মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব-১১+১২

0
16

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব- ১১
#শারমিন আঁচল নিপা

সে লক্ষ্য করল মেঘের রুমের বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির শরীরের ছায়াটা মেঘের রুমের জানালা দিয়ে এসে দেয়ালে পড়েছে। ভালো করে ছায়াটি লক্ষ্য করলে বুঝা যায় এটা একটি ছেলের ছায়া। ছেলেটির মাথার চুল কুঁকরানো হবে আর হালকা বড়ো৷ সামির সাহেব জানালার দিকে তাকাতেই লোকটি দ্রূত সরে দাঁড়ায়। সামির সাহেব রুম থেকে চায়লেও এখন বের হতে পারছে না। কারণ আকরাম সাহেব বাইরে সুরাইয়ার সাথে কথা বলছে। আর এদিকে সে জানালার কাছে গিয়ে জানালা খুলেও লোকটিকে ভালো করে দেখতে পারল না। বাইরে অন্ধকার ছেয়ে আছে তাই। সামির সাহেবের বুঝতে বাকি নেই এটা একটা খু/ন ছিল। আর এ খু/ন টা এমন কেউ করেছে যাদের তারা সন্দেহের চোখেই দেখছে না। বরং তারাই হিরো সেজে আছে৷ নিজেকেই ভিকটিম সাজিয়ে রেখেছে।

এদিকে সুরাইয়া আকরাম সাহেবের কথার জবাব কী দিবে বুঝতে পারছে না৷ অনেক ভেবে আমতা আমতা করে বলল

“উনি উনার রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গিয়েছেন৷ মনে হচ্ছিল অনেক ক্লান্ত। সেজন্য খেয়েই রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিবে বলছিলেন৷ তাই আপনার কথামতো গেস্টরুমটা পরিচ্ছন্ন করে উনাকে শুয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

আকরাম সাহেব সুরাইয়ার দিকে তাকাল। কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন

“তুই এরকম কপাল কুঁচকে আছিস কেন? মেহমান আসলেই তোর কপাল কুঁচকানো শুরু হয়ে যায় তাই না? কাজ দেখলেই রাগ উঠে যায় তাই না? স্বাভাবিক হয়ে কাজ কর৷ নাহয় এ বাসায় কাজ করার আর সুযোগ পাবি না৷ মেঘ ছিল বলে তোদের এসব কর্মকান্ড এতদিন সহ্য করেছি। এখন আর করব না৷ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব যদি উল্টা পাল্টা কিছু দেখি। ”

কথাগুলো কিছুটা রাগান্বিত সুরে বলে আকরাম সাহেব তার রুমে চলে গেলেন। আকরাম সাহেব রুমে যেতেই সুরাইয়া দ্রূত মেঘের রুমের দরজার কাছে গিয়ে সামির সাহেবকে ডেকে বললেন

“আপনি বের হয়ে যান স্যার। বড়ো স্যার সন্দেহ করতেছে৷ এখন বের না হলে পরে ধরা পড়ে যাব। আমার চাকুরিটা চলে যাবে। এ চাকুরি গেলে আমার সন্তান না খেয়ে মরবে। আমার রিজিকের জায়গা এটা।”

সুরাইয়ার কথা শুনে সামির সাহেব আর দেরি করল না। দ্রূত সেখান থেকে বের হয়ে সুরাইয়াকে চাবি দিয়ে নিজের রুমে গেলেন। সামির সাহেব একটা বিষয়েই ভাবছে ভীষণ করে৷ মেঘ কী নেশা করত নাকি করত না? এ ভেবেই সে বৃষ্টিকে মেসেজ করে জিজ্ঞেস করল মেঘের নেশা করার অভ্যাস আছে কি’না। বৃষ্টি উত্তরে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয় মেঘ সিগারেটের গন্ধ পর্যন্ত নিতে পারে না৷ তাহলে বুঝায় যাচ্ছে মেঘের ঘরে যে নেশা দ্রব্যগুলো পাওয়া গেছে সেটা মেঘের না। সে নেশার সবকিছু একটা টিস্যুতে মুড়িয়ে রেখে দিল৷ পরবর্তীতে এটা পরীক্ষা করে দেখবে এতে মেঘের হাতের ছাপ আছে কি’না।

বিছানায় শুয়ে সামির সাহেব মেঘের প্রথম এবং দ্বিতীয় ময়না তদন্তের রিপোর্টের ডকুমেন্টস টা খুলল৷ প্রথম ডকুমেন্টস এ দেখা যায় মেঘের শরীরে এইচ আইভি পজিটিভ পাওয়া গেছে। যদিও পরবর্তীতে সেটা বলা হয় অন্য কারও সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়৷ কিন্তু এখন সামির সাহেবের খোঁজ নিতে হবে সত্যিই ময়না তদন্তের রিপোর্ট পরিবর্তন হয়েছিল নাকি কোনো কিছু ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এরকম করে রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়েছিল৷ পরবর্তীতে দেখা গেল এটাতে বিপত্তি বাড়তে পারে তাই রিপোর্ট অন্য কারও সাথে পরিবর্তনের নাম করে নতুন রিপোর্ট করা হয়৷

এরপর সে দ্বিতীয় রিপোর্টটা ভালো করে যাচাই করে। খেয়াল করে সেখানে লেখা আছে মেঘের শ্বাসরোধে খুন হয়েছে৷ আর তার শরীরে ঘুমের ঔষধের আলামত পাওয়া গেছে৷ অর্থাৎ প্রথমে তাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয় তারপর শ্বাসরোধ করে খু/ন করা হয়। আর তাকে শ্বাসরোধ করা হয়েছে সেই দঁড়ি দিয়ে যে দঁড়িতে মেঘ ঝুলে ছিল। মেঘের ওজন ছিল ৯৪.৬৪ কেজি। সুতরাং কেউ যদি মেঘকে খু/ন করে দঁড়িতে ঝুলাতেও যায় তাহলে তাকে অন্তত ১০০ কেজি ওজনের বস্তু উপরে তুলার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ মৃত্যুর পর একটা শরীর সকল ভার ছেড়ে দেয়। তাহলে একটা সাধারণ মানুষের পক্ষে একা ১০০ কেজি তুলা সম্ভব না। মেঘের খুনের দিন দঁড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশটার ছবি ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় যে বিছানা থেকে তার বডির দূরত্ব বেশ উঁচুতে৷ এত উঁচু পর্যন্ত একা একটা মানুষের পক্ষে এ লাশ ঝুলানো সম্ভব না। অর্থাৎ এ খু/নে একজন না কয়েকজনের হাত আছে।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে মেঘকে যে খু/ন করেছে সে এ বাসাতেই ছিল৷ তাকে প্রথম ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়৷ এরপর সে যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন তাকে শ্বাস রোধ করে খুন করা হয় প্রথম৷ এরপর একা লাশ উপরে তুলতে ব্যর্থ হওয়াতে আরও কয়েকজনকে এ রুমে আনা হয়। তারপর লাশ দঁড়িতে ঝুলানো হয়৷ অর্থাৎ বুঝায় যায় মেঘকে যারা খু/ন করেছে তারা এ পরিবারের খুব কাছের মানুষজন৷ তাদের এ বাসায় যাতায়াতের অবাধ বিচরণ ছিল। আর তাদের যাতায়াতে কেউ সন্দেহও করবে না৷ কিন্তু মেঘকে খু/ন করা এবং তাকে দঁড়ি পর্যন্ত ঝুলানো বেশ সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার ছিল৷ তাহলে এত সময়ে পরিবারের কেউ কী বিষয়টি টের পায়নি? তাহলে কী পরিবারের কেউ খু/ন করেছে? হতে পারে মেঘের বাবা, অথবা মা। কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। পরিবারের কেউ এমন কেন করবে? মেঘ একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তানকে খু/ন করলে পরিবারের কারও কোনো লাভ থাকার কথা না৷

অনেক প্রশ্নই তার মাথায় ঘুরছে। নেশার দ্রব্য গুলো সেখানে কে রাখল? আর এ পরিবারের এমন কে আছে যার এ বাসায় অবাধ বিচরণ আছে। খু/নী একজন না বরং খু/নী কয়েকজন৷ তবে কারা? খু/নের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? মেঘকে খু/ন করলে কার সবচেয়ে বেশি লাভ সেটা খুঁজে বের করাও এখন একটা চ্যালেন্জ হয়ে গেছে৷ সে সাথে এটাও বের করতে হবে অহনা কে? মেঘের সাথে অহনার সম্পর্ক কী। এবং এটাও পর্যালোচনা করতে হবে আদৌ ময়না তদন্তের রিপোর্টে যা লেখা হয়েছে সেটা সঠিক কি’না।

আবারও একটা প্রশ্ন ঝেঁকে ধরে। মেঘের বাবা প্রভাবশালী৷ এরকম একটা প্রভাবশালী মানুষের ছেলের ময়না তদন্ত যা ইচ্ছা তাই লিখে দেওয়াটা বেশ সাহসের ব্যাপার। প্রথমবার ময়না তদন্ত রিপোর্টটা ভুল প্রমাণের পর দ্বিতীয়বার কী সঠিক এসেছে কি’না এটা যাচাই করা প্রয়োজন ছিল৷ মেঘের বাবা বৃষ্টিকে মেরে ফেলার ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারল নিজের ছেলের এমন অদ্ভুত ময়না তদন্তের রিপোর্ট যারা করেছে তাদের ব্যাপারে স্টেপ নিল না৷ আঙ্গুলটা বারবার মেঘের বাবার দিকেই উঠছে।
সামির সাহেবের বেশ পাগল পাগল লাগছে৷ এখানের একটা প্রশ্নের উত্তর মিললে আরও দশটা প্রশ্নের উদ্ভব হয়।

নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিল৷ সে খাটে হালকা হেলান দিতেই চোখ বুজে এলো৷ একটা ছোটো হাতের ছোয়া তার গাল স্পর্শ করছে৷ একটা সুরেলা হাসির শব্দ তার কানে ধেয়ে আসছে। বাচ্চা মেয়েটি জোরে চিৎকার দিয়ে বলছে

“বাবা বলটা দাও না। কী হলো বাবা দাও বলটা ”

সামির সাহেব চমকে ঘুম থেকে উঠল৷ এ দুঃস্বপ্ন টা তাকে ভীষণ তাড়া করে। এ অতীত থেকে সে বাঁচতে চায় তবুও পারছে না। সে নিজেকে সামলে ঘুমের একটা কড়া ঔষধ খেয়ে নিল। যাতে করে কড়া একটা ঘুম হয়। যদিও ইদানীং ঘুমের ঔষধও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

সকাল ঠিক ১১ টায় তার ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠেই সে ড্রইং রুমে আসল। সে সময় আকরাম সাহেব বসে চা খাচ্ছিলেন আর টিভি দেখছিলেন। পূত্র হারানোর কোনো শোক তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রাজনীতির খবর দেখছেন তিনি৷ পাশে একটা পেপার রাখা। সেখানেও রাজনীতির পৃষ্ঠা টা খুলে রাখা। চা খেতে খেতে আকরাম সাহেবের চোখ পড়ল সামির সাহেবের দিকে। সে সামির সাহেবকে দেখে হালকা গলায় বললেন

“এসো সামির এখানে বসো। সুরাইয়াকে চা দিতে বলছি। এক কাপ চা খাও।”

সামির সাহেবও আকরাম সাহেবের কথা মতো গিয়ে পাশে বসলেম। সুরাইয়া ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছে। এ মেয়েটা কাজে বেশ পটু৷ এ বাসায় কখন কী লাগবে বলার আগেই সে বুঝে যায়। সুরাইয়া সামির সাহেবকে চা দেওয়ার সময় ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকাল। মনে হচ্ছিল সে সামির সাহেবকে কিছু একটা ইশারা করে বুঝাতে চেয়েছে। কিন্তু কী সেটা এখন সে বুঝছে না। সুরাইয়াকে এখানে চা দেওয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকরাম সাহেব বেশ রুষ্ঠ গলায় তাকে এখান থেকে যেতে বলল। সুরাইয়া আর দেরি না করেই দ্রূত প্রস্থান নিল। সামির সাহেবও আর মনকে অন্যদিকে নিলেন না। চায়ে একটা চুমুক দিলেন৷ চা টা বেশ তেতো লাগছিল তার কাছে। চায়ে চুমুক দিয়ে হাতে একটা বিস্কুট নিতেই আকরাম সাহেব বলে উঠলেন

“গতকাল মেঘের রুমে গিয়ে কী উদঘাটন করলে? আমাকে খুব বোকা ভাবো? আমি জানি তুমি এখানে কেন এসেছো? এত বছর রাজনীতি করেছি৷ দলের এত এত ষড়যন্ত্র কৌশলে বের করেছি। আর সাধারণ তোমার মটিভ আমি ধরতে পারব না? ”

সামির সাহেবের বুক ধুক করে উঠল। সে সাথে অবাক দৃষ্টিতে আকরাম সাহেবের দিকে তাকাতেই এমন কিছু কথা তিনি বললেন যেটা সামির সাহেবের পেছনে ফেলে আসা কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। সে সাথে নতুন একটা বাঁক নিল কাহিনির।

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব-১২
#শারমিন আঁচল নিপা

আকরাম সাহেব বলে উঠলেন

“স্ত্রী সন্তানের খোঁজ জানতে আমার বাড়িতে এসেছো তাই তো? তোমার স্ত্রী রিদি আর সন্তান আমীরার খোঁজ পাচ্ছ না তিন বছর যাবত। কোথায় হারিয়ে গেছে তারা, সত্যিই তারা বেঁচে আছে কি’না সে জন্য এখানে মেঘের বন্ধু সেজে এসেছো তাই তো? তোমাকে প্রথম দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। গোয়েন্দা বিভাগের সামির। অবশ্য স্ত্রী, সন্তান, চাকুরি হারিয়ে এখন নিঃশ্ব প্রায়। তিন বছরে যেহেতু তাদের খোঁজ পাওনি তার মানে তারা আর বেঁচে নেই। আর এ ঘটনায় আমি জড়িত ছিলাম না কখনও। আমি রাজনীতিবিদ তবে অমানুষ না। আমি খু/নীও না। রাজনীতিতে টিকে থাকতে অনেক খারাপ কাজে না চায়তেও জড়িয়ে যেতে হয়। আর তেমনি একটা খারাপ কাজের মধ্যে ছিল তোমার স্ত্রী, সন্তান নিখোঁজের ব্যাপারটা। আর সেটাতে না চায়তেও আমি জড়িয়ে গিয়েছিলাম। দলের সম্মান রক্ষার্থে আমি কিছুই প্রকাশ করিনি তবে সে জায়গা থেকে পদত্যাগ করে চলে আসি। নিজে দল গঠন করি। দল গঠন করার পরও আমি ক্ষমতায় যেতে পারিনি আমার সততার জন্য। সরল মানসিকতার জন্য।

জুলফিকার সাহেবের সহচর ওয়াসিম যে রেইপটা করেছিল সেটার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তোমার স্ত্রী ছিল৷ আর সেজন্যই তোমার স্ত্রীকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। সাথে বাচ্চা থাকায় সেও কিডন্যাপ হয়৷ তোমার বাড়িতে যে চিঠি রেখে গিয়েছিল সেটা তোমার স্ত্রীর লেখা ছিল। তোমার স্ত্রীকে জোর করিয়ে এ চিঠিটা লেখানো হয়। যাতে করে তুমি মানতে পারো তোমার স্ত্রী, সন্তান সহ তার পরকিয়ার প্রেমিকের সাথে বিদেশ চলে গিয়েছে। শুধু চিঠি লেখাতে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে এবং তুমি তোমার স্ত্রীর খোঁজ করতে পারো। এটা নিয়ে তারা আশঙ্কায় ছিল। কারণ তুমি গোয়োন্দা তুমি সামান্য এ চিঠিকে কেন্দ্রকে সবটা বিশ্বাস করবে না। তাই তোমার মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তোমার স্ত্রীকে দিয়ে তোমাকে কল দেওয়ানো হয়৷ আর এসব মিথ্যা জোর করে বলানো হয়৷ এরপর থেকে তুমি এটাই জানো তোমার স্ত্রী আর সন্তান তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে তুমি নাছোরবান্দা তোমার সন্তানের মুখ দেখার জন্য তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলে। এসব তোমার চাকুরিতে বেশ প্রভাব ফেলছিল। আর তখন তোমাকে চাকুরিচ্যুত ও করানো হয়।

শুনো তোমাকে কল দেওয়ার পরই তোমার স্ত্রী রিদি আর আমীরাকে মেরে ফেলা হয়। তাদের লাশটাও কুমির দিয়ে খাওয়ানো হয়। এখন জুলফিকার সাহেব ক্ষমতায়। তুমি যতই ওদের বিরুদ্ধে স্টেপ নাও প্রমাণ করতে চাও, পারবে না। আমার কথা তো আর গ্রাহ্য হবে না। কারণ আমি বিরোধী দল। একদম ট্যাগ বসিয়ে দিবে আমি দলের দূর্নাম করতে তোমার সাথে হাত মিলিয়ে এমন একটি মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছি।

টানা একবছর তো স্ত্রী সন্তানের খোঁজ নেওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিলে। আবার কী হলো যে খুঁজতে খুঁজতে আমার বাড়ি চলে এসেছো? যাইহোক এসেছো ভালো করেছো। সত্যটা তোমার জানা দরকার। তাই জানিয়ে দিলাম। শুধু শুধু তোমার সময় নষ্ট করিয়ে আমার লাভ নেই। যেহেতু এ জঘন্য কাজে আমি জড়িত ছিলাম না।”

সামির সাহেব থমকে গেল। যে অতীতটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল আজকে সেটা এভাবে প্রকাশ পাবে বুঝতে পারেনি। সে আকরাম সাহেবকে চিনত না। আর এটাও কখনও তার মনে আসেনি তার স্ত্রীকে কেউ কিডন্যাপ করতে পারে। কারণ তার স্ত্রীর ফোন কল, চিঠি এসব দেখে সে ভেবেই নিয়েছিল তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। স্ত্রীর শোকে পাগল হয়ে সে তার চাকুরিও হারিয়েছিল৷ টানা দু বছর সে বেকার ছিল। এরপর আবার সব ঠিক করে নেয়। সুপারিশ করে আবারও সে কাজে যুক্ত হয় ১ বছর হলো। এ ১ বছরে সে তার অতীতটা কেবল ভুলতেই চেয়েছে। কিন্তু আজকের পর তার মনে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর আর ফেলে আসা অতীতটা এমনভাবে উপস্থিত হয়েছে যে সেটা তার মন থেকে আর উঠে যাবে না৷ যে স্ত্রীকে সে এতদিন ঘৃনা করেছে আজকে সে ঘৃনার পর্দা ভেদ করে ভালোবাসা জেগে উঠেছে। স্ত্রী সন্তান বেঁচে নেই এ কথাটা তাকে ভীষণ পীড়া দিতে লাগল।

এবার সামির সাহেবের মেঘের খু/ন নিয়েও নতুন একটা বার্তা পেল। তার ধারণা বিরোধী দলেই মেঘকে খু/ন করেছে। এ খু/নকে কেন্দ্র করে আরও অনেক বড়ো বড়ো সত্য বের হবে সে ভালো করেই বুঝতে পারছে। এটা সাধারণ কোনো খু/ন না। তবে রিদি আর আমীরার মৃত্যুর সংবাদটা শুনে সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না৷ তার কপাল ঘামতে লাগল। আচমকায় সে পড়ে গেল বসা থেকে। হাত পা তার কাঁপতে লাগল। আকরাম সাহেব সামিরের অবস্থা দেখে বিস্মিত গলায় বলতে লাগল

“কী হয়েছে তোমার? শরীর ঠিক আছে? চায়ে আমি কেবল সুরাইয়াকে দিয়ে বেশি করে কালোজিরার রস করে মিশিয়েছি যাতে করে তোমার মনে ভয় হয়। প্রাণ সংশয়ে থাকো চা তেতো কেন এটা ভেবে। কিন্তু তুমি এভাবে কাঁপছো কেন? ঠিক আছো তো?”

সামির সাহেব আর কিছু বলতে পারছে না। তার কানে কেবল বাজছে “বাবা বলটা দাও না।”

বেলা ঠিক তিনটে। সামির সাহেবের হুঁশ ফিরল৷ আকরাম সাহেব পাশেই বসা। জ্ঞান ফিরতেই তাকে জিজ্ঞেস করলেন

“তুমি ঠিক আছো?”

সামির সাহেবের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। হালকা গলায় জবাব দিল

“আমি ঠিক আছি। আপনার দেওয়া তথ্যটা মেনে নিতে পারছিলাম না তাই এমনটা হয়ে গেছে। অনেকদিনের কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর আপনি দিয়ে দিলেন। না চাইতেও জীবনের অনেক বড়ো পাথরটা আপনি নামিয়ে দিয়েছেন। ”

এরপর সামির সাহেব আকরাম সাহেবের হাতটা ধরে বললেন

“আমি আপনার হাত ধরে কথা দিচ্ছি মেঘের খুনী যেই হোক আমি খুঁজে বের করে তাকে মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা করব। আমার চাকুরি চলে গেছে তাতে কী প্রফেশন তো ভুলে যাইনি।”

আকরাম সাহেব শুধু মাথা নাড়লেন। আকরাম সাহেবকে সামির বলেনি সে আবার চাকুরিতে জয়েন করেছে। সে যে মেঘের খু/নীকে বের করতে এসেছে এটা সে লুকিয়ে গিয়েছে। তবে একটা খুনকে কেন্দ্র করে এত বছরের অপ্রকাশিত রহস্য উদঘাটন হবে সে কখনও বুঝতেই পারে নি৷ নিজের ভেতরে থাকা পাথরটা যেন এতদিনে নেমে গেল। একটু হালকা লাগছে তার সে সাথে হারানোর বিষাদও তাকে ঘিরে ধরেছে।

আকরাম সাহেব সামির সাহেবকে হালকা গলায় বললেন

“তোমার যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকতে পারো। তোমার শরীর ঠিক হওয়া পর্যন্ত থাকো। তোমার যদি মনে হয় এ বিষয় নিয়ে সত্যতা যাচাই করবে করতে পারো। জুলফিকার সাহেবকে যদি শাস্তি দিতে চাও আমি সাহায্য করব। সে সাথে আমার ছেলের খু/নী বৃষ্টিকে ধরিয়ে দিতে পারলে তুমি যা চাও তাই দিব।”

সামির সাহেব নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলেন

“বৃষ্টিকেই কেন আপনার সন্দেহ হচ্ছে? অন্য কেউ ও তো এ কাজ করতে পারে। আপনার অন্য কোনো প্রতিপক্ষও তো এ কাজ করতে পারে। জুলফিকার সাহেবও তো এ কাজে জড়িত থাকতে পারে। একা একা মেয়ে মানুষ একটা ছেলে মানুষের বডিকে কীভাবে ফ্যানে ঝুলাতে পারবে? শক্তিরও তো একটা ব্যাপার আছে। আপনি কী নিশ্চিত বৃষ্টিই এ কাজ করেছে?”

আকরাম সাহেব বেশ জোর গলায় বলল

“আমি নিশ্চিত। কারণ সিসিটিভি ফুটেজেও কিছু আলামত পাওয়া গেছে। বৃষ্টি খু/ন করেছে এর পেছনে অনেক প্রমাণ আছে। আর জুলফিকারের এত বড়ো কলিজা হয়নি আমার কলিজায় হাত দিবে। সে জানে আমার কলিজায় হাত দিলে তার অস্তিত্ব থাকবে না। বৃষ্টি আমার ব্যাপারে জানে কম। তাই রাগের মাথায় এ কাজটি করেছে। সে মেঘকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে হয়তো সহ্য করতে পারবে না ভেবেই এ কাজটি করেছে। অতিরিক্ত ভালোবাসা যে হুমকিস্বরূপ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বৃষ্টি। আমরা যে কী হারিয়েছি আমরা জানি। প্রথমবার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বৃষ্টিই পরিবর্তন করিয়েছিল। সে যে মিয়াজ সাহেবের সাথে কথা বলেছে এটার প্রমাণও আছে”

সামির সাহেব কথার মাঝে বলে উঠলেন

“মিয়াজ সাহেব কে?”

“যে মেঘের ময়না তদন্ত রিপোর্ট করেছিল প্রথমবা। সে আপাতত জেলে আছে। এরপর আমাদের নির্দেশে আবার তদন্ত করে সঠিক তথ্য বের করা হয়। সবকিছুর ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট বৃষ্টিই আমার ছেলেকে খুন করেছে।”

সামির সাহেব আকরাম সাহেবকে অনুরোধের সুরে বললেন

“আমাকে কী সিসি টিভি ফুটেজগুলো দেখানো যাবে?”

আকরাম সাহেব হালকা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন

“আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

কিছুক্ষণ পরেই আকরাম সাহেব সিসিটিভি ফুটেজের ডকুমেন্টস সহ ল্যাপটপ পাঠিয়ে দিল সামির সাহেবের কাছে। এবার সামির সাহেব কিছু ফুটেজ চেক করে নিজেই দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে গেল। সত্য আর মিথ্যার ফাঁরাক যেন খুব কাছাকাছি। মনে হচ্ছে ১ সেকেন্ডের একটু ব্যবধানে সত্য মিথ্যা পাল্টে গিয়েছে। সে কোনটাকে প্রাধান্য দিবে নিজেও বুঝতে পারছে না। সিসিটিভি ফুটেজে বৃষ্টির কিছু অসংলগ্ন আচরণ সামির সাহেবকে বেশ দ্বিধায় ফেলে দিল। কারণ