মেঘবালিকার নিমন্ত্রণে পর্ব-০৬

0
186

#মেঘবালিকার_নিমন্ত্রণে
#পর্ব-০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

সময়টা শীতকাল। ভোরে হোক বা রাতে ঠান্ডা সহ্য করেই ঘরের বাহিরে পা রাখতে হয় ইরার। আজ তার রাতে ডিউটি। সেজন্য সে আজকের দিনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে৷ মাথা বের করে কাঁথায় পেছানো হাত দিয়ে ধরে পড়ছে হুমায়ূন আহমেদের একটি বই। ইরা ছোট থেকেই অলস প্রকৃতির। কিন্তু মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সন্তান হওয়ার কারণে তাকে অলসতা পেছনে ফেলে ক্যারিয়ার গুছাতে হয়েছে। এইযে সে আজ নার্স। সেটা হওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না কখনো। সে তো আইনের কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। সবসময় গল্প উপন্যাসে দেখে এসেছে নার্সদের তেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়না তাতে। হসপিটালের কোনো সিন থাকলে সেখানে ডক্টরদেরই সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়। সেজন্য ইরা কখনো নার্স হতে চাইতো না। কিন্তু সে ইনভেস্টিগেটর ও হতে পারবে না। তার বাবার তেমন সামর্থ্য নেই। তার উপর ইরা ইনভেস্টিগেটর হওয়ার পদ্ধতি জানে না। অল্প বয়স হলেও পড়াশোনার বিষয়ে তাকেই সব সিদ্ধান্ত নিতে হতো। কারণ তার বাবা পড়াশোনার বিষয়ে তেমন কিছু বুঝেন না। সে জানতো তার এই ইচ্ছেটা পূরণ হবে না। তবুও চাইতো একটা মিরাক্কেল হোক। কিন্তু হলো না। ইরাকে শেষমেশ নার্সিং পড়তেই হলো। এই পেশায় এসে সে বুঝেছে কতোটুকু সম্মানের একটি পেশা। কিন্তু তবুও কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব হয়। ইরা যখন কোনো থ্রিলার বই পড়ে বা একশন মুভি দেখে তখন সেটা আরও বেশি অনুভব করে। সে আজও না চাইতে ও নিজেকে ফর্মাল স্টাইলে পিস্তল হাতে নিয়ে ক্রিমিনালের পেছনে দৌড়াতে দেখে কল্পনায়। ইরা জানে এসব সারাজীবন কল্পনা হয়েই থাকবে। মানুষের সব ইচ্ছে সবসময় পূর্ণতা পায় না। ইরা ভাগ্যে বিশ্বাসী। কিন্তু তবুও শূন্যতা তাকে শান্তি দেয় না। আজও ইচ্ছে গুলো বুকের ভেতর গুমরে মরে। ইরা কোলাহলে থেকেও তা বুঝতে পারে। সে স্পষ্ট শুনতে পায় তার ভিতর কে যেনো কাঁদছে। অভিযোগ করছে ‘তুমি আমাকে কখনো ভালো রাখোনি।’

‘বুকের ভেতর স্বপ্নেরা আজও গুমরে মরে। তারা প্রকাশ হতে চায়। বলতে চায় ইনভেস্টিগেটর অফিসটা আজও তোমার অপেক্ষায়৷ ক্রিমিনালরা আজও পালিয়ে বেড়াচ্ছে তুমি এসে ধরবে বলে। স্বপ্নেরা কল্পনায় নানান বাহানায় ক্রিমিনালের পেছনে দৌড়ে। মিহি মিহি কন্ঠে বলে ‘ তুমি এসো একবার এসো। ‘

অথচ আমি জানি আমার স্বপ্নেরা এভাবেই বন্দী থাকবে চিরকাল।

এতোটুকু লিখে ডায়েরি বন্ধ করলো ইরা। তার মনের কথা সব ডায়েরিতেই আবদ্ধ থাকে।

*
বাড়িতে মাহিরের জন্য পাত্রী দেখার তোড়জোড় চলছে৷ কিন্তু মাহির নির্লিপ্ত। বয়স হচ্ছে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু কাকে করবে সেটা মাহির নিজেও জানে না। মা একের পর এক পাত্রীর ছবি, সিভি তার ওয়ার্সআপে দিচ্ছেন। মাহিরের কেন যেন একবারও সেগুলো দেখতে ইচ্ছে করেনি। কোথাও একটা তার মন কেমন করে। মনে হয় সে কিছু একটা মিস করে ফেলেছে। কিন্তু সেটা কি মাহির নিজেও বুঝতে পারে না।

কিছুদিন আগে মাহিরের উনত্রিশ তম জন্মদিন চলে গেলো। সবার সাথে আনন্দে কেটেছে তার সেইদিন। কিন্তু সেদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে তার ফোনে কেউ উইশ মেসেজ পাঠিয়েছে। সাথে পাঠিয়েছে ভালোবাসাময় চিঠি। চিঠিটা এমন-

‘ সম্বোধনহীন চিঠি দিলাম বলে আবার আমাকে চিঠি লেখায় অজ্ঞ ভাববেন না যেন। আঠাশ বছর থেকে উনত্রিশ বছরে পদার্পণ করার জন্য আমি আপনাকে শুভেচ্ছা জানাবো না। আপনাকে ভালোবাসা। ত্রিশে পদার্পণ করার আগেই আমাকে নিজের করে নিন। সেদিন থেকেই না-হয় আমি আপনাকে ভালোবাসাময় উইশ করবো। আপনার দিন সুন্দর কাটুক। ‘

ব্যক্তিটি কে মাহির জানে না। এ পর্যন্ত সে যতো প্রপোজাল পেয়েছে সব কমন। বাট এটা একদম অন্যরকম কিছু। এই প্রথম কেউ নিজের পরিচয় গোপন করে তাকে চিঠি দিলো। মাহিরের ব্যাপারটি ইন্টারেস্টিং লাগলেও সে কোনো রিপ্লাই করলো না। অন্যসব ফ্যান ফলোয়ারের মতো অজ্ঞ এই চিঠিটাও ভীষণ অবহেলায় মোবাইল স্কিনে ঘাপটি মারলো।

মেহের কলেজের এডমিশন নিতে ব্যস্ত। ময়মনসিংহ ঘুরতে গিয়ে একটা কান্ড ঘটিয়েছে সে। আচমকা সে প্রেমে পড়ে গেছে। এই আচমকা প্রেমটা ময়মনসিংহ নিবাসী এক পুরুষের প্রতি। পুরুষটি কে সে জানে না। জাস্ট এক দেখায় প্রেমে হোচট খেয়ে পড়েছে সে। তারপর আর দেখেনি। কিন্তু পুরুষটি এখনো তার মনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ট্যুরের দিন শেষ হতেই তারা ব্যস্ত শহরে ফিরে এসেছে। এডমিশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেও ভীষণ একলা থাকার ক্ষণে পুরুষটির অস্পষ্ট মুখ ভেসে উঠে মেহেরের সামনে। এতোদিনে পুরুষটির মুখশ্রী অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। মেহের জানে না এটা স্পষ্ট থেকে যেমন অস্পষ্ট হলো তেমনই অস্পষ্ট থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে কি না!

মেহের এর সাথে ইরাবতীর মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা হয়। দুজনের এখন খুবই গভীর সম্পর্ক। ইরা মেহেরকে তুই করে বলে এখন। মেহের আপু বলেই ডাকে।

গ্রাম থেকে ইরাবতীর মা বাবা ভাই আসবেন। কারণ হলো ইরাবতীর ভাইয়ের ভার্সিটি এডমিশন। সেটা নিয়েই মেহেরের সাথে কথা বলছিল সে। ঢাকার একটি ভার্সিটিতে চান্স হয়েছে ইশানের। ভাইয়ের এই সাকসেস এ খুশি ইরাবতী ও তার পরিবার। মেহের হুট করেই বলল,

‘ আমিও তোমাদের সাথে যাবো ভার্সিটিতে আপু। ‘

ইরাবতী না করতে পারলো না। অগত্যা মেহের তাদের সাথে ভার্সিটিতে যাবে।

যথা সময়ে তারা শহরে এলেন। পরদিন সকালে যখন ভার্সিটি চত্বরে মেহের এসে তাদের সাথে যোগ দিলো তখন মেহের ভীষণ আশ্চর্য ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘ইনি কে গো আপু?’

ইরা হেসে উত্তর দিয়েছিল,

‘আমার ভাই, ইশান আমিন।’

ব্যস মেহেরের মনে থাকা সেই অস্পষ্ট মুখশ্রী অদৃশ্য হওয়ার বদলে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো। বুকের কম্পন বাড়লো। শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হলো। মেহের যতোক্ষণ ইরাদের সাথে ছিল ততোক্ষণ আড়চোখে ওই মানুষটাকেই দেখে গেছে শুধু।

ইরার মা বাবা চলে গেলেন সেদিনই। ইশান বোনের সাথে থেকে পড়বে। শুরু হলো ভাই-বোনের একার জীবন। ইরা ও ইশান দুজন মিলেই ঘরের কাজ করে। ইশান রান্না থেকে শুরু করে সবই পারে। আগের মতো ইরাকে ডিউটি থেকে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আর রান্না বসাতে হয়না।

এরমধ্যে মেহেরের আনাগোনা বেড়েছে ইরার ফ্ল্যাটে। সে আজকাল নানান বাহানায় ইরাকে দেখতে আসছে। বিষয়টা ইরার নজরে তেমর ভাবে পড়েনি। তবে অবাকের বিষয় যার জন্য মেহের ছুটে আসে তার সাথে তার এখনো কোনো কথা হয়নি। চোখাচোখি ও না। মেহেরের মনে হয় মানুষটা রোবোট। নাহলে সামনে জলজ্যান্ত একটা মেয়ে যে তাকে গিলে খাচ্ছে সেটা কিভাবে না বুঝে বসে থাকতে পারে?’

মেহেরের চিন্তা ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে তেমনই একদিন ইশান আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা ঘটালো। ইরা তখন হসপিটালে। ইরাকে দেখার বাহানায় সেদিনও মেহের এসেছে। ভদ্রতাসূচক ইশান কফি বানিয়ে আনলো সাথে সামান্য নাস্তা। মেহেরকে সেগুলো দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ছ্যাচড়ামির লিমিট থাকে। পরের বার আমার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকবেন না। নাহলে আমি আপনার নামে মামলা করবো। আর আপা কখন বাসায় থাকে কখন থাকে না সেটা আপনি জানেন। তারপরও আমাকে ডিস্টার্ব করতে আসেন সেটাও আমি বুঝতে পারি। আপনার মনে যা আছে তা আমি জানতে চাই না। শুধু এতোটুকু বলবো পরেরবার যা করবেন চিন্তা ভাবনা করে। কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাবে খেয়ে আপনি যদি প্রস্থান করেন তাহলে আমি পড়াতে ফোকাস করতে পারি।’

সেই কফিটা তেমনই পড়ে রইলো। মেহের দূর্বল শরীর ও মন নিয়ে প্রস্থান করলো। ইশান বেডরুম থেকে এসে লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ইরার থেকে শুনেছে মেহের কিরকম ফ্যামিলির মেয়ে। সেখানে সে তো! আকাশ পাতাল তফাত।

(চলবে)