মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব-২৬

0
412

মেঘদিঘির পাড়ে – ২৬
মালিহা খান

নীহারিকা কাটিয়ে পূর্বাকাশে নতুন সূর্যের আলতারঙা সুপ্রভা ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে মাত্র। বিভার ঘুম হাল্কা হলো। চোখ মেলে সেকেন্ডকয়েক কিছুই বোধগম্য হলোনা। অন্ধকার ঘরে প্রত্যুষের মায়াআলো ঢুকে পড়ছে।
বিভার টনক নড়লো। মাথার নিচে নরম বালিশের অস্তিত্ব টের পেতেই ধরফড়িয়ে উঠে বসলো সে। ইউসুফ কোথায়? তার কাছেই না ঘুমিয়েছিলো? সরিয়ে দিয়েছে?

সব কেমন ঝাপসাটে লাগছে। ঠান্ডায় গলা বসে গেছে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কপাল কুঁচকালো বিভা। একটুপরেই বুঝতে পারলো এটা তার ঘর। পরণে কালরাতের কালো জামাটা। গায়ে লেপ টেনে দেয়া ছিলো। মন ধাতস্থ হলো কিছুটা। ইউসুফ শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে হয়তো। মিনিটদশেক সেভাবেই বসে রইলো সে। তারপর একটু একটু করে নেমে দাড়ালো। পড়ার টেবিলের এককোণে বিষাদরঙা কাঁচের চুড়িগুলো রেখে দেয়া। আচ্ছা? বিষাদের রং কি কালো? বিভা আচমকা ডুঁকরে উঠে। খন্ডিত বিখন্ডিত মনে চুড়িগুলো হাতে তুলে নিলো।

সেদিনের পর দুরন্ত ছটফটে বিভা অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গেলো। দিনরাত চব্বিশঘন্টা তাকে আর সারাবাড়ি অকাজ করে বেড়াতে দেখা গেলোনা। অবিশ্রান্ত উড়তে থাকা ছোট্ট প্রজাপতির রঙিন ডানাদুটোয় হঠাৎ অসুখ করলো যেনো। ক্রমশ বেরঙে হতে শুরু করলো তারা। একসময় ফিকে, পানসে হয়ে উড়া বন্ধ করে দিলো।
দিন গড়ালো বিভার চোখের মলিনতা গাঢ় থেকে গাঢ়বর্ণ ধারণ করলো।

৪৯.
বাড়িতে মরিচবাতি ঝোলানো হচ্ছে। কর্মরত লোকের হাঁকডাকে সুপ্রভাতের নিস্তব্ধতা হাওয়ায় উবে গেছে। উঠোন থেকে ইউসুফের চড়া গলা ভেসে আসছে তখন থেকে। সে সটান দাড়িয়ে দাড়িয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

ঘুম থেকে উঠে গায়ে হাল্কা বেগুনী রঙের শাল জড়িয়ে উঠোনে এসে দাড়ালো ইভা। শালটা ভীষণ সুন্দর। হাল্কা বেগুনি মসৃণ জমিনে গাঢ় বেগুনী সুতোর কাজ।
একটু এগোতেই পেলব রুর্যকিরণ ঘন আঁখিপল্লব স্পর্শ করলো, চোখ বুজে এলো ইভার। চোখের পাতা পিটপিট করতে করতে ইউসুফের পাশে গিয়ে দাড়ালো। ইউসুফ একনজর ফিরে তাকালো। ইভার গায়ের মোটা শাল লক্ষ্য করে হেসে ফেললো।

-“এই রোদের মধ্যেও তোর ঠান্ডা লাগছে রে ইভা!”

ইভা প্রায়বন্ধ চোখদুটো মেলার চেষ্টা করে ইউসুফের দিকে চাইলো। সফল হলোনা।
ইউসুফ অবস্থান বদলিয়ে তাকে আড়াল করে দাড়ায়। এবার সক্ষম হয় ইভা। চোখের উপর ছায়া পড়ে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। ফিসফিস করে ডাকলো,

-“ইউসুফ ভাই?”

ইউসুফ তাকাল। ইভার ডাকার ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে খুব দুর্জ্ঞেয় গোপন কিছু বলবে। চোখের ভাষা ছুড়ির মতো ধারালো ঠেকছে। ইউসুফ কপালে ভাঁজ ফেলে একটু ঝুঁকে গেলো। ইভার মতোই ফিসফিসিয়ে বললো,”বল, জরুরি কিছু?”

ইভার ঢোক গিলে গলা ভেজায়। আশেপাশে দেখে নেয়। চোখভর্তি প্রখর সংশয়ের মিছিল বসিয়ে পূর্বের ন্যায় ফিসফিস করেই জিজ্ঞেস করে,

-“আপনি আপার সাথে কি করেছেন বলেনতো, আপা আজকাল এতো চুপচাপ থাকে কেনো?”

ইউসুফের কর্ণকুহর কাঁপলো। ভ্রুকুন্চন মিলিয়ে গেলো চট করে। চোখমুখে অদ্ভুত শিথিলতা। দৃষ্টি সরাতে সরাতে আলগোছে সে উওর দিলো,”আমি কি করবো?”
উওর দিয়ে একবার বাড়ির ভেতরে তাকালো ইউসুফ। বিভা খাবার টেবিলে বসে আছে। সামনে প্লেট রাখা তবে সে খাচ্ছেনা। নাড়াচাড়া করছে। ইউসুফ চোখ সরিয়ে নেয়।
ইভা ভ্রু কুঁচকালো। ইউসুফের উওরটা কিয়ৎপরিমানও পছন্দ হয়নি তার। মনমরা হয়ে বললো,

-“আপনিই কিছু করছেন ইউসুফ ভাই। এইতো আপা যেদিন মেলা থেকে আসলো। তারপর থেকেই তো আর কথা বলেনা। প্রশ্ন করলে হু হা জবাব দেয় শুধু।”ইভার চোখ মন খারাপে উপচে ওঠে।

তার কথার মাঝেই বাড়ির পিছন দিক থেকে দৌড়ে এলো বাহাদুর। ইউসুফ চটজলদি হাত বাড়িয়ে দিতেই ধুপ করে কোলে উঠে পড়লো। বিস্তর হেসে বাড়ির দিকে চেয়ে কৌতুহলী কন্ঠে বললো,

-“বাড়িতে রশি লাগাচ্ছে কেনো?”

ইউসুফ হাসলো। ইভাকে দেখে নিয়ে উওর দিলো,”বুবুর বিয়ে যে। এগুলোতে রাতভর আলো জ্বলবে।”

ইভার লাল মুখ চমকে আরো লাল হয়। সে দ্রুত প্রস্থান করতে চায়। আবার ধুম করে চলে গেলে ইউসুফ কি ভাববে ভেবে চুপ করে দাড়িয়ে থাকে। বাহাদুরের প্রশ্নের অন্ত নেই। ইউসুফ উওর দিতে দিতে কাহিল। একটুপর নামিয়ে দেয়। বাহাদুর আবার দৌড় লাগায়।
ইভা দ্রুত বলে,
-“আপনি উওর দেননি ইউসুফ ভাই।”

ইউসুফ স্মিত হাসলো। ইভার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললো,”সায়ন আসবে আজকে। একটু বের হোস ঘর থেকে। ও তো আমাদের দেখতে আসেনা, তোকে দেখতেই আসে।”

ইভা এতক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সায়নের প্রসঙ্গ আসতেই তার মাথা নুঁয়ে পড়লো। ইউসুফ হাসলো। মৃদুস্বরে বললো,

-“রোদে গা পোড়াচ্ছিস কেনো? ভেতরে যা। দেখে তো মনে হচ্ছে গাল নাক কেটে রক্ত বের করে দিয়েছে কেউ।”

৫০.
দুপুরের রোদ আদিপত্য বাড়িয়েছে। ধূসর গাড়িটা গতি কমিয়ে সদরদরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়লো। স্টেয়ারিং থেকে হাত নামাতে নামাতেই পিপাসিত নয়নে বিশাল বারান্দায় পানে তাকালো সায়ন। মরিচবাতির তাঁর ছাড়া সেখানে আর কাকপক্ষীটিও নজরে এলো না। সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ নামালো। লিথিশা মিটিমিটি হেসে বললেন,”তুই দেখি বড্ড অধৈর্য রে! বেচারী বউ মানুষ, লাজ লজ্জা ফেলে তোর জন্য বারান্দায় দাড়িয়ে থাকবে নাকি রে!”

সায়ন আড়চোখে তাকালো। অত:পর হেসে ফেললো।

সারাবাড়ির মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ইভার দেখা মিলালোনা। মাঝখানে একঝলক সালাম দিয়েই সে উপরে চলে গেছে।
সবার সাথে কথায় কথায় সায়ন খেয়াল করে দেখতেও পারেনি মেয়েটাকে। কি যন্ত্রনা!

কাবিনের ডালা-টালা বাদবাকি সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে লিথিশা। ঘর ভরে গেছে।
__________
জামরঙা কামিজ গায়ে গোসল থেকে বেরিয়ে এলো ইভা। পিঠের ফিতেটাও বাঁধা হয়নি। তোয়ালে দিয়ে চুল ঝেড়ে, হাত উঠিয়ে পিঠের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎই চোখ পড়লো পড়ার টেবিলের উপর। ড্রয়ারটা খোলা। সে তো খুলে রেখে যায়নি। তবে?
ড্রয়ার বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইভা। বাহাদুর খুলে রেখেছে হয়তো।
কামিজের সাথে মিলানো কারুকাজ করা একইরঙের ওড়নাটা বিছানার উপর রাখা ছিলো। পিঠের ফিতে বেঁধে, কোনরকমে ভেজা চুল গুছিয়ে বেখেয়ালিভাবে বিছানার ওড়না টান দিতেই মৃদু শব্দ তুলে কলমটা ছিঁটকে পড়লো মেঝেতে। ইভা চমকে উঠলো।কি হলো? একটা সাদা কাগজ খসে পড়েছে পায়ের কাছে।
ভ্রু কুঁচকালো ইভা। উবু হয়ে তুলে নিলো হাতে। তারই পড়ার খাতার একটা এবড়োথেবড়ো ছেঁড়া পৃষ্ঠা। ইভা দ্রুত বিছানায় তাকাল। সবুজ মলাটের খাতাটা ভীষণ অযত্নে পাশেই ফেলে রাখা।

ইভা স্তব্দ, বিমূঢ় হয়ে পড়লো।
ভীষণ তাড়াহুঁড়ো হাতের লেখায় সেখানে দু’টো লাইন লেখা হয়েছে,

-“আমার হাত পায়ের পশম কি বেশি বড় হয়ে গেছে ইভা বিনতে নেওয়াজ? বাঘ ভাল্লুক মনে হয় দেখে?”

ইভা থমকালো। হাসি পেলো খুব।
কাঁপাহাতে কাগজ উল্টাতেই হাসি মিলিয়ে গেলো তার। হাত-পা ক্রমশ অনায়ত্ত, অবশ হয়ে এলো। বিকট লজ্জায় কানের লতি রক্তবর্ণ ধারণ করলো।
কালো কালির সদ্যলেখা অক্ষরগুলোতে নিষ্পলক চেয়ে রইলো সে।

“অনেক হয়েছে অপেক্ষাময়ী। আর পারছিনা বিশ্বাস করো! ব্যস্ত শহরের ইটপাথরে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয় রুপবতী।
এবার এসো, নতুবা নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে।”

~চলবে~