#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব-৭
#শারমিন আঁচল নিপা
বৃষ্টির সবচেয়ে কাছের বন্ধু তুরাগ বৃষ্টির নামে মামলা করার ইন্দন দিয়েছে মেঘের পরিবারকে। তুরাগ জানিয়েছে মেঘ আত্মহত্যা করেনি বরং তাকে খুন করা হয়েছে। তাকে খুন করতে সে স্বচক্ষে দেখেছে। মেঘ যেদিন খুন হয়েছে সে রাতে বৃষ্টি মেঘের বাড়িতে গিয়েছিল এটা তুরাগ নিশ্চিত করেছে। এবং প্রমাণও করেছে। তুরাগের এমন কান্ড দেখে বৃষ্টি একটু রেগে গিয়ে বলল
“আমার উপর ভিত্তিহীন অভিযোগ চাপানো হচ্ছে। এটা সত্যি আমি মেঘের বাড়ির দিকে গিয়েছিলাম। আমার জ্ঞান হারানোর পর রাত ১২ টায় প্রথমবার আমার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই আমি মেঘকে কল দিচ্ছিলাম। মেঘের ফোনে কল দিয়ে বারবার আমি বন্ধ পাচ্ছিলাম। আমার জ্ঞান ফেরার বিষয়টা যেন কেউ জানতে না পারে সেজন্য আমি লুকিয়ে মেঘের বাড়িতে গিয়েছিলাম মেঘের সাথে কথা বলতে। মেঘকে জিজ্ঞেস করতে কেন সে এমনটা করেছে৷ আর এটাও বলতে তাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগছে৷ কারণ আমার ধারণা ছিল আমি তার সামনে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি আর মেঘের সাথে দেখা করতে পারিনি। দারোয়ান গেইট আটকে ঘুমিয়েছিল। আর দেয়াল টপকানোর চেষ্টাও আমি করেছিলাম৷ তবে শরীর দুর্বল হওয়ায় সেটা আমি পারিনি৷ আমি বেশ ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি। তার মানে এই না তো আমি তাকে খু/ন করেছি। আর আপনিই তো বলেছেন মেঘ খুন হয়েছে রাত তিনটে তে। আমি গিয়েছিলাম রাত ১২ টা তে। তাহলে মেঘকে আমি কীভাবে খু/ন করেছি? আমি সেখান থেকে আসার পর নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। বিছানায় হেলান দিয়ে আমি পুনরায় জ্ঞান হারায়। এজন্য আমার মাথা থেকে সব চলে গিয়েছিল। এ বিষয়টা আমি আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম। এতকিছু ঘটছে যে কী রেখে কী বলব সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি কেন মেঘকে খু/ন করব বলুন?”
অফিসার মাহির নম্র গলায় জবাব দিল
“মেঘকে খু/ন করার কারণ তো একটা আছেই৷ আপনার বিয়েটা সে ভেঙে দিয়েছিল। সেটা আপনি মানতে পারেননি বলেই খুন করেছেন। শুধু এটাই না, আপনি প্রথম থেকে এত বড়ো বিষয়টা কী করে লুকিয়ে গেছেন? আর প্রথম ময়না তদন্তের রিপোর্ট ভুল এসেছিল৷ ভুল বললে ভুল হবে আরেকটি লা/শের সাথে সেটা বদলে গিয়েছিল৷ এরপর তুরাগের কথায় আপনাকে সন্দেহ করে যখন মামলা করা হলো তখন পুনরায় ময়না তদন্ত করা হলো। আর সেখানে স্পষ্ট এসেছে মেঘ খু/ন হয়েছে রাত ১২ টা থেকে ১ টার মধ্যে৷ আর আপনার ভাষ্যমতে আপনি নিজেই স্বীকার করেছেন আপনি সেখানে ছিলেন৷ তাহলে তো সব মিলে এটাই প্রমাণ হলো আপনি খু/ন করেছেন। তবে আমি এখন প্রমাণে যাব না৷ আপনার নামে মা/র্ডার মামলা করা হয়েছে সেজন্য আপনাকে এরেস্ট করা আমার দায়িত্ব।”
বৃষ্টির মা এসব শুনে অফিসার মাহিরকে হাত জরো করে বললেন
“বাবা প্লিজ ওকে ধরে নিয়ে যেও না। এমন কাজ ও জীবনেও করবে না। সামান্য রক্ত দেখলেই ও অজ্ঞান হয়ে যায়। সেখানে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে খু/ন করে ফেলবে এটা অসম্ভব। ওর মেঘকে পাগলের মতো ভালো বাসে। তাহলে ও কেন মেঘকে খুন করবে?”
অফিসার মাহির বৃষ্টির মায়ের এ কথা শুনে সাথে সাথে বলে উঠল
“আর এ পাগলের মতো ভালোবাসায় উন্মাদনা বাড়িয়ে ক্রাইম করতে সাহস জুগিয়েছে।”
বৃষ্টির মা কথার প্রেক্ষিতে হাত জোর করে কেঁদে বললেন
“ওকে ধরে নিয়ে গেলে কলঙ্কিত হয়ে যাবে ও। কেউ ওকে বিয়ে করবে না। বাবা আমার আরেকটা মেয়ে আছে। সে মেয়ের জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে। প্লিজ ওকে নিয়ে যেও না৷ এটা মিথ্যা একটা মামলায় ওকে ফাঁসানো হচ্ছে।”
তবে অফিসার মাহির এসব কথা শুনতে বাধ্য নয়। দায়িত্ব পালনে সে সর্বদা তৎপর। আইরিন এবং মীরা সাহাকে সে বললেন বৃষ্টিকে ধরে আনতে। তারা অফিসার মাহিরের কথা মতোই কাজ করল। বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার হাতে হাত কড়া পরানো হলো। পাগলের মতো ভালোবাসলে বুঝি এভাবেই প্রতিদান পেতে হয় সেটাই সে ভাবতে লাগল। তাকে ধরে টেনে নিয়ে দাঁড় করাল। এরপর টানতে টানতে কেবিন থেকে বের করতে লাগল। বৃষ্টির মা মেঝেতে বসে চিৎকার করে কান্না করে বলছিল আমার মেয়েকে নিয়ে যাবেন না। বৃষ্টি শেষবার শুধু তার মায়ের কান্নার দৃশ্যটা অবলোকন করল। মেঝেতে বসে তার মা হাহাকার করছে। এ হাহাকার তার মনের গহীনে দাগ কাটে ভীষণভাবে। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করল। তার সাথে করে আসা সকল অন্যায়ের বদলা সে নিবে। ভালোবাসা যেমন মানুষকে নমনীয় করে তেমনি ভালোবাসা মানুষের উন্মদনা বাড়িয়ে দেয়৷ ভালোবাসায় মানুষকে হিংস্র পশু করে তুলে। ভালোবাসার জন্য মানুষ মরতেও পারে মারতেও পারে৷
বৃষ্টিকে জেল খানায় নিয়ে গেল। জেলের কুঠুরিতে বসে আছে সে। স্বামীকে হারাল। এ সময় তাকে স্বান্ত্বণা দেবার কথা। কিন্তু সবাই মিলে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। পাশ থেকে কিছু কথা তার কানে ধেয়ে আসছে। দুজন কয়েদী বলাবলি করে বলছে
“এই মেয়ে নাকি নিজের প্রেমিককে খুন করে চলে এসেছে। একটা খু/নীকে কেন যে আমাদের কক্ষে রাখল। আমরা তো এত বড়ো পাপ করেনি। এ পাপীকে কেন রাখল আমাদের সাথে।”
বৃষ্টি তাদের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। বৃষ্টির তাকানোতে কয়েদীটা বলে উঠল
“দেখ দেখ কীভাবে সাপের মতো ফুসে উঠছে।”
বৃষ্টি নিজেকে স্বাভাবিক করল। এখন যদি সে ভেঙে পড়ে আর একটু ভুল করে তাহলে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল সে করবে। সে নিজের সকল রাগ দমন করে কয়েদীদের কাছে গিয়ে বলল
“নাম কী আপনাদের? বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি। এ জেলে সবাই ক্রাইম করে ঢুকে না৷ কেউ কেউ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে যায়। তেমনি আমিও জড়িয়ে গিয়েছি। আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন। এখানে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। আর নিজেকে প্রমাণ করার জন্য হলেও আমাকে বের হতে হবে৷ ”
কয়েদীরা বৃষ্টির দিকে তাকাল। মায়াভরা চোখ দুটো তাদের বেশ কোমল করে তুলল। তারা নম্র গলায় উত্তর দিল
“আমার নাম সায়েবা, আর ওর নাম উর্মি। আমরাও এখানে এসেছি চুরি করে ধরা পড়ে। পেট চলে না কী করব? চুরি না করলে তো না খেয়ে মরতে হত। কেউ কাজ দেয় না। আর কাজ দিলেও অনেকে শরীর খুঁজে। এ দুনিয়া অনেক কঠিন। তোকে কেন ফাঁসানো হয়েছে? তোকে দেখে তো খু/নী লাগছে না। তবে এখান থেকে বের করা কষ্ট। আমাদের জামিনের ব্যবস্থা কর। তোকে আমরা বের করে দিব। আমরা ভেতরে থাকলে তোকে বের করতে পারব না। তোকে জামিন দিবে না। যেহেতু মা/র্ডারের আসামী তুই।”
বৃষ্টি সন্দেহ গলায় জবাব দিল
“আমি তোমাদের বিশ্বাস করব কীভাবে? তোমরা তো এখান থেকে বের হয়ে গেলে আমাকে সাহায্য না ও করতে পারো।”
উর্মি কিছুটা গম্ভীর গলায় বলল
“দেখ চুর হলেও নীতি ভালো আছে। আমরা বলেছি তোকে সাহায্য করব মানে করব। আমাদের গ্যাঙ আছে। তোকে এখান থেকে কোর্টে চালান দিবে। দু একদিনের মধ্যেই এ কাজটা করবে৷ আর যেদিন কোর্টে চালান দিবে সেদিন আমরা কয়েকজন মিলে দাঙা শুরু করে দিব৷ এরপর তুই সুযোগ বুঝে পালাবি। সব শিখিয়ে দিব সমস্যা নাই।”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল
“অবশ্যই মা দেখা করতে আসবে। আমি তোমাদের জামিনের ব্যবস্থা করে দিব মাকে বলে। যদি আমি বের হতে পারি আর আমার ভালোবাসার খুনীকে বের করতে পারি তোমরা যা চাইবে আমি দিব।”
সায়েবা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল
“তোর কিছু লাগবে না। আমরা চুরি করেই সব পুষিয়ে নিতে পারব। তুই শুধু বের করার ব্যবস্থা কর।”
বৃষ্টি মাথা নেড়ে এক কোণে বসলো। বুকটা ভীষণ ভারী লাগছে তার। মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে।
এদিকে বৃষ্টির মা মেঝেতেই বসে আছে। ডাক্তার আবীর বৃষ্টির মাকে এ অবস্থায় দেখে চমকে উঠল। বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল
“এভাবে বসে আছেন কেন? বৃষ্টি কোথায়?”
বৃষ্টির মা কাঁদতে কাঁদতে সব বলল। ডাক্তার আবীর থমকে গেল। বৃষ্টির মানসিক অবস্থার কথা সে জানে। এ সময়ে এত বড়ো ধাক্কা সে নিতে পারবে কি’না সেটাই ভাবছে। বৃষ্টির বাবা অনেকদিন যাবৎ অসুস্থ। প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে। এ মুহুর্তে এমন কোনো গার্ডিয়ান বৃষ্টির নেই যে বৃষ্টির পাশে দাঁড়াবে। এ অমানবিক বেদনায় এ পরিবারের প্রতি একটু মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
“আমি আমার পরিচিত উকিলের সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করছি। এরপর পাল্টা মামলা করতে হবে। প্রমাণ করতে সময় লাগবে। মার্ডারের কেইস একটু ধৈর্য ধরে হ্যান্ডেল করতে হবে। আপনি আমার সাথে চলুন।”
ডাক্তার আবীর বৃষ্টির মাকে নিয়ে প্রথমে উকিলের কাছে গেল। বৃষ্টির কেইসটা নিয়ে কথা বলছে এডভোকেট মেহতাব সাহেবের সাথে। মেহতাব সাহেব ভীষণ ভালো এবং নামকরা উকিল। তারা সেখানে বৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করছে। উকিল বৃষ্টির মাকে জানায়
“আগে সঠিক তথ্য জানতে হবে। সত্যিই আপনার মেয়ে খুন করেছে কি’না। যদি করে থাকে তাহলে আমাকে আমার মতো করে এগিয়ে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে অথবা শাস্তি কামানোর চেষ্টা করতে হবে। আর যদি খু’ন না করে তাহলে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব নির্দোষ প্রমাণের। উকিলকে কখনও মিথ্যা কথা বলবেন না।”
আবীর উকিলের কথা শুনে জবাব দিল
“আমি যতটুকু জানি বৃষ্টি এমন কিছু করেনি। তবুও ওর সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।”
এদিকে বৃষ্টি তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তার বুক ধুকধুক করছে। এর মধ্যেই জেলার বলে উঠল
“বৃষ্টি কে? এদিকে আসুন। আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।”
বৃষ্টি অনেকটা আশা নিয়ে দৌড়ে গেল। সে ভেবেছিল তার মা এসেছে। তবে সেখানে গিয়ে সে আৎঁকে উঠল এবং তার মুখও মলিন হয়ে গেল। কারণ…