#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
ইদানীং কামিনী বেগমের মনে একটাই চিন্তা, সায়ানের বিয়ে। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঘর ফাঁকা হয়ে গেছে, আর সেই ফাঁকা ঘর যেন আরও বেশি নিঃসঙ্গ করে তুলেছে তাকে। সারা দিন সময় কাটানোর মতো তেমন কিছুই নেই। তাই মাঝেমধ্যে ভাবেন, যদি সায়ান বিয়ে করত! তখন ঘরে নতুন মানুষ আসত। পুত্রবধূর সঙ্গে গল্প করে, রান্নার কাজে সাহায্য নিয়ে, কিংবা তাকে নানা কিছু শিখিয়ে সময়টা ভালো কাটানো যেত।
একা একা দিনগুলো তাকে যেন আরও বেশি ভাবুক করে তুলছে। এক সময় তিনি সায়ানের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে মনস্থির করেন। মনে মনে ভাবেন, সায়ানের জীবনসঙ্গী তার মতোই হবে—একজন স্নেহশীল, সংসারী এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল মানুষ। যদি এমন নাও হয় তাহলে শিখিয়ে নিবে।
এরপর কামিনী বেগম সায়ানের জন্য পাত্রী খুঁজতে শুরু করেন। পরিবারের ঘনিষ্ঠদের জানিয়ে দেন, সায়ানের জন্য ভালো, ধর্মপরায়ণ এবং শিক্ষিত একটি মেয়ে খুঁজছেন। এদিকে সায়ান মায়ের এই উদ্যোগের কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে নিজে বিয়ের বিষয়ে তেমন কিছু ভাবেনি, কারণ পেশাগত জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে অন্য কিছুতে মন দেওয়ার সময়ই পায়নি।
কামিনী বেগম একদিন সায়ানের সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলেন। তিনি বলেন,
“এখন বড় হয়েছিস, আল্লাহর রহমতে রোজগার ভালো। আমি তো আর চিরদিন তোদের সঙ্গে থাকতে পারব না। যদি একটা ভালো মেয়ে ঘরে আনি, তাহলে আমি নিশ্চিত হয়ে যেতে পারি যে আমার পরে তোর দেখভাল কেউ করবে। তাছাড়া, বাড়ি এতটা ফাঁকা লাগে যে মন ভালো থাকে না। তুই যদি বিয়ে করিস, তোর বউয়ের সঙ্গে গল্প করে আর সময় কাটিয়ে আমার দিনগুলো সুন্দর হয়ে যাবে।”
সায়ান মায়ের মনের কথা বুঝতে পারে। যদিও সে এখনও প্রস্তুত নয়, কিন্তু মায়ের একাকীত্ব দেখে সে ভাবতে শুরু করে। তারপর বলে দেখ ভালো মেয়ে পাও কিনা।
সায়ানের মতামত শুনেই কামিনী বেগম একটি পাত্রী দেখতে যাওয়ার কথা বলেন। সায়ান প্রথমে যেতে না চাইলেও, মায়ের কথা রাখতে পাত্রী দেখতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়। কামিনী বেগম বেশ উত্তেজিত হয়ে পাত্রীপক্ষের বাড়ির ঠিকানা ঠিক করেন এবং সায়ানকে ভালোভাবে তৈরি হতে বলেন। সায়ান যদিও বিষয়টিতে খুব আগ্রহী নয়, তবুও মায়ের খুশির জন্য সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
পাত্রীপক্ষের বাড়িতে পৌঁছানোর পর, তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পায়। মেয়ের নাম তাসনিয়া—একজন মার্জিত, নম্র এবং শিক্ষিত মেয়ে। সায়ানের সঙ্গে তাসনিয়ার প্রথম সাক্ষাত হয়। তারা দুজন আলাদা ঘরে বসে কথা বলে।
সায়ান কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, তাসনিয়ার ব্যক্তিত্ব তার নজর কাড়ে। তাসনিয়া শান্ত স্বভাবের এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী, যা সায়ানের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। তারা পড়াশোনা, এবং জীবনবোধ নিয়ে কথা বলে। এই কথোপকথনের মধ্যে সায়ান প্রথমবারের মতো অনুভব করে, হয়তো বিয়ে করার বিষয়টি এত খারাপ কিছু হবে না।
অন্যদিকে, কামিনী বেগম তাসনিয়ার মা-বাবার সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। তিনি তাসনিয়া কে দেখে ভীষণ খুশি এবং মনে মনে সায়ানের জন্য তাসনিয়া কে পারফেক্ট মনে করেন।
বাড়ি ফিরে আসার পথে কামিনী বেগম সায়ানের মুখ থেকে জানতে চান, “মেয়েটি কেমন লাগল তোর?”
সায়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুচকি হেসে বলেন,
“মন্দ নয়।”
.
.
সন্ধ্যা নামতেই নাবিহা উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে তাসনিয়াকে কল দিল। সে জানতে চায়, পাত্রপক্ষ তাসনিয়াকে দেখে গিয়ে কিছু জানিয়েছে কিনা। কিন্তু তাসনিয়া কোনোভাবে কল রিসিভ করল না। নাবিহা ভেবে নিল, হয়তো তাসনিয়া ব্যস্ত আছে। পরবর্তীতে কলটা দেখলে নিশ্চয়ই ব্যাক করবে।
পরের দিন সকালে তাসনিয়া নিজেই নাবিহাকে কল ব্যাক করে। তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত আনন্দের ঝলক।
— “নাবিহা, পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করেছে!”
নাবিহা উচ্ছ্বাসে যেন লাফিয়ে উঠল,
— “সত্যি? আলহামদুলিল্লাহ! আমি জানতাম তারা তোমাকে পছন্দ করবেই। তোমার মতো মেয়েকে পছন্দ না করার প্রশ্নই ওঠে না।”
তাসনিয়া হেসে বলল,
— “হ্যাঁ, তারা জানিয়েছে যে তাদের ছেলেরও কোনো আপত্তি নেই। এমনকি তারা নাকি শিগগিরই সব ঠিকঠাক করার জন্য আমাদের বাসায় আসবে।”
নাবিহা খুশিতে ভরে উঠল। সে তাসনিয়াকে শুভকামনা জানিয়ে বলল,
— “তাহলে শুরু হয়ে গেল তোমার জীবনের নতুন অধ্যায়! আল্লাহ যেন তোমার জন্য সবকিছু সহজ করে দেন। আর আমার জন্য দোয়া করবে আপু।”
তাসনিয়া হাসতে হাসতে বলল,
— “অবশ্যই করব। যেন তোমার জীবনেও এমন সুন্দর সময় আসে খুব তাড়াতাড়ি।”
এই বলে দুজনে হাসলো, আর তাদের হৃদয় ভরে গেল আনন্দে।
.
.
এরপর কেটে যায় কয়েক দিন। সায়ান সময় বের করতে পারছে না বরে বিয়ের কথাবার্তা এখনো স্থগিত আছে।
তবে কামিনী বেগম মাঝে মাঝেই তাসনিয়ার মায়ের সাথে কথা বলেন যেন তারা ভুল না বুঝেন সায়ানকে।
এদিকে নাবিহার বাসায় তার সকল বান্ধবীদের নিয়ে একটা পিকনিক এর আয়োজন করে সেখানে তাসনিয়া কে ও আসতে বলে নাবিহা। তাসনিয়া প্রথমে আসতে চাইছিল না তার মা বলেছে এই সময়ে কোথাও প্রয়োজন ছাড়া না বেরোতে। কে কখন কি বলে বিয়ে ভেঙে দিবে তার কোন ইয়ত্তা নেই সে জন্য বাসা থেকে না বেরোনোই ভালো। কিন্তু নাবিহার অনুরোধ ফেলতে পারে না তাসনিয়া তাই তাদের সাথে যোগ দিল সে।
নাবিহা আর তার বান্ধবীরা মিলে মিশে রান্নাবান্না করছে। তাসনিয়া সাহায্য করতে চাইলে তাকে বসিয়ে রাখে নাবিহা। বলে,
” কয়দিন পর তোমার বিয়ে হবে ইনশা আল্লাহ। এখন কাজটাজ করে হাত নষ্ট করার কোন দরকার নেই। তুমি বসে বসে আমাদের কে বলে দাও কিভাবে কি করতে হবে।”
তাসনিয়া হেসে বলল,
” শশুর বাড়িতে গিয়ে তো আমাকে সেই রান্নাবান্না ই করতে হবে। এখন যদি করি তাহলে কিছুটা প্রাকটিস হবে বুঝছো? মুরগিটা আমি কা**টি তুমি উঠো তো।”
তারপর নাবিহা কে উঠিয়ে দিয়ে তাসনিয়া মুরগি কা**টতে বসে পরে। নাবিহা আর না পেরে অন্য কাজে হাত দেয়।
আলু কাটতে কাটতে বলে,
“আচ্ছা আপু বাড়ির বউ কেই কেন সব কাজ করতে হবে?”
“কেন করবে না?”
” করবে না তা নয়, কিন্তু আমাদের সমাজ এটা একটা নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে যেমন ধরো, বাড়ির বউ অসুস্থ থাকুক কিংবা কোন একদিন তার কাজ করতে ইচ্ছে করছে না তবুও তাকে করতেই হবে বাধ্যতামূলক। কেন মাঝে মাঝে কি বউটাকে বিশ্রাম নিতে দেওয়া যায় না? বউটাকে কি একটু কাজে সাহায্য করা যায় না বলো?”
তাসনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে ,তাই আমরা চাইলেও এখন পরিবর্তন করতে পারবো না। তবে কিছু কিছু পরিবার আছে যারা বউদের সাহায্য করে।সবাই তো আর এক নয় বলো?”
” আছে কিন্তু বেশিরভাগ ই ঐরকম মেন্টালিটির। আচ্ছা সেসব কথা বাদ দাও। এখন আমার হবু দুলাভাই এর কথা বলো দেখি। উনাকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”
তাসনিয়া লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
” উনি একজন ডাক্তার জানিস? এমনিতে খুব ভদ্র মনে হয়েছে। কিন্তু মানুষের ভিতরে কি আছে সেটা তো আর বাহিরে দেখা যায় না। তবে সবকিছু মিলিয়ে পছন্দ হয়েছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ। তবে ডাক্তার শুনে ভীষণ ভালো লাগছে। ডাক্তাররা বুঝি সবসময় ভদ্র ই হয়?”
” কি জানি। আমার মনে হয় ভালো মন্দ সবখানেই বিরাজমান।”
নাবিহা আলু গুলো কা**টা শেষ হলে তার একটা বান্ধবীকে ধুতে দিয়ে সবজি নিল কাঁটার জন্য। তারপর বলল,
” তা ঠিক বলেছো। আচ্ছা ভাইয়া কিসের ডাক্তার?”
তাসনিয়া মুরগি কা**টা বন্ধ করে বলল,
” ইশশ তা তো জানা হয়নি রে…”
নাবিহা হাসতে হাসতে বলল,
” লোকটার নামটা জানো তো? নাকি এখন বলবা নাম ও জানো না।”
তাসনিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
” সত্যি ই জানি না রে। আসোলে উনার সম্পর্কে আব্বু আম্মু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগে সে জন্য করি না।”
নাবিহা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
” তাও ঠিক। আমিও তোমার জায়গায় থাকলে পারতাম না। কিন্তু আগে হলে ঠিক নিজেই জিজ্ঞাসা করে বসতাম। আচ্ছা তুমি জানার চেষ্টা করো।….
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।