেভিডের বুদ্ধির কারনে পরে মাইকও বেঁচে ফিরেছিল।

সেই মাইকের মুখে এমন সস্তা কথা শুনে ডেভিড নিশ্চিত হয়ে গেল, এটা মিথ্যা।

এরপর রইল কাইলি আর রকম্যান।

কাইলির সাথে ডেভিডের পরিচয় অল্পদিনেরই। তবে ডেভিড কিছুটা হলেও মানুষ চেনে। কাইলি খারাপ মেয়ে নয়। কেবলমাত্র সঙ্গদোষে এডিক্ট হয়ে পড়েছে। সে যে রিহ্যাবে না গিয়ে নিজে নিজেই এর থেকে বের হবার চেষ্টা করছে তার অনেক প্রমাণ ডেভিড পেয়েছে।

কাইলির কথার মধ্যে “আমি একজন এডিক্ট” কথাটা সত্য। বাকিটা মিথ্যা বলেই মনে হলো ডেভিডের।

এরপর রকম্যানের ডায়লগ। “এখন পাশার দান উল্টে গেলেও আমি সবসময় তোমার ভালোই চাইতাম ডেভিড!”

ডেভিডের মনে পড়তে লাগল রকম্যানের সাথে তার কাজের কথা। তারা অনেকগুলো সফল প্রজেক্টে কাজ করেছে একসাথে। বস কখনো সেসব কাজে ওকে ক্রেডিট দিতে ভুল করেনি। ওর সবসময় মনে হয়েছে রকম্যান ওর ভালো চায়। এজন্যই লোকটার ওপর তার বিশ্বাসের পারদ বহু উঁচুতে উঠেছিল। এই বিশ্বাস ভেঙেছে ঠিকই, তবে তার মনে হয় লোকটা আগে এমন ছিল না। এই নির্দিষ্ট কেসটাতেই ওকে কেউ প্রচন্ড লোভ দেখিয়ে কিনে নিয়েছে। কারন লোকটা ভালো হলেও যে লোভী ছিল এটা ডেভিড আগে থেকেই জানত। তাই এর কথা সত্যি হবার সম্ভাবনা আছে।

তবুও ডেভিড কনফিউজড হয়ে রইল কাইলি আর রকম্যানের ভেতর। এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ডেভিড একবার টাইমারের দিকে চাইছে, একবার চাইছে ভিডিওর দিকে। টাইমার যেন মহা গতিতে চলছে। আর পাঁচ সেকেন্ড বাকি। তারপর চার… তিন… দুই… এক… ডেভিড ক্লিক করে দিল রকম্যানের অপশনে।

চোখ বন্ধ করে ফেলল সাথে সাথে। চারদিকে অখণ্ড নিরবতা নেমে এলো। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল ডেভিড। স্ক্রিনের দিকে চাইল।

সবুজ আলো জ্বলে আছে।

প্রচন্ড স্বস্তি নিয়ে চেয়ারে হেলান দিল সে।

স্বস্তি কয়েক সেকেন্ডই রইল। তারপর স্ক্রিন আবার সাদা হয়ে গেল। দ্বিতীয় প্রশ্ন ফুটে উঠল সেখানে।

স্ক্রিনে ছয়টা কার্ড। কার্ডগুলোর প্রত্যেকটিতে একটি করে লাইন লেখা। নিচে প্রশ্ন।

কার্ডের লেখাগুলোর মধ্যে তিনটি সত্য এবং তিনটি মিথ্যে। তোমাকে সত্য তিনটি কার্ডে ক্লিক করতে হবে। কার্ড উল্টে যাবে। কার্ডের পেছনে লাল রঙ দেখা গেলে উত্তর ভুল, আর সবুজ দেখা গেলে উত্তর সঠিক। এই রাউন্ড জিততে হলে তিনটিই সঠিক উত্তর দিতে হবে।

ডেভিডের কপালে চিকন ঘাম দেখা গেল। এই বাক্যগুলো প্রচন্ড রকমের কনফিউজিং!

কার্ড ১: তুমি যাকে ভালোবাসো, সেই তোমাকে সবচেয়ে বেশি ডুবিয়েছে।
কার্ড ২: তোমার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই পর্যন্ত দশজন মারা গেছে।
কার্ড ৩: কাইলি তোমাকে ভালোবাসে।
কার্ড ৪: তুমি তোমার ভুলগুলো দেরিতে বুঝতে পারো।
কার্ড ৫: সব আইওয়াশ ছিল, কেসটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
কার্ড ৬: এই ঘরের পাশে কোনো ঘর নেই, আছে ঘন জঙ্গল।

এবার টাইমারে সময় দেখাচ্ছে দুই মিনিট!

ডেভিড বারবার লেখাগুলো পড়ল। কিন্তু মাথায় যেন কিছু ঢুকছে না, এদিকে সময় ছুটছে রকেটের গতিতে।

এবারও দুই মিনিট শেষ হবার প্রায় কাছাকাছি সময়ে কার্ডগুলোতে ক্লিক করল ডেভিড। শ্বাস বন্ধ করে বসে রইল উত্তরের জন্য ।

******

শিশিরে ফ্যাক্টরিটা চালু হয়ে গেলে সে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এতই ব্যস্ত হয়ে ঠিকমতো খাওয়ারও সময় পায় না, অধরার সাথে কথা বলার সময় তো দূরের বিষয়। অধরা অফিস থেকে আসে, অপেক্ষা করে বসে থাকে শিশিরের জন্য। কোনো কোনোদিন সে চলে আসে তার আটটা নয়টার মধ্যে, তবে বেশিরভাগ দিন তার বাজে দশটা এগারোটা। এসেই কোনোরকম খেয়ে ঘুম। অধরা প্রায়ই অভিযোগ করে, “এটা কি ঠিক হচ্ছে? এটা কেমন জীবন?”

শিশির তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আর ক’টা দিন মাত্র। তারপর কাজের চাপ কমে যাবে। একদম স্টার্টআপ তো, তাই ভীষণ ঝামেলায় আছি।”

অধরার কেন যেন মনে হয় এই ব্যস্ততা আর শেষই হবে না।

একদিন সে বাবার সাথে বাগানে চায়ের কাপ নিয়ে বসল। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বাবা, আপনিও তো শুরু থেকে বিজনেস শুরু করেছিলেন। আপনিও কি এত ব্যস্ত ছিলেন? এভাবে মাকে সময় দেননি? সারাদিন কাজ নিয়ে থেকেছেন?”

বাবা যেন কিছুক্ষণ স্মৃতি হাতড়ে বেড়ালেন। তারপর মৃদু হেসে বললে, “তা কিছুদিন হয়েছিলাম বটে! তবে তোমার বরের মতো এত ডেস্পারেট হয়ে উঠিনি। ওকে যেন জেদ পেয়ে বসেছে। সফল হবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমার লক্ষ্য এত বড় ছিলই না, শুধু সততা ছিল, ভালো করার ইচ্ছে ছিল, বাকিটা আল্লাহ দিয়ে দিয়েছিলেন।”

অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর ভালো লাগে না।”

বাবা বললেন, “এই নেশা এত সহজে ছোটে না রে মা। বড় কঠিন নেশা এই নেশা।”

“আমি কী করব বাবা?”

“কিছুই না। শুধু দোয়া করতে পারো।”

অধরা ওপরের দিকে তাকাল। বাগানবিলাসটা অনেক শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে ছেয়ে গেছে দোতলা। কী ভীষণ সুন্দর লাগে এখন মায়ামঞ্জরী! বাইরে থেকে হঠাৎ দেখলে থমকে দাঁড়ায় লোকে। কয়েক পলক চেয়ে থাকে এই চমৎকার পুরানো ধাঁচের বাড়িটার দিকে, যে যত্ন নিয়ে ফুটিয়েছে অজস্র বাগানবিলাস।

********

“তুমি যাকে ভালোবাসো, সেই তোমাকে সবচেয়ে বেশি ডুবিয়েছে।”

১ নং কার্ডের কথাটা মিথ্যা। কারন ডেভিড একজনকেই ভালোবাসে। সে হলো ইভা। ইভা তাকে ডোবাবে না। আর যদি ডুবিয়ে থাকে, তাহলে তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সে মরে যাক, আফসোস নেই।

“তোমার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই পর্যন্ত দশজন মারা গেছে।”

২য় কার্ডের বাক্যটাও ভুল। তার জন্য বিভিন্ন মিশন মিলে দশজন মারা গেছে এটা সত্য, তবে সেগুলো তার ভুল সিদ্ধান্তের কারনে নয়। ওই পরিস্থিতিগুলোতে তার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

“কাইলি তোমাকে ভালোবাসে।”

৩য় কার্ডের কথাটা ডেভিডকে কনফিউশানে ফেলে দিল সবচেয়ে বেশি। তার বিভিন্ন সময় মনে হয়েছে কাইলির তার জন্য সফল কর্ণার আছে। কিন্তু সেটা ভালোবাসা কি না সে নিশ্চিত নয়। এই অপশনটা সে হাতে রাখল।

“তুমি তোমার ভুলগুলো দেরিতে বুঝতে পারো।”

৪র্থ কার্ডের কথাটা শতভাগ সত্য নিঃসন্দেহে!

“সব আইওয়াশ ছিল, কেসটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।”

৫ম কার্ডের লেখাটার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সময় ভাবল, যদিও সময় ওই দুই মিনিটেই সীমাবদ্ধ! তবুও অন্য প্রশ্নগুলোর তুলনায় এটা সবচেয়ে বেশি ভাবাল। একাডেমিক বিষয় সে দেখে না অনেকদিন। ছদ্মবেশে অফিসে যায়। কেসের ব্যাপারে সব তথ্য রকম্যানের কাছে আছে। তাই কেস ক্লোজ হয়ে যেতেই পারে, হতেই পারে রকম্যান তাকে জানায়নি।

“এই ঘরের পাশে কোনো ঘর নেই, আছে ঘন জঙ্গল।”

শেষ কার্ডের কথাটাও নির্ভর করছে সে রকম্যানকে বিশ্বাস করবে কি না তার ওপর।

এদিকে দুই মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। তিন সেকেন্ড বাকি থাকতে তিনটা অপশনে ক্লিক করল সে দ্রুত হাতে। অত ভাবার সময় পেল না। স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে চয়েজ করল তিন, চার আর পাঁচ নং কার্ড।

স্ক্রিন যেন আটকে গেছে এরপর। সময় যাচ্ছে না। কার্ড ওল্টাচ্ছে না। ঘামে ভিজে গেছে ডেভিডের পুরো শরীর। যেন এক যুগ পেরিয়ে গেল। আসলে পেরুল এক সেকেন্ড৷

কার্ড উল্টে গেল। সেই সাথে বিপ করে একটা শব্দ হলো।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু