মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-৩৩

0
685

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৩

রাত তখন গভীর। চোখের পাতা স্বপ্নের দেশে তলিয়ে গেছে। নাক বন্ধ। একটু ঠান্ডা আবহাওয়ার তৈরি হলেই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। নাকের ডগা টকটকে লাল হয়েছে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে কোনো দৃঢ় বাঁধন। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। লহমায় হকচকিয়ে গেল। ‘বদ জ্বীন’ নামক অদৃশ্য জ্বীন আমাকে বন্দি করেছে। নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াস করলাম। কিন্তু ব্যর্থ! বিনিময়ে দৃঢ় বাঁধনে বন্দি হতে হল আমায়। কাঁধে মুখ গুঁজে দিল‌। কম্পিত হলাম আমি। স্পর্শটা চেনা, অজানা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নয়। আমি চোখ বন্ধ করে আরেকটু উপলব্ধি করলাম, আমার অনুমানে ক্রুটি নেই। ইনি নিঃসন্দেহে ধ্রুব। মুহুর্তেই অভিমানের মেঘ জড়োসড়ো হয়ে এল মনআকাশে। অশ্রু হয়ে নিঃশব্দে ঝরে পড়ল। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তিনি অনুভব করতে পেরে ঘুম ঘুম স্বরে শুধালেন, “সাপের মত মুচড়ামুচড়ি করছ কেন? একটু ঘুমাও, আমাকে ঘুমাতে দাও বউ!”

“বউ” শব্দটা কর্ণে বাজতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। শিহরণ ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। লজ্জা মিশ্রিত আভা ছড়ালো মুখশ্রী জুড়ে। ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন করে লম্বা শ্বাস নিলাম। না, এই মুহূর্তে গরম খাবার না খেলে এই ঠান্ডা কমার উপায় নেই। ধ্রুবকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলাম। অন্ধকার ঘরে নিক্ষেপ করলাম সন্দিহান চাওনি। আমি বাবুই আন্টির ঘরে ছিলাম, কিন্তু এটা ধ্রুবের ঘর। কীভাবে এলাম? ধ্রুব এনেছে না-কি নিজেই চলে এসেছি। ভাবতে ভাবতে হাই তুলে নেমে গেলাম। মেঝে বরফাচ্ছন্ন হয়ে আছে। পা রাখতেই হিম ছড়িয়ে গেল। অপর পা ফেলার পূর্বেই ধ্রুবের আবছা কণ্ঠ শ্রবণ হল। ঘুম জড়ানো গলায় বললেন,

“হটপটে গরম চা করে রেখেছি, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”

বিছানার পাশে থাকা ছোটো টেবিলের উপর হটপট রাখা। একটা চায়ের কাপ উবুত করে রাখা। ঘুমন্ত ধ্রুবের মুখশ্রীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মৃদু হাসলাম। এককাপ চা ঢেলে আয়েশ করে বসলাম। চুমুক দিলাম, আদা চা করেছেন।

“মুখ ফুটে বলার পূর্বেই আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবকিছু বুঝে যান, আমার ভালোলাগা, খারাপ লাগা এটা কেন বুঝেন না?”
____
পাপসে পা মুছে ঘরে ঢুকলাম। জামা কাপড় ভর্তি বালতি মেঝেতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমর ঠিক করলাম। চারজনের জামা কাপড় ধুতে ধুতে কোমরের অবস্থা বেসামাল। শুকাতে ছাদে যেতে হবে। বারান্দা দিয়ে কাঠফাঁটা রোদ উঁকি দিচ্ছে। কালকে রাত অবধি মেঘাচ্ছন্ন বিরাজ করলেও এখন পরিচ্ছন্ন আকাশ। দু’হাতে দুই বালতি ধরে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। ধাপে ধাপে সিঁড়ি পাড় করে উপরে উঠলাম।

আজ শুক্রবার। মসজিদে থেকে মুসল্লিরা জামায়াত শেষ করে ফিরছে। মাথায় সাদা টুপি দেওয়া। সেই মুসল্লিদের মাঝে ধ্রুবকেও দেখা গেল। বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকছেন, সাথে দাড়োয়ান চাচা এবং কর্মীরা। ইতোমধ্যে অর্ধেক কাপড় মেলে দেওয়া শেষ। আন্টির শাড়িটা মেলে দিলাম। শাড়ির মাঝ দিয়ে ধ্রুবের দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নেশাগ্ৰস্থ দৃষ্টি আমার পানে নিবদ্ধ। অস্বস্তিতে ছেয়ে গেল। শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে গেলাম। রোদের উত্তাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ওড়না মাথায় দিলাম। রোদ থেকে রেহাই পাওয়ার প্রয়াস করলাম। বালতির বাকি ভেজা কাপড়গুলো দ্রুতহাতে মেলে দিলাম দড়িতে। ক্লিপ দিয়ে আটকে দিয়ে নিচে নামার উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। মাঝপথে ফিরে এসে ফাঁকা বালতি নিয়ে গেলাম।

আমি নিচে নামতেই ধ্রুবকে সোফায় বসে থাকতে দেখলাম। লাল রঙের রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছেন। সময় দুইটা দুই মিনিট। আন্টি রান্নাঘরে কাজ করছেন। রান্না শেষ। আমাকে দেখতে পেলেই আদেশ করলেন।
“একগ্লাস পানি দাও তো।”

“আমি দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম।”

তার ডানহাতে দু’টো জিলাপি। বামহাতে গ্লাস নিয়ে এক ঢোক পান করলেন। পানি ও মিষ্টি একসাথে এগিয়ে দিলেন।

“মিষ্টি খাবো না।”

“তা খাবে কেন? মিষ্টি খেলে মুখটা একটু মিষ্টি মিষ্টি দেখা যেত। তা-না, খাবে আইসক্রিম। কিছু বললেই, রাগে আইসক্রিমের মত খুলে খুলে পড়বে।”

আমি জিলাপি হাতে না নিয়েই বললাম, “তো আপনি খান-না। আপনার মুখ দিয়ে মিষ্টি কথা একটাও শুনতে পাইনি জীবনে। এটা খেলে যদি শুনতে পারি।
তিত করল্লার বংশধর।”

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুমি দাবি করছ, তুমি মিষ্টি। কিন্তু বাচ্চা তার বংশের মত হবে। তিন-চারটা বাচ্চা হলে একসাথে তোমাকে বুঝাব তিত করল্লার বংশধর কাকে বল? কত প্রকার ও কী কী?”

ধ্রুবের কথার ধরনের প্রতুক্তি করলাম, “বাচ্চা আপনার হবে‌। বাহ্! খুব ভালো। অন্তত কাজের কাজ হবে।”

ধ্রুব নিশ্চুপ হয়ে রইল। ততক্ষণে রান্নাঘরের কাজ সামলে আন্টি ভেতরে চলে এসেছেন। বাবুই খেতে বসেছে। আমাদের মাঝের কথোপকথন শুনে আন্টি বললেন, “তোরা সারাক্ষণ ঝগড়া করেই যাবি, খাবি না? আয় খেতে আয়।”

ধ্রুব বিরবির করে বলেন, “যার মনে জিলাপির প্যাঁচ, তার জিলাপি খাওয়া উচিত নয়।”
আমি ভেংচি দিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। খাওয়া শেষ হতেই বাড়িতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুললাম। ধ্রুব হাত ধুতে ধুতে বলেন, “যাবে, বারণ করেছি আমি? বিকেলে আমি বাইরে বের হবো, তৈরি থেকো।”

“না, আমরা একাই যেত পারব।” একরোখা জবাব।

পানি ভর্তি গ্লাসটা ঝংকার দিয়ে রেখে বললেন, “ভালো, গাড়ির তেল বাঁচল। সাবধানে যেও।” বলেই উঠে দাঁড়ালেন। হনহনিয়ে প্রস্থান করল। আমি বিষাদময় শ্বাস নিলাম। এই মানুষটা আমার অভিমান কেন বুঝে না। না চাইতেও আশা করেছিলাম তিনি বললেন, “স্যরি যেও না। প্রয়োজনে আমি তোমার জন্য আইসক্রিমের দোকান দিবো।”
_________

বিছানার চাদর দলা হয়ে গুটিয়ে আছে মেঝেতে। বিছানার মাঝ বরাবর চায়ের ট্রে আর পপকর্ন। তৌফিক নক ছোট করছে দাঁত দিয়ে। গম্ভীর মুখে বসে আছে সবাই। একটু আগে ফোন করে বাড়িতে এনেছি তাদের। উদ্দেশ্য চাকরি খোঁজা। ছোটোখাটো হলেও সমস্যা নেই, হলেই হবে।

আমি তখন বাড়িতে ফেরার জন্য জামা কাপড় গুছাচ্ছি। ধ্রুব শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। আড়চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন।

“ফ্রিজে আইসক্রিম আছে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।”

মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে বললাম, “আমি আইসক্রিম খাই না, আপনি খান।”

ধ্রুব হাঁটুতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন আমার নিকট। হাত টেনে কোলে বসিয়ে দিলেন। হেসে বললেন, “তুমি কবে নিজের যত্ন নিতে শিখবে? একটু ঠান্ডা লাগলে তোমার টনসিল ফুলে যায়। আমি তোমার ভালোর জন্য বলেছি যাতে তুমি ঠান্ডায় আইসক্রিম না খাও।
তারজন্য এমন বিহেভিয়ার করবে?”

“আপনি কথায় কথায় টাকার খোঁটা দেন, বলুন দেননি? কী মনে হয়, আমি কিছু বুঝি না।”

“কী বুঝো তুমি?” গভীর দৃষ্টিতে।

“সব।” মুখ ফিরিয়ে।

“আমার মন বুঝো?”

দমে গেলাম আমি‌। এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিলাম। তেজ নিয়ে বলি, “সব কথায় টাকা টাকা করেন কেন? আমি টাকা উপার্জন করে দেখিয়ে দিবো। হম।”

গালে হাত দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন, “আচ্ছা।”

“আচ্ছা না, হ্যাঁ।”

ছেদ ঘটল তৌফিকের কথায়। “তোর মামার এত টাকা থাকার সত্বেও তুই চাকরি করবি? এটা মেনে নেওয়া যায়, চড়ুই?”

তৌফিকের কথায় তাল মিলিয়ে প্রিয়া বলল, “আমারও সেম প্রশ্ন। টাকা লাগলে মামাকে বল।”

তৌফিক বিদ্রুপ করে বলল, “এই প্রথমবার তোর বোধবুদ্ধি হল।”

তেজ দেখিয়ে বলল প্রিয়া, “তুই একদম আমার সাথে কথা বলবি না। ”

আমি ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চুপ হয়ে গেল সকলে। কিছুটা বিরক্তকর স্বরে বলি, “তোরা বকবক না করে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দে।”

নিরব চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, “চাকরি একটা আছে, তবে..

“তবে?” সন্দিহান গলায়।

“একটা ফুড কমপ্লেক্সে, স্টার্ফের কাজ।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]