#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(১৪)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
#অন্তিম_পর্ব
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাহিরে এসে ফলের দোকান থেকে হরেক রকম ফল কিনে নিয়ে তারা রওনা দিল। রিকশায় বসে নাবিহা প্রশান্ত কণ্ঠে বলল,
“খাবারগুলো আসলেই অনেক টেস্টি ছিল, আলহামদুলিল্লাহ।”
সায়ান হালকা হেসে তাকাল তার দিকে, তারপর বলল,
“আমি সাধারণত বাহিরের খাবার তেমন খাই না। কিন্তু এখানের হালিম আর লুচি এতোটা মজাদার, সত্যি বলতে, স্বাদটা একদম পারফেক্ট হয়!”
নাবিহা মৃদু হাসল।
“তাহলে তো মনে হচ্ছে, আবার আসা যাবে!”
সায়ান কপট ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল।
“খেতে ইচ্ছে হলে বলবে আমাকে, তখন বাসায় নিয়ে যাব ইনশা আল্লাহ।”
রিকশা ধীরে ধীরে শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে চলতে লাগল। সন্ধ্যার বাতাসে হালকা শীতলতা, আর তাদের কথাগুলো মিষ্টি স্মৃতির মতো মনের কোণে জমতে থাকল।
.
প্রায় বিশ মিনিট পর রিক্সা দাঁড় করিয়ে নাবিহাকে নামতে বলে সায়ান। নাবিহা নেমে গেলে ভাড়া মিটিয়ে আবার কোথাও একটা রওনা দেয় সায়ান। সাথে নাবিহার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন ছাড়লেই কোথাও হারিয়ে যাবে সে!
নাবিহা মনে মনে ভীষণ হাসে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
লিফট থামল পাঁচ তলায়। সায়ান নীরবে বেরিয়ে এল, নাবিহা তার পাশে থাকলেও এখনো কিছুই বুঝতে পারছে না। সামনে গিয়ে একটির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাল সায়ান। নাবিহা চুপচাপ চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে, পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।
কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুললেন এক ভদ্রলোক। সায়ান সালাম দিয়ে বলল,
“আমি ডক্টর সায়ান চৌধুরী। গতকাল আপনার সাথে কথা হয়েছিল।”
ভদ্রলোক হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “ওহ, হ্যাঁ! আসুন, আসুন ভেতরে।”
সায়ান হাতের প্যাকেট গুলো ভদ্রলোক কে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। তিনি বললেন,
” এগুলো আনার প্রয়োজন ছিল না কিন্তু।”
সায়ান প্রতি উত্তরে শুধু হাসে।
এরপর দু’জনকে বসতে দিয়ে তিনি ভিতরের এক রুমে চলে গেলেন। নাবিহা একবার সায়ানের দিকে তাকাল, কিন্তু তার মুখে কোনো স্পষ্ট অভিব্যক্তি নেই। কয়েক মিনিট পর ভদ্রলোক ফিরে এলেন। মুখে কিছুটা দ্বিধার ছাপ।
“আমার স্ত্রী এখানে আসতে চাইছে না, ও বলল, উনি যদি গিয়ে দেখা করতেন, তাহলে ভালো হতো।”
সায়ান মাথা নাড়ল।
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। নাবিহা, তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে! যাও, দেখা করে আসো।”
নাবিহা বিস্মিত চোখে তাকাল সায়ানের দিকে। “আমি? কিন্তু কার সাথে?”
সায়ান কোনো উত্তর দিল না, শুধু চোখের ইশারায় ভেতরের দিকে ইঙ্গিত করল। ধীরে ধীরে নাবিহা রুমের ভেতর এগিয়ে গেল। কয়েক কদম পেরোনোর পর আচমকা সামনে এক নারী এসে দাঁড়াল।
তাকে দেখেই নাবিহার হৃদস্পন্দন এক লাফে বেড়ে গেল। যেন ভুত দেখেছে! বিস্ময়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে, তারপর মুহূর্তের মধ্যেই দৌড়ে গিয়ে সেই নারীর হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
“তাসনিয়া আপু! তুমি এখানে? নাবিহার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। আমি ভাবতেও পারিনি উনি আমাকে এখানে তোমার সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসেছে!”
তাসনিয়া কিছু বলেনি, শুধু এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নাবিহার দিকে। তার চোখের গভীরে একসাথে হাজারো অনুভূতি খেলা করছে, বিস্ময়, অভিমান, বেদনা, নাকি অন্য কিছু, তা বোঝা কঠিন।
নাবিহা তাসনিয়ার সেই নীরব দৃষ্টি সহ্য করতে পারছিল না। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। চোখে জল জমে আসছিল, কণ্ঠটা ধরে এল। অবশেষে আবেগ সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠল,
“তুমি আমার ওপর অনেক রেগে আছো, তাই না? আমি না তোমাকে একদম পড়তে পারিনি আপু! আমাকে ছোট বোন মনে করে মাফ করা যায় না?”
তার কণ্ঠে অনুনয়, চোখে অশ্রুর দীপ্তি। সে তাসনিয়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, যেন আর তাকে হারাতে চায় না।
নাবিহার কথা শুনেও তাসনিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের কোণে চাপা অভিমান জমে আছে, ঠোঁট শক্তভাবে বন্ধ। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বলল,
“মাফ! নাবিহা, তুমি জানোও না আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি। তুমি কি ভেবেছো, এত সহজে তোমাকে ক্ষমা করে দেব?”
তার কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট। নাবিহা তাসনিয়ার হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি জানি, আপু! আমি জানি আমার ভুলের জন্য তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি বুঝতে পারিনি তুমি শুধুমাত্র আমার জন্য বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে। আমি তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি গো। এখন যে তোমার ক্ষমাই আমার একমাত্র ভরসা।”
তাসনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিল। অভিমানের সাথে চোখে জল চিকচিক করছে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বলল,
“তুমি কি জানো, নাবিহা? আমি চেয়েছিলাম, একদিন তুমি নিজে এসে বলবে যে তোমার ভুল হয়েছে। আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তুমি আসোনি। আজ যখন তুমি সামনে এসে দাঁড়িয়েছ, আমার রাগ থাকলেও মনে হচ্ছে আর ধরে রাখতে পারছি না।”
নাবিহার চোখ আনন্দে টলমল করে উঠল। সে আবেগে তাসনিয়াকে জড়িয়ে ধরল।
“তাহলে তুমি আমাকে মাফ করে দিলে, তাই না?”
তাসনিয়া হালকা হাসল।
“তোমাকে কি আর অভিমান করে দূরে রাখতে পারি, পাগলি?”
নাবিহার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল। অভিমান, ভুল বোঝাবুঝির সব অন্ধকার যেন মিলিয়ে গেল।
তাসনিয়া মুচকি হেসে বলল, “তুমি কি জানো, নাবিহা? তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে।”
নাবিহা কপাল কুঁচকে তাকাল,
“মানে? কে অপেক্ষা করছে?”
তাসনিয়া কোনো উত্তর দিল না, শুধু ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল নাবিহা কে। খাটের মাঝখানে বসা একটি ছোট্ট শিশু। মাত্র ছয় মাসের, তুলতুলে ছোট্ট হাত-পা, গোলগাল মুখ, নরম তুলোর মতো গায়ের রং। ছোট্ট মায়াবী চোখজোড়া বিস্ময়ে চারপাশ দেখছে।
নাবিহার হৃদয় ভালোবাসায় ভরে উঠল। সে অবাক হয়ে বলল, “আপুর বেবি! ওগো আমার ছোট্ট পরী!”
নাবিহা শিশুটিকে কোলে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিল। ছোট্ট কোমল গালে চুমু খেয়ে বলল,
“এই পুতুলটা আমার সামনে এতদিন আসেনি কেন?”
তাসনিয়া হেসে বলল,
“তোমার সঙ্গে কথা বন্ধ ছিল, তাই!”
নাবিহা আদর করে শিশুটির ছোট্ট আঙুল ধরে বলল, “ও আমাকে খালামণি বলে ডাকবে তাই না?”
তাসনিয়া মৃদু হেসে বলল,
“হুম খালামণি বলবে ইনশা আল্লাহ।”
নাবিহা খুশিতে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। “ইনশাআল্লাহ! আমার পুতুলটা আমাকে ভুলবে না, তাই না?”
শিশুটি মিষ্টি হাসল, যেন নাবিহার কথারই জবাব দিল। নাবিহা তাকিয়ে দেখল, ছোট্ট হাত দিয়ে সে তার আঙুল ধরে রেখেছে।
তাসনিয়া একপাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিল, ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি। সম্পর্কের অভিমান কেটে গেছে, দূরত্ব মুছে গেছে এখন কেবল ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
.
.
নাবিহা উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“রাত বাড়ছে, আপু, আমাদের এবার যেতে হবে।”
তাসনিয়া দ্রুত বলল,
“রাতের খাবার না খেয়ে তোমাদের ছাড়ছি না!”
সফিক আগেই জানিয়েছিল, আজ আমাদের দুজন মেহমান আসবে। তবে কারা আসবে, তা জানতাম না। অতিথি যখন আসবেই, তখন ভাবলাম, ভালো কিছু রান্না করি।
নাবিহা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল,
“তাহলে দুলাভাই জানতেন যে আমাদের দেখা হবে?”
তাসনিয়া হেসে বলল,
“হুম, আমার উনি আর তোমার উনি মিলেই তো সব প্ল্যান করলো!”
নাবিহা মৃদু হেসে বলল,
“ওহ আচ্ছা, এই ব্যাপার!”
তাসনিয়া মজা করে বলল,
“এখন তো বুঝলে? তাই আর অজুহাত দেওয়ার দরকার নেই। চলো, খাবার টেবিলে যাই!”
নাবিহা আর অমত করল না।
গৃহের পরিবেশ যেন আরও উষ্ণ আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। আন্তরিকতা, ভালোবাসা আর বন্ধনের এক মিষ্টি পরশ ছড়িয়ে পড়ল সবার মাঝে।
এরপর নাবিহা আর সায়ান বিদায় নিয়ে চলে আসে তাদের বাসায়।
.
.
রাতের নীরবতায়, ঘুমানোর সময় নাবিহা সায়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চোখে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি নিয়ে বলল,
“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, তাসনিয়া আপুর সাথে দেখা করতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
সায়ান তার স্নেহভরা হাত নাবিহার মাথায় রেখে মৃদু হেসে বলল,
“আমি জানি, তোমার মন খারাপ ছিল, আর উনাকে দেখে তোমার কিছুটা স্বস্তি তো লাগবে। তাই তোমার স্নিগ্ধ হাসি ফিরে পেতে নিয়ে যাওয়া। তুমি হাসলে, আমি শান্তি পাই।”
নাবিহার চোখে এক মিষ্টি অভিমান আর কৃতজ্ঞতা খেলে গেল। তার মৃদু হাসিতে যেন পৃথিবীর সব শান্তি ছিল। সায়ান তার কপালে এক কোমল চুম্বন দিয়ে বলল,
“তুমি হাসলেই আমার দিন ভালো।”
এই মুহূর্তে, ঘরের কোণে আলো-ছায়ার খেলা চলছিল, যেন চারপাশে একটি সুরেলা গান বাজছিল। সায়ান এবং নাবিহার হৃদয়ের ছন্দ একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে এক অবিস্মরণীয় রোমান্টিক মুহূর্ত সৃষ্টি করেছিল। নাবিহা আরও শক্ত করে সায়ানকে জড়িয়ে ধরল, যেন এই মুহূর্তটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ধারণ করতে চায়। ঘরটি যেন তাদের ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল, একান্তে, নিরব, আর চিরকালীন।
🌿 সমাপ্ত 🌿