মিলি পর্ব-০৫

0
86

#মিলি (৪_২)

‘তুমি আবৃত্তির ক্লাস বন্ধ করে দাও মিলি। সন্তান-সংসারের ওপর চাপ পরছে।তুমিও অসুস্থ হয়ে পরছো।‘
অনিন্দ্যর বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে মিলি। ছুটির দিনের সকাল। মিলির মা গেছেন গ্রামের বাড়িতে। মিলির নানার মৃত্যুবার্ষিকী। তাদের যাবার কথা ছিলো। বাচ্চাদের পরীক্ষার কারনে যাওয়া হলো না। অনিন্দ্যর অফিসে কাজ বেড়েছে। বাসায় আগের মত সময় দিতে পারে না তনু-টুনুকে নিয়ে মিলি হিমশিম খায়। আজ অফিসে হাফ ডে করে ফিরেছে অনিন্দ্য। মিলি আবার রান্না চাপালো। অনিন্দ্যের পছন্দের রূপচাঁদা ভাজা, করল্লা দিয়ে সীমের বিচির ঝোল।বাচ্চারা খেয়ে ঘুমোবার পর স্বামী-স্ত্রীর একান্ত সময়ে অনিন্দ্য কথাটা তুললো।
‘গৃহিনী হওয়া আমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়ে কি ভুল করেছি, অনিন্দ্য? ‘
‘এ কথা বলছে যে। আমাদের ভেতর কথা হয়ে ছিলো। তুমি ঘর সামলাবে। আমি বাহির দেখবো।’
‘আমার কি মনে হয় জানো। আমার কাজ হলো পৃথিবীর সবাইকে ভালো রাখা। ‘
‘পৃথিবীটা কতটুকু মিলি। মানে তোমার পৃথিবীতে আমি, আমাদের সন্তান এরাই।’
‘আমাকে সারাক্ষণ খেয়াল রাখতে হয় তোমাদের কার কি প্রয়োজন।’
‘আমরা তোমার ওপর নির্ভর করে নির্ভার থাকি, মিলি। এটায় তোমার সুবিধা হওয়ার বদলে অসুবিধা হয়?’
‘তোমাদের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমাকে আত্মিক সংযোগ হারাতে হচ্ছে। ‘
অনিন্দ্য উঠে বসলো। এই মিলি তার অচেনা। স্ত্রীকে সে কখনো এমন করে আত্মপ্রকাশ করতে দেখেনি। উল্টো কখনো মেয়েদের মন খারাপ থাকলে মিলি তাদের মন ভালো করতে ঘুরতে বেড়িয়েছে। অনিন্দ্য অফিস থেকে মেজাজ খারাপ করে আসলে মিলি তার মাথা টিপে দিয়ে শান্ত করেছে। মিলি বাসাতেই থাকে। বাহির থেকে নীড়ে ফেরা মানুষদের জন্য মিলি প্রশান্তির ডানা মেলা পরম আশ্রয়ের নাম।
‘তুমি একটা বিষয় খেয়াল করবে। সপ্তাহের সাত দিন আমার রুটিন এক রকম। সকাল থেকে রাত। মেয়েদের তৈরী করা,তোমাকে এগিয়ে দিয়ে, আম্মাকে খাবার দিয়ে, ঔষধ দিয়ে একটু দম ফেলতে না ফেলতে কাজের লোক চলে আসে। ওকে কাজ দেখিয়ে বসতে পারি না। কোথাও না কোথাও ময়লা চোখে পরে। আমি ঝাড়তে বসি। আমার ঘরের কোথাও এক বিন্দু ধুলো নেই। অথচ মনের ঘরে ঝুল জমে অন্ধকার হয়ে উঠেছে।’
‘এর সব কৃতিত্ব তোমার মিলি। সবাই কত প্রশংসা করে বলো।’
‘এই মিথ্যে প্রশংসার স্তুতিতে আমার সত্যিরা মরতে বসেছে। ‘
‘সমাজ সংসার সব এক ধাক্কায় বদলে দেয়া যা না মিলি। তুমি দিনকে দিন অস্থির হয়ে উঠছ। ‘
অনি বলতে চেয়েও পারে না। বিশেষ করে ঐ রেস্তোরা থেকে ফিরে আসবার পর মিলির ভেতর আমূল পরিবর্তন এসেছে। যে কাজ মিলি দায়িত্ব মনে করে করতো, তাই যেন যন্ত্র চালিত মানবের কত করে যায়। অনিন্দ্য স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে যায়। সীমানা অতিক্রম করলেই সীমানা নির্ধারণের প্রশ্ন চলে আসে।
‘সংসারের যা কিছু সব আমাদের দু’জনের ছিল, আছে।‘
‘এই যে ঘরের পর্দার রঙ বদলে যাচ্ছে, বিছানার চাদরে ঝোল লাগলে উঠিয়ে কাঁচতে দিচ্ছি, এদিকে রোজ আমার মনের রঙ কিন্তু ফিকে হয়ে যাচ্ছে, অনিন্দ্য। ‘
‘তুমি অযথা ভাবছো। জীবন যাপনের নিয়ম এটা।‘
‘যে বৃষ্টি দেখলে আমি ভিজতে যেতাম এখন জানালা আটকে দেই। ঘরের ভেতর ভেসে যাবে বলে। আমার মনের ঘরটা শুকনো খটখটে হয়ে গেছে।’
অনিন্দ্য মিলিকে কাছে টেনে নেয়। মিলির মাথায় গরম তেল মালিশ করে দিলে হয়ত একটু ঘুমবে। অনিন্দ্য তেল গরম করতে গেলে মিলি মেয়েদের রুমে যায়। দুই বোন জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে কাঁদা। ওদের গায়ে চাদর দিয়ে মায়ের ঘরের দরজা টানে। মা থাকলে বকবক করতেন। আজ নেই বলেও মন খারাপ করছে। অনিন্দ্য বিকেলে ফুলকপির বড়া খাবে। সেদ্ধ ফুলকপি নামিয়ে রেখে ব্যাটার তৈরী করে মিলি। বিকেলটা কেমন লালচে আলোয় মায়াবী হয়ে ফুটে আছে দিনের মুকুরে। মিলির মন চাইছে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পরতে। পথের মাঝে থেমে চা খেয়ে আবার কোন একটা ঘাসে ঢাকা মাঠে গিয়ে বসে আকাশ দেখতে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস উঠে এলে তাকে চাপা শ্বাসে বদলে দেয় মিলি। সম্ভব না। ঘর ভর্তি স্বামী, সন্তান রেখে মিলির এখন ঠিক এই মুহূর্তে বের হওয়া একদমই সম্ভব না। মিলি এখানেই অদৃশ্য মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে জেল খাটা আসামী হয়েছে। নিজেকে আপাত সুখী মানুষ ভেবে কাজে করে যাওয়া বাদে মিলির আর কিছু ভাবা নিষেধ। একঘেয়ে এই যাত্রাপথে নিজ ভুবনে ডুব দেয়া যেন গর্হিত পাপ।
গরম তেলে পাকোড়া ছেড়ে মিলি ম্যাসেজ চেক করে। সায়েম তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রেখেছে। ম্যাসেঞ্জারে যদিও কথা হয় টুকটাক। অধিকাংশ দিন সায়েম নক করে। মিলি খেয়েছে কি না, বা মিলির থিসিসের অগ্রগতি কদ্দূর জানতে চায়। আজ শেয়ার করেছে ওস্তাদ রাহাত ফাতেহ আলীর গানের লিংক। মিলির খুব প্রিয় গায়ক। পাকোড়া তুলে নিয়ে টিস্যুতে রেখে মিলি গান শোনে। অনির উপস্থিতি ও টের পেলে সায়েমের ম্যাসেজ মুছে ফেলে। কিছু পাকোড়া নিয়ে অনি চলে গেলে মনের ভেতর কেমন করে মিলির। অনির সামনে সায়েমের ম্যাসেজ ও রাখতে পারল না কেন। কি হতো যদি সায়েমের ম্যাসেজ অনি দেখতে পেত? মিলিকে সন্দেহ করার মত কিছু করেনি মিলি।
অনি সরে গেলেও ওর চোখ পরেছে মিলির হুট করে ফোন টেনে লুকিয়ে নেয়ার ওপর। অনিন্দ্যর বেশ খারাপ লাগে। মনে মনে আশঙ্কার দোলা জাগে। মিলি কি লুকিয়ে নিল হুট করে তার কাছ থেকে।। সংসারে দ্বিতীয় দেয়াল বলে কিছু থাকে না। থাকতেও নেই, ওতে ভাংনের সুর একটি বিরহ বাদন নিয়ো সেতারে ধুন বুনতে শুরু করে। অনিন্দ্য পাকোড়া খাওয়া থামিয়ে মিলিকে দেখতে লাগলো। চুলোর ওপর গরম তেলে টগবগ করে ফুটতে থাকা ফুলকপি থেকে সামান্য জলকনা বের হয়ে তুমুল আন্দোলন সৃষ্টি করেছে। চতুর্পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরা তেলের ছিটেকে থামাতে মিলির কোন আগ্রহ নেই। ও ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অনিন্দ্য খুব মন চাইলো, মিলির হাত থেকে ফোন টেনে দেখবার। স্বভাব বিরুদ্ধ কাপুরুষোচিত আচরণ হয়ে যায় ভেবে সে এগিয়ে না এলেও মিলি সায়েমকে পাল্টা মেসেজ পাঠিয়ে তা মুছে দিলো।
‘বেইলি রোডে নতুন নাটক নেমেছে। দুটো টিকিট পেয়েছি। অনি কখনো যায়নি। আমারো একা নাটক দেখতে ইচ্ছে করে না। আপনি যাবেন?’