মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব-০১

0
14

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১

আমার প্রাক্তন পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। তার সাথে আমার বিবাহ বিচ্ছেদ বলব নাকি প্রেমের বিচ্ছেদ বলব বুঝতে পারছি না। তার সাথে আমার বিচ্ছেদ হয় আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে হওয়ার দিনে। চারদিকে বিয়ের আমেজ। আমি চোখ ভরা স্বপ্নের পূর্ণতা নিয়ে ঘরে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কখন সে বর যাত্রী নিয়ে আমাদের বাড়ি আসবে। আমাকে টগবগিয়ে ঘোড়ায় করে রাজপুত্রের মতো নিয়ে যাবে। এ খানিকটা সময়ও যেন খুব ধীর গতিতে চলছে। মনে হচ্ছে সহস্র বছরের পথ যেন একটুর জন্য শেষ হচ্ছে না। অপেক্ষা সত্যিই কঠিন।

১০ বছরের ভালোবাসার পূর্ণতা আজকে পাবে। আমায় বয়স ২৮ বছর আর আমার প্রাক্তনের বয়স ৩১। আমাদের তিন বছরের ব্যবধান। সমাজে ২২,২৩ বছর পার হলেই একটা মেয়ের একা টিকে থাকা কতটা কষ্টকর সেটা কেবল আমি জানি। অথচ সে কষ্টের বলিদান নিজেকে দিয়েও আমি খুশি ছিলাম। আমি পড়াশোনায় তেমন ভালো না। কিন্তু আমার প্রাক্তন ছিল তুখোর মেধাবী। আমি ছিলাম প্রচন্ড চঞ্চল। মূলত আমার চঞ্চলতা দেখেই সে আমার প্রেমে পড়েছিল। সে প্রেম তারুন্য পার হয়ে ম্যাচুরিটিতে এসে পৌঁছেছে। তার প্রতিটা পরীক্ষার সময় আমি দোয়া করতে থাকতাম। তার বিসিএসের জন্য আমি আল্লাহর কাছে চাইতে থাকতাম। শূন্য থেকে গড়ে উঠা মানুষটা আমাকে নিয়েই ছিল। বিসিএস হলো,ডিগ্রি হলো। এরপর আমার বাসায় সে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠাল। বিয়েও ঠিক হলো। দুজন মিলে বিয়ের সকল কিছু কিনলাম। বিয়েতে কী পরব, কীভাবে সাজব, সবকিছুই পরিকল্পনা করে অর্ধেক বাস্তবায়নও করে ফেলেছিলাম।

কিন্তু বিয়ের দিন বরপক্ষ থেকে জানানো হলো তারা কেউ আসবে না। এ বিয়ে হবে না। বিয়ে ভাঙনের মূল কারণ আমার বয়স। আমি কিছুটা অবাক হলাম কথাটা শুনে। একদমই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল একটা চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এটা হয়তো সারপ্রাইজ। কিন্তু বিয়ে বাড়ির সমাগম যখন কমতে লাগল তখন বুঝলাম ঘটনা আসলেই সত্যি। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেঘকে কল দিলাম। মেঘ আমার প্রাক্তন। মেঘকে তিন থেকে চারবার কল দেওয়ার পর সে কল তুলল। আমি তাকে কান্না গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“আমি যা শুনছি সেটা কি ঠিক? তোমরা নাকি বিয়ে ভেঙে দিয়েছো? আর মূল কারণ নাকি আমার বয়স। আমি বিশ্বাসেই করতে পারছি না।”

মেঘ কিছুটা শক্ত গলায় বলল

“তুমি যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। আমি তোমার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পাই না। তোমার চোখে চোখ রাখলে আমি কেবল চোখের বলিরেখা দেখি। রোমান্টিকতা খুঁজে পাই না। বৃষ্টি আমার মনে হয়েছে তোমার সাথে বিয়ে হলেও আমাদের এ বিয়ে বেশিদিন টিকবে না। আমি হয়তো ভালোবাসার মর্যাদা দিতে গিয়ে তোমাকে করুণা করে বিয়ে করব। কিন্তু বিয়ের পরবর্তী জীবনটা অনেক বেশি কষ্টে যাবে। আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারব না। যা হয়েছে ভুলে যাও।”

আমি মেঘের কথা শুনে কান্না করে দিলাম। কান্নার মাত্রা বাড়তে লাগল। কান্নার প্রখরতার জন্য আমি কথাও বলতে পারছিলাম না। হেঁচকি তুলে বলতে লাগলাম

“আমাদের নতুন করে আবার বিয়ে কেন হবে? এটা তো শুধু আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের পরিবার জানে না তাই তাদের জানিয়ে বিয়ে করা। আমরা তো বিয়ে আগেই করেছি। দুবছর আগে করা বিয়ের কথা কী ভুলে গেছো? ১৫ দিন আগেও আমরা একসাথে হয়েছিলাম। সব কী তুমি ভুলে গেছো। আমাকে তো এটা ঠকানো হচ্ছে।”

মেঘ আমার কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত। আমার কান্না তার অন্তরে পৌঁছালো না। বিরক্তির রেশ টেনে আমাকে উত্তর দিল

“এটা খুব স্বাভাবিক। আর একা বিয়ে করলে বিয়ে হয় না। যা হয়েছে ভুলে যাও। তোমার সাথে আমার আজ থেকে কিছুই নেই। ভালো থাকবে। আমি তোমার জীবনে আসলে তোমার জীবন এবং আমার জীবন নরক হয়ে যেত।”

মেঘের কথা শুনে আমি কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। দুই ঘন্টা আগের মেঘের সাথে এখনের মেঘকে কেন জানি আমি মিলাতে পারছি না। দুই ঘন্টা আগেও বিয়ে নিয়ে কত আনন্দে ছিল সে। এর মধ্যে কী এমন হলো যে, সে আমাকে ছেড়ে দিল। বিয়ে ভেঙে দিল। কুকুর পাললেও তো মায়া হয়। কী এমন এ দুই ঘন্টায় হলো যে আমার প্রতি তার মায়ায় কাজ করছে না। ১০ বছরের ভালোবাসা, দুই বছরের সংসার কীভাবে অস্বীকার করতে পারছে। কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না আমার। মেঘের সাথে কথা আর বাড়াতে পারলাম না। কলটা কেটে গেল। আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। এরপর জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না দেখে পাড়া প্রতিবেশী সবাই স্বান্ত্বণা না দিয়ে উল্টো মুখে যা আসছে বলছে। সবাই বলছে বুড়ি মেয়ে আবার ডাক্তার পোলা আশা করে। বৃষ্টির মায়ের বুঝা উচিত ছিল মেয়ে ঘরে বাঁধিয়ে না রেখে আগেই বিয়ে দেওয়া। সবার কথা শুনে মা ও রুমে এসে বলল

“আগেই বলেছিলাম এ ছেলে তোকে বিয়ে করবে না। আমার কথা তো শুনলি না। এখন কর বিয়ে এ ছেলেকে। ছেলেই তোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে গেল। কত ভালো ভালো বিয়ে এতদিন ভেঙে দিয়েছিস। এখন তো এ ঘটনার পর কেউ বিয়েও করতে আসবে না। তার উপর বয়স বেশি।”

আমার কান্না আর থামছে না৷ আমি অনর্গল কেঁদে যাচ্ছি। এত কাঁদছি তবুও যেন আমার বুক হালকা হচ্ছে না। মেঘকে আবারও কল দিলাম। নম্বর ব্লক লিস্টে। কাঁদতেই কাঁদতেই আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। মাথা ব্যথায় টনটন করছে। আমেজমাখা বিয়ে বাড়িটা একদম হাহাকারে রূপ নিল। বিয়ের রান্না সব বিলি করা হচ্ছে। এত খাবার কে খাবে? আর বাড়ির সবার পরিস্থিতি এমন যে খাবার সংরক্ষণ করার মন নেই। আমি বসা থেকে উঠে কাপড় পাল্টে নিলাম। তারপর বিছানায় এসে একটু শুয়ে রইলাম। শরীরটা একদম দুর্বল সকাল থেকে খাইনি। মাথাটা ঘুরে কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেলাম জানি না।

জ্ঞান ফিরে লক্ষ্য করলাম আমার পাশে আমার ছোটো বোন বসা। সে আমাকে জ্ঞান ফিরতেই বলে উঠল

” কিছু খাবা আপু?”

এরপর বাইরে গিয়ে সবাইকে বলতে লাগল আমার জ্ঞান ফিরেছে। দুপুর ১২ টা বাজে তখন। মা, বাবা ঘরে প্রবেশ করার আগেই একজন পুলিশ প্রবেশ করল। সে ইনভেস্টিগেশনে এসেছে। তবে কিসের ইনভেস্টিগেশন প্রথমে বুঝতে পারি নি। কিন্তু পরে যা জানতে পারলাম। সেটা বিশ্বাস করতেই আমার কষ্ট হচ্ছে। মেঘ গতকাল রাতে আত্ম/হত্যা করেছে। আজকে সকালে তার গলায় দঁড়ি দেওয়া লাশটা পুলিশ উদ্ধার করেছে। এটা শুনার পর আমার বুক ধুকধুক করতে লাগল। মনের গহীনে একটা প্রশ্নই মেঘ কেন আত্মহত্যা করল?

চলবে।