মায়ের কষ্টের গল্প
লেখক-লিটু চৌধুরী রক্তিম(লাভ গুরু)
সকাল থেকে সেলিম এর মায়ের শরীর টা খুব খারাপ।তার শরীর যে খারাপ সেটা
কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না।যদি ছেলেগুলো বুঝিতে পারে তাহলে সবাই চিন্তায়
পড়ে যাবে ।এই শেষ বয়সে এসে ছেলেদের ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে এটাই তার ছেলেদের
কাছে অনেক সময় বোঝা মনে হয়। আবার যদি অসুখের কথা বলে তাহলে সেটা আরো
খারাপ হবে।
,
সেলিমেরা চার ভাই।চার ভাই এর মাঝে সেলিম ই সব চেয়ে ছোট। সে ঢাকা
থাকে,সেখানেই পড়াশোনা করে। তাকে নিজের রোজগারের টিউশনির টাকা দিয়েই চলতে
হয়।বাড়ি থেকে টাকা নেওয়ার মত অবস্থা তার থাকে না।কে তাকে টাকা পয়সা দিবে?
বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছেন।আর ভাইয়েরা নিজেদের পরিবার নিয়েই ঠিক মত
চলতে পারে না।আবার ওকে কিভাবে সাহায্য করবে।তাই সেলিম কষ্ট করেই জীবন পার
করে যা চ্ছে।মাঝে মাঝে তার ও খুব ইচ্ছে করে মাকে ঢাকায় নিয়ে এসে
রাখতে।কিন্তু কোন উপায় তো নেই।সামনে একদিন সেলিম এর ও ভালো সময় আসবে,তখন
সে তার মাকে অনেক সুখে রাখবে,সেলিম ভালো ভাবেই জানে তার মা গ্রামে ভালো
নেই।
,
বড় ছেলের বউ এসে সেলিমের মাকে মোবাইল টা দিয়ে গেল।সেলিম নাকি কথা বলতে
চেয়েছিল।একটু পর ই সেলিমের কল এলো,
-হ্যালো মা,কেমন আছ?
-ভালো বাজান,তুমি কেমন আছ?
-জি আম্মু,আমিও ভালো
-তুমি কবে আইবা বাজান?
-পরীক্ষাটা শেষ করার পর ই আসবো আম্মু।তোমার শরীর টা কেমন মা?
-ভালো বাজান,তুমি আইলে আরো ভালো হয়ে যাবে।।
এভাবেই কথা চলতে থাকে সেলিম আর তার মায়ের।সেলিম একটা সময় বুঝতে পারে তার
মায়ের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।সে তার মাকে জিজ্ঞাসাও করে,তবে তবে তার মা বলে
না কিছু।সব কিছুই এড়িয়ে যায়।
,
,
সেলিমের মায়ের পেটের ব্যথা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।আর সহ্য করা যাচ্ছে
না।কতটা আর সহ্য করা যায়।তাই বাধ্য হয়েই বড় ছেলেকে একদিন ডেকে বললো
ডাক্তার এর কাছে একটু নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ডাক্তার সব কিছু দেখে অনেক গুলো ওষুধ দিল।অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল বড়
ছেলের।কিন্তু তার একার পক্ষেও এত দামি দামি ওষুধ কিনে খাওয়া সম্ভব না।তাই
তার মাকে সব কিছু খুলো বললো।
,
সেলিমের মা কিছু আর বললো না।কি ই বা তার বলার মত আছে।ছেলেদের বেপার টাও
একটু দেখতে হবে তো।তাদের নিজেদের পরিবারো আছে।তার উপর আবার মাকে দেখতে
হচ্ছে।আগে তাও ভাগ করে দিন হিসাব করে একেক জনের ঘরে একেক দিন খেত।সেটাতে
তেমন কোন সমস্যা হতো না।কিন্তু এখন তো দিনে ১০০ টাকার করে ওষুধ ও কিনে
খাওয়াতে হবে।সেটা একটু বড় ঝামেলাই মনে হচ্ছে তাদের কাছে।।
,
সেলিম এসব এর কিছুই জানে না।তাকে তার মা ই কিছু জানতে দেয় নি।এসব জানার
পর এমনি এমনি টেনশন করবে ছেলেটা।কোন মা ই চায় না তার ছেলেটা চিন্তায়
থাকুক।প্রতিটা মা চান তাদের ছেলে যেন সব সময় ই ভালো থাকে। সেলিম এর
পরীক্ষা প্রায় শেষ কয়েক দিন পর ই সেলিমের জন্মদিন।তার ইচ্ছা নিজের
জন্মদিনের দিন মাকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিবে।এর জন্য অবশ্য অনেক দিন
যাবৎ ই সেলিম টাকা জমিয়ে যাচ্ছে।এবার প্রায় হাজার টাকার মত হয়েছে।এইগুলো
দিয়েই একটা ভালো শাড়ি পাওয়া যাবে মোটামোটি।
,
,
প্রতিদিন ই ছেলেদের মাঝে ঝগড়া বাজে কে ওষুধ এনে দিবে সেটা নিয়ে।কোন মা
যদি আগে জানতো যে তার সন্তানরা মায়ের সাথে এমন করবে তবে এত কস্ট করে কেউ
সন্তান জন্ম দিত না আর।পেটের ব্যাথাটা হয়ত সহ্য করতে পারে সেলিমের মা,তবে
বুকের ব্যাথাটা আর সহ্য করার মত না।কেন ছেলেরা বুঝে না তারাও একদিন এমন
বৃদ্ধ হবে তারাও বিভিন্ন রকম রোগে ভোগবে,।যদি এই বেপার গুলো বুঝতো তাহলে
হয়ত আজ এরা এমন করতে পারতো না মাকে নিয়ে।
দিনে তিন বেলা ওষুধ খেতে হয় সেলিমের মায়ের ।কোন এক বেলা যদি খাওয়া বাদ
দেয় তবে সেটা অনেক বেড়ে যায়। আর সহ্য করার মত থাকে না।।।
,
সেলিম আর মাত্র দুই দিন পর ই বাড়ি আসবে।সে তার মায়ের জন্য অনেক দেখে একটা
সুন্দর একটা শাড়ি কিনেছে।দুই দিন পর ই মাকে এটা দিতে পারবে,এটা ভাবতেই
কেমন যেন একটা শিহরন লেগে যাচ্ছে সেলিমের।
,
সেলিমের মায়ের ওষুধ প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।আজকের দুপুরটাই খালি চলবে।রাতে
আর থাকবে না।কোন ছেলেকে ডেকে যে বলবে সেটার সাহস ও হচ্ছে না।মা গুলো এত
ভয় পায় কেন সন্তান দের???
সন্তান যখন ছোট থাকে তখন তারা তাদের সকল চাওয়া পাওয়া মায়ের কাছে
জানায়।মায়ের যত কষ্ট ই হোক না কেন সন্তানের জন্য সে সব কিছুই এনে দিতে
চেস্টা করে।আর সেই সন্তান রাই যখন বড় হয়ে যায় আর মা বাবারা বৃদ্ধ হয়ে
গেলে তাদের সেবা যত্ন ঠিক মত করে না।এমন কি বাবা মা রাও তাদের কাছে চাইতে
ভয় পায়।যে সন্তানের অসুখ হলে মা সারা রাত্রি জেগে থাকে, সেই মা অসুখের
ব্যাথায় সারা রাত কাদতে থাকলেও ছেলে আর খোজ নেয় না।কিভাবে এতটা নিষ্ঠুর
হওয়া যায় ! ! !
.
.
আর সহ্য করতে না পেরে ডাক্তারের পেসক্রিপশন টা নিয়ে বড় ছেলের কাছে
গেল।তার কথা একটাই এর আগের মাসে এনে দিয়েছে এ মাসে সে আর পারবে না। তারপর
গেল তার ছোট ছেলের কাছে।সেও পারবে না।তার ছেলের স্কুলের টাকা দিতে
হবে।সম্ভব না।কথা গুলো নিয়ে সেলিমের মায়ের যে কতটা কস্ট লাগতেছিল তা
ভাষায় প্রকাশ করার মত না।সব শেষে তৃতীয় ছেলের কাছে গেল।তাকেও ওষুধ এনে
দিতে বললো।।সে তেমন কিছু বললো না।তার ইচ্ছে ছিল মনে হয় এনে দেওয়ার মতো
তবে এসব আর সেই ছেলের বউ এর সহ্য হচ্ছিল না।সে রেগে গিয়ে বলে উঠলো” সব কি
ওর ই এনে দিতে হবে???, সেলিম কে কিছু বলতে পারেন না??? নাকি ও আপনার ছেলে
না, এদের যেমন দ্বায়িত্ব সেলিমের ও তেমন ই,খালি ওকে বলেন কেন?
ও এনে দিতে পারবে না।”
তার ছেলে কয়েকবার তার বউকে থামানোর চেস্টা করলো,কিন্তু সে আর পারলো
না।।কাদতে কাদতে সেলিমের মা রুম থেকে বের হয়ে গেল।।
,
আগামী কাল সারা দেশে হরতাল।কিন্তু সেলিম তো তার মাকে কথা দিয়েছে বাড়ি
যাবে।যেকোন মুল্যেই তাকে বাড়ি যেতে হবে।সকাল হলেই সে বাড়ি যাওয়ার জন্য
বের হয়ে পড়ে।বাসে করে যাচ্ছে আর ভাবতেছে মায়ের জন্য জীবনের প্রথম কিনা
শাড়ি মাকে দিলে মা কতটা খুশি হবে!।।
,
,
এদিকে তার মা সারা রাত ভেবেছে এই জীবন দিয়ে আর কি হবে।ছেলেদের অপমান আর
সহ্য করা যায় না ।এই জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।চারটা সন্তান পেটে
রেখে তো কত যন্ত্রনা সহ্য করেছে,তার তুলনায় এই সামান্য পেট ব্যথা কিছুই
না।সব কিছুই সে নীরবে সহ্য করে যাবে এখনো।।কাউকে আর কিচ্ছু বলবে না।মারাই
যাবে হয়ত কয়েকদিনের মাঝে।মারা যাওয়ার আগে সেলিম কে একবার দেখে যেতে
পারলেই হলো।
,
সকাল থেকেই সেলিমের মায়ের পেটটা খুব বেশি ব্যথা করতেছে।তবুও কাউকে কিছু
বলতে পারতেছে না।বলবেও না।।।এমন সময় সেলিমের বড় টা মানে তৃতীয় ছেলে মেয়ের
রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।যাওয়ার সময় দেখতে পেলো একটা কাগজ কয়েক টুকরা হয়ে
পড়ে আছে,,,হাতে নিয়েই বুঝতে পারলো এটা তো মায়ের প্রেসক্রিপশন। মা হয়ত রাগ
করে ছিড়ে ফেলে দিয়েছে।
,
,
এদিকে সেলিম বাসে বসে তার মায়ের কথা ভাবতেছে।হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজ শুনতে
পেল।চারিদিকে আগুন আর আগুন।বাসে কে যেন পেট্রোল বোমা মেরেছে।যে যেদিকে
পারলো দৌড়ে নেমে পড়লো।নামার সময় মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা আর নিয়ে আসতে
পারে নি।দুর থেকে শুধু চেয়ে দেখলো মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা আগুনে জ্বল
জ্বল করে পুড়তেছে।নীরবে জল ফেলা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না সেলিমের
কাছে।।
,
,
যে ছেলেটা মায়ের ছেড়া পেসক্রিপশন টা দেখে ছিল সে সেটাকে নিয়ে অনেক কস্ট
করে একসাথে করলো।তারপর ফার্মেসি তে গেল মায়ের জন্য ওষুধ গুলো নিয়ে আনার
জন্য।ওষুধ গুলো এনে মাকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করলো।গিয়ে
দেখলো মা তার বিছানায় শুয়ে আছে।কয়েক বার ডাক দেয়া সত্তেও আর মা শুনলো
না।।।
,
,
সেলিমের শাড়িটা পুড়ে গিয়ে ভালোই হয়েছিল।কারন শাড়িটা নিয়ে এলেও কোন লাভ
হতো না।মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা হয়ত সারা জীবন প্যাকেটের ভিতরেই থাকতো।মা
হয়ত খোলার সময় ই পেত না।কারন মাকে তো সেদিন ই সাদা কাপড় পড়িয়ে অন্ধকার
ঘরে একা রেখে আসতে হয়েছিল সবাইকে মিলে।তারপর থেকে সেলিমের মাকে আর কোন
দিন তার ছেলেদের সংসারের বাড়তি মানুষ হয়ে ছেলেদের সমস্যায় ফেলতে হয় নি।