মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
204

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-১৪ (অন্তিম পর্ব)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

রাত বারোটা। খান বাড়ির গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো মাহিরের কালো টয়েটো গাড়ি। গাড়ি পার্ক করে মাহির নিজের ভেজা শার্ট পড়ে নিলো। ইরাবতীর গায়ে কোর্ট পড়িয়ে দিয়ে কাঁধে তুলে নিলো। গটগট পায়ে প্রবেশ করলো খান বাড়িতে। খান বাড়ির সবাই নিরব। তারা ইতিমধ্যেই জেনে বসে আছেন তাদের গুনধর ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে। মাহির ও ইরার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। ইরা ঘুমে বিভোর। ঔষধের ইফেক্টে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। মাহির সোজা সিঁড়ি দিয়ে নিজের রুমে গেলো। ইরাকে বিছানায় ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলো। তারপর ফ্রেশ হতে চলে গেলো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে কাপড় চেঞ্জ করে মাহির দরজা দিয়ে বের হয়ে সোজা নিচে চলে গেলো। টেবিলে বসে বলল,

‘মা খাবার দাও।’

মমতা খান ফুসফুস করলেন।

‘তুমি এতো নির্লিপ্ত কিভাবে মাহির?’

‘বিয়ে করেছি। তোমরা চাইলে আনুষ্ঠানিক ভাবে আবারও দিতে পারো। আমি নিষেধ করবো না।’

সোফাতে বসা অর্ষার বাবা বললেন,

‘দেখো মাহির সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার যেহেতু পছন্দ ছিল তাহলে আগেই বলতে পারতে। সমাজে তো আমাদের মান সম্মান আছে। আমার মেয়ের চরিত্রে দাগ লেগে গেলো বাবা।’

আরেক সোফায় বসা শাওনের মায়ের কানে সৈকত ফিসফিস করলো।

‘অর্ষা মেয়েটি কিন্তু খারাপ না আন্টি। আজই সুযোগ। শাওনকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিন।’

শাওনের মায়ের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। তিনি জোরে বললেন,

‘আরে ভাই আপনার মেয়ের চরিত্রে কেন দাগ লাগবে? আমাদের ছেলেরা আছে না?’

তাহসিন খান অবাক হলেন,

‘কার কথা বলছেন ভাবী?’

‘আরে আমি শাওনের কথা বলছি। আমার ছেলে তো মাশাআল্লাহ ডাক্তার। অর্ষার সাথে যদি বিয়ে হয় তাহলে তো কোনো সমস্যা হবে না। কি বলেন?

শাওন দূরে দাড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করছে। সৈকত হেসে বলল,

‘আন্টি ঠিকই বলেছেন আঙ্কেল। আমাদের শাওনের মতো ছেলে তো লাখে একটা।’

অর্ষার বাবা চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।’

সিঙ্গেল সোফায় বসে থাকা অর্ষা মনে মনে বিরক্ত হলো। সে কোনোকালেই এসব বিয়ে টিয়ে তে ইন্টারেস্ট ছিলো না। নেহাত বাবা জোর করলেন সেজন্য রাজি হতে হলো। কিন্তু তার যার সাথে সব ঠিক করা হয়েছিল সে তো বিয়ে করে ফেলেছে। জেনে অর্ষা মনে মনে খুশি হয়েছিল৷ কিন্তু সোফায় বসা মুটকি আন্টিটার সে-ই খুশি সহ্য হলোনা। নিজের ছেলের জন্য এখন তাকে চাইছেন। রাগে অর্ষার মাথা ব্যথা করতে লাগলো। তার বাবা একবার যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাহলে যেভাবেই হোক মেয়ের বিয়ে দিবেন। এবার যদি পাত্র বোবা কালাও হয় তবুও দিবেন। কারণ একবার যদি অর্ষা বেঁকে বসার সুযোগ পায় তাহলে আর তাকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। অর্ষার মারাত্মক একটা ট্রমা আছে। তার বাবা ডিভোর্সি। বাবা মায়ের ঝগড়া হতো অনেক। অর্ষা যখন ছোট তখন তার মা নিজের গোপন প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যান। তারপর তার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়। তার পাষাণ মা তাকে কখনো নিজের কাছে নিতে আসেনি। অর্ষার কানে এসেছে তিনি বিদেশে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকেন এখন। অর্ষা নিজেও একজন ডাক্তার৷ নিজেকে কাজে ডুবিয়ে রাখে সে। সময় পেলেই ট্যুর দেয়। এসবই তার সঙ্গী। এই জীবনে কাউকে জড়ানোর ইচ্ছা তার কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু তার পিতা মহাশয় মানতে নারাজ। তার এক কথা, ‘তোমার পিতা বিয়ে করে সুখী হননি বলে যে পিতার মেয়ে সুখী হবে না সেরকম কোনো কথা নেই!’

অর্ষার বাবা রাজি হলেন। নাবিদ, নিবিড় ও সৈকত আবারও ছুটলো কাজি অফিসে৷ এবার তারা কাজিকে তুলে নিয়ে এসেছে খান বাড়িতে। কাজি মহাশয়ের চোখমুখ থমথমে। তিনি বুঝতে পারছেন না পৃথিবীতে ঠিক কতরকমের পাগল রয়েছে।

শাওন চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। মাহির পাশ থেকে দাঁত বের করে হাসলো। শাওন শক্ত কন্ঠে বলল,

‘সব তোর জন্য শালা। নিজে আরেকজনকে বিয়ে করে আমাকে ফাঁসিয়ে দিলি।’

কাজি চোখমুখ গম্ভীর করে বিয়ে পড়িয়ে বিদায় নিলেন। শাওনের মা নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। মাহির খেলতে বিদেশে যাবে। সে ফিরলেই দুজনের বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

সালটা ২০২৪। আষাঢ় মাস। বাহিরে ঝিরিঝিরি বর্ষণ। বারান্দায় দাড়িয়ে উঁচু পেট নিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে ইরা। তন্মোধ্যে পেছন থেকে দুটি হাত তাকে জড়িয়ে ধরলো। মাহির ঘাড়ে নাক ঘষলো।

‘বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ঠান্ডা লাগবে যে।’

‘বৃষ্টি ভালো লাগে।’

মাহির টেনে ভেতরো নিয়ে এলো। কাপড় চেঞ্জ করে দিলো। তারপর বিছানায় শুইয়ে বুকে নিয়ে কাঁথার নিচে চাপা পড়ে গেলো৷ ফিসফিস করে বলল,

‘তোমাকে এতো সুন্দর লাগে কেন ইরা?’


ইশান ও মেহেরের সম্পর্কে উন্নতি এসেছে। ইশান ক্ষমা করেছে মেহেরকে। দুজন পুরোদমে পড়াশোনা করছে। সামনে তাদের ক্যারিয়ার পড়ে আছে। ইশান ইরার ফ্ল্যাটেই থাকে মেহেরকে নিয়ে। যতোদিন না নিজে কিছু করছে ততোদিন তার বোনের ফ্ল্যাটটাই তার ভরসা।

উন্নতি এসেছে অর্ষা ও শাওনের সম্পর্কে। দুজন দুজনকে এখন চোখে হারায়। তারা আপাতত বাচ্চা নিতে চেষ্টা করছে।

নাবিদ ও নিবিড় সন্তানের বাবা হয়ে গেছে। এই সবকিছুর মধ্যে একা হয়ে গেলো ফাজিল সৈকত। সে একদিন সুযোগ বুঝে ইরার হসপিটালে গেলো। চোখ দিয়ে সব নার্সকে দেখে নিলো। তারপর সেখান থেকে একজনকে ভালো লাগতেই প্রপোজ করে বসলো। নার্সটি রেগে বলল,

‘এসব কিরকম ছ্যাচড়ামি?’

সৈকত ইরাকে ফোন দিলো। বলল,

‘আপনি কিছু বলুন তো ভাবি।’

ইরা হেসে বলল, তাকে নাম জিজ্ঞেস করুন তো ভাইয়া।’

নার্সটি নাকমুখ কুঁচকে বলল, ‘ঐশানী।’

ইরা তৎক্ষনাৎ বলল,

‘আমাকে চিনতে পেরেছো ঐশানী? আমি ইরা।’

ঐশানী চিনতে পারলো। বলল,

‘এই ফাজিল ছেলের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?’

‘কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হতে পারে। যদি তুমি তাকে বিয়ে করো।’

ঐশানী চমকে গেলো। সৈকত অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

‘আমার সব বন্ধু বিয়ে করে বাচ্চা ফয়দা করছে। একমাত্র আমিই সিঙ্গেল। আমার ইচ্ছে ইরা ভাবির মতো একজন সুন্দরী নার্সকে বিয়ে করবো। আপনি কি রাজি আছেন ম্যাম?’

ঐশানী মাথা ঘুরে সৈকতের উপর পড়ে গেলো। এ জীবনে সে এমন কিছুর সম্মুখীন হয়নি।


ডিসেম্বর মাস। ইরার একটি ছেলে সন্তান হয়েছে। বয়স চারমাস। মাহির ঠিক করেছে সে ক্রিকেট টিম বানাবে। একটি অবসর বিকেলে ইরাবতী গুছিয়ে রাখা অর্ধ পান্ডুলিপি বের করলো। যেটার সমাপ্তি সে আজ লিখবে। প্রকাশকের সাথে কথা বলে নিলো সে। এবার তার প্রকাশ্যে আসার পালা।’

বই প্রকাশ হলো ফেব্রুয়ারিতে। ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলো। তাতে ইরা তার পুরো পরিবার নিয়ে গেলো। মাইকে যখন বলা হলো লেখিকা ইরাবতী আমিন ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন তখন মেহের খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। ইরা সন্তপর্ণে স্টেজে উঠে গেলো। লেখিকা রুপে তাকে দেখে সবাই অবাক হলো। মাহিরের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি।

ইরা বই হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। মাইক হাতে নিয়ে সবাইকে সালাম দিলো।

‘আমি ইরাবতী আমিন। অনেক বছর ধরে লেখালেখির সাথে যুক্ত। কিন্তু কখনো সামনে আসা হয়নি। সেজন্য ভাবলাম কতোদিন পাঠকদের দেখা না দিয়ে থাকবো। আজ আমার হাতে যে বইটি দেখতে পাচ্ছেন সেটি সদ্য প্রকাশিত হওয়া আমার নতুন বই। বইটা আমি উৎসর্গ করেছি আমার পুরুষ ক্রিকেটার মাহির খানকে। সেজন্য বইটার প্রথম কপিটা তারই হাতে তুলে দিতে চাই।’

মাহির ভীড়ের মধ্যে থেকে স্টেজে এসে দাড়ালো। মাক্স খুলতেই হৈহৈ পড়ে গেলো। এতবড় একজন ক্রিকেটার স্টেজে তা যেনো কেউ ভাবতেই পারছে না। মাহির বইটা গ্রহণ করলো। মাইক হাতে নিয়ে সবার প্রথমেই হেসে ফেললো।

‘আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে, যে আমাকে উৎসর্গ করেও কেউ বই লিখেছে। সে যদি হয় আমার সহধর্মিণী তাহলে তো দ্বিগুণ খুশি। আমাকে এতবড় সম্মান দেওয়ার জন্য ম্যাডামকে ও ম্যাাডামের পাঠকদের অনেক অনেক ভালোবাসা। আমি মাঠে ছক্কা মারতে পারি, কিন্তু সাহিত্য পড়তে জানি না। সাহিত্য পড়াটা নাহয় আমার ম্যাডামের বইটা পড়েই শুরু করলাম।’

স্টেজ থেকে নামতেই মেহের ইরাকে চেপে ধরলো। বার-বার বলতে লাগলো, ‘এতোদিন বলোনি কেন তুমিই সেই। কেন বলোনি?

ইরা শুধু হাসলো। সে জানে মেহের তার লেখার ভক্ত।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন বাড়িতে ফিরলো তখন ইরা মাহিরকে চেপে ধরলো।

‘তুমি জানতে আগে থেকে?’

মাহির হাসলো,

‘জানি বলেই ম্যারিড স্ট্যাটাস দিতে তোমাকে জোর করিনি। আজ স্ট্যাটাস টা দিয়েই ফেলি কি বলো?’

মাহির চোখ মারলো। ইরা মৃদু জোরে বুকে ঘুষি মেরে বলল,

‘ফাজিল ক্রিকেটার।’

মাহির নিজের সাথে চেপে ধরলো, ‘তোমারই তো ম্যাাডম।’

অবশেষে বিয়ের প্রায় দু বছর পর ক্রিকেটার মাহির খানের সাথে লেখিকা ইরাবতী আমিনের ম্যারিড স্ট্যাটাস দেখতে পাওয়া যায় ফেসবুক ফিডে।

*
২০২৯ সাল,

তেমনই একটি বৃষ্টিস্নাত বিকেল। খান বাড়ির বাগানে চার সন্তান নিয়ে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছে মাহির। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার সবাই। ইরা বাগানের সাইডে মাহিরের রুমের বারান্দায় বসে আছে উঁচু পেট নিয়ে। পঞ্চম বারের মতো মা হবে সে। বড়োটার বয়স সাড়ে পাঁচ, দ্বিতীয় টার সাড়ে তিন, তৃতীয় টার আড়াই বছর, চতুর্থ টার এক বছর। এক বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসেছে ইরা। সে বারান্দায় থেকেই মাঝে মধ্যে ইশারা করে বাবা ভাই ও বোনকে বুঝাচ্ছে এটা সেটা। মাঝে মধ্যে ছুটে যেতে চাইছে। সে বাবার মতো খেলবে। মাহিরের দ্বিতীয় সন্তানটি মেয়ে। সবচেয়ে খেলার প্রতি তার আগ্রহ বেশি।

মাহিরের সাথে সবার বড় মাহদি ও যোগ দিয়েছে খেলায়। মাহির মূলত তার বাচ্চাদের খেলতে শেখাচ্ছে। যদিও ছোটরা ভালো করে দাঁড়াতেই পারছে না। দু পা হাঁটলেই পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও তারা কাঁদছে না। তারা আনন্দ পাচ্ছে। বাবার সাথে খেলতে পেরে। মাহির সবার অলক্ষ্যে মাঝে মধ্যে সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে উড়ু চুম্বন করছে।

তন্মধ্যে বাগানের দিকে গিটার কাধে ছুটে এলো একটি পুরুষ। সে প্রায় চিৎকার করে আর্তনাদ করে বলল,

‘এক বৃষ্টিতে নার্স পটিয়ে, আরেক বৃষ্টিতে বিয়ে করে চার চারটা বাচ্চার বাবা হয়ে গেলি বন্ধু। প্রত্যেক সিজনে ওদেশে এদেশে হানিমুনে যাও। চারটা আছে, আরেকটা আসবে আসবে ভাব। এদিকে আমি সুন্দরী নার্সকে পটিয়ে বিয়ে করে সবে মাত্র একটা বাচ্চার বাবা হতে চলেছি। এ কেমন অবিচার বন্ধু? তুমি বছরে বছরে বাচ্চা পয়দা করে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছো কেন?’

ইরা বারান্দায় বসে খিলখিল করে হাসলো। মাহির ঠোঁট কামড়ে মাথা চুলকিয়ে সে হাসি দেখলো। ইরার মনে হলো সেদিন মেঘবালিকার নিমন্ত্রণ পৌঁছেছিল বলেই আজ ক্রিকেটার তার!

(সমাপ্ত)