মাশুল পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
632

#মাশুল (দশম ও শেষ পর্ব)।

আয়ারল্যান্ড যাওয়ার সিদ্ধান্ত ক‍্যান্সেল করায়, মুহূর্তেই সমস্বরে সবার হাততালি আর আনন্দ চিৎকারে পাশের রুমগুলোর ব‍্যাচেলর টিচাররা পর্যন্ত দৌড়ে এলো। ইন্টারেস্টিং কিছু একটা হচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে ওরাও উৎফুল্ল। আমার কাল চলে যাওয়ার ক‍্যানসেলেশন ডিসিশানটায় সবার মুখে আনন্দের হাসি, এমনকি হঠাৎ দৌড়ে আসা লোকগুলোর চোখেও।

এরপরই আশফাক আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। অবাক হলাম, এরই মধ‍্যে ও আমার জন‍্য একমাসের একটা ট‍্যূর শিডিউল তৈরী করেছে।

আমাদের ক্লাসমেট ফরিদ, এখন সিলেটের শাহজালাল ইউনিভার্সিটির টিচার। ভার্সিটিতে থাকার সময়, আমার সাথে খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না। পড়াশোনায় কম্পিটিটরস, রেষারেষি চলতো! সেই ফরিদের ওখানে তিনদিনের ট‍্যুর। ফরিদ আমাকে পুরো সিলেট ঘুরিয়ে দেখানোর উত্তেজনাতে আছে!

অনেক মিনি গ‍্যাদারিং, দাওয়াত আর মুভি দেখার প্ল‍্যানের মধ‍্যে, শেষ সপ্তাহে কক্সবাজারে যাওয়ার সিডিউল দেখে অবাক হলাম। তিনটা বন্ধু পরিবার আমাকে নিয়ে চারদিনের ট‍্যুরে কক্সবাজার যাবে। এর মধ‍্যে শিলার পরিবারও থাকবে !

এরপর থেকে আয়ারল্যান্ড রওনা দেওয়ার মাঝের পঁচিশ দিনের স্মৃতি আমি কখনোই ভুলবো না! প্রতিটা দিন স্বপ্নের মতো কেটেছে। বন্ধুরা সবাই আমাকে সময় দিল যে যার মতো, সাধ‍্যাতীতভাবে।

এতদ্রুত শিডিউলটা কিভাবে ও করতে পারলো? আশফাককে জিজ্ঞেস করতেই অবাক হলাম, বন্ধুদের ভালোবাসায় হয়ে গেলাম ঋণী, সারাজীবনের জন‍্য।

ফ্ল‍্যাশব‍্যাক: রি ইউনিয়ন ডে।

আশাহত হওয়া সে রাতটায় আমার কন্ডিশনটা আশফাকের কাছে খুব খারাপ মনে হয়েছিল। সারারাত আবোল তাবোল বকেছি। হঠাৎ আয়ারল্যান্ডে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াতে আশফাক খুবই কষ্ট পেল। সাথে সাথেই আমাদের ফেসবুক গ্রুপটাতে অন‍্য বন্ধুদের জানিয়ে দেয়, দুঃখ পেয়ে আমার দ্রুত দেশ ছাড়ার ঐ সিদ্ধান্তের কথাটা! বন্ধুদের প্রত‍্যেকেই পুরো বিষয়টিতে বেশ কষ্ট পেল।

সবার উপলব্ধি আর সম্মিলিত উদ‍্যোগেই এতো দ্রুত এ সব আয়োজন করা। আর শিলার সাথেও আশফাকের কথা হয়েছে অনেকবার। সব কিছু বুঝেই, শিলার মধ‍্যেও তীব্র অপরাধবোধ! তাইতো সবার একটাই চাওয়া, আয়ারল্যান্ডে ফেরার আগে আমি যেন ভালো সময় কাটিয়ে যাই!

প্রতিদিনই ব‍্যস্ত ছিলাম বন্ধু ও পরিজনদের নিয়ে। মাঝে দুদিনের জন‍্য আবারো চাঁদপুর গেলাম, সবাইকে অবাক করে দিয়ে।

আমি সহ আরো কয়েকজনকে শিলা ওর বাসায় ইনভাইট করলো। শিলার বাবা মায়ের অনেক গল্প শুনেছি, সেদিনই প্রথম দেখা হল! আরিয়ানার সাথে ততদিনে আমার অনেক ভাব হয়ে গেছে, নীলু আংকেল বলে ডাকে। আমাকে অনেক আপন বলেই ভাবতে শুরু করেছে।

আরিয়ানা এক গাদা ফটো এলবাম এনে ওর বাবাকে দেখালো। বাবার অনেক গল্পও শুনায়। এলবামগুলো দেখেই বুঝলাম পরিবারটা সুখে ভাসা এক সংসার ছিল। আরিয়ানা জোর করে ওর রিডিং রুমে নিয়ে গেল। অবাক হলাম ওর পেইন্টিং স্কিল দেখে, খুব ন‍্যাচারাল আর বয়সের তুলনায় অনেক পরিনত এক শিল্পী!

শিলার বাবা সম্ভবত আমার মুখোমুখি হতে লজ্জা পেল! নাতনি ও কন‍্যা দায়টা ভদ‍্রলোকের চোখে মুখে স্পষ্ট। আচরণে বুঝলাম, আমার হঠাৎ এ দেশে আসাটাতে খুব খুশী হয়েছেন। হয়তো শিলার সাথে আমার বিয়ের সম্ভবনাটাও দেখছিলেন, খুশি মনে। কিন্তু ভদ্রলোক হয়তো জানেনই না যে আমি এরই মধ্যে প্রত‍্যাখিত।

আশফাক, জিয়া আর শিলার পরিবারের সাথে কক্সবাজার গেলাম আকাশ পথে, আয়ারল্যান্ড ফেরার ঠিক কয়েকদিন আগে। শিলার বাবা অবশ‍্য এ ট‍্যুরে ছিলেন না। ছাত্র জীবনে পিকনিকে একবারই কক্সবাজার এসেছিলাম। এক যুগ পর সেই কক্সবাজারকে চিনতেই পারলাম না! অনেক পরিবর্তিত এক বীচ ও শহর!

সেন্ট মার্টিনেও প্রথমবারের মতো গেলাম, সত‍্যিই অভিভূত হলাম দ্বীপের সৌন্দর্যে। আশফাক একরাতের জন‍্য দ্বীপের নামী একটা রিসোর্টে থাকারও ব‍্যবস্হা করলো।

কক্সবাজারে এসে শিলাকে নিয়ে পুরনো ভাবনাটা আবারো ফিরে এলো, একবার প্রত‍্যাখানের পরও। সম্ভবত খুব কাছাকাছি মেশার সুযোগ আসাটাতেই। আরিয়ানার প্রতি তৈরী হওয়া মায়াটাও হয়তো প্রভাবিত করেছে। কিংবা ওদের দুজনেরই দ্বায়িত্ব নেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা! মানুষের মন সত‍্যিই বিচিত্র!

সেন্ট মার্টিনের আবহওয়া ছিল এক কথায় চমৎকার। ছেঁড়া দ্বীপ ঘুরে এসে বেশ ভালো লাগল। সন্ধ্যায় আশফাকের একটা সারপ্রাইজড আয়োজনে সবাই চমৎকৃতও হলাম।

হোটেল স্টাফদের সহায়তায় আমাদের জন‍্য বিশাল এক বারবিকিউর আয়োজন, একদম পানির কাছাকাছি। কাঠের আগুনে সমুদ্রের পাশে বিবিকিউর ঐ আয়োজনটা আসলেই বেশ স্পেশাল ছিল! পরে বুঝেছি, আশফাক ইচ্ছা করেই একটা রোমান্টিক আবহ তৈরী করার চেষ্টা করেছে। বন্ধুর আশা পূরনের শেষ চেষ্টা হিসেবে! সবমিলিয়ে রাতটার কথা সবারই সারা জীবন মনে থাকবে।

বন্ধু জিয়া খুব ভালো গান গায়। প্রফেশনালদের মতোই। সাথে গিটার নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামতেই বারবিকিউর সাথে একটার পর একটা প্রিয় গান গেয়ে যাচ্ছে! সবাই নস্টালজিক হয়ে উঠলাম! গানের ফাঁকে ফাঁকে আমার চোখ বারবারই শিলাকে বোঝার চেষ্টায়।

প্রচন্ড রোমান্টিক পরিবেশে শিলাও গানের তালে তালে দুলছে। হয়তো আমারই মতো ফিরে যাচ্ছে পুরনো দিনে। আমার দিকে আজ ওর তাকানোটাতেও অদ্ভুত মাদকতা, শিহরিত হলাম বার বার। রাত বাড়ার সাথে সাথে আরিয়ানা ওর নানীর কোলে ঘুমিয়ে গেল। ওদেরকে হোটেলে রেখে শিলা আমার পাশে এসে বসলো, এবার বেশ কাছাকাছি। সূরের মূর্ছনায় সবাই আচ্ছন্ন, স্মৃতিকাতরতায় বিভোর!

চাঁদনী রাতে পানিতে চাঁদের আলোর লুকোচুরি খেলা, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের আছড়ে পরার মৃদু শব্দ, বাড়তি একটা সিনেমাটিক আবহও তৈরি করলো! ভালোবাসার ব‍্যথাটা অনুভব করতে লাগলাম প্রবলভাবে।

রাত দুটোর দিকে থামতে হলো, সবাই বেশ টায়ার্ড। তবে আমার দুচোখে ঘুম নেই। পুরনো সেই ভাবনাটা গাঢ় ভাবে আবারো আজ ভর করলো, শিলাকে নিয়েই। আশফাক আর জিয়া দুজনেরই প্রেমের বিয়ে, ওদেরকে কিছু বলতে হলো না। শিলা আর আমাকে ভীষণ রোমান্টিক পরিবেশটায় রেখে ওরা চুপিচুপি হোটেলে চলে গেল।

চাঁদের আলোতে প্রবাল গুলোকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে! সমুদ্রে জোয়ার শুরু হয়েছে, দুজনেই অল্প পানিতে পাশাপাশি হেটে প্রবালের কাছাকাছি চলে এলাম। খুব আলতো করে পরিচিত ভঙ্গিতে ওর হাতটাও ধরলাম। হয়তো পবিত্রতা ছিলো বলে, বাধা পাইনি। হঠাৎ করেই নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। বেশ খানিকক্ষণ নিঃশব্দে হাটলাম, দুজনের কাঁপা হাতের বন্ধনে।

হাটু পানির দুরত্বের একটা প্রবালে শিলা বেশ সাবধানে বসলো। আমি ওর পাশে হাত ধরে দাড়িয়ে। চাঁদের স্পষ্ট আলো শিলার মুখে পরতেই মনে হলো স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন এক অপ্সরী! বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম, অনেকক্ষণ।

“শীলু, আমার কথাটা কি নতুন করে ভাবতে পারো? আরিয়ানা আর তোমার জন‍্য খুব কষ্ট পাবো?” প্রশ্নটার সাথে করা কান্নাটায় আমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না! শিলা তখনও চুপ, ওর চোখেও অঝোর বন‍্যা। প্রবালে সমুদ্রের মৃদু ঢেউয়ের ধাক্কা, চাঁদের ভরাট আলো আর চারিদিকের শুনশান নিরবতায় তৈরী হওয়া পরিবেশটার সাথে দুজনের কান্না মিলেমিশে একাকার।

“নীলু, সত‍্যি করে বলছি। এবার প্রথম যেদিন আগ্রহটা জানালে, সেদিন থেকেই বিষয়টা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভেবেছি। আর ভাববোই বা না কেনো বল? আমি মধ‍্য তিরিশের এক সিঙ্গেল মাদার, এ সমাজের প্রতি পদে পদে হাজারো প্রতিবন্ধকতা! তার উপর তুমি আমার এক সময়ের সবচেয়ে আপনজন। সত‍্যিকার অর্থেই ভালো একটা ছেলে, ভালোবাসাটাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে।” কথাগুলো বলে শিলা একটু থামলো। উত্তেজনায় আমি আমার নিজের হার্টবিট স্পষ্ট শুনতে পারলাম।

“তোমার ব‍্যাপারে আরো সিরিয়াসলি ভাবতে হলো আরিয়ানার কারনেই। প্রথম দিন দেখা হওয়ার পর থেকেই মেয়েটার মুখে শুধুই “নীলু আংকেল” আর “নীলু আংকেল। তোমাকে প্রচন্ড আপন করে নিয়েছে, নিজে থেকেই। মনে হল, হয়তো প্রকৃতি আমাদের মিলন চাচ্ছে আরিয়ানার মাধ‍্যমেই। তোমাদের এ সহজাত সখ‍্য আর শুভাকাংখীদের উপদেশ, তোমাকে নিয়ে অনেক ভাবিয়েছে নেহাল।” শিলার কথাতে শীতলতা। তারপরও এক বুক আশা নিয়ে ওর মনোভাব জানার চেষ্টায়।

“বিশেষ করে কক্সবাজার আসার আগের দু রাত আমার এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তোমার পক্ষ থেকে অনুরোধটা আবারো আসবে। শেষবারের মতো না করে দেওয়ার আগে তাইতো নিজের সাথে বেশ ভালো করেই যুঝলাম।

জানি কথাটা শুনে কষ্ট পাবে, শিহাবের দিয়ে যাওয়া অসীম ভালোবাসাটারই কিন্তু শেষ পযর্ন্ত জয় হল। নীলু সত‍্যি বলতে কি আমি মৃত শিহাবকেই এখনো ভালোবাসি। তাই সম্ভবত এ জীবনে আর কাউকে আর ভালোবাসতে পারবো না।

তোমার হাতে অনেক অপশন! তোমাকে ঠকাতে চাই না নেহাল! আমি অনেক চিন্তা করেই কথাটা বলছি। তুমি যা ভাবছো সেটা করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।” শিলার সরাসরি প্রত‍্যাখানে আবারো বড় একটা ধাক্কা খেলাম। হঠাৎ তৈরী হওয়া প্রবল আশা ভঙ্গের বেদনায় চুপ করে রইলাম।

“বিশ্বাস করবে না নেহাল, মৃত শিহাবের ভালোবাসা আমার কাছে কতোটা শক্তিশালী! একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। দারফুরের হামলায় গুলি খাওয়ার পরও প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বেঁচে ছিলো শিহাব। যতক্ষণ সেন্স ছিল শিহাব নাকি শুধু আমার কথাই বলেছে। মিশনে থাকা অনেক সৈনিকই পরে ঘটনাগুলো বলেছে। প্রত‍্যেকেই কেঁদেছে, পরিবারের প্রতি ওদের স‍্যারের থাকা ভালোবাসাকে দেখে। সৈনিকদের মুখে মুখে এখনো আমার আর শিহাবের ভালোবাসার গল্প।” শিলার কান্নাটা এবার অবধারিত ভাবেই। আমিও চুপচাপ!

“এবার অন‍্য প্রসঙ্গগুলো বলি। তোমার মিসআন্ডারস্ট‍্যান্ডিংটা দূর করার জন‍্যই!

সমাজে খুব কম লোকই আছে যারা স্ত্রীর বিয়ে পূর্ব গভীর প্রনয়কে পরবর্তীকালে দূর্বলতা বা অস্ত্র হিসেবে ব‍্যবহার করবে না। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, শিহাব ওর জীবদ্দশাতে এক দিনের জন‍্যও এ বিষয়ে কথা তুলেনি! আর বৈষয়িক বিষয়ের সবকিছুতো ও শুধু আমার নামেই করেছে, এমনকি জমির প্লটটাও।” শিলা আরো প্রমাণ দাড় করাতে চাইলেই আমি থামিয়ে দিলাম।

আজকের অপার্থিব সুন্দর সময়টাকে আর নষ্ট করতে চাইনি। এরপর নীরবতাকে সাথে নিয়েই দুজনে হোটেলে ফিরলাম। বাকি রাতটুকু আমি আর এক ফোঁটাও ঘুমাইনি। একা একা শুয়ে থাকলাম হোটেলের সামনের শোয়ার বেঞ্চিটায়। ভোরের আকাশে সমুদ্র দেখার সুন্দর অভিজ্ঞতাটা সেবারই প্রথম হল, ভগ্নহৃদয়ে।

পরদিন কক্সবাজার হয়ে রাতের ফ্লাইটে ঢাকা ফেরার পথটায় সংযত থাকলাম। অন‍্যরাও সম্ভবত ক্লান্ত! এয়ারপোর্টে শিলা আর জিয়ার পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, সুন্দর সময় উপহারের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে। আয়ারল্যান্ড যাওয়ার আগে আরিয়ানার সাথে আর দেখা হবে না, এটা ভাবতেও কষ্ট পেলাম। এই কয়দিনে মেয়েটার সাথে একটা মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গেছি, নিজের অজান্তে। বিদায় মুহূর্তে কাঁদছি দেখে, আরিয়ানা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “নীলু আংকেল, কাঁদছো কেন? তোমার কি হয়েছে?”

ওদের বিদায় দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে জাহাঙ্গীরনগরের ক‍্যাম্পাসে ফিরছি, আশফাকের সাথে। সারা রাস্তায় বন্ধু বা বন্ধু পত্নী একটা কথাও বলেনি। দুদিন পর আমার লিমেরিকের ফ্লাইট, ওরা আমাকে আমার মতোই থাকতে দিল। আমি শেষ দুদিন ক‍্যাম্পাসেই থাকলাম। হেঁটে হেঁটে আমার আর শিলার স্মৃতি জড়িত জায়গাগুলোকে শেষবারের মতো দেখে নিলাম, ছবি তুলে নিলাম অজস্র। দেশে হয়তো আমার আর আসা হবে না, এই ভাবনাটা থেকে।

বিকাল চারটায় আমার ফ্লাইট। প্রথমে ঢাকা থেকে লন্ডন, সেখান থেকে ডাবলিন হয়ে লিমেরিকে যাবো। ট্রানজিট সহ প্রায় বাইশ ঘন্টার জার্নি। ইচ্ছে করেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম। লাগেজ আগেই গোছানো ছিল। সকাল এগারটার দিকে আশফাক আর আমাদের আরেক বন্ধু হেলাল এলো আমাকে এয়ারপোর্টে সিঅফ করতে। প্রচন্ড মন খারাপের অনুভূতি তখনোও ভালো হয়নি। পুরোটা পথই চুপচাপ থাকলাম।

আশফাককে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষাটা আমার জানা ছিল না! শুধু বুকে বুক জড়িয়ে ধরে থাকলাম অনেকক্ষণ। আমার জন‍্য এবারের ট‍্যুরটায় ও যা করেছে তা বর্ণনাতীত। এই শেষ সময়ে ট্রলিতে আমার লাগেজটাও উঠিয়ে দিল পরম মমতা নিয়ে। এয়ারপোর্টে আমার দুভাই চাঁদপুর থেকে এসেছেন বিদায় দিতে। ওরাও কাঁদছে। প্রত‍্যেকের চোখই বলছে, এটাই হয়তো আমার সাথে শেষ দেখা!

লাগেজটা এয়ারলাইন্সে চেক ইন করে, কাস্টমসের ডিক্লারেশন কার্ডটা ফিল আপ করছি। এমন সময় দেখি আরিয়ানা দৌড়ে আসছে, পিছনে শিলাও। প্রথমে ভেবেছিলাম ইলিউশনে আছি, স্বপ্ন দেখছি।

আরিয়ানা আমাকে জড়িয়ে ধরতেই সম্বিৎ ফিরলো! ওর হাতে একটা পেইন্টিং। শিলা হাপাতে হাপাতে বললো ভাগ‍্য ভালো বলেই নাকি আমার সাথে ওদের এই শেষ দেখাটা হয়েছে!

” সারারাত নির্ঘুম তুমি আজ চলে যাচ্ছ বলে। হাজারো ভাবনায় বিভোর থাকলাম। নিজের সাথে ঝুঝতে থাকা এই আমি শেষ পযর্ন্ত হেরে গেলাম। দুপুরের দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার সাথে দেখা করবো। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, ভাবনায় পড়ে গেলাম আদৌ তোমার দেখা পাবো কি না।

আরিয়ানাকে বললাম তোমার নীলু আংকেল আজ আয়ারল্যান্ড চলে যাচ্ছে! দ্রুত রেডি হও আমরা দেখা করবো। বেচারী তখন থেকেই গো ধরেছে তোমাকে ওর আঁকা সবচেয়ে সুন্দর পেইন্টিংটা গিফট করবে।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথেই ফোন করে তোমাকে পেলাম না। এরপর আশফাককে ফোন দিতেই বললো মাত্রই নাকি তোমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে এসেছে। চারটায় ফ্লাইট।” এতটুকু বলেই শিলা পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়লো, সম্ভবত দৌড়ে আসার ধকলটা সামলাতে!

” আমার হাতে তখন মাত্র তিন ঘন্টা, তারপরও রিস্ক নিয়েই এই চলে এলাম এক মুহূর্তও দেরী না করে। কাফরুল থেকে এয়ারপোর্টের পথটায় শুধু আল্লাহ্কেই ডেকেছি, তোমার সাথে যেন দেখাটা করিয়ে দেয়।” শিলার মুখে বিজয়ী হাসি, আমার সাথে একেবারে শেষ মুহূর্তে দেখাটা হল বলে।

পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ভীষণ অবাক! ইতোমধ্যে আশেপাশের কিছু উৎসাহি লোক সিনেমার মতো কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে গন্ধ পেয়ে আমাদের উপর তীক্ষ্ণ নজরে। আরিয়ানার দেওয়া উপহারটা নিলাম পরম মমতা নিয়ে। জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দ কান্নায়। এতো ছোট মেয়েটাও কিভাবে যেন ভালোবাসাটাকে পড়ে নিল। প্রানভরে দোয়া করলাম অসম্ভব গুনী এই মেয়েটার জন‍্য।

শিলার দিকে আজ আর তাকাতে পারছি না। বিভ্রান্ত হলাম বার বার। ওর দৃষ্টিটা বেশ পরিবর্তিত। বরাবরের মতো থাকা কঠোরতাটা আজ কেনো জানি ওর মধ‍্যে নেই। সেই সাথে প্রশ্রয়ের হাসিও! তবে আমি পোড় খাওয়া, অন‍্য কিছু ভাবার সাহস নেই। তাইতো মন খারাপ নিয়েই বিদায় পর্বে।

এরপর শিলার বলা কথাগুলো নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকলো

“নিজের সাথে অনেক যুঝলাম নীলু, শেষ পযর্ন্ত আর পারলাম না। অনেক ভেবে চিন্তেই শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে এখানে আসা।

গত রাতে মৃত শিহাব আমার ভাবনায়। আচ্ছা নিলু, শিহাবের জন‍্য আমার ভালোবাসাটা কিন্তু আজীবন থাকবে। এটা কি তুমি মেনে নিতে পারবে? পারবে, আমাদের মা মেয়েকে সারাজীবনের জন‍্য একইভাবে ভালোবেসে যেতে?”

পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবাক। আশে পাশে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেল। সবকিছুই যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে! আমার চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু ঝরছে। নিঃশব্দে শিলা আর আরিয়ানাকে জড়িয়ে ধরলাম, আমৃত্যু ভালোবাসার আশ্বাস জানান দিয়ে।

(শেষ।)