মেঘফুল পর্ব-৫০+৫১+৫২

0
301

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫০
লেখনীতে: মিশু মনি

সারল্য’র সাথে চোখাচোখি হল জাহ্নবী’র। দুজনেই মিষ্টি করে হাসলো। তখনও একটা বাচ্চা সারল্য’র ঘাড়ে। দুই হাতে বাচ্চাটা সারল্য’র চুল খামচে ধরে রেখেছে। পরম আদরের সঙ্গে ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়ে সারল্য ওর নানীর পাশে এসে বসলো।

নানীর মাথার সব চুল পেকে গেছে। টকটকে গায়ের রং, সাদা চুল আর ঝুলে যাওয়া চামড়ায় ওনাকে ভীষণ পবিত্র দেখাচ্ছে। বয়সটা মানিয়েছে ওনাকে। সারল্য বলল, ‘নানু, আজ রাতে কিন্তু গল্প শোনাতে হবে।’
‘এখন তো গল্প বলতে পারিনা নানুভাই। সব ভুলে যাই।’
‘ভুলভাল গল্পই শুনবো। মামী, খিদে পেয়েছে, খানাদানা দিন তারাতাড়ি।’

সারল্য’র মেজো মামী ব্যস্ততার সঙ্গে উঠে পড়লেন। লজ্জা পেয়েছেন তিনি। সারল্য বলল, ‘ঘরে খাবো না মামী, বারান্দার টেবিলে দিন।’

সারল্য’র তিন মামা। বড় মামা তার পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। বাড়িতে মেজো ও ছোট মামার পরিবার। একান্নবর্তী বলা না গেলেও সবাই একই বাড়িতে থাকার দরুন বেশ যৌথ পরিবারের রেশ বিরাজ করে।
মেজো মামী টেবিলে খাবার সাজিয়ে ডাকছেন। গরম গরম খাবারে ভর্তি টেবিল দেখে সারল্য বলল, ‘মামী আমাকে একবেলা খাইয়েই বিদায় দিতে চাচ্ছেন নাকি?’
‘তা কেন হবে? তোমাকে প্রত্যেক বেলাই এমন হরেক রকম খাবার সাজিয়ে দিলেও তোমার মামীর রেসিপি শেষ হবে না।’

কথাটা বলেই মামী হাসলেন। রাঁধতে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। সংকোচের কারণে জাহ্নবী খেতে পারছে না। সারল্য’র সাথে তার সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ না হলেও দুজনে সহজেই গল্প গুজব করতে পারে। কিন্তু এখানে এসে জাহ্নবী বেশ বুঝতে পারল, তার ভেতর থেকে জড়তা কাটেনি আজো। এখনও কারো সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে কষ্ট হয়। কীভাবে এই জড়তা কাটিয়ে উঠবে সে? আনমনে সে কথাই ভাবছিল জাহ্নবী।

নানু একটা বড় মাছের মাথা জাহ্নবী’র পাতে তুলে দিলেন। লজ্জায় কিছু বলতে পারল না সে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে নানীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
নানী বললেন, ‘খাও নানুভাই।’

জাহ্নবী মাথা নিচু করে ফেলল। বাড়িভর্তি অচেনা সব লোকজনের সামনে খাবার খেতে তার বিব্রত লাগছে। সকলেই কথা বলতে ব্যস্ত। কত রকমের গল্প সবার। অথচ তার মনে হচ্ছে সবাই যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। খুব অস্বস্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করলো জাহ্নবী। তারপর ঘরে এলো বিশ্রাম নিতে।

বিছানায় শুয়েই বিশাল জানালার ওপাশে সবুজ গাছের দোল খাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। বাতাসে গাছের পাতারা নাচছে। আকাশটা ভীষণ স্বচ্ছ, নীলাম্বরীর নীল শাড়ির মতো। জাহ্নবীর মনের মেঘ আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। এত সুন্দর আকাশ বহুদিন দেখেনি সে। শহরের আকাশ আর গ্রামের শান্ত শিষ্ট স্বচ্ছ আকাশের মাঝে যেন আকাশ পাতালের মতোই ব্যবধান।

সারল্য দরজায় ঠকঠক করে জানতে চাইলো, ‘বাইরে যাবেন?’

জাহ্নবী চমকে ওঠে। খোলা দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সারল্য। পরনে একটা অফ হোয়াইট রঙের শার্ট। চোখে চশমা নেই। নেই কোনো ক্লান্তি। জাহ্নবীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে আবারও জানতে চাইলো, ‘রেস্ট নেবেন? না বাইরে যাবেন?’
‘বাইরে যাবো।’

জাহ্নবী উঠে পড়ল। যদিও বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তার ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসছিল। তবে সারল্য’র প্রাণবন্ত আমন্ত্রণ কিছুতেই নাকচ করতে পারবে না সে। বাইরের সুনীল আকাশটা যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে।
এতক্ষণে স্বস্তি পেল জাহ্নবী। সারল্য’র সঙ্গে একাকী পথ চলতে তার কোনো অস্বস্তি হয় না।

বাড়ির চারপাশেই অসংখ্য বৃক্ষলতা। পেছন দিকে বিভিন্ন মৌসুমি ফলের বাগান। ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল ওরা। সামনে দিগন্তবিস্তৃত ধানের ক্ষেত। সবুজ ধানের শিষে বাতাসে দোল খেয়ে ঢেউ উঠছে। শিরশির করে গায়ে লাগছে হাওয়া। জাহ্নবী’র মনে হলো, বুক ভরে শ্বাস নেয়ার জন্য গ্রামই সবচেয়ে শান্তির জায়গা। মানুষ অযথা শহরে পড়ে থাকে।
সারল্য বলল, ‘ধান কাটা দেখেছেন কখনো?’
‘না।’
‘আহা, পৃথিবীর অসংখ্য মনোরম দৃশ্যের একটা হচ্ছে ধান কাটার দৃশ্য। শুধু কাটা নয়, ধান কেটে কৃষকের বাড়ির উঠোনে জমিয়ে রাখা, মাড়াই করা, বাড়ির বউরা ঘামে ভিজে সেসব ধান সেদ্ধ করে রোদে শুকান। সবকিছুই বড় মায়ায় ভরা। কখনো সুযোগ পেলে দেখতে আসবেন।’

জাহ্নবী একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘সেই সুযোগ আমি পাবোই না। আপনি না নিয়ে এলে এইযে সবুজ ধানক্ষেত দেখছি, এটাও দেখতে পেতাম না।’
‘মাঝেমাঝে নিজেকে ছুটি দেবেন। জীবনের সব জটিলতা থেকে। তখন চলে যাবেন কোনো গ্রামে। আমি যখন জীবনের মানে খুঁজে পাইনা, তখন গ্রামে যাই। গ্রাম আমাকে নতুন করে জেগে উঠতে শেখায়।’

জাহ্নবী মুগ্ধ হয়ে পান্নাবাহারের কথা শোনে। আর মুগ্ধ চোখে দেখে সবুজ ধানের ক্ষেত, সবুজ গাছের পাতা, নীল আকাশ আর ফুরফুরে সাদা মেঘ।

সারল্য গাছ থেকে ডাব পেরে খাওয়ায় জাহ্নবীকে। আনন্দে জাহ্নবীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে। খুশিমনে বাগানে হাঁটাহাঁটি করে সে। পুরো বাড়িটা তাকে ঘুরে দেখায় সারল্য। বহুদিন পর নিজের চেনা গণ্ডির বাইরে এসে জাহ্নবী যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যাবেলা মেজো মামার মেয়ে উনাইসা জাহ্নবীর সঙ্গে গল্প জমানোর চেষ্টা করে। উনাইসার কলেজে পড়ে। তবে ভীষণ চনমনে স্বভাবের মেয়ে। জাহ্নবী’র সঙ্গে কথায় কথায় এমন ভাব হয়ে গেল যে, নিজের সব জড়তা কখন মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে খেয়ালই করেনি সে। উনাইসার সঙ্গে রান্নাঘরে এসে মেজো মামীর পাশে দাঁড়িয়ে সে রান্না করা দেখছিল। মামী সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকড়া চিনিয়ে দিলো ওকে।
এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জাহ্নবী তোমার বিয়ে হয়নি?’
‘বিয়ে করিনি এখনো মামী।’
মামী খানিকক্ষণ ওর দিকে চেয়ে রইলেন। কড়াইতে গরম তেলে পেয়াজ ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘মনের মানুষ চলে গেছে বলে বিয়ে করোনি নাকি?’
‘পাই ই নি।’
‘মনের মানুষ পাওনি বলে বিয়ে করোনি?’

জাহ্নবী লাজুক হেসে বলল, ‘হুম। জীবনে খুব একটা পুরুষ মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয়ই হয়নি। খুঁজে পাবো কোথায়?’
‘তা আমার ভাগ্নের সঙ্গে পরিচয় হল কীভাবে?’
‘কাজের সূত্রে।’

কড়াইতে পেয়াজের রংটা বাদামী হয়ে এসেছে। মামী সেদিকে দৃষ্টি রেখেই কথা বলছেন জাহ্নবীর সঙ্গে। মশলা বাটা কড়াইতে ছেড়ে দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘ও কি তোমার বন্ধু?’
‘হ্যাঁ মামী।’
‘তোমার জন্য ছেলে দেখবো? হাতে ছেলে আছে।’

এতক্ষণে মামী জাহ্নবী’র দিকে তাকালেন। ওর অস্বস্তি হচ্ছে। লাজুক হেসে বলল, ‘এত বছর যখন পার করে এসেছি, এখন আর দেখতে হবেনা মামী। আর কিছুদিন অপেক্ষা করি।’

মামী আর কিছু বললেন না। কষানো মশলায় মাংস ছেড়ে দিলেন। মশলা ও কাঁচা মাংস কষানোর ঘ্রাণে পুরো রান্নাঘর ভরে উঠল। উনাইসা বলল, ‘আন্টি চলো বাইরে যাই।’
বাড়ির উঠোনে বাচ্চাকাচ্চারা খেলায় মেতে উঠেছে। জাহ্নবী উঠোনে এসে বসলো। শার্লিন বাটিতে খাবার নিয়ে মেয়ের পিছুপিছু ছুটছে। তার বাচ্চাটা একদমই খেতে চায় না। সব দৃশ্য দেখতে দেখতে জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। দুটো বাচ্চা এসে তার হাত ধরে বলল, ‘আন্টি চলো খেলবে।’

ইতস্তত করতে করতে উঠে এলো জাহ্নবী। ওদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিলো। হাসি, আনন্দ আর হৈ হুল্লোড়ের মাঝখানে কখন যে নিজের চেনা সংকোচে ঘেরা চরিত্রটা থেকে বেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারল না। নিজেকে মনে হচ্ছে নতুন জন্ম নেয়া শিশু। উচ্ছল কিশোরীর মতো তার খলখল করে হাসতে ইচ্ছে করছে।

রাতের খাবার খেয়ে সবাই খানিকক্ষণ আড্ডা দিচ্ছিল। জাহ্নবীকে ডেকে বাইরে গিয়ে বসলো সারল্য। সেদিকে তাকিয়ে মেজো মামী সারল্য’র মাকে বললেন, ‘মেয়েটার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই তো?’
‘না। সেটা মনে হয় না।’ উত্তর দিলেন সারল্য’র মা।

মেজো মামী বললেন, ‘হুম। মেয়েটা ভালোই। সাদামাটা। অনেক সহজ সরল আচরণ, কথাবার্তা। আজকালকার মেয়েদের মতো অত প্যাচঘোচ নেই।’
কথাটাতে সায় দিয়ে সারল্য’র মা বললেন, ‘হ্যাঁ। আমাকে খালা বলে ডাকে। আত্মাটা জুড়িয়ে যায়। লক্ষী একটা মেয়ে।’
‘আপা, ওর সঙ্গে আমাদের সারল্য’র বিয়ে দিয়ে দিন না। ওর মতো একটা ছেলে একা একা জীবন পার করবে কেন?’

শার্লিন উত্তর দিলো, ‘কী বলছেন মামী? ওনার সঙ্গে যায়? বা ভাইয়ার সঙ্গে ওনাকে মানায়?’
‘যার সঙ্গে মানায়, সে তো লাত্থি দিয়ে চলে গেল। অত মানামানি দিয়ে কাজ কি শার্লিন? চেহারা আর কয়দিন থাকবে? সারল্য’র বয়স হচ্ছে। এই বয়সে একা থাকা কঠিন। তার ওপর যে একবার নারীসঙ্গ পেয়েছিল, সে একা থাকতে পারে না।’

শার্লিন উত্তর দিলো, ‘ভাইয়া তার মতো আছে। থাকুক না। সে নিজে থেকে বিয়ে করতে চাইলে আলাদা কথা।’

মামী জোর দিয়ে বললেন, ‘ও নিজে থেকে চাইবে না। ওর এখন মনটা ভঙ্গুর। কাউকে ভালো লাগার বিষয় গুলো ওর মাথাতেই আসবে না। ছেলেটা আর সব ছেলের মতো না। এখন যদি আপা ওকে বিয়ের কথা বলেন, আপা বিয়ে দিলে সে বিয়ে করতেও পারে। আর বিয়ে করলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

শার্লিন তার মায়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়া কী ধরনের মেয়ে পছন্দ করে, মা তো সেটা জানে। মা তুমিই বলো না।’

মা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আমার মনে হয় মেজো ঠিকই বলেছে। একটা পরিণত বয়সে এসে ছেলেরা আর উচ্ছলতা, পাগলামি, কেয়ারনেস এসব খোঁজে না। এই সময়ে এসে ওদের দরকার হয় একজন ভালো সঙ্গী, একজন বন্ধু। যে ওকে বুঝবে। ওর কথাগুলো শুনবে। ওর একাকীত্বের সময়টাতে ওর পাশে থাকবে। একটা মেয়ের ক্ষেত্রেও তাই। মেয়েরা অল্প বয়সে জীবনে প্রেম খোঁজে, কেয়ারনেস, পাগলামি, রোমান্টিকতা, সারপ্রাইজ এসব চায়। কিন্তু একটা পরিণত বয়সে এসে ওরা চায় এমন একজন মানুষ ওর জীবনে আসুক, যে ওকে বুঝবে। যে দায়িত্বশীল, ভালো মনের মানুষ হবে। আমি এই জিনিসটা খুব ভালো বুঝি।’

শার্লিন আর উত্তর দিতে পারলো না। মায়ের কথাটা পুরোপুরি যোক্তিক সেটা সেও জানে। তার স্বামী ইতালিতে আছে, মেয়েটা ছোট বলে তাকে নিয়ে যাচ্ছে না এখনও। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও শার্লিন কোথায় একটা শূন্যতা খুঁজে পায়। সে হাতড়ে বেড়ায় সেই অমোঘ জিনিসটাকে, যার জন্য তার মন পোড়ে। এখন মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার একজন বন্ধুর ভীষণ অভাব। তার স্বামী মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো হলেও বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি তার। তাকে বুঝতে চায় না মানুষটা। মন খারাপ হলেও সে বোঝেনা, মনে অনেক আনন্দ নিয়ে তার কাছে গেলেও সে গুরুত্ব দেয় না। প্রত্যেকটা অনুভূতির যে কী মূল্য, যারা অনুভূতিপ্রবণ, কেবল তারাই জানে। শার্লিন মায়েদের আড্ডা থেকে উঠে আসে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ভেতরে চাপ দিচ্ছে। নিশ্বাসটাকে ঠেলে বের করে দেয়ার জন্য তার একটু জায়গা দরকার।
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায় শার্লিন। ফিরে এসে মাকে বলল, ‘জাহ্নবী আপুর মনটা ভাল। তোমার ছেলেকে বুঝবে সে।’

মা হতভম্ব হয়ে শার্লিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরইমধ্যে মেয়ের মতামত বদলে গেল কী করে সেটা ভাবছেন। ওনার চোখের পলক পড়ছে না। শার্লিন সেখান থেকে চলে গেলে তিনি বললেন, ‘ ছেলেমেয়ে গুলো আজকাল খুব জটিল হয়ে গেছে। ঠিকঠাক বোঝা যায় না ওদের।’

মেজো মামী আবারও বললেন, ‘আপা, আপনি সারল্য’র সঙ্গে কথা বলেন। ওর জীবনে আর নতুন করে প্রেম ভালবাসা হবে না। আপনি ওকে বিয়ে দেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মা কোনো কথা বললেন না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার ছোট্ট ছেলে সারল্য’র সরল মুখখানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ছেলেটা কী মেধাবী ছিল, আর কতই না ভালো মনের। একটা মেয়েকে ভালবেসে জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে দিলো ছেলেটা। অথচ প্রাপ্তির খাতায় জুটল শুধুই রিক্ততা!

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫১
লেখনীতে: মিশু মনি

প্রকৃতিতে তখন ছোপছোপ ঘন অন্ধকার। জোনাকিরা উড়ছে, নাচানাচি করছে। পুবের বারান্দায় বসলে জংগলে জোনাকির ওড়াওড়ি আর ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। সেখানে এসে দাঁড়াল ওরা দুজন, সারল্য ও জাহ্নবী। আজকের সন্ধ্যা জাহ্নবী’র জীবনে অভাবনীয় সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিয়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পেরে ওর আনন্দের সীমা নেই। এরপর এইযে মোহময় রাত্রি, নিস্তব্ধতায় মোড়ানো চারপাশ। পাশে দাঁড়িয়ে পান্নাবান্নার, এরচেয়ে মধুর মুহুর্ত জীবনে আর কী এসেছিল তার? ভাবে সে। ভাবতে ভাবতে লেবুগাছের পাতায় হাত বোলায়। বারান্দার পাশেই যে লেবুগাছটা, তার একটা ডাল উঠে এসেছে এদিকে। স্বচ্ছ, পরিষ্কার পাতা। লেবুপাতা কচলালে যে কড়া সুঘ্রাণটা ভেতর থেকে আসে, সেটা ভালো লাগে ওর।

পান্নাবান্নার বলল, ‘এখানে এসে কেমন লাগছে বলুন?’
‘খুব ভালো লাগছে। আপনার প্রতি আমি কতটা কৃতজ্ঞ হয়েছি সেটা বলে বোঝানো যাবে না।’
‘তাহলে লিখে বোঝান।’
‘কী!’
‘বলে বোঝাতে না পারলে লিখে বোঝান।’

জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘আপনি এখানে এসে কিন্তু খুব ফুরফুরে হয়ে গেছেন। দেখতে ভালো লাগছে।’
‘আপনিও ফুরফুরে হয়ে গেছেন। সেটা অস্বীকার করবেন না।’
‘অস্বীকার করছি না। একটা সত্যি কথা বলবো? আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করিনা। তাও বলতে ইচ্ছে করছে।’
‘বলুন। নিজেকে যদি অপ্রকাশ্য রেখে বলা যায় তাহলে বলে ফেলুন।’

জাহ্নবী আবারও মুচকি হাসলো। সারল্য’র মনে আজ খুব ফূর্তি সেটা ওর কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে জাহ্নবী বলল, ‘আমি খুব চাপা স্বভাবের একটা মেয়ে। আমার মধ্যে অনেক জড়তা। সহজে কারো সাথে মিশতে পারিনা। এখানে এসেও খুব অস্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যায় সবার সঙ্গে খেলতে গিয়ে আমার সেই জড়তা ভ্যানিশ হয়ে গেছে। খুব সহজে সবার সঙ্গে গল্প করতে পারছি। এটা অনেক আনন্দের। এই অনুভূতি আমার আগে হয়নি।’

সারল্য মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বেশ ভালো। অনেকদিন ধরে আমার মধ্যেও একটা বিরক্তিকর ব্যাপার চলছিল। হতাশার মতোন। মনে হচ্ছিল আমি একটা ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা সার্কেলে আবদ্ধ হয়ে গেছিলাম, যেখান থেকে বের হতে পারছিলাম না। এখানে এসে আমার সেটা ভাংল। নতুন করে বেঁচে উঠলাম মনে হচ্ছে।’

জাহ্নবী উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সারল্য’র এই ভাললাগার অনুভূতিটা ওর সন্ধ্যার আনন্দকেও ছাড়িয়ে গেল। সারল্য’র সুখেই যেন ওর সুখ, এমনটাই মনে হচ্ছে। কী জানি! কী এর কারণ..

সারল্য বলল, ‘ভেতরে যাই চলুন।’
‘আপনি যান, আমি আসছি।’
‘এখানে দাঁড়াবেন কিছুক্ষণ?’
‘হুম।’

সারল্য ভেতরে প্রবেশ করলো। একলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল জাহ্নবী। বারান্দায় টিমটিমে আলো জ্বলছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মশা কামড়াচ্ছে বেশ। তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে। এখানে এসে সবই ভালো লাগছে তার। আনন্দে বুক ভরে যাচ্ছে। জীবনে সুখগুলো অনেকভাবে আসে, সেটা যেন এখানে এসেই উপলব্ধি করছে। এইযে জোনাকি জ্বলা বাগান, লেবুগাছের ডগা, কিংবা ঝিঁঝিঁর ডাক, সবকিছুই হতে পারে আনন্দের কারণ। শুধু শিখতে হবে উপভোগ করতে।

জাহ্নবী বড় করে শ্বাস নিলো। উনাইসা এসে দাঁড়াল ওর পাশে, ‘আন্টি এখানে কী করছো?’
‘কিছু না।’
‘আন্টি, মামা কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
জাহ্নবী চমকে উঠে উত্তর দিলো, ‘না তো। শুধু বন্ধু।’
‘শুধু বন্ধু? কিন্তু আমার তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড।’
‘কেন এমন মনে হচ্ছে?’
‘এইযে এখানে একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলছো। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ছাড়া কেউ একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলে?’

জাহ্নবী মুচকি হেসে বলল, ‘বলে। তুমি হয়ত জানো না। তোমার মামা খুব ভালো মানুষ। ওর সঙ্গে আমার অফিসে পরিচয় হয়েছে। আমরা বন্ধুর মতো গল্প করি। এর বেশী কিছু না।’
‘আচ্ছা। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। ওকে দেখতে চাও?’
‘তাই? হ্যাঁ দেখতে চাই।’
‘রুমে আসো। তোমাকে গল্প বলি। আমাদের কীভাবে প্রেম হয়েছে। শুনবে?’

জাহ্নবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হুম শুনবো।’
সারা রাত ধরে উনাইসার গুল্প শুনতে শুনতে ভোররাতে ঘুমাতে হল জাহ্নবীকে। উনাইসা মন খুলে কথা বলছিল। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ওর গল্প শুনতে বিভোর হয়ে উঠেছিল জাহ্নবী। পালিয়ে গিয়েছিল ঘুম। কিশোরী মেয়েটা তার বয়সী একজনের সাথে মন খুলে কথা বলছে, এটাই অবাক করছিল জাহ্নবীকে।

সকালের নাস্তা খাওয়ার পর সারল্য’র পরিবার ও জাহ্নবী ঘুরতে বের হল। ইমতিয়াজ মামা নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে কাছেই যে চা বাগানটা আছে, সেখানে যাবেন। টি এস্টেটের ম্যানেজার মামার পরিচিত।

থরে থরে সাজানো চায়ের বাগান দেখে মুগ্ধ হল জাহ্নবী। উজ্জ্বল সবুজ পাতাগুলো ওর ছুঁয়ে দিতে ভালো লাগছিল। দূর হতে তাকিয়ে দেখল সারল্য তার মাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। মানুষটার মনটা এত ভালো! মুহুর্তের জন্য ওর ভেতর ইচ্ছে জাগে জনম জনমের জন্য এমন একটা মানুষের সাথী হয়ে যেতে। পরক্ষণেই একটা নিশ্বাস ফেলল সে। শার্লিন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
জানতে চাইলো, ‘তুমি বিয়ে করোনি কেন?’
জাহ্নবী সংকোচ বোধ করে। উত্তর না চুপ থাকাটাও বেয়াদবি হয়ে যায়। নিতান্তই দায়সারা উত্তর দিলো সে, ‘একটা বয়স পর্যন্ত বিয়ের প্রতি আগ্রহই ছিল না।’
‘আর এখন?’
জাহ্নবী চমকে উঠলো, ‘এখন শুধু আগ্রহ না, বিশ্বাসও এসেছে। এই সম্পর্কটার চাইতে হয়তো সুন্দর কোনো সম্পর্কই হয় না।’
‘এমন বিশ্বাস আসার কারণ কী? যেখানে বিয়ের প্রতি আগ্রহই ছিল না তোমার? শুনেছি মানুষের আগ্রহ তখন চলে যায়, যখন বিয়ের পরের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।’
‘মানুষ তো আপু, জীবনে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন অনুভব হবেই। এই অনুভূতিটা আগে ছিল না। এখন বয়স বাড়ছে তাই প্রয়োজন মনে হচ্ছে। আর একইরকম ভাবে কতদিন বাঁচা যায়? দিনশেষে একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন সবাই দেখে।’

শার্লিন খানিক্ষণ জাহ্নবীর দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘আচ্ছা, সংসারের স্বপ্ন শুধু মেয়েরাই কি দেখে? ছেলেরা দেখে না?’
‘জানিনা।’
‘ছেলেরাও দেখে। আমার ভাইও স্বপ্ন দেখেছিল। ও অনেক সংসারী মাইন্ডের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের পাশে থাকে, মাকে হেল্প করে। সংসারের বিষয় গুলো বোঝে। কিন্তু ওর জীবনে সংসার হল না। এখন ও আর সংসারে বিশ্বাস করে না।’
জাহ্নবী চুপ করে রইল। শার্লিন উদাস গলায় বলল, ‘তোমার যে বোধ হয়েছে, তাতে বাকি জীবনটা খুব সুখে থাকবে তুমি। কিন্তু যাদের উল্টোটা হয়, এরা কোনোদিন সংসারে সুখী হয় না।’
‘যেমন আপনার ভাই?’

শার্লিন চমকে উঠলো। এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। জাহ্নবী’র চোখে চোখ রেখে শুধু বলল, ‘ওকে আমি সুখী দেখতে চাই। এভাবে জীবন কেটে যেতে পারেনা।’

জাহ্নবী ভদ্রতাসূচক হাসলো। আর কোনো কথা হলো না তাদের। বাগানের এক প্রান্তে মালীরা চা পাতা তুলছে। জাহ্নবী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সেই দৃশ্য। মনে হচ্ছে তারা শুধু চা পাতা নয়, স্বপ্ন জমাচ্ছে ঝুড়িতে। অথচ নিতান্তই ছোট্ট ছোট্ট সেই স্বপ্নগুলোও পূরণ হয়না ওদের!

দু দিনের সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরলো ওরা। ফেরার পরদিন রাতেই সারল্য’কে ডেকে নিলেন ওর মা। পাশে বসিয়ে বেশ কোমল গলায় জানতে চাইলেন, ‘নানুবাড়ি ঘুরে এসে কেমন লাগছে তোর বাবা?’
‘ভালো মা। মনটা ফ্রেশ হয়েছে।’
‘জাহ্নবীও খুব মজা করেছে। মেয়েটার সঙ্গে দু তিন দিন থেকেই আমার এমন মায়া পড়ে গেল, বারবার ওর কথা মনে পড়ছে।’
‘তাই? এরকম হয়। জাহ্নবী অনেক ভালো মেয়ে। তোমাকে খালা বলে ডাকে এজন্য হয়ত আরও বেশী মায়ায় পড়েছো।’
‘তুই ওকে নিয়ে আয় না বাবা। কালকেই নিয়ে আয়।’
‘কালকেই? অফিসে ছুটি নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। এরমধ্যে আবার কাল আসতে বলবো?’
‘তাও ঠিক। কিন্তু আমার যে ওর কথা খুব মনে পড়ছে। তুই ওকে বল কাল রাতে আমাদের বাসায় খেতে। অফিস থেকে সোজা এখানে আসবে। রাতে খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে তুই ওকে রেখে আসবি।’

সারল্য মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা মা ঠিক আছে। আসতে বলবো। খুশি?’

মা খুশি হলেন। কিন্তু খুশি হওয়ার কারণটা শুধু জাহ্নবী আসবে বলে নয়। তিনি জাহ্নবীকে আরও একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চান। দুদিনেই মেয়েটার সম্পর্কে ভালো ধারণা রপ্ত করে ফেলেছেন। আদব কায়দা, আচরণ, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে সবদিক থেকেই মেয়েটা আদর্শ। তার ছেলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে কী না সেটা এখনো বুঝতে পারছেন না। তাছাড়া আগের পুত্রবধূকে তিনি অতটা আদর ভালবাসার সুযোগ পান’নি। মেয়েটা সারাক্ষণ দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। কখনো মেয়ে হয়ে উঠতেই পারেনি। তাই এবার যেন মেয়ের মতো একজন তার ঘরে আসে, যে তার দিকে খেয়ালও রাখবে। জাহ্নবী এতটা সংসারী কী না সেটাও দেখতে চান তিনি।
পরেরদিন জাহ্নবী সারল্য’র মায়ের জন্য রসমালাই আর একটা চাদর নিয়ে এলো। কী মনে করে যেন শাড়িও পরে ফেলল সে।

অফিস থেকে সারল্য তাকে রিসিভ করার সময় শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘আজকে দাওয়াত উপলক্ষে শাড়ি নাকি?’
‘বলতে পারেন।’
‘তাহলে মাকে বলি প্রতিদিন দাওয়াত দিতে?’

সারল্য’র কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল জাহ্নবী। আজ শাড়ি পরতে আরাম লাগছে। মনে হচ্ছে তাকে খুব সুন্দর আর পরিপাটি দেখাচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই খানিকটা আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে তার।
রাতের খাবার খেয়ে অনেক্ষণ সে সারল্য’র মায়ের সঙ্গে গল্প করলো। রাতে তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল সারল্য। ক্লান্তিতে ও ঘুমে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছিল বলে শাড়িটা কোনোমত খুলে রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো জাহ্নবী।

তারপর কেটে গেল অনেক গুলো দিন। ভায়োলেটের ব্যবসার শুরুটা হল খুব গুছিয়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লায়েন্টদের এত বেশী ভালবাসা প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে চাকরিটা ছেড়েই দিলো জাহ্নবী। সে এখন জানপ্রাণ দিয়ে ব্যবসার হাল ধরতে চায়। এরমধ্যে টুকটাক করে এগিয়ে চলেছে নাদির স্যারের বিজনেসটাও। সেখানেও প্রায়ই উপস্থিত হতে হয় জাহ্নবীকে। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং গুলোতে মতামত দিতে হয়, কাজ করতে হয় ঘরে বসে। কোনো কোনো দিন কাজের ফাঁকে সারল্য’র সঙ্গে চা খাওয়া আর খুচরো আলাপ, তবে সারল্য কেমন যেন বদলে গেছে। আগের মতো কথা বলে না তার সাথে। জাহ্নবী’র মাঝেমাঝে আক্ষেপ হয়। তবে আক্ষেপ ধরে রাখার সময় পায় না। খুবই ব্যস্ত সময় কাটছে তার। নবজাতক শিশুর মতো পরম যত্নে ব্যবসাটাকে গড়ে তুলতে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করছে সে।

তবে হাল ছেড়ে দেননি সারল্য’র মা। তিনি এতদিন ধরে রোজ সারল্য’কে বুঝিয়ে যাচ্ছেন কেন তার বিয়েটা করা উচিৎ, আর কেন জাহ্নবীকেই করতে হবে। সারল্য মায়ের কথা নিরবে শুনে যায়। কখনো রাগ করে উঠে যায় কথার মাঝখানে। কখনো বা উত্তর দেয়, আমি আর বিয়ে করবো না মা। আমাকে এ ব্যাপারে বোলো না প্লিজ।
নাদিরের প্রথম প্রজেক্ট সফলভাবে শেষ হওয়ায় ছোটখাটো সেলিব্রেশনের আয়োজন করেছে। মাত্র জন ছয়েক কাছের বন্ধুরাই এসেছে শুধু। খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই যখন উঠে চলে গেল, রেস্টুরেন্টের ছাদের এক কোণায় এসে দাঁড়াল জাহ্নবী। আজকাল এত ব্যস্ত সময় কাটছে তার, বুক ভরে শ্বাস নেয়াই হয়না। এখানে দাঁড়িয়ে কয়েকবার বড় বড় শ্বাস নিলো সে। বারো তলা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে পরিচিত শহরটাকে দেখতে লাগল।

সারল্য কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি সে। সারল্য’র কথায় চমকে উঠলো, ‘এই ইট পাথরের শহর ছেড়ে দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করে না?’
জাহ্নবী মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো, ‘না, করে না। এখানে আমার অনেক কাজ বাকি।’
‘আজকাল কাজের ভেতর ডুবে আছেন। বেশ ভালো।’
‘ছোটবোন ভরসা করে দায়িত্ব দিয়েছে। তাছাড়া আমার এই ছোট্ট স্টার্টআপটাকে এখন নিজের বাচ্চা মনে হয়। আমি এটাকে ছাড়তে পারবো না কখনো।’
‘আমায় বিয়ে করবেন জাহ্নবী?’

প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে সারল্য’র মুখের পানে তাকাল সে। বিশ্বাস হতে চাইল না, এইমুহুর্তে ঠিক কী শুনেছে সে! তার মুখভঙ্গির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। চোখের পলক পড়ছে না ক্ষণিকের জন্য। সে স্থিরচোখে সারল্য’র নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়েই রইলো।

সারল্য আবারও বলল সেই স্বপ্নময় বাক্যটা, ‘আমায় বিয়ে করবেন?’

স্তব্ধ জাহ্নবী ধীরেধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মনে হচ্ছে চোখ খুললেই দেখবে সারল্য নেই। সবটাই স্বপ্ন। কিন্তু না, চোখ মেলে সে দেখল সারল্য তার উত্তরের অপেক্ষায়।

চলবে..

মেঘফুল
পরিচ্ছেদ: ৫২

জাহ্নবীর জীবনে এমন মধুর মুহুর্ত কখনোই আসেনি। হাত পা থিরথির করে কাঁপছে, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে। পান্নাবাহারের চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে গিয়ে বুঝতে পারলো, চোখ দুটোও যেন প্রবলভাবে আটকে রেখেছে তাকে। ওই চোখ থেকে চোখ সরানোর সাধ্য তার নেই। গলা শুকিয়ে এলো জাহ্নবীর। কোনোমত নিজেকে সামলে নিয়ে সে মৃদু স্বরে বলল, ‘কী বললেন!’
সারল্য খানিকটা বিব্রতবোধ করল। মাথা নিচু করে ফেলল সে। তারপর লাজুক হেসে বলল, ‘আমি জানি আপনি আমাকে ভালো বন্ধু ভাবেন। প্রস্তাবটা করা হয়তো ঠিক হয়নি। দেখুন বন্ধুর চাইতে ভালো জীবনসঙ্গী আর কে হতে পারে?’

জাহ্নবী ঢোক গিলল। এর উত্তর সে কী করে দেবে! প্রস্তাবটা শোনার পর সর্বাঙ্গে শিহরণ বইছে তার। মনে হচ্ছে জনম জনম সে এমন একটা বাক্য শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। তার খুব আপন একটা মানুষ, তার পান্নাবাহার, যাকে ভালবাসতে গিয়েও নিজের সামলে নিয়েছিল সে। আঁকড়ে ধরতে গিয়েও ছেড়ে দিয়েছে এটা অসম্ভব ভেবে। সেই মানুষটাই তাকে আজ জীবনসঙ্গী হতে বলছে! এরচেয়ে বিস্ময়কর কিছু কবে ঘটেছে তার জীবনে?
জাহ্নবী ধীরেধীরে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না।

এক রাশ দমকা হাওয়া এসে তার চুলে দোলা দিয়ে গেল। শিহরিত হলো সে।
পান্নাবাহার বলল, ‘আমার মা আপনাকে ভীষণ পছন্দ করে। মাকে জীবনে তেমন কিছুই উপহার দিতে পারিনি। মা অসুস্থ, বয়সও হয়েছে অনেক। আপনাকে আবদার করে বসেছে। কী করে না করি বলুন?’
জাহ্নবী আচমকা প্রশ্ন করে বসলো, ‘শুধু মায়ের জন্য?’

সারল্য বলল, ‘এমনটা ভাব্বেন না প্লিজ। মা আপনাকে নিজের জন্য চায়নি, চেয়েছে আমার জন্য। তার মনে হয়েছে এই বয়সে এসে তার ছেলেটাকে আগলে রাখার জন্য আপনি আদর্শ মেয়ে। আপনি নাকি আমার মনের যত্ন নিতে পারবেন। শরীরের যত্ন আমি নিজেই তো নিতে পারি। মায়ের কথাগুলো দিনরাত ভেবেছি। মনে হল, মা ভুল কিছু বলেন নি।’

জাহ্নবী’র মনে হচ্ছে সে খুশিতে কেঁদে ফেলবে। তার জীবনে শোনা সবচেয়ে সেরা কিছু প্রশংসা বাক্য। স্কুল কলেজে সবসময় প্রথম হওয়ায় তার আনন্দ হতো, কিন্তু এতটা আনন্দ কক্ষনো হয়নি। এ যেন জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় অর্জন, সবচেয়ে দামী প্রাপ্তি।

জাহ্নবী’র ইচ্ছে করলো পাগলের মতো ছুটে গিয়ে সারল্য’কে জড়িয়ে ধরতে। ওকে জাপটে হাউমাউ করে কাঁদতে। খুশির জোয়ারে ভেসে ভেসে ওর বুকে নিজেকে শক্ত করে স্থাপন করতে। কিন্তু পারলো না। চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো কেবল।
‘কফি নিয়ে আসি?’
‘হুম।’

সারল্য কফি আনতে চলে গেল। জাহ্নবী পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু পাথরে দোল লাগছে আজ। বাতাসে থরথর করে কাঁপছে পাথরটা। হাত পা শিরশির করছে। নিজেকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে উঠছে তার পক্ষে। এমন লাগছে কেন আজ! প্রেমে পড়ার সেই অনুভূতির মতোন। তার পুরো শরীর জুড়ে সুখের আবেশ।

কফি হাতে ফিরলো সারল্য। জাহ্নবী খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কফির মগে চুমুক দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। মাথার ওপর দিয়ে শোঁ করে একটা উড়োজাহাজ চলে যায়। আকাশের দিকে তাকায় সারল্য ও জাহ্নবী।

সারল্য বলল, ‘প্লেনে চড়েছেন কখনো?’
‘না।’
‘প্রথমবার প্লেনে চড়তে দারুণ লাগে।’
‘হয়ত উঠবো কখনো।’
কফি শেষ করে জাহ্নবী বলল, ‘আমি আজকে বাসায় যাবো। কাজ আছে। ভায়োলেট আসবে।’
‘আমি গাড়ি আনিনি আজকে।’
‘আমি রাইড নিয়ে চলে যাচ্ছি। আপনি থাকুন।’

জাহ্নবী ফোন বের করে এপসে ঢুকে গাড়ি খুঁজতে লাগল। কিন্তু হাত কাঁপছে। নিজের ঠিকানাটাও ঠিক করে টাইপ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ভুল হল। সত্যি বলতে সারল্য’র পাশে থাকতে তার অস্বস্তি হচ্ছে। নিজের এই নার্ভাসনেস ওকে দেখাতে চায় না জাহ্নবী।

সে বলল, ‘গাড়ি চলে এসেছে। আমি তাহলে যাই?’
‘হুম।’

সারল্য এগিয়ে দিতে এলো তাকে। নিষেধ করতে পারলো না জাহ্নবী। খুব জোরে হৃদস্পন্দিত হচ্ছে। লিফটে উঠে জাহ্নবী এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। কথা হল না সারল্যর সঙ্গে। তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে দরজা আটকে দেয়ার সময় ঝুঁকে এসে সারল্য বলল, ‘সাবধানে যাবেন। আর হ্যাঁ, আমি কি আপনার প্রথম প্লেনে চড়ার সাক্ষী হতে পারি? জানাবেন কিন্তু।’

দরজা বন্ধ হয়ে গেল। স্থির চোখে সারল্য’র চোখে চোখ রাখল জাহ্নবী। গাড়ি আস্তে আস্তে ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। জানালার বাইরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে পান্নাবাহারের চোখ। অথচ বুকের ভেতর কী ভীষণ তোলপাড়! জাহ্নবী সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। প্রেমে পড়েছে সে। আর নতুন করে সে সারল্য’র প্রেমে পড়েছে। এই গভীর প্রেমের আস্বাদন তার জীবনে নতুন অনুভূতি। থরথর করে বুক কাঁপছে।

বাসায় ঢুকে ঘরের আলো নিভিয়ে অনেক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে রইল জাহ্নবী। বালিশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে। এই প্রাপ্তিতেও তার কেন কান্না আসছে বুঝতে পারছে না। উদাস লাগছে। এই প্রথম অন্ধকারকেও এত ভালো লাগছে তার।
হঠাৎ ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। ভায়োলেট এসেছে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘুমাচ্ছো?’

জাহ্নবী উত্তর দিল না। সোজা হয়ে শুয়ে চোখ মেলে তাকালো। ভায়োলেট খাবারের প্যাকেট বের করে বলল, ‘পিজ্জা, গরম আছে। খাও।’

জাহ্নবী উঠলো না। বিছানার কাছে এগিয়ে এলো ভায়োলেট। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে আপু? শরীর খারাপ?’

আচমকা উঠে বসে ভায়োলেটকে জাপটে ধরলো জাহ্নবী। ফোঁস ফোঁস করে কয়েকবার নিশ্বাস ফেলল। দুই হাত শক্ত করে ভায়োলেটকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ভেজা গলায় বলল, ‘আমি শেষ ভায়োলেট। আমি শেষ।’
‘এই আপু, কী হয়েছে তোমার?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো ভায়োলেট।

জাহ্নবী বলল, ‘আমি শেষ হয়ে গেছি একদম।’
‘কী হয়েছে?’

ভায়োলেট জাহ্নবীকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। মুখোমুখি বিছানায় বসলো দুই বোন। ভায়োলেটের হাত খামচে ধরে রেখেছে জাহ্নবী। মনে হচ্ছে সে একটা ছয় বছরের শিশু। নতুন কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। চোখেমুখে অন্য ধরনের দ্যুতি।
ভায়োলেট ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। ধরা গলায় জাহ্নবী বলল, ‘আমি একজনের প্রেমে পড়েছি।’

লাজুক হাসিতে দুলে উঠল ভায়োলেট। খলখল করে বলল, ‘বড় আপু সিরিয়াসলি! তুমি কারও প্রেমে পড়েছো?’

জাহ্নবী মাথা ঝাঁকাল, ‘হুম। আমার জীবনে প্রথম এই ফিলিংসটা প্রথমবারের মতো।’
‘সেটা বুঝতেই পারছি আপু। কীভাবে হলো?’

জাহ্নবী খানিকটা উদাস হয়ে গেল। মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘সে তো অনেকদিন আগে রে। তোর মনে আছে কী না জানিনা, একদিন টি মিট টোস্টে দ্বিতীয়বার চা খাবো বলেও খাইনি? ওই তখনকার কথা। তারও আগে একদিন ওখানেই প্রথম দেখি তাকে। প্রথমবার দেখেই আমার মনে হয়েছিল এই মানুষটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। বিশ্বাস কর, আমার সবকিছু নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল এমন একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম।’

ভায়োলেট উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘বাহ দারুণ তো। তারপর?’

জাহ্নবী আনন্দিত গলায় বলল, ‘তারপর তো মহা কাণ্ড। ভাগ্য হয়তো একেই বলে। নাদির স্যার অসুস্থ হবার পর ওনার বাসায় গেলাম ফাইল নিয়ে। ওখানে গিয়ে তাকে আবার দেখি। সে স্যারের কাজিন।’

ভায়োলেট হাত তালি দিয়ে উঠল, ‘এ তো দারুণ গল্প রে আপু। এতদিন বলোনি কেন আমাকে?’
‘এতদিন আমি নিজেই এতকিছু বুঝেছি নাকি? স্যার সুস্থ হবার দিন একটা পার্টি দিয়েছিল। ওইদিন সব এলোমেলো হয়ে যায় আমার। সেদিন থেকেই ওকে ভুলে যেতে চেষ্টা করেছিলাম।’

জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ভায়োলেট অধীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো কী হয়েছিল তারপর? জাহ্নবী ধীরেসুস্থে সবটাই খুলে বললো ওকে। শেষটায় এসে যখন আর আবেগ ধরে রাখতে না পেরে জাহ্নবী কাতর কণ্ঠে বলল, ‘আজ সে আমাকে বিয়ের কথা বলেছে ভায়োলেট। পান্নাবাহার! আমাকে বিয়ের কথা বলেছে।’

ভায়োলেট উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘সত্যি আপু! এ তো স্বপ্নের মতোন।’
‘একদম তাই। আমি তো এতদিন বন্ধুর মতোই মিশেছি। বিশ্বাস কর, আমি আর কোনো স্বপ্ন দেখিনি ওকে নিয়ে।’
‘তুমি অনেক ভাগ্যবতী আপু। তোমার জীবনে ভালবাসা এভাবেই আসার কথা ছিল। তাই হয়তো প্রকৃতি এত অদ্ভুতভাবে অপেক্ষায় রেখেছিল তোমায়। এবার নিজের মনের মানুষকে পেয়ে গেছো। তাকে নিয়ে স্বপ্নের মতো ঘর সাজাও।’

জাহ্নবী আবেগে ঝরঝর কেঁদে ফেলল। চোখ ভেজা থাকলেও মুখে ভুবনজয়ী হাসি। সত্যিই ভুবন জয় করে ফেলেছে সে। একটা পুরুষ মানুষের অপেক্ষায় এতগুলো বছর, এত দীর্ঘশ্বাস, এত অপেক্ষার প্রহর, আজ সবকিছুর বিনিময় পেয়ে গেছে সে। তার স্বপ্ন ছিল একটা খোলা বারান্দায় বসে ভিজবে তার স্বপ্নের মানুষটার সঙ্গে। ভিজবে একটা আরাম কেদারা, সিগারেটের অ্যাস্ট্রে। মুহুর্তেই সারল্য’র বাড়ির বারান্দাটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। জাহ্নবী স্থির থাকতে পারলো না। ছটফট করে উঠল। চোখের জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

মলিন মুখে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ভায়োলেট। অদূরেই সেই চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বড় আপা তার স্বপ্নের জীবন খুঁজে পেয়েছে। গতানুগতিক বিরক্তিকর জীবন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে নব আঙ্গিকে আবিষ্কার করেছে। স্বপ্নের মতো সবকিছু। হুট করে প্রেমে পড়া আবার প্রেমিক পুরুষটাকেও ভাগ্যক্রমে আপন করে পেয়ে গেল সে। সুখী হোক বড় আপা।

ভায়োলেটের আনন্দ হয়। আবার একইসাথে কষ্টও হয়। তার নিজের জন্য। নিজের মনের মানুষটাকে প্রাপ্তির আনন্দ কতটা সীমাহীন, সেটা অনুভব করে তার কষ্ট হয়।

জাহ্নবী এসে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পিজ্জা ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে?’
ভায়োলেট মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘হোক না। ঠাণ্ডা হতে দাও।’
‘বাসায় ওভেন আছে। ভুলেই গেছিলাম ধ্যাৎ। তুই দাড়া আমি গরম করে আনছি।’
জাহ্নবী দৌড়ে গেল পিজ্জা গরম করতে। ভায়োলেট মুগ্ধ হয়ে তার উচ্ছলতা উপভোগ করলো। জাহ্নবীকে এমনই সুখী দেখতে চেয়েছিল সে। জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে।

রাতে থেকে যাওয়ার জন্য বোনকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল জাহ্নবী। কিন্তু ভায়োলেট জানালো তার জরুরি কাজ আছে, বাড়ি ফিরতেই হবে। আসলে কাজের ছুতোয় সে চলে যেতে চায়। আজকের রাতটা আপুকে একা থাকতে দেয়া উচিৎ। আনন্দে, সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবে বড় আপু। হাসবে, একা একা গাইবে, নাচবে, কখনোবা কাঁদবে। আপু আজ একা থাকুক। জীবনের সেরা সময়টা উপভোগ করুক।

বের হওয়ার সময় জাহ্নবী জানতে চাইলো, ‘ওকে আমি কী বলবো ভায়োলেট?’
‘বলো প্লেনের টিকেট কাটতে। হা হা হা।’
‘দুষ্টুমি করিস না। সত্যি সত্যি কী বলবো?’
‘এত সুন্দর করেও প্রপোজ করা যায় আপু? আমি আপনার প্রথম প্লেনে চড়ার সাক্ষী হতে চাই। কী রোমান্টিক! আমার দুলাভাই।’

জাহ্নবী লাজুক হেসে বলল, ‘চুপ কর। ফাজলামো রাখ। আমি তারাহুরো করে চলে এসেছি। ও ভাব্বে আমার উত্তর ‘না’ ই হবে। এখন কীভাবে বোঝাবো ওকে?’
‘উহু অধৈর্য হয়ো না। শান্ত হও। এইমুহুর্তে শান্ত থাকাটা খুব দরকার।’

কয়েকটা দিন কেটে গেল শান্তভাবেই। জাহ্নবী পান্নাবাহারের সঙ্গে নিজ থেকে যোগাযোগ করেনি। এর মাঝে মিটিং ডেকেছিল নাদির। সেখানেও স্বাভাবিক আচরণ করেছে জাহ্নবী। সারল্য নিজেও সেই প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বাড়ায় নি।
কয়েকদিন পর জাহ্নবী সারল্য’র বাসায় এলো ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এসেই ওনাকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিক গলায় বলল, ‘খালা কেমন আছেন?’
‘এতদিন পর খালার কথা মনে পড়ল?’
‘আমি নতুন বিজনেস শুরু করেছি গো। উনি বলেন নি আপনাকে?’
‘না তো। কিসের বিজনেস?’

জাহ্নবী সংক্ষিপ্তভাবে তার ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা দিলো ওনাকে। তিনি অনেক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে সারল্যকে বললেন, ‘তোকে আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে সবার মতো না। ও আলাদা। এত বড় স্পর্ধা কার হবে? এত কঠিন ব্যবসা একা হাতে সামলাচ্ছে। বাবাগো!’

জাহ্নবী হেসে বলল, ‘আমার ছোটবোন সঙ্গে আছে। দুইবোনের বিজনেস।’
‘এত টাকার রিস্ক নিচ্ছো শুনেই তো অবাক হচ্ছি। তুমি বসো, আমি নাস্তা দেই।’
‘আপনাকে কষ্ট দিতে হয় বলেই আসতে ইচ্ছে করে না। নাস্তা টাস্তা লাগবে না। ভাত তরকারি রান্না করা আছে?’
‘আছে।’
‘তাহলে ভাত খাবো। কিন্তু এখন না। একটু বসি, তারপর।’

জাহ্নবী খানিকটা সময় মায়ের সঙ্গে গল্প করে সারল্য’র ঘরে এলো। এখানে সেখানে পড়ে থাকা জিনিসপত্র গোছাচ্ছে সে। জাহ্নবী বলল, ‘আমাকে মেহমান বানিয়ে দিলেন দেখছি। আমি এসেছি বলে ঘর গোছাতে হবে?’
‘সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। দু একদিন না গোছালেই দেখি ঘরটা জংগল হয়ে যায়।’
‘মোটেও না। আপনি অনেক গোছালো একজন মানুষ। আমি আপনার বারান্দায় যাই একটু?’
‘আসুন।’

সারল্য বারান্দার দরজা খুলে দিলো। দিনের আলোয় এটাকে দেখেনি জাহ্নবী। চোখ ধাধানো বাইরের আলো দেখেই মন ভরে যায়। বারান্দায় জমাট বাঁধা ধুলোবালি ও শুকনো পাতা দেখেই অনুমান করা যায় অনেকদিন ধরে দরজাটা বন্ধ। অবশ্য বন্ধ থাকায় লাভ একটা হয়েছে। বারান্দার কার্ণিশে শ্যাওলার সবুজ আবরণ পুরো বারান্দাকে একটা শৈল্পিক রূপ এনে দিয়েছে।

জাহ্নবী বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আপনি এখানে গাছ লাগাচ্ছেন না কেন?’
‘আসা হয় না তো।’
‘ঘরের বারান্দায় আসা হয়না। অদ্ভুত! গাছের যত্ন নিতেও অন্তত দিনে দুইবার আসা হতো। এইদিক দিয়ে টব রাখলে বেশ লাগবে।’
‘আপনি গাছ ভালবাসেন?’ জানতে চাইলো সারল্য।

জাহ্নবী বলল, ‘হুম, খুউউব। আমার বাসায় লাগিয়েছি। ঝোপালো হয়ে গেছে সবগুলো।’
‘চা খাবেন?’
‘না।’

জাহ্নবী অন্যমনস্কভাবে বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আমি আসলে এখানে একটা পর্তুলিকার চারা রাখবো। এখানে বেলিফুল। এদিকটা পরিষ্কার করে বসার জায়গা বানাবো। একটা ইজি চেয়ার বানাতে হবে।’

জাহ্নবী সারল্য’র দিকে তাকাতেই দেখল সারল্য ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। জাহ্নবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে ফিক করে হেসে ফেলল। পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠল জাহ্নবী। অন্যমনস্কভাবে সে এসব কী বলে ফেলেছে! এখানে আসলে মানে? নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় মরে যায় সে। মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল যেন কিছুই হয়নি।

কিন্তু সুযোগটাকে হাতছাড়া করল না সারল্য। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে হাসি হাসি মুখে জানতে চাইলো, ‘তা আর কী কী করবেন আপনি এসে?’

জাহ্নবী শিউরে উঠল। মুখ টিপে হাসলো সে। সারল্য তার দিকে চেয়ে আছে। জাহ্নবী বলল, ‘ওভাবে দেখছেন কেন?’
‘আমার বারান্দাটা দখল হয়ে যাচ্ছে। দেখবো না?’
‘দখল করছি কই। বারান্দার যত্ন নিতে হবে বলছি।’
‘আর কিছুর যত্ন নিতে হবে না?’
‘যত্নের অভাবে যা যা মরে গেছে, সবকিছুর যত্ন নেয়া হবে।’
‘কে কে মরে গেছে?’
জাহ্নবী সারল্য’র চোখে চোখ রেখে বলল, ‘জানেন না?’

সারল্য চমকে উঠলো। জাহ্নবীর কাছাকাছি এগিয়ে এলো সে। দুজনের কখনো এত কাছ থেকে চোখাচোখি হয়নি আগে। সারল্য স্পষ্ট গলায় বলল, ‘পারবেন? এই মরে যাওয়া হৃদয়টার যত্ন নিতে? মরে যাওয়া এই ঘর, সংসার, এলোমেলো একটা জীবনের যত্ন নিতে?’

জাহ্নবী আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল, ‘যে মেয়েটা পঁয়ত্রিশ বছর ধরে গুমরে গুমরে মরে পড়ে থাকা জীবনটাকেই বদলে ফেলেছে, তাকে আপনি কোন দায়িত্বের ভয় দেখাচ্ছেন?’

সারল্য স্থির চোখে চেয়ে রইল। জাহ্নবী নিঃসংকোচে ওর হাত ধরে বলল, ‘আমায় আপনি ভরসা করতে পারেন।’

ম্লান হাসল সারল্য। জাহ্নবীর হাতে আলতো চাপ দিয়ে সে বলল, ‘করি তো। নয়তো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে চাইতাম?’

জাহ্নবী ওর হাত ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। খানিকটা সময় দেয় নিজেকে। বারকয়েক শ্বাস নিয়ে বলল, ‘ক্লারার সঙ্গে দেখা হয়না আপনার?’
‘হয়। মাঝেমাঝে ওকে নিয়ে সারাদিন কাটাই, সন্ধ্যাবেলা মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে আসি।’
‘মেয়ের জন্য কষ্ট হয়না আপনার?’
‘হয়। বুক ফেটে যায়। আমার এত আদরের মেয়ে, প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখতাম ও আমার বুকে জড়িয়ে আছে। বলত, বাবা বাবা আমাকে গুড মর্নিং বলো। আই এম ইয়োর প্রিন্সেস।’

সারল্য’র গলা ধরে এলো। জাহ্নবী কিছু বলার সাহস পেলো না। সারল্য ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমার রাজকন্যাটা হারিয়ে গেছে জাহ্নবী। এ যে একজন বাবার জন্য কত বড় কষ্টের, তুমি বুঝবে না।’

জাহ্নবী সারল্য’র দিকে তাকাতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েই বলল, ‘আমি আপনাকে একটা নতুন রাজকন্যা এনে দেবো।’

সারল্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ জাহ্নবী। মাকে জানানো দরকার। দুইমাস ধরে আমার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।’

জাহ্নবী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো। সারল্য ঘরে প্রবেশ করলেও নড়তে পারলো না সে। অসীম সুখের পরশে অনড় হয়ে রইল।

চলবে..

(রিভিশন দেয়ার সময় পাইনি। বানানে ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)